৪১. বিস্মৃতির কুয়াশার ভিতরে

বহ্ দিল নহীঁ রহা হ্যয় নহ্ বহ্ অব দিমাগ হ্যয়
জী তনমেঁ অপনে বুঝতাসা কোই চিরাগ হ্যয়।
(সে হৃদয়ও নেই, সে মাথাও নেই এখন,
শরীরে প্রাণ আছে, যেন একটা নিভু নিভু প্রদীপ।)

হ্যাঁ, মান্টোভাই, এরপর শুধু বিস্মৃতির কুয়াশার ভিতরে জেগে থাকার সময়। চোখ আর কিছু দেখতে পায় না। মন আর কোনও কথা বলে না। হৃদয়ে কোনও ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে না। শাহজাহানাবাদ দখল করে ব্রিটিশ আমাদের উপহার দিল একটা মৃত শহর। সেখানে সব সময় হিম বাতাস বয়, ঝরা পাতা উড়ে যাওয়ার শব্দ শোনা যায়, রাস্তাগুলো নিহত মানুষের শুকিয়ে যাওয়া রক্তে কালো হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা দিন অভিশপ্ত, আমি জানতুম, এর কোনও শেষ নেই, সব ধ্বংস হয়ে গেছে।

মহল্লার পর মহল্লা ফাঁকা হয়ে গেল। মুসলমানদের তো ওরা কচুকাটা করেছে, যারা বাঁচতে পেরেছিল, তারা পালিয়ে গেছে। রাতে তাদের ঘরে বাতি দেখা যায় না, সকালে উঠোনে দেখা যায় না উনুনের ধোঁয়া। কথা বলবার মতো কেউ ছিল না। আমি তো কথা না বলে থাকতে পারতুম না। বন্ধুরা ছাড়াও প্রত্যেকটা বাড়ির লোকজনের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক ছিল আমার। হাসি ঠাট্টা, খোসগল্প না করতে পারলে হাঁফিয়ে উঠতুম। এত নীরবতা আমি কী করে সহ্য করব বলুন। শেষ পর্যন্ত নিজের কলমের সঙ্গেই কথা বলতে শুরু করলুম, আর নিজের ছায়াই হল আমার বন্ধু। চিঠি লিখে যে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলব, তারও তো উপায় ছিল না। ডাক-ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। খবরের কাগজ আর আসে না। ফরাসি মদও পাওয়া যায় না। রাত্তিরে ওটুকু না পেলে আমি ঘুমোতে পারতুম না। এক বন্ধু মাঝে মাঝে রম পাঠাতেন, তাই কোনও মতে বেঁচে ছিলুম। পেনশন বন্ধ, কিন্তু অতগুলো লোকের পেটের ভাত তো জোগাড় করতে হবে। উমরাও বেগমের গয়নাগাটি বিক্রি করা শুরু হল। বিছানা, জামাকাপড়ও বিক্রি করতে হয়েছে। হেসে নিজেকে বলতুম, মির্জা, অন্য লোকেরা রুটি খায় আর তুমি খাচ্ছ কাপড়। কিন্তু সব কাপড় খাওয়া হয়ে গেলে কী করবে? আঙুল চুষব। বাকি পেনশন যদি পাই তবুও আয়না থেকে রং মুছে যাবে না, আর না-পেলে তো আয়নাটাই চুরমার হয়ে যাবে। হেঁয়ালি করছি না, ভাইজানেরা। এই হৃদয় তো আয়নার মতোই। রোজ ভাবতুম, দিল্লি ছেড়ে এবারে পালাতেই হবে, এখানে আর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। জল পর্যন্ত পাওয়া যায় না।হিসেব মেপে খেতে হয়। ভাবতে পারেন, মান্টোভাই, দুদিন আমাদের ঘরে এক ফোঁটা জল ছিল না। তবু এরই মধ্যে বেঁচে থাকতে পেরেছি, তা দুচারজন মানুষের সাহায্যে। খোদা আমাকে এই অমূল্য রত্ন দিয়েছিলেন মানুষ দুঃসময়ে তারা কেউ না কেউ আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে। হীরা সিং, শিবাজিরাম ব্রাহ্মণ-ওরা আমার ছেলের মতো, শার্গিদ, আমাকে কতভাবেই না সাহায্য করেছে। শিবাজিরামের ছেলে বালমুকুন্দও পাশে-পাশে থেকেছে। আর হরগোপাল তক্তা তো সেকান্দ্রাবাদ থেকে যখন যেমন পেরেছে টাকা পাঠিয়েছে।

ওই দিনগুলোর কথা ভাবতে গেলে সব কেমন গুলিয়ে যায়। মনে হয়, একটা ভুলভুলাইয়ার মধ্যে হারিয়ে গেছি, আর সেই ভুলভুলাইয়ার পথে পথে জমাট বেঁধে আছে রক্ত, ছড়িয়ে আছে কত চেনা অচেনা মানুষের কাটা মুণ্ডু, তারা স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন কিছু বলতে চায়, আমি দেখতে পাই তাদের ঠোঁট ঘৃণায়-অপমানে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এই রকম। বেওয়ারিশের মত মৃত্যু তো তাদের প্রাপ্য ছিল না, মান্টোভাই।

বাদশাহের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ছিল, তাদের ওরা কোতল করতে ছাড়েনি। ওদের চোখে তখন মুসলমান মানেই বিশ্বাসঘাতক। আমিও সন্দেহভাজনদের তালিকায় ছিলুম। একদিন কর্নেল বার্ন গোরা সিপাই পাঠালেন আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পাতিয়ালার মহারাজা নরেন্দ্র সিং প্রথম থেকেই ইংরেজদের পক্ষে ছিলেন। আমার বাড়ির গলিতেই থাকতেন মাহমুদ খান, মুর্তাজা খান, গুলামুল্লা খানের মতো হাকিম। এরা সব পাতিয়ালা দরবারের মানুষ। ব্রিটিশদের সঙ্গে কথা বলে মহারাজা নরেন্দ্র সিং আমাদের গলিতে নিজের সিপাই বসিয়েছিলেন। তাই আমরা খাবারদাবার, জলের যোগাড় করতে একটু বেরুতে পারতাম। তবে চাঁদনি চকের ওপারে যাওয়ার হুকুম ছিল না। না হলেই গর্দান যাবে। তো গোরা সিপাইরা পাচিল ডিঙিয়ে আমাদের গলিতে ঢুকে পড়ল। সোজা এসে আমাদের বাড়িতে হানা দিল। আমার সঙ্গে সঙ্গে বকির, হুসেন, কালু, আশেপাশের বাড়ির দুএকজনকেও কর্নেল বার্নের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। চওকের কাছে কুতুবউদ্দিনের হাভেলিতে ছিলেন কর্নেল। এরা সত্যিই অদ্ভুত মানুষ, যেন সেদিনই দুনিয়াতে পয়দা হয়েছেন। আমাকে ভাঙা ভাঙা উর্দুতে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, আপনি মুসলমান?

মজা করার সুযোগ আমিই বা ছাড়ব কেন? বললুম, আধা মুসলমান হুজুর।

-মতলব?

-মদ খাই, তবে শুয়োর হারাম।

কর্নেল হা-হা করে হেসে উঠলেন।-আপনি তো রসিক দেখছি।

-রসে বসেই তো ষাটটা বছর কেটে গেল হুজুর। বলতে বলতে আমি তার দিকে লন্ডন থেকে পাঠানো চিঠিটা এগিয়ে দিই। মহারানি ভিক্টোরিয়ার জন্য যে কসীদা পাঠিয়েছিলাম তারই প্রাপ্তি স্বীকারের চিঠি।

-এটা কী?

-হুজুর একবার দেখুন।

কর্নেল বার্ন একবার চোখ বুলিয়েই চিঠিটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। -এসব ফালতু জিনিস আমার দেখার দরকার নেই।

-জি হুজুর।

-দিল্লিতে শান্তি ফিরিয়ে আনার পর আমাদের সঙ্গে দেখা করেন নি কেন?

-দেখা করতে চেয়েছিলাম, হুজুর। কিন্তু পথে বেরুলেই তো গুলি করে মারবে।

-নিমকহারামদের তা হলে কী করবে?

-ঠিকই তো হুজুর।

-তা হলে আসেননি কেন?

-হুজুর—

-আমি জানতে চাই আসেননি কেন?

-আমি একজন মির্জা, সাহেব।

-মতলব?

-পাল্কি ছাড়া আমি কোথাও যাই না। শহরে একজনও বেহারা নেই। কী করে আসব বলুন।

-তুমি কোন লাটের বাঁট হে, পাল্কি ছাড়া চলতে পারো না? কর্নেল বার্ন চিৎকার করে ওঠেন, গেট আউট-কেল্লার কাগজপত্রে তোমার নাম ছিল না বলে ছেড়ে দিলাম-গেট আউট

অপমান করাটা ওদের মজ্জায় মজ্জায়। মানুষকে ওরা যত অপমান করতে পারে, ততই ক্ষমতার নেশায় বুদ হয়ে যায়। আমি কি কর্নেল বার্নের মুখে মুতে দিতে পারতুম না? কিন্তু আমাদের তখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। শাহজাহানাবাদ থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া, অন্য কোনও পথ তো আমাদের সামনে খোলা ছিল না। শুধু মুসলমান বলেই এত অপমান, অত্যাচার, খুন হয়ে যাওয়া? শুধু মুসলমান বলেই আমি সন্দেহভাজন? ওরা যে বিজ্ঞানের বড়াই করে, তা কাদের থেকে পেয়েছিল, মান্টোভাই? এই মুসলমানদের থেকেই তো। এত সহজে ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে? সত্যিই তো যায়, আমি নিজের চোখে দেখেছি, শাহজাহানাবাদকে কীভাবে মুছে ফেলা হল।

কাউকে মুছে ফেলার জন্য আগে কী করতে হয়, জানেন? তাকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করো। এরপর কাজটা খুব সহজ। তার বিচারের প্রহসন ও মৃত্যুদণ্ড। জাঁহাপনা বাহাদুর শাহের ক্ষেত্রে ওরা একুশ দিনের প্রহসন চালিয়ে বাদশাকে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। বাদশার অধীন ঝক্কর, বাহাদুরগড়, বল্লভগড়, লোহারু, ফররুকগর, দুজানা, পতৌদির নবাবাদের কী অবস্থা করেছিল শুনুন। দুজানা, পতৌদি ছাড়া সব নবাবাকেই কেল্লায় এনে বন্দি করা হয়েছিল শাহজাহানাবাদ দখলের কয়েকদিনের মধ্যে। চাঁদনি চকের কাছে গাছ থেকে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয় ঝক্কর, বল্লভগড়, ফারুকনগরের নবাবদের।

এখন শস্ত্রধারী ইংরেজ সৈনিক
স্বেচ্ছাচারী ও স্বাধীন।

আতঙ্কহিম নিশ্চল মানুষ,
পথ জনহীন।

নিরানন্দ বাসভূমি আজ কারাগার।
চও পরাজিতের রক্তে রঙিন।

নগর মুসলমানের শোণিত –তৃষিত
প্রতিটি ধূলিকণা তৃপ্তিবিহীন।

আমি বসে বসে শুধু মৃত আর হারিয়ে যাওয়া মানুষদের সংখ্যা গুনি। তারা কেউ আমার আত্মীয় বন্ধু, কেউ পরিচিত। বন্ধু ফজল ই-হককে সারা জীবনের জন্য দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হল। শইফতা সাত বছরের জন্য কারাবন্দি হলেন। অন্যদের হত্যা করা হল বা শাহজাহানাবাদ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। শুধু এক-একটা নাম বেঁচে রইল আমার জীবনে-মুজাফফরাদৌল্লা, মির নাসিরুদ্দিন, মির্জা অসুর বেগ, আহমদ মির্জা, হাকিম রাজিউদ্দিন খান, মুস্তাফা খান, কাজি ফয়জুল্লা, হুসেন মির্জা, মীর মহদী, মীর শরফরাজ হুসেন, মীরন..। আমার শয়তানের কুঠুরিতে বসে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকি। ওই তো মীর মেহদি আসছেন। আরে ইউসুফ মির্জা না? মীরনও তো আসছেন। ইউসুফ আলি খানকেও দেখতে পাচ্ছি। ইয়া আল্লা! এত বন্ধুর মৃত্যু আমাকে বহন করতে হবে? আমি মরলে শোক করার জন্য আর কেউ রইল না, মান্টোভাই।

কথায় কথায় যারা আইন দেখায়, তাদের রাজত্বে আইনের কোনও বালাই রইল না। শুধু, আপনি হিন্দুস্থানের আদমি-বলতে পারবেন না, ওরা আইনকে কবরে শুইয়ে দিয়ে এসেছে। ওরা বলে দেবে, কারা আইন মানে না, আপনাকে তা মেনে নিতে হবে। একটা ঘটনা বলি। হাফিজ মাম্মু আমাদের কাছের মানুষ ছিলেন। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তাঁর ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ যখন ধোপে টিকল না, তখন তো মাম্মুর বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতেই হবে। কমিশনার মাম্মুকে ডেকে পাঠালেন।

-হাফিজ মুহম্মদ খান কে?

-আমি হুজুর।

হাফিজ মাম্মু কে?

-আমি সাব।

-তার মানে?

-আমার নাম হাফিজ মুহম্মদ খান। তবে সবাই হাফিজ মাম্মু বলেই ডাকে।

-কেন?

-মানুষের মর্জি হুজুর।

-দুজন যে একই লোক আমি কী করে বুঝব?

হুজুর, আমি তো বলছি।

-আমিও তা হলে বলছি, তুমি কিছুই পাবে না।

-কেন হুজুর।

-আগে প্রমাণ করো, তুমি কে?

হাফিজ মাম্মুকে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল। আইনের রাজত্ব বলে কথা। শুনেছিলুম, লাহোরে নাকি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য দফতর খোলা হয়েছে। বিদ্রোহী সিপাইরা যাদের সম্পত্তি লুঠ করেছে, তারা ১০ শতাংশ ক্ষতিপূরণ পাবে। হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ আপনি পাবেন একশো টাকা। আর গোরা সিপাইরা যে লুঠপাট চালিয়েছে, তার জন্য কোনও ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে না। এর চেয়ে বড় সুবিধার আর কী হতে পারে? হিন্দুস্থান তো ওদের বাপের সম্পত্তি, লুঠপাট চালিয়ে ক্ষতিপূরণ দেবে কেন?

কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করত না, মান্টোভাই। বকির আর হুসেন এসে মাঝে মাঝে জড়িয়ে ধরত। এটা দাও, ওটা দাও। আমার হাতে পয়সা কোথায় বলুন? কিন্তু ওদের তো সে কথা বলা যায় না। একদিন বিরক্ত হয়ে কাল্লুকে মহলসরায় পাঠালুম। উমরাও বেগমের কোনও গয়না যদি বিক্রি করা যায়। কাল্লু ফিরল না, কিছুক্ষণ পর উমরাও এল আমার ঘরে। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

-বেগম, তুমি এলে কেন?

-আর তো আমার কাছে কিছু নেই।

হারামজাদা কাল্লুই তো এসে বলতে পারত। ও গেল কোথায়?

-ওর কোন দোষ নেই মির্জাসাব। আপনাকে আমার কিছু বলার ছিল।

-বসো। এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কথা হয়?

-আমাকে ক্ষমা করুন মির্জাসাব।

-কী হয়েছে বেগম?

-আমি বেওকুফ বুঝতে পারিনি।

-কী হয়েছে বলো তো?চুরি করে কিছু খেয়েছ না কি? আমি হেসে বলি।-তবে খাবেই বা কী? হাওয়া ছাড়া তো কিছু নেই।

-মির্জাসাব-। কথা শেষ না করেই সে কাঁদতে শুরু করে। আরে, এত চোখের জল কোথা থেকে আসে এই জেনানাদের?

-কেঁদো না বেগম। ব্রিটিশরা দেখলে গুলি করবে। দেশটাকে ওরা মরুভূমি বানাতে চায়, আর তুমি চোখের ভেতর এত জল লুকিয়ে রেখেছ? এবার বল তো, কী বেওকুফিটা করেছ? আমার চেয়ে বড় বেওকুফ তো তুমি নও।

-সিপাইরা যখন এল আমি একটা বাক্স ভর্তি কিছু গয়না কালেসাবের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। জাঁহাপনার মুর্শিদ তিনি, সিপাইরা তো আর তার বাড়ি লুঠ করবে না।

-হু। সব খোয়া গেছে, তাই তো?

সিপাইরা কালেসাবের বাড়িতে লুঠপাট করেনি, কিন্তু গোরা সৈনিকরা তো আর জাঁহাপনার

মুর্শিদকে ছেড়ে দেবে না, মান্টোভাই। উমরাওয়ের শেষ সম্বলটুকুও এভাবে লোপাট হয়ে গেল। বলতে বলতে উমরাও কাঁদছিল। আমি তার হাত ধরে বললুম, বেগম, তুমি তো এত বছর দ্বীনের পথেই আছ। খোদা যে এবার পথের ভিখিরি করে ছাড়লেন, তার মানে বোঝ না? এখন গোটা দুনিয়াটাই তোমার। উমরাও ঘোলাটে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

-আনন্দ করো বেগম, আনন্দ করো। জীবন থেকে যত অলঙ্কার ঝরে পড়ে, ততই তো আনন্দের পথ খুলে যাবে।

-আমরা খাব কী মির্জাসাব?

-গু। নিজেদের গু খেয়ে বেঁচে থাকব। ওখানে তো বেজন্মাগুলো হাত দিতে পারবে না।

-কী কথায় কী বলেন আপনি মির্জাসাব, নিজেও জানেন না।

-ঠিক বলছি, বেগম, ওরা আমাদের দুনিয়া থেকে লোপাট করে দেবার জন্য হিন্দুস্থানে এসেছে।

কেল্লায় আর লোহারুর নবাব জিয়াউদ্দিন খানের কিতাবখানায় আমার কত যে গজল ছিল! আমি যা-ই লিখতুম নবাব জিয়াউদ্দিন তার নকল রাখতেন। প্রায় নশো পৃষ্ঠার গদ্য আর দুহাজারের বেশি কবিতা তার কাছে ছিল। দেখবার মতো ছিল সে-সব কিতাব। মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো, ওপরে সোনা-রুপোর সুতোর অলঙ্করণ। জাঁহাপনার সন্তান, আমার শার্গিদ মির্জা ফকরুদ্দিনও আমার গজলের একটা সংগ্রহ তার কিতাবখানায় রেখেছিল। নিজের লেখা তো আমি কখনও গুছিয়ে রাখতে পারিনি। এতগুলো বছর পেটের ধান্দায়, নানারকম ফন্দিফিকির করে কেটে গিয়েছে। ফিরিঙ্গিরা যখন লুঠপাট শুরু করল, কিতাবখানাকেও ওরা রেহাই দেয়নি। কত যে আশ্চর্য কিতাব এই দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেল। একদিন রাস্তার এক ভিখারি আমার গজল গাইছে শুনতে পেলুম। আমি তাঁকে ডেকে জিজ্ঞেস করলুম, এই গজল তুমি কোথায় পেলে, মিঞা?

-রাস্তায় হুজুর।

-কাগজটা তোমার কাছে আছে?

সে তার আলখাল্লার পকেট থেকে একটা ছেঁড়া কাগজ বার করে আমার হাতে দিল। হ্যাঁ, আমার লেখা গজল। কেল্লার কিতাবখানায় যে হাতে-লেখা বই ছিল, তারই একটা পৃষ্ঠা। আমি কান্না সামলাতে পারিনি, ভাইজানেরা।

-কী হল, হুজুর?

-কাগজটা আমাকে দেবে?

-নিন না। ও দিয়ে আমার কী হবে?

-তুমি গাইবে কী করে?

ভিখিরি হেসে বলল, দিলকেতাবে সব লিখে নিয়েছি, হুজুর।

একেকটা দিন পার হয়ে যায়, মান্টোভাই, আমার দিলকেতাবের পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে উড়ে যায়। মন খুলে কথা বলার একজন লোকও নেই। অনেক মানুষের সঙ্গে খোশগল্প করা যায়, ঠাট্টা ইয়ার্কি মারা যায়, কিন্তু সবাই তো তার নিজের মতো করে হাম জুবান, হাম শুখ লোগ চায়। সেইরকম দুয়েকজনকে তো আমার পেতে ইচ্ছে করত, যাঁদের সঙ্গে আমি কবিতা নিয়ে, আমার কল্পনা নিয়ে কথা বলতে পারি। তাঁরা পাশে না থাকলে তো গুলবাগও শুকিয়ে যায়। দিল্লিতে তখন তো শুধু সৈনিক, ইংরেজ, পাঞ্জাবি আর হিন্দু লোকজন। আমার তজ্জীব-এর মানুষ। কোথায়? জওক নেই, মোমিন খান নেই, কোথায় গেলেন নিজামুদ্দিন মামনুন? কবিদের মধ্যে শুধু আমি আর আজুদা বেঁচে ছিলুম। আজুদা একেবারে নীরব হয়ে গিয়েছে, আর আমার হতবুদ্ধি অবস্থা। কেউ আর গজল লেখে না, কেউ আর কবিতার কথা বলে না। দুনিয়ায় কখনও কখনও এমন দুর্ভাগ্যের সময় আসে, মান্টোভাই, যখন কবিতার মৃত্যু হয়। আমি যেন গজলের কবরের পাশে বসেই প্রহরের পর প্রহর গুণে যাচ্ছিলুম। মৃত্যু এসে কবে আমাকে এই দুনিয়াদারিরি বাইরে নিয়ে যাবে, তার জন্য অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই ভাবতুম না।

সারা রাত জেগেই কেটে যেত। একদিন দেখি, এক ছায়ামূর্তি আমার কুঠুরিতে দাঁড়িয়ে আছে। কে এই মানুষটি? কীভাবে আমার কুঠুরিতে এসে পৌঁছলেন? দীর্ঘকায় এক পুরুষ, তাকে দেখে আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলুম, কে আপনি? কোথা থেকে এসেছেন?

-হুজুর, আমি জালালুদ্দিন রুমি।

-মওলা রুমি! আমি তাঁর পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লুম।-আমার কেয়ামতের দিন তবে এসে গিয়েছে?

-না, হুজুর।

-আপনি আমাকে হুজুর বলছেন কেন? এর চেয়ে বড় গুনাহ্ তো আর হয় না মওলা।

-সবাই আমার হুজুর, মির্জা। হুজুর বলেছেন, একমাত্র ঘাস হয়ে বেঁচে থাকাই আনন্দের। ঋতুরা আসবে যাবে, পাতা ঝরবে, আবার গজাবে, শুধু ঘাসই প্রান্তরে প্রান্তরে ঠিক বেঁচে থাকবে। ঘাসই জানে, কীভাবে মাঝখান থেকে ছড়িয়ে পড়তে হয়।

-আপনি বলুন মওলা, আপনার জন্য কী করতে পারি, বলুন?

মওলা রুমি মুখোমুখি বসে আমার পিঠে হাত রাখলেন। -আপনাকে একটা কিস্সা শোনাতে এলাম মির্জা।

-আমার আজ নবজন্ম হল, মওলা। আপনার মুখ থেকে কিস্সা শোনার সৌভাগ্য কজনের হয়?

-আমারও নবজন্ম হল, হুজুর। হিন্দুস্থানের শেরা শায়রকে কিস্সা শোনানোর সুযোগ দিয়েছেন খোদা।

-আপনার পাশে আমি কে?

-আসমানে ছড়িয়ে থাকা এক একটা নক্ষত্র আমরা। কে কত দূর আছি, খোদা ছাড়া কেউ জানেই না। কেউ মরে গেছে, কেউ বেঁচে আছি। তবু খোদার দয়ায় আমাদের সংলাপ চলছে, মির্জা। একদিন সন্ধেবেলা খেজুর গাছের নীচে বসেছিলেন পয়গম্বর মহম্মদ। তাঁর শিষ্যরা, আশপাশের গ্রামের মানুষরা তাঁকে ঘিরে বসেছিল। সূর্যাস্তের আকাশে তখন গোলাপি আর নীলের খেলা চলছে। হঠাৎ জহু উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, মহম্মদ, আপনার পূর্বপুরুষ হাসিমের মতো কুৎসিত আর নোংরা মানুষ দুনিয়াতে দেখা যায় না। তার সন্তানরাও একের পর এক কুৎসিত সন্তান পয়দা করেছেন।

হজরত মহম্মদের সবচেয়ে অনুরক্ত ভক্ত হায়দর তো সঙ্গে সঙ্গে খাপ থেকে তরবারি বের করেছে। মহম্মদ শান্ত স্বরে বললেন, তুমি সত্যি কথাই বলেছ জহু। এ-কথা শুনে হায়দর চুপসে গেল। তার তো ইচ্ছে ছিল, জহের মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে দেবে।

কিছুক্ষণ পর আবু বকর মহম্মদের সামনে নতজানু হয়ে বলল, জহূকে ক্ষমা করুন পয়গম্বর। আপনার পূর্বপুরুষ হাসিমের মতো সাহসী ও সুন্দর মানুষ দেখা যায় না। আপনিই তেমনই।

মহম্মদ তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, তুমি সত্যি কথাই বলেছ, আবু বকর।

অনেকক্ষণ সবাই চুপচাপ। হায়দর হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, হুজুর, পয়গম্বর, দুজনে দুরকম কথা বলছে। আপনার কাছে দুজনের কথাই সত্যি? কী করে হতে পারে?

মহম্মদ হায়দরের দিকে তাকিয়ে আবার হাসলেন। -তুমিও সত্যি কথাই বলেছ, হায়দর।

-আমিও সত্যি বলেছি?

-হ্যাঁ, আমি তো একটা আয়না, হায়দর। খোদা কবে থেকে আমাকে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে যাচ্ছেন। আমার আয়নায় সবাই নিজের ছবি দেখতে পায়। নীল কাচের মধ্য দিয়ে দুনিয়াকে দেখলে তবে তা নীল, আর লাল কাচের মধ্য দিয়ে যদি দ্যাখো, তবে লালই দেখবে। মানুষ যা দেখে, তা তারই প্রতিচ্ছবি।

-দুনিয়ায় তা হলে সত্য বলে কিছু নেই?

-সত্যকে তুমি পেতে চাও?

-জি হুজুর।

-তা হলে সব উত্তেজনা-আবেগ থেকে নিজেকে মুক্ত কর হায়দর। ভিতরের আয়নাটাকে ঘষতে থাকো, যতক্ষণ না সব রং মুছে গিয়ে একেবারে স্বচ্ছ হয়ে যায়। তখন তুমি তাকে দেখতে পাবে, হায়দর।

-কাকে মওলা? আমি জালালুদ্দিন রুমির দুই পা আঁকড়ে ধরে বললুম।

-পা ছাড়ুন মির্জা। আপনি শেষ হয়ে যাচ্ছেন- এই সৃষ্টির গভীরে হারিয়ে যাচ্ছেন-এর চেয়ে বড় আনন্দ ও সত্য আর কিছু নেই। আমি আশীর্বাদ করি, বিড়ালের মতো যেন মৃত্যু হয় আপনার

-কেন? -মৃত্যুর সময় বুঝতে পেরে বিড়ালরা একা হয়ে যায়। কাউকে বিরক্ত করে না, কারুর করুণা চায় না। মৃত্যুর মুখোমুখি সে একা। মির্জা, একাকিত্বই একমাত্র সত্য। আপনি এত উদ্বেল কেন? সবাই তো একদিন কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে যাবে। এই দুনিয়ায় জন্মেছেন, একে ছেড়ে চলে যাবেন-কী হাল্কা, পালকের মতো উড়ে যাওয়া-এই আনন্দটুকুই তো আপনার একাকিত্বের সঙ্গী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *