2 of 2

হঠাৎ বৃষ্টিতে

হঠাৎ বৃষ্টিতে

আকাশ মেঘলাই ছিল। হঠাৎ দূরে ঝাপসা হয়ে বৃষ্টি এল। বৃষ্টি আসছে, ক্রমশই এগিয়ে আসছে হু হু করে। আমরা দুজনে ছুটতে ছুটতে একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় আশ্রয় নিলাম প্রথমে। জানি ভীষণ জোরে বৃষ্টি এলে মাথা বাঁচবে না; কিন্তু এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। ফোর্টের পাশে এই ফাঁকা মাঠে আর কোনও আশ্রয় আছে! সামনে গেরুয়া গঙ্গা। একটা দুটো মাঝারি জাহাজ বৃষ্টিতে ভিজছে। দূরে পাকিস্তান থেকে ধরে আনা প্যাটনের লোহার চাদরের উপর চটাপট বৃষ্টির ফোঁটা ছিটকোচ্ছে। দুপুরে সাধারণত এদিকে তোক খুব কমই আসে। গ্রীষ্মের দুপুরে কে আর শখ করে বেড়াতে আসে ফাঁকা মাঠে। আমরা দুজনে এসেছিলাম মেঘলা দেখে। মেঘ থমকানো দুপুরে ভরা গঙ্গা, জেটি আর জাহাজকে এক পাশে রেখে হাতে হাত ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে মেরিন হাউসের দিকে যেতে চেয়েছিলাম। একটা দুটো বাস, কি মোটর হুসহুস করে চলে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। এখন বৃষ্টি আমাদের আটকে দিয়েছে। দুটো পাখির মতো জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছি গাছতলায়। গায়ে গুড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির ছাঁট লাগছে। বেশ বুঝতে পারছি মাথার উপর পাতার আবরণ আর বেশিক্ষণ আমাদের বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। কল্পনা ইতিমধ্যে মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়েছে। নীল শাড়ি জড়ানো তার বাইশ বছরের শরীর এখন আমার খুব কাছে। আমি তাকে কোমরের কাছে জড়িয়ে ধরে প্রায় বুকের পাশে টেনে এনেছি। মনে হচ্ছে অনেক দূরের একটা ছবি বৃষ্টির দূরবিনে খুব কাছে এসে গেছে সেই সেদিনের ছবি, যেদিন কল্পনা আমার বউ হবে।

আপাতত অনেক বছর আমাদের এমনি করে মাঝে মাঝে বাড়ি পালিয়ে শহরের এই সব প্রান্তসীমায় এমনি সব অদ্ভুত সময়ে চলে আসতে হবে, কারণ চলে না এসে পারব না। একটা চিঠি লেখা কি দূর থেকে দেখে একটু মুচকি হাসার পর্যায় আমরা অনেক আগেই পেরিয়ে

এসেছি। আমাদের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি হয়েই গেছে, যেদিন একটা চাকরি পাব, ঠিক তার একমাস পরেই বিয়ে করব। কোনও ঘটা-টটা নয়। নিতান্তই সাদামাটা নিম্ন মধ্যবিত্তের বিয়ে। সানাই নয়, ভোজ নয়, তবে হ্যাঁ, হিন্দুমতে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে অগ্নি সাক্ষী করে। বিয়ে। কল্পনার দীর্ঘ শরীর বেনারসীর আবরণে সেদিন কেমন দেখাবে যেদিন আমরা গাঁটছড়া বেঁধে সাতপাক ঘুরব। কল্পনার দিকে আড়চোখে চেয়ে আমার মনে হল, এখন যেমন দেখছি, এতটা স্নিগ্ধ নয় আর একটুদীপ্ত, কারণ উপোস আর হোমের আগুনে সেদিন তার মধ্যে একটা অন্য দীপ্তি আসবে! দৃশ্যটা চিন্তা করে তখনই একটা ইচ্ছে হল। ডান হাতটা তখন কল্পনার। কোমরের উপর একফালি অনাবৃত মসৃণ জায়গার উপর খেলা করছিল। আমি তাকে আর একটু কাছে টেনে এনে তার গালে একটা চুমু খেলাম। বৃষ্টি ভরা সেই ফাঁকা মাঠে ঝাঁকড়া গাছের তলায় ভেজা ভেজা কপোত-কপোতীর মতো আমরা দুজনে দাঁড়িয়ে। জলের ঝাপটা আর পশ্চিমের হু হু হাওয়ায় আমাদের শীত করছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে আমরা একটু আশ্রয় খুঁজছিলাম মনে মনে। যতটা সম্ভব ঘনিষ্ঠ হয়ে একে অন্যকে বৃষ্টির ছাঁট থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিলুম। যদিও ব্যাপারটা ছিল খুব দুঃসাধ্য।

ইতিমধ্যে মনে হল বৃষ্টিটা যেন হঠাৎ একটু কমে গেল। যেন কোনও এক অদৃশ্য প্রান্তে জলের সুতো ছিঁড়ে গিয়ে একটু ফাঁক পড়ে গেল। এই সুযোগে ছুট ছুট করে আমরা দুজনে প্রিনস অফ ওয়েলসের জন্যে কোনও এক সময়ে তৈরি মেমোরিয়ালের তলায় আশ্রয় নিলাম। কল্পনার। শাড়ির নীচের দিকটা ভিজে সপসপে হয়ে গিয়েছিল। ছুটতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল। শাড়িতে, সায়াতে সপ সপ শব্দ। মনে আছে কল্পনা খুব হাসছিল। তার চটি পা থেকে। খুলে বেরিয়ে যাচ্ছিল, মেয়েরা যে কেন বৃষ্টিতে ভিজে এত আনন্দ পায়!

গোটাকতক বিশাল স্তম্ভের উপর একটা ছাদ। চারদিক ফাঁকা, মাথাটাই কেবল আবরণে ঢাকা। ভিতরে কয়েকটা সবার-আসন পাতা। জায়গাটাকে আগে কখনও এত ভালো করে দেখার সুযোগ হয়নি। এ জায়গাটা প্রায়ই বিশেষ একধরনের লোকের দখলে থাকে। আজ আর এত ভাবলে চলে না। কে ভিজবে গাছতলায়। আকাশের অবস্থাও বিশেষ ভালো নয়। চারদিক ঝাপসা যেন মধ্যাহ্ন আঁধার। আজ অবশ্য বেশি লোক ছিল না। বেশি বলি কেন আদৌ কোনও লোক ছিল না। আমি আর কল্পনা। একটা কুকুর তার একরাশ ছানাপোনা। ঢুকতে না ঢুকতেই আবার বৃষ্টি এল। এবার আরও জোরে। সঙ্গে এলোমেলো প্রচণ্ড হাওয়া।

শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে কল্পনা বলল, যাক আর ভয় নেই, এবার শালা কত বৃষ্টি আসবি আয়।

কল্পনা খুব খুশি থাকলে মাঝে মাঝে শালা বলে।

তুমি তো একদম ভিজে গেছ। এক কাজ করো না, এখানে তো কেউ কোথাও নেই, শাড়িটা খুলে এসো আমি একটা দিক ধরি, তুমি একটা দিক ধরো লম্বা করে। যা হাওয়া এক্ষুনি শুকিয়ে যাবে।

যাঃ কী যে বলো তুমি, একেবারে ছেলেমানুষ। চারদিক উদোম খোলা। আমি এখানে সায়া আর ব্লাউজ পরে শাড়ি খুলে শুকোব। হিন্দি ছবি পেয়েছ না!

হিন্দি ছবিরই তো বিষয়বস্তু আমাদের এই দুজনের বেরোনো, এই স্ট্যান্ডে ঘুরে বেড়ানো। এখন এই শাড়ির দৃশ্যটা জুড়ে এসো ডুয়েট গাই—হাওয়া মে উড়তা যায় মেরে লাল দুপাট্টা মলমল।

উঃ কত দিনকার গান। তোমার মনে আছে। নার্গিস, রাজকাপুর। কথাটি বলেই কল্পনা হাত দুটো মাথার উপর তুলে একটা নাচের ভঙ্গি করল। দৃশ্যটা এত দুর্লভ মনে হল মুহূর্তটাকে মুক্তো করে হাতে রাখি। পকেটে তোয়ালে রুমাল ছিল তাই দিয়ে কল্পনার ঘাড়ের গলার বুকের কাছের জল মুছিয়ে দিলাম। মেয়েরা শুধু সেবা করে না, মাঝে মাঝে একটু সেবা পেতে চায়। সেই। সময়টা ওরা কীরকম আদুরে বেড়ালের মতো হয়ে যায়, কেবল ঘর্ঘর শব্দটাই করে না, বাকি সব এক।

চলো না বসি ওই খালি বেঞ্চিটায়—ঝেড়েঝুড়ে।

চলো।

গঙ্গার দিকে মুখ করে দুজনে বসলাম পাশাপাশি। বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না, ঝাপসা হয়ে আছে। ওপার মাঝে মাঝে পরিষ্কার হচ্ছে, আবার বৃষ্টির আঁচলে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কল্পনার ঘাড়ের কাছে গালটা রাখলুম, জলে ভিজে হাওয়ার ঝাপটায় কী সুন্দর ঠান্ডা হয়েছে, যেন পাথরের বাঁধানো বেদি। ঠিক বুকের কাছ থেকে একটা মৃদু, দেহের উত্তাপ মেশানো সুন্দর গন্ধ উঠছে। এই বয়েসের মেয়েদের কারুর কারুর নাভির কাছে মৃগনাভি থাকে না কি?

শব্দটা প্রথমে কল্পনারই কানে এল! বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে সে ঠিকই শুনেছে মৃদু হলেও বোঝা যায় স্পষ্ট কে যেন ফিশফিশ করে বলছে—জল জল।

কে বলো তো। কে যেন জল চাইছে। কোথাও কাউকে দেখছি না।

চলো উঠে দেখি। কে জল চাইছে।

ভিতরে কোথাও কেউ নেই। আওয়াজটা আসছে পশ্চিম দিক থেকে। কল্পনাই প্রথম দেখল। লোকটি মধ্যবয়সি। চেহারা বেশ ভালোই। একটা হাত বুকের কাছে। নিজের গায়ের জামাটা সেই হাতে জড়ানো, রক্তে লাল হয়ে গেছে। আঘাতটা ঠিক কোথায়—মাথায় না বুকে বোঝা গেল না। মাথাটা একটা উঁচু ধাপের উপর। চোখ দুটো ফুলে গেছে, ভিতরের সাদা অংশ অল্প বেরিয়ে আছে, ঠোঁট দুটো মাঝে মাঝে নাড়ছে—জল, জল।

কল্পনা আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি কল্পনাকে প্রশ্ন না করলেও দুজনের মুখেই এক কথা লেখা কী ব্যাপার, ব্যাপার কী?

মার্ডার নয় তো? চলো পালাই। শেষে হাঙ্গামায় জড়িয়ে যেতে হবে। পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।

কী যে বলো না। একটা লোক এই অবস্থায় জল চাইছে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ। তাকে ফেলে রেখে যাবে। আমাদের একটা কর্তব্য নেই!

জল পাব কোথায় এখানে! গঙ্গায় অনেক জল কিন্তু আনবে কী করে? হঠাৎ কল্পনা হাঁটু মুড়ে লোকটার পাশে বসে পড়ল। তারপর শাড়ির আঁচল নিঙড়ে একটু করে বৃষ্টির জল তার ঠোঁটে ঢালতে লাগল। তালু বোধ হয় শুকিয়ে গিয়েছিল একেবারে। জিভ দিয়ে চেটে চেটে সেই জল খেল। খেয়েও যেন কিছু হল না, আরও চাই। এদিকে আঁচলে আর জল থাকে! কল্পনা কোমরের উপরের শাড়ির পুরো অংশটা খুলে নিয়ে এক জায়গায় জড়ো করে নিঙড়ে জল বের করে লোকটার সেই ভীষণ তেষ্টা মেটাতে লাগল।

আমি কী দেখব? সেই লোকটাকে নাকি হাঁটু ভেঙে বসে থাকা কল্পনাকে। ঘাড়ের কাছে খোঁপা দুলছে। খাটো কাঁচুলি ঝুঁকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিঠের দিকে আরও উঠে যাচ্ছে, ভরা বুক সেই। স্থান-কাল-পাত্রেও তার স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিক আকর্ষণ বিকিরণ করছে। এক সময়ে মনে হল এই অসাধারণ দৃশ্যটা দেখার জন্যই আমি হলে উঠে বসতুম। মৃত্যুর দিক থেকে জীবনের দিকে ফিরে আসতুম। কিন্তু লোকটা কিছুই করল না। জল খেতে খেতে এক সময় কাত হয়ে গেল

তার ঘাড়। চোখ দুটো একেবারেই উলটে গেল। একেই কি বলে মৃত্যু! দেখিনি। কল্পনা উঠে দাঁড়াল। শাড়ি আবার শরীরে জড়িয়ে নিয়েছে। চোখের কোণে জল। কাঁদছে সে। কী আশ্চর্য! কোথাকার কে এক নাম না জানা লোক, তার শোকে কাঁদবার কী আছে!

যাঃ মরে গেল। কথাটা এমন ভাবে বলল যেন এইমাত্র তার হাত থেকে একটা পাখি উড়ে গেল।

তুমি আগে কখনও কাউকে মরতে দেখেছ কল্পনা?

দেখেছি বই কি, আমার বোনটা মারা গেল সেবার শীতকালে।

চলো এইবার এইখান থেকে সরে পড়ি, এইবার পুলিশ আসবে তখন মহা মুশকিল হবে। বৃষ্টি থেমেছে, বিকেল হয়ে গেছে। এখুনি অফিস ছুটি হবে, চারদিকে লোক গিসগিস করবে।

তাতে কী হয়েছে? এমনভাবে কথা বলছ যেন তুমি এইমাত্র লোকটিকে খুন করেছ!

তুমি জানো না কল্পনা, মরা মানুষ দেখতে আমার ভীষণ ভয় করে। তারপর পুলিশ? বাবা বলা যায় না কখন কাকে কীসে জড়িয়ে দেয়।

একটা কিছু না করেই চলে যাব? দাঁড়াও একটা ভিজিটিং কার্ড জামার পকেট থেকে গড়িয়ে পড়েছে।

কল্পনা নীচু হয়ে কার্ডটা তুলে নিল। আমি কার্ডটা নিয়ে দেখলাম। লেখা আছে, বিকাশ চৌধুরি, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, রেনবো ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাঃ লিমিটেড। তলায় এন্টালির অফিসের ঠিকানা, নিউ আলিপুর। ছোট্ট করে ফোন নম্বর।

তার মানে এই ভদ্রলোকের নাম বিকাশ চৌধুরি, একটি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। বলো কী? এত বড়লোক!

হতে পারে আবার নাও হতে পারে। এটা অন্য কারুর কার্ড হতে পারে, পকেটে ছিল হয়তো।

আমি তখন ভালো করে সেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। তন্ন তন্ন করে তার গায়ে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের চিহ্ন খুঁজতে লাগলাম। পায়ের জুতো, বেশ দামি টাউজার, হ্যাঁ, কম দামি নয়, গেঞ্জি তাও বেশ দামি, চেহারা যথেষ্ট সুন্দর, হাতে একটি আঙটি রয়েছে, পাথরটা নীল। চেহারা, বেশভূষা বেশ সম্মানজনক। কল্পনা আমার মনে হচ্ছে হয়তো বিকাশ চৌধুরি হলেও হতে পারেন। না হলেই বা কী? একজন মানুষ মারা গেছেন, এখন আমাদের অবশ্য কিছু করতে হবে!

কল্পনা, একবার চেষ্টা করে দেখলে হয় না বাঁচানো যায় কি না?

কীভাবে?

কোনওরকম আর্টিফিসিয়াল ব্রিদিং-ট্রিদিংবা অন্য কিছু করে।

ছেলেমানুষ তুমি। ওভাবে কাউকে এই অবস্থায় কোনও কালে বাঁচানো গেছে?

একবার দেখব চেষ্টা করে। কলেজে আমার এনসিসি ট্রেনিং ছিল। ফার্স্টএড কিছুটা জানা আছে।

হঠাৎ তুমি এত উৎসাহী হয়ে উঠলে? এই তো বলছিলে সরে পড়বে।

ব্যাপারটা তুমি ঠিক বুঝবে না। ভদ্রলোককে কোনওভাবে বাঁচাতে পারলে উনি খুশি হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য আমাকে ওই প্রতিষ্ঠানে একটা চাকরি দিতে পারতেন। কল্পনা হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে চলল। পশ্চিমে গঙ্গার দিক থেকে রেলের লাইন পেরিয়ে একটা কড়া চেহারার লোক আসছে এই দিকে। আমরা জোরে পা চালিয়ে দিলাম, ফোর্টের পাশে সবুজ ঢাকা জমির উপর দিয়ে। বৃষ্টি থেমে গেলেও চারিদিকে বেশ একটু বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব সন্ধেটাকে মধুর শীতল করছে। পশ্চিমে মেঘের ফাটলে সূর্য রঙের খেলা খেলছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *