২৬. স্বামীজীর মহাসমাধি

ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ
স্বামীজীর মহাসমাধি

১৯০০ খ্রীস্টাব্দের শেষভাগে স্বামীজী যে-সকল বন্ধুর সহিত মিশরে ভ্রমণ করিতেছিলেন, সহসা তাহাদের নিকট হইতে বিদায় লইয়া তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। এই সময়ে যাহারা তাহার সঙ্গে ছিলেন, তাহাদের মধ্যে একজন বলেন, “তাকে খুব ক্লান্ত বোধ হতো।” যখন তিনি কাইরোর নিকটবর্তী পিরামিডসমূহ, নারীমুখবিশিষ্ট সিংহমূর্তিটি (the sphinx) এবং অন্যান্য বিখ্যাত দৃশ্যগুলি দেখিতেছিলেন, তখন প্রকৃতপক্ষে তিনি যেন জানিতে পারিয়াছিলেন যে, তিনি অভিজ্ঞতারূপ মহাগ্রন্থের শেষ পৃষ্ঠাগুলি উল্টাইতেছেন। ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নসমূহ আর তাহার হৃদয়তন্ত্রী স্পর্শ করিতে পারিতেছিল না।

অপরদিকে তাহার স্বদেশীগণকে সর্বদা ‘নেটিভ’ বলিয়া অভিহিত হইতে শুনিয়া এবং নিজেকে ঐ সময়ে তাহাদের পরিবর্তে বরং বিদেশীর সহিত সমপর্যায়ভুক্ত হইতে দেখিয়া তিনি মর্মাহত হন। বস্তুতঃ এই দিক দিয়া তিনি যেন মিশর অপেক্ষা কষ্টান্টিনোপল বিশেষ উপভোগ করেন, কারণ জীবনের শেষভাগে তিনি বারংবার এক বৃদ্ধ তুর্কীর উল্লেখ করিতেন। ঐ ব্যক্তির একটি হোটেল ছিল এবং সে এই বিদেশী যাত্রিদলকে—যাহাদের মধ্যে একজন ছিল ভারত হইতে আগত—কোনরূপ পয়সা না লইয়া আহার করাইবার জন্য বিশেষ জি প্রকাশ করিয়াছিল। সত্য সত্যই আধুনিক বিষয়বুদ্ধিবর্জিত প্রাচ্যবাসীর নিকষ্ট সকল পর্যটকই তীর্থযাত্রী, এবং সকল তীর্থযাত্রীই অতিথিরূপে গণ্য।

পরবর্তী শীতকালে তিনি ঢাকায় গমন করেন এবং বিরাট দলবলসহ ব্ৰহ্মপুত্র নদ দিয়া আসামের একটি তীর্থে স্নান করিতে যান। যাহারা তাহার অতি নিকটে থাকিতেন, তাহারাই কেবল জানিতেন, স্বামীজীর স্বাস্থ্য এই সময়ে কত দ্রুত ভাঙিয়া পড়িতেছিল। আমরা দুরে ছিলাম বলিয়া ঐ সম্পর্কে কোনরূপ সন্দেহ হয় নাই। ১৯০১ খ্রীস্টাব্দের গ্রীষ্মকাল তিনি বেড়ে যাপন করেন এই আশা লইয়া যে, বাল্যকালে বৃষ্টিপড়ার যে শব্দ শুনিতেন, পুনরায় উহা শুনিবেন। আবার যখন শীত আসিল, তিনি এত অসুস্থ হইয়া পড়িলেন যে, তাহাকে শয্যা গ্রহণ করিতে হইল।

তথাপি ১৯০২ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আরও একটি তীর্থযাত্রা সম্পন্ন করেন। প্রথমে বুদ্ধগয়া এবং তারপর বারাণসী। উহা যেন তাহার সকল পর্যটনের উপযুক্ত পরিসমাপ্তি। শেষ জন্মদিনের প্রভাতে তিনি বুদ্ধগয়ায় উপনীত হন। মহন্তজীর আদর-আপ্যায়নের কথা বলিয়া শেষ করা যায় না। এখানে এবং পরে কাশীতেও নিষ্ঠাবান হিন্দুসম্প্রদায়ের নিকট তিনি এত অধিক পরিমাণে সমাদর ও বিশ্বাস অর্জন করেন যে, লোকের হৃদয় তিনি কতটা অধিকার করিয়াছেন বুঝিতে পারিয়া নিজেই বিস্মিত হন।

বুদ্ধগয়া এখন যেমন তাহার শেষ তীর্থযাত্রা, তেমন উহাই ছিল তাহার সর্বপ্রথম তীর্থদর্শন। আর ঐ প্রথম তীর্থদর্শনের কয়েক বৎসর পরে তিনি কাশীধামেই একজনের নিকট বিদায়গ্রহণকালে বলিয়াছিলেন, “যতদিন না আমি সমাজের উপর বজ্রের মতো পড়ছি, ততদিন আর এখানে আসব না।”

স্বামীজীর কলিকাতায় প্রত্যাবর্তনের পর দূর দূর দেশ হইতে বহু শিষ্য তাহার নিকটে সমবেত হন। যদিও তাহাকে পীড়িত দেখাইতেছিল, তথাপি কেহই সম্ভবতঃ অনুমান করিতে পারেন নাই যে, অন্তিমকাল কত নিকটে আসিয়া গিয়াছে। তথাপি সাগরবক্ষে অর্ধপৃথিবী অতিক্রম করিয়া লোকের যাতায়াত, দেখা-সাক্ষাৎ এবং পরস্পরের নিকট বিদায় সম্ভাষণ চলিতে লাগিল। আশ্চর্যের বিষয়, কাশী হইতে প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাহারা তাহার নিকটে অবস্থান করেন, তাহাদের স্বাধীনভাবে কার্য করিতে দিবার জন্য তাহার কিছুদিন দূরে সরিয়া থাকা আবশ্যক।

তিনি বলেন, “কতবার দেখা যায় যে, মানুষ দিনরাত তার শিষ্যদের কাছে থেকে তাদের নষ্ট করে ফেলে! একবার তাদের তৈরি হয়ে যাবার পর এটা বিশেষ প্রয়োজন যে, নেতা তাদের কাছে থেকে দূরে থাকবেন, কারণ তাঁর অনুপস্থিতি ব্যতীত তারা নিজেদের বিকাশসাধন করতে পারে না।”

বিদেশিগণের সহিত যে সংস্পর্শ তাহার পরিণত জীবনে অবিচ্ছিন্নভাবে চলিয়া আসিতেছিল, তাহারই সর্বশেষ ফলস্বরূপ যেন ধর্মের মধ্যে গার্হস্থ্য জীবনের নিষ্ঠারূপ উচ্চ আদর্শের কী মূল্য তাহা তিনি সহসা উপলব্ধি করেন। কেবল কথায় ও কার্যে নহে, পরন্তু অধিকতর আন্তরিকতা ও আবেগের সহিত এবং প্রাণপণ চিন্তার দ্বারা সন্ন্যাসিগণ নিজেদের ব্রতগুলি সকল বস্তুর উর্ধ্বে অক্ষুণ্ণ রাখিবার চেষ্টা করেন বলিয়া সামাজিক জীবনের আদর্শসমূহ তাহাদের নিকট সচরাচর নিতান্ত অসাররূপে প্রতীয়মান হইয়া থাকে। স্বামীজী সহসা হৃদয়ঙ্গম করেন, যে-জাতি বিবাহিত জীবনের সম্বন্ধকে পবিত্র জ্ঞান করে না, সে-জাতির মধ্যে কখনও নিষ্ঠাবান যাজককুল অথবা উচ্চস্তরের সন্ন্যাসিসম্প্রদায় উদ্ভূত হইবার আশা নাই।

যেখানে বিবাহবন্ধন অবিচ্ছেদ্য বলিয়া সম্পূর্ণরূপে গৃহীত, কেবল সেখানেই দাম্পত্যজীবনের বাহিরের পথেও লোকে নিষ্ঠার সহিত চলিতে পারে। সামাজিক আদর্শকে পবিত্র জ্ঞানকরিলেই সমাজবন্ধনের উর্বে অবস্থিত সন্ন্যাসজীবনকে পবিত্র জ্ঞান করা সম্ভব।

এই অনুভূতিই তৎপ্রচারিত দর্শনের শীর্ষবিন্দুস্বরূপ। ইহাই ‘মহামায়ার খেলা’র শেষ চিহ্ন সূচিত করে। সন্ন্যাসজীবনের সম্ভাবনা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন সমগ্র সমাজে উন্নতিলাভের প্রচেষ্টা ও উহার প্রাপ্তি। সনাতন ধর্মে নিষ্ঠাবান সাধুর যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন নিষ্ঠাবান গৃহস্থের। বিবাহবন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা এবং সন্ন্যাসব্রত অক্ষুণ্ণ রাখা—উভয়ই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সমাজে উন্নতচরিত্র গৃহস্থ না থাকিলে শক্তিশালী সন্ন্যাসীবৃন্দের উদ্ভব হইতে পারে না। গার্হস্থ্য ব্যতীত সন্ন্যাস জীবন হয় না, ঐহিক কল্যাণ ব্যতীত পারমার্থিক জীবন সম্ভব নয়। সুতরাং দেখা যাইতেছে, সবই এক, তথাপি ইচ্ছাপূর্বক কাহারও বিন্দুমাত্র অঙ্গহানি হইতে দেওয়া চলিবে না; কারণ প্রত্যেক পরমাণুর মধ্য দিয়া প্রকাশ পাইতেছেন সেই ভূমা। বস্তুতঃ ইহা তাহারই পুরাতন বাণী নূতন আকারে মাত্র। তিনি এবং তৎপূর্বে তাহার গুরুদেব যেমন বার বার বিশেষভাবে বলিয়া গিয়াছেন—ভাবোন্মত্ততা অপেক্ষা চরিত্রের বিশুদ্ধতাই ভগবৎ সেবার পক্ষে অধিকতর উপযোগী। কোন জিনিস ধরিয়া রাখিবার শক্তি না থাকিলে শুধু ত্যাগেও কোন বাহাদুরি নাই।

তাঁহার সম্মুখে সর্বদা যেসব কার্য আসিয়া উপস্থিত হইত, তাহাদের খাতিরে ১৯০২ খ্রীস্টাব্দের বসন্তকালে স্বামীজী একবার তাহার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের বিশেষ চেষ্টা করেন, এমনকি, তিনি কবিরাজী চিকিৎসা শুরু করেন, যাহার জন্য এপ্রিল, মে ও জুন এই তিনমাস ধরিয়া তিনি একবিন্দু ঠাণ্ডা জল পান করিতে পারেন নাই। ইহার ফলে শরীরের কতদুর উপকার হইয়াছিল বলা যায় না; তবে ঐকঠোর পরীক্ষার মধ্য দিয়া যাইবার সময় তাহার ইচ্ছাশক্তির বল অব্যাহত আছে দেখিয়া তিনি অতিশয় প্রীত হন।

জুন মাস শেষ হইলে কিন্তু তিনি বিলক্ষণ বুঝিতে পারিলেন, অন্তিমকাল নিকটবর্তী। দেহত্যাগের পূর্ব বুধবারে তিনি নিকটস্থ একজনকে বলেন, “আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। একটা মহা তপস্যা ও ধ্যানের ভাব আমাকে আচ্ছন্ন করেছে, এবং আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।”

আর আমরা যদিও স্বপ্নেও ভাবি নাই যে, অন্ততঃ তিন-চার বৎসরের পূর্বে তিনি আমাদের ছাড়িয়া চলিয়া যাইবেন, তথাপি জানিলাম, কথাগুলি সত্য। জগতের খবরাখবর শুনিয়া তিনি নামমাত্র উত্তর দিতেন। সাময়িক কোন সমস্যা সম্বন্ধে আর তাহার মতামত জিজ্ঞাসা করা অনর্থক। শান্তভাবে তিনি বলিতেন, “তোমার কথা ঠিক হতে পারে, কিন্তু এসব ব্যাপার আমি আর আলোচনা করতে পারি না। আমি মৃত্যুর দিকে চলেছি।”

কাশ্মীরে অবস্থানকালে একবার পীড়া হইতে আরোগ্যলাভের পর তাহাকে দুইখণ্ড পাথর উঠাইয়া বলিতে শুনিয়াছিলাম, “যখনই মৃত্যু কাছে আসে, আমার সব দুর্বলতা চলে যায়। তখন আমার ভয় বা সন্দেহ, বা বাহ্য জগতের চিন্তা, এ-সব কিছুই থাকে না। আমি শুধু নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করতে ব্যস্ত থাকি। তখন আমি এইরকম শক্ত হয়ে যাই”—তিনি দুই হাতে পাথর দুইখানিকে পরস্পর ঠুকিলেন—”কারণ, আমি শ্রীভগবানের পাদস্পর্শ করেছি।”

নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধি সম্পর্কে তিনি কদাচিৎ উল্লেখ করিতেন, সেজন্য ঐ কথাগুলি আমরা কখনও বিস্মৃত হই নাই। আবার সেই ১৮৯৮ খ্রীস্টাব্দের গ্রীষ্মকালেই অমরনাথ গুহা হইতে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি হাসিতে হাসিতে বলিয়াছিলেন যে, তিনি অমরনাথের নিকট ইচ্ছামৃত্যুবর লাভ করিয়াছেন। এই বরলাভের ফলে মৃত্যু তাহাকে সহসা আক্রমণ করিবে না, ইহা যেন নিশ্চিত ছিল এবং উহার সহিত ও নিজেকে জানতে পারলে আর এক মুহূর্তও দেহ রাখবে

শ্রীরামকৃষ্ণের এই ভবিষ্যদ্বাণীর এত চমৎকার ঐক্য ঘটিয়াছিল যে, এ সম্পর্কে সকল চিন্তা আমাদের মন হইতে এককালে দূর করিয়া দিয়াছিলাম। এমনকি, এই সময়ে তাহার নিজ মুখের গম্ভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ কথাগুলিও আমাদের উপরি-উক্ত কথা মনে করাইয়া দিতে পারে নাই।

অধিকন্তু তাহার যৌবনকালের সেই অদ্ভুত নির্বিকল্প সমাধিলাভের কথাও আমাদের মনে ছিল। ইহাও জানিতাম, উক্ত সমাধি-অন্তে তাহার গুরুদেব বলিয়াছিলেন, “এই তোমার আম। আমি এটা বাক্সে চাবি দিয়ে রাখলাম। তোমার কাজ শেষ হলে আবার তুমি এটা আস্বাদ করতে পারবে।”

যে সাধুআমাকে এই গল্পটি বলেন, তিনি ঐ প্রসঙ্গে আরও বলিয়াছিলেন, “আমরা এখন নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারি। সময় এগিয়ে এলে আমরা ঠিক জানতে পারব। কারণ, তিনি আমাদের বলতেন যে, পুনরায় তিনি তার আম আস্বাদন করেছেন।”

ঐ সময়ের কথা স্মরণ করিয়া এখন কতই আশ্চর্য মনে হয় যে, কতভাবেই না প্রত্যাশিত ইঙ্গিত আসিয়াছিল। কিন্তু তখন আমরা শুনিয়াও শুনিতে চাহি নাই, বুঝিয়াও বুঝিতে পারি নাই।

বস্তুতঃ সর্ববিধ দুর্বলতা ও আসক্তি দূরে পরিহার করিলেও একটি বিষয়ে যেন ব্যতিক্রম ছিল। যাহা চিরকাল তাহার নিকট প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তর ছিল, তাহা এখনও তাঁহার হৃদয়তন্ত্রী স্পর্শ করিতে পারিত। দেহান্তের অব্যবহিত পূর্বে রবিবারে জনৈক শিষ্যকে তিনি বলেন,”দেখ,এই-সব কাজই আমার চিরকাল দুর্বলতার জায়গা! যখন ভাবি, এ-সব নষ্ট হয়ে যাবে, তখন একেবারে হতাশ হয়ে পড়ি।”

ঐ সপ্তাহের বুধবারে—সেদিন একাদশী—স্বামীজী সম্পূর্ণ উপবাস করিয়াছিলেন, কিন্তু পূর্বোক্ত শিষ্যকে প্রাতঃকালীন আহার্য স্বহস্তেপরিবেশন করিবেন বলিয়া জেদ করিতে লাগিলেন। আহারের মধ্যে ছিল কাঠালের বিচিসিদ্ধ, আলুসিদ্ধ, সাদা ভাত এবং বরফ দিয়া ঠাণ্ডা করা দুধ। প্রত্যেকটি জিনিস পরিবেশন করিবার সময় সেগুলি সম্বন্ধে স্বামীজী হাস্য-পরিহাস করিতে লাগিলেন। সর্বশেষ আহারান্তে তিনি নিজেই শিষ্যের হাতে জল ঢালিয়া দিলেন এবং তোয়ালে দিয়া হাত মুছাইয়া দিলেন।

স্বভাবতই শিষ্য প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, “স্বামীজী, এ-সব আমারই আপনার জন্য করা উচিত, আপনার আমার জন্য নয়।”

কিন্তু তাহার উত্তর ছিল অতি বিস্ময়জনক গাম্ভীর্যপূর্ণ—”ঈশা তার শিষ্যদের প। ধুইয়ে দিয়েছিলেন।” শিষ্যের মুখে উত্তর আসিতেছিল, “কিন্তু সে তো শেষ সময়ে!” কথাগুলি যেন কিরূপে বাধিয়া গিয়া অনুচ্চারিত রহিয়া গেল। ভালই হইয়াছিল। কারণ, এখানেও শেষ সময় আসিয়া গিয়াছিল।

এই কয়দিন স্বামীজীর কথাবার্তা ও চালচলনে কোন বিষাদগম্ভীর ভাব ছিল না। পাছে তিনি অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করেন—এই আশঙ্কায় ইচ্ছাপূর্বক কথাবার্তা যতদূর সম্ভব লঘু বিষয়ে নিবদ্ধ রাখা হইত। তাঁহার পালিত পশু, বাগান, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গ্রন্থ, দূরদেশে অবস্থিত বন্ধুবর্গ—এই সকল প্রসঙ্গ আলোচিত হইত। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমরা তাহার মধ্যে এক জ্যোতির্ময় সত্তার আবির্ভাব অনুভব করিতাম, বোধ হইত তাহার স্থূল দেহ যেন উহার একটি ছায়া বা প্রতীক মাত্ৰ তথাপি কেহই হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন নাই, এত শীঘ্র শেষ সময় আসিয়া যাইবে—বিশেষতঃ—সেই ৪ জুলাই, শুক্রবারে—কারণ, সেদিন বহুবৎসর ধরিয়া তিনি যেমন ছিলেন, তাহার অপেক্ষা তাহাকে অধিকতর সুস্থ ও সবল দেখাইতেছিল, এবং সেজন্যই ঐ দিনটিকে মনে হইয়াছিল আনন্দময়।

ঐদিন তিনি বহু ঘন্টা রীতিমত ধ্যানে অতিবাহিত করেন। অতঃপর বহুক্ষণ ধরিয়া সংস্কৃত ক্লাস লন। অবশেষে মঠের ফটক হইতে বহুদূর পর্যন্ত বড় রাস্তা ধরিয়া বেড়াইয়া আসেন।

ভ্রমণান্তে তিনি যখন প্রত্যাবর্তন করিলেন, তখন সন্ধ্যারতির কাসর ঘন্টা বাজিতেছে। তিনি নিজের ঘরে গিয়া গঙ্গার দিকে মুখ করিয়া ধ্যানে বসিলেন। ইহাই শেষ ধ্যান। অতঃপর প্রথম হইতে যে মুহূর্তের কথা তাহার গুরুদেব ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন, সেই শেষ মুহূর্ত উপস্থিত হইল। আধঘণ্টা কাটিয়া গেল; তারপর সেই ধ্যানরূপ পক্ষ অবলম্বন করিয়া তাহার আত্মা দেশকালের সীমা অতিক্রম করিয়া পরমধামে চলিয়া গেল—যেখান হইতে আর পুনরাবর্তন ঘটে না, শরীরটা ভাজ করা পোশাকের মতো পৃথিবীতেই পড়িয়া রহিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *