১৯. ঐতিহাসিক খ্রীস্টধর্ম সম্বন্ধে স্বামীজী

উনবিংশ পরিচ্ছেদ
ঐতিহাসিক খ্রীস্টধর্ম সম্বন্ধে স্বামীজী

আমাদের জীবনে কতকগুলি গভীর বিশ্বাসের মূলে এমন সব ঘটনা থাকে, যাহা স্বভাবতই আমাদের ছাড়া অপর কাহাকেও প্রভাবিত করিতে পারে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বলা যায়, কোন উদ্দেশ্য অথবা ব্যক্তিবিশেষ সম্পর্কে মুহূর্তকাল মধ্যে আমাদের যে ধারণা জন্মে, তাহা ঠিক ঐরূপ সুস্পষ্টভাবে অপরকে বুঝানো যায় না। আমাদের মনে কিন্তু উহা দৃঢ়বদ্ধ হইয়া যায়। ঘটনা সত্য অথবা মিথ্যাও হইতে পারে—অর্থাৎ হয়তো উহা এমন এক সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের উপর প্রতিষ্ঠিত, যাহা অল্প সংখ্যক ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। অথবা উহা আবেগপ্রসূত মস্তিষ্কের খেয়ালমাত্র। ঘটনা যাহাই হউক, যাহার একবার ঐরূপ অনুভূতি হইয়াছে, তাহার পরবর্তী জীবনের চিন্তাধারা ঐ ব্যক্তিগত প্রবল অনুভূতিদ্বারা অনুরঞ্জিত হইবেই। সৌভাগ্যক্রমে বাহ্য ঘটনার সহিত মিলিয়া গেলে অপরের নিকট উহা জ্ঞান বলিয়াই প্রতিভাত হইবে, আর দূরদৃষ্টিবশতঃ মিল না হইলে মাথার খেয়াল বলিয়া গণ্য হইবে। সেইরূপ, তর্কের খাতিরে আমরা যদি পুনর্জন্মবাদ সত্য বলিয়া মানিয়া লই, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ আমরা বুঝিতে পারি যে, কয়েকজন ব্যক্তির নিজ নিজ অন্তরে সঞ্চিত সুপ্ত স্মৃতিভাণ্ডারে অবগাহন করিবার ক্ষমতা আছে, যাহা অপরের নিকট দুঃসাধ্য। যদি তাই হয়, তাহা হইলে ঐরূপ অবগাহনের ফলে কতকগুলি মূল্যবান তথ্যের আভাস পাওয়া তাঁহাদের পক্ষে সম্ভব, যদিও বিশুদ্ধ কল্পনা ও ইহার মধ্যে যে পার্থক্য অবস্থিত, তাহা সেই ব্যক্তির পক্ষেই কেবল উপলব্ধি করা সম্ভব, যিনি ঐ আন্তররাজ্যে প্রবেশ করিতে পারিয়াছেন।

আমার গুরুদেবের মন ও চিন্তার উপর যে তিনটি অদ্ভুত স্বসংবেদ্য অনুভূতি সন্দেহাতীতরূপে প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, সেগুলি সম্পর্কে বিশেষরূপে অবহিত হইবার জন্য কতকটা ঐ ধরনের চিন্তার প্রয়োজন। ইহাদের মধ্যে সম্ভবতঃ প্রধান হইল—ধ্যানযোগে সিন্ধুনদতীরে বৈদিক ঋক্‌-মন্ত্র আবৃত্তিরত এক বৃদ্ধের দর্শনলাভ। উহা হইতেই তিনি তাহার সংস্কৃত আবৃত্তির নিজস্ব অদ্ভুত রীতি শিক্ষা করেন। ঐ শিক্ষারীতি সাধারণ বেদোচ্চারণপ্রণালী অপেক্ষা অনেকাংশে গ্রেগরি-প্রবর্তিত সাদাসিধা সুরের সদৃশ।(১) তিনি সর্বদা বিশ্বাস করিতেন যে, এইভাবেই তিনি আর্য পূর্বপুরুষগণের সঙ্গীতসুরের পুনরুদ্ধার করেন। শঙ্করাচার্যের কবিতার মধ্যে তিনি এমন কিছু দেখিতে পান, যাহার সহিত এই আবৃত্তিকরণ-প্রণালীর আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য বিদ্যমান। এই ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি নিজ মত প্রকাশ করিয়া বলেন যে, আচার্য শঙ্করও তাহারই মতো কোন প্রকার দিব্য-দর্শন হইতেই বেদমন্ত্র-উচ্চারণ রীতির ইঙ্গিত লাভ করিয়া থাকিবেন।(২)

তাহার কিশোর বয়সে আর একটি অনুরূপ অভিজ্ঞতা উপস্থিত হয়। তখন তিনি দক্ষিণেশ্বরে পরমহংসদেবের নিকট যাতায়াত করিতেছেন। একদিন বাড়িতে নিজের ক্ষুদ্র পাঠকক্ষে বসিয়া তিনি ধ্যান করিতেছেন, এমন সময়ে সহসা তাহার সামনে এক দীর্ঘাকৃতি বিশালবপু পুরুষের আবির্ভাব ঘটে। তাঁহার মুখমণ্ডলে এরূপ স্থির, গভীর শান্তি বিরাজমান ছিল যে, তাহার দিকে চাহিয়া তরুণবয়স্ক স্বামীজীর মনে হইল, অনন্তকাল ধরিয়া তিনি যেন সুখ এবং দুঃখ উভয়ই বিস্মৃত হইয়াছেন। সাধক আসন ত্যাগ করিয়া উঠিলেন, এবং আগত পুরুষের চরণে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন। অতঃপর ভক্তি ও বিস্ময়ে আত্মহারা হইয়া তিনি নিশ্চলভাবে একদৃষ্টে তাহার প্রতি চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। সহসা তাহার বোধ হইল, সম্মুখস্থ মূর্তি যেন কিছু বলিতে উদ্যত। কিন্তু উহাতে বালক-হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার হওয়ায় তিনি কিছু শুনিবার অপেক্ষা না করিয়া ধীরে ধীরে কক্ষের বাহিরে গেলেন এবং দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন। ঐ দর্শন সম্বন্ধে স্বামীজী পরে বলিতেন, বাল্যকালে তাহার কক্ষে ভগবান বুদ্ধই প্রবেশ করিয়াছিলেন। আমি তার চরণে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করেছিলাম, কারণ আমি জানতাম তিনি স্বয়ং ভগবান।” শ্রীবুদ্ধের প্রতি স্বামীজীর যে জীবন্ত, জ্বলন্ত আবেগ, তাহার অসাধারণ স্থির বুদ্ধি সম্পর্কে যে প্রগাঢ় বিশ্বাস, তাহার অসীম ত্যাগ ও করুণা সম্বন্ধে যে দৃঢ় ধারণা, তাহার কতখানি সেই কৈশোরে তাহার প্রত্যক্ষদর্শনের অনুভূতির মুহূর্ত হইতে উদ্ভূত, তাহার পরিমাণ করা সহজ নহে।

তাহার অন্তরঙ্গ ভক্তগণের যতদূর জানা আছে, এই প্রকার দিব্য দর্শন তৃতীয় এবং শেষবারের মতো ঘটে স্বামীজীর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকালে ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। বুঝিতে পারা যায় যে, ইউরোপের ক্যাথলিক দেশগুলিতে ভ্রমণকালে তাঁহার পূর্ববর্তী অপর ভারতীয়গণের ন্যায় তিনিও পরিচিত সহস্র প্রকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে হিন্দুধর্মের সহিত খ্রীস্টধর্মের সাদৃশ্য দেখিয়া চমৎকৃত হন। খ্রস্টানদের ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত রুটী ও পানীয় (Blessed Sacrament তাঁহার নিকট হিন্দুদের ভোগনিবেদনের বিশদ রূপান্তর বলিয়া বোধ হইত। যাজকদিগের মস্তকের কিয়দংশ মুণ্ডন (tonsure) তাহাকে ভারতীয় সন্ন্যাসিগণের মস্তক মুণ্ডনের কথা স্মরণ করাইয়া দিত। আর যখন তিনি একখানি চিত্রে দেখিতে পাইলেন যে, জাস্টিনিয়ন(৩) দুইজন মুণ্ডিতমস্তক সাধুর নিকট হইতে মুসা-প্রচারিত ধর্মবিধি গ্রহণ করিতেছেন, তখন তাহার মনে হইল, যাজকদের মুণ্ডনপ্রথার উৎপত্তিস্থল তিনি আবিষ্কার করিয়াছেন। তাহার নিশ্চয়ই মনে ছিল, বৌদ্ধধর্মের পূর্বেও ভারতে সন্ন্যাসি-সন্ন্যাসিনী ছিল, এবং ইউরোপ থিবাইড(৪) হইতে সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়ের ভাব গ্রহণ করে; হিন্দু ক্রিয়াকাণ্ডেও ধূপদীপ দান ও গীতবাদ্য আছে। ক্যাথলিকদের মধ্যে মধ্যে অঙ্গুলিদ্বারা অঙ্গে ক্রুশ চিহ্ন অঙ্কিত করিতে দেখিয়া তাহার হিন্দুদের পূজাদিতে ন্যাসের কথা মনে পড়িয়াছিল। অতঃপর যখন তিনি এক গীর্জায় প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, মাত্র কয়েকখানি চেয়ার রহিয়াছে, এবং ঘেরা নির্দিষ্ট আসন (pews) একেবারেই নাই, তখন তিনি এই বিষয়ের চরম নিদর্শন লাভ করেন। অবশেষে তিনি অনুভব করেন, তিনি যেন স্বদেশেই অবস্থান করিতেছেন। এখন হইতে খ্রীস্টধর্মকে আর বিদেশী বলিয়া তাহার বিশ্বাস হইত না।

স্বামীজীর যে স্বপ্নবৃত্তান্ত আমি বলিতে যাইতেছি, হয়তো কতকগুলি চিন্তাধারা তাহাকে অজ্ঞাতসারে উহার জন্য প্রস্তুত করিয়াছিল। ঘটনাটি এই ঃ আমেরিকায় স্বামীজীর এক ইহুদী শিষ্য ছিলেন। স্বামীজীকে তিনি নিষ্ঠাবান ইহুদী সমাজের সহিত পরিচিত করিয়া দেন এবং অল্পবিস্তর মনোযোগসহকারে ইহুদী-ধর্মগ্রন্থ ‘তালমুদ’ অধ্যয়নে প্রবৃত্ত করেন। এইরূপে, যে চিন্তার পটভূমিতে সেন্টপলের উদ্ভব, সে সম্পর্কে সাধারণ লোক অপেক্ষা স্বামীজীর ধারণা অধিকতর স্পষ্ট ছিল।

তাঁহার খ্রীস্টধর্ম আলোচনা সম্পর্কে আরও একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমেরিকায় তিনি কৃশ্চান সায়েন্স’ নামক আন্দোলনের সহিত বিশেষ পরিচিত ছিলেন। পরে তিনি একবার বলেন যে, সকল ধর্মেরই উৎপত্তি আলোচনা করিতে গেলে তিনটি উপাদানের প্রতি লক্ষ্য রাখিতে হইবে—মতবাদ, কর্মকাণ্ড এবং ইন্দ্রজাল বা অলৌকিক কিছু, যাহা সাধারণতঃ ব্যাধি আরোগ্য করারূপেই প্রচারিত। লক্ষণত্রয়ের মধ্যে শেষোক্তটিকে অন্তর্ভুক্ত করিবার কারণ, আমার ধারণা, কতকটা তাহার ‘কৃশান সায়েন্স’ এবং সমশ্রেণীর অন্যান্য আন্দোলন পর্যবেক্ষণের ফল—সেই সঙ্গে তাঁহার নিজের দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমরা বর্তমানে ধর্মের এক নূতন মহাসমন্বয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত, এবং কতকটা তাঁহার নিজের দিব্যদর্শন—যেহেতু ঐ অনুভূতি বা দর্শন বাস্তব ও জীবন্ত প্রত্যক্ষ বিষয়গুলির অন্যতমরূপে চিরকাল তাঁহার স্মৃতিতে বিদ্যমান ছিল।

তখন রাত্রিকাল; নেপলসে যে জাহাজে তিনি ওঠেন, তাহা তখনও পোর্টসৈয়দ অভিমুখে চলিতেছে, এমন সময়ে তিনি এই স্বপ্নটি দেখেন—এক বৃদ্ধ শ্মশ্রুধারী ব্যক্তি তাহার সম্মুখে আবির্ভূত হইয়া বলিলেন, “যে স্থানটি তোমাকে দেখাচ্ছি, তা ভাল করে লক্ষ্য কর। তুমি এখন ক্রীট দ্বীপে। এখানেই খ্রীস্টধর্মের আরম্ভ।” খ্রীস্টধর্মের এই উৎপত্তির সমর্থন হেতু তিনি দুইটি শব্দের উল্লেখ করেন—উহার মধ্যে একটি শব্দ থেরাপিউটি’—এবং উভয় শব্দই যে প্রত্যক্ষভাবে সংস্কৃত ধাতু হইতে উৎপন্ন, তাহাও বলিলেন। পরবর্তী কালে স্বামীজী বার বার এই স্বপ্নের উল্লেখ ও সর্বদা শব্দদ্বয়ের ধাতুপ্রত্যয় নির্দেশ করিতেন। কিন্তু অপর শব্দটি(৫) মনে হয়, আর কখনো পাওয়া যাইবে না। চিরতরে হারাইয়া গিয়াছে। বৃদ্ধ ‘থেরাপিউটি’ (থেরপুত্র) শব্দের অর্থ বলিয়াছিলেন—‘থের’ অর্থাৎ উচ্চপদস্থ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পুত্রগণ-পুত্র শব্দ সংস্কৃত। ভূমির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশপূর্বক বৃদ্ধ আরও বলেন, “প্রমাণ সব এখানে আছে, খুঁড়লেই দেখতে পাবে।”

স্বামীজী জাগিয়া উঠিলেন; তাঁহার বোধ হইল, উহা সাধারণ স্বপ্ন নহে। খোলা বাতাসে বেড়াইবার উদ্দেশ্যে তিনি কোনরকমে ডেকের উপর আসিলেন। বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, জাহাজের একজন কর্মচারী তাহার নির্দিষ্ট কর্ম সমাপনান্তে নিজ কামরায় ফিরিয়া যাইতেছেন। স্বামীজী জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কটা বেজেছে?

উত্তর হইল, ‘মধ্যরাত্রি।

“আমরা এখন কোথায়?”

“ক্রীটের ঠিক পঞ্চাশ মাইল দূরে।”

এই অপ্রত্যাশিত ঐক্যদর্শনে স্বামীজী বিস্মিত বোধ করিলেন, এবং স্বপ্নটির সত্যতা সম্বন্ধে তাহার প্রত্যয় দৃঢ় হইল। এখন তাহার বোধ হইল, ঐ অভিজ্ঞতা এমন কতকগুলি ইঙ্গিত বহন করিতেছে, যাহা উহার সাহায্য ব্যতীত তাহার নিকট চিরদিন অসম্বদ্ধ ও অর্থহীন বলিয়া প্রতীত হইত। পরে তিনি স্বীকার করেন, ইতিপূর্বে খ্রীস্টের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ করিবার কথা তাহার মনে উদয় হয় নাই; এবং এই ঘটনার পরে ঐ বিষয়ে তিনি আর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারিতেন না। তিনি তৎক্ষণাৎ বুঝিতে পারেন যে, কেবল সেন্ট পল সম্পর্কেই আমরা নিশ্চিত হইতে পারি। খ্রীস্টের দ্বাদশ শিষ্যের কার্যাবলী’ (Act of the Apostles) নামক গ্রন্থ ‘গসপেল চতুষ্টয় অপেক্ষা প্রাচীনতর কেন, তাহার অর্থও তিনি হৃদয়ঙ্গম করেন। তিনি আরও অনুমান করেন, সম্ভবতঃ খ্রস্টের উপদেশাবলী র‍্যাবাই হিলেল(Rabbi Hillel)(৬) হইতে উদ্ভূত, এবং ন্যাজারীন নামক প্রাচীন সম্প্রদায় ও সুদূর অতীতের গর্ভ হইতে প্রতিধ্বনিত তাহাদের সুন্দর উক্তিসমূহই খ্রস্টের নাম ও জীবন প্রদান করিয়াছে।(৭)

কিন্তু এই দর্শন তাহার নিজের মনের উপর অনস্বীকার্য প্রভাব বিস্তার করিলেও, অপরের নিকট উহা প্রমাণস্বরূপ উপস্থিত করিতে যাওয়া তাঁহার বাতুলতা বলিয়া মনে হইত। তিনি মনে করিতেন, এইরূপ অনুভূতির কোন ফলাফল আছে স্বীকার করিয়া লইলেও, উহা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত—অর্থাৎ যিনি ঐ প্রকার অনুভব করিয়াছেন, তাহারই কাজে উহা লাগিবে। ঐ স্বপ্নদর্শন প্রভাবে ন্যাজারেথবাসী ঈশার ঐতিহাসিক চরিত্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে স্বামীজীর অবিশ্বাসের সম্ভাবনা থাকিলেও,ক্রীট দ্বীপ সম্ভবতঃ খ্রীস্টধর্মের জন্মভূমি একথা তিনি কখনও উল্লেখ করেন নাই। লৌকিক পণ্ডিতগণের নিকট উহা অনুমানমাত্র, যাহার সত্যাসত্য তাহারাই নির্ধারণ করিতে পারিবেন। আলেকজান্দ্রিয়ায় ভারতীয় ও মিশরীয় ভাবের মিলনের সর্বজনস্বীকৃত ঐতিহাসিক ঘটনা যাহা কেবল ভৌগোলিক ব্যাপার মাত্র, তিনি তাহারই উল্লেখ করিতেন। আর যৌক্তিকতার দিক দিয়া ঐ সম্পর্কে সন্দেহ থাকিলেও মেরীতনয়ের প্রতি তাহার জ্বলন্ত ভক্তির কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই। হিন্দুদের মতে আদর্শ হিসাবে কোন আদর্শের সর্বাঙ্গসম্পূর্ণতাই আসল জিনিস, দেশকালের সহিত উহার সম্বন্ধ কতদূর সত্য, তাহা দেখিবার প্রয়োজন নাই। সুতরাং ভক্তিবশতঃ পুত্রক্রোড়ে খ্রীস্টমার (সিষ্টিন ম্যাডোনা) কোন ছবিকে আশীর্বাদ করিতে অস্বীকারপূর্বক উহার পরিবর্তে ঐ দিব্যশিশুর পাদস্পর্শ করা স্বামীজীর পক্ষে নিতান্তই স্বাভাবিক। সেইরূপ জনৈকা মহিলার প্রশ্নের যে উত্তর তিনি দেন, তাহাও খুবই স্বাভাবিক হইয়াছিল—”যদি আমি ন্যাজারেথবাসী ঈশার সময়ে প্যালেস্টাইনে বাস করতাম, তাহলে চোখের জলে নয়, হৃদয়ের শশাণিত দিয়ে আমি তার পা-দুখানি ধুয়ে দিতাম।” অধিকন্তু, এ বিষয়ে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের স্পষ্ট সম্মতিও লাভ করেন। বাল্যকালে তিনি ব্যগ্রভাবে অনুরূপ একটি প্রশ্ন সম্পর্কে তাহার মতামত জানিতে চাহেন। উত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, “তোমার কি একথা মনে হয় না যে, যারা এই প্রকার সব জিনিস সৃষ্টি করতে পেরেছেন, তারা অপরের উপাসনার জন্য যেসব আদর্শ প্রচার করতেন, নিজেরাই তাদের জীবন্ত মূর্তি ছিলেন?”

————
১ খ্রীস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে পোপ প্রথম গ্রেগবি রোমান ক্যাথলিক উপাসনার অঙ্গস্বরূপ উক্ত-সুরের প্রবর্তন করেন। ঐ সুব সাদাসিধা অথচ গম্ভীর, এবং উহাতে আরোহ-অববোহ অধিক নাই।–অনুঃ
২ স্বামী সারদানন্দ বলেন, স্বামীজীর ঐ দর্শন শ্রীরামকৃষ্ণের অদর্শনের প্রায় দুই বৎসর পরে, সম্ভবতঃ ১৮৮৮ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ঘটে। যে মন্ত্রটি তিনি শুনিয়াছিলেন, তাহা গায়ত্রী দেবীর আবাহনঃ
আয়াহি বরদে দেবি এ্যক্ষরে ব্রহ্মবাদিনি।
গায়ত্রি ছন্দসাং মাতঃ ব্রহ্মযোনি নমোহস্তুতে।।
৩ ফ্লেভিয়াস্ এনিসিস্ জাস্টিনিয়ানা(৪৮২-৫৬৫) ছিলেন নোম সাম্রাজ্যের অধিপতি। তিনি তাঁহার সময়ে প্রচলিত নীতিসমূহ “Corpus Juris Civilis” নামে সংহত করেন এবং সেজন্যই জগতে চিরস্মরণীয় হইয়া আছেন।–অনুঃ
৪ স্টেশিয়াস-প্রণীত খীবসের ইতিবৃত্তিমূলক ল্যাটিন কাব্যখ্রস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত। থী প্রাচীন গ্রীসের এক অংশের সমৃদ্ধ রাজধানী ছিল। সিংহাসন-প্রার্থী ভ্রায়ের পরস্পর যুদ্ধই উহার আখ্যানবস্তু।-অনুঃ
৫ আমার নিজের বিশ্বাস, দ্বিতীয় শব্দটি ‘Essene’, কিন্তু দুঃখের বিষয় উহার সংস্কৃত ধাতুপ্রত্যয় আমার স্মরণ নাই।
৬ ইহুদী ধর্মশাস্ত্রের প্রধান পণ্ডিতবর্গের অন্যতম। খ্রীস্টপূর্ব ৬০ অব্দে ইনি জন্মগ্রহণ কবেন।–অনুঃ
৭ অথবা হয়তো তিনি ভাবিয়াছিলেন, ঈশার ‘সুন্দর উক্তিগুলি’ প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধেরই বাণী এবং ‘গসপেল’গুলিতে যে কাহিনীর উল্লেখ আছে, তাহা শুধু ঈশ্বর দর্শনের আর একটি পথ প্রদর্শন কবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *