০১. আমার ঘুম ভেঙে গেল

০১. রবিবার, ১৪ জুন, ১৯৪২

শুক্রবার, ১২ই জুন, ছ-টায় আমার ঘুম ভেঙে গেল এবং এখন আমি জানি কেন–সেদিন ছিল আমার জন্মদিন। তবে অত ভোরে ওঠা অবশ্যই আমার বারণ, সুতরাং ভেতরে ভেতরে ছটফট করলেও পৌনে সাতটা অব্দি নিজেকে সামলে রাখতে হল। ব্যস, তারপর আর নিজেকে ধরে রাখা গেল না। উঠে আমি খাওয়ার ঘরে চলে গেলাম। সেখানে মুরটিয়ে (বেড়াল) আমাকে দেখে সাদর অভ্যর্থনা জানাল।

সাতটা বাজার খানিক পরেই আমি চলে গেলাম মা-বাবার কাছে। তারপর বৈঠকখানায় গিয়ে উপহারের প্যাকেটগুলো খুলতে লাগলাম। প্রথমেই যে স্বাগত জানাল সে হলে তুমি, সম্ভবত সেটাই হয়েছে আমার সবচেয়ে সেরা জিনিস। এছাড়া টেবিলে একগুচ্ছ গোলাপ, একটা চারা গাছ, আর কিছু পেওনিফুল, সারাদিনের মধ্যে আরও কিছু এসে গেল।

মা-বাবার কাছ থেকে পেলাম একরাশ জিনিস, আর নানা বন্ধুতে আমার মাথাটা সম্পূর্ণ খেল। আর যা যা পেলাম, তার মধ্যে ছিল ক্যামেরা অবন্ধুরা, একটি পার্টি গেম, প্রচুর লজেন্স, চকোলেট, একটি গোলকধাঁধা, একটা ব্রোচ, জোসেফ কোহেনের লেখা ‘নেদারল্যাণ্ডস্-এর লোককথা আর পৌরাণিক উপাখ্যান’, ‘ডেইজি-র ছুটিতে পাহাড়ে’ (দারুণ একখানা বই), আর কিছু টাকাকড়ি। এইবার আমি কিন্তু কিনতে পারব ‘গ্রীস আর রোমের উপকথা’–তোফা।

তারপর লিস বাড়িতে এল ডাকতে, আমরা ইস্কুলে গেলাম। টিফিনের সময় সবাইকে আমি মিষ্টি বিস্কুট দিলাম, তারপর আবার আমাদের মন দিতে হল ইস্কুলের পড়ায়।

এবার ইতি টানতে হবে। আসি ভাই, আমরা হব হলায়-গলায় বন্ধু!

.

সোমবার, ১৫ জুন, ১৯৪২

আমার জন্মদিনে পার্টি হল রবিবার বিকেলে। আমরা একটা ফিল্ম দেখালাম–’বাতিঘর রক্ষক, তাতে রিন-টিন-টিন ছিল। আমার ইস্কুলের বন্ধুরা ছবিটা চুটিয়ে উপভোগ করেছে। আমাদের সময়টা খুব ভালো কেটেছিল। ছেলেমেয়ে ছিল প্রচুর। আমার মা-মণির সবসময় খুব জানার ইচ্ছে কাকে আমি বিয়ে করব। তার কতকটা আন্দাজ, পিটার ভেসেল্ হল সেই ছেলে; একদিন লজ্জায় লাল না হয়ে কিংবা চোখের একটি পাতাও না কাঁপিয়ে মা-মণির মন থেকে সরাসরি ঐ ধারণাটা সো-সো করে ঘোচাতে পেরেছিলাম। বছর কয়েক ধরে, আমার প্রাণের বন্ধু বলতে লিস্ গুসেন আর সানা হুটমান। এরপর ইহুদীদের মাধ্যমিক ইস্কুলে যোপি দ্য বালের সঙ্গে আমার আলাপ; প্রায়ই আমরা একসঙ্গে কাটাই; আমার মেয়ে বন্ধুদের মধ্যে ওর সঙ্গেই এখন আমার সবচেয়ে বেশি ভাব। অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে লিসের বেশি বন্ধুত্ব; আর সানা যায় অন্য একটা ইস্কুলে–সেখানে তার নতুন নতুন বন্ধু হয়েছে।

.

নিবার, ২০ জুন, ১৯৪২

দিন কয়েক আমি লিখিনি, তার কারণ আমি সবার আগে চেয়েছিলাম ডায়রিটা নিয়ে ভাবতে। আমার মতো একজনের পক্ষে ডায়রি রাখার চিন্তাটা বেখাপ্পী; আগে কখনও ডায়রি রাখিনি বলে শুধু নয়, আসলে আমার মনে হয়, তেরো বছরের এক স্কুলের মেয়ের মনখোলা কথাবার্তা কোনো আগ্রহ জাগাবে না–না আমার, না সেদিক থেকে আর কারো; তা হোক, কী আসে যায় তাতে? আমি চাই লিখতে কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, আমার বুকের গভীরে যা কিছু চাপা পড়ে রয়েছে আমি চাই সেসব বের করে আনতে।

লোকে কথায় বলে, ‘মানুষের চেয়ে কাগজে সয় বেশি’; যে দিনগুলোতে আমার মন একটু ভার হয়ে থাকে, সেই রকম একটা দিনে–গালে হাত দিয়ে আমি বসে আছি। মনটা ভীষণ বেজার, এমন একটা নেতিয়ে-পড়া ভাব যে ঘরে থাকব, না বেরিয়ে পড়ব সেটা পর্যন্ত ঠিক করে উঠতে পারছি না–কথাটা ঠিক তখনই আমার মন এল। হ্যাঁ, এটা ঠিকই, কাগজের আছে সহ্যগুণ এবং এই শক্ত মলাট দেওয়া নোটবই, জাক করে যার নাম রাখা হয়েছে। ‘ডায়রি’, সত্যিকার কোনো ছেলে বা মেয়ে বন্ধু না পেলে কাউকেই আমি দেখাতে যাচ্ছি না। কাজেই মনে হয় তাতে কারো কিছু আসে যায় না। এবার আদত ব্যাপারটাতে আসা যাক, কেন আমি ডায়রি শুরু করছি তার কারণটা। এর কারণ হল, আমার তেমন সত্যিকার কোনো বন্ধু নেই।

কথাটা আরেকটু খোলসা করে বলা যাক, কেননা তেরো বছরের একটি মেয়ে দুনিয়ায় নিজেকে একেবারে একা বলে মনে করে, এটা কারো বিশ্বাস হবে না, তাছাড়া তা নয়। আমার আছে খুব আদরের মা-বাবা আর ষোল বছরের এক দিদি। আমার চেনা প্রায় তিরিশজন আছে যাদের বন্ধু বলা যেতে পারে–আমার-একগোছা ছেলে-বন্ধু আছে, যারা আমাকে এক ঝলক দেখবে বলে উদ্গ্রীব এবং না পারলে, ক্লাসের আয়নাগুলোতে আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। আমার আত্মীয়স্বজনেরা আছে, মাসি-পিসি কাকা-মামার দল, তারা আমার ইষ্টিকুটুম; আর রয়েছে একটা সুখের সংসার, না–আমার কোনো অভাব আছে বলে মনে হয় না। তবে আমার সব বন্ধুরই সেই এক ব্যাপার, কেবল হাসি-তামাসা আর ঠাট্টা ইয়ার্কি, তার বেশি কিছু নয়। মামুলি বিষয়ের বাইরে কোনো কথা বলা যায় না। আমরা কেমন যেন কিছুতেই সেরকম ঘনিষ্ঠ হতে পারি না–আসল মুশকিল সেইখানে। হতে পারে। আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব, কিন্তু সে যাই হোক, ঘটনাটা অস্বীকার করা যায় না এবং এ নিয়ে আমার কিছু করার আছে বলে মনে হয় না।

সেই কারণেই, এই ডায়রি। যে বন্ধুটির আশায় এতদিন আমি পথ চেয়ে বসেছিলাম তার ছবিটা আমার মানসপটে বড় করে ফোঁটাতেও চাই; আমি তাই অধিকাংশ লোকের মতন। আমার ডায়রিতে একের পর এক নিছক ন্যাড়া ঘটনাগুলোকে সাজিয়ে দিতে চাই না; তার বদলে আমি চাই এই ডায়রিটা হোক আমার বন্ধু, আমার সেই বন্ধুকে আমি কিটি বলে ডাকব। কিটিকে লেখা আমার চিঠিগুলো যদি হঠাৎ দুম করে শুরু করে দিই তাহলে আমি কী বলছি কেউ বুঝবে না; সেইজন্যে আরম্ভে খানিকটা অনিচ্ছার সঙ্গে মাত্র কয়েকটা আঁচড়ে আমার জীবনের ছবি ফুটিয়ে তুলব।

মাকে যখন বিয়ে করেন তখন আমার বাবার বয়স ছত্রিশ আর মার বয়স পঁচিশ। আমার দিদি মারগট হয় ১৯২৬ সালে ফ্রাঙ্কফোর্ট-অন-মাইন শহরে, তারপর হই আমি–১৯২৯-এর ১২ই জুন। আমরা ইহুদী বলে ১৯৩৩ সালে আমরা হল্যাণ্ডে চলে যাই, সেখানে আমার বাবা। ট্রাভিস্ এন.ভি.-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। যে কোলেন অ্যান্ড কোম্পানীর সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তার অফিস একই বাড়িতে আমার বাবা তার পার্টনার।

আমাদের পরিবারের বাকি সবাইয়ের ওপর অবশ্য হিটলারের ইহুদী বিরোধী বিধি বাঁধনের পুরো চোট এসে পড়েছে, কাজেই জীবন ছিল দুর্ভাবনায় ভরা। যে সময়টা ইহুদীদের দ্যাখ-মার করা হয়, তার ঠিক পরে ১৯৩৮ সালে আমার দুই মামা পালিয়ে আমেরিকায় চলে যান। আমার বুড়ি-দিদিমা আমাদের কাছে চলে আসেন, তাঁর বয়স তখন তিয়াত্তর। ১৯৪০ সালের মে মাসের পর দেখতে দেখতে সুদিন উধাও হতে থাকে। প্রথমে তো যুদ্ধ, তারপর আত্মসমর্পণ, আর তারপরই জার্মানদের পদার্পণ। ওরা পৌঁছুনোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইহুদীদের লাঞ্ছনা দস্তুরমত শুরু হয়ে গেল। দ্রুত পর্যায়ে একের পর এক ইহুদীবিরোধী ফরমান জারি হতে লাগল। ইহুদীদের অবশ্যই হলদে তারা (যাতে আলাদাভাবে তাদের চেনা যায় সেইজন্যে জার্মানরা সমস্ত ইহুদীকে একটি করে ছয় মুখো হলুদ রঙের তারা সকলের চোখে পড়ার মতো করে পরতে বাধ্য করেছিল) পরতে হবে, ইহুদীদের সাইকেলগুলো অবশ্যই জমা দিতে হবে, রেলগাড়িতে ইহুদীদের চড়া নিষিদ্ধ এবং গাড়ি চালানোও তাদের বারণ। কেবল তিনটে থেকে পাঁচটার মধ্যে ইহুদীরা সওদা করতে পারবে এবং তাও একমাত্র ইহুদীদের দোকান’ বলে প্ল্যাকার্ড-মারা দোকানে। আটটার মধ্যে ফিরে ইহুদীদের ঘরে আটক থাকতে হবে। ঐ সময়ের পর এমন কি নিজের বাড়ির বাগানেও বসা চলবে না। থিয়েটার, সিনেমা এবং অন্যান্য আমোদ-প্রমোদের জায়গায় ইহুদীরা যেতে পারবে না। সাধারণের খেলা-ধুলোয় ইহুদীরা যেন যোগ না দেয়। সাঁতারের জায়গা, টেনিস, কোর্ট, হকির মাঠ এবং খেলাধুলোর অন্যান্য জায়গা–সবই তাদের জন্যে নিষিদ্ধ। ইহুদীরা যেন খৃষ্টানদের বাড়িতে না যায়। ইহুদীরা অবশ্যই যাবে ইহুদী স্কুলে। এই রকমের অনেক বিধিনিষেধ জারি হল।

আমরা এটা করতে পারি না, ওটা করা নিষিদ্ধ–এইরকম অবস্থা। কিন্তু তা সত্বেও দিন কেটে যেতে লাগল। গোপি আমাকে বলত, ‘যা কিছু করতে যাও তাতেই ভয়; বলা যায় না, হয়ত বারণ আছে। আমাদের স্বাধীনতায় বেজায় ধরাট। তবু সওয়া যাচ্ছিল।

১৯৪২-এর জানুয়ারিতে দিদু মারা গেলেন; আজও কিভাবে তিনি আমার হৃদয়মন জুড়ে আছেন, আমি তাকে কতটা ভালবাসি–সে কথা কেউ কখনও বুঝবে না।

১৯৩৪ সালে মন্টেসরি কিণ্ডারগার্টেনে আমার হাতেখড়ি, তারপর সেখানেই পাড়শুনো করি। ৬-খ শ্রেণীতে পড়ার সময় ইস্কুলের বৎসরান্তে মিসেস কে.ভে-এর কাছ থেকে আমাকে বিদায় নিতে হল। দুজনেই কেঁদে ফেললাম, মনও খুব খারাপ হয়ে গেল। ১৯৪১ সালে দিদি মারগটের সঙ্গে আমি গেলাম ইহুদী মাধ্যমিক ইস্কুলে–দিদি ভর্তি হল চতুর্থ শ্রেণীতে আর আমি প্রাথমিক শ্রেণীতে।

এ পর্যন্ত আমরা চারজনে নির্ঝঞ্ঝাটে আছি। এরপর আসব আজকের কথায়।

.

শনিবার, ২০ জুন, ১৯৪২

আদরের কিটি,

বিনা বাক্যব্যয়ে শুরু করে দেব। বাড়িটা এখন নীরব নিস্তব্ধ, মা-মণি আর বাপি বেরিয়েছেন আর মারগট গেছে ওর কিছু বন্ধুর সঙ্গে পিং-পং খেলতে।

ইদানীং আমি নিজেও পিং-পং খেলছি। আমরা যারা পিং-পং খেলি, আইসক্রিমের ওপর আমাদের একটু বেশি টান–বিশেষ করে গরমকালে, খেলতে খেলতে যখন শরীর তেতে যায়। কাজেই সচরাচর খেলার পর আমরা চলে যাই সবচেয়ে কাছাকাছি আইসক্রিমের দোকানে–ডেলফি কিংবা ওয়াসিসে–যেখানে ইহুদীরা যেতে পারে। বাড়তি হাত-খরচার জন্যে হাত পাতা আমরা এখন ছেড়ে দিয়েছি। ওয়াসিসে আজকাল প্রায়ই লোকজনে ভর্তি থাকে; আমাদের চেনাশহর বেশ বড় হওয়ায়, তার মধ্যে আমরা সব সময়ই কোনো না কোনো মহাশয় লোক বা ছেলেবন্ধু জুটিয়ে ফেলি। তারা আমাদের এত আইসক্রিম দেয় যা পুরো সপ্তাহ গোগ্রাসে গিলেও আমরা শেষ করতে পারি না।

আমাকে এই বয়সে ছেলে-বন্ধুর কথা মুখ ফুটে বলতে দেখে তুমি বোধহয় খানিকটা অবাক হবে। হায়, আমাদের যা ইস্কুল তাতে এটা কারো পক্ষে এড়ানো সম্ভব বলে মনে হয় না। যেই কোনো ছেলে আমার সঙ্গে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইল এবং আমরা কথা কইতে শুরু করে দিলাম–ব্যস, অমনি সে আকণ্ঠ প্রেমে পড়ে যাবে এবং স্রেফ সে আমাকে তার চোখের আড়াল হতে দেবে না; আমি ধরে নিতে পারি দশবারের মধ্যে নয় বারই এরকম ঘটবে। অবশ্য দিনকতক গেলেই সব পানি হয়ে যায়; বিশেষত যখন দেখে যে, অত সব জুল জুল করে তাকানো-টাকানো আদৌ গায়ে না মেখে আমি দিব্যি মনের আনন্দে সাইকেলে প্যাডেল করে চলেছি। এ ব্যাপারটা যদি আরেকটু বেশি গড়ায়, বাবার কাছে কথা পাড়ার কথা ওরা বলতে আরম্ভ করে সঙ্গে সঙ্গে সাইকেলটাকে একটু হেলিয়ে দিই, আমার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা পড়ে যায়। ছেলেটিকে তখন তার সাইকেল থেকে নামতেই হয়, আমাকে সে ব্যাগটা কুড়িয়ে দেয়। সেই ফাঁকে অন্য দিকে আমি কথার মোড় ঘোরাই।

এরা সব একেবারেই নিরীহ ধরনের ছেলে; কিছু আছে দেখবে যারা চুমো ফুকে দেয় কিংবা খপ করে হাত ব্রার চেষ্টা করে। সেক্ষেত্রে তারা অবশ্যই ভুল দরজায় কড়া নাড়ে! সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল থেকে আমি নেমে পড়ে বলি ওদের সঙ্গে আর একপাও যাব না; কিংবা ইজ্জত নষ্ট হওয়ার ভাব দেখিয়ে সাফ সাফ ওদের কেটে পড়তে বলি।

আমাদের বন্ধুত্বের ভিত গড়া হল। আজকের মত এখানেই ইতি।
তোমার আনা

.

রবিবার, ২১ জুন, ১৯৪২

আদরের কিটি,

আমাদের খ-১ ক্লাসের সকলেরই হাঁটু কাঁপছে, তার কারণ টিচারদের মিটিং আসন্ন। কে কে ওপরের ক্লাসে উঠবে আর কে কে পড়ে থাকবে, এই নিয়ে জোর জল্পনা-কল্পনা চলেছে। আমাদের পেছনে বসে ভিম্ আর য়া; ছেলে দুটির ব্যাপার-স্যাপার দেখে মিপ্‌ দ্য যোং আর আমি বেজায় মজা পাচ্ছি। যে ভাবে ওরা বাজি ধরে চলেছে তাতে ছুটিতে ওদের হাতে আর একটা পয়সাও থাকবে না। ‘তুমি উঠবে’, ‘উঠব না’, ‘উঠবে’,-উদয়াস্ত এই চলেছে। এমন কি মিও ওদের চুপ করতে বলে, আমি রেগে গলা বের করি–তাও ওদের থামানো যায় না।

আমার মতে, সিকি ভাগের উচিত যারা যে ক্লাসে আছে সেই ক্লাসেই থেকে যাওয়া। কিছু আছে একেবারেই নিরেট। কিন্তু টিচাররা দুনিয়ার সবচেয়ে আজব চিড়িয়া; কাজেই তারা হয়ত নেহাৎ খেয়ালবশেই জীবনে এই একবার ঠিক কাজ করে বসবেন।

আমার মেয়ে-বন্ধুদের ক্ষেত্রে আর আমার নিজের ব্যাপারে আমি ভয় পাচ্ছি না। আমরা কোনরকমে ঠেলেঠুলে বেরিয়ে যাব। অবশ্য আমার অঙ্কের ব্যাপারে আমি খুব নিশ্চিন্ত নই। তবু আমরা আর যা হোক ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারি, ইতিমধ্যেই আমরা পরস্পরকে খোশ মেজাজে রাখছি।

আমাদের টিচার মোট নয় জন–সাতজন শিক্ষক আর দুই জন শিক্ষত্রিয়ী। ওঁদের সকলের সঙ্গেই আমার বেশ বনিবনা। আমাদের বুড়ো অঙ্কের মাস্টার মিস্টার কেপ্টর অনেকদিন অব্দি আমার ওপর খুব বেজার ছিলেন, কারণ আমি একটু বেশি বকবক করি। ফলে, ‘একজন বাচাল’-এই বিষয়ে আমাকে একটা রচনা লিখতে হয়েছিল। একজন বাচাল। এ বিষয়ে কী-ই বা লেখা যায়? যাই হোক, এ নিয়ে পরে মাথা ঘামানো যাবে–মনে মনে এটা ঠিক করে আমার নোট বইতে টুকে রাখলাম। তারপর চেষ্টা করলাম নির্বিকার থাকতে।

সেদিন সন্ধ্যেবেলায় অন্যান্য বাড়ির কাজ যখন শেষ করে ফেলেছি, হঠাৎ আমার নোটবইতে লেখা শিরোনামাটার দিকে আমার নজর গেল। ফাউন্টেন পেনের শেষ প্রান্তটা। দাঁত দিয়ে খুঁটতে খুঁটতে, আমি ভাবতে লাগলাম–গোটা গোটা অক্ষরে বেশ ফাঁক-ফাঁক করে। শব্দ সাজিয়ে যে-কেউ কিছুটা আবোল-তাবোল লিখে যেতে পারে; কিন্তু মুশকিল হল বকবক করার আবশ্যকতা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করা। ভাবতে-ভাবতে, হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল–তখনই বসে আমার ভাগের তিনটি পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেললাম। আর লিখে তৃপ্তিও পেলাম। ষোল আনা। আমার যুক্তিগুলো ছিল এই বকবক করাটা হল মেয়েলী স্বভাব; আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব এই স্বভাবের রাশ টেনে রাখতে, কিন্তু আমার এ রোগ একেবারে সারবে না, কেন আমার মা আমার মতই বকবক করেন–সম্ভবত তার চেয়েও বেশি। রক্তের সূত্রে পাওয়া গুণগুলো নিয়ে কে-ই বা কী করতে পারে?

আমার যুক্তিগুলো দেখে মিস্টার কেপ্টর না হেসে পারেননি, কিন্তু পরের বারের পড়াতেও সমানে বকর বকর করতে থাকায় আরেকটি রচনার বোঝা ঘাড়ে এসে গেল। এবারের বিষয় হল ‘সংশোধনের অযোগ্য বাচাল’; লিখে যথারীতি তাঁর হাতে দেওয়ার পর পুরো দুই বারের পড়ায় তিনি আর কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। কিন্তু তৃতীয় বারের পড়ার দিনে তার পক্ষে আর চুপ করে থাকা সম্ভব হয়নি। কথা বলার শাস্তি হিসেবে আমাকে একটা রচনা লিখতে হবে, তার নাম হল বকবকচঞ্চুর ধূর গিন্নী বলল, ‘প্যাঁক্-প্যাঁক্-প্যাঁক’। সারা ক্লাস অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমাকেও হাসতে হল বটে, কিন্তু এটা বেশ মালুম হল যে, এ-বিষয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবনের শক্তি আমি ফুরিয়ে ফেলেছি। আমাকে তখন এমন জিনিস ভেবে বের করতে হল যা পুরোপুরি মৌলিক। আমার বরাত ভালো ছিল, কেননা আমার বন্ধু সানা ভালো কবিতা লেখে–সানা বলল পুরো রচনাটাই সে পদ্য করে লিখে দেবে। আমি তো আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। কেপ্টর চেয়েছিলেন এই রকম কিম্ভুত বিষয়ের প্যাচে ফেলে আমাকে বোকা বানাতে। আমি তার শোধ তুলব; সারা ক্লাসের কাছে তাকেই বরং হাস্যাস্পদ করে ছাড়ব। পদ্যটা লেখা হয়ে গেল হল একেবারে নিখুত। এক মা-হাঁস আর এক রাজহংস বাবার তিনটি ছিল ছানাপোনা। তারা বড় বেশি বকবক করত বলে বাপ ওদের কামড় দিয়ে মেরে ফেলে। ভাগ্য ভালো যে, কেপ্টর এর রসটা ধরতে পারেন; ক্লাসে তিনি টীকাটিপ্পনি সমেত জোরে জোরে পদ্যটা যেমন আমাদের ক্লাসে, তেমনি আরও অন্যান্য ক্লাসেও পড়ে শোনান।

তারপর থেকে ক্লাসে আমি অবাধে কথা বলতে পারি, আমার ঘাড়ে বাড়তি কাজ চাপানো হয় না; বস্তুত কেপ্টর সমস্ত সময়ই ব্যাপারটা নিয়ে তামাসা করেন।

তোমার আনা

.

বুধবার, ২৪ জুন, ১৯৪২

আদরের কিটি,

এখন সব আগুনে সেদ্ধ হচ্ছে, প্রচণ্ড গরমে আমরা সব রীতিমত গলে যাচ্ছি। আর ঠিক সেই সময় আমাকে সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে পায়ে হেঁটে। ট্রাম যে কত ভালো জিনিস এখন আমি তা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছি; কিন্তু ট্রামে চড়ার বিলাস ইহুদীদের পক্ষে নিষিদ্ধ আমাদের পক্ষে পা-গাড়িই প্রশস্ত। কাল দুপুরে টিফিনের সময়টাতে আমাকে যেতে হয়েছিল

য়ান লুইকেন স্ট্রাটে দাঁতের ডাক্তারের কাছে। দুপুরের পর ফিরে ইস্কুলে আরেকটু হলেই আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। ভাগ্য ভালো, দাঁতের ডাক্তারের সহকারিণী ছিলেন খুব দয়ালু, তিনি আমাকে খানিকটা পানীয় দিয়েছিলেন–মানুষটি বড় ভালো।

ফেরী নৌকোয় আমরা পার হতে পারি–ব্যস, ঐ পর্যন্ত। যোসেফ ইস্রাইলস্কাডে থেকে একটা ছোট বোট ছাড়ে, সেখানে বোটের লোকটিকে বলতেই সে আমাদের তৎক্ষণাৎ তুলে নিল। আজ আমাদের যে কষ্টের একশেষ তার জন্যে কিন্তু ওলন্দাজরা দায়ী নয়।

ইস্কুলে যেতে না হলে বাঁচতাম–কেননা ঈস্টারের ছুটিতে আমার সাইকেলটা চুরি হয়ে গেছে আর মা-মণিরটা বাপি দিয়েছেন এক খৃস্টান পরিবারকে নিরাপদে রাখার জন্যে। তবু রক্ষে, সামনে ছুটি–আর এক হপ্তা কাটাতে পারলেই আমাদের শান্তি। কাল একটা মজার ব্যাপার হল; সাইকেল রাখার আড়তটা পেরোচ্ছি, এমন সময় একজন আমার নাম ধরে ডাকল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি সেই সুন্দর দেখতে ছেলেটা, পরশু সন্ধ্যেবেলায় আমার মেয়ে-বন্ধু ইভাদের বাড়িতে যার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। লাজুক-লাজুক ভাব করে এগিয়ে এসে হ্যারি গোল্ডবার্গ বলে সে তার পরিচয় দিল। আমি একটু থতমত খেয়ে ঠিক ধরতে পারছি না ছেলেটা কী চাইছে। কিন্তু আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ইস্কুল অব্দি আমার সঙ্গে সে গেলে আমার আপত্তি হবে কিনা এটা সে জানতে চাইল। আমি বললাম, তুমি তো ঐ রাস্তাতেই যাচ্ছ, চলো আমিও যাচ্ছি’–এই বলে দুজনে হাঁটতে লাগলাম। হ্যারির বয়েস ষোল; ওর ঝুলিতে আছে মজাদার সব গল্প। আজ সকালেও রাস্তায় ও আমার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার মনে হয় এবার থেকে রোজই থাকবে।

তোমার আনা

.

মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ১৯৪২

আদরের কিটি,

এর আগে একদণ্ড সময় পাইনি তোমাকে লেখার। বৃহস্পতি বার সারাটা দিন বন্ধুদের সঙ্গে কেটেছে। শুক্রবার বাড়িতে অতিথিরা এসেছিল, আজ অবধি এইভাবে একটার পর একটা। এই একটা সপ্তাহে হ্যারি আর আমি পরস্পর সম্পর্কে বেশ খানিকটা জেনেছি; হ্যারি ওর জীবনের অনেক বৃত্তান্ত আমাকে বলেছে। হল্যাণ্ডে ও একা এসেছে। ও এখন ওর দাদু দিদিমার কাছে থাকে। হ্যারির বাবা-মা থাকেন বেলজিয়ামে। ফ্যানি বলে হ্রারির এক মেয়ে বন্ধু ছিল। ফ্যানিকেও আমি চিনি। খুব নরম প্রকৃতির খাটো ধরনের মেয়ে। আমাকে দেখার পর হ্যারির মনে হচ্ছে সে এতদিন ফ্যানির সান্নিধ্যে দিবাস্বপ্ন দেখত। আমার উপস্থিতিতে এমন কিছু সে পায় যা তাকে জাগিয়ে রাখে। দেখছ তো, আমরা সকলেই কোনো না কোনো কাজে লাগি এবং কখনও কখনও সেসব অদ্ভুত ধরনের কাজ! গোপি শনিবার রাত্তিরে এখানে ছিল, তবে রবিবার লিসূদের ওখানে চলে যায়; সময় যেন কাটতেই চাইছিল না। কথা ছিল হ্যারি সন্ধ্যেবেলায় আসবে। ছ-টা নাগাদ সে ফোন করলে আমি গিয়ে ধরলাম। হ্যরির গলা, ‘আমি হ্যারি গোল্ডবার্গ, দয়া করে আমাকে একটু ডেকে দেবেন?

‘হ্যাঁ, হ্যারি, আমি আনা বলছি’

‘হ্যালো, আনা, কেমন আছ?’

‘খুব ভালো, ধন্যবাদ।‘

‘আজ সন্ধ্যেবেলা আসতে পারছি না বলে আমার খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু তবু শুধু একটু কথা বলে আসতে চাই। দশ মিনিটের মধ্যে আসছি–অসুবিধে হবে না তো?

‘মোটেই না। এসো কিন্তু।‘

‘আচ্ছা, ছাড়ছি। এখুনি এসে যাব।’

রিসিভারটা রাখলাম।

চটপট ফ্রক বদলে ফেলে মাথার চুল একটু আঁচড়ে নিলাম। তারপর হ্যারির পথ চেয়ে দুরুদুরু বক্ষে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। অবশেষে দেখতে পেলাম ও আসছে। দেখামাত্র দৌড়ে নিচে ছুটে গেলাম না যে, সেটাই আশ্চর্য। তার বদলে ও বেলু না বাজানো পর্যন্ত আমি ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম। তারপর নিচে গেলাম। আমি দরজা খুলবামাত্র হ্যারি ছিটুকে ভেতরে এল। ‘আনা, আমার দিদিমা মনে করেন তোমার মতো ছোট্ট মেয়ের আমার সঙ্গে প্রতিদিন বাড়ির বাইরে যাওয়া ঠিক নয়, উনি মনে করেন আমার উচিত লোর্স এ যাওয়া। তবে এটা তুমি আশাকরি জানো যে, আমি আর এখন ফ্যানিকে নিয়ে বেড়াতে বের হই না?’

‘জানি না তো; কেন, তোমরা কি আড়ি করেছ?’

‘না, না, তা নয়। আমি ফ্যানিকে বলেছি যে, আমাদের দুজনের ঠিক পটে না; সুতরাং দুজনে মিলে বাইরে বের না হওয়াই আমাদের পক্ষে ভালো। অবশ্য আমাদের বাড়িতে সবাই সব সময়ই তাকে স্বাগত জানাবে; তেমনি আশাকরি ওর বাড়িতেও আমার জন্যে দ্বার অবারিত থাকবে। দেখ, আমি ভেবেছিলাম ফ্যানি অন্য একটি ছেলের সঙ্গে বেরোয়; ওর সঙ্গে আমার ব্যবহারটাও হয়েছিল সেইরকম। কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ সত্যি ছিল না। এখন আমার মামা বলেন আমার উচিত ফ্যানির কাছে ক্ষমা চাওয়া। আমার বয়ে গেছে। সুতরাং গোটা ব্যাপারটাই আমি কাটাকাটি করে দিয়েছি। এটা তো ছিল আরও অনেক কারণের মধ্যে মাত্র একটি।

আমার দিদিমার ইচ্ছে, তোমার সঙ্গে না গিয়ে আমি ফ্যানির সঙ্গে যাই; কিন্তু আমি তা করব না। বুড়োমানুষদের মাথায় মাঝে মাঝে এমন বিকট সেকেলে সব ধারণা চেপে বসে! কিন্তু ওদের গোড়ে গোড় দিয়ে চলতে পারব না। দাদু-দিদিমাকে ছাড়া যেমন আমার চলবে না, তেমনি এক হিসেবে আমাকে ছাড়াও ওঁদের চলবে না। এবার থেকে বুধবারের সন্ধেগুলো আমি ফাঁকা পাব।

দাদু-দিদিমার মন রাখার জন্যে আমি নামে কাঠখোদাইয়ের ক্লাস করতে যাই। কিন্তু আদতে যাই জিওনিস্ট-পন্থীদের সভাসমিতিতে। আমার যাওয়ার কথা নয়, কেননা আমার দাদু-দিদিমারা জিওনিস্টদের খুবই বিরুদ্ধে।

আমি আদৌ ধর্মান্ধ নই, কিন্তু ওদিকে আমার একটা ঝোঁক আছে আর মনটাও টানে। কিন্তু ইদানীং এই নিয়ে এমন একটা হ-য-ব-র-ল সৃষ্টি হয়েছে যে আর আমি এর মধ্যে থাকছি না; পরের বুধবারই হবে আমার শেষ যাওয়া। তারপর থেকে বুধবারের সন্ধ্যেগুলো, শনিবারের বিকেল, রবিবারের বিকেল এবং হয়ত আরও কোনো কোনো দিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে।’

কিন্তু তোমার দাদু-দিদিমারা তো এটা চান না; তাদের ফাঁকি দিয়ে তুমি এটা করতে পারো না।’

‘ভারবাসা ঠিকই তার পথ করে নেয়।‘

এরপর আমরা মোড়ের মাথায় বইয়ের দোকানটা পেরোতেই দেখি আরও দুটি ছেলের

সঙ্গে পেটার ভেসেল দাঁড়িয়ে; পেটার বলল, ‘আরে, কী খবর?’–দীর্ঘদিন পর সে আমার সঙ্গে এই প্রথম কথা বলল; আমি সত্যিই খুশী হলাম।

হ্যারি আর আমি হাঁটছি তো হাঁটছিই। শেষকালে ঠিক হল, কাল সন্ধ্যে সাতটার পাঁচ মিনিট আগে হ্যারিদের বাড়ির সামনে আমাদের দেখা হবে।

তোমার আনা

.

শুক্রবার, ৩ জুলাই, ১৯৪২

আদরের কিটি,

কাল হ্যারি আমাদের বাড়িতে এসেছিল বাবা-মার সঙ্গে আলাপ করতে। আমি কিনে এনেছিলাম ক্রীম কেক, মিষ্টি, চা আর বাছাই করা বিস্কুট, বেশ পছন্দসই সব খাবার। কিন্তু আমি বা হ্যারি, আমরা কেউই চাইনি হাত-পা গুটিয়ে অনির্দিষ্টকাল বাড়ি বসে থাকতে। কাজেই আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম হাঁটতে। ও যখন আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল তখন দেখি আটটা বেজে দশ। বাবা তো রেগে কাই; বললেন, আমি খুব অন্যায় করেছি; কারণ আটটার পর ইহুদীদের বাইরে থাকা খুবই বিপজ্জনক। আমাকে কথা দিতে হল যে, এরপর থেকে আটটা বাজার দশ মিনিট আগেই আমি বাড়ি ফিরব।

কাল হ্যারিদের বাড়িতে আমাকে যেতে বলেছে। আমার মেয়ে-বন্ধু গোপি সারাক্ষণ হ্যারি হ্যারি করে আমার পেছনে লাগে। না গো, আমি সত্যিই কিন্তু প্রেমে পড়িনি। কিছু ছেলে-বন্ধু তো আমার থাকতেই পারে–কেউ ও নিয়ে মাথা ঘামায় না। তবে একজন ছেলে বন্ধু অথবা মা যাকে বলেন বল্লভ, অন্যদের চেয়ে সে যেন আলাদা।

একদিন সন্ধ্যেবেলায় হ্যারি গিয়েছিল ইভাদের বাড়িতে। ইভা বলল হ্যারিকে ও জিগ্যেস করেছিল, ‘ফ্যানি না আনা-কাকে তোমার সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে?’ হ্যারি বলেছিল, সে তোমার জেনে কাজ নেই। কিন্তু চলে যাবার আগে (বাকি সন্ধ্যেটা ওরা বাক্যালাপ বন্ধ করে দিয়েছিল), শোনো তবে, সেই মেয়ে হল আনা, এখন পর্যন্ত। কিন্তু কাউকে বলবে না। বলেই হ্যারি সাঁ করে বেরিয়ে গিয়েছিল।

দেখেই বোঝা যায় হ্যারি আমার প্রেমে পড়েছে, এর মধ্যে তবু একটু মজা আছে, মন্দ কি। মারগট বলবে, ‘হ্যারি খাসা ছোকরা!’ হ্যাঁ, তবে সেটাই সব নয়। মা তো তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ; যেমন দেখতে ভালো, তেমনি সুন্দর আচার-ব্যবহার, চমৎকার ছেলেটি। আমার ভালো লাগে, বাড়ির সবাই ওকে পছন্দ করে। হ্যারিরও সবাইকে পছন্দ। ও অবশ্য মনে করে আমার মেয়ে-বন্ধুরা বড় বেশি খুকি-খুকি। হ্যারি মিথ্যে বলে না।

তোমার আনা

.

রবিবার, ৫ জুলাই, ১৯৪২

আদরের কিটি, ইহুদী নাট্যনিকেতনে আমাদের পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হল। আমি এর চেয়ে ভালো আশা করিনি। আমার রিপোর্ট মোটেই খারাপ নয়। একটাতে ‘খুব ভালো’, বীজগণিতে একটা পাঁচ মার্কা, দুটোতে ছয়, আর বাকিগুলোতে কোনোটাতে সাত, কোনোটাতে আট। বাড়ির লোকেরা খুশী হয়েছে তো বটেই, তবে আমার মা-বাবা নম্বরের ব্যাপারে আদৌ অন্যদের মত নন। রিপোর্টের ভাল-মন্দ নিয়ে ওঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি সুখে-স্বচ্ছন্দে বহাল তবিয়তে আছি, একেবারে বাদর হয়ে যাইনি–এটা দেখলেই ওঁরা খুশী। ওঁরা মনে করেন, বাকিটা আপসে হয়ে যাবে। আমার ঠিক তার উল্টো। আমি পড়াশুনো খারাপ হতে চাই না। মণ্টেরী ইস্কুলে প্রকৃতপক্ষে সপ্তম শ্রেণীতেই আমার থেকে যাওয়ার কথা, কিন্তু ইহুদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আমাকে নিয়ে নেওয়া হল। ইহুদী ইস্কুলে ভর্তি হওয়া যখন সমস্ত ইহুদী ছেলেমেয়েদের পক্ষে বাধ্যতামূলক হল, তখন খানিকটা অনুনয় বিনয় করার ফলে তবে হেডমাস্টার মশাই আমাকে আর লিসকে শর্তাধীনে ইস্কুলে নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আমি তাঁর আশাভঙ্গ করতে চাই না। আমার দিদি মারগটও তার রিপোর্ট পেয়েছে; এবারও সে দারুণ ভালো করেছে। ইস্কুলে ‘সপ্রশংস গোছের কোনো ব্যবস্থা থাকলে সেটা পেয়েই সে ওপরে উঠতে পারত, ও যা মাথাওয়ালা মেয়ে! বাবা ইদানীং খুব বেশি সময় বাড়িতেই থাকেন, কেন না ব্যবসার ক্ষেত্রে বাবার কিছু করার নেই; নিজেকে ফালতু বলে ভাবতে নিশ্চয়ই খুব জঘন্য লাগে। ট্রাভিস নিয়ে নিয়েছেন মিস্টার কুপহুইস; কোলেন অ্যাণ্ড কোম্পানী চলে গিয়েছে মিস্টার ক্রালারের হাতে। কদিন আগে আমাদের ছোট্ট চত্বরটা হেঁটে পার হওয়ার সময় আমাদের গা-ঢাকা দিয়ে থাকার কথাটা বাবা পাড়লেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী এমন ঘটল যে হঠাৎ দুম করে এখনই একথা তিনি বলতে শুরু করলেন। বাবা বললেন, ‘দেখ আনা, তুই তো জানিস যে, আজ এক বছরেরও বেশি দিন ধরে অন্য লোকদের সমানে আমরা খাবারদাবার, জামাকাপড়, আসবাবপত্র যুগিয়ে আসছি। আমরা চাই না জার্মানরা আমাদের যথাসর্বস্ব কুজা করুক, তেমনি আমরা নিশ্চয়ই চাই না নিজেরা স্বয়ং ওদের কবলে গিয়ে পড়তে। কাজেই ওরা কবে আসবে, এসে তুলে নিয়ে যাবে তার অপেক্ষায় না থেকে আমরা বরং নিজেদের গরজেই গা-ঢাকা দেব।’

বাবা এমন গুরুতরভাবে কথাগুলো বললেন যে, আমার গলাতেও খুব ব্যগ্রতা ফুটে উঠল, ‘তাহলে, বাবা, এটা হবে কবে নাগাদ?’

‘ও নিয়ে তুই উতলা হোস নে, আমরা সময়মত সব ঠিক করে ফেলব। যতদিন পারিস, কচি বয়েস তোর, গায়ে ফু দিয়ে বেড়া।’ ব্যস, কথা শেষ। হায়, এই অলুক্ষণে কথাগুলো ফলতে যেন যুগ যুগ দেরি হয়!

তোমার আনা।

.

বুধবার, ৮ জুলাই, ১৯৪২

আদরের কিটি,

রবিবার থেকে আজ–এই কয়েকটা দিন মনে হল যেন কয়েকটা বছর। কত কিছু যে ঘটে গেছে এর মধ্যে। গোটা পৃথিবীটা যেন মাটিতে উল্টে পড়েছে। কিন্তু এখনও আমি প্রাণে বেঁচে রয়েছি, কিটি–বাবার মতে, সেটাই বড় কথা।

এখনও বেঁচে আছি ঠিকই, তবে জিজ্ঞেস করো না যেন কোথায় আর কিভাবে। তুমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝবে না, যতক্ষণ না রবিবার বিকেলে কী ঘটেছিল তোমাকে বলছি।

বেলা তখন তিনটে (হ্যারি সবে চলে গেছে, যাবার সময় বলেছে পরে আবার আসবে) সামনের দরজায় কে যেন বেল বাজাল। আমি তখন বারান্দায়, রোদুরে গা এলিয়ে দিয়ে একটা বই পড়ছি; ফলে, আমি শুনতে পাইনি। খানিকক্ষণ পরে মারগটকে দেখলাম, রান্নাঘরের দরজায়; তার চোখমুখ লাল। ফিসফিস করে বলল, ‘ঝটিকা-বাহিনী থেকে বাপির নামে শমন পাঠিয়েছে। মা-মণি সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার ফান ডানের সঙ্গে-দেখা করতে চলে গেছেন।’ (ফান ডান হলেন ব্যবসাতে বাবার সহকর্মী এক বন্ধু)। শমন এসেছে শুনে তো আমার বুক হিম হয়ে গেল; শমন আসার যে কী মানে তা সকলেই জানে। বন্দীশিবির আর নির্জন কুঠুরির ছবিটা মনের মধ্যে ভেসে উঠল–বাপিকে কি আমরা নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে ছেড়ে দেব? দুজনে তখন অপেক্ষা করছি; মারগট স্পষ্ট ভাষায় বলল, ‘বাবা অবশ্যই যাবেন না। আমরা কাল আমাদের গোপন ডেরায় চলে যাব কিনা, মা-মণি গেছেন সেই নিয়ে ফান ডানের সঙ্গে আলোচনা করতে। ফান ডান পরিবারও আমাদের সঙ্গে যাবে। সুতরাং সর্বসাকুল্যে আমরা হব সাতজন। তারপর চুপ। দুজনের কেউই কিছু বলছি না, আমাদের মাথায় তখন বাপির সম্বন্ধে চিন্তা। বাপি গেছেন ঝুড়সে ইভালিডেতে কয়েকজন বুড়োবুড়িকে দেখতে, এদিকে, কী ঘটছে তার বিন্দুবিসর্গ তিনি জানেন না। একে গরম, তার ওপর কী-হয়। কী-হয় ভাব নিয়ে আমরা মা-মণির ফিরে আসার অপেক্ষায়; সব মিলিয়ে আমরা বেজায় সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছি, আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই।

হঠাৎ দরজায় আবার বেল বাজল। আমি বললাম, ‘হ্যারি এসেছে।‘ মারগট আমাকে টেনে ধরল, ‘দরজা খুলিস নে।‘ কিন্তু তার দরকার ছিল না, কেননা ঠিক সেই সময় নিচের তলায় আমরা মা-মণি আর মিস্টার ফান ডানের গলা পেলাম, ওরা হ্যারির সঙ্গে কথা বলছিলেন। তারপর ওঁরা ভেতরে এসে বাইরের দরজাটা এঁটে দিলেন। এরপর যখনই বেল বাজার শব্দ হয় আমরা নিঃশব্দে গুড়ি মেরে নিচে গিয়ে দেখে আসি বাপি এলেন কিনা, আর কেউ এলে দরজা খুলি না।

মারগটকে আর আমাকে ঘর থেকে বার করে দেওয়া হল। ফান ডান, মা-মণির সঙ্গে একা কথা বলতে চান। আমাদের শোবার ঘরে আমরা যখন একা হলাম, মারগট আমাকে বলল শমনটা বাপির নামে নয়, আসলে তার নামে। শুনে আমি আরও ঘাবড়ে গিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। মারগটের বয়েস ষোল; ওরা কি সত্যি ঐ বয়সের মেয়েদের একা তুলে নিয়ে যাবে? তবু ভালো যে, মারগট কিছুতেই যাবে না, সে কথা মা-মণি নিজেই বলেছেন, বাপি যখন আমাদের লুকিয়ে থাকার ব্যাপারে বলছিলেন, তখন সেটাই ছিল তারও মনোগত অভিপ্রায়।

অজ্ঞাতবাসে যাওয়া কোথায় যাব আমরা, শহরে না গ্রামে, বড় বাড়িতে না কুঁড়েঘরে, কবে কখন কিভাবে কোথায়…?

এমন সব প্রশ্ন যা মুখ ফুটে কাউকে জিগ্যেস করা যাবে না, আবার মন থেকে যে ঝেড়ে ফেলে দেব তাও সম্ভব নয়। আমি আর মারগট একটা স্কুলব্যাগে আমাদের সবচেয়ে জরুরি। জিনিসগুলো পুরে ফেলতে শুরু করে দিলাম। প্রথমেই যেটা পুরে ফেললাম সেটা হল এই ডায়রিটা, তারপর চুল কোঁকড়া করার জিনিসপত্র, রুমাল, ইস্কুলের বই, একটা চিরুনি, পুরনো চিঠিচাপাটি; যাচ্ছি অজ্ঞাতবাসে এই ভেবে আমি ব্যাগে ভরেছি যতসব উদভুট্টে জিনিস। কিন্তু তাতে আমার কোনো খেদ নেই আমার কাছে পোশাক-আশাকের চেয়েও ঢের বেশি অর্থবহ হল স্মৃতি।

শেষ পর্যন্ত বাপি এসে গেলেন বেলা পাঁচটায়। সন্ধ্যে নাগাদ আসতে পারেন কিনা জানতে চেয়ে মিস্টার কুপহুইসকে আমরা ফোন করলাম। ফান ডান বেরিয়ে গিয়ে মিপুকে ডেকে আনলেন। ১৯৩৩ থেকে বাপির সঙ্গে মিপের ব্যবসার সম্পর্ক এবং সেই থেকে তাঁরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু; মিপের সদ্য সদ্য বিয়ে-করা স্বামী হেংকও তাই। মিপ এসে তার ব্যাগে কিছু জুতো, কামাকাপড়, কোট, আণ্ডারওয়্যার আর মোজা নিয়ে চলে গেলেন। বলে গেলেন সন্ধ্যেবেলায় আবার আসবেন। তারপর বাড়ি জুড়ে বিরাজ করতে লাগল নৈঃশব্দ্য; আমাদের কারো খাওয়ার কোনো স্পৃহা নেই; তখনও বেশ গুমসানো গরম ভাব এবং সব কিছুই যেন। কেমন-কেমন। আমাদের ওপরের বড় ঘরটা মিস্টার গুডস্মিট বলে একজনকে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। স্ত্রীর সঙ্গে ওঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, ভদ্রলোকের বয়স ত্রিশের কোঠায়। এদিন সন্ধ্যেবেলায় হবি তো হ, ওঁর আবার করবার কিছু ছিল না; রাত প্রায় দশটা অব্দি উনি নেই আঁকড়া হয়ে লেগে রইলেন; ওঁকে ভাগাতে গিয়ে একটু অভদ্র হতেই হল। এগারোটায় এলেন। মিআর হেংক ফান সানৃটেন। জুতো, মোজা, বই, অন্তর্বাস আরও একবার মিপের ব্যাগ আর হেংককের লম্বা পকেটের মধ্যে গা-ঢাকা দিল এবং সাড়ে এগারোটা নাগাদ তারা নিজেরাও চোখের আড়াল হলেন। ক্লান্তিতে আমার শরীর ভেঙে পড়ছিল; নিজের বিছানায় এই আমার শেষ রাত জেনেও আমি তৎক্ষণাৎ ঘুমিয়ে পড়লাম; পরদিন সকাল সাড়ে পাঁচটায় আমাকে ডেকে দেবার আগে পর্যন্ত আমি একেবারে ন্যাতা হয়ে ঘুমিয়েছি।

দিনটা ভাগ্যিস রবিবারের মতো অত গরম ছিল না; সারাদিন সমানে টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ল। আমরা এমনভাবে একগাদা জামাকাপড় গায়ে চড়িয়ে নিলাম যেন কুমেরুতে যাচ্ছি। এর একটাই কারণ ছিল–সঙ্গে যথাসম্ভব জামাকাপড় নেওয়া। সুটকেশ ভর্তি জামাকাপড় নিয়ে বাইরে বেরুনোর কথা আমাদের অবস্থায় কোনো ইহুদী স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। আমি পরে নিয়েছি দুটো ভেস্ট, তিনজোড়া প্যান্ট, একটা ড্রেস স্যুট, তার ওপর একটা স্কার্ট, জ্যাকেট, সুতীর কোট, দুই জোড়া মোজা, লেস লাগানো জুতো। পশমের টুপি, স্কার্ফ এবং আরও কিছু কিছু; বাড়ি থেকে বেরোবার আগে আমার প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল, কিন্তু তা। নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি।

মারগট তার ইস্কুলের ব্যাগে পড়ার বই ভর্তি করে তার সাইকেলটা আনিয়ে নিয়ে মিপের পিছু পিছু উধাও হয়ে গেল এমন কোথাও যা আমার কাছে অজানা। তখনও আমি জানতাম না আমাদের আত্মগোপনের আস্তানাটা কোথায়। সাড়ে সাতটার সময় দরজা টেনে দিয়ে আমরা বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমার মিনিবেড়াল মুরটিয়ে ছিল একমাত্র প্রাণী যার কাছ থেকে আমি বিদায় নিলাম। প্রতিবেশীদের কাছে সে ভালোভাবেই থাকবে। এসব কথা মিস্টার গুডস্মিটের নামে একটা চিঠিতে লেখা হল।

বেড়ালের জন্যে রান্নাঘরে থাকল এক পাউণ্ড মাংস, প্রাতরাশের জিনিসপত্র টেবিলের ওপর ছড়ানো, বিছানাগুলো টান দিয়ে তোলা দেখে মনে হবে আমরা যেন হুটপাট করে চলে গিয়েছি। লোকের কী ধারণা হবে, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা ছিল না; আমরা শুধু চেয়েছিলাম সরে পড়তে কোনরকমে পালিয়ে গিয়ে নিরাপদে পৌঁছুতে; ব্যস, শুধু এইটুকু। এর পরের কথা কালকে।

তোমার আনা।

.

বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ১৯৪২

আদরের কিটি,

এইভাবে অবিরল বর্ষণের মধ্যে বাবা মা আর আমি হেঁটে চললাম; আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে স্কুলব্যাগ আর বাজারের থলি, তার মধ্যে ঠেসে-ফুসে ভর্তি করা রাজ্যের জিনিস।

যেসব লোক কাজে যাচ্ছিল, তারা সহানুভূতির চোখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। তাদের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে, তাদের গাড়িতে তারা আমাদের নিয়ে যেতে পারছে না বলে তারা  বেশ দুঃখিত; ক্যাটকেটে হলদে তারাই এর জন্যে দায়ী।

যখন আমরা বড় বড় রাস্তায় এসে পড়লাম, কেবল তখনই মা-মণি আর বাপি একটু একটু করে গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে ভাঙলেন। বেশ কয়েক মাস ধরে আমাদের মালপত্র এবং নিত্যব্যবহার্য যাবতীয় জিনিস যথাসম্ভব সরিয়ে ফেলা হয়েছে; অজ্ঞাতবাসের সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করে নিজে থেকে আমাদের চলে যাওয়ার কথা ছিল জুলাই ১৬ তারিখে। হঠাৎ শমন আসায় দশদিন আগেই আমাদের চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে; ফলে যেখানে যাচ্ছি। সেখানে তেমন পরিপাটি ব্যবস্থা করা যায়নি, কিন্তু তারই মধ্যে যতটা সম্ভব মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়া হয়েছে, যে বাড়িতে বাবার অফিস, সেখানেই আমাদের গোপন ডেরা। বাইরের লোকের পক্ষে বোঝা শক্ত হবে; যাই হোক, পরে আমি সেটা বুঝিয়ে বলব। বাপির যে কারবার তাতে কর্মচারী খুব বেশি ছিল না। মিস্টার ক্রালার, কুপহুইস, মিস্ আর তেইশ বছর বয়সের টাইপিস্ট এলি ফসেন–শুধু এরাই আমাদের আসবার কথা জানতেন। এলির বাবা মিষ্টান পসেন আর দুটি ছোকরা কাজ করত মালগুদামে তাদের সেকথা জানানো হয়নি।

বাড়িটার চেহারা কি রকম বলছি–একতলায় একটা খুব বড় গুদামঘর, সেখানে মালপত্র রাখা হয়। বাড়ির সদরদরজাটা গুদামঘরের দরজার ঠিক পাশেই, এবং সদরদরজার প্রবেশপথে আরও একটি দরজা–সেখান থেকে উঠে গেছে সিঁড়ি (ক)। সিঁড়ির মাথায় ঘষা কাচ লাগানো আরেকটি দরজা, তাতে কালো কালিতে আড়াআড়ি ভাবে লেখা ‘অফিসঘর’। সেটাই হল সদরদপ্তর, খুব বড়, খুব খোলামেলা এবং খুব গমগমে। এলি, মি আর মিস্টার কুপহুইস দিনমানে সেখানে কাজ করেন। একটা ছোট এঁদো ঘরে সিন্দুক, গা-আলমারি, একটা বড় কাবার্ড; সেই ঘর পেরিয়ে ছোট অন্ধকারমত আরেকটি অফিসঘর। আগে এখানে বসতেন মিস্টার ক্রালার আর মিস্টার ফান ডান–এখন মিস্টার ক্রালার বসেন একা। দালানটা দিয়ে সোজা মিস্টার ক্রালারের অফিসঘরে যাওয়া যায়; কিন্তু একমাত্র যে কাঁচের দরজাটা দিয়ে যেতে হয়, সেটা বাইরে থেকে সহজে খোলা যায় না–খুলতে হয় ভেতর থেকে।

ক্রালারের অফিস থেকে কয়লাগাদার পাশ দিয়ে একটা লম্বা দালানপথ চলে গেছে; তার শেষে চার ধাপ উঠলে গোটা বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে জমকালো ঘর ও দপ্তরের খাসকামরা। গাঢ় রঙের ভবিযুক্ত আসবাব, লিনোলিয়াম আর কার্পেট বিছানো মেঝে, রেডিও, ঝকঝকে বাতি। সবই প্রথম শ্রেণীর। এর ঠিক গায়েই বেশ বড়সড় একটা রান্নাঘর, তাতে পানির কল আর গ্যাসের চুলা, পাশেই বাথরুম। এই নিয়ে হল দোতলা। নিচেকার দালানপথ থেকে একটা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে ওপরতলা (খ)। ওপরে উঠে গেলে একটা ছোট যাতায়াতের পথ। তার দুদিকে দুটো দরজা। বাদিকের দরজা দিয়ে বাড়ির সামনের অংশে। মালগুদামে যাওয়া যায়, অন্যটা দিয়ে যাওয়া যায় চিলেকোঠায়। ওলন্দাজদের সিঁড়িগুলো হয়। বেজায় খাড়া–তারই একটা দিয়ে নেমে গিয়ে নিচের দরজা খুললেই রাস্তা (গ)।

ডানহাতি দরজাটা দিয়ে আমাদের ‘গুপ্ত মহল’টাতে যেতে হয়। বাইরে থেকে দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না যে সাদামাটা ছাই-রঙা দরজাটার ঠিক আড়ালেই এতগুলো ঘর রয়েছে। দরজার সামনে একটা পৈঠে, সেটা পেরোলেই অন্দরমহল।

প্রবেশপথের ঠিক সামনা-সামনি একটা খাড়া সিঁড়ি (ঘ)। বাঁদিকের ছোট গলিটা দিয়ে এগোলে একটা ঘর, সেটা হল ফ্রাঙ্ক-পরিবারের শোয়া-বসার ঘর। তার গায়েই তুলনায় একটা ছোট ঘর–সেটা হল পরিবারের দুই তরুণীর পড়ার আর শোয়ার ঘর। ডানদিকের জানলাহীন ছোট ঘরটাতে এক পাশে বেসিন লাগানো পানির কল আর অন্য পাশে পায়খানার খোপ। অন্য দরজা দিয়ে গেলে মারগট আর আমার ঘর। এর পরের সিঁড়িটা দিয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে তোমার তাক লেগে যাবে। ক্যানেলের পাশে এরকম একটা সেকেলে বাড়িতে আলোয় ঝলমল কী প্রকাণ্ড ঘর। ঘরটার একপাশে একটা গ্যাসের চুলো আর একটা হাত ধোয়ার জায়গা (আগে এটা ল্যাবোরেটারি হিসেবে ব্যবহার হত কিনা)। এখন এটা ফান ডান দম্পতির রান্নাঘর; তাছাড়া সাধারণভাবে সকলেরই বসার ঘর, খাওয়ার ঘর এবং বাসন মাজার জায়গা। একটা ছোট এইটুকু দালানঘর হবে পিটার ফান ডানের বাসস্থান। আর নিচের তলার ল্যাণ্ডিংটার মতই রয়েছে বিরাট একটা চিলেকোঠা। এখন তাহলে গোটা ব্যাপারটা বুঝলে। আমাদের ভারি সুন্দর গোটা ‘গুপ্ত মহল’টার সঙ্গে তোমাকে আমি পরিচয় করিয়ে দিয়েছি।

তোমার আনা

.

শুক্রবার, ১০ জুলাই, ১৯৪২

আদরের কিটি,

আমাদের বাসস্থানের প্যাচানো লম্বা ফিরিস্তি পড়ে তুমি নিশ্চয় ত্যক্ত-বিরক্ত। কিন্তু তবু আমি মনে করি যে, আমরা কোথায় এসে ঠেকেছি সেটা তোমার জানা উচিত।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম–দেখছ তো, এখনও আমার কথা শেষ হয়নি–প্রিনসেনগ্রাখটে যখন। আমরা এসে পৌঁছুলাম, মি তাড়াতাড়ি আমাদের ওপরতলায় নিয়ে গিয়ে ‘গুপ্ত মহলে’ তুললেন। মি দরজা বন্ধ করে দিতেই আমরা একা হয়ে গেলাম।

মারগট সাইকেল চালিয়ে ঢের তাড়াতাড়ি এসে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। আমাদের বসবার আর অন্যান্য সমস্ত ঘরই ছিল অকথ্য ভাবে রাবিশে ভর্তি। আগের মাসগুলোতে অফিসে যত কার্ডবোর্ডের বাক্স এসেছে, সবই হয় মেঝেতে, নয় বিছানার ওপর স্তুপাকার হয়ে আছে।

ছোট ঘরটার মট্‌কা অব্দি বিছানার চাদরে কাপড় ঠাসা। আমরা দেখলাম, সে রাত্রে ভদ্রগোছের বিছানায় যদি শুতে হয় তাহলে তক্ষুনি সব সাফসুফ করা দরকার। আমরা সে কাজ শুরু করে দিলাম। মা আর মারগটের কিছু করবার অবস্থা ছিল না; ওরা এত ক্লান্ত যে বিছানায় নেতিয়ে পড়েছিল, মন খারাপ হওয়া ছাড়াও আরও অনেক কিছু ছিল। পরিবারের দুই-‘ধাঙড়’–আমি আর বাপি–আমরা তৎক্ষণাৎ কাজ শুরু করে দিতে চাইলাম।

দম ফুরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সারাদিন ধরে আমরা বাক্স থেকে জিনিস বের করলাম, তাকগুলোতে ভরলাম, হাতুড়ি ঠুকলাম আর গোছগাছ করলাম। তারপর সে রাতে পরিষ্কার বিছানার ওপর লম্বা হলাম।

সারাটা দিন আমরা দাঁতে কুটো কাটিনি, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায়নি। মা আর মারগট এমন নেতিয়ে পড়েছিল যে তাদের খাওয়ার মতো মনমেজাজই ছিল না। অন্যদিকে বাবা আর আমি খাওয়ার কোনো ফুরসতই পাইনি।

মঙ্গলবার সকালে আমরা তার আগের দিনের কাজের জের টানতে লাগলাম। এলি আর মি আমাদের হয়ে রেশন তুলে এনে দিলেন। বাবা মন দিলেন বাইরে আলো না যাওয়ার ব্যবস্থাটাকে আরও পাকাঁপোক্ত করতে। আমরা রান্নাঘরের মেঝে থেকে ঘষে ঘষে ময়লা তুললাম। সেদিনও সারাদিন ধরে আমাদের এইসব চলল। আমার জীবনে এত বড় একটা ওলট-পালট হয়ে গেল, বুধবারের আগে তা নিয়ে ভাববার কোনো সময়ই পাইনি।

এখানে আসবার পর সেই প্রথম আমি জো পেলাম তোমাকে সব কিছু জানাবার আর সেই সঙ্গে এই বিষয়ে নিজেও ঠিকঠাক বোঝবার যে, আমার জীবনযাত্রায় আদতে কী ঘটে গেছে এবং এরপরেও কী ঘটতে যাচ্ছে।

তোমার আনা

.

শনিবার, ১১ জুলাই ১৯৪২

আদরের কিটি,

প্রত্যেক পনেরো মিনিট অন্তর সময় জানান দেয় যে ভেস্টারটোরেন ঘড়ি, তার আওয়াজে বাবা, মা আর মারগট–এরা কেউই এখনও ঠিক ধাতস্থ হতে পারেনি আমি পেরেছি। গোড়া থেকেই আওয়াজটা আমার মনে ধরেছে, বিশেষ করে রাতের বেলায় তাকে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু বলে মনে হয়। অদৃশ্য হয়ে যেতে কেমন লাগে সেটা জানতে তুমি বোধহয় উৎসুক হবে; দেখ, আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে আমি নিজেই এখনও তা জানি না। আমার মনে হয় না, এ বাড়িতে আমি কখনও সত্যিকার স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব; তার মানে এ নয় যে, এখনে থাকাটা আমি ঘোরতরভাবে অপছন্দ করছি; এটা অনেকটা যেন ছুটির সময় খুব বেখাপ্পা একটা বোর্ডিং হাউসে এসে উঠেছি। একেবারেই পাগলামি, কিন্তু তবু আমার তাই মনে হয়। এই ‘গুপ্ত মহল’টা লুকিয়ে থাকার পক্ষে আদর্শ জায়গা। যদিও এটা একটেরে এবং স্যাতসেতে, তবু এমন আরামদায়ক লুকোবার জায়গা শুধু আমস্টার্ডামে কেন, গোটা হল্যাণ্ড টুড়েও তুমি আর কোথাও খুঁজে পাবে না।

দেয়ালে কিছু না থাকায় আমাদের ছোট ঘরটা গোড়ায় গোড়ায় বেজায় ন্যাড়া লাগত; কিন্তু বাবা যেহেতু আগে থেকে আমার জমানো ফিল্মস্টারদের ছবি আর পিচ্চার পোস্টকার্ডগুলো এনে রেখেছিলেন, তার ফলে আঠার শিশি আর বুরুশের সাহায্যে দেয়ালগুলোকে আমি দিয়েছি অতিকায় ছবির আকার। তাতে ঘরটার মুখে এখন একটু হাসি ফুটেছে। ফান ডানেরা এসে গেলে চিলেকোঠার ঘর থেকে আমরা কিছু কাঠ পাব, তাই দিয়ে দেয়ালে কয়েকটা ছোট ছোট তাক এবং আরও এটা-ওটা বানিয়ে নেব। তাহলেই ঘরটাতে আরেকটু প্রাণ আসবে।

মারগট আর মা-মণি এখন আগের চেয়ে একটু ভালো। সুস্থ বোধ করে মা-মণি কাল প্রথম চুলোতে কিছুটা সুপ চড়িয়েছিলেন, কিন্তু নিচের তলায় কথা বলতে বলতে সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। ফলে, মটরশুঁটির দানাগুলো পুড়ে গিয়ে এমনভাবে তলায় ধরে যায় যে, হাজার চেষ্টা করেও প্যান থেকে তা আর ছাড়ানো যায়নি। মিস্টার কুহুইস আমার জন্যে একটা বই এনেছিলেন–ছোটদের বার্ষিকী। আমরা চারজন কাল সন্ধ্যেবেলায় অফিসের খাসকামরায় চলে গিয়ে রেডিও খুলেছিলাম। পাছে কারো কানে যায়, এই জন্যে আমি এত প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম যে, বাপিকে আমি ধরে টানাটানি করতে লাগলাম আমার সঙ্গে ওপরে যাওয়ার জন্যে। আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে মা-মণিও চলে এলেন। পাড়া পড়শিরা পাছে আমাদের আওয়াজ পায় এবং কিছু একটা চলছে এটা চোখে পড়ে, সেইজন্যে অন্যান্য দিক থেকেও আমরা রীতিমত ঘাবড়ে রয়েছি। এখানে প্রথমদিন পা দিয়েই আমরা পর্দার ব্যবস্থা করেছি। প্রকৃতপক্ষে ওগুলোকে ঠিক পর্দা বলা যায় না–আকারে, প্রকারে আর কারুকার্যে পৃথক শুধু কয়েকটা পাতলা, ঢিলে কাপড়ের ফালি–যা আমি আর বাপি নেহাত আনাড়ি হাতে সেলাই করে জোড়াতালি দিয়েছিলাম। এই বিচিত্র কাপড়গুলো ড্রইংপিন দিয়ে আমরা গেঁথে দিয়েছিলাম, যাতে আমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া অব্দি টিক থাকে।

আমাদের ডানদিকে বড় বড় সওদাগরী অফিস আর বাদিকে আসবাবপত্র তৈরির একটা কারখানা, দিনান্তে কাজের পর কেউ আর সেখানে থাকে না; কিন্তু তাহলেও দেয়াল ফুড়ে আওয়াজ যেতে পারে। মারগটের বেজায় ঠাণ্ডা লেগেছে; তাকে বলেছি রাতের বেলায় যেন সে না কাশে। তাকে গুচ্ছের কোডিন গেলানো হয়েছে। আমি মঙ্গলবারের জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছি, ঐদিন ফান ড্রানেরা এসে যাবে; তখন অনেক বেশি মজা হবে, এতটা চুপচাপ ভাব আর থাকবে না। সন্ধ্যেবেলায় আর রাতে আমার যে এত গা ছমছম করে, সেটা এই নিঃশব্দতারই জন্যে। আমি মনপ্রাণে চাই যে, আমাদের ত্রাণকর্তাদের কেউ না কেউ রাত্তিরে এসে এখানে ঘুমাক।

কখনও আর ঘরের বাইরে যেতে পারব না, এটা যে কী পীড়াদায়ক, তা আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না–সেইসঙ্গে আমার বড় ভয়, আমরা যখন ধরা পড়ে যাব–তখন আমাদের গুলি করে মারা হবে। দিনের বেলায় আমাদের কথা বলতে হয় ফিস ফিস করে আর পা টিপে টিপে চলতে হয় না হলে মালগুদামের লোকগুলো টের পেয়ে যাবে।

চলি। কেউ আমাকে ডাকছে।

তোমার আনা

.

শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ১৯৪২

আদরের কিটি,

পুরো এক মাস আমি তোমাকে ছেড়ে থেকেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, খবর এখানে এত কম যে, প্রত্যেকদিন লেখবার মত মজাদার কিছু আমি খুঁজে পাই না। ফান ডানেরা এসে গেলেন। ১৩ই জুলাই। আমরা জানতাম ওঁরা আসছেন চোদ্দ তারিখে। কিন্তু জুলাইয়ের তেরো থেকে যোল তারিখ পর্যন্ত জার্মানরা একধার থেকে শমন জারি করতে থাকায় লোকে দিন দিন বিচলিত হয়ে উঠতে থাকে। তারা তাই দেখল, যদি বাঁচতে হয় তাহলে একদিন দেরি করে ফাঁদে পড়ার চেয়ে একদিন আগেই ব্যবস্থা করা ভাল। সকাল সাড়ে নটায় (যখন আমরা বসে প্রাতরাশ সারছি) পেটার এসে হাজির। পেটার হল ফান ডানদের ছেলে, তার ষোলো এখনও পূর্ণ হয়নি-নরম প্রকৃতির, লাজুক, খাটো ধরনের ছেলে; ওর সান্নিধ্য থেকে খুব বেশি কিছু পাওয়া যাবে না। পেটারের সঙ্গে এল তার বেড়াল (মুশচি)। মিস্টার আর মিসেস ফান ডান এলেন তার আধঘণ্টা পরে; মিসেস ফান ডানের টুপির বাক্সে একটা বড় পট দেখে। আমাদের খুব মজা লাগল। উনি সবাইকে শুনিয়ে বললেন, সঙ্গে আমার পট না থাকলে কোথাও গিয়ে আমি স্বাচ্ছন্দ্য পাই না। সুতরাং সবার আগে ওটা তিনি স্থায়ীভাবে তার ডিভানের নিচে রাখলেন। মিস্টার ফান ডান অবশ্য তার নিজেরটা সঙ্গে করে আনেননি, তবে বগলদাবা করে এনেছেন একটা ভাঁজ-করা চায়ের টেবিল।

ওঁরা আসার পর থেকে আমরা সবাই একত্রে আরাম করে বসে খাওয়াদাওয়া করছি; তিনদিন কেটে যেতে মনে হল আমরা সবাই যেন একটা বড় পরিবারভুক্ত লোক। বাইরের লোকালয়ে ফান ডানেরা যে অতিরিক্ত সপ্তাহটা কাটিয়ে এসেছেন, সে সম্পর্কে ফান ডানেরা স্বভাবতই বিস্তর বলতে পারেন। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আমাদের খুব কৌতূহল হচ্ছিল আমাদের বাড়িটা আর মিস্টার গুডস্মিট সম্পর্কে জানতে।

মিস্টার ফান ডান আমাদের বললেন–

‘সোমবার সকাল নয়টার সময় মিস্টার গুডস্মিট ফোন করে জানতে চাইলেন আমি একবার আসতে পারি কিনা। আমি তক্ষুনি চলে গেলাম। গিয়ে দেখি গ–বেজায় বিচলিত। ফ্রাংরা একটা চিঠি লিখে রেখে গেছেন, উনি আমাকে সেটা পড়তে দিলেন এবং চিঠিতে যা বলা হয়েছে সেইমত বেড়ালটাকে তিনি আশপাশের বাড়িতে নিয়ে যেতে চান বললেন। তাতে আমি খুশীই হলাম। মিস্টার গ–ভয় পাচ্ছিলেন বাড়িতে তল্লাসি হবে। সেইজন্যে আমরা সমস্ত ঘর তন্ন তন্ন করে দেখলাম; খানিকটা গোছগাছ করে প্রাতরাশের জিনিসগুলো সরিয়ে ফেললাম। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল মিসেস ফ্রাংকের টেবিলে একটা রাইটিং-প্যাড তার ওপর মাসট্রিটের একটা ঠিকানা লেখা। আমি অবশ্য জানতাম যে, ইচ্ছে করেই এসব করা হয়েছে; তবু আমি খুব অবাক হওয়ার এবং, ইস, একটা কাঁচা কাজ করে ফেলেছে, এই রকমের ভাব দেখিয়ে গ–কে বললাম হতচ্ছাড়া চিরকুটটা অবিলম্বে ছিঁড়ে ফেলতে।

‘আমি এতক্ষণ এমন একটা ভাব করছিলাম যেন তোমাদের উধাও হওয়ার ব্যাপারটার বিন্দুবিসর্গ আমি জানি না। কিন্তু চিরকুটটা দেখতে পেয়ে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আমি বললাম, মিস্টার গুডস্মিট, ঠিকানাটার উদ্দিষ্ট পুরুষটি যে কে সেটা এতক্ষণে আমার খেয়াল হচ্ছে। হু এইবার মনে পড়েছে, ইনি একজন উচ্চপদস্থ অফিসার; মাসছয়েক আগে অফিসে এসেছিলেন, দেখে মনে হয়েছিল, মিস্টার ফ্রাংকের সঙ্গে তাঁর বেশ দহরম মহরম। তেমন দরকার পড়লে মিস্টার ফ্রাংককে উনি সাহায্য করবেন বলেছিলেন। ভদ্রলোকের কর্মস্থল ছিল মাসট্রিশটু। আমার মনে হয় দ্রলোক তাঁর কথা রেখেছেন; তিনি কোনো না কোনো ভাবে ওঁদের গোড়ায় বেলজিয়ামে এবং তারপর সেখান থেকে সুইটজারল্যাণ্ডে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বন্ধুরা কেউ খোঁজ করলে এই খবরটা আমি তাদের দেব। অবশ্য কারো কাছে মাসট্রিশটের নাম যেন করবেন না।

কথাগুলো বলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম। ইতিমধ্যে তোমাদের অধিকাংশ বন্ধুই জেনে গেছে, কেননা আলাদা আলাদাভাবে অনেকেই বেশ কয়েকবার খোদ আমাকেই সে কথা বলেছে। এ গল্পটা শুনে আমরা দারুণ মজা পেয়েছিলাম এবং এরপর মিস্টার ফান ডান যখন আমাদের আরও সবিস্তারে সব বললেন, মানুষ কিভাবে কল্পনার লাগাম ছেড়ে দেয় সেটা দেখে তখন আরও বেশি হেসেছিলাম। একটি পরিবার নাকি দেখেছে খুব ভোরবেলায় আমরা দুটিতে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি; আবার এক ভদ্রমহিলা নাকি একেবারে নিশ্চিতভাবে জেনেছেন যে, মাঝরাত্তিরে একটা মিলিটারি গাড়ি এসে আমাদের ডেকে নিয়ে গেছে।

তোমার আনা

.

শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ১৯৪২

আদরের কিটি,

এ আমাদের লুকোবার জায়গায় প্রবেশপথটি এবার যথাযথভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মিস্টার ক্রালার মনে করছিলেন আমাদের দরজার সামনে একটা কাবার্ড রেখে দিলে ভালো হয় (কেননা লুকোনো সাইকেলের খোঁজে বিস্তর বাড়িতে খানাতল্লাসি হচ্ছে), তবে কাবার্ডটা হবে অস্থাবর–যাতে দরজার মতো খোলা যায়।

গোটা জিনিসটা করলেন মিস্টার ফোসেন। আমরা তাঁকে আগেই সব খুলে বলেছি; কিন্তু তিনি কী করবেন, তার হাত-পা বাঁধা। নিচের তলায় যেতে চাইলে প্রথমে আমাদের হাঁটু মুড়ে নিচু হতে হবে, তারপর ঝাঁপ দিতে হবে, কেননা ধাপগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। গোড়ার তিনদিন আমাদের কপালে ঢিবি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হল, কারণ নিচু দরজায় সবাইকেই ঠোক্কর খেতে হয়েছিল। এখন আমরা একটা কাপড়ে, পশম জড়িয়ে ওপরের ঝনকাঠে এঁটে দিয়েছি। দেখা যাক ওতে কোনো উপকার হয় কিনা!

এখন আমি খুব বেশি গা ঘামাচ্ছি না; সেপ্টেম্বর অবধি নিজেকে ছুটি দিয়ে রেখেছি। এরপর বাবা আমাকে পড়ালেখা করাবেন। ইস্, এরই মধ্যে এত কিছু ভুলেছি যে বলার নয়। আমাদের এখানকার জীবন বলতে সেই থোড়বড়িখাড়া আর খাড়াবড়িথোড়। মিস্টার ফান ডান আর আমি যেভাবেই হোক সচরাচর পরস্পরকে নস্যাৎ করি। মারগটের বেলায় তা হয় না, ওকে উনি বিলক্ষণ ভালবাসেন। মা-মণি থেকে থেকে আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেন যেন আমি কচি খুকী–এটা আমার অসহ্য লাগে। না হলে, অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। পেটারকে এখনও আমার আদৌ ভালো লাগে না, ছেলেটা কী যে বিরক্তিকর কী বলব। অর্ধেক সময় বিছানায় পিপুফিশু হয়ে কাটায়, খানিকটা কাঠের কাজ করে, এবং তারপরই। ফিরে গিয়ে আরেক দফা ঘোত ঘোত করে ঘুমোয়। একেবারে গাড়োল।

আবহাওয়াটা এখন ভারি সুন্দর। সবকিছু সত্ত্বেও আমরা যতটা পারি উপভোগ করার চেষ্টা করি; চিলেকোঠায় চলে গিয়ে ক্যাম্প-খাটে লম্বা হই–খোলা জানলা দিয়ে ভেতরে এসে ঝলমল করে রোদ্দুর।

তোমার আনা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *