১১. শক্তিপূজা ও স্বামীজী

একাদশ পরিচ্ছেদ
শক্তিপূজা ও স্বামীজী

স্বামীজীর জীবনের এই অংশের যে পরিচয় আমি কিছুটা লাভ করিয়াছি, তাহার শক্তিপূজার উল্লেখ ব্যতীত উহার বিবরণ নিতান্তই অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে। আমি সর্বদা অনুভব করিয়াছি, তাহার আধ্যাত্মিক চেতনার মধ্যে দ্বিবিধ উপাদান ছিল। নিঃসন্দেহ, তিনি ছিলেন আজন্ম ব্ৰহ্মজ্ঞানী; শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস বারবার উহার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। যখন তিনি আট বৎসরের বালক মাত্র, খেলা করিতে বসিয়াই তাহার মধ্যে সমাধিতে মগ্ন হইবার অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ দেখা যায়। ধর্ম সম্বন্ধে তাহার মনের স্বাভাবিক গতি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও দার্শনিক ভাবাপন্ন; সাধারণতঃ ‘পৌত্তলিক’ বলিয়া অভিহিত ভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। যৌবনে, এবং খুব সম্ভবতঃ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হইবার কিছুকাল পরে, তিনি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের যথারীতি সদস্য হন। ইংলণ্ড ও আমেরিকায় তিনি এমন কিছু প্রচার করিয়াছেন বলিয়া জানা যায় না, যাহা কোন বিশেষ মূর্তি বা সাকার ভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাহার নিকট ব্ৰহ্ম সাক্ষাৎকারই ছিল একমাত্র লক্ষ্য, অদ্বৈতদর্শন সর্বোত্তম মতবাদ, এবং বেদ ও উপনিষদ্ একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থ।

.

কিন্তু ইহাও সত্য, সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে জগন্মাতাবো।ধক ‘মা’ শব্দ সর্বদা তাহার মুখে লাগিয়া থাকিত। আমরা যেমন পারিবারিক জীবনে অত্যন্ত পরিচিত কাহারও সম্পর্কে কথা বলিয়া থাকি, জগন্মাতাকে তিনি ঠিক সেইভাবে উল্লেখ করিতেন। সর্বদা তিনি জগন্মাতার চিন্তায় তন্ময় থাকিতেন। জগন্মাতার অপর সন্তানগণের ন্যায় তিনি সব সময়ে শান্তশিষ্ট ছিলেন না। কখন কখনও দুষ্ট ও বিদ্রোহী হইয়া উঠিতেন, কিন্তু সকল সময়ে তাহারই অনুগত। শুভ অশুভ যাহাই ঘটুক সকলই জগন্মাতার ইচ্ছায়, অপর কাহাকেও তিনি দায়ী করিতেন না। কোন এক ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ অনুষ্ঠানে তিনি তাহার এক শিষ্যকে একটি মাতৃ-প্রার্থনা শিখাইয়া দেন, ঐ প্রার্থনা তাঁহার নিজের জীবনে মন্ত্রশক্তির ন্যায় কার্য করিয়াছিল। তারপরে সহসা অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে শিষ্যের দিকে ফিরিয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন, “আর দেখ, শুধু প্রার্থনা করা নয়, তাঁকে জোর করে ওটা পূরণ করাতে হবে। মায়ের কাছে ও-সব দীন-হীন ভাব চলবে না।” মধ্যে মধ্যে প্রায়ই তিনি হঠাৎ কোন নূতন বর্ণনার আংশিক অবতারণা করিতেন। মায়ের দক্ষিণ হস্ত বরাভয় প্রদানের জন্য উত্তোলিত, বামহস্তে ধৃত খড়গ। তন্ময়ভাবে দীর্ঘকাল চিন্তা করিতে করিতে সহসা তিনি বলিয়া উঠিতেন, “তার শাপই বর।” অথবা ভাবাবেগে কখনও কবির ভাষায় বলিতেন, “অন্তরঙ্গ ভক্তগণের নিভৃত হৃদয়কন্দরে মায়ের রুধিররঞ্জিত অসি ঝম করে। এঁরা আজন্ম মায়ের অসি-মুণ্ড বরাভয়করা মূর্তির উপাসক!” এই সময়ে আমি ‘জগন্মাতার বাণী (Voice of the Mother’) নাম দিয়া যে ক্ষুদ্র স্তোত্রটি রচনা ও প্রকাশ করি, তাহার প্রায় প্রত্যেকটি ছত্র ও বর্ণ তাহারই শ্রীমুখ হইতে এই সব মুহূর্তগুলিতে সংগৃহীত। তিনি সর্বদা বলিতেন, “আমি ভয়ঙ্কর রূপের উপাসক!” একবার বলিয়াছিলেন, “এ কথা মনে করা ভুল যে, সকলেই সুখের আশায় কর্মে প্রবৃত্ত হয়। বহুলোক আছে যারা জন্মাবধি দুঃখকে খুঁজে বেড়ায়। এস, আমরা ভয়ঙ্করা মায়ের জন্যই তার ভয়ঙ্করা মূর্তির উপাসনা করি।”

কোন কিছু লইয়া খুঁতখুঁত করার প্রতি তাঁহার আন্তরিক ঘৃণা ছিল। মন্দিরে পশুবলি সম্পর্কে অভিযোগ লইয়া একবার তাহার নিকট উপস্থিত হই। তিনি অনায়াসে বলিতে পারিতেন, আমাদের অনেকেই বলিদানের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানাইলেও নিজেদের রসনার পরিতৃপ্তির জন্য পশুহত্যায় বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃ করি না। কিন্তু তিনি তাহার উল্লেখ করিলেন না। আধুনিক প্রথায় কসাই ও কসাইখানার যে দুর্গতি ঘটিয়াছে, যুক্তি দ্বারা তিনি তাহা প্রতিপন্ন করিতে পারিতেন, কিন্তু তাহারও উল্লেখ করিলেন না। আমার বিরুদ্ধ যুক্তিগুলির উত্তবে তিনি শুধু স্পষ্টভাবে বলিলেন, “চিত্রটি নিখুঁত করবার জন্য হলোই বা একটু রক্তপাত!” পরে তাহার এবং নিকটে উপবিষ্ট আর একজনশ্রীরামকৃষ্ণ-শিষ্যের নিকট হইতে উচ্চাঙ্গের কালীপূজার প্রকৃত তথ্যগুলি সংগ্রহ করিতে আমাকে বিলক্ষণ বেগ পাইতে হয়। প্রকৃত কালীপূজা বহু কৃচ্ছসাধ্য এবং সেখানে জীবহিংসার স্থান নাই। যাহা হউক, তিনি বলেন, মা কালীর অনুচর ভূতপ্রেতগণের উদ্দেশ্যে বলিদান বা রক্তপাত তাহার সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। তাঁহার মতে উহা ভূতেপাসনা এবং ঐ বিষয়ে তাহার আদৌ সমর্থন নাই। তাহার নিরন্তর প্রচেষ্টা ছিল, অন্তর হইতে ভয় ও দুর্বলতা দূর করিয়া দিয়া যেমন মাধুর্য ও আনন্দের মধ্যে আপনা হইতেই জগজ্জননীর প্রকাশ দেখা যায়, সেইরূপ অশুভ, ভয়ঙ্কর, দুঃখ ও বিনাশের মধ্যেও তাহার প্রকাশ পাবণা করিতে শেখা। সুতরাং সেই মহান আদর্শকে ছোট করিয়া দেওয়া তিনি কোনক্রমেই সই। করিতে পারিতেন না। একদিন ভয়ঙ্করা মূর্তির পূজা এবং উহার সহিত একাত্বতালাভেব প্রসঙ্গে শান্তভাবে কথা বলিতে বলিতে তিনি সহসা উত্তেজিতভাবে বলিয়া উঠেন, “মুণ্ডমালা পরায়ে তোমায়, ভয়ে ফিরে চায়, নাম দেয় দয়াময়ী’। মুখ তারা!” এই কথা বলিবার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতার হৃদয়ঙ্গম হইল যে, ভূমিকম্প বা অগ্ন্যুৎপাতরূপে প্রকাশিত যে ঈশ্বর, তাঁহাকে ভাল না বাসিয়া যে ঈশ্বর দয়াময়, যিনি পালনকর্তা, শোকে-দুঃখে যাহার নিকট সান্ত্বনালাভ করা যায়, তাহার উদ্দেশে নিবেদিত যে পূজা, তাহার মূলে অহংজ্ঞানই বিদ্যমাণ বৃঝিতে পারিলেন, এই ধরনের পূজা হিন্দুরা যাহাকে প্রকৃতপক্ষে ’দোকানদারি’ বলিয়া অভিহিত করেন, তাহা ব্যতীত আর কিছুই নহে। উপলব্ধি করিলেন, মঙ্গলের মধ্যে তাহার যেরূপ প্রকাশ, অমঙ্গলের মধ্যেও সেইরূপ, এবং এই শিক্ষা পূর্বোক্ত শিক্ষা অপেক্ষা বহুগুণ নির্ভীক ও সত্য। দেখিলাম, কাঁচা আমির গণ্ডি অতিক্রম করিতে হইলে যে মনোভাব ও ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন, তাহা বস্তুতঃ দৃঢ়সঙ্কল্প, স্বামীজী কঠোর ভাষায় যাহা প্রকাশ করিয়াছেন,  ‘জীবন না চাহিয়া মৃত্যুকে অনুসন্ধান করিতে হইবে, নিজেকে তরবারিমুখে নিক্ষেপ করিতে হইবে, চিরকালের জন্য ভয়ঙ্করা মূর্তির সহিত একাত্ম হইতে হইবে।’

নিজের ধারণাগুলি স্বামীজী কখনও শিষ্যদের উপর জোর করিয়া চাপাইবার চেষ্টা করিতেন না, কারণ উহা দ্বারা স্বাধীনতা বলিতে তাহার যে আদর্শ বা ভাব তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করা হইত। কিন্তু শিক্ষকরূপে আমার অতীত জীবনের অভিজ্ঞতার ফলে আমি স্পষ্টরূপে বুঝিয়াছিলাম যে, আমাকে ভারতীয়ভাবে চিন্তা করিবার অভ্যাস করিতে হইবে। ঐ ভাবধারায় ভারতের বিভিন্ন উপাসনা প্রণালীর বিশিষ্ট স্থান লক্ষ্য করিয়া আমি কতখানি বিস্ময়বিমূঢ় বোধ করিয়াছিলাম, তখ, অমরনাথ যাত্রার সহিত অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকিয়া উহার সাক্ষ্য বহন করিতেছে। উহা কদাপি ভুলিবার নহে। সুতরাং যে ভাবে কোন ব্যক্তি কোন নূতন ভাষা শিক্ষা করিতে আরম্ভ করে, অথবা সম্ভবপর হইলে ইচ্ছাপূর্বক কোন নূতন জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করিতে চেষ্টা করে, সেইভাবে আমি কালীপূজার রহস্য অনুধাবনের চেষ্টা করিতে লাগিলাম। এই চেষ্টার ফলেই আমি স্বামীজীর জীবন ও চিন্তাধারা কতকটা বুঝিতে সক্ষম হই। ধীরে ধীরে একটু একটু করিয়া আমি বুঝিতে পারিলাম। বলা বাহুল্য,ধর্মসংক্রান্ত ব্যাপারে স্বামীজী নিজে ছিলেন আজন্ম শিক্ষক, যদিও তিনি নিজে এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন না। যে চিন্তা নির্দিষ্ট রূপ লইবার চেষ্টা করিতেছে, তাহাকে তিনি কখনও বাধা দিতেন না। একদিন তাহার নিকট বসিয়া আছি, এমন সময়ে ঐ স্থানে একখানি কালী প্রতিমা আনীত হয়। প্রতিমার মধ্যে কোন একটি ভাব চকিতের মতো লক্ষ্য করিয়া আমি সহসা বলিয়া উঠিলাম, “স্বামীজী, হয়তো মা কালী সদাশিবেরই ধ্যানযোগে উপলব্ধ মূর্তিবিশেষ। তাই কি?” তিনি মুহূর্তের জন্য আমার দিকে চাহিলেন। পরে সস্নেহে বলিলেন, “বেশ, তাই হোক, তোমার নিজের ভাবেই ওটি প্রকাশ কর!”

.

আর একদিন আমাকে সঙ্গে লইয়া তিনি প্রবীণ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাহার জোড়াসাঁকোর নির্জন বাড়িতে দর্শন করিতে যাইতেছিলেন। পূর্বরাত্রে একজনের জীবনের অন্তিমকালের দৃশ্য আমি প্রত্যক্ষ করি। যাত্রার পূর্বে স্বামীজী আমাকে ঐ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। উত্তরে আমি সাগ্রহে বলি, “আমার হঠাৎ উপলব্ধি হইয়াছে, বিভিন্ন ধর্ম যেন বিভিন্ন ভাষা, আর আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির সহিত তাহার নিজের ভাষাতেই কথা বলা উচিত।” তাহার সমগ্র মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “হাঁ, একমাত্র শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই এ কথা শিক্ষা দিয়ে গেছেন। একমাত্র তিনিই সাহস করে বলে গেছেন যে, আমাদের সকল লোকের সঙ্গে তাদের নিজ নিজ ভাষায় কথা বলা উচিত।”

তথাপি এমন একদিন আসিল, যখন তিনি শক্তিপূজা সম্বন্ধে তাহার নিজের মত সুস্পষ্টরূপে জানাইয়া দিবার প্রয়োজন অনুভব করিলেন। আমার কালীঘাটে বক্তৃতা দিবার কথা ছিল। তিনি আমাকে জানাইলেন, আমার বিদেশীয় বন্ধুগণ যোগদান করিতে ইচ্ছা করিলে অন্য শ্রোতাদের মতো তাহাদিগকেও জুতা খুলিয়া যাইতে হইবে এবং মেঝের উপর বসিতে হইবে। সেই মহাপীঠে কাহারও জন্য যেন সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম না ঘটে। আমার উপরেই এই বিষয়টি দেখিবার ভার রহিল।(১)

এই কথা বলিয়া চলিয়া যাইবার পূর্বে তিনি আরও কিছুক্ষণ রহিয়া গেলেন। তারপর যেন একটু অনিচ্ছুকভাবে কর্ণেল হের রক্ষাকারী দেবগণ (Guardian Angels) নামক কবিতার উল্লেখপূর্বক বলিলেন, “ব্ৰহ্ম ও দেবদেবীগণ সম্পর্কে আমারও ঠিক ঐ মত। ব্ৰহ্ম ও দেবদেবীগণেই আমি বিশ্বাস করি। অন্য কিছুতে আমার বিশ্বাস নেই।”

স্পষ্টই বুঝা গেল, তাহার আশঙ্কা তাঁহার নিজের যেরূপ অসুবিধা হইয়াছিল, আমারও যুক্তির দ্বারা বুঝিতে গেলে সেইরূপ অসুবিধা ঘটিবার সম্ভাবনা—কোন এক বিশেষ অঙ্গের পূজাকে সর্বোচ্চ জানিয়া তাহার গুণগান, এবং বেদান্তের চরম ব্রহ্মবাদ এই উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান এক সমস্যা, এবং যুক্তি সহায়ে উহার সমাধান কঠিন। স্বামীজী জানিতেন না, অন্তরঙ্গ ভক্তগণের নিকট তিনি স্বয়ং ছিলেন এইসকল বিপরীতলক্ষণ বিশিষ্ট ধর্মের সমন্বয়স্থল, এবং তাহাদের প্রত্যেকটি যে সত্য তাহার সাক্ষিস্বরূপ। সুতরাং ঐ বিষয়টি চিন্তা করিতে করিতে তিনি যেন কিছুক্ষণ আপন মনেই কথা বলিতে লাগিলেন; কতকটা অসংলগ্ন, যেন কতকগুলি প্রশ্নের উত্তর দিতেছেন, নিজের মতটি সহজবোধ্য করিবার চেষ্টা করিতেছেন, তথাপি যেন নিজের অন্তরে কিছু দেখিয়া তাহাতেই অধমগ্ন, চেষ্টা করিয়াও উহার প্রভাব হইতে নিজেকে মুক্ত করিতে পারিতেছেন না।

অবশেষে বলিলেন, “ওঃ! মা কালী ও তার লীলাকে আমি কি ঘৃণাই করেছি! ছবছর ধরে ঐ নিয়ে সংগ্রাম করেছি, কিছুতেই তাকে মানবনা। শেষে কিন্তু আমাকে মানতেই হলো! শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আমাকে তার কাছে উৎসর্গ করেছিলেন, আর এখন আমি বিশ্বাস করি, অতি সামান্য কাজেও সেই মা আমাকে পরিচালনা করছেন, আমাকে নিয়ে যা খুশি তাই করছেন!…বহুদিন তাকে মানব না বলে আমি জেদ করেছিলাম। ঠাকুরকে ভালবাসতুম কি না, তাই ছাড়তে পারিনি। তার অদ্ভুত পবিত্রতা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। তার অসাধারণ ভালবাসা প্রাণে প্রাণে অনুভব করেছি। তিনি কত বড় ছিলেন, তখন তা আমার ধারণা হয়নি।…সে সব পরে হয়–যখন আমি বশ্যতা স্বীকার করি। সে সময়ে আমি তাকে এক উদ্ভ্রান্ত-মস্তিস্ক শিশু বলে মনে করতাম—সব সময়ে বাজে খেয়াল দেখছেন! ও-সব আমি ঘৃণা করতাম। কিন্তু শেষে আমাকেও মা কালীকে মানতে হলো!

 “কেন আমাকে মানতে হলো, তা অত্যন্ত গুহ্য ব্যাপার, জীবনে কাউকে তা আমি বলব না। তখন আমার অতি দুঃসময়।…মা সুবিধা পেলেন, আমাকে গোলাম করে ফেললেন। ঠাকুরের নিজের মুখের কথা, “তুই মায়ের গোলাম হবি।’ রামকৃষ্ণ পরমহংস আমাকে মায়ের হাতে সমর্পণ করলেন। …আশ্চর্য! ঐ ঘটনার পর তিনি মাত্র দুই বছর জীবিত ছিলেন, অধিকাংশ সময় আবার অসুখে ভুগছিলেন। ছ-মাস যেতে না যেতেই তার স্বাস্থ্যভঙ্গ হলো, সে প্রফুল্লতা কোথায় চলে গেল!

“জান, গুরু নানকেরও ঐ রকম হয়েছিল। তিনি অনুসন্ধান করেছিলেন, কে তার সেই শিষ্য, যার মধ্যে তিনি নিজের শক্তির সঞ্চার করবেন। নিজের পরিবারবর্গকে তিনি উপেক্ষা করে গেলেন তার সন্তানগণ যেন তার কাছে কিছুই নয়! অবশেষে সেই বালকের সন্ধান পেলেন, যাকে তিনি ঐ শক্তি গ্রহণের অধিকারী মনে করলেন। তাকে ঐ শক্তি দান করে তবে তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে পেরেছিলেন।

“তুমি মনেকরছ, ভাবীযুগ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসকে মা কালীরই অবতার বলবে?, আমারও মনে হয়, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, মা তার নিজ প্রয়োজন সিদ্ধির উদ্দেশ্যে শ্রীরামকৃষ্ণশরীরে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

“দেখ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কোথাও এমন এক মহাশক্তি আছেন, যিনি নিজেকে প্রকৃতি-সত্তা বলে মনে করেন। তারই নাম কালী, তারই নাম মা!…আবার আমি ব্রহ্মেও বিশ্বাস করি।…কিন্তু এই রকমই সর্বদা হয় না কি? শরীর মধ্যস্থিত অসংখ্য কোষ (cells) মিলিত হয়েই এক ব্যক্তি সৃষ্টি করে না কি? এক নয়, বহু মস্তিষ্ককেন্দ্রই কি মনের অভিব্যক্তি ঘটায় না? বহু বৈচিত্র্যের মধ্যেই একত্ব—এই আর কি! তবে ব্রহ্মের বেলায় অন্যরূপ হবে কেন? ব্রহ্মই একমাত্র সৎ পদার্থ, তিনি অদ্বিতীয়, কিন্তু তিনিই আবার দেবদেবীতে পরিণত!”

অনুরূপভাবে কাশ্মীর-তীর্থযাত্রা হইতে প্রত্যাবর্তনান্তে তিনি বলিয়াছিলেন, “এই-সব দেবদেবী কেবল মনগড়া জিনিস নয়! ভক্তেরা যে-সকল ঈশ্বরীয় রূপ প্রত্যক্ষ করেছেন, সেই সব রূপই দেবদেবীর মূর্তি বলে গৃহীত হয়েছে।” শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কেও শোনা যায় যে, সমাধি হইতে উখিত হইবার পর কখন কখনও তাহার শরীর মন অবলম্বন করিয়া যিনি অবস্থান করিতেছেন, তাঁহার সম্পর্কে বলিতেন, “বাম ও কৃষ্ণরূপে যিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তিনিই এখন (নিজ শরীর দেখাইয়া) এই শরীরে আবির্ভূত।” তারপর প্রধান শিষ্যের দিকে চাহিয়া হাসিতে হাসিতে বলিতেন, “কিন্তু, নরেন, তা বলে তোর বেদান্তের দিক দিয়ে নয়।”

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে উপলব্ধ সত্যসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সমন্বয়সাধন লইয়া মহাপুরুষগণের মনে যে দ্বন্দ্ব চলিতে থাকে, পূর্বোক্ত ঘটনাগুলি সেই সম্পর্কে আমাদের কিছু কিছু আভাস দেয়। একদিকে জগন্মাতা, অন্যদিকে ব্রহ্ম। বহুদিন পূর্বে স্বামীজীর নিকট শোনা তাহার কথাগুলি মনে পড়ে, “ইন্দ্রিয় জ্ঞানের অস্পষ্ট কুহেলিকার মধ্যে দিয়ে দেখলে নির্গুণ ব্রহ্মই সগুণরূপে প্রতিভাত ইন। প্রকৃতপক্ষে এই উভয় ভাবের মধ্যে সমন্বয়সাধন করা যায় কি না সন্দেহ। একই সময়ে দুইটি ধারণা সমভাবে সত্য হইতে পারে না। এ-কথা সহজেই বোঝা যায় যে, অনুভূতির ক্ষেত্রে অবশেষে হয় শক্তিকে ব্ৰহ্ম হইতে হইবে, নতুবা ব্ৰহ্মই শক্তিতে পরিণত হইবে। উভয়ের মধ্যে একটিতে. অপরের মধ্যে বিলীন হইতে হইবে। কোনটি কাহার মধ্যে লয় প্রাপ্ত হইবে, তাহা বিশেষ ক্ষেত্রে সাধকের অদৃষ্ট ও পূর্বজন্মের সংস্কারের উপর নির্ভর করে।

আমার নিজের কথা বলিতে গেলে, পূর্বোক্ত কথাবার্তা আমার জীবনে এক নূতন যুগের সূচনা করিয়াছে। সেইদিন হইতে স্বামীজীর সকল আচরণে আমি লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছি, তিনি যেন অপর কাহারও নিকট দায়স্বরূপ প্রাপ্ত কোন বিশেষ কার্যভার বহন করিয়া আসিতেছেন। কালীমূর্তির ব্যাখ্যা করিতে অনুরোধ করিলে তিনি বলিতেন—মা যেন একখানি মহাগ্রন্থ; যাহা পাঠ করিয়া মানব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে; পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাইয়া অবশেষে দেখে, উহাতে কিছুই নাই। আমার মনে হয় ইহাই চরম ব্যাখ্যা। ভারতের ভাবীযুগের বংশধরের একমাত্র উপাস্য হইবেন মা কালী। তাহার নাম লইয়াই মাতৃভক্ত সন্তানগণ নানা অভিজ্ঞতার শেষ সীমায় উপনীত হইতে সমর্থ হইবেন। তথাপি সর্বশেষে তাহাদের হৃদয়ে সেই সনাতন জ্ঞানের বিকাশ ঘটিবে, এবং প্রত্যেক মানব নিজ নিজ শুভ মুহূর্ত উদয় হইলে জানিতে পারিবে যে, সমগ্র জীবন ছিল এক স্বপ্নমাত্র।

গীতার সেই বেদতুল্য বাক্য কাহার স্মৃতিপথে না উদিত হয়?

“ন কর্মণামনারম্ভান্নৈষ্ক্ররম্যং পুরুষোহশ্নুতে।
ন চ সংন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি ॥”

অর্থাৎ, কর্মের আরম্ভমাত্র না করিয়া কোন ব্যক্তিই নৈষ্কর্ম লাভ করিতে পারে না। শুধু কর্মত্যাগ করিলেই সিদ্ধি করতলগত হয় না। সেইরূপ আমরাও কি নিশ্চিতভাবে জানি না যে, এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া না যাইলে অন্তিমে সত্যের সাক্ষাৎকার ঘটে না? শক্তির মাধ্যমে ব্রহ্মে উপনীত হইতে হইবেনূতন জীবন, নব নব জ্ঞান, বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়া, অদূর ভবিষ্যতের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়া অবশেষে আমরা সেই আত্মারূপী চিরধামে উপনীত হইব, যেখানে সব এক অখণ্ড সত্তারূপে বিরাজমান এবং শান্তিতে পরিপূর্ণ। যে আচার্যশ্রেষ্ঠকে আমি অনুসরণ করিয়া আসিয়াছি, তাহার জীবনের প্রতি যতই গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করি, ততই প্রতিদিন আমি অধিকতর স্পষ্টরূপে দেখিতে পাই যে, তিনি স্বয়ং অভিজ্ঞতারূপ মহাগ্রন্থের পৃষ্ঠাগুলি উল্টাইয়া যাইতেছিলেন, এবং অবশেষে শেষ শব্দটি পড়া হইয়া যাইবামাত্র শ্রান্ত শিশুর ন্যায় মাতৃক্রোড়ে শয়ন করিয়া মহাসমাধিতে মগ্ন হইলেন। আর তখনই তাঁহার জ্ঞান হইল, এই অনন্ত বৈচিত্র্যময় জীবন স্বপ্নমাত্র।

———

(১) কোথাও কোন দেবস্থানেই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম হইতে দেওয়া উচিত নহে। যে ব্যক্তি নিজের দেবস্থানের পবিত্রতা ও মাহাত্ম্যরক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর না হয়, সে সকলের অশ্রদ্ধার পাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *