৪.১৬-২০ রাম বসুর প্রত্যাবর্তন

৪.১৬ রাম বসুর প্রত্যাবর্তন

যেদিন রেশমী টুশকির বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল, সেদিনই খুব ভোরবেলা রাম বসু জনের অফিসে এসে উপস্থিত হল। সে আগেই খোঁজ নিয়ে জেনেছিল যে, জন এখন অফিসে থাকে।

তাকে দেখে জন বিস্মিত হয়ে শুধাল, একি, মুন্সী যে! এক যুগ পরে কোথা থেকে এলে! তোমার আশা তো একরকম ছেড়েই দিয়েছিলাম!

রাম বসু বলল, এক যুগ না হলেও মাসখানেক হল নিশ্চয়।

কোথায় ছিলে এতদিন, কি করলে এতদিন?

রাম বসু বলল, দাঁড়াও, একে একে সব উত্তর দিই। তার পর আরম্ভ করল, তোমরা তো চলে এলে, আমি কিন্তু আশা ছাড়লাম না রেশমীর। যেখানে যেখানে তার যাওয়ার সম্ভাবনা, গেলাম সব জায়গায়—এমন কি মদনাবাটি অবধি যেতে ত্রুটি করি নি। কিন্তু না, সব বৃথা; পেলাম না তাকে।

জন বলে, যেখানে নেই সেখানে পাবে কি করে? কিন্তু মুন্সী, রেশমী সম্বন্ধে আমার আর কোন আগ্রহ নেই।

সেটা আশ্চর্য নয়। যাকে পাওয়া গেল না তার সম্বন্ধে আগ্রহ পরিত্যাগ করাই। শ্রেয়।

পাওয়া গেল না একথা সত্য নয়। পাওয়া গিয়েছে রেশমীর সন্ধান।

আনন্দে বিস্ময়ে বসু বলে ওঠে, পাওয়া গিয়েছে রেশমীর সন্ধান! কোথায়, কোথায় সে? কি করে পেলে সন্ধান, সব খুলে বল?

জন বলে, তার আগে বল মদনমোহন কে?

হতবুদ্ধি রাম বসু বলে, মদনমোহন! কেমন করে জানব কে সে?

এবারে সে ভাল করে জনের মুখ দেখে বলে, তোমাকে এমন ক্লিষ্ট দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে বল দেখি?

জন রুষ্টভাবে বলে, আগে বল মদনমোহন নামে কোন রাঙ্কেলকে তুমি জান কি

রাম বসু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে, কই না, ও নামে কোন লোক তো মনে পড়ছে না। কিছু হঠাৎ এর মধ্যে মদনমোহন এল কেন? রেশমীর কি জান বল?

জন দাঁড়িয়ে উঠে পায়চারি করতে করতে বলে, রেশমী আস্ত একটি বেশ্যা। আর ঐ মদনমোনহ আস্ত একটি লম্পট।

কিছু বুঝতে না পেরে রাম বসু নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। জন বলে যায়, তবে শোন, অনেক সন্ধান করে রেশমীর সন্ধান পাই, কিন্তু না পেলেই বোধ করি ভাল ছিল।

বসু কিছু বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে জন বলল, থাম, আগে সবটা শোন, বুঝতে পারবে কি শয়তানী সেই মেয়েটা।

আরও বারকয়েক পায়চারি করে সে আরম্ভ করে, রেশমীর সন্ধান পেয়ে তাকে যখন আনবার ব্যবস্থা করছি, তখন সেই চাপা শয়তানী লিখে পাঠাল যে সে আসবে না, মদনমোহনকে বিয়ে করবে। লিখে পাঠাল, এখন মদনমোহনই তার আশ্রয়, তার শান্তি, তার স্বামী। চিতাতে ওর পুড়ে মরাই উচিত ছিল, ওকে বাঁচিয়ে তোমরা অন্যায় করেছ। এমন জঘন্য জীবের বেঁচে থাকবার অধিকার নেই। শুনলে তো। হল তো? দেখলে তো তোমাদের রেশমী কি বস্তু?

রাম বসু বলল, দেখ জন, মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব, তবু রেশমীর ক্ষেত্রে এসব বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।

কেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না? ওর মুখটা সুন্দর বলে?

না, ওর মনটা সরল বলে।

ওর সরলতা সাপের সরলতা, বড় মারাত্মক। কিন্তু তোমার যখন এতই বিশ্বাস সেই কুলটার উপরে, নাও পড়ে দেখ এই চিঠিখানা।

এই বলে সে টেবিলের কাছে গিয়ে সযত্ন-রক্ষিত রেশমীর চিঠিখানা ঘৃণাভরে দুই আঙুলে তুলে রাম বসুর দিকে ছুঁড়ে দিল।

চিঠিখানা পরম আগ্রহে এক নজরে পড়ে বসু বলে উঠল, জন, এ চিঠির উত্তর দিয়েছ?

নিশ্চয় দিয়েছি।

তা জানি। কি লিখেছ?

যা লেখা উচিত। লিখেছি, তুমি বাজারের বেশ্যা, তোমার উপপতি মদনমোহন একটি লম্পট। লিখেছি, এবারে যেন উপপতির সঙ্গে পুড়ে মরতে পার। এর আগেই তোমার পুড়ে মবা উচিত ছিল।

হতবুদ্ধি বসু বলে, লিখেছ এইসব মর্মান্তিক কথা?

লিখব না!

কি সর্বনাশ করেছ জন!

কেন?

কেন কি! এ চিঠির অর্থ তুমি ভুল বুঝেছ!

বসুর অটলতায় জনের বিশ্বাসে টোল খায়, বলে, চিঠিখানা তো খুব দুরূহ নয়।

তোমাদের মত শ্বেতাঙ্গের কাছে দুরূহ বই কি।

কি ব্যাখ্যা তুমি করতে চাও এ চিঠির! তুমি দেখছি শয়তানের উকিল!

জন, আমি শয়তানের উকিল নই, নির্বুদ্ধিতারূপ শয়তান ভর করেছে তোমার ঘাড়ে। মদনমোহন কোন মানুষ নয়, এক দেবতার নাম, মদনমোহন একটা deity, কলকাতার যে-কোন হিন্দু তার নাম জানে। মদনমোহন শব্দটি বললে যে কোন হিন্দু মিত্র জমিদারদের সেই deity বা দেবতাকে বুঝবে।

জনের মন বিচলিত হয়, তবু ভাঙে না; বলে, তুমি হয়তো ভুল বুঝেছ। আচ্ছা, মদনমোহন যদি deity হবে তবে তাকে বিবাহ করবার কথা বলে কি করে?

ও সমস্ত রুপক, অ্যালিগরি। ভগবানকে আমরা কখনও পিতা বলি, কখনও মাতা বলি, আবার কখনও স্বামীরূপে কল্পনা করি। এ ভাবের কথা কি কখনও শোন নি?

শুনেছি বটে। বলে জন।

তোমার চিঠি কি পৌঁছেছে রেশমীর হাতে?

গঙ্গারাম গিয়ে তার স্বহস্তে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। বে

শ করেছে, খুব করেছে। নির্বোধ, নির্বোধ, তুমি কি করেছ জান না।

জন এবারে বোঝে যে, প্রকাণ্ড ভুলে করেছে সে।

কোথায় আছে সে?

গঙ্গারাম জানে।

ডাক গঙ্গারামকে।

গঙ্গারাম আসে।

রাম বস শুধায়, কোথায় আছে রেশমী?

আজ্ঞে মদনমোহন-তলায়।

মদনমোহন-তলায়! চমকে ওঠে রাম বসু। চল এখনই আমার সঙ্গে, দেখিয়ে দেবে। জন বলে, মুন্সী, আমিও যাব, ক্ষমা প্রার্থনা করব তার কাছে।

ক্ষমা প্রার্থনা করবে! ভারি উদারতা দেখানো হচ্ছে। কিন্তু তোমার ক্ষমাপ্রার্থনা শোনবার জন্যে সে এতদিন বেঁচে আছে কিনা সন্দেহ।

কেন?

আবার জিজ্ঞাসা করছ কেন? ও রকম চিঠি পেয়ে কোন মেয়ে কি আর বেঁচে থাকে? বিশ্বাস না হয়, জিজ্ঞাসা করে দেখ তোমার বোন লিজাকে?

এই বলে সে গঙ্গারামকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

জন ঘরের মধ্যে ঢুকে কান্নায় ভেঙে পড়ে বিছানার উপরে। কি আনন্দময় দুঃখ!

.

মদনমোহন-তলায় একটা বাড়ির সম্মুখে এসে গঙ্গারাম দাঁড়াল।

রাম বসু চমকে উঠল, একি, এ যে টুশকির বাড়ি!

গঙ্গারাম বলল, টুশকি কি খুসকি জানি নে, এই বাড়িতেই মেয়েটা আছে।

দরজা খোলা-টুশকি, টুশকি ডাকতে ডাকতে রাম বসু ঢুকে পড়ল।

রাধারানী সম্মুখে এসে দাঁড়াল, একি, আপনি? এতকাল পরে?

রেশমী বেরিয়ে যাওয়ার অল্পক্ষণ পরেই রাম বসু এসে উপস্থিত হয়েছে, তখনও রাধারানী ঘরের কাজ সারছিল। আর কি করা উচিত তা ভেবে পায় নি সে।

ভাল আছিস রাধারানী? কই টুশকি কই?

বসুন, সব বলছি। আজ সকালে এসে শুনলাম যে, তিনি সেই কাল কোথায় আরতি দেখতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, আর ফেরেন নি।

ফেরেন নি! বলিস কি রে? রেশমী কোথায়।

রেশমী আবার কে?

সেই যে-মেয়েটি এ বাড়িতে থাকত?

ও, সৌরভী দিদিমণি?

ক্ষিপ্রবুদ্ধি রাম বসু বুঝলে যে, ঐ নামের পরিচয় দিয়েছিল রেশমী।

বলল, হাঁ, কোথায় গেল সৌরভী?

তিনি তো এখনই বেরিয়ে গেলেন।

বেরিয়ে গেলেন! কোথায় গেলেন?

এ কেমন করে বলব। সকালবেলায় কাজ করতে এসে দেখি যে, দিদিমণি শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। শুধালাম, কি দিদিমণি, এমন অবস্থা কেন? তিনি বললেন যে, টুশকি দিদি কাল সন্ধ্যেয় গিয়েছেন, এখনও ফেরেননি।

তাই খুঁজতে বেরিয়ে গেল?

মনে তো হল তাই।

কিন্তু কোথায় গেল কিছু বলে গেল না?

সে অনেক কথা কায়েৎ দা, আপন বসুন বলছি।

না, আমি বেশ আছি, তুই কি জানিস বল।

তখন সে মোতি রায়ের দৌরাত্ম্যের কথা যেমন জানত বলল। কিন্তু রেশমীই যে তার লক্ষ্য না জানায় পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারল না টুশকির অন্তর্ধান ও রেশমীর অকস্মাৎ গৃহত্যাগের রহস্য।

রাম বসু বুঝল যে রাধারানীর কাছ থেকে আর বেশি কিছু জানবার সম্ভাবনা নেই। সে স্থির করল, অন্যত্র সন্ধান নিতে হবে। তখন সে বলল, রাধারানী, তুই ঘরের কাজ সেরে দরজা বন্ধ করে চলে যা। আমি পরে আবার ফিরব।

এই বলে গঙ্গারামকে সঙ্গে নিয়ে রাম বসু বেরিয়ে এল।

টুশকির বাড়ির পাশে রাম পণ্ডিতের মুদির দোকান। রাম পঙিত চাণক্যশ্লোক, দাতাকর্ণ উপাখ্যান, শুভঙ্করী, এবং প্রকাণ্ড টাক ও সুদীর্ঘ নাকের মাহাত্ম্যে মুদির দোকানের একান্তে পাঠশালা খুলে পণ্ডিতি করেন। রাম পঙিত জাত্যংশে ব্রাহ্মণ ও রাম বসুর দীর্ঘকালের আলাপী। রাম বসু জানত, পাড়ার সাকুল্য বিবরণ রাম পণ্ডিতের মুদির দোকানে এসে জমে। তাই সে রাম পণ্ডিতের মুদির দোকানে এসে উপস্থিত হল।

প্রাতঃপ্রণাম পণ্ডিত মশাই।

আরে মিতে যে! এস, এস, অনেকদিন পরে, এতদিন হিলে কোথায়?

তার পর, সব মঙ্গল তো?

রাম বসু আসন গ্রহণ করতে করতে অবান্তর প্রশ্নের যথাস উত্তর দিল।

ওরে ঐ কায়স্থের হুঁকোটা দিয়ে যা। একজন পোভড়া প্রজ্বলন্ত কল্পে বসিয়ে হুঁকো এগিয়ে দিল রাম বসুর কাছে।

তার পর-পাড়ার খবর কি বল তো মিতে।

আর খবর! এখন পাড়ায় সুভদ্রা-হরণ পালা চলছে! বলে হো হো করে হেসে ওঠে রাম পণ্ডিত। নাকটা তাল রক্ষা করে হাসির সঙ্গে সঙ্গে কাঁপে।

কি রকম, সব শুনি?

এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে গলা খাটো করে রাম পণ্ডিত বলে, সমস্তর মূলে ঐ মোতি রায়। জান তো লোকটাকে।

বসু বলে, ওকে না জানে কে। অতবড় পাষণ্ড ভূভারতে নেই।

তবে তো জানই। মাসখানেক আগে রেশমী নামে একটা ছুঁড়িকে কোত্থেকে নিয়ে আসে ওর লোকজন।

রাম বসু কান খাড়া করে শুনে যায়। শুধায়, কোত্থেকে কি জান?

নিশ্চয় করে জানি নে, তবে শুনলাম যে শ্রীরামপুরের পাদ্রীরা নাকি ওকে খ্রীষ্টান করবার জন্যে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় মোতি রায়ের লোকজন চুরির উপরে বাটপাড়ি করে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসে।

ঘটনাগুলো ক্রমে শৃঙ্খলিত হয়ে দেখা দেয় রাম বসুর মনে।

তার পারে?

মেয়েটা গঙ্গার ঘাট থেকে পালিয়ে যায়।

মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাম বসু, বাহবা দেয় রেশমীর সাহসকে।

এ যে সত্যি সুভদ্রা-হরণের কাহিনী। তার পরে কি হল বল?

এদিকে মেয়েটা পালাল, ওদিকে মাধব রায় দুয়ো দিয়ে বলতে লাগল, মোতি রায়ের আর সেদিন নেই, নইলে মেয়েটা পালাবার পথ পায় কি করে? তাই না মোতি রায় গর্জে উঠল।

মোতি রায়ের কাল্পনিক গর্জনের অনুকরণে রাম পণ্ডিত হঠাৎ এমন বাস্তব গর্জন করে উঠল যে পোডোর দল আঁতকে উঠল, গোটা দুই ছেলে তো ডুকরে কেঁদে উঠল।

না রে না, তোদের বলি নি, তোরা পড়বলে আশ্বাস দিয়ে বলে যেতে লাগল রাম পণ্ডিত।

বুঝলে কিনা মিতে, সেই থেকে পুলিসের সঙ্গে যোগসাজসে আরম্ভ হল পাড়ায় অত্যাচার।

পাড়ায় অত্যাচার আরম্ভ হতে যাবে কেন?

আরে মেয়েটাকে খুঁজে বার করতে হবে তো!

পাড়ার লোকে কি জানে রেশমীর?

নইলে আর অত্যাচার বলছি কেন? কচি বয়সের মেয়ে দেখলেই ধরে নিয়ে যায় সেই ‘ড়িটা মনে করে।

রাম বসু বলে, এ যে দেখছি বিশল্যকরণী না পেয়ে গন্ধমাদন-বহন!

ঠিক তাই ভায়া, বলে রাম পণ্ডিত। তার পরে বলে, কাল রাত থেকে নাকি তোমায় টুশকিও উধাও হয়েছে।

আমিও তাই শুনলাম।

তবে আর সন্দেহ নেই, ধরে নিয়ে গিয়েছে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে।

এখন উপায়? নিরুপায় ভাবে জিজ্ঞাসা করে রাম বসু।

আর যাই কর মিতে, ঝোঁকের মাথায় কাশীপুরের বাগানবাড়ির দিকে যেয়ো না, সঙীন খাড়া করে পাহারা দিচ্ছে মোতি রায়ের বরকন্দাজের দল।

যতদূর যা জানবার জেনে নিয়েছে রাম বসু, তাই সে এবারে বিদায় নিয়ে উঠে পড়ল, আর গঙ্গারামকে নিয়ে দুত রওনা হল জনের অফিসের মুখে।

সে বুঝল যে, সৌরভীই রেশমী, ঘটনাক্রমে রেশমী পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল টুশকির বাড়িতে। আরও বুঝল যে, কাল রাতে মোতি রায়ের লোকে ধরে নিয়ে গিয়েহে টুশকিকে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে। সে ভাবল যে, রেশমী ব্যাপার অনুমান করে রওনা হয়ে গিয়েছে কাশীপুরে, কিংবা হয়তো খোদ মোতি রায়ের কাছে গিয়েই উপস্থিত হবে সে। রেশমীর চরিত্র ও সাহস, তার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। সে বুঝল যে, এখন টুশকি ও রেশমীকে রক্ষা করা তার সাধ্যের অতীত-এক ভরসা জন, সে যে শেতাঙ্গ।

হেঁটে যেতে বিলম্ব হবে দেখে একটানা ফিটন গাড়িতে দুজনে চেপে বসল, জলদি চল কসাইটোলা।

.

৪.১৭ রেশমী আবির্ভাব

মোতি রায়ের খাস কামরায় মোতি রায় আলবোলার নল মুখে তাকিয়ার উপরে ভর দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। পাশে নীচু একটা জলচৌকির উপরে চণ্ডী বলী উপবিষ্ট। চণ্ডী বক্সী ইতিপূর্বে দেশে ফিরে যাওয়ার আবেদন পেশ করেছে, সঠিক উত্তর পায় নি; এবারে আবার প্রসঙ্গটা উত্থাপন করল, বলল, হুজুর, এবারে দেশে ফিরে যাওয়ার হুকুম করে দিন।

মোতি রায় বার দুই নড়ে-চড়ে বলল, সে কি কথা বী, আজ তো যাওয়া হতেই পারে না। আজ বাগানবাড়িতে নাচ-গান আছে, শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি সব আসবে, আমাদের মেধোটাকেও নিমন্ত্রণ করেছি, তার পরে আড়াই হাজার টাকার বাজি পুড়বে। এসব না দেখে কোথায় যাবে? তা ছাড়া তোমার পারিতোষিকের কথাটাও ভেবে দেখতে হবে, কি দেওয়া যায় না যায় এখনও স্থির করি নি।

চণ্ডী সবিনয়ে বলল, কিন্তু হুজুর, অনেককাল দেশছাড়া, ওদিকে সব নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপম হল বলে খবর পেয়েছি।

তা বটে, কিন্তু আর একটা দিন বই তো নয়, এর মধ্যে আর কত কি হবে।

তার পরে প্রসঙ্গ পাটে আরম্ভ করল, যাই বল বী, তোমাদের রেশমী মেয়েটা খুব তোয়ের মেয়ে। প্রথমে খানিকটা গুই-গাঁই করেছিল, বুঝলে না বী, প্রথমে অমন একটু আপত্তি না করলে দর বাড়ে না, কিন্তু শেষে…এই বলে গতরান্ত্রির অভিজ্ঞতার যে বাস্তব ও বিস্তারিত বিবরণ দিতে লাগল, তাতে বীর মত পাষঙও অধোবদন হয়ে গেল, সে নীরবে বসে ঘরের কার্পেটের নয়াগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠে মোতি রায় বলল, ওঃ, তোমার বুঝি আবার লজ্জা করছে।

তখনই সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আরে তোমার সঙ্গে তো রক্তের সম্বন্ধই নেই, তা এত লজ্জা কিসের?

চণ্ডী কি বলতে যাচ্ছিল, মোতি রায় থামিয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা, ও প্রসঙ্গ না হয় থাক। এখন বল তো বক্সী, কি পারিতোষিক চাও? শাল-দোশালা আর টাকা— না খানিকটে ব্রহ্মত্র জমি?

চণ্ডীর উপযুক্ত শিক্ষা হয়ে গিয়েছে, এখন সে পালাতে পারলে বাঁচে, তাই সে সংক্ষেপে বলল, হুজুরের যা ইচ্ছে হয় দেবেন।

এ অতি উত্তম কথা, না হয় দুই-ই পাবে, কিন্তু রেশমীকে পাচ্ছ না, মেয়েটা থাকবে আমার কাছে, অমন মেয়ে কালে-ভদ্রে মেলে।

চণ্ডী চুপ করে বসে রইল, হাঁ না বলবার সাহস তার নেই, কোন্ কথার কি অর্থ হবে বুঝতে পারে না সে।

এমন সময় দেউড়ির কাছে একটা শোরগোলের মত শুত হল-হাঁ রোখো, রোখো, অন্দর যানা মানা হ্যায়; একেলা নেহি, ক্যায়সে যায়গা?

সকালবেলাতেই কি আবার হাঙ্গামা, বলে অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে উঠে বসবার চেষ্টা করল মোতি রায়, কিন্তু সম্পূর্ণ সফল হওয়ার আগেই খলিতকেশ, শ্ৰস্তবসন আবেগে ও রৌদ্রে রক্তিম মুখমণ্ডল রেশমী এসে সম্মুখে দাঁড়াল, দুঃখে কশাহত হয়ে তার সৌন্দর্য যেন সহস্রনয়নে জেগে উঠছে। রৌদ্রপ্রতিফলিত হীরকের দীপ্তির মত বিচছুরিত হচ্ছে সৌন্দর্যের সূচীমুখ, চেয়ে থাকা কঠিন, চোখ ফিরিয়ে নেওয়া কঠিনতর।

হাঁ করে তাকিয়ে রইল মোতি রায়।

আমি জোড়ামউ গাঁয়ের রেশমী। আমার সন্ধান করছেন আপনি, কি চান বলুন? আমি এসেছি।

বাক্যস্ফূর্তি হল না মোতি রায়ের। সে দুই চোখ দিয়ে গিলতে লাগল সেই অগ্নিসম রূপের মদিরা।

ক্রোধে, অপমানে, লজ্জায়, পরিশ্রমে খুন চেপে গিয়েছিল রেশমীয় মাথায়। চরিত্রের সমস্ত শক্তি তাকে ঠেলে নিয়ে এসেছে এই প্রচণ্ড দুশ্চেষ্টায়। এখন ঐ নির্বাক লুব্ধ দৃষ্টি তার শক্তির শেষ অঞ্জলিকে তরঙ্গিত করে তুলল, সে বলে উঠল, নারীর রূপ কি কখনও দেখেন নি? তবে এই দেখুন! এই বলে, কি করছে ভাল করে বোঝবার আগেই সে অপসারিত করল বক্ষের অঞ্চল। দোভাসমসৃণ মাণিক্যকঠিন সবুর্ণচিক্কণ, স্তনাগ্রযুগলের সেই সহজ স্বগীয় কান্তিতে এমন একটা সপ্রতিভ পবিত্রতা ছিল যে, পাষণ্ডটাও তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখ নামিয়ে নিল।

রেশমীর ঘরে প্রবেশ করবার পরে মিনিট দুই কালের মধ্যে এই সব কাণ্ড ঘটে গেল। ক্রমে সম্বিৎ ফিরে এল মোতি রায়ের, এতক্ষণ ঘটনার আকস্মিকতায় সে বিগতসম্বিৎ ছিল। মোতি রায়ের কিছুমাত্র সন্দেহ রইল না যে, যে মেয়ের সন্ধান সে করছিল এ ই সেই মেয়ে। কিন্তু এখন কি কর্তব্য স্থির করবার অবকাশ পেল না সে, তার চিন্তা বারে বারে শিথিল হয়ে যায় রেশমীর কথার তোড়ে।

বিস্মিত হয় মোতি রায়। তবে কাল রাতে কাকে উপভোগ করল সে রেশমী ভেবে?

অধিকতর বিস্মিত হয় চণ্ডী বক্সী। তবে কাল রাতে কাকে সে ধরিয়ে দিয়েছিল রেশমী বলে?

কিন্তু বেশিক্ষণ তারা চিন্তা করতে পারে না, রেশমীর অনর্গল বাক্যে ছিন্ন হয়ে যায় চিন্তার সূত্র।

এই নারীদেহটা ভোগ করতে চান, এই তো? পাবেন। কিন্তু তার আগে আমার বোনকে মুক্তি দিন। কোথায় রেখেছেন তাকে বলুন। কেমন আছে সে বলুন। তার বদলে তৃপ্ত হবে আপনার রাক্ষসী ক্ষুধা।

মোতি রায় পাষণ্ড, আর পাষণ্ড বলেই নির্বোধ নয়। ক্ষণকালের জন্য সে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেও বেশিক্ষণ সে ভাব থাকল না তার। সে বুঝল যে, চণ্ডী বগী বাজে মাল দিয়ে তাকে ঠকিয়েছে, আর বাড়ি যাওয়ার আগ্রহটার অর্থও স্পষ্ট হল এতক্ষণে, ধরা পড়বার আগেই সে সরে পড়তে চায়।

মোতি রায় গর্জন করে উঠল, বুধন সিং!

দরজায় এসে সেলাম করে দাঁড়াল বুধন সিং।

এই হারামজাদকে লাগাও পঞ্চাশ জুতি। আর শালালোগকো মৎ ভাগনে দেও।

জী হুজুর।

বুধন সিং টেনে নিয়ে গেল চণ্ডী বক্সীকে।

এই প্রথম রেশমী সচেতন হল যে, ঘরে অপর ব্যক্তি হিল আর সে স্বয়ং চণ্ডী বক্সী।

ইতিমধ্যে রেশমীরও মরীয়া ভাব ক্রমে কমে এসেছে। সে বুঝেছে যে, হঠকারিতায় প্রবেশ করেছে পিঞ্জরে, বিষফল গলাধঃকরণ না করে আর উপায় নেই। বুকের আঁচল তুলে দিয়ে শিলামূর্তির মত সে দাঁড়িয়ে রইল।

মোতি রায় ডাকল, খুদিরাম!

কালো, খোঁড়া, কুৎসিত একটা বুড়ো লোক এসে দরজায় দাঁড়াল। খুদিরাম মোতি রায়ের খাস খানসামা, সমস্ত দুস্কার্যের সহায়ক ও সাক্ষী।

খুদিরাম বলল, বাবু!

এই মেয়েটাকে পালকি করে বাগানবাড়িতে নিয়ে যা। সেখানে স্নানাহারের বন্দোবস্ত করে দিবি, কড়া পাহারা রাখবি। দেখিস পালাতে না পারে, ভারি শয়তান।

তার পরে রেশমীকে লক্ষ্য করে বলল, পালাতে চেষ্টা করলে ডালকুন্তায় ছিঁড়ে ফেলবে, সে চেষ্টা ক’র না। আর তোমার বোনকে ব’ল—তার দেখা ওখানেই পাবে বাজে মাল দিয়ে মোতি রায়কে ঠকালে মোতি রায় সহজে ভোলে না। শুনছ তো বাজে মাল সরবরাহ করলে কিরকম ব্যবস্থা হয়।

অদূরে কোনখানে চণ্ডী বক্সী আর্তনাদ করছে।

আজ সন্ধ্যাবেলায় দেখা হবে, তখন যাচাই করে নেব তোমাদের দুজনের মধ্যে কে রেশমী আর কে সুতী!

তার পরে খুদিরামের উদ্দেশে আর একবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করে মোতি রায় গৃহান্তরে প্রস্থান করল।

.

৪.১৮ জনের যুদ্ধোদ্যম

রাম বসুর মুখে আদ্যন্ত বৃত্তান্ত শুনে জন বলে উঠল, তবে কি তুমি বলতে চাও যে ঐ মোতি রায় নামে লোকটা অসদুদ্দেশ্যে রেশমীকে বন্দী করে রেখেছে?

রাম বসু বলল, সদুদ্দেশ্যে কে কবে বন্দী করে রাখে। তার পরে বলল, তবে রেশমী যে তার আশ্রয়দাত্রীকে উদ্ধার করতে গিয়েছে আর গিয়ে বন্দী হয়েছে এ একপ্রকার নিশ্চিত।

তবে আমি চললাম, বলে টেবিলের দেরাজ থেকে পিস্তল বের করে নিয়ে জন উঠে দাঁড়াল।

ওকি, কোথায় চললে?

রেশমীকে উদ্ধার করতে।

দেখ জন, এ গোঁয়ার্তুমির সময় নয়, ধীরেসুস্থে ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে।

আর ইতিমধ্যে রেশমী অসম্মানিত হক!

না, আজ রাতের আগে সে আশঙ্কা নেই।

কিন্তু ততক্ষণ আমি অপেক্ষা করতে রাজী নই, বলে সে অধীরভাবে পায়চারি করে।

রাম বসু বলে, আমিও রাজী নই, কিন্তু একা তুমি কি করতে পার?

মোতি রায় লোকটাও তো একা।

না, সে একা নয়, তার অনেক বরকন্দাজ অনেক লাঠিয়াল আছে।

তা থাক, জেনে রেখো, আমি শ্বেতাঙ্গ, আর এটা কোম্পানির মুলুক।

তাতে কি লাভটা হবে? তুমি একা গেলে তোমাকে সে হত্যা করে ফেলবে। তার পরে তাকে বিচার করে ফাঁসি দিতে পারবে কোম্পানি; যেমন ফাঁসি দিয়েছিল নন্দকুমারকে। কিন্তু রেশমী কি তাতে রক্ষা পাবে?

জন যুক্তির সাববত্তা বোঝে, পিস্তলটা টেবিলের উপরে রেখে দিয়ে বলে, তবে কি করতে হবে বল?

অস্ত্রশস্ত্র দলবল নিয়ে বাগানবাড়ি ঘেরাও করে রেশমী আর তার আশ্রয়দাত্রীকে উদ্ধার করতে হবে।

রাম বসুর পরামর্শ শুনে জন বলে ওঠে, রাইট! এ অতি উত্তর পরামর্শ। তবে আমি সেই চেষ্টা দেখি।

এই বলে সে কাদির আলীকে ডেকে হুকুম দিল, আমার অফিসের আর বাড়ির যে-সব লোক ঘোড়ায় চড়তে পারে তাদের ডেকে বলে দাও, সব যেন তৈরী থাকে, আমি ঘোড়র ব্যবস্থা করছি।

কাদির আলী গঙ্গারাম ও রাম বসুর মুখে ঘটনা শুনেছিল, এখন ঢালাও হুকুম পেল, ‘জী হুজুর’ বলে সেলাম করে সে বেরিয়ে গেল।

জন বুঝেছিল যে, দু-চারজন শ্বেতাঙ্গ সঙ্গে থাকলে আক্রমণের গুরুত্ব বাড়বে, তার মনে পড়ল, মেরিডিথের নাম। তখনই সে মেরিডিথকে চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিল, জানাল যে, তোমার লোকজনদের মধ্যে যারা ঘোড়ায় চড়তে পারে তাদের নিয়ে যত শীঘ্র সম্ভব আমার অফিসে এস-এখনই একটা অ্যাডভেঞ্চারে বের হতে হবে। আরও জানাল যে, উদ্দেশ্য অতিশয় মহৎ, কাজেই দ্বিধা কর না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মেরিডিথের উত্তর হাতে এসে পৌঁছল। মেরিডিথ লিখেছে “জন, যুদ্ধযাত্রার আহ্বান পেলাম। টিপু সুলতান তো পরাজিত, কার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা? পেশবার বিরুদ্ধে নাকি? না, স্বয়ং দিল্লীর বাদশার বিরুদ্ধে? যার বিরুদ্ধেই হক, আমি আহ্লাদের সঙ্গে প্রস্তুত আছি। মনে হচ্ছে যে, জন-পঞ্চাশেক লোককে ঘোড়ায় চাপাতে পারব। তবে আশঙ্কা হচ্ছে, পঞ্চাশটা ঘোড় যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছলেও পঞ্চাশজন সওয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে না পৌঁছতেও পারে, অনেকেই মাঝপথে পড়ে আহত হবে; তবে তাদেরও যুদ্ধে আহত বলে ধরতে হবে, রণশাস্ত্রের এই হচ্ছে বিধি। যাই হোক, তুমি নিশ্চিত হও, অপরাহ্নের আগেই তোমার অফিসে গিয়ে পৌঁছব। মেরিডিথ।”

পরে ‘পুনশ্চ’ দিয়ে লিখেছে—”যদি দু-চারজন উদ্যমী শ্বেতাঙ্গ পাই, তাদের সঙ্গে নেব।”

মেরিডিথের পত্র পেয়ে জনের ভরসা বাড়ল, বুঝল সে একা নয়।

ইতিমধ্যে জনের লোকজন জমায়েৎ হতে শুরু করেছে। বাড়ি থেকে আরদালি, চাপরাসী, ভিস্তি প্রভৃতিদের ডেকে আনা হয়েছে। সকলকে প্রচুর বকশিশ কবুল করা হয়েছে। জনদের গোটা-পঁচিশেক ঘোড়া ছিল, আরও গোটা-পঁচিশেক ভাড়া করে আনবার ব্যবস্থা হয়েছে। ঢাল, তলোয়ার, শডকিও তূপীকৃত হল, বন্দুকগুলো জন নিজের হেফাজতে রাখল, বাছা বাছা লোকের হাতে দেবে।

রাম বসু খবর পাঠিয়ে ন্যাড়াকে জানিয়ে দিল। সমস্ত খবর শুনে ন্যাড়া মস্ত এক পাগড়ি বেঁধে ঢাল-তলোয়ার হাতে প্রস্তুত হল।

ন্যাড়াকে খুঁজতে গিয়ে রাম বসু আবিষ্কার করল যে, ন্যাড়া ও গঙ্গারাম দুজনে যথারীতি সুসজ্জিত হয়ে তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে, তাদের দুজনেরই দৃষ্টিতে অপরে মোতি রায়।

রাম বসু বলল, ওরে এখন থাম, সে সময়ে দেখা যাবে কে কত বড় ওস্তাদ!

দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, দাঁড়াও কায়েৎ দা, আগে মোতি রায় বেটাকে নিকেশ করে ফেলি।

এমন সময়ে অদূরে অনেকগুলো ঘোড়ার পায়ের শব্দ উঠল। ব্যাপার কি?

সকলে ছাদে উঠে দেখল চৌরঙ্গির পথ দিয়ে একদল ঘোড়সোয়র আসছে—সকলের আগে মেরিডিথ ও জন-দুই শ্বেতাঙ্গ। তাদের দেখে জনের লোকজন আনন্দে চীৎকার করে উঠল। ও পক্ষ থেকেও উঠল আনন্দধ্বনি—দুই পক্ষে বিউগ উঠল বেজে। দু চার মিনিটের মধ্যেই সদলবলে মেরিডিথ এসে পৌঁছল।

জন এগিয়ে গিয়ে মেরিডিথের করমর্দন করল।

মেরিডিথ সঙ্গী দুজনের পরিচয় করিয়ে দিল, মিঃ প্রেস্টন, মিঃ অগলার—আর এ হচ্ছে মিঃ স্মিথ, এই যুদ্ধের কম্যাডার-ইন-চীফ।

বাপার কি জন?

চল ভিতরে চল, সব খুলে বলছি। এই বলে জন তিনজনকে নিয়ে তার খাস কামরায় গিয়ে বসল; আবদার দু বোতল ব্র্যাঙি আর চারটে গেলাস টেবিলের উপর রেখে সেলাম করে বেরিয়ে গেল।

মেরিডিথ বলল, বল এবার সব খুলে। জন বলল, দাঁড়াও, আগে বোতলের মুখ খুলি, তার পরে খুলছি নিজের মুখ।

.

৪.১৯ পরিচয়

অপ্রত্যাশিত মিলনের প্রথম বিস্ময় কাটলে রেশমী আগে কথা বলল। বলল, দিদি, অবশেষে তোমাকেও ঋণশোধ করতে হল, সেই রেশমী নামে মেয়েটার জন্যে!

টুশকি বুঝল যে রেশমী এখনও তার যথার্থ পরিচয় পায় নি। সে ভাবল কিভাবে আসল পরিচয় দেওয়া যায়। হঠাৎ ভেবে পায় না, তার পরে ভাবে, যাক গে, কথার মুখে আপনি বেরিয়ে পড়বে, আগে থেকে চেষ্টা করে লাভ নেই।

সে বলে, সংসারে কার ঋণ কে শোধ করে বোন, মানুষের এমন সাধ্য কি যে অপরের ঋণ শোধ করে!

ও সব তত্ত্বকথা জানি নে দিদি, কিন্তু এ নিশ্চয় জানি তুমি যেভাবে ঋণশোধ করলে রেশমীর আপন দিদিও তা করতে পারত না।

টুশকি দেখল আসল কথা পাড়বার এই হচ্ছে সুযোগ, কিন্তু মুখে কথা আসবার আগে চোখে যে জল আসে, ভেসে যায় দুই গাল।

রেশমী ভাবে, গতরাত্রের অভিজ্ঞতা অশ্রর হেতু। তারও চোখ ভরে ওঠে জলে, ভাবে তার জন্যেই এই অপমান টুশকির। ভাবে আর আত্মগোপন করে লাভ কি, এমন উপকারীর কাছে কি আত্মগোপন করতে আছে। ভাবে কাল রাতে পরিচয় দেবে বলেই তো স্থির করেছিল, তবে আর বাধা কি। তবু শেষ বাধাটুকু ঘুচতে চায় না।

তাকে দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয় টুশকি, বলে, কি করে জানলে যে তোমার আপন বোন থাকলে এমনভাবে ঋণশোধ করত না?

কেমন করে জানব বল, থাকলে কি হত!

কখনও কি ছিল না?

রেশমী দ্বিধামাত্র না করে বলে, না, ছিল না। টুশকি স্থির করেছিল ধীরে ধীরে কথার মোড়ে মোড়ে আঘাত সইয়ে সইয়ে আত্মপরিচয় দেবে। কিন্তু রেশমীর অস্বীকৃতিতে তার সমস্ত ধৈর্য ভেঙে পড়ল, কীটদষ্ট মহীরুহ একমুহূর্তে হল ভুমিসাৎ। মানুষ বোধ করি আর সব সহ্য করতে পারে, কেবল বেনামী কৃতজ্ঞতা ছাড়া।

সে একেবারে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

রেশমী বলল, কাঁদ কেন টুশকি-দি?

ওরে টুশকি নয়, টুশকি নয়, বল্ টুনিদি।

টুনি! রেশমী আমূল কেঁপে ওঠে, কি বলবে ভেবে পায় না, ও নাম কেমন করে জানল টুশকি?

দুর্লঙ্ঘ্য বাঁধে প্রথম বন্ধ দিয়ে এক অঞ্জলি জল যখন নির্গত হয়, কারিগরে ভাবে মেরামত করে নিলেই হবে, কিন্তু তখনই এখানে ওখানে ফাটল দেখা দেয়, ক্রমে ফাটলের সংখ্যা আর বিস্তার বাড়ে, কিছুক্ষণ পরে বাঁধের আর অস্তিত্ব থাকে না।

.

এবারে বাঁধের প্রকাণ্ড এক চাঙড় ভেঙে পড়ে। টুশকি বলে, ওরে আর ভাঁড়াস নে। কাল যখন পাষণ্ডটা ধরে আনল, ভাবলাম, ভগবান, এ কি পরীক্ষায় ফেললে! কিন্তু যখন শুনলাম যে, আমাকে রেশমী মনে করে এনেছে,–

সকলকেই তো তাই মনে করে আনে—

কিন্তু সকলে তো তার আপন বোন নয়—

কি বলছ তুমি!

এবারে চীৎকার করে টুশকি বলে ওঠে, ওরে রেশমী রেশমী, এতকাল কেন সৌরভী নাম নিয়ে ভাঁড়িয়ে ছিলি, কেন বলিস নি তুই আমার আপন বোন, তুই রেশমী!

রেশমীর মনে অভাবিতের চমক লাগে। বলে, এসব কি বলছ, খুলে বল, খুলে বল!

কিন্তু খুলে বলা কি সহজ! এ যে লজ্জার কথা, দুঃখের কথা। যে জীবন মাটির তলে চাপা পড়ে ছিল তা তুলে বলবার কথা! তবু বলতে হয়।

ওরে রেশমী, তোর টুনি নামে বোন ছিল মনে পড়ে?

বিদ্যুৎভরা নৈঃশব্দ্য নামে রেশমীর মুখে চোখে।

টুশকি সংক্ষেপে বলে, আমি সেই টুনি।

তুমি টুনি। আর কিছু বলতে পারে না রেশমী।

আমি টুনি, জোড়ামউ গাঁয়ের টুনি; তুমি বেশমী, জোডমউ গাঁয়ের রেশমী।

ঐ কথাগুলো বারংবার সে আবৃত্তি করে করে যায়, জীবমৃত ব্যক্তি যেমন বারে বারে দেহে আঘাত করে দেখে সত্যই জীবনের অনুভূতি আছে কি না।

বিস্ময় কাটে না রেশমীর। সে বলে, তুমি টুনিদি! তবে বাবা মা নাড় কোথায়? মনে পড়ে না তাদের কথা সত্য কিন্তু বাল্যকাল থেকে শুনে শুনে সমস্ত যেন পরিষ্কার দেখতে পাই।

কেউ নেই রে বোন। আমি না থাকলেও বোধ করি ভাল ছিল।

সুগভীর খাদের ধারে দাঁড়িয়ে পা পিছলে পড়বার ঠিক আগের মুহূর্তে এ কি অন্তিম রহস্যময় পরিচয়! আর দু’দণ্ড পরিচয়টা না হলে এমন কি ক্ষতি ছিল! আশ্চর্য এই জীবন!

এতদিন দুজনের জীবন এক বাড়িতেই সমান্তরালভাবে চলছিল, কোথাও দুই জলধারায় যোগাযোগ ঘটে নি। আজ দুঃখের বন্যায় তীর ছাপিয়ে দুই নদী একাকার হয়ে গেল।

তখন দুই বোনে নিরিবিলি বসে নিজ নিজ জীবন-বৃত্তান্ত বলে যায়। টুশকি আগে বলে গঙ্গাসাগর যাত্রা, বোম্বেটের আক্রমণ, আর সকলের মৃত্যু, টুশকির কলকাতায় আগমন। কলকাতার অভিজ্ঞতা বর্ণনার সময়ে বড় বড় ফাঁক রয়ে যায়, সে ফাঁকগুলো পূরণ করে নিতে কষ্ট হয় না রেশমীর, জীবনের সঙ্গে তারও ঘটেছে পরিচয়।

ওদিকে রেশমী বলে তার জীবন বৃত্তান্ত। মুমূর্যর সঙ্গে বিয়ে, চণ্ডী বীর লোভ, চিতা থেকে পলায়ন, কেরীর আশ্রয়, মদনাবাটির অভিজ্ঞতা, কলকাতায় প্রত্যাবর্তন, রোজ এলমার—সব বলে যায়। জনের সঙ্গে তার সম্বন্ধটা খসড়ায় আঁকে, বাদ দেওয়া চলে না, বাদ দিলে শ্রীরামপুরের কথা বাদ দিতে হয়, মোতি রায়ের কথাও বাদ পড়ে যায়।

টুশকি আর রেশমী আবিষ্কার করে যে, তাদের পরিচয় হওয়ার অনেক আগে। থেকেই দুটো সুতোয় তারা বাঁধা পড়ে গিয়েছে—রামরাম বসু আর ন্যাড়া।

দুজনেই মনে মনে ভাবে, মুখেও শেষ পর্যন্ত বলে, কায়েৎ দা থাকলে এর বোধ হয় একটা বিহিত হত, কিন্তু কোথায় যে গেল সে!

আর ভাবে, আহা, ঐ ন্যাড়া যদি তাদের হারানো ভাইটি হত! কিন্তু কেমন করে তারা জানবে যে, উপন্যাসে যেমন করে সমস্ত ছিন্ন সূত্রগুলো অনায়াসে জোড়া লেগে যায, জীবনে তেমনটি যায় না। দু-চারটে ছিন্নসূত্র শেষ পর্যন্ত অবলম্বনহীন হয়ে ঝুলতেই থাকে।

লজ্জায় আর দুঃখে ভরা দুজনের জীবনকাহিনী কখন একসময়ে শেষ হয়ে আসে, তখন সম্মুখে থাকে ভবিষ্যতের চিন্তা।

দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তার পর হঠাৎ টুশকি বলে ওঠে, আচ্ছা রেশমী, তুমি জনকে বিয়ে কর না কেন?

রেশমী কৃত্রিম বিস্ময়ে বলে, সে যে খ্রীষ্টান!

সত্যকার বিস্ময়ে টুশকি বলে, তাতে কি? খ্রীষ্টান জন কি খাঁটি হিন্দু মোতি রায়ের চেয়ে খারাপ?

আসল কথা রেশমী বলতে পারে না; জনের সঙ্গে তার বিয়ের আভাস দিয়েছিল সে, কিন্তু পরে জন যে তাকে ত্যাগ করেছে, অকথ্য দোষারোপ করেছে সে কথাটুকু বলে নি। ও কথা প্রকাশ করতে চায় কোন মেয়ের মন!

কিন্তু এখন জনের প্রসঙ্গে সঙ্কটমুক্তির একটা উপায় যেন সে দেখতে পেল। এতক্ষণ কথাবার্তার তলে তলে টুশকিকে মুক্ত করবার উপায় অনুসন্ধান করছিল। কাল রাত্রে টুশকি তার পরিচয় স্বীকার করে নিয়ে তাকে বাঁচিয়েছে—আজকে কি তাকে বাঁচাতে পারবে রেশমী?

জনের প্রসঙ্গে মনে হল, এবারে বোধ করি উপাযটা পাওয়া যাবে, তাই বলল, এতদিনে আমার খোঁজ না পেয়ে জন বোধ করি বিয়ের ইচ্ছা পরিত্যাগ করেছে।

টুশকি বলল, আবাৰ খোঁজ পেলেই সে ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠবে।

কিন্তু খোঁজ পাবে কেমন করে দিদি, কেমন করে জানবে যে আমরা এখানে বন্দী হয়ে আছি?

তা বটে। চুপ করে টুশকি, ভেবে পায় না জনকে সংবাদ দেওয়ার উপায়।

তখন রেশমী বলে, তুমি এক কাজ কর না দিদি, জনের ঠিকানা দিচ্ছি, তাকে গিয়ে সংবাদটা দাও না, তাহলে নিশ্চয় সে একটা উপায় করবে।

রেশমী জানত যে, জনের মনের যে অবস্থা তাতে কিছু আশা করা চলে না আর সে উদ্দেশ্যেও এ প্রস্তাব করে নি সে। তার ইচ্ছা ঐ ছুতোয় টুশকিকে বাইরে যেতে রাজী করা। তার নিজের কর্তব্য সে একপ্রকার স্থির করে ফেলেছে।

রেশমীর কথা শুনে টুশকি বলল, কিন্তু এখান থেকে বাইরে যাওয়ার পথ যে বন্ধ।

সে কি একটা কথা! যতক্ষণ খাস ততক্ষণ আশ। উপায় করতেই হবে, বাঁচতে হবে তো।

কিন্তু তুমি?

জন যদি তোমার কাছে খোঁজ পেয়ে আসে তো ভালই, আর না এলেও আমি পালাতে পারব।

টুশকির মুখে সংশয়ের ছায়া দেখে সে বলে, পালাতে আমি খুব অভ্যস্ত। চিতা থেকে পালিয়েছি, মোতি রায়ের গুদের হাত থেকে একবার পালিয়েছি-আবার পালাব।

সরল বিশ্বাসে কথাটা গ্রহণ করে টুশকি, তবু শুধায়, কিন্তু উপায়?

ঐ যে উপায় আসছে।

এমন সময়ে খুদিরাম প্রবেশ করে বলে, কি, নাওয়া-খাওয়া হবে নি? না খেয়ে চোখ মুখ বসে গেলে কর্তা আমাকে যে বকবে? সন্ধ্যাবেলা আবার যে দুজনে জুডি মিলবে ভাল।

এই বলে সে হেসে ওঠে।

টুশকি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় কিন্তু রেশমীর ভাব অন্য রকম। সে সয়েহে হেসে বলে, তোমারও নাওয়া-খাওয়া হয় নি খুদিরাম দাদা?

খুদিরাম দাদা একটু নরম হয়, বলে, আমার আর নাওয়া-খাওয়া! তোমাদের পাহারা দিয়ে বসে আছি।

আহা, তোমার তবে তো বড় কষ্ট।

এই রকম চলেছে আজ কুড়ি বছর।

কি বল খুদিরাম দাদা, কুড়ি বছর খাও নি তুমি? তবে তো লক্ষণকেও ছাড়িয়ে গিয়েছ—সে তো কেবল বারো বছর না খেয়ে ছিল।

হেসে ওঠে খুদিরাম।

টুশকি এতক্ষণ নীরবে দেখছিল খুদিরামকে। তার মনে হল, উঃ, কি বীভৎস লোকটা! আগাগোড়া ঘোর কালো, একটা পা খোঁড়া-কিন্তু কালো রঙটা ঘনতর দেখায় মাথার সাদা সাদা চুলে, সাদা ভুরুতে, সাদা দাঁতগুলোয়–আর চোখের সাদা সাদা অংশ দুটোতে। ঐ সাদার আলোটুকু ফেলে কালো রঙকে দেদীপ্যমান করে তুলেছে।

টুশকি ভাবে, এই বীভৎস পাষটার সঙ্গে রেশমীর এ কি সদয় ব্যবহার!

খুদিরাম রসিকতার উত্তর দেয়, বলে, লক্ষ্মণ না হয় বারো বছর না খেয়ে ছিল, সীতা তো না খেয়ে ছিল না; এখন ওঠ, গান কর, খাও। ওদিকে আবার রাবণ আসছে।

রেশমী হেসে বলে, রাবণের জন্য প্রস্তৃত হয়েই আছি।

এই তো চাই। কিন্তু এ রাবণ আবার মুখ-চোখ-বসা সীতা পছন্দ করে না। তা ছাড়া তোমাকে দেখবার জন্যে শহরের বড়লোকদের আজ ভিড় লেগে যাবে-সকলকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে যে।

রেশমী সাগ্রহে বলে, তবে তো নাওয়া-খাওয়া করতে হয়। এতগুলো বড়লোকের সামনে শুকনো মুখে বের হলে কর্তা বোধ হয় তোমাকে মন্দ বলবে।

শুধু মন্দ বলা! চাবকে হাড়েমাসে আলাদা করে দেবে না। এই দেখ বলে পিঠে কয়েকটা দাগ দেখায়।

এবারে সত্যই দুঃখ হয় রেশমীর।

খুদিরাম বলে, আমাকে কেন রেখেছে জান দিদিমণি, এই কালো রঙটার জন্যে। কালো রঙ যে চাবুকের দাগ লুকিয়ে রাখে।

এ কাজ ছেড়ে দাও না কেন!

সাধ করে কে এমন কাজ করে?

তবে?

ছাড়তে গেলে কুকুরের মত গুলি করে মারবে।

কেন?

কেন কি! আমি যে বাগানবাড়ির অনেক রহিস্যি জানি। যতদিন এখানে আছি, মুখ বন্ধ আছে, কাজ ছেড়ে অন্যত্র গেলেই মুখ খুলব বলে ভয় করে কর্তাবাবু।

সত্যি তোমার বড় দুঃখ, দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেশমী।

নররাক্ষস মোতি রায়ের সহকারী খুদিরামও কম রাক্ষস নয়। কিন্তু এ সংসারে কোন রাক্ষসই নিরেট রাক্ষস নয়। তাকে তৈরি করবার সময়ে সৃষ্টিকর্তার আঙুলের স্পর্শ যে লাগে রাক্ষসের দেহে-ঐটুকুতে বাঁধন আগা থেকে যায়। রেশমীর সদয় ব্যবহার ঐ বাঁধনগুলোকে আর একটু আগা করে দিল।

রেশমী বলল, উঠে নাওয়া-খাওয়া করতে হয়, নইলে আবার তোমার উপরে মারধোর হবে। কিন্তু এক কাজ কর না কেন খুদিরাম দাদা—এই টুশকিদিকে ছেড়ে দাও না কেন?

সে কেমন করে হয়?

কেন হবে না? কর্তার নিজের মুখে তো শুনেছ যে, আমি হচ্ছি আসল রেশমী।

তা শুনেছি বই কি।

তবে আর একে আটকে রাখা কেন?

ছাড়তে তো বলে নি।

না ছাড়তেও বলে নি-ওটা বুঝে নিতে হবে। বুঝলে না খুদিরাম দাদা, অন্য লোক হলে খুলে বলত, তোমার মত বুদ্ধিমান লোককে খুলে বলা বাহুল্য মনে করেই বলে নি।

বুদ্ধির প্রশংসায় খুশি হয়ে সে বলল—তা বাতুল্যি বটে।

তবে আর কি, ছেড়ে দাও। নাও এখন কোথায় স্নানের জায়গা দেখিয়ে দাও।

কি কারণে জানি না, দীনতম মানুষের মনও প্রাজ্ঞতম ব্যক্তির দুরধিগম্য, টুশকিকে ছেড়ে দিতে খুদিরাম সম্মত হল।

তবে তুমি এস টুশকিদিদি, বলে খুদিরাম এগিয়ে গেল।

শেষ মুহূর্তে টুশকি বেঁকে বসে, বলে, না, তোমাকে ছেড়ে আমি একা যাব না।

রেশমী বোঝায়, দুজনের একসঙ্গে যাওয়া সম্ভব নয়। তুমি যাও, গিয়ে জনকে সব খবর দাও, কায়েৎ দার সন্ধান পেলে তাকেও সব জানিও–আমার মুক্তি পাওয়ার এ ছাড়া উপায় নেই। নাও ওঠ, শীগগির কর, আবার কে কোথা থেকে এসে পড়বে, তখন সব মাটি হয়ে যাবে।

অনেক কষ্টে তাকে বুঝিয়ে পড়িয়ে জনের ঠিকানা বলে দিয়ে বিদায় করে দেয় টুশকিকে। সে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় হয়ে যায়, বলে যায়, আমি এখনই ওদের নিয়ে ফিরে আসছি বোন, ততক্ষণ একটু সাবধানে থেকো।

রেশমী হেসে বলে, আমার জন্যে ভয় কর না দিদি, আমার কর্তব্য আমি স্থির করে ফেলেছি।

তার শেষ কথাগুলোর অর্থ তলিয়ে দেখে না টুশকি, রেশমীকে উদ্ধার করতে হবে এই সঙ্কম নিয়ে দ্রুত অনুসরণ করে খুদিরামের।

.

৪.২০ রেশমীর সঙ্কল্প

রেশমী স্থির করেছে মরবে। বাঁচবে কেন? ধাচে আশায়। কোন আশা আছে রেশমীর? মৃত্যুর সাক্ষী বা সঙ্গী করতে চায় না টুশকিকে—তাই তাকে কোন ছুতায় বিদায় করে দিয়েছে সে। জনের কাছে সাহায্যের আশা যে নেই, তার চেয়ে বেশি কে জানে। দীর্ঘকাল পরে, অপ্রত্যাশিত ভাবে ফিরে পেল হারানো বোনকে, কিন্তু এ যে না-পাওয়ারই সামিল। আর দুদিন, না, একদিন আগে ফিরে পেলেও পাওয়া হত। গতকাল পরস্পরের পরিচয় দানের কথা ছিল, তখন পেলেও পাওয়া হত। কিন্তু এ যে খাদের মধ্যে পতনশীল বাক্তির পাওয়া। সে-পাওয়া কি না-পাওয়া নয়? আর মদনমোহন! সে যে এমন করে দুঃসময়ে ফাঁকি দেবে কে জানত? সেই বুড়ি-মা বলেছিল, ও আমার দুইর শিরোমণি, ফাঁকি দিতে ওর জুড়ি নেই, সব ছেড়ে ওকে না ধরতে পারলে ও ধরা দেয় না। সব ছেড়ে ওকে ধরতে পারে নি রেশমী, ও জনের সন্ধান পাওয়া মাত্র আলগা হাত ফসকে মদনমোহন পালাল। জন, টুশকি, মদনমোহন—তিন কৃল গিয়ে তার কোন আশাটা রইল বাকি? বাঁচবে কেন? মৃত্যুর দিকেই যে হাতের পাঁচটা আঙুলের নির্দেশ।

মৃত্যুর কথায় তার ফুলকিকে মনে পড়ে। সে বলেছিল যে, মরতে চাই নে, আবার মরতে ভয়ও পাই নে। সে আকাশের দিকে দেখিয়ে বলেছিল যে, ঐ মেঘখানার মত কখন মিলিয়ে যাব-ভয়টা কিসের?

রেশমী বলেছিল, মৃত্যুর পর কি হবে ভেবে ভয় কর না?

ফুলকি হেসে বলেছিল, মৃত্যুর আগে কি আছে দেখলাম তো সব। মৃত্যুর পরে এর চেয়ে আর খারাপ কি হবে? না রেশমী, আমার ভয় করে না।

ফুলকির প্রসঙ্গে ওর আরও অনেক কথা মনে পড়ে। ফুলকি বলেছিল, পুরুষগুলো বড় লোভী, সন্দেশ দেখলেই খাই-খাই করে। কত আর পাহারা দিয়ে বসে থাকা যায়। দিই একটু হাতে তুলে, খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

রেশমী ভাবে, এমন করে তো সন্দেশ যার-তার হাতে তুলে দেওয়া যায় না, এ যে একজনের উদ্দেশে নিবেদন করা। আর অনিবেদিত হলেই কি যাকে-তাকে দেওয়া যায়? ফুলকির সঙ্গে এখানে মেলে না তার।

স্নানের ঘরে বসে বসে টবের জলের সঙ্গে চোখের জল মিলিয়ে ভেবে যায় রেশমী। এমন সময়ে দরজায় ঘা পড়ে।

ও রেশমী দি, হল? বেলা যে বয়ে গেল!

কাপড় ছেড়ে বেরিয়ে আসে রেশমী। খুদিরাম বলে, এবারে দুটো খেয়ে নাও।

রেশমী বলে, না, এবেলা আর খাব না।

আরও দু-একবার অনুরোধ করে ফিরে যায় খুদিরাম। দোতলার ঘরটা থেকে নীচেকার কর্মচাঞ্চল্যের আভাস পায় সে। ঘরে ঘরে ঝাড়লণ্ঠন জ্বালাবার ব্যবস্থা হচ্ছে, নাচ-ঘরটার যে অংশটা চোখে পড়ে, সেখানে সাদা জাজিম, জরির তাকিয়া, ফুলের হড়াছড়ি; একপাশে বারান্দার উপরে ভূপীকৃত আতসবাজি; পাশের হোট ঘরটায় দেখতে পেল কাঠের বাক্স থেকে বের করা মদের বোতলের সার। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল যে গাড়িবারান্দার কাছে ফিটন, ব্রাউনবেরি জুটতে আরম্ভ করেছে-হঠাৎ সমস্ত বাগানবাড়িটা যেন প্রকাণ্ড একটা বিলাসের দুঃস্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছে।

এত আয়োজন রেশমীর জন্যে! মনে মনে সে হাসে, কিন্তু বুঝতে পারে না যে, তার অগোচরে একটুখানি গর্বের আভাস মিশ্রিত রয়েছে সেই হাসিতে।

এমন সময়ে খুদিরাম এসে একটা পেটরা রাখে তার সম্মুখে। কি আছে ওতে?

খুদিরাম বলে, পেশোয়াজ, কাঁচুলি, ওড়না, ঘুঙুর, আর যেমন মানায় সোনার গহনা।

এসব কেন?

শোন কথা একবার! তুমি কি এই পুরনো শাড়ি পরে আসরে বের হবে নাকি? আজ শহরের বড়লোক সব ভেঙে পড়বে যে তোমাকে দেখতে।

সংক্ষেপে রেশমী বলে, তা বটে।

তবে আর কি, এগুলো নিয়ে সাজতে আরম্ভ কর।

তার পরে বলে, অবশ্য এখনও দেরি আছে, আগে নিকি বাইজীর গান হবে, তার পরে পড়বে তোমার ডাক, সে রাত দশটার আগে নয়।

রেশমী বলে, আচ্ছা তুমি এখন যাও, আমি ঠিক সময়ে সেজে বের হব।

এই বলে পেটরা নিয়ে সে ঘরের দরজা বন্ধ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *