৩০. রোজগার কম ছিল

তমাশা-এ গুলশন, তমান্না-এ চীদন্‌–
বহার-আফ্রীনা, গুনঙ্গার হৈঁ হম।
(ফুলবাগিচার রূপ দেখতে চাই, আবার ফুল তুলতেও চাই–
হে বসন্তের স্রষ্টা, আমার মন পাপী।)

রোজগার কম ছিল ঠিকই, তবে শফিয়ার সঙ্গে সংসারে বেশ মন বসে গেল আমার, মির্জাসাব। শফিয়া তো জান দিয়ে ভালবাসত আমাকে। সবচেয়ে বড় কথা, ও আমাকে বুঝতে চেয়েছিল। তাই প্রথম প্রথম আমার মদ খাওয়া নিয়ে আপত্তি থাকলেও, পরে মেনে নিয়েছিল। তবে সবসময় নজর, যাতে আমি বেশী না খেয়ে ফেলি। আমি যে কী সংসারী হয়ে গিয়েছিলাম। ভাইজানেরা, আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। নিজে হাতে ঘর ঝাঁট দিতাম, জিনিসপত্র পুঁছে পুঁছে পরিষ্কার করতাম। এক-একদিন রান্নাতেও হাত লাগিয়েছি। রান্না করতে খুব মজা পেতাম, বিশেষ করে কাবাব বানাতে। মশলা আর মাংস পোড়ার গন্ধে নেশা ধরে যেত আমার। বাইরে তো বম্বের সিনেমা জগতের সঙ্গে আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ছিলাম; সেই দুনিয়ায় ঢুকে পড়লে মনে হত আমি যেন আমির হামজা, কত যে অ্যাডভেঞ্চার আমার সামনে অপেক্ষা করে আছে। পাকিস্থান যাওয়ার পর বম্বের ফিল্মি দুনিয়ার এইসব রংবাহার মানুষদের নিয়ে লিখেছিলাম গাঞ্জে ফেরে। কোনও রকম সাজপোশাক না পরিয়ে, স্নো-পাউডার না-মাখিয়েই আমি এই মানুষগুলোর আসলি চেহারা দেখতে চেয়েছিলাম।তাতে কেউ কেউ আপত্তি করেছিল। কিন্তু যে-সমাজে কেউ মারা যাওয়ার পর তার কাজকর্মকে লন্ড্রিতে পাঠিয়ে খুব করে সাফাই করে দেখানো হয়, আহা কত শরিফই না ছিলেন মানুষটা, সে সমাজ গোল্লায় যাক। আমার মনে আছে, সাকী-তে ইসমতের দোজখি গল্প ছাপা হয়েছিল। এই গল্পে ইসমত ওর মৃত দাদা আজিম বেগ চুঘতাইকে একেবারে নগ্ন করে ছেড়েছিল। গল্পটা পড়ে আমার বোন ইকবাল বলেছিল, এ তো আজিব মেয়ে সাদাত। নিজের মরা ভাইকে পর্যন্ত রেহাই দেয়নি। গল্পে এ-সব কথা লেখা কি ঠিক?

আমি বলেছিলাম, ইকবাল, আমার মৃত্যুর পর তুমি যদি এমন একটা গল্প লিখতে পারো, খোদা কসম, আমি আজই মরতে প্রস্তুত।

-আমি তোমাকে নিয়ে লিখব? কী লিখব?

-তোমার সাদাত নরকের সবচেয়ে জঘন্য কীট।

-তুমি পাগল সাদাত। প্রিয় মানুষকে কেউ ওভাবে দেখতে চায়?

-প্রিয় মানুষকেই তো ওভাবে দেখানো যায় ইকবাল। তুমি তার পাপ-পূণ্য সব জানো। তুমি তার প্রতি কখনও অবিচার করতে পারো না। মানুষ কি শুধু ভাল-ভাল গুণের একটা পিণ্ড? তার ভেতর কোন ফাটল নেই?

-তুমি লেখক, তুমি এভাবে ভাবতে পারো।

-না ইকবাল। তুমিও এভাবেই ভাবো। শুধু সত্যিটা দেখতে ভয় পাও। একদিন তোমাকে সিতারার গল্প বলব। আমি মনে করি, পৃথিবীতে একশো বছরে ওইরকম এক মেয়ে জন্মায়। অথচ চারদিকে ওর কত বদনাম। সবাই মনে করে, সেক্স ছাড়া ওর জীবনে আর কিছু নেই।

না, না, ভাইজানেরা অমন চনমনে হয়ে উঠবেন না, সিতারার কিস্সা আমার হাতের একটা। লুকোন তাস, পরে দেখাব। সেই বাঘিনীর গল্প কী এত তাড়াতাড়ি বলতে হয়? দোজখে আরও কতদিন পচতে হবে আমাদের, হাতে কত সময়। তখন সিতারা আসবে, নাসিম বানু আসবে, নার্গিস, নূরজাহান-রা আসবে। শুধু একটু ধৈর্য ধরতে হবে ভাইজানেরা। এ-সব কতদিন আগের কথা, সাল তারিখ সব ভুলে গিয়েছি, মনে হয় যেন, দীর্ঘদিন ধরে এক লম্বা স্বপ্নে ওদের দেখেছিলাম আমি। কিন্তু এখন ক্ষমাঘেন্না করে এই মান্টো হারামির জীবনের দুএকটা কথা শুনুন।

মুসাওয়ার কাগজে কাজ করতে করতেই বাবুরাও প্যাটেল আমাকে একটা সিনেমার চিত্রনাট্য উর্দুতে অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন। প্রভাত স্টুডিও সিনেমাটা তৈরি করবে। বম্বের সিনামা দুনিয়ায় এভাবেই আমি পা রেখেছিলাম। একদিন নাজির লুধিয়ানভিসাব-মুসাওয়ার-এর মালিক-ইমপেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। সিনামার জন্য সংলাপ লিখে দিতে হবে; মাসে চল্লিশ টাকা করে পাব। ভাবলাম, এবার তাহলে কপাল খুলল। কিন্তু লুধিয়ানভিসাব আমার মাইনে কমিয়ে চল্লিশ থেকে কুড়ি টাকা করে দিলেন। ব্যাপারটা বুঝলেন? একদিক থেকে পাইয়ে দিলেন, অন্য দিক থেকে কেড়ে নিলেন। আমার মাসে রোজগার দাঁড়াল ষাট টাকা। তবে ইমপেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানির তখন যা অবস্থা, প্রতি মাসে ঠিক মত টাকা দিতে পারত না। আমি মাঝে মাঝে আগাম টাকা নিয়ে নিতাম। বেশীদিন। কাজটা টিকল না। লুধিয়ানভিসাবের চেষ্টাতেই ফিল্ম সিটিতে মাসে একশো টাকা মাইনের চাকরি পেয়ে গেলাম। কত যে ফিল্ম কোম্পানিতে তখন কাজ করেছি, যা টাকা হাতে আসে। কিন্তু মুসাওয়ার-এর চাকরি ছাড়িনি। মুসাওয়ার-ই তো আমকে বম্বেতে নিয়ে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত লাথিটা মারলেন লুধিয়ানভিসাবই। কোনও কারন না জানিয়েই আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হল। পায়ের তলার মাটি সরে গেল ভাইজানরা। ফিল্ম কোম্পানিতে তো আজ আছি, কাল নেই। বরখাস্তের চিঠি নিয়ে সরাসরি দেখা করলাম বাবুরাও প্যাটেলের সঙ্গে। বাবুরাওজি তার কারবা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে আমাকে চাকরি দিতেও রাজি হয়ে গেলেন। বাবুরাওজি তাঁর সেক্রেটারি রিটা কারালাইলকে ডেকে পাঠালেন। শুনেছিলাম, রিটা তার সেক্রেটারি, স্টেনো, প্রেমিকা-সবকিছুই। রিটা ঘরে ঢুকতেই বাবুরাওজি বললেন, কাছে এসো।

কাছে যেতেই বাবুরাওজি রিটার পেছনে চাপড় মেরে বললেন, যাও কাগজ পেন্সিল নিয়ে এসো।

রিটা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বাবুরাওজি হেসে বললেন, এমন ঠাসা নিতম্ব আগে দেখিনি, মান্টো।

-খুব চাপড় মারেন বুঝি?

-মারিই তো। আর হাত বুলিয়ে কী যে সুখ। যেন পলসন মাখনে হাত বোলাচ্ছি। রিটা শর্ট হ্যান্ড-এর খাতা-পেন্সিল নিয়ে ফিরে এল। আমার নিয়োগপত্রের বয়ান বলতে বলতে বাবুরাওজি মুখ তুলে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন মান্টো কত হলে চলবে? একটু থেমে নিজেই বললেন, একশো টাকায় চলবে তো?

-না।

-মান্টো, এর বেশী তো আমি দিতে পারব না।

-আমি মাত্র ষাট টাকা নেব। তার বেশীও নয় কমও নয়।

বাবুরাওজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, তুমি দেখছি একটা আস্ত গাধা।

-ঠিক তাই।

-তার মানে?

-আমি ষাট টাকার বেশী নেব না। কিন্তু কোন টাইমটেবিল আমি মানতে পারব না। যখন খুশি আসব, যাব। পত্রিকা ঠিকমত বেরলেই তো হবে?

চাকরি পেলাম ঠিকই, তবে সাত মাসের বেশী টিকল না। এদিকে বম্বেতেও কোনও কাজ নেই। ১৯৪১-এ রেডিওতে কাজ নিয়ে দিল্লি চলে গেলাম। মাইনে মাসে দেড়শো টাকা। রেডিও-র জন্য অনেক নাটক লিখেছিলাম। কিন্তু দেড় বছরের বেশী টিকতে পারলাম না রেডিওতে। সরকারি দপ্তরের চাকরি আমার জন্য নয়, মির্জাসাব। সে যে কী বিরক্তিকর সব লোক চারপাশে। আর বম্বের ফিল্মি দুনিয়ার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। আপনি আমির হলেন, কী ফকির কেউ যেমন ফিরে দেখবে না, তেমনই আপনার কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ তা নিয়েও প্রশ্ন তুলবে না কেউ। শুধু বাঁচো, বেঁচে থাকো, হাড়েমজ্জায় বেঁচে থাকার আনন্দ উপভোগ করো। যেমন আমার বন্ধু শ্যাম বলত, মান্টো, এই জীবনটাই আমার আশিক। বলো মান্টো, তুমি কী চাও? শুধু জীবনটা বেঁচে থাকুক, আর সব জাহান্নামে যাক। তুমি চাও না, বলল, চাও না?

শ্যামের কথাও একদিন আপনাদের বলতে হবে ভাইজানেরা। পাকিস্থানে মদ ছাড়ানোর জন্য মানসিক হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় শ্যামের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম। শ্যাম যেন আমার কানে কানে এসে বলেছিল, মান্টো, মৃত্যুর স্বাদ সত্যিই অন্যরকমের। কোনও দিন কল্পনাই করতে পারি নি। দিল্লির চাকরি একদিন ছেড়ে দিলাম, ভাইজানেরা। তখন আদবানি বলে কে যেন একজন দিল্লি রেডিও-র অধিকর্তা ছিল। সে একদিন আমার একটা নাটক পড়ে বলল, কয়েকটা শব্দ বদলাতে হবে। রেডিও -র ডিরেক্টর জেনারেল তখন বোখারিসাব; আদবানি তাঁর খুবই প্রিয় মানুষ। কেউ আদবানির বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারত না। আমি সরাসরি জানিয়ে দিলাম, আদবানিজি উর্দু জানেন না, বোঝেন না, পড়তেও পারেন না। আমার নাটকের ভুল ধরার ক্ষমতা তাঁর নেই। চাকরি থেকে ইস্তাফাই দিতে হল আমাকে। আর ওই বোখারিসাব? তিনি আমাকে আর কোনদিন সহ্য করতে পারেন নি। দেশত্যাগের পর রেডিও পাকিস্থানের ডিরেক্টর জেনারেল হয়েছিলেন, কিন্তু আমাকে কোনও দিন রেডিওর অনুষ্ঠানে ডাকেন নি। তো বয়ে গেছে মির্জাসাব। আমার মৃত্যুর পর তো আধ ঘন্টার অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল রেডিও পাকিস্থানে। বোখারিসাবই তখন রেডিওর হর্তাকর্তা। এরা ভুলে যায় মির্জাসাব, তুমি সরকারের নোকর মাত্র, সে তুমি যত উঁচু পদেই থাকো, চেয়ার সরে গেলেই কেউ তোমার দিকে ফিরেও তাকাবে না।

দেড় বছর দিল্লিতে কাটিয়ে আবার বম্বেতে ফিরে এলাম, মির্জাসাব। মুসাওয়ার থেকে আবার ডাক এল, তার ওপর বম্বের হাতছানি ছিল বড় মারাত্মক। টাকা তো সেখানে উড়ছে, শুধু ধরতে পারলেই হল। আমি, কৃষণ চন্দর, রাজিন্দর সিং বেদি, উপেন্দ্রনাথ অশক, ইসমত আমরা যে ফিল্মের দুনিয়ায় ভিড়ে গিয়েছিলাম, তা শুধু টাকার জন্য। ভাল ভাবে খেয়ে পরে বাঁচব বলে। রোজ যেন জনি ওয়াকার পাই, ক্যাভার্ন সিগারেটের প্যাকেট যেন পকেটে রাখতে পারি। ফিল্মের গল্প লেখার সঙ্গে সাহিত্যের তো কোনও সম্পর্ক নেই। কৃষণ একটু সরল ছিল, প্রথম ব্যাপারটা বুঝত না। ভাবত, সিনেমার জন্য গল্প লিখে মহৎ কাজ করছে। একবার আমরা দুজনে বানজারা নামে একটা গল্প লিখলাম সিনেমার জন্য। গল্প বিক্রির জন্য জগৎ টকিজ-এর মালিক শেঠ জগৎ নারায়নের কাছে যাওয়া হল। গল্পটা শুনে শেঠ বলল, বহৎ খুব। আমি স্টোরিটা কিনব। কিন্তু মান্টোসাব। আপনি কারখানার ম্যানেজারকে বড় বুরা আদমি বানিয়েছেন। ওকে একটু ভাল করা যায় না? কারখানার ওয়ার্কাররা তো ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখবে না। বুঝতে পারছেন, কি বলছি।

-নিশ্চয়ই, আমি বললাম।-কারখানার ম্যানেজারকে ভাল করতে বেশি সময় লাগবে না শেঠজি

-মতলব?

-একটু কাগজ-কলম নিয়ে বসা আর কী।

-সহি বাত। শেঠ হাসতে লাগল।

কৃষণ তো আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আস্তে ও কী যেন বলতে চাইছিল, আমি থামিয়ে দিলাম।

-আর একটা কথা বলি মান্টোসাব?

-জি।

-ম্যানেজারের বউকে আনলেন কেন? ওকে ম্যানেজারের বহিন বানিয়ে দিন।

-কেন?

-অনেক সুবিধা আছে তাতে।

-কী সুবিধে? কৃষণ প্রায় গর্জে ওঠে।

-কৃষণ, তুমি চুপ করো। শেঠজি তো গল্পটা কিনছেন। উনি যা চাইবেন—

-সহি বাত। আমার কথা তো ভাববেন। শুনুন মান্টোসাব, বোনটার যদি শাদি না হয়, একটু ভ্যাম্প টাইপ বানিয়ে দেবেন। হিরোর সাথে নখরা করবে। ব্যাপারটা জমে যাবে কি না বলুন?

-ইনশাল্লা। এর চেয়ে ভাল আর কিছু হয় না শেঠজি।

কৃষন আমার কথা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি তার চেনা সেই মান্টো, যে রেডিও-র নাটকে একটাও শব্দ বদলাতে চায়নি। দেখলাম অবিশ্বাস আর ঘৃণায় তার চোখ ছলছল করছে।

শেঠের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কৃষণ তো চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিল।-তুমি লেখক মান্টো? এইভাবে নিজেকে বেঁচে দিলে? আর আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম।

-আমি কী তোমার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছি?

-তোমার লেখার একটা শব্দ বদলাতে বললে, তুমি ছাপতে দেবে?

-না।

-শেঠজির কথা তুমি মেনে নিলে?

-নিলাম কৃষণভাই। শেঠের কাছে আমরা সাহিত্যের জন্য আসিনি। তুমি কি মনে করো, গল্পটার কোন সাহিত্যমূল্য আছে? ওটা আমরা সিনেমার জন্য ভেবেছিলাম। মা সেখানে বোন হয়ে যেতে পারে, বোন ভ্যাম্প হয়ে যেতে পারে, হিরোর সঙ্গে যা খুশি তাই করতে পারে। তাতে তোমার আমার কী আসে যায়? সিনেমার গল্প লিখতে এসেছি টাকার জন্য। সাহিত্যের কথা এখানে ভেবো না কৃষণ। বুঝলে আমার কথা?

–হুঁ।

-তাহলে গল্পটা বদলানো যায়, তাই তো?

কৃষণ মাথা নেড়েছিল।

আমি জানতাম মির্জাসাব, কার জন্য জীবন দেব, আর কার জন্য নখরা করব। ফিল্মি দুনিয়া সেই নখরার জায়গা। কত লোক গল্প লিখে অপেক্ষা করে থাকত, কবে তার গল্প থেকে সিনেমা হবে। এদের আপনি লেখক বলবেন, মির্জাসাব? আমি কাগজ-কলম নিয়ে বসে ভাবতাম, আমি যে গল্প লিখতে যাচ্ছি দুনিয়ার কেউ এই গল্পটাকে সিনেমা বানাতে পারবে না। সাহিত্যের সব সত্য লুকিয়ে থাকে তার শব্দ-বাক্যে-অনুচ্ছেদে, কোনও ছবি তাকে প্রকাশ করতে পারে না; যেমন কোনও ছবিকে আমরা শব্দ দিয়ে বোঝাতে পারি না। আর বম্বের ফিল্মি দুনিয়া কখনও ছুঁতে পারবে মান্টো, কৃষণ চন্দর, ইসমত চুঘতাইয়ের গল্পকে? একদিন বম্বে টকিজ থেকে ট্রামে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ইসমতকে বলেছিলাম, কৃষণের লেখায় আজকাল দুটো জিনিস আমি প্রায়ই লক্ষ্য করি।

-কী?

-ধর্ষণ আর রামধনু।

-একদম ঠিক মান্টোভাই।

-ভাবছি ওই নামেই একটা প্রবন্ধ লিখব কৃষণকে নিয়ে। জিনা বিলজবর আউর কাওস ও কাজা। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, ওর লেখায় ধর্ষণ আর রামধনুর সম্পর্কটা কী?

ইসমত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, রামধনুর অতগুলো রং কী সুন্দর। কিন্তু তুমি তো অন্য দিক থেকে বিষয়টাকে ভাবছ, মান্টোভাই।

-হ্যাঁ, আগুন আর রক্তের রং লাল। মঙ্গলগ্রহের সঙ্গে এই রঙের গভীর যোগ আছে ইসমত। আর একই রং দেখা যায় ধর্ষণ ও রামধনুতে।

-হতে পারে। লেখাটা তবে লিখেই ফেলল।

-আরও একটু ভাবো ইসমত। খ্রিস্টান চিত্রকলায় লাল ঈশ্বরীয় প্রেমের প্রতীক। এই রং জড়িয়ে আছে খ্রিস্টকে ক্রুশে চড়ানোর সঙ্গে। কুমারী মেরিও পরেন লাল পোশাক। পবিত্রতার রং। বলতে বলতেই দেখলাম, ইসমতের পোশাক সেদিন সম্পূর্ণ সাদা।

ইসমত হেসে বলল, লিখে ফেললা মান্টোভাই। তবে লেখার নামে বিলজবর-জোর করে শব্দটা দিও না।

-কিন্তু কৃষণ আপত্তি করবে। বিলজবর বলেই তো কৃষণ ধর্ষণকে ঘৃণা করে।

-ও আপত্তি টিকবে না মান্টোভাই।

-কেন?

-কৃষণ কী করে জানবে, ওর নায়িকা ভায়োলেন্সটাকেই ভালবেসেছিল কি না। হ্যাঁ, ইসমত ছিল এইরকম, বেপরোয়া, না হলে লিহাফ-এর মতো গল্প তো ও লিখতে পারত না। মির্জাসাব, উর্দু সাহিত্যে সে এক বিস্ফোরণ, তাও এক মেয়ের কলমে। ইসমতের সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনই গল্পটা নিয়ে কথা তুলেছিলাম। সেটা বোধহয় ১৯৪২-এর আগস্টের কথা। ক্লেয়ার রোডে অ্যাডলেফি চেম্বার্সে মুসাওয়ার-এর অফিসে কাজ করছিলাম। মহাত্মা গান্ধী ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতাকে তখন গ্রেফতার করা হয়েছে। সারা শহর জুড়ে গোলমাল। তখন একদিন শহিদ লতিফ ওর বেগম ইসমতকে নিয়ে এল। আলিগড় ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে শহিদের সঙ্গে পরিচয়। লক্ষ করলাম, ইসমত একই সঙ্গে লাজুক এবং কথা বলার সময় স্পষ্ট চোখের দিকে তাকাতে পারে। কিছুক্ষণ স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে কথা বলার পর গল্প-কবিতার দিকে আমাদের আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। আমি ইসমতকে বললাম, আদাব-ই-লতিফ-এ আপনার লিহাফ গল্পটা পড়েছিলাম।

-তখন দিল্লিতে ছিলেন বুঝি?

-হ্যাঁ। ভাল বেশ ভাল। তবে শেষ বাক্যটা-আহমদ নাদিম কাসিমি-র জায়গায় আমি সম্পাদক হলে শেষ বাক্যটা কেটে দিতাম।

-কেন?

-আপনি কী লিখেছিলেন, মনে আছে?

-হুঁ।

-লেপটা এক ইঞ্চি ওঠার পর আমি কী দেখতে পেয়েছিলাম, তা কেউ এক লক্ষ টাকা দিলেও বলব না। লাইনটা তো এমনই ছিল, তাই না?

-হ্যাঁ।

-বলার দরকার ছিল?

-কেন, অসুবিধে কোথায়?

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ইসমতের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কথা বলতে পারলাম না। যেন এমন কিছু তাকে বলেছি, যা শোনা তার পক্ষে পাপ। ইসমত ছিল এমনই; হঠাৎ এমন কথা বলবে, মির্জাসাব, আপনি সহ্য করতে পারবেন না, পরক্ষণেই যেন লজ্জাবতী লতাটি।

ইসমতের কথা তো সহজে ফুরোবে না, ভাইজানেরা। হায়দরাবাদ থেকে একজন আমাকে চিঠি লিখেছিল, কী ব্যাপার, এখনও ইসমত চুঘতাইয়ের সঙ্গে আপনার বিয়ে হল না? মান্টো আর ইসমত যদি এক হয়ে যেত, তা হলে কত ভাল হত। বড় আফশোস মান্টোসাব, ইসমত আপনাকে বিয়ে না করে শহিদ লতিফকে বিয়ে করল।

তখন হায়দরাবাদে প্রগতিশীল লেখকদের একটা সম্মেলন চলছিল। সেখানে নাকি অনেক মেয়ে ইসমতকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি মান্টোসাবকে বিয়ে করলেন না কেন? এসব কতদূর সত্যি আমি জানি না। তবে ইসমত বম্বেতে ফিরে শফিয়াকে বলেছিল হায়দরাবাদের এক মেয়ে নাকি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, মান্টোসাব কি অবিবাহিত? জি না, ইসমতের উত্তর শুনে মেয়েটি চুপসে গিয়েছিল।

পরে ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছিলাম, মির্জাসাব। যদি ইসমত আর আমার সত্যি নিকাহ্ হত, তা হলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াত? এই যদির মানে খুঁজে পেতে হিমসিম খেতে হবে। যেমন ধরুন, এই প্রশ্নের আপনি কী উত্তর দেবেন, ক্লিওপেট্রা-র নাক যদি এক ইঞ্চির আঠারো ভাগের এক ভাগ বড় হত, তা হলে নীল নদের অবস্থা কী দাঁড়াত? মান্টো আর ইসমতের বিয়ে নিয়ে প্রশ্নটাও এমনই আজগুবি। শুধু এটুকু বলা যায়, বিয়েটা হলে উর্দু সাহিত্যের ইতিহাসে। একটা আনবিক বিস্ফোরণ ঘটে যেত। হয়তো নিকাহনামার সাক্ষরই হত দুজনের শেষ লেখা। আর আমি কল্পনা করতাম সেই বিয়ের মজলিসে কাজি সাহেবের সামনে আমার ও ইসমতের কথাবার্তা :

-কাজি সাহেবের কপালটা বেশ চওড়া, স্লেটের মতো নয় ইসমত?

-কী বললে?

-কানের মাথা খেয়েছ নাকি?

-আমার কান ঠিকই আছে। তোমার গলায় কি ইঁদুর ঢুকেছে?

-তওবা,তওবা, বলছিলাম, কাজি সাহেবের কপাল একেবারে স্লেটের মতো।

-তবে বেশ মসৃণ।

-মসৃণ কাকে বলে তুমি জানো থোড়াই।

-না, আমি জানি না। তুমি যেন খুব জানো।

-তুমি জানো তোমার মাথা।

-কাজী সাহেবের মাথা খুব সুন্দর। তুমি বড় বকবক করছ মান্টো।

-বকবক তো তুমিই করছ।

-না। আমি না, তুমি।

-তুমি-তুমি-কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছ।

-ও বাবা, এখন থেকেই দেখছি আমার শওহর বনে গেছ।

আমি কাজি সাহেবের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললাম, এ মেয়েকে আমি কিছুতেই নিকে করব না। যদি আপনার মেয়ের মাথা ঠিক আপনার মাথার মতো হয়, তবে তার সঙ্গেই আমার নিকাহ পড়িয়ে দিন।

ইসমতও চেঁচিয়ে উঠল, আমিও এই লোকটাকে নিকে করব না কাজি সাহেব। আপনি যদি এখনও চার বিবি নিয়ে থাকেন, তবে আমাকেই নিকে করুন। আমি আপনাকেই পছন্দ করি কাজি সাহেব।

বম্বের জীবন এমন কিস্সার মতোই মির্জাসাব, সত্যি-মিথ্যে সেখানে একাকার হয়ে যায়। আমি পাকিস্থানে চলে যাওয়ার পর ইসমত যে আমার একটা চিঠিরও উত্তর দেয়নি, সেই নীরবতায় কি কোনও সত্য লেখা ছিল না, মির্জাসাব? ইসমত একবার আমার হাত ধরে বলেছিল, মান্টোভাই, জীবনে একটা কথাও তুমি মুখ ফুটে বলতে পারলে না? মির্জাসাব, আমি ইসমতকে আপনার একটা শের শুনিয়েছিলাম :

আ-হী জাতা বোহ রাহ-পর, গালিব
কোঈ দিন অওর-ভী জীয়ে হোতে।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *