১৩.আরণ্যক – ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ


প্রায় তিন মাস পরে নিজের মহালে ফিরিব। সার্ভের কাজ এতদিনে শেষ হইল।

এগারো ক্রোশ রাস্তা। এই পথেই সে-বার সেই পৌষসংক্রান্তির মেলায় আসিয়াছিলাম-সেই শাল-পলাশের বন, শিলাখণ্ড-ছড়ানো মুক্তপ্রান্তর, উঁচু নিচু শৈলমালা। ঘণ্টা-দুই চলিয়া আসিবার পরে দূরে দিগ্বলয়ের কোলে একটি ধূসর রেখা দেখা গেল-মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্ট।

এই পরিচিত দিক্-জ্ঞাপক দৃশ্যটি আজ তিন মাস দেখি নাই। এতদিন এখানে আসিয়া আমাদের লবটুলিয়া ও নাঢ়া-বইহারের উপর এমন একটা টান জন্মিয়া গিয়াছে যেন ইহাদের ছাড়িয়া বেশিদিন কোথাও থাকিলে কষ্ট হয়, মনে হয়, দেশ ছাড়িয়া বিদেশে আছি। আজ তিন মাস পরে মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের সীমারেখা দেখিয়া প্রবাসীর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের আনন্দ অনুভব করিলাম, যদিচ এখনো লবটুলিয়ার সীমানা এখান হইতে সাত-আট মাইল দূরে হইবে।

ছোট একটা পাহাড়ের নিচে এক জায়গায় অনেকখানি জুড়িয়া জঙ্গল কাটিয়া কুসুমফুলের আবাদ করিয়াছিল-এখন পাকিবার সময়, কাটুনী জনেরা ক্ষেতে কাজ করিতেছে।

আমি ক্ষেতের পাশের রাস্তা দিয়া যাইতেছি, হঠাৎ ক্ষেতের দিক হইতে কে আমায় ডাকিল-বাবুজী, ও বাবুজী-বাবুজী-
চাহিয়া দেখি, আর-বছরের সেই মঞ্চী!

বিস্মিত হইলাম, আনন্দিতও হইলাম। ঘোড়া থামাইতেই মঞ্চী হাসিমুখে কাস্তে-হাতে ছুটিয়া ঘোড়ার পাশে দাঁড়াইল। বলিল-আমি দূর থেকেই ঘোড়া দেখে মালুম করেছি। কোথায় গিয়েছিলেন বাবুজী?

মঞ্চী ঠিক তেমনই আছে দেখিতে-বরং আরো একটু স্বাস্থ্যবতী হইয়াছে। কুসুমফুলের পাপড়ির গুঁড়া লাগিয়া তাহার হাতখানা ও পরনের শাড়ির সামনের দিকটা রাঙা।

বলিলাম-বহরাবুরু পাহাড়ের নিচে কাজ পড়েছিল, সেখানে তিন মাস ছিলাম। সেখান থেকে ফিরছি। তোমরা এখানে কি করছ?
-কুসুমফুল কাটছি, বাবুজী। বেলা হয়ে গিয়েছে, এবেলা নামুন এখানে। ঐ তো কাছেই খুপরি।

আমার কোনো আপত্তি টিকিল না। মঞ্চী কাজ ফেলিয়া আমাকে তাহাদের খুপরিতে লইয়া চলিল। মঞ্চীর স্বামী নক্ছেদী ভকত আমার আসার সংবাদ শুনিয়া ক্ষেত হইতে আসিল।

নক্ছেদী ভকতের প্রথম-পক্ষের স্ত্রী খুপরির মধ্যে রান্নার কাজ করিতেছিল, সেও আমাকে দেখিয়া খুশি হইল।

তবে মঞ্চী সকল কাজে অগ্রণী। সে আমার জন্য গমের খড় পাতিয়া পুরু করিয়া বসিবার আসন করিল। একটি ছোট বাটিতে মহুয়ার তৈল আনিয়া আমাকে স্নান করিয়া আসিতে বলিল।

বলিল-চলুন, আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি-ঐ টোলার দক্ষিণে একটা ছোট্ট কুণ্ডী আছে। বেশ জল।

বলিলাম-সে জলে আমি নাইব না মঞ্চী। টোলসুদ্ধ লোক সেই জলে কাপড় কাচে, মুখ ধোয়, স্নান করে, বাসনও মাজে। সে জল বড় খারাপ হবে, তোমরা কি এখানে সেই জলই খাচ্ছ? তা হলে আমি উঠি। ও জল আমি খাব না।

মঞ্চী ভাবনায় পড়িয়া গেল। বোঝা গেল ইহারাও সেই জল ছাড়া অন্য জল পাইবে কোথায় যে খাইবে না। না খাইয়া উপায় কি?

মঞ্চীর বিষন্ন মুখ দেখিয়া আমার কষ্ট হইল। এই দূষিত জল ইহারা মনের আনন্দে পান করিয়া আসিতেছে, কখনো ভাবে নাই এ-জলে আবার কি থাকিতে পারে, আজ আমি যদি জলের অজুহাতে ইহাদের আতিথ্য গ্রহণ না করিয়া চলিয়া যাই, সরলপ্রাণ মেয়েটি মনে বড় আঘাত পাইবে।

মঞ্চীকে বলিলাম-বেশ, ঐ জল খুব করে ফুটিয়ে নাও-তবে খাব। স্নান করা থাক গে।

মঞ্চী বলিল-কেন বাবুজী, আমি আপনাকে এক টিন জল ফুটিয়ে দিচ্ছি তাতেই আপনি স্নান করুন। এখনো তেমন বেলা হয় নি। আমি জল নিয়ে আসছি, বসুন।

মঞ্চী জল আনিয়া রান্নার যোগাড় করিয়া দিল। বলিল-আমার হাতে তো খাবেন না বাবুজী, আপনি নিজেই রাঁধুন তবে?

-কেন খাব না, তুমি যা পার তাই রাঁধ।

-তা হবে না বাবুজী, আপনিই রাঁধুন! একদিনের জন্যে আপনার জাত কেন মারব? আমার পাপ হবে।

-কিছু হবে না। আমি তোমাকে বলছি, এতে কোনো দোষ হবে না।

অগত্যা মঞ্চী রাঁধিতে বসিল। রাঁধিবার আয়োজন বিশেষ কিছু নয়-খানকতক মোটা মোটা হাতে-গড়া রুটি ও বুনো ধুঁধুলের তরকারি। নক্ছেদী কোথা হইতে এক ভাঁড় মহিষের দুধ যোগাড় করিয়া আনিল।

রাঁধিতে বসিয়া মঞ্চী এতদিন কোথায় কোথায় ঘুরিয়াছে, সে গল্প করিতে লাগিল। পাহাড়ের অঞ্চলে কলাই কাটিতে গিয়া একটা রামছাগলের বাচ্চা পুষিয়াছিল, সেটা কি করিয়া হারাইয়া গেল সে-গল্পও আমাকে ঠায় বসিয়া শুনিতে হইল।

আমায় বলিল-বাবুজী, কাঁকোয়াড়া-রাজের জমিদারিতে যে গরম জলের কুণ্ড আছে জানেন? আপনি তো কাছাকাছি গিয়েছিলেন, সেখানে যান নি?

আমি বলিলাম, কুণ্ডের কথা শুনিয়াছি, কিন্তু সেখানে যাওয়া আমার ঘটে নাই।

মঞ্চী বলিল-জানেন বাবুজী, আমি সেখানে নাইতে গিয়ে মার খেয়েছিলাম। আমাকে নাইতে দেয় নি!

মঞ্চীর স্বামী বলিল-হ্যাঁ, সে এক কাণ্ড বাবুজী। ভারি বদমাইশ সেখানকার পাণ্ডার দল।

বলিলাম-ব্যাপারখানা কি?

মঞ্চী স্বামীকে বলিল-তুমি বল না বাবুজীকে। বাবুজী কলকাতায় থাকেন, উনি লিখে দেবেন। তখন বদমাইশ গুণ্ডারা মজা টের পাবে।
নক্ছেদী বলিল-বাবুজী, ওর মধ্যে সূরয-কুণ্ড খুব ভালো জায়গা। যাত্রীরা সেখানে স্নান করে। আমরা আমলাতলীর পাহাড়ের নিচে কলাই কাটছিলাম, পূর্ণিমার যোগ পড়লো কিনা? মঞ্চী নাইতে গেল ক্ষেতের কাজ বন্ধ রেখে। আমার সেদিন জ্বর, আমি নাইবো না। বড়বৌ তুলসীও গেল না, ওর তত ধর্মের বাতিক নেই। মঞ্চী সূরয-কুণ্ডে নামতে যাচ্ছে, পাণ্ডারা বলেছে-এই ওখানে কেন নামছিস? ও বলেছে- জলে নাইবো। তারা বলেছে-তুই কি জাত? ও বলেছে-গাঙ্গোতা। তখন তারা বলেছে-গাঙ্গোতীনকে আমরা নাইতে দিই নে কুণ্ডের জলে, চলে যা! ও তো জানেন তেজী মেয়ে। ও বলেছে-এ তো পাহাড়ি ঝরনা, যে-সে নাইতে পারে। ঐ তো কত লোক নাইছে। ওরা কি সকলে ব্রাহ্মণ আর ছত্রী? বলে যেমন নামতে গিয়েছে, দুজন ছুটে এসে ওকে টেনে হিঁচড়ে মারতে মারতে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলে। ও কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এল।

-তারপর কি হল?

-কি হবে বাবুজী? আমরা গরিব গাঙ্গোতা কাট্নী মজুর। আমাদের ফরিয়াদ কে শুনবে। আমি বলি, কাঁদিস নে, তোকে আমি মুঙ্গেরের সীতাকুণ্ডে নাইয়ে আনবো।

মঞ্চী বলিল-বাবুজী, আপনি একটু লিখে দেবেন তো কথাটা। আপনাদের বাঙালি বাবুদের- কলমের খুব জোর। পাজিগুলো জব্দ হয়ে যাবে।

উৎসাহের সহিত বলিলাম-নিশ্চয়ই লিখবো।

তাহার পর মঞ্চী পরম যত্নে আমায় খাওয়াইল। বড় ভালো লাগিল তাহার আগ্রহ ও সেবাযত্ন।

বিদায় লইবার সময় তাহাকে বারবার বলিলাম-সামনের বৈশাখ মাসে যব গম কাটুনীর সময় তারা যেন নিশ্চয়ই আমাদের লবটুলিয়া-বইহারে যায়।

মঞ্চী বলিল-ঠিক যাব বাবুজী। সে কি আপনাকে বলতে হবে!

মঞ্চীর আতিথ্য গ্রহণ করিয়া চলিয়া আসিবার সময় মনে হইল, আনন্দ, স্বাস্থ্য ও সারল্যের প্রতিমূর্তি যেন সে। এই বনভূমির সে যেন বনলক্ষ্মী, পরিপূর্ণযৌবনা, প্রাণময়ী, তেজস্বিনী অথচ মুগ্ধা, অনভিজ্ঞা, বালিকাস্বভাবা।

বাঙালির কলমের উপর অসীম নির্ভরশীলা এই বন্য মেয়েটির নিকট সেদিন যে অঙ্গীকার করিয়া আসিয়াছিলাম, আজ তাহা পালন করিলাম- জানি না ইহাতে এতকাল পরে তাহার কি উপকার হইবে। এতদিন সে কোথায়, কি ভাবে আছে, বাঁচিয়া আছে কি না তাহাই বা কে জানে!


শ্রাবণ মাস। নবীন মেঘে ঢল নামিয়াছে অনেক দিন, নাঢ়া ও লবটুলিয়া-বইহারে কিংবা গ্র্যাণ্ট সাহেবের বটতলায় দাঁড়াইয়া চারিদিকে চাও, শুধুই দেখ সবুজের সমুদ্রের মতো নবীন কচি কাশবন।

একদিন রাজা দোবরু পান্নার চিঠি পাইয়া শ্রাবণ-পূর্ণিমায় তাঁর ওখানে ঝুলনোৎসবের নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে চলিলাম। রাজু ও মটুকনাথ ছাড়িল না, আমার সঙ্গে তাহারাও চলিল। হাঁটিয়া যাইবে বলিয়া উহারা রওনা হইল আমার আগেই।

বেলা দেড়টার সময় ডোঙায় মিছি নদী পার হইলাম। দলের সকলের পার হইতে আড়াইটা বাজিয়া গেল। দলটিকে পিছনে ফেলিয়া তখন ঘোড়া ছুটাইয়া দিলাম।

ঘন মেঘ করিয়া আসিল পশ্চিমে। তার পরেই নামিল ঝম্‌ঝম্ বর্ষা।

কি অপূর্ব বর্ষার দৃশ্য দেখিলাম সেই অরণ্য-প্রান্তরে! মেঘে মেঘে দিগন্তের শৈলমালা নীল, থম্কানো কালো বিদ্যুৎগর্ভ মেঘে আকাশ ছাইয়া আছে, ক্বচিৎ পথের পাশের শাল কি কেঁদ শাখায় ময়ূর পেখম মেলিয়া নৃত্যপরায়ণ, পাহাড়ি ঝরনার জলে গ্রাম্য বালকবালিকা মহা উৎসাহে শাল-কাটির ও বন্য বাঁশের ঘুনি পাতিয়া কুচো মাছ ধরিতেছে, ধূসর শিলাখণ্ডও ভিজিয়া কালো দেখাইতেছে, তাহার উপর মহিষের রাখাল কাঁচা শালপাতার লম্বা বিড়ি টানিতেছে। শান্তস্তব্ধ দেশ-অরণ্যের পর অরণ্য, প্রান্তরের পর প্রান্তর, শুধুই ঝরনা, পাহাড়ি গ্রাম, মরুম-ছড়ানো রাঙামাটির জমি, ক্বচিৎ কোথাও পুষ্পিত কদম্ব বা পিয়াল বৃক্ষ।

সন্ধ্যার পূর্বে আমি রাজা দোবরু পান্নার রাজধানীতে পৌঁছিয়া গেলাম।

সেবারকার সেই খড়ের ঘরখানা অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য চমৎকার করিয়া লেপিয়া পুঁছিয়া রাখা হইয়াছে। দেওয়ালে গিরিমাটির রং, পদ্মগাছ ও ময়ূর আঁকা, শালকাঠের খুঁটির গায়ে লতা ও ফুল ছড়ানো। আমার বিছানা এখনো আসিয়া পৌঁছায় নাই, আমি ঘোড়ায় আগেই পৌঁছিয়াছিলাম-কিন্তু তাহাতে কোনো অসুবিধা হইল না। ঘরে নূতন মাদুর পাতাই ছিল, গোটা দুই ফর্সা তাকিয়াও দিয়া গেল।

একটু পরে ভানুমতী একখানা বড় পিতলের সরাতে ফলমূল-কাঁটা ও একবাটি জ্বাল-দেওয়া দুধ লইয়া ঘরে ঢুকিল, তাহার পিছু পিছু আসিল একখানা কাঁচা শালপাতায় গোটা পান, গোটা সুপারি ও অন্যান্য পানের মসলা সাজাইয়া লইয়া আর একটি তাহার বয়সী মেয়ে।

ভানুমতীর পরনে একখানা জাম-রঙের খাটো শাড়ি হাঁটুর উপর উঠিয়াছে, গলায় সবুজ ও লাল হিংলাজের মালা, খোঁপায় জলজ স্পাইডার লিলি গোঁজা। আরো স্বাস্থ্যবতী ও লাবণ্যময়ী হইয়া উঠিয়াছে ভানুমতী-তাহার নিটোল দেহে যৌবনের উচ্ছলিত লাবণ্যের বান ডাকিয়াছে, চোখের ভাবে কিন্তু যে সরলা বালিকা দেখিয়াছিলাম, সেই সরলা বালিকাই আছে।

বলিলাম-কি ভানুমতী, ভালো আছ?

ভানুমতী নমস্কার করিতে জানে না-আমার কথার উত্তরে সরল হাসি হাসিয়া বলিল-আপনি, বাবুজী?

-আমি ভালো আছি।

-কিছু খান। সারাদিন ঘোড়ায় এসে খিদে পেয়েছে খুব।

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া সে আমার সামনে মাটির মেঝেতে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া পড়িল ও পিতলের থালাখানা হইতে দু-খানা পেঁপের টুকরা আমার হাতে তুলিয়া দিল।

আমার ভালো লাগিল-ইহার নিঃসঙ্কোচ বন্ধুত্ব। বাংলা দেশের মানুষের কাছে ইহা কি অদ্ভুত ধরনের, অপ্রত্যাশিত ধরনের নূতন, সুন্দর, মধুর। কোনো বাঙালি কুমারী অনাত্মীয়া ষোড়শী এমন ব্যবহার করিত? মেয়েদের সম্পর্কে আমাদের মন কোথায় যেন গুটাইয়া পাকাইয়া জড়োসড়ো হইয়া আছে সর্বদা। তাহাদের সম্বন্ধে না-পারি প্রাণ খুলিয়া ভাবিতে, না-পারি তাহাদের সঙ্গে মন খুলিয়া মিশিতে।

আরো দেখিয়াছি, এ-দেশের প্রান্তর যেমন উদার, অরণ্যানী, মেঘমালা, শৈলশ্রেণী যেমন মুক্ত ও দূরচ্ছন্দা-ভানুমতীর ব্যবহার তেমনি সঙ্কোচহীন, সরল, বাধাহীন। মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারের মতো স্বাভাবিক। এমনি পাইয়াছি মঞ্চীর কাছে ও বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদের স্ত্রীর কাছে। অরণ্য ও পাহাড় এদের মনকে মুক্তি দিয়াছে, দৃষ্টিকে উদার করিয়াছে-এদের ভালবাসাও সে অনুপাতে মুক্ত, দৃঢ়, উদার। মন বড় বলিয়া এদের ভালবাসাও বড়।

কিন্তু ভানুমতীর কাছে বসিয়া হাতে তুলিয়া দিয়া খাওয়ানোর তুলনা হয় না! জীবনে সেদিন সর্বপ্রথম আমি অনুভব করিলাম নারীর নিঃসঙ্কোচ ব্যবহারের মাধুর্য। সে যখন স্নেহ করে, তখন সে কি স্বর্গের দ্বার খুলিয়া দেয় পৃথিবীতে!

ভানুমতীর মধ্যে যে আদিম নারী আছে, সভ্য সমাজে সে-নারীর আত্মা সংস্কারের ও বন্ধনের চাপে মূর্ছিত।

সে-বার যে রকম ব্যবহার পাইয়াছিলাম, এবারকার ব্যবহার তার চেয়েও আপন, ভানুমতী বুঝিতে পারিয়াছে এ বাঙালি বাবু তাদের পরিবারের বন্ধু, তাদেরই শুভাকাক্সক্ষী আপনার লোকদের মধ্যে গণ্য- সুতরাং যে ব্যবহার তাহার নিকট পাইলাম তাহা নিজের স্নেহময়ী ভগ্নীর মতোই।

অনেককাল হইয়া গিয়াছে-কিন্তু ভানুমতীর এই সুন্দর প্রীতি ও বন্ধুত্বের কথা আমার স্মৃতিপটে তেমনি সমুজ্জ্বল-বন্য অসভ্যতার এই দানের নিকট সভ্য সমাজের বহু সম্পদ আমার মনে নিষ্প্রভ হইয়া আছে।

রাজা দোবরু উৎসবের অন্য আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন, এইবার আসিয়া আমার ঘরে বসিলেন।

আমি বলিলাম-ঝুলন কি আপনাদের এখানে বরাবর হয়?

রাজা দোবরু বলিলেন-আমাদের বংশে বহুদিনের উৎসব এইটি। এ সময়ে অনেক দূর থেকে আত্মীয়স্বজন আসে ঝুলনে নাচতে। আড়াই মন চাল রান্না হবে কাল।

মটুকনাথ আসিয়াছে পণ্ডিত-বিদায়ের লোভে-ভাবিয়াছিল কত বড় রাজবাড়ি, কি কাণ্ডই আসিয়া দেখিবে! তাহার মুখের ভাবে মনে হইল সে বেশ একটু নিরাশ হইয়াছে। এ রাজবাড়ি অপেক্ষা টোলগৃহ যে অনেক ভালো।

রাজু তো মনের কথা চাপিতে না পারিয়া স্পষ্টই বলিল-রাজা কোথায় হুজুর, এ তো এক সাঁওতাল সর্দার! আমার যে ক’টা মহিষ আছে, রাজার শুনলাম তাও নেই, হুজুর!

সে ইহারই মধ্যে রাজার পার্থিব সম্পদের বিষয় অনুসন্ধান করিয়াছে-গোরু, মহিষ এদেশে সম্পদের বড় মাপকাঠি। যার যত মহিষ, সে তত বড়লোক।

গভীর রাত্রে চতুর্দশীর জ্যোৎস্না বনের বড় বড় গাছপালার আড়ালে উঠিয়া যখন সেই বন্য গ্রামের গৃহস্থবাড়ির প্রাঙ্গণে আলো-আঁধারের জাল বুনিয়াছে, তখন শুনিলাম রাজবাড়িতে বহু নারীকণ্ঠের সম্মিলিত এক অদ্ভুত ধরনের গান। কাল ঝুলন পূর্ণিমা, রাজবাড়িতে নবাগত কুটুম্বিনী ও রাজকন্যার সহচরীগণ কল্যকার নাচগানের মহলা দিতেছে। সারারাত ধরিয়া তাহাদের গান ও মাদল বাজনা থামিল না।

শুনিতে শুনিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছি, ঘুমের মধ্যেও ওদের সেই গান কতবার যেন শুনিতে পাইতেছিলাম।


কিন্তু পরদিন ঝুলনোৎসব দেখিয়া মটুকনাথ, রাজু, এমন কি মুনেশ্বর সিং পর্যন্ত মুগ্ধ হইয়া গেল।

পরদিন সকালে উঠিয়া দেখি ভানুমতীর বয়সী কুমারী মেয়েই অন্তত ত্রিশজন চারিপাশের বহু টোলা ও পাহাড়ি বস্তি হইতে উৎসব উপলক্ষে আসিয়া জুটিয়াছে। একটি ভালো প্রথা দেখিলাম, এত নাচগানের মধ্যে ইহাদের কেহই মহুয়ার মদ খায় নাই। রাজা দোবরুকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি হাসিয়া গর্বের সুরে বলিলেন- আমাদের বংশে মেয়েদের মধ্যে ও নিয়ম নেই। তা ছাড়া, আমি হুকুম না দিলে, কারো সাধ্যি নেই আমার ছেলেমেয়ের সামনে মদ খায়।

মটুকনাথ দুপুরবেলা আমায় চুপি চুপি বলিল-রাজা দেখছি আমার চেয়ে গরিব। রাঁধবার জন্যে দিয়েছে মোটা রাঙা চাল, আর পাকা চালকুমড়ো, আর বুনো ধুঁধুল। এতগুলো লোকের জন্যে কি রাঁধি বলুন তো?

সারা সকাল ভানুমতীর দেখা পাই নাই-খাইতে বসিয়াছি, সে এক বাটি দুধ আনিয়া আমার সামনে বসিল।

বলিলাম-তোমাদের গান কাল রাত্রে বেশ লেগেছিল।

ভানুমতী হাসিমুখে বলিল-আমাদের গান বুঝতে পারেন?

বলিলাম-কেন পারব না? এতদিন তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমাদের গান বুঝব না কেন?

-আজ ও-বেলা আপনি ঝুলন দেখতে যাবেন তো?

-সে জন্যেই তো এসেছি। কতদূর যেতে হবে?

ভানুমতী ধন্‌ঝরি পাহাড়শ্রেণীর দিকে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া বলিল-আপনি তো গিয়েছেন ও পাহাড়ে। আমাদের সেই মন্দির দেখেন নি?

এই সময় ভানুমতীর বয়সী একদল কিশোরী মেয়ে আমার খাবার ঘরের দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, বাঙালি বাবুর ভোজন পরম কৌতূহলের সহিত দেখিতে এবং পরস্পরে কি বলাবলি করিতে লাগিল।

ভানুমতী বলিল-যা সব এখান থেকে, এখানে কি?

একটি মেয়ের সাহস অন্য মেয়েদের চেয়ে বেশি, সে একটু আগাইয়া আসিয়া বলিল-বাবুজীকে ঝুলনের দিন নুন করমচা খেতে দিস্ নি তো?

তাহার এ কথায় পিছনের সব মেয়ে খিলখিল করিয়া হাসির উঠিয়া এ উহার গায়ে হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল।

ভানুমতীকে বলিলাম-ওরা হাসছে কেন?

ভানুমতী সলজ্জ মুখে বলিল-ওদের জিজ্ঞেস করুন! আমি কি জানি!

ইতিমধ্যে একটি মেয়ে বড় একটা পাকা কামরাঙা লঙ্কা আনিয়া আমার পাতে দিয়া হাসিয়া বলিল- খান বাবুজী একটু লঙ্কার আচার। ভানুমতী শুধু আপনাকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে, তা তো হবে না। আমরা একটু ঝাল খাওয়াই!

সকলে আবার হাসিয়া উঠিল। এতগুলি তরুণীর মুখের সরল হাসিতে দিনমানেই যেন পূর্ণিমার জ্যোৎস্না ফুটিয়া উঠিয়াছে।

সন্ধ্যার পূর্বেই একদল তরুণ-তরুণী পাহাড়ের দিকে রওনা হইল-তাহদের পিছু পিছু আমরাও গেলাম-সে এক প্রকাণ্ড শোভাযাত্রা! পূর্বদিকে নাওয়াদা লছমীপুরার সীমানায় ধন্ঝরি পাহাড়, যে পাহাড়ের নিচে মিছি নদী উত্তরবাহিনী হইয়াছে, সে পাহাড়ের বনশীর্ষে পূর্ণচন্দ্র উঠিতেছে, একদিকে নিচু উপত্যকা, বনে বনে সবুজ, অন্যদিকে ধন্ঝরি শৈলমালা। মাইলখানেক হাঁটিয়া আমরা পাহাড়ের পাদদেশে আসিয়া পৌঁছিলাম। কিছুদূর উঠিতে একটা সমতল স্থান পাহাড়ের মাথায়। জায়গাটার ঠিক মাঝখানে একটা প্রাচীন পিয়াল গাছ-গাছের গুঁড়ি ফুল ও লতায় জড়ানো। রাজা দোবরু বলিলেন-এই গাছ অনেক কালের পুরোনো-আমি ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি এই গাছের তলায় ঝুলনের সময় মেয়েরা নাচে।

আমরা একপাশে তালপাতার চেটাই পাতিয়া বসিলাম, আর এই পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাপ্লাবিত বনান্তস্থলীতে প্রায় ত্রিশটি কিশোরী তরুণী গাছটিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচিতে লাগিল-পাশে পাশে মাদল বাজাইয়া একদল যুবক তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিতেছে। ভানুমতীকে দেখিলাম এই দলের পুরোভাগে। মেয়েদের খোঁপায় ফুলের মালা, গায়ে ফুলের গহনা। …

কত রাত পর্যন্ত সমানভাবে নাচ ও গান চলিল-মাঝে মাঝে দলটি একটু বিশ্রাম করিয়া লয় আবার আরম্ভ করে-মাদলের বোল, জ্যোৎস্না, বর্ষাস্নিগ্ধ বনভূমি, সুঠাম শ্যামা নৃত্যপরায়ণা তরুণীর দল- সব মিলিয়া কোনো বড় শিল্পীর অঙ্কিত একখানি ছবির মতো তা সুশ্রী-একটি মধুর সঙ্গীতের মতো তার আকুল আবেদন। মনে পড়ে দূর ইতিহাসের সোলাঙ্কি-রাজকন্যা ও তার সহচরীগণের এমনি ঝুলন নাচ ও গানের কথা, মনে পড়ে রাখাল বালক বাপ্পাদিত্যকে খেলার ছলে মাল্যদানের কথা।

আজু কি আনন্দ, আজু কি আনন্দ
ঝুলত ঝুলনে শ্যামর চন্দ্

তার চেয়েও বহু দূরের অতীতে, প্রাচীন প্রাচীন যুগের প্রস্তর যুগের ভারতের রহস্যাচ্ছন্ন ইতিহাসের সকল ঘটনা যেন আবার সম্মুখে অভিনীত হইতে দেখিলাম-আদিম ভারতের সংস্কৃতি যেন মূর্তিমতী হইয়া উঠিয়াছে সরলা পর্বতবালা ভানুমতী ও তাহার সখীগণের নৃত্যে-হাজার হাজার বৎসর পূর্বে এমনি কত বন, কত শৈলমালা, এমনিতর কত জ্যোৎস্নারাত্রি, ভানুমতীর মতো কত বালিকার নৃত্যচঞ্চল চরণের ছন্দে আকুল হইয়া উঠিয়াছিল, তাহাদের মুখের সে হাসি আজও মরে নাই-এইসব গুপ্ত অরণ্য ও শৈলমালার আড়ালে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া তারা তাদের বর্তমান বংশধরগণের রক্তে আজও আনন্দ ও উৎসাহের বাণী পাঠাইয়া দিতেছে।

গভীর রাত্রি। চাঁদ ঢলিয়া পড়িয়াছে পশ্চিম দিকের দূর বনের পিছনে। আমরা সবাই পাহাড় হইতে নামিয়া আসিলাম। সুখের বিষয় আজ আকাশে মেঘ নাই, কিন্তু আর্দ্র বাতাস শেষরাত্রে অত্যন্ত শীতল হইয়া উঠিয়াছে। অত রাত্রেও আমি খাইতে বসিলে ভানুমতী দুধ ও পেঁড়া আনিল।

আমি বলিলাম-বড় চমৎকার নাচ দেখলাম তোমাদের।

সে সলজ্জ হাসিমুখে বলিল-আপনার কি আর ভালো লাগবে বাবুজী-আপনাদের কলকাতায় ওসব কি দ্যাখে?

পরদিন ভানুমতী ও তাহার প্রপিতামহ রাজা দোবরু আমায় কিছুতেই আসিতে দিবে না। অথচ আমার কাজ ফেলিয়া থাকিলে চলে না, বাধ্য হইয়া চলিয়া আসিলাম। আসিবার সময় ভানুমতী বলিল-বাবুজী, কল্কাতা থেকে আমার জন্যে একখানা আয়না এনে দেবেন? আমার আয়না একখানা ছিল, অনেক দিন ভেঙ্গে গিয়েছে।

ষোল বছর বয়সের সুশ্রী নবযৌবনা কিশোরীর আয়নার অভাব! তবে আয়নার সৃষ্টি হইয়াছে কাদের জন্যে? এক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ণিয়া হইতে একখানা ভালো আয়না আনাইয়া তাহাকে পাঠাইয়া দিয়াছিলাম।

1 Comment
Collapse Comments
মশিউর রহমান May 6, 2020 at 8:28 pm

প্রিয় লেখকের লেখা পড়ছি।হারিয়ে যাচ্ছি অতল থেকে আরো অতল গহীনে।এই যে ভানুমতী, তার প্রেমে পড়ে গেছি নিজেরই অজান্তে . . . কি অসাধারণ প্রকাশভঙ্গি !

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *