০২. ভিয়েনার যন্ত্রণাময় বছরগুলো

ভিয়েনার যন্ত্রণাময় বছরগুলো

মা’র মৃত্যুর পর আমার ভাগ্য নৌকোর হাল একমুখী। মা’র অসুখের শেষের দিকে একবার ভিয়েনায় গিয়েছিলাম আকাদমি অফ্ ফাইন আর্টসে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। পকেটে এক গাদা স্কেচ নিয়ে আমি তখন নিশ্চিত যে অতি সহজেই পরীক্ষাটায় উরোবো। স্কুলে ড্রইয়ে বরাবর ভাল রেজাল্ট করেছি। ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি। সুতরাং ড্রইংয়ে আমার ক্ষমতা প্রশ্নাতীত। তাই বুক ভরা গর্ব ছিল যে সেই দক্ষতার জোরে প্রবেশ পরীক্ষার সমুদ্র পার হওয়া আমার পক্ষে কিছুই নয়।

কিন্তু আমার ভুল ঠিক কোথায় আকাদমিতে পরীক্ষা দিতে এসে বুঝতে পারি। ড্রইংয়ে আমার হাত পাকা হলেও অঙ্কন শিল্পে নয়। বিশেষ করে আর্কিটেক্টারাল অর্থাৎ স্থাপত্য বিদ্যার ড্রইংয়ে। তখন স্থাপত্য বিদ্যায় আমার উৎসাহ বাড়ছে। এবং ভিয়েনায় দু’সপ্তাহ কাটিয়ে আসার পরে স্থাপত্য বিদ্যার তৃষ্ণা আরো বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। তখনো আমার বয়স সোল পূর্ণ হয়নি। হোফ মিউজিয়ামে যাতায়াত শুরু করি, আর্ট গ্যালারির ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখার জন্য। কিন্তু ছবির বদলে হোফ মিউজিয়ামের বাড়িটার গঠনশৈলী আমাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় ঘুরে ঘুরে প্রাচীন বাড়িগুলোর গঠন নৈপুণ্য লক্ষ্য করতাম। এবং প্রায় ভেঙে পড়া অতি পুরনো বাড়িগুলো কি এক অদ্ভুত আকর্ষণে আমাকে টানতো। কিছুতেই স্থির থাকতে দিত না। ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম অপেরা হাউস বা পার্লামেন্টের সামনে। বিশেষ করে পুরো রি স্ট্রীটটা আমাকে যেন ভানুমতীর যাদু করেছিল। মনে হত বাড়িঘরগুলো আরব্য রজনীর পাতা থেকে হঠাৎ উঠে আসা কোন দৃশ্যপট।

এবার নিয়ে দ্বিতীয়বার আমি এ সুন্দরী নগরী ভিয়েনায় আসি; অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি প্রবেশিকা পরীক্ষার ফলাফলের জন্য। অবশ্য নিজের মনে নিশ্চিত যে এ পরীক্ষায় পাশ আমি করবই। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ফলাফল বেরোলে দেখি পাশ করতে পারিনি। বিশ্বাস করা কঠিন। তবু সত্যি আমি যে আমি পাশ করিনি। সুতরাং অধ্যক্ষর সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞাসা করি যে কেন আমি আকাদমীর অংকন বিভাগে সুযোগ পাব না। অধ্যক্ষ জানালেন, যে স্কেচগুলো আমি পরীক্ষার ব্যাপারে দাখিল করেছি সেগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে আর্কিটেকচারে আমার দখল অনেক বেশি, অংকন শিল্পের চেয়ে। সুতরাং অংকন শিল্প বিভাগে আমাকে নেওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তবে আকাদমির আরেক বিভাগ আর্কিটেকচারে নেওয়া যেতে পারে। মানে? আমার বিস্ময় তখন তুঙ্গে। স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কে আমার বিশেষ কোন জ্ঞানই নেই। এমন কি কারোর থেকে আর্কিটেকচার ড্রইং সম্পর্কে কোন শিক্ষাও পাইনি।

শিলার প্লাটৎজের হানসেন প্যালস ছেড়ে যখন বেরিয়ে আসি, তখন আমি নিরাশার গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত। এ বয়সে প্রথম যেন জীবনে নিজেকে ছোট বলে মনে হয়। যার জন্য নিজেকে উপযুক্ত বলে এতদিন ভেবে এসেছি, স্বপ্নের সেই সৌধ আজ মুহূর্তে ভেঙে পড়ে।

কয়েকদিনের মধ্যে মনের জোর আবার খুঁজে পাই। আর্কিটেকটু আমাকে হতেই হবে। যদিও জানি সে পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়; বরং অনেক কঠিন। আকাদমির আর্কিটেকচার বিভাগে যোগদানের আগে আমাকে টেকনিক্যাল বিল্ডিং স্কুলে পড়তে হবে। কিন্তু স্কুলে পড়ার অধিকার পেতে হলে মাধ্যমিক স্কুলের শেষ পরীক্ষায় পাশের সার্টিফিকেট চাই, যেটা আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়, আমার স্বপ্ন আমার ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে।

মার মৃত্যুর পর তৃতীয় বার ভিয়েনায় আসি। অবশ্য এবারে বেশ কয়েক বছরের জন্য। এতদিনে আবার আত্মবিশ্বাসটা ফিরে এসেছে। সুতরাং লক্ষ্যের দিকে আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ। আমাকে আর্কিটেক্ট হতেই হবে। জীবনের পথে বাধা তো থাকবেই। যে করেই হোক সেগুলো ডিঙিয়ে যাব। তাছাড়া বাবার স্মৃতি তো চোখের সামনে সব সময় ভাসছে। দরিদ্র চর্মকারের সন্তান হয়েও কত সংগ্রাম করে তাঁকে সরকারি চাকুরে হতে হয়েছে। তার চেয়ে আমার জীবনের শুরু তো অনেক মসৃণ, আমার যুদ্ধের প্রতিকূলতাও বাবার পরিবেশের মত তীক্ষ্ণ নয়। তখন অবশ্য মনের দিক থেকে এমন একটা অবস্থায় এসে উপস্থিত হয়েছি যে বারবার মনে হয় ভাগ্যদেবী নিদারুণ হাতে কষাঘাত করে চলেছে। আমার প্রতি বিমুখ, নির্দয়। তবু ইচ্ছা বেগবতী নদী; বাধা পেলে আরো ফুলে ফেঁপে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আমার সেই অদম্য ইচ্ছাশক্তিটাই জয়ী হয়।

জীবনের এ অধ্যবসায়টার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কারণ জীবনের এ পর্বটাই আমাকে শক্ত আর অনমনীয় করে তুলেছিল। সেই কারণে খুব কাছে থেকে জীবনটাকে চিনতে পেরেছি। সত্যি বলতে কি আজকে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, এখানে আমার পক্ষে ওঠা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র জীবনের এ অধ্যায়টার জন্য। এবং জীবনের এ দিনগুলোই আমাকে শূন্যতার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। স্নিগ্ধ মায়ের কোল থেকে ছুঁড়ে দিয়েছে রুক্ষ আরেক নতুন মায়ের হাতে। যদিও এ দুঃসময়ে চরম দারিদ্রতার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য নিষ্ঠুর ভাগ্যের প্রতি মাঝে মাঝে মনটা বিদ্রোহ করে উঠেছে; তবু যাদের জন্য পরবর্তী জীবনে আমি সংগ্রাম করেছি, এ পথেই আমি সেসব মানুষদের কাছে এসে দাঁড়াতে পেরেছি।

এ সময়ে আমি জাতির অস্তিত্বের পক্ষে দুটো বিপদ উপলব্ধি করতে পারি। একটা মার্কসইজম্ আরেকটা হল জুডোইজম বা ইহুদী ধর্মমত।

অনেকের কাছেই ভিয়েনা তখন প্রমোদ নগরী। আনন্দের মুহূর্তগুলো উপভোগের নিমিত্ত বেহিসেবী খরচের জায়গা। কিন্তু আমার কাছে। সে বছরগুলো শুধু দুঃস্বপ্ন বিশেষ। এমন কি সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে আজকে পর্যন্ত মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। সেই স্মৃতিচিহ্নগুলোর একটাতেও যদি এতটুকু রঙের ছোঁয়া থাকত। সুদীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রতিটি দিন রাহুগ্রস্ত যেন প্যাসিয়ান শহরের দিনগুলো। হোমারের ওডিসি কাব্যের রূপক হল প্যাসিয়ান লোকগুলো, তারা ভূমধ্যসাগরের পূর্বদিকের কোন এক অজানা দ্বীপে বসবাস করত। কেউ কেউ বলে আজকে সেই দ্বীপের নামকরণ হয়েছে কোরসিয়া, আধুনিক সুসজ্জিত কর্য। তারা কাজের চেয়ে জীবনটাকে উপভোগ করতে বেশি ভালবাসত। তাই ওডিসি কাব্যে তাদের নামকরণ করা হয়েছে প্যাসিয়ান। যার অর্থ ক্রমে ক্রমে দাঁড়িয়েছে প্যারাসাইট বা সমাজের পরগাছা।

এ পাঁচ বছরে কখনো দৈনিক শ্রমিক অথবা তুচ্ছ ছবি এঁকে আমাকে রুটির জোগাড় করতে হয়েছে। তবু পেট ভরাতে পারিনি। সব সময়ই ক্ষুধা আমার পিছু পিছু তাড়া করে ফিরেছে। সেই সময় একটা বই কেনা বা একবার অপেরায় যাওয়ার মানে হল পরের কয়েকটা দিন মুখিয়ে থাকা ক্ষুধায় ফু দিয়ে আগুন জ্বালানো। তবু এদিনগুলোতেই শিখেছি আমি সবচেয়ে বেশি। আর্কিটেকচারাল স্টাডি অর্থাৎ স্থাপত্যবিদ্যার পড়াশোনার বাইরে মাঝে মাঝে কশ্চিৎ কখনো অপেরায় যেতাম। তখনকার জীবনে বিলাসিতা বলতে ঠিক এটুকুই। আর বই। হ্যাঁ, বই-ই ছিল ক্ষুধা ছাড়া আমার নিত্যসঙ্গী।

তখন আমি খুব পড়তাম। এবং যা যা পড়তাম সেই বিষয়গুলোকে চেষ্টা করতাম মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করতে। যেটুকু সময় ফাঁকা পেতাম পড়াশোনার মধ্যে ডুবে থাকতাম। সেই অল্প কয়েকটা বছরে বই পড়ে যে জ্ঞান আমি অর্জন করেছিলাম, বলতে দ্বিধা নেই আজও তা কাজে লাগছে। তার চেয়েও বড় কথা জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ একটা দৃষ্টিভঙ্গি আর পৃথিবী সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা আমার সে সময়েই গড়ে ওঠে। যেটা ভবিষ্যত জীবনে আজ পর্যন্ত বদলায়নি। উপরন্তু আমার দৃঢ় ধারণা, যৌবনের বছরগুলো মানুষকে যে অভিজ্ঞতার বনিয়াদ গড়ে দেয়, ভবিষ্যতের জ্ঞানের প্রাসাদ তাকেই ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। যৌবনের ধ্যান ধারণাগুলোই ভবিষ্যতের রঙিন ফুল। যদি অবশ্য তার মধ্যে সৃষ্টির বীজ বোনা থাকে। যৌবনের সৃষ্টির চিন্তাধারা ভবিষ্যতের প্রাসাদ নির্মাণের রসদ।

আমার বাল্যকাল যাদের সঙ্গে কেটেছে, তাদের জীবনধারার সঙ্গে আমার জীবনের কোন পার্থক্য ছিল না। আমার ছোটবেলা কেটেছে নিচুস্তরের বুর্জুয়া অর্থাৎ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে। সুতরাং সত্যিকারের মেহনতী মানুষদের সঙ্গে আমার পরিচিত তখন হয়নি। সম্ভবও ছিল না। যে অর্থনৈতিক পরিখাটা এ দুই শ্রেণীর মাঝখানে ছিল সেটা মোটেই গভীর নয়। বরং অনেক সময় মেহনতি শ্রেণীর অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল ছিল। তবে কেন এ পার্থক্য? আসলে মেহনতী জনগণের একটা দল যারা একটু উঁচুতে উঠেছিল, তারা চাইত মেহনতী জনগণের ওপর মাতব্বরী করতে অথবা যেখান থেকে তারা উঠেছে, টালমাটাল হয়ে আবার সেখানেই পড়ে যেতে পারে এ ভয়ে তারা মেহনতী জনগণের থেকে দূরে সরে থাকত। আসলে পুরনো দিনের যে রুক্ষ স্মৃতিটা পেরিয়ে এসে তারা সিঁড়ির সবচেয়ে নিচেকার ধাপটা ধরেছে, সেখান থেকে গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার ভয়টাই তাদের সব সময় শঙ্কিত করে রাখত। যে জীবন অতিকষ্টে পেরিয়ে এসেছে সেখানে গিয়ে কিছুতেই আর দাঁড়াতে চাইত না।

এ কারণেই সম্ভবত সত্যিকারের যারা সমাজের ওপরতলার বাসিন্দা, তারা যতটা চট করে সমাজের একবারে নিচুস্তরের সঙ্গে মিশতে পারত, হঠাৎ এ ভূঁইফোড়দের পক্ষে সেটা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। হয়তো বা যে প্রচণ্ড সংগ্রাম করে এসব উঁইফোড়দের দল নিচের তলার বাসিন্দাদের ছাড়িয়ে উপরে উঠেছে, সেই নিদারুণ সংগ্রামের জন্য মানুষের মনের সুকোমল প্রবৃত্তিগুলোই মরে গেছে। নতুবা জীবনযুদ্ধে যুঝতে গিয়ে অপরের দিকে তাকাবার আর ফুরসৎ পায়নি।

এদিক থেকে ভাগ্য আমার ভাল ছিল বলতে হবে। অবস্থা বিপর্যয়ে আমার ছেলেবেলাকার ভূঁইফোড়দের যে জগতে বাস, নিদারুণ দারিদ্রতা আর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেদিনকার বুর্জুয়া জীবনের রঙিন ছবিটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়েছিল। জীবনে এ প্রথম আমি হামবাড়া আর সত্যিকারের ভাল লোকদের মধ্যে ফারাক বুঝতে শিখি। মানুষকে চিনি অনেক কাছে থেকে। যাদের রঙ অভিজ্ঞতা থাকলে ধরা অসম্ভব।

বর্তমান শতাব্দীর প্রথমার্ধে পৃথিবীর যে ক’টা শহর অপরাধীতে অধ্যুষিত ছিল, ভিয়েনা তন্মধ্যে অন্যতম। হঠাৎ ফুলে ফেঁপে ওঠা প্রাচুর্যের পাশে চরমতম দারিদ্রতা পাশাপাশি বিরাজমান। বাহান্ন মিলিয়ান বিভিন্ন জাতির লোকসংখ্যা সমৃদ্ধ এ শহরের ভেতরে ঢুকলেই এটা স্পষ্ট বোঝা যেত। প্রাসাদগুলো উপচে পড়া ঐশ্বর্যের প্রতীক। বিশেষ করে সাধারণকে বঞ্চিত করে এ ঐশ্বর্যের স্থূপ প্রাসাদে প্রাসাদে সবচেয়ে বেশি জমা হয় হাববুর্গ শাসনকালে।

এ কেন্দ্রে সবকিছু জমা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল সম্ভবত পাঁচমিশেলী জনসাধারণের জন্য। সুতরাং শহরের কেন্দ্রে উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং রাজার বসবাস গড়ে ওঠে।

কিন্তু দানুবিয়ান শাসকের সময় ভিয়েনা শুধু রাজনৈতিক এবং সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল না। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেও শহরটা গড়ে উঠেছিল। তাই সামরিক, অসামরিক অফিসার, বিজ্ঞানী এবং শিল্পী ছাড়া প্রচুর শ্রমিক শহরের অভ্যন্তরে বসবাস করত। দারিদ্রতার সঙ্গে এ অভিজাত ধনী ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের প্রায়ই মুখোমুখি সংঘর্ষ নেগে থাকত। হাজার হাজার বেকার উদ্দেশ্যহীনভাবে রিঙ স্ট্রীটের প্রাসাদগুলোর সামনে ঘুরে বেড়াত; এবং পুরনো অস্ট্রিয়ার ভায়া ট্রায়াম্ফ ফালিসের নিচে নরক গুলজার করত। অবশ্য তখনকার প্রায় প্রতিটি জার্মান শহরই এরকম ছিল। এ সমস্যাটা আলোচনা করার আগে যথেষ্ট সতর্কতা প্রয়োজন। প্রথমত ওপরতলা থেকে এ সমস্যাটা সম্পূর্ণরূপে বোঝা সম্ভব নয়, এ বিষাক্ত ভাইপারের কবলে যে না পড়েছে, তার পক্ষে বোঝা অসম্ভব যে এর বিষ কত তীব্র হতে পারে। নিজে ভুক্তভোগী না হলে এ সমস্যাটা শুধু আলোচনার স্তরেই থেকে যেতে বাধ্য। এর শিকড়ে পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার আরেকটা পথ সমস্যাটার দিকে পেছন ফিরে থাকা, অথবা মৌখিক সহানুভূতি দেখানো। কিন্তু তাতে ক্ষতি বৈ লাভ হয় না। তখন অবশ্য এরাই আবার তাদের অকৃতজ্ঞ বলে গালাগাল করে।

ধীরে ধীরে মানুষগুলো এক সময় বুঝতে পারে যে এ সামাজিক পরিবেশে সমাজ সংস্কারের কাজ করে কোন লাভ নেই। কারণ পুরো সমাজটার গঠনই এমন যে কৃতজ্ঞতা বলে জিনিসটাই সমাজের বুক থেকে অন্তর্হিত। সুতরাং সমাজের কাছ থেকে বিনিময়ে কিছু পাওয়ার আশা দুরাশা মাত্র; বরং প্রাপ্য যদি কিছু হয় তা হল অন্যায় বিচার। সামাজিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে জানবার লোভ থাকলেও সেই সময়ের আমার দারিদ্র পীড়িত অবস্থাই আমাকে সেদিকে পা বাড়াতে দেয়নি। অবশ্য এভাবে কোন সমস্যাই দূর থেকে বোঝা সম্ভব নয়, যদি না কেউ তাতে জড়িয়ে পড়ে। তাই বলা যেতে পারে যে, শশক যদিও গবেষণাগারের পাশ কাটিয়ে এসেছে, তবু একেবারে তার ক্ষতি হয়নি তা বলা যায় না।

যখন আমি আজ সেইদিনগুলোকে স্মরণে আনতে চেষ্টা করি, পুরোটা কিছুতেই পারি না। তাই এখানে আমি সেই ঘটনাগুলোর কথাই বলব যেগুলো আমায় ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করে বদ্ধ এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। যার থেকে অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি।

সেই দিনগুলোতে আমার পক্ষে চাকরি জোগাড় করা কষ্টকর হলেও একেবারে অসম্ভব ছিল না। তার প্রধান কারণ হল আমি কুশলী শ্রমিক দলে পড়তাম না। কুলি কামারের কাজ যেগুলো অন্য কেউ করতে চাইত না, আমি পেটের দায়ে সেগুলোই জুটিয়ে নিতাম।

অন্যান্য যারা নিজেদের দেশ ছেড়ে প্রবাসী হয়ে পা থেকে ইউরোপের ধুলো ঝেড়ে লৌহকঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে এ নতুন দেশে নতুন জগতে নতুন নীড় তৈরি করতে আসে, আমিও সেই দলেরই একটি নতুন মুখ। শ্রেণী সংস্কার ইত্যাদি সমস্ত কিছু পেছনে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য তারা চাকরিক্ষেত্রে যে দরজা খোলা পায় তা দিয়েই ঢুকে পড়ে। আসলে এখানে এসে তারা উপলব্ধী করতে পারে শ্রমের মর্যাদা। কোন কাজই কাউকে ছোট করে না, যদি তা সততার সঙ্গে সম্পন্ন করা যায়। আর এ চিন্তাধারাই আমাকে নতুন জগতের নতুন রাস্তায় এগিয়ে যাবার প্রেরণা দিয়েছিল।

অতি শীঘ্র বুঝতে পারলাম এ ধরনের কাজ যেমন সব সময় জোগাড় করা যায়, তেমনি চট করে চোখের পলকে সেই চাকরি চলেও যায়।

দৈনিক রুটি জোগাড়ের এ অনিশ্চয়তাই আমার এ নতুন জগতের দিনগুলোকে বিন্ন করে তুলেছিল।

যদিও শিক্ষিত শ্রমিকদের কুলি কামারদের মত যখন তখন চাকরি থেকে বরখাস্ত করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হত না, তবু তাদের চাকরির নিশ্চয়তা বলে তেমন কিছু ছিল না। তাই শিক্ষিত শ্রমিক দলের একেবারে অনাহারের মুখোমুখি হতে না হলেও বেকারী, ধর্মঘট আর লক্ আউটের দরুন প্রতিদিনই তাদের রুটির চিন্তায় বিপর্যস্ত থাকতে হত। এ দৈনন্দিন রুটির অনিশ্চয়তা সামাজিক অর্থনীতির অন্ধকারময় দিক।

গ্রামে থেকে অনেক ছেলে শহরে সহজ কাজের লোভে চলে আসে। সহজ কাজ মানে কয়েক ঘন্টার কাজ। অবশ্য সেই সঙ্গে শহর জীবনের রহস্যময়তাও তাদের আকর্ষণ করত। গ্রামে তবু যা হোক বাঁধাধরা একটা রোজগার ছিল। কারণ চাষাবাসের কাজে লোক খুঁজে পাওয়া তখন রীতিমত কষ্টকর। অনেকেই শহরের সহজ জীবনযাত্রার হাতছানিতে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে পাড়ী দিয়েছে। তবু যারা গ্রাম ছেড়ে দিয়ে শহরে আসত তাদের অবস্থা গ্রামে থাকা লোকদের থেকে খারাপ ছিল একথা বলা যায় না। অবশ্য আমি প্রবাসী বলতে যারা আমেরিকায় পাড়ী দিয়েছে তাদের কথা বলছি না। যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসত তাদেরও আমি প্রবাসী বলেই মনে করি। কারণ সরল যে ছেলেটা বেশি রোজগারের আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে, শহর জীবনে সে তো সম্পূর্ণ বিদেশী। অবশ্য অনিশ্চিত জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সে শহরে এসেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পকেটে গোনাগুণতি পয়সা নিয়ে আসা ছেলেগুলোর ভাগ্য খুব খারাপ না থাকলে প্রথম কিছুদিন মন্দ কাটত না। কিন্তু চাকরি পেয়ে অল্পদিনের মধ্যে হারালেই, যা অহরহ ঘটত, অবস্থা তাদের শোচনীয় হয়ে উঠত। বিশেষ করে শীতের সময় তো অসম্ভব। অবশ্য চাকরি যাওয়ার পরের কয়েকটা সপ্তাহ ততবেশি দুঃসহ ছিল না। পকেটে তখন শেষ মাইনের রেস্ত কিছুটা অবশিষ্ট। ট্রেড ইউনিয়ন থেকে তখন পর্যন্ত পাওয়া বেকার ভাতার টাকায় দিনগুলো চলে যেত। কিন্তু একসময়ে শেষ মাইনের টাকাটা আর দীর্ঘ বেকারত্বের জন্য ট্রেড ইউনিয়নের বেকার ভাতাও বন্ধ হয়ে যেত। তখনই পড়তে হত অসহনীয় দুর্দশার মধ্যে। পেটের জ্বালায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ছাড়া উপায় কি? উপায় বলতে অবশিষ্ট যা কিছু তা বন্ধক দেওয়া বা বিক্রি করা। কিন্তু সে পয়সায় আর কতদিন চলে। জামাকাপড় ততদিনে নোংরা আর শতচ্ছিন্ন। বাইরের অবয়বেও দারিদ্রতার ছাপ ফুটে উঠেছে। বাধ্য হয়ে সমাজের নিম্নস্তরের লোকগুলোর সঙ্গে মেলামেশা করতে হত, যাদের চিন্তাধারায় মন যায় বিষিয়ে। তদুপরি শারীরিক দুর্দশা তো আছেই। উপরন্তু মাথা গোঁজার ঠাঁই কোথায় পাবে? শীতের দিন হলে তো দুর্দশার একশেষ। শেষমেষ যদি আবার প্রাণপণ চেষ্টাতে একটা চাকরি যোগাড় করতে পারে; কিন্তু সেটা তো আবার আগেকার ব্যাপারটাই পুনরাবৃত্তি। তৃতীয় বারেও সেই একই নাটক। অর্থাৎ দিনে দিনে সে আরও বেশি হতাশা আর অনিশ্চয়তার সমুদ্রে নিমজ্জমান। ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে কঠোর পরিশ্রমে একটা লোক তার জীবনের প্রতি উদাসীন আর অমনযোগী হয়ে ওঠে। এবং একসময় কতগুলো ঠগ জোচ্চরের হাতের পুতুল হয়ে পড়ে, যারা তাদের নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করে। এত বেশি বেকারত্বের বোঝা বইতে স্ট্রাইক, দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি, নিজের ভবিষ্যত অনিশ্চিয়তার ব্যাপারগুলো সম্বন্ধে পুরোপুরি উদাসীন হয়ে পড়ে। যদিও সে মনেপ্রাণে স্ট্রাইক ইত্যাদি ব্যাপারগুলো চায় না; তবু মনের সব অনুভূতি হারিয়ে ফেলে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে ধর্মঘটীদের দলে ভিড়ে যায়।

এরকম বহু উদাহরণ আমি দিনের পর দিন দেখিছি। যতদিন গেছে, এ দানব শহরটা যেভাবে পাগলের মত লোকগুলোকে আকর্ষণ করে তা দেখে দেখে শহরটার প্রতি মনের মধ্যে একটা তিক্ততা জন্মে গেছে। প্রথম যখন তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে, কিছুদিন পর্যন্ত সেই গ্রাম্য জীবনের সংগে তাদের একটা যোগাযোগ বজায় থাকে, তারপর, একদিন তাদের অলেক্ষ্যে ছিঁড়ে যায়।

আমি সেই শহর জীবনের আবর্তে পড়ে বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার ভাগ্যও সেই লোকগুলোর মত; এবং আমার ওপরেও শহুরে জীবন তার থাবা নিয়ত বসিয়ে চলেছে। এ অর্থনৈতিক ওঠা নামায় স্বভাবতই তার খরচা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যখন পকেটে পয়সা থাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খায়; বাকি সময় অনাহারে কাটায়। এটা শারীরিক একটা চক্রের আবর্ত। ক্ষুধার্ত অবস্থায় দীর্ঘদিন কাটানোর সময় যে স্বপ্ন দেখে খাওয়ার দিনগুলোর। এবং এ স্বপ্নগুলো তার মানসিক অবস্থাকে এমন এক জায়গায় পৌঁছে দেয় যে সে এ খরচা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে মানসিক ভারসাম্য একেবারে হারিয়ে ফেলে। তাই আবার যখন সে চাকরি পায়, মাইনের দিনগুলোর আগামীদিনের কথা মনে না রেখে পুরোটাই খরচা করে বসে। এটা যে শুধু তার ব্যক্তিগত জীবনের অভাব ডেকে আনে তা নয়, তার এ স্বল্প সাপ্তাহিক বেতনে গৃহের প্রয়োজনীয় খরচের হিসেবও রাখতে পারে না। ব্যাপারটা এরকম; প্রথম দিকে তার সাপ্তাহিক রোজগারে পাঁচদিন কোন রকমে চলে যায়; তারপরে অভ্যাসটা বাড়তে বাড়তে সেই একই রোজগারে তিনদিন পার হওয়া মুস্কিল হয়ে পড়ে। শেষে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় একদিনে। অবশেষে এক উৎসবের রাত্রেই পুরো সাপ্তাহিক মাইনে সে খুঁকে দেয়। এগুলোর একমাত্র কারণ হল তার নিজস্ব রোজগারে খরচা করার বাজেট তৈরি করার অক্ষমতা।

অনেক সময়েই তাদের ঘরে স্ত্রী পুত্র থাকে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার এ অভ্যাস ওদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়; বিশেষ করে স্বামী যদি তার পরিবারকে নিজস্ব ধরনে ভালবাসে আর সেই পরিবারকে জড়িয়ে ধরে দিনগুলোকে পাড়ী দিতে চায়; সেই ক্ষেত্রে পুরো সপ্তাহের রোজগারে পরিবারটির তিন চার দিনের ভরণপোষণ কোনক্রমে চলে। যতদিন টাকা থাকে সবাই মিলে খাদ্য আর পানীয়ের মহাফিল জুড়ে দেয়, সপ্তাহের বাকি দিনগুলো তারপর ওদের কাটে অনাহারে। তখন তার স্ত্রী প্রতিবেশীদের থেকে গোপনে ধার করে আর পাড়ার দোকানদারদের কাছে সামান্য জিনিসের জন্য হাত পেতে দুঃখের দিনগুলো পাড়ি দিতে চায়। পুরো পরিবারটা শূন্য খাবার টেবিলে বসে মনে মনে কল্পনা করে আগামী সপ্তাহে এ অভাবের আর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। আর সেই ক্ষুধার দিনগুলোয় স্বপ্ন দেখে প্রাচুর্যের দিনে পেট ভরে খাওয়ার। এবং শিশুকাল থেকেই এ দুঃখের দিনগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওরা এ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

এ অভাবরূপী শয়তান পুরুষটাকে সপ্তাহের প্রথম দিকে তাড়া করে ফেরে। স্ত্রী স্বভাবতই ছেলে মেয়েদের মুখ চেয়ে সংসারের দাবি আদায়ের জন্য সচেষ্ট হয়। ক্রমে সেটা রূপ নেয় কদর্য কুৎসিত ঝগড়ায়। স্বামী আর কোন পথ খুঁজে না পেয়ে মদ খেতে আরম্ভ করে। দিনে দিনে পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে মনের দিক থেকে অনেক দূরে সরে যায়। তারপর মানুষটার শুরু হয় প্রতি শনিবারে মদ খাওয়া; স্ত্রী তার এবং সন্তানদের অস্তিত্ব রাখার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রামে নামতে বাধ্য হয়। কারখানার রাস্তা থেকে নোংরা পুঁড়িখানা পর্যন্ত কয়েকটা পয়সার জন্য মাইনের দিনে স্বামীকে ধাওয়া করে। সব পয়সা খুইয়ে রোববার বা সোমবার যখন সে বাড়ি ফেরে তখন সম্পূর্ণ নিঃস্ব। আবার অভাব অনটন, ঝগড়াঝাটি, শেষে ভগবানের দাহাই পেড়ে চিৎকার আর কান্নাকাটিতে ভরা প্রহরগুলো কাটে।

এরকম শয়ে শয়ে ঘটনা আমার চোখের ওপর দেখেছি। প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে ট্রাজেডি এবং দুর্ভাগ্য কোথায় বুঝতে অসুবিধে হয়নি। ওরা হল শয়তান সমাজ ব্যবস্থার শিকারমাত্র।

তখনকার পারিবারিক অবস্থা প্রায় সব পরিবারেই এক। বিশেষ করে ভিয়েনার শ্রমিকেরা চারিদিকে দুঃখ-দুর্দশার দেওয়ালের মধ্যে দিন যাপন করত। এখনো যখন সেই দুঃখের দিনগুলো আমার স্মৃতির সামনে ভেসে ওঠে, সারা শরীরটা ভয়ে কাঁপতে থাকে। গভীর নিঝুম রাত্রে বস্তি থেকে ভেসে আসা মাতাল স্বামীর সঙ্গে তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের ঝগড়া আর নিষ্ঠুর মারামারি। ক্লেদাক্ত পরিবেশে ওদের জীবনযাত্রা মানুষকে এক একটা পুরো শয়তান বানিয়ে ছাড়ে।

সেদিন কি হবে যেদিন মানুষগুলো নিজেদের অবস্থা বুঝতে পেরে যারা তাদের এ অবস্থায় এনে ফেলেছে তাদের তাড়া করবে? কিন্তু আশ্চর্যের কথা সে জগতের বাসিন্দারা এ জগতের লোকদের কোন খোঁজ খবরই রাখে না। কিন্তু একদিন আসবে যখন পুরো ঘটনাটা তার আপন গতিপথে মোড় নেবে, যদি না সময় মত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

আজ এতদিন পরে আমি আমার ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাই এজন্য যে নিয়তি আমাকে এমন একটা বিদ্যালয়ে ঘটনাক্রমে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল, ইচ্ছে না থাকলেও সেই পরিবেশে বাধ্য হয়েছি ঘটনাগুলোর প্রতি মন সংযোগ করতে। এ স্কুলই আমাকে জীবনের এক শক্ত বুনিয়াদের ওপর এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

পুরোপুরি নিজেকে হতাশার সমুদ্রে নিমজ্জিত না করার জন্য আমি তঙ্কালীন পরিবেশটাকে দু’ভাগে ভাগ করি। এক, বাইরের চেহারা অনুযায়ী; দুই যে যে কারণে তারা এরকম পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে। এ একমাত্র পথ যার দ্বারা নিজেকে হতাশা সমুদ্রে পুরোপুরি ডোবার হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছি। তারা এ দুঃখ দুর্দশায় এবং দুর্ভাগ্যের সমুদ্রে ডুবে নিজেদের এ নোংরা পরিবেশ এবং নিচুতে নামাতে বাধ্য হয়েছে। তাদের অবস্থা সত্যই শোচনীয়। আমার জীবনেও এ একই ধরনের দুর্দশা আমাকে মানুষগুলোর প্রতি ভাবালু হতে দেয়নি। না, ভাবালু হয়ে পড়লে কোন কিছুরই সঠিক মূল্যায়ণ সম্ভব নয়।

সে দিনগুলোতে আমি বুঝতে পারতাম যে একমাত্র এ অবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য দুটো পথ খোলা আছে। এক সামাজিক অবস্থার পুরো একটা পরিবর্তন এনে নিচেকার লোকদের সমাজের প্রতি কর্তব্য এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। দুই, এ কর্তব্য এবং দায়িত্ব বোধের সমন্বয় সাধন করে নিষ্ঠুর হাতে সমাজের অপ্রয়োজনীয় অনুশাসন তথা শুকনো ডালপালা হেঁটে দিতে হবে— যেগুলো এ সমাজটাকে সুস্থভাবে বাড়তে দিচ্ছে না।

প্রকৃতি যেমন স্থিতাবস্থায় থাকে না, তেমনি মানুষের জীবনেও যান্ত্রিক উপায়ে উন্নতি সাধন করা অসম্ভব। জন্মের পর থেকেই তার ভবিষ্যতের উন্নতির জন্য একটা সুনির্দিষ্ট এবং পাকা রাস্তা চাই, যেটা ধরে সে তরতর করে এগিয়ে যেতে পারে।

ভিয়েনাতে আমার সংগ্রামের দিনগুলোতে আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম যে শুধু ভাবাবেগ দিয়ে সামাজিক এ অদ্ভুত সমস্যার সমাধান করা যাবে না। বরং তা ভাবতে গেলে পুরো ব্যাপারটাই হাস্যাস্পদ এবং অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। তার চেয়ে এমন একটা পথ আবিষ্কার করতে হবে যা আমাদের সমাজের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক এ ক্ষয়িষ্ণু দিকের ক্ষয় রোধ করে ওপরে টেনে তুলতে পারে। সমাজের এ ক্ষুয়িষ্ণু দিকটাই একটা মানুষকে তার নিজের সিংহাসন থেকে ঠেলে নিচে নামিয়ে দিয়েছে বা দিতে সাহায্য করেছে। এবং বেকারত্বই হল তার একটি সর্বপ্রধান কারণ; যেটা মানুষকে প্রতিনিয়ত এক চরম অনিশ্চয়তার পথে এগিয়ে দিয়েছে। আর এ প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তাই তাকে নিচের দিকে আকর্ষণ করেছে; গভীর বা সুনির্দিষ্ট জীবনের ধারা গ্রহণ করতে দিচ্ছে না। তাদের কাপুরুষ আর জীবন সম্পর্কে উদাসীন বা অমনোযোগী করে তুলছে। এবং এ মনোভাব তাকে আত্মবিশ্বাসে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। যখন এ আত্মপীড়ন থেকে লোকে মুক্তি পাবে, তখনই তার অন্তশক্তি এবং বহিঃশক্ত দুটো মিলিয়ে সে সমাজের এবং নিজের উন্নতির চেষ্টা করবে। হ্যাঁ, পঙ্গু ডালপালা এবং অপ্রয়োজনীয় শিকড়ের ডাল থেকে বেরিয়ে আসার এ একমাত্র পথ।

কিন্তু অস্ট্রিয়ার শাসককুলের সামাজিক দাবি দাওয়া সম্বন্ধে কোন ধ্যান ধারণা বা সামাজিক সঠিক অনুশাসনের অভাবই সমাজের এ দুষ্ট ক্ষতগুলোকে সারতে দেয়নি।

আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি সঠিক কোন জিনিসটা আমাকে বেশি আচ্ছন্ন। করেছিল? দারিদ্রতা, যেটা আমার সেদিনের সর্বক্ষণের সঙ্গী অথবা আমাকে ঘিরে থাকা লোকগুলোর বুদ্ধিমত্তা এবং সাংস্কৃতির অভাব।

সবচেয়ে অবাক ব্যাপার আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা কত তাড়াতাড়ি কুদ্ধ হয়ে ওঠে যখন এসব ব্যাপার তারা পদদলিত কোন ব্যক্তির কাছ থেকে শোনে। তারা জার্মান হোক, বা না হোক। এ অবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভে তারা ফেটে পড়ে, কিন্তু তাদের সেই ঘৃণা মিশ্রিত ক্ষোভের বেশির ভাগটাই ভাবালুতায় ভরা ফানুস মাত্র।

কিন্তু ক’জন সত্যিকারের আত্মবিশ্লেষণ করে? অবশ্য ভাবালুতার বাষ্পে তা সম্ভবও নয়। ক’জন বুঝতে চেষ্টা করে যে পিতৃভূমির যে অংশটার তারা অংশীদার, তার সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক সমৃদ্ধির দিকটাকে। আমাদের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় কি একবারও ভাবে যে পিতৃভূমির সমাজের এমন একটা উজ্জ্বল দিক থাকা উচিত যা নিয়ে তারা গর্ব করতে পারে।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, যে অন্যান্য দেশের শ্রমিক শ্রেণীও কম দেশপ্রেমিক নয়। যদি সেটা স্বীকার করে নেওয়া যায় তবু আমাদের অবহেলাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। কিন্তু ব্যাপারটা এ রকম নয়। আমরা যেটাকে বলি অন্ধ জাতীয়তাবাদী, ফ্রান্সের মহত্বের পরিপূর্ণ বিকাশে সেটাই তাদের সভ্যতা। শুধু সামনে একটা আদর্শ বা লক্ষ্যকে দাঁড় করিয়ে রেখে ফরাসী ছেলেদের শিক্ষা দেওয়া হয় না। শিক্ষা বলতে তাদের দেশের বিস্তারিত সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক পটভূমিকা শেখা, এবং তা শেখানো হয় অতি বিস্তারিতভাবে।

এ ধরনের শিক্ষার পটভূমি বিরাট হওয়া উচিত এবং বারবার শিখিয়ে মনের গভীরে তার অনুপ্রবেশ ঘটানো চাই।

আমাদের ক্ষেত্রে আমরা যে শিক্ষার সেই দিকটাকে উপেক্ষা করে চলেছি শুধু তাই নয়, যারা ভাগ্যবলে স্কুলের দৌলতে একটু আধটু শিক্ষা পাচ্ছে তাদের মনটাও সম্পূর্ণ বিকৃত করে দেওয়া হচ্ছে। বিষাক্ত ইঁদুর প্রতিনিয়ত আমাদের রাজনৈতিক দেহে বিষ ছড়িয়ে চলেছে। হৃদয় এবং সেই স্মৃতিশক্তিকে সেই বিষে আচ্ছন্ন করে দিয়ে এ বিশাল জনতাকে দুঃখ দুর্দশার চরমে নামিয়ে দিচ্ছে।

পাঠকগণকে নিচের একটা দৃশ্য কল্পনা করতে অনুরোধ করি।

মাটির নিচের আর্দ্র দুটো ঘরে একজন শ্রমিক তার পরিবার নিয়ে বাস করে, সর্বসাকুল্যে তারা সাতজন। ধরে নেওয়া যাক পরিবারের একজন হল তিন বছরের একটা ছেলে। এ বয়সে বাচ্চারা যা দেখে এবং শোনে, তাদের মনে তা গভীরভাবে দাগ কেটে বসে। প্রতিভাশালী লোকের ক্ষেত্রে এ বয়সের ঘটনা এমনভাবে মনের মধ্যে রেখাপাত করে যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তা তাদের স্মরণে থাকে। সুতরাং এ জীবনের সংকীর্ণতা এবং এতটুকু পরিবেশে অতো লোকের ভিড় তার মনে নিশ্চয়ই কোন সুখস্মৃতির ছবি আঁকে না। এ পরিবেশে তাই ঝগড়া আর পরস্পরের বোঝাপড়ার অমিল তো থাকবেই। এতটুকু জায়গায় যেখানে পাশাপাশি শোওয়াও অসম্ভব; ওপর নিচে শোওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ছোট ছোট অমিলগুলো, যেগুলো ঘরে বেশি জায়গা থাকলে পরস্পরের কাছ থেকে একটু দূরে সরে বসতে পারলে সহজেই মিটে যায়; এখানে সেগুলোই পুরনো রোগের মত দেখা দেয়। ছোটদের ক্ষেত্রে তারা পরস্পর ঝগড়া করলেও ঝগড়া সহজে মিটে যায়। এবং অল্পক্ষণের মধ্যে তা ভুলেও যায়। কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটাই অন্যরকম হয়ে দেখা দেয়। প্রাত্যহিক ঝগড়াতে যে নির্দয়তা থাকে, সেটাই সংসারের সব শান্তি ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। এগুলো ছেলেপেলেদের জীবনে প্রতিক্রিয়াও কম করে না। কারোর যদি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকে, তার পক্ষে ব্যাপারটা বোঝা সম্ভব। যখন মত্তমাতাল অবস্থায় ঘরে ফিরে স্বামী স্ত্রীকে দৈহিক নির্যাতন করে, সমস্ত পারিবারিক প্রতিক্রিয়া ব্যাপারটাতে যা হয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া বোঝা এটা সম্ভব নয়। বছর ছয়েক বয়স হলে বাচ্চারা তো দূরের কথা, এসব ঘটনাতে বড়রাও স্থির থাকতে পারে না। বিষাক্ত তত্ত্বে জারিত, পেট ভরে খেতে না পাওয়ায় অপুষ্ট শরীর আর মস্তিষ্ক ভরা কীট নিয়ে তারা ঢেকে গিয়ে প্রাইমারী স্কুলে। এরাই দেশের ভবিষ্যত নাগরিক। অতিকষ্টে সেখানেই তারা যতটুকু পারে পড়াশোনা করে। বাড়িতে তো পড়াশোনা করার না আছে জায়গা, না পরিবেশ। উপরন্ত বাবা মা সর্বক্ষণ স্কুলের শিক্ষকদের সমালোচনায় মুখর। বিশেষ করে এ পরিবেশে যেসব সমালোচনা হয়, তার আওতা থেকে কিছুই বাদ পড়ে না। স্কুল থেকে শুরু করে গভর্নমেন্ট পর্যন্ত। ধর্ম, আদর্শ, রাষ্ট্র কোন কিছু সম্পর্কেই এখানে গঠনধর্মী কোন আলোচনা হয় না। যখন চৌদ্দ বছর বয়সে সে স্কুল ছেড়ে বেরয়, তখন সুশিক্ষার বদলে এ জিনিসগুলোই নড়াচড়া করে বেশি।

জীবনের এ সন্ধিলগ্নে মহৎ আদর্শের প্রতি মন ধাবিত না হয়ে মানব জীবনের অন্ধকার দিকটার প্রতিই মন আকৃষ্ট হয় বেশি। পনেরো বছর বয়সে সেই তিন বছরের ছেলেটা সব কিছুর বিরুদ্ধে জেহাদ শুরু করে। জীবনের নোংরা এবং কদর্যময় দিকটার প্রতি-ই তার আকর্ষণ গড়ে উঠে; চিন্তাধারার উঁচু দিকটার প্রতি তখন তার চরম অনীহা। মানসিক ঠিক এ অবস্থাতে সে স্কুলে গিয়ে প্রবেশ করে।

তার জীবনের ছোটবেলায় দেখা পিতার দৈনন্দিন খাত ধরেই বয়ে চলে। ভবঘুরে হয়ে সারাটা দিন রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়ে ঘরে ফেরে। আর সেই অর্ধমৃত জন্মদাতার উদ্দেশ্যে গালাগাল ছোড়ে। শুধু তাই নয় অভিশাপ দেয় ঈশ্বর এবং এ পৃথিবীটাকেও; শেষমেষ গিয়ে ঢেকে অল্প বয়স্ক ছেলেদের শুদ্ধিকরণের জন্য তৈরি জেলখানায়। বাকি যেটুকু ছিল তা ওখানেই পূর্ণতা পায়। এবং মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ওদের ভেতরে দেশপ্রেমের অভাব দেখে সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।

দিনের পর দিন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় দেখে আসছে থিয়েটার, সিনেমা; নোংরা সাংবাদিকতা এবং কদর্য বইপত্রগুলি জনতার মধ্যে বিষ ছড়িয়ে চলেছে। তবু ওরা আশ্চর্য হয় যখন দেখে যুবক সম্প্রদায়ের আদর্শ এত নিচু বা দেশপ্রেম বলতে কিছু নেই। আসলে ছোটবেলা থেকে যে মানসিকতা নিয়ে এ ছেলেগুলো বেড়ে ওঠে, বড় হয়ে সিনেমা, থিয়েটার এবং সাংবাদিকতায় তারই প্রতিফলন দেখতে পায়। এ যেন আগুনের সঙ্গে ঝড়ের হাওয়া এসে ফু দেওয়ার মত অবস্থা।

আমি কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলাম। যেটা আগে আমার ধারণায় ছিল না, সেই ব্যাপারটা এরকম;

উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন মানুষের ভেতরে দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদী আদর্শ জাগরিত করা। যা ছাড়া সমাজকে কিছুতেই ওপরে টেনে তোলা যাবে না। কিন্তু সেটা করতে প্রথমেই শিক্ষা এবং পারিবারিক পরিবেশের আমূল পরিবর্তন দরকার। প্রত্যেকের সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সচেতনতারও প্রয়োজন; সর্বোপরি দেশের রাজনৈতিক পটভূমিকাও মহৎ হওয়া চাই একমাত্র তাহলেই সে দেশের নাগরিক হিসেবে গর্ব অনুভব করা যাবে। মানুষ যাকে ভালবাসে, তারই জন্য যে সংগ্রাম করতে পারে; আর যেটাকে সে শ্রদ্ধা করে, তাকেই সে ভালবাসতে পারে। আর শ্রদ্ধা করার জন্য সেই বিষয়টা সম্পর্কে পুরো না হলেও কিছুটা জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

যেইমাত্র সামাজিক সমস্যায় আমার উৎসাহ আসে, সঙ্গে সঙ্গে তার ভিত্তি সম্পর্কে বিচার বিবেচনা শুরু করি। নতুন আর একটা অনাবিষ্কৃত জগতের পর্দা চোখের সামনে থেকে সরে যায়।

১৯০৯-১০ সালে আমার অবস্থা অনেকটা ভাল অর্থাৎ কায়িক শ্রমের কাজ করে আর আমাকে পেট ভরাতে হয় না। আমি তখন স্বাধীনভাবে ড্রাফটসম্যান এবং জল রঙের অংকন শিল্পী হিসেবে যা রোজগার করি তাতে পেটে ভরবার মত রুটি কেনার সামর্থ্য হয়েছে। এবং সেই রোজগারে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। যদিও যথেষ্ট রোজগার নয়, তবুও পেশাটাকে আমি ভালবাসি। আমাকে ভবিষ্যত উৎসাহ দেয়। তদুপরি সন্ধ্যেবেলায় যখন আমি ঘরে ফিরে আসি, আগেকার মত অতো পরিশ্রান্ত হই না। আগে যখন আমি বাড়ি ফিরতাম তখন পড়াশোনা করার মত অবস্থা আর থাকত না। শরীরটাকে কোনরকমে বিছানায় ছুঁড়ে দিতে পারলে বেঁচে যেতাম। আমার বর্তমান কাজকর্ম ভবিষ্যতের পেশাভিত্তিক। সর্বোপরি আমি আমার কর্মসময়ের নির্ধারক, এবং নিজের মত অনুযায়ী সেই কাৰ্যসূচি পরিবর্তন বা সময় ভাগ করাও আমার হাতে। আমি ছবি আঁকতাম পেট ভরাবার জন্য, এবং পড়াশোনা করতাম, পড়াশোনা করতে ভালবাসতাম বলে।

এভাবে সামাজিক সমস্যাগুলোর পুঁতিগত দিকটা বুঝতে পারি, যাকে সাহায্য করে দিনের পর দিন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। যে সমস্ত বইপত্র এ বিষয় নিয়ে লেখা, প্রায় সবই আমি জোগাড় করে নিয়ে পড়তাম। শুধু পড়া নয়; রীতিমত চিন্তাও করতাম সেগুলো নিয়ে। সেজন্যই লোকে আমাকে খামখেয়ালী বলে ভাবত।

সমাজ সংস্কার ছাড়া আমি সাগ্রহে আর্কিটেকচার বিষয়ে পড়াশোনায় ঝাপিয়ে পড়ি। পাশাপাশি মনোনিবেশ করি সংগীত চর্চায়। যেটা আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করতাম আর্টের রানী। আর সবচেয়ে বড় কথা এ ব্যাপারে আমার যেমন উৎসাহ ছিল, আনন্দও পেতাম প্রচুর। আমি সারারাত ধরে এমন কি ভোর হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে চর্চা বা পড়াশোনা করতাম। এবং দিনে দিনে আমার আত্মবিশ্বাসও দৃঢ় হয়। সময়ে আমার স্বপ্ন সফল হবে; হয়তো বা তারজন্য আমাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে। আমি এখন সুনিশ্চিত যে একদিন বড় স্থপতি শিল্পী হব।

আমার পেশাগত পড়াশোনার পাশে পাশে রাজনীতি সম্পর্কেও পড়াশোনা করতে শুরু করি। কিন্তু রাজনীতি বিষয়টাই আমার মনে তেমন একটা গুরুত্ব পায় না। বরং ব্যাপারটা সম্পর্কে আমার তখনকার ধারণা যে প্রতিটি চিন্তাশীল লোকের রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রাথমিক কর্তব্য। যাদের পারিপার্শ্বিক জগতটার রাজনীতি সম্বন্ধে জ্ঞান নেই, তাদের আলোচনা বা সমালোচনার কোন অধিকারই নেই। রাজনীতি সম্পর্কে আমি যথেষ্ট পড়াশোনা করি, এবং বলতে দ্বিধা নেই পড়াশোনা বলতে তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা যা বোঝে, আমার কাছে তা ছিল অন্য।

আমি এমন অনেককে জানি যারা বইয়ের পর বই, পাতার পর পাতা পড়ে চলে, তবু আমি তাদের পাঠক বলি না। হয়ত বা তারা অনেক পড়ছে। এমনকি তাদের কোন বইটা প্রয়োজনীয় আর কোনটা অপ্রয়োজনীয় সেটুকু তফাৎ করার মত ক্ষমতা নেই। সুতরাং তাদের অবস্থা আগেরটা পড়ে তা পরেরটা ভোলে; তারপর আবার সেটা পড়ে। আর নইলে সমস্ত ব্যাপারটাই অপ্রয়োজনীয় মাল বোঝাই জাহাজের মত মাথা ভারী করে। পড়াশোনা ব্যাপারটা শেষের জন্য নয়; বরং শেষের দিকে পা বাড়াবার প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। একটা মূল উদ্দেশ্যই হল প্রত্যেকের ভেতরে যে সুপ্ত প্রতিভা বা বিশ্বাস ঘুমিয়ে আছে তাকে জাগিয়ে তোলা। দৈনন্দিন রুটির রোজগার অথবা বড় কাজ করার বাসনা— একমাত্র পড়াশোনাই এর রসদ এবং উৎসাহ জোগাতে পারে। এগুলোই হল পড়াশোনা করার প্রথম উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল, যে পৃথিবীতে আমরা বাস করি সেটা সম্পর্কে পড়াশোনাই সম্যক জ্ঞান আমাদের দিতে পারে। উভয়ক্ষেত্রেই সমস্ত অধীত বিষয় মস্তিষ্কে জড়ো করে রাখার প্রয়োজন নেই। পড়াশোনার মাধ্যমে যে ছোট ছোট জ্ঞান আহরিত হয়, সেটা মোজাক করা মেঝেতে পাথরের মত গেঁথে রাখা উচিত। যাতে ভবিষ্যতে সাধারণ জ্ঞানের পরিপূর্ণতার জন্য সঠিক সময়ে টুকরোটা সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। নইলে অধীত বিষয়গুলো প্রয়োজনের সময়ে শুধু গোলমালের সৃষ্টিই করবে; এগুলো শুধু অপ্রয়োজনীয় নয়, প্রয়োজনের সময়ে বিপথগামীও করতে পারে। কারণ সে তো নিজেকে সব সময় বিদ্বান বলে ভাববে; মনে করবে জীবনের অনেকটাই বুঝি সে দেখে ফেলেছে। সে তখন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। সে মনে করে জীবনে সত্যের দিকে এগোচ্ছে, কিন্তু সত্যি বলতে কি এগুলো তাকে সত্যিকারের জীবন থেকে দূরেই সরিয়ে দেয়। যদি না তাকে শেষজীবনে স্যানিটোরিয়াম বা রাজনীতি গ্রহণ করে পার্লামেন্টে জীবন পাড়ী দিতে হয়।

এসব লোকেরা জীবনে যখন সুযোগ আসে তখন তাদের বই পড়া বিদ্যা কাজে লাগাতে সক্ষম হয় না। বিশেষ করে তার মানসিক গঠনটাই তো দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, তার জন্য তৈরি নয়। মাথায় হয়তো বা বোঝাই বই পড়া বিদ্যা জমা হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু ভাগ্যক্রমে যদি একদিন হঠাৎ ডাক পড়ে যে সে বিদ্যা কাজে লাগাও কোন একটা বিশেষ কাজের জন্য; কিন্তু কোন বইয়ের কোন অধীত পৃষ্ঠাটাকে ঠিক সেই সময় সেই কাজে লাগাতে হবে তা বলে না দিলে বেচারা এত পড়াশোনা করেও শুধু হাতড়ে মরবে। মনের এ উত্তেজক অবস্থায় সে হয়ত মন হাতড়ে ঘটনার সাদৃশ্য কিছু খুঁজে বেড়াবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে হয়ত বা দেখা যাবে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে।

এ যদি সত্যিকারের অবস্থা হয়, তবে আমাদের দেশের পার্লামেন্টের যারা তাবড় তাবড় নায়ক, তাদের কাছ থেকে রাজনীতির ব্যাপারে কতটুকু আশা করতে পারি। আসলে তারা তাদের কথার জাল বিস্তার করে, খিস্তি খেউড় করে আর ছল চাতুরীতে সবাইকে ভোলায়।

অপরদিকে পঠিত বিদ্যা যে জ্ঞান সম্যকরূপে আহরণ করে, তা বই, জার্নাল বা বিজ্ঞাপনলিপি যা থেকেই হোক প্রয়োজনে তৎক্ষণাৎ তা স্মরণ করে সেটা কাজে লাগাতে পারে। যেটা সে পড়েছে সেই বিষয়টা মনের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে যায় যে সেটা শুধু মানসিক চিন্তাধারটাকেই সঠিক পথে চালনা করে না, মনটাকেও উদার করতে সাহায্য করে যাতে সেটা সঠিক জায়গায় ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে। হঠাৎ কোন বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হয়ে পড়লে স্মৃতির পৃষ্ঠা হাতড়ে সেই বিশাল জ্ঞান সন্দ্র থেকে মুক্তাটা তুলে এনে জায়গা মত বসিয়ে দিতে পারে। এ পড়াশোনার কিছু অর্থ হয় বা এর কিছু মূল্য আছে।

বক্তা— যার হাতের কাছে খবর তৈরি নেই প্রতিপক্ষের বক্তব্য খণ্ডানোর মত, তার এ বিদ্যার কোন অর্থ হয় না— তা তার নিজের যুক্তি যত ধারালই হোক না কেন? প্রত্যেক আলোচনাতেই তার স্মৃতি তাকে লজ্জায় ফেলে হারিয়ে দেবে। প্রতিপক্ষের বক্তব্যকে বিধ্বস্ত করার মত যুক্তি সে খুঁজে পায় না সে সময়ে। যতক্ষণ পর্যন্ত বক্তা তার নিজের যুক্তির জাল বিস্তার করে, ব্যাপারটা তখন ঘোরালো হয় না। কিন্তু ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে ওঠে কোন বিশেষ জনসাধারণের ব্যাপার হলে, যখন সে ভাবে সব কিছুই তার জানা, আসলে সে কিছুই জানে না।

ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা আমি সঠিক পথে করতাম। উপরন্তু আমি ভাগ্যবান যে আমার স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর এবং বুদ্ধিমান ছিলাম, যা পঠিত বিষয়কে স্মরণে রাখতে এবং জায়গা মত ঠিক মত প্রয়োগ করতে সাহায্য করত। সেইদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমার ভিয়েনার প্রবাস জীবন আমার পক্ষে শুধু প্রয়োজনীয়ই ছিল না, উপকারীও ছিল বটে। আমার দৈনন্দিন কাজই ছিল বিভিন্ন সমস্যাগুলোকে নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করা। আমি যার জন্য বাস্তব অবস্থাগুলোকে সূত্রের মাধ্যমে বা সূত্রগুলোকে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে পারতাম। সুতরাং প্রতি বিষয়ে একদিকে পণ্ডিতাভিমানী তত্ত্ব আর অপরদিকে বাস্তব অবস্থায় ওপরটা দেখার বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেছি।

প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি মনস্থির করি দুটো প্রশ্নের ব্যাপারে তত্ত্বের গভীরে আমাকে প্রবেশ করতে হবে; বিশেষ করে সামাজিক সমস্যার বাইরে।

এটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে সঠিক কখন আমি মার্কস্ মতবাদের চরিত্র সম্পর্কে পড়াশোনা বা বিচার বিশ্লেষণ শুরু করি; তবু এটা সত্য নয় যে এ মার্কসীয় সমস্যা নিয়ে আমাকে খুব বেশি রকম মাথা ঘামাতে হয়েছে।

আমার যৌবনকালে সামাজিক গণতন্ত্র সম্পর্কে আমার যে ধ্যান-ধারণা ছিল তা অতি সামান্য; এবং সেই সামান্য অংশের ভেতরে বেশিরভাগটাই ভুল ধারণা। সত্যি বলতে কি বিশ্বজোড়া দুঃখের এটা একটা কারণ, তবু গোপন ভোটদানের পদ্ধতি আমাকে সন্তুষ্ট করেছিল। আমার বুদ্ধি এবং বিশ্লেষণী শক্তি যেন আমায় তখন বুঝিয়েছিল যে এ পথই হাবুবুর্গ শাসককে দুর্বল করে দেবে; যাকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতাম। যদিও এ পদ্ধতিতে দানুবিয়ান রাজ্যের হয়ত বা অস্তিত্ব থাকত না। এমন কি অস্ট্রিয়ার জার্মান সাম্রাজ্যের অস্তিত্বও হয়ত বা বিপন্ন হয়ে পড়ত, কারণ শ্লাভদের রাজনৈতিক সাংগঠনিক দক্ষতা কতদূর ছিল তা মোটেই প্রশ্নাতীত নয়। সুতরাং আমার আগ্রহ ছিল এমন সব সংগ্রাম যাতে এসব শাসককুল পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে দশলক্ষ লোক তাদের নিজস্ব জার্মান প্রকৃতি ফিরে পায়। পার্লামেন্টে যত বেশি হট্টগোল হবে, এ ব্যবিলোনিয়ান সাম্রাজ্যের পতন তত আসন্ন হয়ে উঠবে। তার মানে অস্ট্রিয়ার জার্মানদের মুক্তি। একমাত্র তখনই তারা তাদের মাতৃভূমির সঙ্গে একত্র হতে পারবে।

সত্যিকারের সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের প্রতি আমার এতটুকু বিরাগ বা বিতৃষ্ণা ছিল। কিন্তু আমার অক্ষমতার জন্য আমি বিশ্বাস করতাম যে শ্রমিক শ্রেণীকে ওপরে তোলার এটাই একমাত্র পথ; এটা একটা প্রধান কারণ যে জন্য আমি সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের স্বপক্ষেই ওকালতি করে এসেছি, বিপক্ষে নয়। সোশ্যাল ডেমোক্রেট মুভমেন্টের যে দিকটা আমার ভাল লেগেছে তা হল অস্ট্রিয়ায় বসবাসকারী জার্মানদের জন্য ওদের সংগ্রাম, তাদের শ্লাভ কমরেডদের প্রতি সহানুভূতি। কিন্তু তখন আমি বুঝতে পারি নি, যে যতদিন পর্যন্ত তাদের দিয়ে কাজ হবে, সোশ্যাল ডেমোক্রেট ততদিন পর্যন্ত তাদের এই চোখে দেখত।

সুতরাং সতের বছর বয়সে মার্কসইজম শব্দটাই আমার কাছে খুব একটা পরিচিত ছিল না, বরং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি যাকে সোশ্যালিজিমের সমর্থক বলেই ধরে নিয়েছিলাম। সেইজন্যই বোধহয় ভাগ্য আমাকে হঠাৎ বজ্ৰমুষ্ঠাঘাতে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে এটা জনসাধারণকে ধোঁকা দেবার এক অতি উত্তম পদ্ধতি।

অবশ্য এ সময় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সঙ্গে আমার সংস্রব বলতে ওদের গণ মিটিংয়ে আমি স্রেফ দর্শক ছিলাম। পার্টির নীতি এবং তাদের সামাজিক শিক্ষা সম্পর্কে পার্টি নেতৃত্বের সামান্যতম ধ্যান-ধারণাও আমার ছিল না। হঠাৎ আমাকে তাদের তথাকথিত শিক্ষা বা দর্শনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এভাবে কয়েক দিনের মধ্যে আমি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির স্বরূপ বুঝতে পারি, স্রেফ যে পরিবেশে আমার দিনগুলো কাটত তার জন্য। অন্যথায় এ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির স্বরূপ বোঝার জন্য আমাকে হয়ত বা একটা পুরো যুগ কাটাত হত। আর সামাজিক উন্নতি এবং প্রেমের ছদ্মবেশে পরস্পর এ অতি বাস্তব সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ত দেশে বিদেশে; এবং কালে এ সংক্রামক ব্যাধিকে রোধ করা না গেলে পৃথিবীর বুক থেকে মানুষ জাতিটাকেই হয়ত বা নিশ্চিহ্ন করে দিত।

বাড়িঘর নির্মাণের ব্যাপারে জড়িত থাকাকালে আমি প্রথম সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সংস্পর্শে আসি।

আমি যখন কাজ শুরু করি তখনকার অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। জামা-কাপড়ের অবস্থা শোচনীয়। আমি তখন অবশ্য আমার কথাবার্তায় অত্যন্ত সতর্ক এবং ব্যবহারেরও প্রচণ্ড রকমের সংযত হয়ে চলতাম। আমি তখন আমার বর্তমানের দুরবস্থা এবং ভবিষ্যতের ভাবনা, নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে বর্তমান পরিবেশ নিয়ে মাথা ঘামানোর মত না ছিল মানসিক অবস্থা, না ফুরসৎ। আমাকে কাজ করতে হত নেহাত-ই পেটের দায়ে এবং পড়াশোনা করার তাগিদে। ভবিষ্যতের এগিয়ে থাকার পথ ধরে অবশ্যই এ পরিক্রমা আমার ধীরগতিতে ছিল; যদি আমার কাজের তৃতীয় বা চতুর্থ দিনে বিশেষ ঘটনা ঘটত, তবে হয়ত বা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা করতাম না। এ সময় আমার ওপরে আদেশ হয় ট্রেড ইউনিয়নে যোগ দেবার।

তখন অবশ্য ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে আমার জ্ঞান বলতে কিছু ছিল না। সত্যি বলতে কি এর প্রয়োজনীয়তা বা অপ্রয়োজনীয়তা কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু আমাকে যখন বলা হল যে ট্রেড ইউনিয়নে আমাকে নাম লেখাতে হবে, আমি সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করলাম। প্রত্যাখ্যানের কারণ হিসেবে আমি বললাম, যে বিষয়ে আমার কোন জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে নিজেকে আমি কখনই জোর করব না। সম্ভবত এ কারণটাই আমাকে আমার সত্যিকারের পথ থেকে বিচ্যুতি করেনি। ওরা বোধহয় ভেবেছিল কয়েকদিনের ভেতরে আমার চিন্তাধারা বদলে আমি ওদের বাধ্য হয়ে উঠব। কিন্তু ওরা এটা ভেবে যে প্রচণ্ড রকমের ভুল করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। সপ্তাহ দুয়েক পরে আমি বুঝতে পারি, প্রথমে রাজী যদি হয়েও যেতাম, কিন্তু বর্তমানে রাজী হওয়া অসম্ভব। এ দুই সপ্তাহে আমি আমার সহকর্মিদের আরো ভালভাবে বুঝতে পারি এবং নিজের মনটাকে এমন দৃঢ়ভাবে স্থির করি যে পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই যা আমাকে ট্রেড ইউনিয়ানে যোগ দেওয়াতে পারে। আসলে এখন আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের স্বরূপটা ভালভাবেই বুঝতে পেরেছি।

বলাবাহুল্য আমার চাকরির প্রথম দিনেই ব্যাপারটাতে তখন আমার বিরক্তি এসে গেছে। দুপুরবেলা আমার কয়েকজন সহকর্মি শ্রমিক কাছের গুড়িখানায় গিয়ে হাজির হত, আর অন্যেরা সেই নির্মীয়মান বাড়ির একাংশে বসে তাদের মধ্যাহ্নের খাওয়া-দাওয়া সারত; বেশিরভাগ খাওয়া-দাওয়া বলতে বোঝাতে শুকনো এক আধ টুকরো রুটি। অবশ্য এরা সবাই সংসারী, বিবাহিত। তাদের স্ত্রীরা ভাঙা পাত্রে দুপুরের খাওয়ার জন্য স্যুপ নিয়ে আসত। সপ্তাহের শেষের দিকে শুঁড়িখানায় যাওয়ার লোক কমতে থাকত; বেশির ভাগই দুপুরের খাওয়ার জন্য নির্মীয়মান বাড়ির একাংশে ভিড় জমাত। পরে অবশ্য এর কারণটা আমি বুঝতে পেরেছি। তখন তারা রাজনীতি নিয়ে তর্কে-বিতর্কে মেতে থাকত।

আমি বাইরে কোথাও বসে দুধের বোতলের সঙ্গে রুটির টুকরো চিবোতাম আর যে পরিবেশে আমি বর্তমানের দিনগুলো কাটাচ্ছি তার দুর্ভাগ্যের কথা মনে মনে চিন্তা করতাম। যদিও আমি ওদের কথাবার্তা বেশিরভাগই শুনতে পেতাম। আমার ধারণা, দলে টানবার জন্য ওরা ইচ্ছে করেই আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আলোচনাগুলো উঁচু স্বরে করত। কিন্তু আসলে ওদের কথাবার্তা শুনে আমার মনটা আরো বেশি বিষিয়ে উঠত। সেই সমালোচনায় সবকিছুরই নিন্দা চলত–বিশেষ করে জাতির উদ্দেশ্যে; কারণ তা নাকি খালি বড়লোকদেরই স্বার্থ দেখেছে। (এ কথাটা আমাকে যখন তখন প্রায়ই শুনতে হত।) ফাদারল্যান্ড অর্থাৎ পুরো দেশটাই নাকি বুর্জোয়াদের হাতে এবং তারা ইচ্ছে মত শ্রমিক শ্রেণীর ওপর নিরঙ্কুশ শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। শাসক স্কুলের কাজই নাকি প্রলেতেরিয়া গোষ্ঠীকে নিচে ঠেলে ফেলে দেওয়া; ধর্ম তো শুধু লোকেদের ফাঁকি দিয়ে প্রতারণা করার জন্য; আদর্শ-টাদর্শ কথাগুলো স্রেফ লোকেদের বোকা বানানো আর মেয়েদের মত জনতাকে সুবোধ রাখার জন্য। এমন কিছু বিষয়বস্তু বাদ থাকত না যা তারা আলোচনার নোংরা কাদায় টেনে না নামাত।

প্রথমদিকে আমি চুপচাপ থাকতাম। কিন্তু এমনি মুখে কুলুপ এঁটে আর কতদিন থাকা যায়। শেষে ওদের আলোচনায় অংশ নিতে শুরু করি; এবং তাদের বক্তব্যের উত্তর দিতে থাকি। যদিও জানতাম এসবের কোন ফলই পাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি ওদের আলোচনার বা সমালোচনার সঠিক উত্তর দিতে পারছি, সুতরাং আমি স্থির করি ওরা যেখান থেকে ওদের জ্ঞান বুদ্ধি আহরণ করে, সেই জায়গাগুলোর খোঁজ খবর আমাকে রাখতে হবে। সুতরাং আমি বই এবং পত্র-পত্রিকার সমুদ্রে ডুবে যাই।

ইতিমধ্যে সেই নির্মীয়মান বাড়ির মধ্যে বসে আমাদের তর্ক-বিতর্ক চলতেই থাকে। দিনে দিনে তারা যেসব বিষয়ে নিজেদের বিশেষজ্ঞ বলে মনে করত, তাদের চেয়ে সেসব বিষয়ে আমার জ্ঞান অনেক বেশি বেড়ে যায়। তারপর একদিন আসে যখন আমার আহরিত জ্ঞানের ধারালো কথাগুলোকে তাদের জোরালো যুক্তি দিয়ে খণ্ডনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু যুক্তি থাকলে তো খুঁজে পাবে। সুতরাং শুরু হয় আমাকে গায়ের জোরে ভয় দেখানো। দলের কয়েকজন নেতা আমাকে সেই চাকরি ছেড়ে দিতে আদেশ দেয় নইলে মারধোর করে তাড়াবে। আমি একা হওয়াতে গায়ের জোরে ওদের সঙ্গে পেরে উঠব কেমন করে? সুতরাং আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আরো কিছু অভিজ্ঞতা ভরে নিয়ে প্রথম সুযোগেই তাদের সংস্পর্শ ত্যাগ করি।

যদিও আমি বিরক্তিতে দূরে চলে গিয়েছিলাম, তবু পুরো ব্যাপারটা আমার মনকে এত প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল যে কিছুতেই আমার পক্ষে তার দিকে পেছন ফিরে থাকা সম্ভব হয়নি। পুরো ব্যাপারটা নিজেই চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছি। রাগ পড়ে এলে আবার আমার মধ্যেকার একগুঁয়েমিটা ফিরে আসে এবং যে কোন মূল্যের বিনিময়ে আমি আবার বাড়ি তৈরির কাজে ফিরে আসার জন্য মনস্থির করি। এ চিন্তাধারাটা কয়েক সপ্তাহ পরে আরো বেশি দৃঢ় হয়, কারণ সঞ্চয় বলতে স্বল্প যে কয়েকটা টাকা ছিল, ইতিমধ্যেই তা খরচ হয়ে গেছে। ক্ষুধা তার নির্মম থাবা আবার হেনেছে আমার ওপর। অন্য কোন রাস্তাও আমার সামনে খোলা নেই। কাজ খুঁজে পেলেও আমাকে আবার তা ছেড়ে দিতে হয়। কারণ সেই আগেকার অবস্থা।

তখন আমি আত্মবিশ্লেষণ শুরু করি। এ মানুষগুলো কী মহৎ মানুষের পর্যায়ে পড়ে উত্তরটা রীতিমত চাঞ্চল্যকর। যদি উত্তর হয়— হঁা, তবে এত বিপদ এবং আত্মত্যাগ নিয়ে এ ইতর শ্রেণীর জন্য সগ্রাম করা অনর্থক। অপরদিকে যদি উত্তর হয় না, তবে এ লোকগুলোর জাতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা একেবারেই নেই। অর্থাৎ আমাদের জাতি সত্যি তা হলে গরীব। সেই দ্বিধাপুর্ণ মানসিক দিনগুলোয় গভীর মনসংযোগ দিয়ে মানস চোখে আমি যেন দেখতে পাই ক্রমাগত বেড়ে চলা এ লোকগুলোকে জাতির উন্নতির পথে হিসেবে আনা কোনরকমই সম্ভব নয়।

কয়েকদিন পরে আমার মানসিকতা সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে মোড় নেয়। রাস্তা দিয়ে যেতে দেখি কিছু ভিয়েনার শ্রমিক বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। আমি প্রায় ঘন্টা দুয়েক স্থির নিশ্চিতভাবে সেই মনুষ্যরূপী ড্রাগনদের দেখি। যখন জায়গাটা পরিত্যাগ করে আমার বাড়ির দিকে রওনা হই, তখন মনটা হতাশায় ভরে ওঠে। যেতে যেতে একটা তামাকের দোকানে শ্রমিকদের সংবাদপত্র নজরে আসে। সংবাদপত্রটির নাম আরবাইটার ঝাইটুঙ বা শ্রমিকদের মুখপাত্র। এটাই হল পুরনো অস্ট্রিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির মুখপত্র। সে সস্তা চায়ের দোকানে যেখানে সাধারণ মানুষ ভিড় করত, সেখানে মাঝে মাঝে আমিও যেতাম এ পত্রিকাটা পড়ার জন্য। দোকানদার এ একটা পত্রিকাই রাখত। কিন্তু কখনই কয়েক মিনিটের বেশি এ কদর্য সংবাদ পত্রটায় আমি চোখ বোলাতে পারিনি; আসলে পত্রিকাটার মূল সুরটাই কেমন যেন এক বিশ্রী গন্ধে ভরা। কিন্তু সেদিনকার দেখা বিক্ষোভ আমার মনে যে হতাশার সৃষ্টি করেছিল, সেটাই যেন আমাকে বারবার পত্রিকাটা কিনে খুঁটিয়ে পড়ার তাগাদা অন্তর থেকে দিচ্ছিলো। সুতরাং পত্রিকাটা কিনে আমি বাড়ি গিয়ে সমস্ত সন্ধ্যে ধরে পড়ি। নজর এড়ায় না যে কতগুলো মিথ্যা পত্রিকাটা সত্য বলে চালাচ্ছে।

এখন আমি অন্যান্য বইয়ের থেকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির দৈনিক পত্রিকাগুলো কিনে পড়ে সহজেই ওদের সত্যিকারের রাজনৈতিক দর্শনের চরিত্রটা অনুধাবন করতে পারি।

দুটো সত্যের মাঝখানের ফরাকটা দিনের আলোর মত স্পষ্ট। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি পত্রিকাগুলো যদিও মুখে স্বাধীনতা, শ্রমের মর্যাদা এবং জীবন সম্পর্কে বড় বড় শব্দ বসিয়ে অবতারের ভঙ্গিতে মানুষকে আশ্বাস দিত; কিন্তু এটা পাঠকদের ধোঁকা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। অপরদিকে মানুষের লোভটাই নির্দয়ভাবে প্রকট হয়ে উঠত। কোন কিছুরই সত্যিকারের ভিত্তি তাতে ছিল না, শুধু মানুষকে প্রতারণা করা ছাড়া। এ সাংবাদিকতা সত্য সংবাদ মোচড় দিয়ে ঘুরিয়ে এমনভাবে পরিবেশন করত যাতে সত্যিকারের সংবাদ বোঝা কারোর পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর এ পুঁথিগত তথ্য নিয়ে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ সম্প্রদায় যারা নিজেদের বুদ্ধিমান ভাবতো, তারা আত্ম সন্তুষ্টিতে ভুগত। এ সংবাদপত্রগুলো জনগণের কাছে মিথ্যা প্রচার ছাড়া আর কিছু নয়।

এভাবে এবং সংবাদপত্রগুলোর মাধ্যমে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির উপদেশাবলী পড়ে আমার দেশের মানুষের প্রতি আমাকে আরো বেশি আকর্ষণ করে। যেটাকে আমি প্রথমে অনতিক্রম্য গহ্বর বলে ভেবেছিলাম, পরে সেটা অনেক বেশি স্নেহ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।

একবার যখন বুঝতে পারি কী বিরাট পদ্ধতিতে ওরা জনগণের মনকে বিষাক্ত করে তুলেছে, তখন একমাত্র বোকারাই এর বলী হতে পারে। সেই বছরগুলোতে যখন আমি ক্রমে ক্রমে স্বাধীন চিন্তার জগতে পা রাখতে শুরু করেছি, তখন আমি ভালভাবেই বুঝতে শিখেছি, কি করে ওরা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির সুসমাচারের মাধ্যমে জয় লাভ করছে। এখন আমি উপলব্ধি করতে পারি কেন এবং কী উদ্দেশ্যে ভাল ভাল বই এবং সংবাদপত্র পড়া ওরা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। বিশেষ করে যে সব বই আদৌ লাল বলে গণ্য নয়। কিন্তু লাল মিটিংয়ে যোগদান করা নিষিদ্ধ হয়নি। পরিষ্কার নিষ্ঠুর বাস্তবের আলোকে আমি ভবিষ্যতকে যেন দেখতে পাই। যে ভবিষ্যত এ অসহ্য উপদেশাবলীতে কালো হয়ে গেছে।

বিরাট গনমানসকে একমাত্র তাদের দৃঢ় এবং অনমনীয় মন দ্বারাই মাপা যায়। যেমন মেয়েদের অন্তর মানস এতটা নিষ্ফলা যে কোন কারণে দোলা খায় না, কিন্তু মিথ্যা আর আবেগে তারা তাদের সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত করে। শক্ত মানুষের কাছে দুর্বলরা সত্বর যেমন মাথা নোওয়ায়— ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষ শক্ত শাসকের কাছে প্রার্থনা জানাতে ভালবাসে। যদিও সেই শাসক আবার তাদের উপদেশাবলীর আড়ালে মানসিক নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়। কারণ সাধারণ জনতার পছন্দ সম্পর্কে কোন ধ্যান-ধারণা থাকে না। এবং সবসময় তারা ভাবে যে সমাজ কর্তৃক তারা পরিত্যক্ত। বুদ্ধির দিক দিয়ে তাদের ভয় দেখালেও তারা লজ্জিত হয় না। কারণ তারা চিন্তাতেও আনতে পারে না যে মানুষ হিসেবে তাদের স্বাধীনতা নির্লজ্জের মত তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং তাদের সামান্যতম সন্দেহ হয় না যে ভুল মতবাদটাই তারা স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছে। একমাত্র নির্দয় শক্তি এবং বীভৎসতার কাছেই তারা মাথা নত করে।

যদি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসিকে সত্যিকারের শিক্ষা দিয়ে বিরুদ্ধতা করা যায় তবে সে সংগ্রাম হবে তিক্ততায় পরিপূর্ণ। তবু এ সত্যিকারের শিক্ষাই হবে চিরস্থায়ী অবশ্য যদি ঠিক একই রকম নির্দয়ভাবে সঙ্গে সেটাকে রূপায়িত করা সম্ভব হয়।

মাত্র দু বছরেরও কম সময়ে এ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির প্রকৃত শিক্ষা ও তাদের কলাকৌশল রপ্ত করে ফেলি।

আমি ওদের এ কুখ্যাত কলাকৌশল যেটা দিয়ে ওরা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে ভয় পাওয়ায় সেটা সহজেই অনুধাবন করি। এ ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার জন্য মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় কখনই মানসিক বা আধ্যাত্মিক শক্তি রাখে না। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির কলাকৌশল হল আর কিছুই নয়, একরাশ প্রজ্জলিত মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে তাদের চোখে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ভয় পাইয়ে দেওয়া, যতক্ষণ না পর্যন্ত লোকটার মানসিক শক্তি ভেঙে পড়ে এবং তাদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। কারণ তখন লোকটার মনের অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় যখন সে একটু শান্তিতে থাকতে পারলে বেঁচে যায়। কিন্তু তাদের আশা দুরাশাই হয়ে দাঁড়ায়; কখনই তাদের শান্তিতে থাকতে দেওয়া হয় না।

ওই কলাকৌশল বারে বারে পুনরাবৃত্তি করা হয়, যাতে লোকটা উন্মাদ কুকুরের পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়, ওদের কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে।

যদিও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতায় শক্তির মূল্য বুঝতে শিখেছে, সেই কারণে যখনই কোন লোকের মধ্যে ব্যক্তিত্বের গন্ধ পায়, যেটা অবশ্য খুবই কম, তাকেই বশে আনতে একই পদ্ধতি প্রয়োগ করে। অপরদিকে দুর্বল মানুষগুলো মরা ইতর প্রাণী ছাড়া আর কিছু নয়, অন্ততপক্ষে মানসিক শক্তির দিক থেকে, তাদের প্রশংসা এবং উৎসাহ দিয়ে নিজেদের দলে ভেড়ায়। যে প্রতিভাধর মানুষের ইচ্ছাশক্তি থাকে না, তারাই কম ভীতিপ্রদ। যে সব বলিষ্ঠ চরিত্রের সঙ্গে বুদ্ধি যোগ দেয়, তারা বুদ্ধি এবং ইচ্ছাশক্তির জোরে নেতৃত্বের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসে।

সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা ভালভাবেই জানে কি করে জনগণের মনের ওপরে চাপ ফেরতে হয় যে তারাই একমাত্র শক্তির ধারক ও বাহক। এভাবে অবস্থা অনুযায়ী ধীরে ধীরে তারা তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলে। একের পর এক জায়গা দখল করে। কখনো বা ভয় দেখিয়ে কখনো দিন দুপুরে ডাকাতি করে। এ শেষের পদ্ধতি ওরা প্রয়োগ করে যখন জনতার আকর্ষণ অন্য কোন বিষয় বস্তুতে নিবদ্ধ হয় এবং তা ফিরতে না চায়। অথবা যখন সাধারণ মানুষ মনে করে নগণ্য কোন ঘটনাকে ওরা বিকৃত করে বিরুদ্ধ পক্ষের চরিত্র হনন করছে।

এ কলাকৌশলগুলো মানুষের দুর্বল দিকটাকে সঠিক বিবেচনা করে অংকের মত হিসেব করে তৈরি করা হয় যাতে সাফল্যে কোন সন্দেহ না থাকে, অবশ্য যদি না প্রতিপক্ষ শেখে বিষ বাস্পের বিরুদ্ধে কি করে বিষবাষ্প দিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। দুর্বল প্রকৃতির লোকদের প্রতিটি পদক্ষেপে বলে দিতে হয় এটা হওয়া উচিত বা উচিত নয়। আমিও অবশ্য বুঝতে শিখলাম শারীরিক ভয় প্রদর্শন দ্বারা জনতা বা একক ব্যক্তিকে দিয়ে কোন একটা উদ্দেশ্য সাধন করা যায়। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে সোশ্যালিস্টরা গাণিতিক ছক কষে নিয়েছিল যে তাদের শারীরিক প্রতিক্রিয়া দ্বারা কর্মস্থলে বা কারখানায়, জামায়েতে বা গণবিক্ষোভে এ ভয় প্রদর্শন সব সময়ই সফল হবে, যদি না তার চেয়ে বেশি ভয় এবং বীভৎসতা অপরপক্ষকে দেখানো যায়। তখন অবশ্য পার্টি মরণ আর্তনাদ করে উঠবে। এ ঠান্ডা মাথায় হত্যার বিরুদ্ধে সেই শাসককুলের কাছেই আবেদন জানাবে, যে শাসককুলকে তারা স্বীকার করে না বা পাত্তা দেয় না। এ ভাবে। তারা নিজেরাই নিজেদের লক্ষ্যপথ থেকে সরে আসবে এবং নিজেদের গন্তব্যস্থল অনেক বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়বে। তারা তখন প্রাণপণ চেষ্টা করবে উঁচু পদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে সঁড়ের মত বোকা কয়েকটাকে খুঁজে বের করতে; যারা বোকার মত চেষ্টা করবে অপরপক্ষের ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা অর্জন করার, যাতে তারা তার ভবিষ্যতের বিপদ আপদের সময় সাহায্যে আসে, এবং সে তাদের বর্তমান পথের কাঁটাটাকে ভেঙে ফেলে দূরে সরিয়ে দিতে সহায়ক হবে।

এ ধরনের কলাকৌশল সাধারণ গণমানসে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া তুলবে, অনুগত বা বিরুদ্ধপক্ষ যে-ই হোক না কেন, একমাত্র তারাই বুঝতে পারবে যাদের জনতার চরিত্র ভালভাবে জানা আছে। হ্যাঁ, বইপড়া বিদ্যে নিয়ে নয়, নিকট অভিজ্ঞতা থেকে। এ সাফল্যগুলোই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির অনুগতরা শিঙা ফুকে নিজেদের সঠিক বলে প্রচার করে বেড়ায়। অপরদিকে মার খাওয়া প্রতিপক্ষ বেশির ভাগ সময়েই নিজেদের প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।

যতই এ শারীরিক ভয় প্রদর্শন করতে থাকে, তত বেশি সহানুভূতি আমার জেগে। ওঠে সাধারণ জনসাধারণের প্রতি, যারা ভয়েই ওদের বশীভূত।

সেই সময় যে সব পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে আমাকে পথ হাঁটতে হয়েছে তার জন্য আমি নিজেকে ধন্যবাদ দেই। কারণ এটাই আমাকে জনসাধারণের কাছে এবং জনসাধারণের প্রতি ভাবতে সাহায্য করেছে। অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি নকল নেতৃত্ব এবং সেই নকল নেতৃত্বের বশীভূত বিপথগামী লোকগুলোকে আলাদা করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

আমাদের উচিত এ যুপকাষ্ঠে বলি হওয়া লোকগুলোর প্রতি সহানুভূতি দেখানো। আমি এখানে কয়েকটা উদাহরণ দেব যে লক্ষণগুলোর সাহায্যে সামাজিক নিচুতলার লোকগুলোর মানসিকতা বোঝা যাবে। কিন্তু আমার লেখা চরিত্রগুলো কিছুতেই জীবন্ত হয়ে উঠবে না, যদি না আমি স্বীকার করেনি যে সেই অন্ধকার সামাজিক নিচুতলার লোকগুলোর মধ্যেই আলোর স্ফুলিঙ্গ দেখেছিলাম; তাদের মধ্যেও কয়েকজন ছিল অবশ্যই সংখ্যায় অত্যন্ত কম, যাদের আত্মোৎসর্গ এবং অনুগত মনোভাব সগ্রামের সত্যিকারের সঙ্গী হওয়ার যোগ্যতা রাখে। যারা জীবনে প্রায় কিছুই চায় না এবং যে সাধারণ পরিবেশ তাদের ঘিরে থাকে, তাতেই তারা সন্তুষ্ট; এ গুণগুলো বিশেষ করে পুরনো শ্রমিকদের মধ্যে দেখা যেত। যুবকদের মধ্যে থেকে এ বিশেষ গুণগুলো দ্রুত অবলুপ্তি পেলেও তার জন্য শহুরে পরিবেশ ও আধিপত্যই দায়ী; তবু সেই যুবকদের মধ্যেও কিছু ছিল যারা আন্তরিকভাবে একটা আদর্শকে (সেই নোংরা দৈনন্দিন জীবনে কোনরকমে বেঁচে থাকার পরিবেশের মধ্যে থেকেও) বুকের মধ্যে সযত্নে লালন পালন করত। যদি ওদের মধ্যে কেউ জনসাধারণের শত্রুদের সমর্থন করে থাকে, তবে তার একমাত্র কারণ হল সোশ্যালিস্ট আন্দোলনকারীদের কুখ্যাত মতবাদ তারা বুঝতে পারত না। এর আরো একটা কারণ হল জনসাধারণের কোন অংশই শ্রমিকদের ভাগ্য সম্পর্কে কোনরকম চিন্তা-ভাবনা করত না। আসলে সামাজিক অবস্থাটাই ছিল এ ধরনের ঘঁচে ঢালা, যাতে প্রথমে অনিচ্ছুক হলেও শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হত। শেষে এমন একদিন এল যে দারিদ্রতার ভয়ংকর হাঁ মুখ তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের দলে।

অসংখ্যবার বুর্জুয়া অর্থাৎ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় শ্রমিকদের মানবতার দিকে পর্যন্ত তাকায়নি, তাদের ন্যায্য দাবি দাওয়ার চরম বিরোধিতা করেছে। এ অন্যায় এবং অবিবেচনায় মধ্যবিত্ত শ্ৰেণীর কোন লাভই হয়নি। কিন্তু তার ফলে সত্যিকারের সৎ শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে রাজনীতির দিকে বাধ্য হয়ে দৌড়ে গেছে।

লক্ষ লক্ষ শ্রমিক যারা প্রথমদিকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রচন্ড বিরোধিতা করেছে; কিন্তু তাদের সেই বিরোধিতাকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি গায়ের জোরে এমনভাবে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে যে তারা একসময়ে বাধ্য হয়েছে নতি স্বীকার করতে। তবু আমি বলব এ পরাজয় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের চরম মুখামীর ফল। যারা শ্রমিক শ্রেণীর সমস্ত রকম ন্যায্য দাবির শুধু বিরোধিতাই করে এসেছে। এ অপরিণামদর্শিতা যেটা শ্রমিকদের উন্নতিতে বাধা দিয়েছে, কারখানায় কর্মরত আহত শ্রমিকের অস্তিত্ব বিপন্ন করেছে বা নাবালক শ্রমিককে কাজ করতে বাধা দেয়নি; মহিলা শ্রমিকদের কোনরকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি, বিশেষ করে গর্ভবতী মাদের এগুলো সম্ভবপর হয়েছে একমাত্র সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিকদের নেতাদের সাহায্যে। যারা প্রতি মুহূর্তে সুযোগ খুঁজে বেড়িয়েছে যাতে জনতাকে প্রতারিত করে নিজেদের জালে এনে ফেলতে পারে। আমাদের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় তাদের নিজেদের ভুলে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে তা কখনই সারাতে পারবে না। কারণ সামাজিক সংস্কারের সবরকম বিরোধতা করে তারা আসলে ঘৃণার বীজ বপন করেছে। এটাকেই ওরা অর্থাৎ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট্রা শ্রমিকদের স্বার্থ দেখেছে বলে দাবি করেছে।

এগুলোই হল ট্রেড ইউনিয়নগুলোর অস্তিত্ব বিপন্নের সত্যিকারের কারণ; এবং তার ফলে শ্রমিক সংগঠনগুলো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছে।

সামাজিক এ যে সমস্যাগুলো আমাকে ঘিরেছিল সেগুলো বিশ্লেষণ করে আমি চাই বা না চাই একরকম বাধ্য হই নিজেকে ট্রেড ইউনিয়নের দিকে এগিয়ে দিতে। কারণ আমি ভেবেছিলাম এগুলোও হল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অঙ্গ বিশেষ; বলতে দ্বিধা নেই আমার এ তড়িঘড়ি মন ঠিক করা ভুল হয়েছিল। অবশ্যই পরে আমি এ ভুলটাকে বর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু এ বিশেষ ব্যাপারে আমার ভাগ্য আমাকে শুধু বুঝিয়েই দেয়নি; সেই সঙ্গে শিক্ষাও দিয়েছিল, যাতে করে পরে আমি আমার প্রথমের মনস্থির পরিবর্তন করি।

কুড়ি বছর বয়সে আমি বুঝতে পারি যে ট্রেড ইউনিয়ান যেমন কর্মচারীদের দাবি এবং উন্নত জীবন ধারনের জন্য শক্তিশালী হাতিয়ার, অন্যদিকে তেমনি এ ট্রেড ইউনিয়ন রাজনৈতিক দলগুলোর শ্রেণী সংগ্রাম করারও যন্ত্র।

সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা ট্রেড ইউনিয়ান চরিত্রের এ দিকটা ভালভাবেই বুঝত এবং তা প্রয়োজনে নিপুণভাবে ব্যবহার করত। তারা ট্রেড ইউনিয়ান নামক যন্ত্রটিকে এমন নিপুণভাবে ব্যবহার করত যে তাতে সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। অপরদিকে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ট্রেড ইউনিয়ানের চরিত্রের এ দিকটা অক্ষম হওয়ায় রাজনীতির পটভুমিকা থেকে শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। তারা সব সময় ভেবে এসেছে যে তাদের একগুয়েমী এ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বৃদ্ধি বন্ধ করবে এবং রাজনৈতিক পটভূমিকা থেকে জায়গা হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু এটা কখনই সম্ভব বা সত্যি নয় যে ট্রেড ইউনিয়ান মুভমেন্ট জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি। সত্যি বলতে কি এর উল্টোটাই হল অনেক বেশি সত্য। যদি ট্রেড ইউনিয়ানের কার্যকলাপ শ্রেণী উন্নতির কাজে লাগান যায় এবং তা সাফল্যের সঙ্গে করা যায় তবে সেই ট্রেড ইউনিয়ান মুভমেন্ট পিতৃভূমি এবং শাসককুলের বিরুদ্ধে তো যাবেই না, বরং জাতির সত্যিকারের উন্নতির সহায়ক হবে। এ পথে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন হল জাতির শিক্ষায় একটা অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গবিশেষ। এটাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নেওয়া উচিত, কারণ এটা শুধু সামাজিক দূষিত বীজাণুগুলিকে মারবে না বরং জাতির পারিপর্শ্বিক এবং সামগ্রিক উন্নতির পথে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

সুতরাং ট্রেড ইউনিয়ান যে অতি প্রয়োজনীয় এটা জিজ্ঞাসা করা শুধু নিম্প্রয়োজন তা নয়, অবাঞ্ছনীয়ও বটে।

যতদিন পর্যন্ত কর্মচারীরা সামাজিক সচেতন না হয় এবং ন্যায্য বিচার সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে, ততদিন পর্যন্ত তাদের মালিকদের কর্তব্য, যারা আমাদের জনসাধারণের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে, সাধারণ ব্যক্তিদের লোভ এবং অযৌক্তিক স্বার্থ থেকে তাদের রক্ষা করা। জাতীয় স্বার্থেই কেবল যেমন জনসাধারণের প্রতি বিশ্বাস এবং আস্থা রাখা উচিত নয়, সুস্বাস্থ্যের জন্য এটা প্রয়োননীয়ও বটে।

এ দুই ব্যবস্থাকে অসাধু মালিকেরা ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রেখে জাতির একজন সদস্য হিসেবে চরম অন্যায় করে চলত। তাদের ব্যক্তিগত তীব্র লালসা এবং দায়িত্বহীনতাই ভবিষ্যতের যত গণ্ডগোলের বীজ বপন করেছিল। এ অন্যায়গুলোর প্রতিরোধ করা মানেই দেশের উন্নতি করা।

এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন যে যদি কোন শ্রমিক মালিকের তরফ থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হয়, তবে তার পরিপূর্ণ অধিকার আছে সেকথা স্বাধীনভাবে চিন্তা করার অথবা সে চাকরিস্থল পরিত্যাগ করার। না, এ যুক্তি বর্তমানে যে প্রসঙ্গ আলোচনা করতে বসেছি তা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে। এ সামাজিক বিক্ষোভ দূরে সরানো উচিত কিনা এটাই হল আমাদের কাছে বড় প্রশ্ন। যদি উচিত হয় তবে এমন এক শক্তিশালী অস্ত্র দিয়ে সংগ্রাম করতে হবে যাতে সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে একজন শ্রমিকের পক্ষে তার মালিকের প্রচণ্ড ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। এটাই যদি চলার আদর্শ হত, তবে তো সংঘর্ষের কোন কারণই থাকত না। এখানে প্রশ্ন হল কে বেশি শক্তিশালী? যদি ব্যাপারটা অন্যরকম হত বিচারের মানবত্ব ঝগড়াটাকে সম্মানের সঙ্গে মিটিয়ে দিতে পারত; অথবা ব্যাপারটাকে আরো বেশি সঠিকভাবে উপস্থাপনা করা যেত যাতে ঝগড়াটা গড়াতেই পারত না।

যদি অসামাজিক বা ঘৃণামিশ্রিত ব্যবহার মানুষকে প্রতিরোধ করতে বাধ্য করে, তখন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তাদের নিজস্ব মতবাদ সেই প্রতিরোধের ওপরে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, আইনসভা আইনের সাহায্যে এসব শয়তানী মতবাদগুলোকে অবশ্যই দূরীভূত না করলে। সুতরাং এর থেকে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে একক শ্রমিককে যদি এ যুদ্ধে জিততে হয় তবে তাকে তার সহকর্মীদের নিয়ে একটা যুজফ্রন্ট তৈরি করে তবে মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে সগ্রামে নামতে হবে। অবশ্য মালিক তার পেটোয়া লোকদের জড়ো করার আগেই। কারণ মালিক সবসময় তার পেটোয়া লোকগুলোকে জড়ো করে নিয়েই শিল্প অথবা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে থাকে।

এভাবেই শুধু যে ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করতে পারে তা নয়। ভবিষ্যতের বাস্তব ফলাফলের রাস্তাও খুলে দিতে সক্ষম হয়। এ পথেই তারা তাদের সংঘর্ষের কারণগুলো দূর করতে পারে; যেগুলো হল তাদের অসন্তোষের মূল কারণ।

ট্রেড ইউনিয়ান যে সত্যিকারের পথে কাজ করে না তার জন্য দায়ী হল যারা আইনের সাহায্যে সংস্কারের বা সংস্কার করা হলেও সেগুলোকে পেছন থেকে ছুরি মেরে বাস্তবে রূপায়িত হতে দেয় না। আর এ সবগুলোই তারা করে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি দিয়ে।

মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল না এসব বোঝার বা ইচ্ছে করেই বুঝতে চাইত না যে ট্রেড ইউনিয়ান মুভমেন্ট কত দরকারি। আর সেই সুযোগে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট্রা ফায়দা উঠিয়েছে; পুরো মুভমেন্টটাকেই নিজেদের দিকে টেনে নিয়েছে। এভাবে শক্ত একটা দুর্গ বানিয়ে যখনই সংগ্রাম আকার ধারণ করেছে তার আড়ালে মুখ লুকিয়েছে; সংগ্রামের সত্যিকারের উদ্দেশ্যে মানুষ বিস্মৃত হয়ে গেছে তার বদলে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এসে জায়গা দখল করে বসেছে। ট্রেড ইউনিয়ান মুভমেন্ট যে উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল তা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বিপদে ফেলতে সমর্থ হয়নি। বরং তারা সংগ্রামটার গতি রুদ্ধ এবং বিপথগামী করে দিয়েছে নিজেদের সুবিধার জন্য।

কয়েক যুগের মধ্যেই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা নিপুণ হাতে ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্টটাকে যেটা সৃষ্টি হয়েছিল মানবাধিকার রক্ষার জন্য, সেটাকে জাতীয় অর্থনীতির ধ্বংস যন্ত্রে পরিণত করে, শ্রমিকদের স্বার্থ যাতে এক মুহূর্তের জন্যও তাদের উদ্দেশ্যের পথ রোধ করতে না পারে। কারণ রাজনীতিতে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা খুব একটা কঠিন কাজ কিছু নয়; যদি একপক্ষ যথেষ্ট অসৎ আর অপরপক্ষ প্রচণ্ডরকমের নিষ্ক্রিয় ও অনুগত হয়। এ ব্যাপারে দেশের বর্তমান অবস্থা ওপরের দুটো পথকেই মেনে নিয়েছিল।

এ শতাব্দীর প্রারম্ভে ট্রেড ইউনিয়ান মুভমেন্ট তার নিজস্ব অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে এটার সৃষ্টি তা হারিয়ে ফেলেছিল। সময়ের স্রোতে এ ট্রেড ইউনিয়ান মুভমেন্ট সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের রাজনৈতিক ছায়ায় চলে যায়; শেষ পর্যন্ত একটা শ্রেণী সংগ্রামের ব্যাপারে প্রাচীনকালে অবরুদ্ধ নগরীর দেওয়াল ভাঙার জন্য কাঠের গুঁড়ির মুখে যে লোহা বাঁধানো থাকত, এ ট্রেড ইউনিয়ান সেই লোহা বাঁধানোর পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। ওদের পুরো পরিকল্পনা ছিল অর্থনৈতিক রাজপ্রাসাদকে, যেটা অতি কষ্টে দিনের পর দিন বহু পরিশ্রমে গড়ে তোলা হয়েছিল; আঘাতের পর আঘাতে সেটাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। একবার এ উদ্দেশ্য সফল করতে পারলে সমগ্র দেশের ধ্বংস শুধু সময় অপেক্ষার ব্যাপার, কারণ তার আগেই তো দেশ অর্থনৈতিক বুনিয়াদ থেকে বঞ্চিত। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা কখনই শ্রমিকদের স্বার্থ দেখেনি। এবং দিনে দিনে এটা শূন্যের দিকে এগিয়ে চলে যতক্ষণ না পর্যন্ত ধূর্ত নেতারা উপলব্ধী করে জনতার সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে উপেক্ষা করা উচিত; কারণ যদি জনতার মধ্যে একবার আত্মসন্তুষ্টির ভাব আসে তা হলে আর কখনই এ রাজনৈতিক সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে না।

শ্ৰেণী সগ্রামের এ বিভিন্ন ভবিষ্যত, তাদের এত বেশি উদ্বিগ্ন করে তোলে যে জনতার অসন্তোষ ভবিষ্যতে হয়ত বা আর অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে না; এ ভেবে সমাজ সংস্কারের প্রাথমিক ধাপগুলো তারা শুধু প্রতিরোধই করে না, ভেঙেও দেয়। দেশের অবস্থা তখন এমনই শোচনীয় যে এ সব নেতাদের বে-আইনি কাজ করার জন্য কোনরকম অসুবিধে হয় না।

যেহেতু জনতাকে সবসময় তাদের দাবি কি করে বাড়াতে হয় সেটাই দেখানো হত, তাই তাদের সন্তুষ্টির ভাব এমন দিশেহারা হয়ে যায় যে যেরকম উন্নতির ব্যবস্থাই করা হোক না কেন, তাদের কাছে তার কোন মূল্যই থাকে না। সুতরাং এটা তখন শ্রমিক শ্ৰেণীকে বোঝানো অসম্ভব ছিল না যে এ ধরনের হাস্যাস্পদ ব্যবস্থা হল তাদের সংগ্রাম শক্তিকে ভেঙে দেওয়ার পৈশাচিক পথ; শুধু তাই নয় তাদের সংগ্রামের ক্ষমতাও ভেঙে দেওয়া এর উদ্দেশ্য। যাদের বোঝবার ক্ষমতা আছে যে সাধারণ মানুষের চিন্তাশক্তি কতটুকু, তারা এ পথের সাফল্যে আশ্চর্য হবে না।

মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের এ কলাকৌশলগুলোর প্রতি বরাবরই এক ঘৃণা মিশ্রিত ক্রোধ ছিল। কিন্তু তাদের তরফ থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার জন্য কোন সংগঠন করারই চেষ্টা করা হয়নি। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিকদের বরাবরই একটা ভয় ছিল যে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা ভাল হলেই বুর্জুয়া সম্প্রদায়ে যোগ দেবে; সুতরাং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের হাত থেকে শ্রেণী সংগ্রামে সবচেয়ে বড় অস্ত্রটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটেনি।

বিপক্ষদের আক্রমণ করার চেয়ে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নিজেরাই ওদের চাপ এবং ভয় প্রদর্শন মেনে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় এমন একটা পথ বেছে নেয় যা এত মন্থর এবং ভোতা, ফলে অচিরে সেটাকে বর্জন করতে বাধ্য হয়। সুতরাং সমস্ত অবস্থাটাই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে যেখানে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ব্যাপারটাতে মাথা গলাবার পূর্বে ছিল; কিন্তু ততদিনে জনসাধারণের অসন্তোষ চরমে উঠেছে।

বিদ্যুৎ ঝড়ের মত মুক্ত ট্রেড ইউনিয়ান রাজনৈতিক দিগন্তে এবং ব্যক্তিগত জীবনের ওপর চক্র কেটে বেড়ায়। জাতীয় অর্থনীতির অনিশ্চয়তা এবং পরনির্ভরতা হল দেশের এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক চরম বিপজ্জনক ব্যাপার। সর্বোপরি এ মুক্ত ট্রেড ইউনিয়ান গণতন্ত্রকে শুধু হাস্যাস্পদ করে তোলেনি, ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়াও বাঁধিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতাকে কলংকিত করে ধ্বনি তুলেছে— তোমরা যদি আমাদের সঙ্গে হাত না মিলাও আমরা তোমাদের মস্তিষ্ক চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেব।

সেই সময়ে আমি মানবত্বের সত্যিকারের বন্ধুকে চিনতে পারি। দিনে দিনে আমার জ্ঞান যেমন বিস্তৃত হয়, তেমনি গভীরতাও বাড়ে; তবু অন্তত এ বিষয়ে আমার মত পরিবর্তনের কোন কারণ খুঁজে পাই না।

যতই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির বাইরের রূপের সঙ্গে পরিচিত হই, তত বেশি এ মতবাদটার অন্তর প্রকৃতি দেখার জন্য আমার তৃষ্ণা বেড়ে ওঠে।

এ তৃষ্ণা নিবারণের উপায় পার্টির প্রচার পুত্রের মাধ্যমে ছিল না। কারণ ওদের অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলোর সঙ্গে যে বিবৃতি থাকত তা মিথ্যা এবং অগভীর। ওদের রাজনৈতিক লক্ষ্য বলতে কিছু ছিল না। উপরন্তু যুক্তিতর্ক উপস্থাপনায় ওরা যে আধুনিক ছল চাতুরীর আশ্রয় নিত তা ছিল আমার কাছে চরম অপ্রীতিকর। ওদের বড় বড় কথা শুধু শূন্যগর্ভ এবং ধারণাতীত বাক্যে ভরা। হঠাৎ পড়লে মনে হয় এগুলো মহৎ চিন্তার ফসল; কিন্তু এগুলো ছিল সত্যিকারের চিন্তা-শূন্যতায় ভরা এবং অনর্থক কতগুলো শব্দের সমষ্টি। আজকের এ আধুনিক সমাজে যে কোন লোক নিজেকে ক্ষয়িত বলে মনে করে, কারণ এ শহরে জীবনের বিচিত্র গোলকধাঁধা তাদের মনকে বিপথগামী করে তোলে। সেজন্য হয়ত বা এ দুর্গন্ধময় ধোঁয়ার মধ্যে সে তার স্বাধীনতার নামে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার গন্ধ পায়। এ লেখকগুলো আমাদের জনগণের এক অংশের যে সুবিদিত লাঞ্ছনা সেইগুলোকে শুধু দেখে; আর তা দেখেই বিশ্বাস করে যে ব্যক্তিকে ধারণায় আনা যায় না, সে নিশ্চয়ই অত্যন্ত জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান।

এ মতবাদের তত্ত্বের দিক দিয়ে মিথ্যা উক্তি এবং অবাস্তবতা, এর বাইরের অভিব্যক্তির মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি ক্রমে ক্রমে এর শেষ লক্ষ্য কি সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারি।

এ মুহূর্তগুলোতে আমি সেই ভবিষ্যতের অন্ধকার প্রতিচ্ছবি এবং অমঙ্গলের পূর্বাভাস যেন দেখতে পাই। আমার যে শিক্ষা, সেই শিক্ষার ইন্ধন জুগিয়েছে অহমিকা আর ঘৃণা যেটা গাণিতিক ছকে ফেলে হিসেব করলে সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সে সাফল্য হবে মানবত্বের ওপরে প্রচণ্ড এক মুষ্ঠাঘাত।

ইতিমধ্যে এ ধ্বংসমূলক শিক্ষা এবং সত্যিকারের জনসাধারণের চরিত্র, যেটা এতদিন পর্যন্ত আমার কাছে অজ্ঞাত ছিল স্পষ্ট বুঝতে পারি।

ইহুদীদের সম্পর্কে অজ্ঞানতা হল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির প্রকৃত চরিত্র এবং সত্যিকারের লক্ষ্য বোঝার চাবিকাঠি। যে লোক এ জাতটার সম্পর্কে তার দৃষ্টির সামনের কুয়াশা সরিয়ে দিতে পেরেছে, তার পক্ষে এ পার্টির অর্থ এবং লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে বোঝা সম্ভব; এবং তারপর এ অন্ধকার তথাকথিত সামাজিক উন্নতির কুয়াশা সরিয়ে সে মার্কসীয় মতবাদের নিকট আসল রূপ দেখতে পারে।

আজকে আমার পক্ষে বলা অত্যন্ত কষ্টকর, প্রায় অসম্ভব যে কখন ‘ইহুদী’ শব্দটা আমার মনে বিশেষ এক চিন্তাধারার উদয় করেছিল। আমি ঠিক স্মরণে আনতে পারি না, পিতার জীবিতকালে বাড়িতে থাকাকালীন এ শব্দটা আমি শুনেছি কিনা। যদি এ শব্দটা কোন অপমানকর ভাষায় ব্যবহার করা হত তাহলে সেই বৃদ্ধ লোকটি ভাবত যে এটা একমাত্র অশিক্ষার ফল। কারণ তার চাকরি জীবনে এত বেশি এবং বিভিন্ন ধরনের লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করেছে যে তাকে জাতীয় সংস্কারমুক্ত বলা চলে। যদিও তার জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রখর ছিল, এবং তার সেই প্রভাব আমার ওপরেও ভালভাবে বর্তেছিল। স্কুল জীবনেও আমি আমার এ ধারণার পরিবর্তনের কোন কারণ খুঁজে পাইনি; যেটা আমার মনের মধ্যে বাড়িতে থাকাকালীন বেড়ে উঠেছিল।

মাধ্যমিক স্কুলে আমার সাথে একটা ইহুদী ছেলে পড়াশুনা করত যার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালই ছিল। কিন্তু তার মৌন ভাব এবং কয়েকটা ব্যাপারে আমরা সর্বদা সতর্ক থাকতাম। এছাড়া আমি এবং আমার বন্ধুদের ওর সম্পর্কে অন্য কোন রকম ধারণা ছিল না।

চৌদ্দ পনের বছর বয়সে আমি ‘ইহুদী’ শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হই রাজনৈতিক প্রতিবেদনের সম্পর্কে। এসময়ে আমার মনে ইহুদী সম্পর্কে একটা বিরূপ ভাব জাগে। সত্যি বলতে কি মনের এ অবস্থা আমি সব সময়ে আয়ত্তে রাখতে পারিনি। বিশেষ করে ধর্মের সম্পর্কে সংঘর্ষের ব্যাপারগুলোতে। কিন্তু এছাড়া ইহুদীদের সম্পর্কে অন্য কোন বিরূপ ধারণা আমার মনে সে সময় ছিল না।

লিনৎস শহরে ইহুদীদের সংখ্যা অত্যন্ত কম ছিল। শতাব্দী ধরে এসব ইহুদী সেখানে বসবাস করার ফলে বাইরে থেকে দেখতে ইউরোপের আর পাঁচজন অধিবাসীর মতই লাগত এবং বলতে দ্বিধা নেই আমি অন্যান্যদের মত তাদেরও জার্মান বলেই ভাবতাম। এর কারণ হল মানুষ হিসেবে তাদের বাইরের চেহারায় অন্য কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনি। একমাত্র ধর্মীয় ব্যাপারগুলোয় তাদের অদ্ভুত আচরণ ছাড়া। আমার তখন ধারণা ছিল যে তাদের ধর্ম-বিশ্বাসের জন্য অন্যেরা তাদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং আমারও তাদের প্রতি তীব্র একটা ঘৃণা বোধ জেগে ওঠে। তখন পর্যন্ত আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না যে ইহুদীদের সম্পর্কে একটা বিদ্বেষের ভাব দেশ জুড়ে ফলু ধারার মত চলে আসছে। এরপরে আমি ভিয়েনায় চলে আসি।

জনসাধারণের চিন্তাধারায় আমি বিভ্রান্ত হই যখন আমি স্থাপত্যকর্মে নিযুক্ত। তখন অবশ্য নিজের বিপদের জন্যও আমি হতাশাগ্রস্ত। প্রথমে বুঝতে পারিনি সে শহুরে জনজীবন কতগুলো বিভিন্ন সামাজিক স্তরে গঠিত। যদিও তখন ভিয়েনার অধিবাসীর সংখ্যা কুড়ি লক্ষ, কিন্তু ইহুদীদের সংখ্যা মাত্র লাখ দুয়েক। সেই জন্যই ব্যাপারটা আমার নজরে আসেনি। সেই প্রবাস জীবনে প্রথম কয়েক সপ্তাহ আমার মনে এবং চোখে নতুন ধারণা ও চিন্তাধারার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি। যখন আমি ধীরে ধীরে আমার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিলাম, তখন চোখের সামনে এ গোলমেলে ছবিগুলো এক এক করে আমার সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল; আমি আমার নতুন জগতটা সম্পর্কে অবিসাংবাদিত ধারণা নিতে সক্ষম হই ও ইহুদী সমস্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।

আমি বলতে চাই না যে প্রথমে আমি যেভাবে এ সমস্যাটার সঙ্গে পরিচিত হই, তা খুব একটা অপ্রীতিকর ছিল। ইহুদীদের সম্পর্কে তখন আমার ধারণা যে ওরা অন্যধর্মী, সুতরাং মানবত্বের খাতিরে অন্যধর্মী বলে তাদের আক্রমণ করার বিপক্ষে আমি ছিলাম। এবং ইহুদী বিরুদ্ধ যে সংবাদপত্রগুলো ভিয়েনাতে প্রচলিত ছিল তাদের সংস্কৃতির প্রতি আমার সন্দেহ ছিল। মধ্যযুগে যে বিশেষ কতগুলো ঘটনা ঘটে গিয়েছিল সেগুলোও আমার স্মৃতিতে ছিল এবং আমি চাইতাম যে এগুলোর পুনরাবৃত্তি আর যেন না হয়। বিশেষ করে বলতে গেলে এ ইহুদী বিরুদ্ধ পত্রিকাগুলো মোটেই প্রথম শ্রেণীর ছিল না। কিন্তু আমি তখন এর কারণটা বুঝতে পারিনি এবং ভেবেছি ঈর্ষার ফল, যার মধ্যে এতটুকুও সপ্রচেষ্টা নেই।

আমার নিজস্ব অভিমত আমি গাম্ভীর্যের সঙ্গে পর্যালোচনা করতেই অভ্যস্ত ছিলাম; যে কারণে প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রগুলো হয় তার উত্তর দিত, নয় সেগুলো পাশ কাটিয়ে যেত। ভবিষ্যতে আমি বুঝতে পেরেছি যে এটাই হল সবচেয়ে সম্মানজনক পথ।

যে পত্রিকাগুলোকে পৃথিবীর মুখপাত্র বলা হয়, যেমন নয়ি প্রেসে, ভিনার টাগেরাটে ইত্যাদি পড়তাম। আশ্চর্য হয়ে যেতাম এরা কত বেশি পরিমাণে এদের পাঠকদের জন্য সংবাদ পরিবেশনা করে। তার চেয়ে বড় কথা কোন একটা বিশেষ সমস্যাকে এরা নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে থাকে। তাদের অভিজাত ভঙ্গিতে লেখা আমার ভাল লাগত। তবে কখনো কখনো এ প্রচণ্ড রকমের স্টাইল সর্বস্ব সাংবাদিকতা আমার পছন্দ হত না। কিন্তু সারা পৃথিবীর প্রধান প্রধান শহরগুলোর সংবাদ রাখতে আমি ভালবাসতাম।

আমার ধারণায় ভিয়েনাও পৃথিবীর প্রধান নগরীগুলোর অন্যতম; সে কারণেই ভিয়েনার সংবাদের স্বল্পতা সম্পর্কে কোন নালিশ করা চলে না। কিন্তু ভিয়েনা প্রেসের রাজবংশীয়দের প্রতি এ চাকরের মত আনুগত্য আমাকে বিরক্ত করত। যদি হাববুর্গের প্রতি কোন আক্রমণ করা হত, সেটা যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে পাঠকদের কাছে হাজির করা হত না। এটা পৃথিবীর অন্যতম চালাক একজন রাজার প্রতি প্রচেষ্টা, তখন গৌরবের সঙ্গে তুলে না ধরাটা আমি বোকামী বলেই মনে করতাম। এগুলো যেন আমাকে স্মরণ করিয়ে দিত বনমোরগ তার সঙ্গিনীকে চিন্তার সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে হঠাৎ পালিয়েছে। আমি ভাবতাম এ চালাকি আর কিছুই নয়, ঢিলে গণতন্ত্রের আদর্শের ওপর রঙ করা মতবাদ মাত্র। এটা হল কতগুলো অপদার্থ লোকের আনুকূল্য কুড়াবার অপচেষ্টা। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভাবতাম এ ধরনের সংবাদ ভিয়েনার সংবাদপত্রগুলোর সুনামের কলঙ্ক বিশেষ।

ভিয়েনায় থাকাকালীন রাজনীতি বা সংস্কৃতি যে কোন ব্যাপারেই হোক জার্মানিতে যা ঘটত তার প্রতি নজর রাখতাম। এবং বলতে আপত্তি নেই নিজেকে গর্বিত মনে হত যখন ভাবতাম কী ভাবে অস্ট্রীয়াকে অস্বীকার করে নতুন সাম্রাজ্যের অভ্যুদয় হল। সে সাম্রাজ্যের বৈদেশিক নীতি রীতিমত প্রশংসার যোগ্য, যদিও আভ্যন্তরিক নীতি ততটা নয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় উইলহেলমের বিরুদ্ধে প্রচারটাকে কোন মতেই আমি মেনে নিতে পারিনি। কারণ আমার চোখে দ্বিতীয় উইলহেলম্ শুধু একজন জার্মান সাম্রাজ্যের অধীশ্বরই নন, জার্মান নৌ-বাহিনীরও স্রষ্টা। বিশেষ করে রাইখষ্টাগে তাকে বক্তৃতা দিতে না দেওয়ায় আমি ক্রুদ্ধ হই। কারণ যারা তাকে বক্তৃতা দিতে দেয় না তাদের সে ক্ষমতাই নেই। পার্লামেন্টের এক অধিবেশনে তথাকথিত রাজহংসগুলো অনেক বেশি প্যাক প্যাক করে যা পুরো রাজবংশীয়দের এমন কি দুর্বলতম রাজার সময়েও পুরো শতাব্দী ধরে এর চেয়ে অনেক কম কাজ হয়েছে।

যখন ভাবি একটা ব্যক্তির মধ্যে আধা বুদ্ধিসম্পন্ন কোন জাতির বিধানকর্তা হিসেবে রাইখষ্টাগের সমালোচনা করার অধিকার রাখে ও জনতাকে লেলিয়ে দেয় এবং তার দ্বারা রাজমুকুটকে কঠোর ভৎসনা জনতার কাছ থেকে শুনতে হয়, তখন এসব নির্বোধ বিধান সভার সভ্যগুলোর ওপরে প্রচণ্ড রকমের রেগে যাই।

সবচেয়ে বিরক্তিকর যখন দেখি ভিয়েনা প্রেস রোজই গিরগিটির মত ভোল পাল্টায়। হাসবুর্গ রাজপ্রাসাদের গাড়ি টানার ঘোড়াগুলোর লেজ ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিয়েনা প্রেসেরও মত বদলায়। সাথে সাথে এ প্রেস ভিয়েনার জনতার মধ্যে জার্মান সাম্রাজ্য সম্পর্কেও একটা শত্রুতার আতংক জাগিয়ে তোলার প্রয়াস করে। কিন্তু আমার মতে সেই শক্রতা দৈন্যবেশে সাজানো। সঙ্গে সঙ্গে এও আবার জানায় যে জার্মানির আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনরকম ইচ্ছেই নেই। ইশ্বরের দোহাই, তারা এরকম ভাণ করে যে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তারা বিশেষ বন্ধুরই কাজ করেছে। এবং দুই দেশের বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য এটা হল সাংবাদিকসুলভ সততা; এ কথার আড়ালে তারা একটা বিষাক্ত ক্ষতে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে আর বিষাক্ত করে তোলে।

এ ধরনের ব্যাপারগুলো আমার রক্তকে যেন টগবগিয়ে ফোঁটাচ্ছে।

একথা অস্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে এ বিষয়ে ইহুদী বিরোধী পত্রিকা দ্য ডয়েচে ভল্কসূব্ল্যাটের বক্তব্য অনেক বেশি পরিষ্কার এবং সুন্দর।

বড় বড় নামী পত্রিকাগুলো যেভাবে ফ্রান্সের জয়গানে মুখর, ভাবলেও আমার শিরায় শিরায় রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে ওঠে। একজন জার্মান হিসেবে তথাকথিত মহৎ সংস্কৃতি সম্পন্ন একটা জাতির শ্রুতিমধুর জয়গানে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায়। এ নষ্টামী ভরা জয়গানের জন্যই একাধিক বার এ বিখ্যাত পত্রিকাগুলো আমি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। সেই কারণেই আমি বর্তমানে একমাত্র ভল্টকব্লাটের পত্রিকাটা পড়ি। মাপে ছোট হলেও এসব বিষয়ে পত্রিকাটার লেখা বেশ পরিচ্ছন্ন। যদিও ওদের চড়া ইহুদী বিদ্বেষী সুর আমার মনের সঙ্গে মিলত না; তবু ওদের যুক্তি আমাকে বারে বারে ভাবিয়ে তুলত।

যাহোক, এসব পড়াশোনার জন্যই আমি ভিয়েনার সেই বিশেষ মানুষটা, সংগ্রামটাকে, এবং ভিয়েনার ভবিষ্যত বুঝতে পারি। মানুষটা হল ডক্টর কার্ল লয়েগার আর তার সংগ্রামের নাম হল ক্রিশ্চান সোশ্যালিস্ট মুভমেন্ট। যখন প্রথম ভিয়েনায় আসি, তখন কিন্তু উভয়েরই বিরোধিতা করেছিলাম। মানুষটা এবং তার সংগ্রাম সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল–এরা উভয়েই প্রতিক্রিয়াশীল।

এমন কি ডক্টর লয়েগার এবং তার কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করার পরেই আমার অভিমত আমি বদলে ফেলি। ধীরে ধীরে সেটা প্রশংসায় রূপান্তরিত হয়; কারণ তখন আমি বিচার করতে সক্ষম। শুধু সেদিনই নয়, আজকে পর্যন্ত আমি ডক্টর কার্ল লয়েগারকে শ্রেষ্ঠ জার্মান মেয়র বা নগরপালের সঙ্গে তুলনা করি। এবং ক্রিশ্চান সোশ্যালিস্ট মুভমেন্টের প্রতি আমার এ মানসিক পরিবর্তন আমাকে অনেক কুসংস্কারকে ঝেড়ে ফেলে দিতে সাহায্য করেছে।

আমার ইহুদী বিদ্বেষী মনোভাবের পরিবর্তন হয়, তবে সহজে নয়। বরং কষ্ট করেই এ মতবাদের পরিবর্তন করতে হয় আমাকে। সত্যি বলতে কি তার জন্য আমাকে মানসিক অনেক সংঘাত সহ্য করতে হয়েছে। এবং এ সংঘর্ষ হল ভাবালুতার সঙ্গে বাস্তবতার। শেষ পর্যন্ত বাস্তবই জয়ী হয়েছে সেই মানসিক টানাপোড়েনের সংঘাতে।

বছর দুই বাস্তবতার কাছে ভাবালুতা ছিন্নভিন্ন হয়ে পলায়ন করে এবং বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিই অভিভাবক ও আমার মনোজগতের পরিচালক হয়ে বসে।

সেই তিক্ত মানসিক সংঘর্ষের দিনগুলোতে যখন ভাবালুতার আর বাস্তবতার টানাপোড়েনিতে দিনগুলো পাড়ি দিচ্ছি, তখন ভিয়েনার রাস্তায় প্রত্যক্ষ কতগুলো শিক্ষা আমার আমূল পরিবর্তনে সাহায্য করে। এমন একটা সময় আসে যখন আমি আর আগের মত অন্ধের ন্যায় রাস্তাঘাটে চলাফেরা করি না; বরং চোখ কান এমনভাবে খুলে রাখি যাতে শুধু বাড়িঘরই নয়, মানুষগুলোকেও পর্যবেক্ষণ করতে পারি।

একদিন শহরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, আজানুলম্বিত কালো রঙের কোট পরা একজনের মুখোমুখি হই, প্রথমেই ভাবি : এ কি একজন ইহুদী? কিন্তু লিনৎসে তো এ ধরনের চেহারা আগে দেখিনি। আমি গোপনে সতর্কতার সঙ্গে লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করি। সেই বিদেশী চেহারাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় মনে হয় এ জার্মান নয় তো?

আমার বরাবরের অভ্যাসের মত আমি এর সমাধানে বইপত্র হাতড়াতে শুরু করি। এ প্রথম জীবনে অনেক কটা পয়সার বিনিময়ে ইহুদী বিদ্বেষী প্রচারপত্রও কিনে ফেলি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রচারপত্রগুলোয় কিছুই পাইনি। কারণ এগুলো লেখা হয়েছে এভাবে–যে পাঠকদের ইহুদী সম্পর্কে জ্ঞান আগে থেকেই রয়েছে বা ইহুদীদের সঙ্গে এরা বিশেষভাবে পরিচিত। উপরন্তু প্রচারপত্রগুলোর ঢংটাই এরকম যে সেগুলো শুধু ভাসা ভাসা তাই নয়; অবৈজ্ঞানিক মতবাদেও ভর্তি। কয়েকটা সপ্তাহ এবং মাসের পর আমি আমার পুরনো চিন্তার রাজ্যে ফিরে আসি। কিন্তু বিষয়বস্তুটা এত বিস্তৃত এবং পরস্পর বিরোধী যে আবার মনে দ্বিধা আসে হয়ত বা বিষয়বস্তুটার প্রতি সঠিক মর্যাদা দেওয়া হবে না।

স্বভাবতই জার্মানদের কথা নয়, যারা হয়ত বা অন্য ধর্মের, কিন্তু ওরা হল সম্পূর্ণ অন্য জাতের এবং ধাতের লোক। যখনই আমি ইহুদীদের সম্পর্কে আরো বেশি খোঁজখবর নিয়ে ওদের পর্যবেক্ষণ শুরু করি, পুরো ভিয়েনাটা যেন আমার চোখের সামনে অন্য আলোতে ধরা দেয়। যত দেখি তত যেন তারা সাধারণ নাগরিকের থেকে আলাদা হওয়ায় আমার মনকে আকর্ষণ করে। বিশেষ করে শহরের অভ্যন্তর ভাগ এবং দানিয়ুব ক্যানেলের উত্তর দিকটা এ পতঙ্গের পালে অধ্যুষিত, যাদের সঙ্গে জার্মানদের বিন্দুমাত্র মিল নেই।

কিন্তু তবু আমার মনের মধ্যে যেটুকু দ্বিধার ভাব ছিল, ইহুদীদের একটা দলের কার্যকলাপে সে দ্বিধাটুকুও অল্প কয়েকদিনের মধ্যে উবে যায়। জিয়ানিজ নামে একটা বড় ধরনের বিপ্লব ওদের মধ্যে শুরু হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল জুডাইজম বা ইহুদী ধর্ম সম্পর্কে পরিষ্কার বক্তব্য রাখা; এবং ভিয়েনার শাসককুলের কাছে নিজেদের বক্তব্য জোরদার করে তুলে ধরা।

বাইরে থেকে হঠাৎ মনে হবে যে ইহুদীদের একটা দলই বোধহয় এ সগ্রাম এগিয়ে নিয়ে চলেছে, অপরদিকে বেশিরভাগ ইহুদীই এর বিপক্ষে, তাই একে বর্জন করেছে। কিন্তু অত্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারি যে এ আচরণ পুরো ব্যাপারটাকেই ধোঁকা দেবার জন্য। এবং তা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। তার ওপর তত্ত্বটাকে এমনভাবে রূপ দেওয়া হয়েছে, যার প্রয়োজন ছিল। সম্ভবত সমস্ত ব্যাপারটা থেকেই সাধারণ জনমানসকে প্রতারণা করার জন্য। ইহুদীদের যে অংশটা নিজেদের উদারতা দেখিয়ে জিয়োনিস্টদের সংগ্রামে অংশ নিত না, কিন্তু ভাই হিসেবে তারা প্রকাশ্যে তাদের সমর্থন করত। সত্যি বলতে কি নিজেদের ধর্মের ওরা তাতে ক্ষতিই বেশি করত।

তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়ায় নিজেদের মধ্যে কোন দ্বন্দু ছিল না। উদার ইহুদী এবং জিয়োনিষ্টদের মধ্যে লোক দেখানো ওপর ওপর ঝগড়া আমাকে বিরক্ত করে তুলেছিল। কারণ এ ধরনের মনোবৃত্তি শুধু নৈতিক প্রবৃত্তিগুলোকেই নিচু করে না, একটা জাতির চরিত্রেও কলঙ্ক লেপন করে।

পরিষ্কার ও ছিমছাম, তা সে নৈতিক বা যে কোন বিষয়েই হোক, তার নিজস্ব একটা রূপ সাধারণ মানুষের কাছে আছে। যেটা জলের প্রতিবিম্বে মুখ দেখার মত। অবশ্য যদি তারা তা দেখে। ওদের পোশাক পরিচ্ছদে বিশ্রী গন্ধ আমাকে অসুস্থ করে তুলত। তাছাড়া ওদের এলোমেলো জামাকাপড় পরা দেখে নিচু স্তরের বিদেশী বলে মনে হত।

এ বিস্তারিত বর্ণনা কাররই ভাল লাগার কথা নয়; কিন্তু সত্যি কথাগুলোর মাধ্যমে একটা বিদেশী অপরিষ্কার জাতির সাংস্কৃতিক কয়েকটা দিকে কিছু ইহুদীর কার্যকলাপের রহস্যময়তা আমার কাছে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়। আমিও তার গভীরে প্রবেশ করি। এটা জীবনের সংস্কৃতির এমন একটা দিক যেখানে একটা ইহুদীও ছিল না যে তার নোংরা হাতের স্পর্শ রাখেনি। সেই ঘায়ের উপর ছুরি চালালেই যে কোন লোক মুহূর্তে আবিষ্কার করবে যে সেই পচনশীল দেহটায় পোকা কিলবিল করছে; আর হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে প্রায় সব ইহুদীই তখন অন্ধ।

আমার অভিযোগের পরিমাণও বাড়তে থাকে যখন দেখি সাংবাদিকতায়, সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে আর নাটকে ওদের কার্যকলাপের বহর। উচ্চ নিনাদিত বিজ্ঞাপনগুলোয় খালি রঙচঙেরই মোড়ক। কেউ যদি সেই বিজ্ঞাপনগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে তবে দেখতে পাবে লেখক হিসেবে যার নাম বিশেষভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, সে একজন গোঁড়া ইহুদী। এভাবেই একটা সংক্রামক ব্যাধি ধীরে ধীরে জনসাধারণের ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাচীনকালের কালো প্লেগের থেকেও এ রোগ অনেক বেশি তীব্র। বিশেষ করে যে ভীষণ পরিমাণে এতে বিষ মিশিয়ে জনসাধারণের কাছে পরিবেশন করা হত। স্বভাবতই যে লেখক যত নিচুমানের এবং চালক, তত বেশি তার জনপ্রিয়তা। এক এক সময় সেটার পরিমাণ এত বেশি হয়ে দাঁড়াত যে মনে হত কেউ যেন নর্দমার ময়লা জল পাম্পের সাহায্যে সমস্ত জাতির মুখে ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, এ ধরনের নোংরা লোকের ঘাটতি ছিল না। একজন গ্যেটের সৃষ্টির পেছনে অন্তত দশ হাজার এ ধরনের লুণ্ঠনকারি প্রকৃতি নিজেই নিয়ে আসে, যারা হল ভয়াবহ বীজাণুবাহক এবং মানুষের আত্মাকে বিষাক্ত করাই যাদের প্রধান কাজ। যদিও কথাটা চিন্তা করতে গা শিউরে ওঠে, তবু তা অস্বীকার করা যায় না যে বেশিরভাগ ইহুদীদের কাজই ছিল এটা; এবং তারা পুরোপুরি এ নিচু কাজেই নিজেদের পরিপূর্ণভাবে নিয়োগ করেছিল। এজন্যই কি ওদের সমাজের ওপরের স্তরের লোক বলা যায়।

এ নোংরা লোকগুলো সম্পর্কে আমি আরো বেশি খোঁজখবর নিতে শুরু করি। ফলে আরো বেশি তীব্র ইহুদী বিদ্বেষ আমার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। যদি আমার মনোবৃত্তি ওদের বিরুদ্ধে এক হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে, তবে সেই বৃদ্ধি পাওয়ার কারণগুলো খুঁজে বের করতে আমি সমর্থ।

সত্যিকারের ব্যাপারটা হল দশ ভাগের নয় ভাগ অশ্লীল সাহিত্য, নোংরা শিল্প এবং নাটকে বেলেল্লাপনা যারা চুটিয়ে করছে, তারা সমগ্র জনসাধারণের এক অংশ-ও নয়, এটাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। যা সত্যি তাকে তো স্বীকার করে নিতেই হবে। এরপর মনের মধ্যে গেঁথে যাওয়া ভাবটা নিয়েই ওয়ার্ল্ড প্রেস খুঁটিয়ে পড়তে শুরু করি।

সংবাদপত্রটার ভেতরে যত বেশি ঢুকতে থাকি তত বেশি সংবাদপত্রটার সততা সম্পর্কে শ্রদ্ধা হারাই। নিজেরই আশ্চর্য লাগে কী করে এ অসৎ সাংবাদিকতার প্রতি এতদিন শ্রদ্ধা পোষণ করে এসেছি। ক্রমে ক্রমে সংবাদপত্রটির প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে যায়; এদের পুরো ধ্যান-ধারণাটাই ভাসা ভাসা এবং অলীক। শুধু তাই নয় সত্য ঘটনাগুলোও এমনভাবে সাজানো যে তাতেই সত্যের থেকে মিথ্যাই বেশি পরিবেশিত। লেখকেরা হল,–ইহুদী।

হাজার হাজার ঘটনা যেগুলোয় আগে মনোযোগ দিয়েছি, এখন দেখি সেগুলোর কোন গুরুত্বই নেই। পুরো ব্যাপারটাই আমার সামনে অন্য আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, যার মর্মার্থ এর আগে আমি বুঝে উঠতে পারিনি।

সাংবাদিকতার এ উদারতা আমার চোখে অন্য আলোতে পুরো ব্যাপারটা ধরা দেয়। প্রতিপক্ষকে আক্রমণের জন্য ওরা গাম্ভীর্যপুর্ণ স্বর ব্যবহার করে,–কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে ওদের সম্পূর্ণ নীরবতায় আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি যে ওরা কত ধূর্ত এবং কী পরিমাণে ঘৃণ্যভাবে পাঠককে ঠকিয়ে চলেছে। সুন্দর সুন্দর প্রবন্ধের মাধ্যমে ইহুদী লেখকদের প্রশংসা এবং জার্মান লেখকদের প্রতি বিরূপ সমালোচনা যেন ওদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। তার সঙ্গে দ্বিতীয় উইলহেলকে আলত খোঁচা মারাও ওদের বাঁধাধরা মৌলিক নীতি, যেমন অপরদিকে ফ্রান্সের সংস্কৃতি এবং সভ্যতাকে ক্রমাগত পিঠ চাপড়ানো। প্রবন্ধের বেশিরভাগ বিষয়বস্তুই বস্তাপচা ও বিকৃত যৌন প্রসঙ্গে ভর্তি। বিশেষ করে সংবাদ পরিবেশনের পুরো ভাষার ধাচটাই বিদেশী ঢঙে পরিবেশিত। মোদ্দা কথা, খোলাখুলি জার্মানদের নির্লজ্জভাবে নিচু করার অপচেষ্টা।

কোন্ স্বার্থে ভিয়েনা প্রেস এ নীতি নিয়েছিল? হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই কি? এর সদুত্তরগুলো খুঁজে বের করতে গিয়ে ক্রমেই আমার মন আরো বেশি সন্দিদ্ধ হয়ে পড়ে।

এমনকি সমাজের বুকে গণিকা বৃত্তিতেও ইহুদীরাই সবচেয়ে বড় অংশ নিয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপীয় যে কোন শহরের চেয়ে এ শহরে তা অনেক বেশি স্পষ্ট। তবে দক্ষিণ ফ্রান্সের কয়েকটা বন্দর শহর ছাড়া। লিওপোল্ডস্টাড় শহরে রাতের বেলা রাস্তায় চলাফেরা করাই মুস্কিল। রাস্তাঘাটের প্রতিটি বাঁকে হঠাৎ যে রঙ মাখা মুখের দেখা পাওয়া যায়— যুদ্ধের পূর্বে এ জনপদবধূদের সঙ্গে জার্মানদের পরিচয়ই ছিল না। শুধু জার্মান সৈন্যরা ওদের মুখোমুখি হত ইষ্টার্ন ফ্রন্টে।

এ সত্যটার প্রথম আবিষ্কারে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠাণ্ডা হিম-শিতল স্রোত যেন ছুটে নামে; এ সেই ঠাণ্ডা মাথার গণ্ডারের চর্মধারী, নির্লজ্জ ইহুদীর দল যারা চরম ঘৃণ্য কৌশলে এ বিশাল শহরের তলানীদের বিদ্রোহের চেষ্টাকে অহরহ প্রতারণা করে চলেছে। এ সত্য আবিষ্কারের পর সেই প্রেতাত্মাগুলোর ওপর আমি জ্বলে উঠি।

এবার আর মনে কোন দ্বিধা থাকে না যে করেই হোক ইহুদীদের দ্বারা সুসংগঠিত সমস্যাগুলো:জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতেই হবে। না, একাজে কিছুতেই পেছ পা হলে চলবে না। কিন্তু ততদিনে শিখে গেছি জীবনের শিক্ষা সংস্কৃতি বলতে গেলে সবক্ষেত্রেই ওদের অভিব্যক্তির সত্যিকারের অর্থটা খুঁজে বার করা। এবং বুঝতে পারি ইহুদীরাই হল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির তাবড় নেতা। এ সত্যটা চোখের সামনের পর্দাটা তুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরকার এতদিনের মানসিক দ্বন্দটারও পরিসমাপ্তি ঘটে।

আমি আমার সহকর্মিদের মধ্যে দেখতাম কত সহজে এবং অহরহ একই ব্যাপারে তারা তাদের মত পরিবর্তন করে। কখনো কখনো তাদের এ পরিবর্তন ঘটতে সময় লাগে কয়েকটা দিন। কখনো বা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাদের মতামত পরিবর্তিত হয়। বিশেষ করে একটা ব্যাপার তো আমার মাথাতে কিছুতেই ঢুকত না যে একজন ব্যক্তি একক হিসেবে যুক্তিতর্কের জাল সুন্দর বিস্তার করে; কিন্তু সেই ব্যক্তিই যখন জনতার মুখোমুখি হয়, পুরো বিষয়টাই সে গুলিয়ে ফেলে এলোমেলো করে দেয়। আর এ ব্যাপারটাই লোকটাকে হতাশার সমুদ্রে নিমজ্জিত করে। আমি ঘন্টার পর ঘন্টা যুক্তিতর্ক দিয়ে তাদের স্বমতে আনতে চেষ্টা করতাম। শেষে আমার সাফল্যে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়তাম। কিন্তু পরের দিনই দেখতাম পুরো ব্যাপারটাই ভস্মে ঘি ঢালা। এটা চিন্তা করলে দুঃখ পেতাম যে ব্যাপারটার ইতিমধ্যে পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে। পেণ্ডুলামের দোদুল্যমান অবস্থার মত তারা তাদের আগেকার মতামতের পর্যায়ে ফিরে গেছে।

ওদের অবস্থাটা অবশ্য আমি বুঝতে পারতাম। ও ওদের ভাগ্যকে নিয়ে সর্বদাই অসন্তুষ্ট —যেটা ওদের দৃঢ়ভাবে জীবনে আঘাত করেছে। ও ওদের মালিককে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে, বিশ্বাস করে ওদের যান্ত্রিক হৃদয়হীন শাসনই তাদের এ নিষ্ঠুর গন্তব্যে ঠেলে দিয়েছে। প্রায়ই ওরা সরকারি কর্মচারীদের প্রতি অশ্রাব্য কটুক্তি করত। ওরা ভাবত এ সরকারি কর্মচারীদের শ্রমিকদের প্রতি কোন সহানুভূতি নেই। নিত্য নৈমিত্তিক জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির জন্য লোক জড় করে সভা করত আর রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল বার করত। অবশ্য এসব ব্যাপারগুলোর পেছনে যুক্তির মাধ্যমে একটা ব্যাখ্যা দেওয়া চলত। কিন্তু যে ব্যাপারটা কিছুতেই আমার বোধগম্য হত না, সেটা হল ওদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের তীব্র ঘৃণা। নিজেদের জাতটাকেই নিন্দা করত; এর মহত্ব নিয়ে উপহাস করত। ইতিহাসের পৃষ্ঠা খুলে অতীতের পরম গৌরবমণ্ডিত মানুষগুলোকে সমালোচনার নোংরা নর্দমায় টেনে আনত।

তাদের নিকট আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি বিরূপ মনোভাব, দেশ এবং জাতির প্রতি ঘৃণায় যে অপরিমেয় ক্ষতি সাধন করেছে তা পূরণ করা অসম্ভব। এটা একটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ।

শুধু তাই নয়, এটা মানসিক এক ধরনের ব্যাধিও বটে; যেটাকে সাময়িকভাবে অর্থাৎ কয়েক মাস কয়েকদিনের জন্য সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু পরে ওদের সঙ্গে দেখা হলেই বুঝতে পারতাম যে আগে যা ভেবেছি যে ওদের মতের পরিবর্তন হয়েছে, তা সম্পূর্ণ নিল। ওরা ওদের আগেকার জায়গাতেই ফিরে গেছে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাদের সেই মানসিক পীড়া আবার নিষ্ঠুর থাবা বসিয়েছে।

আমি ক্রমেই বুঝতে পারি যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক প্রেসও ইহুদীদের করতলগত। কিন্তু অন্যান্য প্রেসগুলোর যে একই অবস্থা এটা আগে কখনো বুঝতে পারিনি। সবচেয়ে উলঙ্গ সত্য হল, একটা সংবাদপত্রও ছিল না যাতে ইহুদীরা জড়িত নয় এবং যেটাকে সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র বলা যেতে পারে। অন্ততপক্ষে এ ব্যাপারে আমার জ্ঞান এবং বিদ্যা বুদ্ধি অনুসারে আমি যা বুঝতাম।

অনেক চেষ্টার পর নিজের ভেতরের অলসতাটা ভেঙে আমি মার্কসিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত এ ধরনের প্রবন্ধগুলো পড়তে শুরু করি। কিন্তু তাতে ওদের প্রতি বিরূপতাই বাড়ে। এবং এরপরে আমি এসব লেখক আর প্রকাশকদের সম্পর্কে আরো বেশি খোঁজখবর নিতে শুরু করি।

এসব পত্রিকার প্রকাশক থেকে শুরু করে সবচেয়ে নিচু তলার কর্মী পর্যন্ত সবাই ইহুদী। মার্কসবাদী জননেতার নাম স্মরণে আসতে দেখি প্রায় সবাই এ একই সম্প্রদায়ের— রাজ পরিষদের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক সদস্যবৃন্দ থেকে শুরু করে ট্রেড ইউনিয়ানের সেক্রেটারী, পথরোধকারি, বিক্ষোভকারি, সবক্ষেত্রে এ একই সাজানো ছবি। আমার পক্ষে অস্টারলিটজু, ডেভিড, আড়লার,—এলেনবোগেন এবং অন্যান্য নামগুলো বিস্মৃত হওয়া কখনই সম্ভব নয়। একটা সত্য আমার সামনে ঝলঝল করে ওঠে; আমি যে দলটার সঙ্গে মাসাধিককাল মত বিরোধে লিপ্ত, তারা ওদেরই একটা ছোট শাখা বিশেষ। তবে শেষমেষ আমার একটা শান্তি ছিল যে ততদিনে জেনে গেছি ইহুদীরা আর যাহোক জার্মান নয়।

এবারে আমি আবিষ্কার করতে সমর্থ হই, কারা সেই প্রেতাত্মা যারা আমাদের জনসাধারণকে নিয়ত তাড়িত করে ছাইদানির দিকে নিয়ে চলেছে। ভিয়েনায় আমার বছর খানেকের প্রবাসী জীবনে বুঝতে পারি যে কোন শ্রমিকের এ বিষয়ে ধ্যান ধারণার শিকড় এত গভীর নয়। ক্রমে ক্রমে মার্কসীয় মতবাদ সম্পর্কে আমি একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠি এবং এ বিষয়ে অর্জিত জ্ঞানকে, নিজের বিশ্বাসকে দৃঢ় করার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি। বলতে আপত্তি নেই যে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃতকার্য হয়েছি। এ বিশাল জনসাধারণকে অবক্ষয়ের পথ থেকে টেনে তোলা অসম্ভব নয়; তবে তার জন্য প্রয়োজন প্রচুর সময় এবং প্রচণ্ড অধ্যাবসায়।

কিন্তু একটা ইহুদীকেও তার স্থির মতবাদ থেকে এক চুল নড়ানো সম্ভব নয়।

আমি তখন ওদের শিক্ষার অবাস্তবতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে শুরু করি। যে ছোট্ট গণ্ডিটা আমাকে ঘিরে থাকত, গলা না চেরা এবং কণ্ঠস্বর বসে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের একনাগাড়ে বুঝিয়ে যেতাম। আমি মনে করি শেষ পর্যন্ত মার্কসিস্ট মতবাদের ভয়াবহ দিকটার ছবি আমি তাদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হব। যত আমার মতামতটাকে আমি প্রতিষ্ঠা করি, তত ওদের একগুঁয়েমিটা বেড়ে ওঠে।

তর্ক করতে করতে আমি ওদের কৌশলটা বুঝে ফেলি। তর্কের প্রথম পর্যায়ে ওরা বক্তার নিবুদ্ধিতার সুযোগের ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়ে; কিন্তু যখন তর্কের জালে জড়িয়ে যুক্তির হালে আর পানি পায় না, তখন ভণিতা করে সহজে প্রতারিত হয়েছে, এমন ব্যক্তিরা যুক্তির জাল এড়িয়ে অভিনয় করে যেন বক্তার কিছুই ওরা বুঝতে পারছে না এবং প্রাণপণে চেষ্টা করে অন্যদিকে তর্কের স্রোতটাকে প্রবাহিত করার। তারা স্বতসিদ্ধ সত্যটাকে এড়িয়ে গিয়ে অন্য পথে কথাবার্তা বলে চলে। যদি এটাকে সহ্য করে নেওয়া হয়, তবে ওরা তর্কের ব্যাপারটাকে ভিন্নমুখী করে দিয়ে গোড়ার সমস্যার থেকে অন্য কোন বিষয় বস্তৃতে চলে যায়। যার সঙ্গে আগের বিষয়বস্তুর কোন সম্পর্কই নেই।

আবার যদি ওদের মূল তর্কের বিষয়ে টেনে আনার চেষ্টা করা হয়, ওরা আবার পালাবে সেই জাল থেকে। মোটকথা ওদের দিয়ে বিষয়বস্তুটার ওপরে কোন মন্তব্যই পাওয়া সম্ভব নয়। যখন কেউ শক্ত মুঠিতে এ তথাকথিত অবতারদের একজনকে পাকড়াতে চেষ্টা করে, জেলী বা আঠালো কাদার মত ঠিক আঙুলের ফাঁক দিয়ে সে গলে গিয়ে পরক্ষণেই আবার সেই কাদা বা জেলী জমে শক্ত জিনিসের অবয়ব ধরবে। যদি উপস্থিত জনতার উপস্থিতিতে বিরুদ্ধজনক পরিস্থিতিতে কারোর বিরুদ্ধপক্ষ যুক্তি স্বীকারও করে নেয়, এবং তা নিয়ে কেউ যদি ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যে যাক শেষপর্যন্ত ওদের একটা নির্দিষ্ট জমিতে দাঁড় করান গেছে, তা হলে তার পরের দিনের জন্য তার কাছে অবাক করা কিছু লুকানো থাকবে। ইহুদীরা বড়ই বিস্মৃতিপরায়ণ। অর্থাৎ কাল যা ঘটেছে তা আজ ভুলে যেতে ওরা এতই ওস্তাদ যে তারা আবার গতকালের সেই অসংগতিপূর্ণ যুক্তিটাকেই তুলে ধরবে এমনভাবে যেন গতকাল তাদের সঙ্গে কোন আলোচনাই হয়নি। তখন যদি কেউ রাগ করে তাকে গতকালের কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়,–সে এমন অবাক হওয়ার ভাণ করবে যেন তার কিছুই মনে নেই। শুধু একমাত্র তার যা স্মরণ আছে তা হল গতকাল সে তো প্রমাণই করে দিয়েছে যে তার যুক্তিগুলোই ঠিক। আমি তো এ অবস্থায় হতবুদ্ধি হয়ে যেতাম। আমাকে ঠিক কোনটা হতবুদ্ধি করে দিত,–তার বাগাড়ম্বরের প্রাচুর্য নাকি সুনিপুণভাবে মিথ্যেটাকে সত্য বলে পরিবেশন করার ভঙ্গি, তা বলতে পারব না। ক্রমে ক্রমে আমি তাদের ঘৃণা করতে শুরু করি।

তবু এসবগুলোর ভাল একটা দিক ছিল,–কারণ আমি যত বেশি এসব নেতাদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতে পারি, (নেতা না বলে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির প্রচারক বলাই ঠিক) আমার নিজের লোকেদের প্রতি তত বেশি ভালবাসা বাড়তে থাকে, ঠিক সেই অনুপাতে। ওদের এ পৈশাচিক কুশলতা যেটা এ শয়তান মন্ত্রণাসভার সভ্যগুলোর কার্যকলাপ এবং কথাবার্তায় প্রদর্শিত হত, তাতে ওদের নিকটে হতভাগ্য পরাজিতদের পরাজিত হওয়ার জন্য কোন দোষ আমি দেখি না। সত্যি বলতে কি, এ প্রাদেশিক বিশ্বাসঘাতকগুলোর সঙ্গে কোনরকম সামঞ্জস্য রেখে চলা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। সত্য বলায় বিকৃত এ মুখগুলো, যারা নিজেদের উচ্চারিত কথা পরমুহূর্তেই অস্বীকার করে, পরক্ষণেই আবার মুক্তির ধ্বজা তুলে ধরতে তর্ক প্রসঙ্গে সেটাকেই ফিরিয়ে আনে, এরকম নোংরা জীবগুলোর বিরুদ্ধে তর্ক যুদ্ধে জয়ী হওয়ার প্রস্তাবটাও নিরর্থক। অসম্ভব তো বটেই। না, যত বেশি ইহুদীদের আমি চিনতে পারি, তত সহজে আমি সেই শ্রমিকদের মতামতের জন্য তাদের ক্ষমা করি। শেষে আমার মত হল এ যে শ্রমিকদের মধ্যে নিন্দনীয় কিছু নেই। কিন্তু যারা নিজেদের আপন লোকদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর কষ্টটুকু পর্যন্ত স্বীকার করতে নারাজ, তারা জাতির পরিশ্রমী সন্তানকে বিনা দ্বিধায় অবিচার স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেছে, অপরদিকে একদল নিচুমনা লোভী এবং দুর্নীতিপরায়ণকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, যাদের কোনরকমেই ক্ষমা করা উচিত নয়।

আমি নিত্যদিনের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে মার্কসবাদীয় মতবাদের শিক্ষার উৎস মুখটা খুঁজতে আরম্ভ করি। কারণ এ মতবাদের ফলাফল আমি বিস্তারিতভাবেই জানতাম। সুতীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে এ মতবাদের নিত্য বিস্তারও আমার নজর এড়ায়নি। কারও একটু কল্পনা শক্তি থাকলেই ব্যাপারটার ভবিষ্যত ফলাফল সম্পর্কে ধারণা করে নেওয়া কোন কষ্টসাধ্য ব্যাপারই নয়। শুধু একটাই জিজ্ঞাসা— এ মতবাদের প্রতিষ্ঠাতারা কি আজকের ফলাফল তাদের ভবিষ্যত দ্রষ্টার দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিল? নাকি প্রতিষ্ঠাতারা নিজেরাই নিজেদের ভুলের জালে জড়িয়ে পড়েছে। আমার তো মনে হয় দুটোরই সম্ভাবনা আছে।

যদি দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে প্রতিটি চিন্তাশীল ব্যক্তির উচিত তখনই এ দানবকে রজ্জবদ্ধ করা, যাতে ভবিষ্যতে আরো খারাপ কিছু না করতে পারে। কিন্তু যদি প্রথম প্রশ্নটার উত্তর যা হয়, তবে এটাকে স্বীকার করে নিতেই হবে যে এ মতবাদের প্রতিষ্ঠাতারা ইচ্ছে করেই জাতির মধ্যে এক মূর্ত শয়তানকে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। একমাত্র কোন দানবীয় অস্তিত্বই, হা–মানুষের নয়; এ ধরনের কোন সংগঠনের সৃষ্টি করতে পারে যার কার্যকলাপ ভবিষ্যতে মানব সভ্যতাকে বিলুপ্ত করে দিয়ে পৃথিবীটাকে সাহারা বানিয়ে ছাড়বে।

এ যদি ব্যাপারটা হয়ে থাকে, তবে এর প্রতিকার হল সমস্ত মনুষ্যশক্তি, বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তি দিয়ে এর বিরোধিতা করা এবং পুরো ব্যাপারটাকেই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে দেখা কার দিকে ভাগ্যদেবী তার প্রসন্নতার হাত বাড়ায়।

সংগ্রামের মূল সূত্রগুলো জানার জন্য আমি এ তথাকথিত প্রবন্ধ সম্পর্কে আরো বেশি সংবাদ সগ্রহ করতে শুরু করি। সত্যি বলতে কি, আমার উদ্দেশ্যের কাছাকাছি আমি অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাই। এত শীঘ্র যে পৌঁছাব এটা আমিও আশা করিনি। আসলে ইহুদীদের ব্যাপারে ততদিনে আমার জ্ঞান চক্ষু খুলে গেছে। এতদিন পর্যন্ত ইহুদীদের সম্পর্কে আমার জ্ঞান ছিল ভাসা ভাসা। এ নতুন অর্জিত জ্ঞানের সাহায্যে আমি সত্যিকারের বিষয় বস্তুটার বক্তব্যটায় তথাকথিত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির অবতারদের লিখিত আদর্শবাদীতার থেকে কতখানি দূরে, এ সত্যটা বুঝতে পারি। কারণ ততদিনে ইহুদীদের ভাষা হৃদয়ঙ্গম করতে আমি সক্ষম হয়েছি। ইহুদীরা ইচ্ছে করেই এমন কৌশলে তাদের বক্তব্য রাখত যাতে ভাষার কারসাজির জাল ভেদ করে কেউ ওদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে। সুতরাং একমাত্র ওদের লেখাগুলোর বিশ্লেষণ করেই তা ধরতে পারা সম্ভব। এ জ্ঞানই আমার ভেতরে সবচেয়ে বেশি মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। একজন হৃদয়বান জাতীয় সংস্কারমুক্ত শহরবাসী থেকে কট্টর ইহুদী বিরোধী করে তোলে।

মাত্র একবার হ্যাঁ, শেষবারের মত আমি নিরাশার চিন্তায় নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করি, যা আমাকে কিছু সময়ের জন্য উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল।

আমি ইহুদীদের অতীতের দীর্ঘ ইতিহাসের কার্যাবলী বিশ্লেষণ করে রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করি, কোন দুয়ে কারণে যেটা আমাদের হতভাগ্য নশ্বরদের বোধগম্যের বাইরে, পরিণতির অপরিবর্তনীয় আদেশে প্রছন্ন রয়ে গেল। আর জয় সুনিশ্চিতভাবে চলে যাবে এ ছোট্ট একটা জাতির হাতে। হতে পারে পৃথিবীতে এতদিন ধরে যারা বসবাস করে এসেছে, পৃথিবীর নিকট তারা তাদের ঋণ কি পরিশোধ করেনি? নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য আমরা এ যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছি তার ভিত্তিমূল কি বাস্তবতার মাটিতে পোথিত? নাকি এটা শুধু একটা রঙিন কল্পনা? আমি যত বেশি মার্কসীয় মতবাদ সম্পর্কে অনুধাবন এবং বিশ্লেষণ করি, ভাগ্যই আমাকে এর উত্তর দিয়ে দেয়। ইহুদীদের কার্যকলাপ এদের সঙ্গে কতখানি জড়িত তা স্পষ্ট চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়।

ইহুদীদের মার্কসীয় মতবাদ প্রকৃতির সম্ভ্রান্ত আদর্শগুলো থেকে লোকগুলোকে বর্জন করে। এভাবে ওদের শিক্ষা জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা থেকে সাধারণ মানুষকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। এবং এর অর্থ মানুষের অস্তিত্ব এবং সভ্যতাটার ভিত্তিমূলটাকেই প্রচন্ডভাবে নাড়া দেওয়া। যদি মার্কসীয় মতবাদকে জীবনের ভিত্তিমূল বলে সারা পৃথিবী মেনে নেয়, তবে মানব মনের পুরো ধ্যান ধারণাটাই অদৃশ্য হয়ে যাবে। এবং এ ধরনের কোন মতবাদকে মেনে নেওয়ার অর্থই হল নিজেদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করা, যা এ পৃথিবী নামক মধ্যগ্রহের বাসিন্দাদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে ছাড়বে।

সুতরাং ইহুদীরা যদি ওদের এ মার্কসীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীতে কোনরকমে জয়ী হতে পারে, তবে সেদিন হবে মানুষের ইতিহাসের শেষদিন। এ উপগ্রহ আবার তাহলে জনপ্ৰাণীহীন মহাশ্মশান হিসেবে তার অক্ষরেখা ধরে পরিক্রমা করবে, যা আজ থেকে কোটি কোটি বছর আগে করত।

আমি বিশ্বাস করি যে আমার ধ্যান-ধারণা এবং চিন্তাধারা সেই সর্বশক্তিমানের দ্বারা পরিচালিত। সুতরাং ইহুদীদের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোই হল ইশ্বরের আপন হাতে সৃষ্ট মহান শিল্পকর্মকে রক্ষা করার একমাত্র পথ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *