০৭.রায়-নন্দিনী – সপ্তম পরিচ্ছেঃ মনোহরপুরে

সপ্তম পরিচ্ছেঃ মনোহরপুরে

মাহতাব খাঁ রাগে ও ঘৃণায় নগর হইতে নৌকা ছাড়িলেন। তাঁহার মনে হইতেছিল যত শীঘ্র যশোরের এলাকার বাহিরে যাইতে পারেন, ততই মঙ্গল। যশোরের বায়ুমণ্ডল যেন তাঁহার কাছে বিষাক্ত বলিয়া ক্রোধ হইতেছিল। বিশেষতঃ প্রতাপাদিত্যের লোকজন আসিয়া অনায়াসেই তাঁহাকে আবদ্ধ করিতে পারে। তিনি বীরপুরুষ হইলেও একাকী কি করিতে পারেন! তাঁহাকে ধরিতে পারিলে প্রতাপাদিত্য যে হাত-পা বাঁধিয়া জ্বলন্ত চিতায় দগ্ধ করিবেন, সে-বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। সুতরাং তিনি মাল্লাদিগকে খুব দ্রুত নৌকা বাহিতে আদেশ করিলেন। খাঁ সাহেব যে প্রতাপাদিত্যের রাজ্য ত্যাগ করিয়া যাইতেছেন, মাঝি-মাল্লারা অবশ্য তাহা জাতিন না। তাহাদের জানিবার কথাও ছিল না। তাহারা জানিলে অবশ্য আসিত না। কারণ এইরূপ কার্যে প্রতাপাদিত্যে যে তাহাদের শরীরের চর্ম ছাড়াইয়া তাহাতে লবণ মাখিয়া দিবেন, তাহা তাহারা বেশ জানিত। সেনাপতি কোন দরকারবশতঃ মনোহরপুরে যাইতেছেন বলিয়া মাঝিরা বিশ্বাস করিতেছিল।

মাহতাব খাঁ মনোহরপুরে পঁহুছিতেই প্রায় সন্ধ্যা হইল। মনোহরপুরে প্রতাপাদিত্যের একখানা বাড়ী ও একটি কাছারি ছিল। এতদ্ব্যতীত সেখানে গোলা ও হাটবাজার দস্তরমত ছিল। কাছারিতে ১০ জন তবকী অর্থাৎ বন্দুকধারী, ২৫ জন লাঠিয়াল, একজন জমাদার, একজন নায়েব এবং অন্যান্য কর্মচারী ১০/১২ জন ছিল। প্রতাপাদিত্যের স্ত্রীর সংখ্যা চল্লিশেরও উপর ছিল এতদ্ব্যতীত উপপত্নীও যথেষ্ঠ ছিল। মনোহরপুরে চতুর্থ রাণী দুর্গাবতী বাস করিতেছেন। তিনি পূর্বে যশোরের প্রাসাদের অধিবাসিনী ছিলেন। কিন্তু ক্রমে সন্তানাদি হওয়ায় তাঁহার যৌবনে, ভাঁটা ধরিলে প্রতাপাদিত্যের মন-মধুকর যখন দুর্গাবতীকে কিঞ্চিৎ নীরস বলিয়া মনে করিল, তখন মনোহরপুরের ক্ষুদ্র বাটীতে তাঁহাকে সরাইবার ব্যবস্থা হইল। তদ্ব্যতীত প্রতাপাদিত্য আরও একটি কারণে দুর্গাবতীকে নির্বাসিত করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। দুর্গাবতী অত্যন্ত মুখরা ছিলেন, একবার রাগিয়া গেলে তাঁহার জিহবার বাক্যানলে সকলকেই দগ্ধ হইতে হইত। তাঁহার জিহবা সর্বতোভাবে নিঃশঙ্ক ও নিঃসঙ্কোচ ছিল। তাঁহার তীব্র সমালোচনা এবং বিদ্রুপ-বাণে প্রাসাদবাসিনী অন্যান্য রাণীরা অস্থির থাকিতেন। তিনি প্রতাপাদিত্যকেও অতি সামান্যই গ্রাহ্য করিতেন। দুর্গাবতী তাঁহার পরবর্তী রাণীদিগকে আপনার ক্রীতদাসী অপেক্ষাও তাচ্ছিল্য করিতেন। প্রতাপাদিত্য অবশেষে এই দারুণ সঙ্কট হইতে মুক্ত হইবার জন্য তাঁহাকে মনোহরপুরে নির্বাসিত করিয়াছিলেন।

দুর্গাবতী মনোহরপুরে আসিয়া প্রাসাদের নিত্য ব্যভিচার, অত্যাচার ও হত্যা-দূষিত বিষাক্ত বায়ু হইতে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছিলেন। প্রতাপাদিত্য বৎসরের কোনও সময় এদিকে আসিলে দুর্গাবতীর মন্দিরে অবশ্যই পদধূলি পড়িত। নতুবা তাঁহাকে একপ্রকার বৈধব্য জীবনই কাটাইতে হইত। এই দুর্গাবতীর সময়েই মাহতাব খাঁ যশোরের রাজপুরীতে প্রবেশ এবং নিজের বীরত্ব ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়া প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন। সে আজ দশ বৎসরের কথা। যশোরের অন্তঃপুরে তখন দুর্গাবতীর একাধিপত্য। দুর্গাবতীর যৌবনের সুবর্ণ-শঙ্খলে প্রতাপাদিত্য তখন দুশ্চেদ্যভাবে পোষা কুকুরের ন্যায় বাঁধা ছিলেন। দুর্গাবতী মুখরা ও আধিপত্যপ্রিয়া হইলেও অত্যন্ত বদান্যা ও উদার-প্রকৃতি ছিলেন। লোকের গুণানুকীর্তনে সর্বদাই তাঁহাকে মুক্তকণ্ঠ দেখা যাইত। প্রতাপের কুৎসিৎ ব্যবহারই পরে তাঁহাকে মুখরা করিয়া তুলিয়াছিল। মাহতাব খাঁ রাণীর সৌভাগ্যের দিনে রাণীর হস্ত ও মুখ হইতে অনেক আর্থিক পুরস্কার ও বাচনিক প্রশংসা পাইয়াছিলেন বলিয়া রাণীকে তিনি মাতৃবৎ শ্রদ্ধা করিতেন। রাণীও মাহতাবকে পুত্রবৎ স্নেহের চক্ষে দেখিতেন। রাণীর মনোহরপুর নির্বাসনে এবং তাঁহার আধিপত্য চ্যুতিতে সর্বাপেক্ষা যদি কেহ দুঃখিত হইয়া থাকেন, তবে সে মাহতাব খাঁ। রাণীর একটি কন্যা এবং একটি পুত্র। কন্যার বয়স অষ্টাদশ বৎসর, নাম অরুণাবতী। পুত্র শিশু, পঞ্চম বৎসর মাত্র বয়ঃক্রম। নাম অরুণকুমার। অরুণাবতী পূর্ণ যুবতী। ভাদ্রের ভরা গাঙ্গ, কূলে কূলে রূপ উছলিয়া পড়িতেছে। বক্ষে বক্ষে প্রেমের তরঙ্গ আকুল উচ্ছ্বাসে আবর্ত সৃষ্টি করিয়াছে। চোখে মুখে প্রেমের বিদ্যুদ্দীপ্তি স্ফুরিত হইতেছে। প্রাণের পিপাসা বাড়িতে বাড়িতে এখন যেন উহা বিশ্ব-বিমোষিণী মূর্তি পরিগ্রহ করিতেছে। সুপক্ক আঙ্গুর বা রসাল আম্র যেমন বৃক্ষ-পক্ক হইলে ফাট ফাট হইয়া পড়ে, অরুণাবতীও তেমনি রসবতী হইয়া ফাট ফাট প্রায়। তাহার হৃষ্ট-পুষ্ট সবল ও সুডৌল দেহে যৌবন পূর্ণ প্রতাপে রাজত্ব বিস্তার করিয়াছে। তাহাকে দেখিলেই মনে হয় যে, রমণী বহু কষ্টে বহু সাধনায় যৌবনের প্রতাপ ও প্রভাকে আয়ত্ত রাখিতে সমর্থ হইয়াছে। যেন চন্দ্রমার সূর্বণ কৌমুদীজাল বিস্নাত ভাদ্রের সফেনতোয়া স্রোতস্বতী কূলে কূলে পূর্ণ হইয়া ফুলিয়া ফাঁপিয়া হেলিয়া দুলিয়া আবর্ত রচিয়া কল কল ছল ছল করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। এত বয়স এবং এত রূপের গৌরব থাকা সত্ত্বে অরুণাবতীর বিবাহ হয় নাই। বিবাহ না হইবার কারণ পাত্র না জোটা। গৌরব থাকা সত্ত্বে অরুণাবতীর বিবাহ হয় নাই। বিবাহ না হইবার কারণ পাত্র না জোটা। পাত্র না জুটিবার কারণ প্রতাপাদিত্যের নিদারুণ নৃশংস পৈশাচিক ব্যবহার। কথাটা একটু খুলিয়াই বলিতেছি। ইতঃপূর্বে প্রতাপ তাঁহার জ্যেষ্ঠ কন্যা শ্রীমতী বিভাবতীয় বিবাহ বাকলা চন্দ্রদ্বীপাধিপতি রামচন্দ্র রায়ের সহিত সম্পন্ন করিয়াছেন। এই রামচন্দ্র রায়ের রাজ্য অধিকার করিবার জন্য প্রতাপের নিদ্রাকর্ষণ হইত না। কিন্তু রামচন্দ্র রায় জীবিত থাকিতে বিনাযুদ্ধে রাজ্য অধিকার করা অসম্ভব। যুদ্ধ করিলে প্রতাপই জিতিবেন, তাহারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? রামচন্দ্র রায় বারভূঁইয়ার এক ভূঁইয়া ছিলেন। বিশেষতঃ তাঁহারই পল্টনে পর্তুগীজ ও ওলন্দাজ সেনা ছিল। তাহাদের তোপের জন্য প্রতাপাদিত্য ভীত ছিলেন। অগত্যা প্রতাপাদিত্য, জামাতাকে কোন পর্ব উপলক্ষে বিশেষ সমাদার ও ধূম-ধামের সহিত একদা নিমন্ত্রণ করিলেন। রামচন্দ্র রায় শ্বশুরের নিমন্ত্রণ পাইয়া পরমাহলাদে যশোরের রাজপুরীতে আগমন করিলেন। প্রতাপাদিত্য গভীর নিশীথকালে জামাতা রামচন্দ্র রায়কে উপাংশু-বধ করিবার জন্য সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া রাখিলেন। নরাধম পাষণ্ড একবারের জন্যও উদ্ভিন্ন-যৌবনা কন্যার ভবিষ্যৎ পযর্ন্ত চিন্তা করিলেন না। কন্যা সেই নিদারুণ লোহমর্ষণ ঘটনার আভাস পাইয়া স্বামীকে সমস্ত নিবেদন করিল। রামচন্দ্র রায় রাত্রিযোগে কৌশলক্রমে প্রতাপাদিত্যের পুরী হইতে প্রাণ লইয়া কোনও রুপে পলায়ন করিলেন।” এই ঘটনার পরে কোনও রাজা কি জমিদার প্রতাপাদিত্যের সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হইতে চাহিতেন না। এ-দিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কেহই সাহস করিয়া সুন্দরবনের ভীষণ ব্যাঘ্রের ন্যায় নররক্ত-লোলুপ প্রতাপের কন্যা বিবাহের প্রস্তাব করিবারও সাহস করিত না। প্রতাপত্ত গর্ব-অহঙ্কারে রাজা ব্যতীত আর কাহাকেও কন্যা সম্প্রদানের কল্পনাও করিতেন না। কিন্তু এদিকে কন্যার দেহে যখন যৌবন-জোয়ার খরতার বেগে বহিতে লাগিল, তখন প্রতাপাদিত্য নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে মাহতাব খাঁর করে অরুণাবতীকে সমর্পনের বাসনা করিলেন। কারণ মাহতাব খাঁ অপেক্ষা উচ্চদরের পাত্র আর জুটিতেছিল না। কিন্তু মাহতাব খাঁকে সাধিয়া কন্যা দান করিতে প্রতাপের ইচ্ছা ছিল না। কোনও ঘটনা উপলক্ষ্ করিয়াই তাঁহাকে কন্যাদানের সংকল্প করিলেন। ঘটনাও জুটিয়া উঠিল। পাঠকগণ পূর্বেই তাহা অবগত হইয়াছিল। কিন্তু প্রতাপের দুর্ভাগ্যবশতঃ খাঁ সাহেব স্বর্ণময়ী-হরণে সম্মত হইলেন না।

সে যাহা হউক, মাহতাব খাঁ প্রতাপাদিত্যের রাজ্য হইতে চিরবিদায় লইবার পূর্বে পথে মনোহরপুরে অবতরণ করিয়া মাতৃতুল্য রাণী দুর্গাবতীর আশীর্বাদ লইয়া চিরবিদায় গ্রহণ করাই সঙ্গত মনে করিলেন। অরুণাবতীকে তিনি ভালোবাসিতেন, কিন্তু সে ভালোবাসায় প্রেমের নেশা প্রবেশ করে নাই। খাঁ সাহেব ঘাটে নৌকা লাগাইয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। প্রহরী তাঁহাকে চিনিত ও জানিত। রাণী দুর্গাবতী মাহতাব খাঁকে দেখিয়া আনন্দে পরম পুলকিত হইলেন। মাহতাব খাঁ জলযোগের আয়োজন দেখিয়া রাণীকে বলিলেন, “মা! আমার আর জলযোগের সময় নেই। আমাকে এখনই মহারাজের এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে। যদি বেঁচে থাকি এবং খোদার মর্জী সুদিন পাই, তখন আবার শ্রীচরণে উপস্থিত হব।” এই বলিয়া রাজার সমস্ত ব্যবহার দুঃখার্ত চিত্তে বর্ণনা করিলেন। শুনিয়া রাণীর চক্ষু হইতে জলধারা বহিতে লাগিল। ঘটনা শুনিয়া এবং প্রতাপের ক্রোধের কথা ভাবিয়া দুর্গাবতীর প্রাণ যেন শুকাইয়া গেল। রাণী সত্য সত্যই মাহতাব খাঁকে পুত্রের ন্যায় ভালোবাসিতেন। তারপর অরুণাবতীর বিবাহের আশাভরসাও যে মাহতাব খাঁর সঙ্গে শূন্যে মিশাইবে, ইহা ভাবিয়া রাণীর মুখ শুকাইয়া গেল। বুকের পঞ্জর যেন ধ্বসিয়া যাইতে লাগিল! রাণী ক্রন্দনের উচ্ছ্বাস রোধ অনেকেই থাকে, যারা অতীব তীব্র সন্তাপেও লোকের সম্মুখে কাঁদিতে পারে না। রাণীও সেই প্রকৃতির ছিলেন। তিনি উঠিয়া অন্য ঘরে গেলেন। সেই নির্জন গৃহে যাইয়া তাঁহার রুদ্ধপ্রাণের উচ্ছ্বাস একেবারে গুমরিয়া উঠিল। রাণী কাঁদিতে লাগিলেন। বাস্তবিক রাণী যুগপৎ পুত্র-লোক ও কন্যা-শোকে অভিভূত হইয়া পড়িলেন। এদিকে অরুণাবতী নানা প্রকার মিষ্টান্ন এবং ফলমূলে স্বর্ণমালা ও রৌপ্যবাটি সাজাইয়া মাহতাব খাঁর সম্মুখে উপস্থিত করিল। মাহতাব খাঁ প্রায় দুই বৎসর পরে অরুণাবতীকে দেখিলেন। দেখিয়া একেবারে বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। খাঁ সাহেব যেন সহসা এক স্বপ্নাতীত রাজ্যে উপনীত হইলেন; তিনি দেখিলেন, অরুণাবতীর সর্বাঙ্গ আশাতীতরুপে পরিপুষ্ট। সমস্ত শরীরে যৌবন উত্থলিয়া পড়িতেছে। কৃতজ্ঞতার ডাগর আঁখিতটে শত শত বিদ্যুৎ ক্রীড়া করিতেছে। দেহলতিকা, জ্যোৎস্নাফুল্ল রজনীগন্ধার ন্যায় ফুটিয়া গর্বভরে বৃন্তের উপর ঈষৎ হেলিত অবস্থায় যেন দণ্ডায়মানা। অরুণাবতী যদিও পূর্বে শত শতবার মাহতাব খাঁকে দেখিয়াছে, তাঁহার ক্রোড়ে উঠিয়াছে, তাঁহার সহিত কতদিন নদীতটে ভ্রমণ করিয়াছে, কিন্তু আজ সে মাহতাব খাঁকে যেমন অপূর্ব সুন্দর সুঠাম রমণীয় কান্তি লোভনীয় পুরুষরুপে দেখিতেছে, পূর্বে সে কখনও তেমনটি দেখে নাই। মাহতাব খাঁই যে তাহার প্রেম-দেবতা হইবেন, তাহার পাণিতেই যে পাণি মিশাইতে হইবে, অরুণাবতী তাহা নানা সূত্রেই বেশ ভাল করিয়া শুনিয়াছিল এবং সেই সূত্রে অরুণাবতীর হৃদয় মাহতাব খাঁর দেখিতেছিল-তখন খাঁ সাহেব যে তাহার চক্ষে অদ্বিতীয় পুরুষত্ব বলিয়া প্রতিভাত হইবেন, তাহাতে আর আশ্চর্য কি? প্রেম যখন অসুন্দরকে সুন্দর করে-মরুকে উদ্যানে পরিণত করে-অগ্নিকে তুষার,-নীরসকে সরস এবং অপবিত্রকে পবিত্র করে, তখন স্বাভাবিক সুন্দর খাঁ সাহেব অপার্থিব সুন্দর বলিয়া অরুণাবতীর চক্ষে প্রতিভাত হইবেন তাহাতে আর সন্দেহ কি? ঊষার দৃষ্টি যেমন আকাশকে অরুণিমাজালে বিভূষিত করে-বসন্ত যেমন বিগতশ্রী উদ্যানকে স্বর্গীয় শ্রীমণ্ডিত ফুল্লফুলদলে বিশোভিত করে, রজনী যেমন আঁধার আকাশে তারকামালা ফুটাইয়া অপার্থিব সৌন্দর্য প্রদর্শন করে-প্রেমও তেমনি প্রেমাস্পদকে অলৌকিক সৌন্দর্য, অসাধারণ গুণ এবং অপার্থিব মহিমায় বিভূষিত, বিমণ্ডিত এবং বিশোভিত করে। মাহতাব খাঁ খাইতে খাইতে এক একবার অরুণাবতীর দিকে চাহিতেছেন, অরুণাবতী তাহার ত্রিভুবন-মোহিনী দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরাইতেছে। লজ্জা-রাগে তাহার বদনমণ্ডল আরক্ত হইয়া যাইতেছে। আবার মাহতাব খাঁ নত আঁখিতে আহারে রত হওয়া মাত্রই, অরুণাবতীর চঞ্চল ও পিপাসাতুর আঁখি তাহার মুখে দৃষ্টি স্থাপন করিতেছে। আবার আঁখিতে আঁখিতে আঁখি পড়া মাত্রই দৃষ্টি অন্য বিষয়ে পতিত হইতেছে এবং হৃদয় ফুটিতেছে, শরীর শিহরিত হইতেছে, মন দুলিতেছে। প্রাণের তীব্র চৌম্বক আকর্ষণ উভয়ের হৃদয়কে এত জোরে টানিতেছে যে, বোধ হয় উভয়ের হৃদয় দুইটি শরীর ভেদ করিয়া এই মুহুর্তেই বাহির হইয়া আসিবে। সেনাপতি নিজের সঙ্কটজনক অবস্থা ভাবিয়া বীরের মত আত্মসংযম করিবার চেষ্টা করিলেন। অতি সামান্য নাশতা করিয়াই হাত ধুইতে উদ্যত হইলে, অরুণাবতী লজ্জার বাঁধ ভাঙ্গিয়া রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, “সে কি!” এই বলিয়া মাহতাব খাঁর হস্ত ধারণ করিয়া বলিল, “সব খেতে হবে।” যুবতীর স্নেহমাখা সুকোমল করস্পর্শে মাহতাব খাঁর সর্বাঙ্গে যেন কি এক অপার্থিব পুলক-প্রবাহ প্রবাহিত হইল। সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত এবং হৃদয়ের প্রত্যেক বিন্দু সুধাধারায় সিক্ত হইল। মাহতাব খাঁ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ছলছল নেত্রে তাঁহার বিপদের কথা বর্ণনা করিলেন। শুনিয়া যুবতীর বুক অতি বিষম বেগে স্পন্দিত হইয়া থামিয়া গেল। যুবতী বাকশূন্য স্পন্দনহীন মৃন্ময়ী প্রতিমার ন্যায় দণ্ডায়মানা। অরুণাবতীর দুই চক্ষে অশ্রুর ঝরণা ছুটিল। প্রতাপ-কুমারীর ইচ্ছা হইতেছিল যে, সে একবার ছিন্ন লতিকার ন্যায় মাহতাব খাঁর চরণমূলে পতিত হইয়া দুই হস্তে তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া প্রাণ ভরিয়া ক্রন্দন করে। কিন্তু লজ্জা আসিয়া তাহাতে বাদ সাধিল। যুবতী অবশেষে থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। পাছে বা পড়িয়া যায় এই ভাবিয়া মাহতাব খাঁ দ্রুত উঠিয়া তাহাকে ধরিলেন। প্রিয়তমের উভয় বাণ্ডস্পর্শে যুবতীর শরীরের প্রতি অনুপরমাণুতে যে প্রেমের তীব্র উচ্ছ্বাস হইল, তাহাতে যুবতী ক্ষণকালের জন্য আত্মসম্বরণে অসমর্থ হইয়া বিহবলা হইয়া পড়িল। মাহতাব খাঁ তাহাকে মূর্ছিত মনে করিয়া তাহার মস্তক নিজ ক্রোড়ে স্থাপনপূর্বক পাখা দ্বারা বাতাস করিতে লাগিলেন। খাঁ সাহেব মহাবিপদ গণিয়া দুর্গাবতীকে ব্যস্তকণ্ঠে ৩/৪ বার “রাণী মা! রাণী মা!” বলিয়া আহবান করিতেই রাণী অঞ্চলে চক্ষু মুছিয়া ত্বরিতপদে তথায় উপস্থিত হইলেন। চোখে-মুখে কয়েকবার শীতল জলের ঝাপটা দিলে অরুণাবতীর চেতনা হইল। সে আপনাকে তদবস্থায় দেখিয়া লজ্জায় সমস্ত বদনমণ্ডল আরক্ত করিয়া অবগুণ্ঠন টানিয়া দূরে সরিয়া বসিল। রাণী সমস্তই বুঝিতে পারিলেন। ইহা যে মূর্ছা নহে, নিদারুণ সকাম প্রেমাবেশ, তাহা বুঝিয়া কন্যার মানসিক অবস্থার শোচনীয়তা স্মরণে নিতান্তই কিষ্ট ও ব্যথিত হইলেন। তিনি ভাবিলেন, পরস্পরের চুম্বনেই এ-ঘটনা ঘটিয়াছে।

রাত্রি অধিক হয় দেখিয়া মাহতাব খাঁ দুর্গাবতীর নিকট নিত্যন্ত বিনীত ও কাতরভাবে বিদায় প্রার্থনা করিলেন। রাণী কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “বাবা! আর্শীবাদ করি নিরাপদ, দীর্ঘজীবন লাভ কর। এ রাক্ষসের রাজ্য ছেড়ে যাওয়াই ভাল। কিন্তু বাবা! আমার অরুণাবতীর কি উপায় হবে?” রাণী আর কিছু বলিতে পারিলেন না, কাঁদিতে লাগিলেন। মাহতাব খাঁর প্রাণেও অসীম বেদনা। সে স্থান ত্যাগ করিতে তাঁহার পা যেন অগ্রসর হইতেছিল না। তাঁহার হৃদয় ও চক্ষু সমস্তই অরুণাবতীতে ডুবিয়া মজিয়া গিয়াছিল। বহু কষ্টে ধৈর্য ধারণা স্থান পরিত্যাগে উদ্যত হইয়াছিলেন। কিন্তু রাণীর কথায় হৃদয় যেন সেখানেই বসিয়া পড়িল। মনে হইল, অরুণাবতীকে ছাড়িয়া কিছুতেই যাইব না, যা’ হইবার তা’ হউক। আবার ভাবিলেন, এখানে থাকিবই বা কোথায়? আমার জন্য অরুণাবতীও শেষে কি প্রতাপের রোষানলে দগ্ধ হইবে! মাহতাব খাঁ বজ্রাহতের ন্যায় বহুক্ষণ পর্যন্ত নীরবে দাঁড়াইয়া থাকিলেন। তিনি এমন দুর্বলতা জীবনে কখনও উপলব্ধি করেন নাই। আজ তিনি দেখিলেন, হৃদয় প্রেম-সুরায় উন্মুক্ত হইয়া তাহাকে প্রশান্ত করা ভীষণ অসম যুদ্ধে জয়লাভ করা অপেক্ষাও শত কঠিন।

“অরুণাবতীর কি উপায় হবে?” এ-প্রশ্নের উত্তর কি দিবেন? তাহা কিছুই ঠিক করিতে পারিতেছিলেন না। এইরূপে প্রায় অর্ধ ঘন্টা অতীত হইল, এমন সময় দূর আকাশের কোণে গুড় গুড় করিয়া মেঘ ডাকায় মাহতাব খাঁর চটকা ভাঙ্গিল। বহু কষ্টে ও যত্নে হৃদয় বাঁধিয়া তিনি বলিলেন “মা! আমি জীবনে কখনও অরুণাবতীকে ভুলব না। সুদিন হ’লে অরুণাকে বিয়ে করব। অরুণা ব্যতীত কা’কেও বিয়ে করব না। মা! আমি এখন পথের কাঙ্গাল। সঙ্গে পঞ্চাশটি মাত্র টাকা আছে। ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে ফেলবে জানি না। মা! আমি বাল্যকালেই পিতৃমাতৃহীন। জোষ্ঠ ভ্রাতা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। তিনি এখন এলাহাবাদের বাদশাহী দুর্গের অধ্যক্ষ। আমি দশ বৎসর চাকুরী করে যে-অর্থ সঞ্চিত করেছি, তা’ সবই মহারাজের নিকট গচ্ছিত। সে বিপুল অর্থ পেলে আমি অবশিষ্ট জীবন সুখে কাটাতে পারতাম। কিন্তু ঘটনা যা’ ঘটেছে, তা’তে অতি শীঘ্র রাজ্য ছাড়তে না পারলে প্রাণ পর্যন্ত হারাতে হবে। হয়ত এতক্ষণ আমাকে ধরবার জন্য রণতরী অর্ধপথে এসে উপস্থিত হয়েছে।”

রাণী মাহতাব খাঁর অর্থাভাবে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া তাড়াতাড়ি একশত মোহরের একটি মোড়ক এবং নিজের হস্তের একটি হীরাকাঙ্গুরী উন্মোচনপূর্বক খাঁর করে অর্পণ করিয়া কহিলেন, “বৎস! আর বিলম্ব করো না। সত্বর প্রস্থান কর। পরমেশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, তাঁর হস্তে তোমাকে সমর্পণ করলাম। বড় বিপদ! সত্বর প্রস্থান কর।” রাণীকে অভিবাদপূর্বক আর্শীবাদ গ্রহণ করিয়া মাহতাব খাঁ দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন। ঘাটে যাইয়া তাড়াতাড়ি নৌকা খুলিয়া দিলে মাল্লারা দ্রুত দাঁড় ফেলিতে লাগিল।

“বাবা! আমার অরুণাবতীর কি হবে?” রাণী দুর্গাবতীর এ কথায় অরুণাবতীর শোকসিন্ধু উত্থলিয়া উঠিল। সে নিজের হৃদয়কে বহু প্রবোধিত করিল কিন্ত কিছুতেই তাহা প্রবোধিত হইল না। সে স্পষ্ট বুঝিল, তাহার মন ঘড়ির ন্যায় টক টক করিয়া তাহাকে বলিল, “মাহতাব খাঁ আর এ রাজ্যে ফিরিবে না, ফিরিতে পারে না। তোমার কপাল চিরদিনের জন্য পুড়ে গেল।”

অরুণাবতী গৃহে আসিয়া বাত্যাহাত লতিকায় ন্যায় উত্তপ্ত সৈকত-নিপ্তি শফরীর ন্যায় বিছানায় পড়িয়া ছঁফট করিয়া কাঁদিতে লাগিল। সে মাহতাব খাঁকে যতই ভুলিতে চেষ্টা করিল, ততই তাহার পক্ষে মাহতাব খাঁর বিরহ অসহ্য হইতে অসহ্যতর, অসহ্যতম হইয়া উঠিল। মুহুর্তের মধ্যে অরুণাবতী উন্মাদিনীর ন্যায় তাহার গহনার হস্তিদন্ত নির্মিত ক্ষুদ্র পেটিকা লইয়া সকলের অজ্ঞাতসারে বাটীর পশ্চাৎভাগের খিড়কী-দ্বার উদ্‌ঘাটনপূর্বক প্রেমাস্পদের উদ্দেশ্য ধাবিত হইল।

নৌকা তখন ঘাটি ছাড়িয়া কয়েক রশি দূরে চলিয়া গিয়াছে। অন্ধকারের মধ্যে শুধু বাতি দেখা যাইতেছে। নদী তীর নির্জন। অরুণাবতী বহুদিন নদীতটে পরিভ্রমণ করিয়াছে। সে তাহার গন্তব্যপথে রুদ্ধশ্বাসে দ্রুত ধাবিত হইল এবং অল্প সময়ের মধ্যে নৌকার নিকটবর্তী হইয়া নৌকা কূলে ভিড়াইতে বলিল। মাহতাব খাঁ বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়া অরুণাবতীকে গৃহে ফিরিবার জন্য পুনঃ পুনঃ বিনীত অনুরোধ করিতে লাগিলেন। মাঝিরা নৌকা কূলে ভিড়াইতেছিল, কিন্তু মাহতাব খাঁর নিষেধে পুনরায় ছাড়িয়া দিবার উপক্রম করিল। অরুণাবতী তখন জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া সাঁতরাইয়া নৌকা ধরিতে অগ্রসর হইল। মাহতাব খাঁ আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া অরুণাবতীকে মুহুর্ত মধ্যে কিসতীতে টানিয়া তুলিলেন। বলা বাণ্ডল্য, অরুণাবতী জলে পড়ায় কোন কষ্ট পায় নাই। কারণ, প্রত্যহ সে নদীর জলে স্নান করিত বলিয়া ভাল সাঁতার জানিত। উভয়ের সিক্ত বস্ত্র পরিবর্তন করা আবশ্যক হইল। অরুণাবতীর বস্ত্র লইয়া মাহতাব খাঁকে বিপদে পড়িতে হইল। অরুণাবতী আসিবার কালে কেবল গহনার বাক্সই আনিয়াছিল। অতিরিক্ত কাপড় আনিবার বিষয় চিন্তাও করে নাই। মাহতাব খাঁও ধুতি পরিতেন না। সুতরাং সিক্ত শাড়ী পরিবর্তন করিয়া অরুণা কি পারিবে, তাহাই চিন্তায় বিষয় হইল। এদিকে অরুণাবতী পশ্চাৎ দ্বার দিয়া নির্গত হইবা মাত্রই দ্বারের শব্দে রাণী গৃহ হইতে বহির্গত হন। তিনি বাহির হইয়াই তরল আঁধারে বেশ দেখিলেন যে, অরুণাবতী গহনার বাক্স হস্তে নৌকার উদ্দেশে ধাবিত হইলেন। কিন্ত কন্যাকে পলায়ন করিতে দেখিয়া কিছুমাত্র দুঃখিত না হইয়া বরং কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইলেন। কারণ তিনি কন্যার ভীষণ প্রেমোন্মাদের লক্ষণ দেখিয়া তাঁহার জীবন সম্বন্ধে আকুল হইয়া পড়িয়াছিলেন। রাণী তাড়াতাড়ি গৃহে ফিরিয়া নিজের কিছু গহনা, দুইশত মোহর এবং কয়েকখানি কাপড় লইয়া অরুণাবতীর পশ্চাতে ছুটিলেন। তিনি পৌঁছিতে পৌঁছিতেই মাহতাব খাঁ সুন্দরীকে জল হইতে নৌকায় তুলিলেন এবং অরুণার বস্ত্র পরিবর্তনের মহাসমস্যায় পতিত হইয়া অবশেষে বাক্স হইতে নিজের অপ্রশস্ত রেশমী পাগড়ী বাহির করিয়া তাহাকে পরিধানের জন্য দিতেছিলেন, ঠিক এমন সময়েই রাণী তট হইতে আহবান করিলেন। দুর্গাবতীর আহবানে অরুণার হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল। মাহতাব খাঁও লজ্জিত হইলেন। রাণী নৌকা লাগাইতে বলায় অরুণার ভয় হইল, পাছে বা তাহাকে ছিনাইয়া বাটি লইয়া যায়। অরুণা বলিল, “মা! নৌকা আর লাগাব না, আমি যখন ভেসেছি, তখন ভাসতে দাও।” রাণী অরুণার প্রাণের ব্যথা বুঝিয়া বলিলেন, “মা, তুই কলঙ্কিনী নস। তুই-ই প্রকৃত সতী। মা! আমি তোর গমনে বাধা দিব না। আমি গমনের সুবিধা করে দিবার জন্যই এসেছি। কাপড় ও টাকা এনেছি, নিয়া যা।”

নৌকা কূলে লাগিল। রাণী মোহর, গহনা ও কাপড় দিয়া আশীর্বাদ করিয়া বলিলেনঃ “ধাজ আমি তোমাদেরকে অকূলে ভাসালাম, কিন্তু বিধাতা শীঘ্রই তোমাদেরকে কূল দিবেন।” রাণী এই বলিয়া নৌকা ছাড়িয়া দিতে বলিলেন। রাণী বাড়ী ফিরিতে ফিরিতে এক এশবার সাশ্রুনেত্রে পশ্চাৎ ফিরিয়া নৌকা দেখিতে লাগিলেন। শেষে আর নৌকা দেখা গেল না। কেবল প্রদীপের আলো দেখা যাইতে লাগিল। অবশেষে নৌকা বাঁক ফিরিলে তাহাও অন্তর্হিত হইল। রাণী নিঃশব্দে বাটি ফিরিলেন। প্রাঙ্গণে পদার্পন করিয়া বুঝিলেন-বাড়ী যেন শূন্য শূন্য বোধ হইতেছে। প্রকৃতি যেন উদাস প্রাণে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিতেছে। রাণী রুদ্ধশ্বাসে গৃহে প্রবেশ করতঃ বিছানায় পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *