1 of 2

কে?

কে?

১.

দু গেলাস চা, দুটো দিশি বিস্কুট। হাসপাতালের সামনে কোনওরকমের একটা চায়ের দোকান। যত বিপদগ্রস্ত মানুষ খদ্দের। কী খাচ্ছে না খাচ্ছে খেয়ালই নেই। মন পড়ে আছে বিপরীত দিকের হাসপাতালে, যেখানে প্রিয়জনেরা জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। সায়েব আমলের এক নম্বর হাসপাতালের এখন দশদশা। ভেতরে ঢুকলে কান্না পায়।

সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। কোনওরকমে চা শেষ করে আমি আর সুবীর একটা পার্কে। গিয়ে বসলুম। শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। সুবীর বললে, ‘কী হয়ে গেল বল তো! আমি ভাবতেই পারছি না। কী করে হল? আত্মহত্যার চেষ্টা নয় তো!’

‘আত্মহত্যা করতে যাবে কী কারণে? অসাবধানতা। গ্যাস জ্বালিয়ে দেশলাই কাঠিটা নাইটির ওপর ফেলে রেখেছে। খেয়াল করতে পারিনি। যখন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে, তখন ভয়ে কী করবে না করবে ঠিক করতে পারেনি। অনেকেই পারে না।’

‘বেশ ভালোরকম পুড়েছে। তোর কি মনে হয়, বাঁচবে তো?’

‘ভগবান জানেন। বার্ন কেসে কিছু বলা যায় না।’

সুবীর বাদাম কিনলে। সন্ধে এগিয়ে আসছে। একপাশে বাচ্চারা হইচই করছে। ছড়ি হাতে বৃদ্ধরা পাকের পর পাক মেরে চলেছেন। আরও আরও বাঁচতে হবে। কেউ মরতে চায় না। সাজপোশাক দেখে বোঝা যায় বিত্তবান। হয় বড় চাকরি করতেন, না হয় ব্যবসা। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, ভরপুর সংসার।

এই সরকারি উদ্যানে আগেও বসেছি অনেকবার। ছাত্রজীবনের কত বিকেল এখানে পড়ে আছে! সৌরভ, শ্যামল, বিদ্যুৎ, বিকাশ। কে কোথায় চলে গেল! ডাকাবুকো শ্যামল এত জোরে বাইক চালাল, পৃথিবীর বাইরে চলে গেল। আমাদের ব্যাচে বিধানই খুব উন্নতি করেছে। এখন আমেরিকার ‘নাসা’য় আছে। সায়েন্টিস্ট। খুব অভাবের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছে। হয়েছে তার। মায়ের জন্যে। অমন মা বিরল। আমার দাদু বলতেন, জন্ম দিলেই মা হয় না। কোন্নগরে গঙ্গার ধারে এক চিলতে একটা বাড়ি। ছোট্ট একটা কিচেন গার্ডেন। বিধানের বয়েস তখন তিন, বাবা মারা গেলেন। মা মানুষ করলেন ছেলেকে। সে এক সংগ্রাম। বিধানের বাড়িতে প্রায় প্রতি রবিবারেই যেতুম। দুটো আকর্ষণে—গঙ্গা আর মাসিমার হাতের অসাধারণ রান্না। ভীষণ। ভালোবাসতেন আমাকে। এখন আর যাই না। সংকোচ। আমি তো কিছু হতে পারলুম না। একেবারে মিডিওকার। আমার বাবা দুঃখ করে বলতেন, হওয়ার ইচ্ছে না থাকলে কিছু হওয়া যায় না।

সুবীর বললে, ‘কিছু মনে করিস না, আমাকে যেতে হচ্ছে, শেয়ালদার এক পার্টিকে টাইম দেওয়া আছে।’

সুবীরের নিজস্ব একটা ফার্ম আছে—ইলেকট্রিক্যাল কনট্রাক্টর। বেশ ভালোই চালাচ্ছে। ব্যবসাদারের ফ্যামিলি। পরিবারের কেউ কখনও চাকরি করেননি। বড়বাজারে পারিবারিক একটা ব্যবসা আছে হার্ডওয়্যারের। কলকাতায় তিনখানা বাড়ি।

সুবীর একটু অন্যরকমের। লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিল। শিবপুরের ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। চাকরির অনেক সুযোগ এসেছিল। নেয়নি। হাতে বড় বড় প্রোজেক্ট। গ্রে স্ট্রিটে অফিস। কেন জানি না আমাকে ভালোবাসে। কখনও বন্ধু, কখনও আবার অভিভাবক। জীবনের পরামর্শ দেয়। মাঝেমধ্যে শাসনও করে।

আমি একটা জরাজীর্ণ বাড়ির দোতলার একটা ঘরে থাকি। বাড়িটা আমার দাদুর। বেশ বড়ো বাড়ি। আমার দাদু একজন নামী মানুষ ছিলেন। ইংরেজির অধ্যাপক। বহুবার বিলেত গেছেন। আমার মা একমাত্র মেয়ে। ছেলে ছিল না। দিদিমা বাড়িটা আমাকে লিখে দিয়ে গেলেন। আমার আদর্শবাদী বাবা দান নেবেন না। বাড়িও করলেন না। ভাড়া বাড়িতে দিন কাটালেন। বাড়িটা পড়ে রইল তালা বন্ধ। বাবা ছিলেন কেমিস্ট। জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনে ল্যাবরেটারিটা নষ্ট হল। নেতারা নৃত্য করলেন। বাবা ওপরে চলে গেলেন। পড়ে রইলুম আমি আর আমার মা। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে উঠে এলুম দিদিমার বাড়িতে।

বাড়িটা হন্টেড।

বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করবেন না। আমি বিশ্বাস করি। বিজ্ঞান মঞ্চে তরুণ বামপন্থী বিজ্ঞানীদের বক্তৃতা অনেক শুনেছি। আমার বিশ্বাস কিন্তু বদলায়নি। গভীর রাতে সারা বাড়িতে যে বেহালার সুর ঘুরে বেড়ায় কে বাজায়? সে সুর বাইরে থেকে আসে না। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে, একতলার গুদাম ঘরে বিরাট একটা সিন্দুক আবিষ্কার করলুম। বিশাল তালা ঝুলছে। বিলেতের ‘চাবস কোম্পানি’-র তৈরি। চাবি কোথায়? চাবি হারিয়ে গেছে। মা জানে না। সিন্দুকে কী আছে, তাও জানে না। পড়ে আছে—আছে।

মা হঠাৎ মারা গেলেন। রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর বারান্দায় বসে আমার সঙ্গে গল্প করছিলেন। ভবিষ্যতের গল্প। ‘ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে তোর চাকরিটা যদি হয়ে যায়, তা হলে তো তোকে ফরেস্টেই থাকতে হবে, তা হলে আমি কোথায় কার কাছে থাকব?’

‘তোমাকে আমি মাথায় করে রাখব। আমার কাছে থাকবে তুমি। আমাকে একটা ফার্স্ট ক্লাস ফরেস্ট বাংলো দেবে। চারপাশে বড়ো বড়ো শাল আর সেগুন গাছ। বাংলোর সামনে সবুজ লন। ফুলের বাগান। একটু হেঁটে গেলেই একটা নদী। দূরে পাহাড়ের পর পাহাড়। তোমার হাঁস। পোষবার শখ। তোমাকে আমি কুড়িটা হাঁস কিনে দেব। সাদা-কালো, পাঁশুটে রং। তুমি চই চই। করে ডাকবে। তোমাকে গোল করে ঘিরে হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক করবে। মা সরস্বতীর একটা হাঁস আমার মায়ের কুড়িটা হাঁস।’

‘বাঘ আসবে?’

‘আসতেও পারে। তবে রোজই হাতি আসবে। বড় বড় হাতি।’

‘আমি একটা কিচেন গার্ডেন করব।’

‘কিচেন গার্ডেন কি গো, তোমার বিরাট বড় একটা বাগান হবে!’

‘যাক বাবা, অনেক দুঃখের পর এইবার একটু সুখ, কী বল খোকা?’ মা হেসে উঠলেন। হাসিটা আচমকা কেটে গেল। শব্দ নেই। মুখে হাসি লেগে আছে। মা নেই। পাখি যেভাবে খাঁচা থেকে উড়ে যায় মায়ের প্রাণ সেইভাবে উড়ে গেল।

অদ্ভুত আমার জীবন। কেউ আমার কথা একবারও ভাবলে না। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি মায়ের ব্যবহারে। এক নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কেউ আর আমার রইল না। আমি বেঁচে থাকলেই বা কী, মরে গেলেই বা কী? কারও কিছু যায়-আসে না।

মা চলে যাওয়ার পর শুরু হল আমার অন্বেষণ। বাড়িটার কোথায় কী আছে! ঘরের পর ঘর তালাবন্ধ। খোলার কোনও প্রয়োজন হত না। বড় বড় খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল। আলমারির ভেতর কত কত কাপড়, জামা। অতীতের চরিত্রটা পড়তেন। ড্রেসিং টেবিলে কত রকমের সাজার জিনিস। চিরুনি, হেয়ার ব্রাশ। হাড়ের চিরুনির হাতল ফেটে ফেটে গেছে। হেয়ার ব্রাশের হেয়ার সব ডেলা পাকিয়ে গেছে। পারফিউমের শিশির সব গন্ধ উড়ে গেছে। আয়নার বেলজিয়াম কাচে ছোপ ধরে গেছে। সোফায় সাতপুরুষের ধুলো। খাটে পরিপাটি বিছানা-বালিশ। ধুলোয় সাদা। মশারি ওপরে গোটানো। দামি নেটের মশারি। হাত দিলেই ঝরে পড়ে যাবে।

একটা ঘরের মেঝেতে পাউডারের মতো ধুলো। তার ওপর ছোট ছোট পায়ের ছাপ। ছোট তো কেউ ছিল না। কে এসেছিল এই ঘরে! এ এক রহস্য! মা থাকলে বলতে পারতেন। একবার মনে। হয়েছিল মেঝেটা ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ফেলিসাহস হয়নি।

নীচের গুদাম ঘরে ঢুকে অবাক। অসম্ভব ব্যাপার! এক পা এগোবার উপায় নেই। ভাঙা ফার্নিচার। হরেক রকমের বাক্স। হাভানা চুরুটের খালি বাক্স কমসে কম শ’ দুই। মাতামহ চুরুট খেতেন। এক ডজন বিলিতি ছিপ। গোটা কুড়ি হুইল। মাছ-ধরা সুতো সমেত।

এই পৃথিবীতে আমার একমাত্র বন্ধু সুবীর। মা মারা যাওয়ার পর রাতে সে আমাদের এই বাড়িতে আমার সঙ্গে শুতে আসত। কোনও কোনও দিন কাজকর্ম তাড়াতাড়ি শেষ করে সন্ধের পরেই। চলে আসত। সুবীরের হবি ছিল রান্না। নানারকম বাজার করে আনত। দুজনে রান্নাঘরে ঢুকে যেতুম। সর্বত্র মায়ের হাতের স্পর্শ। সুন্দরভাবে সব গোছানো। কৌটোর গায়ে গায়ে লেবেল মারা। ধনে, জিরে, পাঁচফোড়ন। ময়দা, সুজি, চিনি, চা। সব বৈজ্ঞানিক কায়দায় সাজানো। বড় মানুষের মেয়ে, একমাত্র মেয়ে।

আমার মাতামহী প্রয়াগের কুম্ভমেলায় হারিয়ে গিয়েছিলেন। রহস্যের জট খোলা যায়নি। সারা ভারতের পুলিশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আমার দিদিমাকে উদ্ধার করে আনতে পারেননি। দাদু প্রাইভেট এজেন্সিকে ভার দিয়েছিলেন। সন্ধান মেলেনি। সিদ্ধান্ত হয়েছিল—ডুবে গেছেন। অথবা, যেহেতু সুন্দরী ছিলেন দুর্বত্তরা ধরে নিয়ে গেছে।

দাদুর দুঃখ আমি বুঝি। চুরুট, বই, মাছ ধরা আর বিদেশ ভ্রমণ–নিঃসঙ্গ জীবনের এই হল সঙ্গী। সাত, আট খানা মোটা মোটা ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

মায়ের রান্নাঘরে ঢুকলে প্রথম প্রথম আমার খুব কান্না পেত। সুবীর একদিন খুব বকাবকি করলে। পুরুষ মানুষ পুরুষ মানুষের মতো হবি। মেয়েদের চোখের জলের দাম আছে। পুরুষের চোখের জল দুর্বলতা। মৃত্যুর পৃথিবীতে মৃত্যু থাকবেই। কেউ আগে যাবে, কেউ পরে যাবে। কেউ কালে যাবে, কেউ অকালে। নাথিং ডুয়িং।

আমতা আমতা করে বলেছিলুম, ‘স্মৃতি’।

সুবীর বলেছিল, ‘একটা সুন্দরী মেয়ে এসে জাপটে ধরে চুমু খেলে চোখে জল থাকবে? মায়ের স্মৃতি ভেঁড়া কাগজের মতো উড়ে চলে যাবে। দুঃখ বাইরে প্রকাশ করবি না। ভেতরে ধরে রাখবি। দেখবি জীবনটা অন্যরকম হয়ে গেছে। দুঃখের সুখে ভরে উঠেছিস। সংগীত হয়ে গেছিস, বাউল। হয়ে গেছিস, বসন্তের উদাস বাতাসের মতো। নে, বড় বড় দুটো পেঁয়াজ ডুমো ডুমো করে কাট।’

এটা হল সুবীর। এক রবিবার সুবীর বললে, ‘চল, সিন্দুকটা খোলার চেষ্টা করি।’ যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিল। ঘণ্টাখানেক মরণপণ, তালা খুলল। ভেতরে একটা ভেলভেট মোড়া বেহালার বাক্স। বাক্সটা কিন্তু খালি। বেহালাটা নেই। আছে পাট করা একটা সিল্কের রুমাল। এক কোণে মোনোগ্রাম।

সুবীর বললে, ‘ব্যাপারটা কী হল? বেহালাটা গেল কোথায়? এত যত্ন করে একটা খালি বাক্স! রহস্যজনক। চল তো দেখি।’

বাক্সটা নিয়ে আমরা বারান্দার রোদে এলুম। সুবীর মন নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে কী একটা করল, তলাটা খুলে গেল। একটা গুপ্ত কন্দর। একগাদা সোনার গয়না, জড়োয়ার সেট।

আমাকে হা হা করে হাসতে দেখে, সুবীর বললে, ‘কী হল? ম্যাড হয়ে গেলি?’

‘গয়নাগুলোর কত দাম হবে?’

‘অনেক।’

‘আর আমরা কী অভাবেই না দিন কাটিয়েছি!’

পরের দিন আমরা দুজনে ব্যাঙ্কের লকারে গয়নাগুলো ঢুকিয়ে দিয়ে এলুম। শান্তি।

কিন্তু বেহালাটার কী হল? যে বেহালা রাতে বাজে। সুবীর বললে, ‘ছেড়ে দে। ও নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করিস না, তবে এই বাড়িটা একটা ট্রেজার হাউস। কী আছে তোরা জানিস না। জানার চেষ্টাও করিসনি।’

‘কী করা উচিত?

‘অনুসন্ধান।’

আমার একার দ্বারা সম্ভব নয়।’

‘বাইরের লোক ঢোকালে হবে না। জানাজানি হয়ে যাবে। সে খুব বিপদের। মাসিমা খুব ক্যালাস ছিলেন।’

‘না, মা ভয় পেতেন।’

‘কীসের ভয়?’

‘মা আমাকে প্রায় বলতেন, এই বাড়িটার ওপর আমার কোনও অধিকার নেই। তোর বাবা। বলতেন অনুপার্জিত ধন একটা উৎপাত, একটা অভিশাপ। দান নিয়ে বড়লোক হওয়ার চেয়ে ভিখিরি হওয়া ভালো। মা বলতেন, এর কোনও কিছুই আমার নয়। আছি, এই পর্যন্ত। নীচের তলায় তিনটে ঘরে আমাদের দুজনের সংসার।’

সুবীর কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইল, ‘ঠিক কথাই বলেছিলেন, তবু যখন হাতে এসেছে ফেলে তো আর দেওয়া যায় না। এত বড় একটা বাড়ি। একটু অদলবদল, মেরামত করে আমরা এখানে। একটা হাসপাতাল করব। অনেকের উপকার হবে।’

‘বড় কিছু ভাবতে ভালো লাগে, করাটাই কঠিন।’

‘ইচ্ছের জোর থাকলে সবই করা যায়। ইচ্ছে থাকলেই উপায় বেরোয়। গয়নাগুলো লকারে ফেলে

রেখে বিক্রি করে দিলেই অগাধ টাকা।’

‘কার গয়না কে বিক্রি করে!’

‘কার গয়না মানে?’ তোর মায়ের গয়না।’

‘আইনে আটকাবে না! যদি চোরাই মাল হয়?’

‘তোর দাদু নিশ্চয় চোর ছিলেন না!’

‘আমার দাদু বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। সেকালের ইতিহাসে হয়তো তাঁর নাম আছে।’

‘হয়তো কী? অবশ্যই নাম আছে। অত বড় একজন ভাষাতত্ববিদ! অ্যাকাডেমিক সার্কেলে, বিদগ্ধমহলে তিনি অমর।’

তিনি বেহলা বাজাতেন না।’

‘তোর দিদিমা?’

‘শুনিনি।’

‘এই বাড়ির ইতিহাস এই বাড়িতেই আছে। রবি, সোম, মঙ্গল—এই তিন দিন আমার তেমন কাজ নেই, এই তিন দিন আমরা দুজনে বাড়িটা ওলট-পালট করব।’

.

২.

সন্ধেবেলা খবর এল চিন্ময়ী মারা গেছে। সুবীরকে ফোন করলুম। সুবীরের মোবাইলে।

‘চিন্ময়ী চলে গেল! তুই কোথায়?’

‘স্টক এক্সচেঞ্জে। একঘণ্টার মধ্যে আসছি। পোস্টমর্টেম থেকে ছাড়বে কখন? কারা গেছে?’

‘ওদের বাড়ি থেকে কেউ এসে আমাকে কিছু বলেনি।’

‘তবে? কী করবি?’

‘কিচ্ছু করব না। তোর কাজ মিটে গেলে চলে আয়!’

একেবারে একা বসে আছি আমাদের বাড়িতে। দাদুর আমলের বৈঠকখানা ঘরে। একদিকের দেয়ালে অয়েলে আঁকা একটা পোট্রেট ঝুলছে, স্যার উইলিয়াম জোনস। ভারতে এসে ভারতচর্চার পথ খুলে দিলেন। স্থাপন করলেন এশিয়াটিক সোসাইটি। ভারততত্ববিদ। অসাধারণ পণ্ডিত। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি। দাদু তাঁর ছবি আঁকিয়েছিলেন। শিল্পীর অস্পষ্ট স্বাক্ষর, ‘পিয়ারী’। মনে হয় কোনও সায়েব। দাদুর সঙ্গে বড় মানুষের আলাপ ছিল।

যে-ঘরে বসে আছি, সেখান থেকে বড় রাস্তা বেশ কিছুটা দূরে। রাত নেমেছে শহরে। দূরের বড় রাস্তায় যান চলাচল বেড়েছে। এই সময় যা হয়। চিনুর কথা খুব মনে পড়ছে। এই বাড়ির এই ঘরে সে কতবার এসেছে। কত আনন্দ করেছে। মা চলে যাওয়ার পর, সাবধান করেছিলুম, ‘আমি একা থাকি, তুমি একা আর এসো না, পাঁচজনে পাঁচ কথা বলতে পারে।’

‘বলে বলবে, আমি গ্রাহ্য করি না।’

‘আমি যদি কিছু করে ফেলি!’

‘আমিও তো কিছু করে ফেলতে পারি!’

দুজনে হা হা করে খানিক হাসলুম। ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল। আমাদের আলাপের জায়গাটা আমাদের কলেজ। আমি বেরোবার মুখে, চিন্ময়ী তখন ওপর দিকে উঠছে।

আলাপের উপলক্ষ্যটা খুব মজার। হেদোর পাশ দিয়ে চিনু ট্রামরাস্তার দিকে এগোচ্ছে। আমি পেছনে। হঠাৎ গোটাচারেক কুকুর ঝটাপটি করতে করতে ঘাড়ে পড়ে আর কি! চিনু দু-হাতে আমাকে জাপটে ধরেছে। আমার বুকের সঙ্গে তার বুক লেগে আছে। ধুকপুক করছে। দুজনের কপাল ঠেকাঠেকি। রাস্তার বাঁ-ধারে প্রাচীনকালের বিখ্যাত, ঐতিহাসিক চায়ের দোকান। কড়া টোস্ট আর ডবল হাফ চায়ের জন্য সুখ্যাত। দোকানের রসিক মালিক আমাদের অবস্থা দেখে বললেন, ‘হয়ে গেল।’

কুকুরগুলো মারামারি করতে করতে পেছন দিকে চলে গেল।

চিনু বললে, ‘কী হল?’

 ‘যা হবার তাই হল, এখন এখান থেকে আগে সরে পড়ি চল।’

আমরা বিডন স্ট্রিট ধরে সোজা হাঁটছি। তখনও জানি না, কে কোন দিকে যাব। কলেজে মেয়েদের দঙ্গলে হয়তো দেখেছি, মনে রাখিনি। প্রয়োজন হয়নি। ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর ভালোবেসে ফেলেছি। পাগল হয়ে গেছি বললে ভুল হবে না। সামান্য ব্যাপার—একটি মেয়ে। দেহে দেহে ঠোকাঠুকি নয়, মনে মনে ছুঁয়ে যাওয়া। চোখে চোখে লেগে যাওয়া।

এসব ভাবছি কেন আমি, যখন সে নেই। সারা ঘরে ছড়িয়ে আছে তার উপস্থিতির স্মৃতি। একদিন সকালে এসে বললে,

‘তুমি কিছু পারো না, একেবারে লেদাডুস।’

আমি ছুরি দিয়ে আলুর খোসা ছাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলুম। একটা খাপছাড়া ব্যাপার হচ্ছিল।

‘দেখি, সরো। আলু কাটছ কেন?’

‘মাছের ঝোল হবে।’

‘কে রাঁধবে?’

‘কেন? আমি রাঁধব।’

‘সর্বনাশ! সে ঝোল মুখে দেওয়া যাবে? মাছটা কে কাটবে?’

‘বাজার থেকে কাটিয়ে এনেছি।’

‘কী মশলা দেবে?’

‘ধনে, জিরে, হলুদ, কাঁচালঙ্কা ফেঁড়ে দেব।’

সে নিজেই রান্নায় লেগে গেল, আমি জোগাড়ে। সুন্দর কপালে দু-এক গাছা চুল ঝুলে পড়েছে। গলার চারপাশে বিন্দু বিন্দু ঘাম। একটা সরু সোনার চেন গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে গেছে। গোল গোল হাতে একটা করে চুড়ি। সে-হাতের কী কায়দা! কানে ছোট ছোট দুটো ইয়ার রিং। হালকা। হলুদ রঙের শাড়ি সাদা ব্লাউজ। ফরসা ফরসা পা দুটো আমার চারপাশে নেচে বেড়াচ্ছে। আমি মেঝেতে থেবড়ে বসে আছি। চারপাশে ঘটিবাটি, জলের বালতি। মাঝে মাঝে হুকুম হচ্ছে, এটা দাও ওটা দাও।

সেদিন আমরা দালানে একসঙ্গে খেতে বসেছিলুম।

‘কী, কেমন বেঁধেছি?’

‘দুর্দান্ত।’

‘ঝাল লাগছে? আমি একটু ঝাল বেশি খাই।’

‘আমিও। মা বলতেন, ঝাল খেলে বুদ্ধি খোলে।’

সেদিন আমার একটা কথাই মনে হচ্ছিল, চিনু আমার বোন নয় বউ। এত এত মানুষের মধ্যে থেকে হাত ধরাধরি করে দুজনে বেরিয়ে এল। সেই দুজনই তখন জগৎ। তাদের সম্পর্ক, সুখ দুঃখ, বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া। চিনু আমার বুকটা খালি করে দিয়ে চলে গেল। আমার আশ্রয় চুরমার। পড়ে আছি ফাঁকা মাঠে। পাশ দিয়ে সবাই সব দিকে চলে যাচ্ছে। কেউ যেন সিগারেট

ধরিয়ে কাঠিটা ফেলে দিয়ে গেছে!

ধ্যাৎ, ধ্যাৎ!

৩.

সুবীর এল। দেরিতে এল। ক্লান্ত দেখাচ্ছে। খুব খাটে। একা অত বড় একটা ব্যবসা চালায়। আমাকে বলেছিল, কি চাকরি করবি, আমার সঙ্গে আয়। আমি বলেছিলুম, না, ভাই আমাদের এই বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চাই না।

সুবীর আসার সময় খাবার নিয়ে এসেছে। আমাদের দুজনেরই যা প্রিয়, হিং-এর কচুরি। রাতে আর কিছু খেতে হবে না। এইতেই হয়ে যাবে।

‘হ্যাঁ রে, ওদিকের কোনও খবর আছে?’

‘পোস্টমর্টেম হবে। কাল দুপুরের আগে বেরোবে না।’

‘আমরা কিছু করতে পারি?’

‘কী করবি, ওদের অনেক লোকজন!’

আমরা কথা বলছি, দরজার কাছে কে একজন এসে দাঁড়াল। বাইরের দালানে আলো জ্বলছে। লম্বা একটা ছায়া ঘরে এসে ঢুকেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। বেশ ভয় পেয়ে গেছি।

মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়াল। চিনতে পেরেছি। চিন্ময়ীদের বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের মেয়েটি।

‘কী রে রুমকি?’

রুমকি খুব নীচু গলায় প্রায় ফিশফিশ করে বললে, ‘ভেতরের ঘরে চলো, অনেক কথা আছে।’

রুমকিকে নিয়ে শোবার ঘরে গেলুম। সে চেয়ারে বসল। আমি আর সুবীর খাটে। রুমকি খুব স্মার্ট। চেয়ারটা সরিয়ে আনল খাটের কাছে।

‘দিদিকে ওরা খুন করেছে।’

‘সে কী? কে খুন করেছে?

‘ওর মা আর ওর কাকা!’

‘সে আবার কী?’

‘ওই কাকা খুব বাজে লোক। চিনুদির মায়ের সঙ্গে একটা ব্যাপার আছে। এই নিয়ে দিদির সঙ্গে খুব অশান্তি হত। সম্পত্তি দিদির নামে। চিনুদির বাবার সঙ্গে চিনুদির মায়ের সম্পর্ক খুব খারাপ ছিল। মা আর মেয়েতে যখন ঝগড়া হত তখন সব শুনেছি। অনেক বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি ব্যাপার আমি

আড়াল থেকে দেখেছি।’

‘সে হোক, মেরে ফেলেছে বলছ কেন?’

‘এইটুকরো কাগজটা আমি পেয়েছি, পড়ে দেখ।’

কাগজটায় একটা লাইন, ‘অঙ্ক মেলাতে পারলেই পথ পরিষ্কার।’

‘এটা কার হাতের লেখা?’

‘কাকাবাবুর।’

‘এর মানে কী?

‘পথ পরিষ্কার মানে কী! একদিন রাত্তিরে, এই সাত-আট দিন আগে দিদি মাকে বলেছিল, তোমরা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও।’

‘চিনু মারা যাওয়ার পর বাড়ি, সম্পত্তি কে পাবে?’

‘কাকাবাবু।’

‘মা পাবে না কেন?’

‘মায়ের অধিকার নেই। পৈতৃক সম্পত্তি সেই তরফেই ফিরে যাবে।’

‘কে বললে?’

‘প্রশান্তদা, হাইকোর্টের। আমি সকালেই জিগ্যেস করে জেনে এসেছি।’

সুবীর বললে, ‘এ তো অসাধারণ মেয়ে, এর ব্যারিস্টার হওয়া উচিত।’

রুমকি হাসল। কপালে টোকা মেরে বললে, ‘মানুষের এই জায়গাটাই সব। যা লেখা আছে তাই হবে।’

‘তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে?’

‘অঙ্ক। ব্যাপারটা অঙ্ক। দুই আর দুয়ে চার। মন দিয়ে শোনো অঙ্কটা কী! তোমার আর দিদির সম্পর্কটা বিয়ের দিকে যাচ্ছিল। বিয়ে তোমাদের হতই। অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা দুটোই

তুমি পেতে। তাহলে রাজকন্যাকে সরাতেই হবে। এইবার শোনো, দিদির বাবা বেঁচে থাকতেই ঠাকুরপো আর বউদির লটঘট চলছিল। শোনো, খুন একটা নয়, খুন দুটো। দিদির বাবাকেও খুব কায়দা করে সরানো হয়েছিল।’

‘কী রকম?’

‘আজ থেকে সাত বছর আগে লরি দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছিল।’

‘কাকাবাবু লরি কোথা থেকে পেল?’

‘সেই সময় ট্রান্সপোর্ট বিজনেস ছিল। দিদির বাবা ডানকুনির কোল কমপ্লেক্সে ছিলেন। সন্ধের সময় মোটর সাইকেলে বাড়ি ফিরছিলেন। লরিটা মেরে দিয়ে চলে গেল। একটা জায়গায় অঙ্কটা গোলমাল হয়ে গেল, ওরা জানত না তিন মাস আগেই বাবা উইল করে মেয়েকে সব সম্পত্তি দিয়ে গেছেন। সলিসিটারের ঘরে সেই উইল জমা ছিল। কেস কেঁচে গেল। এইবার কী হল, বউদিকে ভোগ করা হয়ে গেছে। বউদিকে বাঁচতে হবে মেয়ের দয়ায়, অতএব বউদিকে আর দরকার নেই। তখন বউদির সঙ্গে প্ল্যান হল, সম্পত্তিটা যদি পাইয়ে দিতে পার তাহলে তুমি হবে আমার পাটরানি।’

‘আগুনটা লাগল কী করে?’

সুবীর বললে, ‘গ্যাস খুলে রেখেছিল।’

রুমকি বললে, ‘অত বোকা নয়। গ্যাসের গন্ধ আছে।’

‘তাহলে!’

‘ওই যে বলেছে, অঙ্কটা যদি মেলাতে পারো! ভালো করে শোনো, চোখ বুজিয়ে দেখো। দেশলাই কাঠি জ্বলল, ডান হাত এগোচ্ছে। বাঁ-হাতে ওভেনের নবটা ঘোরানো হল, হঠাৎ আচমকা একগাদা বাসন পড়ল। চমকে উঠল। জ্বলন্ত কাঠিটা পড়ল নাইটির ওপরে। গ্যাস খোলা। হুহু করে বেরোচ্ছে। সেই গ্যাস আগুনকে দাউদাউ করে বাড়িয়ে দিল। প্রথম চান্সেই হিসেব মিলে গেল।’

আমি আর সুবীর হাঁ করে বসে রইলুম কিছুক্ষণ।

সুবীর বললে, ‘পারফেক্ট মার্ডার। কোনও ভাবেই প্রমাণ করা যাবে না।’

‘একটা কথাও তো বলতে পারল না। বললে কিছু করা যেত হয়তো।’

‘পোস্টমর্টেম?

‘কী পাওয়া যাবে? কিস্যু পাওয়া যাবে না। ভিসেরায় কিছু মিলবে না। যদি এফআইআর করতে হয় কে করবে? এ তো শ্বশুরবাড়িতে বউ পোড়ানো নয়। আমরা তো বাইরের লোক। ঘটনার জায়গায় ছিলুম না। প্রত্যক্ষদর্শী নই। সাক্ষীও হতে পারব না।’

রুমকি বললে, ‘কোনও খুনই কি কেউ দেখিয়ে করে!’

‘তা করে না, তবে কিছু না কিছু প্রমাণ ফেলে যায়। এখানে তো কিছুই নেই।’

রুমকি বললে, ‘কেন এই কাগজটা।’

‘এটা পেলে কোথায়?

‘দিদির মায়ের মাথার বালিশের তলায়। বিছানা করতে গিয়ে পেয়েছি।’

সুবীর বললে, ‘আমার প্রথম প্রশ্ন, এটা যদি নির্দেশ হয়, পড়ে ছিঁড়ে ফেললেই হত। যত্ন করে বালিশের তলায় রাখা কেন? প্রমাণ তো লোপাট করারই কথা।’

‘অসাবধানতা। ভুলে গেছে। আমার ধারণা, যেই আনুক এটা এসেছিল রাত্তিরবেলা। পড়ার সময় দিদি হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়েছিল। তাড়াতাড়ি বালিশের তলায় ঢোকাতে গিয়ে ঢুকিয়ে ফেলেছিল ওয়াড়ের ভেতর। পরে আর খুঁজে পায়নি।’

‘ঠিক আছে, এটা ধরে রাখা যাক, পরের প্রশ্ন, যাদের দু-বেলা দেখা হচ্ছে, এত ঘনিষ্ঠ, তাদের একজন আর একজনকে চিরকুট দেবে কেন, কায়দার কথা লিখে! কানে কানে ফিশফিশ করে বললেই তো হয়।’

রুমকি একটু চিন্তিত হল।

‘এই জায়গায় আমরা একটা কর্মাশিয়াল ব্রেক নি।’

সুবীর বললে। ‘কচুরিদের যথাস্থানে পাঠানো দরকার, বিলম্বে আরও শীতল হয়ে যাবে। তোর জায়গা-জমি বের কর।’

উঠে রান্নাঘরে গেলুম। রুমকি আমার পাশে এসে দাঁড়াল, ‘তুমি যাও। আমি ব্যবস্থা করছি।’

আমাদের সামনে কচুরি আর তরকারির প্লেট ধরে দিল।

‘তোমার?’

‘আনছি? হাত তো দুটো।’

সুবীর বললে, ‘তাও তো বটে।’

রুমকি এসে বসল।

‘সমান ভাগ করেছ তো!’

‘আমার একটা কম।’

‘কেন? বারোটা এনেছি তো!’

‘তুমি বারোটার দাম দিয়েছ, কচুরি দিয়েছে এগারোটা।’

‘আমাদের থেকে হাফ হাফ নাও।’

‘খাও তো। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে উপোস, ও বাড়িতে শোকের নকশা চলছে। এর পর চা খাবে তো?’

‘যদি করো।’

‘যন্ত্রপাতি দেখিয়ে দাও।’

আমার মা খুব গোছানো ছিলেন। সংসারটাকে করে রেখেছিলেন ছবির মতো। বড় ঘরের মেয়ে ছিলেন তো।

‘এই নাও কেটলি!’

‘কেটলি তো দেখতেই পাচ্ছি, কত বছর ধোওয়া হয়নি!’

‘রোজ চা করি, সপ্তাহে একদিন আচ্ছাসে ধোলাই করি।’

‘চা কোথায়, চিনি কোথায়, দুধ কোথায়?’

‘সব আছে।’

সুবীর চায়ে চুমুক দিয়ে বললে, ‘কাকাবাবু নয়, তৃতীয় আর একজন কেউ আছে। চিরকুটটার সঙ্গে এই মৃত্যুর যদি যোগ থাকে, তাহলে কাকাবাবু এর মধ্যে নেই।’

রুমকি বললে, ‘হতে পারে। কাকাবাবু আজ তিন মাস কলকাতার বাইরে।’

‘তাহলে, এই তৃতীয় লোকটা কে? তার সঙ্গে চিনুর মায়ের কী সম্পর্ক? তুমি কী আর কোনও লোককে বাড়িতে আসতে দেখেছ?’

‘না।’

‘তা হলে?

আমি বললুম, ‘সুবীর, এই সমস্যার সমাধান আমাদের দিয়ে হবে না। আমাদের সঙ্গে পড়ত প্রশান্ত, মনে আছে তোর?’

‘বারুইপুরে আমবাগান, আমরা পিকনিক করেছিলুম।’

‘প্রশান্ত পুলিশের বড়ো অফিসার। চল, কাল আমরা তার কাছে যাই।’

রুমকি বললে, ‘আমিও যাব। রান্নাঘর, যেখানে আগুন লেগেছিল, দিদি মেঝেতে পড়ে গড়াগড়ি দিয়েছিল, সেই মেঝেতে পোড়া আঙুল দিয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করেছিল। চারটে অক্ষর। প্রথমটা মুছে গিয়েছিল। অক্ষর তিনটে যা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, বিনাশ।’

‘বিনাশ মানে, শেষ করে দেওয়া, হত্যা।’

‘আগে আর একটা অক্ষর ছিল। ছিলই ছিল।’

সুবীর বললে, ‘আজকের মতো এই পর্যন্ত থাক। কাল তো আমরা প্রোন্তর কাছে যাবই। একটা ফোন কর না।’

‘নম্বর জানি না।’

‘আমি তা হলে আজকের মতো ছুটি নিচ্ছি।’

রুমকি বললে, ‘আমি কোথায় যাব?’

‘কেন? ও বাড়িতে!’

‘আজ সকালে আমাকে ওরা ছুটি করে দিয়েছে।’

‘সে কী!’

‘গম্ভীর গলায় বললে, দরকার নেই।’

‘তোমার মালপত্র?’

‘ওই যে, দুটো স্যুটকেস।’

সুবীর বললে, ‘কী ব্যাপার বল তো? এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফাঁকা!’

‘মনে হয়, রুমকিকে সন্দেহ করছে।’

রুমকি বললে, ‘কিছু কাগজপত্র কাল ছাতের ঘরে পোড়াচ্ছিল। আমি জিগ্যেস করলুম, কী পোড়াচ্ছ? তা আমার দিকে কটমট করে তাকাল।’

‘কী পোড়াচ্ছিল মনে হল? ‘অনেক খাতা-মাতা, চিঠিপত্তর।’

সুবীর বললে, ‘এই রে, আগুনের নেশা ধরেছে। আগুনের একটা বিশ্রী নেশা আছে। তাহলে রুমকির কী হবে?’

রুমকি করুণ গলায় বললে, ‘সুবীরদা আজ তুমি থেকে যাও না। আমি কে, সেটা তোমার জানা হয়নি। তোমরা দুজনেই জানো না। কাল সকালে আমি কোথায় না কোথায় চলে যাব, আর তো দেখা নাও হতে পারে।

সুবীর বললে, ‘অল রাইট! তুমি যদি খিচুড়ি খাওয়াও তাহলে থেকে যেতে পারি।’

রুমকি বললে, ‘খিচুড়ি আর পাঁপড় ভাজা।’

সুবীর আমাকে জিগ্যেস করলে, ‘কিরে কাঁচামাল সব আছে তো? পাঁপড় আনতে হবে?

‘আমি যাচ্ছি। ভালো করে দেখ, চাল, ডাল, আলু সব আছে তো? ঘি আছে? খিচুড়ি কিন্তু ঘি চাইবে।’

ঘি আছে।’

রুমকি বললে, ‘খিচুড়ির সঙ্গে ডিমের ওমলেট?’

‘ওঃ! ভেরি ইন্টারেস্টিং। ফাটাফাটি।‘

সুবীর বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল।

‘কী হল রে?’

‘শোন শুভ্র, তোদের ওই আউটহাউসে কেউ থাকে?’

‘না তো, ওটা তো প্রায় ভেঙে পড়েছে। সাপ-খোপের আচ্ছা।’

‘বিশ্বাস কর, একটা দেশলাই কাঠি জ্বলেই নিবে গেল।’

‘সে কী রে?’

রুমকি আমার গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে।

সুবীর বললে, ‘সামওয়ান ইজ দেয়ার, আই অ্যাম সিওর। একবার দেখা দরকার।’

রুমকি বললে, ‘আমাকে মারবে।’

‘তোমাকে মারবে কেন?’

‘আমার মন বলছে। আমি একটা বিরাট চক্রর সন্ধান পেয়েছি।’

সুবীর বললে, ‘টর্চ আছে?’

ঝোপ-জঙ্গল মাড়িয়ে, বুনো গাছের ডালপালার খোঁচা সহ্য করে অতীতের সেই কুঠিটায় দুজনে পৌঁছোলুম। আমার মাতামহ যখন জীবিত ছিলেন তখন এই ঘরে একটি দাতব্য হোমিও চিকিৎসালয় করেছিলেন। আউটহাউসের পরেই বাউন্ডারি ওয়াল। তারপরেই বিরাট স্কুলবিল্ডিং। খাড়া দেয়াল ওপর দিকে উঠে গেছে। মাঝখানে ছোট্ট একটা গলি। পাক মেরে পৌঁছে গেছে শ্মশানে। গঙ্গা। প্রাচীন ঘাট। লঞ্চ সার্ভিস, জেটি।

সুবীর ঘরে আলো ফেলল। কেউ নেই। বাতাসে সিগারেটের গন্ধ। মেঝেতে দুটো সিগারেটেরে টুকরো। তিন-চারটে পোড়া দেশলাই কাঠি। টর্চের আলো ঘোরাতে ঘোরাতে দেয়ালের একটা জায়গায় একটা লেখা চোখে পড়ল। কাঠকয়লা দিয়ে কেউ লিখেছে,

নাক গলালেই বিপদ

লেখাটার পাশে একটা ত্রিশূল চিহ্ন। মেঝেতে আরও একটা কী পড়ে আছে। টর্চের আলো ফেলে দেখা গেল, চিবিয়ে চিবিয়ে প্রায় বিধ্বস্ত করে একটা মুরগির ঠ্যাং কেউ ফেলে গেছে।

ঘরের কোণে হঠাৎ আলোয় কী একটা ঝলমল করে উঠল। সুবীর ভালো করে দেখে একটা শব্দ করল ‘হুঁ’।

ওপাশে অনেক কালের ভাঙাচোরা টেবিল পড়েছিল। সুবীর তার তলায় একটা বাজে জিনিস আবিষ্কার করল।

‘তুই খুব বিপদে পড়ে যাবি শুভ্র। এই ঘরে ড্রাগ-অ্যাডিক্টরা আসে। মেয়েরাও আসে। তোর কোনও নজর নেই। এই ঘরে খুন করে কারওকে ফেলে গেলে তোকেই তো জেল খাটতে হবে।’

‘দেয়ালে লেখাটা?’

‘ওটা কোনও নাবালকের কাজ। পাশেই স্কুল। বাউন্ডারিটা তেমন উঁচু নয়। টপকে চলে এসেছিল, রোজই হয়তো আসে। ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ার ফল। হয়তো তাদেরই কেউ এসে ব্রাউন-সুগার নেয়। রাংতাটা তারই সাক্ষী। কাল সকালে আমার ফার্স্ট কাজ হবে, এই ঘরটাকে। ভেঙে মাঠ করে দেওয়া।’

পাঁচিলের পাশের সরু পথ দিয়ে মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে শ্মশানে। পায়ের দুপদাপ শব্দ। মাঝে মাঝে ভারী গলায়, বলহরি হরি বোল। গা ছম ছম। সুবীর বললে, ‘চল, এর পর দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যাবে।’

রাত হয়েছে। বাজারে তেমন লোকজন নেই। কোনও কোনও দোকান বন্ধ হওয়ার মুখে। সবচেয়ে বড় কাপড়ের দোকান, বসাক স্টোর্স। দোকানের মালিক সারাদিন পা মুড়ে গদিতে বসে থাকেন। দোকান বন্ধ হওয়ার আগে কাপড় মাপার গজকাঠিটা মেঝেতে দাঁড় করিয়ে দুহাত দিয়ে ধরে ওঠবোস করছেন। পয়সা প্রচুর কিন্তু গৃহসুখ আর দেহসুখের অভাব। বড় মেয়েটি একের পর এক প্রেম করতে করতে শেষ প্রেমের প্রেমিকের সঙ্গে হাওয়া। কোন দেশে গেছে কেউ জানে না।

বাজারের পেছন দিকে ছোট্ট একটি গণিকাপল্লি। রাত্তিরে বেশ জমজমাট হয়। একটা লাল বিরাট মোটর সাইকেল একপাশে খাড়া। মালিক কোনও একটা ঘরে আয়েস করছি। মালিককে আমরা সবাই চিনি। রায়বাহাদুরের নাতি। তোলাবাজ। খুনটুনও করে।

ছোট ছোট খুপরি খুপরি ঘর। করুণ চেহারার একটি মেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। সুবীরকে বললে, ‘এসো না আমীর।’

সুবীর কেঁদে ফেলেছে। ‘শুভ্র! মেয়েদের এই পরিণতি সহ্য করতে পারি না।’

মেয়েটার হাতে একশো টাকার একটা নোট গুঁজে দিতে গেল।

মেয়েটা পরিষ্কার বলছে কানে এল, ‘কাজ না করে পয়সা নিতে পারব না। আমাদের নিয়ম নেই।’

সুবীর বললে, ‘তুমি আমার বোন।’

মেয়েটা কাটা কাটা উত্তর, ‘বোন, তা বাড়ি নিয়ে চলোনা।’

খদ্দের এসে গেল। একটা আধবুড়ো। কাঁধে একটা ব্যাগ। মদের গন্ধ। মেয়ের বয়সি মেয়েটার হাত খামচে ধরে ভেতরে চলে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

লোকটি আমার চেনা। বাজারে ইলেকট্রিক্যাল গুডসের চালু দোকান। বউ আছে, ছেলেমেয়ে আছে।

সুবীর ফেরার পথে, সারাটা পথ একটা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে এল—

ধরণী তোমার প্রমোদপ্রবাস,
বাঁধনিকো হেথা ঘর,
বিশ্বসুদ্ধ বুকে টেনে, বল
সবাই আমার পর।
পুণ্য তোমারে করে না লুব্ধ,
পাপে নাকি কাঁপে বুক!
নহ মা ঘৃণ্য কৃপার পাত্র,
আজ যে বুঝেছি খাঁটি—
মায়ের পুজোয় কেন লাগে তোর
চরণে দলিত মাটি!

বাড়িতে ঢোকার মুখে সুবীর আমার একটা হাত ধরে বললে, ‘আয় আজ রাতে আমরা শপথ করি—মেয়েদের আমরা খুব যত্ন করব।’

রুমকি ভয়ে সিঁটিয়ে আছে।

‘কীসের ভয়?’

‘এত বড় একটা বাড়িতে আমাকে একলা ফেলে চলে গেলে। গেলে তো গেলেই। কত রকমের শব্দ!’

‘ভয় পেলেই ভয় মানুষকে পেয়ে বসবে। এখন চলো রান্নাঘরে। শুরু হোক আমাদের সমবেত রন্ধনযজ্ঞ।’

রুমকি জিগ্যেস করলে, ‘কী ডাল?’

‘মুসৌরি।’

‘পেঁয়াজ চলবে?

‘লাগাও প্যাঁজ।’

সুবীর পেঁয়াজ ছাড়াচ্ছে আর গাইছে—

জীবনে মরণে সমপরিমাণে
মিলায়ে কেরাঁধে এ জগা-খিচুড়ি!
যারাচাপা ব্রহ্মাণ্ড-ভাণ্ডে
নুনে ঝালে অভাব রাখেনি কিছুরই!
নেপথ্যে হাঁকে কর্তা বাঙ্গাল—
জ্বাল ঠেলে দাও গণ্ডা গণ্ডা ঝাল;
বাকি কোনো দিকে রাখে না খেয়াল–
ঝি-চাকরে করে সকল খিচুড়ি।

সুবীর হঠাৎ নাচতে লাগল—

গুমে গুমে সিজে কাহার জন্য
ভূচর-জলচর-খেচরান,
তলা হতে সরা, সরা হতে তলা
মাথা ঠুকে মরে আছাড়ি বিছুরি!

‘এমন প্রলয় নাচ নাচলে রান্না করা যায়?

সুবীর শান্ত হতে হতে,

‘যে রাঁধুক আর যেই এরে খাক
এ খিচুড়ি নাহি হবে পরিপাক।
দেবতার পেট না হলেও ঢাক
অন্তত ফুলে হবেই কচুরি।’

রান্নাটা খুব জমেছে। সুগন্ধে বাড়ি ভরে গেছে। মা চলে যাওয়ার পর এই প্রথম। রান্না শেষ করে রুমকি বললে, ‘চান করব।’

‘কোনও অসুবিধে নেই। চলে যাও, ওই বাথরুম। সব আছে।’

খাওয়াদাওয়া শেষ হল প্রায় বারোটায়। সুবীরকে খুব খুশি লাগছে। ও সাধারণত খুব ধীর স্থির। ওর মন বোঝা যায় না।

.

৪.

আমাদের সেই সাবেককালের বিরাট খাট। অকারণে কারুকার্য। সেকালে কাঠ সস্তা, বড়লোকদের তহবিলে বাজে খরচ করার মতো অঢেল টাকা। সুবীর শুয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড খেয়েছে। আমি আর রুমকি খাটের আর এক পাশে বসেছি।

মা বেঁচে থাকলে এইভাবে একই খাটে তিনজনে বসা যেত কি?

রুমকি সুবীরকে বললে, ‘তুমি শুয়ে শুয়ে শুনবে, তবেই হয়েছে। এক্ষুনি নাক ডাকবে।’

সুবীর বললে, ‘আমার ইনসমনিয়া আছে ভাই। বছরের পর বছর নিদ্রাহীন রাত আমার।’

‘ঘুমোতে পার না কেন? এর পর তো পাগল হয়ে যাবে।’

‘পাগল হতে আর বাকি কি? কত রকমের সমস্যা! জীবন-মরণ সমস্যা। এই প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় বেঁচে থাকাটা যেন কুস্তি! আমার কথা থাক, তোমার কথা বলো।’

‘তা হলে শোনো। চিনুদির এই কাকাবাবু আর আমার বাবা, দুজনে হলায়গলায় বন্ধু। পার্টনারশিপে ব্যবসা শুরু হল স্ক্র্যাপ আয়রনের। হাওড়ায় বিরাট গোডাউন। ক্যানিং স্ট্রিটে সাজানো, সুন্দর অফিস। দেখতে দেখতে ব্যবসা জমে উঠল। কত সুখ!

‘এইবার শুরু হল কাকাবাবুর খেলা। বাবাকে মদ আর মেয়েছেলে ধরাল। আমার এত সুন্দর মা জীবন থেকে ভেসে গেল। প্রথমে লুকিয়ে লুকিয়ে তারপর খোলাখুলি। জলের বদলে মদ। মাকে ধরে পেটানো। একজন নিভাঁজ নিপাট ভদ্রলোক—চোখের সামনে একটা কুৎসিত ছোটলোক হয়ে গেল। এইবার হল সিফিলিস। লোকটা কী ভয়ংকর শয়তান, ওই বিশ্রী রোগটা আমার নিরীহ মাকে ধরাবে বলে রোজ রাতে আমাদের চোখের সামনে আঁচড়া-আঁচড়ি, কামড়া-কামড়ি। মা চিৎকার করছে। একদিন দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকতে হল। সে দৃশ্য ভাবা যায় না! মদের ঘোরে বেহেড। মদের বোতলটাকে ভেঙে হাতে নিয়েছে। মায়ের পোশাক ছিন্নভিন্ন। লোকটার মুখ। বীভৎস রাক্ষসের মতো। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। জানোয়ারের মতো শব্দ করছে।

‘মারলুম তলপেটে এক লাথি। কোঁক করে উঠল। আচমকা ভাঙা বোতলটা ঢুকিয়ে দিল আমার দুই উরুর মাঝখানে। সে রাতে নির্ঘাৎ আমার মৃত্যু হত। অথবা আমার হাতেই জানোয়ারটার মৃত্যু হত। ঝুঁঝিয়ে রক্ত পড়ছে। এই দৃশ্য দেখে মা আর স্থির থাকতে পারল না। তখন মা আমার মা দুর্গা। জানোয়ারটাকে মারতে মারতে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিল। গড়াতে গড়াতে দোতলা থেকে একতলায়।

‘সুবীরদা বিরক্ত হচ্ছে! বই বন্ধ করব?

সুবীর উঠে বসল, ‘চা খাব।’

রুমকি উঠে দাঁড়াল, ‘জানো তো, সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে এখনও শিরায় টান ধরে।’

সুবীর বললে, ‘তোমরা বোসো, আমি চা করে আনছি’, রুমকি বললে, ‘আমি কি করতে আছি। একটাই সমস্যা, ওদিকে একা যেতে ভয় করছে।’

‘চলো, আমরা তিনজনে যাই। শুভ্র! গুমটি ঘরটা একবার দেখে এলে কেমন হয়!’

‘অসম্ভব! আমার যাওয়ার সাহস নেই। চুপ, চুপ একদম চুপ। সেই বেহালা। শুনতে পাচ্ছিস? কে বাজায়!’

রুমকি, ‘ওরে বাবারে’,বলে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল।

ঠিক এইভাবেই অনেক দিন আগে কুকুরের তাড়া খেয়ে চিনু আমাকে পথের মাঝে জড়িয়ে ধরেছিল। এ মেয়ে আলাদা মেয়ে, আলাদা শরীর, কিন্তু মনটা সেই এক।

সুবীর বললে, ‘ভয় কীসের, একটি কবিতা শোনো,

আমি বোধ হয় কোন জীবনে,
দূর অতীতের কোন ভুবনে,
ছিলাম কোন গুণীর হাতে বেহালা
অকারণে কান্না-হাসি
মুখে যে মোর উঠছে ভাসি
এ বুঝি সেই পুবজনমের দেয়ালা।’

‘তোমার ভয় করে না সুবীরদা?

‘ভয় করবে কেন, কেউ তো আমাকে মেরে ফেলতে আসছে না। সাধু-সন্তরা বলে গেছেন, রাতের পৃথিবীতে অনেক রকম শব্দ ওঠে, আকাশে অনেক কিছু দেখা যায়। মানুষ ঘুমোয় তাই জানতে পারে না। পাশেই আবার গঙ্গা, মহাশ্মশান। চল না, ছাদটা একটু ঘুরে আসি। খুব ভালো। লাগবে।’

‘সে সাহস নেই ভাই।’

‘কী আশ্চর্য! তোর বাড়ির ছাদ, তুই ভয় পাচ্ছিস যেতে!’

বেহালার শব্দ ক্রমশ দূর থেকে দূরে চলে গেল। কে যেন বাজাতে বাজাতে মহাকাশে মিলিয়ে গেল।

এক রাউন্ড চা হল। বাইরের বাগানের ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটা ঝটাপটির আওয়াজ হল। একটা বেড়াল একবার মাত্র ‘ম্যাও’ করে থেমে গেল। একটা ছায়া বাইরের দালান অতিক্রম করে চলে গেল। আমরা তিনজনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। রান্নাঘরে একটা স্টিলের গেলাস কোনও কারণ নেই ভীষণ শব্দ করে তাক থেকে মেঝেতে আছড়ে পড়ল। একটা পরিচিত সুগন্ধ নাকে এল।

সুবীর বললে, ‘কেউ ধূপ জ্বালিয়ে পুজোয় বসেছে।’

রুমকি কানে কানে বললে, ‘গন্ধটা চিনতে পারছ?’

‘পারছি।’

‘তোমার কাছে দিদি এসেছিল, আমরা আছি দেখে চলে গেল।’

বোধ হয় একটু আবেগ এসেছিল। বুকের কাছটা কেমন করে উঠল। রুমকি আমাকে তার নরম শরীরে জড়িয়ে ধরে বললে, ‘আমি আছি। আমি তোমাকে যেদিন দেখেছি সেইদিনই ভালোবেসে ফেলেছি।’

সুবীর টয়লেটে গিয়েছিল। দরজা খোলার শব্দ হতেই রুমকি দূরে সরে গেল।

শেষ রাতে যদি কোনও সুন্দরী বলে, ‘ভালোবাসি’, বুকের ভেতরে ভোরের পাখি ডেকে ওঠে।

সুবীর বললে, ‘একটা কথা বলি, রুমকির আত্মকথার দ্বিতীয় পর্বটা আমরা কাল শুনব। আজ আমরা কিছুক্ষণের জন্যে হলেও একটু শুয়েনি। তা না হলে কাল সকালে খুব খারাপ লাগবে। বিরাট খাট, গড়ের মাঠের মতো। তিনজন তিন দিকে। এখন কথা হল, রুমকির যদি আপত্তি থাকে।’

রুমকি বললে, ‘আমি একলা শুতে পারব না। ভয়ে হার্টফেল করব।’

সুবীর ধপাস করে শুয়ে পড়ে বললে, ‘রুমকিকে তোর দিকে নিয়ে নে। গুড নাইট।’

‘একটু আগে বললি, ‘ইনসমনিয়া!’

‘ভোরের দিকে আসে, তিনটে থেকে আটটা।’

সুবীর নেতিয়ে পড়ল। নাক ডাকছে ফুরুর, ফুরুর।

রুমকি আমার পাশে শুয়ে বললে, ‘মনে কোনও পাপ রেখোনা। শরীর আলগা কর।’

মনে পাপ রেখো না। বললেই হল! এ যে আমার কাছে ফুলশয্যার রাত। রুমকি সুন্দরী। চিনুর চেয়ে সুন্দরী। যৌবনের ঢেউ খেলছে শরীরে। সে আমি বর্ণনা করতে পারব না। একাল অনেক এগিয়ে গেছে। সেকাল হলে এমন মেয়েকে মায়েরা চোখে চোখে আগলে রাখত।

দোতলার দালানের আলোটা জ্বেলে রাখা হয়েছে। আলোর আভা জলের ধারার মতো সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নামছে। ওপাশে সুবীর না থাকলে আমি হয়তো ভীষণ রকমের একটা অন্যায় করে জেলে যেতুম।

রুমকি বললে, ‘ঘুমোলে?

‘না, আসছে না।’

‘আমারও আসছে না। আমার দিকে সরে এসো না।’

আমার একটা হাত টেনে নিয়ে নিজের বুকের ওপর রাখল। শ্বাসপ্রশ্বাসে তার বুক ওঠা-নামা করছে আমার হাতটাকে নিয়ে। এতটা ঘনিষ্ঠতা ভালো লাগছে না। পৃথিবীতে যে-ক-বছর এসেছি। তাতে সার বুঝেছি, আপনার বলতে দুজন, মা আর বাবা, আর সবচেয়ে আপনজন—ভগবান! এসব বাজে—সব ঝুট হ্যায়।

সুবীর ঘুমিয়েছে, না মটকা মেরে পড়ে আছে! আমাদের খানিক ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। ঘি আর আগুন পাশাপাশি। রুমকি আমার খুব কাছে সরে এল। আমার কানের কাছে মুখ। গলায় নরম নিঃশ্বাস। বড়ো এলাচের গন্ধ।

রুমকি ফিশফিশ করে বললে, ‘দিদির মা পাগলের মতো একটা জিনিস খুঁজছে।’

‘কী জিনিস?’

‘কোথা থেকে শুনেছে, পারিবারিক যত গয়না শ্বশুরমশাই এই সবই কারও কাছে গচ্ছিত রেখে। গেছেন। বেহালার বাক্সে ভরে। তিনি খুব বড় ওস্তাদ ছিলেন। বেহালাটা ওই বাড়িতে পড়ে আছে। বাক্সটা নেই।’

 সুবীর আচমকা ‘উঃ’ বলে লাফিয়ে উঠল ‘আলো জ্বাল, আলো জ্বাল।’

‘কী হল রে!’

‘কামড়েছে। মনে হয় কাঁকড়াবিছে!’

নিমেষে সব লণ্ডভণ্ড। বালিশ-চাদর মেঝেতে গড়াগড়ি। সুবীর বাইরে বেরিয়ে গেছে। আকাশে ভোরের আলো ফুটছে। সুবীর বাইরে থেকে ডাকছে, ‘শুভ্র! একবার আয় না।’

অনেকটা দূরে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘কিছু কামড়ায়নি। পাছে তুই গচ্ছিত গয়নার কথা বলে ফেলিস! আমি ঘুমোইনি। মটকা মেরে পড়েছিলুম। মেয়েটাকে স্টাডি করছিলুম। সব কিছু বাজিয়ে নিতে হয়। তোকে একটা কঠিন কাজ সুবীর থেমে গেল। রুমকি আসছে। ভীষণ উত্তেজিত। ‘এই দেখো কী বেরিয়েছে।’

এত বড় একটা ধুতরো ফল। ভোরের আলোয় স্পষ্ট।

অবাক কাণ্ড। ধুতরো এল কোথা থেকে!

রুমকি চা বসাতে রান্নাঘরে চলে গেল।

ধুতরো ফলটা আমার হাতে। মা সারা জীবন শিবপূজা করে গেছেন। বিছানায় ধুতরো রেখেছিলেন সুরক্ষার জন্যে। রুমকি চলে যেতেই সুবীর বললে, ‘তোকে লম্পট প্রেমিক হতে হবে।’

‘মানে?’

‘তোকে দেখতে হবে, রুমকির জঘনে ক্ষতচিহ্ন আছে কি না?’

‘সে কী করে সম্ভব!’

‘সম্ভব! রুমকি ভীষণভাবে তোর প্রেমে পড়েছে। ঘরে তুলতে হলে যাচাই করে নিতে হবে। কে সে! সে কোন দলের! হঠাৎ গয়নার কথা উঠল কেন?’

‘কোন দলের মানে?’

‘ওই ভদ্রমহিলার দলের কি না? হঠাৎ এল? কেন এল?’

‘তুই মানুষকে ভীষণ সন্দেহ করিস।’

‘আমাকে ব্যবসা করে খেতে হয় ভাই। আমি এখন যাচ্ছি। রাত্তিরে আসব।’ ফিশফিশের বললে, ‘চুটিয়ে প্রেম কর। জায়গাটা দেখে নে। গল্প না সত্যি।’

.

৫.

চা, বিস্কুট খেয়ে সুবীর বেরিয়ে গেল। একবার বললে, চানটা সেরে নি, তারপর বললে, থাক সময় নেই। খুব তাড়াহুড়ো করে চলে গেল।

রুমকি বললে, ‘ঘরে এসো।’

খাটের ধারে আমাকে ঠেলে বসিয়ে দিল। গায়ে খুব জোর আছে। ছাত্রজীবন থেকেই আমি ব্যায়াম করি। এখনও সপ্তাহে তিন দিন জিমনাসিয়ামে যাই। তবুও মনে হল রুমকির সঙ্গে লড়াই হলে আমি হেরে যাব।

রুমকি একে একে সব জানালা বন্ধ করে, দরজায় ছিটকিনি তুলে দিল।

ব্যাপারটা কী! বেশ ভয় পেয়ে গেলুম। আমাকে খুন করবে নাকি! মনে মনে আত্মরক্ষার জন্যে প্রস্তুত আমি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে একে একে সব পোশাক খুলে ফেলে বললে, ‘নাও, দেখে নাও। যাচাই করে নাও। মাথা নীচু করে আছ কেন? যেদিকে তাকাবার তাকাও সে দিকে।’

জীবনের আমি কখনও নগ্ন নারী দেখিনি। ছবিতে না, সিনেমাতেও না। সামনে দাঁড়িয়ে সুঠাম এক দেবী। যবের মতো গায়ের রং। সিল্কের মতো ত্বক।

‘কী হল? চোখ বুজিয়ে আছ কেন? তোমার বন্ধু যা দেখতে বলেছে দেখ। তাকাও।’ আমার ভীষণ ভয় করছে। বুক ঢিপঢিপ করছে। মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত।

ভয়ে ভয়ে বললুম, ‘তুমি কী করে শুনলে?’

‘আমার কুকুরের কান।’

‘তুমি সব পরে ফেল। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।’

রুমকি হেসে উঠল, ‘তা কি হয়! নেপালীর ভোজালি জানো?’

‘না।’

‘খাপ থেকে বেরোলে একটু না একটু রক্ত না নিয়ে ঢোকে না। আমার এই বুক তোমার হাত দুটো চাইছে।’

কারও মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়লে যেমন হয়, আমার ঠিক সেই রকম হল। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো রুমকি আছড়ে পড়ল আমার ওপর। কিছুক্ষণ কী হল বলতে পারব না। তাল তাল মাখনের মধ্যে আমি ডুবে যাচ্ছি। আমি যেন একটা পুডিং। ছোট্ট একটা চেরি ফল আমার ঠোঁটের সামনে। এক ঝাঁক টিয়া বাইরের আকাশে বাতাস-কাঁপানো ডাক ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। পরক্ষণেই সেই প্রাচীন ঘুঘুটার ঘুক ঘুক ডাক। সুন্দর একটা দেহের তলায় চাপা পড়ে আছি। চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। বেলাভূমিতে আঁজলা আঁজলা ঝিনুক ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ। এখন চোখের সামনে সেই ক্ষতস্থান। কোনও এক নেশাকাতর পিতার খোদাই। আর পাশেই রহস্যময় গুহা। বীজ আকারে প্রতিটি মানবসন্তানকে দশমাসের জন্মসাধনা করতে হয়। সুরক্ষিত, শব্দহীন, আলোকহীন সেই নিভৃত। যেখানে খাদ্য আছে, স্নেহ আছে, অদৃশ্য কোনও ভাস্কর আছে। চৈতন্য দিয়ে, সংসার দিয়ে তৈরি করছে মানবদেহ। প্রবেশে পুলকিত আনন্দ, নিমণে কুঁকড়ে যাওয়া যন্ত্রণা। বিরাট জগতের ঝলসে যাওয়া আলোয় ক্রন্দনের ভূমিকায় ভূমিষ্ঠের জীবনকাব্যের শুরু। ঘড়ির টিকটিক। ষাট, সত্তর, আশি।

জানালা খুলে গেল। দরজা উন্মুক্ত। দালানের মেঝেতে খবরের কাগজ। ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেছে রবিদা। রুমকি ঝিনুকের মতো দাঁত বের করে হাসছে। সাদা সালোয়ার, সাদা কামিজ। নরম। সাদা ওড়না।

‘তোমার মুক্তি নেই। অজগরে ধরেছে। তুমি এত বোকা কেন?’

‘এ কথা বললে?’

‘কাকে বিশ্বাস করে বসে আছো? এই তো সেই তৃতীয় ব্যক্তি!’

‘কী বলছ তুমি?’

‘সাচ বাত। কম্বল চাপা দিয়ে আগুন নেভাবার চেষ্টা করছি। দূর থেকে সব হইহই করে আসছে। দিদি একটা কথাই বলতে পেরেছিল—বাঁচাস। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, বাঁচাও বলতে গিয়ে বাঁচাস বলেছে; কিন্তু না; পড়ো এইটা, তোমাকে লিখছিল, শেষ করে ডাকে দেওয়ার সময় পায়নি।’

অসমাপ্ত সেই চিঠি—’শুভ্র, সাবধানে থেকো। যেভাবেই হোক ওরা জেনেছে বেহালার বাক্সটা তোমাদের বাড়িতে আছে। আইনজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে জেনেছে আমি মরলে বিষয়-সম্পত্তি ওই মা নামধারিণী মহিলাটি পাবেন। তোমাকে একটা অদ্ভুত কথা শোনাতে চাই, সুবীর একজন নয় দুজন আমি হয়তো—’ চিঠি আর এগোয়নি।

‘এর মানে?’

‘মানে এই হতে পারে, আইডেন্টিক্যাল টুইন। এক সুবীর যেমন ভালো, আর সুবীর সেইরকম খারাপ। উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু। এইবার ধরো কাল রাতের সুবীর বদলে যদি আর এক সুবীর আসে।’

‘কেন আসবে?’

‘বেহালা উদ্ধারে। সত্তর থেকে আশি লক্ষ টাকার গয়না। সতেরোখানা হিরে, পনেরোখানা রুবি। প্লাস সোনা।’

‘তুমি কী করে জানলে?’

‘এই যে, এই কাগজখানা।’

লম্বা একটা পার্চমেন্ট। গয়নার লিস্ট।

‘তুমি কোথায় পেলে?’

‘চোরের ওপর বাটপারি। এই দ্বিতীয় সুবীর আর কাকাবাবু—এদের একটা ঘাঁটি আছে, নারকেলডাঙার বাগানে।’

‘তুমি কী করে জানলে?’

‘এক সেকেন্ড। আমি আসছি।’

রুমকি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মিনিট পনেরো পর একটি মেয়ে ঘরে এসে বললে ‘হাই।’

চোখে সানগ্লাস, চুল অন্যরকম। জিন্স, টিশার্ট। রুমকি বলে চেনার উপায় নেই।

বললে, ‘বসতে পারি?’

‘হ্যাঁ বসুন।‘

বসেই একটা রিভলভার বের করে আমার দিকে নিশানা করে বললে, ‘যা আছে বের করে দাও।’

ভয় পেয়ে গেছি। ইয়ারকি না সত্যি! দুই সুবীরের গল্প, সত্যি না গল্প!

রুমকি কি ওদের দলের!

‘ভিতু, ভিতু’, হেসে উঠল রুমকি, ‘এটা টয় রিভলভার।’

সানগ্লাসটা চোখ থেকে সরিয়ে বললে, ‘তোমাকে মানুষ করতে আমার অনেক সময় লাগবে। তোমাকে আমার বর করব, না ছেলে করব, বউ হব, না মা হব!’

ধর্মের জগতে একটা কথা—সমর্পণ। রুমকির এই একটি কথায় মনে মনে নিজেকে তার কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দিলুম—কিন্তু, আমি যে তোমাকে চাই, এই একটু আগে যেভাবে পেয়েছিলুম।’

‘থামো, ওটাও আমাকে শেখাতে হবে। আনাড়ি কোথাকার।’

‘তুমি এই মেকআপে কী করো?’

‘ফলো করি। গোয়েন্দাগিরি করি।’

‘এই সাজ নিশ্চয় ওই বাড়িতে বসে করো না?’

‘অবশ্যই না। এজেন্সিতে বসে করি।’

‘অ্যাঁ, সে আবার কী?’

‘দিদি এক ডিটেকটিভ এজেন্সিকে দায়িত্ব দিয়েছিল তার মায়ের রহস্য বের করার জন্যে। চুপিচুপি আমাকে পাঠাত খবর নেওয়ার জন্যে। কর্নেল মুখার্জি একদিন আমাকে বললেন, ঘরের। শত্রু হবে। পারব আমি? নিশ্চয় পারবে। একটাই কায়দা, খুব সহজ হতে হবে। চোখে-মুখে যেন কোনও উদ্বেগ, উত্তেজনা না থাকে। এই ড্রেস তাঁরই দেওয়া। নারকেলডাঙার একটা পোড়ো বাগানে এদের ঘাঁটি। কারবার হল ব্ল্যাকমেল। দিদি মেঝেতে লিখেছিল বিনাশ, ওটা হবে অবিনাশ। ‘অ’টা ঠিকমতো ফোটেনি। এই অবিনাশই দ্বিতীয় সুবীর।’

‘কী কাণ্ড! এখন কোন সুবীর এল বুঝব কী করে?’

‘দেখো, এইরকম যদি হয় প্রথম সুবীর আর এলই না। বেমালুম উধাও করে দিল। তুমি কি জানো এই বাড়ির ওপর নজরদারি আছে? ওয়াচ করছে? তোমাদের আউটহাউসে তাকে ভয় দেখাবার জন্যে যা-তা কাণ্ড করছে। দূর থেকে বেহালার শব্দ ছুঁড়ছে।’

‘কেন? আমার ওপর এত রাগ কেন?’

‘বেহালাটা চাই, বাড়িটাও চাই। ওই বাড়িটাকে কেন্দ্র করে এই পাড়ায় পাপ ঢুকেছে।’

‘আমি এখন কী করব?’

রুমকি গম্ভীর মুখে বললে, ‘বিয়ে করবে।’

‘কাকে?’

‘কাকে আবার, আমাকে।’

‘তোমাকে করব কেন?’

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাই।’

‘কেন ভালোবাস? আমাকে কেউ ভালোবাসতে পারে আমি বিশ্বাস করি না।’

‘যে গুণ থাকলে মেয়েরা ভালোবাসতে পারে, তোমার মধ্যে সেইসব গুণ আছে। সব মেয়েই

তোমাকে ভালোবাসবে সেটাই আমার সমস্যা।’

‘তোমার মতো একটা স্মার্ট মেয়েকে আমার মতো একটা ক্যাবলা কতদিন কাছে রাখতে পারবে, সেটাই আমার ভয়।’

‘তুমি রাখবে কেন, আমিই তো তোমাকে আমার বুকে জড়িয়ে রাখব। আমার কত স্বপ্ন, তবে কী জানো, আমাকে মেরে ফেলতে পারে। অবিনাশযদি আমাকে বিনাশ করে!’

রুমকি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। দেহটাকে চেয়ারে এলিয়ে দিয়েছে। চোখ দুটো আধ বোজা। স্বপ্নের রিলে হচ্ছে, ‘বাগানঘেরা সুন্দর একটা বাংলো। ছোট্ট একটা মোটরগাড়ি, লাল রঙের। কাঠের মেঝে। নরম কার্পেট পাতা বসার ঘর। এক দিকের জানালায় ফরেস্ট, আর দিকের জানালায় পাহাড়। সুন্দর একটা রান্নাঘর। সুন্দর একটা চানঘর। একটা ধ্যানঘর। একটা গোল্ডেন রিট্রিভার কুকুর। ভালো একটা মিউজিক সিস্টেম। আর তোমার মতো একটা তুমি। বাঁচতে বাঁচতে আমরা দুজনে বুড়ো-বুড়ি হয়ে যাব। আমাদের কোনও সন্তান থাকবে না। শীতের রোদে গোলাপ বাগানে গার্ডেন চেয়ারে দুজনে বসে থাকব। আমার হাতে বোনা সাদা পশমের। সোয়েটার তোমার গায়ে। মাথায় বেরে ক্যাপ। কোনও দুশ্চিন্তা নেই, বেয়াড়া কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই। বাইনোকুলার দিয়ে পাখি দেখব। পাহাড়ের দিক থেকে বয়ে আসবে শীতল বাতাস। শীতের পাতা বড় বড় গাছ থেকে খস খস করে ঝরে ঝরে পড়বে।’

সুবীর ফিরে এল।

বেশ আড়ষ্ট হয়ে গেলুম, এ কোন সুবীর!

রুমকি বললে, ‘যাচাই করে নাও।’

সুবীর একটু থতোমতো খেয়ে গেল।

রুমকি বললে, ‘যাচাই হয়ে গেছে, আসল সুবীর।’

জিগ্যেস করলুম, ‘কী ভাবে করলে?’

‘তোমাকে বলেছিল, আমাকে যাচাই করে নিতে। এই যাচাই শব্দটা শুনে সুবীরদা কেমন যেন হয়ে গেল। অবিনাশ হলে বুঝতই না।’

‘তোর যে একজন যমজ ভাই আছে কোনওদিন বলিসনি তো!’

‘আমাদের পরিবারের লজ্জা। আমি ভুলতে চাই। সে এক সমস্যা। হয় সে জেলে যাবে, না হয় আমি যাব। অথবা আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। তোদের দুজনকে আমার একটা আইডেন্টিফিকেশন মার্ক দেখিয়ে রাখি যেটা ওর নেই। এই দেখ আমার কপালের ডানপাশে হেয়ার লাইনের নীচে ছোট্ট একটা কাটমার্ক। ভাঙা কাচ ঢুকে গিয়েছিল। খুব সাবধান, দ্বিতীয় সুবীর যে কোনও সময় আসতে পারে, আর প্রথম সুবীর অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। আমাকে। একজন ফোন করেছিল—বেহালার বাক্সটা কোথায়! যে কোনও দিন এই বাড়িতে হামলা হতে পারে। আমাদের প্রথম কাজ, এই মুহূর্তে হোলার বাক্সটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।’

‘কী ভাবে?’

‘আগুন। আগুনের মতো আর কী আছে! আর সেই কাজটা এখুনি করতে হবে।’

‘অত সুন্দর বাক্সটা!’

‘তোর সবচেয়ে বড় বিপদ কী বল তো—তুই চুরি না করেও চোর।’

‘গয়নাগুলো ফেরত দিয়ে দিলেই তো হয়।’

সুবীর দৃঢ় গলায় বললে, ‘না, ও গয়না চিনুর। তার মানে তোর।’

‘আমি তো চিনুকে বিয়ে করিনি।’

‘করবি! চিনু তো তোর সামনে বসেই আছে।’

চারদিক থেকে কীরকম একটা ভয় ঘিরে আসছে। নারকেলডাঙার যে বন্ধ কারখানায় পোডড়া বাড়ি থেকে সুবীরের যমজ অবিনাশ ‘অপারেট’ করছে, সেই বিখ্যাত স্বদেশী ফ্যাক্টরির ফাউন্ডার ছিলেন সুবীরের ঠাকুরদা। কোন জায়গার কী পরিণতি! পৃথিবীর সব দেশ চেষ্টা করছে এগোতে, আমরা চেষ্টা করছি পেছোতে।

সুবীর বললে, ‘আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।‘

‘কী আইডিয়া?’

‘বেহালার কেসটা লুকিয়ে লুকিয়ে নারকেলডাঙার বাগানে ওদের ঘাঁটিতে রেখে আসব।’

‘কী লাভ?’

‘নিজেদের মধ্যে লাঠালাঠি শুরু হয়ে যাবে। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সন্দেহ করতে থাকবে।’

আমি বললুম, ‘এই উদবেগ, এই অশান্তি এক কথায় মিটে যায়, যদি গয়নাগুলো চিনুর মাকে দিয়ে আসি। কারণ চিনুর মৃত্যুর পর সমস্ত কিছুর মালিক চিনুর মা।’

রুমকি বললে, ‘অসম্ভব! এমনও তো হতে পারে গয়নাগুলো তোমার দাদুর কাছে বাঁধা রেখে টাকা ধার নিয়েছিল? এমনও তো হতে পারে ওর মধ্যে তোমাদের গয়নাও আছে। এটা কাঁচা প্রস্তাব?’

সুবীর চান করতে গেল।

রুমকি হঠাৎ বললে, ‘সুবীর একজন না দুজন?

‘মানে?’

‘আমার সন্দেহ হচ্ছে।’

রুমকি ফিশফিশ করে তার সন্দেহের কথা জানাচ্ছে। ‘দেখো, এমনও তো হতে পারে, একটা লোক ডবল রোল প্লে করছে।’

‘সন্দেহের কারণ?

‘সিনেমায় সীতা ঔর গীতা হয়, বাস্তবে দেখেছ?’

‘না। তবে ভ্রান্তিবিলাস পড়েছি।’

সন্দেহের দ্বিতীয় কারণ, আঙুলের আংটি। একেবারে একই আংটি দুজনের আঙুলে থাকতে পারে কি? তৃতীয় কারণ, বেহালার বাক্সটা বাগাতে চাইছে, কারণ ওইটা হল রশিদ। সবচেয়ে বড়ো বিপদ, তোমরা দুজনে গিয়ে লকারে গয়নাগুলো রেখে এসেছ। সুবীর কী ব্যবসা করে? সে। ব্যবসা কেমন চলে? তুমি জানো কিছু?

‘না।’

‘একালে মানুষকে বিশ্বাস করা শুধু বোকামি নয় বিপদেরও কারণ। আমি কে? আমাকে এতটা বিশ্বাসের কারণ? যে-মেয়ে এক কথায় অজানা এক পুরুষের সামনে সব খুলে দাঁড়াতে পারে সে কি ভালো মেয়ে? তুমি আমাকে বিশ্বাস করলে, তোমার বন্ধু আমাকে যাচাই করে নিতে বলল। কেন? তুমি সরল, সে সন্দিগ্ধ। সে ব্যবসাদার।’

সুবীর আসছে। রুমকি রান্নাঘরে চলে গেল। সুবীরের সঙ্গে কোনও কথা না বলে আমি বাথরুমে স্নানে ঢুকে গেলুম। বাথরুমের মতো নিভৃত চিন্তার জায়গা দ্বিতীয় নেই। চিনু মারা গেল আগুনে পুড়ে। পোস্টমর্টেমে সন্দেহজনক কিছু নেই। এখানেই তো সব মিটে যেতে পারত! একটি মেয়ে এল। সঙ্গে নিয়ে এল একগাদা সমস্যা ও সন্দেহ। বন্ধু বিচ্ছেদের উপক্রম। এখন মনে হচ্ছে, বাড়ির কোথায় কী আছে দেখার জন্যে সুবীরের এত উৎসাহ কেন?

আমরা যখন একসঙ্গে খেতে বসলুম, সুবীরকে কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক দেখাল। খেয়ে উঠে জামা-প্যান্ট পরে বেরোবার সময় বললে, ‘আমি ব্যবসার কাজে দিন পনেরোর জন্যে বাইরে। যাচ্ছি শুভ্র! তুই এদিকটা ম্যানেজ কর। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ চলে গেল!

আমি আর রুমকি বেশ অবাক হয়ে বসে রইলুম কিছুক্ষণ।

রুমকি বললে, ‘চলো, অলক্ষুণে বেহালার বাক্সটা পোড়াই। তুমি ওটাকে টুকরো টুকরো করে দাও, আমি কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দি।’

সৎকার করার আগে সেই অপূর্ব সুন্দর বাক্সটা একবার খুললুম। ভেতরে একটা ভাঁজ করা কাগজ। ‘কী আশ্চর্য! এটা আবার কী?’

রুমকি বললে, ‘ছিল না?’

‘না।’

‘খোলো। খুলে দেখ।’

একটা চিঠি।

শুভ্র, এ আমার স্বীকারোক্তি। আমিই সুবীর, আমিই অবিনাশ। চিনুর মৃত্যুর জন্যে আমিই দায়ী। চিনুকে আমি পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে তোকে ছাড়া আর কিছু চাইত না। আমার ঈর্ষা তাকে প্রাণদণ্ড দিল। অবিনাশ নামে ওই বাড়িতে আমার প্রবল প্রতিপত্তি ছিল। ওর মায়ের সঙ্গে আমার বিশ্রী একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দোষটা আমার নয় ওই মহিলার। কাকাবাবু অসুস্থ মানুষ। বাইপাস হয়ে গেছে। লোকটার আর কিছু নেই।

মা যে মেয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে, শুনেছি, এই প্রথম দেখলুম। যে-রাতে চিনু আমাকে

জুতো মারলে, সেই রাতেই আমার প্রতিশোধস্পৃহা প্রবল হল। একাধিক রাত আমি ওদের বাড়িতে থেকে দেখেছিলুম, সকালের চা চিনু নিজেই করে। অনেক মাথা খাঁটিয়ে একটু ফুলপুফ প্ল্যান বের করলুম। এমন বরাত, লেগে গেল। খুব ভোরে উঠে খানিকটা মোবিল রান্নাঘরের মেঝেতে কায়দা করে ফেলে রাখলুম। সন্দেহটা যাতে তৃতীয় কারও দিকে যায়, তার জন্যে একটা হেঁয়ালি চিরকুট লিখে ওর মায়ের বালিশের ভেতর রাখলুম। আমি ত্রিসীমানায় আর থাকলুম না। মোবিলে পা স্লিপ করে ওর মায়ের হাত থেকে বাসন পড়ল, চিনু পা হড়কে গ্যাসের ফ্লেমের ওপরে পড়ে সবসুদ্ধ নিয়ে মেঝেতে। বীভৎস! রাতের ঘুম চলে গেল। আমি এখন অন্য ঘুমের কোলে চলে যাচ্ছি। তুই যদি এই স্বীকারোক্তি নিয়ে থানায় যাস, আমাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তোর প্রেমিকা, তোর বাড়ি—দুটোর ওপরেই আমার লোভ ছিল। ভূতের উপদ্রব আমার প্ল্যান, আউটহাউসের যত কাণ্ড আমি করিয়েছি।

একটা শক্তিরূপিণী মেয়ে তোর জীবনে হঠাৎ এসে পড়ায় তুই জোর বাঁচা বেঁচে গেলি শুভ্র। আমার ভয়ঙ্কর, ভয়ঙ্কর সব প্ল্যান ছিল। আমি জানতুম তুই ফরেস্টে যাবি, আর তখনই ওই প্রাসাদের মতো বাড়িটা আমার দখলে এসে যাবে। চিনু কিন্তু খুব বিশ্বাসযোগ্য মেয়ে ছিল না। রাগী, অহংকারী, বিলাসী, খুঁতখুঁতে। সে আমাকে ধরে ফেললেও উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে যাচ্ছি, রুমকি দেবী। দেবী দুর্গা। তোদের জীবনে সুখ আসুক।

আর একটা আশ্চর্য কথা বলে যাই, গয়নাগুলো সব রুমকির। রুমকির মা জমিদারের মেয়ে ছিলেন। স্বামীর অবস্থা দেখে গয়নাগুলো তোর দাদুর কাছে রেখেছিলেন। তারপর এল সেই দুর্যোগ। বোলপুরের কাছে রেললাইনে যে অজ্ঞাত পরিচয় মহিলা কাটা পড়েছিলেন, তিনি। রুমকির মা।

দেখ, কী মজার ব্যাপার, ভদ্রমহিলা কেমন না জেনেই ঠিক জায়গায় মেয়ের বিয়ের গয়না রেখে গিয়েছিলেন, পাত্রটিও তুলনাহীন ভালো। তিনি ওপর থেকে দেখে সুখী হবেন, আশীর্বাদ করবেন নিশ্চয়! ভগবান আছেন, কী বলিস শুভ্র! গয়নাগুলো কিন্তু আমার আবিষ্কার। বিদায়! তোদের ঘৃণাই আমার পাথেয়। একটা হিরের আংটি বাথরুমের সোপকেসে রইল। ঘৃণ্য অপরাধীর প্রীতি উপহার।

সুবীর।

রুমকির চোখে জল। আমার ভেতরটাও কেমন যেন থমথম করছে। না, ভাবব না। কিছুই ভাবব না। ভাবনা খুব খারাপ জিনিস। আমার মা বলতেন—সমর্পণ। ঠাকুরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দে।

হঠাৎ রুমকি তেড়েফুঁড়ে উঠল, ‘আজ পূর্ণিমা। আজই আমরা বিয়ে করব।’

‘সে কী, পুরোহিত পাব কোথায়?’

‘নিজেদের বিয়ে আমরা নিজেরাই করব। তুমি অনেক ফুল আর মালা কিনে আনো। মায়ের ছবির সামনে। চাঁদ সাক্ষী।‘ বিছানায় থইথই চাঁদের আলো। সাদা সাদা ফুল, মালা, সুরভি। রুমকির সুন্দর কপালে সোনার টিপ। তার ওপর চাঁদের আলো। রুদ্ধগলায় বললে, ‘যেদিন তোমার কাছে এলুম, সেদিন সুবীরদা ওই ওই পাশটায় শুয়েছিল।’ সেই বেহালা আজ আবার বাজছে। কে! কে বাজায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *