০৫. ডায়রির কিছু কিছু পাতা

রবিবার, ২ জানুয়ারি, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আজ সকালে কিছু করবার না থাকায় আমার ডায়রির কিছু কিছু পাতা উল্টাচ্ছিলাম। বেশ কয়েবার চোখে পড়ল ‘মা-মণি’র বিষয়ে লেখা চিঠিগুলো এমন মাথা গরম করে চিঠিগুলো লেখা হয়েছে যে, আমি পড়ে রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলাম—‘আনা, ঘৃণার কথা এই যে বলেছো এ কি প্রকৃতই তুমি? ইস্, এ তুমি কী করে পারলে, আনা?’ খোলা পাতা সামনে নিয়ে বসে আছি। এ বিষয়ে ভাবছিলাম যে, কী করে আমার মধ্যে এ রকম ক্রোধ উপচে পড়ল এবং সত্যিই ঘৃণার মতন এমন জিনিসে মন ভরে উঠল যে, তোমাকে সব কিছু গোপনে না বলে পারলাম না। এক বছর আগের আনাকে আমি বুঝতে এবং তার অপরাধ মার্জনা করতে চেষ্টা করছি, কেননা কিভাবে তা ঘটল সেটা পেছনে তাকিয়ে যতক্ষণ না ব্যাখ্যা করতে পারছি, ততক্ষণ এইসব অভিযোগ তোমার কাছে ফেলে রেখে আমার বিবেক শান্তি পাবে না।

আমার মনের অবস্থা হয়েছিল যেন (বলতে গেলে) ডুবে যাওয়ার মতন। ফলে, সবকিছু আমি শুধু নিজেকে দিয়ে দেখছিলাম; আমি অন্যপক্ষের কথাগুলো নির্বিকারচিত্তে বিচার করতে পারিনি; মাথা গরম করে মেজাজ দেখিয়ে যাদের আমি চটিয়েছি কিংবা মনে আঘাত দিয়েছি, সেইভাবে তাদের কথার আমি জবাব দিতে পারিনি।

নিজের মধ্যে আমি নিজেকে আড়াল করেছি, শুধুমাত্র নিজেরটা দেখেছি আর আমার ডায়রিতে চুপচাপ লিখে রেখেছি আমার যত সুখ-দুঃখ আর ঘৃণার কথা। আমার কাছে এই ডায়রির অনেক মূল্য, কেননা অনেক জায়গায় এই ডায়রি হয়ে উঠেছে আমার স্মৃতিকথার বই, কিন্তু বেশ অনেক পৃষ্ঠাতেই আমি লিখে দিতে পারতাম ‘অতীতের কথা চুকেবুকে গেছে।’

এক সময়ে আমি মা-মণির ওপর প্রচণ্ড রেগে যেতাম, এখনও মাঝে মাঝে রেগে যাই। মা-মণি আমাকে বোঝেন না এটা ঠিক, কিন্তু আমিও তো ওঁকে বুঝি না। আমাকে তিনি ভালবাসতেন খুবই, স্নেহের ঘাটতি ছিল না, কিন্তু আমার দরুন এত রকমের অপ্রীতিকর অবস্থায় ওকে পড়তে হয়েছে, সেইসঙ্গে অন্যান্য দুশ্চিন্তা আর মুশকিলের জন্যে ওঁকে এমন ভয়ে ভয়ে থাকতে হত এবং ওঁর মেজাজ এমন তিরিক্ষে হয়ে থাকত যে, এটা স্পষ্ট বোঝাই যায় কেন উনি আমাকে দাতঝাড়া দিতেন।

আমি সে জিনিসটাতে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতাম, মনে মনে ক্ষুণ্ণ হতাম এবং মা-মণির প্রতি রূঢ় ব্যবহার করে তাকে আরও চটিয়ে দিতাম; এই সবের ফলে আবার মা-মণির মন। খারাপ হত। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে সমস্ত সময় এটা হত অশান্তি আর দুঃখকষ্টের ঘাত প্রতিঘাত। দুজনের কারো পক্ষেই সেটা ভালো ছিল না, তবে সেটা কেটে যাচ্ছে।

আমি এসব সম্পর্কে চোখ বুজে থেকে নিজের মনে অসম্ভব দুঃখ পেয়েছি। তবে তারও মানে বোঝা যায়। খুব রাগ হলে সাধারণ জীবনে আমরা বদ্ধ ঘরে বার দুই দুম দুম করে পা ঠুকে কিংবা আড়ালে মা-মণিকে এটা-ওটা বলে গায়ের ঝাল ঝেড়ে নিতে পারি–কাগজে ঐ রকম চড়াগলায় চোটপাটের ব্যাপারটাও তাই।

আমার জন্যে মা-মণির চোখের পানি ফেলার পর্যায় শেষ হয়ে গেছে। আগের চেয়ে এখন আমার জ্ঞানবুদ্ধি বেড়েছে, মা-মণিও এখন আগের মত একটুতেই চটে যান না। বিরক্ত হলে আমি সাধারণত মুখ বুঝে থাকি, মা-মণিও তাই করেন; কাজেই লোকে দেখে, আমরা দুজনে আগের চেয়ে ঢের বেশি মানিয়ে চলছি। পরাধীন শিশুর মত করে মা-মণিকে আমি সত্যি ভালবাসতে পারি না। আমার মধ্যে সে ভাব আদৌ নেই।

মনে মনে এই বলে আমি আমার বিবেককে শান্ত করি যে, মা-মণি তার হৃদয়ে বহন করার চেয়ে কড়া কথাগুলো কাগজে থেকে যাওয়াই ভালো।

তোমার আনা।

.

বুধবার, ৫ জানুয়ারি, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আজ আমি তোমার কাছে দুটো জিনিস কবুল করব। তাতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে। কাউকে আমায় বলতেই হবে, সেদিক থেকে তোমাকে বলাই সবচেয়ে ভালো। কেননা যতদূর জানি, যে অবস্থাই আসুক, তুমি সব সময় গোপন কথা রক্ষা করো।

প্রথমটা মা-মণিকে নিয়ে। তুমি জানো, মা-মণির ব্যাপারে আমি প্রচুর গজগজ করেছি তবু নতুন করে আমি চেষ্টা করেছি তার মন পেতে। আজ হঠাৎ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি তার মধ্যে কিসের অভাব। মা-মণি নিজেই আমাদের বলেছেন যে, আমাদের তিনি মেয়ের চেয়ে বেশি করে বন্ধু হিসেবে দেখেন। তা সে সব খুব ভালো কথা। কিন্তু তবু মায়ের স্থান কখনও বন্ধু নিতে পারে না।

আমি একান্তভাবে চাই আমার মা হবেন এমন এক আদর্শ–যাকে আমি অনুসরণ করতে পারি, আমি চাই যাতে তাকে আমি ভক্তিশ্রদ্ধা করতে পারি। আমার মনে হয়, মারগট এসব জিনিস অন্য ভাবে দেখে এবং আমি তোমাকে যা বললাম ও কখনই তা অনুধাবন করতে পারবে না। আর বাপি তো মা-মণির ব্যাপারে কোনো রকম বাদানুবাদে যেতে রাজী নন।

আমার ধারণায়, মা হবেন এমন একজন স্ত্রীলোক বিশেষত নিজেরই সন্তানদের ব্যাপারে যিনি প্রথমত যথেষ্ট বিবেচনার পরিচয় দেবেন— যখন তারা আমাদের বয়সে পৌঁছবে এবং আমি চেঁচামেচি করলে–ব্যথায় নয়, অন্য সব ব্যাপারে–উনি তা নিয়ে আমাকে ঠাট্টা করবেন না, মা-মনি যা করে থাকেন।

আমি কখনই ভুলতে পারিনি তার একটা জিনিস, যেটা হয়ত খানিকটা বোকামি বলে মনে হবে। আমাকে একদিন দাঁতের ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছিল।

মারগটকে নিয়ে মা-মণি যাচ্ছিলেন আমার সঙ্গে; আমি সাইকেল নিয়ে যাব বলতে ওঁরা রাজী হলেন। দাঁতের ডাক্তার সেরে, যখন আমরা বাইরে বেরোলাম–মারগট আর মা-মণি বললেন ওরা শহরের বাজারে যাবেন কী একটা জিনিস দেখতে কিংবা কিছু একটা কিনতে ঠিক কী জন্যে আমার মনে নেই।

আমিও যেতে চাইলে ওঁরা আমাকে নিয়ে যেতে রাজী হলেন না। কেননা আমার সঙ্গে সাইকেল ছিল। রাগে আমার চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এল; তাই দেখে মারগট আর মা মণি আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলেন। তাতে আমি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওদের জিভ ভেঙাতে লাগলাম–ঠিক সেই সময় এক বৃদ্ধা সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন, আমার কাণ্ড দেখে তার চক্ষু ছানাবড়া! সাইকেল করে বাড়ি ফিরে এসে, আমার মনে আছে, আমি অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছিলাম।

সেদিন বিকেলে কী ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম, এটা যখন ভাবি, আশ্চর্য, আমার প্রাণে মা-মণির দুঃখ দেয়া ব্যাপারটা এখনও বুকের মধ্যে খচখচ করে। দ্বিতীয় জিনিসটা তোমার কাছে ব্যক্ত করা খুব কঠিন, কেননা ব্যাপারটা আমার নিজেকে নিয়ে।

লজ্জায় লাল হওয়ার বিষয়ে মিস্ হেপ্টারের লেখা একটা প্রবন্ধ পড়লাম কাল। প্রবন্ধটা ব্যক্তিগত ভাবে আমার উদ্দেশ্যে লেখা হতে পারত।

যদিও খুব সহজে আমি লজ্জায় লাল হই না, তাহলেও প্রবন্ধের অন্যান্য জিনিস আমার ক্ষেত্রে সমস্তই খাপ খেয়ে যায়। ভদ্রমহিলা যা লিখেছেন মোটামুটি ভাবে তা এই রকম বয়ঃসন্ধির বছরগুলোতে মেয়েরা ভেতরে ভেতরে চুপচাপ হয়ে পড়ে এবং তাদের শরীরে যে অবাক কাণ্ড ঘটছে তাই নিয়ে ভাবতে থাকে।

আমিও দেখছি তা ঘটছে এবং সেই জন্যে মারগট, মা-মণি আর বাপির ব্যাপারে ইদানীং আমি কেমন যেন সঙ্কোচ বোধ করছি। মজার বিষয়, আমার চেয়ে মারগট অত যে লাজুক, ও কিন্তু আদৌ সঙ্কোচ বোধ করে না।

আমার যেটা হচ্ছে আমি মনে করি সে এক অদ্ভুত ব্যাপার, এবং শুধু যে শরীরে তা ফুটে উঠেছে তাই নয়, আমার ভেতরেও তার যাবতীয় ক্রিয়া চলেছে। নিজের বিষয়ে কিংবা এর একটা কিছু নিয়েও কারো সঙ্গে আমি আলোচনা করি না; সেইজন্যে এই সব প্রসঙ্গ নিয়ে আমাকে নিজের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

প্রত্যেকবার যখনই আমার মাসিক হয়–এটা হয়েছে মোটে তিন বার সমস্ত ব্যথা, অস্বস্তি এবং কদর্যতা সত্ত্বেও, আমার কেমন যেন মনে হয় আমার একটা মধুর রহস্য আছে, তাই একদিক থেকে দেখলে এটা আমার কাছে নিছক একটা উৎপাত হওয়া সত্ত্বেও, আমি বারবার সেই সময়টার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকি যখন আমার মধ্যে আমি আবার অনুভব করব সেই রহস্য।

মিস হেস্টর এও লিখেছেন যে, এই বয়সের মেয়েদের খুব একটা মনের জোর থাকে না, এবং তারা যে নিজস্ব ধ্যানধারণা এবং প্রকৃতিযুক্ত একেকটি ব্যক্তিসত্তা–এটা তাদের চোখে ধরা পড়ে।

এখানে আসার পর আমার বয়স যখন সবে চৌদ্দ, অন্য বেশির ভাগ মেয়ের আগেই আমি নিজের সম্পর্কে ভাবতে এবং আমি যে একজন ব্যক্তি এটা বুঝতে শুরু করি। মাঝে মাঝে, রাতের বেলায় বিছানায় শোয়ার পর স্তনযুগলে হাত দিতে এবং হৃদপিণ্ডের নিঃশব্দ স্পন্দন শুনতে আমার প্রচণ্ড ইচ্ছে হয়।

এখানে আসার আগেই অবচেতনভাবে এই ধরনের জিনিস আমি অনুভব করেছি, কেননা আমার মনে আছে একবার এক মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে শুয়ে থাকতে থাকতে আমার ওকে চুমো খাওয়ার প্রবল বাসনা হয়েছিল এবং চুমো আমি খেয়েছিলাম। তার শরীর সম্পর্কে আমি প্রচণ্ড কৌতূহল বোধ না করে পারিনি, কেননা সে তার শরীরকে সবসময় আমার কাছ থেকে গোপন করে রাখত।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাদের বন্ধুত্বের প্রমাণস্বরূপ, আমরা পরস্পরের স্তন। স্পর্শ করতে পারি কিনা, কিন্তু সে তাতে রাজী হয়নি।

যখনই কোনো নগ্ন নারীমূর্তি দেখি, যেমন ভেনাস, আনন্দে আমি মাতোয়ারা হই। আমার কাছে এত বিস্ময়কর, এত অপরূপ বলে মনে হয় যে অনেক চেষ্টা করেও আমি চোখের পানি সামলাতে পারি না।

তোমার আনা।

.

বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারি, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

কারো সঙ্গে কথা বলার বাসনা আমার মধ্যে এমন তীব্র হয়ে উঠেছিল যে, কিভাবে যেন পেটারকে বেছে নেওয়ার কথা আমার মাথায় ঢুকেছিল।

কখনও কখনও দিনের বেলায় ওপরতলায় পেটারের ঘরে গেলে আমার সব সময়ই জায়গাটা খুব আরামদায়ক বলে মনে হত, কিন্তু পেটার এমন ভালোমানুষ বলে এবং কেউ এসে উৎপাত করলেও তাকে সে কখনই ঘর থেকে বের করে দেবে না বলে আমি কখনই সাহস করে বেশিক্ষণ থাকিনি, কেননা আমার ভয় হত ও হয়ত বিরক্ত বোধ করবে। আমি চেষ্টা করলাম ওর ঘরে বসে থাকার একটা অছিলা বের করে ওকে দিয়ে যাতে কথা বলাতে পারি করতে হবে এমনভাবে যাতে বিশেষ টের না পায়। কাল আমার সেই সুযোগ জুটে গেল। পেটারের এখন বাতিক ক্রসওয়ার্ড পাজল; আর প্রায় কিছুই সে করে না। আমি ওকে ক্রসওয়ার্ডে সাহায্য করলাম এবং অচিরেই ওর ছোট্ট টেবিলে আমার মুখোমুখি হয়ে বসলাম পেটার চেয়ারে আর আমি ডিভানে।

যতবারই আমি ওর গভীর নীল চোখের দিকে তাকাই, ততবারই আমার কেমন একটা অনুভূতি হয়; ঠোটের চারদিকে সেই রহস্যময় হাসি খেলিয়ে পেটার বসে। আমি তার মনোগত ভাবনাগুলো ধরতে পারছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম তার মুখচোখে একদিকে আচার আচরণ নিয়ে অসহায়তা আর সংশয়ের ভাব এবং অন্যদিকে একই সঙ্গে সে যে পুরুষমানুষ এই চেতনার আভাষ। আমি তার সলজ্জ হাবভাব লক্ষ্য করে খুব নরম হয়ে পড়েছিলাম; আমি তার নীল চোখ দুটোর দিকে বার বার না তাকিয়ে পারছিলাম না আর সর্বান্তঃকরণে আমি প্রায় তার কাছে যাথা করছিলাম আমাকে তুমি বলো গো, তোমার মনের মধ্যে কী হচ্ছে এই হজরং-বজরং কথার বাইরে কি তোমার দৃষ্টি যায় না?

কিন্তু সন্ধ্যেটা কেটে গেল, কিছুই হল না; আমি তাকে শুধু লজ্জায় লাল হওয়ার ব্যাপারটা বলেছিলাম–আমি লিখেছি স্বভাবতই তা বলিনি। বলেছি শুধু এইটুকু–যেটাকে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে সে আরও বেশি বল পায়।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে পরে আমি ভেবেছি। আমার খুব আশাব্যঞ্জক মনে হয়নি এবং পেটারের অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে হবে এটা আমার কাছে একেবারে অসহ্য বলে মনে হচ্ছিল। নিজের বাসনা চরিতার্থ করার জন্যে একজন অনেক কিছু করতে পারে, আমার ক্ষেত্রে সেটা নিশ্চয়ই বড় হয়ে উঠেছিল; কেননা আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম যে, আবারও ঘন ঘন আমি পেটারের কাছে গিয়ে বসব এবং এ-ও-তা নিয়ে আমি ওকে কথা বলাব।

আর যাই করো, তুমি যেন তাই বলে ধরে নিও না যে, আমি পেটারের প্রেমে পড়েছি। একেবারেই নয়! ফান ডানদের ছেলের বদলে যদি মেয়ে থাকত তাহলে তার সঙ্গেও বন্ধুত্ব পাতাতে আমি চেষ্টা করতাম।

আজ সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙল, তখন প্রায় সাতটা বাজতে পাঁচ। তৎক্ষণাৎ খুব স্পষ্ট আকারে মনে পড়ল স্বপ্নে আমি কী দেখেছি। …আমি একটা চেয়ারে বসে আছি আর আমার ঠিক সামনে বসে পেটার…ভেনেল। মারি বস-এর আঁকা একটি ছবির বই আমার দুজনে মিলে দেখছি। স্বপ্নটা এত জীবন্ত যে, কিছু কিছু ছবি এখনও আমার চোখে ভাসছে। কিন্তু সেটাই সব নয়–স্বপ্নটা দেখে যেতে লাগলাম। হঠাৎ পেটারের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল; আমি অনেকক্ষণ ধরে ওর সুন্দর মখমলের মতো বাদামী চোখের দিকে চেয়ে রইলাম। পেটার তখন খুব নরম করে বলল, ‘আগে জানলে অনেক আগেই আমি তোমার কাছে চলে আসতাম।’ আমি আবেগ সামলাতে না পেরে ঝট করে মুখ সরিয়ে নিলাম। এরপর আমি বুঝলাম আমার গালে একটা স্নিগ্ধ মমতাময় গাল এসে ঠেকল। আমার কী যে ভালো লাগল, কী ভালো যে লাগল…।

ঠিক এই সময় আমার ঘুম ভেঙে গেল, তখনও আমার গালে লেগে রয়েছে তার গালের স্পর্শ; আমার হৃদয়ের গভীরে, এত গভীরে তার বাদামী চোখের চাহনি আমি অনুভব করছি যে, সেখানে সে দেখতে পাচ্ছে তাকে আমি কতটা ভালবেসে ছিলাম এবং এখনও কতখানি ভালবাসি। আরও একবার আমার চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এল; তাকে আবার হারিয়ে ফেলে আমার মন বিষাদে ভরে গেল; সেই সঙ্গে ভালোও লাগল; কেননা এর ফলে এ বিষয়ে আমি কৃতনিশ্চয় হলাম যে পেটার এখনও আমার কাছে বরণীয়।

এটা অদ্ভুত, এখানে আমি প্রায়ই আমার স্বপ্নে সব যেন জীবন্ত দেখতে পাই। প্রথম আমি এক রাত্রে দিদিমাকে এত স্পষ্ট দেখতে পাই যে, আমি তার পুরু তুলতুলে কোঁচকানো মখমলের মতো গায়ের চামড়া পর্যন্ত যেন আলাদা করতে পারছিলাম। এরপর দিদিমা দেখা দেন বিপত্তারিণী পরীর মতন; তারপর আসে লিস্। ও আমার কাছে আমার সমস্ত মেয়ে বন্ধু এবং ইহুদীর লাঞ্ছনার প্রতীক। ওর জন্যে যখন আমি সৃষ্টিকর্তাকে ডাকি, তখন আমার সেই প্রার্থনা হয় সকল ইহুদী এবং সকল আর্তের জন্যে। আর এখন এল পেটার, আমার প্রাণাধিক পেটার–এর আগে আমার মানসপটে তার এত স্পষ্ট ছবি কখনও ছিল না। আমার কাছে তার ফটোর কোনো দরকার নেই, আমি তাকে আমার মনশ্চক্ষে দেখতে পাই এবং কী সুন্দরভাবে।

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ৭ জানুয়ারি, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আমি কী বোকা গাধা। আমি একেবারে ভুলে বসে আছি যে, আমি আমার নিজের এবং আমার তাবৎ ছেলে-বন্ধুদের ইতিহাস তোমাকে কখনও বলিনি।

যখন আমি নিতান্তই ছোট–কিন্ডারগার্টেনের গণ্ডীও যখন ছাড়াইনি–কারেল সামসনের প্রতি আমার টান হয়। ওর বাবা মারা গিয়েছিলেন; মাকে নিয়ে সে তার এক মাসীর কাছে থাকত। কারেলের এক মাসতুতো ভাই ছিল, তার নাম রবী; ছেলেটি ছিল রোগা, সুশ্রী, গায়ের রং একটু চাপা। কারেল ছিল ছোটখাটো, কৌতুকপ্রিয়। কারেলের চেয়ে রবীকে নিয়ে সবাই বেশি আদিখ্যেতা করত। কিন্তু আমি চেহারা জিনিসটাকে আমল দিতাম না; বেশ কয়েকবছর আমি কারেলের খুব অনুরক্ত ছিলাম।

আমরা বিস্তর সময় প্রায়ই একসঙ্গে কাটাতাম, কিন্তু সে ছাড়া, আমার ভালবাসার প্রতিদান পাইনি। এ এরপর পেটারকে পেলাম; ছেলেমানুষের মতো আমি সত্যিই প্রেমে পড়লাম। আমাকেও সে খুব পছন্দ করত এবং একটি পুরো গ্রীষ্ম আমরা পরস্পর অচ্ছেদ্যভাবে কাটালাম। এখনও মনে পড়ে, দুজনে হাত ধরাধরি করে আমরা একসঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি; পেটারের পরনে একটা সাদা স্যুট আর আমি পরেছি গরমকালের খাটো পোশাক। গরমের ছুটির পর পেটার গিয়ে ভর্তি হল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শ্রেণীতে আর আমি নিম্নতর বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীতে। ইস্কুল থেকে ও আসত আমার কাছে, আমিও তেমনি যেতাম। দুজনের দেখা হত। পেটার ছেলেটা ছিল খুব প্রিয়দর্শন, লম্বা, সুন্দর আর ছিপছিপে; অমায়িক, শান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। কালো চুল, আশ্চর্য বাদামী চোখ, রক্তিম গাল আর টিকোলো নাক। সবচেয়ে বড় কথা, আমাকে মাত করে দিত ওর হাসি–ওকে তখন এমন মিচকে শয়তানের মতো দেখাতো।

ছুটিতে আমি গ্রামে গিয়েছিলাম; ফিরে এসে দেখি–পেটার যেখানে থাকত সেখান থেকে উঠে গেছে; ঐ একই বাড়িতে থাকত পেটারের চেয়ে বয়সে ঢের বড় একটি ছেলে। সম্ভবত পেটারকে সে এটা বুঝিয়েছিল যে, আমি হলাম একজন বাচ্চা ক্ষুদে শয়তান এবং সেই শুনে পেটার আমাকে ত্যাগ করে। আমি পেটারকে এত বেশি ভক্তি-শ্রদ্ধা করতাম যে, প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হতে আমার মন চায়নি। আমি তাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পরে আমার খেয়াল হল যে, আমি যদি এভাবে তার পেছনে ছুটি, তাহলে শীগগিরই লোকে আমাকে ছেলে-ধরা বলে বদনাম দেবে। বছরগুলো চলে গেল। তার মধ্যে পেটার তার সমবয়সী মেয়েদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, একবার ডেকে আমার খবর নেওয়ার কথাও তার মনে হয় না। আমি কিন্তু তাকে ভুলতে পারিনি।

আমি চলে গেলাম ইহুদীদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। আমাদের ক্লাসের প্রচুর ছেলে আমার সঙ্গ পাওয়ার জন্য উদগ্রীব–তাতে আমার মজা লাগত, ইজ্জত বাড়ত, কিন্তু অন্যদিকে থেকে সেসব আদৌ আমার মন স্পর্শ করত না। এরপর একটা সময়ে হ্যারি আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। কিন্তু তোমাকে তো আগেই বলেছি আমি আর কখনো কারো প্রেমে পড়িনি।

কথায় বলে, ‘সময় সব ব্যথা ভুলিয়ে দেয়,’ আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। আমি ধারণা করেছিলাম পেটারকে আমি ভুলে গিয়েছি, তার প্রতি আমার আর এতটুকুও টান নেই। তবু তার স্মৃতি আমার অবচেতন মনে খুব প্রবলভাবে থেকে গিয়েছিল; মাঝে মাঝে আমি নিজের কাছে কবুল করতাম যে, অন্য মেয়েগুলোকে আমি হিংসে করি; আর সেই জন্যেই হ্যারিকে আমার পছন্দ হত না। আজ সকালে আমি জানলাম, কিছুই বদলায়নি; বরং, বয়স আর বুদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভালবাসারও বৃদ্ধি ঘটেছে। এখন আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারি, পেটার আমাকে খুকী মনে করত; কিন্তু ও আমাকে একেবারে ভুলে যাওয়ায় আমার মনে লেগেছিল। ওর মুখ এত স্পষ্ট দেখাচ্ছিল যে, এখন আমি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ যে, ও ছাড়া আর কেউ আমার কাছে টিকে থাকতে পারত না।

স্বপ্নটা দেখা অব্দি আমি যেন আর আমাতে নেই। আজ সকালে বাপির চুমো খাওয়ার সময় আমি তারস্বরে বলে উঠতে পারতাম–’ইস, তুমি যদি পেটার হতে!’ সারাক্ষণ আমার ধ্যানজ্ঞান হল সে আর আমি। সারাদিন মনে মনে আওড়াতে থাকলাম, ‘ও পেটেল, আমার আদরের পেটেল…!’

এখন কে আমার সহায় হবে? বেঁচে থেকে আমাকে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হবে যখন আমি এখান থেকে বের হব তখন তিনি যেন এমন করেন যাতে পেটারের সঙ্গে আমার দেখা হয়; পেটার আমার দিকে তাকিয়ে আমার চোখে ভালবাসার লেখন পড়ে বলবে–’আনা গো, আগে জানলে কবে আমি তোমার কাছে চলে আসতাম!’

আর্শিতে নিজের মুখ দেখলাম। একেবারে অন্যরকম দেখাল। চোখ দুটো কী স্বচ্ছ আর গাঢ়, গাল দুটো গোলাপী–এ রকম যে কতদিন ছিল না আমার হাঁ-মুখটা অনেক তুলতুলে দেখাল; দেখে মনে হবে আমি আছি মনের সুখে, অথচ আমার মধ্যে কোথায় যেন একটা করুণ বিষাদের ভাব, আর আমার ঠোটে হাসি ফুটে উঠতে না উঠতে মিলিয়ে যায়। আমার মনে যে সুখ নেই, তার কারণ কবে হয়ত জানব আমার কথা পেটার আর ভাবে না; কিন্তু এ সত্ত্বেও আমি আজও যেন আমার চোখে তার দুটি অসামান্য চোখ আর আমার গালে তার স্নিগ্ধ নরম গাল অনুভব করি।

পেটেল, ও পেটেল, আমার মানসপট থেকে কেমন করে তোমার মূর্তি আমি সরিয়ে নেব? তোমার জায়গায় আর যাকেই বসাই, কেউই তো তোমার নখের যুগ্যিও হবে না? আমি তোমাকে ভালবাসি, সে ভালবাসা এত বড় যে আমার হৃদয়ের কূল ছাপিয়ে একদিন সে প্রকাশ্যে আছড়ে পড়বে, হঠাৎ সবকিছু ধসিয়ে দিয়ে নিজেকে সে লোকচক্ষে তুলে ধরবে!

এক সপ্তাহ আগে কেন, কেউ যদি গতকালও আমাকে জিজ্ঞাসা করত, ‘তোমার বন্ধুদের মধ্যে কাকে তুমি বিয়ে করার সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করো?’ আমি বলতাম, আমি জানি না; কিন্তু এখন হলে আমি গলা ফাটিয়ে বলব, পেটেলকে। কেননা মনপ্রাণ দিয়ে তাকে আমি ভালবাসি। নিজেকে আমি নিঃশেষে তার কাছে সঁপে দিয়েছি।’ তবে একটা কথা, পেটেল আমার মুখ স্পর্শ করতে পারে, কিন্তু তার বেশি নয়।

একবার যৌন বিষয়ে কথা হওয়ার সময় বাপি আমাকে বলেছিলেন যে, আমি এখনও সম্ভবত সেই কামনা বোধ করি না; আমি জানতাম আমার এই কামনাবোধ সব সময়েই ছিল এবং এখন আমি সে সম্বন্ধে পূর্ণভাবে সজাগ। এখন একজনই আমার পরম প্রিয়, সে হল আমার পেটেল।

তোমার আনা।

.

বুধবার, ১২ জানুয়ারি, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

এলি ফিরেছেন দিন পনেরো হল। মিপ আর হেক্ক দুদিন কাজে আসেননি–দুজনেরই পেটের গণ্ডগোল হয়েছিল।

এখন আমাকে পেয়ে বসেছে নাচ আর ব্যালে; রোজ সন্ধ্যেবেলা আমি নাচের তালে তালে পা ফেলা অভ্যেস করি। মা-র একটা লেস-লাগানো হালকা নীল সায়া ছিল, তাই দিয়ে আমি একটা অতি আধুনিক ঢংয়ের নীচের ঘাঘরা তৈরি করে নিয়েছি। ওপর দিয়ে গোল করে একটা রিবন পরিয়ে নিয়েছি আর ঠিক মাঝখানে লাগিয়ে নিয়েছি একটা বো-টাই; একটা পাকানো গোলাপী রিবনে হয়েছে ষোলকলা পূর্ণ। বৃথাই চেষ্টা করলাম আমার জিমন্যাস্টিকের জুতোটাকে সত্যিকার ব্যালে-জুতোর রূপ দিতে। আমার কাঠ-কাঠ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আবার আগের মতন নমনীয় হয়ে আসছে। সবচেয়ে সাংঘাতিক যে ব্যায়াম, সেটা হল মাটিতে বসে দুই হাতে দুটো গোড়ালি ধরে শূন্যে উঁচু করে তোলা। বসবার জন্যে আমাকে একটা কূশন পেতে নিতে হয়, নইলে আমার পাছার অবস্থাটা খুবই সংকটজনক হয়ে ওঠে।

এখানে ‘নির্মেঘ সকাল’ বইটা সবাই পড়ছে। মা-মণি বইটা অসাধারণ বলে মনে করেন; বইটাতে তরুণ-তরুণীদের সমস্যার বিষয়ে অনেক কিছু আছে। আমি ঠোট উল্টে মনে মনে ভাবি; তার আগে তোমাদের নিজেদের ছেলেপুলেদের ব্যাপারে একটু মাথা দিলেই তো পারো।’

আমার বিশ্বাস, মা-মণি মনে করেন মা-বাবার সঙ্গে ওঁদের ছেলেপুলেদের যে সম্পর্ক তার চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না, এবং ছেলেপুলেদের ব্যাপারে তাঁর মতন অত আদরযত্ন আর কেউই করতে পারে না। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, মা-মণি দেখেন শুধু মারগটকে আমার মনে হয় না মারগটের আমার মতন সমস্যা বা চিন্তাভাবনা। তবু মা মণিকে এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার কথা আমি ভাবতেই পারি না যে, মেয়েদের ব্যাপারে তার মনগড়া ধারণাটা আদৌ ঠিক নয়। কেননা সেটা জানলে তিনি একেবারে আকাশ থেকে পড়বেন এবং বুঝে নিজেকে বদল করাও কোনোভাবেই তার পক্ষে সম্ভব হবে না। এতে তিনি মনে যে দুঃখ পাবেন, আমি সে দুঃখ তাকে দিতে চাই না। বিশেষত আমি তো জানি আমার তাতে কিছুতেই কিছু যাবে আসবে না।

মা-মণি নিশ্চয় মনে করেন যে আমার চেয়ে মারগট তাকে বেশি ভালবাসে, তবে তাঁর ধারণা চন্দ্রকলার মতন এর হ্রাসবৃদ্ধি আছে। মারগট বড় হয়ে খুব মিষ্টি হয়েছে; ও অনেক বদলেছে, এখন আর আগের মতো অতটা হিংসুটে নেই। ক্রমশ ও আমার সত্যিকার বন্ধু হয়ে উঠছে। ও আমাকে আর এখন আগের মতো নেহাত এলেবেলে ছেলেমানুষ বলে মনে করে না।

কখনও কখনও আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়; আমি অন্যের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখতে পারি। তখন আমি অনায়াসে জনৈক ‘আনা’র ব্যাপার-স্যাপার দেখতে পাই এবং একজন বাইরের লোক হিসেবে তার জীবনের পাতাগুলো আমি উল্টে যাই। এখনে আসার আগে, যখন আমি আজকের মতো এটা-ওটা নিয়ে অত বেশি মাথা ঘামাতাম না, মাঝে-মাঝে আমার মনে হত মা, পিম্ আর মারগট–এরা আমার কেউ নয়, ভাবতাম চিরদিনই আমি থেকে যাব খানিকটা বাইরের লোক। কখনও কখনও এমন ভান করতাম যেন আমি অনাথ; পরে তার জন্যে নিজেকেই বকতাম এবং শাস্তি দিতাম; নিজেকে বোঝাতাম যে, এত ভাগ্য করে এসেও এই যে আমি আত্মনিগ্রহ করি এটা তো আমারই দোষ।

এরপর একটা সময়ে আমি নিজেকে জোর করে আত্মীয় করে তুলি। রোজ সকালে নিচের তলায় কেউ এলে আমি ভাবতাম নিশ্চয়ই মা-মণি, এবার আমার শিয়রে এসে সুপ্রভাত বলবেন। আমি তাঁকে দেখলেই আন্তরিক সম্ভাষণ জানাতাম, কেননা মনে মনে আমি সত্যিই চাইতাম যে,–মণি আমার দিকে স্নেহভরে তাকান।

ঠিক তখন মা-মণি এমন একটা মন্তব্য করলেন বা কথা বললেন যাতে প্রতিকূলতা আছে বলে মনে হল, তারপর একেবারে ভাঙা মন নিয়ে আমি চলে গেলাম ইস্কুলে। বাড়ি ফেরার সময় ভাবতে ভাবতে আসতাম–মা-মণির আর দোষ কী, তার মাথায় এতরকমের বোঝা! বাড়ি ফিরতাম খুব হাসিখুশী হয়ে, মুখে খই ফুটত শেষে এই কথা যখন বার বার বলতে শুরু করতাম, তখন ইস্কুলের ব্যাগ বগলে করে মুখে চিন্তার ভাব ফুটিয়ে সট করে ঘর ছেড়ে চলে যেতাম।

মাঝে মাঝে ঠিক করতাম মুখ ভার করে থাকব, কিন্তু তখন ইস্কুল থেকে ফিরতাম তখন আমার এত খবর থাকত বলবার যে, সেসব সংকল্প কোথায় ভেসে যেত। আর মা-মণির হাতে যতই কাজ থাক, আমার সারাদিনের ঘটনা শোনার জন্যে মা-মণিকে কান খাড়া করে থাকতে হত। এরপর আবার সেই সময় এল, যখন আমি সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা ছেড়ে দিলাম। আর রাত্তিরে আমার বালিশ চোখের পানিতে ভিজে যেত।

সেই সময়টাতে সবকিছুই আরো খারাপ হয়ে পড়ল; বলতে কি, সে সবই তুমি জানো।

এখন আল্লাহর দয়ায় পেয়েছি একজন সহায়ক-পেটার…। আমি আমার লকেটটা জড়িয়ে ধরি, চুমো খাই আর আপন মনে বলি, ‘ওদের আমি কলা দেখাই! আমার আছে। পেটার। ওরা তার কী জানে?’ আমি যে এত দাবড়ানি খাই, এইভাবে তার আঘাত কাটিয়ে উঠি। একজন কমবয়সী মেয়ের গহন মনে এত কিছু তোলপাড় করে! কার আর সে কথা মাথায় আসে?

তোমার আনা।

.

শনিবার, ১২ জানুয়ারি, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আমাদের যেসব ঝগড়া-বিবাদ, তা নিয়ে প্রতিবারই সবিস্তারে তোমাকে বলার কোনো মানে হয় না। তোমাকে শুধু এইটুকু বললেই হবে যে, বিস্তর জিনিস–তার মধ্যে আছে মাখন আর মাংস–আমরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছি এবং নিজেদের আলু আমরাই ভেজে নিই। কিছুদিন থেকে আজকাল আমরা দুই বেলার আহারের মাঝখানে অতিরিক্ত হিসেবে ময়দার রুটি খাচ্ছি, কেননা বিকেল চারটে নাগাদ রাতের খাবারের জন্যে আমরা এমন উতলা হয়ে পড়ি যে, পেটের ভোঁচকানি আর আমরা সামাল দিতে পারি না।

মা-মণির জন্মদিন দ্রুত এসে যাচ্ছে। ক্রালারের কাছ থেকে মা-মণি কিছুটা বাড়তি চিনি পাওয়ায় ফান ডানদের খুব গায়ের জ্বালা, কেননা মিসেস ফান ডানের জন্মদিনে এভাবে দাক্ষিণ্য করা হয়নি। কিন্তু এ নিয়ে অকথা-কুকথা বলে, চোখের পানি ফেলে, মেজাজ খারাপ করে একে অন্যের অশান্তি সৃষ্টি করে কী লাভ? এ কথা জেনে রাখো কিটি, ওদের ওপর আমাদের আগের চেয়েও বেশি ঘেন্না ধরে গেছে। এক পক্ষকাল যেন ফান ডানদের মুখ আর না দেখি। মা-মণি তাঁর এই ইচ্ছের কথা বলেই ফেলেছেন। এখুনি অবশ্য সেটা পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়।

আমি বসে বসে ভাবি, এক বাড়িতে যার সঙ্গেই থাকা যাক, শেষ অবধি খিটিমিটি বাধা অবধারিত কিনা। নাকি অদ্ভদেরই কপাল অতিরিক্ত খারাপ? বেশিরভাগ লোকেরাই কি তাহলে এই রকম হাঁটান আর নিজের কোলে ঝোল টানার স্বভাব? মনে হয়, মানুষজন সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জ্ঞান হয়ে ভালোই হয়েছে; তবে এখন মনে হয়, যতটা জেনেছি সেই ঢের। আমরা চুলোচুলি করি বা না করি, মুক্তি পেয়ে খোলা হাওয়া গায়ে লাগাতে চাই বা না চাই, যুদ্ধ চলছে এবং চলবে।

কাজেই এখানে যতদিন আছি, আমাদের উচিত সবচেয়ে শ্রেয়ভাবে থাকা। এখন আমি জ্ঞানের কথা বলছি, কিন্তু এও জানি, খুব বেশিদিন এখানে থাকলে আস্তে আস্তে হয়ে যাব বুড়িয়ে-যাওয়া শুকনো সিমের বোঁটা। অথচ আমি কত না চেয়েছিলাম একজন প্রকৃত সুকুমারী রমণী হয়ে উঠতে!

তোমার আনা।

.

নিবার, ২২ জানুয়ারি, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আচ্ছা, তুমি বলতে পারো, লোকে সব সময়ে কেন নিজেদের আসল মনের ভাবটাকে ঢেকে রাখার জন্যে এত কোমর বেঁধে লাগে? অন্য লোক থাকলে যে রকম করা উচিত, তা করে কেন আমি একেবারে অন্য রকমের ব্যবহার করি বলো তো?

কেন আমরা পরস্পরকে এত কম বিশ্বাস করি? আমি জানি, নিশ্চয় তার কারণ আছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে আমার দেখে শুনে মনে হয় এটা কী ভয়ঙ্কর যে, আমরা কখনই কাউকে বিশ্বাস করে ঠিক মনের কথা বলতে পারি না–সে যদি খুব আপনজন হয় তাহলেও।

সেদিন রাত্রে স্বপ্নটা দেখার পর থেকে আমার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে। এখন আর আমি কারো মুখাপেক্ষী নই। শুনে আশ্চর্য হবে, ফান ডানদের প্রতি আমার মনোভাবও ঠিক আগের মতো নেই। সবার সব যুক্তিতর্ক এবং আর যা কিছু সমস্তই আমি হঠাৎ অন্য এক দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি। আমার মনের পাল্লা একদিকে এখন আর আগে থেকে ততটা ভারী হয়ে থাকে না।

আমি এতটা বদলে গেলাম কেমন করে? তার কারণ, এটা আমার হঠাৎ মনে হল যে, মা-মণি অন্য রকমের হতেন, মা যাকে সত্যিকার বলে–সম্পর্কটা তাহলে একেবারে অন্য রকমের ইত। এটা সত্যি যে, মিসেস ফান ভান মানুষটা আদৌ সুবিধের নন, কিন্তু তাহলেও অর্ধেক ঝগড়াঝাটি এড়ানো যেতে পারত–কথা কাটাকাটির সময় মা-মণি যদি একটু কম একগুয়ে হতেন।

মিসেস ফান ডানের একটা ভালো দিক এই যে, ওঁর সঙ্গে কথা বলা যায়। ওঁর মধ্যে স্বার্থপরতা, কঞ্জুষপনা আর লুকোচুরির ভাব থাকলেও ওঁকে নোয়ানো যায় সহজেই–অবশ্যই ওঁকে না চটিয়ে এবং আঁতে ঘা না দিয়ে। প্রতিবারেই যে এতে কাজ হবে তা নয়, তবে ধৈর্য ধরে করতে পারলে ফিরে চেষ্টা করে দেখতে পারো কতটা এগোনো যায়।

আমাদের মানুষ হওয়ার, পরকাল ঝরঝরে হওয়ার, খাওয়াদাওয়ার যা কিছু সমস্যা এসব একেবারেই অন্যরূপ নিত যদি আমরা পুরোপুরি দিলখোলা আর অমায়িক হতাম এবং যদি পরের দোষ ধরার জন্যে সবসময় মুখিয়ে না থাকতাম।

তুমি ঠিক কী বলবে আমি জানি, কিটি; ‘আনা, এ কী কথা শুনি আজ…? যে ওপরতলার লোকদের এত বাক্যযন্ত্রণী শুনেছে, যে মেয়ে এত বেশি অন্যায় অবিচার সয়েছে, সেই তোমার মুখ থেকেই কিনা…?’–হ্যাঁ, তবু আমারই কথা এসব।

আমি কেঁচে গণ্ডুষ করতে চাই, যেতে চাই এইসব কিছুর মূলে। লোকে বলে, সব সময় ছোটরা যা খারাপ দেখবে তাই শিখবে। আমি তেমন হতে চাই না; আমি চাই গোটা জিনিসটা নিজে সযত্নে যাচাই করতে এবং কোন্‌টা ঠিক আর কোনটা অতিরঞ্জিত তা খুঁজে বার করতে। যদি দেখি আমি যা ভেবেছিলাম, হায়, ওরা তা নয়। তাহলে মা-মণি আর বাপির সঙ্গে আমি একমত হব। তা না হলে, আমি গোড়ায় চেষ্টা করব ওঁদের ধারণাগুলো বদলাতে, যদি না পারি তাহলে আমি আমার মতামত আর সিদ্ধান্তে অবিচল থাকব। মিসেস ফান ভানের সঙ্গে আমাদের মতান্তরের প্রতিটি বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনার প্রত্যেকটি সুযোগ আমি গ্রহণ করব এবং নিজেকে নিরপেক্ষ বলে জাহির করতে আমি ডরাব না–তাতে যদি আমাকে সবজান্তা বলে খোটা দেওয়া হয় তো হোক। তার মানে এই নয় যে আমি আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে চলে যাব–আসলে আজ থেকে যেটা করব তা হল নির্মম গল্পগুজবে আর আমি নিজেকে ফাসাব না।

এ পর্যন্ত আমি নিজের মত থেকে এক চুল নড়তাম না! সব সময় ভাবতাম যত দোষ সব ঐ ফান ডানদের, কিন্তু আমরাও দোষের ভাগী ছিলাম। এ ব্যাপারে সন্দেহের নেই যে, বিতর্কিত বিষয়টাতে আমরাই ছিলাম সঠিক; কিন্তু যাদের বুদ্ধি বিবেচনা আছে (আমাদের আছে বলে তো আমরা মনেই করি!) অন্যদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞান আরো টনটনে হবে, লোকে এটাই প্রত্যাশা করে। আমি কিছুটা অন্তদৃষ্টি লাভ করেছি বলে এবং সময়ে সেটা সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করবার আশা রাখি।

তোমার আনা।

.

সোমবার, ২৪ জানুয়ারি, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আমার কী যেন ঘটেছে; কিংবা, সেটাকে একটা ঘটনা হিসেবেও আমি দেখাতে পারি না; শুধু বলতে পারি, ব্যাপারটাতে বেশ খানিকটা মাথার ছিট আছে। বাড়িতে বা ইস্কুলে যখনই কেউ যৌন সমস্যার বিষয়ে কিছু বলত, তাতে হয় থাকত একটা রহস্যের ভাব, নয় সেটা হত নিধৃণ্য ধরনের।

প্রাসঙ্গিক কথাগুলো বলা হত ফিস্ ফিস্ করে, এবং কেউ বুঝতে না পারলে সে হত উপহাসের পাত্র। জিনিষটা আমার কাছে বিসদৃশ মনে হত। আমি ভাবতাম, এসব জিনিস নিয়ে কথা বলবার সময় লোকে কেন এত ঢাকঢাক গুড়গুড় করে? কেনই বা এত কান ঝালাপালা করে? এসব পাল্টে দেব এমন দুরাশা আমার না থাকায় আমি যথাসম্ভব মুখে কলুপ এঁটে থাকতাম, কিংবা দু-এক সময় আমার মেয়েবন্ধুদের কাছ থেকে এটা-ওটা জেনে নিতাম। যখন বেশ কিছু জানা হয়ে গেল এবং মা-বাবাকেও তা বললাম, মা-মণি একদিন আমাকে ডাকলেন, ‘আনা, তোমার ভালোর জন্যেই এটা বলছি–ছেলেছোকরাদের সামনে যেন এসব কথা বলো না; ওরা যদি কথাটা তোলে তাহলে তুমি হা-ও বলো না, না-ও বলো না। তার উত্তরে কী বলেছিলাম আমার অবিকল মনে আছে। আমি বলেছিলাম, সে আর বলতে!’ ব্যস, এখানেই এর ইতি।

যখন গোড়ায় আমরা এখানে এলাম, বাপি প্রায়ই এমন সব জিনিস নিয়ে আমাকে বলতেন যেসব বিষয়ে বরং মা-মণির কাছ থেকে শুনতে পারলেই আমি বেশি খুশি হতাম; জানার যেটুকু বাকি ছিল, সেটুকু পুষিয়ে নিলাম কিছু বইপত্র থেকে আর কিছুটা লোকপ্রমুখাৎ। ইস্কুলের ছেলেদের মতন পেটার ফান ডানকে কিন্তু এ ব্যাপারে কখনই ততটা অসহ্য বলে মনে হয়নি–হয়ত গোড়ার দিকে দু-একবার ছাড়া। কখনই ও আমার মুখ খোলার চেষ্টা করেনি।

মিসেস ফান ডান আমাদের বলেছিলেন এসব প্রসঙ্গে তিনি বা তার জ্ঞানত, তাঁর স্বামীও পেটারকে কোনদিনই কিছু বলেননি। বোঝাই যায়, পেটার কতটা কী জানে না জানে সে সম্পর্কে তিনি কোনো খবরও রাখতেন না।

কাল মারগট, পেটার আর আমি যখন আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিলাম, কথায় কথায় বোখার প্রসঙ্গ ওঠে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আমরা এখনও জানি না বোখা ছেলে না মেয়ে-তাই না?’

পেটার তার উত্তরে বলেছিল, ‘আলবৎ জানি, ও হচ্ছে হুলো।‘

শুনে আমি হেসে উঠি। ‘হুলোর পেটে বাচ্চা, অবাক কাণ্ড!’

পেটার আর মারগটও এই ছেলেমানুষী ভুলের ব্যাপারটা নিয়ে খুব হাসল। দেখ, দুই মাস আগে পেটার বলেছিল শীগগিরই বোখার বাচ্চা হবে, ওর পেটটা কি রকম বড় হয়ে উঠেছে। অবিশ্যি ওর পেট মোটা হওয়ার কারণ বোঝা গেল চুরি করে খাওয়া প্রচুর হাড়, কেননা বাচ্চা পাড়া দূরের কথা, পেটের মধ্যে বাচ্চাগুলোর চটপট বেড়ে ওঠারও কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।

স্বপক্ষে যুক্তি না দেখিয়ে পেটারের উপায় নেই। বলল, না হে না, আমার সঙ্গে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসতে পারো। একদিন ওর আশপাশে খেলা করছিলাম, তখন একদম স্পষ্ট দেখতে পাই ও হচ্ছে হুলো।

শুনে আমার এমন কৌতূহল হল যে ওর সঙ্গে মালখানায় না গিয়ে পারলাম না। কিন্তু বোখা তখন দেখা দেওয়ার মেজাজে ছিল না, ফলে কোথাও তার টিকি দেখা গেল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ঠাণ্ডা লাগতে থাকায় ফের ওপরতলায় চলে গেলাম। পরে বিকেলের দিকে পেটার যখন দ্বিতীয়বার নিচের তলায় যায় তখন তার পায়ের শব্দ পেলাম। মনে অনেক সাহস সঞ্চয় করে নিঃশব্দ বাড়িটাতে পা ফেলে ফেলে আমি নিচে মালখানায় চলে গেলাম। গিয়ে দেখি একটা প্যাকিং টেবিলে দাঁড়িয়ে বোখা পেটারের সঙ্গে খেলছে। ওজন নেবার জন্যে পেটার তখন তাকে সবে দাঁড়িপাল্লায় তুলেছে।

‘এই যে, তুমি এটাকে দেখতে চাও?’ বলে কোনো হাবিজাবি বাগ্‌বিস্তরের ভেতর না গিয়ে বেড়ালটাকে স্রেফ চিৎ করে পেড়ে ফেলে পেটার সূকৌশলে এক হাতে তার মাথা আর অন্য হাতে তার থাবা দুটো ঠেসে ধরল। তারপর শুরু হল পেটারের মাস্টারি–এই হলো পুরুষের লিঙ্গ, এই হল মাত্র গুটিকয় চুল আর ঐটা হল ও পাছা।’ বেড়ালটা এবার এক কাতে উল্টে আবার তার সাদা লোমশ পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

আর কোনো ছেলে যদি আমাকে পুরুষের লিঙ্গ প্রদর্শন করত, আমি তার দিকে কখনই ফিরে তাকাতাম না। কিন্তু পেটার কোনোরকম মানসিক বিকার না ঘটিয়ে এমন একটা কষ্টকর বিষয়ে খুব নির্বিকার ভাবে কথা বলে চলল। শেষ অবধি আমার আড়ষ্টতা ভেঙে দিয়ে আমাকেও ও বেশ স্বাভাবিক করে তুলল। আমরা বোখার সঙ্গে মজা করে খেললাম, নিজেরা বকর বকর করলাম আর তারপর প্রকান্ড গুদাম ঘরটার ভিতর দিয়ে পায়চারি করতে করতে দরজার দিকে গেলাম।

যেতে যেতে জিজ্ঞেস করি, সাধারণত যখন আমার কিছু জানতে ইচ্ছে হয়, আমি বইপত্র ঘেঁটে বার করি। তুমি করো না?’

মাথা খারাপ? সোজা ওপরতলায় গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করি। আমার বাবা আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। এসব বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা অনেক বেশি।’

ততক্ষণে আমরা সিঁড়ির কাছে চলে এসেছি। সুতরাং এর পর আমি মুখে কুলুপ দিলাম।

ব্রের রাবিট বলেছিলেন, ‘সব কিছুরই হেরফের হতে পারে।‘ এটা ঠিক। কোনো মেয়ের সঙ্গে এসব জিনিস অতটা স্বাভাবিকভাবে বলা চলত না। ছেলেদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে মা-মণি বারণ করেছিলেন বটে, কিন্তু এ ব্যাপারে আমার কোনোই সন্দেহ নেই যে মা-মণি ঠিক সে অর্থে বলেননি। কিন্তু শত হলেও এরপর সারাদিন আমি যেন কেমন একটা হয়ে গেলাম। আমাদের কথাবার্তার কথা মনে পড়ে কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছিল। কিন্তু অন্তত একটা বিষয়ে আমার চোখ খুলে গিয়েছিল; সেটা এই যে, প্রকৃতই এমন কমবয়সী মানুষজন আছে–এমন কি তারা ছেলে হলেও মেয়েদের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে এসব বিষয়ে ভালো মনে কথা বলতে পারে।

আমি ভাবি পেটার সত্যিই ওর বাবা-মাকে খুব বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করে কি না। কাল আমার সঙ্গে যেভাবে করেছিল সেইভাবে পেটার ওঁদের সাক্ষাতে অকপট আচরণ করে কি? হায়, আমি তা কী জানব!

তোমার আনা।

.

বৃহস্পতিবার, ২৭ জানয়ারি, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

ইদানীং পারিবারিক কুলজি আর রাজবংশাবলী নিয়ে আমি খুব মজে গিয়েছি। এখন আমার ধারণা হয়েছে যে, একবার শুরু করে দিলে আরও গভীরভাবে ইতিহাসচর্চার দিকে মন যায় এবং তখন ক্রমাগত নতুন নতুন আর মজার মজার জিনিস চোখে পড়ে। লেখাপড়ার ব্যাপারে আমি অসাধারণ পরিশ্রমী এবং স্থানীয় বেতারে ইংরেজিতে যে প্রোগ্রাম হয় আমি তা শুনে বিলক্ষণ বুঝতে পারি, কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমার কাছে ফিল্মস্টারদের যেসব ছবি আছে সেগুলো অনেক রবিবারেই সাজাই বাছাই করি এবং মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে দেখি–এখন সেই ছবির সংগ্রহটা বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে।

প্রতি সোমবারে মিস্টার ক্রালার যখন ‘সিনেমা আর থিয়েটার’ পত্রিকাটা আনেন–আমি খুশীতে ডগমগ হয়ে উঠি। এই বাড়িতে যাদের স্কুল জিনিসে টান কম, তারা প্রায়ই এই সামান্য উপহারটিকে অর্থের অপব্যয় বলে মনে করেন; অবশ্য বছরখানেক পরেও আমি যখন নির্ভুলভাবে বলে দিই কোন্ ফিল্মে কে আছে তখন তারা অবাক হয়ে যান। ছুটির দিনগুলোতে এলি তার ছেলেবন্ধুর সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে সিনেমায় যান; যেই উনি আমাকে ছবির নাম বলেন, অমনি আমি এক নিঃশ্বাসে গড় গড় করে বলে চলি ছবির তারকাদের নাম আর সেই সঙ্গে ছবিটি সম্পর্কে চলচ্চিত্র-সমালোচকদের বক্তব্য। অল্প কিছুদিন আগে মা বলছিলেন যে, এরপর আমার আর কোনো সিনেমার যাওয়ার দরকার হবে না। কেননা ছবির প্লট, তারকাদের নাম আর সমালোচকদের মতামত সমস্তই আমার কণ্ঠস্থ।

কখনও যদি আমি নতুন কায়দায় চুল বাঁধি, অমনি সকলে চোখ কুঁচকে তাকায়। আমি জানি ঠিক কেউ জিজ্ঞেস করে বসবে সিনেমার কোন্ রূপসীর চুলের ঢং আমি নকল করেছি। ওটা আমি নিজের মাথা থেকে বের করেছি বললে পুরোপুরি কেউ বিশ্বাস করে না।

চুল বাধার ব্যাপার নিয়ে আরেকটু বলি–চুল বেঁধে আঘঘণ্টার বেশি সেটা থাকে না; লোকের বাক্যবাণে তিতিবিরক্ত হয়ে চটপট বাথরুমে চলে গিয়ে চুল খুলে ফেলে বেঁধে নিই আমার সেই আটপৌরে এলোখোঁপা।

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ২৮ জানুয়ারি, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আজ সকালে মনে মনে ভাবছিলাম, মাঝে মাঝে নিজেকে তোমার পুরনো খবরের জাবর কাটা গরুর মত মনে হতে পারে যে শেষ অবধি সশব্দে হাই তুলে মনে মনে কামনা করে আনা যেন মাঝে-মধ্যে কিছুটা নতুন খবর দেয়।

দুঃখ এই যে, আমি জানি তোমার কাছে এ সবই খুব নিরস, তবে আমার দিকটাও তুমি একটু ভেবে দেখ ভাবো একবার আমার কী হাল বুড়ো গরুদের নিয়ে, যাদের উপর্যুপরি খানাখন্দ থেকে উঠিয়ে আনতে হয়। খেতে বসে রাজনীতি বা উপাদেয় খাবারের প্রসঙ্গ না। থাকলে, তখন মা-মণি কিংবা মিসেস ফান ডান তাদের ঝুলি থেকে তরুণ বয়সের পুরনো কোনো গল্প বের করেন, যে-গল্প শুনে শুনে আমাদের কান পচে গেছে। কিংবা ডুসেল ঘ্যানর ঘ্যানর করে বলতে থাকেন স্ত্রীর এলাহি পোশাক-আশাক, রেসের সুন্দর সব ঘোড়া, ফুটো হওয়া দাঁড়নৌকো, চার বছর বয়সের সাঁতারু সব ছেলে, পেশীর ব্যথা আর ভয়তরাসে সব রুগীর গল্প। মোদ্দা ব্যাপার যেটা দাঁড়ায় তা এই–আমাদের আটজনের যে কেউ যদি মুখ খোলে, তাহলে বাকি সাতজনই তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বাকি গল্পটা তার হয়ে বলে যেতে পারে। প্রত্যেকটা হাসির কথার নির্দিষ্ট বিষয়টা গোড়া থেকেই আমাদের জানা এবং যে বলে সে ছাড়া আর কেউ সেই রসিকতা শুনে হাসে না। দুই প্রাক্তন গিন্নী-মার হরেক গোয়ালা, মুদি আর কশাইদের এত বেশিবার আকাশে তোলা হয়েছে কিংবা কাদায় ফেলা হয়েছে যে শুনে শুনে আমাদের মানসপটে তাদের দাড়ি গজিয়ে গিয়েছে; এখানে কোনো টাটকা কিংবা আনকোরা বিষয়ে কথাবার্তা হওয়া সম্ভবই নয়।

এসব তবু সহ্য হত যদি বড়দের গল্প বলার ধরনটা অমন অকিঞ্চিত্ত্বর না হত কুপহুইস, হেংক বা মিল্ক ঐভাবেই আসরে বলতেন–একই জিনিস দশবার করে। তাতে জুড়ে দিতেন নিজেদের একটু-আধটু চুনট-বুনট। মাঝে মাঝে আমার প্রবল ইচ্ছে হত ওঁদের শুধরে দেবার, অতিকষ্টে নিজেকে সামলাতাম। ছোট ছেলেমেয়েরা যেমন আনা কোনো ক্ষেত্রেই কদাচ বড়দের চেয়ে বেশি জানতে পারে না–তা বড় যত ভুলভ্রান্তিই করুক না কেন, যতই মনগড়া কথা বলে যাক না কেন।

কুপহুইস আর হেংকক্‌-এর একটা প্রিয় বিষয় হল অজ্ঞাতবাসের আর গুপ্ত আন্দোলনের লোকদের কথা। ওঁরা বিলক্ষণ জানেন যে, আমাদের আত্মগোপনকারী লোকদের কথা জানবার প্রচণ্ড আগ্রহ এবং ধরা-পড়া লোকদের লাঞ্ছনায় যেমন আমরা দুঃখ পাই–তেমনি খুশী হই কেউ বন্দিদশা থেকে ছাড়া পেলে।

অজ্ঞাতবাসে যাওয়া বা আণ্ডার গ্রাউণ্ড হওয়ার ব্যাপারটাতে আমরা এখন সেইভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, যেমন আমরা অতীতে অভ্যস্ত ছিলাম বাপির শোবার ঘরের চটি গরম করার জন্য ফায়ার প্রেসের সামনে রেখে দেওয়ার ব্যাপারে।

‘স্বাধীন নেদারল্যাণ্ডের মত বিস্তর সংস্থা আছে, যাদের কাজ ‘অভিজ্ঞানপত্র জাল করা, ‘আণ্ডার গ্রাউণ্ডে’র লোকদের অর্থ যোগানো, লোকজনদের লুকিয়ে থাকার জায়গা দেখে দেওয়া এবং আত্মগোপনকারী তরুণদের জন্যে কাজের ব্যবস্থা করা; দেখে আশ্চর্য লাগে, এই লোকগুলো নিজেদের জীবন বিপন্ন করে অন্যদের সহায় হয়ে আর বাঁচাবার জন্যে নিঃস্বার্থভাবে কী পরিমাণ মহৎ কাজ করে চলেছে। আমাদের সাহায্যকারীরা এর একটি দৃষ্টান্ত? এ পর্যন্ত তারা আমাদের বিপদ থেকে ত্রাণ করেছেন এবং আমরা আশাকরি তারা আমাদের নিরাপদে ডাঙায় পৌঁছে দেবেন। নইলে, হন্যে হয়ে যাদের খুঁজছে সেই অন্য অনেকের মতোই ওঁদের কপালেও আছে একই দুর্গতি। আমরা ওঁদের গলগ্রহ হয়ে আছি সন্দেহ নেই। কিন্তু সে সম্বন্ধে একটা টু শব্দও তাদের কাছ থেকে কোনোদিন আমরা শুনিনি; আমরা যে ওঁদের এত মুশকিলে ফেলি, ওঁরা একজনও তা নিয়ে কখনও নালিশ করেন না।

এমন দিন যায় না যেদিন ওঁরা ওপরে উঠে আসেন না। এসে ওঁরা কথা বলেন পুরুষদের সঙ্গে ব্যবসাপত্র আর রাজনীতি, মায়েদের সঙ্গে খাবারদাবার আর যুদ্ধকালীন সংকট আর ছোটদের সঙ্গে খবরের কাগজ আর বইপত্র নিয়ে। মুখে ওঁদের যথাসম্ভব ফোঁটানো থাকে। হাসিখুশি ভাব, জন্মদিনে আর ব্যাঙ্ক বন্ধের দিন আনেন ফুল আর উপহার, সাহায্যে কখনও বিমুখ নন এবং সবকিছু করেন প্রাণ দিয়ে। এ জিনিস জীবনে কখনও ভোলার নয়। অন্যেরা যেখানে লড়াইতে আর জার্মানদের বিরুদ্ধে বীরত্ব দেখায়, আমাদের সাহায্যকারীরা বীরত্ব দেখান তাদের সদাহাস্যময়তায় আর স্নেহভালবাসায়।

অবিশ্বাস্য সব গল্প বাজারে চলেছে, কিন্তু তাহলেও সচরাচর এসবের মূলে সত্য আছে। যেমন, কূপহুইস এ সপ্তাহে আমাদের বললেন যে, গেণ্ডার ল্যাণ্ডে এগারোজন এগারোজন করে দুটো ফুটবল টিমের খেলায় এক পক্ষে ছিল পুরোপুরি ‘আনডার গ্রাউণ্ডে’র লোক আর অন্য পক্ষে ছিল পুলিশ বাহিনীর লোক।

হিভারসুমে নতুন রেশন কার্ড বিলি করা হচ্ছে। লুকিয়ে থাকা লোকরাও যাতে রেশন পেতে পারে তার জন্যে কর্মাচরীদের পক্ষ থেকে এলাকার ঐসব লোকদের জানানো হয়েছে তারা যেন একটা বিশেষ সময়ে এসে আলাদা একটা ছোট টেবিল থেকে উপযুক্ত দলিলপত্র নিয়ে যায়। তাহলেও এ ধরনের দুঃসাহসী কলাকৌশলের কথা যাতে জার্মানদের কানে না। যায় তার জন্যে ওদের সতর্ক হতে হবে।

তোমার আনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *