1 of 2

বালির ঝড় – সমরেশ বসু

বালির ঝড়
সমরেশ বসু

ট্রেন এসে পৌঁছুলো প্রায় এক ঘন্টা দেরিতে।

সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। কিন্তু দিকে দিকে প্রসারিত তার লেলিহান জিহ্বা এখনো গুটিয়ে নেওয়া হয়নি। এখনো গরম বাতাসের ঝাপ্টা! পায়ের তলায় আদিম পাথুরে-মাটিতে এখনো জ্বলন্ত অঙ্গারের উত্তাপ।

গাড়ির জানলা দিয়ে আগেই লক্ষ্য পড়েছিলো দগ্ধ-ধূসর তিন-পাহাড়ের পিঠ। এই পশ্চিমা সূর্যের জ্বলন্ত থাবায় যেন একটি অতিকায় পশুর মতো ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে পাহাড়টা। পশুটা মৃতপ্রায়।

কিন্তু গাড়ি যতই সামনে এগোচ্ছিলো, ততই একটা জিনিস বুঝে ওঠা যাচ্ছিলো। দূরে ওগুলো কী? ওই ধোঁয়া ধূসর যেন মাটি থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আকাশব্যাপী অন্ধকার করে দিচ্ছে? যেন ওই অতিকায় পশুটা পা ছুঁড়ছে এখনো মরার যন্ত্রণায়? খাবি খাওয়ার মতো। বালি উড়ছে যেন তারই অন্তিম নখরাঘাতে—তার শেষ দাপাদাপিতে।

তারপর গাড়ি আরো এগিয়েছে। টের পাওয়া গেছে, বালি-ই উড়ছে। দিগব্যাপী অন্ধকার করে দিয়ে যেন একটা কাঁপালিক খ্যাপা হয়ে ফিরছে। হাসছে অট্টরোলে। আদিম মানবের জাদু-বিশ্বাসের একটা খেলা দেখাচ্ছে যেন সে।

সামনে মাঠ কি ঘাট কিছু বোঝার উপায় নেই। সম্ভবত খোলা চরভূমি। তারপরে গঙ্গা। কারণ, দূরে স্টীমারের একটি অস্পষ্ট ছায়া যেন দেখা যাচ্ছে। আরো দেখা যায়, যেন কতকগুলো প্রেতছায়া ছুটে আসছে। দেখা যেতে যেতেই ছায়াগুলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো ট্রেনের কামরায়। ওরা যে কুলি, তা আর চেনার উপায় নেই। ততক্ষণে খোলা জানলা দরজা দিয়ে গরম বালুকারাশি কামরাগুলো ভরে তুলতে আরম্ভ করেছে।

মুহূর্তে একটা বীভৎস তাণ্ডব শুরু হলো। ঝোড়োবাতাস আর বালু যেন তপ্ত খোলার মুড়ি-ভাজা বালি তার সঙ্গে মানুষের হাঁক-ডাক চীৎকার। মানুষের চেয়ে বেশী। কুলির ধস্তাধস্তি।

সুলতা-শিবনাথদের কামরাতেও তাণ্ডবটা শুরু হয়েছে। সুলতা ব্যাপারটা ঠিক বুঝতেই পারেনি। কিছুটা বুঝি বেলা শেষের আমেজে আর গাড়ির দোলানিতে ওর চোখ জড়িয়ে আসছিলো। তারপর সহসা বালুর আক্রমণে রুমাল চেপে ধরেছিলো মুখে। এবার বোম্বাই–

সিকের গোটা আঁচলটাই মুখে মাথায় টেনে এনে বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো, এটা কি হচ্ছে?

অবস্থাটা শিবনাথের খুব সুবিধের নয়। দম চাপতে গিয়ে, প্রায় দৈববাণীর মতো কড়া আর মোটা শোনালো তার গলা, বালির ঝড়।

এই সহসা-দুর্যোগের ওপর যেন রেগে উঠে, প্রায় শাসিয়ে উঠলো সুলতা, ‘বালির ঝড়? কী বিশ্রী।’

পশ্চিম গঙ্গার খেয়ালী ঢালু পাড়ে, দূরবিশারী এই ধুধু বালুচরে কোনো এক অজানা দিগন্ত থেকে ঝড় উঠে এসেছে কে জানে! মানুষের মন রাখা সুশী-বিশ্রীর চৈতন্য তার নেই। না মানে শাসন, না মানে কর্ষণ। গাড়িটা থেমেও না থেমে যতই চাকা ঘষে ঘষে ইঞ্চি ইঞ্চি এগোয়, ততই ঝড়ের দস্যিপনা বাড়ে।

এবার বিরক্তির চেয়ে কষ্টটাই টের পাওয়া গেল সুলতার, ‘উঃ, গেলুম! এ আমরা কোথায় এসেছি?’

যেন অনেক দূর থেকে জবাব দিলো শিবনাথ, শরিগলি ঘাট।

-তারপর?

এখানেই নামতে হবে আমাদের। নেমে স্টীমারে উঠতে হবে।

–ওরে বাবা!

বুঝি ভয় পেয়েই সুলতা দু’হাত বাড়িয়ে শিবনাথকে ধরে তার পিঠে মুখ জলো। শিবনাথেরও দু’চোখের কোল বালুকণায় ঝাপসা হয়ে গেল। সে সস্নেহে বললো, একটু সামলে নাও সুলতা। স্টীমারে গিয়ে উঠলে আর লাগবে না।

সুলতা প্রায় ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, কী করে সামলাব। সব তছনছ করে দিচ্ছে

শিবনাথ হাসলো একটু। মুখ নামিয়ে এনে বললো, তা বেড়াতে গেলে একটু কষ্ট সইতে হয় না বুঝি! কষ্ট করলেই কেষ্ট মিলবে।

–যাও! তোমার সবটাতেই ফাজলামি। আমি বলে কানা হয়ে যাচ্ছি। আর গায়ে যেন ছুঁচ ফোঁটাচ্ছে গরম বালি, ইস্।

রক্তের মতো লাল তরল শাড়িটার আঁচল তখন লুটিয়ে পড়েছে। অতলপৃষ্ট জলের মতো লাল নাইলনের জামাটা শাড়ি পরিত্যক্তা। তেইশ চব্বিশ বর্ষণের অনেকটাই অনাবৃষ্টির লক্ষণাক্রান্ত শরীরে, অন্ধকারে নিওন-আলোর বিজ্ঞাপনের মতো অন্তর্বাস সুস্পষ্ট। প্রসাধন অনেক আগেই ধুয়ে মুছে গেছে ট্রেনের গরমে ও ঘামে। এখন চোখ ঘষে ঘষে কাজল হয়েছে চোখের কালি। বালি ইতিমধ্যেই সাদা স্তর ফেলেছে চুলে বালি খোঁপার ভাঁজে ভাঁজে।

শিবনাথের অবস্থা এমন কিছু ভাল নয়। তরে পুরুষ হওয়ার সুযোগটাই একমাত্র সুযোগ। সে কোঁচাকে মালকোচা করে নিয়েছে। রিস্টওয়াচে বেঁধেছে রুমাল।

এদিকে কুলিদের ডাকাতে-হাত পড়েছে তাদের মালের ওপর। কামরার অন্যদুটি পরিবার তখন কুলির মাথায় মালপত্তর চাপিয়ে নামতে উদ্যত। সুলতার আঁকড়ে ধরা হাত এবার কোমর থেকে না সরালে নয় শিবনাথের।।

এমন সময়ে সুলতার তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে শোনা গেল, ও কি, ও কি করছে আপনি? ওটা আমার, আমাদের ওটা।

দরজার দিকে যেতে গিয়ে ভদ্রমহিলা হকচকিয়ে থমকে গেলেন। যাকে অন্তত বারকয়েক লীলা বলে ডাকতে শোনা গেছে কামরায়, সেই ভদ্রমহিলাই। আর এই বালির ঝড়ে যখন সুলতার চোখ যাচ্ছে তখন সে এ জিনিসটা ঠিকই লক্ষ্য করেছে, তাদের ছোট হ্যান্ডব্যাগটি ভদ্রমহিলার হাতে।

বালির ঝড়ের মধ্যেও ভদ্রমহিলার দুটি আয়ত চোখ লজ্জায় ও বিস্ময়ে উদ্দীপ্ত হলো। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে থিতিয়ে গেলেন একেবারে। যদিও রং নেই ঠোঁটে, স্বাভাবিক রক্তাভাটা ছিলো। ঈষৎ পুরু ঠোঁট দুটি চকিতে একবার দংশে তাড়াতাড়ি সুলতাদের বেডিং এর ওপর হ্যান্ডব্যাগটা রেখে বলে উঠলেন, ‘ছি ছি, আমি একেবারে জানতে পারি নি। কিছু মনে করবেন না। কিন্তু—’

চোখে আর মুখে হাত চাপা দিলেন উনি। ঝড়ের কামাই নেই। বালি ঢুকছে। মাথায় সুলতার মতনই হবে। বয়সটা কম হতে পারে, বেশী হতে পারে। ধরবার উপায় নেই। কারণ এখন শিবনাথই দেখছে কি না। তবে সব মিলিয়ে, ভদ্রমহিলার শ্যাম চিক্কণ মুখে কিছু একটা বিশেষত্ব ছিলো। সেটা কী, বলা মুশকিল। বোধ হয় আকাশ নীল মানেই যে এক নয়, নানান রূপ অরূপের বিশেষত্ব থাকে, প্রায় সেই-ই রকম। স্নিগ্ধ উজ্জ্বল আর বোধ হয় সুন্দর। সে তাড়াতাড়ি সান্ত্বনা দিতে গেল। ততক্ষণে দরজার প্রায় বাইরে থেকে পুরুষ গলায় প্রশ্ন এল, “কি হয়েছে লীলা?”

লীলা বললেন, ‘কিছু নয়। আমাদের হ্যাণ্ডব্যাগটা নিয়েছ?’

জবাব এল, ‘নিয়েছি।‘

লজ্জায় ও বালির ঝড়ে যদিও রুদ্ধশ্বাস, তবু হাসলেন লীলা। বললেন, ‘ছি ছি, কী যে কাণ্ড!’

সুলতা কোনোরকমে আঁচলের বাইরে মুখ এনে বললো, তাতে কি? ওরকম হয়ে যায়।

মুক্তি পেলেন ভদ্রমহিলা। সুলতার ওকথাকটি যেন জেল সুপারিন্টেণ্ডেন্টের মুক্তির আদেশের মতো শোনাল। উনি নেমে গেলেন বালির ঝড়ের মধ্যে। শিবনাথ ততক্ষণে কুলিকে মাল তোলবার আদেশ দিয়েছে। তাড়া দিল সুলতাকে, চল চল, আর দেরি নয়। ওদিকে স্টীমার ছেড়ে দেবে আবার।

নামতে নামতে সুলতা মুখে কাপড় চাপা অবস্থায় বলে নিলো, পরের জিনিসের হাত দিতে গেলে সবাই ওরকম না-জানার ভান করে। ওসব আমার রে জানা আছে।

শিবনাথ যেন জানতো একথাটা সুলতা বলবেই। সে বললো, যাগকে। এবার সামনের দিকে তাকাও। ভবিষ্যৎ বড় অন্ধকার বোধ হচ্চে। এই, এই কুলি, আস্তে যাও।

কিন্তু সুলতা শিবনাথের কথারই খেই টানল, ‘না, ইয়ার্কি নয়, ওসব আমি জানি। ওটা আমার কত সাধের শৌখিন জিনিস জান? হাতিয়ে তোত নিয়েছিলো প্রায়। অমন সুন্দর ফুটফাট জিনিসটি দেখলে সকলেরই ভুল হয়ে যায়। আঃ! উঃ! গেলুম গেলুম।‘

শিবনাথ বললো, ‘বলছি তখন থেকে চুপ করো। মুখে বালি ঢুকে গেছে তো?’

সুলতার মুখ তখন শিবনাথের কুক্ষিতলে। সেখান থেকেই কাঁদো কাঁদো স্বরে জবাব এলো, শুধু মুখে নাকি? চোখ নাক কান সব বালিতে ভরতি হয়ে গেল। কী জঘন্য। আর কতদূর?

—আর একটুখানি।

শিবনাথও বেজায় রকম বেসামাল। তপ্তবালু তারও স্যান্ডেল পরা পা পোড়াচ্ছে। মুখে ও গায়ের ভোলা অংশে যেন কোটি কোটি বিষ-পিঁপড়ে হুল ফোঁটাচ্ছে ছুটে এসে। যেন বাস-ভাঙা-রোষে, ফুঁসে ফুঁসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এসে ইতিমধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকারও নেমেছে। বুঝি একটা যোগ-সাজস করেই নেমেছে এই বালির ঝড়ের সঙ্গে। এক বালির অন্ধকারেই রেহাই নেই, তার ওপরে সন্ধ্যার কালিমা। আর অবস্থা সকলেরই সমান। কে যে কার ঘাড়ে পড়ছে। পা মাড়িয়ে দিচ্ছে, সে সব দেখবার বিচার করবার অবসর নেই। একটা গড্ডলিকা প্রবাহের মতো চলেছে সবাই লাইন ধরে। সামনের লোকটা ভুল করলে, পেছনের সব লোকেরই বিপথগামী হবার সম্ভাবনা।

তবু এ দুর্দৈবটা যেন শিবনাথের কাছে ধরাবাঁধা জীবনের একটি ব্যতিক্রমের উল্লাসে উচ্চকিত হয়ে উঠছে। কাজের চাপে পর্যুদস্ত সাব-এডিটরের বেসামাল অবস্থা তো নয় এটা। নিতান্ত বউ নিয়ে বেরিয়ে পড়া পথের খেলা এটা। আসুক না যত খুশি। কতক্ষণ আর। তবু তো জানা গেল বালির ঝড়ের লীলা। মরুভূমিতেও কি এমনি হয় নাকি। কী একটা কবিতা যেন তার মনে মধ্যে তোলপাড় করতে লাগলো; মুখে এলো না। তার আগেই সুলতার রুদ্ধ গলা শোনা গেল, কী সর্বনেশে ঝড়। আর কতদূর গো?

–‘এসে পড়েছি’

সুলতার অবস্থা দেখে কষ্ট হলো, হাসিও পেলো শিবনাথের। সে দেখলো আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে, সুলতা প্রায় একটি বোম্বাই সিলকের বস্তায় পরিণত হয়েছে। প্রায় ঝুলে পড়েছে শিবনাথের বলিষ্ঠ কাধ ধরে।

শিবনাথ বললো, ‘একটু সোজা হও, এইবার আমরা ঢালুতে নামছি।‘

সন্ত্রস্ত গলা শোনা গেল সুলতার, ‘পড়ে যাব নাকি?’

‘–না।‘

স্টীমারে পা দিতে না দিতেই বালির প্রকোপটা একেবারে শেষ হয়ে গেল। হাওয়াটা সম্ভবত পূর্ব-দক্ষিণাগামী। কিংবা পাগলা বেসামাল বাতাস। দিক ঠিক নেই। আপাতত নদীর বুক ঠেলেই বাতাস বহমান। তাতে জলকণা আছে, বালি নেই।

দোতলার প্রথম আর দ্বিতীয়শ্রেণীর অবস্থাও খুব সুখকর নয়। শুধু যে রুদ্র বৈশাখের তাপ দগ্ধ সমতলবাসীর পাহাড় ভ্রমণের টান, তা নয়। উত্তরবঙ্গ আর আসাম-গামী তাবৎ লোকের ভিড় একটি স্টীমারেই।

সুলতা কোনোরকমে একটু জায়গা করে নিয়ে শিবনাথকেও ডাকলো। তারপর হেসে ফেললো শিবনাথের ধবধবে সাদা ভ্র দেখে তাড়াতাড়ি নিজেরই রুমাল দিয়ে শিবনাথের ভ্র, চোখ, মুখ মুছে দিতে গেল।

শিবনাথ বললো, এ বালি এত সহজে যাবে না সুলতা। এখন থাক।

সুলতা ভ্রূ কুঁচকে একটু শাসন করলো শিবনাথকে, ধুলো বালিতে তোমার একটু ঘেন্না নেই আমি দেখছি। মুখটা অন্তত মুছবে তো।

শিবনাথ দেখলো, সুলতা মুখ মুছে নিয়েছে ইতিমধ্যে। সুতরাং তারও মুক্তি নেই। রুমালটা নিয়ে শিবনাথ মুখ মুছলো। তারপর হ্যান্ডব্যগটা খুলে আর একটি রুমাল বার করতে করতে, মুগ্ধ চোখে আর একবার ব্যাগটি দেখলো সুলতা। বললো, ‘গেছলো একটু হলেই।‘

তারপরই তার ঠোঁটদুটি বেঁকে উঠলো শ্লেষে, ‘এদিকে তো সারাটি পথ টেনে স্বামীর সেবা আর বই পড়ে কেটে গেল। যেন ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানেন না। কিন্তু আমাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঠিক দেখছিলো।‘

শিবনাথ ভয় ভয় চোখে তাকালো আশেপাশে। কী জানি, যার উদ্দেশ্যে কথাগুলি বলা হচ্ছে, তিনি হয়তো আশেপাশেই আছে। আর সুলতার কথাগুলিও প্রায় সেই রেল কর্তৃপক্ষের নোটিসের মতো, …জুয়াচোর চোর ও পকেটমার নিকটেই আছে।‘ শিবনাথ হেসে গলা নামিয়ে বললো, আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন, আমাদের ব্যাগটার দিকে নয় তো?’

সুলতা হাসলেও, ঠাট্টা করলো না। বললো, তা কি বলা যায়। শিবনাথ উঠে পড়লো।

-কোথায় যাচ্ছো?

—বসোখাবারের ব্যবস্থা দেখি। ওপারে গিয়ে আর খাওয়া যাবেনা শুনছি। সেই একেবারে কাল দুপুরে দার্জিলিং গিয়ে।

স্টীমার তখন ছেড়েছে। সকলেরই ছুটোছুটি পড়েছে ডাইনিং রুমের দিকে।

সুলতা কুঁচকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শিবনাথের চলে যাওয়ার দিকে। এই নোংরা হাতে পায়ে, ভিড়ের মধ্যে কেউ খেতে পারে?

পারে। না পারলে এত লোক ছুটোছুটি করছে কেন। আর শিবনাথ লোকের হাতে প্লেট চাপিয়ে এভাবে ভাত মাংস একেবারে কোলের ওপর এনে উপস্থিত করতে পারে নাকি?

অগত্যা গ্লাসের জলে হাত ধুয়েই আরম্ভ করতে হলো। খোঁপাটা ভেঙেছে সুলতার আগেই। আঁচলটা লুটোচ্ছে এখনো। বালির ঝাপটায় নাইলনের প্রাণও মূৰ্ছ। গেছে প্রায়। কেবল শিবনাথ একবার কানে কানে না বলে পারলো না, তোমার জামার একটা বোতাম কিন্তু অনেকক্ষণ ছেড়েছে। আঁটবে কখন?

সুলতার মুখ পাংশু দেখালো। সে একবার চোরাচোখে তাকিয়ে দেখলো, সত্যি তাই। ফিসফিস করে বললো, অসভ্য! এতক্ষণ বললানি কেন?, বাঁ হাতে আঁচলটা তুলে দাও শীগগির।

আঁচলটা তুলে দিতে দিতে বললো শিবনাথ, যা ঝড়!

যদিও সুলতার শরীরের লক্ষ্যটা ঔদ্ধত্যের দিকেই, কিন্তু সেটা স্বাভাবিক নয়। অতি দুরন্ত বিজ্ঞাপনের সাহায্য বোধ হয় সেজন্যই তাকে নিতে হয়েছে। গোটা শরীরের কাঠামোটা নিখুঁত ছিলো সুলতার, সৌন্দর্যটুকু ধরা দেয়নি প্রায় কোথাও। সর্বত্র একটা কাঠিন্যের স্পর্শ। এমন কি চোখের কোণে, ঠোঁটের কুঞ্চনেও। ফর্সা রং টুকু বোধ হয় সেইজন্যেই কেনো দীপ্তি দেয়নি? দিয়েছে রক্তহীন রুক্ষতা।–তার পাশে শিবনাথকে মোটামুটি দেখাচ্ছে কালো, সাধারণ মাপের বলিষ্ঠ চেহারা। সহসা দেখলে ক্লান্ত আর চিন্তাশীল মনে হতে পারে। কিন্তু তিরিশ পেরিয়েও তার আপাত শান্ত চোখে, আলোছায়ার দ্যুতিতে, একটু স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে যেন ঠেকে আছে কোথায়।

সাত বছরের চাকরি আর আড়াই বছরের বিয়ে, এই নিয়ে ঘরে বাইরের লেনদেন। বিধবা মা আর দিদি আছেন। একই সংসারের তারা ভিন্ন লোকবাসী। সাব এডিটরের টেবিল থেকে সুলতার খাটে, জীবনটাকে এরকম ভাগ করে দেখলেও ক্ষতি নেই।

প্রেমের ফাঁদ নাকি পাতা বনে। তাই এক আধবার যে পা আটকায়নি তা নয়। জীবনধারণের মারে সেগুলি আপনি খুলে গেছে। শেষ পর্যন্ত সুলতা, রীতিমতো দর কষাকষি করে। নিশ্বাসের ওপরে একটু বাতাস, এরকম একটি অবস্থার বাড়ির মেয়ে ও। কিছু নগদ টাকা, কিছু গহনা, খাট আর ড্রেসিং টেবিল নিয়ে ও এসেছিলো। আরো কিছু ঘর আর দম্পতির সাজবার মতো অনেক উপকরণ।

বিয়ের পর প্রথম গিয়েছিলো মধুপুরে। সেটা ছিলো সুলতাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়া। তারপরে এই দ্বিতীয় যাত্রা একেবারে হিমালয়ে, রফবাতাস এখন যেখানে শীত ধরাচ্ছে।

খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে সেই কথাটাই বললো সুলতা, মনে আছে সেই মধুপুরের কথা?

একটু যেন ভয়েই হেসে বললো কিনাথ, ‘খুব!’

অমনি সুলতা অভিমানাহত কটাক্ষ হেনে, কনুই দিয়ে খোঁচা দিলো শিবনাথকে। বললো, তাতে খুব হবেই। আমার সেই মাসতুতো বোন মিলিটা তো ডাইনীর মতো পেয়ে বসেছিলো তোমাকে।

হেসে ফেললো শিবনাথ। আরে, কী আশ্চর্য! কী যে বলো?

–না বাপু, তুমিও মেয়েন্যাকড়া কম নও।

–আমার তো ধারণা মেয়েরাই ছেলেনেকড়ি।

—ইস্‌।

তা বটে। আর সব বিবাহিতা মেয়েদের মতোই, সুলতারও স্বামী ছাড়া সব পুরুষ ছার। পাপের মধ্যে মিলি একটু জামাইবাবুর ভক্ত হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু সুলতা নিশ্চয় মরে গেলেও বিয়ের আগে অমন জাহবাবুর ভক্ত হতে পারতো না। পারতো না বলেই তার রচিত সংসারটা প্রেমের সংসার বলে ঘোষিত। শিবনাথ সেইটুকু জেনেই শান্ত।

কিন্তু চোখগুলো জ্বালা করছে কেন? যাত্রীদের সকলের মধ্যেই যেন একটু চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে।

ক্লিথ সামনে তাকালো। দূরের বিন্দু আলোগুলো তখন একটু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু আলোগুলো যতটা দূরে ভাবা গিয়েছিলো ততটা দূরে নেই। বোঝা গেল, স্টীমাঝে হুইসেল আর সুলতার প্রায় ডুকরে ওঠা ওগো আবার বালি। আবার বালির ঝড়।

ততক্ষণে কিনাথও চোখ ঢেকেছে। বাতাসটা যে এপর থেকেই ওপারে যাচ্ছিলো, তা বোঝা গেল। বালির ঝড়ের তাণ্ডবেই বাতিগুলোকে আরো দূরে মনে হচ্ছিলো। কিন্তু যে মুহূর্তে বালি তার সীমার মধ্যে পেয়েছে স্টীমারটাকে, সেই মুহূর্তে চমকে উঠেছে ধ্বই। এবার ঝিনাথও যেন একটু মুষড়ে পড়েছে। কারণ এবার ভিড় বেশী। তাড়াতাড়ি গিয়ে গাড়িতে না উঠতে পারলে, জায়গা পাওয়াই দুষ্কর। যদিও, সীট রিজার্ভ আছে তাদের।

তবু সে বললো, আরে তুমি ভাবছ কেন? যাওয়া হবেই। না হয় পরের প্যাসেঞ্জারে যাব। আমি তো ডিউটিতে যাচ্ছিনে। তুমি হ্যান্ডব্যাগটা হাতে নাও, নইলে এবারও কেউ টানাটানি করবে হয়তো।

বলতে বলতেই মুখে রুমাল চাপা দিলো শিবনাথ। বালির তাত কমেছে বটে, ঝাপটার দাপট এপারে দ্বিগুণ। রাশি রাশি ছুঁচ ছুঁড়ে মারার মতো। বাতাসের বেগ আরো প্রবল। খ্যাপাটা যে এপার থেকেই ডাক ছাড়ছিলো, বোঝা গেল এবার তীব্র গর্জনে। এপারে যেন সে সত্যি একটা নারে ফাঁদ-ই পেতেছে। বাতিগুলো শুধু ছায়াময়ী কুয়াশার মতো কী এক রহস্যে যেন হাসছে।

সুলতা প্রায় হাল ছেড়ে দেবার মতো, বললো ‘কী হবে? এ যে আরো ভয়ংকর!’

হেসে ফেললো শিবনাথ। বললো, ‘কী আবার হবে। তখন যেমন করে এসেছ, এখনো তেমন করেই যাবে। গাড়িতে উঠলেই সব শেষ। তারপরে হিমালয়ে গিয়ে যখন উঠবে—’

—থাক।

ধমক দিলো সুলতা। আঁচল চাপা মুখ থেকে তার স্বর ভেসে এলো, এরকম অবস্থায় অনেক গোলমাল হতে পারে। কেন যে মরতে হার-চুড়িগুলি পরে রেখেছিলুম। টাকা পয়সা খুব সাবধান, কিছু হারিও না যেন।

—আরে না না, কিছু হারাবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাক।

শিবনাথ সান্ত্বনা দিলে হেসে। সুলতা বললো, কি করে নিশ্চিন্ত থাকবো। এসব আপদের কথা তো তুমি কিছুই বলো নি।

শিবনাথ বললো, ‘আমি কি জানতুম নাকি?’

এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক পাশ থেকে বলে উঠলেন, ‘রোজ রোজ কি আর এমন ঝড় ওঠে এখানে। মাঝে মধ্যে হয়। আজ আমাদের কপালে জুটে গেছে।‘

স্টীমারটা একটা দীর্ঘ বাঁক নিয়ে জেটির গায়ে ঠেকলো। পরমুহূর্তেই ডাকাত পড়ার মতো, আবার সেই প্রেতছায়া কুলিরা। এবার ঝড়টা যত বেগে, কোলাহল তার চেয়ে বেশী। নিচের ডেকে হুড়োহুড়ি মারামারি লেগে গেছে। কুলিরা ওপরে এসেও মালপত্র ধরে টানাটানি শুরু করেছে। ওপরের লোকও হুড়মুড় করে নিচে নামতে চাইছে তাড়াতাড়ি। শিশুর কান্না, মেয়েদের চীৎকার, আর কুলিরা যেন এরই সঙ্গে তাল রাখছে হৈ-হৈ শব্দে।

আর এবার স্টীমারে থাকতে থাকতেই মনে হলো, যেন কেউ মুঠো মুঠো বালি চোখে মুখে ছুঁড়ে মারছে। এখন আর লু বইছে না বটে। পশ্চিমের এই দিগন্ত উন্মুক্ত রুক্ষ্ম চরার বাতাসে এখনো উত্তাপের আভাস। মেঘ কিংবা নক্ষত্র কিছুই নেই সামনে। আকাশটা উধাও হয়ে গেছে কোথায়। আছে শুধু কতকগুলো এক-চোখো ভুতুড়ে আলো। যেগুলো কোনো নিশানই দেয় না।

শিবনাথ ছটফটিয়ে উঠলো। অনেকেই নেমে পড়ছে তার সামনে দিয়ে। সে আর কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না। কুলিকে মাল তুলতে বললো।

সুলতা তাকে কঠিন বাহুপাশে আঁকড়ে ধরেছে। শিবনাথের সামনে লোক, পিছনে লোক। তাকে কে ঠেলছে আর সে কাকে ঠেলছে, কিছুই বলা যায় না। সবাই সবাইকে ঠেলছে। তার মনে হলো সিঁড়ি না ভেঙেই হুস করে নেমে এলো নিচে। সুলতা বারে বারে আর্তনাদ করে উঠছে। কিন্তু এখন আর কান দিতে গেলে চলবে না। বরং শিবনাথের মনে হলো, লোকের মধ্যে থাকলে বালির আক্রমণের সামনে থেকে অনেকখানি রেহাই পাওয়া যায়।

সিঁড়িটার নিচে নামতেই সুলতা ককিয়ে উঠলো, ‘উঃ, কিছু দেখতে পাচ্ছিনে।’

—দেখতে হবে না তোমাকে। কথা বলো না, আবার বালি ঢুকে যাবে মুখে।

এবার বোধ হয় সত্যি কাঁদছে সুলতা। বললো, ‘বাকী আছে নাকি! বালি তো খাচ্ছিই।’

শিবনাথ দম বন্ধ করে বললো, ‘জোরে ধর সুলতা। এখানটায় কাঠের সিঁড়িটা। খুব ভিড় এখানে।’

–কোথায় যে কম।

রাগে এবং দুঃখে সুলতা বললো শিবনাথেরই শরীরের কোনো একটা অংশ থেকে।

কিন্তু সিঁড়িটা পার হতে হতে শিবনাথের মনে হলো, সুলতার বন্ধন যেন শিথিল হয়ে যাচ্ছে!

-কি হলো!

—কিছু না। সুলতার প্রায় অস্ফুট গলা শোনা গেল।

সিঁড়ির বাইরে আসতে আসতে সুলতা ছিঁড়ে গেল শিবনাথের গা থেকে। আর সিঁড়ির কাছে আসামাত্রই প্রচণ্ড বালির ঝাপটা চাবুক কষালে চোখে মুখে। চোখে। একরাশ পিঁপড়ে হুল ফুটিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে, হাত বাড়িয়ে ডাকলো শিবনাথ, সুলতা।

কাছের ভিড় থেকে জবাব এলো, ‘এই যে।‘

শিবনাথ লোকের ধাক্কায় সরে গেল একপাশে। সে ডাকলো ‘এস! এই, এই কুলি।‘

কুলিটা দাঁড়িয়ে পড়েছিলো আগেই।

চোখ ঘষে শিবনাথ সামনে তাকালো কোনোরকমে। দেখলো, সামনেই সুলতার চুড়ি-পরা প্রসারিত হাত। শিবনাথ ধরলো হাতটা, একেবারে টেনে নিয়ে এলো বুকের কাছে। রুমাল কামড়ে ধরে মুখে কোনোরকমে বললো, কথা বলো না।

সুলতা খালি বললো, ‘উঃ!’

সে শিবনাথের কাঁধ না ধরে, দু’হাতে সর্বাঙ্গ বেষ্টন করলো।

মানুষের মন বড় বিচিত্র। শিবনাথের সহসা সুলতাকে বড় বেশী ভালো লাগতে লাগলো। শুধু আপন প্রাণ বাঁচানো নয়। যেন শিবনাথকে বাঁচাবার জন্য তার বুক দিয়ে আলিঙ্গন করেছে। এবার সে ঝুলে পড়ে নি। যেন শিবনাথ হোঁচট খেলে, সেও ধরে ফেলবে।

শিবনাথ বাঁ হাত দিয়ে তাকে আরও ঘনিষ্ট করে নিলো। এতো ভালো লাগলো, মনে হলো, এ দুর্দৈবের মধ্যে সুলতাকে সে যেন নতুন করে পেলো। আর অবাক্ হলো শিবনাথ, ঝড়ের দোলাটা যেন তার রক্তেই লেগেছে। সে দ্রুত এগুতে লাগলো অস্পষ্ট ছায়া ট্রেনটাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু বালির ঝড়টা এগুতে দিতে চায় না। সামনের মাটিই যেন চৌচির হয়ে ছিটকে লাগছে চোখে মুখে। বাতাস শাসাচ্ছে, ফুসছে, পরমুহূর্তেই দূরে সরে গিয়ে হাহা করে হাততালি দিয়ে হাসছে।

গাড়িটা কতদূর? লোকের ধাক্কা, ছুটোছুটি, চিৎকার। তারই সঙ্গে কতকগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়া উটের মতো ঘরের ছায়া থেকে গরম চা আর খাবারের ডাকাডাকি চলছে।

শিবনাথের মনে হলো সুলতা হাসছে। শিবনাথ মুখ নামিয়ে প্রায় বদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করলো, হাসছ নাকি?

চকিত মুহূর্তের একটি আড়ষ্টতায় যেন সুলতা স্তব্ধ হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই। সহজ হয়ে বললো, হ্যাঁ। তোমার গায়ে হঠাৎ এত শক্তি এলো কোথা থেকে তাই ভাবছি। আমাকে পিষে ফেললে যে!

হেসে উঠতে গিয়ে শিবনাথের সর্বাঙ্গে যেন বিদ্যুৎচমক লাগলো। সে তখনো হাঁটছিলো সামনের দিকে। সামনের আলোটার দিকে তাকাবার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু তার সমস্ত অনুভূতি দুটি হারে আলিঙ্গনের ঘন স্পর্শে বোমার মতো দাপাতে লাগলো। বালিতে ভরে যেতে লাগলো তার উদ্দীপ্ত চোখ। সে ডাকতে গেল। ঝড় যেন থাবা মারলো তার মুখে। সে আবার মুখ খুললো। ডাকলো, ‘সুলতা।‘

আর একটি চকিত মুহূর্তে স্তব্ধতা। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ছিটকে সরে গেল শিবনাথের দেহসংলগ্ন ছায়া। ঝড়ের শাসানির মধ্যেও শোনা গেল অস্ফুট আর্তস্বর। শিবনাথ দেখলো, লাল বোম্বাই সিল্ক নয়, হালকা আসমানি জর্জেট। ফর্শা নয়; শ্যাম চিকন বর্ণ। সুলতা নয়, লীলা। আশ্চর্য!

ঝড়টা, যেন থমকে গেল। বালি সরে গেল। দপদপিয়ে উঠলো বিশ্বের সব আলো। ক্ষোভে ও বিস্ময়ে প্রায় অস্ফুট কান্নার মতো শোনা গেল, ‘আপনি? আপনি কেন? আপনি কেন?’

শিবনাথের মনে হলো তার কান বন্ধ হয়ে গেল বালিতে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। চোখ অন্ধ হয়ে গেল। সে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, মাপ করবেন; আমি, আমি জানতে পারি নি।

বলেই সে চিৎকার করে উঠলো, ‘কুলি! কুলি দাঁড়াও এখানে।‘

আবার সে ভদ্রমহিলার দিকেই ফিরলো। বললো, ‘আমি এখুনি দেখছি আপনার স্বামী কোথায়। আপনি দাঁড়ান একটু দয়া করে। মাপ করবেন, আমি সুলতাকে—’

কথা শেষ না করেই, পিছনদিকে ছুটলো। ঝড়টা এবার তাকে তাড়া করলো পেছনে থেকে। মনে হলো সে উড়ে যাচ্ছে! আর খ্যাপা ঝড়টা হাসছে তার পেছনে হাততালি দিয়ে। কাঠের সিঁড়ির কাছে এসে সে চিৎকার করে ডাকলো, সুলতা! সুলতা!

কয়েকটি লোকের ভিড়ের মধ্যে, সুলতার রোরুদ্যমান গলা শোনা গেল, এসেছ, এসেছ তুমি? এই যে, এই যে আমি? এই যে।

ভিড় ঠেলে প্রায় ঝাঁপিয়ে এসে পড়লো সুলতা শিবনাথের বুকে। বোঝা গেল, সুলতার চিৎকারেই লোক জমে গেছে। চারদিক থেকে শুধু শোনা গেল, যাক, পাওয়া গেছে।

সুলতা তখন সমূহ আতঙ্কটা পার হয়, না কেঁদে পারছে না। কিন্তু খানিকটা অমনোযোগীভাবেই শিবনাথ তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো, কেঁদ না সুলতা। কদবার কি আছে? এখানে কি মানুষ হারায় নাকি? ওই তো স্টেশন, ওখানেই থাকতুম নিশ্চয়। তোমাকে ফেলে তো আর চলে যেতুম না গাড়িতে করে।

কান্নার মধ্যেও সুলতার অভিমান ফুটে উঠলো, কি করে আমাকে ফেলে চলে গেলে তুমি?

—কি আশ্চর্য!

বলছে, কিন্তু শিবনাথের দৃষ্টি ছায়াদের ভিড়ে। বললো, তোমাকে কি আমি ইচ্ছে করে ফেলে গেছি নাকি? আমি মনে করেছি, তুমি আমার সঙ্গে আছ।

বালি খেয়েও সুলতা একবার মুখ না ঢেকে বললো, কি করে মনে করলে? আমি তো তোমার গায়ের সঙ্গে লেপটে ছিলাম।

শিবনাথ যেন সচেতন হলো একটু। একটু চুপ করে রইলো। বলতে গেল, কিন্তু পারলো না। মনে হলো, সুলতা ব্যাপারটাকে তার নিজের প্রতি অবিচার ভেবে নেবে। বললো, আরে! সবাই তো সবার সঙ্গে লেপটে যাচ্ছে। এর আবার

থেমে গেল। সেই লাইটপোস্টটা। চোখের উপর থেকে রুমালটা একটু সরালো শিবনাথ। দেখলো, ভদ্রমহিলা একটি বেডিং-এর ওপর মুখে হাত চাপা দিয়ে বসে

আছেন। পাশে ভদ্রমহিলার স্বামী। কাছে যাবে নাকি শিবনাথ?

সুলতা বললো, ‘দাঁড়ালে কেন?’

–না, কুলিটাকে দেখছি। এখানেই ছিলো।

তার গলার স্বর শুনেই যেন ভদ্রমহিলা চোখ তুললেন। বালির ঝড়, মানুষগুলো সব ছাড়া। লু মনে হলো শিবনাথের ভদ্রমহিলা তার দিকেই তাকালেন। তারপরে দৃষ্টিটা আনুসরণ করেই নিজের কুলিটাকে চোখে পড়লো শিবনাথের। সুলতাকে নিয়ে সে এগিয়ে গেল।

তারপর গাড়িতে ওঠার পালা। সেখানেও ধস্তাধস্তি মারামারি। রিজার্ভেশন ক্লার্ক ভদ্রলোকটি প্রায় দয়া করে তাদের তুলে দিলেন। কিন্তু গোটা কামরাটা ভরতি শুধু বালি আর বালি। সবুজ রং চামড়ার সীটগুলি সাদা বালিতে ভরা। মানুষগুলো সব বালির পুতুল। সুলতা চিনতে পারে না শিবনাথকে। শিবনাথ পারে না সুলতাকে। সবাই ঝঋ করে কাঁচের শার্সি ফেলতে লাগলো। ফেলতে না ফেলতে বালির স্তর পড়তে লাগলো কাঁচের গায়ে। এ ঝড়ের এই জেদ, যতই সে বাধা পাবে রুদ্র হবে ততই। শার্সির তলায় সামান্য যে পিপড়ে ঢোকার মত ফাঁক, সেখান দিয়েও বালি ঢুকছে বাতাসের ঝাপটায়। যেন বালি নয়। চাক ভাঙা বোলতারা গর্জন করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

সুলতা বসলো। শিবনাথ বসতে গেল, পারলো না। বাইরে যাবে মনে করে দরজার দিকে এগুতে গেল। তার পা সরলো না। এখনো সে হতচকিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তবু তার দু চোখ ভরে একটি অদ্ভুত শূন্যতা।

সুলতা শিবনাথকে এই অবস্থায় দেখে, মুহূর্তে পাংশু হয়ে উঠলো। ছোট কামরাটার সবাইকে চমকে দিয়ে সে প্রায় আর্তস্বরে বলে উঠলো, হয়েছে! সর্বনাশ হয়েছে!

শিবনাথ ফিরলো, কিন্তু তার শূন্যতা ঘুচলো না চোখের। গলার স্বরে কোন সুর নেই যেন। বললো, ‘অ্যাঁ?’

সুলতা শিবনাথের পাঞ্জাবি ধরে হ্যাচকা টান মেরে বললো, ‘গেছে, মানিব্যাগটা গেছে?’ বলতে বলতে সে নিজেই হাত ঢুকিয়ে দিলো পকেটে। শিবনাথ বললো, ‘না তো। মানিব্যাগ আছে।’ সুলতার হাতে উঠে এলো মানিব্যাগটা। দু’চোখে তার দ্যুতি ফিরে এলো। বললো, ‘তবে তুমি ওরকম করে আছো কেন?’

সচেতন হতে চাইলে শিবনাথ। বললো, ‘কেমন?’

-কেমন যেন। কি যেন একটা হয়েছে তোমার। এখনো তোমার ভয় করছে? কেন, আমাকে তো পেয়ে গেছ।

সবই তো ঠিক আছে। কিছু তো হারায় নি।

হারিয়েছে কিনা দেখবার জন্যেই সুলতা আর একবার তার সমস্ত মালপত্রের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো।

শিবনাথের সারা মুখে ঘামের ওপর বালি পড়ে পুরনো ঘরের ভাঙা খসা পলেস্তারার মতো দেখাচ্ছে। শুকনো ঠোঁট দুটিতে জমে গেছে বালি। মাথার চুল সাদা। সে প্রায় একটা ক্লাউনের মতো পেশার দায়ে জোর করে হেসে বললো, হারায় নি কিছু। মানে কিরকম একটা অব্যবস্থা, হট্টগোল…’

সুলতা মুখ মুছতে মুছতে বললো, ‘জঘন্য!’

গাড়িটা কখন চলতে শুরু করেছে। বোঝা যাচ্ছে, ঝড়টা এখনো গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এখনো নানান ফাঁকে ফাঁকে সোঁ সোঁ করে ঢুকছে বালি। এখনো সেই খ্যাপাটা হাসছে অট্টরোলে। হাততালি দিচ্ছে নেচে নেচে।

শিনাথ বাথরুমে ঢুকলো। দরজা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াতেই আয়নার বুকে নিজের মুখোমুখি হলো সে। আর তক্ষণাৎ সেই আলিঙ্গনের অনুভূতিটা পিলপিল করে, বেয়ে বেয়ে বেড়াতে লাগলো তার সারা গায়ে। শিকনাথ ধিক্কার দিলো নিজেকে। ছি ছি করলো। মুখ ফিরিয়ে নিলো, নিজের ছায়ার দিক থেকে। তু তার সারা গায়ে বিস্মিত বাবা তীব্র অনুভূতিটা দপদপ করতে লাগলো। তার দু’চোখের শূন্যতা ভরাট হতে চাইলো না কিছুতেই। সে যেন সভয়ে দেখলো, কত অব্যর্থভাবে হাত বাড়িয়ে ব্যাগটি তুলে নিয়েছিলো মেয়েটি। কিন্তু ব্যাগ সে নেয় নি। শেষ পর্যন্ত যা সে নিয়েছে তার কোনো মূল্য নেই সংসারে। কোনো কৈফিয়ত নেই সমাজের কাছে, নীতির কাছে যুক্তির কাছে। একজন বিবাহিত পুরুষ একজন সাধারণ সব-এডিটরের লজ্জাকর ধিকৃত তৃষ্ণার গ্লানি, মৌমাছির মত নিজেরই গায়ে হুল ফুটিয়ে একটি আস্বাদ খুঁজবে।

আর একজন, দেখে মনে হয়েছে, স্বামীকে সে বলতে পারে নি। কেবল কুটনা অবিশ্বাসী এক পুরুষের জেনে শুনে স্বেচ্ছাকৃত আলিঙ্গনের গ্লানি অনুভব করবে। এবং সেও দার্জিলিং যাচ্ছে। হয়তো দেখা হবে। তীব্র সন্দেহে ঝলকে উঠবে আয়ত চোখ দুটি। রুদ্ধ তীক্ষ্ণ স্বক্সের ভৎর্সনা হানবে পাহাড়ের বাতাসে, আপনি কেন? আপনি কেন?

জবাব দূরের কথা। শিবনাথের অনুভূতির পিঞ্জরে বোবাটা বু মরবে দাপিয়ে দাপিয়ে। বিশ্বের এক ভয়ংকর বিস্ময়ে অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকবে তার স্ত্রী সুলতার স্নেহে ও ভালোবাসায় রচা সংসারের দিকে।

ট্যাপ খুলে দিলো কিনাথ। জল গরম আর বালি মেশানো। এ বালি কোনো রই বাদ দেয়নি দেখা যাচ্ছে। বালি মেশানো গরম জল শিবনাথ আঁজলা মুখে ছিটিয়ে দিতে লাগলো।

বাইরে যখন এলো, তখনো বালি উড়ছে সারা কামরায়।

.

সুলতা ডাকলো, ‘এই। এই, ওঠো না।’

শিবনাথের দ্বাঙ্গ তখনো লেপের তলায়। সুলতা রীতিমতো প্রসাধন করে উলেন ক্লোক চাপিয়ে বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত। ওরা দশদিন হলো দার্জিলিং এসেছে।

শিনাথ ক্লান্ত সুরে বললো, উঠতে ইচ্ছে করছে না। উত্তরে জানালাটা খুলে দাও না সুলত।

সুলতা জানালা খুলে দিতে দিতে বললো, ‘কী হবে ছাই খুলে দিয়ে। ওই ছিচকেপোড়া রোদ, কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা নেই।’

জানলাটা খুলে দিতেই এক ঝলক রোদ ঢুকলো ঘরে। সামনে ধূর আকাশ। পুব ঘেঁষে। দূরে কালিম্পং-এর ইশারা। সামনে ভুটিয়া বস্তির ধাপে ধাপে নেমে-পড়া বনস্পতির শীর্ষ। তারপরের শূন্যতাটা যেন লেবং মালভূমির মাথার ওপরে। ভুটিয়া বস্তির পুব উঁচুতে—ভাড়াটে বাংলোর একটি ঘর নিয়েছে ওরা। খাবার আসে হোটেল থেকে। চায়ের সরঞ্জামটাই শুধু রেখেছে সুলতা নিজের হাতে।

ঘুম-জড়ানোমোটা স্বরে বললো শিবনাথ, ‘ও কি অত সহজে দেখা দেয়। কত সাধ্য সাধনা করতে হয়, তবেই না আবির্ভাব।‘

সুলতা এসে বসলো শিবনাথের শিয়রে। বললো,’ তা তো বুঝলুম, কিন্তু তোমার কি হয়েছে বলছ না কেন, বলো তো? তুমিও যে কাঞ্চনঝঙঘার মতো মেঘে ঢাকা হয়ে রইলে।‘

শিবনাথ হাসবার ভান করে বললো, ‘কি আবার হবে।‘

—সেইটাই তো শুনতে চাই। সেই যে মণিহারিঘাট থেকে কি হলো, তারপরে আর ঠিক সে মানুষটাকে তো খুঁজে পাচ্ছিনে।

–কী খুঁজে পাচ্ছ না?

—সেটা হাতে করে তুলে দেখাতে পারছিনে। ওরকমভাবে দেখানো যায় না, না হলে দেখাতুম।

—তা হলে চেখে দেখাও। সুলতা পা দাপিয়ে, ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, না সত্যি, ফাজলামো নয়।

শিবনাথ যেন কথা বাড়াবার ভয়েই তাড়াতাড়ি সুলতাকে টেনে এনে চুমু খেলো। তারপর বললো, ’বোকা কোথাকার।‘

সুলতা বললে, হ্যাঁ, ভোলানো হচ্ছে আমাকে।

বলেও কিন্তু সুলতা উঠে পড়ে বললো, আমি তাহলে যাচ্ছি। ফ্লাস্কে চা আছে, খেয়ে এসো তাড়াতাড়ি।

চলে গেল সুলতা। ম্যালে গেল, বেড়াবে, বসে থাকবে বলে। প্রথম প্রথম দু’দিন শিবনাথের সঙ্গে এখানে সেখানে হেঁটে হেঁটে গেছে। কিন্তু পারে না। ওর হৃৎপিণ্ডে চাপ লাগে। রক্তহীন রুক্ষতাটা রুগ্নতায় পর্যবসিত হয়। ভিটা ওর অনেকখানি শূন্য।

তাই সুলতা ম্যালে বেড়ায়, বসে থাকে। শিবনাথ তাকে বুড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘুরে বেড়ায় অরণ্যে, খাদে, ঢালুতে পাহাড়ী জনপদে।

আর শিবনাথ দেখেছে, ওরাও এসেছে। ও আর ওর স্বামী। ও কেন, নামটাই বলা যাক। লীলা আর ওর স্বামী। লীলার স্বামীও বসে থাকেন ম্যালের বেঞ্চে। শান্ত, চিন্তিত। মোটা লেন্সের চশমায় একটা ঝকঝকে তীক্ষ্ণতা নিয়ে চারদিকে তাকান। বোধহয় ভদ্রলোক অসুস্থ। হেঁটে ফিরে বেড়াবার উপায় নেই হয়তো। তাই তন্ময় হয়ে দেখেন চারদিক। লীলা যেন পা টিপে টিপে কাছে কাছেই ঘোরাফেরা করে। তার বুড়ি ছোঁয়া দৌড়ের পাল্লা বেশী দূর নয়। অবজারভেটারির একটু এপাশে, নয়তো একটু ওপাশে। ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরীর কাছাকাছি, নয়তো দেশবন্ধুর স্মৃতি-মন্দিরটার সীমানায়। এদিকে শহর আর হ্যাপিভ্যালীর সীমানায় চোখ যায়। ওদিকে ভুটিয়া বস্তি আর সর্পিল পক্ষের পাকে জড়ানো লেবং।

ফিরে আসে আবার। মুখখামুখি হয় স্বামীর। দু’জনেই হাসেন। তারপর ভদ্রলোকের প্রসারিত হাতটা লীলাকে অনেক দূর যাবার নিশানা দেখিয়ে, তার জন্য নিশ্চিন্ত থাকতে বলেন।

লীলা হেসে তাকায় সেই দূরের দিকে। পায়ে পায়ে এগোয়। টিপে টিপে, আস্তে আস্তে, সভয়ে। যেন কেউ তাকে অনুসরণ করছে, সেই ভয়ংকর পায়ের শব্দ তার কানে যায়। সেই শব্দ পায় সে, সন্ত্রস্ত হৃৎপিণ্ডের তালে। কিংবা হয়তো, শিবনাথই শুধু এমনটা ভাবে। লীলা কিছুই ভাবে না।

শিবনাথ জানে, লীলা টের পেয়েছে তার উপস্থিতি। শুধু উপস্থিত নয়, শিবনাথের সঙ্গে তার সহসা দৃষ্টিবিনিময় হয়েছে দু একবার। লীলা তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়েছে। শিবনাথও চোখ ফিরিয়েছে। লীলা ওর আয়ত চোখ তুলে, ঈষৎ স্কুল ঠোঁটে বিচিত্র হেসে কী বিচিত্র কথা না জানি বলেছে তখন স্বামীকে।

সুলতা তখন শুধু ধমকেছে হয়তো শিবনাথকে, কী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ম্যালের শো-কেস দেখছো? কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। আচ্ছা চলো, আমি গভর্ণর হাউস পর্যন্ত হেঁটে আসি। ও রাস্তা তো উঁচু নিচু নয়।

আশ্চর্য। লীলাকে আর চিনতেও পরে না সুলতা।

শিবনাথ চলে যায় সুলতার সঙ্গে। হয়তো গভর্ণর হাউস পর্যন্ত। কিংবা সিনেমা হল অবধি।

তারপর সুলতা ফিরে যায়। শিবনাথ চলে যায় দূরে। কোনো পাহাড়ে, চা বাগানে কিংবা শহরেরই অলিতে গলিতে।

এর মধ্যে এরা গাড়িতে ঘুম মনারিতে গেছে, দেখে এসেছে লেবং-এর ছোট্টা মালভূমিকে। আর পাঁচদিনের মেয়াদ আছে ওদের তারপরে নেমে যেতে হবে।

কিন্তু অনুভূতির পিঞ্জরে বোবাটার দাপানি গেল না। মুখও খুলল না। কী একটা ব্যক্ত করার আকাঙক্ষা রয়ে গেল। কেউ ধরে রাখে নি, বেঁধেও রাখে নি এমনি একটা ছুতো তবু খেলা, খাওয়া, বেড়ানো আর পাহাড়ী জনপদের পায়ের তলায় রইলো পড়ে।

বিছানা ছেড়ে উঠলো শিবনাথ। দাড়ি কামালো আগে। ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে খেয়ে, জানলায় উঁকি দিলো। গড়িয়ে গড়িয়ে এঁকেবেঁকে নেমেছে ভুটিয়া বস্তি। কোথাও কতকগুলো বিচিত্রবেশিনী মেয়ের দল, কোথাও কতগুলো বিচিত্রবেশ পুরুষের ঝিমুনো জটলা। লোক নামে, লোক ওঠে, পায়ে পায়ে খেলে বেড়াচ্ছে বাচ্চারা। গাছে মাথা পেরিয়ে লেবং-এর সামান্য সমতল উঁকি দিচ্ছে।

চপ্পল পরে, সার্জের পাঞ্জাবিটা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লো শিবনাথ। পাঁচ মিনিটেই ম্যাল। মরশুমী ফুলের মতো আগন্তুক জনতার ভিড়। ভিড় করেছে পাহাড়ীরা। ওরাও গালে হাত দিয়ে এই সমতলবাসী মানুষদের দেখতে থাকে।

কী দেখে, কে জানে!

-এই যে!

সুলতার চড়া গলা ভেসে এলো দূরের বেঞ্চি থেকে। সেই ডাকে অনেকেই ফিরে তাকালো ওদের দুজনের দিকে।

সুলতাই এগিয়ে এলো তাড়াতাড়ি। বললো, উঃ, অপেক্ষা করে করে আর পারিনে। নিশ্চয় ঘুমোচ্ছিলে আবার।

শিবনাথ বললো, একটুখানি।

–কুম্ভকর্ণ কোথাকার!

তারপরেই বললো, আচ্ছা, তুমি তো একদিনও ঘোড়ায় চাপলে না?

—আমি?

হো হো করে হেসে উঠলো শিবনাথ। আর ওর হাস্কি শব্দে চমকেই বুঝি লীলা ফিরে তাকালো। চোখাচোখি হয়ে গেল দু’জনের। কিনাথ দেখলো, লীলা তার স্বামীর পাশে বসে। ওর স্বামীর ঘাড়ের পাশ দিয়ে, মুখটা একেবারে উল্টোদিকে ঘুরিয়েছে।

—না সত্যি, তুমি একবার ঘোড়ায় চাপ না?

—আমার ভয় করে। তুমি চাপবে তো বলো।

সুলতা বললো, অসভ্য!

—অসভ্য কেন? কত মেয়েরা তো চাপে।

–বাব্বা আমি মরেই যাব।

অতএব ইতি। শিবনাথ বললো, আজ তুমি অবজারভেটরি রাউন্ড দিয়ে এস, আমি বসি।

সুলতা বললো, প্যাচার মতো?

—প্যাচার মতো কেন? আমি ততক্ষণ খবরের কাগজটা পড়ি।

—বেশ।

সুলতা সত্যি হাঁটতে আরম্ভ করলো। শিবনাথ ফিরতে গিয়ে দেখলো, লীলা উঠে দাঁড়িয়েছে। শিবনাথ ফোয়ারাটা পর্যন্ত গেল। আবার ফিরলো। দেখলো লীলা সুলতার পথটাই ধরেছে।

শিবনাথ দোকানে গিয়ে একটা বাসি খবরের কাগজ কিনলো। মুড়ে রাখলো পকেটে। এলোমেলোভাবে। ছবি দেখলো শো-কেসে, তারপর আবার এলো ম্যালের সমতলে। লীলা নেই। কিন্তু ও পথে পা বাড়াতে তার ভয় করতে লাগলো। সে অবজারভেটরির উত্তরদিকের পথটা ধরে হাঁটতে লাগলো। এ পাথরের পটার ওপিঠেই, সুলতা আর লীলার অস্তিত্বটা সে যেন টের পাচ্ছে। ঘুরে এলো, ওরা এ পথেই আসবে।

শিনাথ এগুতে লাগলো। কতক্ষণ এগিয়েছে, খেয়াল নেই। সহসা দূরে একটি লালের ইশারা পেয়ে থেমে গেলো সে। লীলার গায়ে একটা লাল স্কার্ফ ছিলো না? ছিলো। কিন্তু সামনের লালটা সুলতার লাল ক্লোক। তারই হাই হিলের ঘায়ে চকিত হচ্ছে—এই নির্জন পাহাড়ের গা।

শিবনাথ বললো, এসে পড়েছ?

সুলতা তখনো হাঁফাচ্ছে।–উঃ, কী নির্জন রাস্তা। এত ভয় করছিলো একলা একলা। কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছ?

শিবনাথ বললো, এমনি এগুচ্ছিলাম। জানি তুমি এ পথেই ফিরবে। তবে ভয়ের কিছু নেই।

সুলতা হাত ধরলো শিবনাথের। শিবনাথ বললো, এস এই গাছতলাটায় বসি।

ওরা বসলো। রাস্তাটা একটু জেগেছিলো। আবার যেন পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। একেবারে নিঃশব্দ, শুধু ঝিঝির ডাক। কুয়াশা ঘনাতে লাগলো।

তারপরে দুদিন শিবনাথ অনেক দূর-দূরান্তে বেড়ালো পায়ে হেঁটে। তৃতীয় দিন ঘোষণা করলো, বিছানাপত্র বাঁধা যাক।

–এর মধ্যেই?

—আর কি, পরশু তো যেতে হবে।

—তা বলে এখুনি বিছানা বাঁধতে হবে।

—ওই আর কি কথার কথা বললুম। আর কি, পুরনো লাগছে দার্জিলিং।

তোমাদের সবই তাড়াতাড়ি পুরনো লেগে যায়। একদিন তো ভালো করে কাঞ্চনজঙ্ঘাও

সে তো কাঞ্চনঝঙঘার মর্জি।

একথা হচ্ছিলো রাত্রে। পরদিন সুলতার চিৎকার ও দাপাদাপিতে ঘুম ভাঙলো শিবনাথের। গা থেকে লেপটা খুলে নিলো সে।

শিবনাথ বললো, কী হয়েছে?

সুলতা জানলার দিকে দেখিয়ে বললো, দেখ দেখ, আজ একটু দেখ।

শিবনাথ দেখলো, সুনীল আকাশের বুকে রুপোর মুকুট মাথায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। ধূসর রক্তাভ তার মুখের রেখা। গরাদহীন জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সে আরো দেখলো, উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় অর্ধচন্দ্রাকারে তুষার ধবল হাসি গলে গলে পড়ছে নীল আকাশে। আর ভুটিয়া বস্তি থেকে ভেসে আসছে ব্যাগপাইপের বিচিত্র এক আদিম পাহাড়ী রাগিণী। বস্তিতে আজ দলা পাকানো জটলা নেই, ঝর্ণার মতো চলমান। ছেলেমেয়েরা দৌড়ে চীৎকার করে বেড়াচ্ছে।

নীল আকাশ, তুষার শৃঙ্গের উদয়, ঝকঝকে রোদ আজ যেন কিসের উৎসব লাগিয়ে দিয়েছে পাহাড়ে। শুধু বাইরের নয়, পাহাড়ের ঘরের মানুষেরাও যেন আজ আমন্ত্রিত।

সুলতা ছুটে গেল দরজার কাছে। থেমে বললো, আমি যাচ্ছি বাইরে, তুমি এস।

চলে গেলও। শিবনাথ বসতে যাচ্ছিলো, পারলো না। হাত মুখ ধুতে হলো তাকে। চা খেয়ে জামা চাপাতে হলো। ম্যালে এসে উঠলো সে। চেনা বেঞ্চিটার দিকে তাকিয়ে দেখলো। লীলা নেই, স্বামী আছেন। কিন্তু আজ বসে নেই। উত্তরে দক্ষিণে পায়চারি করছেন অলেস্টার পরে।

সুলতা ছুটে এলো কোত্থেকে। বললো, তুমি কোথাও যাবে।

—তুমি যাবে?

–না। আমি বসে বসে খালি দেখব। আজ হয়তো আর কাঞ্চনজঙ্ঘা ঢাকবে না, না?

—বোধ হয়। তুমি তবে বস, আমি একটা চক্কর দিয়ে আসি।

শিবনাথ ভুটিয়া বস্তিরই পাশ দিয়ে, নেমে চললো বার্চ হিল রোডের সর্পিল ঢালুতে। যে-পথে চললে, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সঙ্গী বলে মনে হবে। আজ বুঝি কোন্ ভুটিয়া জোয়ান সকাল থেকেই মাতাল হয়ে গেছে। কিংবা কোনো ধর্মীয় উৎসব আছে। ব্যাগপাইপটা নামবে না ওর মুখ থেকে আজ। তুষার শৃঙ্গে পাঠাবে ওর সুর।

বাৰ্চহিল রোডের একটা সীমান্ত, গভর্ণরের বাড়ির পশ্চিম দরজার কাছে এসে উঠলো শিবনাথ। সামনেই অবজারভেটারি পাশেই উত্তর দিকের নির্জন রাস্তাটা।

উত্তর দিকে নির্জন রাস্তাটায় বেঁকে গিয়ে দাঁড়ালো সে। লীলা। লীলা দক্ষিণের পথ দিয়ে এসে উত্তরের বাঁকে থমকে দাঁড়ালো। দাঁড়ালো পিছন ফিরে তাকালো একবার। তারপর শিবনাথের কয়েক হাত দূর দিয়ে, উত্তরের ঘুমন্ত রাস্তাটাকে জাগিয়ে দিলো।

যেন পথরোধ হলো শিবনাথের। সে দাঁড়িয়ে রইলো তেমনি। লীলা চলেছে ধীরে, অতি ধীরে। অনেকক্ষণ পর পর তার ছোট হিলের একটি একটি শব্দ, যেন একটু একটু করে ঘুম ভাঙাচ্ছে রাস্তাটার। শিবনাথ দু’পা সরে, রাস্তার রেলিংটা চেপে ধরলো। লীলাও দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়ে উত্তরদিকে ফিরে সেও রেলিংটা ধরলো। একই রেলিং, পনের হাত দূরে। শিবনাথের মনে হলো লীলার হাতটা যেন তারই হাতের ওপর এসে পড়লো।

কে একটি লোক চলে গেল আপন মনে। উত্তরে বাৰ্চহিল রোডের পাড়াগুলি নেমে গেছে নিচে। রোদে চক করছে লেবং-এর সমতল। আর গোটা আকাশব্যাপী তুষারশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার বিস্তৃত বাহু। লাল, নীল, সবুজ বুনো ফুলের ছড়াছড়ি ঘাসে গাসে। পাথারে পাথারে পাথরের গোলাপেরা রোদে চলকাচ্ছে। সবুজসোনা গলে পড়ছে দেবদারুর পাতায় পাতায়। প্রজাপতিরা হারিয়ে যাচ্ছে ফুলের রঙে রঙে। বাতাস বইছে। পাতা ঝরছে দু একটি। আর পাগলা ভুটিয়াটার ব্যাগপাইপের আদিম সুর থামবে না।

এত আয়োজন কি আজই হলো। কি করবে শিবনাথ? তার মনে হলো তার পিঞ্জরাবদ্ধ বোবা অনুভূতিটারই এতো প্রকাশ সমারোহ। তাই ওর বুকের রক্তধারা যেন নাচতে লাগলো। ফিরে তাকালো লীলার দিকে। দেখলো, লীলা, ঠিক ওর দিকে নয়, ওরই দেহের সীমায় তাকিয়ে আছে। ওর শ্যামচিকন মুখে রোদ লেগে কচি পাতার মতো দেখাচ্ছে। আয়ত চোখ দুটিতে রৌদ্রচকিত তুষারশৃঙ্গের ছায়া।

শিবনাথ রেলিং ধরে ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেল। লীলা চোখ তুললো। তুলে, হাসল সলজ্জভাবে।

শিবনাথ অনেক কষ্টে বললো, আপনার স্বামী ভালো আছেন?

—আছেন।

লীলা বললো নিচু গলায়। কপাল থেকে তুলে দিলো কয়েক গোছা রুক্ষ চুল। বললো, আপনার স্ত্রীকে নিয়ে বেরোন না কেন?

শিবনাথ বললো, ও উঁচু নিচু করতে পারে না।

একটু চুপ। আবার বললো, আপনার স্বামীর কি শরীর ভালো নেই?

লীলার স্বাভাবিক রক্তাভ ঠোঁটে অতি সাধারণ হাসি একটি অসাধারণ মায়ায় উজ্জ্বল। বললো, না। ওঁর ধারণা, ওর শরীর মোটেই ভালো নেই। দিনরাত্রি ফার্মের ব্যবসার হিসেবে সব সময় টায়ার্ড থাকেন।

কে দু’জন লোক চলে গেল দুদিকে। ওরা দু’জনে তাকিয়ে রইলো কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে। শুকনো পাতা পড়লো খসে একটা। দু’জনেই পাতাটার দিকে তাকিয়েছিলো। চোখাচোখি হলো আবার। হাসলো দু’জনই। শিবনাথ আরো এগিয়ে এলো কাছে। বললো, দেখুন সেদিন সেই বালির ঝড়ে–

লীলাও বলে উঠলো, আমিও সেই কথা বলবো ভাবছিলুম, বালির ঝড়—

শিবনাথ প্রায় ফিফি করে বললো, বলুন।

লীলার দু’চোখে যেন সহসা একটি নতুন হাসি লজ্জায় ঝিলিক দিয়ে উঠলো। বললো, কী আর বলবো। বালির ঝড় বলেই এমন হয়েছিলো নিশ্চয়।

—তাতে আপনার মনে কোনো গ্লানি–?

শিবনাথ কথাটা শেষ করতে পারলো না। উগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইলো লীলার নত মুখের দিকে। রেলিং-এ আঙুল ঘষতে গিয়ে লীলার সোনার বালাটা লোহায় লেগে বাজতে লাগলো ঠুনঠু করে।

মাথা নিচু করেই ঘাড় নেড়ে বললো, নেই। আপনার?

লীলা তাকালো শিবনাথের দিকে। শিবনাথের মুখে সেই বোব অসহায় অনুভূতিটা যেন ফিরে এলো। পরমুহূর্তেই নিশ্বাস ফেলে বললো, আপনার গ্লানি না থাকার আনন্দটাই আমার ভাগে রয়েছে।

লীলা তাড়াতাড়ি চোখ নামালো। অস্ফুটে বললো, কী বিচিত্র! আবার চোখ তুললো। তারপর দুজনেই হেসে ফেললো। বালির ঝড়ের ঝাপসা বোবা কথাগুলি যেন বিশ্বের ওই সকল আলোর মাঝখানে হাসির ছটায় ঝলকে উঠলো। পাতা হাসছে, ফুল হাসছে, কনক কিরীট মাথায় কাঞ্চনজঙঘাও হাসছে। ওই আদিম বাঁশটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে একটা হাসিরই উচ্ছ্বাস যেন সুর হয়ে ভাসছে।

আর হাসি দিয়ে এই শেষ কথার পর, বরফলেহী বাতাস যেন সহসা ব্যাকুল হয়ে উঠলো। ব্যাকুল বাতাসে ওরা আবার চুপ করে অনেকক্ষণ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইলো। আরো অনেক ক’টা পাতা ঝরলো। বাঁশীটা বাজতে লাগলো। কাঞ্চনজঙ্ঘা আজ কিছুতেই বিদায় নিচ্ছে না।

তারপরে আবার ওরা দু’জনে চোখাচোখি করে হাসলো। লীলা বললো, যাই এবারে।।

শিবনাথ বললো, আসুন।

লীলা চলে গেল রাস্তাটার ঘুম ভাঙাতে ভাঙাতে। শিবনাথ আবার নেমে গেলো বাৰ্চহিল রোডে, যে-পথে এসেছিলো। দূরের উঁচুতে একবার যেন দেখা গেল লীলাকে। তারপরেই ঘন জঙ্গল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *