৪৩. মৃতের শহর দিল্লি

জের-এ ফলক্‌ ভলা তূ রোতা হ্যয় আপকো মীর,
কিস কিস তরহ্‌ কা আলম য়াঁ খাক্‌ হো গয়া হ্যায়।।
(আকাশতলায় বসে তুমি নিজের দুঃখ নিয়েই কাঁদছ মীর;
কত সমাজ সংসার এখানে পুড়ে ছাই হয়ে গেল।।)।

মৃতের শহর দিল্লির দিকে তাকিয়ে কত পুরোন কথাই মনে পড়ত, মান্টোভাই। সেসব দিন তো আমরা দেখি নি, শরিফ আদমিদের মুখে-মুখে শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গল্পগুলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। সব বাস্তবই তো একদিন না একদিন গল্প হয়ে যায়। তারা যেন জাঁহাপনা জাহাঙ্গীরের তসবিরখানার এক-একটা ছবি-কী রং, কী জেল্লা, কী সুক্ষ্মতা-যেন একবিন্দু জলের ভিতরে প্রতিবিম্বিত আশ্চর্য দুনিয়া। মুঘলরা তো শুধু একটা সাম্রাজ্য তৈরি করেনি, লুঠপাট করে এই দেশ থেকে সম্পদ নিয়ে যায়নি। তজীবেরও জন্ম দিয়েছিল। এই তজীব-ই আমাদের শিখিয়েছে, আদব ও আখলাখ ছাড়া কেউ শরিফ হতে পারে না। সুফি কবি খাজা মীর দর্দ বলতেন, আদবের শেষ কথা ছিলেন তার ওয়ালিদ। অন্তরের সৌন্দর্য ফুটে উঠত মানুষটির বাইরের চেহারাতেও। দিল্লির রাস্তা দিয়ে যখন ঘোড়ায় চেপে যেতেন চেনা-অচেনা সবাই এসে তাঁকে কদমবুসি করত। আমরা যে সালাম-আলেকুম সম্ভাষণ করি, শুধুই তো দুটো শব্দ নয়, এই অভিবাদনে বলা হয়েছে, আপনার ওপর খোদার শান্তি বর্ষিত হোক। কত শতাব্দীর আদব এই সম্ভাষণের মধ্যে রয়ে গেছে, ভাবুন তো। দিল্লির মৃত্যু আমার কাছে আদব ও আখলাকের মৃত্যু।

ব্রিটিশদের মধ্যে কেউ কেউ প্রস্তাব দিয়েছিল, কেল্লাকে তোপ দেগে উড়িয়ে দেওয়া হোক, জামা মসজিদকে ধুলোয় মিশিয়ে দাও। সেখানে তৈরী হবে রানি ভিক্টোরিয়ার নামে প্রাসাদ আর গির্জা। এতটা না হলেও লাহোর আর দিল্লি দরজার নাম দেওয়া হল ভিক্টোরিয়া ও আলেক্সান্দার গেট। পুরো কেল্লাটাকেই ওরা বানিয়ে ফেলল সেনাছাউনি। জামা মসজিদ আর গাজিউদ্দিন মাদ্রাসারও একই হাল হল। ফতেপুরি মসজিদ বিক্রি করে দেওয়া হল হিন্দু ব্যবসায়ীর কাছে। জিনাতুল মসজিদে তৈরি হল বিলিতি রুটি বানানোর কারখানা। আমি তখন অন্ধকার কুঠুরিতে বসে কী দেখতে পাচ্ছি জানেন? ওই তো কিলা মুবারক তৈরি হয়ে গিয়েছে। সরকারি। দস্তাবেজে, সবার মুখে মুখে প্রাসাদ দূর্গের নাম কিলা মুবারক-পূণ্য দুর্গ। ১৬৪৮ -এর ১৯ এপ্রিল। জাঁহাপনা শাহজাহান দৌলতখানা-ই-খাস এ প্রবেশ করলেন। জ্যোতিষীরা এই দিনটাই স্থির করে দিয়েছিলেন। সেই উৎসবের কথা আমরা কল্পনাও করতে পারব না, মান্টোভাই। হিন্দুস্থান, কাশ্মীর, ইরান থেকে কত যে গাইয়ে-বাজিয়ে এসেছিলেন। পেশকার সাদাউল্লা খান যেসব আসবাব ও গালিচা দিয়ে ঘরটিকে সাজিয়েছিলেন, তার দাম নাকি ষাট হাজার টাকা। শুনেছি তিনি একটা কবিতা লিখে খোয়াবগাহ্-র দেওয়ালে খোদাই করে দেন। খোয়াবগাহ্ জানেন তো? সম্রাট সেই বাড়িতে ঘুমাতেন আর খোয়ব দেখতেন। ঘুমোনোর বাড়ির নাম খোয়াবগাহ্; এই নামের সঙ্গে কত কল্পনা জড়িয়ে আছে, ভাবুন মান্টোভাই।

পাথরের বিরাট পাঁচিল ঘিরে রেখেছিল শাহজাহানাবাদকে। যাতায়াতের জন্য তৈরি হয়েছিল সাতটা বড় দরজা-কাশ্মীর, মোড়ি, কাবুলি, লাহোরি, আজমিরি, তুর্কোমানি ও আকবরাবাদি। লাহোরি আর আকবরাবাদি ছিল প্রধান দুই দরজা। জাঁহাপনা শাহজাহান জোড়া হাতির মূর্তি বসিয়েছিলেন সেখানে। জাঁহাপনা ঔরঙ্গজেব এসে মূর্তিগুলো ভেঙে দিয়েছিলেন। তারপর দিল্লির ওপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে গেছে জানেনই তো মান্টোভাই। নাদির শাহ, মারাঠাদের আক্রমণে দিল্লি বারবার নাঙ্গা হয়ে গিয়েছে। মীরসাব লিখেছিলেন :

দিল্লি যো এক শহর থা, আলম সে ইন্তিখাব
রহতে থে মুন্তাখাব হি, জাঁহা রোজগার কে
 উসকো ফলক নে লুটকে, বরবাদ কর দিয়া
হম রহনেবালে হ্যায়, উসি উজরে দিবার কে।

ব্রীটিশরা আরও নৃশংস, ভাইজানেরা। ১৮৫৮-র নভেম্বরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রটিশ সরকার এ-দেশের শাসনভার নিয়ে নিল। মান্টোভাই, সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশে। কয়েকদিন ধরেই আমি ধূমকেতু দেখতে পাচ্ছিলুম। ভয়ে বুক কেঁপে উঠছিল। বুঝতে পারছিলুম, আমাদের ধ্বংস আসন্ন। ইংল্যান্ডেশ্বরীর হয়ে শাসনভার হাতে নিলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং বাহাদুর। হায় আল্লা! আমি জানতুম, এবার ওদের লক্ষ্য, শাহজাহানাবাদকে-তজ্জীবকে মিছে দেওয়া। গোরারা এবার নিজেদের মতো করে শহরটাকে গড়ে পিটে নেবে, আর আমরা, ভাঙাচোরা মানুষেরা, ক্ষতবিক্ষত ছায়ার মতো পড়ে থাকব।

আমার তখন একমাত্র বন্ধু মহল্লার একটা ঘেয়ো কুকুর। যারা পালিয়ে গেছে, তাদেরই কারও বাড়ির পাহারাদার কুকুর ছিল সে। হাড় জিরজিরে চেহারা, লোম ঝরে গেছে, সারা শরীরে। পোকা। একদিন আমার দরজার সামনে এসে শুয়ে কুঁইকুই করে কাঁদছিল। আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল।

আমিও মজা করে ডাকলুম, ঘেউ-ঘেউ-।

-মির্জাসাব

আমি তো ভয়ে পিছিয়ে গেলুম। আরে, কুকুর আবার মানুষের মতো কথা বলে নাকি? কে জানে, গোরাদের রাজত্বে কখন কী হবে, কিছুই তো বলা যায় না। সে আবার ডাকল মির্জাসাব-।

-বেত্তমিজ কুত্তা কাঁহি কা।

-দুদিন কিছু খাইনি, মির্জাসাব।

আমি চিৎকার করে ডাকলুম, কালু, এই কাল্লু হারামজাদা।

কাল্লু দৌড়তে দৌড়তে হাজির। আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কাল্লু তখন প্রায় কথাই বলে না বলতে গেলে। দস্তান ছাড়া তো ও বাঁচতে পারত না। কারবালা দিল্লিতে তখন আর ওকে দস্তান শোনাবে কে?

-কুত্তাটাকে কিছু খেতে দে।

-খাবার কোথায় পাব হুজুর?

-কেন খাবার নেই কাল্লু? এখন তো ইংরেজ বাহাদুর এসেছেন-তাদের দেশে কতরকম খাবার, কত মদ-লাল, নীল,সাদা-আমাদের জন্য কেন খাবার নেই? ভিতরে গিয়ে দেখ একবার, শুকনো হাড়-টাড় কিছু পড়ে আছে কি না।

-হুজুর

-কী হুজুর? এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে? কুত্তাটা কি না খেয়ে মরবে নাকি?

-আপনিও তো না খেয়েই আছেন।

-তাতে কি? সাচ্চা মুসলমানের কাছে কেউ কিছু চাইলে, তাকে ফিরিয়ে দিতে নেই, জানিস না?

-ঘেউ-ঘেউ—

-কী হল মিঞা? একটু অপেক্ষা করো, কিছু না কিছু জুটে যাবেই।

কুকুরটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে বলে, চলুন না হয় রাস্তায় ঘুরে আসি। পথে ঠিক খাবার পাওয়া যাবে মির্জাসাব।

আমি তার কথা শুনে হেসে ফেলি। কাল্পর পিঠে হাত রেখে বলি, দ্যাখ, আমার ধর্মরাজ কেমন বাড়িতে এসে হাজির হয়েছেন। এবার মহাপ্রস্থানের পথে যাব। তোর আর দুঃখ থাকবে না কাল্লু। এবার থেকে মহাপ্রস্থানের কিস্সা শুনতে পাবি। যা আমার লাঠিটা নিয়ে আয়।

-কোথায় যাবেন হুজুর?

-শাহজাহানাবাদ হারিয়ে যাবার আগে একটু ঘুরে ঘুরে দেখি।

সেই আমার মহাপ্রস্থানযাত্রা শুরু হল, মান্টোভাই। ধর্মরাজ আমার বাড়িতে বারান্দাতেই রয়ে গেলেন। আমি তাকে মিঞা বলেই ডাকতুম। হাঁটতে কষ্ট হয়, পা দিনে দিনে ফুলছে, চোখেও ঠিকঠাক দেখতে দেখি না; মিঞা আমাকে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখায়। গলির পর গলি,

মহল্লার পর মহল্লা মুছে যেতে থাকে। ব্রিটিশ শহরকে ঢেলে সাজাচ্ছে। সেখানে গোলকধাঁধার মতো গলি ও মহল্লা তো থাকতে পারে না। গোলকধাঁধা মানেই কোথাও না কোথাও বিপদ। লুকিয়ে থাকবে; বিদ্রোহীরা তো এইসব জায়গাতেই ডেরা বাঁধে। তাই বড় বড় রাস্তা বানাতে হবে, যাতে ব্রিটিশের নজরের বাইরে কিছু থাকতে না পারে। কেল্লার দেওয়ালের বাইরে। চারদিকে বহুদূর পর্যন্ত যত বাড়ি-ঘর ছিল সব ভেঙে দেওয়া হল। শহরের বুজুর্গ আদমিদের আবেদনে কোনও মতে বেঁচে গেল দরিবা বাজার। মান্টোভাই, বাজার ছাড়া কি শাহজাহানাবাদের কথা ভাবা যায়? উর্দু বাজার, খাস বাজার, খরম-কা বাজার, সবার ওপরে চাঁদনি চক। শাহজাহানাবাদের প্রাণস্পন্দন তো বাজারগুলোয় হাঁটলেই শোনা যেত। বাজার তো শুধু কেনাবেচার জায়গা নয়, কতরকম আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হত বাজারেই। কতদিন আমি একা একা এইসব বাজারে ঘুরে বেড়িয়েছি। কেন জানেন? শুধু রংয়ের ফোয়ারা দেখার জন্য আর হঠাৎ হঠাৎ ঝলসে উঠত নতুন কোনও মুখ, যাকে আগে কখনও দেখিনি। উদ্দেশ্যহীন ভাবে বাজারে ঘুরতে ঘুরতেই তো কত শের কুড়িয়ে পেয়েছি আমি। ভিড়ের মাঝে একা একা হেঁটে যাওয়ার মৌতাত আপনি বাজার ছাড়া কোথায় পাবেন বলুন? তো উর্দু বাজার, খাস বাজার, খড়ম-কা-বাজার- সব ওরা লোপাট করে দিল।

-ঘেউ-ঘেউ-মির্জাসাব—

-বলুন মিঞা। ঘেউ-ঘেউ–

-আমরা তাহলে কোথায়?

-মাটির তলায়। শাহজাহানাবাদে যখন প্রথম এসেছিলুম, মাটির গভীর থেকে উঠে এসে ওরা আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। কারা জানেন, মিঞা? শাহজাহানাবাদ তৈরির সময় যাদের মেরে। মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। এটাই শহর তৈরির তরিকা। ইংরেজরা এবার নতুন শহর তৈরি করছে, আমাদের তো মাটির তলাতেই যেতে হবে। তা খারাপ হবে না মিঞা, একে অপরকে জড়িয়ে শুয়ে থাকব।

মান্টোভাই, ইংরেজদের নতুন শহরে আমার মতো মানুষ বেঁচে থেকে কী করবে? বলুন? আমাদের শহর আর ওদের শহর তো আলাদা। আমাদের দেশে যে-সব শহর তৈরি হয়েছিল, সেখানে চওড়া সিধে রাস্তা আপনি খুব কমই দেখতে পাবেন। এখানে গলির পর গলি, সেইসব গলিকে ঘিরে একের পর এক মহল্লা। শহর নির্মানের এই পরিকল্পনার পিছেনে রয়ে গিয়েছে আমাদের অন্য জীবনবোধ। আমরা সবাই কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি। গলিপথে আমরা ঢিমেতালে চলতে পেরেছি, চলতে-চলতে কারুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে একটু খোশগল্প করেছি। কারুর বারান্দায় বসে এক ছিলিম তামাক খেয়েছি, আড়চোখে তাকিয়ে কোনও বাড়ির জানলায় হঠাৎই কোনও সুন্দরীকে দেখে ফেলেছি, কত অমরুওয়ালা, ফুলওয়ালা, কুলপিওয়ালারা আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে, এইসব পথ তো শুধু হাঁটার জন্য ছিল না, বলতে পারেন এ একরকম মণ্ডপ, যেখানে চেনা অচেনা মানুষরা মিলতে পারতুম। ব্রিটিশ যে নতুন শহরটা তৈরি করছিল তা আমাদের ওপর নজরদারির জন্য। জামা মসজিদের চারপাশের বিরাট এলাকা জুড়ে সব ঘরবাড়ি, দোকানপাট ভেঙে দেওয়া হল। আজুদার তৈরি দার-উল-বাকাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। সেখানে বিনে পয়সায় সাহিত্য, চিকিৎসা, ধর্মতত্ত্ব পড়ানো হত। কিন্তু আমাদের সাহিত্যে, চিকিৎসায়, ধর্মতত্ত্বে ওদের কী প্রয়োজন? খোদা মেহেরবান, আমি কানে কম শুনতে শুরু করেছিলুম, নইলে তো সারাক্ষণ শুধু ভাঙনের আওয়াজেই আমার মাথা ভরে যেত।

এই ধ্বংস্তূপে বসে আমি আর গজলকে স্পর্শ করতে পারতুম না, মান্টোভাই। আমি-আমিই একসময় গজল লিখতুম? ভাবতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে যেতুম। ইবন সিনার দর্শন বা নাজিরি র কবিতা, কোথাও কোন শান্তি নেই। সব ফালতু-সব-কবিতা, সাম্রাজ্য, দর্শন-কিছুতেই কিছু এসে যায় না। শুধু একটু আনন্দে বেঁচে থাকার চেয়ে বড় আর কিছুই নয়। হিন্দুদের তো কতো অবতার, মুসলমানদের কত পয়গম্বর-তাতে কী এসে যায়? আমি হরগোপাল তাকে লিখেছিলুম, বিখ্যাত বা অনামা, যাই হও, তাতে সত্যিই কিছু এসে যায় না। খেয়ে পড়ে, সুস্থ হয়ে বাচাই বড় কথা। শিল্প আসলে এক বধ্যভূমি, তক্তা, যেখানে তুমিই দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত, তুমি জহ্লাদ। খোদা এই মায়াপাশ থেকে আমাকে মুক্ত করো। এতগুলো বছর আমি নিজের, আমার কাছের মানুষদের রক্ত ঝরিয়েছি, আর সেই রক্তেই রাঙা হয়ে উঠেছে আমার শিল্পের গুলবাগ। জাঁহাপনা ঔরঙ্গজেব, আমি আপনাকে সমর্থণ করি। ধ্বংস করুন সব ছবি,মুর্তি-মিঞা তানসেনের শ্বাসরোধ করুন-গর্দান নিন মীর তকি মীরের.. এত মায়া নিয়ে আমরা কী করব বলুন? আমার অন্ধকার কুঠুরিতে বসে কিছুই আর চিনতে পারতুম না, মান্টোভাই। চারপাশের দুনিয়া-কাউকে নয়। যদি অনেক শতাব্দী পরে সাদি বা হাফিজসাবের সঙ্গে আমার নাম কেউ উচ্চারণ করে, তাতে কী এসে যায়? আমি তো একটা কুকুরের মতো তাড়া খেয়েই বেঁচেছিলুম।

ওদের চোখে মুসলমানরা রাস্তার কুকুর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। দিল্লি অধিকারের কিছুদিন পর থেকে হিন্দুরা শহরে ফিরে আসতে পারছিল, মুসলমানদের ফিরতে দেওয়া হয় নি। অনেক পরে তারা শহরে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিল। মান্টোভাই, বড় বড় খানদানের বেগম, ছেলেমেয়েরা তখন রাস্তায়-রাস্তায় ভিক্ষে করছে। কেল্লার চাঁদপানা মুখের বেগমরা ছেঁড়া জামাকাপড় পরে পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিজের মনে বিড়বিড় করছে, হাসছে। আমার মহাপ্রস্তানের পথে এইসব ভাঙাচোরা, মরেও হেটে-চলে বাড়ানো মানুষকে দেখতে পেতুম মান্টোভাই। আর প্রার্থণা করতুম, খোদা, আমাকে কবরে নিয়ে চলো। এক টুকরো কাফন আমার জন্য রেখো।

একদিন হাটতে হাটতে জামা মসজিদের চত্বরে বসে পড়লুম। শ্বাস নিতে পারছিলুম না, মনে হচ্ছিল শেষ মুহূর্ত এসে গেছে। আমি বুঝতে পারছিলুম, মান্টোভাই, দরজায় তার ছায়া এসে পড়েছে। রোজ মাঝরাতে বিছানায় উঠে বসতুম। ঘুমের মধ্যে শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু। একের পর এক গাছ থেকে ঝুলছে মৃতদেহ। বুকের বাঁদিকে ছুরি চালানোর ব্যাথা নিয়ে আমি জেগে উঠতুম। ভয় হত, যদি এই মুহূর্তে হৃৎপিণ্ড বোবা হয়ে যায়? খোদা, আমাকে রহ্ম করো, মৃত্যুকে এবার পাঠাও, মনে মনে সবসময় তো এ-কথা বলতুম, অথচ ভয় পেয়ে কেন জেগে উঠতুম, কেন বুকের বাঁদিক চেপে ধরে ভোর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতুম? জামা মসজিদের চত্বরে বসে যখন হাঁফাচ্ছি, আমার মিঞা ডেকে উঠল।

-ঘেউ-ঘেউ

-একটু জিরিয়ে নিতে দিন মিঞা। ঘেউ-ঘেউ–

-এখনই জিরোবেন? আরও কত দেখার বাকি আছে, মির্জাসাব।

-ঘেউ-ঘেউ-। আপনি চলে যান, মিঞা। আমি আর মহাপ্রস্থানের পথে হাঁটব না।

-বেশ তো তবে না হয় একটা কবিতা শুনুন।ঘেউ-ঘেউ

-কবিতার পেছনে আমি লাথি মারি।

-ঘেউ-ঘেউ-। ভালবাসার ধনকে এভাবে লাথি মারতে নেই, মির্জাসাব। আমি তো জানি, কবিতা ছাড়া আর কাউকেই ভালবাসেননি আপনি।

-কাউকে নয়?

-না। কাউকে নয়। দুনিয়ার সব রং-রূপ আপনি অক্ষরের ভিতরেই দেখেছিলেন, মির্জাসাব। অক্ষরই আপানার রক্তমাংস। আমি আপনার শেষ কবিতাটি বলছি, শুনুন।

-আমার শেষ কবিতা?

-ঘেউ-ঘেউ-। এক শতাব্দী পরে তা লেখা হবে।

-বলুন মিঞা।

-ঘেউ-ঘেউ-। কবিতা কেমন শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে যায়, তাই না মির্জাসাব?

আমার ধর্মরাজ স্থির হয়ে বসে জামা মসজিদের চূড়ার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে

এই তো জানু পেতে বসেছি পশ্চিম
আজ বসন্তের শূণ্য হাত
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

কোথায় গেল ওর স্বচ্ছ যৌবন
কোথায় কুরে খায় গোপন ক্ষয়
চোখের কোণে এই সমস্থ পরাভব
বিষায় ফুসফুস ধমণী শিরা।

জাগাও শহরের প্রান্তে প্রান্তরে
ধূসর শূন্যের আজান গান
পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

নাকি এ শরীরের পাপের বীজাণুতে
কোনই ত্রান নেই ভবিষ্যের
আমারই বর্বর জয়ের উল্লাসে
মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে।

নাকি এ প্রাসাদে আলোর ঝলকানি
পুড়িয়ে দেয় সব হৃদয় হাড়
এবং শরীরের ভিতরে বাসা গড়ে
লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গের?

আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার
জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে
ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

কিন্তু আমার কোন স্বপ্ন ছিল না, মান্টোভাই। গোরারা সব স্বপ্ন কিমা করে ওদের তেলে কিমার গোল্লা ভাজছে। সেদিন ফিরে দেখলুম, বাড়ির সামনে কিছু লোকজন, উমরাও বেগম বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখেই উমরাও কান্নায় ভেঙে পড়ল, মির্জাসাব–

-কি হয়েছে, বেগম?

-কাল্লু—

-কী করেছে কাল্লু হারামজাদা?

এতদিনের কাল্লু আমাদের ছেড়ে চলে গেল, ভাইজানেরা। কী করেই বা বাঁচবে? ওকে কিস্স শোনাবে কে? কাল্লু তাই ঘুমিয়ে পড়ল, ওর মুখের কষ বেয়ে গ্যাঁজলা নামছিল। আমি ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ডাকলুম, কাল্লু-বেটা আমার—

-হুজুর

-আর হুজুর বলিস না কাল্লু। তুই আমার বাপ-তুই আমার বেটা-কী কষ্ট হয়েছিল কাল্লু?

-দস্তানগোর-রা সব কোথায় গেল হুজুর?

-আমিই তো রোজ এসে কত দস্তান বলতুম তোকে কাল্লু।

-মাফ কিজিয়ে হুজুর। আপনার দস্তানে কোন রং ছিল না।

-রং দেখবি? আয়, তা হলে আমার হার ধর।

-কোথায় যাব হুজুর?

-জাঁহাপনা সলোমনের দরবারে।

-মাশাল্লা।

-কত মণি-মুক্তো-হিরে-জহরত থেকে রং ঠিকরোচ্ছে দেখতে পাচ্ছিস?

-জি হুজুর। আঃ। কী আলো-কী আলো-হুজুর, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। দস্তানের ভেতরে তো এরকম আলো দেখতে পেতাম হুজুর।

-ওই দেখ, সভাকবি শাহেদ এসে জাঁহাপনার পায়ে লুটিয়ে পড়েছেন। কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না-কথা জড়িয়ে গেছে তাঁর।

সলোমন জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে আপনার? এমন উদভ্রান্ত কেন?

ভয়ে শাহেদের ঠোঁট নীল হয়ে গিয়েছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, আমাকে বাঁচান জাঁহাপনা

-কী হয়েছে বলুন? কে আপনাকে মারতে চায়?

-হাওয়া হুজুর-রাস্তায় রাস্তায় শুধু একই হাওয়া-কী যে ঠাণ্ডা-তলোয়ারের মতো আমার বুকে, পেটে, চোখে এসে ঢুকছে-আমাকে বাঁচতে দেবে না।

-কে?

ইস্রাফিল হুজুর।আপনার দরবারে আসতে আসতেই তাঁকে দেখলাম। কালো কাপড়ে তাঁর মুখ ঢাকা। তাঁর দৃষ্টি ছোরার মত আমার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। হুজুর, ইস্রাফিলের নিশ্বাস থেকে আমাকে বাঁচান। কত কাজ আমার বাকি রয়ে গেছে। আমি এখনই মরতে চাই না।

-আমি কী করব, বলুন?

-হাওয়া তো আপনার ক্রিতদাস।

-হুঁ।

-তাঁকে বলুন আমাকে ভারতবর্ষে নিয়ে যেতে। ইস্রাফিলের থেকে দূরে মহাসাগরের ওপারে থাকব আমি।

-তাই হোক।

জাঁহাপনা সলোমন হাওয়াকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর প্রিয় কবিকে পাহাড়-সমুদ্র পেরিয়ে হিমালয়ের ওপর দুর্গম অরেণ্যে রেখে আসতে বললেন।

পরদিন তার দরবারে ভিড়ের মধ্যে ইস্রাফিলকে দেখতে পেলেন জাঁহাপনা। তিনি মৃত্যুর ফরিস্তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কাল আপনি আমার প্রিয় কবিকে ভয় দেখিয়েছেন?

-না জাঁহাপনা। কবি শাহেদকে দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। খোদা আমাকে বলেছিলেন, কালকের মধ্যেই তাঁকে ভারতবর্ষে পৌঁছে দিতে। তো আমি ভাবলাম, কবির ডানা থাকলেও তো তিনি একদিনে পৌঁছতে পারবেন না। তাই—

-হুজুর-। কাল্লু চোখ মেলে তাকাল।

-বল কাল্লু।

-এটা কোন দেশ হুজুর?

-ভারতবর্ষ।

-সালাম আলেকুম, হুজুর। কাল্লু আবার চোখ বুজল।

কাল্লুকে কবরে শুইয়ে দিয়ে এসে আমার কুঠুরিতে বসেছিলুম। যেন নক্ষত্রহীন আকাশের মধ্যে বসে আছি। বেগম কখন এসেছে টের পাইনি। একসময় কান্নার শব্দ পেয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কে?

-আমি মির্জাসাব।

-উমরাও-কী হয়েছে-ঘুমাওনি?

-আপনিও তো ঘুমোননি।

-কিছু বলবে?

-চলুন এই দেশ ছেড়ে আমরা চলে যাই।

-কোথায়?

-আপনি জানেন।

-কবর ছাড়া তো আর কোনও জায়গা নেই, বেগম। খোদা কখন কাকে ডাকবেন, তিনিই জানেন। কয়েকটা দিন তোমাকে শুধু স্বপ্ন দেখতে হবে বেগম। তুমি শাহজাহানাবাদেই আছো। কান খাড়া করে শোনো-ওই তো ফতেপুর সিক্রি থেকে মিঞা তানসেনের পুকার ভেসে আসছে

বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে। আমার ধর্মরাজ মিঞা ভিজতে ভিজতে কুইকুই করে ডাকছে।

মান্টোভাই, রহম করুন, এবার আমাকে শেষবারের মতো ঘুমোতে দিন। আল্লা মেহেরবান।

হম-নে বহশৎকদহ-এ বজম-এ জঁহা-মেঁ জুঁ শমা
শোনহ-এ ই কো অপনা সর ও সাঁমা সমঝাঁ।
(দুনিয়ার এই ভয়ানক উজাড় মজলিসে প্রদীপের মতো আমি
প্রেমের শিখাকেই আমার সর্বস্ব জ্ঞান করলাম।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *