৫. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ

পঞ্চম খণ্ড
৫.১ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ

কি, চারদিক যে বড় নীরব, পাখানগুলো সব গেল কোথায়—বলতে বলতে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বিপুল দেহ টেনে নিযে ঘরে প্রবেশ করে।

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রথম পণ্ডিত। বিপুল তার দেহ, বিপুল তার পাণ্ডিত্য, লোকে বলে ঐ প্রকাণ্ড পেটটা বিদ্যায় ঠেসে ভর্তি করা। বিদ্যালঙ্কার ঘরের কোণে নিয়মিত স্থানে হাতের মোটা লাঠিটা রেখে দেয়, তার পরে বিস্তৃত ফরাসের উপরে বসে পড়ে পাঙ্খাপুলারদের উদ্দেশে বলে ওঠে, একটু জোরে টান বাবা, ঘামটা মরুক।

দ্বিতীয় পণ্ডিত রামনাথ বাচস্পতি নস্যের ডিবেটা সরাতে সরাতে বলে, এস ভায়া, তোমার তো আবার এর গন্ধটা পর্যন্ত সহ্য হয় না।

সহ্য হয় না সাধে! ও বস্তু নাসাতে গ্রহণ করলে পুষ্পের ঘ্রাণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

পড়লেই বা ক্ষতি কি? এর ঘ্রাণটাও তো মন্দ নয়?

চাদরের প্রান্ত দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে বিদ্যালঙ্কার, দেবতার নির্মাল্যের গন্ধ যদি না পেলাম, তবে তো জীবন বৃথা।

তার পরে প্রসঙ্গ পালটিয়ে বলে, আজ যে সব নীরব, ব্যাপার কি?

ব্যাপার তো আমিও বুঝতে পারছি না, এসে দেখি সব ভোঁ ভোঁ, জনপ্রাণী নেই।

এসব রহস্য জানা তোমার আমার কর্ম নয় রামনাথ। বসুজা কোথায়? রাজীবলোচনকেও তো দেখছি না।

রামনাথ বলে, রাজীবলোচনের কথা বলতে পারি না, তবে বসুজা পাদ্রী কেরী সাহেবের ঘরে। সে এলেই সব জানতে পারা যাবে, ততক্ষণ ধৈর্য অবলম্বন কর।

মন্দ বল নি, যেমন গরম পড়েছে—এই বলে মৃত্যুঞ্জয় চাদরের প্রান্ত দিয়ে হাওয়া করে পাখার হাওয়াকে প্রবলতর করে তুলতে চেষ্টা করে।

এবারে রামনাথ বলে, এখানকার ফিরিঙ্গী পড়ুয়াদের তোমার ঐ হোলের লাঠিটাকে বড় ভয়।

সশব্দে হেসে উঠে মৃত্যুঞ্জয় বলে, হেতালের লাঠিই বটে! এই লাঠি দিয়ে গোখরোর বাচ্ছাদের শাসন করে রেখেছি।

কাজটা ভাল কর না হে বিদ্যালঙ্কার। দুদিন পরে এরা সব জঞ্জ-ম্যাজিস্টর হবে, তখন যে ওদেরই হাতে উঠবে হেন্তালের লাঠি।

এ তোমার ভুল বাচস্পতি। ছাত্রজীবনের শাসন উত্তরকালে ছাত্ররা মনে রাখে না। এই দেখ না কেন, সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে কসাইটোলা থেকে ফিরছিলাম, হঠাৎ সামনে এক ফিটন গাড়ি থেমে গেল। গাড়ি থেকে নামল এই কলেজের—তুমি যাকে বল বিরাট রাজার গোশালা—এক প্রাক্তন ফিরিঙ্গী ছাত্র-আমাকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাল।

কে হে লোকটা?

নামটা হচ্ছে থ্যাকারে, ছোকরাকে আমি বেশ চিনতাম। শ্রীহট্টের যে হাতীধরা থ্যাকলে ছিল, সে ওর কাকা কি জেঠা, বা ঐ রকম কি একটা।

হ্যাঁ, ফিরিঙ্গী বেটাদের কাকা-জেঠা, মামা-মেসো-পিসে সবাই ‘অঙ্কেল। যেমন জাত, তেমনি সম্বন্ধ-বিচার।

জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কি করছ? বলল, চব্বিশ পরগণার রাজস্ব-সংগ্রাহক, কলেকটার। তবেই দেখ, মনে রেখেছে! একদিন ওকেই এই কলেজে-ঘরে খুব ভৎসনা করেছিলাম—অথচ কেমন বিনয়ের সঙ্গে কথা বলল।

যাক ভাই, চাঁদ সওদাগরের হাতেই হোলের লাঠি শোভা পায়। আমার বোধ হয় কি জান, কেরী সাহেবও মনে মনে ভয় করে তোমার ঐ লাঠিগাছাকে। ঐ যে কেরী সাহেব ও বসুজা আসছে।

কেরী ও বসুজা প্রবেশ করে। রামনাথ উঠে দাঁড়ায়, বিদ্যালঙ্কার তত্তাপোশের উপরেই নড়েচড়ে বসে সম্মান জানায়।

কেরী দুজনের উদ্দেশে বলে, নমস্তে।

আগে সে গুড মর্নিং বলে অভিবাদন করত, এখন বিদ্যালঙ্কারের পরামর্শে দেশীয় অভিবাদনবাক্য উচ্চারণ করে।

বিদ্যালঙ্কার বলে, আজ সব নীরব কেন? ছাত্রেরা সব গেল কোথায়?

কেরী আসন গ্রহণ করতে করতে বলে, আজ ওরা আমাদের ছুটি দিয়েছে।

বিস্মিত বিদ্যালঙ্কার বলে, কেমন?

কেরী বলে, আজ ওরা সব ধর্মঘট করেছে।*

সে বস্তু আবার কি? শুধায় বিদ্যালঙ্কার।

কেরী বুঝিয়ে বলে, কর্তৃপক্ষের কোন আদেশ বা ব্যবস্থা পছন্দ না হলে হাত পা গুটিয়ে বসে থেকে আপত্তি জানানোকে স্ট্রাইক করা বা ধর্মঘট করা বলে।

সে তো বুঝলাম, বলে মৃত্যুঞ্জয়, কিন্তু এখানকার পাখানদের অপছন্দ কোন্ ব্যবস্থা?

তবে পূর্ব ইতিহাস বলতে হয়। আগে সিভিলিয়ান রাইটাররা শহরের যত্রতত্র বাড়ি ভাড়া করে থাকত। তার ফলে কামিনীকাঞ্চন-সংক্রান্ত দুনীতি বেড়ে যাচ্ছিল দেখে লর্ড ওয়েলেসলি ব্যবস্থা করে যে, সকলকে এই রাইটার্স বিল্ডিং-এর দোতলায় থাকতে হবে। এই ব্যবস্থার ফলে রাইটারদের মধ্যে দুনীতি অনেক কমে যায়।

মৃত্যুঞ্জয় বলে, সে তো অনেক দিনের কথা। এতদিন পরে হঠাৎ ওরা সচেতন হয়ে উঠল কেন?

ছোকরার দল অনেকদিন থেকেই ভিতরে ভিতরে সচেতন হয়ে উঠেছিল, কিন্তু প্রশ্রয়ের অভাবে সেটা প্রকাশ পায় নি।

প্রশ্রয় দেবে কে? এ যে রাজার শাসন।

পণ্ডিত, রাজার উপরেও রাজা আছে। এখানে সবসময় কর্তা গভর্নর জেনারেল, কিন্তু বিলাতের বোর্ড অব ডিরেকটরস তারও উপরে।

তাতে কি হল?

হল এই যে, কলেজের জন্য প্রভূত ব্যয় হচ্ছে দেখে বোর্ড এটা উঠিয়ে দেবার মতলবে আছে। ওয়েলেসলির মত জবরদস্ত লোক না থাকলে কোনদিন উঠিয়ে দিত এই কলেজ। এখানকার বড়লাট তেমন তেজস্বী নয়, বিলাতের বোর্ড আবার কলেজ উঠিয়ে দেবার উপায় সন্ধান করছে।

তার সঙ্গে এই ধর্মঘটের সম্বন্ধটা তো বুঝতে পারছি না।

ধৈর্য অবলম্বন কর পণ্ডিত, বুঝিয়ে দিচ্ছি। এখানকার লাট কাউন্সিলের মধ্যেই কোন কোন মেম্বার বোর্ডের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। এখন তাদের ইঙ্গিতেই এই ধর্মঘট।

কেন কি! একটা অশান্তি হক, গোলযোগ হক, তাহলে কলেজ উঠিয়ে দেবার পথ সুগম হয়।

ছাত্রেরা কি এত কথা জানে?

স্পষ্ট জানে না, আভাসে জানে, ইঙ্গিতে জানে যে, গোলমাল করলে প্রভুরা অসন্তুষ্ট হবে না।

কিন্তু তাদের কি লাভ এতে?

লাভ ষোল আনা। এখানকার কলেজের ঘরে পড়াশুনার সুবিধা হচ্ছে না, আলো হাওয়ার অভাব ইত্যাদির ছুতো তুলে তারা আবার রাণীমুদিনীর গলি, ম্যাঙ্গো লেনে বাড়িভাড়া করে স্বাধীনভাবে থাকতে চায়। তাদের লাভ যথেচ্ছাচার, বোর্ডের লাভ কলেজ উঠে গেলে বিস্তর খরচা বাঁচে। তাই তো বলছিলাম লাভ যোল আনা।

আর ষোল আনা ক্ষতি আমাদের। বাঙালীর ছেলের চাকরি গেলে আর থাকে কি।

না মুন্সী, ক্ষতি সমস্ত দেশের, ক্ষতি ইংরেজ-শাসনের। আর বাঙালীর ছেলের কথা বলছ? তাদের থাকে কি জিজ্ঞাসা করছ? এখানে আমরা মিলিত হয়ে আজ দশ বছর ধরে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ অভিধানগ্রন্থ রচনা করে যে ভিত্তি পত্তন করেছি—একদিন সেই মহাসৌধ হবে ভবিষ্যতের বাঙালীর ছেলের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়; তা ঝড়ে টলবে না, ভূমিকম্পে নড়বে না, আগুনে পুড়বে না, মহামন্তরেও বিচলিত হবে না। বাঙালীর ছেলের এই লাভ। এ লাভের চেয়ে বড় লাভ আর কি হতে পারে জানি না।

বলতে বলতে উৎসাহে দাঁড়িয়ে উঠে কেরী ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে।

লোকমুখের শব্দ, বিদেশী শব্দ, সংস্কৃত শব্দ তিনে মিলিয়ে সেই সৌধের গাঁথুনি চলেছে। সংস্কৃত এর ভিত্তি, লোকমুখের শব্দ এর হাক আর বিদেশী শব্দ চুন-সুরকি। আর এর কারিগর হচ্ছে খ্রীষ্টান, মুসলমান, হিন্দু। দিনে দিনে দিব্য সৌধ উঠছে আকাশের দিকে। তুচ্ছ কিছু ক্ষুদ্র কিছু গ্রাম্য কিছু অশোভন অকিঞ্চিৎকর কিছু থাকবে না ভাষায়। অবশেষে একদিন এর স্বর্ণময় চুড়া রবির আলোকে ভাস্বর হয়ে উঠবে। সেদিন দেশ বিদেশের লোকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে, ভাববে কোন্ সে ময়দানবের অক্ষয় কীর্তি এই অঞ্চয় মন্দির।

এবারে সে রামরাম বসুর কাছে এসে বলে ওঠে, মুন্সী, এই থাকবে বাঙালীর ছেলের।

তার পরে বিদ্যালঙ্কারের কাছে এসে বলে ওঠে, যতই দিন যাচ্ছে সংস্কৃত ভাষার মহিমা বুঝতে পারছি, তুলনা নেই এর তুলনা নেই, ডিভাইন, সিমপ্লি ডিভাই।

.

পরদিন আবার অধ্যাপক, পণ্ডিত ও শিক্ষকগণ যথাসময়ে কলেজ হলে মিলিত হয়, কিন্তু ছাত্রগণ দেখা দেয় না।

রাম বসু বলে, আজও দেখছি ছাত্রেরা আমাদের দুটি দিল।

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বলে, তা যেন দিল, কিন্তু পাখানগুলো গেল কোথায়? দোতলায় আছে বলে তো মনে হচ্ছে না, সমস্ত নীরব নিঝুম।

কেরী বলে, সব ঘুমোচ্ছ।

ঘুমোচ্ছ! এখন! বিস্মিত হয় বিদ্যালঙ্কার।

কেরী বলে, ঘুমোবে না? কাল সারারাত হুল্লোড় করেছে।

কেমন? শুধায় বিদ্যালঙ্কার।

কেরী বলে, কাল রাত্রে ইয়ং রাস্কেলরা মদ আর মেয়েমানুষ নিয়ে এমন তুমুল। কাজ করে যে, শেষ পর্যন্ত দারোয়ানরা গিয়ে আমাকে ডেকে আনে।

কেরীর বাস চৌত্রিশ নম্বর বউবাজার স্ত্রীটে।

আমি এসে দেখি দোতলায় নারকীয় কাণ্ড চলছে। আমাকে দেখেও লজ্জা হল না ওদের। আমি বললাম, এমন কাণ্ড করলে তোমাদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে এ বাড়ি থেকে। তাই শুনে একজন বলে উঠল, আমরাও তো তাই চাই। কেন আমাদের এখানে রেখেছ? দাও তাড়িয়ে, আমরা প্রেম ব্যানাজীর বাড়ি ঠিক করে রেখেছি।

তখন আমি ঐ গির্জাটা দেখিয়ে বললাম, গির্জার এত কাছে থেকেও তোমাদের এই রকম নির্লজ্জ ব্যবহার! তা শুনে একজন কি বলল জান? বলল, নীয়ারেস্ট টু চার্চ ইজ ফার্দেস্ট ফ্রম হেভেন। নির্লজ্জ যত সব!

এই পর্যন্ত বলে কেরী থামে।

তখন মৃত্যুঞ্জয় বলে, তবে এখন ঘুমোবে তাতে আর বিস্ময়ের কি আছে!

তখন কেরী বলল, কালকে আমি লাট কাউন্সিলের একজন মেম্বারকে সব খুলে বলেছি। সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, কাউন্সিলে ব্যাপারটা আজ তুলবে। তার পরে কেরী বলে, আশা করি আপাতত সব মিটে যাবে। কিন্তু রোগটার মূল খুব গভীরে।

রামরাম বসু বলে, যে রোগের মূল স্বভাবে তার নিরাময় সহজ, কিন্তু যে রোগের মূল চরিত্রে তা দুঃসাধ্য।

কথাটা ঠিক, বলে কেরী।

তার পরে প্রসঙ্গত মনস্তত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব এসে পড়ে।

কেরী বলে, কুসংস্কার সব দেশেই আছে, আমাদের দেশে আছে, তোমাদের দেশেও আছে। এই কলেজের একটা উদ্দেশ্য, সেই সব কুসংস্কার দূরীকরণ।

মৃত্যুঞ্জয় বলে, কিন্তু এ যে রোজাকে ভূতে পেয়ে বসল! এখানকার ছাত্ররা যদি এমন দুবৃত্ত হয়ে ওঠে, তবে তো চারদিক অন্ধকার!

অন্ধকার বলেই তো জ্ঞানের আলোর দরকার পণ্ডিত, স্বর্গে পাঠশালা অনাবশ্যক।

ঠিক বলেছ ডাকার কেরী-মৃত্যুঞ্জয় ডক্টর শব্দটাকে ডাক্তার উচ্চারণ করে—কিন্তু সর্বাঙ্গে ক্ষত, ওষুধ লাগাবে কোথায়?

মনের মধ্যে, পণ্ডিত, মনের মধ্যে-ঐ জায়গায় ওষুধ পড়লে তার গুণ সর্বানে ছড়িয়ে পড়বে। এই উদ্দেশ্যেই কলেজ স্থাপন করেছিল ওয়েলেসলি। আবার ক্ষতস্থানের বিবরণ সংগ্রহের জন্যেও ওয়েলেসলি আমার উপর ভারাপণ করেছিল। গঙ্গাসাগরে সন্তানবিসর্জন, সতীদাহ প্রথা প্রভৃতির প্রকৃত বিবরণ সংগ্রহের জন্য আমি আদি হয়েছিলাম। চারজন সহকর্মী নিয়ে ১৮০৪ সালে কলকাতার ত্রিশ মাইলের পরিধিতে সন্ধান করে আমার ধারণা হয় যে, বছরে প্রায় পঁচিশ হাজার প্রাণীকে হত্যা করা এয় এইভাবে। তার পরে আমার অনুরোধে তোমারই শাস্ত্র থেকে প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে, সন্তানবিসর্জন, সহমরণ প্রভৃতি শাস্ত্রানুমোদিত নয়।

রামনাথ বাচস্পতি একান্তে বসে নিম্নস্বরে বলে, আরম্ভ হল পাত্রীগিরি! শানুমোদিত নয়! কত শাস্ত্রই না পড়েছ!

বিদ্যালঙ্কার বলে, কিন্তু তাতে অবস্থার উন্নতি হল কই? তার পরেও তো পাঁচ ছ বছর অতিবাহিত হল!

হত না অতিবাহিত, জোরের সঙ্গে বলে কেরী, ওয়েলেসলি আমাদের রিপোর্ট আর তোমাদের বিধান পেয়ে স্থির করেছিল যে, আইন প্রণয়ন করে নিষিদ্ধ করবে সতীদাহ। সমস্ত প্রস্তুত, এমন সময়ে কাজে ইস্তফা দিয়ে লাটসাহেব চলে গেল বিলাতে।

তাই তো বলছি ডাক্তার কেরী–যথা পূর্বং তথা পরং। এখনও অবাধে চলছে সতীদাহ দেশের যত্রতত্র।

ব্যাকুলভাবে রাম বসু বলে ওঠে, এর কি কোন প্রতিকার নেই? তুমিই তো এইমাত্র বললে চরিত্রের মধ্যে যে রোগের মূল নিহিত, তা দুঃসাধ্য। দুঃসাধ্য, কিন্তু অসাধ্য নয়।

কে বলল অসাধ্য মুন্সী, তবে কঠিন। কিন্তু একথাও বলছি, তোমার আমার জীবনকালেই অবসান ঘটবে এই পাশবিক সংস্কারের। ওষুধ পড়তে শুরু করেছে।

কি ওষুধ? ইংরেজী শিক্ষা। আবার স্বগতভাবে বলে রামনাথ বাচস্পতি, ব্যাধির চেয়ে ঔষধ উৎকটতর।

কেরীর অভয়দানে রাম বসু যে উৎসাহ পেল এমন মনে হল না, বিষমুখে বসে রইল সে।

.

কলেজে অধ্যায়, কাজেই সকলে বাড়ি রওনা হয়।

রাম বসু বলে, বিদ্যালঙ্কার, চল তোমাকে একটু এগিয়ে দিই।

বেশ তো চল, দুটো কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে।

লালবাজার দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ওরা একটা সরু গলিপথে চলে, আগে মৃত্যুঞ্জয় পিছনে রাম বসু। রাম বসু লক্ষ্য করে বিদ্যালঙ্কারের চলবার ভঙ্গীটি। বাঁ পাখানা তার কিঞ্চিৎ বিকল, তাই লাঠি আর ডান পার জোরে বাঁ পা সুদ্ধ দেহটাকে হেঁচকা টান মেরে চালিয়ে নিয়ে যায় সে। রাম বসু দেখে, মেদবহুল দেহ সাদা আঙরাখার খাজে খাঁজে নিবিষ্ট; কাঁধের উপরে বিষ্ণুপুরী তসরের চাদর। মাথার চারপাশ কামানো, মাঝখানে গুচ্ছবদ্ধ চুল। তখন তার মনে পড়ে প্রশস্ত গড়ানে কপালে লিপ্ত আছে প্রাতঃকালের সন্ধ্যাজিকের চন্দনের হপ, সেই কপালের নীচে কাঁচা-পাকা ভুরুর তলায় জ্বলন্ত টিকার মত দুটি চোখ, জ্ঞানের একটুখানি হাওয়া লাগতেই উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে—আর দুই চোখের মাঝখানে বিন্ধ্যপর্বতের ব্যবধান সৃষ্টি করেছে মস্ত একটা শুকনাসা। প্রকাণ্ড চিবুক অদৃষ্টের উদ্যত ঘুষির মত সংসারকে যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করছে। রাম বসু মনে মনে ভাবে, আশ্চর্য এই লোকটি! তখনই মনে পড়ে এ বিস্ময়বোধ কেরীর মনেও জেগেছে। কেরী অনেকদিন বলেছে যে, পণ্ডিতকে দেখলে, তার পাণ্ডিত্য, বিপুল দেহ, স্কুলষ্টি, রাশভারী চালচলন দেখলে বিখ্যাত ডাক্তার জনসনকে মনে পড়ে যায়, যাকে বাল্যকালে একাধিকবার দেখেছে কেরী। কেরী বলত যে, ডাক্তার জনসনকে লোকে নিজেদের মধ্যে সশ্রদ্ধভাবে ‘ভালুক’ বলে অভিহিত করত। আর পণ্ডিত হচ্ছে হস্তী, একেবারে রাজহস্তী। রাম বস আবার ভাবে, আশ্চর্য এই লোকটি!

ততক্ষণে তারা চিৎপুর রোডে পড়ে পাশাপাশি চলতে শুরু করে।

হঠাৎ রাম বসু জিজ্ঞাসা করে, বিদ্যালঙ্কার, সহমরণ সম্বন্ধে শাস্ত্রীয় বিধান কি?

বিদ্যালঙ্কার বলে, দেখ বসুজা, শাস্ত্রে সবরকম কথাই আছে। ভিন্ন ভিন্ন যুগ অভিপ্রায় অনুসারে মনোমত উক্তি বেছে নেয়।

তার পরে সে বলে, এতদিন যুগ ছিল সতীদাহ-সমর্থক, এবারে যে যুগ পড়তে চলেছে তাতে বদল হবে ব্যাখ্যার, সতীদাহ আর চলবে না।

আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করে বসুজা, কিন্তু কবে বিদ্যালঙ্কার-কবে?

যুগের হাওয়া প্রবল হয়ে উঠলেই।

তুমি তো হিন্দুশাস্ত্র মহন করেছ, গোটা সুবে বাংলা জানে তোমাকে, মানে তোমাকে। ওঠাও হাওয়া।

না ভায়া, যার যা কাজ নয় তাকে দিয়ে তা হবার নয়। আমি জ্ঞানের কথা জানি, তা বলতে পারি। কিন্তু শুধু জ্ঞানে হাওয়া ওঠানো যায় না, তার জন্যে চাই শক্তি, চাই উদ্যম, চাই যুগযন্ত্রকে চালনা করবার কৌশল।

কোথায় পাব তেমন নোক? জিজ্ঞাসা করে বসুজা।

যাও তবে মানিকতলায়, খোঁজ করে দেখ দেওয়ানজী কলকাতায় আছেন কি না–ঐ রকম লোকের উপরেই যুগের মতিগতি নির্ভর করছে।

বেশ, তাই যাব, আগামীকাল রবিবার। তার পরে কতকটা স্বগতভাবেই যেন রাম বসু বলে ওঠে, জ্ঞানের কথাও শুনলাম, শক্তির কথাও শুনলাম—কিন্তু হৃদয়ের কথা?

স্বগত উক্তির স্বগত উত্তর দেয় মৃত্যুঞ্জয়, বলে—হৃদয়ের কথা হৃদয় জানে, অপরে কি জানবে!

কথাটির উত্তর দেয় না রাম বসু।

মৃত্যুঞ্জয় বলে, ভায়া, আর নয়, অনেকদূর এসে পড়েছ, এবারে ফেরো।

তখন দুইজন দুই ভিন্ন পথ অবলম্বন করে।

————-
* পাঠক, এটি লেখকের কল্পনা নয়। সেকালে কলকাতার শ্বেতাঙ্গ-সমাজের ইতিহাসে একাধিক strike-এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। অবশ্য ধর্মঘট নামটি তখন ব্যবহৃত হত না।

.

৫.২ দশ বছরের কথা

রামরাম বসু বাড়ি ফিরতেই নরু বলে উঠল, বাবা, দেখসে কে এসেছে!

এই ভরসন্ধ্যায় আবার কে এল রে-বলে গৃহান্তরে গিয়ে চমকে ওঠে সে, বলে, একি টুশকি, তুই কখন এলি, কার সঙ্গে এলি, তোর দিদিমা কই রে?

টুশকি হেসে বলে, দাঁড়াও কায়েৎ দা, আগে প্রণাম করে নিই, তার পরে একে একে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।

প্রণামাদির পরে দুজনে বসল, রাম বসু বলল, এবারে সব খুলে বল্ তো, আগে বল মোদাবুড়ি কোথায়?

টুশকি চোখ মুছতে মুছতে বলল, গোবিন্দজী তাকে পায়ে ঠাই দিয়েছেন।

বলিস কি রে। এ কতদিনকার কথা?

তা চার-পাঁচ মাস হল বইকি। তখন ভাবলাম, গোবিজীর চরণে ঠাঁই পাব এমন ভাগ্য কি করেছি! ভাবলাম, পাই আর না পাই পা দুখানা জড়িয়ে ধরেই পড়ে থাকব। কিন্তু তার আগে একবার কায়েৎ দাকে, নরুকে আর ন্যাড়াকে শেষ দেখা দেখে আসি।

তা এসেছিস বোন বেশ করেছি। কিন্তু এলি কার সঙ্গে?

গোবিন্দজী সেথো জুটিয়ে দিলেন, নইলে শ্রীধাম বৃন্দাবন থেকে কলকাতায় কি একা আসতে পারি।

তার পরে সে বলে, কিছুদিন হল ভেঙে পড়েছিল দিদিমার শরীর। আর শরীরের কি দোষ বল, দিবারাত্রি ধ্যান-জ্ঞান রেশমী, দিবারাত্রি মুখে রেশমী নাম। নাওয়া নেই খাওয়া নেই, ঐ চিন্তা আর ঐ নাম। আমি বলি, দিদিমা, একবার গোবিন্দজীর নাম কর, রাধাকৃষ্ণর কথা ভাব, মহাপ্রভুকে স্মরণ করতে বললে দিদিমা কি বলে জান? বলে, কেমন করে করব দিদি, ঐ সর্বনাশী যে সব ভুলিয়ে দিল। বলে যে, রাধাকৃষ্ণের নাম করব বলে বসি-ঐ নামটা মুখে বেরিয়ে পড়ে, ঐ মুখ মনে ভেসে ওঠে। তার পরে ডুকরে কেঁদে ওঠে, সর্বনাশী, সর্বনাশী, এমন করে সর্বনাশ করে যেতে হয়!

টুশকি বলে যায়, ভেঙে পড়ল শরীর, অবশেষে নাম জপতে জপতে—বিশ্বাস কর কায়েৎ দাকান পেতে শুনেছি রাধাকৃষ্ণ নাম নয়, রেশমী রেশমী জপতে জপতে গোবিন্দজীর পাদপদ্মে দেহরক্ষা করল দিদিমা।

তার পরে হঠাৎ বলে ওঠে, অন্তিম কালে রেশমী নামে কি সদগতি হবে?

কেন হবে না রে পাগলী! শুনিস নি ভগবানের অসংখ্য নাম, ভালবাসার লোকের নামও যে তাঁর নাম। শোন বোন, অনেক বয়স হল, এখন বুঝেছি এই যে নদী পার হওয়াটাই আসল কথা, কে কোন্ নৌকায় পার হল তাতে কি আসে যায়। বিমঙ্গল ঠাকুর মৃতদেহ আঁকড়ে নদী পার হয়েছিল।

কিন্তু যার ভাগ্যে মৃতদেহটাও জোটে না?

রাম বসু বুঝল, কত গভীর নৈরাশ্য টুশকির ঐ উক্তিতে।

বসুজা বলল, সে চোখ বুজে ঝাঁপ দিক নদীতে, মনে ভক্তি থাকলে নদীর ঢেউ মায়ের কোলের মত দোলাতে দোলাতে তাকে নিয়ে যাবে ওপারে।

রাম বসুর কথা শুনে টুশকি বলে ওঠে, কায়েৎ দা, তোমার খুব পরিবর্তন হয়েছে।

হবে না তো কি! দশ বছর কি কম সময়! তার পরে বলে, যা এখন খেয়ে শো গে। খুব ক্লান্ত হয়েছিস, রাতও হয়েছে অনেক।

.

বিছানায় শুয়ে রাম বসুর নিজের কথাটা মনে পড়ে। ভাবে, হবে না পরিবর্তন, দশ বৎসর কি কম সময়?

সত্যই দশ বৎসর কম সময় নয়, তার উপরে যদি আবার ঘটনার গুরুত্ব চাপে, তবে দশ বৎসর শতাব্দীর ব্যবধান লাভ করে। দশ বৎসর অদৃষ্ট রাম বসুকে ঢেলে সেজেছে—মালমশলা সেই আগেরই, সজ্জাটা নৃতন।

সেদিনের কথা কি সে কখনও ভুলবে? এ জন্যে তো নয়। জন্মান্তরে কি হবে জানে না সে। খুব সম্ভব জন্মান্তরের দিগন্তকে মাঝে মাঝে হঠাৎ-আলোয় চমকে দেবে রেশমীদাহের উষ্কার-শিখা। এখনও চোখ মুদ্রিত করলেই সে দেখতে পায় অসহায় বীরের মত জনের প্রচন্ড প্রচেষ্টা, দেখতে পায় ন্যাড়ার আকুলিবিকুলি, টুশকির মাথা কুটে মরা, আর উদভ্রান্ত জনতার হায় হায় ধনি। সকলে অবাক হয়ে গিয়েছিল সে নিজেও কম অবাক হয় নি—নিজের পুত্তলিকাবৎ স্থাণুতায়। অল্প দুঃখেরই প্রকাশ সম্ভব, মহৎ দুঃখ অপ্রকট। সানুদেশের তুষার গলে, শিখরের তুষার অটল।

রাম বসু ভাবে, ওদের আর কি গেল, কতটুকু ক্ষতি হল ওদের! জনের প্রিয়া গেল, টুশকির ভগ্নী গেল, ন্যাড়ার রেশমীদি গেল—কিন্তু তার নিজের? তার জীবনের সমস্ত আশা, স্বপ্ন, কল্পনা ঘূর্ণমান হয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল যে সুমেরুশিখরে, সেই সোনার লঙ্কা যে পুডে নিঃশেষ হয়ে গেল। তার আর থাকল কি? ক্ষতির দুঃসহতা বোঝবার জন্যে থাকল কেবল সে নিজে। রাম বসু অনেক দিন মনে মনে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে চেষ্টা করেছে রেশমীর সঙ্গে তার সম্বন্ধটা। তার মনে হয়েছে যে, সে সম্বন্ধটা কামজ নয়, প্রেমজ নয়, রক্তের বা সমাজের নয়—এ যেন একটা দিব্য অলৌকিক ভাব। এ যেন চাঁদের সঙ্গে সমুদ্রের আকর্ষণ-বিকর্ষণের যোগাযোগ। চাঁদের টানে সমুদ্র উদ্বেল হয়ে ওঠে, জোয়ারের ধাপে ধাপে এগিয়ে চন্দ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু সে হাত কখনও স্পর্শ করতে পারে না চন্দ্রমাকে। অপ্রাপ্যতার উচ্চাকাশে বসে রসিযে তোলে সমুদ্রের মন রহস্যময় সুধাকর। রেশমী চন্দ্রমা, রাম বসু পারাবার। দশ বৎসর আগে তার গগন ভুবন জীবন চির-অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে সে চাঁদ অস্তমিত হয়েছে অগ্নিশিখার দিগন্তে। তার পর থেকে অনুম্বেল নিস্তরঙ্গ একটানা সমুদ্র জনান্তিকে প্রলাপরত, তার ধনি এখন চিন্তার মত নীরব, নিজের কানেই পৌঁছতে চায় না।

মদনাবাটির সেই ব্যর্থ অভিসারের অভিজ্ঞতায় রাম বসু বুঝেছিল যে, ও মেয়ে হাতে পাওয়ার নয়। দুষ্প্রাপ্যতার কুয়াশায় সে হয়ে উঠল আরও লোভনীয়, আরও রমণীয়, আরও রহস্যময়। তার পর থেকে তাকে কেন্দ্র করে ঘুরে মরছে রাম বসুর জীবন। গ্রীক পুরাণের কাহিনী সে পড়েছিল, বুঝেছিল যে, গ্রীসের সমস্ত কল্পনা সংহত হয়ে জ্বলে উঠেছিল একটি পাবকশিখারূপে, সে হচ্ছে হেলেন। গ্রীসের কাব্য পুরাণ জীবন ঐ পাবকশিখার চারদিকে মুমূর্ষ পতঙ্গের মত ঘুরে মরেছে। ঘুরে মরেছে এই দশ বছর রাম বসুর জীবন রেশমীর চারদিকে। যখন সে বেঁচে ছিল তখন তার আকর্ষণ প্রবল ছিল, মৃত্যুর পরে সে আকর্ষণ হয়েছে প্রবলতর। রূপজ কামজ সম্বন্ধের এ প্রকৃতি তো নয় এমন কি প্রেমজ সম্বন্ধেরও বুঝি নয়। এ আর কি। ভাল করে বুঝতে পারে না সে কি এ। কতদিন বুঝতে চেষ্টা করেছে, পারে নি। আজ যখন টুশকি এল সেই পুরনো দিনের হাওয়া পালে নিয়ে, তখন সেই দমকা বাতাসে তার মনের গুটানো নিশান খুলে গিয়ে বিস্ফারিত হল অতীতের দিকে ইঙ্গিতপরায়ণ চেলালের একমাত্র লক্ষ্য রেশমী। সে মনে মনে জপ করতে থাকে-রেশমী, রেশমী, রেশমী। তার পরে কখন ঘুমিয়ে পড়ে।

.

রাম বসু বলে, টুশকি এসেছিস, আর তোর বৃন্দাবনে ফিরে গিয়ে কাজ নেই, আমার কাছে থেকে যা।

সে বলে, কায়েৎ দা, এ কেমন বিচার? লোকে শেষ বয়সটা তীর্থে কাটায়, আর আমি কিনা মাঝবয়সটা তীর্থে কাটিয়ে শেষ বয়সে মরব কলকাতা শহরে!

কেন রে, কালীঘাট, গঙ্গাতীর, এ কি তীর্থ নয়?

অমন কথা কি মুখে আনতে আছে, ছি! এই বলে মাথায় হাত ঠেকিয়ে সে বলে, কার তীর্থ কোন্‌খানে কে বলতে পারে? গোবিন্দজী যে আমাকে টেনেছেন।

না রে পাগলী, গোবিন্দজী নয়, মোকদা বুড়ি টেনে রেখেছিল তোকে। যেমনি সে মরেছে অমনি টান ছুটে গিয়েছে, ছুটে এসেছিস কলকাতায়।

।টুশকি বলে, সত্যিকার পাপ মনেরও অগোচর। তোমার কথাই বুঝি সত্যি!

তবে আর কি, এখানে থেকে যা। আমারও তো সংসার দেখবার জন্যে একটা লোকের দরকার।

আবার বাঁধবে আমাকে সংসারে? কেন, তোমার লোকের অভাব কি? নরুর বিয়ে দাও, লোকের অভাব দূর হবে।

আরে সেজন্যে তো একটা লোকের দরকার। আমার কি পাত্রী দেখে বেড়াবার সময় আছে!

তোমার কথা কবে ঠেলেছি কায়েৎ দা, কিন্তু তার আগে একবার জোড়ামড় যেতে চাই যে।

কেন রে, সেখানে কেন?

বল কি, জন্মগ্রাম, দেখতে ইচ্ছা যায় না?

অমনি চণ্ডী বক্সীর হুড়োটাও খেতে ইচ্ছা যায়, কি বলিস?

চণ্ডী খুড়ো কি এখনও জীবিত আছেন?

শুধু জীবিত! বেশ বহাল তবিয়তে আছে। দুষ্ট লোক দীর্ঘজীবী হয়, জানিস না?

টুশকি বলে, তা খুড়ো বেঁচে থাকে থাকুক, আমি একবার গাঁয়ে গেলে তার আপত্তি হবে কেন?

আলবৎ হবে। তোদর বিষয়-সম্পত্তি ভোগ করছে, আর তুই গেলে তার আপত্তি হবে না? কি যে বলিস! না, ও মতলব তুই ছেড়ে দে।

তখন টুশকি সাময়িকভাবে পরাজয় স্বীকার করে বলে, না হয় না-ই যাব, কিন্তু তুমি এত সকালে কোথায় চললে, আজ ত তোমাদের ছুটি।

রাম বসু সংক্ষেপে বলে, কলেজ নেই, কিন্তু অন্য একটা কাজ আছে, একবার মানিকতলার দিকে যাব একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।

ফিরতে খুব দেরি ক’র না। তোমার স্বভাব, মনের মতন লোকের দেখা পেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে বসে থাক!

রাম বসু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, মনের মতন লোকের দেখা দশ বছরের মধ্যে পাই। নি রে, নাওয়া-খাওয়ার আর ভুল হয় না।

এই বলে সে হাসল। সে হাসিতে টেনে বের করল টুশকির হাসি। কিন্তু দুটি হাসিই বড় স্নান, ওর চেয়ে চোখের জলের উজ্জ্বলতাও বুঝি বেশি।

শীগগির ফিরে আসছি, বলে ছাতা আর চাদর নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রামরাম বসু।

জানবাজার সড়ক ধরে খানিকটা পুব দিকে চলে মারাঠা খাল বোজানো বাহার সড়ক নামে নূতন যে রাস্তা তৈরি হয়েছে তাই ধরে বরাবর উত্তরমুখে চলতে শুরু করল রাম বসু। দেখতে পেল রাস্তার ডানদিকে খালের মধ্যে বড় বড় সব নৌকা বাধা; সেগুলো আসছে সুন্দরবন থেকে, জ্বালানী কাঠ, হরিণের চামড়া আর মধুর জালায় ভর্তি। এসব তার চোখে পড়লেও মনটা ছিল অন্য বিষয়ে নিমগ্ন। সে সিদ্ধান্ত করেছিল যে রেশমীর মৃত্যুর মূল কারণ সহমরণ প্রথা। সহমরণ প্রথা এমন নিষ্ঠুর ব্যাপকতা লাভ না করলে রেশমীর জীবন স্বাভাবিক খাতে প্রবাহিত হত। সে ভাবে, রেশমী না হয় অকালে বিধবা হয়েছিল, কিন্তু তাই বলে স্বামীর চিতায় উঠতে বাধ্য হবে কেন? অবশ্য চিতা থেকে সে পালিয়েছিল সত্য, কিন্তু কোথায় তার মনের কোন অগোচরে অগ্নি তার জ্বালাময় দাবির স্বাক্ষর রেখে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অগ্নিই তার গ্রাস পুনরায় গ্রহণ করল। কিন্তু কেবল অগ্নিই সক্রিয় আর রেশমী নিষ্ক্রিয় ছিল, একথা আর সে ভাবতে পারে না। রাম বসুর ধারণা হয়েছিল যে অগ্নির দাবিই রেশমীকে প্ররোচিত করেছিল বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতে। যেদিন সে কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ দাঁড়িয়ে সেই অগ্নিদাহ লক্ষ্য করেছিল, সেইদিনই কথাটা তার মনের মধ্যে ঝলক দিয়ে উঠেছিল। তার পরে দশ বৎসর ধরে সেই নিদারুণ শোক লালিত হয়েছে স্মৃতিতে। স্মৃতি থেকে এসেছে চিন্তায়, চিন্তা থেকে চেষ্টায়-সহমরণ প্রথা উঠিয়ে দিতে হবে, রেশমীর মত আর কেউ যেন চিতায় মরতে না বাধ্য হয়। সে জানে রেশমী আর ফিরবে না, কিন্তু সহমরণের চিতানল দেশ থেকে নিভে গেলে রেশমীর আত্মা শান্তি পাবে—এমনিধারা একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল বসুজার মনে। কত পণ্ডিতের কাছে যাতায়াত করেছে মীমাংসার আশায়, কেউ প্রশ্রয় দেয় নি; কেউ খ্রীষ্টান বলে তাড়িয়ে দিয়েছে, বলেছে, তোমার কথা শুনলেও পাপ। শেষ পর্যন্ত সহায় পেল মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারকে। বিদ্যালঙ্কার বলল, এ প্রথা শাস্ত্রানুমোদিত নয়, কিন্তু—ঐ কিন্তুতে এসে সব ঠেকে গিয়েছে। ‘কিন্তু’, ‘যদি’ এরা সব রত্মাকরের অনুচর, সমস্ত শুভ সঙ্কল্পের মোড়ে দাঁড়িয়ে দুঃসাহসী পথিককে লাঠির ঘায়ে ধরাশায়ী করে ফেলে। কিন্তু ধরাশায়ী হওয়ার লোক রাম বসু নয়। এখন চলেছে সে দ্রুতপদে অনেক আশা নিয়ে রামমোহনের কাছে, দেখা যাক তার কাছে ‘কিন্তু’র প্রতিষেধক পাওয়া যায় কিনা।

অবশেষে মাইলদেড়েক পথ চলবার পরে মানিকতলায় এসে উপস্থিত হল রাম। বসু। রাস্তার বাঁ-ধারে গেটওয়ালা প্রকাও বাড়িটা সহজেই চিনতে পারল, প্রবেশ করল বাড়ির বিস্তৃত হাতার মধ্যে।

একজন চাপরাসধারী ভিসা করল, কাকে চান?

দেওয়ানজীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

সে সসম্ভ্রমে বলল, আসুন আমার সঙ্গে।

দেওয়ানজীর দ্বার অবারিত।

.

৫.৩ দেওয়ানজী

দারোয়ানের সঙ্গে চলল রাম বসু। প্রকাও হাতার মধ্যে ফলের বাগান, বাগানের মাঝখানে একতলা ছডানো মস্ত বাড়ি। বাড়ির পিছন দিকে পৌঁছে রাম বসু দেখল যে সেখানেও নানাজাতীয় ফলের গাছ। এমন সময়ে নজরে পড়ল মাঝারি আয়তনের একটা পুকুরের পাশে বড় একটা লিচু গাছের ছায়ায় শ্বেতপাথরের জলচৌকির উপরে আসীন রামমোহন, দুজন পশ্চিমে বেহারা তৈল মর্দন করছে তার গায়ে। এর আগে সে বার কয়েক রামমোহনকে দেখেছে, সামান্য মুখচেনাও ছিল। তখন দেখেছে তাঁকে বাইরের পোশাকে, শালের চোগা-চাপকানে মণ্ডিত। এখন খালি গায়ে, খাটো তেলধুতি-পরা অবস্থায় দেখে তার ভারি মজা লাগল। দূরে থেকেই চোখে পড়ে দেহের বিপুল পালোয়ানী আয়তন। আবার মনে পড়ল রঘুবংশে পড়া দিলীপের চেহারার বর্ণনা। মনে মনে সে বলে উঠল, একেই বৃটোরস্ক, বৃষস্কন্ধ বলে বটে।

রামমোহনের কাছে গিয়ে প্রণাম করতে উদ্যত হলে তিনি বলে উঠলেন, না না, তৈলাক্তদেহে প্রণাম গ্রহণ করতে নেই। ব’স বেরাদার ওখানে।

এই বলে তিনি একখানা জলচৌকি দেখিয়ে দিলেন।

রাম বসু বলে উঠল-বড় অসময়ে এসে পড়লাম।

কিছু না, কিছু না, সব সময়ই সুসময়। তাছাড়া অতিথি যদি সময় বিচার করে আসবে, তবে আর তাকে অতিথি বলেছে কেন?

একটু থেমে শুধালেন, কেমন, আর গীত রচনা করলে?

সলজ্জ হাসিতে বসুজা বলল, আজ্ঞে না, আর নূতন কিছু রচনা করি নি।

কয়েক বছর আগে একটা স্বরচিত “যীশ-সঙ্গীত”-কে “ব্রহ্ম-সঙ্গীত” বলে শুনিয়ে গিয়েছিল সে। বিশেষ আয়াস করতে হয় নি, “যীশু” শব্দের বদলে “ব্ৰহ্ম” শব্দটি বসিয়ে দিয়েছিল মাত্র। রামমোহন খুব প্রশংসা করেছিলেন গীতটির।

এবারে রামমোহন বললেন, বসুজা, তোমার প্রতাপাদিত্য-চরিত বইখানা পড়েছি।

সে ভয়ে ভয়ে শুধায়, কেমন লাগল?

বসুজা জানে, বাংলা ভাষায় আঁচড় কাটলেই ইংরেজ পাত্রী প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। কিন্তু এ ইংরেজ পাত্রী নয়, শিক্ষিত বাঙালী, তাও আবার একেবারে বাথ ভালুক।

রামমোহন বলেন, ও বই তুমি ছাড়া আর কেউ লিখতে পারত না-ওর মধ্যে কাহিনীর আকর্ষণ সঞ্চারিত করে দিতে পেরেই। ওটা মস্ত গুণ। কিন্তু কি জান, ওটা জীবনচরিত হয় নি, হয়েছে ইতিহাস।

পাছে বসুজা নিরুৎসাহিত হয়, তাই শুধরে নিয়ে বললেন, তা হক, বাংলা গদ্যের প্রথম রচনা হিসাবে বইখানা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

তার চেয়ে আর বেশি কি আশা করতে পারি দেওয়ানজী!

তোমরা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যে-কাজ করহ তার তুলনা নেই। কোম্পানি ভাবছে রাইটারদের বাংলা ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা হচ্ছে, পাত্রীরা ভাবছে বাইবেল অনুবাদের যোগ্য ভাষা তৈরি হয়ে উঠেছে, কিন্তু হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি।

রামমোহন বলে যান, বেহারারা সশব্দে উদার বক্ষে, প্রশস্ত পৃষ্ঠে, যুগন্ধর স্কন্ধে সশব্দে তৈল মর্দন করে আর রাম বসু লক্ষ্য করে রামমোহদের দেহের সৌষ্ঠব ও বৈশিষ্ট্য। সে লক্ষ্য করে মখমণ্ডলের অনুপাতে চোখ দুটি ছোট, কিন্তু উজ্জ্বল, অথচ কেমন একটি স্নিগ্ধ ভাব তাতে, রৌদ্রভাস্বর জলের উপরে স্নেহপদার্থ বিস্তারিত। সরল নাসিকাটির মাঝখানে একটুখানি অতর্কিত উচ্চতা, উপরের পাটির সম্মুখের একটা দাঁত ঈষৎ ভগ্ন, চিবুকের নীচে চওড়া কাটা দাগ।

বসু বোঝে, মনে মনে হাসে-বাল্যকালে খুব শান্তশিষ্ট ছিল দেওয়ানজী!

রামমোহন যোগ) শ্রোতা পেয়ে বলে যান, আর যোগ্য দর্শনীয় পেয়ে রাম বসু লক্ষ্য করে যায়-ঘোট ঘোট কান দুটো দেহের সঙ্গে সংলগ্ন, তৈলচিক্কণ লম্বিত বাবরি, রোমশ বক্ষস্থল, আর হাঁ, যুগের অর্গল উন্মুক্ত করবার উপযুক্ত সুস্পষ্ট সুদীর্ঘ বাহুদ্বয়, আর সেই বাহুর প্রান্তে রক্তাভ করতলের সঙ্গে যুক্ত সুঠাম সুডৌল অঙ্গুলিগুলি। ডান হাতের অনামিকায় উজ্জ্বল রক্তিম পলার আঙটি; বাম হাতের অনামিকায় অঙ্গুরীয়টি শাখার। গলায় মালাকারে দোদুল্যমান শুভ্র সূক্ষ্ম উপবীত।

আশ্চর্য ঐ লোকটি কেরী! জ্ঞান, কর্ম, হৃদয়বত্তার এমন শুভ যোগাযোগ বিরল। বলে যান রামমোহন, বিধাতা কাকে দিয়ে কোথায় যে কি কাজ করিয়ে নেন, মানুষের সাধ্য কি বোঝে! বিধাতা এক হাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ক্লাইভকে আর এক হাতে পাঠিয়ে দিলেন কেরীকে, এক হাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন হেস্টিংসকে, আর এক হাতে পাঠিয়ে দিলেন হেয়ারকে, দুই হাত লাগিয়েছেন তিনি এদেশকে জাগাবার কাজে। ক্লাইভ, হেস্টিংস এদেশকে বাঁধছে শাসনের জালে, আর কেরী, হেয়ার এদেশকে মুক্তি দিচ্ছে আত্মার অধিকারে। বন্ধনে আর মুক্তিতে কেমন সহযোগিতা করে চলেছে, লক্ষ্য করেছ কি?

এত কথা বাম বসু ভাবে নি, তখনকার দিনে কেউ ভাবত না-তাই সে চুপ করে থাকল।

দেখছ না, বাংলা ভাষা গড়ে উঠছে, ইংরেজী শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে, আবার চাই কি! দেখতে দেখতে যাবতীয় কুসংস্কার, গঙ্গাসাগরে সন্তানবিসর্জন, সতীদাহ, পৌত্তলিক হিন্দুধর্ম প্রাচীন যুগের ভূতের মত দূর হয়ে যাবে। নিশ্চয় যাবে বসুজা, নিশ্চয় যাবে; দেখছ না, চারিদিকের সব দরজা-জানলা যে খুলে গিয়েছে, পশ্চিমের হাওয়া ঘরের মধ্যে ঘুম ভাঙিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিয়েছে। পালে লেগেছে হাওয়া, এবারে হাল ধরে লক্ষ্য স্থির করে ধৈর্য ধরে বসে থাকা আবশ্যক। ধৈর্য চাই বসুজা-ধৈর্য চাই।

রাম বসুর মনটা দমে যায়, বিদ্যালঙ্কার বলেছিল ধৈর্য চাই, এখানেও সেই কথা ধৈর্য চাই–ধৈর্য চাই। কিন্তু মানুষের আয়ু যে পরিমিত, আর কতদিন বাঁচব, ভাবে রাম বসু। রেশমীর আত্মার তৃপ্তি না দেখেই কি তবে তাকে মরতে হবে। সে ভাবে-ধৈর্য দেবতার, ত্বরা মানুষের।

কিন্তু মনের কথা মনে চেপে রেখে রামমোহনকে সমর্থন করে সে বলে, আপনি যা বললেন তা সত্য। কেরী, হেয়ার প্রভৃতি পাঁচজন গোরাকে স্মরণ করে ‘পঞ্চকন্যা শ্লোকের অদির্শে লোকে এখন বলে থাকে

“হেয়ার কম্বিন পামরশ্চ
কেরী মার্শমেনস্তথা
পঞ্চগোরা স্মরেন্নিত্যং
মহাপাতকনাশনং।”

রামমোহন বিস্ময়ে বলে ওঠেন, বাঃ বাঃ, বেশ লিখেছে তো, বলে তিনি শ্লোকটার পুনরাবৃত্তি করেন।

রাম বসু অবাক হয়ে যায় রামমোহনের স্মৃতিশক্তি দেখে।

তার পরে রামমোহন বলেন, তুমি একটা শ্লোক শোনালে, আমি তবে একটা শোনাই শোন–

“সুরাই মেলের কুল,
বেটার বাড়ি খানাকুল,
ওঁ তৎসৎ বলে বেটা
বানিয়েছে এক স্কুল!
ও সে জেতের দফা করলে রফা,
মজলে তিন কুল।”

শ্লোকটা যে রামমোহন সম্বন্ধে–শুনেই বুঝল রাম বসু, কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে সে বলল, ও সব বাজে লোকের কথা ছেড়ে দিন দেওয়ানজী।

মিছে লজ্জা পাচ্ছ মুন্সী, আমি কি ও সব লোকের কথার মূল্য দেওয়ার বান্দা! তুমি একটা শ্লোক শোনালে তাই আমিও শুনিয়ে দিলাম—এই আর কি। তবে কি জান, আমার সঙ্গে বহু বিশিষ্ট লোক আছেন যারা আমার ডান হাত বাঁ হাত। আছেন দ্বারিক ঠাকুর, কালীনাথ রায়, রামকৃষ্ণ সিংহ, তেলিনীপাড়ার অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়-আরও কতজন।

তার পরে তিনি বলেন, আশার কথা হচ্ছে এই যে, নৃতন যুগের হাওয়া উঠেছে, একে থামায় এমন সাধ্য কারও নেই। প্রথমেই লাগতে হবে সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে।

আবেগের সঙ্গে মুন্সী বলে ওঠে, আগুন দেওয়ানজী লাগুন, বুকের মধ্যে নিত্য আগুন জ্বলছে।

এই তো চাই মুন্সী, দেশের আগুন বুকের মধ্যে অনুভব করলে আর ভাবনার কারণ থাকে না। আমার বুকে আগুনের জ্বালা বড় অল্প নয়, এই ক’মাস আগে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃবধূ সহমৃতা হয়েছেন।

বিদ্যালঙ্কারের কথার প্রতিধ্বনি করে রাম বসু বলে, দেশব্যাপী এ প্রথা দূর করতে হলে চাই উদ্যম, কর্মকৌশল, চাই যুগযন্ত্রটাকে চালনা করার পারদর্শিতা, শুধু জ্ঞানে কিছু হবে না। তেমন লোক তো আপনাকে ছাড়া দেখি নে।

দাঁড়াও, আগে কলকাতায় এসে স্থায়ী হয়ে বসি, তার পর লড়াই শুরু করব নারীভক দানবটার সঙ্গে।

এমন সময়ে একজন চাকর শ্বেতপাথরের থালায় মিষ্টি ও ফল আর তেপাথরের বাটিতে তরমুজের শরবৎ নিয়ে এসে দাঁড়াল।

রাম বসু বলে উঠল, এ সব আবার অসময়ে কেন, অসুখ হবে যে।

রামমোহন বললেন, আর মিষ্টিমুখ না করে গেলে গেরস্তর অকল্যাণ হবে না? নাও, তুমি ওগুলো মুখে দিয়ে মুখ চালাও, আমি বকতে বকতে মুখ চালাই।

রাম বসু খেতে শুরু করে, রামমোহন তাঁর ভবিষ্যৎ সমাজসংস্কার-পরিকল্পনা সম্বন্ধে বলে যান।

রাম বসু খেতে খেতে লক্ষ্য করে রামমোহনের নগ্নকান্তি। সে ভাবে, পোশাক পরিচ্ছদ খুলে নিলে অধিকাংশ মানুষকে পালক-ছাড়ানো মুরগীর মত দেখায়। অথচ এঁকে! পোশাক-পরিচ্ছদে যেন এঁর প্রকৃত বিভূতি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তার মন বলে ওঠে, বিনা ভূষণে যাকে মহৎ মনে হয় মহাপুরুষ বলি তাকে।

বুঝলে বসুজা, রংপুরের কালেকটার ডিগবি সাহেব ছাড়তে চান না আমাকে; বলেন, দেওয়ান, তুমি গেলে আর একজন দেওয়ান অনায়াসে পাব কিন্তু আর একজন রামমোহন তো মিলবে না। তিনি বলেন, সমাজ-সংস্কার করতে চাও, বেশ তো, রংপুরে আরম্ভ কর না কেন, এখানকার প্রয়োজন তো অল্প নয়। বুঝলে বসুজা, আমি তাঁকে অনেক বলে-কয়ে রাজী করেছি, আর বড়জোর তিন-চার বছর থাকব ওখানে। তার পরে চলে এসে স্থায়ীভাবে বসব কলকাতায়। তখন তোমাদের নিয়ে শুরু করে দেব লড়াই।

নৈরাশ্য চেপে শোনে রাম বসু। রামমোহন বলেন, আমাদের একদিকে শত্ৰ পাদ্রীর দল আর একদিকে শত্র ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের দল। দো-হাত্তা লড়াই করতে হবে আমাদের। ধৈর্য ধর বসু, ধৈর্য ধর, সময়ে সব হবে।

সময়ে সব হবে কিন্তু এ জীর্ণ খাঁচাটা কি আর ততদিন টিকবে, ভাবে বসুজা।

অবশেষে বিদায় নিয়ে উঠে পড়ে রাম বসু। রামমোহন বলেন, মাঝে মাঝে এসো হে, তোমাদের মত উৎসাহী লোক আছে জানলে মনে বল পাওয়া যায়। আর বাংলা লেখার অভ্যাসটা ছেডো না। ফিরে এসে বসি না, আমিও শুরু করব বাংলা রচনা। আরবী-ফারসীতে মনের কথা প্রকাশ করে তৃপ্তি হয় না।

.

রাম বসু বাহার সড়ক ধরে বাড়ি ফেরে। এবারে তার গতি মন্থর, পদক্ষেপ ক্লান্ত। অনেক আশা-ভরসা নিয়ে এসেছিল সে, অপেক্ষা করার উপদেশ পেয়ে মন গেল ভেঙে। জ্ঞানের প্রেরণা যার, কর্মের প্রেরণা যার সে পারে অপেক্ষা করতে, কিন্তু মনে যার আগুন জ্বলছে তার পক্ষে সময়ক্ষেপ যে অসহ্য। দীর্ঘনিশ্বাসে বেরিয়ে আসে বুকের তাপ।

এমন সময়ে সে শুনতে পেল কে যেন ডাকছে, হ্যালো মুন্সী, হ্যালো মুন্সী!

কে ডাকে? পিছনে ফিরে দেখল মেরিডিথ আসছে ফিটন হাঁকিয়ে।

ফিটন কাছে এসে পড়লে মেরিডিথ বলল, মুন্সী, উঠে বস, অনেক কথা আছে। সম্প্রতি জনের চিঠি পেয়েছি।

জনের নাম শুনে আগ্রহে ফিটনে চাপে মুন্সী।

তারপর মুন্সী, অনেককাল তোমাকে দেখি নি। কিন্তু এ কি, একবারে যে ভেঙে পডেছ!

মুন্সী হেসে বলে, ব্যস তো হল।

এমন আর কি বয়স হয়েছে তোমার?

তা মন্দ আর কি, পঞ্চান্ন পেরিয়েছে।

পঞ্চান্ন এমন কিছু বেশি নয়, কিন্তু এ যে হঠাৎ বুড়িয়ে গিয়েছ, মুখ-চোখের চেহারা আগুনে ঝলসানো গাছের মত।

রাম বসু ভাবে, আগুনে ঝলসানো গাছই বটে। প্রকাশ্যে বলে, এখন জনের খবর বল, কোথায় আছে, কেমন আছে, কবে ফিরবে খুলে বল! আহা, বেচারার জন্যে বড় দুঃখ হয়।

এবারে আবার পূর্বকথা উত্থাপন করতে হল। রেশমীর মৃত্যুর পরে জন কোম্পানির চাকরি নিয়ে বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে চলে গেল। লিজা অনেক কাকুতি-মিনতি, অনেক উপরোধ-অনুরোধ করেছিল, চোখের জলও কম ফেলে নি–কিন্তু জনের সঙ্কল্প টলল না।

লিজা বলল, জন, বিয়ে করে সংসারী হও।

জন বলল, বার বার তিনবার তো পরীক্ষা হল, আর কেন? বিয়ে আমার জন্যে নয়।

লিজার মনে পড়ে কেটি, রোজ এলমার, রেশমীর কথা।

এ সব বিষয়-সম্পত্তি ভোগ করবে কে?

লিজা, তুমি ভোগ করবে, আর কখনও যদি আমি ফিরে আসি, আমিও ভোগ করব।

নির্বোধ জন বোম্বাই যাত্রার আগে একটি বুদ্ধির কাজ করল, মেরিডিথের সঙ্গে লিজার বিয়ে দিয়ে দিল। সে মেরিডিথকে বলল, ফেও, আমার বোনটিকে তোমাকে দিয়ে গেলুম, এর চেয়ে মূল্যবান আমার আর কিছু নেই, ওর অযত্ন কর না, এমন নারীর বিরল।

মেরিডিথ কোন কথা না বলে সজোরে তাব করমর্দন করে প্রত্যুত্তর দিল।

জন পুনার ইংরেজ রেসিডেন্টের এডিকং।

এখানে একটু এগিযে পরের কথা আগে সেরে নিই।

১৮১৮ সালে তৃতীয় মারাঠা যুদ্ধে জনের মৃত্যু ঘটে। পুনার উপকণ্ঠে এখনও তার সমাধিস্তম্ভ দেখতে পাওয়া যায়। সমাধির প্রস্তরফলকে শুধু তার নাম লেখা আছে জন স্মিথ। আর লেখা আছে–”এখানে তার দেহ সমাহিত, যার আশা-আকাকা অনেক আগেই সমাহিত হয়েছে।” এইভাবে কঠিন পরীক্ষাময় করুণ জীবন সমাপ্ত হল হতভাগ্য জনের।

বসু শুধায়, জন কি আর ফিরবে না?

তেমন সম্ভাবনা আছে বলে তো মনে হয় না।

মিসেস মেরিডিথ একবার ভাল করে অনুরোধ করে দেখুন না।

সে চেষ্টা হয় নি বুঝি?

কি বলে জন?

সে বলে, কলকাতার ক্ষতচিহ্ন থেকে দূরে এসে স্বস্তিতে আছে, যদিচ শান্তি আর এ জীবনে মিলবে না তবু স্বস্তিটাই বা কম কি! সে লিখেছে, কলকাতায় ফিরে গেলে বেশিদিন আর বাঁচবে না, তাই ও অনুরোধ যেন তাকে না করা হয়।

রাম বসু বলে, এর পরে আর কথা কি! তা যেখানে থাকলে স্বস্তিতে থাকে থাকুক।

লিজাও সেই কথা বলে, মুলী, একদিন বিকেলে আমাদের বাড়িতে যেও। লিজা প্রায়ই তোমার কথা বলে। বলে যে, মুগী যতটা বুঝত জনকে-এমন আর কেউ নয়।

মুন্সী মনে মনে বলে, দুজনেই যে এক আগুনে ঝলসানো।

প্রকাশ্যে বলে, মিসেস মেরিডিথকে আমার বহুৎ বহুৎ সেলাম দিও, আমাকে মনে রাখবার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিও।

গাড়ি জানবাজার রোডে এসে পড়লে মুন্সীকে নামিয়ে দিয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রীট ধরে চলে যায় মেরিডিথ বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোডের দিকে, বলে যায়, সময় পেলে যেতে ভুলো না মুন্সী।

মুন্সী আবার ধন্যবাদ জানায়। তার পরে মনে মনে ভাবতে ভাবতে চলে, রেশমী অনেকের অনেক পরিবর্তন সাধন করে গিয়েছে তাদের মধ্যে এই পরিবারটিও। নইলে এরা সেধে নেটিভ জেন্টুকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইত না। মেরিডিথ যেতে যেতে ভাবে মুন্সী দেহেমনে একবারে ভেঙে পড়েছে, বোধ করি আর বেশিদিন বাঁচবে না; ভাবে, জনের মতই তার অবস্থা। তখন হঠাৎ বিদ্যুৎ-ঝলক দিয়ে যায় তার মনে, জনের মত তবে কি মুন্সীও ভালবাসত রেশমীকে? তার মন বলে, অমন অপূর্ব লাবণ্যময়ী নারীকে ভাল না-বাসাই যে আশ্চর্য!

.

৫.৪ একটি নীরব অধ্যায়

লর্ড ওয়েলেসলি বাদশাহী মেজাজ নিয়ে এসেছিল এদেশে। সে বুঝেছিল যে ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অ্যাডভেঞ্চারের যুগ অবসিত, এবারে আরম্ভ হবে বাদশাহী যুগ; মুঘল বাদশাহীর পরবর্তী অধ্যায় ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাদশাহী। গোড়া ঘেঁষে সাম্রাজ্যপত্তনে মনোনিবেশ করল ওয়েলেসলি। পাঠান ও মুঘল বাদশাহেরাও একদিন বুঝেছিল যে, রাজকীয় স্বার্থের অনুরোধে দেশীয় ভাষার সঙ্গে পরিচয়-সাধন আবশ্যক। ভাষার ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন যে, পাঠান শাসকদের সময়েই বাংলা ভাষার চর্চা বাড়ল, বাংলা সাহিত্যের উন্নতি আরম্ভ হল। ওয়েলেসলির সিদ্ধান্তেও অনুরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। সেকালে পনেরো-ষোল বছরের নাবালক ইংরেজ রাইটার (পরবর্তীকালের সিভিলিয়ান) হোকরার দল এদেশে আসত; তারা না জানত দেশের ভাষা, না জানত দেশের ইতিহাস, আইন প্রভৃতি। ইংরেজী ভাষা ও পাঁচ টাকা বেতনের দোভাষীর সাহায্যে যেভাবে দেশ শাসন করত তারাতা কুশাসন, অত্যাচার ও খামখেয়ালির নামান্তর। ওয়েলেসলি বুঝল, এভাবে আর যাই হক, বাদশাহী শাসনের উত্তরাধিকার গ্রহণ চলে না। প্রজার মুখে রাজার সুনাম রাজগীর পক্ষে অত্যাবশ্যক। তাই ওয়েলেসলি সিদ্ধান্ত করল যে, রাইটারগণকে দেশী ভাষা শিক্ষা করতে হবে, তবে তারা পাবে শাসনকার্যের ভার। তখন দু-একজন ইংরেজ হিন্দুস্থানী ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্যে সেমিনার খুলেছিল। ওয়েলেসলি দেখল যে অভিলষিত কাজের কোন ব্যবস্থা নেই। তখন এই উদ্দেশ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ নামে এক কলেজের প্রতিষ্ঠা হল। সেটা ইংরেজী ১৮০০ সালের কথা। এই কলেজে সংস্কৃত, আরবী, ফারসী, হিন্দুস্থানী, মারাঠী, বাংলা প্রভৃতি ভাষা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হল। বর্তমান প্রসঙ্গে কেবল বাংলা ভাষার কথাই বলা হবে।

গার্ডেনীচে কলেজের নিজস্ব বাড়ি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত রাইটার্স বিভিং-এ কলেজের কাজ চলবে স্থির হল। নীচের তলায় কলেজ ও গ্রন্থাগার, দোতলায় ছাত্রাবাস। বিলাতের বোর্ড অব ডিরেক্টর্সদের নিষেধের ফলে গার্ডেনরীচে কলেজের নিজ বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা ওয়েলেসলির স্বপ্নমাত্র রয়ে গেল। যতদিন কলেজ ছিল, রাইটার্স বিন্ডিঙেই চলেছিল তার কাজ। ১৮৫৪ সালে কলেজ বাতিল হয়ে যায়। কলেজের শেষ অবস্থায় স্বয়ং বিদ্যাসাগর যুক্ত হয়েছিলেন কলেজের সঙ্গে।

১৮৮১ সালে কেরী বাংলা ভাষার প্রধান অধ্যাপকরূপে যোগদান করে কলেজে। প্রধানত তার সুপারিশে কয়েকজন পণ্ডিত ও মুন্সী কলেজের চাকুরিতে নিযুক্ত হয়। খ্যাতি ও ভাষাকর্মের দিক দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ও রামরাম বসু তাদের মধ্যে প্রধান।

একদিন পাঠান শাসনকর্তার উৎসাহে বাংলা পদ্য নৃতন উজ্জীবন লাভ করেছিল। এবারে ইংরেজ শাসনকর্তার উৎসাহে বাংলা গদ্য লাভ করল নাতন উজ্জীবন; সত্যের খাতিরে বলা উচিত যে, বাংলা ভাষায় সাহিত্যিক গদ্যের হল যথার্থ ভিত্তিপত্তন। ফোট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠায় ইংরেজ সুশাসনের কতটা উন্নতি হয়েছিল সে বিচার করুক ঐতিহাসিকের দল; ভাষাবিচারকের রায় হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান নূতন বাংলাসাহিত্যের সূত্রপাত করে দিল। শাসন-সৌকর্যের উপলক্ষ্যকে ছাড়িয়ে গেল ওয়েলেসলির আকাকা। আমাদের কাহিনীর পক্ষে কলেজের বিস্তারিত ইতিহাস অবান্তর। কেরী ও তার মুগীর নূতন কর্মক্ষেত্ররূপে যেটুকু প্রয়োজন তা-ই বলা হল।

মদনাবাটিতে বাংলা গদ্যসৃষ্টিতে কেরীর ব্যক্তিগত প্রয়াস, শ্রীরামপুরের মিশনে পাদ্রীদের সঙ্গে মিলিত প্রয়াস আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে এসে সেই প্রয়াস পেল রাজকীয় সমর্থন ও সাহায্য। তিন জায়গাতেই রামরাম বসু তার মুন্সী, তার প্রধান সহায়।

কিন্তু কেরী দেখল যে, তার মুন্সীর কোথায় যেন পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। আগের সে উৎসাহ, কর্মশক্তি আর নেই; নেই সে অসাধারণ বাকপটুতা ও ক্ষিপ্রবুদ্ধি, যা দীর্ঘকাল মুগ্ধ করে রেখেছিল পাদ্রীদের। এখন সে কেমন যেন নিস্তেজ, অন্যমনস্ক। খান-দুই বই লিখে সেই যে তার কলম নেতিয়ে পড়ল, হাজার উৎসাহ-উদ্দীপনাতেও আর তা সরল না। কেরী দেখে যে, কলেজের কাজে মুন্সীব শ্লাগ্রহ নেই, সব দিন নিয়মিত আসে না, অনেক সময়েই আগে চলে যায়।

একদিন সে শুধাল, মুন্সী, তোমার কি শরীর অসুস্থ?

না, তেমন কিছু নয়, বলে প্রশ্নটাকে পাশ কাটিয়ে গেল রামরাম বসু।

কিছুদিন বিশ্রাম নাও না কেন!

কেরীর অত স্বরে সে বলল, এবারে একবারেই বিশ্রাম নেব।

কেরী ঠিক বুঝতে পারে নি বসুর আঘাতটা ঠিক কোথায়, আর তার গুরুত্ব কতখানি। নিজের জীবনেও সে কম আঘাত পায় নি; কিন্তু ভেঙে পড়ে নি কখনও।

এমন লোকের পক্ষে পরের মনোভঙ্গের কারণ বা গুরুত্ব বোঝা সহজ নয়।

কেরী ও রামরাম বসুর গড়ন কেবল ভিন্ন নয়, ওরা ভিন্ন ধাতুতে গঠিত। মধ্যযুগীয় জীবনের ভিত্তি ভগবদবিশ্বাস। তা বিচলিত হলেও একবারে ভেঙে পড়ে না। নব্যযুগের জীবনের ভিত্তি আপন ব্যক্তিত্বে বিশ্বাস। বিচলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ভেঙে পড়ে, আপনার উপরে আপনি দাঁড়াতে পারে না। কেরীর জীবন বেঁকে পড়েও দাঁড়িয়ে থেকে আজ পর্যন্ত বিস্ময় উদ্রেক করছে। রামরাম বসুর আমূল-ভেঙেপড়া জীবন করুণা জাগায় দর্শকের মনে।

.

৫.৫ শেষ অধ্যায়

টুশকি বলে, কায়েৎ দা, আজকে কলেজ না-ই গেলে, শরীরটা তেমন ভাল নেই দেখছি।

বেশ আছি, বলে চাদর কাঁধে ফেলে বেরিয়ে যায় সে।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও যখন সে ফেরে না, ন্যাড়া বের হয় সন্ধানে। অনেক খোজাখুঁজি করে গঙ্গার ধার থেকে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এমন ঘটনা এখন প্রায় নিত্য ঘটে।

কখনও কখনও গভীর রাতে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে সে। খোলা দরজা দেখে ন্যাড়া আর টুশকি বোঝে যে কখন বেরিয়ে গিয়েছে তাদের কায়েৎ দা। তখন নরু আর ন্যাড়া অন্ধকারের মধ্যে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে।

এমন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চলে। আবার যখন ঘরে থাকে, না ঘুমোয় সে দিনে, না ঘুমোয় রাতে। হয় চুপটি করে বসে থাকে, নয় আপন মনে গুনগুন করে গান করে।

টুশকি বলে, এমন করে কদিন চলবে কায়েৎ দা! চল না, কোথাও থেকে ঘুরে আসি।

কখনও কোন উত্তর দেয় না সে, কখনও বলে, কি হবে? মনের আগুন যে সঙ্গে যাবে।

মনের আগুন কি আর নিভবে না?

কেন নিভবে রে টুশকি, কেন নিভবে!

তার পরে একটু ভেবে বলে, যে আগুনে সে পুড়ে মরেছে, এর জ্বালা কি তার চেয়েও বেশি! তারপর হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, দেব না নিভতে এ আগুন, কখনও দেব না।

হঠাৎ হেসে উঠে সে বলে, সহমরণে পুড়ছি রে, তার সঙ্গে সহমরণে পুড়ে মরছি।

টুশকি ভাবে, পাগল হতে আর দেরি নেই। টুশকি বোঝে তার জ্বালা, তাই তারই কাছে কখনও কখনও মনের কথা প্রকাশ করে বসুজা, আয় সকলের কাছে সে নির্বাক।

সকলে ভাবে, বুড়ো পাগল হয়ে গিয়েছে; টুশকি জানে তার জ্বালা কোথায়, সে ও যে ঐ জ্বলুনির সঙ্গী।

.

অনেক রাত্রে ন্যাড়াকে ঠেলে জাগিয়ে টুশকি বলল, ওরে কায়েৎ দা তো এখনও ফিরল না, একবার বেরিয়ে খুঁজে দেখ!

তখনই বেরিয়ে পড়ল ন্যাড়া আর নরু। তারা জানত গঙ্গার ধারটা তার বড় প্রিয়, সেই দিকেই চলল দুজনে।

সেদিন সন্ধ্যার সময়ে গঙ্গার ধারে বেড়াচ্ছিল রাম বসু। এমন সময়ে একটা ভিড় দেখে এগিয়ে গেল; দেখল যে, হোট একটি কচি মেয়েকে, কচি রেশমীর বয়সী হবে, চিতায় তোলার আয়োজন হচ্ছে।

ওরে রাখ রাখ, বলে চীৎকার করে উঠল বসুজা। মেয়েটি প্রাণভয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। সকলে মিলে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে ঠেলেঠুলে চিতায় উঠিয়ে দিল। চিতা থেকে নামানোর উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাম বসু। সকলে মিলে তাকে নিবারিত করল। কতক আগুনের ঝলসানিতে, কতক মানুষের ঠেলাঠেলিতে অধচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকল সে গঙ্গাতীরে।

ন্যাড়া আর নর সেই অবস্থায় তাকে দেখতে পেল সেখানে। একখানা গাড়িতে চাপিয়ে তারা নিয়ে এল তাকে বাড়িতে। তখন সে অজ্ঞান।

পরদিন বৈদ্য এল, নাড়ী দেখে বলে গেল সান্নিপাত, অর্থাৎ কিনা যার আর ঔষধ নেই।

ন্যাড়া গিয়ে খবর দিল কেরীকে। কেরী সাহেব-ডাক্তার নিয়ে এল তখন। ডাক্তার বলল, অবস্থা ভাল নয়।

বিকালবেলা আবার এল কেরী। অনেকক্ষণ শয্যার পাশে বসে থেকে বিষয় মুখে প্রস্থান করল, বলে গেল আগামীকাল সকালেই আবার আসবে।

সারা দিন-রাত অচৈতন্য অবস্থায় কাটে রামরাম বসুর। মাঝে মাঝে ঠোঁট নড়ে।

নরু বলে, বাবা, কি বলছ?

ন্যাড়া বলে, টুশকি দি, কি বলছে দাদা!

টুশকি চুপ করে থাকে, সে জানে কি বলছে মুমূর্ষ।

শেষরাত্রে স্তিমিত দীপ হঠাৎ প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে, পূর্ণজ্ঞান পায় রাম বসু।

চারদিকে তাকিয়ে দেখে সবিস্ময়ে শুধায়, কই নেই সে?

কে?

কাকে খুঁজছ?

আবার কাকে! এইমাত্র এসেছিল যে!

হঠাৎ জোরে চীৎকার করে ওঠে—ঐ যে, ঐ যে! রেশমী, রেশমী, রেশমী–

ঐ নামের অন্তিম উচ্চারণে জীবনের যাবতীয় আশা-আকাঙ্খা, করুণা, মাধুর্য নিঃশেষ করে দিয়ে এক ফুৎকারে নির্বাপিত হয়ে গেল দীপ।

টুশকি ডুকরে কেঁদে উঠল–কায়েৎ দা, তোমার নরুকে ন্যাড়াকে কার হাতে দিয়ে গেলে?

.

প্রভাত হল। পরম শোকের পরদিবসেও সূর্য তেমনি উজ্জ্বল, বাতাস তেমনি মধুর, আকাশ তেমনি নির্মল আশ্চর্য এই জীবন! আশ্চর্য এই পৃথিবী!

১৮১৩ সালের ৭ই আগস্ট।

–: সমাপ্ত :–

Leave a Reply to পর্দা করা ফরজ Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *