৩.০১-৫ রোজ এলমার (Rose Aymer) বা গুলবদনী

৩.০১ রোজ এলমার (Rose Aymer) বা গুলবদনী

বাগানে দেশী বিদেশী নানা জাতীয় ফুল; গোলাপের বাহারই কিছু বেশি। সাদা লাল, কোথাও কুঁড়ি কোথাও ফোটে-ফোটে, কোথাও পূর্ণ প্রস্ফুটিত। রেশমী বেছে বেহে ফুটনোম্মুখ লাল কুঁড়ি তুলছিল। একবার একটি তোলবার জন্য হাত বাড়ায়, ভাল করে নিরীক্ষণ করে হাত গুটিয়ে নেয়–কিছুতেই পছন্দ হয় না। অবশেষে অনেকক্ষণ ঘুরে অনেকগুলো কুঁড়ি তুলল, তুলে ঘরে ফিরে এল। ঘরে এসে একটি জরির সুতো নিয়ে বেশ ভাল করে একটি তোড়া বাঁধল।

তার পরে তোড়াটি নিয়ে একটি তরুণীর কাছে গিয়ে বলল—এই নাও মিসিবাবা।

তোড়াটি নিয়ে তরুণী করুণ-সুন্দর হাসি হেসে বলল—ঐ বিশ্রী নাম করে আমাকে ডেকো না—ওর অর্থ হচ্ছে ‘মিস ফাদার’।

রেশমী বলল, ঐ নামেই তো সকলে ডাকে তোমাকে।

সকলে যা খুশি বলুক, তোমার সঙ্গে সম্বন্ধ আলাদা। দেখ না আমি তোমাকে কেমন Silken Lady বলে ডাকি।

তরুণী ‘রেশমী’ শব্দের অর্থ জেনে নিয়ে অনুবাদ করে নিয়েছিল ‘Silken Lady’।

কি বলে ডাকলে তুমি খুশি হও?

কেন, তুমি যে মাঝে মাঝে ‘গুলবদনী’ বলতে তাই বল না কেন, নইলে auntie যেমন Rosy বলে—তাই ব’ল।

রেশমী বলল, তার চেয়ে দেশী নামটাই ভাল, তোমাকে না হয় গুলবদনী বলেই ডাকব।

মনে থাকবে ত?

দেখো, এবার আর ভুল হবে না।

তখন রোজ এলমার তোড়াটি নিয়ে উঠে দাঁড়াল, টেবিলের উপরে একজন তরুণের ছবি দাঁড় করানো ছিল, তার কাছে গিয়ে রেখে দিল।

রেশমী বললে, তোমাকে এত যত্নে তোড়া বেঁধে দিই, তুমি রোজ রোজ সেটা ঐ ছবির কাছে নিয়ে রেখে দাও কেন? ও কার ছবি?

রোজ এলমার হাসল, বলল, ও একজন কবির ছবি।

কবিওয়ালার সঙ্গে তোমার সম্বন্ধ কি?

সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে রোজ এলমার বলল, জান, হবিখানা আমি এঁকেছি।

তুমি ছবি আঁকতে জান নাকি? কই কখনও দেখি না তো আঁকতে?

দেশে থাকতে আঁকতাম—এদেশে এসে ঐ একখানা ছবিই এঁকেছি।

কই মানুষটাকে তো কখনও দেখি নি?

মানুষটা দেশে আছে।

বেশ কথা! মানুষ রইল দুরে, ছবি আঁকলে কি করে? তরুণী হেসে বলল, দূরে থাকলেই কি সব সময়ে দূরে থাকে? সে আবার কি রকম? মনের মধ্যেও তো থাকতে পারে!

কথাটা রেশমী ঠিক বুঝল কিনা জানি না, সে বলে উঠল—ঐ যে মিঃ স্মিথ আসছে, আমি যাই।

না, না, তুমি থাক।

রেশমী সে কথায় কর্ণপাত করল না, এক দরজায় সে বেরিয়ে গেল, অন্য দরজায় প্রবেশ করল জন স্মিথ।

শুভ সন্ধ্যা, মিস এলমার!

শুভ সন্ধ্যা, মিঃ স্মিথ। ব’স।

জন অপাঙ্গে ছবিটির কাছে নিয়মিত স্থানে নিয়মিত ফুলের তোড়াটি দেখে অপ্রসন্ন মুখে উপবেশন করল।

আশা করি, আজকের দিনটা আনন্দ কেটেছে।

কালকের দিন যেমন কেটেছিল তার চেয়ে বেশিও নয়, কমও নয়।

মিস এলমার, আমার ইচ্ছা তোমাকে নিয়ে একদিন নৌ-বিহারে যাই। আমরা একখানা নূতন হাউসবোট কিনেছি।

মিস এলমারকে নীরব দেখে জন বলে উঠল, সঙ্গে মিস স্মিথও যাবে।

সেজন্য নয়, নদীর মাঝিদের কোলাহল আমার ভাল লাগে না তার চেয়ে এই বাগানের নীরবতা বড় মধুর।

কিন্তু কর্নেল রিকেট তো তোমাকে মাঝে মাঝে এখানে-ওখানে নিয়ে যায়।

সে যে নাছোড়বান্দা।

আমি নিরীহ, সেটাই কি তবে দোষ?

কখনও কখনও, হেসে উত্তর দেয় এলমার।

বেশ, তবে এবার থেকে জবরদস্তি করব।

যার যা স্বভাব নয় তেমন আচরণ করতে গেলে আরও বিসদৃশ দেখাবে।

দেখ মিস এলমার, আমি ঐ গোঁয়ারটাকে একদম পছন্দ করি নে। তুমি কি করে ওটাকে সহ্য কর তাই ভাবি।

ও যে জঙ্গী সেপাই, গোয়ার্তুমি করাই ওর ব্যবসা।

লোকটা বড় অভদ্র।

ভদ্রতা করলে লড়াই করা চলে না।

কিন্তু তোমার বাড়ি কি লড়াই-এর মাঠ?

ও হয়তো এ-বাড়িটাকে অপরের বাড়ি মনে করে না।

ঠিক বলেছ, লোকটা এমন ভাবে তোমার ঘরে প্রবেশ করে, যেন এটা ওর পৈতৃক আলয়।

এটাই তো যুদ্ধজয়ের রহস্য।

কিন্তু এ বাড়িতে যুদ্ধজয়ের আশা ওর নেই।

বুঝলে কি করে?

এ তো সহজ ব্যাপার। আত্মম্ভরি লোকটা তোমাকে নিজের যে ছবিখানা উপহার দিয়েছিল—ঐ যে তার উপরে জমেছে ধুলো। আর প্রতিদিন ফুলের তোড়া পড়ে…আচ্ছা মিস এলমার, ছবিটি নাকি একজন কবির-কই নাম তো শুনি নি!

একদিন শুনবে।

আচ্ছা, ও কি গ্রে, বার্ন-এর মত লিখতে পারে?

এই দেখ! একজন কবি কি অপর কবির মত কবিতা লেখে? গোলাপ কি ডালিয়ার মত? তার পর বলে—জান মিঃ স্মিথ, ঐ কবির সঙ্গে আমার একটা চুক্তি হয়েছে।

শঙ্কিত জন শুধায়, কি চুক্তি?

আমি মরলে এমন সুন্দর একটা কবিতা লিখবে যাতে আমার নাম অমর হয়ে থাকবে।

আহা, তুমি মরতে যাবে কেন?

আমি কি অমর হয়ে জন্মেছি?

অন্তত একজনের মনে।

তবে বোধ করি সে অমর। কিন্তু ঠাট্টা ছাড়, আমার মনে হয় কি জান, এখানকার প্রতিকূল আবহাওয়ায় আমি বুঝি বেশি দিন বাঁচতে পারব না।

তার পরে নিজ মনে বলে চলে, কি জীবন! নাচ-গান, হৈ-হল্ল, পান-ভোজন, জুয়ো-আড্ডা, ডুয়েল-মারামারি! অসহ্য। এর মধ্যে লোকে বাঁচে কি করে?

জন বলে, বাঁচে আর কই, কটা লোক পঞ্চাশ পেরোয় কলকাতায়?

তবু তো পঞ্চাশ অবধি জেঁকে–আমি তো কুড়িও পার হতে পারব না।

Three-score and ten! তার আগে তোমাকে মারে কে? সদস্তে সদপে ঘরে প্রবেশ করে সগর্জনে বলে ওঠে জঙ্গী সেপাই কর্নেল রিকেট।

তার পরে টুপিটা টেবিলের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে প্রকাণ্ড একখানা চেয়ারের সর্বাঙ্গে আর্তনাদ উঠিয়ে বসে পড়ে বলে, শুভ সন্ধ্যা রোজি!

শুভ সন্ধ্যা কর্নেল, এই যে এখানে মিঃ স্মিথ আছে।

মিস এলমারের কথায় ফলোদয় হয় না, রিকেট লক্ষ্যই করে না জনকে। তার বদলে উঠে দাঁড়িয়ে তরুণ কবির পদপ্রান্তে লুষ্ঠিত তোড়াটি হস্তগত করে বলে ওঠে–এটা তো আমার প্রাপ্য, অস্থানে কেন?

নীরব ঈর্ষায় জ্বলতে থাকে জন।

তার পর রিকেট নিজের বোম থেকে লাল গোলাপের কুঁড়িটি খসিয়ে নিয়ে মিস এলমারের দিকে এগিয়ে দেয়-সঙ্গে সঙ্গে ফরাসী কায়দায় ‘বাউ’ করে–বলে-Rose to Rose! তার পরে একবার কটাক্ষে জনকে লক্ষ্য করে বলে, ফরাসী ধরনে ‘বাউ’ করার কায়দাটি শিখেছি ম দুবোয়ার কাছে। লোকটা গুণী বটে।

লজ্জায় ঘৃণায় মাটিতে মিশিয়ে যায় জন। মিস এলমারেরও সঙ্কোচের অবধি থাকে।

মিস এলমার, কাল আমরা মস্ত একটা দল নৌকোয় করে সুখচরে যাচ্ছি। খুব হৈ-হল্লা, স্ফূর্তি হবে।

কথায় মোড় ঘুরল এই আশায় মিস এলমার বলল, তাই নাকি, খুব আনন্দের বিষয়। তা কে কে যাচ্ছে?

অনেকেই যাচ্ছে, সঙ্গে তুমিও যাচ্ছ।

রোজ কুষ্ঠিতভাবে বলল—আমার তো ভাল লাগে না।

সঙ্গে আমি থাকলে অবশ্যই ভাল লাগবে।

রোজ আবার মৃদু আপত্তি করল। রিকেট সে সব ঠেলে দিয়ে বলল, ওসব ঠিক হয়ে গিয়েছে। কাল ব্রেকফাস্টের পরে তোমাকে তুলে নিতে আসব।

ম্লান ছায়ার মত সন্তর্পণে প্রস্থান করল জন, তার পক্ষে আর বসে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। প্রেমে ও সঙ্কটে যারা ইতস্তত করে, তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।

নিঃসপত্ন যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ীর অকুণ্ঠিত প্রত্যয়ে কর্নেল বলে উঠল, তুমি অবশ্যই যাচ্ছ–তোমার জন্যেই এত আয়োজন এত খরচ, দেশ থেকে সদ্য আনীত তিন কাস্কেট বী-হাইভ ব্রান্ডি!…নাও, অমন মনমরা হয়ে থেকো না রোজি, চল একটু হাওয়া খেয়ে আসা যাক—আমার গাড়ির নৃতন জন্তুটা দেখবে কেমন ছোটে! চল, রেলকোর্সে এক পাক ঘুরে এলেই মনটাও হাল্কা হবে—আর খিদেটাও বেশ জমবে।

জঙ্গী কর্নেলের উৎসাহে বাধাদান রোজ এলমারের সাধ্য নয়—কাজেই সে ফাঁসির আসামীর মুখ নিয়ে চেপে বসল গিয়ে নূতন জন্তুতে টানা গাড়িতে, আদিম জন্তুটির পাশে।

গাড়ি ছুটল টগবগিয়ে। চরম বিজয়ের আশায় উল্লসিত সুখাসীন কর্নেল রিকেট তখন জীবনের ফিলজফি ব্যাখ্যায় লেগে গিয়েছে। সে ফিলজফি তার যেমন, তেমনি সেকালের কলকাতা সমাজের অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গেরও বটে।

রোজি ডিয়ার, জীবনটার অর্ধেক যুদ্ধক্ষেত্র, অর্ধেক জুয়োর আড়া, দুই জায়গাতেই লড়াই আর তার জন্যে চাই টাকা। কাজেই যেন-তেন-প্রকারেণ চাই টাকা রোজগার করা। যে কটা দিন বাঁচা যায় স্ফুর্তি করে নিতে হবে, কারণ কবে যে কলকাতার Ditch Fever আক্রমণ করে বসবে তার স্থিরতা নেই।

কর্নেলের বিচিত্র ফিলজফি শুনে রোজ এলমার স্তম্ভিত হয়, বলে, তবে যে এত খরচ করে সেন্ট জন্স চার্চ তৈরি হল তার সার্থকতা কোথায়?

ওসব হচ্ছে বাতিকগ্রস্ত লোকের কাণ্ড।

বল কি! জীবনে তবে ধর্মের স্থান নেই?

একেবারেই নেই তা নয়, লড়াই ফতে করবার জন্যে একটা ভগবানের দরকার।

শুধু এই জন্যেই?

তাছাড়া আর কি, আমার বুদ্ধিতে তো আসে না। আসল কথা কি জান ডিয়ারি, লড়াই হক আর জুয়োর টেস্ হক, চাই সাহস, ভীরুর স্থান নেই জীবনে।

রিকেট নিজের বাগ্মিতায় এমন মুগ্ধ হল যে গলা খুলে গান ধরল—

None but the Brave, none but the Brave, none but the Brave deserves the Fair.

সঙ্গে সঙ্গে ঢিল দিল লাগামে-গাড়ি ছুটল দ্রুত।

জন স্মিথ হেঁটে যাচ্ছিল, তার চোখে পড়ল গাড়ির উল্কাপাত, মনে পড়ল তার আর একদিনের কথা, রোজ এলমারের জন্য সে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল।

.

৩.০২ আর একদিনের কথা

জন ফিরছিল ময়দানের দিক থেকে, এমন সময়ে দেখতে পেল ছোট একখানা হাল্কা গাড়ি ছুটছে বেগে, ঘোড়া রাশ মানছে না তরুণী আরোহীর হাতে। জন বুঝল আর একটু পরেই গাড়িসুদ্ধ তরুণী উল্টে পড়বে খানার মধ্যে। গাড়িখানা যেমনি তার কাছে এসে পৌঁছল, অমনি সে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে লাফিয়ে উঠল গাড়ির পাদানির উপরে, আর লাগাম সবলে আকর্ষণ করল। দশ-বিশ গজ গিয়েই গাড়ি থামল প্রকাণ্ড একটা ঝাঁকুনি খেয়ে। তরুণী হুমড়ি খেয়ে পড়ল জনের গায়ে, জন বাঁহাতে তাকে জড়িয়ে ধরল, নইলে সে পড়ে যেত নীচে।

খুব কি লেগেছে তোমার?

দু-চার মুহূর্ত দম নিয়ে তরুণী বলল, আর দু-দণ্ড তুমি না এলে আমার আজ দুর্দশার অন্ত থাকত না।

জন বলল, সব ভাল যার শেষ ভাল। এমন এক বের হওয়া উচিত হয় নি।

প্রত্যেকদিন তো একাকীই বের হই, তবে আজ ঘোড়াটা নৃতন। অনুগ্রহ করে আমাদের বাড়িতে চল। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ শুনলে মেসো আর মাসিমা খুব খুশি হবে।

এবারে জন তরুণীকে লক্ষ্য করল, এতক্ষণ আসন্ন বিপদের কথা ভাবছিল।

জন দেখল তরুণী আশ্চর্য সুন্দরী। শরতের ঊষাকে পেটিকোট আর বডিস পরিয়ে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পরিশ্রমে ও উদ্বেগে সে সৌন্দর্য আমূল প্রকট হয়ে উঠেছে, ঝড়ের আভাস-লাগা শরতের ঊষা।

তরুণী রোজ এলমার। সুপ্রীম কোর্টের জজ সার হেনরি রাসেলের শ্যালীকন্যা।

সার হেনরি ও লেডি রাসেল সব শুনে জনকে সাদর অভ্যর্থনা করে নিল; বলল, জন, তোমার বাড়ি তো কাছেই, যখন খুশি এসো। তারা বলল, রোজ দেশ থেকে সবে এসে পৌঁছেছে, এখনও কারও সঙ্গে পরিচিত হয় নি, বড় নিঃসঙ্গ অনুভব করছে, তুমি এলে ও খুশি হবে। অবশ্য আমরাও কম খুশি হব না।

ঘটনাচক্রে জনের রাসেলদের বাড়িতে যাতায়াতের পথ সুগম হয়ে গেল। নতুবা এমন আশা ছিল না, কেননা সামাজিক বিচারে রাসেলরা স্মিথদের উপরের থাকের লোক।

রোজ এলমারের সঙ্গে জনের বন্ধুত্বে লিজা মনে মনে খুশি হল, ভাবল এতদিনে কেটির অভাব ও ভুলতে পারবে।

লিজা মাঝে মাঝে বোজ এলমারকে নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে নিয়ে আসে। লেডি রাসেলের নিমন্ত্রণে সে-ও যায় তাদের বাড়িতে। জন ও রোজের পরিচয় যে প্রণয়ে পরিণত হয়েছে, স্ত্রীসুলভ বুদ্ধিতে বুঝে নিল লিজা।

একদিন সে জনকে বলল-রোজকে বিয়ে কর না জন।

আগের দিনের জন হলে কথাটা অসম্ভব মনে হত না তার কাছে। কিন্তু কেটির ব্যাপারে এমন আঘাত পেয়েছিল যে, তার মনে একটা দীনতার ভাব স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছিল, তাই সে বলল—কোনদিন বলবে, জন, চাঁদকে বিয়ে কর।

তা তো আর বলছি নে।

প্রায় তাই বলছ। জান রোজ এলমার লাটঘরানা?

তার চেয়েও বেশি জানি। রোজের বাপ আবার বিয়ে করেছে সেই দুঃখেই তো এদেশে চলে এসেছে ও।

তার পরে একটু থেমে বলল, এদেশে তোমার চেয়ে ভাল বর পাবে কোথায়?

জন বলল, হয়তো তা অসম্ভব ছিল না, কিন্তু মাঝখানে এক কবি এসে জুটেছে।

সে আবার কে? বিস্ময়ে শুধায় লিজা।

ওয়াল্টার ল্যান্ডের তার নাম, বয়সে রোজের প্রায় সমান, লোকটা নাকি কবি।

কোথায় থাকে সে?

দেশে।

নিশ্চিন্ত হয়ে লিজা বলল, তাই বল। সে যদি দেশে থাকে, তবে তোমার বাধা কোথায়?

ছবিতে লিজা, ছবিতে। আমি প্রতিদিন যত ফুল নিয়ে গিয়ে দিই, সব পড়ে গিয়ে ছবির পদতলে।

ছবিকে ভয় কর না জন, ও ছায়া মাত্র। কিন্তু কায়াটা আছে মনের মধ্যে, নইলে ছায়া আসে কিভাবে?

তুমি এবারে মনের মধ্যেকার কায়াটাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে সেখানে গিয়ে আসন নাও। অনুপস্থিত কবির চেয়ে বেশি দাবি উপস্থিত ব্যবসায়ীর। জন, আমার কথা শোন, মেয়েরা লতার মত, যে গাছটা কাছে পায় তাকেই জড়িয়ে ধরে।

জন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে, মনের মানুষের চেয়ে কাছে আর কে!

তার পরে একটুখানি নীরব থেকে বলে, তা হবার নয় লিজা, বিশেষ মিস এলমার একটু অন্য প্রকৃতির লোক।

হেসে ওঠে লিজা, বলে, সব মেয়েরই এক প্রকৃতি, তাদের কাছে শেষ পর্যন্ত কাছের মানুষের মূল্য বেশি হয়ে দাঁড়ায় মনের মানুষের চেয়ে।

তবে তোমার বেলায় ভিন্ন নিয়ম দেখছি কেন, তোমার কাছে তো রিংলার আর মেরিডিথ দুটি বনস্পতি বর্তমান।

সেই তো হয়েছে বিপদ। কোনটিকে বেয়ে উঠব বিচার করতে করতেই বিয়ের বয়স গেল পেরিয়ে।

তার পরে গম্ভীরভাবে বলে, না জন, আমি ওন্ড মেড, আইবুড়ো হয়ে থাকব।

এ কেমন শখ!

শখের কি কোন কারণ থাকে।

তার পরে আন্তরিকতার সঙ্গে বলে লিজা, না জন, শীঘ্র বিয়ে কর। বাবা গত হবার পর থেকে বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। তাছাড়া একবার মিস এলমারের কথাটাও ভেবে দেখা উচিত, সে খুব নিঃসঙ্গ।

আপাতত একটি সঙ্গিনী জুটিয়ে দিয়েছি।

দেখেছি মেয়েটিকে, এদেশী মেয়েদের মধ্যে অমনটি সচরাচর দেখা যায় না। প্রথম দিন দেখে হঠাৎ ইউরেশিয়ান মেয়ে বলে মনে হয়েছিল।

হাঁ, ইংরেজি বলতে কইতে শিখতে বেশ মজবুত।

এই বলে রেশমীর পূর্ব ইতিহাস শোনায় জন লিজাকে।

.

৩.০৩ এক নদীতে দুইবার স্নান সম্ভবে না

দার্শনিকেরা বলেন এক নদীতে দুবার স্নান করা সম্ভব নয়। মানুষ সম্বন্ধে একথা আরও সত্য। নিয়ত সঞ্চরমাণ চৈতন্যপ্রবাহ মানুষকে অবলম্বন করে চলেছে, এই মুহূর্তের মানুষ পরমূহুর্তে থাকে না। এক মানুষের সঙ্গে দুবার কথা বলা সম্ভব নয়। জলপ্রবাহ নিয়ত পরিবর্তনশীল, নদী অপরিবর্তিত। চৈতন্যপ্রবাহ পরিবর্তনশীল, মনুষ্যরূপী সংস্কার অপরিবর্তিত। কিন্তু তলিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে নদী ও মানুষ দুই-ই চঞ্চল। সব নদীতে স্রোতোবেগ সমান নয়, সব মানুষে চৈতন্যপ্রবাহ সমান গতিশীল নয়। মহানদীতে ও মহাপুরুষে পরিবর্তন দ্রুততর।

যে রাম বসু মালদ গিয়েছিল আর যে রাম বসু মালদ থেকে ফিরল কেবল তত্ত্ববিচারে তারা ভিন্ন নয়—ব্যবহারিক বিচারেও তাদের ভেদ প্রকট হয়ে উঠল।

বিনা নোটিশে রাম বসুকে ফিরতে দেখে পত্নী অন্নদা ঝকার দিয়ে উঠল-কথা নেই বার্তা নেই অমনি এসে পড়লেই হল!

উত্তম বীণা-যন্ত্রের ও সাধী পত্নীর বিনা কারণে ঝকৃত হয়ে ওঠা স্বভাব।

আগে হলে রাম বসু উত্তর দিত, হয়তো বলত, নিজের বাড়িতে আসব তার আবার এত্তালা কি; হয়তো বলত, যখন শালাদের বাড়িতে যাব তোমাকে দিয়ে আগে এত্তালা পাঠাব। ঐ উপলক্ষে স্বামী-স্ত্রীতে এক পশলা ঝগড়া হয়ে যেত। কিন্তু এখন তেমন উদ্যম করল না, শুধু একবার হেসে বলল, ভাল লাগল না, চলে এলাম। তাছাড়া অনেকদিন তোমাদের দেখি নি।

মরি মরি, কত সোহাগ রে, বলে অন্নদা বলয়বক্তৃত হাতখানা তার মুখের কাছে বার-কতক নেড়ে দিল।

নরোত্তম বা নেরু ন্যাড়াদাকে পেয়ে খুশি হল, তার সঙ্গে জুটে গেল।

অন্নদা লক্ষ্য করল যে রাম বস এবারে কেমন যেন নীরব, সর্বদা মনমরা হয়ে থাকে, নয়তো বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়।

রাম বসু বার হতে যাচ্ছে দেখে জিজ্ঞাসা করে, কোন ভাগাড়ে যাচ্ছ?

একটা চাকুরি ছেড়ে এলাম, আর একটা খুঁজে বার করতে হবে তো? চলবে কি করে?

কেন, ধিঙ্গিপনা করে! যাও খিরিস্তানগুলোর সঙ্গে গিয়ে ঘোর গে! দিলে তো ঝাঁটা মেরে বিদেয় করে!

নিরুত্তর রাম বসু চাদরখানা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে যায়।

ঝগড়ার মুখে নিরুত্তর স্বামী স্ত্রীর পক্ষে অসহ্য। উত্তর-প্রত্যুত্তর দুইজনে ভাগ করে নেবে—এই হল গিয়ে কলহের গার্হস্থ্যবিধি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে স্ত্রীকে একা পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ করতে হলে যে তাপ উৎপন্ন হয় তার আঁচ পাড়া-প্রতিবেশীর গায়ে গিয়ে লাগে। স্বামীর ভৎসনাকে স্ত্রী প্রেমের বিকার বলে গ্রহণ করে, কিন্তু স্বামীর নীরবতার অর্থ অবহেলা। কোন সাধী স্ত্রী তা সহ্য করবে? রাম বসুর নিরুত্তর অবহেলায় কালবৈশাখীর অতর্কিত কর্কশ মেঘ-গর্জনের মত চীৎকার করে উঠল অন্নদা—এমন পাষাণের হাতেও পড়েছিলাম! এবং মুহূর্তেই কালবৈশাখীর পুল বর্ষণে সংসার-ক্ষেত্র পরিপ্লাবিত করে দিল-হাড় জ্বলে গেল, হাড় জ্বলে গেল, এখন মরণ হলেই বাঁচি!

অভীষ্ট ফলোদয়ে বিলম্ব হল না, পাশের বাড়ির বর্ষীয়সী বামুন-গিন্নী এসে উপস্থিত হল।

কি আবার হল কায়েৎ বউ, এতদিন পরে সোয়ামী ঘরে এল, অমন করে কি কাঁদতে আছে!

সোয়ামী ঘরে এল তো আমার চৌদ্দ পুরুষ স্বর্গে গেল! এখন মরণ হলেই বাঁচি বামুনদিদি।

তবে সত্যি কথা বলি কায়েৎ বউ-বলে ধীরেসুস্থে আসন গ্রহণ করে মধুর উপদেশের সঙ্গে তীব্র বিষ মিশিয়ে দিয়ে তেমন করে মধুতে বিষে মেশাতে কেবল মেয়েরাই পারে—বলল, সত্যি কথা বলি বাছা, পুরুষ মানুষ একটু গায়েগত্তি আশা করে, কেবল নাকে কাঁদলে কি পুরষের মন পাওয়া যায়। তুমি তো বাছা কাঠের পুতুল আমার কথা যদি শোন–

কথা শোনাবার সুযোগ বামুন-গিন্নীর ঘটল না, ছিন্ন-জ্যা ধনুষ্ঠির মত উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল অন্নদা—তোমাকে তো সাতটা বাঘে খেয়ে ফুরোতে পারবে না, তবে বামুন দাদা সারারাত বাইরে বাইরে কাটায় কেন? বলি আমাকে আর ঘাঁটিও না।

এত বড় অপবাদেও বামুন-গিন্নী বিচলিত হল না, আত্মস্থভাবে ধীরেসুস্থে বলল, তোমরা তো আসল কথা জান না—তাই ঐ রকম ভাব, বামুন শ্মশানে গিয়ে শব-সাধনা করে-তান্ত্রিক কিনা।

তবু যদি সব না জানতাম। শ্মশান হচ্ছে গিয়ে সোনাগাছি আর শবটি হল ক্ষান্তমণি।

ভরি-পরিমাণ দোক্তা মুখের মধ্যে নিক্ষেপ করে বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বামুন গিন্নী বলল, এত কথাও জান, তোমার কর্তাটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল বুঝি, না তোমার নিজেরই যাওয়া-আসা আছে ওই দিকে?

তবে রে শতেকখোয়ারী মাগী–

তখন অবিচলিত বামুন-গিন্নী উঠে দাঁড়িয়ে ধীরপদে অগ্রসর হতে হতে শেষ বিষটুকু ঝেড়ে বিদায় হল–এখন থেকে রাতের বেলায় বামনুটাকে আর অত দূরে যেতে দেব না–বলব পাশের বাড়িতেই শবের যোগাড় হয়েছে, চণ্ডালের শবের অনুসন্ধান করছিল কিনা লোকটা!

এ কথার মোগ্য উত্তর মানবভাষায় সম্ভব নয় বুঝে অন্নদা সম্মার্জনীর সন্ধান করছিল। সশস্ত্র প্রত্যাবর্তন করে দেখল শত্ৰু প্ৰস্থিতা। তখন সে মনের আক্রোশ মিটিয়ে শত্ৰু-অধিকৃত স্থানটির উপরে সম্মার্জনী বর্ষণ করতে শুরু করল, মর মর তুই শুকিয়ে, পাটকাঠি হয়ে শীগগির মর।

.

টুশকি বলে, কায়েৎ দা, এবারে তোমার রকম-সকম কিছু ভিন্ন রকম দেখছি।

কি রকম দেখছিস বল্ না!

কথাবার্তা আর আগের মত নয়।

রাম বসু বলে, না রে, আর কথাবার্তায় ফুল ফোঁটানো নয়, এবারে ভিতরের দিকে শিকড় চালিয়ে দিচ্ছি।

সেখানে রস যোগাচ্ছে কে, গৌতমী নাকি? শুধায় টুশকি।

রাম বসু হেসে বলে, কে, ওই ছোট্ট মেয়েটা? তার সাধ্যি কি!

রেশমী বলেছিল, কায়েৎ দা, আমার নামটা আর গাঁয়ের নামটা প্রকাশ কর না। মুখ পুড়িয়েছি, কে কোথায় চিনে ফেলবে।

রাম বস বলে, তা ছাড়া চণ্ডী বক্সীর ভয়টাও আছে।

রেশমীকে গৌতমী বলে উল্লেখ করে ন্যাড়া আর রাম বসু। টুশকি শুধায়, মেয়েটাকে একদিন নিয়ে এসে না। খুব দেখতে ইচ্ছে করে।

তাকে আনা সহজ নয় রে, সে এখন সাহেব বাড়ির দাসী, মেমসাহেবরা খুব ভালবাসে।

তবে একদিন আমাকেই কেন নিয়ে চল না সেখানে?

কি বলে পরিচয় দেব?

বলবে, ওর দিদি।

আচ্ছা দেখি, আজকাল আমিই দেখা করবার সুযোগ পাই কম।

টুশকি বলল, কায়েৎ দা, অনেকদিন পরে এলে, আজ রাতটা এখানে থাক না।

রাম বসু একটু ভেবে বলল, না, আজকে থাক।

কেন, কায়েৎ বউদির ভয়ে বুঝি? কেমন আছে বউদি?

সে তোর ঐ চরখাটার মত, যত সুতো কাটে তার বেশি জড়ায়, ঘ্যানর ঘ্যানর করে তার চেয়ে বেশি।

টুশকি বলে, আহা কি সুখের তোমার জীবন!

রাম বসু কিছু বলে না, একটা দীর্ঘনিশ্বাস চাপে।

টুশকির কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাম বসু, চলতে থাকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এপথ সেপথ ধরে।

পাহাড়ের চূড়ায় সজ্জিত ছিল স্তরবিন্যস্ত শুষ্ক ইন্ধন, সে জানত একদিন না একদিন নামবে বিদ্যুদগ্নিশিখা, প্রজ্বলিত দাবানলে সার্থক হবে তার নিষ্প্রভ জীবন। সহসা নামল বহুপ্রতীক্ষিত শিখা; ইন্ধনবহ্নি উদ্বোধিত করযুগলে বলে উঠল, ধন্য হল আমার প্রতীক্ষা, সার্থক হল আমার জীবন, যত দাহ সার্থকতা তত অধিক।

রাম বসুর মন পর্বতচূড়াস্থ ইন্ধনপ, রেশমী বিহ্নিশিখা।

মধ্যযুগের জীবন-মানদণ্ড ছিল পাপ আর পূণ্য। নব্যযুগ বদলে ফেলল পুরাতন মানদণ্ড, তার বদলে গ্রহণ করল নুতন মানদণ্ড-সুন্দর আর কুৎসিত। নব্যযুগের চোখে যা সুন্দর তা-ই পুণ্য, যা কুৎসিত তা-ই পাপ। মধ্যযুগ শিল্পী, মধ্যযুগ সাধক। নব্যযুগের প্রথম মানুষ রাম বসুর চোখে সৌন্দর্যের অরুণাভা উদঘাটিত হল রেশমীর দিব্য সৌন্দর্যে। রাম বসু প্রচ্ছন্ন কবি।

রাম বসুর যখন সম্বিৎ হল সে দেখলে রাসেল সাহেবের বাড়ির কাছে এসে পৌঁছেছে—ভাবল একবার দেখা করেই যাই না কেন! বাগানের খিড়কি দরজায় এসে সে ডাক দিল, রেশমী, রেশমী!

.

৩.০৪ বকলমে প্রেম

রাম বসু শুধালে, হাঁরে রেশমী, তার পর, কেমন লাগছে বল?

রেশমী বলল, আমার ভাগ্যে এমন সুখ হবে ভাবি নি। রোজি দিদি খুব ভালবাসে। আর কর্তা গিন্নী?

তাদের সঙ্গে দেখা হয় না। আর দেখা হলেই কি কাছে যাই? দূর থেকে সেলাম করে সরে পডি। তাদের আলাদা মহল।

আর কে কে আসে?

একজনকে তো চেন। জন সাহেব।

আর একজন কে?

মহাজন সাহেব!

মহাজন আবার কে রে?

যেমন মোটা তেমনি লম্বা, কুমোরের চাকার মত বেড় পেটের, মহাজন ছাড়া আর কি বলব?

আর কেউ আসে না?

এই দুইজনের উপরে আরও দরকার? বিশেষ, মহাজন সাহেব একাই একশ।

কেমন? ঘরের মধ্যে যখন কথা বলে, ছাদের কড়িবরগা কাঁপে।

তুই কাঁপিস না?

আমি কাঁপি কিনা জানি নে তবে জন সাহেব কাঁপে।

কেন?

কেন কি, রাগে হিংসায় এককোণে বসে কাঁপতে কাঁপতে অবশেষে উঠে বেরিয়ে যায়।

কেন রে?

কেন রে? তুমি এত বোঝ আর এইটে বুঝতে পারছ না? দুইজনেই ভালবাসে রোজি দিদিকে। কিন্তু মহাজনের সঙ্গে পারবে কেন জন?

তোর রোজি দিদি কাকে আমল দেয়?

মহাজন কি সেই পাত্র যে তাকে আমল দিতে হবে। পুরনো জামাই-এর মত নিশ্চিন্তভাবে প্রবেশ করে সে।

আর জন সাহেব?

মুখটি শুকিয়ে বেরিয়ে চলে যায়।

আহা, বেচারার তবে বড় কষ্ট।

কষ্ট তো আসে কেন? ওরকম মেয়েলী পুরুষকে পছন্দ করে কোন্ মেয়ে! কথাগুলো ঝাঁঝের সঙ্গে বলে রেশমী।

তুই-ও দেখছি মহাজনের দিকে।

না হয়ে উপায় কি! হাঁ, একটা পুরুষ বটে।

হয় তাই হল। তা কতদিন আর দ্রৌপদী হয়ে সৈরিঞ্জী বেশে থাকবি?

যতদিন না কীচক-বধ সম্পন্ন হয়।

কীচক আবার হতে গেল কে?

কেন, চণ্ডী খুড়ো! কোন সন্ধান পেলে তার?

কখনও তো চোখে পড়ে নি, বোধ করি সব ভুলে গিয়েছে।

পাগল হয়েছ তুমি! ভীমরুল সাত হাত জলের তলে গিয়ে কামড়ায়—চণ্ডীখুড়ো যায় সাতান্ন হাত জলের তলে!

তাহলে খুব নিরাপদ স্থানে আছিস।

তা আছি বই কি। আর যদি এদিকে ভুলে আসেই, তবে ভীমসেন তো ঘরেই আছে।

কে?

কেন, মহাজন সাহেব! রেশমী হেসে ওঠে।

এবার তবে যাই।

মাঝে মাঝে এসো, একদিন ন্যাড়াকে এনো সঙ্গে।

আচ্ছা দেখব, বলে বিদায় নেয় রাম বসু।

রাতে একা ঘরে শুয়ে রোজ এলমার, জন কর্নেল রিকেটের নিত্যকার জীবনলীলার কথা চিন্তা করে রৈশমী।

কতক ফল আছে যার পাক ধরে বাইরে থেকে শেষে একদিন ভিতরে গিয়ে পৌঁছয় পরিণতি। আর এক জাতের ফল আছে যাদের পরিণতি শুরু হয় ভিতরে, বাইরে থেকে হঠাৎ দেখলে মনে হয় বেশ কাঁচা, তার পরে বাইরে যখন রঙ ধরে বুঝতে হবে যে কোথাও এতটুকু অপরিণত নেই। রেশমী সেই শেষ জাতের ফল। ফুলকি তাকে জ্ঞান বৃক্ষের সন্ধান দিয়েছিল, তার পরে একদিন রাতে রাম বসু তার হাতে তুলে দিয়ে গেল জ্ঞানবৃক্ষের পরমরমণীয় ফলটি। রেশমী না পারল ফেলতে, না পারল গিলতে, কিংকর্তব্য স্থির করতে না পেরে বেঁধে রাখল আঁচলে। জ্ঞানবৃক্ষের স্বাদ গ্রহণ না করলেই যে তার প্রভাব নিষ্ক্রিয় থাকে তা নয়। তার সৌগন্ধে ঘরের বায়ু আমোদিত হয়ে মনকে উতলা করে, তার সৌন্দর্যে মন রঙীন হয়ে ওঠে, তার মধুর উত্তাপে মনটি তাপিত হতে থাকে। বেচারা রেশমী জানত না, কেউ বলে দিলেও স্বীকার করত না যে তার ভিতরে পাক ধরেছে। রাম বসুকে সে বলেছিল যে চিতার আগুনে সব পুড়ে গিয়েছে। কিন্তু সব কিছু কি পোড়ে? সোনা ও বাসনা কি অগ্নিদাহ্য? তবে বাসনার তাড়নায় অশরীরী প্রেত ঘুরে বেড়ায় কেন মৃত্যুর পরেও? না, তা নয়। চিতার আগুনে রেশমীর পুড়েছিল হিন্দুনারীর সংস্কার, পোড়ে নি রমণী-হৃদয়। পুড়েছিল বাঁধন, পোড়ে নি বাসনা; হয়তো সে বাসনা নিস্তেজ হয়ে থাকত তার জীবনে, কিন্তু এখন এমন এক পরিবেশে এসে পড়েছে সে, যেখানে সমস্তই বাসনার অনুকূল। পরিচিত আচার বিচার শাস্ত্র সংসার কতদুরে গিয়ে পড়েছে। তার উপরে রোজ এলমারকে নিয়ে প্রেমের যে লীলা চলেছে সম্মুখে, তার তাপে সমস্ত দেহমন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ওদের সুরার ছিটেফোঁটা এসে লাগে ওর গায়ে, তার তীব্র মদির গন্ধ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে—ওকে ভিতরে মাতিয়ে তোলে, তাতিয়ে দেয়। সে রোজ এলমারের বকলমে প্রেমানিভিনয় করেকার সঙ্গে?

নারীসুলভ অশিক্ষিত-পটুতায় সে বুঝে নিয়েছিল যে ঐ গোঁয়ার কর্নেলটার কোন আশা নেই; ঝড়ের বেগে লতা নত হয়, উম্মলিত হয় না, তেমনি দশা মিস এলমারের কর্নেলের সম্মুখে। তাই কর্নেলের প্রতি রেশমী ঈর্ষা অনুভব করত না। কিন্তু জনের কথা স্বতন্ত্র। রেশমী জানত জনের প্রতি রোজ অনুকূল তবে মাঝে বাধা ঐ ছবিখানা। কি জানি কেন ঐ ছবির মানুষটার প্রতি কৃতজ্ঞতার ভাব অনুভব করে। জনকে আসতে দেখলে সে আরও বেশি করে ফুল ঢেলে দিত ছবির কাছে। জনের মুখ কালো হয়ে যেতে দেখলে সে ভারি আনন্দ পেত।

সেদিন ছিল রোজ এলমারের জন্মদিন। জন বেশ সাজগোজ করে উপহার নিয়ে এসে দেখে ছবিটি ফুলের তোড়ায় সাজানো, অগুরু গন্ধ উঠছে ধূপদীপ থেকে, জন এতটুকু হয়ে গেল।

রোজ বলল, দেখ জন, কেমন ইন্ডিয়ান স্টাইলে সাজানো হয়েছে।

জন শুধু বলল, হুঁ।

রোজ আবার বলল, আমি এত জানতাম না, রেশমী সাহায্য করেছে।

অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল রেশমী। জন রোষ-কটাক্ষে তাকাল তার দিকে, কৌতুকমিশ্রিত আনন্দ অনুভব করল সে।

আর একদিন জন আসতে রোজ বলল, দেখ জন, রেশমী আমাকে কত ভালবাসে। পুরনো কাঠের ফ্রেমের বদলে কেমন চন্দন কাঠের ফ্রেমে ভরে দিয়েছে ছবিখানাকে।

রাম বসুকে দিয়ে চীনেবাজার থেকে কাঠের ফ্রেম আনিয়ে নিয়েছে রেশমী। বলা বাহুল্য কারও প্রতি প্রেমে নয়, জন মর্মাহত হবে আশাতে।

জন বললে-বেশ।

শুধু এটুকু বললে? ওকে একটা থ্যাঙ্কস্ দাও।

জন চাপা গলায় যন্ত্রের মত উচ্চারণ করল, থ্যাঙ্কস্-তা প্রায় Dam-এর মতই শোনাল।

তার উম্মায় রেশমীর মুখে ফুটল হাসির রেখা। সে হাসি দেখে জন উঠল জ্বলে, বলল, মিস এলমার, আমি বোধ হয় দু-চার দিন আসতে পারব না।

ব্যস্ত হয়ে মিস এলমার বলল, কেন, কেন?

রেশমী মনে মনে বলল, অত উদ্বিগ্ন হয়ো না রোজি, চব্বিশ ঘণ্টা না যেতেই বান্দা আবার ফিরে আসবে।

সুন্দরবনে যাব।

রেশমী মনে মনে বলল, একবার গিয়ে শখ মেটে নি? সেবার তো হারিয়েছিলে কেটিকে, এবার বুঝি পৈতৃক প্রাণটা হারবার শখ!

কেটি-প্রসঙ্গ শুনেছে সে রাম বসুর কাছে।

জন জানত যে পশু-বধ পছন্দ করে না মিস এলমার। তাই বলল, মধুর সন্ধানে।

রেশমী মনে মনে বলে, এখানকার মধুর আশা তবে ছাড়লে?

আমাকে কিছু দিও।

উল্লসিত জন বলে, তুমি নেবে? ইনডীড! কি করবে? খাবে?

না, মধু আমার ভাল লাগে না। রেশমী বলছিল ভাল মধু পেলে ইন্ডিয়ান স্টাইলে অফারি (offering) দেবে ছবির কাছে।

কালো হয়ে যায় জনের মুখ, বলে, আচ্ছা পেলে দেব, কিন্তু আজকাল ভাল মধু সুন্দরবনে পাওয়া যায় না।

কেন, সব বুঝি ম দুবোয়া খেয়ে ফেলেছে? মানস-উক্তি রেশমীর।

আর একদিনের কথা মনে পড়ে রেশমীর। জন আসতেই উল্লাসে মিস এলমার তাকে বলে, জন, আজ একটা surprise আছে তোমার ভাগ্যে।

আশা করি সুখদায়ক?

নিশ্চয়।

এই দেখ জুই কি না জেসমিন ফুলের মালা।

চমৎকার!

কি দিয়ে গাঁথা অনুমান কর তো!

কেমন করে বলব?

আমার চুল দিয়ে।

ওয়ারফুল, হেভেনলি! দাও, রোজি, আমাকে দাও।

তা কি করে সম্ভব, ছবিটির জন্যে স্বহস্তে কত যত্নে তৈরী করেছে রেশমী।

জন রূঢ় কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে চোখে পড়ল পর্দার ফাঁকে রেশমীর হাস্যোজ্জ্বল চোখ দুটি—মুখ ফিরিয়ে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল জন।

জনের হাড় জ্বলে যায় যখন দেখে যে কর্নেল রিকেট ঘরে ঢোকামাত্র রেশমী আভূমিত হয়ে সেলাম করে, আর চেয়ারখানা সরিয়ে দেয় মিস এলমারের কাছে।জনকে সেলাম দুরে থাকুক যেন মানুষ বলেই গ্রাহ্য করে না। আবার চেয়ারখানা যদি মিস এলমারের কাছে থাকে, সুবিন্যস্ত করবার অজুহাতে বেশ খানিকটা দূরে সরিয়ে দেয়। আরও তার মনে পড়ে-কর্নেল রিকেট আসন গ্রহণ করলে সম্রমে ও যায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে, কিন্তু জন বসলে চায় না ঘর ছেড়ে নড়তে–আর যদিই বা বাইরে যায়, পর্দার চঞ্চলতা প্রমাণ করে সে পাশেই আছে দাঁড়িয়ে। অব্যক্ত ক্রোধে জ্বলতে থাকে জন, আবার ঠিক সেই পরিমাণে কৌতুক অনুভব করতে থাকে রেশমী।

সেদিনকার ঘটনা মনে পড়ে রেশমীর। সেদিন মনে মনে খুব হেসেছিল, আজও হাসি পেল। ছোট ছেলে চুরি করা সন্দেশের স্বাদ যেমন গোপনে নেয় আবার ধরা পড়বার ভয়ে লুকিয়ে ফেলে, তেমনিভাবে স্বাদ অনুভব করতে থাকে অভিজ্ঞতাটির।

জন ঘরে ঢুকে দেখে মিস এলমার নেই, শুধাল, মিস এলমার কোথায়?

রেশমী বলল, বেরিয়েছেন।

কোথায়?

জানি নে।

কার সঙ্গে?

রেশমীর বলা উচিত ছিল, একাকী, কারণ একাকী বেরিয়ে গিয়েছিল সে।

কিন্তু তা না বলে ‘অশ্বথামা হত ইতি গজঃ’ করল, বলল, মিসি বাবা সাধারণত কর্নেল সাহেব ছাড়া আর কারও সঙ্গে বের হন না।

খুঁটিয়ে জেরা করবার প্রবৃত্তি হল না জনের, গম্ভীরভাবে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রইল।

রেশমী চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললে, বস।

না, এখানে বেশ আছি, বাতাস লাগছে।

রেশমী উদাসীনভাবে বলল, যদি মাথা গরম হয়ে থাকে টানা পাখার হুকুম করছি।

জন মনে মনে বলল, অসহ্য! কড়া কিছু বলবে ভেবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। এতদিন ভাল করে দেখে নি তাকে, আজ মনে হল মেয়েটি তো। সামান্য সুন্দরী নয়। মিস এলমারকে মনে হয়েছিল পেটিকোট পরা শরতের উষা আর এখন রেশমীকে মনে হল শাডি শেমিজ পরা বসন্তের সন্ধ্যা। হাঁ, উন্মাদিনী শক্তি এই ওরিয়েন্টাল মেয়েদের যেমন আছে তেমন কোথায় ঠাণ্ডা দেশের মেয়েদের সৌন্দর্যে?

অবাক হয়ে নীরবে তাকিয়ে থাকা অভদ্রতা, কিছু বলতে হয়—জন বলল, রেশমী বিবি, তুমি খুব সুন্দরী।

কথাটা শুনে আমি অবশ্যই খুব খুশি হলাম কিন্তু মিসি বাবার কানে গেলে কি সে সে-রকম খুশি হবে?

কেন, ক্ষতি কি?

লাভ ক্ষতি সে বুঝবে।

যাই হক, তার কান তো এখানে নেই।

আমিই না হয় কানে কথাটা তুলব।

খানিকটা আন্তরিকভাবে, খানিকটা খুশি করবার অভিপ্রায়ে জন বলল-তুমি খুব বুদ্ধিমতি।

এসব গুণ আজ হঠাৎ আবিষ্কার হল নাকি?

সে কথার উত্তর না দিয়ে জন বলল, এ রকম ইংরেজী উচ্চারণ দেশী মেয়েদের মুখে শুনি নি।

দেশী মেয়েদের সঙ্গে খুব মেলামেশা আছে বুঝি?

রেশমী বিবি, তোমার বাকপটুতা অসাধারণ।

এমন সময়ে মিস এলমার ঘরে প্রবেশ করল।

জনের ভয় হল পাছে মেয়েটা সব প্রকাশ করে দেয়।

মিস এলমার শুধাল, কখন এলে?

জন উত্তর দেবার আগেই রেশমী বলল, এইমাত্র।

সে বুঝল রেশমী কিছু প্রকাশ করবে না। তার প্রশংসার মনোভাবের সঙ্গে কৃতজ্ঞতা যুক্ত হল।

এইসব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল রেশমী। স্বপ্ন দেখল আকাশে তিনটি তারা জ্বলজ্বল করছে, ভাল করে তাকিয়ে দেখলে তিনটি তারায় তিনটি মুখ, মিস এলমার কর্নেল রিকেট আর জন স্মিথ—তিনজনের। এমন সময়ে দেখল জন স্মিথের তারাটি খসে পড়ল। ও কি, তারাটা জানলার দিকেই ছুটে আসছে যে! জানলার বাইরে এসে জন থামল।

ওখানে থেমে রইলে কেন? ভিতরে এস।

না না, মিস এলমার আছে!

তবে এসেছিলে কেন?

তুমি খুব সুন্দরী এই কথাটি বলতে।

রেশমীর ঘুম ভেঙে যায়। তার কানে সঙ্গীতের মত বাজতে থাকে-রেশমী, তুমি খুব সুন্দরী রেশমী, তুমি খুব সুন্দরী।

যে মেয়ে ঐ কথাটি কখনও কোন পুরুষের মুখে শোনন নি, তার নারীদেহ-ধারণ বৃথা। কিন্তু তেমন মেয়ে কি সত্যই আছে?

রেশমী শয্যা ত্যাগ করে উঠে আয়নার সম্মুখে দাঁড়াল—স্বপ্নের শিশির পড়ে মুখখানি অলৌকিক হয়ে উঠেছে। সে একবার চুলটা আঁচড়ে নিয়ে, বালিসে দীর্ঘশ্বাস চেপে শুয়ে পড়ল।

তখনও ভোর হতে অনেক বিলম্ব।

.

৩.০৫ সুরা-সাম্য

রাম বসু বাড়ি ফিরে চলেছে, এমন সময় শুনতে পেল কে যেন পিছন থেকে ডাকছে, মিঃ মুন্সী, মিঃ মুন্সী!

কে ডাকে? পিছন ফিরে দেখে যে মিঃ স্মিথ দ্রুতপায়ে তার দিকে আসছে।

মিঃ স্মিথ যে, গুড ইভনিং! তার পর-খবর কি?

গুড ইভনিং। এদিকে কোথায় এসেছিলে?

অনেকদিন রেশমীকে দেখি নি তাই একবার দেখে এলাম। তোমার সঙ্গেও অনেকদিন পরে দেখা, আশা করি সব কুশল।

এক রকম কুশল বই কি। মিঃ মুন্সী, তোমার কি খুব তাড়া আছে?

আমার কখনও তাড়া থাকে না। যে-কাজটা সম্মুখে এসে পড়ে তখনকার মত সেটাই আমার একমাত্র কাজ।

এখন কি কাজ তোমার সম্মুখে?

বাড়ি ফিরে যাওয়াটাই কাজ।

আর ধর আমি যদি একটু গল্পগুজব করতে অনুরোধ করি?

তখন সেটাই হবে একমাত্র কাজ।

তুমি incomparable, মিঃ মুন্সী।

আমারও তাই বিশ্বাস।

দুইজনে একসঙ্গে হেসে উঠল।

জন বলল, চল না, কাছেই আমাদের বাড়ি, একটু গল্পগাছা করা যাক, রাত তো এমন হয় নি।

রাম বসু বুঝল গরজ কিছু বেশি, নইলে কোন শ্বেতাঙ্গ এমন করে কৃষ্ণাঙ্গকে বাড়িতে আহ্বান করে না।

চল, ক্ষতি কি!

বাড়ি পৌঁছে লিজাকে বলল, মিঃ মুন্সীকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আমি একটু স্কলারলি ডিসকাশন করছি, এখন যেন কেউ না আসে, দেখো।

লিজা হেসে বলল, কেউ যাবে না। তবে ব্রাঙি সোড়া পাঠিয়ে দেব কি? শুনেছি স্কলারলি ডিসকাশনে ও দুটো বস্তু অপরিহার্য।

জন হেসে বলল, মিথ্যা শোন নি, দাও পাঠিয়ে।

সোডার সঙ্গে উপযুক্ত মাত্রায় মিশ্রিত ব্র্যান্ডির মহৎ গুণ এই যে ওতে বয়স বিদ্যা লিঙ্গ জাতি বর্ণ ভাষা প্রভৃতি লৌকিক গুণ অতি সত্বর লোপ পায়। এখানেও তার অন্যথা ঘটল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই জনের সাদা চামড়া কটা ও মুন্সীর কালো চামড়া ফিকে হতে মৈত্রী সীমান্তে এসে ঠেকল—তখন মুখোমুখি হল দুটিমাত্র মানুষ; বয়স, বর্ণ বিদ্যা ইত্যাদির তুচ্ছ পার্থক্য বেঙাচির লেজের মত গেল খসে।

মুন্সী, ইউ আর এ জলি গুড ফেলো।

সো আর ইউ, জন।

দেখ মুন্সী, তোমাদের হিঙু রিলিজ্যান অতি আশ্চর্য বস্তু।

সেই রকম ধারণাই ছিল, কিন্তু পাদ্রী ব্রাদাব-ইন-ল’দের সঙ্গে পরিচয় হয়ে অবধি হতমান হয়ে আছি।

আচ্ছা মুন্সী, তুমি পাদ্রীদের ব্রাদান-ইন-ল বললে কেন?

বাংলা ভাষার ওটা সবচেয়ে আদরের শব্দ।

ইনডীড! কি ওটার বাংলা?

শালা।

জন উচ্চারণ করে, সালা। চমৎকার, fine-sounding word! Sala, Sa la, তার পর নিজ মনেই বলে উঠল, How I wish Miss Ayimer’s brothers were my S-ala!

হবে জন, হবে। দুঃখ করো না।

আবেগ-কম্পিত কণ্ঠে জন জিজ্ঞাসা করে—কেমন করে জানলে মুন্সী?

ঐ যে হিন্দু রিলিজ্যানের কথা বললে না—তারই কৃপায়। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে নেই এমন জিনিস নেই।

ইনডীড!

এখন তোমার একজন রাইভ্যাল জুটেছে।

কি করে জানলে মুন্সী?

প্রসঙ্গের উত্তর না দিয়ে মুন্সী বলে, লোকটা খুব মোটা।

আশ্চর্য!

লোকটা জঙ্গী সেপাই।

ঠিক কথা।

আপাতত মিস এলমার তার প্রতি অনুরক্ত।

জিজ্ঞাসা ও কান্নার মাঝামাঝি সুরে জন ফুকরে ওঠে, আমার কি হবে মুন্সী?

ঋষিবাক্যের গাম্ভীর্যে রাম বসু বলে, মিস এলমার তোমারই হবে।

ঋষিবাক্যের আশ্বাসে কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে জন বলে, তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব মুন্সী, সেই ব্যবস্থাই করে দাও।

বেশ, তাই হবে, বলে বসুজা।

শুনেছি তোমাদের Shastras-এ yogic rites দ্বারা অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়?

শাস্ত্রগৌরবে স্ফীতবক্ষ রাম বসু সংক্ষেপে বলল, যায়ই তো। কিন্তু সে যে ব্যয়-সাপেক্ষ।

ব্যয়ে আমি কুণ্ঠিত নই। তুমি একটু চেষ্টা করে ঐ জঙ্গী সেপাই বেটাকে কাত করে দাও। লোকটা পাওয়ারফুল, কিন্তু শুনেছি তোমাদের Coligot-এর (কালীঘাট) Coli (কালী) একবারে অলমাইটি!

নিশ্চয়। বলে কালীর প্রাপ্য সম্মান আত্মসাৎ করে নেয় রাম বসু।

তুমি শীঘ্র ব্যবস্থা কর।

তুমি চিন্তা কর না জন, আমি কালকেই yogic rites-এর সবচেয়ে বড় এক্সপার্টের সঙ্গে দেখা করব—তার ক্রিয়ায় মানে ফাংকশনে হাতে হাতে ফল মানে হ্যান্ড টু হ্যাঙ ফুট পাওয়া যায়।

তবে তাই ক’র মুন্সী, আপাতত এই নাও, বলে মুন্সীর হাতে কিছু টাকা খুঁজে দিল জন।

দেখ না জন, তোমার রাইভ্যাল ব্রাদার-ইন-ল-কে কেমন জব্দ করি!

ও কি মুন্সী, তুমি গোড়াতেই বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করলে?

কেন? সত্যিই বিস্মিত হয় মুন্সী।

ওই মোস্ট এনডিয়ারিং টার্মটা ব্যবহার করলে ঐ গোয়ারটা সম্বন্ধে!

রাম বসু বুঝল তার ব্যাখ্যাতেই ভুলের মূল; বলল, আই অ্যাম সরি! ভুল হয়ে গিয়েছে।

নেভার মাইণ্ড ম্যান! এখন মিস এলমারের ভাই শীঘ্র যাতে আমার ব্রাদার-ইন ল হতে পারে তার ব্যবস্থা করে দাও। ওটার বাংলা কি যেন বললে?

শালা।

Sa-la! Fine! Il tastes as sweets as Miss Aylmer! Sa–la! আস্নন জয়ের সুনিশ্চিত সম্ভাবনায় সে এমনি উল্লসিত হয়েছিল, স-সোড়া ব্র্যান্ডিতে দুটি গেলাস পূর্ণ করে একটি বসুজার হাতে তুলে দিয়ে বলল, মুন্সী, বিদায় নেবার আগে—let us drink to the honour of Eternal, Universal, Ever-present, All-powerful–

রাম বসু বলল, ব্রাদার-ইন-ল!

জন বলল, নো, নো, বাংলা শব্দটা অনেক বেশি মিষ্টি, সা–লা!

তখন দুজনে সমকাণ্ঠে উচ্চারণ করল, শা–লা।

অগ্নিময় পানীয় যথাস্থানে পৌঁছল।

বিদায় নেবার মুখে রাম বসু বলল, উদ্বিগ্ন হয়ে না জন, আমি কালই এক্সপার্ট ওপিনিয়ন নেব-হ্যাঙ টু হ্যাণ্ড ফ্রুট।

জন বলল, নাঃ, এই খ্রীষ্টধর্মে কিছু নেই। কাল থেকেই আমি যাতায়াত শুরু করব “হিন্দু স্টুয়ার্ট”-এর কাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *