৪.২১-২২ যুদ্ধযাত্রা

৪.২১ যুদ্ধযাত্রা

অপরায়ে বিউগ বেজে উঠল। অমনি দেখতে দেখতে জনের অফিসের সম্মুখে শ্বেতাঙ্গে, কৃষ্ণাঙ্গে শতাধিক লোক সমবেত হল। ঘোডাও শতাধিক, এ সৈন্যবাহিনীতে পদাতিক হতে কেউ রাজী নয়, সকলেই অশ্বারোহী। জন, মেরিডিথ, প্রেস্টন, অগলার ও রাম বসু মিলে সকলকে সারবন্দী দাঁড় করাবার চেষ্টায় নিযুক্ত হয়। জন, মেরিডিথ, প্রেস্টন, অগলার চারজন পাশাপাশি, রাম বসু তাদের ঠিক পিছনেই। তার পরে দুই সারিতে শ’খানেক অশ্বারোহী—দলের মধ্যে ন্যাড়া আর গঙ্গারামও বর্তমান।

এমন বিচিত্র সৈন্যবাহিনী চালনা করবার সৌভাগ্য ক্লাইভ বা নেপোলিয়নের ঘটে নি। জাত্যাংশে, শিক্ষায়, পোশাকে, অস্ত্রে, অশ্বের উৎকর্ষে বৈচিত্র্যের চরম। ইংরেজ, বাঙালী, হিন্দুস্থানী, খ্রীষ্টান, হিন্দু, মুসলমান-সাহেবী কাটা পোশাক, ধুতি, পাজামা বন্দুক পিস্তল লাঠি শড়কি-রেসের ঘোড়া, দামী আরবী, ফকিরের টাটু ঘোড়া। এমন কত বৈচিত্র্যের উল্লেখ করব। পাড়ার লোক অবাক, পথের কুকুরগুলো অবধিও ডাকতে ভুলে গেল বৈচিত্র্যের জলুসে।

কাদির আলীকে পাগড়ি বেঁধে প্রস্তুত হতে দেখে সবাই বলল, মিঞা সাহেব, তুমি আবার কেন, বয়েস হয়েছে ঘরে বসে থাক।

উত্তরে কাদির আলী একটি সামরিক হাসি হেসে বলল, ভাইজান, বুম বুড়ো হলেও রুস্তম, যুদ্ধের দামামা শুনে কি সে ঘরে বসে থাকতে পারে?

ঘোড়া পেয়েছ তো?

পেয়েছি একটা যেমন-তেমন।

যথাসময়ে দেখা গেল কাদির আলী একটি গাধার পিঠে চেপে প্রস্তুত।

এ কি রকম ঘোড়া মিঞা সাহেব?

আরে ভাইসাহেব, ঘোড়া আর গাধা একই জাত।

সকলে বলে, তা বটে, তা বটে।

কিন্তু পড়লে যে একবারে সকলের পিছনে!

ফেরবার বেলায় রইব সকলের আগে। বুঝলে না ভাই, আল্লা দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন, মানুষে সৃষ্টি করেছে আগু আর পিছু। আল্লার চোখে সব সমান।

এমন তত্ত্ববজ্ঞানীর প্রতিবাদ সম্ভব নয়, সকলে চুপ করে থাকে। বিজয়ী কাদির আলী আবার সামরিক হাসি হাসে।

ন্যাড়া আর গঙ্গারামের বয়স অপেক্ষাকৃত অল্প। সাজপোশাক পাওয়ার পক্ষপাতিত্ব হবে আশঙ্কা করে পরিচিত এক যাত্রাওয়ালার কাছে গিয়ে দুজনে বর্মচম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এসেছে। যোদ্ধা বলতে যেমনটি বোঝায় ঠিক সেই রকম, চোখ ঝলসে যায়।

বাহিনীকে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে জন সঙ্কেত করতেই বিউগল বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ঘোষিত হল মার্চিং অর্ডার। একযোগে গোটা পঁচিশেক বন্দুকের আওয়াজ হল যাত্রা করল সৈন্যদল কাশীপুরের উদ্দেশে।

জন, মেরিডিথ, প্রেস্টন, অগলার সম্মিলিত কণ্ঠে গান ধরল

“None but the Brave,
None bui the Brave,
None but the Brave deserves the Fair.”

সাহেবরা গান ধরেছে, কাজেই অন্য সকলের কিছু গাওয়া চাই। তখন নানা কঠে নানা সুরে গান উঠল; সৈন্যবাহিনীর মত সঙ্গীত-বাহিনীও সমান বিচিত্র।

পলাশীর যুদ্ধ সম্বন্ধে একটা গান মুখে মুখে ছড়িয়েছিল, অনেকে আরম্ভ করল সেটা–

“ছোট ছোট তেলেঙ্গাগুলি
লাল কুর্তি গায়
হাঁটু গেড়ে মারছে তীর
মীরমদনের গায়।
পড়ে যদি মীরমদন
খাড়া মোহনলাল,
জাফর আলির বেইমানিতে
নবাবের হল কাল।”

কেউ আবার পলাশীর যুদ্ধের ইতিবৃত্তে সন্তুষ্ট না হয়ে ক্লাইভের সময় থেকে ওয়ারেন হেস্টিংসের কালে চলে এল। গান ধরল,

“হাতী পর হাওদা, ঘোড়া পর জিন,
জলদি যাও জলদি যাও ওয়ারেন হস্তিন।”

গানও চলে, পা-ও চলে, সৈন্যদল কসাইটোলা পেরিয়ে চিৎপুর রোডে পড়ে। পথের ধারের দরজা-জানলা খুলে যায় কোথায় চলেছে এরা সব?

কেউ বলে, সাহেবরা শিকার খেলতে যাচ্ছে, কেউ বলে, সুখচরে সাহেবদের ছাউনি পড়বে। অধিকাংশ কিছুই বলে না, চুপ করে তাকিয়ে থাকে।

এমন সময়ে তারস্বরে গঙ্গারাম গগয়ে উঠল,

“পামকিন লাউ কুমড়া, কোকোর শসা।
ব্রিঞ্জেল বার্তাকু, প্লাউমেন চাষা।”

গানটাকে ঠিক সামরিক সঙ্গীত বলা যায় না, কিন্তু সে বুঝে নিয়েছিল যে দেশকালপাত্র বিবেচনায় ইংরেজী গান কর্তব্য। তার ভাণ্ডারে এই গানটিই ইংরেজির নিকটবর্তী জ্ঞাতি। তার ইংরেজী জ্ঞানে আর-সকলে যতই বিস্মিত হয়, তার কণ্ঠস্বর তত উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে থাকে–

ব্রিঞ্জেল বার্তাকু, প্লাউমেন চাষা

ইংরেজী-অনভিজ্ঞরা ঈর্ষায় কানাকানি করে—মুখস্থ করে এসেছে রে, নতুবা ওর বিদ্যের দৌড় তো আমাদের অজানা নেই।

বিশুদ্ধ ইংরেজী বা বাংলা গানের চেয়ে গঙ্গারামের মিশ্র-সঙ্গীত মিশ্র-বাহিনী কর্তৃক অধিকতর সংবর্ধিত হল দেখে ন্যাড়া ইংরি তালে খাম্বাজ রাগিণীতে গান ধরে দিল–

“Nigh কাছে, Near কাছে,
Nearest অতি কাছে।
Cut কাট, Cot খাট,
Following পাছে।”

বাঃ ভাই, বেশ, বেশ।

তোমরা না থাকলে কি এমন জমত!

চলুক দুজনে উতোর চাপান।

সার ভেঙে সবাই প্রায় দাঁড়ায় ওদের দুজনকে ঘিরে, যুদ্ধযাত্রা যাত্রাদলে পরিণত হওয়ার মত আর কি। এমন সময় জন এসে গর্জন করে ওঠে, চাবুক চালায়—তাতে আসর ভেঙে গেলেও গান চলতে বাধা থাকে না।

জন ফিরে গিয়ে বন্ধুদের বলে, জোড়া ফলস্টাফ খুব জমিয়েছে।

জন বলে, মুন্সী, তুমি চুপ করে আছ কেন, একটা কিছু গাও!

আমি তো তোমাদের মত জঙ্গী গান জানি নে, কি গাইব?

বল কি, তুমি জঙ্গী গান জান না! তোমাদের গডেস কালী হচ্ছে গ্রেটেস্ট ওয়ারিয়র। গডেস কালীর একটা গান ধর।

বেশ, তবে তাই হক, এই বলে বিশুদ্ধ রামপ্রসাদী সুরে সে গান–

“আয় মা সাধন সমরে
দেখি মা হারে কি পুত্র হারে।”

বাস্তব সমরসজ্জার সঙ্গে আধ্যাত্মিক যুদ্ধের সুর মিলে গিয়ে সে এক অপূর্ব আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। একশ ঘোড়ার চারশ পা তাল দেয় সেই সঙ্গীতে, সকলে তস্ময় হয়ে শোনে, ‘আয় মা সাধন সমরে।

জন, অনুবাদ করে বুঝিয়ে দেব নাকি?

মেরিডিথ বলে ওঠে, অমন চেষ্টাও কর না মুলী। এসব দৈব সঙ্গীত অনুবাদের ধোপ টেকে না।

কেমন করে জানলে? শুধায় প্রেস্টন আর অগলার।

তবে একটা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করি শোন।

দেশে থাকতে হে-মার্কেট থিয়েটারের এক অভিনেত্রীর রুপে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। নাটকে সাজত সে গ্রীক পুরাণের দেবী। কি রূপ, কি পোশাক! অনেক অনুনয়-বিনয় ও অনেক বেশি অর্থব্যয় করে এক রাত তার কাছে থাকবার অধিকার পেয়েছিলাম।

থাক, থাক। বলে ওঠে জন।

থাকবে কেন! অনুবাদ মানে ভাষার পোশাক খুলে নেওয়া—এই তো? সেই গ্রীক দেবীর অনুবাদ করতে পেলাম কঙ্কালসার এক বুডি। আক্কেল-সেলামী রেখে সরে পড়লাম। সেই থেকেই অনুবাদের উপর আমার বিষম বিতৃষ্ণা, বিশেষ দেবদেবী সম্পর্কিত হলে।

সকলে হো হো করে হেসে ওঠে।

রামরাম বসু বলে-তবে না হয় থাক, কিন্তু সুরটা লাগছে কেমন?

খুব সামরিক। প্রত্যেক গিটকিরিতে সঙ্গিনের খোঁচা মারছে।

“আয় মা সাধন সমরে,
দেখি মা হারে কি পুত্র হারে!”

জনের সৈন্যদল জোড়াসাঁকোর একটি গলির মুখে এসে পড়তে একখানা সুদৃশ্য ব্রহাম গাড়ির বাধা পেল। গাডিখানা গলি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পড়ছিল। সৈন্যদের হল্লায় ব্রহাম থেকে মুখ বার করে দিল দুইজন সুবেশ সুপুরুষ যুবক।

দ্বারিকবাবু, ব্যাপার কি?

কেমন করে বলব দেওয়ানজী!

তা বটে। কলকাতায় এ তোমাদের নিত্যকার ব্যাপার।

তা হলেও আজ কিছু বাড়াবাড়ি দেখছি, দেওয়ানজী।

যাই বল দ্বারিকবাবু, আমরা রংপুরে বেশ আছি, এমন নিত্য অশান্তি সেখানে নেই।

দেওয়ানজী, সাহেবগুলোর স্পর্ধা বেড়ে উঠেছে।

তার প্রতিকার কি জান? আমাদের স্পর্ধা তার চেয়েও বেশি বাড়িয়ে তোলা।

তেমন আশা করার মত বুকের পাটা নেই।

হবে হবে, কালে সব হবে দ্বারিকবাবু, একটা পাখী যখন ডেকেছে, হাজার পাখী ডাকবে। ভোর হতে আর বিলম্ব নেই।

সৈন্যবাহিনী চলে যায়, গাড়িখানা বড় রাস্তায় পড়ে একটা গলিতে মোড় ফিরে চলে যায় পূর্বদিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে জনরা সকলে মদনমোহন তলায় এসে পৌঁছয়।

রাম বসু জনকে মদনমোহনের মন্দিরের পরিচয় দিতে উদ্যত এমন সময় ন্যাড়া চীৎকার করে ওঠে, কায়েৎ দা, ঐ যে টুশকি দি!

টুশকি জনের অফিসের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল, এমন সময়ে জনতায় বাধা পেয়ে পাশ দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর ঠিক সেই সময়ে পড়ে গেল ন্যাড়ায় চোখে।

সে উচ্চস্বরে হাঁকল, ব্যাটেলিয়ন, হ–ল্ট।

ঘোড়া থেকে নেমে রাম বসু যায় টুকরি কাছে। রেশমীর আশ্রয়দাত্রী টুশকির নামটা শুনেহিল জন রাম বসুর মুখে, কাজেই জন বুঝল যে, ঘটনা এবার চূড়ান্ত পরিণামের দিকে ঘনিয়ে উঠেছে।

.

মাধব রায় জলসার নিমন্ত্রণ-চিঠি পেয়ে ছুটে উপস্থিত হল শোভাবাজারে, রাধাকান্ত দেবের কাছে। বলল, হুজুর, আজ কাশীপুরের বাগানবাড়িতে মেয়েদের উপর অত্যাচার হওয়ার আশঙ্কা আছে, দেখুন চিঠি।

রাধাকান্ত দেব চিঠিখানা পড়ে বললেন, লোকটার আস্পর্ধা তো কম নয়! একবারে রোঘো ডাকাতের মতন নোটিশ দিয়ে অত্যাচার করে! আচ্ছা তুমি এক কাজ কর, আমার চিঠি নিয়ে যাও লাট কাউন্সিলের সেক্রেটারি ম্যাকার্থির কাছে।

রাধাকান্ত দেবের চিঠি নিয়ে মাধব রায় গেল ম্যাকার্থির কাছে। ম্যাকার্থি তখন স্পেকারের নামে চিঠি লিখে মাধব রায়ের হাতে দিল। চিঠিতে লিখে দিল যে, সে যেন অবিলম্বে পুলিস নিয়ে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়, মেয়েছেলের উপর অত্যাচার নিবারণ করতে হবে।

স্পেকারের তলে তলে সহানুভূতি ছিল মোতি রায়ের সঙ্গে। কিন্তু হলে কি হয়, লাট কাউন্সিলের সেক্রেটারির চিঠির মূল্য মোতি রায়ের গোপন অর্ঘ্য নিবেদনের চেয়ে অনেক বেশি। সে তখনই জন-পঁচিশেক পুলিস নিয়ে রওনা হল কাশীপুর অভিমুখে।

এতক্ষণে মাধব রায়ের দৌত্য সফল হল। এবারে সে ফিরে গেল নিজের বাড়িতে।

সবাই বলল, যাবে না আজ কাশীপুরের বাগানবাড়িতে?

মাধব রায় বলল, বাপ রে, মোতিদার নিমন্ত্রণ, না গেলে রক্ষে আছে!

তবে এত পাইক-বরকন্দাজ সঙ্গে নিচ্ছ কেন?

আরে বাপু, রাজার নিমন্ত্রণে রাজার মত যেতে হয়। তার পরে হেসে বলে, রাজা হই রাজার ভাই তো বটি!

মাধব রায় জনপঁচিশেক পাইক-বরকন্দাজ নিয়ে ব্রহাম গাড়ি চড়ে রওনা হয় বাগানবাড়ির দিকে।

সমস্ত কলকাতা শহর আজ কাশীপুর-অভিমুখী।

টুশকি রাম বসুর কাছে সংক্ষেপে গত একমাস কালের ঘটনা বর্ণনা করল। সৌরভী যে রেশমী, রেশমী যে তার সহোদরা, সে যে জোডামউ গাঁয়ের মেয়ে, সমস্ত খুলে বলল, কিছুই গোপন করল না, আর গোপন করার কারণও ছিল না।

স্বাভাবিক অবস্থা হলে এসব বর্ণনা ও ব্যাখ্যায় কিছু সময় লাগত, কিন্তু তড়িঘড়ি অবস্থা, তাই সমস্ত দ্রুত নিঃশেষ হল। সঙ্কটকালে মানুষ এক পদক্ষেপে দশধাপ অতিক্রম করে।

রাম বসু ও ন্যাড়া স্তম্ভিত হয়ে শুনল, কাহিনী শেষ হয়ে গেলেও কথা সরল না তাদের মুখে। ন্যাড়া প্রথমে কথা কইল, বলল, এ যেন একটা রূপকথা, কেবল সেই হারানো ভাইটিকে পাওয়া গেলেই আমার কথাটি ফুরোল নটে গাছটি মুড়োল’ হত।

বহুদর্শী রাম বসু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, সংসারের রূপকথা অত শীঘ্ন ফুরোয়, আর সংসারের নটে গাছের ডালপালাগুলোও খুব জটিল।

তার পর বলল, চল, তোকে জন সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।

ইতিপূর্বেই জনের পরিচয় ও তাদের সদলবলে আগমনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছে রাম বসু। টুশকিও বলেছে যে, সে জনকে খবর দেবার উদ্দেশ্যেই রওনা হয়েছিল, তবে রাম বসুর সাক্ষাৎ যে পাবে এমন আশা ছিল না।

রাম বসু জনকে বলল, জন, এই মহিলাটি হচ্ছে রেশমীর আপন বোন। এদের জীবনে অনেক কমেডি অব এর, অনেক রোমান্স আছে, সে-সব একসময়ে খুলে বলব, আপাতত এইটুকুতেই সন্তুষ্ট থাক।

তার পরে সংক্ষেপে জানাল যে, টুশকি তাকে রেশমীর সন্ধান দেবার জন্যেই যাত্রা করেছিল।

জন টুশকিকে অভিবাদন করে জানাল যে, তার মুখে রেশমীর সঠিক সংবাদ পেয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হল, কিন্তু সশরীরে তাকে পাষণ্ডটার কবল থেকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।

তার পরে জন মেরিডিথ, অগলার ও প্রেস্টনকে সব খুলে বলে জানাল যে, এই মহিলাটি রেশমীর সহোদরা।

মেরিডিথ প্রেস্টন ও অগলারকে একান্তে ডেকে বলল, ঊষার সৌন্দর্য প্রভাতের সৌন্দর্যের সূচনা দিচ্ছে, জন ঠকে নি।

প্রেস্টন বলল, এরকম মেয়ের জন্যে লড়াই করে আনন্দ আহে।

অগলার বলল, শুধু লড়াই কেন, মরতেও আনন্দ, নইলে ইলিয়াড কাব্য লেখা হত না।

রাম বসু বলল, আর দেরি নয়।

জন বলল, নিশ্চয়।

তার পর সে হাঁকল, ব্যাটেলিয়ন, টেনশন-ব্যাটেলিয়ন, মা–র্চ।

মদনমোহনতলা ও বাগবাজার বিস্মিত উচ্চকিত করে বিচিত্র বাহিনী আবার যাত্রা শুরু করল সম্মুখে বাগবাজারের খাল।

রাম বসু বলল, টুশকি, তুই সঙ্গে যাবি?

বাঃ, সঙ্গে যাব না তো কি এখানে থাকব।

তুই যে ঘোড়ায় চড়তে পারিস না।

হেঁটেই যাব।

হেঁটে যাবি কি রে, ঘোড়ার সঙ্গে হেঁটে পারবি কেন?

তখন সমস্যার সমধান করে দিল কাদির মিঞা। সে বলল, বিবিজান যদি তার ‘ঘোড়ায়’ চাপে তবে সে ‘ঘোড়াটা দিতে পারে।

টুশকি বলে উঠল, কায়েৎ দা, এ কিরকম ঘোড়া!

কাদির আলী একগাল হেসে বলল, সোয়ারের গৌরবে বেটার গাধাজন্ম ঘুচে যাবে। মেহেরবানি করে চাপতে হুকুম হক।

রাম বসু বলল, মিঞাসাহেবের যৌবন যেন এখনও যায় নি।

বহুৎ আচ্ছা মুলীজি! বাহাদুর আদমীর যৌবন আর বীরত্ব কখনও যায় না।

অগত্যা টুশকি ‘ঘোড়া’য় চাপল।

রাম বসু বলল, যাঃ, বেটার গাধাজন্ম ঘুচে গেল, পরজন্মে উচ্চঃশ্রবার বাচ্চা হয়ে কার্তিক-গণেশকে পিঠে করে ছুটোছুটি করে বেড়াবে।

টুশকি বলল, কায়েৎ দা, এমন দুঃখের সময়েও এমন সব হাসির কথা মনে আসে তোমার!

ঐ যে শুনলি না কাদির আলীর কথা। বাহাদুর আদমীর রস আর রঙ্গ কখনও যায় না।

পথ শেষ হয়ে এল, সূর্য ডোবে-ডোবে, অদূরে কাশীপুরের বাগানবাড়ির প্রকাণ্ড সৌধ।

.

৪.২২ অগ্নিদেব

বাগানবাড়িতে একতলার প্রকাও নাচঘরের পাঁচটা ঝাড়ের আলোয় শুভ্র জাজিমে আসীন, শয়ান, অর্ধশয়ান “বাবু”দের সোনার চেন, হীরার আঙটি, কোচানো চাদর, গিলে করা জামা, কুঞ্চিত কেশদাম, মসৃণ টাক, নিমীল-উন্মীল রক্তাভ নেত্র অপূর্ব শোভা বিস্তার করছে। সেই সঙ্গে ফুলের মালার, আতর-গোলাপের আর সুরার গন্ধ টানাপাখার বাতাসের তালে তালে হিল্লোল্লিত। অদূরে উপবিষ্ট নিকি বাইজী তানপুরা নিয়ে গান করছে “বাজে পায়োরিয়া ঝনন নন।” অনেক বাবু ইতিমধ্যেই স্থান-কাল-পাত্র সম্বন্ধে গতসম্বিৎ; যাদের চৈতন্য এখনও মহাপ্রলয়ে নিমজ্জমান নয়, তাদের কেউ কেউ তাকিয়ার উপরে টোকা মেরে গানের সঙ্গে তাল দেবার চেষ্টায় নিযুক্ত, কেউ কেউ তাল রক্ষার চেষ্টায় সমে’ পৌঁছবার আগেই চুলে পড়ছে; কোন কোন বাবু খলিতবচনে কিছু বলবার চেষ্টা করছে, কিন্তু সুরবিকল বাগযন্ত্র অন্তরায়। এই বাবুসমাজের মাঝখানে উচ্চাবচ গিরিশৃঙ্গসমাজে কাঞ্চনজঙ্ঘার ন্যায় মোতি বিরাজমান। লোকট সুরার নীলকণ্ঠ, সকলের চেয়ে বেশি পান করেও এখনও পুরোপুরি সজ্ঞান। তার হাতের গোটা আষ্টেক আঙটিতে, হীরের বোতামে, সোনার চেনে, সুচিকণ টাকে বিদ্যুৎ খেলছে, রক্তাভ চক্ষুদ্বয় মঙ্গলগ্রহের মত নির্নিমেষ; ছয় রিপু তার সমস্ত মুখে অসংখ্য ছাপ মেরে দিয়েছে—হাত-ফিরতি চিঠিতে যেমন হয়ে থাকে। রাত্রি প্রথম প্রহর।

এমন সময়ে বেচারামবাবু বলে উঠল, রায়মশায়, এইসব পায়োরিয়া-টায়োরিয়া এখন থাকুক, এবারে বাঘের খেলা আরম্ভ করতে হুকুম দিন।

বাঘ শব্দটা জনৈক বাবুর সুপ্তচৈতন্যে সুড়সুড়ি দেওয়াতে সে জেগে উঠল। বাঘ শব্দটা তখনও তার মগজে ঘুরছে, চীৎকার করে বলে উঠল, “বাঘের বিক্রম সম মাঘের হিমানী।” তার সুরাজড়িত হুঙ্কারে অনেক বাবুর নিদ্রাভঙ্গ হল, বেচারামের দাবির সমর্থনে সবাই বলে উঠল, হাঁ হাঁ, বাঘের খেলা আরম্ভ হক, নিকি বাইজীর গান শুনতে আমরা আজ আসি নি।

বাঘের খেলা সার্কাসের শেষ খেলা। বর্তমান প্রসঙ্গে আসরে রেশমীর আগমন।

মোতি রায় বলল, আপনারা আর একটু অপেক্ষা করুন, মাধব রায় আগে আসুক।

বেচারাম বলে উঠল, কেন বাবা, মাধবের চেয়ে কি আয়ান ঘোষের দাবি কম?

আবার সকলে একযোগে বলে উঠল, হাঁ হাঁ, মাধবের চেয়ে আয়ান ঘোষের দাবি বেশি।

বেচারামবাবু গান ধরল, “রাধা তুই রেশমী হলি কলকেতাতে, জীবনে সুখ কি বল না পড়লি যদি আমার পাতে।”

সমবেত ঐকতানে সকলে গেয়ে উঠল, “রাধা তুই রেশমী হলি কলকেতাতে।”

বেডে ভাই, বেড়ে হয়েছে!

বলিহারি যাই!

তখন বাবুগণ রেশমীর রূপ, গুণ, বয়স ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা আরম্ভ করল।

কেউ বলল, এ চীজ মিলল কোথায়?

কেউ বলল, চোরের উপরে বাটপাড়ি আর কি!

কেউ বলল, মেয়েটা খাঁটি ফিরিঙ্গী, চন্দনগর থেকে চুরি করে আনা।

সকলে একসঙ্গে বলে উঠল, রায় মশায়, এবার আর সবুর সয় না, এবারে বের করুন আপনার রেশমী পুতুল।

মোতি রায় বলল, আর একটু সবুর করুন, মাধব এসে পড়ুক।

এমন সময়ে বাইরে বন্দুকের আওয়াজ উঠল।

দোতলার ঘরটায় দরজা বন্ধ করে রেশমী বসে ছিল। খুদিরাম বারে বারে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলে গিয়েছে, শীগগির সাজপোশাক সেরে নাও, বাবুরা বসে আছে।

রেশমী বারে বারে বলেছে, এই হল আমার। ততক্ষণ সবাই নিকি বাঈজীর গান শুনুক না।

কেন যে সে দেরি করছে নিজেই তা ভাল করে জানে না। বলা বাহুল্য, সাজপোশাক সে করে নি, নিজের শাডিখানা মাত্র পরেছিল।

ঘরটার দক্ষিণ পশ্চিম খোলা। দক্ষিণের জানলা দিয়ে কলকাতার দিকটা দেখা যায়, পশ্চিমের জানলা দিয়ে দেখা যায় ঠিক সম্মুখে গঙ্গা।

দক্ষিণের জানলার ধারে সে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও আশা-ভরসা মনে পোষণ করছিল কি? টুশকি গিয়ে খবর দেবে, দলবল নিয়ে উদ্ধারের জন্য আসবে জন, এমন আশা-পোষণ বাতুলতা মাত্র। তবু সেরকম ক্ষীণ আশা হয়তো ছিল মনে, সময়-বিশেষে মানুষ বাতুল। লতার বেয়ে ওঠবার জন্যে সরু একখানা কঞ্চির আবশ্যক হয়; আশা লতার পক্ষে সেটুকুও আবশ্যক। কিন্তু দক্ষিণদিকে দলবল কেন, একটা মানুষ পর্যন্ত নেই। সে ভাবল, ভালই মল, টুশকি বেঁচে গেল। আর জন! জনের কথা মনে হতেই দু চোখ জলে ভরে উঠল। এ হেন সময়ে, এ হেন লোকের স্মরণে অশুদগম! ভালবাসা যে একমুখী পথ।

এবারে সে পশ্চিমের জানলায় এসে দাঁড়াল। ওপারে জনশূন্য তরুশূন্য দিগন্তে মহাসমারোহে সূর্য অস্তায়মান। স্তরে স্তরে মেঘপুঞ্জ রচনা করেছে বিরাট সৌধ। সূর্য তাকে স্পর্শ করবামাত্র বর্ণবিপর্যয় শুরু হল পাথরগুলোয়। কালো হয়ে উঠল সাদা, সাদা হয়ে উঠল ভাস্বর, ক্ৰমে সমস্ত উজ্জ্বল, প্রোজ্জ্বল, সমুজ্জ্বল। ধীরে ধীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ল মহল থেকে মহলে, শিখর থেকে শিখরে, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। কোন রূপকথার রাজপুরী পুড়ে যাচ্ছে দৈবীশিখায়। খান খান হয়ে, চুর চুর হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়ছে প্রাসাদ, বলভি, অলিন্দ, বাতায়ন, গম্বুজ, শিখর, কার্নিস। গঙ্গাবকে বিস্তারিত হয়ে গেল স্বর্ণময় সেতু, ঠেকল এসে এপারে ঠিক বাগানবাড়ির ঘাটে। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রেশমী। ক্রমে সব ম্লান, নিস্তেজ, নিষ্প্রভ হয়ে গেল। তবু সে তাকিয়েই রইল। এ কি মহান্ ইঙ্গিত ভাস্করের! এ কি পথনির্দেশ মৃত্যুর, মুক্তির!

এমন সময়ে চমকে উঠল সে বন্দুকের শব্দে; যে-শব্দে নীচতলায় বাবুর দল চমকে উঠেছিল, এ সেই আওয়াজ।

মোতি রায় একজন মোসাহেবকে বলল, মাধব এসে পৌঁছল বোধ হয়, যাও তাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এস।

লোকটা যেতে না যেতেই বাইরে বিষম কোলাহল উঠল, বেশ একটু চড়া রকমের কোলাহল। ভিতরে বাবুরা বলে উঠল, মাধব রায়ের এ কি রকম আচরণ, যেন ডাকাত পড়ল!

বাইরে ঘোড়ার হেষা, কোচম্যান আদালী সিপাহী বেহারার হাঁক-ডাক অন্ধকারকে যেন গুলিয়ে ঘেঁটে দিল।

ব্যাপার কি হে?

বাবুরা চঞ্চল হয়ে উঠল, কেউ কেউ অতি কষ্টে দেহটা টেনে দরজায় এসে দাঁড়াল। এতক্ষণ চণ্ডী বক্সী নজরবন্দী হয়ে এক কোণে বসে ছিল, এখন প্রথম সুযোগেই গৃহত্যাগ করে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিল।

বাইরে মাধব রায়ের দল আর স্পেকারের সিপাহীদের সঙ্গে বাগানবাড়িতে আগত বাবুদের আদালী চাপরাসী বেহারা বরকন্দাজদের সংঘর্ষ বেধে গিয়েছে। সমস্ত সংঘর্ষেরই সূচনার ইতিহাস অন্ধকারাচ্ছন্ন। কুরুক্ষেত্রের মহাহব থেকে পাড়ার বেলগাছটা নিয়ে হাঙ্গামা কোনটাই পূর্বপরিকল্পনা-প্রসূত নয়। যুযুধান দুটো দল মুখোমুখি হওয়াটাই আসল, তার পরে লাঠালাঠি কাটাকাটি সে তো নিশাবসানে দিবাসমাগমের মত সুনিশ্চিত।

মাধব রায় আর স্পেকারের জনপঞ্চাশেক লোক—তার মধ্যে অনেকগুলোই অশ্বারোহী-বাগানবাড়িতে এসে পৌঁছলে একটা শোরগোল পড়ে যায়। এরা আবার কারা এল? হয়তো ঘোড়াগুলো ক্ষেপে উঠেছিল, হয়তো দু পক্ষের বরকন্দাজ “তেরি মেরি” হয়েছিল, হয়তো আদালী চড়া মেজাজে কথা বলেছিল, অমনি ব্যস শুরু হয়ে গেল। বন্দুক ছুঁড়ল স্পোকার।

মোতি রায়ের বরকন্দাজেরাও হুঁডল বন্দুক। তারা জানত না যে, কোম্পানির সিপাহী এসেছে। তখন দু পক্ষের বন্দুক ছোড়বার পাল্লা পড়ে গেল। সৌভাগ্যবশত সবগুলোই ফাঁকা আওয়াজ। বন্দুকের আওয়াজে ফিটন বুহামের ঘোড়াগুলো ক্ষেপে উঠে এদিকে ওদিকে ছুটে চলে গেল, পালকির বেহারাগুলো মুক্তিদায়িনী গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। চারিদিকে ব্যবস্থা ও অবস্থা লণ্ডভণ্ড হওয়ার মত।

এমন সময়ে অনেকগুলো ঘোড়ার পায়ের দড়বড়িতে সকলে চমকে উঠল, আবার কারা আসে?

জনের দলবল এসে পৌঁছল।

রেশমী এসব কাণ্ডের মর্ম বুঝতে পারল না। গোলমালটা তার কানে প্রবেশ করল, কিন্তু তার অর্থটা নয়। নিমজ্জমান ব্যক্তির বিশ্বাস করতে সাহস হয় না যে, তার উদ্ধারের আয়োজন চলছে। বিশেষ তখন রেশমী নিজের সঙ্ক সাধনের জন্য দোতলার সে ঘরটি পরিত্যাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিল।

টুশকি জনকে ইঙ্গিতে দোতলার ঘরটা দেখিয়ে দিল—ঐ ঘরে রেশমী আছে।

তখন জন, মেরিডিথ, অগলার, প্রেস্টন, রাম বসু ও ন্যাড়া ছুটল দোতলার ঘরটা লক্ষ্য করে, পথপ্রদর্শিকা টুশকি।

বেচারামবাবুর দল যে যেখান দিয়ে পারল বেরিয়ে ছুটল গঙ্গার দিকে, গঙ্গা হিন্দুর শেষ আশ্রয়। অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে বেচারাম বলে উঠল, “ওরে, আয়ান এল ভীষণরূপে দড়বড়িয়ে ঘোড়া, কলির কেষ্ট পালা এবার নইলে হবি খোঁড়া।” বেচারাম জাত-কবি, সঙ্কটকালেও ছড়া আওড়ায়।

সবাই গেল, গেল না কেবল মোতি রায়। মুহূর্তে গোলমালের অর্থ বুঝল সে। বলে উঠল, ওহো, সে হারামজাদা মেধোটা এসেছে আমার শিকার ছিনিয়ে নিতে! রহে পাজি!

এই বলে সে ছুটল দোতলার ঘরটার দিকে। মোতি রায় ও জনেরা ঠিক একই সময়ে ঘরটায় ঢুকল—বিপরীত দুই দিক থেকে।

সবাই দেখল-ঘর শূন্য।

পরমুহূর্তে টুশকি চেঁচিয়ে বলে উঠল, ঐ মোতি রায়।

মোতি রায়! জন ছুটে এসে মারল তাকে এক লাথি।

রেশমী কোথায়, বল্?

কে দেবে উত্তর? ধরাশায়ী মোতি রায় তখন সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

আগুন! আগুন!

চারিদিক থেকে নানা কণ্ঠে চীৎকার উঠল, আগুন! আগুন! বেরিয়ে এস, বেরিয়ে এস!

ক্ষণকালের জন্য জনেরা হতভম্ব হয়ে গেল, তার পরে দেখল যে, সত্যই নীচতলায় আগুন লেগেছে।

সকলে তখন বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছে; জনেরা ভাবল, রেশমীও নিশ্চয় বেরিয়ে গিয়েছে, তারাও দ্রুত বেরিয়ে এল।

মোতি রায়ের লোকজন মোতি রায়কে টেনে বের করল।

কিন্তু রেশমী কোথায়? কোথাও তো নেই! কিংবা প্রকাণ্ড জনতার মধ্যে অন্ধকারে কোথাও থাকলেও খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। রাম বসু, টুশকি, ন্যাড়া “রেশমী”, “রেশমী দি” বলে চীৎকার শুরু করল, কিন্তু জনতার কোলাহল ছাপিয়ে সে ডাক রেশমীর কানে পৌঁছবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না।

আগুন! আগুন!

সমস্ত নীচতলাটা আগুনে ছেয়ে ফেলেছে। শত্রু-মিত্র ভুলে তখন সবাই তাকিয়ে আছে প্রবর্ধমান অগ্নিকুণ্ডের দিকে।

কেমন করে লাগল? কে লাগাল? মদের ভাঁড়ারে আগুন, নাচঘরে আগুন, আতসবাজিগুলোয় আগুন। সমস্ত দাউ দাউ করে জ্বলছে। জানালা দিয়ে, দরজা দিয়ে, ফাঁক-ফুকর দিয়ে শত শত অগ্নিময় জিহা লক লক করে বের হচ্ছে, আকাশ আচ্ছন্ন ধোঁয়ায়।

তুবড়িগুলো যেটা যে-ভাবে ছিল অগ্নি-প্রস্রবণ হোটাচ্ছে। হাউইগুলো পাগলের মত হুসহাস করে অন্ধকারকে ঢু মেরে ছুটছে। ঝাড়লণ্ঠন, আয়না, দেয়াল-জোড়া ছবিগুলো খান খান হয়ে ঝন ঝন শব্দে ভেঙে ভেঙে পড়ছে।

ক্ষণকালের জন্য বৃহৎ জনতা স্তব্ধ হয়ে গেল, জনেরা ভুলে গেল রেশমীর প্রসঙ্গ। আগুনের সুযোগ নিয়ে রেশমী পালিয়েছে, কাছেই কোথাও আছে—ভেবে জনেরা নিশ্চিন্ত হয়েছিল।

এমন সময়ে আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে ন্যাড়া বলল, দেখ টুশকি দি, লকেট বাজিগুলোর কি বাহার!

একটা লকেট বাজি ফেটে গিয়ে আকাশে আগুনের অক্ষরে লিখে দিল ‘রেশমীমিলন’। আর একটা, আর একটা, আর একটা! আকাশ অগ্নিময় ‘রেশমী’ নামে গেল ভরে।

সেই অগ্নিময় প্রভায় তেতলার ছাদ লক্ষ্য করে টুশকি চীৎকার করে উঠল, কায়েৎ দা, ঐ যে রেশমী!

সত্যিই তো রেশমী।

ওরে রেশমী, নেমে আয়!

রেশমী, নেমে আয়, নেমে আয়!

এতক্ষণে রেশমী দেখতে পেল যে আলোয় ওরা দেখেছিল তাকে, সেই আলোতেই সে দেখল ওদের দেখল যে রাম বসু, টুশকিরা এসেছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে তার কানে প্রবেশ করল জনের করুণ মিনতি-রেশমী, নেমে এস! রেশমী, নেমে এস!

এ পর্যন্ত রেশমী ছিল নিশ্চল, নির্বিকার, পাষাণবৎ। জনের কণ্ঠস্বর কানে যেতেই পাষাণ গলল, সে বলে উঠল, জন, জন, তুমি এসেছ?

রেশমী, আমি ভুল বুঝেছিলাম, ভুল করেছিলাম, নেমে এস।

রেশমী বলল, জন, তুমি এসেছ? আবার আমার বাঁচতে ইচ্ছা করছে, আবার আমার তোমার বুকে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু তা বুঝি হবার নয়।

জন আর্তস্বরে বলে উঠল, এখনও সময় আছে, নেমে এস নেমে এস!

না জন, আর সময় নেই, নিজের হাতে লাগিয়েছি আমি আগুন, এ আগুন এখন আমার সাধ্যের অতীত।

তবে দাঁড়াও আমি যাচ্ছি, বলে জন ছুটল সেই অগ্নিকাণ্ডের দিকে।

I say, John–পাগলের মত আচরণ কর না। এ অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করলে বাঁচবে।

আমি বাঁচতে চাই না, আমি রেশমী চাই, বলে জন এগিয়ে গেল।

তখন অগলার, প্রেস্টন ও মেরিডিথ তিনে মিলে জনকে আটকে রাখল। ওদের হাত ছাড়াবার উদ্দেশ্যে ধস্তাধস্তি করতে করতে জন বলল, তোমরা বুঝছ না, রেশমীকে ছাড়া আমার জীবন নিরর্থক। ছাড়, ছাড়।

জনের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করে রেশমী বলল, জন, এখানে প্রবেশ করলে মরবে। মরে কি লাভ? আমিও আর মরতে চাই না, কিন্তু এখন আর বাঁচবার পথ নেই।

সবাই দেখল, রেশমী অত্যুক্তি করে নি। একতলা দোতলা ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ডে পরিণত। পলায়নের পথ বন্ধ করে আগুনের শিখা তেতলার ছাদে রেশমীর পায়ের কাছে পৌঁছেছে।

ন্যাড়া আগুন টপকাতে গিয়ে জখম হল, তাকে সবাই সরিয়ে নিয়ে এল। আর জন কিছুতেই ছাড়া পেল না বন্ধুদের হাত থেকে।

পাগলের মত সে বলতে লাগল, মেরিডিথ, প্রভুর দোহাই দিয়ে বলছি, একটিবার আমাকে ছেড়ে দাও, আমি ওকে নামিয়ে নিয়ে আসি, না হয় দুজনে এক শিখায় প্রাণ বিসর্জন করি।

রেশমী ধূমনিরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, জন, বড় দুঃখে মরতে যাচ্ছিলাম, এখন বড় আনন্দে মরছি। কখনও ভাবতে পারি নি, জীবন-পেয়ালার শেষ চুমুকে এমন অক্ষয় অমৃত ছিল। মরবার আগে জেনে গেলাম যে, তোমার ভালবাসা হায়াই নি। এর চেয়ে আর কি বেশি পেতাম বেঁচে থাকলে।

তখনও ছাড়া পাওয়ার আশায় জন ধস্তাধস্তি করছে। টুশকি মাথা কুটছে। ন্যাড়ার দৈহিক যাতনাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে মানসিক দুঃখ, সে লুটিয়ে লুটিয়ে কাঁদছে। কেবল নিশ্চল কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ দণ্ডায়মান রামরাম বসু।

তখন শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ ভুলে সেই প্রকাও জনতা অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইল তেতলার ছাদের দিকে। মৃত্যুর অগ্নিনাগিনীর বলয়-বেষ্টন ক্ৰমে সংকীর্ণতর হতে হতে স্পর্শ করেছে রেশমীর অঙ্গে। তার পায়ের নখ থেকে মস্তকের প্রতি কেশ দেদীপ্যমান, তার তরুণ মুখচ্ছবির প্রত্যেকটি রেখা দৃষ্টিগম্য, মৃত্যুর রক্ত-পদ্মের মধু কোষের উপরে দণ্ডায়মান সে মূর্তির কি দিব্য কাত্তি। আকাশজোড়া অন্ধকারের পটে ঐ ভাস্বতী মূর্তিটি আজ যেন সমগ্র চরাচরের একমাত্র দর্শনীয় সামগ্রী।

সমগ্র জনতার সমবেত হায় হায় ধনির মধ্যে অগ্নিবলয় গ্রাস করল রেশমীকে। এমন বহ্নিয়ন বিবাহের দিব্য দুকুলে তার দিব্য অঙ্গ মণ্ডিত, অগ্নিশিখার বলয় তার বাহুতে, অগ্নিশিখার কুণ্ডল কর্ণে, অগ্নিশিখার সিথি সীমন্তে, অগ্নিশিখার স্বর্ণহার তাব কণ্ঠে, অবশেষে স্বয়ং অগ্নিদেব স্বর্ণোজ্জ্বল কিরীটী পরিয়ে দিলেন তার শিরে।

একবার সে চীৎকার করে বলল, জন, সেদিনের সেই কথাটা—

আর কিছু শোনা গেল না, শেষ হল না সেই কথাটা।

মানুষের শেষ কথাটা আর শেষ হল না।

অগ্নিশিখা নিস্তেজ হয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে তারাগুলোর জ্যোতি উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে লাগল। জগতে ওদের ভাষাটাই সত্য। আগুন নিভে আসতেই চারদিক গাঢ়তর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হল। তখনও শেষ দু একটা লকেট কর্তৃক নিক্ষিপ্ত ‘রেশমী’ অক্ষরের আঁচড় একবারে মিলিয়ে যায় নি আকাশের পট থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *