০৮.রায়-নন্দিনী – অষ্টম পরিচ্ছেদঃ হেমদার ষড়যন্ত্র

অষ্টম পরিচ্ছেদঃ হেমদার ষড়যন্ত্র

মহর্‌রম নিকটবর্তী। আর সাতদিন মাত্র অবশিষ্ট। বরদাকান্তের জ্যেষ্ঠপুত্র হেমদাকান্ত কাশী হইতে বাটি ফিরিয়াছে। তাহার এক পিসী বৃদ্ধ বয়সে কাশীবাসী হইয়াছিলেন। পিসী হিমদাকে পুত্রবৎ লালন-পালন করিয়াছিলেন। পিসীর সন্তানাদি কিছুই ছিল না। হেমদাই তাঁহার সর্বস্ব। পিসীর যথেষ্ট টাকাকড়ি ছিল। সুতরাং হেমদাকান্ত বাল্যকাল হইতেই পিসী ক্ষীরদার আদরে বিলাসে উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিয়াছিল। ছোটবেলা হইতেই তাহার কোনও আব্দার বা আকাঙ্খা একদিনের জন্যও অপূর্ব থাকিত না। হেমদা তাহার পিসী ক্ষীরদার নিকটেই প্রায় থাকিত। কাশীতে গঙ্গাতটে এশটি দ্বিতল বাড়ীতে হেমদা তাহার পিসী ও স্ত্রীর সহিত বাস করিত। পিসীর নগদ প্রায় ২৫ হাজার টাকা ছিল। সে কালের এক পঁচিশ হাজার আজকালকার লাখেরও উপর। পিসী সমস্ত টাকাই লগ্নী কারবারে লাগাইয়াছেন। তাহা হইতে যে আয় হইত তাহাতেই পিসী, ও হেমদা-পত্নী কমলার স্বচ্ছন্দে খরচপত্র পোষাইত। টাকা হেমদার হস্তেই খাটিত। পিসী দিবারাত্রি তপ জপ আহ্নিক উপবাস করিয়া এবং নানা প্রকার দেবলীলা ও উৎসব দেখিয়া সময় কাটাইতেন। ক্ষীরদা-সুন্দরী সম্ভ্রান্ত হিন্দু-ঘরের আদর্শ নিষ্ঠাবতী প্রবীণা মহিলা ন্যায় ছিলেন। জীবন-সন্ধ্যার আঁধার যতই ঘনাইয়া আসিতে লাগিল, ক্ষীরদাও ততই অন্তিমের সম্বলের জন্য অধীর ও আকুল প্রাণে ধর্মকর্মেই অধিকতর লিপ্ত হইতে লাগিলেন। সংসারের সর্বস্বই হেমদা ও তাহার স্ত্রীর হাতে ছাড়িয়া দিলেন। হেমদা কয়েক বৎসরের মধ্যে টাকা খাটাইয়া পঞ্চাশ হাজার টাকার লোক হইয়া দাঁড়াইল। সে আর কয়েক বৎসরের মধ্যেই যে কাশীর মধ্যে একজন প্রথম শ্রেণীর শ্রেষ্ঠী বা ধনীতে গণ্য হইবে, ইহা সকলেই আলোচনা করিত। কিন্তু এই সময় হইতেই তাহার চরিত্র ভীষণরুপে কলুষিত হইয়া উঠিল। পূর্ব হইতেই তাহার লাম্পট্য দোষ ছিল। এক্ষণে এই লাম্পট্যের সঙ্গে মধ্যপান, দ্যূতক্রীড়া এবং পরদাগমন অভ্যস্ত হইয়া উঠিল। অগ্নিশিখা বায়ু সংযোগে আরও প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। কাশী ভারতে সত্য সত্যই এক অদ্‌ভুত স্থান। উহার অসংখ্য ক্ষুদ্র ও বৃহৎ মন্দির, অসংখ্য সুন্দর ও কুৎসিত দেবীর প্রাতঃসন্ধ্যা আরতি-অর্চনার ধর্মপিপাসু হিন্দু নরনারীর চোর, জালিয়াত, বিশেষতঃ লম্পট নরনারীর অবিরাম বীভৎস লীলায় পরিত্রাত্মা মানবমাত্রকেই ব্যথিত করে। জগতে যে সমস্ত জঘন্য লোকের অন্যত্র মাথা লুকাইবার স্থান নেই, কাশীতে তাহারা পরমানন্দে বাস করে। বহুসংখ্যক রাজ-রাজড়ার অন্নসত্র উন্মুক্ত থাকায় এই সমস্ত পাপাত্মাদিগের উদরান্নের জন্যও বড় ভাবিতে হয় না। কাশীতে প্রকৃত চরিত্রবান ভালো লোকের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। চরিত্রহীন লম্পট ও জুয়াচোরদের সংখ্যাধিক্যে এই অল্প সংখ্যক প্রকৃত নিষ্ঠাবান চরিত্রশালী লোকের অস্তিত্বে অনেক সময়েই সন্দেহের সঞ্চার করে।

সে যাহা হইক, হেমদা কাশীর ব্যভিচার-দুষ্ট বায়ুতে এবং কুসংসর্গ প্রভাবে অল্পকালের মধ্যেই একজন প্রথম শ্রেণীর গুণ্ডার মধ্যে পরিগণিত হইল। তাহার শরীরে বেশ শক্তি ছিল, সে শক্তি এক্ষণে নানা প্রকার পাশবিক এবং পেশাচিক কার্য সাধনে দিন দিন দুর্দম ও অসংযত হইয়া উঠিল। গায়ের শক্তি, হৃদয়ের সাহস, টাকার বল, সহচরদিগের নিত্য উৎসাহ এবং পাপ-বিলাসের উদ্‌ভট-চিন্তা তাহাকে একটা সাক্ষাৎ শয়তানে পরিণত করিল। অনবরত কাম-পূজায় তাহার ধর্মকর্ম-জ্ঞান লোপ পাইল। মদের নেশা তাহাকে আরও গভীর পঙ্কে নিক্ষেপ করিল। শেষে মদ্য-সেবা এবং কাম-পূজাই তাহার জীবনের একমাত্র কর্তব্য হইয়া উঠিল। অবশেষে বামাচারী তান্ত্রিক-সম্প্রদায়ের এক কাপালিক হস্তে সে তন্ত্রে মন্ত্রে দীতি হইয়া পাপে দ্বিধাশূন্যও নির্ভীক হইয়া পড়িল।

হেমদা বামাচারী-সম্প্রদায়ে দীতি হইবার কিছু পরেই সাদুল্লাপুরে প্রায় দুই বৎসর পরে বাড়ী ফিরিল। আত্মীয়-স্বজন সকলেই তাহার আগমনে পরমানন্দিত হইল। সে কাশী হইতে বাড়ী ফিরিবার সময়ে নানা প্রকার সুন্দর সুন্দর অলঙ্কার, ছেলেদের খেলনা, বানারসী শাড়ী, চাদর, পাথরের নানাপ্রকার দ্রব্য ও মূর্তি, জরীর কাঁচুলী সকলকে উপহার দিবার জন্য আনিয়াছিল। হেমদা বাড়ীতে আসিয়াই দেখিতে পাইল যে, উদি্‌ভন্ন-যৌবনা প্রদীপ্তকান্তি স্বর্ণময়ী তাহাদের বাড়ী আলোকিত করিয়া বিরাজ করিতেছে। স্বর্ণময়ীকে দেখিয়া সে চমৎকৃত, মুগ্ধ এবং লুব্ধ হইয়া গেল। সে কাশীতে নানাদেশীয় অনেক সুন্দরী দেখিয়াছে এবং নিজে অনেক সুন্দরীর সর্বনাশও করিয়াছে, কিন্তু তাহার মনে হইল স্বর্ণময়ীর ন্যায় কোন সুন্দরী কদাপি নেত্রপথবর্তী হয় নাই। স্বর্ণময়ী যে এরূপ রসমতী, লীলাবতী, রূপবতী এবং লোভনীয় মোহনীয় সুন্দরীতে পরিণত হইয়াছে, তাহা দেখিয়া তাহার প্রাণ যেন অপার্থিব আনন্দে পূর্ণ এবং মগ্ন হইয়া গেল। কাশী ত্যাগ করিতে তাহার যে কষ্ট হইয়াছিল। এক্ষণে তদপেক্ষা শতগুণ আনন্দ হইয়া গেল। কাশী ত্যাগ করিতে তাহার যে কষ্ট হইয়াছিল, এক্ষণে তদপো শতগুণ আনন্দ তাহার প্রাণে সমুদিত হইল। সে নিজেকে পরম সৌভাগ্যশালী বলিয়া মনে করিল। পিশাচের হৃদয় পৈশাচিত ঘৃণিত বাসনায় চঞ্চল হইয়া উঠিল। সে সর্বোৎকৃষ্ট শাড়ী, চাদর, চুড়ি, পুতুল ও পাথরের একপ্রস্থ বসন স্বর্ণময়ীকে উপহার দিল। সরল-প্রাণা বিমল-চিত্ত স্বর্ণ ভ্রাতার উপহার বলিয়া প্রাণের সহিত গ্রহণ করিল। কিন্তু দুই তিন দিনের মধ্যেই হেমদার কুৎসিত হাবভাবে, সকাম-পিপাসু দৃষ্টিতে স্বর্ণ একটু সঙ্কুচিত এবং লজ্জিতা হইল। হেমদার প্রতি তাহার একটু ঘৃণারও উদ্রেক হইল। পাপিষ্ঠ হেমদা নানা ছলে স্বর্ণময়ীর গৃহে প্রবেশ করিয়া নানারূপে তাহা মনোহরণের চেষ্টা করিলেও স্বর্ণময়ী অঢ়ল অটল রহিল।

হেমদা যতই তাহাকে ধর্মভ্রষ্ট করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল, স্বর্ণময়ী ততই তাহাকে ঘৃণার চক্ষে দেখিতে লাগিল। হেমদার চেষ্টা বিফল হইতে লাগিল, ততই তাহার হৃদয়ের পাপ-লিপ্সা বলবতী হইতে লাগিল। তাহার আগ্রহ ও যত্ন বাড়িয়াই চলিল। মেঘ-বিহারিণী চঞ্চলা সৌদামিনী যেমন ময়ূরকে বিমুগ্ধ এবং উন্মুত্ত করে, বৈদ্যুতিক শুভ্র আলোকে যেমন শলভকে আত্মহারা ও আকৃষ্ট করে, বংশীধ্বনির মধুরতা যেমন মগৃকে জ্ঞানশূন্য করে, রায়-নন্দিনীর ভরা যৌবনের উচ্ছ্বসিত রূপতরঙ্গও তেমনি হেমদাকান্তকে উন্মত্ত ও অশান্ত করিয়া তুলিল।

হেমদা কাশী হইতে আসিবার সময় তাহার দীক্ষাগুরু অভিরাম স্বামীও সঙ্গে আসিয়াছিল। অভিরাম স্বামী সন্ন্যাসীর মত গৈরিকবাস পরিধান এবং সর্বদা কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা ধারণ করিত। বাহুতে ও গলায় রুদ্রামালা, শিরে দীর্ঘকেশ, কিন্তু জটাবদ্ধ নহে। এতদ্ব্যতীত তাহার সন্ন্যাসের বাহ্যিক বা আভ্যন্তরিক কোনও লক্ষণ ছিল না। সে সর্বদাই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং মন্তকে প্রচুর তৈল মর্দন করিত। তাহার শরীর মাংসল, মসৃণ, স্থুল এবং পেশীবণ্ডল। সে অসুরের মত ভোজ করিত। সকালে তাহার জন্য দুই সের লুচি, এক সের মোহনভোগ ও অন্যান্য ফলমূল বরাদ্ধ ছিল। দ্বিপ্রহরে অর্ধ সের চাউলের ভাত, এক পোয়া ঘৃত, এক সের পরিমিত মাছ এবং দুই সের মাংস এবং অন্যান্য মিষ্টান্ন প্রায় দুই সের, সর্বশুদ্ধ ছয় সের ভোজ্যজাত তাহার উদর-গহবরে স্থান পাইত। অপরাহ্নে দেড় সের ঘন ক্ষীর তাহার জলখাবার সেবায় লাগিত। রাত্রে রুটি ও মাংসে প্রায় পাঁচ সেরে তাহার ুন্নিবৃত্তি হইত। তাহার ভোজন, আচরণ ও ব্যবহারে সন্ন্যাসের নামগন্ধও ছিল না। মদ্য সর্বদাই চলিত। তাহার চেহারা ও নয়নের কুটিলতা তীব্রভাবে লক্ষ্য করিলে সে যে একটি প্রচ্ছন্ন শয়তান তাহা তীক্ষ্ণবুদ্ধি লোকে বুঝিতে পারিত। কিন্তু তাহার গৈরিক বাস, দীর্ঘকেশভার এবং রক্ত-চন্দনের ফোঁটা হিন্দু-সমাজে তাহাকে সম্ভ্রমের সহিত সন্ন্যাসীর আসন প্রদান করিয়াছিল। তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর নামে অনেকে ‘ইতঃ নষ্ট ততঃ ভ্রষ্টের’ দল, শিষ্য ও চেলারূপে স্বামীজীবর পাদ-সেবায় লাগিয়া গেল। স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে কবচ লইবারও ধুম পড়িয়া গেল। বশীকরণ, উঢ়াটন, মারণ প্রভৃতির মন্ত্র-প্রণালী ও ছিটেফোঁটা কত লোকে শিখিতে লাগিল। শিষ্যদিগের আধ্যাত্মিক উন্নতির মধ্যে ধান্যেশ্বরীর সেবা খুব চলিল। সেকালের ইসলামীয় শাসনে মদ্য কোথায়ও ক্রয় করিতে পাওয়া যাইত না। এখনকার মত ব্রাণ্ডি, শ্যাম্পেন, শেরী, কোরেট প্রভূতি বোতলবাহিনীর অস্তিত্ব ছিল না। কোনও মুসলমান মদ্যপান করিলে কাজী সাহেব তাহাকে কষাঘাতে পিঠ ফাটাইয়া দিতেন। হিন্দুর মধ্যে কেহ মদ খাইয়া মাতলামী করিলেও কষাঘাতে পিঠ ফাটিয়া যাইত। কাজেই বড় শহরেও মদের দুর্গন্ধ, মাতালের পৈশাচিত লীলা কদাপি অনুভূত ও দৃষ্ট হইত না। হিন্দুদের মধ্যে বাড়ীতে অতি নিভৃতে ধান্যেশ্বরী নামক দেশী মদ প্রস্তুত করিয়া কেহ কেহ সেবন করিত। ইসলামীয় সভ্যতার অনুকরণে হিন্দু সমাজেও মদ্যপান ও শূকর-মাংস ভণ অত্যন্ত গর্হিত এবং ঘৃণিত বলিয়া বিবেচিত হইত।”

স্বামীজির আগমনে আর কিছু উপকার হউক আর না হউক, অনেক হিন্দু যুবকই বাড়ীতেই বকযন্ত্রে মদ চোঁয়াইতে লাগিল। স্বামীজি হেমদাকান্তের বিশেষ অনুরোধে পড়িয়া সাদুল্লাপুরে আসিয়াছিল। দুইদিন থাকিবার কথা, কিন্তু আজ পাঁচদিন অতীত হইতে চলিল, তথাপি স্বামীজির মুখে যাইবার কথাটি নাই। ইহার কারণ আর কিছুই নহে, কেবল রায়নন্দিনী। হায় যুবতীর সৌন্দর্য! তুমি এ জগতে কতই না অনর্থ ঘাঁইয়াছ! তুমি স্বর্গের অমূল্য সম্পদ হইলেও কামুক ও পিশাচের দল তোমাকে কামোন্মত্তার তীব্র সুরা মধ্যে গণ্য করিয়াছে। তুমি একদিকে যেমন পূর্ণিমার জ্যোৎস্না-বিধৌত রমনীয় কুসুমোদ্যান সৃষ্টি করিতেছ, অন্যদিকে তেমনি পূতিগন্ধপুরিত অতি বীভৎস শ্মানানেরও সৃষ্টি করিতেছ। কেহ কেহ তোমার ধ্যান করিয়া ফেরেশতা প্রকৃতি লাভ করিতেছে বটে, কিন্তু অনেকেই নরকের কামকীটে পরিণত হইতেছে।

পেটুক বালক রসগোল্লা দেখিলে তাহার মুখে যেমন লালা ঝরে, গর্ভিনী তেঁতুল দেখিলে তাহার জিহবায় যেমন জল আইসে, তীব্র তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি বরফ দেখিলে যেমন তল্লাভে অধীর হইয়া উঠে, বহুমূল্য মণি দেখিলে তস্কর যেমন আকুল হইয়া পড়ে, আমাদের অভিরাম স্বামী মহাশয়ও তেমনি নবযুবতী অতুল রূপবতী নির্মল রসবতী শ্রীমতি রায়-নন্দিনীকে দেখিয়া একেবারে ভিজিয়া গলিয়া গেলেন। পাষণ্ডের পাপলিস্পা যেন ফেনাইয়া ফুলিয়া উঠিল। শিষ্য এবং গুরু উভয়ে যুগপৎ রায়-নন্দিনীর জন্য দিবস-যামিনী চিন্তা করিতে লাগিল। হেমদার কু-মতলব স্বর্ণ বেশ বুঝিতে পারিয়াছিল, কিন্তু অভিরাম স্বামীর “মনের বাসনা” স্বর্ণ দূরে থাকুক, হেমদাও বুঝিতে পারে নাই। বলা বাহুল্য, শিষ্য অপেক্ষা গুরু চিরদিনই পাকা থাকে। সুতরাং এখানেই বা তাহার ব্যতিক্রম হইবে কেন?

হেমদা কয়েক দিনেই বুঝিতে পারিল যে, স্বর্ণকে দূষিত করা সহজ নহে। স্বর্ণ প্রথম প্রথম পূর্বের ন্যায় ভাই-বোন ভাবে তাহার পাশে বসিত, কিন্তু পরে আর তাহার পাশে বসা দূরে থাকুক, তাহার সম্মুখেও বাহির হইত না। এমনকি, তাহাকে দাদা বলিয়া সম্বোধন করাও পরিত্যাগ করিল। স্বর্ণ এক্ষণে মহররমের দিন গণিতে লাগিল। কারণ মহররমের পরের দিবসই তাহাকে পিত্রালয়ে লইবার জন্য লোক আসিবে।

যত শীঘ্র হেমদার কলুষদৃষ্টি ও ঘৃণিত সঙ্কল্প-দুষ্ট বাটি হইতে নির্গত হইতে পারে ততই মঙ্গল! কয়েক দিবসের মধ্যেই স্বর্ণ যেন বড়ই স্ফুর্তিহীনতা বোধ করিতে লাগিল। ঈসা খাঁর পত্র পাইয়া স্বর্ণ অনেকটা প্রফুল্ল ও আনন্দিত হইয়াছিল। কিন্তু পাপাত্মা হেমদাকান্তের ঘৃণিত ব্যবহারে বড়ই অসুখ বোধ করিতে লাগিল। একবার তাহার মামীর কাছে হেমদার ঘৃণিত সংকল্প ও পাপ-প্রস্তাবের কথা বলিয়া দিবার জন্য ইচ্ছা করিত; কিন্তু তাহাতে বিপরীত ফল ফলিতে পারে এবং তাহার নামেও হেমদা মিথ্যা কুৎসা আরোপ করিয়া বিষম কলঙ্ক সৃষ্টি করিতে পারে, এই আশঙ্কায় তাহা হইতে নিবৃত্ত হইল। ভাবিল, আর তিনটা দিন কাটিয়া গেলেই রক্ষা পাই। হেমদাও স্বর্ণময়ীর পিত্রালয়ে যাইবার দিন আসন্ন দেখিয়া অস্থির হইয়া উঠিল। সে এবং তাহার গুরুদেব যত প্রকার তন্ত্রমন্ত্র এবং ছিটেফোঁটা জানিত, তাহার কোনটিই বাকী রাখিল না। গুরুদেব অভিরাম স্বামী হেমদার প্রতি গভীর সহানুভূতি দেখাইতে লাগিল। অভিরাম স্বামী নিজে স্বর্ণময়ীর যৌবনে মুগ্ধচিত্ত না হইলে এরূপ ভয়ানক এবং নিতান্ত জঘন্য কার্যের সংকল্প হয়ত লোক-লজ্জার জন্যও অনুমোদন করিত না। কিন্তু সে জানিত যে, হেমদার ভাগ্যে শিকা ছিঁড়িতে সে নিজেও দুগ্ধভাণ্ডে জিহবা লেহন করিবার সুবিধা পাইবে।

দিন চলিয়া যাইতেছে-স্বর্ণময়ী হস্তচ্যুত হইতে চলিল দেখিয়া গুরুদেবও বিশেষ চিন্তিত হইল। অবশেষে তন্ত্রের বিশেষ একটি বশীকরণ মন্ত্র সারা দিবারাত্রি জাগিয়া লবার জপ করতঃ একটি পান শক্তিপূত করিল। এই পান স্বর্ণকে স্বহস্তে সেবন করাইতে পারিলেই হেমদাকান্তের বাসনা পূর্ণ হইবে বলিয়া স্বামীজি দৃঢ়তার সহিত মত প্রকাশ করিলেন, পানের রস গলাধঃকরণ মাত্রই স্বর্ণময়ী হেমদার বশীভূতা হইবে।

পাপাত্মা হেমদাকান্ত এই পান পাইয়া পরম আহলাদিত হইল। এক্ষণে এই পান স্বর্ণকে কিরূপে খাইয়াইবে তাহাই হেমদার চিন্তার বিষয়ীভূত হইল। সন্ন্যাসী যখন পান দিল, তখন সন্ধ্যা। স্বর্ণ তখন অন্যান্য বহু স্ত্রীলোকের মধ্যে বসিয়া গল্প করিতেছিল, সুতরাং তাহাকে পান দিবার জন্য দুবৃত্তের মনে সাহস হইল না।

অতঃপর কিছু রাত্রি হইলে হেমদা সকলের অসাক্ষাতে স্বর্ণময়ীর গৃহে নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়া পালঙ্কের আড়ালে বসিয়া রহিল। স্বর্ণময়ী আহারান্তে গৃহে আসিয়া দ্বার বন্ধ করতঃ শয়ন করিবার পরে পাপাত্মা মৃদুমন্দ হাস্যে স্বর্ণের নিকটে উপস্থিত হইল। স্বর্ণ সহসা তাহাকে গৃহ মধ্যে দর্শন করিয়া-পথিমধ্যে দংশনোদ্যত ফণী দর্শনে পথিকের ন্যায় বিচলিতা হইয়া চীৎকার করিবার উপক্রম করিল। পাপাত্মা তদ্দর্শনে অতীব বিনীতভাবে দুই হস্ত জোড় করিয়া বলিল, “স্বর্ণ! আমি কোন মন্দ অভিপ্রায়ে আসি নাই। তুমি যাতে চিরকাল সুস্থ থাক, সেই জন্য সন্ন্যাসী-ঠাকুর এই মন্ত্রপূত-পান দিয়েছেন; এটা তোমাকে খেতে হবে।”

স্বর্ণঃ তুমি এখনই গৃহ থেকে নির্গত হও। নতুবা বিপদ ঘটবে, ও পান সন্ন্যাসীকে খেতে বল। আমি ও পান কিছুতেই খাব না!

স্বর্ণের দৃঢ়তা দেখিয়া হেমদা দুই হস্তে স্বর্ণের পা জড়াইয়া ধরিয়া তাহাকে পান খাইবার জন্য অনুরোধ করিতে লাগিল। স্বর্ণ তাহার এই বিসদৃশ ব্যবহারে নিতান্ত কুপিত হইয়া সজোরে তাহার বক্ষে পদাঘাত পূর্বক দ্বার খুলিয়া তাহার ছোট মামীর গৃহের দিকে চলিয়া গেল। সহসা স্বর্ণের সবল পদাঘাতে পাপিষ্ঠ কামাদ্ধ হেমদাকান্ত একেবারে ঘরের মেঝেতে চিৎ হইয়া পড়িল। বুকে পদাঘাত এবং মস্তকে পাকা মেঝের শক্ত আঘাত পাইল। কিন্তু এ আঘাত অপেক্ষা তাহার মানসিক আঘাত সর্বাপেক্ষা অসহ্য হইয়া উঠিল। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল, যেরূপেই হউক স্বর্ণের সর্বনাশ সাধন করিবেই।

হেমদা নিতান্ত দুঃখিত ক্ষুদ্ধু ও উত্তেজিতভাবে সমস্তই গুরুদেবের নিকট নিবেদন করিল। অতঃপর পরামর্শ হইল যে, মহররমের দিবস স্বর্ণকে নৌকাপথে হরণ করিয়া একেবারে কাশী লইয়া যাইতে হইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *