৩.১১-১৫ শ্রীরামপুরে পুনর্মিলন

৩.১১ শ্রীরামপুরে পুনর্মিলন

শ্রীরামপুরে ঘাটের কাছেই ‘ডেনমার্ক টাভার্ন’। কেরী সেখানে খোঁজ করতে রাম বসুকে লিখেছিল। ডেনমার্ক টাভানে পৌঁছতেই কেরী দৌড়ে এসে রাম বসুকে ধরল, ওয়েলকাম মুন্সী, ওয়েলকাম। আমি জানতাম তুমি আসবেই।

কেরী উৎসাহে চীৎকার করে ডাকে, মিঃ মার্শম্যান, মিঃ ওয়ার্ড, শীগগির এস, আমাদের বন্ধু মিঃ বসু এসেছে।

কেরীর আহ্বানে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ওয়ার্ড আর মার্শম্যান।

তার পরে পরিচয়, করমর্দন ও সৌজন্যের পালা শুরু হয়। রাম বসু দেখে ওয়ার্ড আর মার্শম্যান দুজনেরই বয়স অল্প, ত্রিশের দু-চার বছরের উপর, তার অধিক নয়।

কেরী বলে, মুন্সী, আমি তোমার সবিশেষ পরিচয় এদের দিয়েছি, এদের পরিচয় দিই।

তার পরে একটু থেমে বলে, এদের পরিচয় মুখে আর দেব কি-ক্রমে প্রকাশ পাবে। এদের আগমনে আমার শক্তি শতগুণ বেড়ে গিয়েছে, আমরা জোর কদমে ছাপখানার কাজ শুরু করে দিয়েছি।

রাম বসু শুধায়, কিন্তু তোমরা কলকাতা থাকতে শ্রীরামপুরে আস্তানা গাড়লে কেন? এ সব কাজের জন্য কলকাতাই প্রশস্ত।

তাই তো ইচ্ছা ছিল এদের, কিন্তু মাঝখানে এক ভ্রান্তিবিলাস ঘটে যাওয়ার এখানে বাস করা ছাড়া আর গত্যন্তর রইল না।

এমন কি ভ্রান্তিবিলাস ঘটতে পারে যাতে এমন হওয়া সম্ভব?

তবে খুলে বলি, বলে কেরী।

এদের জাহাজ কলকাতায় পৌঁছবার আগে সেখানকার কাগজে ছাপা হল যে, কয়েকজন প্যাপিস্ট পাদ্রী আসছে। লেখা উচিত ছিল ব্যাপটিস্ট কিন্তু লেখা হয়ে গেল ‘প্যাপিস্ট’!-কি না পোপের চেলা, রোমান ক্যাথলিক। তুমি নিশ্চয় জান যে, কলকাতার খ্রষ্টীয় সমাজ প্রোটেস্টান্ট খ্রীষ্টান, রোমান ক্যাথলিক গুরু পোপের চেলাদের বড় ভয় তাদের। তখনই সরকারী হুকুম বের হল যে, ওরা যেন কলকাতায় নামতে না পারে। অগত্যা তাদের নামতে হল শ্রীরামপুরে। এ শহর ইংরেজ কোম্পানির অধীন নয়, ডেনমার্কের রাজার রাজত্ব। এখানকার খ্রীষ্টীয় সমাজ সাদরে এদের বরণ করে নিল।

কিন্তু এই সামান্য ভুল কি সংশোধন করা যায় না? শুধায় রাম বসু।

মুন্সী, ভুল বড় মারাত্মক বস্তু, আর সবচেয়ে মারাত্মক—ছাপার ভুল।

তার পরে একটু থেমে সকলের দিকে তাকিয়ে বলে, আমরাও ছাপাখানা খুলেছি, আর ছাপাখানার দৈত্যদানবদের—আমরাই ছাপাখানার দৈত্যদানব-বলে দিয়েছি, দেখো সাবধান, তোমরা এক মারাত্মক ছাপার ভুলের শহিদ, তোমরা যেন আবার ভুল ছেপে বোসো না।

সকলে হো হো করে হেসে ওঠে।

এমন সময়ে মার্শম্যান বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ওই যে একটি ক্ষুদে দৈত্য আসছে।

এক গেলি ভিজে প্রফ হাতে প্রবেশ করে ফেলিক্স কেরী, এই প্রফটা এখনই দেখে দিতে হবে।

কেরী ছোঁ মেরে প্রফটা কেড়ে নিয়ে তন্ময় হয়ে যায়।

মুন্সী এগিয়ে এসে ফেলিক্সের করমর্দন করে জিজ্ঞাসা করে, তার পর মাস্টার কেরী, কেমন আছ?

খারাপ থাকবার উপায় কি! দিনরাত্রি আমি আর মিঃ ফাউন্টেন কাজের মধ্যে ডুবে রয়েছি।

কি ছাপছ?

‘মথীয়ের লিখিত সুসমাচার।’

ওটা কবে শেষ হল?

তুমি চলে আসবার পরে বাবা একাই শেষ কবেছে।

তোমার পিতার তুলনা হয় না মাস্টার কেরী।

প্রুফ নিয়ে ফেলিক্স ফিরে যেতে উদ্যত হলে রাম বসু বলল, চল তোমার সঙ্গে গিয়ে ছাপাখানার কাজ কেমন হচ্ছে দেখি গে। আর অমনি মদনাবাটি ত্যাগের পরেকার ইতিহাসটুকুও শুনে নেওয়া যাবে।

বেশ তো, চল, বলে ফেলিক্স, কাছেই ঐ বাড়িটা আমাদের ছাপাখানা।

ওদের যেতে দেখে কেরী বলে, মুন্সী, এক মিনিট দাঁড়াও।

তার পরে বলে, মুন্সী, তুমি আজ এই মুহূর্ত থেকে আমাদের মিশনের কাজে নিযুক্ত হলে, বেতন ত্রিশ টাকা। কেমন, রাজী তো?

রাম বসু বলে, ডাঃ কেরী, কবে আমি তোমার কথার অন্যথাচরণ করেছি।

ওরা দুজনে বেরিয়ে যায়। কেরী মার্শম্যান আর ওয়ার্ডকে বলে, মুন্সীর সঙ্গে পরিচয় হলে দেখবে পাণ্ডিত্যে, বাগ্মিতায়, নিষ্ঠায় ওর দোসর নেই হিন্দুস্থানে।

তুমি তো চলে এলে মুন্সী, কেন চলে এলে আজও জানতে পারলাম না, তার পরে শুরু হল বিপদ, একটার পরে একটা।

বিগত কাহিনী বলে যায় ফেলিক্স। প্রথমে বাংলা পাঠশালাটি গেল ভেঙে, হিরুর মা একদিন রাতে বাসনকোসন চুরি করে পালাল—সেই সঙ্গে পালাল কুঠির আমলা গোমস্তার দল তবিল ভেঙে। এদিকে মার পাগলামি আরও বাড়ল, ওদিকে উড়নী সাহেব নোটিশ দিল কুঠি দেবে উঠিয়ে। আমি বাবাকে বললাম, চল যাই কলকাতায় ফিরে। বাবা কি বলে জান মুন্সী? সে বলল, জীবন-যুদ্ধে এক পা হটলে আর কখনও এগোনো সম্ভব হয় না। বাবা বলল, এইটুকু অসুবিধেয় পড়ে যদি কলকাতায় ফিরি, তবে কলকাতায় অসুবিধা দেখলে শেষ পর্যন্ত বিলেত ফিরে যেতে ইচ্ছা হবে। না ফেলিক্স, তা হয় না।

মুন্সী তন্ময় হয়ে শোনে, বলে, কথাটা মিথ্যা নয় ফেলিক্স, শেষ পর্যন্ত হটবার ইচ্ছা না থাকলে কেউ প্রথম ধাপ পিছোয় না।

এমন সময়ে মিঃ ফাউন্টেন এল, তার সহায়তায় বাবা কলকাতা থেকে কিনে আনল চল্লিশ পাউণ্ড দিয়ে একটা মুদ্রাযন্ত্র। ঠিক সেই সময়ে গেল কুঠি উঠে, সবাই মিলে চলে এলাম খিদিরপুর নামে নিকটবর্তী এক গ্রামে। সেই ছাপাখানায় যেদিন প্রথম শীট ছাপা হল, পাঁচ গাঁয়ের লোক পড়ল ভেঙে, কলে বই ছাপা হয়। ওদের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। উপলক্ষটা নিয়ে গায়ের লোক একটা গান বেঁধে ছিল, এখনও দু-একটা কলি মনে আছে।

এই পর্যন্ত বলে সুর করে আবৃত্তি করে ফেলিক্স–

ধন্য সাহেব কোম্পানি,
বই লেখা হয় কলে
কলটি যখন চলে
গুরুমশার ব্যবসা মাটি, ঘুচল দানাপানি,
মরি ধন্য সাহেব কোম্পানি।

বাঃ, বেশ লিখেছে তো! বলে রাম বসু, তার পরে কি হল বল?

এমন সময় খবর পৌঁছল যে, এরা পৌঁছেছে শ্রীরামপুরে। বাবাকে সাদরে আহ্বান করল। বাবাও দেখল, উদ্দেশ্য এক, তবে আর অতদূরে পড়ে থাকি কেন, সবাই মিলে চলে এলাম।

আর টমাসের কি হল?

তোমার চলে আসবার কিছুদিন পরে সেই যে সে বেগানা হল, আজও খোঁজ পাই নি তার। কেউ বলে, গিয়েছে রাজমহলে, কেউ বলে বীরভূমে।

মদনাবাটির পরবর্তী ইতিহাসের মোটামুটি একটা আভাস পায় রাম বসু।

রাত্রিবেলা বিছানাতে শুতেই সারাদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা মাকড়সার সুতোর মত কোথায় ছিন্ন হয়ে গেল উড়ে, মনে পড়ল রেশমীর অশুকাতর মুখখানা। নিস্পন্দ চোখের কোণ দিয়ে জল গড়াচ্ছে—সমস্ত মুখখানি নিপুণ ভাস্করের গড়া মূর্তির মত স্থির। সামনে দাঁড়িয়ে রাম বসু অথচ চোখে পড়ছে না, দৃষ্টি হারিয়ে গিয়েছে কোন্ অলক্ষ্য দিগন্তে।

কি হল রে রেশমী, কাঁদছিস কেন?

কে উত্তর দেবে? উত্তর দেবার মালিক যে মন সে আজ কোন্ অগম গহনে পৃথ ভুলেছে। বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে থাকে রাম বসু-দুইজনে মুখোমুখি নির্বাক।

হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে রেশমী বলে ওঠেকায়েৎ দা যে, এখন এলে?

রাম বসু ব্যাখ্যার মধ্যে যায় না, বলে-ব্যাপার কি রে, কাঁদছিস কেন?

ঐ প্রশ্নে চোখের জল আবার দ্বিগুণ বেগে নামে।

রাম বসু বিরক্তির সুরে বলল, কেন কাঁদছিস যদি না বলিস, তবে থাক, আমি চললাম!

ওঃ, বলি নি বুঝি? কায়েৎ দা, আজ সকালে মিস এলমার মারা গেছে।

বলিস কি রে, চমকে ওঠে বসুজা। বলে, হঠাৎ?

ঠিক হঠাৎ নয়, কিছুদিন থেকে শরীর খারাপ চলছিল। প্রায়ই আমাকে বলত, রেশমী বিবি, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না।

ওসব কথা বললে আমি আর তোমার কাছে ঘেঁষব না।

মিস এলমার বলত, তাই বলে মনে কর না যে তোমার দৃষ্টান্ত যম গ্রহণ করবে প্রতিদিন সে একটু একটু করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

বুঝলে কায়েৎ দা, প্রায়ই এমনি কথাবার্তা হত আমাদের মধ্যে।

শেষে কি হয়েছিল বল।

এমন কিছুই নয়, দুইদিন আগে সামান্য জ্বর-কালকে জ্বর বিকারে পরিণত হল, আজ সকালে সব শেষ হয়ে গেল।

রাম বসু বলল, মিঃ স্মিথ খুব দুঃখিত হয়েছে নিশ্চয়?

একবারে ভেঙে পড়েছে, তার সবতাতেই বাড়াবাড়ি।

বলিস কি রে, ভালবাসে, দুদিন বাদে বিয়ে হবে, এমন সময়ে এই কাণ্ড, ভেঙে পড়বে না তো কি?

ভালবাসে না ছাই, মিস এলমার ওকে দুচক্ষে দেখতে পারত না।

কিন্তু আমাকে যে স্মিথ বলেছিল কবচের ফল ফলেছিল!

এই তো ফল দেখলে। তাছাড়া যে পুরুষ কবচ-তাবিজ করে তাদের এমনিটিই হয়ে থাকে, এমনিটিই হওয়া উচিত।

বেশ একটু চাপা ঝাজের সঙ্গে কথাগুলো বলে রেশমী। রাম বসু বুঝতে পারে তার ঝাঁজের কারণ।

এ যে আর এক সমস্যা হল।

কেন?

এখন থাকবি কোথায়?

লেছি রাসেল এখানেই থাকতে বলেছে আমাকে; বলেছে, তুমি আর কোথায় যাবে, যতদিন আমরা আছি এখানে থাক।

যাক, নিশ্চিন্ত হলাম, নইলে কাল আমার যাওয়া হত না।

কাল আবার কোথায় চললে?

শ্রীরামপুরে, কেরী সাহেব ডেকে পাঠিয়েছে।

ওরা কি সব শ্রীরামপুরে এসেছে?

নইলে আর আমাকে ডেকে পাঠাবে কেন?

তবে কি এখন ওখানেই স্থায়ীভাবে থাকবে?

আমার পক্ষে যতখানি স্থায়ী হওয়া সম্ভব।

কিন্তু নরুর কষ্ট হবে না?

ইতিমধ্যে ন্যাড়া এসে অন্নদার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে গিয়েছে।

রাম বসু বলে, মা মরলে কোন ছেলের কষ্ট না হয়?

তার উপরে তুমি আবার চললে!

মার অভাব কি বাপে দূর করতে পারে? থেকেই বা কি করব?

রাম বসুর ঘুম আসতে চায় না, ঘুরে ঘুরে রেশমীর মুখ, রেশমীর চোখের জল মনে পড়ে। এতদিন রেশমীর স্মৃতি যদি বা একটু ঝাপসা হয়ে এসেছিল, অশ্রুধীত হয়ে তা আবার শতগুণ উজ্জ্বল হয়ে উদিত হল তার মনে। একটুখানি কলঙ্কিত না হলে চাঁদ বুঝি এত সুন্দর হত না।

শেষ রাতে একটু ঘুম এসেছিল, হঠাৎ একটা কোলাহলে ঘুম ভেঙে গেল রাম বসুর।

উঠানের মধ্যে সকলে একসঙ্গে তারস্বরে কথা বলছে, বিশেষ উৎসাহের কারণ ঘটে থাকবে। কৌতূহলী হয়ে বাইরে গিয়ে দেখা পাদ্রীদের মধ্যে ডাঃ টমাস দণ্ডায়মান। রাম বসু দেখল টমাসের পোশাক যেমন ছিন্ন তেমনি মলিন, চেহারাও তৎ, উপরির মধ্যে সঙ্গে একটি জরাজীর্ণ মধ্যবয়স্ক বাঙালী হিন্দ।

এই যে মুন্সী, তুমিও এসেছ, আহা প্রভুর মন্দির পূর্ণ হয়ে উঠল–বলে ছুটে এসে টমাস জড়িয়ে ধরে রাম বসুকে।

তার পর, ভাল ছিলে তো ডাঃ টমাস?

খুব ভাল। আনন্দে ছিলাম।

এতদিন ছিলে কোথায়?

বীরভূমে সরুল নামে একটা গ্রাম আছে সেখানে।

সেখানে কি গির্জা আছে নাকি?

কোম্পানীর প্রত্যেক কুঠিটাই যে একটা গির্জা। ওখানকার কুঠিয়াল মিঃ চীপ বড় সদাশয় ব্যক্তি।

সঙ্গে ওটি তোমার চাকর নাকি?

আমার চাকর কোথায়? প্রভুর চাকর। ওর নাম ফকির। ও হচ্ছে ‘খ্রীষ্টের খোয়াডে প্রবেশেছু একটি মেষ।’

বেশ বেশ, বড় আনন্দের কথা, বলে মুন্সী।

ওকে খ্রীষ্টমন্ডলীভুক্ত করে প্রথম খ্রীষ্টান করবার গৌরব লাভ করব আমি।

দেখা যাবে তুমি কত বড় বাহাদুর! মনে মনে বলে রাম বসু।

ইতিমধ্যে কেরী, মার্শম্যান, ওয়ার্ড, ফাউন্টেন প্রভৃতি সকলে একে একে সরে পড়েছে, তার কারণ টমাসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রত্যেকের একবার করে শোনা হয়ে গিয়েছিল, পুনরায় শোনবার আগ্রহ আর কারও ছিল না।

টমাস দেখল মুন্সীই একমাত্র শ্রোতা, পাছে সেও অন্য সকলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, তাই সবলে তার হাত ধরে বসিয়ে সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের বিস্তারিত ভাষ্য কথনে নিযুক্ত হল। রাম বসু টমাসের প্রকৃতি জানত, বুঝল সকালবেলাটা এই পর্বেই যাবে।

 .

৩.১২ উদ্দেশ্য—তীর্থদর্শন

চণ্ডী বক্সী রেশমীর দিদিমা মোক্ষদা বুড়িকে হাত করে নিয়ে রেশমীর নামীয় বিষয় আশয় জোত-ব্ৰহ্মত্র বাড়িঘর দখল করে বসেছিল। লোক কানাকানি করছে অনুমান করে যত্রতত্র বলে বেড়াত, আরে বাপু, একটু দেখাশোনা না করলে পাঁচভূতে লুটে খাবে, বুড়ো মানুষ সামলাতে পারবে কেন?

তার পরে বলত, কি গেরো! যত দায় কি আমার ঘাড়ে এসে চাপবে!

লোকে মনে মনে বলত, কথাটা মিথ্যা নয়, গায়ে এবং আশেপাশে পাঁচ গাঁয়ের এমন অনেকগুলো বিষয়-আশয়ের ভার ঘাড়ে চেপেছে বটে তোমার।

চণ্ডী বক্সী বলত, এ যেন কাকের বাসায় কোকিলের ছানা পুষছি, ডানায় জোর পেলেই উড়ে পালাবে, তখন কাকস্য পরিবেদনা! মানে বুঝলে তো মুৎসুদ্দি, কাকের কেবল মনে ব্যথা। এর চেয়ে অনেক ভাল ছিল যদি নিজের জোত-জমির তদারক করতাম।

সে খেদের প্রয়োজন ছিল না চণ্ডীর, নিজস্ব বলতে এক ছটাক জমিও ছিল না তার। চণ্ডীর মত লোকের পক্ষে পরস্বই নিজস্ব।

কিন্তু লোকের কাছে যাই বলুক, মনে শান্তি ছিল না চণ্ডীর। সে জানত রেশমী এখনও জীবিত, আর আছে সাহেবের হেফাজতে। কোনদিন যে হঠাৎ দেখা দেবে, তখন বিষয়-আশয় যাবেই, না জানি কোন প্যাচে পড়বে, ভেবে তার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। বিপদে মধুসূদন মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুর কিছুকাল আগে দেহরক্ষা করেছেন, কাজেই কে তখন রক্ষা করবে চণ্ডীকে!

কিন্তু মেঘ যতই কালো হক দু-একটা রজতরেখা না থেকে যায় না। চণ্ডীর অভিপ্রায়ের প্রধান অন্তরায় তিনু চক্রবর্তী নিহত হয়েছে। গাঁয়ের লোকে আজও বুঝতে পারে নি তিনুর হত্যাকাণ্ডের রহস্য। কেবল চণ্ডী ঠিক অনুমান করেছিল। অসৎ লোকের ধূর্ত না হলে চলে না, সাধুসজ্জনেরই নির্বোধ হওয়া সাজে।

চণ্ডী বুঝেছিল যে, তিনু চক্রবর্তী তার অভিপ্রায় জানতে পেরে রেশমীকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে গিয়েছিল বজরায়। অন্ধকারে শত্রমিত্র একাকার। মরতে মরল তিনু। এটাকেও সে বিধাতার অভিপ্রায় বলে ব্যাখ্যা করত।

সে বলত, মিত্যুঞ্জয়,—মিত্যুঞ্জয় তার দুষ্কর্মের প্রধান সঙ্গী,-বল দেখি এটা কেমন করে ঘটল? আমি যদি অন্যায় কাজ করতেই গিয়ে থাকি, মরা উচিত ছিল আমার, মরল কেন তিন?

লোকে বলে সাহেব অন্ধকারে গুলি চালিয়েছিল।

বাবা মিত্যুঞ্জয়, অন্তর্যামীর চোখেও কি আলো অন্ধকার আছে? তিনি তো দেখেছিলেন কে মরছে, রক্ষা করলেন না কেন?

মৃত্যুঞ্জয় বলে, আপনিই বুঝিয়ে দিন, আমরা যে লোকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না।

তাতে দুঃখিত হয়ো না বাবা, শাস্ত্রের ধর্ম বোঝা সহজ নয়।

তার পরে বেশ শাস্ত্রালোচনার উপযুক্ত শান্ত সংযত ভাবে উপবেশন করে বলে, গীতায় শ্রীভগবান কি বলেন নি যে পরিত্রাণায় সাধুনাম, বিনাশায় চ দুস্কৃতাম, সম্ভবামি যুগে যুগে! আরে বাপু, তিনু যখন মরল তখন বুঝে নিতে হবে যে লোকটা দুষ্কৃতকারী, আমি যখন বেঁচে গেলাম বুঝে নিতে হবে যে আমি সাধু।

একটু থেমে পুনরায় বলে, পড় পড়-গীতা পড়, ভাল করে গীতা পড়লে কোন কাজ করতে বাধবে না।

চণ্ডী খুব সম্ভব শাগরেদের মহিমা সম্পূর্ণ অবগত ছিল না, নতুবা এমন উপদেশ কেন দিতে যাবে!

মৃত্যুঞ্জয় বলল, এখন কি করবেন ভাবছেন?

একবার কলকাতা যেতে হবে।

কলকাতায় কেন?

আমার মনে হচ্ছে খুঁড়িটা ওখানেই গিয়েছে, সেখানে সাহেবের সাহেবে মুখ শোকাশ্রুকি, কতদূর কি গড়াল একবার সরেজমিনে দেখে আসা ভাল–জানই তো ক্ষেত্রে কর্ম বিধীয়তে।

আর কাকে সঙ্গে নেবেন?

বেশি লোক নেওয়া কিছু নয়, জানাজানি হবে যাবে।

তবে একাই যাচ্ছেন?

একেবারে একাকীও কিছু নয়। তুমি যেতে পারবে না?

বাধা কি।

আর সঙ্গে নিতে হবে মোক্ষদা বুড়িকে।

তাকে আবার কেন?

ছেলেমানুষ, কিছুই বোঝ না দেখছি। কলকাতা কোম্পানির মুল্লুক, আইনের রাজত্ব। ঘুড়িটার প্ররোচনায় সাহেবগুলো গোলমাল বাধতে চেষ্টা করলে মোক্ষদাকে এগিয়ে দেব, বলব যে বুড়ি এসেছে নাতনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। বুঝলে না? তা হলে আমাদের আর কোন দায় থাকবে না।

ভাল বলেছেন, কিন্তু বুডিকে তো এত বলা যায় না।

যা বলা যায়, বলেছি, কালীঘাটে যাচ্ছি মা কালীকে দর্শন করতে। বুড়ি নেচে রাজী হয়েছে।

তবে তো চারদিক বেঁধেই অগ্রসর হয়েছেন।

অগ্রসর আর কোথায় হলাম, এখনও তো জোড়ামউ গায়ে বসে আছি। যাও তুমি গিয়ে গোছগাছ করে নাও, কাল সকালেই বেরিয়ে পড়ব।

পরদিন সকালে মোক্ষদাকে নিয়ে চণ্ডী আর মৃত্যুঞ্জয় কলকাতা রওনা হয়ে গেল।

লোকে বলাবলি করল, চণ্ডী মুখে কটুকাটব্য করলেও মনটায় সাদা। বুড়িকে নিয়ে তো গেল কালীঘাটে—একা যেতে তার কি বাধা ছিল? যাই বল, দোষে গুণে মানুষ।

তিনু চক্রবর্তীর অভাবে চণ্ডীর প্রকৃত উদ্দেশ্যের সন্ধান কেউ জানতে পারল না।

.

৩.১৩ জীবিত না মৃত?

বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোডের পুবদিকে সুন্দরবনের মধ্যে খানিকটা জায়গা গাছপালা কেটে পরিষ্কার করে নিয়ে নূতন সমাধিক্ষেত্র স্থাপিত হয়েছে। তারই একদিকে একটি সদ্যোনির্মিত সমাধি পাথর দিয়ে গাঁথা, এখনও চুন-সুরকি ভাল করে শুকোয় নি। একদিন বিকালবেলা জন কতকগুলো সাদা ফুল নিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হল। ধীরপদে বিষণ্ণ মুখে সমাধির কাছে এসে চমকে উঠল—একি, এ ফুলগুলো দিয়ে গেল কে? কাল অবশ্য সে এসেছিল, কিন্তু ফুল তো রেখে যায় নি। সাদা গোলাপের একটি তোড়া নিয়ে কাল এসেছিল সে, তোড়াটি রেখেছিল সমাধির শিয়রে। অনেকক্ষণ বসে থেকে উঠে যাওয়ার সময়ে তোডাটি নিয়ে গিয়েছিল। সাদা গোলাপ রোজির খুব প্রিয় ছিল; ইদানীং কতদিন তাকে হোয়াইট রোজ বলে ঠাট্টা করত। মনে পড়ল রোজি বলেছিল যে কর্নেল ডাকে আমাকে রেড রোজ বলে, এখন আবার তোমাদের মধ্যে ওয়ার অব রোজেস না বেধে যায়। রোজের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ সাদা গোলাপের তোড়াটি সঙ্গে করে সে বাড়ি ফিরেছিল। এখন আবার সেখানে সাদা ফুল দেখে তার বিস্ময়ের অন্ত রইল না, সেই সঙ্গে একটুখানি ঈর্ষাও কাঁটা ফুটিয়ে দিল। আমার প্রিয়জন আর কারও প্রিয়, এ চিন্তা প্রেমিকের পক্ষে হৃদ্য নয়, এমন কি প্রিয়জনের মৃত্যুর পরেও এ চিন্তার ধারা অবসিত হয় না, হয়তো বা বাড়ে। মৃত্যু যখন পর্দা ঝুলিয়ে দেয়, তখন সমস্ত সম্বন্ধের অবসান হয়—থাকে একমাত্র প্রেমের সম্বন্ধ; সেই সম্বন্ধ অপর কোন জীবিত মানুষ স্মরণ করে রেখেছে প্রেমিকের পক্ষে তা অসহ্য। তার মনে একবার বিদ্যুতের কশা আঘাত করে গেল-কর্নেল নয় তো? তখনই আবার মনে পড়ল, না! কর্নেল রোজির মৃত্যুর দিনেই আড়াই-মণী মিস স্পেংলারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে; অবশ্য কর্নেলের পক্ষে যতখানি আত্মসমর্পণ সম্ভব। এ তার নিজের চোখে দেখা। যখন সবাই রোজ এলমারের মৃতদেহের সঙ্গে সমাধিক্ষেত্রের দিকে যাচ্ছিল তখন কর্নেলকে দেখা গেল নবলব্ধ প্রিয়তমাকে নিয়ে জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে যেতে। পাষণ্ডটা নামল না, একটু থামল না, এমন কি একবার টুপিটাও তুলল না! সবাই মনে মনে তাকে ধিক্কার দিল, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, জনের মনে কেন যেন আনন্দ হল। ওঃ, এবার বেশ প্রমাণ হয়ে গেল তোমার প্রেম কতটা সত্য। মৃত্যুর কাছে চালাকি খাটে না।

সে ভাবল, তবে এক ফুল কে দিয়ে গেল? কাল যখন এসেছিল, ছিল না এ ফুল। তবে সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি আরও পরে এসেছিল—অর্থাৎ প্রায় সন্ধ্যাবেলা। তার পরে ভাবল, যে-ই দিক ক্ষতি কি? কর্নেল যে দেয় নি এই তো যথেষ্ট। ফুলগুলি সমাধির শিয়রে রেখে সে মূঢ়ের মত বসে রইল। এমন সময়ে পিছনে পত্ৰমৰ্মরে পদশব্দ শুনে চমকে পিছনে চাইল-রেশমীর হাতে লাল ফুল! এক মুহূর্তে ফুলের রহস্য পরিষ্কার হয়ে গেল তার মনে।

জন উঠে দাঁড়াল, রেশমী বিবি, তুমি?

হাঁ মিঃ স্মিথ।

তুমি কাল এই ফুলগুলো দিয়ে গিয়েছিলে?

হাঁ মিঃ স্মিথ।

আমি ভাবছিলাম, আবার কে এল!

এলেই বা ক্ষতি কি? মৃত্যুর কাছে তো রেষারেষি চলে না।

অবশ্যই চলে না, তাছাড়া তোমার সঙ্গে আমার রেষারেষিই বা হতে যাবে কেন? দাঁড়িয়ে রইলে যে? ফুলগুলো দাও। বস।

রেশমী ফুলগুলো সমাধির শিয়রে সাজিয়ে দিয়ে বসল। লাল ফুল। রেশমীর ফুলে আর জনের ফুলে মেশামেশি হয়ে গেল।

মৃতকে কি লাল ফুল দেয় রেশমী বিবি?

মিস এলমার মরেছেন, একথা আমার মন মানতে চায় না।

হায়, যদি তা সত্য হত!

সত্য হতে বাধা কি? সবই তো মনের ব্যাপার!

ফাল্গুনের হাওয়ার দমক বড় বড় বনস্পতিগুলোর মধ্যে চাপা দীর্ঘনিশ্বাসের মত হুহু করে ওঠে; নানা ফুলের মিশ্র গন্ধ ছড়িয়ে দেয় অব্যক্ত অস্পষ্ট আকৃতি; হাজার পতঙ্গের চঞ্চল পাখা অদৃশ্যের উত্তরীয়-প্রান্তের মত হঠাৎ গায়ে এসে ঠেকে; আর অলক্ষ্য ঘুঘুটা একটানা বিলাপের রশি নামিয়েই চলেছে অতলের তল সন্ধান করে।

কথা ফুরিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ দুজনের, দুজনে মূঢ়ের মত বনের রহস্যের দিকে তাকিয়ে নির্বাক বলে থাকে। মৃত্যুর কাছে মুখরতার স্থান নেই।

রেশমী কি ভাবছিল কেমন করে বলব। তবে জনের আর্ত ভাব, ফুল নিয়ে আগমন বোধ করি তাকে খুশি করে নি। কাল যখন সে দেখল যে সমাধিতে কারও ফুলের চিহ্ন নেই, সে নিশ্চয় জানত জন ছাড়া ফুল দেওয়ার লোক আর কেউ নেই,-তখন মনে মনে বেশ একটু খুশি হয়েছিল। নিজের মনকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল যে, ভালই হল, মৃত্যুর পরে নিঃসপত্ন অধিকার সে পেয়েছে মিস এলমারের। কিন্তু খুশি কি কেবল সেই জন্যেই? হয়তো মনের নীচের তলায় আরও একটা কারণ ছিল—জনের আর কোন টান নেই মিস এলমারের উপরে, নইলে মৃত্যুর দুদিন পরেই এমন করে ভুলে যেত না, সমাধির শিয়রে দুটো ফুল নিতান্ত নিম্পরেও দিয়ে থাকে। আজকে জনকে দেখে মনে লাগল তার খোঁচা, তবে দেখছি ভোলে নি; ভাবল, ভালই তো, এত শীগগির ভোলা কি শোভন? আবার ভাবল, দুটো ফুল দেওয়া নিতান্ত সামাজিক প্রথা, ওর সঙ্গে ভোলা না ভোলার কোন সম্বন্ধ নেই।

মিঃ স্মিথ, তুমি আজই প্রথম এলে?

রেশমী বিবি, গতকালও এসেছিলাম।

তবে ফুল দাও নি কেন?

এনেছিলাম সাদা গোলাপ, সমাধির শিয়রে ঠেকিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেলাম, সাদা গোলাপ আমার প্রিয়ার বড় প্রিয় ছিল।

সমাধির ফুল কি ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

কেন?

মৃত্যুর দান ফিরিয়ে নিতে নেই।

এই তো তুমি এখনই বললে যে রোজিকে তুমি মৃত ভাবতে পার না!

তুমি তো পেরেছ দেখছি।

কেমন করে জানলে?

তোমরা পুরুষরা প্রেয়সী মরলে নিতান্ত দুঃখিত হও না।

চমকে উঠে জন বলে, সে কি কথা!

তরুণতর প্রেয়সীর সন্ধানে সুযোগ পাও তোমরা।

রেশমী বিবি, তুমি যেমন কোমল তোমার কথাগুলো তেমনি কঠিন।

খুশি হল মনে মনে রেশমী। বলল, তোমাদের মনকে আঘাত করতে পারে এমন কঠিন কথা মেয়েদের অজ্ঞাত।

কি উত্তর দেবে জন ভেবে পায় না।

কোকিল দুটো সুরের টানাপোড়েনে আকাশটা প্রায় আচ্ছন্ন করে ফেলল।

জন বলল, রেশমী বিবি, চল, আর থাকা উচিত নয়, সন্ধ্যায় অনেক সময় শ্বাপদ বের হয় এদিকে।

রেশমী উঠল।

কাল আবার আসবে তো বিবি?

দেখি, চেষ্টা করব, সময় পাওয়া দুর্ঘট।

না, অবশ্য এসো, তোমার হাতের ফুল বড় ভালবাসত মিস এলমার।

তুমি নিশ্চয় আসছ মিঃ স্মিথ?

আমার আর অন্য কি কাজ আছে বল। চল তোমাকে একটু এগিয়ে দিই।

দুজনে অগ্রসর হয় পশ্চিমদিকে এবং লোকালয়ের কাছাকাছি এসে চলে যায় দুজন দুদিকে।

জন মনে মনে ভাবে, রেশমী বিবি আসবে তো?

রেশমী মনে মনে ভাবে, পৃথিবী রসাতলে গেলেও জনের না এসে উপায় নেই।

পরদিন নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে মিস এলমারের সমাধির কাছে পৌঁছে জনের মন দমে গেল। কেউ নেই। কিন্তু যখন তার নজরে পড়ল সমাধির শিয়রে টাটকা তাজা ফুলের রাশ, সে হতাশ হয়ে একবারে বসে পড়ল। রেশমী এসেছিল এবং ফুল দিয়ে চলে গিয়েছে। জনের মনে হল এ অন্যায়, মনে হল রেশমী অত্যন্ত বিশ্বাসঘাতক, মনে হল সুখ-সৌন্দর্য আশাপূর্ণ পৃথিবী একবারে নিরর্থক। সে চুপ করে বসে হাঁটুর মধ্যে মাথা খুঁজে পড়ে রইল।

অদূরে একটা সমাধির আড়ালে দাঁড়িয়ে জনের হেনস্তা দেখে রেশমীর চোখে কৌতুকের আভা ফুটল, ওষ্ঠাধরে হাসির রেখা ফুটল, সমস্ত মুখে চোখে ফুটল সার্থকতার আলো, সে যা চাইছিল তা-ই ঘটল। বলা বাহুল্য সে আগেই এসেছিল আর ফুলগুলো রেখে একটু আড়াল হয়েছিল জনের মনোভাব যাচাই করবার উদ্দেশ্যে, সে পরীক্ষা করতে চায় জীবিত ও মৃতের মধ্যে কার টান বেশি? গতকাল পর্যন্ত তার ধারণা ছিল মৃত চাঁদের টানে যেমন জোয়ার ফেনিয়ে ওঠে সমুদ্রের বুকে, তেমনি আজও মৃত এলমার ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে তুলছে জনের বুক। কিন্তু এইমাত্র জনের যে দশা স্বচক্ষে সে দেখল, বুঝল যে এক্ষেত্রে মূতের উপরে জীবিতের স্থান। তার মনে কেমন একটু দয়াভাবের সঞ্চার হল এই হতভাগ্য যুবকটির উপরে, কেমন যেন একটু মাতৃভাব। প্রত্যেক প্রেমের সঙ্গে মাতৃভাব মিশ্রিত, প্রত্যেক নারী সম্ভাবিত মাতা, এই অর্থে নিতান্ত বালিকাও অত্যন্ত বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষের চেয়ে জ্যেষ্ঠতর।

ফাগুনের পত্র-মর্মরে পায়ের শব্দ মিশিয়ে রেশমী কাছে গিয়ে ডাকল, মিঃ স্মিথ।

চকিতে মুখ তুলে চাইল জন, তার মুখে জ্বলে উঠল আলো, বলে উঠল, বিবি, তুমি এসেছ?

এবং তার পরেই কি করছে ভাল করে ভেবে দেখবার আগেই হাত বাড়িয়ে রেশমীর হাতখানা ধরে-পাছে ছলনাময়ী পালিয়ে যায়, পাছে রহস্যময়ী স্বপ্নে পরিণত হয়—বসাল তাকে সমাধির উপরে।

তোমার ফুলগুলো দেখে আমার মন দমে গিযেছিল, ধারণা হয়েছিল তুমি এসে চলে গিয়েছ।

চলে যাব কেন, অন্য সমাধিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম।

কি আর দেখবার আছে ওগুলোতে?

বল কি মিঃ স্মিথ, মৃতের সমাধি বড় রহস্যময়।

না বিবি, এ তোমার ভুল, রহস্যময় যদি কিছু থাকে তবে তা জীবন, যেমন রহস্যময় তেমনি সৌন্দর্যময়, তেমনি সার্থক।

কিন্তু মিঃ স্মিথ, মৃত্যুও কি জীবনের অঙ্গ নয়, মৃত্যুর রহসও যে জীবনের রহস্যের অন্তর্গত।

তোমার কথা ঠিক বিবি, কিন্তু মৃত্যুর মধ্যে প্রবেশের পথ যে জীবনের তোরণ দিয়ে, সমাধিতে প্রবেশ করতে হয় আঁতুড়ঘর দিয়ে।

সেই কথাই তো বলছিলাম, জীবনে প্রবেশের দুটি দরজা, আঁতুরঘর আর সমাধি।

বিবি, তোমাদের হিঙুদের দর্শনশাস্ত্রে সহজাত অধিকার।

তার পর বলে উঠল, আহা তুমি যদি হিঙু না হতে!

তবে কি নিগ্রো হলে খুশি হতে? বলে খিল খিল করে হেসে উঠল রেশমী, যেন প্রেমিকার শিয়রে বীজনরত বনাঙ্গনার হাতে বেজে উঠল রেশমী চুড়ির গোছা।

জীবন-মৃত্যু সম্বন্ধে এত কথা ওদের জানবার নয় যারা বলে, তাদের মনে রাখা। উচিত প্রেম মুখে অজ্ঞাত ভাষা যুগিয়ে দেয়, আবার প্রেমই হরণ করে মুখের ভাষা; যে বসন্ত বনে বনে ফুল ফুটিয়ে তোলে সেই বসন্তই দমকা হাওয়া তুলে আবার তা ঝরিয়ে দেয়।

ওদের মুখের কথা গেল বন্ধ হয়ে, কিন্তু মানুষ তো শুধু মুখ দিয়েই ভাব প্রকাশ করে না। চৈত্রসন্ধ্যায় আকাশ-কোণায় ছোট ছোট বিদ্যুৎ-সঞ্চারের মত ওদের চোখের কোণে কোণে ফুটল জিজ্ঞাসা, শুক্লা তৃতীয়ার চাদের ফালির মত ওদের ওষ্ঠাধরে ফুটল হাসির রেখা, পিপাসার অদৃশ্য মরীচিকা ওদের সর্ব অঙ্গ ঘিরে আলোকরশ্মির চমক তুলতে লাগল।

অবশেষে ওদের মুখের কথা গেল একবারে বন্ধ হয়ে। বসন্তের রাতে হাওয়ার মাতামাতি যখন ক্ষণতরে স্তব্ধ হয়ে যায় তখন আমের বোলের ঘন গন্ধ চেপে ধরে অরণ্যের বুক, সে চাপ একাধারে অসহ্য সুখের আর দুর্বহ দুঃখের, তা সহ্য করা বা সরিয়ে ফেলা দুই-ই সমান কঠিন।

কিছুক্ষণ পরে,কতক্ষণ পরে তা ওরা জানে না, প্রেমের জগৎ দেশকালের অতীত,জন আচমকা বলে উঠল, রেশমী বিবি, আমি তোমাকে ভালবাসি।

নিজের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল জন, কে বলল তার মুখ দিয়ে ঐ কথা? বোকার মত, কিঞ্চিৎ লজ্জিতভাবে তাকিয়ে রইল; ভাবল, না জানি এখনই কি রূঢ় উত্তর শুনতে হবে।

অত্যন্ত সহজভাবে রেশমী বলল, এবারে ওঠ মিঃ স্মিথ, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।

উত্তরের সহজ প্রসন্নতায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল জন, ফাঁসির হুকুমের বদলে বেকসুর খালাসের রায়।

তখনই পরমুহূর্তে নৈরাশ্যের ধাক্কা অনুভব করল বুকে—এখনই ফিরতে হবে?

অবশ্য রেশমী ওঠবার জন্যে কিছুমাত্র ব্যস্ততা প্রকাশ না করায় আনন্দিত হল; কিন্তু তখনই আবার কেমন আশাভঙ্গের ভাব প্রবল হয়ে উঠল মনে, আসল কথাটার জবাব তো মিলল না। বেকসুর খালাস আসামী ফাঁসির দায় থেকে মুক্ত হয়ে দেখে, মুক্তি মিলল বটে, কিন্তু আর কিছু তো মিলল না। বাড়িঘর আত্মীয়স্বজন মায় রাহাখরচ কিছুই নেই সম্মুখে!

কোন্ কৌতুকপরায়ণ অদৃষ্ট প্রেমের নাগরদোলায় চাপিয়ে মানুষকে নিয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস করে, কি আনন্দ পায় সে-ই জানে।

ওঠ মিঃ স্মিথ, সন্ধ্যা হল যে!

সন্ধ্যা হল তো কি হল?

বাঃ, তুমিই তো কাল বলেছিলে যে, সন্ধ্যাবেলায় এদিকে বাঘ বের হয়!

হয় হক, ক্ষতি কি?

ক্ষতি আর এমন কি, কেবল দুজনের ঘাড় ভেঙে রক্ত পান করবে!

বীর্য প্রকাশ করে জন বলল, ডিয়ারি, আগে আমার ঘাড় ভাঙবে।

কিন্তু তাতেই বা কি লাভ হবে, দু-দণ্ড পরে যদি আমার ঘাড় ভাঙে!

দুশমনটার এমন দুঃসাহস কখনো হবে না।

হওয়ার কি কারণ? সে তো আমার সঙ্গে প্রেমে পড়ে নি?

ইনডীড! বলে হেসে ওঠে জন।

হাসির দমকায় ভাবালুতার কুয়াশা যায় কেটে। হাসি তত্ত্বজিজ্ঞাসার প্রথম সোপান।

দুজনে সমাধিক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে রাস্তার উপর আসে। এমন সময় চমকে উঠে জন ইশারা করে দেখায়, ভীত বিস্ময়ে রেশমী দেখে অদূরে গাছপালার আড়ালে সঞ্চরমাণ শার্দূলরাজ। টু শব্দটি করে না কেউ। ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে জনের কাছে রেশমী। জন বাহুবন্ধনে রেশমীকে টেনে নেয়। বাঘের ভয় বাহুবন্ধনের যে জোর দাবি করে তার চেয়ে বোধ করি কিছু অধিক ছিল জনের বাহুতে; বাঘের ভয় পুরুষের যে ঘনিষ্ঠতা দাবি করে। তার চেয়ে বোধ করি কিছু অধিক ছিল রেশমীর নৈকট্যে; দুজনে প্রায় একাঙ্গ হয়ে স্থাণুর মত, মূঢ়ের মত, শিশুর মত, জগতে সবচেয়ে সুখীর মত দাঁড়িয়ে থাকে, ভয়ে, আনন্দে, বিচিত্র সৌভাগ্যে; আবার এখনই ছাড়াছাড়ি করতে হবে সেই দুর্ভাগ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপে; নির্বাক তাকিয়ে থাকে ওরা বাঘটার দিকে; শীঘ্র চলে যাক, ধীরে ধীরে যাক, আর কখনও যেন না আসে, আবার কাল যেন এইভাবে আসে-কত কি বিরুদ্ধ ভাবনার বলাকা উড়ে উড়ে যায় ওদের মনে। মুগ্ধ প্রণয়ী-যুগলের লীলার প্রতি দৃকপাত মাত্র না করে শাল-রাজ নির্দিষ্ট পথে চলে গেল। যে অরণ্যে এদের প্রণয়ের ভূমিকা সৃষ্টি হয়েছিল সেই অরণ্যের শাল-রাজ নির্মোচ্য গ্রন্থি এঁটে দিল ওদের বসনে। বহু যুগ আগে অরণ্যের এক সর্প যে-ভূমিকার সৃষ্টি করে দিয়েছিল আদিম দম্পতির জীবনে, সেই অরণ্যেরই আর এক পশু তারই আর এক অধ্যায়ের সূচনা করে দিল বহুযুগ-পরেকার আর এক দম্পতির জীবনে।

বাঘটা চলে গেলেও বাহুবন্ধন ওদের শিথিল হল না, দৃঢ় হল না ঘনিষ্ঠতা। এখনও ভয়ের কারণ যায় নি, এই বিশ্বাস জাগিয়ে রেখে ওরা তেমনি রইল দাঁড়িয়ে। এমন কতক্ষণ। চলত কে জানে, কিন্তু হঠাৎ সেই সময়ে কোকিলের কুহুতে বুঝি নূতন শর নিক্ষিপ্ত হল, আমের বোলের গন্ধ বুঝি আর একটু চেপে এল, বাতাসের হু-হুতে বুঝি নবীন ইন্দ ধনিত হল, আর শুক্লা তৃতীয়ার কৌতূহলী চন্দ্ৰ বুঝি শাখা-প্রশাখা ভেদ করে কৌতুকের পিচকারি আর একটু বেগে নিক্ষেপ করল–কি হচ্ছে ভাল করে বোঝবার আগেই জনের ওষ্ঠাধর স্পষ্ট হল রেশমীর অধরোষ্ঠে। এমনি চকিতে জ্বালাময় সুখময়, বিষময় অমৃতময়, বেদনা আনন্দময়, সুখদুঃখের নির্যাসময়, বকুজ্জ্বল অগ্নিময় অভিজ্ঞতার সুতীব্র সুদীর্ঘ শূল আমূল নিহিত হল রেশমীর সত্তায়। সে এক ঝটকায় নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে বেগে ছুটে গেল বাড়ির দিকে, পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল না জনের অবস্থা। কিয়ৎক্ষণ অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অপরাধীর ন্যায় ধীরপদে জন চলতে শুরু করল।

এতক্ষণ কৌতুকপরায়ণ অদৃষ্ট দুটি অবোধ তরুণতরুণীর প্রেমের লীলা দেখে নিশ্চয় খুব হাসছিল—এবারে তার ছুটি হল।

তত্ত্বজ্ঞানীরা চিরকাল ধরে আলোচনা করে আসছেন মূলত মানুষ ভাল কি মন্দ। কিন্তু সত্য কথা এই যে, মানুষ মূলত ভালও নয়, মন্দও নয়, মূলত মানুষ বিচিত্র, অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত তার প্রকৃতি। তাই সমাধিতে বসে প্রেমসূত্র রচনায় তার সঙ্কোচ নেই; তাই অচিরগত প্রেয়সীর শ্মশান ভস্ম তার হাতে আবীরমুষ্টি হয়ে ওঠে, তাই সমাধির ফুলে প্রেমের মালা রচনা করে সে। এ কি ভালমন্দের কাজ! এ কাজ অভূতের। বোধ করি এই হচ্ছে মানব-প্রকৃতির সত্য! কিংবা তার চেয়েও অধিক—এই বোধ করি বিশ্বপ্রকৃতির সত্য। জীর্ণ পত্ৰপুষ্প রচনা করে নূতন জীবনের ভূমিকা, প্রেমের সমাধি গঠন করে নূতন প্রেমের রঙ্গমঞ্চ, শ্মশানের বুকে অঙ্কুরিত হয় পঞ্চবটী আর একদিন অবশেষে সমাধিস্থ মৃতদেহ নবতর জীবনের পাত্র হাতে করে দেখা দেয় জ্যোতির্ময় রূপে। জীবনের অশ্ব সবেগে সোল্লাসে সার্থকতার মুখে টেনে নিয়ে যায় মৃত্যুর অনড় রথখানা। পরাজিত মৃত্যু আনন্দধ্বনি তোলে, জয় জীবনের জয়।

.

৩.১৪ কর্তব্যপরায়ণ জন

বাণগ্ৰস্থা মৃগীর মত ছুটে এল রেশমী, পথে লোকজন ছিল না, নইলে সে অবস্থায় তাকে দেখলে অবাক হয়ে যেত—একটা আস্ত মেয়ে এমনভাবে ছুটছে কেন! বাগানের খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল বাড়িতে, একেবারে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল, সে রাতে আহার করবার জন্যেও উঠল না।

সমস্ত অবস্থা ধীরভাবে বিবেচনা করে দেখবার মত মনের অবস্থা তার ছিল না; যখন যে-ভাবটা প্রবল হয়ে উঠেছিল সেইটাকেই নিচ্ছিল চরম বলে; ফলে পলে পলে, পলকে পলকে মনের মধ্যে তার ভাবান্তরের বন্যা প্রবল হয়ে উঠেছিল। প্রথমে অপ্রতিরোধ্য দুর্জয় একটা রাগ হল জনের উপরে, মনে হল অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ঘোতর অপমান করেছে সে রেশমীকে। কিন্তু একবারও তার মনে হল না যে, অসহায় অবস্থা কেবল রেশমীর ঘটে নি, হাতে পেলে জনকে ছেড়ে কথা কইত না বাঘটা। তার পর জনকে কাপুরুষ বলে মনে হল, নইলে একলা পেয়ে মেয়েদের সঙ্গে এমন ব্যবহার কোন পুরুষে করে না। কিন্তু তখনও ভেবে দেখল না যে, মনে মনে সে-ও আকৃষ্ট হয়েছিল জনের প্রতি। খুঁটিয়ে দেখলে তাকে স্বীকার করতেই হত যে, তার মনটাও বেশ নুয়ে পড়েছিল জনের দিকে। দুইখানি মনের মেঘ যখন বেশ জলভার-অবনত হয়ে কাছাকাছি এসে পড়েছে, তখন বাঘটা হঠাৎ এসে পড়ে তাদের মধ্যে বিদ্যুতের রাখী বেঁধে দিল। এতদিনের ধীর মন্থর মন্দাক্রান্তা এক মুহূর্তে শার্দূলবিক্ৰীড়িত ছন্দে পরিণামে গিয়ে পৌঁছল।

এই হল গিয়ে তার মনের সাক্ষ্য। কিন্তু দেহ সাক্ষ্য দেয় ঠিক উল্টো। দেহ থেকে থেকে জনের স্পর্শপুলক স্মরণ করে উল্লাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে। সেই চুম্বিত মুহূর্তটাকে স্মৃতির উপরিতলে টেনে আনবার জন্য চেষ্টার তার অবধি নেই, কিন্তু ঠিকমত পেরে ওঠে না। স্বচ্ছ জলের নীচে দেখা যায় সেই স্বলিত চুনিটা, হাত বাড়িয়ে দেয়, আর একটু নীচে, আর একটু, তবু রয়ে যায় অপ্রাপ্য; চোখে মনে হয় এত কাছে, তবু হাতটা পৌঁছয় না কেন, বুঝতে পারে না বিমূঢ় দেহ। একি রহস্য! একি রহস্যময় যন্ত্রণা! ইন্দ্রধনুর মধ্যে দুটি একটি রঙ আছে, মন বলে আছে বই কি, চোখ তবু ধরতে পারে না, মন যত নিবিষ্ট হয়, চোখ হয় তত উদ্ভ্রান্ত, চোখে আর মনে কিছুতেই সাক্ষ্য মেলাতে পারে না। রেশমীর মন যতই বলছে জন কাপুরুষ, অত্যাচারী, নিষ্ঠুর, দেহ ততই আগ্রহে সেই চুম্বনে উজ্জ্বল মুহূর্তটিকে যথাযথ আকারে উদ্ধার করতে চায়। মন ও দেহের দ্বৈরথ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে রেশমী ভাবে, একি আপদ! এমন সময়ে তার চোখে পরে জনের ছবিখানা। এখানা আবার কে আনল বলে উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে। এনেছিল সে নিজে। রোজ এলমারের মৃত্যুর পরে তার ঘর থেকে ছবিখানা সরিয়ে নিয়ে এসেছিল সে নিজের ঘরে। সরিয়ে ফেলবার উদ্দেশ্যে ছবিখানা হাতে নিয়ে হঠাৎ চমকে ওঠে, জনের মুখে একসঙ্গে দেহ ও মনের বিপরীত সাক্ষ্যের চিহ্ন পড়ে তার চোখে চোখ দুটো দেখে মন বলে ওঠে, এ তো নিষ্ঠুরতায় পূর্ণ; অধরোষ্ঠের গুণ-পরানো ছোট্ট ধনুকটার বিলাস বঙ্কিমা দেখে দেহ সর্বাঙ্গে কণ্টকিত হয়ে ওঠে, চুম্বনঘন সেই মুহূর্তটি অমৃতসিক্ত ক্ষুদ্র একটি শরের মত নিক্ষিপ্ত হয় তার বুকে। কি করছে ভাল করে বোঝবার আগেই দেহ সেখানে মুদ্রিত করে দেয় একটি চুম্বন। পরমুহূর্তে মন করে ওঠে প্রতিবাদ, ছবিখানা দূরে নিক্ষিপ্ত হয়। এইভাবে কতক্ষণ চলত বলা যায় না, কিন্তু এক সময়ে এই অসম দ্বন্দ্বে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল কখন, কাপড় বদলাতেও গেল ভুলে।

ওদিকে জনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। পরদিন যথাসময়ে গেল সে রোজ এলমারের সমাধিতে, বসে রইল সন্ধ্যা যতক্ষণ না গড়িয়ে যায় ঘনান্ধকার রাতে, এল না কেউ। একবারও তার মনে পড়ল না যে, কাল এখানে বাঘ বেরিয়েছিল, আজও বের হতে পারে। মনের বাঘের মুখে যে ধরা পড়েছে বনের বাঘে তার কি করতে পারে। অবশেষে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ফিরে এল। এমনি প্রতিদিন যায়, প্রতিদিন হতাশ হয়ে ফিরে আসে। লিজা তার বিষণ্ণ উদভ্রান্ত ভাব দেখে ভাবে, আহা বেচারা জন, কত কষ্টই না পাচ্ছে! লিজা ভাবে, এত অল্প বয়সে এত বেশি দুঃখ পেল জন। কেটির শোক ভুলতে না ভুলতে রোজির শোক। এক-একবার ভাবে জনকে সান্ত্বনা দেবে, কিন্তু ভাষা পায় খুঁজে; ভাই-এর শোককে মনের মধ্যে গোপনে লালন করে চুপ করে থাকে, ভাবে বেচারা জন।

রেশমী মিস এলমারের সমাধিতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল; জানত যে, সেখানে গেলে জনের সঙ্গে দেখা হওয়া অনিবার্য। সে মনে মনে ভাবল, থাক ওখানে আহাম্মুকটা বসে। বিকাল হলেই বুঝতে পারত জন ওখানে বসে আছে। নির্বোধের নিরর্থক প্রতীক্ষা স্মরণ করে মাঝে মাঝে সে কৌতুক অনুভব করত; আবার রাগও হত, পড়ুক একদিন বাঘের মুখে, হক উচিত শিক্ষা। লোকে বলে প্রেম অন্ধ। ওটা বাড়াবাড়ি, আসলে প্রেম কানা, নিজের দিকের চোখে মাত্র দেখতে পায়।

ক্রমে জনের মনেও প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। সে ভাবল সে কি অকৃতজ্ঞ। ঐ একটা নেটিভ মেয়ের জন্যে সে কিনা স্বর্গের দূতী রোজিকে অবহেলা করেছে। হি হি, এ কি কাপুরুষতা! ভাবল, এ দুঃখ তার ন্যায্য প্রাপ্য, এ তার শিক্ষা। তখনই সে মনঃস্থির। করে ফেলল, রোজি ছাড়া আর কোন মেয়ের কথা স্বপ্নেও চিন্তা করবে না সে। টেবিলের উপরে তাকিয়ে দেখল, এতদিনকার অযতে মিস এলমারের ছবিতে ধুলো জমেছে, অনেকদিনের ফুলগুলো শুকিয়ে মলিন অবস্থায় পড়ে আছে। তখনই সে তুলে আনল তাজা ফুল, সাদা গোলাপ, ধুলো ঝেড়ে ছবিখানাকে সাজাল, আর অনেকদিন পরে তন্ময় হয়ে তাকাল রোজির মুখে। কি সুন্দর চোখ দুটি আনন্দে কৌতুকে সৌন্দর্যে ঝলমল করছে। আর সেই সঙ্গে যে একটুখানি অবিশ্বাসের ভাব ছিল চোখ দুটিতে–সেটুকু পড়ল না অবশ্য জনের চোখে।

জনের মনে পড়ল একদিনের বিশ্রলাপ। জন বলেছিল, রোজি, তোমাকে চিরকাল আমি ভালবাসব।

রোজি উত্তর দিয়েছিল, তার মানে এ-বেলাটা!

ক্ষুব্ধ জন বলেছিল, রোজি, তুমি আমাকে এমন চপল মনে কর?

তোমার দোষ কি জন, ভালবাসা বটাই চপল।

তাই বলে এবেলা ও-বেলা?

এক বেলার জন্যে পেলেই বা মন্দ কি?

দেখে নিও রোজি, আমি সারাজীবন বাসব ভাল।

আমার মৃত্যুর পরেও? শুধিয়েছিল রোজি, চোখে জেগেছিল কৌতুকময় অবিশ্বাসের ভাব।

নিশ্চয়।

কিন্তু কেন জন, চপল বস্তুকে চিরস্থায়ী করবার এই ব্যর্থ চেষ্টা কেন?

তোমাকে ছাড়া আর কাউকে যে আমি জানি নে।

আমাকেই বা কতটুকু জান?

তোমাকে সবটুকু জানি।

জনের ছেলেমানুষি দেখে রোজি হেসেছিল।

জন নিতান্ত অবুঝ না হলে বুঝতে পারত যে, তার প্রতি রোজির মনোভা আর যাই হক, ভালবাসার নয়। যে ভালবাসে, ভালবাসাকে চপল জেনেও চিরন্তন মনে করে সে। তাত্ত্বিকের কাছে ভালবাসা চপল, প্রেমিকের কাছে চিরন্তন।

হবিখানা দেখে আজ সেই সব কথা মনে পড়ল জনের। ছবিখানাকে টেনে নিয়ে সে চুম্বন করল; সঙ্কল্প করল, আজ রোজির সমাধিতে গিয়ে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দেবে। সঙ্কর করবামাত্র দেহে মনে নৃতন এক তেজ ও উৎসাহ বোধ করল সে, তখন সদর্পে সমস্ত অপবাদ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সদম্ভে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। তার পর অনেকদিন পরে দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে প্রফুল্ল মনে একটা হাল্কা গানের সুর শিস দিতে দিতে দ্রুতবিক্ষেপে বেরিয়ে চলে গেল আপিসের দিকে। কর্তব্যপরায়ণ জন।

বিকালবেলা মিস এলমারের সমাধিক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হল জন। সেখানে আর কাউকে না দেখতে পেয়ে সে যে হতাশ হয় নি এই কথাটাই মনকে বোঝাবার জন্যে শিস দিতে দিতে বারকয়েক প্রদক্ষিণ করে নিল সমাধিটা। তার পরে ফুল সংগ্রহের আশায় প্রবেশ করল বনের মধ্যে। আজ অফিস থেকে সোজা আসছিল, তাই ফুল আনতে পারে নি।

ওদিকে সমাধির কাছে এসে দাঁড়াল রেশমী। এতদিন পরে হঠাৎ আজ আসতে গেল কেন সে? রেশমী মনকে বোঝায়, একবার বোকা মানুষটার আহামুকি দেখে আসি; বলে, পুরুষের বোকামি দেখতে আমার বড় ভাল লাগে। এ ছাড়া আর কিছু তার মনের অগোচরে থাকলে কেমন করে জানব! একথা অবশ্য সত্য যে, জনের প্রতি বিদ্বেষ সত্ত্বেও তাকে অনেকদিন না দেখে কেমন যেন দমে গিয়েছিল সে। মনকে বোঝাত, একবার দেখা পেলে দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দিতাম; বুঝত যে, রেশমী রোজি নয়, রেশমী ন্যায্য কথা বলতে জানে। কিন্তু কড়া কথা বলবে কাকে? মানুষটার যে দেখা নেই। মন বলে, যাও না কেন সমাধিস্থলে, শুনিয়ে দিয়ে এস কড়া কথা। রেশমী বলে, পাগল নাকি! তাহলে ভাববে তার সঙ্গে দেখা করবার জন্যেই এসেছি। তার চেয়ে আসুক না এ বাড়িতে। মন বলে, তুমিও পাগল হলে দেখছি। এ বাড়িতে আর কোন সুবাদে আসবে সে? রেশমী বলে, আচ্ছা বাড়িতে না হয় না-ই এল, কিন্তু বাড়ির সামনের পথেও কি যাতায়াত করতে নেই? মন বলে, তুমি কি পথে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে ঝগড়া করবে নাকি? রেশমী বলে, দূর, তা কেন, তবে একবার দেখতাম। মন বলে, দেখবার এত আগ্রহ কেন? সন্দেহজনক নয় কি? রেশমী বলে, আগ্রহ আবার কিসের দেখলে? লোকটা কতখানি শুকিয়ে গিয়েছে তাই একবার দেখতাম। মন বলে, শুকোবে কোন্ দুঃখে? তোমার বিরহে নাকি? আর যদি দেখ যে, না শুকিয়ে বেশ মোটাসোটা হয়ে উঠেছে? রেশমী বলে যে রকম আহাম্মুক, হতেও পারে।

মনের সঙ্গে এইরকম অবিশ্রাম ঝগড়া করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল রেশমী, ভাবল, একবার দেখেই আসি না, ব্যাপার কি! তাছাড়া, গুলবদনীর প্রতিও তো একটা কর্তব্য আছে। কিন্তু সমাধিস্থল শূন্য দেখে মনটা কেমন দমে গেল, নিজের নৈরাশ্যকে অস্বীকার করবার উদ্দেশ্যে বারংবার মনকে বোঝাতে লাগল, আহা, কড়া কথা বলবার সুযোগ হল না। সমাধিস্থলে গিয়ে বসে পড়ল বিষণ্ণ মনে।

কিছুক্ষণ পরে পত্রমর্মরে সচকিত হলে পিছন ফিরে রেশমী দেখল, পাশেই জন কতকগুলো সাদা করবী ফুল হাতে দণ্ডায়মান। জনকে প্রত্যাশা করে নি সে, কাজেই বিস্মিত হল। জনও কম বিস্মিত হয় নি রেশমীকে দেখে। সেও আগে দেখতে পায় নি রেমশীকে, একটা গাছের আড়াল পড়েছিল, অপ্রস্তুত হয়ে সে তাড়াতাড়ি ফেলে দিল হাতের ফুলগুলো।

রেশমী বলে উঠল, ফুল ফেলে দিলে কেন?

জন বলল, রেশমী, তুমি তো সাদা ফুল পছন্দ কর না!

কিন্তু সাদা ফুল যে পছন্দ করে তার জন্যেই তো এনেছিলে?

কে বলল, তোমার জন্যে আনছিলাম।

আমাকে তো প্রত্যাশা কর নি এখানে।

নিশ্চয় করেছি, বলে জন। বলে, প্রেমিকের প্রত্যাশা কি কখনও যায়!

রেশমী জনের কথা বিশ্বাস না করলেও তার অপ্রস্তুত ভাব দর্শনে খুশি হল। চাঁদ কি খুশি হয় না সমুদ্রের উদ্বেল ভাব দর্শনে?

জন শুধাল, তুমি এতদিন এখানে আস নি কেন রেশমী?

কেমন করে জানলে যে আসি নি?

আমি যে এসে এসে হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছি।

হতাশ হলে কেন? সমাধি তো ছুটে পালায় নি!

সম্পূর্ণ অসহায়ভাবে জন বলে ফেললে, তুমি জান রেশমী, আমি এখানে কেন। আসি?

নিতান্ত নিরীহের মত রেশমী বলল, কেমন করে জানব?

অধীর আবেগে জন বলে উঠল, জান না? নিশ্চয় জান।

কি জানি?

আমি তোমাকে ভালবাসি, কায়মনোবাক্যে ভালবাসি, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসি নে।

জনের উক্তির পক্ষে অন্য কোন প্রমাণের প্রয়োজন ছিল না, তার কণ্ঠস্বরই যথেষ্ট প্রমাণ।

বলা বাহুল্য, রেশমী মনে মনে খুশি হল—এহেন কণ্ঠস্বরে এহেন উক্তিতে কোন্ নারী না খুশি হয়!

কিন্তু এ কথার কি উত্তর দেবে রেশমী? যেখানে কথাটা অবিশ্বাস্য বা অগ্রাহ্য সেখানে উত্তর যেগায়, অন্যত্র মৌনই যে শ্রেষ্ঠ উত্তর। কিন্তু গোলমাল বাধায় এই মৌন ভাবে, মৌন সম্মতির লক্ষণ হতে পারে আবার অসম্মতির লক্ষণ হতেও বাধা নেই।

রেশমীর নীরবতায় শঙ্কিত জন তার পাশে বসে পড়ে রেশমীর হাত দুটি হাতের মধ্যে টেনে নিল, রেশমী ছাড়িয়ে নিল না হাত। এতেই রেশমীর মনোভাব বোঝা উচিত ছিল জনের, কিন্তু কিছু বুঝতে না পেরে উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে রইল রেশমীর মুখের দিকে।

এসব ক্ষেত্রে পুরুষ নির্বোধ। মেয়েরা অনেক অনায়াসে পুরুষের মনের ভাব বুঝতে পারে। বুদ্ধিজীবী পুরুষ প্রমাণ চায়, সংস্কারজীবী নারী অনুমান করে নেয়।

হঠাৎ লাফিয়ে উঠে জন বলল, দাঁড়াও, তোমার জন্যে লাল ফুল নিয়ে আসি, বনের মধ্যে দেখেছি একটা পলাশ গাছ!

এই বলে সে বনের ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে ছুটে চলে গেল। বনের মধ্যে সন্ধ্যাবেলায় বিপদ হতে পারে জেনেও বাধা দিল না রেশমী। দ্রৌপদীও তো বাধা দেয় নি পাণ্ডবদের নীলপদ্যের সন্ধানে যেতে।

রেশমী সুখস্বপ্নগ্রস্তের ন্যায় বসে রইল, কিছু চিন্তা করবার মত মনের অবস্থা তার ছিল না, জনের স্পর্শে তখন তার দেহের উপশিরা উচ্চ নিখাদে আহত বীণাযন্ত্রের মত রী রী করছিল। কখন যে ফিরে এল জন কিংশুকের স্তবক নিয়ে, কখন যে তার খোঁপায় খুঁজে দিল কিংশুকের বহ্নিবলয়—ভাল করে জানতেও পায় নি রেশমী, তার পর যখন জন তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে চুম্বনে চুম্বনে সহস্র ভ্রমর-চিহ্নিত নিশ্চল পদ্মের মত উদভ্রান্ত করে দিল তখন আর কিছু জানবার অবস্থা ছিল না তার, বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হয়ে দিব্যজ্ঞানের স্বর্ণতোরণ দিয়ে তখন চলে গিয়েছে সে কোন আদিম অবস্থার মধ্যে। তখন সেই অবস্থায় সে একরকম করে অনুভব করল, আকাশের সবগুলো গ্রহনক্ষত্র সোনার ঘণ্টা হয়ে জ্যোতির্ময় সঙ্গীত ধনিত করছে, অরণ্যের সবগুলো তরুলতা অযুত বাহু আন্দোলন করে মহানত্যে মত্ত হয়ে উঠেছে, আর পৃথিবীর সব ধূলিকণা মহোৎসবের ক্ষেত্রে যে ধুলোট রচনা করেছে আত্মবিস্মৃত স্বয়ং মহাকাল সেখানে লুটোচ্ছে, চরাচরের চৈতন্য চেতনার শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে আপনাকে ফেলেছে হারিয়ে, সিন্ধুতে বিন্দুবিলীন।

প্রথম সম্বিৎ পেল জন, দেখল রাত্রি প্রায়োত্তীর্ণ প্রথম প্রহর, বুঝল নিরাপত্তার কাল অনেকক্ষণ গত।

সে বলল, রেশমী, এবারে ওঠ। রেশমী কোন কথা না বলে কেশবাস বিন্যস্ত করে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

তখন দুইজনে বাহুবদ্ধ অবস্থায় বেরিয়ে এল সমাধিক্ষেত্র থেকে।

সমাধির উপরে যখন মুগ্ধ নরনারীর এই লীলা চলছিল তখন খুব সম্ভব অসহায় জনের একটা হিল্লে হল ভেবে সমাধির অভ্যন্তরে রোজ এলমার স্বস্তিতে পাশ ফিরে শুয়েছিল। আর তার আশেপাশে যেসব মৃত নরনারী শায়িত ছিল খুব সম্ভব তারাও অনেকদিন পরে মর্ত্যজীবনের এই প্রহসন দেখে নিজ নিজ জীবনস্মৃতি স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। জীবনে মরণে মানুষ সত্যিই বিচিত্র!

জনহীন নিরালোক পথে চলতে চলতে জন বলল, রেশমী, কাল সন্ধ্যায় আসবে আমার ওখানে?

বিস্ময়ে বলে ওঠে রেশমী, তোমার বাড়িতে?

না না, বাড়িতে কেন? কসাইটোলা আমার অফিসে ঘরগুলো সন্ধ্যাবেলায় খালি থাকে, তুমি বাড়ির কাছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকো, গাড়ি করে তুলে নিয়ে যাব, আবার পৌঁছে দিয়ে যাব গাড়ি করে। যাবে?

রেশমী বলল, যাব।

তার পর বলল, অত রাতে ফেরা সুবিধা হবে না, ধর রাতটা যদি ওখানেই থাকি?

খুব ভাল হবে, আমিও থাকব। বলে টেনে নেয় আর একটু কাছে, কিন্তু কি বলবে লেডি রাসেলকে?

সে কি আমার মত তুচ্ছ লোকের সন্ধান রাখে? যারা রাখে তাদের বলব, আজকের রাতটা কাটাব কায়েৎ দার বাড়িতে।

তুমি লক্ষ্মী মেয়ে রেশমী। তাহলে কথা ঠিক?

নিশ্চয়।

চল তোমাকে বাড়ির কাছ পর্যন্ত এগিয়ে দিই—একাকী ছেড়ে দেওয়া কিছু নয়।

এই বলে রেশমীকে বাহুসংবদ্ধ করে নিয়ে অগ্রসর হয় জন। কর্তব্যপরায়ণ জন।

.

৩.১৫ রেশমীর ‘না’

পরদিন অপরাহ্নে জন রেশমীকে গাড়িতে তুলে নিল, পূর্বনির্দেশমত বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড ও চৌরঙ্গীর মোড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল সে। সেকালে অনেক শেতাঙ্গ দেশীয় রমণীদের নিয়ে প্রকাশ্যে যাতায়াত করত, ঘর করত, কাজেই কেউ বিশেষভাবে লক্ষ্য করল না রেশমীকে। গাড়ি সোজা উত্তর দিকে চলে কসাইটোলার মোড়ে এসে পৌঁছল, মোড়ের কাছেই জনের অফিস। তখন সন্ধ্যাবেলা অফিস খালি, দু-চারজন আরদালি দারোয়ান মাত্র ছিল। জন রেশমীকে নিয়ে সোজা তেতলায় গেল, তেতলায় তার খাস কামরা।

ড্রয়িংরুমে ঢুকে জন রেশমীকে বলল, বস। রেশমী বসলে জন বলল, রেশমী, তুমি আসবে ভাবিনি।

কি আশ্চর্য, না আসব কেন, কাল তো কথা ঠিক হয়ে গেল!

ইউ আর সাচ এ গুড গার্ল!

আম আই? আর ইউ শিওর?

দুজনে হো হো করে হেসে ওঠে।

আচ্ছা রেশমী, কি বলে বের হলে বাড়ি থেকে?

সে কথা কালকে তো বলেছি।

আমার কি ছাই কালকের সব কথা মনে আছে?

কেবল আমাকে তুলে নেবার কথাটা ভুলতে পার নি!

তাহলে তো নিজেকেই ভুলে যেতে হয়।

কিন্তু আমার ভয় হয়েছিল যে, তুমি ভুলে যাবে।

দেখলে তো যে ভূলি নি।

বাস্তবিক, আশ্চর্য তোমার স্মরণশক্তি।

আবার দুজনে হো হো করে হেসে ওঠে।

প্রাণপ্রাচুর্যের উচছুসিত ফেনা ঐ হাসি, যৌবনে তা সুলভ। বার্ধক্যে প্রাণপ্রবাহ নিস্তেজ, হাসি স্তিমিত। যুবক অকারণে হাসে, কারণ উপস্থিত হলেও বৃদ্ধের মুখে হাসি যোগায় না।

জন শুধাল, আচ্ছা রেশমী, আমার আরদালি যদি খাদ্য এনে দেয় তবে খাবে?

কেন খাব না?

আমার ধারণা ছিল তোমাদের সমাজের সংস্কার অন্তরায়।

আমি আজ কতদিন সমাজছাড়া, দীর্ঘকাল কাটল খ্রীষ্টানদের সঙ্গে, খাওয়া-ছোঁওয়া সম্বন্ধে বাছবিচার ছেড়ে দিয়েছি।

ভালই করেছ।

না করে উপায় ছিল না, রাতদিন একসঙ্গে থাকলে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলা খুব শক্ত। তাছাড়া ডাঃ কেরীর মত লোকের, মিস এলমারের মত লোকের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতেই বা যাব কেন?

আর আমার মত লোকের ছোঁয়াচ?

তুমি আর সে বিষয়ে চিন্তা করবার সময় দিলে কই?

রেশমী, আমার মনের কথা যদি জানতে–

তার চেয়ে তোমার আরদালিকে ডাক, খুব খিদে পেয়েছে। মনের কথা না হয়। পেটের খিদে মিটিয়ে নিয়ে ধীরেসুস্থে শুনব।

জনের ইঙ্গিতে আরদালি দুজনের মত খাদ্য নিয়ে এল। জন যতদূর সম্ভব দেশীয় খানার ব্যবস্থা করেছিল, রেশমীর কোন রকম অসুবিধা হল না। উচ্ছিষ্ট পাত্র সরিয়ে নিয়ে গেলে একটি সিগারেট ধরিয়ে জন ও রেশমী আবার মুখখামুখি বসল।

হেমন্তের তৃণবনে একটি হাওয়া লাগবামাত্র যেমন অজস্র পতঙ্গ চঞ্চল হয়ে ওঠে, তেমনি অজস্র তুচ্ছ কথা রঙীন পাখার চপল ভঙ্গীতে চঞ্চল হয়ে উঠল ওদের মুখে। মাঝে মাঝে একটা করে হাসির দমকা হাওয়া লাগে, ততই আরও বেশি চঞ্চলতা প্রকাশ করে তাদের পাখা। অবশেষে এক সময়ে কথার ভাগ কমে নীরবতার ভাগ বাড়ল এবং ক্রমে সব কথা আত্মবিসর্জন করল অখণ্ড নীরবতায়। তখন দুজনে মুখোমুখি নীরবে বসে রইল। দুজন লোক নীরব বসে রইলে বুঝতে হবে যে, হয় তাদের সব কথা বলা হয়ে গিয়েছে, নতুবা এমন কিছু কথা আছে যা অনির্বচনীয়। যুবক-যুবতীর নিছক সান্নিধ্য একরকম জৈব বিদ্যুৎ সৃষ্টি করে—মুখের শব্দের চেয়েও যা গভীরতর অর্থে পরিপূর্ণ। সেই বিদ্যুৎত্ময় নীরবতা দুজনের মধ্যে তখন কথা চলাচল শুরু করে। কথা কুলুপ, নীরবতা কক্ষ।

রেশমীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে জন ভাবছিল, যার নয়নে অধরে, কপোল গ্রীবায়, সন্ধিতে কুন্তলে, বসনে ভূষণে সর্বাঙ্গে এমন অজস্র অমৃতের সঞ্চয় তার কেন এত কৃপণতা; একজন দারুণ পিপাসায় সামনেই পুড়ে মরছে, আর একজন শীতল বারিধি নিয়ে নির্বিকার বসে আছে! জন ভাবছিল, কেন এমন সৌন্দর্য, এমন নিষ্ঠুরতা, এমন তৃষ্ণা, এমন পানীয় পাশাপাশি!

রেশমী জনের মনের কথা বুঝেছিল, ভারি একটা বেদনা বোধ করছিল মনে মনে, তবু শেষ সঙ্কোচটুকু কিছুতে যেতে চায় না। জন কেন একটুখানি জোর করে না! রেশমী যুদ্ধপ্রত্যাশী নয়, তবু একবার যুদ্ধের ভাণ না করে আত্মসমর্পণ করে কিভাবে সে? পরাজয় অবশ্যম্ভাবী তবে আত্মসম্মান রক্ষার পক্ষে অপরিহার্য ঐ যুদ্ধের অভিনয়টুকু। রেশমী ভাবছিল, জন বোধকরি মনে করছে যে এখনও স্তম্ভমূল দৃঢ়। নির্বোধ! এখন একটিমাত্র মৃদু ধাক্কার প্রয়োজন, সেটুকুও কি দিতে রাজী নয় জন? মনে একটুখানি রাগের মতও হল। কিন্তু তখনই দৃষ্টি পড়ল জনের আর্ত অসহায় তৃষিত চোখের দিকে। সে আর স্থির থাকতে পারল না, তার সঙ্কল্প বিচলিত হল। সে মনে মনে বলল, জন, তোমাকে কেবল আত্মসমর্পণ করলাম না, আত্মসম্মান রক্ষার যে সান্ত্বনাটুকু নারীরা হাতে রেখে দেয় সেটুকু অবধি তোমাকে দিলাম। তুমি বড় অসহায় বলেই তোমার দাবি বড় প্রচণ্ড।

হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে রেশমী বলল, জন, আর ঠায় বসে থাকতে পারছি না, আমি কাপড় বদলাতে চাই, শোবার ঘর কোথায় দেখিয়ে দাও।

জনের মত নির্বোধ লোকেও কথাটার ইঙ্গিত বুঝল, কৃতজ্ঞতায় আনন্দে তার দুই চোখ চকচক করে উঠল, বলল, এটা তোমার শোবার ঘর রেশমী, পাশেই স্নানের ঘর, সেখানে ব্যবস্থা আছে। যাও ভিতরে যাও, আমি ‘নক’ করলে তুমি আসতে বল।

কোন উত্তর না দিয়ে রেশমী শয়নগৃহে প্রবেশ করল।

রেশমী ক্লান্ত হয়েছিল, ভাবল স্নান করে নিই, তাহলে আরাম পাওয়া যাবে। স্নানের ঘরে ঢুকে শাড়ি শেমিজ খুলে ফেলে শীতলজলে খুব আরাম করে সে স্নান করে নিল, তার পরে মাথাটা মুছে শোবার ঘরের প্রকাণ্ড আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াবার জন্যে চিরুনি হাতে নিয়ে প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে একবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। বিধাতাপুরুষ সদ্যসৃষ্টি বিষদৃশ্যের দিকে তাকিয়ে খুব সম্ভব এমনি বিস্ময় বোধ করেছিল; আদিম নারী ইভ পলে প্রথমবার নিজেকে প্রতিবিম্বিত দেখে নিশ্চয় এমনি মোহ বোধ করেছিল; সমুদ্রোথিত উর্বশী পুরুষের আঁখিতারায় নিজেকে প্রতিবিম্বিত দেখে নিশ্চয় এমনি তন্ময়তা বোধ করেছিল। কেশবিন্যাস, বেশবিন্যাস ভুলে গিয়ে রেশমী অপলক তাকিয়ে রইল নিজের জীবন্ত ছায়ার দিকে। স্ফুটনোম্মুখ সূচ্যগ্র ম্যাগনোলিয়ার কুঁডির মত চিবুক থেকে একটির পর একটি জলবিন্দু ঝরে বুকের দুর্গম গিরিসঙ্কটে অবিরত ধারার সৃষ্টি করেছে; মসৃণ তপ্ত উজ্জ্বল ত্বকের স্পর্শে জলবিন্দু মুস্তাবিন্দুর চেয়ে রমণীয় হয়ে উঠেছে; আর স্নানের আয়েসে মৃদু স্পন্দিত বক্ষের আন্দোলনে তালে তালে কাঁপছে সেই মুহার। রেখামনোরম কণ্ঠ, জলে সিক্ত আঁখিপশ্ন; ভেজা অলকাগুলো বিচিত্র রেখায় ললাটপ্রান্তে লিপ্ত; চোখের দৃষ্টি স্বভারাতুর মধুকরী তরীর মত নিরুদ্দেশের দিকে উধাও, আর চুম্বনের কুঁড়িভরা অধরাষ্ঠের দুই কোণে বিস্মিত পুলকের আভাস। রেশমীর আর পলক পড়ে না; তৃপ্তি হয় না তার মনে হল, সে যেন আর কাউকে দেখছে। রূপ দেহলগ্ন, সৌন্দর্য দেহবিবিক্ত; নিতান্ত সৌন্দর্যচেতন নারীর কাছেও আপন সৌন্দর্য সম্পূর্ণ আয়ত্ত নয়; রূপসী স্বাধীন, সৌন্দর্যময়ী আপন সৌন্দর্যের অধীন; সে নিতান্ত অসহায়। দেব-সমাজে যার অসীম প্রতাপ সেই উর্বশীর মত অসহায়, দুর্বল, পরাধীন আর কে।

আয়নার কাছে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রহস্যময়ী হায়ার দিকে রেশমী; সে ভুলে গেল জনের কথা, ভুলে গেল বেশবিন্যাসের কথা, ভুলে গেল বাহ্যজ্ঞান। তার মনে পড়ে গেল মদনাবাটির পন্বলে ছায়া-দর্শনের স্মৃতি; তার মনে হল, সেদিন সৌন্দর্য ছিল পাতার আড়ালের কুঁড়ি, আর আজকের সৌন্দর্য পত্রাবরণ মুক্ত, নিরাবরণ, নিরাভরণ, আবৃন্তপ্রস্ফুট পুষ্প।

হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজে তার আচ্ছন্ন ভাব কেটে গেল, মনে পড়ল, বাইরে অপেক্ষমাণ জনের কথা। কেমন একটা বিস্বাদে বিতৃষ্ণায় তার মন ভরে গেল; কেবলই মনে হতে লাগল, এ অন্যায়, এ অন্যায়, জনের এ অন্যায় দাবি। তার মনে হল, জন সৌন্দর্যের দস্যু, তার দেহ মন্থন করে হরণ করে নিতে চায় সৌন্দর্যটুকু। এ অন্যায় দাবি জন, এ অন্যায় দাবি!

আবার দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। রেশমী কাপড় পরে নিল, আর টেবিলের উপর থেকে কলম তুলে নিয়ে এক টুকরো কাগজে কি যেন লিখল, তার পরে উকষ্ঠ ব্যাকুল ঠক ঠক আওয়াজ উপেক্ষা করে স্নানের ঘরসংলগ্ন ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে সোজা নেমে গিয়ে বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোডের বাড়ির দিকে দ্রুত চলতে শুরু করে দিল।

আরও কিছুক্ষণ পরে, বিলম্বশঙ্কিত জন ‘ভিতরে আসছি রেশমী’ বলে ঘরে ঢুকে পড়ে দেখল ঘর শূন্য, কেউ কোথাও নেই। ভয়ে আশাভঙ্গে যখন সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, চোখে পড়ল কাগজের টুকরো-খপ করে তুলে নিয়ে পড়ে ফেলল এক নজরে। তার মনে হল সে বুঝি ভাষা ভুলে গিয়েছে; বারংবার পড়ে, মনে মনে পড়ে, অবশেষে নিজেকে শোনাবার উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে পাঠ করল-”জন, পারলাম না। ক্ষমা কর। সংস্কার অন্তরায়। আমার মন তুমি জান, ঠিক বুঝে নিতে পারবে আমার কথার অর্থ। রেশমী।”

ভন্ন মহীরুহের মত একেবারে ভেঙে গিয়ে বসে পড়ল জন, চিন্তা করবার শক্তি তার লোপ পেল। রেশমীর মনের কথা জন ঠিক বুঝতে পারল কিনা জানি নে। কিন্তু কি তার যথার্থ অন্তরায়? সংস্কার না সৌন্দর্য? সে ভাবল সৌন্দর্য, লিখল সংস্কার, তার কলম আর মন চলল ভিন্ন পথে। অথবা সৌন্দর্যই প্রবল করে তুলল তার সংস্কারকে। অথবা সুন্দরী নারীর মনের কথা স্পষ্ট বোধগম্য হলে মানুষ শিল্পসৃষ্টি করবার অসাধ্য সাধনে আত্মনিয়োগ করত না কখনও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *