১৮.আরণ্যক – অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ (সমাপ্ত)

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ


এখান হইতে চলিয়া যাইবার সময় আসিয়াছে। একবার ভানুমতীর সঙ্গে দেখা করিবার ইচ্ছা প্রবল হইল। ধন্‌ঝরি শৈলমালা একটি সুন্দর স্বপ্নের মতো আমার মন অধিকার করিয়া আছে… তাহার বনানী … তাহার জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রি …

সঙ্গে লইলাম যুগলপ্রসাদকে।

তহসিলদার সজ্জন সিং-এর ঘোড়াটাতে যুগলপ্রসাদ চড়িয়াছিল- আমাদের মহালের সীমানা পার হইতে না-হইতেই বলিল-হুজুর, এ ঘোড়া চলবে না, জঙ্গলের পথে রহল চাল ধরলেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে আমারও পা খোঁড়া হবে। বদলে নিয়ে আসি।

তাহাকে আশ্বস্ত করিলাম। সজ্জন সিং ভালো সওয়ার, সে কতবার পূর্ণিয়ায় মকদ্দমা তদারক করিতে গিয়াছে এই ঘোড়ায়। পূর্ণিয়া যাইতে হইলে কেমন পথে যাইতে হয় যুগলপ্রসাদের তাহা অজ্ঞাত নয় নিশ্চয়ই।

শীঘ্রই কারো নদী পার হইলাম।

তারপর অরণ্য, অরণ্য- সুন্দর অপূর্ব ঘন নির্জন অরণ্য! পূর্বেই বলিয়াছি এ-জঙ্গলে মাথার উপরে গাছপালার ডালে ডালে জড়াজড়ি নাই- কেঁদচারা, শালচারা, পলাশ, মহুয়া, কুলের অরণ্য- প্রস্তরাকীর্ণ রাঙা মাটির ডাঙা, উঁচু-নিচু। মাঝে মাঝে মাটির উপর বন্য হস্তীর পদচিহ্ন। মানুষজন নাই।

হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম লবটুলিয়ার নূতন তৈরি ঘিঞ্জি কুশ্রী টোলা ও বস্তি এবং একঘেয়ে ধূসর, চষা জমি দেখিবার পরে। এ-রকম আরণ্য প্রদেশ এদিকে আর কোথাও নাই।

এই পথের সেই দুটি বন্য গ্রাম- বুরুডি ও কুলপাল- বেলা বারোটার মধ্যেই ছাড়াইলাম। তার পরেই ফাঁকা জঙ্গল পিছনে পড়িয়া রহিল- সম্মুখে বড় বড় বনস্পতির ঘন অরণ্য। কার্তিকের শেষ, বাতাস ঠাণ্ডা- গরমের লেশমাত্রও নাই।

দূরে দূরে ধন্‌ঝরি পাহাড়শ্রেণী বেশ স্পষ্ট হইয়া ফুটিল।

সন্ধ্যার পরে কাছারিতে পৌঁছিলাম। যে বিড়িপাতার জঙ্গল আমাদের স্টেট নিলামে ডাকিয়া লইয়াছিল, এ-কাছারি সেই জঙ্গলের ইজারাদারের!

লোকটা মুসলমান, শাহাবাদ জেলায় বাড়ি। নাম আবদুল ওয়াহেদ। খুব খাতির করিয়া রাখিয়া দিল। বলিল- সন্ধের সময় পৌঁছেছেন, ভালো হয়েছে বাবুজী। জঙ্গলে বড় বাঘের ভয় হয়েছে।

নির্জন রাত্রি।

বড় বড় গাছে শন্ শন্ করিয়া বাতাস বাধিতেছে।

কাছারির বারান্দায় বসিবার ভরসা পাইলাম না কথাটা শুনিয়া।

ঘরের মধ্যে জানালা খুলিয়া বসিয়া গল্প করিতেছি-হঠাৎ কি একটা জন্তু ডাকিয়া উঠিল বনের মধ্যে। যুগলকে বলিলাম- কি ও?
যুগল বলিল- ও কিছু না, হুড়াল। অর্থাৎ নেকড়ে বাঘ।

একবার গভীর রাত্রে বনের মধ্যে হায়েনার হাসি শোনা গেল-হঠাৎ শুনিলে বুকের রক্ত জমিয়া যায় ভয়ে, ঠিক যেন কাশরোগীর হাসি, মাঝে মাঝে দম বন্ধ হইয়া যায়, মাঝে মাঝে হাসির উচ্ছ্বাস।

পরদিন ভোরে রওনা হইয়া বেলা ন-টার মধ্যে দোবরু পান্নার রাজধানী চক্‌মকিটোলায় পৌঁছানো গেল। ভানুমতী কি খুশি আমার অপ্রত্যাশিত আগমনে! তার মুখ-চোখে খুশি যেন চাপিতে পারিতেছে না, উপচাইয়া পড়িতেছে।

-আপনার কথা কালও ভেবেছি বাবুজী। এতদিন আসেন নি কেন?

ভানুমতীকে একটু লম্বা দেখাইতেছে, একটু রোগাও বটে। তা ছাড়া মুখশ্রী আছে ঠিক তেমনি লাবণ্যভরা, সেই নিটোল গড়ন তেমনি আছে!

-নাইবেন তো ঝরনায়? মহুয়া তেল আনব না কড়ুয়া তেল? এবার বর্ষায় ঝরনায় কি সুন্দর জল হয়েছে দেখবেন চলুন।

আর একটা জিনিস লক্ষ্য করিয়া আসিতেছি- ভানুমতী ভারি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সাধারণ সাঁওতাল মেয়েদের সঙ্গে তার সেদিক দিয়া তুলনাই হয় না- তার বেশভূষা ও প্রসাধনের সহজ সৌন্দর্য ও রুচিবোধই তাহাকে অভিজাতবংশের মেয়ে বলিয়া পরিচয় দেয়।

যে-মাটির ঘরের দাওয়ায় বসিয়া আছি, তাহার উঠানের চারিধারে বড় বড় আসান ও অর্জুন গাছ। এক ঝাঁক সবুজ বনটিয়া সামনের আসান গাছটার ডালে কলরব করিতেছে। হেমন্তের প্রথম, বেলা চড়িলেও বাতাস ঠাণ্ডা। আমার সামনে আধ মাইলেরও কম দূরে ধন্‌ঝরি পাহাড়শ্রেণী, পাহাড়ের গা বাহিয়া নামিয়া আসিয়াছে চেরা সিঁথির মতো পথ-একদিকে অনেক দূরে নীল মেঘের মতো দৃশ্যমান গয়া জেলার পাহাড়শ্রেণী।

বিড়ির পাতার জঙ্গল ইজারা লইয়া এই শান্ত জনবিরল বন্য প্রদেশের পল্লবপ্রচ্ছায় উপত্যকার কোনো পাহাড়ী ঝরনার তীরে কুটির বাঁধিয়া বাস করিতাম চিরদিন! লবটুলিয়া তো গেল, ভানুমতীর দেশের এ-বন কেহ নষ্ট করিবে না। এ-অঞ্চলে মরুমকাঁকর ও পাইওরাইট্ বেশি মাটিতে, ফসল তেমন হয় না- হইলে এ-বন কোন্ কালে ঘুচিয়া যাইত। তবে যদি তামার খনি বাহির হইয়া পড়ে, সে স্বতন্ত্র কথা…

তামার কারখানার চিমনি, ট্রলি লাইন, সারি সারি কুলিবস্তি, ময়লা জলের ড্রেন, এঞ্জিনঝাড়া কয়লার ছাইয়ের স্তূপ- দোকানঘর, চায়ের দোকান, সস্তা সিনেমায় ‘জোয়ানী-হাওয়া’ ‘শের শমশের’ ‘প্রণয়ের জের’ (ম্যাটিনিতে তিন আনা, পূর্বাহে¦ আসন দখল করুন)-দেশী মদের দোকান, দরজির দোকান। হোমিও ফার্মেসি (সমাগত দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়)। আদি ও অকৃত্রিম আদর্শ হিন্দু হোটেল।

কলের বাঁশিতে তিনটার সিটি বাজিল।

ভানুমতী মাথায় করিয়া এঞ্জিনের ঝাড়া কয়লা বাজারে ফিরি করিতে বাহির হইয়াছে-ক-ই-লা চা-ই-ই-চার পয়সা ঝুড়ি।

ভানুমতী তেল আনিয়া সামনে দাঁড়াইল। ওদের বাড়ির সবাই আসিয়া আমাকে নমস্কার করিয়া ঘিরিয়া দাঁড়াইল। ভানুমতীর ছোট কাকা নবীন যুবক জগরু একটা গাছের ডাল ছুলিতে ছুলিতে আসিয়া আমার দিকে চাহিয়া হাসিল। এই ছেলেটিকে আমি বড় পছন্দ করি! রাজপুত্রের মতো চেহারা ওর, কালোর উপরে কি রূপ! এদের বাড়ির মধ্যে এই যুবক এবং ভানুমতী, এদের দুজনকে দেখিলে সত্যই যে ইহারা বন্য জাতির মধ্যে অভিজাতবংশ, তা মনে না হইয়া পারে না।

বলিলাম-কি জগরু, শিকার-টিকার কেমন চলেছে?

জগরু হাসিয়া বলিল-আপনাকে আজই খাইয়ে দেব বাবুজী, ভাববেন না। বলুন কি খাবেন, সজারু না হরিয়াল, না বনমোরগ?
স্নান করিয়া আসিলাম। ভানুমতী নিজের সেই আয়নাখানি (সেবার যেখানা পূর্ণিয়া হইতে আনাইয়া দিয়াছিলাম) আর একখানা কাঠের কাঁকুই চুল আঁচড়াইবার জন্য আনিয়া দিল।

আহারাদির পর বিশ্রাম করিতেছি, বেলা পড়িয়া আসিয়াছে, ভানুমতী প্রস্তাব করিল- বাবুজী চলুন, পাহাড়ে উঠবেন না! আপনি তো ভালবাসেন।

যুগলপ্রসাদ ঘুমাইতেছিল, সে ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিলে আমরা বেড়াইবার জন্য বাহির হইলাম। সঙ্গে রহিল ভানুমতী, ওর খুড়তুতো বোন- জগরু পান্নার মেজ ভাইয়ের মেয়ে, বছর বারো বয়স- আর যুগলপ্রসাদ।

আধ মাইল হাঁটিয়া পাহাড়ের নিচে পৌঁছিলাম।

ধন্‌ঝরির পাদমূলে এই জায়গায় বনের দৃশ্য এত অপূর্ব যে, খানিকটা দাঁড়াইয়া দেখিতে ইচ্ছা করে। যেদিকে চোখ ফিরাই সেদিকেই বড় বড় গাছ, লতা, উপল-বিছানো ঝরনার খাদ, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছোট-বড় শিলাস্তূপ। ধন্ঝরির দিকে বন ও পাহাড়ের আড়ালে আকাশটা কেমন সরু হইয়া গিয়াছে, সামনে লাল কাঁকুরে মাটির রাস্তা উঁচু হইয়া ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়া পাহাড়ের ও-পারের দিকে উঠিয়াছে, কেমন খট্খটে শুকনো ডাঙা মাটি, কোথাও ভিজা নয়, স্যাঁতসেঁতে নয়। ঝরনার খাদেও এতটুকু জল নাই।

পাহাড়ের উপরে ঘন বন ঠেলিয়া কিছুদূর উঠিতেই কিসের মধুর সুবাসে মনপ্রাণ মাতিয়া উঠিল, গন্ধটা অত্যন্ত পরিচিত-প্রথমটা ধরিতে পারি নাই, তারপরে চারিদিকে চাহিয়া দেখি-ধন্ঝরি পাহাড়ে যে এত ছাতিম গাছ তাহা পূর্বে লক্ষ্য করি নাই-এখন প্রথম হেমন্তে ছাতিম গাছে ফুল ধরিয়াছে, তাহারই সুবাস।

সে কি দু-চারটি ছাতিম গাছ! সপ্তপর্ণের বন, সপ্তপর্ণ আর কেলিকদম্ব-কদম্বফুলের গাছ নয়, কেলিকদম্ব ভিন্নজাতীয় বৃক্ষ, সেগুনপাতার মতো বড় বড় পাতা, চমৎকার আঁকাবাঁকা ডালপালাওয়ালা বনস্পতিশ্রেণীর বৃক্ষ।

হেমন্তের অপরাহে¦র শীতল বাতাসে পুষ্পিত বন্য সপ্তপর্ণের ঘন বনে দাঁড়াইয়া নিটোল স্বাস্থ্যবতী কিশোরী ভানুমতীর দিকে চাহিয়া মনে হইল, মূর্তিমতী বনদেবীর সঙ্গলাভ করিয়া ধন্য হইয়াছি- কৃষ্ণা বনদেবী। রাজকুমারী তো ও বটেই! এই বনাঞ্চল, পাহাড়, ওই মিছি নদী, কারো নদীর উপত্যকা, এদিকে ধন্ঝরি ওদিকে নওয়াদার শৈলশ্রেণী- এই সমস্ত স্থান একসময়ে যে পরাক্রান্ত রাজবংশের অধীনে ছিল, ও সেই রাজবংশের মেয়ে-আজ ভিন্ন যুগের আবহাওয়ায় ভিন্ন সভ্যতার সংঘাতে যে রাজবংশ বিপর্যস্ত, দরিদ্র, প্রভাবহীন-তাই আজ ভানুমতীকে দেখিতেছি সাঁওতালী মেয়ের মতো। ওকে দেখিলেই অলিখিত ভারতবর্ষের ইতিহাসের এই ট্র্যাজিক অধ্যায় আমার চোখের সামনে ফুটিয়া ওঠে।

আজকার এই অপরাহ্নটি আমার জীবনের আরো বহু সুন্দর অপরাহ্নের সঙ্গে মিলিয়া মধুময় স্মৃতির সমারোহে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল-স্বপ্নের মতো মধুর, স্বপ্নের মতোই অবাস্তব।

ভানুমতী বলিল-চলুন, আরো উঠবেন না?

-কি সুন্দর ফুলের গন্ধ বল তো! একটু বসবে না এখানে? সূর্য অস্ত যাচ্ছে, দেখি-

ভানুমতী হাসিমুখে বলিল-আপনার যা মর্জি বাবুজী। বসতে বলেন এখানে বসি। কিন্তু জ্যাঠামশায়ের কবরে ফুল দেবেন না? আপনি সেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন, আমি রোজ পাহাড়ে উঠি ফুল দিতে। এখন তো বনে কত ফুল।

দূরে মিছি নদী উত্তরবাহিনী হইয়া পাহাড়ের নিচে দিয়া ঘুরিয়া যাইতেছে।

নওয়াদার দিকে যে অস্পষ্ট পাহাড়শ্রেণী, তারই পিছনে সূর্য অস্ত গেল। সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি হাওয়া আরো শীতল হইল। ছাতিম ফুলের সুবাস আরো ঘন হইয়া উঠিল, ছায়া গাঢ় হইয়া নামিল শৈলসানুর বনস্থলীতে, নিন্মের বনাবৃত উপত্যকায়, মিছি নদীর পরপারের গণ্ড-শৈলমালার গাত্রে।

ভানুমতী একগুচ্ছ ছাতিম ফুল পাড়িয়া খোঁপায় গুঁজিল। বলিল- বসব, না উঠবেন বাবুজী?

আবার উঠিতে আরম্ভ করিলাম। প্রত্যেকের হাতে এক-একটা ছাতিম ফুলের ডাল। একেবারে উপরে পাহাড়ের উপরে উঠিয়া গেলাম। সেই প্রাচীন বটগাছটা ও তার তলায় প্রাচীন রাজসমাধি। বড় বড় বাটনাবাটা শিলের মতো পাথর চারিদিকে ছড়ানো। রাজা দোবরু পান্নার কবরের উপর ভানুমতী ও তাহার বোন নিছনী ফুল ছড়াইল, আমি ও যুগলপ্রসাদ ফুল ছড়াইলাম।

ভানুমতী বালিকা তো বটেই, সরলা বালিকার মতোই মহা খুশি। বালিকার মতো আবদারের সুরে বলিল- এখানে একটু দাঁড়াই বাবুজী, কেমন? বেশ লাগছে, না?

আমি ভাবিতেছিলাম- এই শেষ। আর এখানে আসিব না। এ পাহাড়ের উপরকার সমাধিস্থান, এ বনাঞ্চল আর দেখিব না। ধন্ঝরির শৈলচূড়ায় পুষ্পিত সপ্তপর্ণের নিকট, ভানুমতীর নিটক, এই আমার চিরবিদায়। ছ-বছরের দীর্ঘ বনবাস সাঙ্গ করিয়া কলিকাতা নগরীতে ফিরিব- কিন্তু যাইবার দিন ঘনাইয়া আসিবার সঙ্গে সঙ্গে ইহাদের কেন এত বেশি করিয়া জড়াইয়া ধরিতেছি!

ভানুমতীকে কথাটা বলিবার ইচ্ছা হইল, ভানমতী কি বলে আমি আর আসিব না শুনিয়া- জানিবার ইচ্ছা হইল। কিন্তু কি হইবে সরলা বনবালাকে বৃথা ভালবাসার, আদরের কথা বলিয়া?

সন্ধ্যা হইবার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি নূতন সুবাস পাইলাম। আশপাশের বনের মধ্যে যথেষ্ট শিউলি গাছ আছে। বেলা পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে শিউলি ফুলের ঘন সুগন্ধ সান্ধ্য-বাতাসকে সুমিষ্ট করিয়া তুলিয়াছে। ছাতিম বন এখানে নাই-সে আরো নিচে নামিলে তবে। এরই মধ্যে গাছপালার ডালে জোনাকি জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে। বাতাস কি সতেজ, মধুর, প্রাণারাম! এ বাতাস সকালে বিকালে উপভোগ করিলে আয়ু না বাড়িয়া পারে? নামিতে ইচ্ছা করিতেছিল না, কিন্তু বন্য জন্তুর ভয় আছে-তা ছাড়া ভানুমতী সঙ্গে রহিয়াছে। যুগলপ্রসাদ বোধ হয় ভাবিতেছিল নূতন কোন্ ধরনের গাছপালা এ জঙ্গল হইতে লইয়া গিয়া অন্যত্র রোপণ করিতে পারে। দেখিলাম তাহার সমস্ত মনোযোগ নূতন লতাপাতার ফুল, সুদৃশ্য পাতার গাছ প্রভৃতির দিকে নিবদ্ধ-অন্য দিকে তাহার দৃষ্টি নাই। যুগলপ্রসাদ পাগলই বটে, কিন্তু ঐ এক ধরনের পাগল।

নূরজাহান নাকি পারস্য হইতে চেনার গাছ আনিয়া কাশ্মীরে রোপণ করিয়াছিলেন। এখন নূরজাহান নাই, কিন্তু সারা কাশ্মীর সুদৃশ্য চেনার বৃক্ষে ছাইয়া ফেলিয়াছে। যুগলপ্রসাদ মরিয়া যাইবে, কিন্তু সরস্বতী হ্রদের জলে আজ হইতে শতবর্ষ পরেও হেমন্তে ফুটন্ত স্পাইডারলিলি বাতাসে সুগন্ধ ছড়াইবে, কিংবা কোনো-না-কোনো বনঝোপে বন্য হংসলতার হংসাকৃতি নীলফুল দুলিবে, যুগলপ্রসাদই যে সেগুলি নাঢ়া-বইহারের জঙ্গলে আমদানি করিয়াছিল একদিন- একথা না-ই বা কেহ বলিল!

ভানুমতী বলিল- বাঁয়ে ওই সেই টাঁড়বারোর গাছ- চিনেছেন?

বন্য-মহিষের রক্ষাকর্তা সদয় দেবতা টাঁড়বারোর গাছ অন্ধকারে চিনিতে পারি নাই। আকাশে চাঁদ নাই, কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি।

অনেকটা নামিয়া আসিয়াছি। এবার সেই ছাতিম বন। কি মিষ্টি মনমাতানো গন্ধ!

ভানুমতীকে বলিলাম- একটু বসি।

পরে সেই বনপথে অন্ধকারের মধ্যে নামিতে নামিতে ভাবিলাম, লবটুলিয়া গিয়াছে, নাঢ়া ও ফুলকিয়া বইহার গিয়াছে-কিন্তু মহালিখারূপের পাহাড় রহিল-ভানুমতীদের ধন্‌ঝরি পাহাড়ের বনভূমি রহিল। এমন সময় আসিবে হয়তো দেশে, যখন মানুষে অরণ্য দেখিতে পাইবে না-শুধুই চাষের ক্ষেত আর পাটের কল, কাপড়ের কলের চিমনি চোখে পড়িবে, তখন তাহারা আসিবে এই নিভৃত অরণ্যপ্রদেশে, যেমন লোকে তীর্থে আসে। সেই সব অনাগত দিনের মানুষদের জন্য এ বন অক্ষুন্ন থাকুক।


রাত্রে বসিয়া জগরু পান্না ও তাহার দাদার মুখে তাহাদের সম্বন্ধে অনেক কথাবার্তা শুনিলাম। মহাজনের দেনা এখনো শোধ যায় নাই, দুইটি মহিষ ধার করিয়া কিনিতে হইয়াছে, না কিনিলে চলে না, গয়ার এক মারোয়াড়ী মহাজন আগে আসিয়া ঘি কিনিয়া লইয়া যাইত-আজ তিন চার মাস সে আর আসে না। প্রায় আধ মন ঘি ঘরে মজুত, খরিদ্দার নাই।

ভানুমতী আসিয়া দাওয়ার একধারে বসিল। যুগলপ্রসাদ অত্যন্ত চা-খোর, সে চা-চিনি সঙ্গে আনিয়াছে আমি জানি। কিন্তু লাজুকতাবশত গরম জলের কথা বলিতে পারিতেছে না, তাহাও জানি। বলিলাম- চায়ের জল একটু গরম করার সুবিধে হবে কি ভানুমতী?

রাজকুমারী ভানুমতী চা কখনো করে নাই। চা খাইবার রেওয়াজই নাই এখানে। তাহাকে জলের পরিমাণ বুঝাইয়া দিতে সে মাটির হাঁড়িতে জল গরম করিয়া আনিল। তাহার ছোট বোন কয়েকটি পাথরবাটি আনিল। ভানুমতীকে চা খাইবার অনুরোধ করিলাম, সে খাইতে চাহিল না। জগরু পান্না পাথরের ছোট খোরার এক খোরা চা শেষ করিয়া আরো খানিকটা চাহিয়া লইল।

চা খাইয়া আর-সকলে উঠিয়া গেল, ভানুমতী গেল না। আমায় বলিল-ক’দিন এখন আছেন বাবুজী? এবার বড় দেরি করে এসেছেন। কাল তো যেতেই দেব না। চলুন আপনাকে কাল ঝাটি ঝরনা বেড়িয়ে নিয়ে আসি। ঝাটি ঝরনায় আরো ভয়ানক জঙ্গল। ওদিকে বড্ড বুনো হাতি। অনেক বনময়ূরও আছে দেখতে পাবেন। চমৎকার জায়গা। পৃথিবীর মধ্যে এমন আর নেই।

ভানুমতীর পৃথিবী কতটুকু জানিতে বড় ইচ্ছা হইল। বলিলাম- ভানুমতী, কখনো কোনো শহর দেখেছ?

– না বাবুজী।

– দু-একটা শহরের নাম বল তো?

– গয়া, মুঙ্গের, পাটনা।

– কল্‌কাতার নাম শোন নি?

– হাঁ বাবুজী।

– কোনদিকে জান?

– কি জানি বাবুজী।

-আমরা যে দেশে বাস করি তার নাম জান?

– আমরা গয়া জেলায় বাস করি।

– ভারতবর্ষের নাম শুনেছ?

ভানুমতী মাথা নাড়িয়া জানাইল সে শোনে নাই। কখনো কোথায় যায় নাই চক্‌মকিটোলা ছাড়িয়া। ভারতবর্ষ কোন্‌দিকে?

একটু পরে বলিল- আমার জ্যাঠামশায় একটা মহিষ এনেছিলেন, সেটা এবেলা তিন সের, ওবেলা তিন সের দুধ দিত। তখন আমাদের এর চেয়ে ভালো অবস্থা ছিল বাবুজী, তখন যদি আপনি আসতেন, আপনাকে রোজ খোয়া খাওয়াতাম। জ্যাঠামশায় নিজের হাতে খোয়া তৈরি করতেন। কি মিষ্টি খোয়া! এখন তেমন দুধই হয় না তার খোয়া। তখন আমাদের খাতিরও ছিল খুব।

পরে হাতখানি একবার তুলিয়া চারিদিকে ঘুরাইয়া গর্বের সহিত বলিল- জানেন বাবুজী, এই সমস্ত দেশ আমাদের রাজ্য ছিল! সারা পৃথিবীটা। বনে যে গোঁড় দেখেন, সাঁওতাল দেখেন ওরা আমাদের জাত নয়। আমরা রাজগোঁড়। আমাদের প্রজা ওরা, আমাদের রাজা বলে মানে।

উহার কথায় দুঃখও হইল, হাসিও পাইল। মহাজনে দেনার দায়ে দুইবেলা যাহাদের মহিষ ধরিয়া লইয়া যায়, সেও রাজবংশের গর্ব করিতে ছাড়ে না।

বলিলাম- আমি জানি ভানুমতী তোমাদের কত বড় বংশ-

ভানুমতী বলিল- তারপর শুনুন বাবুজী, আমাদের সেই মহিষটা বাঘে নিয়ে গেল। জ্যাঠামশায় যে মহিষটা এনেছিলেন।

– কি করে?

– জ্যাঠামশায় ওই পাহাড়ের নিচে চরাতে নিয়ে গিয়ে একটা গাছতলায় বসে ছিলেন, সেখানে বাঘে ধরল।

বলিলাম- তুমি বাঘ দেখেছ কখনো?

ভানুমতী কালো জোড়া-ভুরু দুটি আশ্চর্য হইবার ভঙ্গিতে উপরের দিকে তুলিয়া বলিল- বাঘ দেখি নি বাবুজী! শীতকালে আস্‌বেন চক্‌মকিটোলায়-বাড়ির উঠোন থেকে গোরু বাছুর ধরে নিয়ে যায় বাঘে-

বলিয়াই সে ডাকিল-নিছনি, নিছনি-শোন-

ছোট বোন আসিলে বলিল-নিছনি, বাবুজীকে শুনিয়ে দে তো আর-বছর শীতকালে বাঘ রোজ রাতে আমাদের উঠোনে এসে কি করে বেড়াত। জগরু একদিন ফাঁদ পেতেছিল। ধরা পড়ল না।

পরে হঠাৎ বলিল- ভালো কথা, বাবুজী, একখানা চিঠি পড়ে দেবেন? কোথা থেকে একখানা চিঠি এসেছিল, কে পড়বে, এমনি তোলা রয়েছে। যা নিছনি, চিঠিখানা নিয়ে আয়, আর জগরু-কাকাকেও ডেকে নিয়ে আয়-

নিছনি চিঠি পাইল না। তখন ভানুমতী নিজে গিয়া অনেক খুঁজিয়া সেখানা বাহির করিয়া আমার হাতে আনিয়া দিল।

বলিলাম- কবে এসেছে এখানা?

ভানুমতী বলিল- মাস ছ-সাত হবে বাবুজী- তুলে রেখে দিইছি, আপনি এলে পড়াবো। আমরা তো কেউ পড়তে পারি নে। ও নিছনি, জগরু-কাকাকে ডেকে নিয়ে আয়। চিঠি পড়া হবে- সবাইকে ডাক দে।

ছ-সাত মাস পূর্বের পুরোনো অপঠিত পত্রখানা আমি যুগলপ্রসাদের উনুনের আলোয় পড়িতে বসিলাম- আমার চারিধারে বাড়িসুদ্ধ লোক ঘিরিয়া বসিল চিঠি শুনিবার জন্য। চিঠিখানা কায়েথী-হিন্দিতে লেখা- রাজা দোবরু পান্নার নামে চিঠি। পাটনার জনৈক মহাজন রাজা দোবরুকে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইয়াছে, এখানে বিড়িপাতার জঙ্গল আছে কিনা- থাকিলে কি দরে ইজারা বিলি হয়।

এ পত্রের সঙ্গে ইহাদের কোনো সম্পর্ক নাই- ইহাদের অধীনে কোনো বিড়িপাতার জঙ্গল নাই। রাজা দোবরু, নামে রাজা ছিলেন, চক্‌মকিটোলার নিজ বসতবাটির বাহিরে তাঁর যে কোথাও এক ছটাক জমিও নাই একথা পাটনার উক্ত পত্রলেখক মহাজন জানিলে ডাকমাসুল খরচ করিয়া বৃথা পত্র দিত না নিশ্চয়ই।

একটু দূরে দাওয়ার ও-পাশে যুগলপ্রসাদ রান্না করিতেছে। তাহার কাঠের উনুনের আলোয় দাওয়ার খানিকটা আলো হইয়াছে। এদিকে দাওয়ার অর্ধেকটায় জ্যোৎস্না পড়িয়াছে, যদিও কৃষ্ণপক্ষের আজ মোটে তৃতীয়া- ধন্‌ঝরি পাহাড়ের আড়াল কাটাইয়া এই কিছুক্ষণ মাত্র চাঁদ ফাঁকা আকাশে দৃশ্যমান হইয়াছে। সামনে কিছুদূরে অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাহাড়শ্রেণী- চক্‌মকিটোলার বস্তির ছেলেপুলেদের কথা ও কলরব শোনা যাইতেছে। … কি সুন্দর ও অপূর্ব মনে হইতেছিল এই বন্য গ্রামে যাপিত এই রাত্রিটি। ভানুমতীর তুচ্ছ ও সাধারণ গল্পও কি আনন্দই দিতেছিল! সেদিন বলভদ্রের মুখে শোনা সেই উন্নতি করিবার কথা মনে পড়িল।

মানুষে কি চায়- উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কি হইবে যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে? আমি এমন কত লোকের কথা জানি, যাহারা জীবনে উন্নতি করিয়াছে বটে, কিন্তু আনন্দকে হারাইয়াছে। অতিরিক্ত ভোগে মনোবৃত্তির ধার ক্ষইয়া ক্ষইয়া ভোঁতা- এখন আর কিছুতেই তেমন আনন্দ পায় না, জীবন তাহাদের নিকট একঘেয়ে, একরঙা, অর্থহীন। মন শান-বাঁধানো-রস ঢুকিতে পায় না।

এখানেই যদি থাকিতে পারিতাম! ভানুমতীকে বিবাহ করিতাম। এই মাটির ঘরের জ্যোৎস্না-ওঠা দাওয়ায় সরলা বন্যবালা রাঁধিতে রাঁধিতে এমনি করিয়া ছেলেমানুষি গল্প করিত- আমি বসিয়া বসিয়া শুনিতাম। আর শুনিতাম বেশি রাত্রে ওই বনে হুড়ালের ডাক, বনমোরগের ডাক, বন্য হস্তীর বৃংহিত, হায়েনার হাসি। ভানুমতী কালো বটে, কিন্তু এমন নিটোল স্বাস্থ্যবতী মেয়ে বাংলা দেশে পাওয়া যায় না। আর ওর ওই সতেজ সরল মন! দয়া আছে, মায়া আছে, স্নেহ আছে,-তার কত প্রমাণ পাইয়াছি।… ভাবিতেও বেশ লাগে। কি সুন্দর স্বপ্ন! কি হইবে উন্নতি করিয়া? বলভদ্র সেঙ্গাৎ গিয়া উন্নতি করুক। রাসবিহারী সিং উন্নতি করুক।

যুগলপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করিল, রান্না হইয়াছে, চৌকা লাগাইবে কি না। ভানুমতীদের বাড়িতে আতিথ্যের কোনো ত্রুটি হয় না। এদেশে আনাজ মেলে না, তবুও কোথা হইত জগরু বেগুন ও আলু আনিয়াছে। মাষকলাইয়ের ডাল, পাখির মাংস, বাড়িতে তৈরি অতি উৎকৃষ্ট টাটকা ভয়সা ঘি, দুধ। যুগলপ্রসাদের হাতের রান্নাও চমৎকার।

ভানুমতী, জগরু, জগরুর দাদা, নিছনি-সবাই আজ আমাদের এখানে খাইবে-আমি খাইতে বলিয়াছি। কারণ এমন রান্না উহারা কখনো খাইতে পায় না। বলিলাম-একটু দূরে উহারাও একসঙ্গে সবাই বসুক। যুগলপ্রসাদের দেওয়ারও সুবিধা হইবে। একত্র খাওয়া যাক।

ওরা রাজি হইল না। আমাদের আগে না খাওয়া হইলে উহারা খাইবে না।

পরদিন আসিবার সময় ভানুমতী এক কাণ্ড করিল।

হঠাৎ আমার হাত ধরিয়া বলিল- আজ যেতে দেব না বাবুজী-

আমি অবাক হইয়া উহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম। কষ্ট হইল।

উহার অনুরোধ সকালে রওনা হইতে পারিলাম না- দুপুরের আহারাদির পরে বিদায় লইলাম।

আবার দুধারে ছায়ানিবিড় বনপথ। পথের ধারে কোথাও রাজকুমারী ভানুমতী যেন দাঁড়াইয়া আছে- বালিকা নয়, যুবতী ভানুমতী-তাহাকে আমি কখনো দেখি নাই। তার সাগ্রহ দৃষ্টি তার প্রণয়ীর আগমন-পথের দিকে নিবদ্ধ-হয়তো সে পাহাড়ের ওপারের বনে শিকারে গিয়াছে, আসিবার দেরি নাই। তরুণীকে মনে মনে আশীর্বাদ করিলাম। ধন্‌ঝরি পাহাড়ের জোনাকি-জ্বলা নিস্তব্ধ প্রাচীন ছাতিম ফুলের বন ও অপূর্ব দূরছন্দা সন্ধ্যার আড়ালে বনবালার গোপন অভিসার সার্থক হউক।

মহালে ফিরিয়া সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সকলের নিকট বিদায় লইয়া লবটুলিয়া ত্যাগ করিলাম।

আসিবার সময় রাজু পাঁড়ে, গনোরী, যুগলপ্রসাদ, আস্রফি টিণ্ডেল প্রভৃতি পালকির চারিধারে ঘিরিয়া পালকির সঙ্গে সঙ্গে লবটুলিয়ার সীমানার নূতন বস্তি মহারাজটোলা পর্যন্ত আসিল। মটুকনাথ সংস্কৃতে স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করিয়া আমায় আশীর্বাদ করিল। রাজু বলিল- হুজুর, আপনি চলে গেলে লবটুলিয়া উদাস হয়ে যাবে।

প্রসঙ্গক্রমে বলি এদেশে ‘উদাস’ শব্দের ব্যবহার এবং উহার অর্থের ব্যাপকতা অত্যন্ত বেশি। মকাই-ভাজা খাইতে খারাপ লাগিলে বলে, ‘ভাজা উদাস লাগছে।’ আমার সম্পর্কে কি অর্থে উহা ব্যবহৃত হইল ঠিক বলিতে পারিব না।

আমার বিদায় লইয়া আসিবার সময় একটি মেয়ে কাঁদিয়াছিল। আজ সকাল হইতে আসিয়া সে কাছারির উঠানে দাঁড়াইয়া ছিল- আমার পালকি যখন তোলা হইল, তখন চাহিয়া দেখি সে হাপুস-নয়নে কাঁদিতেছে। মেয়েটি কুন্তা।

নিরাশ্রয়া কুন্তাকে জমি দিয়া বসবাস করাইয়াছি, আমার ম্যানেজারি জীবনের ইহা একটি সৎকাজ। পারিলাম না কিছু করিতে সেই বালিকা মঞ্চীর। অভাগিনীকে কে কোথায় যে ভুলাইয়া লইয়া গেল! – আজ সে যদি থাকিত তাহার নিজের নামে জমি দিতাম বিনা সেলামিতে।

নাঢ়া-বইহারের সীমানায় নক্ছেদীর ঘর দেখিয়াই আরো কথা মনে পড়িল। সুরতিয়া ঘরের বাহিরে কি করিতেছিল, আমার পালকি দেখিয়াই বলিয়া উঠিল-বাবুজী, বাবুজী, একটু রাখুন-

পরে সে ছুটিয়া আসিয়া পালকির কাছে দাঁড়াইল। ছনিয়াও আসিল পিছু-পিছু।

– বাবুজী, কোথায় যাচ্ছেন?

– ভাগলপুরে। তোর বাবা কোথায়?

– ঝল্লুটোলায় গমের বীজ আনতে গিয়েছে। কবে আসবেন?

– আর আসব না।

– ইস! মিথ্যে কথা! …

নাঢ়া-বইহারের সীমানা পার হইয়া পালকি হইতে মুখ বাড়াইয়া একবার পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখিলাম।

বহু বস্তি, চালে চালে বসত, লোকজনের কথাবার্তা, বালকবালিকার কলহাস্য, চিৎকার, গোরু-মহিষ, ফসলের গোলা। ঘন বন কাটিয়া আমিই এই হাস্যদীপ্ত শস্যপূর্ণ জনপদ বসাইয়াছি ছয়-সাত বৎসরের মধ্যে। সবাই কাল তাহাই বলিতেছিল- বাবুজী, আপনার কাজ দেখে আমরা পর্যন্ত অবাক হয়ে গিয়েছি, নাঢ়া লবটুলিয়া কি ছিল আর কি হয়েছে!

কথাটা আমিও ভাবিতে ভাবিতে চলিয়াছি। নাঢ়া লবটুলিয়া কি ছিল আর কি হইয়াছে!

দিগন্তলীন মহালিখারূপের পাহাড় ও মোহনপুরা অরণ্যানীর উদ্দেশে দূর হইতে নমস্কার করিলাম।

হে অরণ্যানীর আদিম দেবতারা, ক্ষমা করিও আমায়। বিদায়! …


বহুকাল কাটিয়া গিয়াছে তারপর- পনের-ষোল বছর।

বাদামগাছের তলায় বসিয়া এইসব ভাবিতেছিলাম।

বেলা একেবারে পড়িয়া আসিয়াছে। …

বিস্মৃতপ্রায় অতীতের যে নাঢ়া ও লবটুলিয়ার আরণ্য-প্রান্তর আমার হাতেই নষ্ট হইয়াছিল, সরস্বতী হ্রদের যে অপূর্ব বনানী, তাহাদের স্মৃতি স্বপ্নের মতো আসিয়া মাঝে মাঝে মনকে উদাস করে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, কেমন আছে কুন্তা, কত বড় হইয়া উঠিয়াছে সুরতিয়া, মটুকনাথের টোল আজও আছে কি না, ভানুমতী তাহাদের সেই শৈলবেষ্টিত আরণ্যভূমিতে কি করিতেছে, রাখালবাবুর স্ত্রী, ধ্রুবা, গিরধারীলাল, কে জানে এতকাল পরে কে কেমন অবস্থায় আছে। …

আর মনে হয় মাঝে মাঝে মঞ্চীর কথা। অনুতপ্তা মঞ্চী কি আবার স্বামীর কাছে ফিরিয়াছে, না আসামের চা-বাগানে চায়ের পাতা তুলিতেছে আজও।

কতকাল তাহাদের আর খবর রাখি না।

মানুষের বসতির পাশে কোথাও নিবিড় অরণ্য নাই। অরণ্য আছে দূর দেশে, যেখানে পতিত-পক্ব জম্বুফলের গন্ধে গোদাবরী-তীরের বাতাস ভারাক্রান্ত হইয়া ওঠে, ‘আরণ্যক’ সেই কল্পনালোকের বিবরণ। ইহা ভ্রমণবৃত্তান্ত বা ডায়েরি নহে-উপন্যাস। অভিধানে লেখে ‘উপন্যাস’ মানে বানানো গল্প। অভিধানকার পণ্ডিতদের কথা আমরা মানিয়া লইতে বাধ্য। তবে ‘আরণ্যক’-এর পটভূমি সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয়। কুশী নদীর অপর পারে এরূপ দিগন্ত-বিস্তীর্ণ অরণ্যপ্রান্তর পূর্বে ছিল, এখনো আছে। দক্ষিণ ভাগলপুর ও গয়া জেলার বন পাহাড় তো বিখ্যাত।

(সমাপ্ত)

6 Comments
Collapse Comments
Nightbird Sunmun May 4, 2015 at 1:02 am

হুম

ইয়াসির শাহরিয়ার স্মরণ August 9, 2018 at 1:14 am

মনের মত একটা উপন্যাস আরণ্যক। মন ভরে যায়।

মশিউর রহমান May 7, 2020 at 1:26 pm

পড়েছি হ্রদয় দিয়ে।
এত সুন্দর-এত অপূর্ব লেখা আমাকে ‘উদাস’ করে দিয়েছে।বিভুতিভুষণের লেখনীতে আমি আজীবন মুগ্ধ-বিমুগ্ধ।
বনানী,অরণ্যানীর এই যে সাহিত্যিক প্রকাশ,কতই না জড়িয়ে গেছি এর সাথে !
নিজেই যেন লেখকের জায়গায় বিচরণ করেছি।সত্যি কথা বলতে,বিদায়বেলায় আমার বুকটা ভীষণ ভারী হয়ে গেছে ! এমন অপ্রতিভ বিদায়ে দারুণ কষ্ট পেলাম।হু হু করে কান্না আসছে।
লেখার মাঝে এত সকরুণচিত্তে কিভাবে যে আমাকে ভুলিয়ে রেখেছেন তিনি, তার কৃতজ্ঞতা আমার জানা ভাষায় কখনোই প্রকাশ করা যাবে না।
হায় !
যদি তিনি বেঁচে থাকতেন,
আমিই হতাম তার একমাত্র পাগল পাঠক।যেন আমারই জন্য তিনি এত মাধুর্য মিশিয়ে লিখেছেন তার বিশ্বজোড়া রচনাবলী।
কতই না ভালোবাসি তাকে।
তার ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসটি আমার পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিশোর উপন্যাস।
আরণ্যক,ইছামতি পড়ে তার প্রতি শ্রদ্ধায় বারবার অবণত হলাম।
আপনি নেই আর,
আছে আপনার সাহিত্যকর্ম,
তা দিয়েই এক-পৃথিবী তৈরি করেছেন,
আর আমিই সেই পৃথিবীর একমাত্র অধিষ্ঠাত্রী !
বিদায় প্রিয় . . .
জনম জনম মনে রাখিব আপনারে ,,,
আজীবন থাকিবেন হ্রদয়কুটিরে . . .
বাঁচিয়া থাক বিরহসন্তাপ শত কালোরাত্তির, আমারই চারিপাশে থাকিয়া কৃপা করুক আমায় . . . !
–মশিউর রহমান

আমিও ভাই আপনার মতই, আপনার ফেসবুক আছে? সংলাপে সুখী হতাম, ্‌্‌ আমার id Gain Bitosh

ইনসান আনোয়ার January 7, 2021 at 1:27 pm

শেষ হয়েও যেন হইলো না শেষ। সেই অরন্য প্রান্তরে যেন আমি ছিলাম। মন মাতানো গভীর অরন্য যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যেন ছুটে যাই তার পানে হয়ে যাই ভবঘুরে। বিচরণ করে ফিরি পৃথিবীর বুকে।

ইয়াসির শাহরিয়ার স্মরন October 19, 2023 at 1:11 am

তৃতীয়বার পড়লাম! আমার পড়া অন্যতম সেরা উপন্যাস। (১৯-১০-২০২৩)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *