৩৪. কবরে আজ আমাদের খুশির দিন

খুলতা কিসী-পে কিঁউ মেরে দিল-কা মুআমিল;
শেরোঁ-কে ইন্তখাব-নে রুস্বা কিয়া মুঝে।।
(কেই-বা জানতো আমার হৃদয়ের ব্যাপার;
কোন্ কুক্ষণেই যে কবি হতে গেলাম, মান-মর্যাদা সবই গেলো।)

ভাইজানেরা, কবরে আজ আমাদের খুশির দিন। আমি জানি, মির্জাসাবের কথা শুনতে শুনতে আপনাদের মন ভারী হয়ে উঠেছে; কিন্তু মনে রাখবেন, মির্জাসাবের জীবন তো একটা পাথরকে বার বার পাহাড়ের চূড়ায় ঠেলে তোলার চেষ্টা, বার বার পাথরটা নেমে এসেছে আর মির্জাসাব তাঁকে আবার ওপরে তোলার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। জীবন কি সবসময় এভাবে পাথর বইবে? তার চেয়ে নরক গুলজার হোক। আমরা আজ গাঞ্জে ফেরেস্তে-দের কিস্সা শুনব। এরা বেশির ভাগই বম্বের সিনেমা জগতের লোকজন। পর্দার ছবিতে তাদের যেমন দেখাত, আসলে জীবন তো তেমন ছিল না। জীবন তো সিনেমার মতো সাজানো-গোছানো নয়। রোটি, আওরত আর তন্তের জন্য লড়াইয়ের নামই জীবন। দুনিয়ার সব কিস্সাও লেখা হয়েছে এই লড়াই নিয়েই। খিদে সবচেয়ে আদিম, তাই না ভাইজানেরা? খিদের কথা কেউ কখনো ভুলতে পারে না। মানুষ যবে থেকে এই দুনিয়ায় এসেছে, সেদিন থেকেই ক্ষমতার জন্য তার লোভ, নারীর জন্য তার রিরংসা। এগুলো কোনদিনই বদলায় না, ভাইজানরা। শুধু রুটি, নারী ও সিংহাসনের ওপর যখন ঘৃণা জন্মায় তখনই মানুষ আল্লার কথা ভাবে। এই তিনের চেয়ে তিনি তো আরও রহস্যময়, যাঁকে লড়াই করেও পাওয়া যায় না।

মাফ করবেন, বেশি বকবক করে ফেললাম। আপনাদের কথা দিয়েছিলাম, সিতারার কিস্সা একদিন শোনাব; গাঞ্জে ফেরেস্তেদের কথা ওকে দিয়েই শুরু করছি। ভাইজানেরা, সিতারা এক বাঘিনীর নাম, যেন একটা ঘূর্ণিঝড় ওর ভিতরে লুকিয়ে ছিল, বাইরে থেকে তাকে বোঝা যায় না। রোজ সকালে এক ঘন্টা সিতারা নাচের রেওয়াজ করত অথচ তারপর ওকে ক্লান্ত দেখিনি। সিতারা চুপচাপ বসে থাকতে পারত না, কিছু না কিছু করছেই বা করার ফন্দি আঁটছে।

সিতারার আরও দুই বোন ছিল-তারা ও অলকনন্দা। ওরা একে একে নেপালের এক গ্রাম। থেকে বম্বেতে এসেছিল নসিব বদলানোর জন্য। তবে তিন বোনের মধ্যে সিতারার কোনও তুলনা নেই। লাখে একজন এইরকম মেয়ে জন্মায়। আমার মাঝে মাঝে মনে হত, সিতারা আসলে অনেকগুলো মেয়ের নাম, নইলে অত পুরুষকে নিয়ে সে খেলত কী করে? সিতারা যেন। বম্বের পাঁচতলা কোন বাড়ি, সেখানে কত যে ফ্ল্যাট, আলোকিত, কোনওটা বা অন্ধকার। সবসময় পাতলা, ফিনফিনে মসলিন শাড়ি পরত। ফলে ওর শরীর নিয়ে কল্পনা করার কিছু ছিল না।

সিতারা বম্বেতে এসেছিল সিনেমার এক পরিচালকের হাত ধরে, তার নাম ভুলে গেছি, আমরা দেশাই বলেই ডাকতাম। ওদের বিয়েও হয়েছিল। কিন্তু বেশিদিন একসঙ্গে থাকতে পারেনি। দেশাই বলত, ওই মেয়ের সঙ্গে যুঝে ওঠা আমার কম্মো নয়। সিতারা তখন অন্য কার সঙ্গে যেন থাকে, কিন্তু মাঝেমধ্যেই দেশাইয়ের কাছে আসত। তবে দেশাই তাকে বেশীদিন নিজের কাছে রাখত না। হিন্দু আইন মেনে দুজনের বিয়ে হয়েছিল তো, তাই নতুন নতুন প্রেমিক জোটালেও সিতারার পরিচয় ছিল মিসেস দেশাই।

মেহবুব সাবের কপাল তখন তুঙ্গে। সিতারাকে একটা সিনেমায় নিয়েছিলেন। মেহবুব সাবও সিতারার শিকার হয়ে গেলেন। আমাদের লাইনে তখন তাদের নিয়ে রোজই নতুন নতুন কিস্সা। মেহবুব সাবের ছবিও শেষ, সিতারাও নতুন প্রেমিক পাকড়ে ফেলল। তার নাম পি এন অরোরা। ইংল্যান্ড থেকে সিনেমার ট্রেনিং নিয়ে এসেছিল। তারপর সিতারা ঝাঁপ দিল আল নাসিরের ওপর। এর মধ্যে পি এন অরোরার একটা গল্প বলে নিই, ভাইজানেরা। আমি তখন দিল্লিতে চাকরি করি। হঠাৎ একদিন রাস্তায় অরোরাকে দেখতে পেলাম। লাঠি হাতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। মনে হল, লোকটার সামান্য জীবনীশক্তিও অবশিষ্ট নেই। টাঙ্গা থামিয়ে আমি অরোরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

-আরে মান্টো, কেমন আছ?

-আমি তো ভালই। আপনার এই হাল কেন? কী হয়েছে?

অরোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদু হাসল। -সিতারা, মান্টো, সিতারা। সব সিতারার জন্য।

আল-নাসির এসেছিলেন দেরাদুন থেকে নায়ক হবে বলে। দেখতে-শুনতে ভাল, পুরুষালি চেহারা। সুযোগও পেয়ে গেল একটা ছবিতে আরা সেই সিনেমাটায় সিতারাও অভিনয় করছিল। আল-নাসির এক্কেবারে বাঘিনীর মুখে গিয়ে পড়ল। এমন ভাববেন না ভাইজানেরা যে, সিতারা এক প্রেমিক ছেড়ে আর এক প্রেমিক ধরত। সবাইকে ও একসঙ্গে ধরে রাখত; দেশাই, অরোরা, মেহবুব, আল-নাসির, আরও কত যে ছিল, হিসেব নেই। বম্বেতে ফিরে এসে আল নাসিরের অবস্থাও আমি দেখেছিলাম। তার রং ছিল একেবারে গোলাপি, তা ছাইয়ের মতো পোড়া-পোড়া হয়ে গেছে। অমন সুন্দর চেহারাও ভাঙাচোরা, যেন ওর শরীরের সব রক্ত কেউ শুষে নিয়েছে। আল-নাসিরও একই কথা বলেছিল, সিতারা, মান্টোসিতারা, সব সিতারার জন্য

-কেন, ও কী করেছে?

-ও একটা ভ্যাম্পায়ার মান্টো। আমাকে ছিবড়ে করে দিয়েছে। ওর কাছ থেকে বেরোতে না পারলে আমি শেষ হয়ে যাব।

আল-নাসির তারপর দেরাদুন পালাল। তিনমাস সেখানে এক স্যানিটোরিয়ামে থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরেছিল।

এরপর সিতারা এক আশ্চর্য কাণ্ড করেছিল। আরে লাখে এইরকম একটা মেয়ে হয়, বলছি না ভাইজানেরা। যেন একটা অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গেরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সিতারা এবার ফাঁসাল নাজির সাবকে। নাজির সাবের প্রেমিকা জেসমিন তখন তাঁকে ছেড়ে গেছে। সোসাইটি সিনেমায় নাজির সাব সিতারাকে নিয়েছিলেন। আর অমনি সিতারার জালে আটকে গেলেন। খুব সোজা সাপ্টা, দিলখোলা মানুষ নাজির সাব। যাকে পছন্দ করতেন,তাকে খিস্তি দিতে দিতে বুকে টেনে নিতেন। সিতারার সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ কয়েক বছর টিকেছিল। নাজির সাবের ব্যক্তিত্ব ছিল প্রখর, তাই সিতারা প্রথম দিকে কিছুদিন অন্য পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। কিন্তু ওভাবে থাকা তো সিতারার মতো মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়, ভাইজানেরা। অরোরা, আল নাসির,মেহবুব, দেশাইয়ের কাছেও আবার যাওয়া আসা শুরু হল। নাজির সাহেব মতো। মানুষের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব হল না। নাজির সাব মাঝেমধ্যেই সিতারাকে পেটাতেন। সিতারা যেন সেই মারের মধ্যেও এক ধরনের যৌন আনন্দ উপভোগ করত।

এবার কিস্সটা আরেকরকম ভাবে জমে উঠতে চলেছে, ভাইজানেরা। নাজির সাবের ভাইপো আসিফও একই ফ্ল্যাটে থাকত। বয়স কম হলে কী হবে, বেশ শক্তপোক্ত চেহারা, দেখতেও। সুন্দর। তখনও পর্যন্ত আসিফের জীবনে কোনও মেয়ে আসেনি। কাকার কাছ থেকে সিনেমার কাজকর্ম শেখাতেই ওর আগ্রহ। নাজির সাব আর সিতারার মধ্যে কী কাণ্ড চলছে, সে বুঝতে পারত। বন্ধ ঘর থেকে ভেসে আসা সিতারার শীৎকার ও উন্মাদনা তাকে দিনে দিনে খেপিয়ে তুলছিল। একদিন সে কী করে যেন সবটা দেখেও ফেলল। আসিফ আমাকে বলেছিল, মান্টোসাব, যেন দুটো কুকুর-কুকুরী নিজেদের ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। সিতারার সঙ্গে কাকা পারবে কেন?

-সে এক ভয়ঙ্কর খেলা, তাই না আসিফ?

-জন্তু। মানুষ যে আসলে জন্তু, এই প্রথম বুঝতে পারলাম। আর মহব্বত কী জানেন, মান্টোসাব?

-কী

-মওতের সঙ্গে মোকাবিলা। আমিও শালা একবার এইরকম মোকাবিলা করতে চাই।

-সিতারার সঙ্গে?

-আলবৎ। একবার পাঞ্জা লড়বই মান্টোসাব। তবে কী জানেন, মেয়েছেলেটাকে দেখলেই কেমন ভয় করে।

-কেন? সিতারাকে ভয়ের কী আছে?

-মনে হয়, ওর ভেতরে জিন ঢুকে বসে আছে।

-আসিফ, বরফের মতো ঠাণ্ডা মেয়েদের থেকে সিতারা অনেক ভাল। ওর উন্মাদনার মধ্যে

জীবন আছে। লড়ে যাও। আসিফ সিতারার সঙ্গে প্রথম কথাবার্তা শুরু করল। কিন্তু ছুঁয়ে দেখার সাহস পাচ্ছিল না। কেননা কাকার মেজাজ সে জানে। অথচ কে না জানে, আসিফ একবার ইঙ্গিত করলেই সিতারা। ঝাঁপিয়ে পড়বে। আসিফ দিনে দিনে অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। চনমনে যুবক, কতদিন নিজেকে ধরে রাখবে? নাজির সাব আস্তে আস্তে খেলাটা টের পাচ্ছিলেন। একদিন সিতারাকে বহুৎ পেটালেন, তারপর ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যেতে বললেন। সিতারা তবু গেল না। সেই রাতে রাগে গরগর করতে করতে নাজির সাব তাঁর অফিস ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আসিফ দেখল এই সুযোগ। সে সিতারার ঘরে গিয়ে তার ব্যাথার জায়গায় হাত বোলাতে শুরু করল। ব্যস, কেল্লা ফতে। মৃত্যুর সঙ্গে আসিফের মোকাবিলা হয়ে গেল। তারপর জিনিসপত্র গুছিয়ে সে সিতারাকে পৌঁছে দিল দাদারের ফ্ল্যাটে। ওখানে সিতারার নিজের একটা ফ্ল্যাট ছিল। আসিফের সঙ্গে শুরু হল সিতারার নতুন প্রণয়পর্ব। সেদিনই আসিফ সিতারাকে বলেছিল, আমাদের সম্পর্কটা অনেক গভীর সিতারা। তুমি আর কারও কাছে যেও না। শুধু আমার কাছেই থেকো।

-মেরি জান, আমি এতদিন ধরে তোমাকেই খুঁজেছি। বিশ্বাস করো, সিতারা আজ থেকে আর কারুর দিকে তাকাবে না।

-না হলে আমি পাগল হয়ে যাব।

-কথা দিলাম।

সিতারা আসিফকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তুলল।

পরদিন আসবে বলে আসিফ ফিরে গেল। সিতারা তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল। নতুন করে সাজল। শাড়ি বদলাল। রাস্তায় এসে ট্যাক্সি ধরে ড্রাইভারকে অরোরার ঠিকানায় নিয়ে যেতে বলল। আচ্ছা মির্জাসাব, আপনার কী মনে হয়, এই মেয়েটা সারাজীবন শুধু যৌনখিদের পিছনে দৌড়েছে? আমি এক গভীর অসহয়তা দেখতে পাই। একই অসহায়তা দেখতে পেয়েছিলাম সৌগন্ধীর মধ্যে। মধু তাঁকে শুষে খাচ্ছিল। তারপর একদিন মধুকে তাড়িয়ে দিয়ে সৌগন্ধী তার পোষা রাস্তার কুকুরটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। সিতারা আমাকে একেবারে সহ্য করতে পারত না। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম ও যেন একদিন সৌগন্ধীর মতো ঘুমিয়ে পড়তে পারে।

এরা সব আশ্চর্য মেয়ে, ভাইজানেরা। পরিরানি নাসিম বানুর কথা কি আমি কোনদিন ভুলতে পারব? কী চোখ তার। যেন সরোবরে ফুটে ওঠা দুটো পদ্ম। বেগম সিনেমার গল্প লেখার সময় আমি নাসিমকে কাছ থেকে দেখেছিলাম। নাসিমের বাড়িতে বসে আমি আর এস মুখার্জি গল্পটা নিয়ে আলোচনা করতাম, গল্পের অদলবদল করতাম। আমরা ভেবেছিলাম নাসিম না জানি কত বড় বাড়িতে থাকে। ওর পোরবন্দর রোডের বাড়িটা একেবারেই সেকেলে ধরনের, দেওয়ালে পলেস্তারা খসা, জানলার খড়খড়ি টুটফুটা। ঘরে সাধারণ কিছু আসবাবপত্র, সবই ভাড়া করা। একদিন দেখি সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গোয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করছে। গোয়ালা নাকি আধ সের দুধের হেরফের করেছে। আমি তো অবাক। যে নাসিমের জন্য লোকজন দুধের নহর বইয়ে দিতে পারে, সে আধ সের দুধের জন্য গোয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করে? পুকার-এর নূরজাহান আসলে এইরকম? কেনই বা হবে না? আমাদের সবার ভিতরেই তো খড়ের একটা কাঠামো আছে। একেক সময় তা বেরিয়ে পড়ে।

সিনেমার লোকেরা এই খড়ের কাঠামোটা সবসময় ঢেকে রাখতে চায়, ভাইজানেরা। নাসিম বেশির ভাগ সময় গোলাপি রঙের পোশাক পরত। গোলাপি তো বড় মারাত্মক রং, চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। নাসিম যেন সেটাই চাইত। তবে ধাঁধা লাগানোর মতো ব্যাপারও ওর মধ্যে ছিল। গোলাপের পাপড়ির মতো অমন ত্বক আর কারও দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।

গয়না, আতর, সেন্টের প্রতি নাসিমের তীব্র আকর্ষেণের পাশাপাশি দেখেছি অন্য এক অনুরাগ, তার বাবার প্রতি। ওর ভ্যানিটি ব্যাগে সবসময় বাবার ছবি থাকত। আমি একবার লুকিয়ে ছবিটা দেখেছিলাম। আমার একটা বদভ্যাস ছিল, মির্জাসাব। চুরি করে মেয়েদের ব্যাগ দেখা। এভাবেই একদিন ওর ব্যাগ দেখছিলাম আর তখনই নাসিম এসে হাজির।

-এ কী করছেন, মান্টোসাব?

-মাফ কিজিয়ে, এটা আমার খুব বাজে অভ্যাস। তবু নিজেকে ধরে রাখতে পারি না।

নাসিম হেসে ফেলল।-মেয়েদের দিল লুকিয়ে দেখার অভ্যাস নেই, এটাই বাঁচোয়া।

-ও আমি এমনিতেই দেখতে পাই।

-মেয়েদের দিল?

-হুঁ।

-আমার হৃদয়ে কী আছে বলুন তো?

-একটা গোলাপি ওড়না উড়ছে।

-ভারি মজার আপনি, মান্টোসাব।

-কিন্তু ফটোটা কার?

-কেন? আমার আব্বাজানের। শধু ওই শব্দটা আব্বাজান-উচ্চারণ করতেই ও যেন শৈশবের শিশিরভেজা দিনগুলোতে ফিরে গেল। আমি দেখতে পেলাম, কী গভীর টান-ভালবাসা ফুটে উঠেছে ওর মুখে।

বেগম-এর গল্প লেখার সময় এস মুখার্জির সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে প্রায় রাত দুটো হয়ে গেল। সেদিন আমার সঙ্গে শফিয়াও ছিল। আমরা যাবার জন্য পা বাড়াতেই নাসিম বলল, এটা যাবার সময়? আজ এখানেই থেকে যান।

-কোনও অসুবিধা হবে না। সাড়ে তিনটেয় ট্রেন আছে। প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে করতেই ট্রেন এসে যাবে।

কিন্তু নাসিম আর ওর বর এহসান কিছুতেই ছাড়বে না। অগত্যা থেকে যেতে হল। শফিয়াকে নিয়ে নাসিম শোবার ঘরে চলে গেল। আমি আর এহসান বারান্দাতেই শুয়ে পড়লাম।

পরদিন শফিয়ার মুখ থেকে এক অন্য নাসিমের ছবি দেখতে পেলাম, ভাইজানেরা। শোবার ঘরে ঢুকেই পালঙ্কে নতুন চাদর বিছিয়ে দিল নাসিম। তারপর একটা শোয়ার পোষাক বার করে শফিয়াকে বলল, এটা পরে নাও। একেবারে নতুন। তারপর শুয়ে পড়ো।

-তুমি?

-আমার কয়েকটা কাজ বাকি আছে।

নাসিম কাপড় বদলে মুখের মেকাপ ধুয়ে এল। শফিয়া ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, এ কী চেহারা তোমার নাসিম? তুমি তো একেবারে শ্যামলা। তা হলে..?

-সব সাজের বাহার শফিয়া। নইলে আমিও তো একটা বাজে মেয়ের মতোই। নাসিম তারপর নানারকম তেল মালিশ করল মুখে। অজু করে পড়তে শুরু করল কোরান শরিফ। শফিয়া মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিল, নাসিম, তুমি তো আমাদের চেয়েও অনেক ভালো মেয়ে। নাসিম কোন উত্তর দেয় নি; আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল।

এইরকম ছেঁড়া ছেড়া কতজনকে যে মনে পড়ে, মির্জাসাব। আমি কী কোনদিন ভুলতে পারব নূরজাহানের কণ্ঠস্বর? সবাই তার সৌন্দর্যের কথা বলত, কিন্তু তার রূপ আমাকে কোনওদিন ছুঁতে পারেনি। শুধু কণ্ঠস্বর। নূরজাহান মানেই, আমার কাছে আকাশপথে ভেসে যাওয়া একটা পুকার। অমন দরাজ গলা, অপূর্ব খরজ, তীব্র শাণিত পঞ্চম আমি আর কখনও শুনিনি, মির্জাসাব। বাজিকররা যেমন শূণ্যে দড়ির ওপর স্থির হয়ে থাকতে পারে, নূরজাহানের তানও সেইরকম-ঘন্টাখানেক তো সে ধরে রাখতেই পারত। তবে কী জানেন, খোদা যাদের দয়া করেন, তারাই সবচেয়ে বেশী অপচয় করে। মদে গলা নষ্ট হয়ে যায় আর সায়গল সাব মদ ছাড়া এক পাও চলতে পারতেন না। টক আর তেলেভাজায় গলার ক্ষতি হয়, আর নূরজাহান এক পোয়া তেলের আচার একবারে খেয়ে ফেলত। মাঝে মাঝে মনে হয়, খোদার সঙ্গে টক্কর দিতেই সায়গল-নূরজাহানদের জন্ম। এই গ্রহ যতদিন থাকবে, মির্জাসাব, নূরজাহানের কণ্ঠস্বরও ততদিন থেকে যাবে।

নূরজাহানের কত যে প্রেমিক ছিল, তার ঠিকঠিকানা নেই। রইস আদমিদের কথা বাদ দিন, কত হোটেলের বাবুর্চিকে জানি, তারা নূরজাহানের ছবি উনুনের ধারে লটকে ওর গাওয়া গান বেসুরো গলায় গাইতে গাইতে সাহেব-মেমদের জন্য রান্না করত। নূরজাহানের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার সময় রফিক আমাকে বলেছিল, এ হল নূর, নুর-এ-জাঁহা। খোদার কসম এমন গলা পেয়েছে যে বেহস্তের হুরও যদি শোনে তা হলে আকাশ থেকে নীচে নেমে আসবে। রফিক আলাপ করিয়ে দেওয়ার আগেই আমি নূরজাহানকে জান-মন দিয়ে চিনতাম, শুধু ওর গলার জন্য। নূরজাহানের এক প্রেমিক ছিল নাপিত। তার মুখে সবসময় নূরজাহানের কথা আর ওর গান। একদিন নাপিতের দোস্ত তাঁকে জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যিই নূরজাহানকে ভালবাস?

-খোদা কসম, নূরজাহান বেগম মেরা জান হ্যায়।

-তার জন্য জান দিয়ে দিতে পারো?

-ছোটা সা চিজ।

-মহিওয়ালের মতো নিজের মাংস কেটে দিতে পারবে?

নাপিত সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুর বার করে বন্ধুর হাতে দিয়ে বলল, যে কোনও জায়গা থেকে গোস্ত কেটে নাও।

বন্ধুও ভারি আজিব আদমি। নাপিতের হাত থেকে মাংস কেটে ফেলল। রক্তাক্ত হাত দেখে সে নিজেই পালাল। নাপিত অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জ্ঞান ফিরতেই তার মুখে একটাই নাম, নূরজাহান। সে এক আজিব দুনিয়া ছিল, ভাইজানেরা। ইশক, খুন,রক্তপাত-এই না হলে জীবন?

জীবনকে একেবারে খুল্লামখুল্লা উপভোগ করেছিল আমার বন্ধু শ্যাম। আমি তখন পাকিস্থানে। শ্যাম একটা চিঠিতে লিখেছিল, আমি মানুষকে ঘেন্না করি। এভাবেই জীবন যাচ্ছে। এই জীবনটাই আমার প্রেমিকা, যাকে আমি হাড়েমজ্জায় ভালবাসি। শ্যাম ছিল অদ্ভুত মানুষ। সভা সমিতিতে যারা পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপি পরে ভালোমানুষ সেজে বসে থাকে শ্যাম তাদের বলত জোকার। মদ খেয়ে জীবন নিয়ে কেউ বড় বড় কথা বললে খিস্তির বন্যা বইয়ে দিত সে। টাকা আর খ্যাতি পাওয়ার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছিল শ্যামকে। টুটাফাটা অবস্থায় হাতে পয়সা নিয়ে হাসতে হাসতে বলত, দোস্ত আর কত কষ্ট দেবে? একদিন না একদিন আমার পকেটে তোমাকে আসতেই হবে। বাড়ি, গাড়ি, খ্যাতি-সবই হয়েছিল শ্যামের। শ্যাম কখনও আমাকে ভোলেনি।

পাকিস্থানে এসে তখন আমার ল্যাজে গোবরে অবস্থা। সিনেমা প্রায় তৈরিই হয় না বলতে গেলে, কার জন্য গল্প লিখব, এদিকে ঠাণ্ডা গোস্ত গল্প লেখার জন্য মামলায় জেরবার। আদালত আমাকে তিনমাস সশ্রম কারাদণ্ড ও তিনশো টাকা জরিমানা শাস্তি দিয়েছে। মন একেবারে বিষিয়ে গেছে। বারে বারেই মনে হচ্ছিল, এতদিন যা লিখেছি, সব পুড়িয়ে ফেলব। এর চেয়ে কোন অফিসে কেরানিগিরি করব। বউ-বাচ্চারা তো বাঁচবে। দিনে দিনে মদ খাওয়া বেড়ে যাচ্ছিল। একদিন তাহসিন পিকচার্স –এর মালিকের চিঠি পেলাম। তাড়াতাড়ি দেখা করুন। বম্বে থেকে একটা চিঠি এসেছে। আমি পাকিস্থানে, আমাকে বম্বে থেকে কে চিঠি পাঠাবে? তবু গেলাম। শ্যামের চিঠি। সঙ্গে পাঁচশো টাকা। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। মির্জাসাব। ও কী করে জানল, আমার খুব টাকার দরকার। অনেকবার ওকে চিঠি লেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সব ছিঁড়ে ফেলেছি।

শ্যামকে ধন্যবাদ দেওয়া কি মানায়? ও নিশ্চয়ই তা হলে লিখত, মান্টো এই তোমার উত্তর? শ্যাম একবার একটা অনুষ্ঠানে লাহোরে এসেছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে দেখার জন্য দৌড়লাম। গাড়ি থেকে শ্যাম আমাকে দেখতে পেয়েছিল, হাত নাড়ল, ড্রাইভারকে থামাতে বলল। কিন্তু ওর ভক্তদের ভিড় এড়াতে ড্রাইভার গাড়ি থামাতে পারল না। হলের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে ওর সঙ্গে দেখা করলাম। বললাম রাতে তোমার হোটেলে যাব।

হোটেলে আমি বহিরাগতদের মতোই বসে ছিলাম। ভক্তদের ভিড় ঠেলে শ্যামের কাছে পৌঁছতে ইচ্ছে করছিল না। শ্যাম একসময় এসে আমাকে বলল, সবাই হিরামন্ডি যাচ্ছে। তুমিও চলো। আমার সঙ্গে।

-না

-কেন?

-আমি যাব না, তুমি গেলে যাও।

-তাহলে আমার জন্য অপেক্ষা করো। আমি এই এলাম বলে। শ্যাম চলে গেল। আমিও বাড়িতে ফিরে এলাম। আমি জানি, শ্যাম আর আমি এখন অনেক দূরের মানুষ। যেমন হিন্দুস্থান আর পাকিস্থান। আমরা আর কেউ কারও বন্ধু নই। যেভাবে আমি পাকিস্থানে চলে আসার পর ইসমত আর আমার কোনও চিঠির উত্তর দেয় নি। উত্তর দিলেই বা আর কী হত?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *