০৮. অমরনাথ

অষ্টম পরিচ্ছেদ
অমরনাথ

আচ্ছাবলের মোগলবাগে একদিন আমরা উন্মুক্ত আকাশের নিচে বসিয়া আহার করিতেছি, এমন সময় স্বামীজী হঠাৎ ঘোষণা করিলেন, তিনি যাত্রিগণের সহিত অমরনাথ যাত্রা করিবেন এবং তাহার কন্যাকেও (লেখিকা) সঙ্গে লইবেন। আমাদের ক্ষুদ্র দলটির সকলেই এই সংবাদে এবং ঐ কন্যার সৌভাগ্যে এত আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন যে, তাঁহার যাত্রা সম্পর্কে কোন আপত্তি উত্থাপিত হইল না। তাহাদের সম্মতিক্রমে, এবং উক্ত যাত্রার ভারপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীর আনুকূল্যে, এই অভিনব তীর্থদর্শনের আয়োজন চলিতে লাগিল।

সেই কয় সপ্তাহ মনে হইতেছিল কাশ্মীর তীর্থযাত্রীতে পরিপূর্ণ। শেষ বন্দোবস্তের জন্য আমরা আচ্ছাবল পরিত্যাগ করিয়া ইসলামাবাদে আমাদের নৌকায় প্রত্যাবর্তন করিলাম। সর্বত্র নূতন নূতন যাত্রীদল চলিয়াছে। নিস্তব্ধ, সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে সব সম্পন্ন হইতেছে। দুই-তিন সহস্র লোক একটি মাঠে ছাউনি ফেলিয়া আবার সূর্যোদয়ের পূর্বেই ঐ স্থান ছাড়িয়া চলিয়া যায়। চুল্লীর ছাই ব্যতীত রাত্রিবাসের আর কোন চিহ্ন দৃষ্ট হয় না। তাহারা সঙ্গে বাজার লইয়া চলিয়াছে, প্রত্যেক বিশ্রামস্থানে তাঁবু-খাটানো ও দোকান-সাজানোর কার্য অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সহিত সম্পাদিত হয়। সঙ্ঘবদ্ধভাবে কার্য করা যেন তাহাদের স্বভাবত। ছাউনির এক অংশের মাঝখান দিয়া চওড়া রাস্তা চলিয়া গিয়াছে এবং সেখানে শুষ্ক ফল, দুধ ও চালডাল কিনিতে পাওয়া যায়। তহশীলদারের তাঁবুটি—যাহার এক পার্ধে স্বামীজীর ও অপর পার্শে আমার তাঁবু-সাধারণতঃ এরূপ স্থানে খাটানো হইত, যেখানে সন্ধ্যাকালে আগুন জ্বালানোর সুবিধা হয় এবং এইরূপে উহা স্বামীজীর সান্নিধ্যবশতঃ পরস্পরের মেলা-মেশা করিবার স্থান হইয়া উঠিত।

যাত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শত শত সাধু। তাহাদের তাঁবুগুলির রঙ গৈরিক; কতকগুলি আবার আকারে এক একটি বড় ছাতার মতো। এই সাধু সম্প্রদায়ের উপর স্বামীজীর অসীম প্রভাব। তাহাদের মধ্যে যাহারা অপেক্ষাকৃত বিদ্বান, তাহারা প্রত্যেক বিশ্রামস্থলে স্বামীজীকে ঘিরিয়া থাকিতেন। তাঁহার তাঁবুর মধ্যে সর্বদা ভিড়, দিনের আলো থাকা পর্যন্ত সাধুরা কথাবার্তায় মগ্ন থাকিতেন। স্বামীজী পরে আমাদের বলেন, তাহাদের প্রসঙ্গ ছিল শিববিষয়ক, আর মধ্যে মধ্যে তিনি জোর করিয়া তাহাদের মনোযোগ বাহ্যজগতের প্রতি আকর্ষণ করিলে তাহারা গম্ভীরভাবে তাহাকে ভৎসনা করিতেন। তাহাদের বক্তব্য ছিল যে, বিদেশীরাও ‘মানুষ’। তবে স্বদেশ ও বিদেশের মধ্যে পার্থক্য করা কেন? আবার তাহাদের মধ্যে অনেকে মুসলমান ধর্মের প্রতি স্বামীজীর প্রেম ও সহানুভূতির অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিতেন না। যে পরলোকচিন্তা স্বদেশ-বিদেশকে অভিন্ন জ্ঞান করাইত, সেই চিন্তাই এই সরলান্তঃকরণ ব্যক্তিগণকে হিন্দু ও মুসলমান যে এক অখণ্ড সত্তার দুইটি পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপ অঙ্গবিশেষ—এই চিন্তায় বাধা দিত। তাহাদের যুক্তি ছিল, ধর্মের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়াছেন, এরূপ বহুলোকের শোণিতে পঞ্চনদের ভূমি প্লাবিত। অন্ততঃ এখানে যেন স্বামীজী প্রচলিত ধর্মের গোড়ামির সঙ্কীর্ণতা মানিয়া চলেন! ইহার উত্তরে সেই সময়ের মতো স্বামীজী কতকগুলি আচরণে বিরত রহিলেন, যাহাতে ভ্রাতৃস্থানীয় সাধুমণ্ডলীর প্রতি তাহার প্রীতির পরিচয় পাওয়া গেল এবং তাহার মূল নীতিগুলি অধিকতর দৃঢ়তার সহিত গভীরভাবে তাহাদের মনে অঙ্কিত হইয়া গেল। এইরূপ আচরণ তাঁহার পক্ষে উপযুক্তই হইয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন ভাবীযুগের, কোনক্রমে পূর্ববর্তী যুগে আসিয়া পড়িয়াছিলেন! যাহা হউক, স্বামীজী যখন এই সকল আলোচনা বর্ণনা করিতেছিলেন, তখন উহার অসংলগ্নতা দর্শনে পাশ্চাত্যবাসীরা কৌতুক অনুভব না করিয়া পারেন নাই। কারণ, এই তীর্থযাত্রা-সংক্রান্ত বহু কর্মচারী ও ভৃত্য এবং তহশীলদার স্বয়ং ছিলেন মুসলমান এবং যথাসময়ে তীর্থস্থানে উপনীত হইয়া তাহাদের গুহায় প্রবেশে যে কোনরূপ বাধা থাকিতে পারে, একথা স্বপ্নেও কাহারও মনে উঠে নাই। বস্তুতঃ পরে তহশীলদার কয়েকজন বন্ধুসহ স্বামীজীর নিকট যথাবিধি শিষ্যত্ব গ্রহণ করিবার জন্য আগমন করেন; এবং এই ব্যাপার কাহারও নিকট বিস্ময়কর বা বিসদৃশ বোধ হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না।

ইসলামাবাদ পরিত্যাগ করিয়া আমরা পথের মধ্যে এক জায়গায় যাত্রিদলের সহিত মিলিত হই এবং তাহাদের সঙ্গে সেই রাত্রির মতো বওয়ান নামক স্থানে তাঁবু ফেলা হয়। বওয়ান কতকগুলি পুণ্য উৎসের জন্য বিখ্যাত। সন্ধ্যাকালে দীর্ঘিকার পরিষ্কার কাল জলে দীপমালার প্রতিচ্ছায়া, এবং অসংখ্য যাত্রীর এক মন্দির হইতে অন্য মন্দিরে গমন—এখনও আমার মনে পড়িতেছে।

পহলগাম মেষপালকগণের গ্রাম—একাদশী পালন করিবার জন্য যাত্রিদল এখানে একদিন বিশ্রাম করিল। অদূরে দুইটি ক্ষুদ্র পাহাড়ের সংযোগস্থলে একটি ক্ষুদ্র পার্বত্য নদী, তাহারই প্রস্তর-সংঘর্ষে সৃষ্ট গর্ভে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুদ্বীপ। সুন্দর দৃশ্য! দুই পার্শ্বে ঢালু জমি সরল বৃক্ষের সারিতে ছাইয়া গিয়াছে। সূর্যাস্তের পর সর্বাপেক্ষা উচ্চ পর্বতের উপর দিয়া চন্দ্র দেখা গেল এখনও পরিপূর্ণ নহে। সুইজারল্যাণ্ড অথবা নরওয়ের সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও মনোরম দৃশ্যগুলির অন্যতম। এখানে আমরা শেষ জনবসতির চিহ্ন দেখিলাম—একটি পুল, একটি খামারবাড়ি, তাহার সংলগ্ন ক্ষেত্র কর্ষণ করা হইয়াছে, এবং কতকগুলি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কুটির। শেষ পথটুকু অতিক্রম করিবার জন্য যাত্রা আরম্ভ হইলে দেখিলাম, অবশিষ্ট যাত্রিগণের তাঁবুগুলি তখনও শস্পাচ্ছাদিত গোলাকার পাহাড়টির উপর খাটানো রহিয়াছে।

অনির্বচনীয় সৌন্দর্যপূর্ণ দৃশ্যের মধ্য দিয়া আমরা তিন সহস্র যাত্রী সম্মুখস্থিত উন্মুক্ত উপত্যকায় আরোহণ করিতে লাগিলাম। প্রথম দিন আমাদের তাঁবু পড়িল সরল বৃক্ষের বনে; পরদিন তুষারবত্মরেখা অতিক্রম করিয়া একটি তুষার নদীর ধারে আমরা তাঁবু খাটাইলাম। নদীটি জমিয়া গিয়াছে। সে রাত্রে জুনিপার কাঠ দ্বারা ছাউনীর সুবৃহৎ অগ্নি প্রজ্বলিত হইল; পরদিন সন্ধ্যায় আরও উচ্চে অবস্থান করায়, ঐ বিরল ইন্ধনের অনুসন্ধানে ভৃত্যগণকে বহু ক্রোশ ঘুরিতে হয়। অবশেষে প্রকৃত পথের শেষ হইয়া গেল এবং আমরা পাকদণ্ডী (অত্যন্ত উঁচু-নিচু সরু পথ) দিয়া অতিকষ্টে খাড়া খাড়া পাহাড় চড়াই-উত্রাই করিতে লাগিলাম। অবশেষে যে গিরিসঙ্কটে অমরনাথ-গুহা অবস্থিত, সেখানে উপস্থিত হওয়া গেল। চারিদিকে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাথর ছড়ানো। সামনেই তুষারমণ্ডিত শিখরগুলি সদ্য-পতিও তুষাররূপ শ্বেত অবগুণ্ঠনে আবৃত। গুহার অভ্যন্তরে সূর্যালোক প্রবেশ করিতে পারে না, এমন এক গভীর অংশে মহান তুষারলিঙ্গ বিরাজমান। যে সকল কৃষক ঐ তুষারলিঙ্গের প্রথম দর্শনলাভে বিস্ময়ে অভিভূত হইয়াছিল, তাহাদের নিকট উহা সাক্ষাৎ ভগবানের আবির্ভাব বলিয়াই বোধ হইয়া থাকিবে।

আসিবার পথে স্বামীজী তীর্থযাত্রার প্রত্যেকটি বিধি-নিয়ম পালন করিয়াছেন। মালা-জপ, উপবাস এবং যাত্রার দ্বিতীয় দিনে কঙ্করময় নদী গর্ভগুলি অতিক্রমকালে পরপর চিটি স্রোতস্বিনীর (পঞ্চতরণী) বরফ-গলা জলে স্নান—সবই তিনি যথাবিধি করিয়াছেন। এইবার যখন তিনি গুহা মধ্যে প্রবেশ করিলেন, বোধ হইল, মহাদেব যেন সশরীরে তাহার নিকট প্রত্যক্ষ হইলেন। কোলাহল করিয়া অসংখ্য যাত্রী গুহায় প্রবেশ করিতেছে, মাথার উপর পারাবতকুল ঝটপট শব্দ করিয়া উড়িতেছে; তাহারই মধ্যে স্বামীজী অপরের অলক্ষ্যে দুই-তিন বার ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন; তারপর পাছে ভাবাবেশে আত্মহারা হইয়া পড়েন, এই ভয়ে নিঃশব্দে উঠিয়া দাঁড়াইলেন ও দ্রুতপদে বাহিরে চলিয়া গেলেন। পরে বলিয়াছিলেন, ঐ সংক্ষিপ্ত কয়েক মুহূর্তে তিনি মহাদেবের নিকট ইচ্ছামৃত্যু বব লাভ করেন। আশৈশব যে অস্ফুট ধারণা তাহার মনে দৃঢ়বদ্ধ ছিল যে, পর্বতের মধ্যে কোন শিব-মন্দিরে তাহার মৃত্যু ঘটিবে, সম্ভবতঃ এইরূপে তাহা ব্যর্থ হয়, অথবা সার্থকতা লাভ করে।

গুহার বহির্ভাগে অসহায় যাত্রিগণের উপর পাণ্ডাদের অত্যাচার ছিল না। অনাড়ম্বর এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য অমরনাথের প্রসিদ্ধি আছে। রাখিবন্ধনের পণ্য দিবসেই এই যাত্রাব শ্রেষ্ঠ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অনেকেই আমাদের হাতে রক্ত ও পীতবর্ণের রাখি বাধিয়া দিয়া গেল। অতঃপর কিছুক্ষণ বিশ্রামান্তে আমরা নদীর ধারে কয়েকটি প্রকাণ্ড উচ্চ পাথরের উপর বসিয়া আহার সম্পন্ন করিলাম, পরে তাঁবুতে ফিরিয়া আসিলাম।

স্বামীজী স্থান মাহাত্ম্যে বিভোর হইয়া গিয়াছেন। তাহার বোধ হইল, এরূপ সুন্দর স্থানে ইতিপূর্বে তিনি আর কখনও আসেন নাই। বহুক্ষণ তিনি নীরবে বসিয়া রহিলেন। তারপর স্বপ্নবিষ্টের ন্যায় বলিলেন, “আমি বেশ কল্পনা করতে পারি, কী ভাবে এই গুহাটি প্রথম আবিষ্কৃত হয়। গ্রীষ্মকালের কোন একদিন একদল মেষপালক তাদের নিরুদ্দিষ্ট মেষগুলির সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পড়ে। তারপর উপত্যকায় অবস্থিত তাদের ঘরে ফিরে বর্ণনা করে, কী ভাবে তা হঠাৎ মহাদেবের দর্শন লাভ করেছে।”

অন্ততঃ আমার গুরুর নিজের সম্পর্কে এইরূপ কাহিনী বলা চলে। তুষারলিঙ্গের পবিত্রতা ও শুভ্রতা তাহাকে মুগ্ধ এবং বিস্মিত করিয়াছিল। গুহাটি তাঁহাব নিকট কৈলাসের রহস্য উদঘাটিত করে। কীভাবে তিনি একটি পার্বত্য গুহায় প্রবেশ করিয়া সাক্ষাৎ ভগবানকে প্রত্যক্ষ করেন, তাহার স্মৃতি তিনি সারাজীবন হৃদয়ে পোষণ করিতেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *