১৬. পাশ্চাত্যদেশে স্বামীজীর সহিত কয়েকদিন

যোড়শ পরিচ্ছেদ
পাশ্চাত্যদেশে স্বামীজীর সহি
কয়েকদিন

৩১ জুলাই আমরা লণ্ডনে পৌঁছাই, এবং যে সমুদ্রযাত্রা আমার নিকট এত স্মরণীয় হইয়াছিল, তাহারও অবসান ঘটে। স্বামীজী উইম্বল্ডনে কয়েক সপ্তাহ অতিবাহিত করেন, কিন্তু বৎসরের এই সময়ে তাহার বন্ধুবর্গের অধিকাংশই লণ্ডনে ছিলেন না। এদিকে আমেরিকা হইতে ক্রমাগত আমন্ত্রণ আসিতেছিল। সুতরাং অল্পদিন পরেই তিনি ঐ আমন্ত্রণ গ্রহণপূর্বক আমেরিকা যাত্রা করেন। উদ্দেশ্য ছিল—সেখানে হাডসন নদীর তীরে এক রমণীয় পল্লীনিবাসে অবস্থানপূর্বক অতঃপর তাহার পরবর্তী কর্মক্ষেত্র বিষয়ে ভগবানের ইঙ্গিতের প্রতীক্ষা করিবেন। তাহার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ঐ ইঙ্গিত আসিবেই। একমাস পরে আমি ঐ ভবনেই অতিথিরূপে বাস করি, এবং ৫ নভেম্বর পর্যন্ত, অর্থাৎ ছয়-সাত সপ্তাহ ধরিয়া প্রত্যহ তাহার দর্শনলাভের সুযোগ পাই। ঐ তারিখে আমরা পরস্পরের নিকট বিদায় গ্রহণ করিবার পর স্বামীজী নিউ ইয়র্ক এবং উহার কাছাকাছি কয়েকটি স্থান দর্শন করেন। ঐ মাসের শেষের দিকে কালিফোর্নিয়া যাইবার পথে তিনি শিকাগো হইয়া যান। আমিও তখন শিকাগোতে ছিলাম। পরবর্তী জুন মাসে (১৯০০ খ্রীঃ) আমি পুনরায় নিউ ইয়র্কে তাহার সাক্ষাৎলাভ করি। সেখানে কয়েক সপ্তাহ এবং পরে প্যারিসেও অনুরূপ সময় তাহার ঘন ঘন সাক্ষাৎ পাইতাম; অবশেষে সেপ্টেম্বর মাসে, ব্রিটানিতে তাহার সহিত আমেরিকাবাসী বন্ধুগণের অতিথিরূপে একই ভবনে একপক্ষ কাল অতিবাহিত করি। কয়েক বৎসর ধরিয়া তাহার নিকট শিক্ষালাভের যে অমূল্য স্মৃতি আমার মনে বর্তমান রহিয়াছে—এখানেই তাহার পরিসমাপ্তি। কারণ, ইহার পর ভারতবর্ষে ১৯০২ খ্রীস্টাব্দের প্রথমার্ধে যখন আমি স্বামীজীর সাক্ষাৎ লাভ করি, সে কেবল তাঁহার শেষ আশীর্বাদ গ্রহণ করিবার এবং শেষ বিদায় লইবার জন্য।

গুরুর সমীপে অবস্থানকালে শিষ্যের কর্তব্য শান্ত সংযতভাবে গুরুর আদেশ-পালন; কিন্তু গুরু অন্যত্র গমন করিলে তৎক্ষণাৎ শিষ্যের যথাশক্তি উদ্যম ও তৎপরতা দেখানো প্রয়োজন। এই শেষোক্ত আচরণই স্বামীজী তাহার শিষ্যগণের নিকট সর্বদা প্রত্যাশা করিতেন। একবার তিনি বলেন, যখনই কোন তরুণ সন্ন্যাসী কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস মঠবাসের পর ‘কিছুই শিখিলাম না’ বলিয়া অভিযোগ করিত, তিনি তখনই তাহাকে কিছুদিনের জন্য পূর্বাশ্রমে পাঠাইয়া দিতেন; এবং সেখানে যাইবার পর সে বুঝিতে পারিত, ইতিমধ্যে অজ্ঞাতসারে সে কতটা আয়ত্ত করিয়া ফেলিয়াছে। প্রতিবার তাহার নিকট বিদায় লওয়ার অর্থ ছিল, সেই শিষ্যের হস্তে যুদ্ধপতাকার ভার অর্পিত হইল। একবার এক বালিকা তাহার বাদত্ত স্বামীকে বিদায় দিবার সময় ভাবের আবেগে কাদিয়া ফেলিবার উপক্রম করে, এমন সময়ে স্বামীজী তাহাকে অনুচ্চকণ্ঠে বলিয়া ওঠেন, ‘রাজপুত রমণীর ন্যায় বীরপত্নী হও, তারা হাসিমুখে পতিকে বিদায় দিতেন।’ কথাগুলি যেন মন্ত্রের ন্যায় কাজ করিল। শিকাগো নগরে অল্পক্ষণ সাক্ষাতের পর যখন আমি তাহার নিকট বিদায় গ্রহণ করি, তখন তাহার শেষকথা ছিল, “মনে রেখো, ভারত চিরকালই ঘোষণা করছে, আত্মা প্রকৃতির জন্য নয়, প্রকৃতিই আত্মার জন্য।”

১৯০০ খ্রীস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে আমি ব্রিট্যানিতে তাহার নিকট বিদায় গ্রহণ করি, তখন আমি একাকী ইংলণ্ডে প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ করিতেছিলাম, উদ্দেশ্য, ভারতীয় কার্যের জন্য সহায়তা লাভ ও অর্থসংগ্রহের প্রচেষ্টা। কতদিন আমাকে সেখানে থাকিতে হইবে, তাহার স্থিরতা ছিল না। কোন কার্যপ্রণালীও নির্দিষ্ট ছিল না। সম্ভবতঃ স্বামীজীর মনে এই চিন্তার উদয় হইয়া থাকিবে যে, পুরানো সম্পর্কগুলি বহুসময়ে বিদেশে নূতন সম্পর্কস্থাপনের প্রবল অন্তরায় হয়। বহুলোককে তিনি কথা দিয়া কার্যের সময় পশ্চাৎপদ হইতে দেখিয়াছেন। মনে হইত, অন্য যে কেহ ঐরূপ করিতে পারে, এজন্য তিনি সর্বদা প্রস্তুত থাকিতেন। যেভাবেই হউক, তাঁহার শিষ্যের পক্ষে ঐ সময়টি ছিল সঙ্কটকাল, এবং উহা তিনি অবহিত ছিলেন। ব্রিটানিতে অবস্থানের শেষদিন সন্ধ্যার পর আমার লতাপাদপমণ্ডিত ক্ষুদ্র পাঠাগারের দ্বারপ্রান্তে আমি সহসা স্বামীজীর কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম। তখন রাত্রির আহার সমাপ্ত হইয়াছে, চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন। স্বামীজী আমাকে উদ্যানে যাইবার জন্য ডাকিতেছেন। আমি বাহিরে আসিলাম, দেখিলাম, তিনি জনৈক বন্ধুর সহিত নির্দিষ্ট কুটিরে যাইবার পথে আমাকে আশীর্বাদ জানাইবার জন্য দাঁড়াইয়া আছেন।

আমাকে দেখিয়া তিনি বলিলেন, “এক অদ্ভুত রকমের মুসলমান সম্প্রদায় আছে; শোনা যায়, তারা এত গোড়া যে, প্রত্যেক নবজাত শিশুকে ঘরের বাইরে ফেলে রেখে বলে, “যদি আল্লা তোমাকে সৃষ্টি করে থাকেন, তবে তোমার মৃত্যু হোক, আর যদি আলি তোমাকে সৃষ্টি করে থাকেন, তবে বেঁচে থাক। শিশুকে তারা যা বলে থাকে, আজ রাত্রে আমিও তোমাকে তাই বলছি, কিন্তু কথাটাকে উল্টে দিয়ে যাও কর্মক্ষেত্রে ঝাপ দাও। যদি আমি তোমাকে সৃষ্টি করে থাকি, বিনষ্ট হও। আর যদি মহামায়া তোমাকে সৃষ্টি করে থাকেন, সার্থক হও।”

তথাপি পরদিন সকালে, সূর্যোদয়ের একটু পরেই তিনি পুনরায় আসিলেন আমাকে বিদায় দিতে। ইউরোপের ভূখণ্ডে তাঁহার সহিত এই আমার শেষ সাক্ষাৎ। আর একবার কৃষকের পণ্যবাহী শকট হইতে এই শেষ দিনটির প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিতে পাই, স্বামীজী আমাদের ল্যানিয়র কুটিরের বাহিরে রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া আছেন এবং উর্ধ্বে হাত তুলিয়া অভিনন্দন জানাইতেছেন। তাঁহার পশ্চাতে প্রভাতের আলোকে সমুজ্জ্বল আকাশ, প্রাচ্যদেশের অধিবাসিগণের নিকট ইহা কেবল অভিনন্দন নহে, আশীর্বাদও।

ইউরোপ ও আমেরিকায় এই কয়মাস অবস্থানকালে স্বামীজীর জীবনযাপন দেখিয়া বিশেষভাবে এই ধারণা জন্মিয়াছিল যে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন। প্রচলিত জিনিসের মূল্যবোধের প্রতি তাহার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। কর্মক্ষেত্রে সাফল্যলাভ তাহাকে কদাপি চমকিত অথবা সন্দিহান করিত না। বিস্মিত না হইবার কারণ, যে মহাশক্তি তাঁহার মধ্য দিয়া কার্য করিতেছিল, তাহার মাহাত্ম্য তিনি গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন। কিন্তু কোন কর্মে ব্যর্থতাও তাহাকে হতাশ করিত না। জয়-পরাজয় উভয়ই আসিবে এবং চলিয়া যাইবে; তিনি উহাদের সাক্ষিস্বরূপ। একবার তিনি বলিয়াছিলেন, “যদি জগৎটাই অদৃশ্য হয়ে যায়, তাতেই বা আমার কি? আমার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তা হবে অতি চমৎকার।” পরক্ষণেই সহসা গম্ভীর হইয়া বলিলেন, “কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, বর্তমানে যা কিছু আমার প্রতিকূলে, তা সবই শেষে স্বপক্ষে আসবে। আমি কি মহামায়ার সৈনিক নই!”

পাশ্চাত্যের বিলাসপূর্ণ জীবনে তিনি নির্ভীকভাবে এবং বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃ না করিয়া বিচরণ করিতেন। যেমন তাহাকে ভারতে অবিচলিতভাবে সাধারণ লোকের মতো বস্ত্র ও উত্তরীয়মাত্রে সজ্জিত এবং মেঝের উপর বসিয়া হাত দিয়া আহার করিতে দেখিয়াছি, ঠিক অনুরূপভাবে তিনি কিছুমাত্র সন্দেহ বা সঙ্কোচ না করিয়া আমেরিকা ও ফ্রান্সের জটিল ভোগবহুল জীবনকে গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন, “সাধু ও রাজা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। জগতের সকল শ্রেষ্ঠ বস্তুর ভোগ ও ত্যাগ—এই উভয়ের মধ্যে ব্যবধান অতি অল্প। ভারত অতীতে দারিদ্র্যকেই সকল গৌরব প্রদান করেছিল। ভবিষ্যতে সম্পদকেও কিছুটা গৌরব দান করতে হবে।”

কিন্তু, বিদেশে যাহারা দ্বারে দ্বারে আতিথ্য গ্রহণপূর্বক বিচরণ করেন, তাহাদের অদৃষ্টে দ্রুত পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এই অবস্থা-বিপর্যয় তিনি গ্রাহ্য করিতেন না। কোন সম্প্রদায়ের গণ্ডি অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাহাকে সহৃদয় ব্যক্তির সহানুভূতি হইতে বঞ্চিত করিতে পারিত না। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত ঈশ্বরীয় সত্তা বিদ্যমান—যাহার সম্পর্কে তিনি প্রায়ই উল্লেখ করিতেন—সেই সত্তার প্রতি তার এরূপ পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, সাম্রাজ্যবাদী, প্রভুত্বপরায়ণ অভিজাত ব্যক্তি, কিংবা আমেরিকার কোটিপতি ঐশ্বর্যশালী, অথবা যাহারা নিপীড়িত, অত্যাচারিত তাহাদের সকলের সহিত আলাপকালে সর্বক্ষেত্রে সমভাবে তাহার প্রত্যক্ষ আবেদন ছিল মানবের ঐ সত্তার প্রতি। কিন্তু তাহার প্রেম ও সৌজন্য বিশেষ করিয়া প্রবাহিত হইত সাধারণ দীন-দরিদ্রের উপর।

|||||||||| আমেরিকায় ভ্রমণকালে যখন দক্ষিণ অঞ্চলের কোন কোন শহরে নিগ্রো মনে করিয়া তাহাকে হোটেলে প্রবেশ করিতে দেওয়া হয় নাই, তখন একথা তিনি কদাপি বলেন নাই যে, তিনি আফ্রিকাবাসী নিগ্রো নহেন। স্থানীয় সম্রান্ত ব্যক্তিগণ যখন এইরূপ আচরণের দ্বারা তাহাকে অপমান করা হইয়াছে বিবেচনা করিয়া দুঃখিত অন্তঃকরণে ক্ষমাপ্রার্থনা করিবার জন্য তাহার নিকট ছুটিয়া আসেন, তখন যেমনভাবে তিনি তাঁহাদের আতিথ্য গ্রহণ করেন, তেমন কৃষ্ণকায় নিগ্রো সমাজের আতিথ্যও অনুরূপভাবে নীরবে ও কৃতজ্ঞতাপূর্ণ হৃদয়ে গ্রহণ করিয়াছিলেন। বহুদিন পরে এক ব্যক্তি বিস্ময়ের সহিত জাতি সম্পর্কে তাহার এই নীরবতার উল্লেখ করিলে তাহাকে এইরূপ স্বগতোক্তি করিতে শোনা গিয়াছিল, “কী! একজনকে ছোট করে বড় হতে হবে! সেজন্য আমি এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিনি।” সন্ন্যাসীর কোন জিনিস চাই বলিয়া জোর করিবার অধিকার নাই; তাহাকে সকল অবস্থাই মানিয়া লইতে হয়। এই সময়ে বহু কৃষ্ণকায় ব্যক্তি তাহার নিকট বিশ্বস্তচিত্তে গোপনে শ্বেতকায় জাতি কর্তৃক তাহাদের অধিকার বঞ্চনার যে করুণ কাহিনী নিবেদন করিত, পরবর্তী কালে স্বামীজী প্রায়ই তাহার উল্লেখ করিতেন। একবার কোন কারণে স্বামীজী স্টেশনে অপেক্ষা করিতেছিলেন, এমন সময়ে রেলের এক নিগ্রো ভৃত্য তাহার নিকট আসিয়া বলে যে, সে শুনিয়াছে, তাহার স্বজাতির মধ্যে একজন বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছে এবং সে ব্যক্তি তিনি, সুতরাং সে তাহার সহিত করমর্দন করিতে চাহে। ঐ ঘটনার ন্যায় আনন্দ তিনি অল্প ঘটনাতেই পাইয়াছিলেন। তাহার সামনে কোন শ্বেতকায় ব্যক্তি সামাজিক পদমর্যাদা হেতু ইতরজননাচিত উল্লাস প্রদর্শন করিলে তিরস্কৃত হইত না, ইহা কখনও সম্ভব ছিল না। এ বিষয়ে এতটুকু আভাস পাইবামাত্র তিনি কি কঠোরভাব ধারণ করিতেন! কী তীব্র ছিল তাহার তিরস্কার! সর্বোপরি, এই জাতির সন্তানগণই হয়তো ভবিষ্যতে কখনও অপর সকলকে অতিক্রম করিয়া সমগ্র মানবজাতির নেতৃত্ব গ্রহণ করিবে, এই সম্পর্কে তাহার অঙ্কিত চিত্র কতই না উজ্জ্বল ছিল! অধিকারপ্রাপ্ত জাতিসমূহ কর্তৃক নিজেদের উৎপত্তির অসত্য বিবরণের প্রতি তাহার প্রতিবাদ ছিল ঘৃণাপূর্ণ। বলিতেন, “যদি আমি আমার শ্বেতকায় আর্য পূর্বপুরুষদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকি, তবে আমার পীতকায় মোঙ্গল পূর্বপুরুষদের কাছে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ, আর সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ কৃষ্ণকায় নিগ্রোজাতির কাছে।”

নিজের শারীরিক গঠনের মধ্যে, তাঁহার মোঙ্গলীয়সদৃশ চোয়ালের জন্য তিনি বিশেষ গর্ববোধ করিতেন। উহাকে তিনি বুলডগের লক্ষণ অর্থাৎ কিছুতেই লক্ষ্যভ্রষ্ট না হওয়ার চিহ্ন বলিয়া গণ্য করিতেন। তিনি বিশ্বাস করিতেন, মোঙ্গলদের এই বিশেষ গুণটি আর্য জাতির সকল শাখা-প্রশাখার মধ্যে অনুস্যত হইয়া আছে, এবং সেজন্য একদিন উহার উল্লেখপূর্বক বলিয়া ওঠেন, “দেখছ না ? তাতার জাতিই আর্যজাতির মদিরাস্বরূপ। তাতার জাতিই সকলের রক্তে শক্তি ও বল সঞ্চার করেছে।”

পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি তাহার উদাসীনতার গৃঢ় কারণ অনুসন্ধান করিতে হইলে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, সর্বদাই তাঁহার প্রচেষ্টা ছিল চিন্তার সহায়ক আদর্শ স্থান খুঁজিয়া বাহির করা। প্রত্যেকটি পরিবার, গৃহস্থালীর প্রত্যেকটি মুখ্য উপকরণ তাঁহার নিকট সেই পরিমাণে সমাদর লাভ করিত, যে পরিমাণে তাহারা উচ্চতম চিন্তাশীল জীবনগঠনের পক্ষে আবশ্যক চিত্ত ও ভাবের স্থৈর্য প্রদান করিতে পারিত। ১৯০০ খ্রীস্টাব্দের মাইকেলমাস(১) দিবসে কয়েকজন ব্যক্তি স্বামীজীর সহিত সঁ্যা মিশেল পর্বত (Mont Saint Michel) দর্শনে গমন করেন। ঘটনাক্রমে তাহাদের মধ্যে একজন স্বামীজীর পাশেই দাড়াইয়া ছিলেন। স্বামীজী তখন মধ্যযুগে কয়েদীদের জন্য নির্দিষ্ট অন্ধকার খাচার মতাে ঘরগুলি দেখিতেছিলেন। সহসা ঐ ব্যক্তি চমকিত হইয়া শুনিলেন, স্বামীজী অনুচ্চস্বরে বলিতেছেন, “আহা, কি চমৎকার ধ্যানের জায়গা !” যাহারা তাহাকে ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দে আতিথ্যদানে আপ্যায়িত করেন, তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ এখনও বর্তমান। তাহারা বর্ণনা করেন, পাশ্চাত্যদেশে প্রথম পদার্পণের পর সর্বদা গভীর চিন্তায় মগ্ন হইয়া যাওয়ার অভ্যাস দূর করিবার জন্য স্বামীজীকে কিরূপ বেগ পাইতে হইত। ট্রামে উঠিয়া তিনি এমন গভীরভাবে চিন্তায় তন্ময় হইয়া যাইতেন যে, গন্তব্যস্থলে কখন পৌঁছিয়াছেন সে বিষয়ে হুঁশ থাকিত না; ফলে কোন এক জায়গায় যাইবার জন্য হয়তো তাঁহাকে দুই-তিনবার সমস্ত পথের ভাড়া দিতে হইত। যেমন বৎসরের পর বৎসর অতিবাহিত হইতে লাগিল এবং এই বন্ধুগণ মধ্যে মধ্যে তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে লাগিলেন, তাহারা দেখিতে পাইলেন, ক্রমশঃ বাহিরের তৎপরতা ও লৌকিক ব্যবহার সম্পর্কে তাঁহার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হইতেছে। কিন্তু স্বভাবের এই পরিবর্তন ছিল নিতান্তই বাহ্য। ভিতরে পূর্বের ন্যায় সেই জ্বলন্ত ইচ্ছাশক্তি বিরাজ করিত, এবং মন সর্বদা ভাবমুখে অবস্থান করিত! তাঁহার নিজের অলঙ্কারপূর্ণ ভাষায় বলা যায়, নে হইত, যেন কোন প্রতিকূল শক্তির দ্বারা তিনি বলের মতো একস্থান হইতে অপর স্থানে নিক্ষিপ্ত হইতেছেন এবং ঐরূপে ধীরে ধীরে শান্ত হইয়া যাইতেছেন’। একবার আবেগের সহিত তিনি বলিয়া ওঠেন, “আমি জানি, সারা পৃথিবী আমি ঘুরে বেড়িয়েছি, কিন্তু ভারতে আমি কেবল ধ্যান করবার জন্য গুহাই খুঁজে বেড়িয়েছি, আর কিছু নয়!”

আবার এ-সব সত্ত্বেও সর্বদাই তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষক। ছাত্রের আগ্রহ লইয়া তিনি যাদুঘর, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় ইতিহাস প্রভৃতির খোঁজ লইতেন। তবে কোন স্থানেরই রীতি-নীতি, আচার ব্যবহার প্রভৃতি তাঁহাকে কদাপি প্রভাবিত করিতে পারিত না। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে যে বিপুল পার্থক্য, তাহা অনুভব করিয়া তাহাদের আবেদনে যথোচিত সাড়া দিবার মানসিক শক্তি তাঁহার ছিল! প্রত্যেক বস্তু যে ভাবরাশি অভিব্যক্ত করিতে প্রয়াস পায়, সেই ভাবের মাধ্যমেই তিনি সব কিছু বুঝিবার চেষ্টা করিতেন। ইংলণ্ড-যাত্রাকালে একদিন তিনি গভীর নিদ্রার পর জাহাজের ডেকে আসিয়া আমাকে বলেন যে, স্বপ্নে তিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দেশের বিবাহসম্পর্কিত কতকগুলি আদর্শের বিচার করিতেছিলেন, এবং অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, উভয়ের মধ্যেই কিছু কিছু জিনিস আছে যাহা জগতের কল্যাণের পক্ষে অপরিহার্য। শেষবার আমেরিকা হইতে প্রত্যাগমনের পর তিনি আমাকে বলেন, “পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রথম পরিচয়ে আমি তার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করেছিলাম; কিন্তু এখন প্রধানতঃ তারঅর্থলিপ্সা ও ক্ষমতাই দেখতে পাচ্ছি। অপর সকলের মতো আমিও.চিন্তা না করে ধরে নিয়েছিলাম যে, যন্ত্রপাতির দ্বারা কৃষিকার্যের বিশেষ উন্নতি হবে; কিন্তু এখন দেখছি যে, যন্ত্রের দ্বারা আমেরিকার কৃষকের সুবিধা হতে পারে, কারণ তাকে বহু বর্গমাইল চাষ করতে হয়, কিন্তু ভারতীয় চাষীদের ছোট ছোট জমির পক্ষে এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হবার সম্ভাবনাই বেশি। ভারত ও আমেরিকার সমস্যা সম্পূর্ণ পৃথক, অন্ততঃ এ বিষয়ে আমার অণুমাত্র সন্দেহ নেই।” ধনের সমবণ্টন সমস্যা সম্বন্ধেও—যাহা দুর্বল বা দরিদ্ৰশ্রেণীর সমূল উচ্ছেদসাধন চাহে, এমন সব তর্কের প্রতি তিনি সন্দিগ্ধচিত্তে কর্ণপাত করিতেন। অপরাপর বিষয়ের ন্যায় এই বিষয়েও যেন অজ্ঞাতসারেই তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার প্রতিমূর্তিস্বরূপ। কোন জাতির মধ্যে দলবদ্ধ হইবার প্রবল অভ্যাস দেখিলে তিনি উহার প্রশংসা করিতে জানিতেন, কিন্তু হিংস্রপ্রকৃতির বৃকযুথের দলবদ্ধ হওয়ার মধ্যে সৌন্দর্য কোথায়?

বিদেশে ভারতের অভাব অথবা সমস্যা সম্পর্কে আলোচনায় তাহার ঘোর আপত্তি ছিল, এবং তাহার উপস্থিতিতে ঐ প্রকার আলোচনায় তিনি নিজেকে অপমানিত বোধ করিতেন। পক্ষান্তরে, সমগ্র জগৎ বিপক্ষে থাকিলেও কোন স্বদেশবাসীকে সাহায্য করিতে তিনি কখনও পশ্চাৎপদ হইতেন না। যদি কোন ভারতীয় কোন বিষয়ে অনুসন্ধান দ্বারা এমন এক সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়া থাকেন, যাহা ইউরোপীয়দের সিদ্ধান্তের বিপরীত, তাহা হইলে ঐ বিষয়ে তাহাদের শত যুক্তি তর্কও তাহার নিকট আসিয়া যাইত। বালকের সরলতার সহিত তিনি স্পষ্ট উত্তর দিতেন, “আশা করি, আপনি আরও সূক্ষ্মতর যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করবেন, আপনার মাপজোখ আরও নিখুঁত হবে, যাতে আপনার প্রতিপাদ্য বিষয়টি প্রমাণিত হতে পারে।”

এইরূপে, যদিও অপর সকলে তাহাকে লইয়া গর্ব অনুভব করিতেন যে, তিনি সমগ্র বিশ্বেরই অধিবাসী ও তত্ত্বজিজ্ঞাসু ছাত্র, তিনি স্বয়ং কিন্তু ভারতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন বলিয়াই সর্বদা গৌরব বোধ করিতেন। আর রাজোচিত পারিপার্শ্বিক আবেষ্টনী ও নানা সুযোগ-সুবিধার মধ্যে অবস্থান করিলেও তিনি যে সন্ন্যাসী, ইহাই লোকের নিকট দিন দিন স্পষ্টতর ভাবে প্রকাশ পাইত।

———-
(১) ২৯ সেপ্টেম্বর।—অনুঃ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *