বা’র দরিয়ায়

বা’র দরিয়ায়

সমুদ্র থেকে সমুদ্রে ঘোরে দরিয়ায় শাদা তাজী!
খুরের হলকা,–ধারালো দাঁড়ের আঘাতে ফুলকি জ্বলে
সমুদ্র থেকে সমুদ্রে ঘোরে দরিয়ায় শালা তাজী….
কেশর ফোলানো পালে লাগে হাওয়া, মালে দোলে চাঁদ,
তারার আগুনে পথ বেছে নেয় স্বপ্নেরা সারারাত,

তাজী ছুটে চলে দূরন্ত গতি দুর্বার উচ্ছল;
সারারাত ভরি তোলপাড় করি দরিয়ার নোনাজল।

আদমসুরাত মুছে যায়, জ্বলে দিগন্তে শুকতারা,
জ্বলন্ত খুনে প্রভাতের হাওয়া লাগে,
সুবে সাদিকের স্পন্দন যেন আরো মৃদু হয়ে আসে;
কেশর ফোলানো পাল নুয়ে যায় প্রশান্তি প্রশ্বাসে।

সিন্ধু ঈগল পাড়ি দেয় পাশে ফেন উত্তাল রাত,
ঝলসায় কালো মেহরাবে তাজা মুক্ত নীল প্রভাত,
বাজে দ্রুত তালে দৃঢ় মাস্তুলে কাফা হাওয়ার ছড়ে,
ঘোরে উদ্দাম সিন্ধু ঈগল সমুদ্র-নীল ঝড়ে,
তুফানের ছাঁচে ঘূর্ণাবর্তে সুগঠিত তার তনু,
পুষ্ট পালকে পিছলিয়া পড়ে প্রবল বর্ণধনু
দুই রঙা স্রোতে কোথা দূরে দূরে ঘুরে ফেরে দিনমান
ফিরে আসে মৃত বুস্তানে ফের নও বাহারের গান;
দীর্ঘছন্দা নারিকেল শাখে মুক্তি উঠেছে বাজি
সন্দিপের তীরে তীরে কোথা পাখিরা ধরেছে গান;
সিন্ধু ঈগল বালুচরে বুঝি নীড় করে সন্ধান
সমুদ্র থেকে সমুদ্রে ছোটে দরিয়ার শাদা তাজী।

এবার কোথায় কোন্ বন্দরে মাঝি।
ভিড়বে কিশতী মুখ।
থামবে কোথায় দরিয়ার শাদা তাজী।

কত স্রোত আর ঘূর্ণি তুফান পাড়ি দিয়ে অবহেলে;
কত লাল, নীল, জরদ, প্রভাত; সন্ধ্যা এসেছি ফেলে;
আমাদের তাজী ফেন উচ্ছল মুখ
থামবে না বুঝি সব স্রোত থেমে গেলে।

তুফানের মাঠ পাড়ি দেওয়া তার একী দুরন্ত নেশা।
দাঁড়ের আঘাতে জিঞ্জিরে তার নীল নেশা ওঠে বাজি
আমাদের মনে দরিয়ার মত্ততা।
কোথায় উল্কা ছুটেছে মাতাল তাজী?
দূরে বহু দূরে বন্দর গেছে মিশে
দিগকাওসের কোলে,
সূর্যের ঝাঁজ জমে ওঠে পাল ভরে
নতুন পথের বাঁকা ধনু আসে সরে
সমুদ্র কল্লোলে;
তীব্র নেশায় দুরন্ত গতিবেগে
বুঝি পথ লোলে দরিয়ার শাদা তাজী!

দূর বন্দরে দীপ্ত সূর্য, আমাদের গতিমান
জাহাজের পাল স্রোতের নেশায় ভরা,
যেথা দিগন্তে সবৃজা হেরেমে ভাসে পরীদের গান,
নেকাব দোলায়ে আদিম বনানী জাগছে নৃত্যপরা;
দরিয়া-মরুর মরীচিকা পানে মাতাল
দুঃসাহসী ছুটছে অঙ্ক তাজী।

হয়তো সে ভুল, হয়তো সে ভুল নয়
তুফানের মুখে জমা হয় বিষ, জমা হয় সংশয়,
জাহাজের হাল নির্মম হাতে ঘোরাও এবার মাঝি।
এ পথের শেষ, এ গতির শেষ কোথা,
কোথায় মাতাল ছুটছে অন্ধ তাজী।

জমা হয় কালো টাইফুন মেঘ
পাটাতনে লাগে দোলা,
শংকায় নীল থেমে যায় মৃদু আবর্ত কল্লোল,
প্ন শেষের আসন্ন বৈশাখী,
শিকলে শিকলে হেষা ওঠে, পালে লাগে টাইফুন দোল
নির্মম হাতে হাল টেনে ধরো মাঝি।
আঁধির পাহাড়, অজগর ঢেউ, শোনো,
শব্দিত ঐ সাপের ফণার ত্রাস,
কালো ঐ মৃত্যু সর্বনাশ।
পাল খুলে নাও, যেতে হবে ঝড় ঠেলে
চমকাক পাশে কালো আজদহা লোল জিভ ঘন ঘন …
আবুরুজের চূড়া যেন এক উড়ে আসে কালো দেউ
বজ্রের বেগে পাটাতনে ভাঙে পাহাড়ের মত ঢেউ,
দিনের আকাশে একী জুলমাত মাঝি!
ঐ দেখ আসে মউজের পর মউজের কালো সারি;
ঐ দেখ সাথে নীল আসমানে চম্‌কায় তলওয়ার,
পাল ফেটে গেল, মাদ্ভুল ভাঙে বুঝি
ঝড়ের চাবুকে পাটাতনে ওঠে সকরুণ হাহাকার

এই দরিয়ায় ডুবলো বুঝি এবার
আমাদের শাদা তাজী।

পাক বারিলা আল্লার শান–এই মউজের বুকে
মরদের মত হাল সামলাও মাঝি!

নিপুণ হাতের বলিষ্ঠ পেশী যদি পড়ে যায় ছিঁড়ে
তবে তুরন্ত বদলায়ে নাও হাত,
এক লহমার গাফলতে জেনো এই মৃত্যুর তীরে
ডোবালে অতলে প্রবল ঝঞ্ঝাঘাত।
বল্প টানো এ ফেনিলাবর্তে
পার হয়ে এই ঝড়
সমুদ্র থেকে সমুদ্র ঘুরে পথ খুঁজে পাবে তাজী!

পাড়ি দিয়ে তুমি এসেছ দরিয়া কতো,
কিশতীর মুখ বাঁচায়ে এনেছ বহু টাইফুনে যুঝি;
ছিঁড়ে গেছে শিরা, উড়ে গেছে এক হাত;
আর হাতে তুমি হাল যোরায়েছ তুফানের সাথে যুঝি।

দরিয়ার মাঝি। তোমার ওজুদে পাথর গলানো খাক!
পাথর পারানো কুঅত তোমারে-দিয়াছে আল্লা পাক!
চলো বেমার দরিয়ার ঢেউ ছিঁড়ে,
আবুরুজের মতো এ মউজ ঘিরে।
ঝলসাতে থাক তোমার হালের চাকা,
চম্‌কাতে থাক তোমার চোখের তারা,
দরিয়া সেতায় যেখানে এ তাজী ভেসে চলে দিশাহারা
দাঁড়াও সেখানে ভেঙে চলো এই মউজের কালো পাখা।
পার হয়ে রাত ম্লান জুলমাত ঘেরা।
পারে নিয়ে যাবে ভাসমান এই ডেরা
দরিয়ার শাদা তাজী।
সরন্দিপের ঘাটে নোঙ্গর ফেলবে আবার মাঝি।
তোমার সঙ্গে দরিয়া তুফানে পরিচয় সুনিবিড়।
লাখো মউজের জুলমাত ঘেরা কালো সামিয়ানা টুটি,
তুলে নিয়ে গেছে তোমার জোরালো মুঠি;
চাঁদ আলোয় দেখেছি আমার সরন্দিপের তীর।
এবার যদি এ তাজী হয় বানচাল
তক্তায় ভেসে পাড়ি দেব কালাপানি,
হাজার জীবন হয় যদি পয়মাল
মানব না পরাজয়!
ধরো অচপল আবার হালের মুঠি;
শেষ ঢেউয়ে আর করব না সংশয়।

দরিয়া তুফান জয় করে মোরা দাঁড়ায়েছি দেখ মাঝি।
ভেসে গেছে শুধু মাল্লা সাতশো, আর
উড়ে গেছে শুধু সামনের এক পাটাতন তক্তার,
দেখ ক্ষত তনু সুদৃঢ় মাস্তুল
প্রশান্ত ভাবে মাপে দরিয়ার মুক্ত নীল কিনার,
দেখ আসমানে ফোটে সেতারার কলি,
আরশির মতো নিটোল পানিতে মুখ দেখে বকাওলি।
এসেছি এখন তুফান বিজয়ী খিজিরের এলাকায়
এবারের ঝড় পাড়ি দিয়ে মোবা ফিরেছি রিজয়ী মাঝি!
দেখ আমাদের নিশান উড়ছে নীল আকাশের গায়
 কেশর ফোলানোপাল নিয়ে ফের ছুটছে সফেদ তাজী।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *