০৮. আমি মরে যাচ্ছি একটি চুমোর জন্যে

শনিবার, ১ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আর এত করেও এখনও সবই কী দুষ্কর; আশাকরি বুঝতে পারছ আমি কী বলতে চাইছি; পারছ না? আমি মরে যাচ্ছি একটি চুমোর জন্যে, যে চুমো আসি-আসি করে আজও এল না। তবে কি সমতক্ষণ আমাকে সে আজও বন্ধুর আসনেই বসিয়ে রেখে দিয়েছে? আমি কি তার বেশি কিছু নই? তুমি জানো আর আমি জানি, আমি শক্ত মানুষ আমার প্রায় সব বোঝা আমি একাই বহন করতে পারি! আর কাউকে নিজের মাথাব্যথার অংশীদার করা, আমার মা র আঁচল ধরে থাকা–কখনই এটা আমার অভ্যেস নয়। কিন্তু এখন আমি আপনা থেকে চাই শুধু একটি বারের জন্যে তার কাধে মাথা রেখে চুপচাপ পড়ে থাকতে।

পেটারের গালে গাল রাখার সেই স্বপ্ন আমি জীবনেও ভুলব না, কী যে ভালো লেগেছিল। কী বলব! পেটারও কি তার জন্যে ব্যাকুল হবে না? শুধু কি বেশিরকম লজ্জার দরুনই সে তার নিজের ভালবাসা স্বীকার করতে পারছে না? কেন সে থেকে থেকেই আমাকে তার কাছে চায়? হায়, কেন ও মুখ ফুটে বলে না? আর নয়, আমাকে শান্ত হতে হবে, আমি শক্ত থাকব। এবং একটু ধৈর্য ধরে থাকলে অন্যটাও এসে যাবে, কিন্তু সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার সেটাই দেখে মনে হচ্ছে আমি হন্যে হয়েছি ওর জন্যে; সবসময় শুধু আমিই ওপরে যাই, ও কখনই আমার কাছে আসে না। কিন্তু তার কারণ তো শুধু ঘর। ও সেই অসুবিধে নিশ্চয়ই বুঝবে।

বটেই তো, আরও অনেক কিছু আছে যা সে বুঝবে।

তোমার আনা।

.

সোমবার, ৩ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

সাধারণত যা করি না আজ একবার তাই করব; খাবারের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে লিখব, তার। কারণ বিষয়টা হয়ে দাঁড়িয়েছে অত্যন্ত গোলমেলে আর জরুরী–শুধু এই ‘গুপ্ত মহলে’ নয়। সারা হল্যাণ্ড, গোটা ইউরোপ এবং তারও বাইরে।

এখানে আমাদের বসবাসের এই একুশ মাসে অনেকগুলো খাদ্য চক্করের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এর মানেটা, দাঁড়াও, এখুনি তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। খাদ্য চক্কর’ হচ্ছে সেই সময়টা যখন শুধু একটি মাত্র পদ বা একটিমাত্র সব্জি ছাড়া আর কিছু খাবার জোটে না। একসময়ে দীর্ঘদিন আমাদের ক্রমাগত কাসনি শাক খেতে হয়েছে–বালি-কিচকিচ-করা কাসনি, বালি-ছাড়া কাসনি, কাসনির দমপুক্ত, কাসনি সেদ্ধ বা কাসনির বাটা-চচ্চড়ি। এরপর পালা করে এল পালং শাক, কচালু, শশা, টমেটো, টক-কপি, এইরকম আরও কিছু।

যেমন, রোজ এবেলা ওবেলা একগাদা টক-কপি খাওয়াটা কী যে অরুচিকর কী বলব, অথচ ক্ষিধের পেটে খেতে তো হবেই। যাই হোক, এখন আমাদের সবচেয়ে রমরমে সময়, কারণ টাটকা সব্জি একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না।

সন্ধ্যেবেলায় হপ্তাভর আমাদের খাদ্যতালিকা হল শিম, কড়াইশুটির সুপ, মালপুয়ার সঙ্গে আলু, আলু-পনির এবং ঈশ্বরের কৃপায়, মাঝেমধ্যে শালগমের মাথা আর পচ-ধরা গাজর আর তারপর আবার ঘুরে আসে শিম। পাউরুটির ঘাটতির জন্যে প্রাতরাশ থেকে শুরু করে বসলেই খাওয়ার পাতে আলু। আমরা তৈরি শিম বা শিমের কোয়া, আলু দিয়ে সুপ, প্যাকেটের জুলিনে সুপ, প্যাকেটের ফ্রেঞ্চ সুপ, প্যাকেটের শিম দিয়ে সুপ। রুটি বাদ দিলে সবেতেই শিম।

সন্ধ্যেবেলায় থাকবেই সুরুয়ার সঙ্গে আলু আর–এখনও থেকে গেছে, ভাগ্যিস–বীট সালাড। সরকারী ময়দা, পানি আর খামির দিয়ে আমাদের তৈরি মালপুয়ার একটু গুণ বর্ননা করব। মালপুয়াগুলো এত শক্ত আর আঠা আঠা হয় যে, পেটে গিয়ে যেন পাথরের মতো চেপে বসে–ওহ্, সে যা জিনিস!

প্রতি সপ্তাহের মস্ত বড় আকর্ষণ হলো মেটে দিয়ে তৈরি সসেজ, আর জ্যাম মাখানো শুখা রুটি। তবু কিন্তু আমরা বেঁচে আছি এবং খাবার খারাপ হলেও প্রায়ই খেয়ে তৃপ্তি হয়।

তোমার আনা।

.

মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

অনেক দিন অব্দি আমার মনে হত কিসের জন্যে আর খেটে মরব। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত, রূপকথার মতোই অবাস্তব। সেপ্টেম্বরের মধ্যে যুদ্ধ শেষ না হলে আমার ইস্কুল যাওয়ার দফারফা। কেননা আমি চাই না দুই বছর পেছনে পড়ে থাকতে। আমার দিনগুলো ভরে রাখতে পেটার–উঠতে পেটার; বসতে পেটার, শয়নে স্বপনে শুধুই সে। শনিবার পর্যন্ত এই চলেছে।

এই সময় আমি এমন মনমরা হয়ে পড়লাম কী বলব। সাংঘাতিক মন-মরা। পেটারের সঙ্গে যতক্ষণ ছিলাম চোখের পানি ঠেকিয়ে রেখেছিলাম; তারপর ফান ডানদের সঙ্গে লেবুর শরবত খেতে খেতে একটু হাসিগল্প করে মনটা ভালো আর চাঙ্গা হলো। কিন্তু যে মুহূর্তে একা হয়েছি–তখনই আমি জানি আমি কেঁদে কেঁদে সারা হব। কাজেই রাতের পোশাক পরা অবস্থায় আমি মেঝের ওপর ঢলে পড়লাম।

প্রথম আমি খুব মনপ্রাণ দিয়ে আমার দীর্ঘ প্রার্থনাটা সেরে নিলাম; তারপর খালি মেঝের ওপর হাঁটু মুড়ে পুঁটুলি পাকিয়ে বসে দুটো বাহুর মধ্যে মুখ ডুবিয়ে আমি কাঁদলাম। একবার ফুপিয়ে কাদার পরই আমার চৈতন্য ফিরে এল; আমি কান্না বন্ধ করে দিলাম, পাছে পাশের ঘরের লোকে শুনতে পায়। এরপর আমি চেষ্টা করলাম মনের মধ্যে খানিকটা জোর আনতে। আমি চাই, আমি চাই, আমি চাই…’ এর বেশি গলা দিয়ে আর স্বর বেরোল না। অস্বাভাবিক ভঙ্গির দরুন সম্পূর্ণ কাঠ হয়ে গিয়ে শরীরটা বিছানার ধারে গিয়ে পড়ল, তারপর থেকে চেষ্টা করতে করতে বিছানায় ওঠা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হলো না ঠিক সাড়ে দশটার আগে। ততক্ষণে। নিজেকে সামলে নিয়েছি।

এখন আর তার কোনো জের নেই। আমাকে খাটতে হবে যাতে মূখ বনে না যাই, যাতে উন্নতি করি, যাতে সাংবাদিক হতে পারি–সেটা হওয়াই আমার বাসনা। আমি জানি আমার। লেখার হাত আছে, আমার লেখা গোটা দুই গল্প বেশ ভালো, ‘গুপ্ত মহলে’র বর্ণনাগুলো সরস, আমার ডায়রির বিস্তর জায়গায় যথাযথ ভাব ফুটেছে আমার সত্যিকার ক্ষমতা আছে কি নেই পরে বোঝা যাবে।

আমার সবচেয়ে ভালো রূপকথা ইভার স্বপ্ন’; অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কোথা থেকে যে সেটা এসেছে আমি জানি না। ‘ক্যাডির জীবনের বেশ খানিকটা ভালো, কিন্তু সব মিলিয়ে কিছু নয়।

আমার নিজের লেখার সবচেয়ে ভালো এবং তীব্রতম সমালোচক আমি নিজে। আমি জানি কোটা সুলিখিত, কোনটা নয়। যে নিজে লেখক না, সে জানে না লেখা জিনিসটা কী অপূর্ব একটা ব্যাপার। আমি একেবারেই আঁকতে পারি না বলে আগে দুঃখ করতাম, কিন্তু অন্তত লিখতে পারি বলে আমি ঢের বেশি খুশি। বই লেখা বা কাগজে লেখার গুণ যদি আমার নাও থেকে থাকে, সেক্ষেত্রে আমি নিজের জন্য লিখতে পারি।

আমি চাই এগিয়ে যেতে। মা-মণি আর মিসেস ফান ডান এবং অন্য সব মহিলারা যে যার কাজ করেন আর তারপর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান, ঠিক তাদের মতো জীবন-যাপন করার কথা আমি ভাবতেই পারি না। স্বামী-পুত্র ছাড়াও আমার এমন কিছু থাকবে, যার হাতে আমি নিজেকে সঁপে দিতে পারব।

মৃত্যুর পরেও আমি চাই বেঁচে থাকতে। কাজেই ঈশ্বরদও এই ক্ষমতা নিজেকে ফুটিয়ে তোলার, লেখার, আমার অন্তরের সব কিছু ব্যক্ত করার এই সম্ভাবনা–এর জন্যে আমি কৃতজ্ঞ।

আমি লিখতে বসে সব কিছু মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারি; আমার দুঃখ উবে যায়, আমার মনোবল ফিরে আসে। কিন্তু আমি কি মহৎ কিছু লিখতে পারব, কখনও কি হতে পারব সাংবাদিক বা লেখক? এটাই বড় প্রশ্ন। আমার আশা, খুব বড় রকমের আশা যে, আমি পারব; কারণ, আমি যখন লিখি, আমার চিন্তা আমার আদর্শ আর আমার স্ব-কপোলকল্পনা সমস্তই আমার স্মৃতিপথে ফিরে আসে।

‘ক্যাডির জীবন’ যতটা লিখেছিলাম, তারপর এতদিনেও আর এগোয়নি। কি ভাবে এগোতে হবে আমার মনের মধ্যে তার ছবিটা স্পষ্ট, কিন্তু কেন জানি না কলম থেকে তা স্বতোৎসারিত হচ্ছে না। হয়ত কোনোদিনই ওটা শেষ হব না। হয়ত ছেড়া কাগজের ঝুড়িতে, কিংবা অগ্নিগর্ভে ওর স্থান হবে…। ভাবতে খুবই খারাপ লাগে, কিন্তু আমি তখন আমার মনকে বলি, ‘চৌদ্দ বছর বয়সে, এত সামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে, কোন্ সাহসে লেখায় তুমি দর্শন আনো?’ অগত্যা নতুন সাহসে বুক বেঁধে আবার এগোই; আমার ধারণা, আমি সফল হব, কেননা আমি লিখতে চাই।

তোমার আনা।

.

বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

তুমি জানতে চেয়েছ কী আমার নেশা, কিসে আমার ঝোক। বলছি–আগে থেকে জানিয়ে রাখি, আমার নেশা আর ঝোক এত বেশি যে, তাই দেখে যেন আবার ঘাবড়ে যেও না।

সর্বপ্রথম : লেখা কিন্তু নেশার মধ্যে সেটা ঠিক পড়ে না।

দুই নম্বর : বংশপঞ্জী। বই, পত্রিকা, পুস্তিকা পেলেই আমি ফরাসী, জার্মান, স্প্যানিশ, ইংরেজ, অস্ট্রিয়ান, রুশ, নরওয়েজিয়ান আর ডাচ রাজবংশের কুলজী খুঁজে বেড়াই! ওদের অনেকের বেলাতেই এ কাজে আমি অনেক দূর এগিয়েছি; তার কারণ, আজ বহুদিন থেকেই যাবতীয় জীবনী আর ইতিহাস বই পড়ে তা থেকে টুকে রাখার কাজ করে আসছি। এমন কি ইতিহাসের অনেক ভালো ভালো জায়গা আমি টুকে রাখি। আমার তৃতীয় নেশা, তার মানে, ইতিহাস। বাপি আমাকে এ বিষয়ের অনেক বই আগেই কিনে দিয়েছেন। যেদিন কোনো সাধারণ পাঠাগারে গিয়ে কবে বই হাঁটকাতে পারব সেই আশায় অধীর হয়ে দিন গুনছি।

চার নম্বর হল গ্রীস আর রোমের পুরাণ। এ বিষয়েও আমার হরেক বই আছে।

অন্য সব নেশার মধ্যে চিত্রতারকা আর পরিবারের ফটো। বই আর পড়া বলতে পাগল। আমার প্রচণ্ড ভালো লাগে শিল্পের ইতিহাস, কবি আর শিল্পীদের বৃত্তান্ত। পরে সঙ্গীতের দিকে। মন দেব। বীজগণিত, জ্যামিতি আর অঙ্ক আমার দুই চোখের বিষ।

স্কুলপাঠ্য অন্য সব বিষয়ই আমার মনঃপূত, তবে সবচেয়ে বেশি ইতিহাস প্রিয়।

তোমার আনা।

.

মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আমার মাথা টিপ টিপ করছে, আমি সত্যি জানি না কোথা থেকে শুরু করব।

শুক্রবার (গুড ফ্রাইডে) আমরা মনোপলি খেলেছিলাম, শনিবার বিকেলেও তাই। এই দিনগুলো ঘটনাহীনভাবে তরতরিয়ে কেটে গেল। রবিবার বিকেলে আমি ডাকায় পেটার আমার ঘরে আসে সাড়ে চারটায়। সোয়া পাঁচটায় আমরা সামনের চিলেকোঠায় যাই, ছটা পর্যন্ত সেখানে থাকি। ছটা থেকে সোয়া সাতটা পর্যন্ত রেডিওতে মোৎসার্টের বড় সুন্দর কনসার্ট ছিল। আমি চুটিয়ে উপভোগ করেছিলাম বিশেষ করে ‘ক্লাইনে নাখটমুজিক’। যখন আমি ভালো সঙ্গীত শুনি তখন প্রাণের মধ্যে এমন নাড়া লাগে যে, ঘরের মধ্যে আমার কানে কিছু ঢোকে না। রবিবার সন্ধ্যের পর পেটার আর আমি সামনের দিকে চিলেকোঠায় চলে যাই। আরামে বসার জন্যে ডিভানের কিছু কুশন আমরা হাতিয়ে নিয়ে যাই। আমরা এটা প্যাকিং বাক্সের ওপর বসি। প্যাকিং বাক্স আর কুশন দুটোই এত সরু যে একেবারে চ্যাপ্টা হয়ে বসে আমরা পিঠ রেখেছিলাম অন্য বাক্সগুলোতে। আমাদের সঙ্গে ছিল মুশ্চি, কাজেই পাহারা দেবার লোক ছিল।

হঠাৎ পৌনে নটায় মিস্টার ফান ডান শিস দিয়ে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন ডুসেলের একটি কুশন আমাদের কাছে আছে কিনা। আমরা লাফ দিয়ে পড়ে কুশন, বেড়াল আর ফান ডান সমেত নিচে নেমে গেলাম।

কুশন নিয়ে পানি অনেক দূর গড়াল। ডুসেল ওঁর একটি কুশন বালিশ হিসেবে ব্যবহার করতেন। আমরা সেটি নিয়ে যাওয়ায় উনি খুব চটিতং। ওঁর ভয়, ওঁর প্রিয় কুশনে পিসু ঢুকবে এবং তাই নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাধালেন। প্রতিশোধ নেবার জন্যে আমি আর পেটার দুটো শক্ত বুরুশ ওঁর বিছানায় ফেলে রাখলাম। মধ্যের এই ঘটনাটা নিয়ে আমরা দুজনে প্রাণ খুলে। হাসলাম।

কিন্তু আমাদের মুখের হাসি মুখেই থেকে গেল। রাত সাড়ে নটা নাগাদ পেটার দরজায় আস্তে করে ডেকে বাপিকে বলল একটি কঠিন ইংরেজি বাক্য নিয়ে ও ফাপরে পড়েছে বাপি যদি একবার ওপরে গিয়ে ওকে একটু সাহায্য করেন। আমি মারগটকে বললাম, ‘আসল ব্যাপার লুকোচ্ছে। শুনলেই বোঝা যায়। আমার কথাই ঠিক। কারা যেন জোর করে মালগুদামে ঢোকার চেষ্টা করছে। বাপি, ফান ডান, ডুসেল আর পেটার সাঁ করে নিচে নেমে গেছে। ওপরে বসে অপেক্ষা করছি আমি, মারগট, মা-মণি আর মিসেস ফান ডান।

চারজন ভীতসন্ত্রস্ত মেয়ে, কাজেই কথা তাদের বলতেই হয়। হঠাৎ দড়াম করে আওয়াজ। তারপর সব চুপ। ঘড়িতে পৌনে দশ বাজল। আমাদের মুখগুলো সব প্যাঙাস হয়ে গেছে; ভয় পেলেও আমরা আর টু শব্দ করছি না। পুরুষগুলো গেল কোথায়? অত জোরে শব্দটা হল কিসের? ওরা কি চোরদের সঙ্গে লড়ছে? দশটা বাজল, সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ। ঘরে ঢুকলেন বাপি, মুখ ভয়ে সাদা; পেছনে পেছনে এলেন মিস্টার ফান ডান। বিমর্ষ মুখে তিনি বললেন, ‘আলো সব বন্ধ, গুটি গুটি ওপরে চলে যাও, বাড়িতে বোধ হয় পুলিসের হামলা হবে।’

একটা জ্যাকেট টেনে নিলাম, তারপর আমরা চলে গেলাম ওপরে। ‘কী হয়েছে? চটপট বলো।’ কে বলবে? পুরুষরা সবাই আবার নিচের তলায় হাওয়া। দশটা বেজে দশে ওদের পুনঃদর্শন মিলল। পেটারের খোলা জানলায় দুজন পঁড়াল পাহারায়। সিঁড়ির নিচের দরজাটা বন্ধ করে ঝোলা-আলমারিটা এঁটে দেওয়া হল। নাইট-লাইটের ওপর আমরা একটা সোয়েটার জড়িয়ে দিলাম। তখন ওরা বলল

সিঁড়ির নিচে দুম দুম্ করে দুটো আওয়াজ হয়। পেটার তাই শুনে নিচে নেমে গিয়ে দেখে বামদিকের দরজার আধখানা জুড়ে একটা পাল্লা উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। ছুটে ওপরে চলে এসে বাড়ির ‘হোমগার্ডদের হুশিয়ার করলে ওরা চারজন একসঙ্গে নিচের তলায় নেমে যায়। ওরা যখন মালখানায় ঢোকে তখন দেখতে পায় সিঁদেল চোররা গর্তটাকে বড় করছে। ফান ডান আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব না করে পুলিস! পুলিস!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন।

বাইরে দু-চারটে দ্রুত পায়ের শব্দ–চোরের দল হাওয়া। গর্তটা যাতে পুলিসের চোখে না পড়ে, তার জন্যে দরজার গায়ে একটা তক্তা খাড়া করা হল। বাইরে থেকে একটা জোর লাথি, সঙ্গে সঙ্গে তক্তাটা মেঝের ওপর ছিটকে পড়ল। এরা থ হয়ে গেল, স্পর্ধা তো কম নয়। ফান ডান আর পেটার, দুজনেরই তখন মাথায় খুন চেপেছে। একটা কাটারি দিয়ে ফান ডান মেঝের ওপর, একটা বাড়ি মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে সব ঠাণ্ডা। গর্তের মুখে দরজার তক্তাটা ওঁরা লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাতে বাধা পড়ল। বাইরে থেকে এক বিবাহিত দম্পতি গর্তের মুখে টর্চ ফেলায় গোটা গুদামঘরটা আলোয় ভরে যায়। এদের একজন রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে। এবার এদের চৌকিদারের ভুমিকা ছেড়ে চোরের ভূমিকায় দেখা গেল। মানুষ চারজন পা টিপে টিপে ওপরতলায় উঠে এল। পেটার চটপট রান্নাঘর আর খাস কামরার দরজা জানালা খুলে দিয়ে টেলিফোনটা মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। শেষ পর্যন্ত এরা চারজন ঝোলা-আলমারির পেছনের দালানে এসে পড়ল।

টর্চ-হাতে সেই বিবাহিত দম্পতি, খুব সম্ভবত ওরা কথাটা পুলিসের কানে তুলেছিলেন। ঘটনাটা ঘটে রবিবার সন্ধ্যেবেলায়, ঈস্টারের রবিবারে; পরদিন ঈস্টারের সোমবার, অফিস ফাঁকা। কাজেই মঙ্গলবার সকালের আগে আমরা কেউ জায়গা ছেড়ে নড়তে পারিনি।

ভেবে দেখ, দুই রাত আর একটি দিন ভয়ে কাঁটা হয়ে অপেক্ষা করে থাকা! কেউ কিছু করবার কথা বলতে পারছে না; কাজেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে বসে থাকা ছাড়া আমাদের কোনো কাজ নেই–কেননা মিসেস ফান ডান ভয়ের চোটে নিজের অজ্ঞাত বাতিটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। উনি কথা বলছেন ফিফিস করে এবং ক্যাচ করে শব্দ হলেই বলে উঠছেন, ‘চুপ, একদম চুপ!’

সাড়ে দশটা বাজল, এগারোটা বাজল, তবু কোনো আওয়াজ নেই। বাপি এবং ফান ডান পালা করে আমাদের কাছে বসছেন। যখন সোয়া এগারোটা হল, নিচের তলায়। লোকজনের নড়াচড়া আর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। প্রত্যেকের শুধু নিঃশ্বাস পড়ার শব্দ হচ্ছে, নইলে নড়াচড়া একেবারে বন্ধ। বাড়ির মধ্যে পায়ের শব্দ–খাস কামরার দপ্তরে, রান্নাঘরে, তারপর… আমাদের সিঁড়িতে। সবাই এবার নিঃশ্বাস চেপে রেখেছে, সিঁড়ি বেয়ে কারা যেন উঠছে, তারপরই ঝোলা-আলমারিতে ঘট ঘটু শব্দ। সেই মুহূর্তটির কোনো বর্ণনা হয় না। আমি বললাম, ব্যস, এবার খতম।’ মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি ঐ রাত্রেই গেস্টাপো আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আলমারির কাছে বার দুই ঘট ঘট শব্দ হওয়ার পর সব চুপচাপ। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার শব্দ। এ পর্যন্ত আমরা তরে গেলাম। একটা কাঁপুনি যেন সবার মধ্যে সংক্রামিত হল; আমার কানে এল কারো দাঁতে দাঁতে ঠক ঠক করার শব্দ; কারো মুখে কোনো কথা নেই।

বাড়িটা এখন একেবারে নিস্তব্ধ; শুধু সিঁড়ির নিচে আলমারিটার ঠিক সামনে ড্যাব ড্যাব করে একটা আলো জ্বলছে। ওটা একটা রহস্যপূর্ণ আলমারি বলে কি? হতেও তো পারে, পুলিস আলো নেভাতে ভুলে গেছে? কেউ কি ফিরে এসে নিভিয়ে দিয়ে যাবে? আস্তে আস্তে মুখে কথা ফুটছে। বাড়িটাতে এখন আর কেউ নেই, হয়ত কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।

এরপর আমরা তিনটে জিনিস করলাম–আমাদের ধারণায় যা ঘটেছে, তার পুনরালোচনা করলাম; ভয়ে আমরা কাঁপতে লাগলাম; এবং আমাদের পায়খানায় যেতে হল। টুকরিগুলো ছিল চিলেকোঠায়; থাকার মধ্যে আমাদের ছিল পেটারের ভেঁড়া কাগজ ফেলার টিনের পাত্র। প্রথমে গেলেন ফান ডান, তারপর বাপি, কিন্তু মা-মণি লজ্জায় ও মুখো হলেন না। বাপি হেঁড়া কাগজের টুরিটা ঘরের মধ্যে এনে দিলে মারগট, মিসেস ফান ডান আর আমি সানন্দে সেটির সদ্ব্যবহার করলাম। শেষ পর্যন্ত মা-মণিও পথে এলেন। সকলে সমানে কাগজ চাইতে লাগল–ভাগ্যক্রমে আমার পকেটে কিছু ছিল।

টিনটা থেকে ভয়ঙ্কর গন্ধ বেরোচ্ছে; সবাই ফিস্ ফিস্ করে কথাবার্তা বলছে; আমরা ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়লাম; বেলা তখন বারোটা। মেঝেতেই তবে লম্বা হয়ে ঘুমোও। মারগটকে আর আমাকে একটি করে বালিশ আর একটি করে কম্বল দেওয়া হল। মারগট গিয়ে শুলো ভাড়ার রাখার আলমারির কাছে আর আমি টেবিলের দুটোর পায়ার মাঝখানে। মেঝের ওপর গন্ধটা তত তীব্র নয়, কিন্তু এই সঙ্গেও মিসেস ফান ডান চুপচাপ। কিছুটা ক্লোরিন নিয়ে এলেন এবং দ্বিতীয় কৌশল হাত মোছার একটা তোয়ালে এনে টুরির ওপর চাপা দিলেন।

কথা, ফিসফাস, ভয়, কটুগন্ধ, বায়ু নিঃসরণ আর তার সঙ্গে সর্বক্ষণ কারো না কারো টুকরিতে বসা; ঘুমোও তো দেখি কেমন পারো! যাই হোক, আড়াইটা নাগাদ ক্লান্তিতে আমার চোখ আপনি বুজে এল। অঘোরে ঘুমোলাম সাড়ে তিনটে অব্দি। মিসেস ফান ডানের মাথা আমার পায়ে ঠেকতে ঘুম ভেঙে গেল।

আমি বললাম, ‘দোহাই, আমাকে পরবার একটা কিছু দিন। আমাকে দেওয়া হল, কিন্তু কী দেওয়া হল জানতে চেয়ো না–আমার পাজামার ওপর এক জোড়া পশমের নিকার, একটা লাল জাম্পার আর একটা কালো স্কার্ট, সাদা উপরতল্লা জুতো এবং খেলার মাঠের এক জোড়া শতচ্ছিদ্র মোজা। এরপর মিসেস ফান ডান চেয়ারে বসলেন আর তাঁর স্বামী এসে আমার পায়ের ওপর ধপ করে শুয়ে পড়লেন। সাড়ে তিনটে পর্যন্ত শুয়ে আমি আকাশ-পাতাল ভাবলাম। সারাক্ষণ আমি হি হি করে কাঁপছিলাম–ফলে, মিস্টার ফান ডানের ঘুম মাটি হল। পুলিশ ফিরে আসবে, তার জন্যে আমি মনে মনে তৈরি হচ্ছিলাম; তখন বলতে হবে আমরা লুকিয়ে ছিলাম; ওরা যদি সাধারণ ঘরের ভালো ডাচ হয়, তো আমরা বাঁচলাম; আর যদি ডাচ নাৎসী (ডাচ ন্যাশনাল সোশালিস্ট) হয়, তো ঘুষ খাওয়াতে হবে।

মিসেস ফান ডান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সে ক্ষেত্রে রেডিওটা নষ্ট করে ফেল।’ ওঁর স্বামী বললেন, ‘বেশ বলেছ, উনুনে ফেলে দাও! দেখ, ওরা যদি আমারই পাত্তা পায়, তাহলে আর রেডিওর পাত্তা পেলে কী এল গেল!‘

বাপি তাতে জুড়লেন, ‘তারপর আনার ডায়রিটা ওরা দেখতে পারে।’ এ বাড়ির সবচেয়ে ঘাবড়ে-যাওয়া লোকটি বলল, ‘ওটা পুড়িয়ে ফেললেই তো হয়।‘ এই কথা যখন বলা হল আর পুলিস যখন আলমারি-দেওয়া দরজায় ঘট ঘট ঘট করে শব্দ করেছিল–এই দুটোই ছিল আমার সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত। আমার ডায়রি কিছুতেই না; ডায়রি চলে গেলে তার সঙ্গে আমিও বিদায় হব।’ কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বাপি চুপ হয়ে গেলেন।

এত বেশি কথা হয়েছিল যে, যতটা মনে আছে, তার সব পুনরুদ্ধার করে লাভ নেই। মিসেস ফান ডান বেজায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, ওকে আমি সান্ত্বনা দিলাম। পালিয়ে যাওয়া আর গেস্টাপোর জেরার মুখে পড়া সম্পর্কে, টেলিফোন করার বিষয়ে এবং সাহসে বুক বাধার ব্যাপারে দুজনের কথা হল।

‘মিসেস ফান ডান, সৈন্যদের মতো আমাদের আচরণ হওয়া উচিত। যদি আমাদের দিন ফুরিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে যাওয়া যাক রানী আর দেশের জন্যে, স্বাধীনতা সত্য আর ন্যায়ের জন্যে ইংল্যাণ্ড থেকে ডাচ খবর প্রচারের সূত্রে সব সময় যা বলা হয়। একটাই শুধু যাচ্ছেতাই ব্যাপার। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আরও গুচ্ছের লোক মুশকিলে পড়ে যাবে।‘

এক ঘণ্টা পরে মিস্টার ফান ডান তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আবার জায়গা বদল করলেন। আর বাপি এসে আমার পাশে বসলেন। দুই পুরুষ মানুষ মিলে অবিরাম ধোয়া টেনে চললেন, থেকে থেকে একটি করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, তারপর একজন কেউ টুকরিতে গিয়ে বসে, তারপর আগাগোড়া আবার একই ভাবে চলে।

চারটে, পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটা। তখন আমি গিয়ে পেটারের কাছে জানলার পাশে বসে কান খাড়া করে রইলাম। দুজনে দুজনের এত কাছাকাছি যে, আমরা পরস্পরের শরীরের কেঁপে ওঠা টের পাচ্ছি। পাশের ঘরে ওরা আলোয় পরানো ঠুলি সরিয়ে নিয়েছে। ওরা চেয়েছিল সাতটায় কুপহুইসকে টেলিফোনে ধরতে, যাতে তিনি কাউকে এদিকটাতে পাঠিয়ে দেন। টেলিফোনে কী বলা হবে, সেটা ওরা একটা কাগজে আনুপূর্বিক লিখে নেয়। দরজায় কিংবা মালখানায় কোনো পুলিশ পাহারায় থাকলে তার কানে টেলিফোনের আওয়াজ যাওয়ার সমূহ ভয়। কিন্তু পুলিস বাহিনী ফিরে এলে তাতে আরও বেশি বিপদের ভয়।

কুপহুইসকে এই এই জিনিস বলতে হবে–

সিঁদ কেটে চোর ঢুকেছিল; পুলিস এ বাড়িতে আসে; তারা ঝোলা-আলমারি পর্যন্ত যায়, তার বেশি এগোয়নি।

বোঝাই যায়, সিঁদেল-চোররা বাধা পেয়ে মালখানার দরজা ভেঙে বাগানের দিক দিয়ে চম্পট দেয়।

সদর দরজায় হুড়কো দেওয়া ছিল বলে বেরোবার সময় ক্রালার নিশ্চয় দ্বিতীয় দরজাটি ব্যবহার করেন। খাস কামরার অফিসে কালো কেসের মধ্যে টাইপরাইটার আর গণক যন্ত্রটি নিরাপদে রাখা আছে।

হেংককে যেন হুঁশিয়ার করা হয় এবং এলির কাছ থেকে চাবি আনিয়ে নিয়ে বেড়ালকে খেতে দেওয়ার অছিলায়–সে যেন অফিসে গিয়ে একটু টহল দিয়ে দেখে নেয়।

সব কিছু ঠিক প্ল্যান মাফিক হল। কুপহুইস ফোন পেলেন। যে টাইপরাইটারগুলো ওপর তলায় ছিল সেগুলো কেসের ভেতর ভরে রাখা হল। তারপর আমরা টেবিলে গোল হয়ে বসে হয় হেংক, নয় পুলিসের জন্যে অপেক্ষা করে রইলাম।

পেটার ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি আর ফান ডান মেঝের ওপর এলিয়ে রয়েছি। এমন সময় নিচের তলায় দুম দুম করে পায়ের আওয়াজ। আমি চুপচাপ উঠে পড়ে বললাম, ‘হেংক এসেছেন।

বাকি লোকদের কয়েকজন বলল, ‘না, না, পুলিস।‘

দরজায় খুট খুট করে কারো আওয়াজ, সেইসঙ্গে মিপের শিস্। মিসেস ফান ডান আর পারলেন না, তাঁর মুখ কাগজের মতো সাদা, হাঁটু ভেঙে ধপ করে চেয়ারের ওপর বসে পড়লেন। ওঁর স্নায়ুর ওপর চাপ যদি আর এক মিনিটও স্থায়ী হত, তাহলে উনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন।

মিপ আর হেংক যখন আমাদের ঘরে ঢুকলেন, তখন সে এক দৃশ্যই বটে–শুধু টেবিলটারই অবস্থা ফটো তুলে রেখে দেওয়ার মতো। এক কপি ‘সিনেমা ও থিয়েটার’, তার ওপর জেবৃড়ে রয়েছে জ্যাম আর উদরাময়ের একটি দাওয়াই, খোলা পৃষ্ঠাটিতে নর্তকীর দল; জ্যাম রাখার দুটো বয়াম, আধ-খাওয়া দুটো পাউরুটি; একটা আরশি, চিরুনি, দেশলাই, ছাই, সিগারেট, তামাক, ছাইদানি, বই, গোটা দুই প্যান্ট, একটা টর্চ, টয়লেট পেপার ইত্যাদি, ইত্যাদি সব বিচিত্র জেল্লায় একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে।

হেংকক্ আর মিকে অবশ্যই হৈ হৈ করে এবং চোখের পানিতে স্বাগত জানানো হল। কয়েকটা তক্তা দিয়ে হেংক দরজার গর্তটা মেরামত করে দিলেন এবং খানিক পরেই সিঁদ কাটার ব্যাপারটা পুলিসকে এতেলা করতে চলে গেলেন। মিপ্‌ মালখানার দরজার তলা থেকে রাতের চৌকিদার স্লটারের লেখা এটা চিরকুট কুড়িয়ে পেয়েছিলেন; স্লাটার ঐ গর্তটা দেখতে পেয়েছিলেন এবং পুলিসকে জানিয়েছিলেন। হেংক তার সঙ্গেও দেখা করে আসবেন।

সুতরাং আধঘণ্টার মধ্যে আমাদের ফিটফাট হয়ে নিতে হবে মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে এমন রূপান্তর ঘটতে এর আগে কখনও দেখিনি। মারগট আর আমি বিছানার চাদরপত্র নিয়ে নিচের তলায় শৌচাগারে চলে গেলাম; ধোয়াধুয়ি সেরে দাঁত মাজলাম আর চুল ঠিক করে নিলাম। তারপর ঘরটা খানিকটা গোছগাছ করে ওপরতলায় ফিরে এলাম। এসে দেখি। টেবিলটা ইতিমধ্যেই সাফসুফ করা হয়ে গেছে। খানিকটা পানি ফুটিয়ে কফি আর চা করে, দুধ ফুটিয়ে নিয়ে টেবিলে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করে ফেললাম। পেটারকে সঙ্গে নিয়ে বাপি টুরিগুলো খালি করে, গরম পানি ক্লোরিন দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে ফেললেন।

হেংক ফিরে এলে এগারোটায় আমরা তাকে নিয়ে টেবিলের চারধারে বসে গেলাম। ততক্ষণে স্বাভাবিক জীবন আর জমাটি ভাব ফিরে আসতে শুরু করেছে।

মিস্টার স্লাটার তখন ঘুমোচ্ছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী হেংককে বললেন, ক্যানেলের কাছ বরাবর টহল দিতে দিতে তাঁর স্বামী আমাদের দরজায় ফোকর দেখতে পান এবং তখন পুলিসের একটি লোককে ডেকে এনে ওঁরা দুজনে বাড়ির ভেতর ঢুকে খোঁজখবর করেন। স্লাগটার মঙ্গলবার ক্রালারের সঙ্গে দেখা করে আরও সবিস্তারে সব বলবেন। থানায় গিয়ে দেখা গেল তারা সিঁদ কাটার কথা জানে না, তবে সেখানে সঙ্গে সঙ্গে পুলিস সেটা নোট করে নেয় এবং বলে যে, মঙ্গলবার এসে সব দেখেশুনে যাবে। ফেরার পথে মোড়ের মাথায় হেংক এর সঙ্গে আমাদের সব্জিওয়ালার দেখা হয়; হেংক তাকে বাড়িতে সিঁদ কাটার কথাটা বলেন। উনি শান্ত গলায় বললেন, ‘আমি সেটা জানি। কাল সন্ধ্যেবেলা আমার স্ত্রীকে নিয়ে যখন বেরোই তখন দরজার গায়ে গর্তটা দেখতে পাই। আমার স্ত্রীর দাঁড়াবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু আমি টর্চ জ্বেলে ভেতরটা একবার দেখে নিলাম; সঙ্গে সঙ্গে চোরগুলো তখন পিঠটান দেয়। যাতে বিপদ-আপদ না হয়, তার জন্যে আমি ফোন করে পুলিসে খবর দিইনি; কেননা তোমার সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক, তাতে সেটা করা উচিত হবে না বলে মনে করেছি। আমি কিছু জানি না, তবে অনেক কিছু আঁচ করতে পারি।’

হেংক তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যান। আমরা এখানে আছি বোঝাই যায়, সব্জিওয়ালা সেটা আঁচ করেন; কারণ উনি দুপুরের খাওয়ার সময়টাতে বরাবর আলু এনে দেন। লোকটা কী ভালো!

হেংক চলে গেলেন এবং আমরা বাসন মাজা সেরে ফেললাম, ঘড়িতে তখন একটা। আমরা সবাই ঘুমোতে চলে গেলাম। পৌনে তিনটেয় আমার ঘুম ভাঙল, ততক্ষণে দেখি ডুসেল হাওয়া। ঘুম-ঘুম চোখে একেবারেই আলটপকা পেটারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পেটার তখন সবে নেমে এসেছে। কথা হল নিচের তলায় আমরা দেখা করব।

আমি ঠিকঠাক হয়ে নিচে গেলাম। পেটার জিজ্ঞেস করল, সামনের চিলেকোঠায় যাওয়ার এখনও বুকের পাটা আছে তোমার?’ আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম, তারপর আমার বালিশটা বগলদাবা করে চিলেকোঠায় উঠে গেলাম। আবহাওয়াটা ছিল দারুণ, একটু পরেই আর্তনাদ শুরু করে দিল সাইরেন। আমরা নড়লাম না। পেটার একটা হাতে আমার কাঁধ জড়াল, আমি একটা হাতে ওর কাঁধ হাত রেখে আমরা চুপচাপ বসে রইলাম যতক্ষণ চারটের সময় মারগট কফি খাওয়ার জন্যে আমাদের ডাকতে এল।

আমরা রুটি শেষ করে লেমোনেড খেলাম এবং হাসিঠাট্টা করলাম (আবার আমরা পারছি), বলতে গেলে সব সেই আগের মতোই স্বাভবিক ভাবে। সন্ধ্যেবেলায় পেটারকে আমি সাবাস জানালাম আমাদের মধ্যে পেটারই সবচেয়ে বেশি সাহস দেখিয়েছে।

সে রাতের মতো বিপদে আমরা কেউ কখনও পড়িনি। ঈশ্বর আমাদের প্রকৃতই রক্ষা করেছেন; একবার অবস্থাটা ভেবে দেখ–আমাদের আলমারির গুপ্তস্থলে পুলিস দাঁড়িয়ে ডানদিকে ঠিক তার সামনে প্যাট প্যাট করে আলো জ্বলছে, এবং এ সত্ত্বেও আমরা চোখের আড়ালে রয়ে গেলাম। যদি দেশ চড়াও হয়, সেই সঙ্গে বোমাবাজি চলে–সবাই তাহলে চাচা আপন প্রাণ বাচা বলে ছুটবে। কিন্তু অপকট রক্ষাকারী হিসেবে এক্ষেত্রে ভয় জিনিসটা আমাদের উপকারেও লেগেছে।

‘আমরা রক্ষা পেয়েছি, আমাদের রক্ষা করে চলো।’ এইটুকুই আমরা শুধু বলতে পারি।

এই ব্যাপারটা বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছে। মিস্টার ডুসেল আর এখন সন্ধ্যেগুলোতে নিচে গিয়ে ক্রালারের আপিস ঘরে বসেন না; তার বদলে বাথরুমে বসেন। সাড়ে আটটায় এবং সাড়ে নটায় পেটার একবার সারা বাড়ি চক্কর দিয়ে দেখে আসে। রাতে এখন আর পেটারকে তার জানলা খুলতে দেওয়া হয় না। বন্ধ ফাঁকফোকর সাড়ে নটার পর কেউ খুলতে পারবে না। আজ সন্ধ্যের দিকে একজন ছুতোর মিস্ত্রি আসছে মালখানার দরজাগুলো আরও মজবুত করতে।

‘গুপ্ত মহলে’ এখন সবসময় নানা বিষয়ে বাদানুবাদ চলেছে। অসতর্কতার জন্যে ক্রালার আমাদের বকেছেন। হেংকও বলেছেন যে, এ রকম ক্ষেত্রে আমরা যেন কখনো নিচের তলায় না যাই। আমাদের পই পই করে বলা হয়েছে যেন মনে রাখি আমরা লুকিয়ে আছি, আমরা হলাম পায়ে বেড়ি পরা ইহুদি, এক জায়গায় আটক, আমাদের অধিকার বলে কিছু নেই, কিন্তু আমাদের হাজারটা করণীয়। আমরা ইহুদিরা যেন কাউকে জানতে না দিই আমাদের মনে কী হচ্ছে, আমাদের সাহসী আর শক্ত হতে হবে। বিনা ওজর আপত্তিতে সব অসুবিধে মাথা পেতে নিতে হবে, ক্ষমতায় যতটা কুলোয় করে যেতে হবে এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে হবে। একদিন এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ থেমে যাবে। এমন একটা সময় নিশ্চয়ই আসবে যখন আমরা আবার মনুষ্য পদবাচ্য হব কেবল ইহুদি হয়ে থাকব না।

কে আমাদের ওপর এ জিনিস চাপিয়েছে? আর সব মানুষ থেকে আমাদের ইহুদিদের কে আলাদা করেছে? আজ অব্দি কার প্রশ্রয়ে আমাদের এমন জ্বালাযন্ত্রণা পেতে হয়েছে? ঈশ্বর আজ আমাদের এমন অবস্থায় ফেলেছেন, আবার সেই ঈশ্বরই আমাদের টেনে ওপরে তুলবেন। আমরা যদি তাবৎ লাঞ্ছনা সহ্য করতে পারি এবং এসব চুকেবুকে গেলে, ফৌত না হয়ে যে ইহুদিরা আখেরে বেঁচে থাকবে তাদের আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হবে। কে জানে, এমন কি এও হতে পারে যে, আমাদের ধর্ম থেকেই সারা দুনিয়ার সব জাতের মানুষ সৎ শিক্ষা পারে এবং সেই কারণে, শুধু সেই কারণেই, এখন আমাদের কষ্ট পেতে হবে। আমরা কোনাদিনই নিছক নেদারল্যাণ্ডীয়, কিংবা নিছক ইংরেজ বা সেদিক থেকে অন্য কোনো দেশীয় হতে পারব না; আমরা চিরদিই যে ইহুদিই থাকব। কিন্তু তাই তো আমরা চাই।

সাহসে বুক বাধো! এসো আমরা গাইগুই না করে আমাদের কর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত থাকি, সমাধান একটা হবেই, ঈশ্বর আমাদের লোকজনদের কখনই ছেড়ে যাননি। যুগ যুগ ধরে ইহুদিরা আছে, সব যুগেই তাদের লাঞ্ছনা পেতে হয়েছে, কিন্তু তাতে তারা শক্তিমানও হয়েছে; যে দুর্বল সে মরে; যে সবল সে থেকে যায়, কখনও বরবাদ হয়ে যায় না।

সেদিন রাত্রে আমার সত্যিই মনে হয়েছিল আমি মরে যাব, পুলিস আসার অপেক্ষা করেছি, যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকের মতোই আমি তৈরি ছিলাম। দেশের জন্যে প্রাণ দিতে আমি উৎসুক ছিলাম, কিন্তু এখন, এখন আমি আবার যমের মুখ থেকে ফিরে এসেছি, এখন আমার যুদ্ধান্তের প্রথম ইচ্ছে হল ওলন্দাজ হওয়া। ওলন্দাজদের আমি ভালবাসি, এই দেশ আমি ভালবাসি, এখনকার ভাষা আমার প্রিয় এবং আমি এখানে কাজ করতে চাই। এমন কি যদি রানীকে আমায় লিখতেও হয়, তবু লক্ষ্যে না পৌঁছুনো পর্যন্ত আমি হাল ছাড়ব না।

দিন দিন আমার মা-বাবার ওপর নির্ভরতা আরও কমছে; আমার বয়স কম বলে, মা মণির চেয়ে ঢের বেশি সাহস ভারে আমি জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারি; ন্যায় বিচারের প্রতি আমার মনোভাব ওঁর চেয়ে ঢের অবিচল আর অকৃত্রিম। আমি আমার মন চিনি, আমার একটা লক্ষ্য আছে, মতামত আছে; আমার আছে একটা ধর্ম আর ভালবাসা। আমি যা, আমি যদি তাই হই তাহলেই সন্তুষ্ট হব। আমি জানি আমি একজন মেয়ে; এমন এক মেয়ে, যার আন্তরিক শক্তি আছে এবং যে প্রচুর সাহসী।

ঈশ্বর যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন, মা-মণির চেয়ে আমি অনেক বেশি সার্থক হব, আমি হেঁজিপেঁজি হয়ে থাকব না, আমি দুনিয়া জুড়ে সব মানুষের জন্যে নিজেকে ঢেলে দেব।–এখন আমি জেনেছি, আমার পক্ষে সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হল সাহস

আর চিত্তের প্রফুল্লতা।

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

এখানকার আবহাওয়া এখনও বেজায় অস্বাভাবিক। পিমের এমন অবস্থা যে, আরেকটু হলেই ফেটে পড়বেন। মিসেস ফান ডান সর্দিজ্বরে পড়েছেন এবং হেঁচে-কেশে বাড়ি মাথায় করছেন। মিস্টার ফান ডান সিগারেটের অভাবে কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে পড়ছেন, প্রচুর সুখস্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করছেন যে ডুসেল, তাঁর টিকাটিপ্পনি লেগেই আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, এখন আমাদের পাথর চাপা কপাল। শৌচাগারে ফুটো পানির কলের ওয়াশার বেপাত্তা, তবে যেহেতু আমাদের অনেক চেনাজানা, শীগগিরই এসব জিনিস আমরা ঠিকঠাক করে নিতে পারব।

জানি, মাঝে মাঝে আমি ভাবালু হয়ে পড়ি, তবে কখনও কখনও এখানে কারণ ঘটে ভাবালু হয়ে পড়ার, যখন আমি আর পেটার কোথাও রাবিশ আর ধুলোর রাজ্যে একটা শক্ত প্যাকিং বাক্সের ওপর কাঁধ ধরাধরি করে খুব ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে বসি, আমার একথোকা কোকড়া চুলে থাকে ওর হাত; যখন বাইরে পাখিরা গান গায় আর তুমি দেখতে পাও গাছগুলো কেমন পাল্টে সবুজ হয়ে যায়, খোলা হাওয়ার আমন্ত্রণ জানায় ঝকঝকে রোদ, যখন আকাশ অসম্ভব নীল, তখন–হায়, তখন আমার কত কী যে ইচ্ছে হয়।

তাকালেই দেখা যাবে এখানে সবাই অখুশি, সকলেরই হাঁড়ি মুখ; শুধূ দীর্ঘশ্বাস আর। চাপা নালিশ। দেখে বাস্তবিকই মনে হবে আমরা যেন অকস্মাৎ, খুব দুরবস্থায় পড়ে গিয়েছি। যদি সত্যি বলতে হয়, যতটা খারাপ পুরোটাই তোমার নিজেরই তৈরি। এখানে ভালো জিনিস করে দেখাবার কেউ নেই; প্রত্যেকের দেখা উচিত সে যাতে তার বিশেষ মানসিক অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে। রোজই তুমি শুনবে ‘এ সবের শেষ হলে বাঁচতাম।‘

আমার কাজ, আমার আশা, আমার ভালবাসা, আমার সাহস–এরই জোরে আমি পানির ওপর মাথা ভাসিয়ে রেখেছি এবং খুঁতখুঁত করার হাত থেকে বেঁচেছি।

আমি সত্যিই মনে করি, কিটি, আজ আমার মাথাটা একটু গুলিয়ে গিয়েছে। তবে, কেন তা জানি না। এখানে সবকিছু এত তালগোল পাকানো, কোনোটার সঙ্গে কোনোটারই আর কোনো যোগ নেই, এবং কখনও কখনও আমার খুবই সন্দেহ হয়, ভবিষ্যতে আমার এই আবোলতাবোলে কেউ কোনো আগ্রহ বোধ করবে কিনা।

এই সব আবোলতাবোলের শিরোনাম হবে ‘এক কুচ্ছিত হংসীশাবকের মনখোলা কথা।‘ আমার ডায়রি বস্তুত সর্বশ্রী বকেস্টাইন বা জেব্রাণ্ডির (লণ্ডনে নির্বাসনে গঠিত মন্ত্রিসভার দুই সদস্য) বিশেষ কাজে আসবে না।

তোমার আনা।

.

শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি।

‘এক ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে আরেক ধাক্কা। এ থেকে কি কোনো নিষ্কৃতি নেই?’ নিজেদের অকপটে এখন আমরা এ প্রশ্ন করতেই পারি। সর্বশেষ কী ঘটনা ঘটেছে বোধহয় জানো না। পেটার, করেছিল কি, সামনের দরজার হুড়কো খুলতে (রাত্রে ভেতর থেকে আগল দিয়ে রাখা হয়) ভুলে গিয়েছিল; এদিকে অন্য দরজাটার তালা বিগৃড়ে আছে। ফলে, ক্রালার আর অফিসের অন্য লোকজনের বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারেননি। ক্রালার তখন পাড়াপড়শীদের সাহায্য নিয়ে রান্নাঘরে জানালা ভেঙে পেছনের দিক দিয়ে বাড়িতে ঢোকেন। আমাদের এই আহাম্মকিতে ক্রালার রেগে আগুন হয়ে গেছেন।

পেটার জানো তা, এতে ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে পড়েছে। খেতে বসে একসময়ে মা-মণি যেই বলেছেন যে, আর কারো চেয়ে পেটারের জন্যেই তার বেশি দুঃখ হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে পেটারের যেন চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসার উপক্রম হল। এ ব্যাপারে পেটার একা নয়, আমরাও সমান দোষী; কারণ প্রায় প্রতিদিনই এ বাড়ির পুরুষেরা জিজ্ঞেস করেন দরজার হুড়কো ভোলা হয়েছে কিনা। আজই কেউ সেটা জিজ্ঞেস করেনি।

হয়ত পরে আমি ওকে খানিকটা বুঝিয়ে শান্ত করে তুলতে পারব। ওর জন্যে কিছু করতে পারলে আমি কী আনন্দ যে পাই!

তোমার আনা।

.

রবিবার, ১৬ এপ্রিল, ১৯৪৪

প্রাণপ্রতিম কিটি,

কালকের তারিখটা মনে রেখো, আমার জীবনে ছিল খুব স্মরণীয় একটি দিন। প্রত্যেকটি মেয়ের কাছেই সেই দিনটি নিশ্চয় খুব বড় হয়ে দেখা দেয়, যেদিন সে পায় জীবনের প্রথম চুম্বন? তাহলে আমার কাছেও এই দিনের ততটাই গুরুত্ব। আমার ডান গালে আমার ডান হাতে মিস্টার ওয়াকারের সেই চুম্বনটি।

হঠাৎ কী করে এই চুমো খাওয়ার ব্যাপারটা ঘটল? রসো, বলছি।

কাল সন্ধ্যেবেলায়, তখন ঘড়িতে আটটা, আমি পেটারের ডিভানে গিয়ে বসেছি তার খানিক পরেই ও আমাকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। আমি বললাম, একটু সরে বসলে ভালো হয়, তাহলে আর আলমারিতে আমার মাথা ঠুকে যাওয়ার ভয় থাকবে না। প্রায় কোণের দিকে ও সরে গেল! ওর হাতের ভেতর দিয়ে ওর পিঠের আড়াআড়ি আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম; আমার কাধে ওর হাত ঝুলে থাকায় আমি প্রায় ওর কোলের মধ্যে চলে গেলাম।

আগেও আমরা এভাবে কয়েকবার বসেছি, কিন্তু কালকের মতন অতটা গায়ে গায়ে হয়ে নয়। ও বেশ শক্ত করে আমাকে ধরে রইল, আমার বাঁ কাঁধ ওর বুকের ওপর। ততক্ষণে আমার হৃদস্পন্দন দ্রুততর; কিন্তু তখনও আমরা শেষ করিনি। ওর কাঁধে যতক্ষণ আমি মাথা রাখলাম এবং যতক্ষণ দুজনে মাথায় মাথায় না হলাম পেটার ছাড়ল না। মিনিট পাঁচেক পরে আমি সোজা হয়ে বসেছি, খানিক পরে পেটার আরেকবার আমার মাথাটা ওর হাতের মধ্যে ধরে কাঁধে রেখে মাথায় মাথা ঠেকাল। ওঃ, কী যে ভাল লাগছিল বলবার নয়, আনন্দে গদগদ হয়ে আমি বিশেষ কথা বলতে পারছিরাম না। ও আমার গালে আর হাতে খানিকটা আনাড়ির মতো ঠোনা মারছিল, আমার কোঁকড়া চুলের থোকাগুলো নিয়ে খেলা করছিল এবং প্রায় সারাক্ষণ আমরা মাথায় মাথা দিয়ে ছিলাম। আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না, কিটি, সে যে কী আশ্চর্য অনুভুতি; আনন্দে আমার বারোধ হয়ে গিয়েছিল; আমার ধারণা, পেটারেরও তাই।

আমরা সাড়ে আটটায় উঠে পড়লাম। পেটার ওর খেলতে যাওয়ার রবারের জুতোটা পরে নিল, যাতে বাড়িটা টহল দেবার সময় শব্দ না হয়। আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে। আমরা নিচে নামব, এমন সময় জানি না কোথা থেকে কী হয়ে গেল, হঠাৎ আমাকে ও চুমো খেয়ে বসল। আমার চুলের ভেতরে মুখ ডুবিয়ে, বা গালে অর্ধেক আর অর্ধেক আমার কানে। ওর হাত ছাড়িয়ে আমি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা নিচে নেমে এলাম। আজ কেবলই আমার মন উচাটন হয়ে আছে।

তোমার আনা।

.

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

সাড়ে সতেরো বছরের এক ছেলে আর পুরো পঞ্চদশীও নয় এমন এক মেয়ে, আমি ডিভানে বসে ছেলেটিকে চুমো খাচ্ছি–এমন জিনিস আমার বাপি আর মা-মণি মেনে নেবেন বলে তুমি মনে করো? আমার ঠিক মনে হয় না ওঁরা মেনে নেবেন। তবে এ ব্যাপারে আমার নিজের ওপর ভরসা করতে হবে। নিরিবিলিতে আঁর প্রশান্তিতে ওর কোলের মধ্যে শুয়ে থাকা আর স্বপ্ন দেখা; শরীরে শিহরণ তুলে দুজনে গালে গাল ঠেকিয়ে রাখা; জেনে আনন্দ হওয়া যে কেউ একজন আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু এর মধ্যিখানে বড় রকমের ‘কিন্তু’ একটা থেকেই যায়, কারণ, পেটার কি এইখানে ইতি টেনে দিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে? আগেই যে ও কথা দিয়েছে, আমি সে কথা ভুলিনি। তবু… ও ছেলের জাত তো বটে!

নিজেই জানি, আমি অনেক আগে আগে শুরু করেছি, এখনও পনেরোও নয় এবং এরই মধ্যে এতখানি পাখা গজিয়েছে। অন্যদের পক্ষে এটা বুঝে ওঠা শক্ত; আমি এটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই জানি যে, বাগদান বা বিয়ের কোনোরকম কথা না হয়ে থাকলে মারগট কখনই কোনো ছেলেকে চুমো খাবে না; সেদিক থেকে পেটার বা আমি আমরা কেউ তেমন কিছু ভাবিইনি। বাপির আগে মা-মণি যে কোনো পুরুষ মানুষকে ছোননি, সে বিষয়েও আমি নিশ্চিত। আমি যে পেটারের বুকে বুক ঠেকিয়ে, দুজনে দুজনের কাঁধে মাথা রেখে ওর কোলের মধ্যে শুয়েছি, আমার মেয়ে-বন্ধুরা সে কথা জানতে পারলে কী বলবে!

ইস, আনা, কী কেলেঙ্কারির কথা! আমি কিন্তু সত্যিই তা মনে করি না। এখানে আমরা ভয় আর দুর্ভাবনার মধ্যে, দুনিয়ার বের হয়ে, খাচায় বন্ধ হয়ে আছি, বিশেষ করে ইদানীং পরস্পরকে আমরা যখন ভালবাসি, তখন কেন আমরা পরস্পরের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলব? যোগ্য বয়স না হওয়া অব্দি কেন আমরা অপেক্ষা করব? কেন আমরা ও নিয়ে ভেবে মরব?

আমার ওপর খবরদারি করার ভার আমি নিজের কাঁধে নিয়েছি; পেটার কখনই আমাকে দুঃখ বা বেদনা দেবে না। আমরা দুজনেই যদি তাতে সুখী হই, কেন আমি আমার হৃদয়ের হাত ধরে চলব না? এসব সত্ত্বেও, কিটি, আমার মনে হয় তুমি ধরতে পারছ যে, আমি দ্বিধার মধ্যে আছি। আমি মনে করি, আমার মধ্যে যে সততা আছে, সেটা লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করতে গেলে বেঁকে বসে। তোমার কি মনে হয় আমি কী করছি সেটা বাপিকে আমার বলা কর্তব্য? তোমার কি মনে হয় তৃতীয় কাউকে আমাদের এই গোপন ব্যাপারটা জানানো উচিত? এর মাধুর্য তাতে অনেকখানি নষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু আমার বিবেক তো তুষ্ট হবে? আমি ওর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করব। হ্যাঁ, আরও অনেক কিছু নিয়ে ওর সঙ্গে আমার কথা বলার আছে; কারণ, পরস্পরকে শুধু জড়াজড়ি করে কাজ হবে না। দুজনে কে কী ভাবছি, তার আদান-প্রদান হওয়া দরকার; তাতে বোঝা যাবে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের কতটা বিশ্বাস আর আস্থা। আমরা দুজনেই এতে নিশ্চিতই লাভবান হব।

তোমার আনা।

.

মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

এখানে সবই সুভালাভালি চলেছে। বাপি এইমাত্র বললেন যে, বিশ তারিখের আগেই রাশিয়া আর ইতালি দুদেশেই, এবং পশ্চিমেও, বড় রকমের যুদ্ধাভিযান শুরু হয়ে যাবে। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা কল্পনা করা আমার পক্ষে দিন দিন দুষ্কর হয়ে উঠছে।

গত দশদিন ধরে পেটারের সঙ্গে যে আলোচনাটা কেবলই করব করব করছিলাম, কাল পেটারের সঙ্গে বসে সেটা সেরে ফেলা গেল। ওকে আমি মেয়েদের ব্যাপারগুলো সব খোলাসা করে বললাম এবং যা সবাইকে বলা যায় না এমন জিনিসও বলতে বাধল না। সন্ধ্যেটা শেষ হল দুজনে দুজনকে চুম্বন করে, আমার ঠিক হাঁ-মুখের পাশেই ওর ঠোটে, সে এক রমণীয় অনুভূতি। কখনও হয়ত আমার ডায়রি নিয়ে ওপরে উঠে যেতে পারি, একটি বার হলেও আমি চাই আরও গভীরে যেতে। দিনের পর দিন শুধু পরস্পরের বাহুবন্ধনে থেকে আমার সুখ হয় না, আমি মনেপ্রাণে চাই ওর সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে।

দীর্ঘ, বিলম্বিত শীতের পর আমাদের এখানে এখন অতুলনীয় বসন্ত; এপ্রিল মাস সত্যিই অসামান্য, খুব গরমও নয় আবার খুব ঠাণ্ডাও নয়। মাঝে মধ্যে ঝিরঝির করে বৃষ্টি। আমাদের চেস্টনাট গাছটা এরই মধ্যে বেশ সবুজাভ হয়ে উঠেছে, এমন কি তাকালে এখানে-সেখানে ছোট্ট ছোট্ট মুকুলও তোমার নজর আসবে।

শনিবার এলি এসে আমাদের যে কী খুশি করে গেলেন! এনেছিলেন চারগোছা ফুল, তিনগোছা নারগিস আর একগোছা কুমুদিনী–শেষেরটা আমার জন্যে।

আমাকে খানিকটা বীজগণিত করতে হবে, কিটি–এখন আসি।

তোমার আনা।

.

বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ১৯৪৪

প্রিয় আমার,

খোলা জানলার ধারে বসে নিসর্গ সুখ অনুভব করা, পাখিদের গান শোনা, দুই গালে রোদ এসে পড়া আর তোমার বাহুডোরে এক প্রিয়জন–এর চেয়ে সুন্দর জিনিস পৃথিবীতে আর আছে নাকি? দুই হাত দিয়ে সে আমাকে ঘিরে রেখেছে–কী স্নিগ্ধ, কী প্রশান্ত সেই অনুভূতি; ও আমার কাছে রয়েছে জেনেও মুখে আমার কোনো কথা নেই; জিনিসটা খারাপ নয়, কেননা এই অচঞ্চলতা কল্যাণকর। আর যেন কখনও কেউ এসে শান্তি ভঙ্গ না করে, এমন কি মুশ্চিও নয়।

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

গলা ছ্যানছেনে হওয়ায় কাল বিকেলে আমি বিছানায় শুয়ে ছিলাম, কিন্তু প্রথম দিন বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং গায়ে জ্বর ছিল না বলে আজ ফের উঠে পড়েছি। ইয়র্কের মহামান্য রাজকুমারী এলিজাবেথের জন্মদিন আজ। বি.বি.সি. বলেছে সাধারণত বয়ঃপ্রাপ্তির ঘোষণা রাজপুত্র-রাজকন্যাদের বেলায় করা হয় বটে, কিন্তু এলিজাবেথের ক্ষেত্রে সেটা এখনও করা হয়নি। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলাম, এই সুন্দরী কোন্ রাজকুমারের গলায় যে মালা দেবে! অনেক ভেবেও যোগ্য কোনো নাম আমরা মনে করতে পারলাম না। হয়ত এলিজাবেথের বোন মারগারেট রোজ-এর সঙ্গে বেলজিয়ামের রাজকুমার বুদুইনের একদা বিয়ে হতে পারে। এখানে আমাদের দুর্ভাগ্যের অন্ত নেই। বাইরের দরজাগুলো মজবুত করতে না করতে ফের মালখানাদার এসে হাজির। যতদূর মনে হয়, এ লোকটিই আলুর গুড়ো গায়েব করে এখন এলির ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছে। গোটা গুপ্ত মহল’ আবার কেন খাপ্পা হয়েছে বোঝা যায়। এলি তো রেগে আগুন।

কোনো পত্রিকা বা কোথাও পাঠিয়ে দেখতে চাই আমার কোনো গল্প ওরা নেয় কিনা পাঠাবো অবশ্যই ছদ্মনামে।

আবার দেখা হবে, প্রিয় আমার।

তোমার আনা।

.

মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি

আজ দশদিন হল ফান ডানের সঙ্গে ডুসেলের ব্যাক্যালাপ নেই। তার একটাই কারণ সিঁদ কাটার পর থেকে নতুন বেশ কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যাতে ডুসেলের অসুবিধে হচ্ছে। ডুসেল বলে বেড়াচ্ছেন যে, ফান ডান ওঁর ওপর চোটপাট করেছে।

ডুসেল আমাকে বললেন, ‘এখানে যা হয় সব উল্টোপাল্টা। আমি যাচ্ছি, তোমার বাবাকে এ নিয়ে বলব।’ শনিবার বিকেলগুলোতে আর রবিবারগুলোতে নিচের তলার অফিসে এখন আর ওঁর বাবার কথা নয়; কিন্তু তাও উনি দিব্যি বসছেন। ফান ডান চটে লাল, বাবা নিচের তলায় গিয়েছিলেন কথা বলতে। স্বভাবতই উনি বানিয়ে বানিয়ে অজুহাত দেখালেন, কিন্তু এবার এমন কি বাবাকেও বোকা বানাতে পারলেন না। বাবা এখন পারতপক্ষে ওঁর সঙ্গে কথা বলেন না, কারণ ডুসেল ওকে অপমান করেছিলেন। কি ভাবে আমরা তা কেউই জানি না। তবে খুবই যে খারাপ ভাবে তাতে সন্দেহ নেই।

আমি একটা সুন্দর গল্প লিখেছি। নাম ঠুলিরাম গবেষক’। যে তিনজনকে পড়ে শুনিয়েছি, তারা বেজায় খুশি।

তোমার আনা।

.

বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আজ সকালে মিসেস ফান ডানের এমন মেজাজ খারাপ ছিল কী বলব। কেবল নালিশ, কেবল নালিশ।

প্রথম তো ওঁর সর্দি; চুষবেন যে, সে ওষুধ পাচ্ছেন না এবং নাক ঝাড়তে ঝাড়তে ওঁর জান কয়লা। তারপর, রোদের দেখা নেই, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

ওঁর কথায় আমরা না হেসে পারিনি; আমুদে বলে উনিও তাতে যোগ দেন। ঠিক এখন আমি পড়ছি গোটিঞ্জেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের লেখা ‘সম্রাট পঞ্চম চার্লস’; বইটি তাঁর চল্লিশ বছরের পরিশ্রমের ফল।

পঞ্চাশ পৃষ্ঠা পড়তে আমার পাঁচদিন লেগেছে; তার বেশি পড়া সম্ভব নয়। ৫৯৮ পৃষ্ঠার বই; সুতরাং এখন হিসেব করলে জানতে পারবে বইটি শেষ করতে আমার কতদিন লাগবে এর পর রয়েছে দ্বিতীয় খণ্ড। কিন্তু পড়তে খুব আগ্রহ লাগে।

মাত্র একদিনে একটি স্কুলের মেয়ের জ্ঞানলাভের একবার বহর দেখ। আমাকেই ধরো, কেন। প্রথমত, ডাচ থেকে নেলসনের শেষ লড়াই নিয়ে লেখা একটি রচনা আমি ইংরেজিতে তর্জমা করেছি। এরপর নরওয়ে (১৭০০-১৭২১), দ্বাদশ চার্লস, বলবান অগাস্টাস, স্তানিস্লাভ লেজিস্কি, মাসেপা, ফন গ্যোৎস, ব্ৰাণ্ডেনবুর্গ, পোমেরানিয়া আর ডেনমার্কের বিরুদ্ধে পিটার দি গ্রেটের যুদ্ধ এবং সেই সঙ্গে যেটির যা তারিখ।

এরপর অবতরণ করলাম ব্রাজিলে; পড়লাম বাহিয়া তামাক, কফির প্রাচুর্য এবং রিওদা জানেরো, পেনামবুকো আর সাও-পাউলোর পনেরো লক্ষ অধিবাসীদের কথা। সেই সঙ্গে আমাজন নদীর বৃত্তান্ত; নিগ্রো, মুলাটো, মেসূতিজো, শ্বেতাঙ্গ; জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি নিরক্ষর; আর ম্যালেরিয়ার কথা।

হাতে তখনও সময় থাকায় চটপট একটা বংশপঞ্জীতে চোখ বুলিয়ে গেলাম। অগ্রজ ইয়ান, ভিলেম লোডাভিক, প্রথম আর্ন কাসিমির, হেরিক কাসিমির থেকে নেমে এসে ক্ষুদে মারগ্রিট ফ্রান্সিসকা (ওটাওয়াতে ১৯৪৩ সালে জন্ম) পর্যন্ত।

বারোটায় চিলেকোঠায়, গির্জার ইতিহাস সংক্রান্ত পড়াশুনো চালিয়ে গেলাম–ফুঃ! বেলা একটা অবধি।

ঠিক দুটোর পর, বেচারা আবার বসল বই নেয়ে (হুঁ-উঁ, হুঁ-উঁ), এবার তার পড়ার বিষয় টিকোলো নাকের আর থ্যাবড়া নাকের বানর কুল। কিটি, বলো তো চটপট–জলহস্তীর পায়ে কয়টা করে আঙুল আছে।

তারপর বাইবেল এল, নোয়া আর নেওকোটি, শেম, হাম আর জাফেৎ! এরপর পঞ্চম চার্লস। তারপর পেটারের সঙ্গে বসে–ইংরিজিতে থ্যাকারের ‘দি কার্নেল’। ফরাসী ক্রিয়াপদগুলো আওড়ানোর পর মিসিসিপির সঙ্গে মিসৌরির তুলনা করলাম।

আমার সর্দি এখনও সারেনি; মারগট আর সেই সঙ্গে মা-মণি আর বাপিরও আমার ছোঁয়া লেগেছে। পেটারের এখন না রাগলেই বাঁচি। পেটার আমাকে ওর ‘এলডোরাডো’ বলে ডেকে একটা চুমো চেয়েছিল। অবশ্যই আমি পারিনি। ছেলেটা যা মজার। কিন্তু হলেও, ও আমার বড় প্রিয়।

আজ ঢের হয়েছে; থাক। আসি।

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল, ১৯৪৪

আদরের কিটি

পেটার ভেসেলকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম (জানুয়ারির গোড়ায় দেখ), কখনও ভুলিনি। সে কথা চিন্তা করলে আমি এখনও অনুভব করতে পারি সে আমার গালে গাল রেখেছে; যে সুন্দর অনুভূতিটা সব কিছু রাঙিয়ে দিয়েছিল আমি তখন যেন তা মনের মধ্যে ফিরে পাই।

পেটারের বেলায়ও মাঝে মাঝে আমার একই রকম অনুভূতি হয়, কিন্তু তার ব্যাপ্তি কখনই অতটা নয়। কাল অন্য ব্যাপার হল। রোজকার মতো হাত দিয়ে পরস্পরের কোমর জড়িয়ে আমরা ডিভানে বসে ছিলাম। তারপর হঠাৎ দেখি সাধারণ যে আনা সে সরে পড়েছে এবং এসে তার জায়গা নিয়েছে দ্বিতীয় আনা; এই আনা বেপরোয়া আর পরিহাসপ্রিয় নয় এ শুধু চায় ভালবাসতে আর নম্র হতে।

আমি ওর গায়ে শক্ত সেঁটে রইলাম। আবেগের ঢেউ এসে আমার ওপর আছড়ে পড়ল, আমার চোখ দিয়ে ঝরতে লাগল অশ্রুর নিঝর, আমার বা চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল ওর মোটা সুতির জামায়, ডান চোখের পানি আমার নাক বেয়ে ওর গায়ে। ও কি টের পেয়েছিল? ও নড়ল না এবং এমন কোনো চিহ্নও দেখাল না যাতে ও টের পেয়েছে সেটা বোঝা যায়। কে জানে ও ঠিক আমার মতোই অনুভব করে কিনা! ও প্রায় কোনোই কথা বলেনি। ও কি জানে যে, ওর সামনে আনা আছে দুটো? এসব প্রশ্নের কখনই কোনো উত্তর মিলবে না।

সাড়ে আটটায় আমি উঠে পড়ে জানালায় গেলাম; আমরা সবসময় এই জায়গায় ‘আসি’ বলে বিদায় নিই। আমি তখনও কাপছিলাম, তখন আমি দুই নম্বর আনা। পেটার আমার দিকে আসতে আমি দুই হাতে ওর গলা জড়িয়ে ওর বাম গালে একটা চুমো একে দিয়ে অন্য গালে চুমো খেতে যাব, এমন সময়ে আমার ঠোটে ওর ঠোট ঠেকে যাওয়ায় আমরা একসঙ্গে চাপ দিলাম। ঝট করে ঘুরে আমরা পরস্পরের আলিঙ্গনবদ্ধ হতে লাগলাম বার বার, কেউ কাউকে আমরা আর ছাড়তে রাজী নই। সত্যি স্নেহমমতা পেটারের এত বেশি দরকার। জীবনে সে এই প্রথম একটি মেয়েকে আবিষ্কার করেছে, এই প্রথম দেখেছে যে, এমন কি সবচেয়ে গা-জ্বালানো মেয়েদেরও একটা অন্য দিক থাকে, তাদের হৃদয় আছে এবং যখন তুমি তাদের নিয়ে একা থাকো তখন তারা অন্য মানুষ। পেটার জীবনে এই প্রথম স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে দিয়েছে এবং এর আগে কখনই তার ছেলে বা মেয়ে বন্ধু না থাকায় সে আসলে যা, সেটাকেই সে প্রকাশ করেছে। এবার আমরা পরস্পরকে খুঁজে পেয়েছি। বলতে কি, আমিও ওকে চিনতাম না; ওর যেমন কখনই কোনো বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল না, তেমনি। আর আজ পানি কোথায় এসে গড়িয়েছে…

একটি প্রশ্ন আবারও আমাকে জ্বালিয়ে মারছে–এটা কি ঠিক? আমি যে এত আগে ধরা দিয়েছি, আমি যে এত উন্মত্ত, পেটার ঠিক নিজে যতটা উন্মত্ত আর ব্যাকুল ততটাই–এটা কি হওয়া উচিত? আমি একজন মেয়ে হয়ে, নিজেকে কি এই পর্যায়ে টেনে নামাতে দিতে পারি?’ এর একটাই উত্তর—‘আমি কত দীর্ঘদিন কত যে অপেক্ষা করেছি–আমি এত নিঃসঙ্গ–এতদিনে খুঁজে পেয়েছি সান্ত্বনা।’

সকালগুলোতে আমাদের আচরণ হয় মামুলি গোছের, বিকেলগুলোতে কম-বেশি তাই (ব্যতিক্রম শুধু মাঝে মধ্যে); কিন্তু সন্ধ্যেগুলোতে সারাদিনের চাপা বাসনা, পূর্বতন সময়গুলোর সুখস্মৃতি হুস্ করে ভেসে ওঠে এবং তখন আমাদের ভাবনায় দুজনের কাছে শুধু দুজন।

প্রতি সন্ধ্যার শেষে চুম্বনের পর আমার ভালো লাগে ছুটে পালাতে, ওর চোখের দিকে আর না তাকাতে ভালো লাগে একা অন্ধকারে দূরে চলে যেতে।

সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আমি কিসের মুখে পড়ব? জ্বলজ্বলে আলো, কোথায় কেন, হোহো-হিহি; মুখের ভাব প্রকাশ না করে আমাকে সব গিলতে হবে। আনা আসলে নম্র, বাইরে সেটা বিশেষ দেখায় না; সুতরাং কারো তাড়ায় নিজেকে সে হঠাৎ পেছনে পড়ে যেতে দেবে না। একমাত্র আমার স্বপ্ন বাদে–পেটার ছাড়া আর কেউ এত গভীরভাবে আমার আবেগকে স্পর্শ করেনি। পেটার আমাকে একেবারে সম্পূর্ণভাবে কজা করে ফেলেছে; না বললেও এটা নিশ্চয়ই বোঝা যায় যে, এমন একটা ওলটপালটের পর সামলে ওঠার জন্যে যে কারো একটু বিশ্রাম এবং একটু সময় চাই।

পেটার গো, আমাকে এ কী করেছ তুমি? আমার কাছে তুমি কী চাও? এরপর কী আমাদের পরিণতি? এখন হ্যাঁ, এইবার আমি এলিকে বুঝতে পারছি। এখন নিজে আঙুল পুড়িয়ে বুঝতে পারছি এলির কেন সংশয়। আমি যদি আরও বড় হতাম এবং পেটার যদি আমাকে বিয়ে করতে চাইত, আমি তাকে কী উত্তর দিতাম? আনা, বুকে হাত দিয়ে তুমি বল। তুমি ওকে বিয়ে করতে পারতে না, কিন্তু এও ঠিক, ওকে ছাড়াও তোমার পক্ষে কঠিন হত। পেটারের এখনও আশানুরূপ চরিত্র নেই, নেই যথেষ্ট ইচ্ছাশক্তি, সাহস আর শক্তিও বড় কম। এখনও অন্তরের অন্তস্থলে সে একজন শিশু, আমার চেয়ে আদৌ বড় নয়। তার অন্বিষ্ট শুধু প্রশান্তি আর সুখ।

আমার বয়স কি মাত্র চৌদ্দ? আমি কি আদতে এখনও ইস্কুলের বেকুব ছোট্ট মেয়ে? আমি কি সব কিছু সম্পর্কে এতই আনাড়ি? খুব কম মিলবে যার আমার মতো এত অভিজ্ঞতা। আমার বয়সী বোধহয় এমন কাউকেই পাওয়া যাবে না যাকে আমার মত এতকিছুর ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। নিজের সম্বন্ধে আমার ভয় হচ্ছে, আমি ভয় পাচ্ছি অধীর হয়ে পড়ে বড় তাড়াতাড়ি নিজেকে আমি দিয়ে ফেলছি। পরে অন্য ছেলেদের বেলায় কখনও এটা কি শোধরাবে? সমস্ত সময় নিজের হৃদয় আর যুক্তির সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়া যে কী দুঃসাধ্য বলার নয়; সময় এলে যখন বলার প্রত্যেকে বলবে, কিন্তু আমি কি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ যে, ঠিক সময়ই আমি বেছেছি?

তোমার আনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *