৩৫. জীবনটাকে একেবারে শূণ্য করে

করেঁ কেয়া কেহ্ দিলভী তো মজবুর হয়।
জমীন সখত হয়, আসমা দূর হয়।।
(কবর কী, হৃদয়ের কি কোনও স্বাধীনতা আছে?
মাটি কঠিন, আকাশ দূর।।)

একেকজন মানুষ কয়েক দিনের জন্য এসে জীবনটাকে একেবারে শূণ্য করে দিয়ে চলে যায়। বুকের ভেতরে ধূ-ধূ করে কারবালা। আরিফ আমাকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গেল। সেই প্রথম বুঝলুম, অন্য সব প্রবৃত্তির মতো সন্তানস্নেহও মানুষের কত গভীরে লুকিয়ে থাকে। সন্তানস্নেহ যে অনুভব করেনি, তার জীবনে একটা বড় জায়গা অন্ধকারেই থেকে যায়। যে মোমবাতি আমার ঘর আলো করে, আরিফ ছিল তার শিখা, মান্টোভাই।

উমরাও বেগমের বোনের ছেলে আরিফ; ওর আসল নাম জৈন-উল-আবিদিন খাঁ। আরিফ ওর তখঙ্কুশ। ও আর ওর দোস্ত গুলাম হুসেন খাঁ মাহব রোজ আমার কাছে আসত। একের পর। এক প্রশ্ন, গজল নিয়ে। আরিফের কল্পনাশক্তি ছিল অসাধারণ। মনে হত, হ্যাঁ, আরিফই আমার একমাত্র ছেলে হতে পারে। আমি তো মুশায়েরায় যেতে চাইতুম না। ওই বাচ্চা ছেলে দুটো এসে আমাকে জোড় করে নিয়ে যেত। আরিফ মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞেস করত, আপনি মুশায়েরায় যেতে চান না কেন, মির্জাসাব?

-আমি বজম-এর বাইরের লোক আরিফ।

-কেন এমন মনে করেন নিজেকে?

 -আমি তো পথে-পথেই সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছি। মজলিসে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি সবসময় পথের পাশেই বসে থাকতে চেয়েছি। তবু সেখান থেকেও আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

-কেন মির্জাসাব?

-পাগলকে কে না ভয় পায় বলো? গজল লিখতে লিখতে তুমি একদিন বুঝতে পারবে, শব্দের জান্-কে ছুঁতে হলে ভেতর থেকে একেবারে ফকির হয়ে যেতে হবে। কেউ তোমার পাশে থাকবে না আরিফ। প্রিয়জনরা তোমার মুখে থুতু ছিটোবে। আর সেদিন তুমি বুঝতে পারবে গুগু শব্দটার অর্থ। কাকে বলে আশিকের সঙ্গে প্রেমালাপ। কত সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত ওই শব্দের ভেতরে লুকিয়ে আছে।

 -আমি লিখতে পারব, মির্জাসাব?

-খোদা চাইলে পারবে।

আরিফকে একদিন না দেখলে অস্থির হয়ে উঠতুম, মান্টোভাই। তাই একদিন বললুম, তুমি আমার বাড়িতে এসেই থাকো। আরিফ এককথায় রাজি। আকাশের মতো মন ছিল ওর। বিবি আর দুই ছেলেকে নিয়ে আমার বাড়িতে এসেই উঠল। উমরাও বেগমও আনন্দে আত্মহারা। ছেলে, ছেলের বউ, নাতিরা এসেছে। অনেকদিন বড় একা একা কাটিয়েছি, মান্টোভাই। ওরা এসে আমাদের ঘর রংদার বানিয়ে দিল। বাচ্চা দুটোর কিচিরমিচির শুনতে-শুনতে মনে হত, একটা বাগনই যেন আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। পাখিরা গান গাইছে। ফুলের খুশবু পেতে লাগলুম। জীবন যদি এইরকম উৎসব না হয়, তবে আর বাঁচা কেন? আমার রোজগারে তো এত মানুষের ভরণপোষন সম্ভব নয়, তবু কষ্ট করে এতজন একসঙ্গে থাকার আনন্দও তো আলাদা। উমরাও খুব খুশি হয়েছিল বুঝতে পেরেছিলুম, ওর ওই খুশিটুকু আমি কেড়ে নিতে চাইনি। তার চেয়েও বড় কথা, আরিফকে তো আমার নিজের ছেলে বলেই মনে হত। ওর নাম কাগজে লিখতে গেলে আমার আঙুলে ধরা কলম যেন আনন্দে নেচে উঠত।

ওর শরীরের অবস্থা একেবারেই ভাল ছিল না। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ত-জ্বর, কাশি। তারপর একদিন বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতাই রইল না। হাকিম এসে দেখে বললেন, ওর রু আ মানে যক্ষা হয়েছে। মুখ দিয়ে জলের মত রক্ত বেরোতে লাগল। আমরা ভেবেছিলাম ওর দিন শেষ হয়ে এসেছে। এদিকে ওর বিবিও একই অসুখে ভুগছিল। আরিফের আগেই চলে গেল মেয়েটা। আরিফ তারপর আর মাস চারেক বেঁচেছিল। ওর দিকে তাকানো যেত না, মান্টোভাই। যেন একটা কঙ্কাল বিছানায় শুয়ে আছে। উমরাও বেগম তো সবসময় তার বিছানার পাশে আর খোদার কাছে দোয়া মাঙে। একদিন আমার হাত আঁকড়ে শিশুর মতো কাঁদতে লাগল উমরাও, আমি যাকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই, সে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যায় কেন মির্জাসাব? এর তো কোনও উত্তর হয় না। খোদা কী খেলা খেলবেন আমাদের মতো ছায়াপুতুলদের নিয়ে, তা তিনিই জানেন। আরিফ চলে গেল, ওরা রেখে গেল দুটো ছোট্ট বাচ্চাকে। বকিরের বয়স তখন পাঁচ, আর হুসেন দুই।

আমার মহল একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। নিজের কুঠুরিতে একা-একা বসে থাকতুম, কোথাও যেতে ইচ্ছে করত না। তবে দরবারে তো যেতেই হবে। বাদশার চাকর কি না। আরিফের মৃত্যু একদিন ফুটে উঠল গজল হয়ে, মান্টোভাই। আমরা তো মৃত্যুকেই লিখি। এভাবে মৃত্যু রচনা করতে-করতে হয়তো একদিন অমৃতের পথে যাওয়া যায়। আমি অমরত্বের কথা বলছি না, মান্টোভাই; নিজেকে মুছতে-মুছতে, মৃত্যু লিখতে লিখতে এই যে অমৃতের পথের দিকে যাওয়া, তা তো অমরত্বের জন্য নয়; আমার নাম এই দুনিয়ায় থেকে যাবে, হাজার বছর পরেও আমার গজল মানুষ পড়বে, তা আমি কখনও ভাবিনি; শুধু ভেবেছি, যে ধুলো থেকে। আল্লা আমাদের তৈরি করেছেন, আবার যেন সে-ধুলো হয়ে যেতে পারি-সে-ই আমার অমৃতের পথ।

আরিফ, বেটা আমার, তাকে ডেকে আমি বললুম:

লাজিম থা কে দেখো মেরা রাস্তা কোই দিন অওর
তহা গয়ে কিউ অব রহো, তহা কোই দিন অওর

আমাদের পথ, আরিফ বেটা আমার, কোনও একদিন গিয়ে মিলবে; একা চলে গেছে, আরও কিছুদিনের জন্য একাই থাকো।

মিট জায়েগা শর গর তিরা পাথর না ঘিসেগা
হুঁ দর পে তের নাসিয়া-ফর্শ কোই দিন অওর

তোমার কবরে মাথা ঠুকতে ঠুকতে আমার কপাল রক্তাক্ত হবে, আরিফ, তবু আমি সেই দিন-না আসা পর্যন্ত কবরের পাসেই থাকব।

আয়ে হো কাল অওর হি কহতে কি যাউঁ
মানা কে হামেশা নহীঁ আচ্ছা কোই দিন অওর

গতকাল তো এলে, আর আজই চলে যাওয়ার কথা বলছ? চিরদিন থাকবে না জানি, অন্তত কয়েকটা দিন তো থাকো।

যাতে হুয়ে কহতে হো কয়ামৎ কো মিলেঙ্গে
কেয়া খুব কেয়ামৎ কা হ্যায় গয়া কোই দিন অওর

যাওয়ার সময় বলে গেলে, কেয়ামতের দিন দেখা হবে। তোমার চলে যাওয়াই তো আমার জীবনে কেয়ামতের দিন, আরিফ।

হাঁ আয়ে ফলক -এ -পীর জবান থা অভি আরিফ
কেয়া তেরা বিগড়তা জো না মরতা কোই দিন অওর

ওগো প্রাচীন আশমান, আরফ তো যুবকই ছিল। আরও কিছুদিন ও বেঁচে থাকলে কী এমন ক্ষতি হত তোমার?

তুম মাহ্ -এ-শব্‌-এ-চার- দুহম্ থে মেরে ঘর কে
ফির কিউ না রহা ঘর কা ওহ্ নকশা কোই দিন অওর

তুমি আমার মহলের পূর্ণচাঁদ ছিলে আরিফ। আরও কিছুদিন কি অমন নকশা থেকে যেতে পারতে না?

নাদান হো জো কহতে হো কি কিউ জিতে হয় গালিব
কিসমত মে হয় মরনে কি তমান্না কোই দিন অওর

বোকারা শুধোয়, গালিব এখনও বেঁচে আছে কেন? আমার ভাগ্য এমনই যে আরও কিছুদিন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে যেতে হবে।

হ্যাঁ, মান্টোভাই, আমাকে তো সব দেখে যেতেই হবে, সব ক্ষতচিহ্ন শরীরে বহন করতে হবে; খোদা তো আমাকে ফকিরির পথে যেতে দেননি; আমার সব প্রার্থনা না-জায়েজ হয়ে গেছে। শুধু মাঝে মাঝে আমার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে পূর্ণতায় ভরে গেছে মন। সেইটুকু আমার খোদাকে পাওয়া। আরিফের জন্য ওই গজলটা লেখার অনেকদিন পর আমি বুঝতে পেরেছিলুম উর্দু গজলে এমনটা আর কখনও হয় নি। কেন জানেন? আমার সময়ে কবি আনিস, দবীর-রা দীর্ঘ মার্সিয়া লিখে গেছেন। সেসব শোকগাথার বিষয় ছিল কারবালা-হুসেন ও তাঁর পরিবারের শহাদৎ। কারবালা ছাড়া মার্সিয়া লেখার কথা কেউ ভাবতেই পারত না। সেই প্রথম, আরিফের জন্য লেখা উর্দু গজলে মার্সিয়ার সুর ফুটে উঠল। এ-সব তো আমি ভেবে করিনি। কীভাবে যে হয়ে গেছে। শুধু কারবালা? প্রিয়জনের জন্য আমরা শোকগাথা লিখব না?

আরিফের জন্য শোকে ডুবে থাকার সময় তো আমাদের ছিল না। বকির আর হুসেনকে ওরা। এতিম করে দিয়ে চলে গেছে। যে জীবন দুটো রয়ে গেল, এবার তাদেরই তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বকিরকে নিয়ে গেলেন আরিফের মা। হুসেনকে আমরা দত্তক নিলুম। ওইটুকুন ছেলে, সারাক্ষণ আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে; আমি বুঝতে পারতুম, মা-বাবার কথাই ও জানতে চায়। বাপ-মা হারা ছেলে মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ত। উমরাও সারা রাত ওর মাথার কাছে জেগে বসে থাকত। বুঝতে পারি, ওর সবসময় ভয়, হুসেনও যদি আমাদের ছেড়ে চলে যায়। বছর খানেকের মধ্যে আরিফের মা-ও মারা গেলেন। বকিরকে নিয়ে এলুম আমাদের কাছে। ওকে কোথায় ফেলে দেব বলুন? তবে দুটো বাচ্চার খেলাধুলো, কথাবার্তায় আমার মহলে প্রাণ ফিরে এল।

এর মধ্যে মিঞা কালে সাবের হাভেলি থেকে বল্লিমারোঁ মহল্লায় একটা বাড়িতে উঠে এসেছি। ১৮৫৪-তে এসে একটু পয়সাকড়ির মুখও দেখতে পেলুম। বছরে আমার রোজগার বাইশশো পঞ্চাশ টাকা। পেনশন পেতুম সাড়ে সাতশ টাকা, বাদশা দিতেন দুশো টাকা, বাদশার উত্তরাধিকারী মির্জা ফকরউদ্দিন আমাকে তাঁর উস্তাদ মেনেছিলেন, সে জন্য চারশো টাকা। আর অওধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের জন্য কসীদা লিখে পাঠিয়েছিলুম বলে তিনি আমাকে বছরে পাঁচশো টাকা মঞ্জুর করলেন। ওই বছরেরই শেষে বাদশার উস্তাদ কবি জওকের মৃত্যু হল। কবি মোমিন খাঁও তখন আর বেঁচে নেই। মোমিন খাঁ-র একটা শের শুনুন, ভাইজানেরা :

তুম মেরে পাস হোতে হো গয়া
যব কোই দুসরাঁ নহীঁ হোতা।
(মনে হয় যেন আমার পাশে থাকো তুমি
যখন আর কেউ থাকে না।)

কেয়াবাৎ! এই শেরটা শুনে মোমিন খাঁকে বলেছিলুম, মিঞা, এই শেরটা আমাকে দিয়ে দিন, বদলে আমার পুরো দিবান নিয়ে নিন।

জওক মারা গেলেন, মোমিন খাঁ নেই, জাঁহাপনাকে অগত্যা এই ব্যাঙকেই গিলতে হল। বাদশা আমাকে শায়র-উল-মুলক পদে বরণ করলেন। আমি জানতুম জওক সাবের মতো মালিক-উশ শুয়ারা উপাধি আমার জুটবে না। তা নিয়ে আমার তেমন মাথা ব্যাথাও ছিল না। কিন্তু বাদশা টাকার অঙ্কও বাড়ালেন না। এদিকে বাদশার উস্তাদ হয়ে তাঁর গজলও আমাকে সংশোধন করে দিতে হবে। এই কাজটা আমার কোন দিনই ভাল লাগত না। কবিতার কোন সংশোধন হয়? যা লেখা হল, তা কবিতা, নয়তো কবিতা নয়। সংশোধন করে তো গাধাকে ঘোড়া বানানো যায়। না। তবু চাকরি বলে কথা। একদিন দেওয়ান-ই-আমে নাজির হুসেন মির্জার সাথে বসে গল্প করছি। নাজিরসাব হলেন বাদশার দেওয়ান। একজন রক্ষী এসে বলল, বাদশা তাঁর। গজলগুলো দেখতে চাইছেন। আমি কাল্লুকে বললুম, যা পালকি থেকে কাপড়ের পোঁটলাটা নিয়ে আয়। তো পোঁটলা এল, আমি সেটা খুলে আট-নটা কাগজ বার করলুম, বাদশার অর্ধেক লেখা সব শের। প্রত্যেকটার বাকি অর্ধেক আমি লিখে রক্ষীর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলুম।

নাজিরসাব বললেন, এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?

-এ আর এমন কী কাজ! জাঁহাপনা খুশ হয়ে যাবেন। কবিতার সংশোধন, বইয়ের ভূমিকা লিখে দেওয়া, এসব কাজ যে কত ঘেন্নার সঙ্গে করতে হয়েছে, মান্টোভাই। ও কি কোনও কবির কাজ? যাদের সব পণ্ড হয়ে গেছে, তারা এইসব করুক গিয়ে। হরগোপাল তক্তা ছিল আমার এক শার্গিদ, দোস্তও বটে। সেকান্দ্রাবাদে থাকত। ওর কতো যে ফারসি কবিতা আমাকে সংশোধন করে দিতে হয়েছে। ওর দিবানের ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলুম। পড়ে তক্তা খুব রেগে গিয়েছিল; ওর মনে হয়েছিল, আমি নাকি প্রশংসার আড়ালে ওর কবিতা নিয়ে ব্যাঙ্গ করেছি। আমি আর কী বলব, বলুন? চিঠিতে লিখেছিলুম,  তুমি আমার শত্রু নও, প্রতিদ্বন্দ্বীও নও। আমার বন্ধু এবং নিজেকে আমার শার্গিদ মনে করো। প্রশংসার আড়ালে আমি তোমাকে নিয়ে মজা করব? এত দূর হীন মনে করো আমাকে? কিছুদিন বাদে আবার একটা দিবান প্রকাশ করার জন্য উঠে পড়ে লাগল তাস্তা। অনুরোধ এল আমাকে ভূমিকা লিখে দিতে। এবার সত্যিই বিরক্ত হলুম। সোজাসুজি ওকে লিখলুম, তুমি খুব সহজে দিবান লিখতে পারো ঠিকই, কিন্তু আমি ত সহজে ভূমিকা লিখতে পারি না। কবিতাকে ভালবাসলে শুধু লিখে যাও, ছাপানোর জন্য অত তাড়াহুড়ো করো না। ধৈর্য ধরো। না হলে দ্বিতীয় দিন ছাপা হলেই তুমি তৃতীয়টার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেবে। এত ভূমিকা তো আমার পক্ষে লেখা সম্ভব হবে না। আমি এই বয়েসে আমার পথ থেকে সরে আসতে পারব না । প্রতি বছর তুমি দিবান লিখলে আমাকে ভূমিকা লিখে দিতে হবে? এইসব ফালতু লেখা আমি আর লিখব না। তারপর তক্তা আমাকে অনেকদিন চিঠি লেখে নি। এরা কী মনে করে, মান্টোভাই? কবিতার মতো গদ্য লেখাও খুবই কঠিন কাজ। আমার ওই বয়েসে কারও সঙ্গে সমঝোতা করার কথা আমি ভাবতেও পারতুম না। আবুল ফজলের আইন-ই আকবরি সম্পাদনা করার সময় সৈয়দ আহমদ খান আমাকে একটা ভূমিকা লিখতে বলেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার খুবই দোস্তি ছিল। অতবড় দার্শনিক, নেতা। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, এই নতুন সময়ে আইন-ই আকবরি-র কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। তার ওপর আবুল ফজলের গদ্যশৈলী আমার একেবারেই না -পসন্দ ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ইতিহাস সম্পর্কে আমার কোন আগ্রহই ছিল না। তো, আমি ভূমিকা হিসাবে একটা কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলুম। তাতে আইন-ই-আকবরি নতুন সময়ে কতটা অসাড়, সে কথাই লিখেছিলুম। সৈয়দ সাবের পছন্দ হয় নি। কবিতাটি তিনি ছাপেনওনি। এজন্য আমি কী করতে পারি বলুন? বন্ধু বলেই তার সব কাজের প্রশংসা করতে হবে, এমনটা তো আমার ধাতে ছিল না। তাই ধীরে ধীরে একা হয়ে যাচ্ছিলুম আর তা মেনেও নিয়েছিলুম। নতুন কিছু আর কী-ই বা ঘটতে পারে জীবনে?

কাল্লু কোথা থেকে এক দস্তানগোকে ধরে নিয়ে এল। ও তো শিকারি বাঘের মতো কিস্সা বলিয়েদের খোঁজে থাকত। আমি আর কাল্লু তার কাছে কিস্সা শুনতে বসলুম। মওলা রুমির মসনবি থেকে, আহা কী স্বর্গীয় কিস্সাই যে সে শোনাল আমাদের। মন দিয়ে শুনুন ভাইজানেরা।

দ্বিতীয় খলিফা ওমরের সময়ের কথা বলছি। মদিনায় তখন তসলিম নামে একজন গায়ক। থাকতেন। শুধু গানই নয়, রবাব বাজানোতেও তিনি ছিলেন উস্তাদ। লোকে বলত, তার গান শুনে নাকি বুলবুলও নাকি লজ্জা পেতে, মৃতরাও কবরে উঠে বসত। উঁচু-নীচু, সবরকমের মানুষের সঙ্গেই ভাব -ভালবাসা ছিল তাঁর। তসলিম যেখানেই যেতেন, কত যে মানুষ তার পিছনে পিছনে যেত; যেন তসলিম ছাড়া তাদের জীবনে আর কেউ নেই।

তসলিমের বয়স বাড়তে লাগল, কণ্ঠস্বর আর আগের মতো রইল না, আঙুলও সুরঝঙ্কার তোলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে লাগল। একসময় তার গলা শুনে মদিনার লোকজনদের মনে হতে লাগল, যেন গাধা ডাকছে। তসলিম যখন সত্তর বছরে পৌঁছলেন, তখন তাঁর গান ও রবাবের শ্রোতা কেউ রইল না। তসলিম ভেবেছিলেন, তাঁর জনপ্রিয়তা আজীবন একই রকম থেকে যাবে। তাই উপার্জনের সব টাকা উড়িয়ে দিয়েছেলেন ভোগ বিলাসে। বৃদ্ধ বয়েসে তিনি ঋণগ্রস্থ। বাড়িওয়ালা তাঁকে ঘর থেকে বের করে দিল। একটা রুটি কিনে খাবার মত পয়সাও তার ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, ছেড়া তারের রবাব নিয়ে তিনি পথে-পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। একা একা নিজের সঙ্গেই কথা বলেন। আল্লা, পরম করুণাময়, আমার এই এত যন্ত্রণা পাওয়ার কথা ছিল? এক সময় সবাই তো তাঁকে খোদারই সুর সাধক মনে করত। আর খোদা তাকেই ভুলে গেলেন? এ দুনিয়ায় তা হলে কি কোনও বিচার নেই?

রাস্তায় তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাত না। দুএকজনের সালাম আলেকুম বলে পাশ কাটিয়ে যেত। মদিনার মানুষ তখন নতুন শিল্পীর কাছে ছুটেছে। তসলিমকে দেখে মনে হত, যেন একটা খণ্ডহর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এভাবেই তিনি একদিন মদিনার বাইরে কবরস্থানে। এসে পৌঁছলেন। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত তসলিম একটা কবরের উপর গিয়ে বসলেন। এই জীবনের অর্থ কী? যে সম্মান তিনি পেয়েছেন, সবই আসলে মিথ্যে? যৌবনের খ্যাতি এখন তিক্ত স্মৃতি। আর তো তিনি গাইতে পারবেন না, রবাব বাজাতে পারবেন না। এই-ই তো তাঁর জীবনের দোজখ। তসলিমের মনে হল,নিজের প্রতিভার জন্য গর্বই কি তাঁর পাপ? খ্যাতির মোহের জন্যই কি আজকের এই শাস্তি? চারপাশের কবর তাঁকে একটা কথাই বলছিল : একমাত্র মৃত্যুই সত্য। তসলিম ভাবলেন, মৃত্যুর আগে খোদার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করবেন। কখনও তো সেভাবে আল্লার কথা ভাবেননি তিনি। কবরের ওপরেই শুয়ে পড়লেন তিনি। অনুভব করলেন, তার নীচে পড়ে আছে একজন মানুষ বা মানুষীর ঠাণ্ডা হাড়-হাড়ের কাঠামোটুকু শুধু। তাঁর চোখের অশ্রুর সঙ্গে মিশে গেল নীরব কথাগুলি। আল্লা, তুমি আমার গান কেড়ে নিয়েছ। গানই ছিল আমার শ্বাস-প্রশ্বাস, আমার রুটি। গান ছাড়া আমি কী করে বাচব? এই অধমকে তুমি অনেক দিয়েছ, আবার একসময় কেড়েও নিয়েছ। আমার তো নালিশ কিছু নেই। যা দিয়েছ, আর নিয়েছ, সবই তোমার। শুধু যেন এই যন্ত্রণাকে বহন করতে পারি। নাঙ্গা হয়ে আমি তোমার দরজায় এসে আজ দাঁড়িয়েছি। খোদা, আমাকে গ্রহণ করো। যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকি, আমি শুধু তোমার জন্যই রবাব বাজাব, তোমার জন্যই গান গাইব। অন্তত কয়েকটা পয়সা জুটিয়ে দাও, যাতে রবাবের তার কিনতে পারি। যে তোমাকে ভুলে থাকে, তাকেও তো তুমি ক্ষমা করো। আমাকেও ক্ষমা করো খোদা।

বলতে-বলতে তসলিমের প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেল সেই অনন্ত বাগানে যেখানে সবসময় বসন্ত। তাঁর আত্মা যেন মধুর সাগরে ডুবে গেল। পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার কোনও বাসনাই আর রইল না। সে জগতে তো খ্যাতি-সমৃদ্ধি-উচ্চাশা কিছুই নেই। তসলিমের আত্মা ভাবল, এর চেয়ে সুখের জায়গা আর কোথায়? তখনই সে সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, ভাইজানেরা, সেই আদি শব্দ,যার পাশে সব শব্দই প্রতিধ্বনি মাত্র। কণ্ঠস্বর বলল, এখানে আটকে থেকো না। এ শুধু তোমার জন্য অন্য এক অভিজ্ঞতা। এবার বেরিয়ে পড়ো।

-কোথায়? ওই দুনিয়ায় আবার ফিরে যেতে হবে? দয়া করো, কিছুতেই আমি ওখনে ফিরব না।

ঠিক সেইসময়, এই দুনিয়াতে, দরবারে বসে থাকতে থাকতে খলিফা ওমরের ঝিমুনি এসেছিল। দেখতে-দেখতে খলিফা ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে খলিফা ওমর সেই আদি কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন, মদিনার কবরখানায় আমার প্রিয় একজন মানুষ শুয়ে আছে। কোষাগার থেকে সাতশো দিনার নিয়ে তাঁকে দিয়ে এসো। আর বোলো, রবাবের জন্য সে যেন তার কিনে নেয়।

ঘুম ভেঙে উঠেই খলিফা ওমর সাতশো দিনার নিয়ে কবরখানার দিকে দৌড়লেন। এক কবর থেকে আরেক কবরে ঘুরতে ঘুরতে তিনি দেখলেন থুথুরে একজন বুড়ো মানুষ একটা কবরের ওপর শুয়ে আছেন। খলিফা আরও খুঁজতে লাগলেন। শেষে তার মনে হল, আমি বুড়োর বাইরের চেহারাটাই শুধু দেখেছি। খোদার প্রিয় মানুষ হয়তো এই লোকটিই। ওমর বুড়োর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ খেয়াল করে দেখার পর তসলিমকে চিনতে পারলেন।

তসলিমের আত্মা তখনও অন্য দুনিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন সময় একটা হাঁচির শব্দ। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে হেঁচেছিলেন খলিফা ওমর। কিন্তু তসলিমের আত্মার মনে হল, এই হাঁচিরও নিশ্চয়ই কোন অর্থ আছে। খোদার দুনিয়ায় সবই নিয়মে বাঁধা। তসলিমের আত্মা তার শরীরের ভিতরে এসে ঢুকে পড়ল। তসলিম সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলেন। খলিফাঁকে দেখে তার পা জড়িয়ে ধরলেন। হুজুর ধার বাকির জন্য আমাকে কয়েদখানায় পুরবেন না। এবারের মতো আমাকে ছেড়ে দিন।

-ভয়ের কিছু নেই মিঞা। এই সাতশো দিনার রাখুন। নিজের ইচ্ছে মতন খরচা করবেন। তবে রবাবের জন্য অবশ্যই তার কিনে নেবেন।

তসলিম হাত বাড়িয়ে দিনারগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন। তারপর ওমরের হাতে সেগুলো তুলে দিয়ে লজ্জায়, নিজের প্রতি ঘৃণায় কবরে আঘাত করে রবাব ভেঙে ফেললেন, ছিড়তে শুরু করলেন নিজের পোশাক।

-এ কী করছেন আপনি? আপনি খোদার প্রিয় মানুষ। খোদাই তো আমাকে পাঠিয়েছেন।

-আমি এর যোগ্য নই খলিফা সাব। এই রবাবের জন্যই আমি তাঁর থেকে দূরে সরে গেছি। আমার কণ্ঠস্বরের জন্যই তাঁর সৌন্দর্যকে দেখতে পাইনি। আমার উচ্চাশা তার কাছে আমাকে। পৌঁছতে দেয়নি। বিখ্যাত হওয়ার জন্য যখন আমি ব্যস্ত ছিলাম, তখন তার কাফেলা আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। এই পাপ, এই অহং কিছুতেই মোছবার নয় খলিফা সাব।

-এত যে কথা বলছেন, তাও আপনার অহং-এরই পরিচয়, মিঞা। অনুতাপে পাপ আরও বাড়বে।

-কিন্তু ওই রবাব আমাকে তার কাছে পৌঁছতে দেয়নি।

-রবাব তো তিনিই আপনার হাতে তুলে দিয়েছেন। না হলে কী পেতেন? রবাবের তার কেনার। জন্য তিনিই তো আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনার কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়েই আল্লাই তো গান করেন।

তসলিম খলিফার কাছে দিনার নিয়ে তাঁকে সালাম জানালেন। তারপর বাজারের পথে রওনা দিলেন নতুন রবাব কেনার জন্য। এরপর থেকে তসলিমকে আর কেউ দেখতে পায়নি। নতুন রবাব বাজাতে বাজাতে তিনি সেই নীরবতার দিকে চলে গেলেন, কোনও কিস্সার শব্দ যাকে ছুঁতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *