1 of 2

আমার সামনে পথ তোমার সামনে দেয়াল

আমার সামনে পথ তোমার সামনে দেয়াল

আমার কেউ কোথাও নেই। একেবারে নিঃসঙ্গ। আমি আছি আর আমার সামনে বৈরী এক পৃথিবী। মুদিওলার মতো টাটে বসে আছে সামনে পাল্লা ঝুলিয়ে। মুখে লেখা আছে, ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল, আমি কি তোমার পর।’ আমার শিক্ষা নেই, দীক্ষা নেই, তেমন কোনও বংশ পরিচয় নেই। এমন কোনও পুঁজি নেই যা আমি ভাঙিয়ে খেতে পারি। শুধু একটা শরীর আছে, আর সেই শরীরে আছে একটি মন। আছে আর পাঁচজনের মতো বেঁচে থাকার ইচ্ছা। দুটো চলতে পারে। আমাকে চালাতে পারে। হাত দুটো ভাঙতে পারে, গড়তে পারে। সহজাত একটা বুদ্ধিবৃত্তি আছে, যা পড়ে শিখছে না, দেখে শিখছে।

এমন একটা অবস্থার কথা ভাবতেও ভয় লাগে। বুক কেঁপে ওঠে। আমি বেড়াল, কি কুকুর হলে এসব ভাবতুম না। নির্জন দুপুরে আমাদের গলিতে লম্বা, লম্বা ছায়া পড়েছে। শুকনো জলের কল। জল আসার আগেই সার সার রংচটা প্লাস্টিকের বালতির লাইন পড়ে গেছে। দুহাত, তিন হাত অন্তর অন্তর ছাই আর আবর্জনার টিবি চড়া আলোয় ক্যাট ক্যাট করছে। হঠাৎ কোথা থেকে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে একটা কুকুর এসে ছাই ঢিবি শুঁকতে লাগল। দেখেই মনে হল বহুদিন তেমন আহারাদি হয়নি। শীর্ণ হয়ে গেছে। সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত। চোখে অদ্ভুত এক ভীত দৃষ্টি। হঠাৎ কোথা থেকে তেড়ে এল হোমদা হোমদা আরও গোটা দুই কুকুর। শুরু হয়ে গেল তর্জন-গর্জন। সমবেত আক্রমণ। কামড়াকামড়ি। কুকুরটা ন্যাজ গুটিয়ে পালাল।

কুকুরের পৃথিবী আর মানুষের পৃথিবীতে বিশেষ তফাত নেই। প্রায় একই নিয়মে চলেছে। কুকুরের ভাষা নেই, মানুষের ভাষা আছে। মানুষ বেরোও বলতে পারে। শুয়োরের বাচ্ছা বলতে পারে। কোটে কেস ঠুকে মায়ের পেটের ভাইকে ভিটেছাড়া করতে পারে। একজন আর একজনের পেছনে লেগে জীবিকাচ্যুত করতে পারে। কলের সামনে জলের লাইনে শক্তিমান ঠ্যাঙা হাতে এসে একজনের লাশ ফেলে নিজের বালতিটিকে শেষ থেকে প্রথম আনতে পারে। এই নাকি ‘রুল অফ দি গেম।’

এক মানব আর মানবী কোনও এক শ্রাবণের রাতে জৈব নিয়মে শরীরে শরীর রেখেছিল। আর ঠিক দশটি মাসের ব্যবধানে কেঁদে উঠল আর এক মানব সন্তান। রাজারও ছেলে হয়, ভিখিরিরও হয়। কেউ ঠেকাতে পারে না। অসংখ্য যোনি জীব যন্ত্রণায় ছটফট করছে। জন্মের ওপর জাতকের নিজস্ব কোনও ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই। কে কোথায় এসে পড়ব একেবারেই অজানা। আমাদের শৈশব বড় অনিশ্চিত। নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কত কী ঘটে যেতে পারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেও ভাগ্যকে মানতেই হয়। যে সংসারে জন্মেছি বড়লোকের খেয়ালে সে সংসার ভেঙে যেতে পারে। জমিদার কি শিল্পপতি পিতা, মদ আর মেয়েমানুষের পেছনে সব উড়িয়ে দিলেন। উত্তরপুরুষের জন্যে নীলরক্তের অহংকার ছাড়া আর কিছুই রইল না। শৈশব চলে গেল

অবহেলায়। যৌবন জীবনের সঙ্গে লড়াইয়ের নামটি গলায় তকমা হয়ে ঝুলছে। কারু করুণা নয়, ঘৃণাই তখন জীবনের সম্বল। হতাশাই তখন ভূষণ। মধ্যাহ্নেই আঁধার ঘনিয়ে এল। বীরভোগ্যা। পৃথিবীর যাবতীয় আয়োজনের মাঝে শুষ্ক, শীর্ণ, পত্রবিরল একটি বৃক্ষের ডালপালায় নীল আকাশ অতি ধূসর। পাখি আসে না। পায়ের তলায় পথিকের জন্যে ছায়া পড়ে থাকে না। বর্ষার সঞ্চিত। জলধারা তুলে নিতে পারে না। অপ্রস্তুত শিকড়।

এমনও হতে পারত মাতা তার অবাঞ্ছিত শিশুটিকে আবর্জনায় নিক্ষেপ করে মাতৃত্বের দায় মুক্ত হলেন। ক্রন্দনই যার পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণে একমাত্র ক্ষমতা, সে হয়তো সেই কান্না দিয়েই একটি প্রাণের উপস্থিতির কথা জানাল কোনও দয়ালুর কাছে, আবর্জনা থেকে উঠল গিয়ে। দোলায়। এমন আর কটি পরিত্যক্ত শিশুর বরাতে ঘটে! অন্ধকার এলাকার পরিসর অনেক বেশি। অন্ধকারের নায়করা আলোর সেনাপতিদের অতি সহজেই কিনতে পারে। সংসার-স্নেহে যারা সুরক্ষিত তারাও তো ছিটকে বেরিয়ে যায়! আর যারা একেবারেই অসহায় অপরাধ জগতের অক্টোপাস তাদের তো ধরবেই। অমৃতের পুত্র গরল-পুত্র হয়ে মানুষের শুভ প্রচেষ্টাকে বানচাল করে দিতে চায়।

পৃথিবী বড় অনিশ্চিত স্থান। আকস্মিকতায় ভরা। কার ভাগ্যে কখন কী ঘটে যাবে কিছুই জানা নেই। উত্তরপুরুষ পূর্বপুরুষের অবস্থার দিকে তাকিয়ে কোনও দিনই বলতে পারে না, তুমি নিজেই পরাজিত, ক্রীতদাসের সংখ্যা, পথের পাশে পড়ে থাকা ভিখিরির সংখ্যা আর না-ই বা বাড়ালে। পৃথিবীর ভাগ-বাঁটোয়ারা বহু বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। রাজা থেকে রাজা বেরোবে। প্রজা থেকে প্রজা। ভূস্বামীর বীজ থেকে অঙ্কুরিত হবে আর এক ভূস্বামী। দিনমজুর সংখ্যায় বেড়ে দিনমজুরই হবে। দার্শনিক অথবা সমাজ সংস্কারকের হাতে কিছু নেই। অক্ষরের মালা গেঁথে পৃথিবীর পুরোনো চেহারা পালটান যাবে না। অসিমুখে পৃথিবী ফালাফালা হয়ে গেছে। পাট্টা আর পত্তনি নিয়ে যে যেখানে ঘাঁটি আগলে বসে আছে, সে সেখানেই বসে থাকবে। পুরুষানুক্রমে। বিনা রণে সূচ্যগ্র স্বার্থ কেউ ছাড়বে না। তুমি কিছু চাও! একখণ্ড রুটি তোমার মুখের সামনে ছুড়ে দিতে পারি—দয়ার দান। কিন্তু খানার টেবিলটি আমার। কে বলে এটা মানুষের পৃথিবী! পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদকে মানুষের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে যে ভাগফল বেরোবে তা প্রতিটি মানুষের ভাগ্যফল হতে পারে না। প্রশ্ন কোরো না, কে তোমাকে ঐশ্বর্যের অধিকার দিয়েছে! ঈশ্বর! না ইতিহাস?

অধিকার থেকে গড়িয়ে চলেছে উত্তরাধিকারের স্রোতধারা। ইতিহাস হল অধিকারের ইতিহাস। অধিকার হারাবার ইতিহাস। শোণিতের ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে ভয়। তক্তে বসিয়ে যাই। উত্তরপুরুষকে। জীবনভর তারই প্রস্তুতি। আমি অধিকার করেছি। তুমিও অধিকার করো। আমার অধিকার মানে তোমার বঞ্চনা। ইতিহাসের দুটি ধারা—অধিকারের ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস। তোমার প্রতি আমার যত দয়া আর করুণা সবই হল অধিকারীর অহংকার। পৃথিবীর দুটি মাত্র খেতাব হওয়া উচিত, অধিকারী আর অনধিকারী। উইলসন, নেলসন, রকিফেলার, চট্টোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, ঘোষ, বোস, মিত্তির নয়।

অনধিকারীরা আছে বলেই, অধিকারীদের এত বিলাস। চায়ের দোকানের বয়, গৃহের গৃহভৃত্য। আমার সম্পদ ঠাসা সুদশ্য ব্যাগ তোমার মাথায়। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া আমার পুত্রের হাত। তোমার হাতে। আমার মোজাইক করা মেঝেতে তোমার হাতের ন্যাতার দুবেলা ঘর্ষণ। আমার স্ত্রী-র ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রূপচর্চা তোমারই শ্রমের দান। আমার। সন্তুষ্টিই তোমার বেঁচে থাকার প্রাণরস। আমার অতীত ছিল বলেই বর্তমান আছে। বর্তমান আছে বলেই ভবিষ্যৎ তৈরি হচ্ছে। তোমার বর্তমান নেই, ভবিষ্যৎও নেই। আমার সামনে পথ তোমার সামনে দেয়াল।

যুগে যুগে অনেকেই এলেন, পৃথিবীর আদি বিলিব্যবস্থা কিন্তু বদলানো গেল না। এখানে নয়, কোথাও নয়। কত ইজম এল আর গেল। ছাপাখানা কোটি কোটি অক্ষর প্রসব করে গেল। লক্ষ লক্ষ কথামালা ইথার তরঙ্গে ভেসে গেল। হল না কিছুই।

আকাশছোঁয়া ইমারত উঠে গেল আকাশের দিকে। ফোর্ড থেকে ডাটসন। ভল্ল আর বর্ম থেকে মিরাজ, ফ্যান্টম, আণবিক ক্ষেপনাস্ত্র। বিদেশি শোষকের বদলে স্বদেশী শোষক। টিবির বদলে ক্যানসার। কলেরার বদলে জন্ডিস। অনাহার নাম পালটে সভ্য ম্যালনিউট্রিশান।

লাখ লাখ পিএইচডি, ডি লিট তবু বধূর গায়ে কেরোসিন, গলায় শাড়ি। নাটকে বিস্ফোরণ, যাত্রায় রণহুঙ্কার, সংগীতে সমুদ্রের দোলা, গণনৃত্য, গণমিছিল আবার গণধর্ষণ। টাই আঁটা সেমিনার ফাইলবাঁধা রিপোর্ট। সাপের সেই একই সর্পিল চলন, লাঠির সেই একই উদ্যত ভঙ্গি। কেউ কাউকে স্পর্শ করে না। আমসত্ব দুধে ফেলি /তাহাতে কদলি দলি/ পিপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে। অধিকারীর জগতে অধিকারীর আইনই সাব্যস্ত। অনধিকারীদের শুধু মেনে নেওয়া আর মানানো। পৃথিবী এক অদ্ভুত স্থান।

এই সবুজ শ্যামল ভূখণ্ড
আর অগাধ জলরাশি,
অথবা ধু ধু মরু
আর শিলা সারি সারি
ঞ্চল আলোকিত জনপদ
অন্ধকার গ্রাম আর নিবিড় বনানী
আমরা সবাই জানি।
পর্যটক ঘুরে ঘুরে সবই দেখেছে।
পৃথিবীতে আর কোনো স্থান নেই
যেখানে কলম্বাস দিতে পারে পাড়ি।
এইবার!
আর এক পৃথিবীর খবর
আমি দিতে পারি
এই গোলকেরই আদলে
কায়ার পাশে ছায়ার মতো
মহাশূন্যে ভাসছে।
এই পৃথিবীরই এক ছায়া ছায়া
বিষণ্ণ বীভৎস রূপ
সেখানে হায়নারা ধরেছে
মানুষের কায়া
তস্কর পরেছে সাধুর বেশ,
জননী ডাকিনী সেজে
সন্তানের শোণিতে করে
তৃষ্ণা নিবারণ।
সে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল
দূষিত বাষ্পে ভরা
সেখানে চুম্বন শুধু
মৃত্যুর নিশানা
আমি সেইনভোচর
মহাশূন্যে নভোযান থেকে
রাতে,
দেখেছি সেই ছায়া ছায়া
বিষাক্ত দ্বিপদে ভরা
ধূমায়িত আর এক পৃথিবী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *