৩৮. আমি যে অশ্লীল লেখক

ঈমাঁ মুঝে রোকে হৈ তো খীঁচে হৈ মুঝে কুফ্র।
কাবহ্ মেরে পীছে হৈ, কলীমা মেরে আগে।
(ধর্মবিশ্বাস আমাকে ধরে রাখে, অবিশ্বাস আমাকে টানে,
আমার পিছনে রয়েছে কাবা, সামনে প্রতিমার বেদি।)

আমি যে অশ্লীল লেখক, তার বড় প্রমাণ হিসেবে আমার চারপাশের সব সচ্চা আদমিরা কী বলেছিল, জানেন মির্জাসাব? তাদের একটাই প্রশ্ন, আমার গল্পে বারবার বেশ্যাপল্লি আর বেশ্যারা ঘুরে ফিরে আসে কেন? বেশ্যা কী করে গল্পের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠতে পারে? প্রশ্নগুলো কারা তুলেছে? তারা সব প্রগতিশীল, সমাজের নিচুতলার মানুষদের নিয়ে গল্প লেখে বলে গর্বে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। হ্যাঁ, মির্জাসাব, এইসব লোকের কাছেও বেশ্যারা নর্দমার পোকার চেয়েও খারাপ। অথচ এরা অনেকেই লুকিয়ে-চুরিয়ে লালবাতি এলাকায় গিয়েছে। আমি যে গিয়েছি, তা নিয়ে রাখঢাক করিনি। চারপাশের বর্ণহীন মানুষদের মাঝে ওই পরিত্যাক্ত রংচং-মাখা মেয়েরা, তাদের দালালরা, ও পাড়ার ফুলওয়ালা,কাবাবওয়ালারা-ওদরে অনেক বেশী জীবন্ত মনে হত আমার। ওই মেয়েরা যাকে একবার ভালবাসে, তাঁকে পুরোপুরি পাওয়ার জন্য খুন করেও ফেলতে পারে। আমাদের সমাজের বাইরে লালবাতির দুনিয়াটা যেন এক মহাকাব্য। সৌগন্ধী, সুলতানা, নেস্তি, বিসমিল্লা, মহমুদা, জিনতদের কথা আমি বানিয়ে-বানিয়ে লিখিনি; দিল্লি, লাহোর, বম্বের বেশ্যাপল্লিতেই ওরা বেঁচে ছিল একদিন। মাহমুদাবাদের রাজা সাহেবের সঙ্গে একদিন খুব তর্ক হয়েছিল আমার। তারও একই বক্তব্য, এইসব ননাংরা মেয়েছেলেদের মধ্যে তুমি কী দেখতে পাও, মান্টো? যাও ফুর্তি করতে, তারপর ওদের নিয়ে বড় বড় কথা লেখো।

-ওদের নিয়ে আমি লিখে কী গুনাহ্ করেছি বলতে পারেন?

-সাহিত্য তো নোংরা জগৎ তুলে আনার জন্য নয়।

-তাহলে সাহিত্য লেখা হয় কেন রাজাসাহেব?

-আমাদের স্বপ্নের কথা তুলে ধরার জন্য।

আমি হেসে ফেলি।-এই আমাদের মধ্যে ওরা নেই। ওদের স্বপ্ন দেখার অধিকার নেই? ওদের স্বপ্নের কথা বলার কেউ থাকবে না? আমরা, ওরা-র খেলাটা খুব মজার রাজাসাহেব। কমিউনিস্টরা এই খেলায় খুব ওস্তাদ।

-তুমি কমিউনিজম কে ঘেন্না করো?

-জানি না। শুধু এটুকু জানি, আমার কমিউনিস্ট বন্ধুরাই সবচেয়ে আগে আমাকে অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

-তুমি একের পর এক গল্পে বেশ্যাদের কথা লিখবে আর অশ্লীল বলবে না তোমাকে?

-বেশ্যাদের কথা বলা যদি অশ্লীল হয়, তবে তাদের অস্তিত্বও অশ্লীল। তা হলে সেই অশ্লীলতা টিকে আছে কেন? বেশ্যাদের কথা বলা যদি নিষিদ্ধ হয়, তবে এই পেশাকেও নিষিদ্ধ করতে হবে, রাজাসাহেব। বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ করুন, তা হলে বেশ্যাদের কথা লেখার জন্য কোনও মান্টোর জন্ম হবে না। আমরা চাষি, মজুর, নাপিত, ধোপা, চোর, ডাকাতদের কথা বলতে পারি। জিন পরীদের নিয়ে গল্প ফাঁদতে পারি। তাহলে বেশ্যাদের কথা কেন বলতে পারব না?

-বলো বলো যতখুশি বলো। তোমার লেখাও কিচর ছাড়া আর কিছু হবে না।

-আমি তো তা-ই চাই রাজাসাহেব।

-মানে?

-এই সমাজের সব ননাংরা যেন আমার লেখায় জমে ওঠে। আপনারা যেন দেখতে পান, সাফসুরতির আড়ালে আসলে কী রয়ে গেছে।

-তুমি কি নিজেকে পয়গম্বর মনে করো?

-না। এই দুনিয়ায় লেখক-কবি সবচেয়ে দুর্বল প্রাণী। তাঁকে যে কেউ লাথি মেরে যেতে পারে, রাজাসাহেব। তার হাতে তো কোন ক্ষমতা নেই। সে শুধু যা দেখছে, অনুভব করছে, সে – কথাই সত্তাবে লিখে গেছে না, এ-সব কথা আপনাকে আমি বলতে চাইছি না। কেননা, আপনি বুঝবেন না।

-যা বুঝব, তা-ই বলো তা হলে।

-বেশ্যাপল্লি আসলে কী জানেন?

-কী? বেশ্যাপল্লি তো বেশ্যাপল্লিই। তবে মান্টোর নতুন ভাষ্য শোনা যাক।

-একটা পচা-গলা মৃতদেহ। এই সমাজ মুর্দাটাকে কাঁধে করে নিয়ে চলেছে। যদদিন না মরাটাকে কবর দেওয়া হবে, ততদিন মুর্দাটাকে নিয়ে কথাও চলবে, রাজাসাহেব। তবে কী জানেন মরাটা যতই পচা গলা হোক, যতই বীভৎস হোক, তার মুখের দিকে তো কেউ-না-কেউ তাকাবেই। তাকালে দোষই বা কী বলুন? মুর্দাটার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই? রাজাসাহেব, একবার ভাবুন তো, আমারাই কী ওকে মেরে ফেলিনি? শুধু তার মুখের দিকে তাকালেই দোষ? তা হলেই মান্টোকে অশ্লীল বলে দেওয়া যায়?

-মান্টো গল্পলেখক হিসেবে তুমি সেরা, আমি স্বীকার করি। ওই জগৎটাকে বাদ দিতে পারো না?

-না রাজাসাহেব। তাহলে নেস্তির গল্পটা আজ আপনাকে শোনাই।

-নেস্তি কে?

-একটা বেশ্যা। ও কীভাবে বেশ্যা হয়েছিল সেই কিস্সাটা শুনুন।

-বলো। রাজাসাহেব হাসলেন।

-কিস্সা ফাঁদায় তোমার জুড়ি নেই।

-এ কিস্সার শুরুতে নেস্তি কোথাও ছিল না, রাজাসাহেব। কোচোয়ান আবুকে নিয়েই এই গল্পের শুরুয়াত। আবু খুবই ভাল মানুষ, রাজাসাহেব।ভাল শব্দে বাগানের খুশবু আছে, মনে রাখবেন। সে ছিল খুবই সৌখিন, আর তার ঘোড়ার গাড়ি শহরে এক নম্বর। গাড়িটাকে সে মনের। মতন করে সাজিয়েছিল। যে-কোনও লোককে সে গাড়িতে তুলতই না। সব যাত্রীই ছিল নিয়মিত খদ্দের। অন্য কোচোয়ানদের মত মদে আসক্তি ছিল না আবুর; ওর নেশা ছিল ভাল জামাকাপড়ের প্রতি। আবুর ঘোড়ার গাড়ি যখন রাস্তা দিয়ে চলত, সবাই মুখ বেঁকিয়ে বলত, নবাবজাদা চলেছে। সেকথা শুনে আবুর যেমন বুক ফুলত, আবুর ঘোড়া চিন্নিরও গতি বেড়ে যেত। ঘোড়ার জিন আবুর হাতে থাকত ঠিকই, তবে চিন্নি আবুর মেজাজমর্জি এতটাই বুঝত যে ওকে কখনও চাবুক মারতে হত না। যেন আবু আর চিন্নি আলাদা কেউ নয়, রাজাসাহেব। অন্য কোচোয়ানরা কেউ কেউ আবুকে নকল করার চেষ্টা করত, কিন্তু ওর মতো রুচি তো তাদের ছিল না।

তো আবু একদিন দুপুরবেলা গাছের ছায়ার নীচে ওর গাড়িতে শুয়েছিল। ঘুমে চোখ বুজে এসেছে। এমন সময় একটা কণ্ঠস্বর শুনে আবু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল, একটা মেয়ে। দাঁড়িয়ে আছে। আবু ধড়মড় করে উঠে বসল। মেয়েটির রূপ তিরের মতো তার বুকে গিয়ে বিধেছে যে। ষোলো-সতেরো বছরের কালো মেয়েটি যৌবনের উদ্ভাসে ঝলমল করছে।

কী চাই? আবু আমতা-আমতা করে বলে। যেন স্বপ্ন রাজাসাহেব, কোনও পরি জন্নত থেকে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

-টেশন যেতে কত নেবে?

আবু হেসে বলল, এক পয়সাও না।

মেয়েটা আবারও জিজ্ঞেস করল, টেশন যেতে কত নেবে, বলো না।

-তোমার কাছ থেকে পয়সা নেব? উঠে বসো।

-তার মানে? মেয়েটা জড়োসড়ো হয়ে যায়।

-আরে ওঠোই না। তোমার যা ইচ্ছে হবে দিও।

মেয়েটা আবুর গাড়ির পিছনে উঠে বসে।-তাড়াতাড়ি চলো।

-এত তাড়া কিসের?

-তুমি-সে তুমি। মেয়েটা কথা শেষ না করেই থেমে যায়।

আবুর গাড়ি চলতে থাকে। চিন্নির খুরের ছন্দে যেন আজ অন্য রহস্য। পিছনেই বসে আছে মেয়েটা। আবু বারবার ফিরে তাকাতে গিয়েও পারে না। মেয়েটা একসময় বলে, টেশন এখনও এল না?

-আসবে গো। আবু হেসে বলে।-তোমার আমার টেশন তো একই জায়গায়।

-মতলব?

-তুমি তো অত বোকা নও, জানেমন। তোমার আমার টেশন একই জায়গায়। তোমাকে দেখেই বুঝেছি। জান কসম,আমি তোমার বান্দা হয়ে গেছি।

মেয়েটা কোন উত্তর দেয় না। গায়ের চাদর আরও ভালো করে জড়িয়ে নেয়।

আবু জিজ্ঞেস করে, কী ভাবছ জানেমন?

মেয়েটা তবু কোনও কথা বলে না।আবু হঠাৎ গাড়ি থামায়। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পিছনে মেয়েটির পাশে এসে বসে। তার হাত চেপে ধরে বলে, জানেমন, তোমার লাগাম আমার হাতে দাও।

-খুব হয়েছে। মেয়েটা মাথা নীচু করে বলে।

আবু মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটা প্রথমে বাধা দিলেও শান্ত হয়ে আসে। আবু বলতে থাকে, এই গাড়ি আর ঘোড়াকে আমি আমার জানের চেয়েও ভালবাসি। খোদা কসম, তোমার জন্য ওদেরও আমি বেঁচে দিতে পারি। অনেক সোনার গয়না বানিয়ে দেব জানেমন। বলো বলো-আমার সঙ্গে থাকবে? না হলে এখনই-তোমার সামনে-গলার নলি কেটে ফেলব।

মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আবু একসময় বিড়বিড় করে বলে, আজ যে কী হয়েছে। আমার! চলো, তোমাকে টেনে নামিয়ে দিয়ে আসি।

-না। তুমি আমাকে ছুঁয়েছ।

-মাফ করো। আমি ভুল করেছি।

-ভুলের কোন ইমান নেই? মেয়েটা ফুঁসে ওঠে।

আবু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর নিজের বুকে হাত রেখে বলে, তোমার জন্য জান। দিতে পারি।

মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, তা হলে আমার হাত ধরো।

আবু তার হাত চেপে ধরে বলে, আজ থেকে আমি তোমার বান্দা।

ওই মেয়েটির নাম নেস্তি, রাজাসাহেব। নেস্তি এসেছিল গুজরাত থেকে; এক মুচির মেয়ে। বাড়ির লোকদের ছেড়ে নেস্তি আবুর কাছেই থেকে গেল। পরদিন ওদের শাদি হল। না, ঘোড়া বা গাড়ি, কিছুই আবু বিক্রি করে নি, জমানো টাকা দিয়ে নেস্তিকে সিল্কের কুর্তা-পায়জামা, কানের দুল কিনে দিয়েছিল। আবু নেস্তিকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাঝে-মাঝেই বলত, তুম মেরি নবাবজাদি হো।

মাসখানেক পরে পুলিশ হঠাৎ অপহরণের অভিযোগে আবুকে গ্রেফতার করল। নেস্তি সবসময় ওর পাশে ছিল। আদালতের রায়ে দুবছরের জেল হল আবুর। নেস্তি আবুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, বাবা-মার কাছে আমি আর যাব না। তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব, মিঞা।

-ভাল থেকো। গাড়ি আমি দিনোকে চালাতে দিয়েছি। ওর কাছ থেকে রোজকার টাকা গুনে নিও, বিবিজান।

বাবা-মা অনেক বোঝানো সত্ত্বেও নেস্তি তাদের কাছে ফিরে গেল না, রাজাসাহেব। অচেনা শহরে আবুর ফিরে আসার অপেক্ষায় সে একাই রয়ে গেল। দিনো তাঁকে রোজ সন্ধ্যায় পাঁচ টাকা করে দিয়ে যেত। নেস্তির তাতে ভাল ভাবেই চলে যেত। সপ্তাহে একদিন জেলে কিছুক্ষণের জন্য আবুর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হত। আবুর জন্য সে ভাল খাবার, ফল নিয়ে যেত।

আবু একদিন দেখল, নেস্তির কানে দুল নেই।-তোমার কানের দুল কোথায় গেল?

নেস্তি চোখ বড় বড় করে দুই কানে হাত দিয়ে বলল,তাই তো। খেয়ালই করিনি। কোথায় যে পড়ে গেছে।

-আমার জন্য খাবারদাবার আনতে হবে না বিবিজান। আমি ঠিক আছি।

নেস্তি দেখতে পাচ্ছিল, আবুর শরীর দিনে দিনে ভেঙে যাচ্ছে। শেষবার জেলে গিয়ে নেস্তি শক্তসমর্থ আবুর বদলে একটা কঙ্কালকে দেখতে পেল। নেস্তি ভাবল, ওর সঙ্গে বিচ্ছেদের দুঃখে আবু ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আসলে রাজাসাহেব, আবুর ছিল টিবি রোগ। আবুর বাবা, দাদাও টিবিতেই মারা গিয়েছিল। জেলের হাসপাতেলে শুয়ে নেস্তিকে আবু বলেছিল, এভাবে মারা যাব জানলে আমি তোমাকে শাদি করতাম না বিবিজান। আমাকে ক্ষমা করো। চিন্নি আর গাড়িটাকে যত্ন করো। ওরাই তোমাকে দেখবে। চিন্নিকে বলল, আমি ওর কথা কখনও ভুলব না।

নেস্তিকে শূণ্য প্রান্তরে ফেলে রেখে আবু এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু নেস্তি ছিল অন্য ধাতের মেয়ে, রাজাসাহেব। এত বড় বেদনা নিয়েও সে সোজা দাঁড়িয়ে থাকল। সারাদিন একা -একা ঘরে কেটে যায় আবুর কথা ভাবতে ভাবতে। সন্ধেয় দিনো আসে বরাদ্দের টাকা দিতে।

-ভয় পেয়ো না ভাবিজি। আৰু আমার ভাইয়ের মতো ছিল। তোমার জন্য আমি যথাসাধ্য করব। একদিন দিননা বলল।

-খোদা যা করবেন।

-খোদা তো মানুষকে দিয়েই করান ভাবিজি। তুমি এভাবে মুখ কালো করে থেকো না। আমার ভালো লাগে না।

-কী করব দিনোভাই?

-ফির শাদি করো। আৰু ভাইয়ার কথা ভাবতে ভাবতে সারা জীবন কাটিয়ে দেবে নাকি?

-শাদি!

-তুমি যেদিন বলবে, আমি রাজি।

-দিনোভাই!

 -কী হল?

নেস্তির ইচ্ছে হয়েছিল, লাথি মেরে দিনোকে ঘর থেকে বার করে দেয়। তা তো পারেনি, শুধু বলেছিল, আমি আর শাদি করব না, দিনোভাই।

সেদিন থেকে দিনোর ব্যবহারও বদলে গেল। পাঁচ টাকার বদলে কোনওদিন চার, কোনওদিন তিন টাকা দিতে শুরু করল। নেস্তি জিজ্ঞেস করলে বলত, সওয়ারি পাওয়া যাচ্ছে না, আগের মতো আর রোজগার নেই। এরপর দুতিনদিন পর পর এসে টাকা দিয়ে যেত। একদিন নেস্তি বলেই ফেলল, তোমাকে আর গাড়ি চালাতে হবে না দিনোভাই। যা করবার আমিই করব।

নেস্তি এরপর দিনোর আর এক বন্দুকে গাড়ি চালাতে দিল। কয়েকদিনের মধ্যে সেও নেস্তিকে শাদি করার কথা বলল। নেস্তি তাকেও না বলল। এবার অচেনা এক কোচোয়ানকে সে গাড়ি চালাতে দিল। একরাতে লোকটা মাতাল হয়ে এসে নেস্তির হাত ধরে টানাটানি শুরু করল, রাজাসাহেব।

আট-দশদিন গাড়ি আর ঘোড়া পড়ে রইল। নেস্তি কী করবে ভেবে পায় না। নিজের দিন গুজরানের খরচ, চিন্নির খাবার, গাড়ি রাখার জায়গার ভাড়া-এ সব কোথা থেকে আসবে? সবাই তো এসে তাকে শুধু বিয়ে করতে চায়। নেস্তি বোঝে উদ্দেশ্য তার সঙ্গে শোওয়া। বাইরে বেরোলে সবাই তার দিকে লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকে। একরাতে পাশের বাড়ির লোকটা পর্যন্ত এসে দরজায় ধাক্কা মারতে শুরু করেছিল, আর বলছিল, কত টাকা চাস, মাগী? কত টাকা পেলে দরজা খুলবি?

একদিন হঠাৎই নেস্তির মনে হল, আচ্ছা, আমিই তো গাড়ি চালাতে পারি। আবুর সঙ্গে যখন সে বেড়াতে যেত, তখন মাঝে মাঝে সেও গাড়ি চালিয়েছে। পথ ঘাটও সে ভালই চেনে। তাহলে অসুবিধা কোথায়? মেয়েরা যদি মাটি কাটতে পারে, ভাড়া বইতে পারে, ঘোড়ার গাড়িই বা চালাতে পারবে না কেন? বেশ কয়েকদিন ভাবার পর নেস্তি ঠিক করল, সে নিজেই গাড়ি চালাবে।

নেস্তিকে গাড়ি নিয়ে আসতে দেখে কোচোয়ানদের চোখ তো কপালে উঠল। অনেকে মজা পেয়ে হাসতে শুরু করল। সবচেয়ে বয়স্ক কোচোয়ান এসে নেস্তিকে বোঝাল, ঘোড়ার গাড়ি চালানো মেয়েদের কাজ নয়। নেস্তি তার কথায় কান দিল না। চিন্নিকে আদর করে, আবুর সঙ্গে মনে – মনে কথা বলে সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

সারা শহরে হইহই পড়ে গেল। এক খুবসুরত জেনানা ঘোড়ার গাড়ি চালাচ্ছে। লোকজন। অপেক্ষা করে থাকে, কখন নেস্তির গাড়ি আসবে। প্রথম দিকে পুরুষ যাত্রীদের গাড়িতে তুলত না সে; তারপর সেই লজ্জাটুকুও চলে গেল। গাড়ি চালিয়ে নেস্তি বেশ ভালই রোজগার করতে লাগল। ওর গাড়ি কখনই দাঁড়িয়ে থাকত না, রাজাসাহেব। পুরুষরা তো ওর গাড়িতে চড়ার জন্য মুখিয়ে আছে। একটা মেয়ের কাঁধ, কোমর, বাহু, স্তন, নিতম্ব কিছু সময়ের জন্য চেখে দেখার পুরুষালি লোভ আপনি নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না রাজাসাহেব। নেস্তি তা বুঝতও। কিন্তু কী করবে সে? সম্মানজনক ভাবে খেয়েপরে থাকতে হবে তো তাকে। গাড়ি চালানোর সময় ও ঠিক করেই নিয়েছিল। সকালে সাতটা থেকে বারোটা, আর দুপুর দুটো থেকে সন্ধে ছটা। নেস্তি এভাবে নিজের মতো করে বেঁচেছিল, রাজাসাহেব।

একদিন মিউনিসিপ্যাল কমিটি থেকে নেস্তিকে ডেকে পাঠিয়ে জানানো হল, ওর গাড়ির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। কেন? মেয়েদের ঘোড়ার গাড়ি চালানোর নিয়ম নেই। নেস্তিও বলল, আমি তো চালাতে পারি, হুজুর। তা হলে অসুবিধা কোথায়?

-আর চালাতে পারবে না।

-কেন হুজুর? মেয়েরা যদি সব কাজ করতে পারে, ঘোড়ার গাড়ি চালাতে পারবে না? এই ঘোড়া আর গাড়ি আমার শহরের। আমি কেন চালাতে পারব না? গাড়ি না-চালালে আমি খাবার কোথা থেকে পাব হুজুর?

মিউনিসিপ্যাল অফিসার কী বললেন জানেন?-বাজারে গিয়ে জায়গা খুঁজে নাও। তাতে অনেক রোজগার হবে।

নেস্তির মতো একটা মেয়ে এর কী উত্তর দেবে বলুন তো? ঘোড়া আর গাড়ি বেঁচে দিতে হল ওকে। আবুর কবরের সামনে গিয়ে ও বসেছিল। রাজাসাহেব, আমি হলফ করে বলছি, ওর চোখে তখন জল ছিল না, মরুভূমির মতোই ধূ-ধূ করছিল দুই চোখ। আবুর কবরে মাথা রেখে নেস্তি বলেছিল, ওরা আমাকে বাঁচতে দিল না। আমাকে ক্ষমা করো।

পরদিন নেস্তি মাংসের বাজারে দরখাস্ত করল। হ্যাঁ, এখন থেকে প্রতিরাতে ও নিজের মাংস বিক্রি করবে। রাজাসাহেব, নেস্তির এই গল্পটাকে আমরা ইতিহাস থেকে মুছে দেব? তা হলে সব সাফসুরত থাকবে তো?

না, মির্জাসাব, আমার এই প্রশ্নের উত্তর রাজাসাহেব দেননি। কিই বা উত্তর দিতে পারতেন? তিনি কি কখনও সুলতানার মতো মেয়েকে দেখেছেন? কালি শালোয়ার গল্পে আমি সুলতানার কথা লিখেছিলাম, ভাইজানেরা। একটা বেশ্যা, মহরমে পরবে বলে শুধু একটা কালো শালোয়ার পেতে চায়, এই সামান্য আকাঙ্খায় অশ্লীলতা কোথায় আমাকে বলতে পারেন? কিন্তু ওরা সমাজের মাতব্বররা-খুঁজে খুঁজে ঠিক বার করে; ওরা তো সম্পূর্ণ মানুষকে দেখতে পায় না; কয়েকটা শব্দ, কিছু মুহূর্তকে কাটাছেড়া করে; এরা কারা জানেন, মির্জাসাব? পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের পর বসে থাকে সিংহাসনে-কবি নয়-অজর, অক্ষর অধ্যাপক, দাঁত নেই-চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি; বেতন হাজার টাকা মাসে-আর হাজার দেড়েক পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি।

এরা কী করে সুলতানাকে বুঝবে বলুন? বেশ্যাপল্লির সেই ভাঙাচোরা বাড়িটার ব্যালকনিতে ও বিকেল শেষে এসে দাঁড়াত। সুলতানার ব্যালকনি থেকে দেখা যেত রেলইয়ার্ড। রেললাইনের দিকে তাকিয়ে ও নিজের হাতের দিকে তাকাত। ফুলে ওঠা নীল শিরাগুলো একেবারে রেললাইনের মতো মনে হত ওর। রেল ইয়ার্ডের মধ্যে ট্রেনের বগি আর ইঞ্জিনগুলো সবসময় আসছে আর যাচ্ছে; ইঞ্জিনগুলো ধোয়া উগরে সুলতানার সামনের আকাশটাকে কালো করে। দিচ্ছে। অনেক সময় কোনও গাড়িকে একটা লাইনে ঢুকিয়ে দেওয়া হত, গাড়িটা নির্দিষ্ট লাইন ধরে চলতে শুরু করত আর সুলতানার মনে হত, তাকেও ওই গাড়িটার মতো একটা নির্দিষ্ট লাইনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর সে চলছে তো চলছেই। এই চলায় তার কোনও হাত নেই। অন্য কয়েকজন মানুষ সুইচ টিপে টিপে তাকে চালাবে। সে কোনও দিন জানতেও পারবে না। কোথায় সে চলেছে। তারপর একদিন গতি হারিয়ে যেখানে সে থেমে যাবে, সেই। জায়গাটাও তার কাছে অচেনা।

এক অদ্ভুত লকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সুলতানার। তার নাম শঙ্কর। মাঝে মাঝেই তাঁকে দেখা যেত, রাস্তার ও-পারে সুলতানাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। সুলতানার ব্যবসা জমছিল না, সারাদিন একা-একা কাটত। একদিন সে শঙ্করকে হাত নেড়ে ডেকেই ফেলল। শঙ্কর এমনভাবে এসে ঘরে বসল, যেন সে নয়, আসলে সুলতানাই খদ্দের। বেশ মজা লাগছিল সুলতানার। সে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার জন্য কী করব, বলুন?

-আমার জন্য? তার চেয়ে বললো, তোমার জন্য আমি কী করতে পারি? তুমিই তো আমাকে ডেকে আনলে।

সুলতানা তার কথায় অবাক হয়ে যায়।

শঙ্কর বলে চলে, বুঝতে পেরেছি। এবার আমার কথা শোনো। তুমি যা ভেবেছ, তা ঠিক নয়। আমি সেই বান্দা নই যে, এ-বাড়িতে ঢুকে কিছু টাকা গচ্চা দিয়ে বেরিয়ে যাব। আমারও মজুরি আছে, বুঝলে? ডাক্তার ডাকলে ফি দাও না? আমাকে ডাকলে আমারও মজুরি দিতে হবে।

শঙ্করের কথা শুনে হতচকিত হয়েও সুলতানা হাসি চাপতে পারেনি। সে জিজ্ঞেস করেছিল, তা, তোমার কী করা হয়?

-তোমরা যা করো। শঙ্কর বলে।

-সেটা কী?

-তুমি কী করো?

-আমি…আমি…আমি কিছু করি না।

-আমিও কিছু করি না।

-এ কথার কোনও মানে নেই। কিছু তো একটা করো।

-তা হলে তুমিও তো কিছু করো-

-জানি না শুধু সময় কাটাই।

-আমিও।

মাঝে মাঝেই শঙ্কর আসত, সুলতানা একদিন জিজ্ঞেস করে ফেলল, তুমি আমাকে শাদি করবে?

-শাদি? মাথা খারাপ। তোমার আমার দুজনেরই কখনও বিয়ে হবে না, সুলতানা। ও-সব বস্তাপচা ব্যাপার আমাদের জন্য নয়। আর কখনও এইরকম বাজে কথা বোলো না। তুমি একটা মেয়ে। আমাকে কিছুক্ষণ ভালো রাখার জন্য কিছু বলো। জীবনটা তো শুধু কেনা-বেচার জায়গা নয়।

-সোজা কথা বলো তো। কী চাও আমার কাছে?

-অন্যরা যা চায়। শঙ্কর ভাবলেশহীন গলায় বলল।

-তাহলে অন্যদের থেকে তুমি আলাদা কোথায়?

-শোনো সুলতানা, তোমার আমার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। কিন্তু ওই অন্যদের সঙ্গে আমার আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

হ্যাঁ, মির্জাসাব, আমি মনে-মনে জানতাম, এমনকি জোর গলায় বলেওছি, আমার চারপাশের অন্যদের চেয়ে আমি আলাদা। কিন্তু সুলতানাদের চেয়ে আমি কোথাও আলাদা নই। কোনও না কোনওভাবে এই দুনিয়ার বাজারে আমি নিজেকে বেচতেই এসেছিলাম। যারা আমাকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করেছে, তারাও নিজেদের বেচেছে, কিন্তু বেশ্যাবৃত্তিটা আড়াল করে নিজেদের মহত্ত্বের বেলুন উড়িয়েছে। আমি আপাদমস্তক একটা বেশ্যা, আমার ঠিকানা দুনিয়ার সব লালবাতির এলাকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *