০২. লণ্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ–১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
লণ্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ–১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে

পর বৎসর এপ্রিল মাসে স্বামীজী লণ্ডনে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সেন্ট জর্জেস রোডের যে বাড়িতে তিনি তাহার সদাশয় বন্ধু মিঃ ই. টি. স্টার্ডির সহিত বাস করেন, সেখানে ও গ্রীষ্মকাশের পর পুনরায় ভিক্টোরিয়া স্ট্রীটের নিকট এক বৃহৎ ক্লাসরুমে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষা দেন। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে তিনি তাহার বন্ধু মিঃ ও মিসেস সেভিয়ার ও মিস এইচ. এফ. মূলারের সহিত ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইজর্লণ্ড ভ্রমণ করেন। ডিসেম্বর মাসে কয়েকজন শিষ্যসহ রোম হইয়া তিনি ভারত যাত্রা করেন এবং ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারী সিংহলের অন্তর্গত কলম্বো শহরে উপনীত হন।

১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে প্রদত্ত বক্তৃতাবলীর অধিকাংশ পরে প্রকাশিত হইয়াছে। ঐ বক্তৃতাগুলি পাঠ করিয়া সকলে অবগত হইতে পারেন, জগৎকে তাহার কি দিবার ছিল এবং কিরূপে উহা তিনি ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন, যাহাতে সকলের বোধগম্য হয়। ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজ করেন—হিন্দুগণের এই যে বিশ্বাস, তাহারই প্রচারকরূপে স্বামীজী আমাদের দেশে আসিয়াছিলেন, এবং তাহার প্রচারিত ধর্মের (gospel) সত্যতা নির্ণয়ের জন্য তিনি সকলকে উহা পরীক্ষা করিয়া লইতে আহ্বান করেন। তখনই বা কি, আর পরেই বা কি, আমি তাহাকে কখনও শ্রোতৃবর্গের নিকট কোন বিশেষ ধর্মমতের পক্ষ সমর্থন করিতে শুনি নাই। বক্তব্য বিষয় উদাহরণ দ্বারা বুঝাইতে গিয়া তিনি অসঙ্কোচে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের (sects) উল্লেখ করিতেন—উহাদিগকে সম্প্রদায়’ না বলিয়া বিভিন্ন ধর্মমত (churches) বলিলেই ভাল হয়। কিন্তু ভারতীয় চিন্তাপ্রণালীতে যে দর্শন সমুদয় ধর্মমতের ভিত্তিস্বরূপ, তাহা ব্যতীত তিনি অপর কিছু কদাপি প্রচার করেন নাই। বেদ, উপনিষদ্ ও ভগবদ্গীতা ব্যতীত অপর কোন গ্রন্থ হইতে কখনও কোন অংশ উদ্ধৃত করেন নাই। জনসমক্ষে তিনি কখনও তাহার গুরুদেবের উল্লেখ করেন নাই, অথবা হিন্দু পৌরাণিক আখ্যানসমূহের অংশবিশেষ সম্বন্ধে কোন সুস্পষ্ট মতামতও প্রকাশ করেন নাই।

তিনি গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করেন যে, যাহাতে পাশ্চাত্য ধর্মচেতনা আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারসমূহ সাদরে গ্রহণ ও আত্মসাৎ করিতে পারে, এবং সমগ্র জগৎ একসূত্রে আবদ্ধ হইলে তাহার অবশ্যম্ভাবী পরিণামস্বরূপ স্থানীয় পৌরাণিক আখ্যানসমূহের অবলুপ্তির পরেও টিকিয়া থাকিতে পারে, সেজন্য ভারতীয় চিন্তার প্রয়োজনীয়তা আছে। তিনি বুঝিয়াছিলেন, ধর্মমতকে (faith) এমন রূপ দিতে হইবে যাহাতে উহার অনুগামিগণ কিছুতেই সত্যকে ভয় করিবে না! এক বক্তৃতায় তিনি আবেগভরে বলেন, “বিচারমূলক ধর্মের উপরেই ইউরোপের মুক্তি নির্ভর করিতেছে।” আবার বহুবার তিনি বলিয়াছেন, “জড়বাদী ঠিকই বলেন, জগতে মাত্র একটি বস্তুই বিদ্যমান। কেবল সেই অদ্বিতীয় বস্তুকে তিনি জড় বলিতেছেন, আর আমি উহাকেই ঈশ্বর বলি।” আর একস্থলে তিনি বিস্তৃতভাবে ধর্মভাবের বিকাশ ও উহার বিভিন্ন রূপের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “প্রথমে লক্ষ্যবস্তু বহুদূরে, জড়প্রকৃতির বাহিরে, এবং উহা হইতে বহুদূরে অবস্থিত থাকিয়া আমাদের উহার প্রতি আকৃষ্ট করে। লক্ষ্যবস্তুকে ক্রমশঃ নিকটে আনিতে হয়, কিন্তু হীন বা নিকৃষ্ট করিয়া নহে। নিকটতর হইতে হইতে অবশেষে সেই স্বর্গস্থ ঈশ্বর জড়প্রকৃতির ঈশ্বররূপে পরিণত হন; জড়প্রকৃতির মধ্যগত ঈশ্বরই আবার এই প্রকৃতিরূপী ঈশ্বর হইয়া দাঁড়ান; ক্রমে যে ঈশ্বর এই প্রকৃতিরূপী, তিনিই এই দেহমন্দিরের অধিষ্ঠাতা ঈশ্বর হন; তারপর এই দেহমন্দিরই তিনি এবং সর্বশেষে তিনিই মানবাত্মা, এইরূপ হইয়া যায়। এইরূপে জ্ঞান চরমসীমায় উপস্থিত হয়। ঋষিগণ যাহাকে এই সকল স্থানে অন্বেষণ করিয়াছেন, সেই আত্মা আমাদের হৃদয়েই অবস্থিত। ‘তত্ত্বমসি’—তুমিই সেই, হে মানব, তুমিই সেই।

স্বামীজী নিজে মনে করিতেন, এইকালে মায়াসম্বন্ধীয় বক্তৃতাগুলির মধ্যেইতাহার বুদ্ধিবৃত্তির সর্বাপেক্ষা বিকাশ ঘটিয়াছে। মনোযোগ সহকারে ঐগুলি পাঠ করিলেই ধারণা করিতে পারা যায় যে, আধুনিক ইংরেজী ভাষায় ঐসকল ভাবকে প্রকাশ করিতে গিয়া তিনি কি দুরূহ কার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন। ঐ অধ্যায়গুলি আগাগোড়া পাঠ করিলে আমাদের মনে হয়, সুস্পষ্টভাবে অনুভূত একটি ভাবকে প্রকাশের অনুপযোগী এক ভাষায় প্রকাশ করিবার জন্য একটা প্রাণপণ চেষ্টা চলিতেছে। স্বামীজী বলেন, “মায়া’ শব্দটি ভুল করিয়া মিথ্যাজ্ঞান (delusion) অর্থে বুঝা হয়। সর্বপ্রথম উহা দ্বারা ইন্দ্রজালের (magic) মতো একটা কিছু বুঝাইত, যেমন “ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরূপ ঈয়তে”—ইন্দ্র (ঈশ্বর) মায়ায় নানা রূপ ধারণ করিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে এই অর্থ লোপ পায়, এবং শব্দটির এক এক করিয়া বহু অর্থান্তর ঘটে। কিরূপে এই বিভিন্ন অর্থের মধ্য হইতে একটি অর্থ চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট হইয়া গেল, তাহার নিদর্শন নিম্নোক্ত বাক্যে পাওয়া যায়—”নীহারেণ প্রাবৃতা জল্প্যা অসুতৃপ উকথাশাসশ্চরন্তি।”—অর্থাৎ, যেহেতু আমরা বৃথা বাক্যালাপ করিয়া থাকি, ইন্দ্রিয়ের বিষয় লইয়াই সন্তুষ্ট থাকি এবং বাসনারই অনুবর্তন করি—সেই হেতু সত্য বস্তুকে যেন কুয়াসার দ্বারা আচ্ছাদিত করি। অবশেষে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ হইতে উদ্ধৃত শ্লোকেই দেখা যায়, শব্দটি উহার সর্বশেষ অর্থ পরিগ্রহ করিয়াছে—”মায়ান্তু প্রকৃতিং বিদ্যায়িনন্তু মহেশ্বরম্”, অর্থাৎ মায়াকে প্রকৃতি বলিয়া জানিবে, আর যিনি মায়াধীশ, তাঁহাকেই মহেশ্বর বলিয়া জানিবে। স্বামীজী বলেন, বেদান্তে ‘মায়া’ শব্দ সর্বশেষ যে পরিণতি লাভ করিয়াছে তাহার অর্থ—যাহা ঘটিতেছে তাহার উল্লেখমাত্র প্রকৃতপক্ষে আমরা যাহা এবং আমাদের চতুর্দিকে যাহা দেখিয়া থাকি, তাহারই উল্লেখ।

কিন্তু এই কথাগুলি যে সংজ্ঞানির্দেশ হিসাবে ব্যবহৃত হয় নাই, তাহা যে কেহ তাহার মায়া-সম্বন্ধীয় বক্তৃতাবলী পাঠ করিয়াছেন, তিনিই বুঝিতে পারিবেন। মায়া শব্দে যে কেবল ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জগৎকে যেরূপে জানা যায়, তাহাই নির্দেশ করে না, পরন্তু ঐ জ্ঞান যে কুটিল-পথগামী, ভ্রমপূর্ণ ও স্ববিরোধী, তাহা স্পষ্টতঃ বুঝা যায়। স্বামীজী বলেন, “এই জগৎ যে ‘ধোঁকার টাটি’, ইহাতে যে সুখের লেশমাত্র নাই, কেবল পরিশ্রমই সার, আমরা যে ইহার সম্বন্ধে কিছুই জানি না, অথচ জানি না, ইহা বলিতে পারি না—ইহা কোন মতবাদ নহে, পরন্তু প্রকৃত ঘটনাসমূহের উল্লেখমাত্র। স্বপ্নের মধ্যে অর্ধনিদ্রিত, অধজাগরিত অবস্থায় সঞ্চরণ, সমগ্র জীবন এক অস্পষ্ট কুহেলিকার মধ্যে যাপন—ইহাই প্রত্যেকের অদৃষ্ট। সমগ্র ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানেরই এই পরিণতি। আর ইহারই নাম জগৎ।” তাঁহার ব্যাখ্যার অন্যান্য অংশের ন্যায় এখানেও আমরা দেখিতে পাই যে, ভারতীয় শব্দবিশেষকে সঠিকভাবে ইংরেজীতে অনুবাদ করা যায় না; এবং উহা বোধগম্য করিবার একমাত্র উপায় হইল—এখানে সেখানে এক-আধটি বাক্যের উপর সমগ্র মনোযোগ না দিয়া, বক্তা যে ভাবটি প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিতেছেন, তাহা ধরিবার চেষ্টা করা। সুতরাং মায়া অর্থে সেই চকিতের ন্যায় প্রকাশমান, এই আছে, এই নাই, অর্ধ সত্য, অর্ধ মিথ্যা, জটিল কোন কিছু, যাহাতে বিশ্রাম নাই, তৃপ্তিও নাই, কোন চরম নিশ্চয়তা নাই, যাহা আমরা ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয় নির্ভরশীল মনের সাহায্যেই জানিতে পারি। অথচ “আর এই সকলের মধ্যে যিনি ওতপ্রোত রহিয়াছেন, তাঁহাকেই মহেশ্বর বলিয়া জানিও” —’মায়িনন্তু মহেশ্বর। পাশ্চাত্যে স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক সমগ্র হিন্দুধর্মতত্ত্বের ব্যাখ্যা পাশাপাশি অবস্থিত এই দুইটি ভাবের মধ্যেই বিদ্যমান। অন্যান্য উপদেশ ও ভাবগুলি ইহাদের অনুবর্তী মাত্র। ধর্ম হইল ব্যক্তির ক্রমবিকাশের ব্যাপার “ক্রমাগত সত্তা ও পরিণাম (being and becoming) থাকা ও হওয়া।” কিন্তু এই ক্রমবিকাশের মূলে ঐ দুটি মুখ্য ঘটনা থাকা চাই, এবং ভরকেন্দ্রটি যেন একটি হইতে অপরটিতে—মায়া হইতে আত্মায় ধীরে ধীরে স্থানান্তরিত হয়। প্রাচ্যমতে মায়াতে তন্ময় হইয়া থাকার নামই ‘বন্ধন’। আর এই বন্ধন ভাঙিয়া ফেলার নামই ‘মুক্তি’; এমনকি, উহাকে ‘নির্বাণ’ পর্যন্ত বলা হয়। এই বন্ধন যিনি ভাঙিয়া ফেলিতে চাহেন,তাহাকে সর্বদা ত্যাগের পথ অন্বেষণ করিতে হইবে—ভোগের অন্বেষণ করিলে চলিবে না। স্বামীজী বলেন, এই বিষয়ে তিনি সকল ধর্মের যাহা মূলম, তাহারই প্রতিধ্বনি করিতেছেন মাত্র। কারণ, ভারতীয় ও অন্যান্য সকল ধর্মই সুখের অন্বেষণ করিতে করিতে অবশেষে কোন এক স্থলে আর নয়’ বলিয়া নিবৃত্ত হইয়াছেন। সকল ধর্মই সংসাবকে নাচঘরে পরিণত না করিয়া সংগ্রামক্ষেত্রে পরিণত করিতে প্রয়াস পাইয়াছেন। সকল ধর্মই মানবকে জীবন অপেক্ষা মৃত্যুর সম্মুখীন হইবার জন্য শক্তি দিতে চেষ্টা করিয়াছেন। আমার মতে অন্যান্য আচার্যগণ হইতে স্বামীজীর পার্থক্য বোধ হয় এইখানে যে, তিনি সকল প্রকার প্রভুত্বকে ত্যাগের কোন না কোন রূপান্তর বলিয়া জ্ঞান করিতেন। তাহার জীবনের শেষপ্রান্তে আমি একদিন বলি যে, তাহার মুখ হইতে আমি শুধু ত্যাগ’ শব্দই শুনিয়াছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমার মনে হয় ‘জয় কর কথাটিই তাহার প্রকৃতির অধিকতর অনুগামী ছিল। কারণ, দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি স্টিফেনসনেব উল্লেখ করিয়া বলেন, ত্যাগের দ্বারাই তিনি বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারে সমর্থ হন—অর্থাৎ তাহার ঐ আবিষ্কারের পিছনে ছিল বহুদিনব্যাপি ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্জনে কঠিন সমস্যার সমাধানে তন্ময় হইয়া থাকা এবং সর্বপ্রকার দেহসুখ পরিহারপূর্বক ক্লেশ বরণ করিয়া লওয়া। তিনি দেখাইয়া দেন যে,প্রার্থনা বা চিন্তা দ্বারা রোগ আরাম করিবার জন্য চিত্তের যতটা একাগ্রতার প্রয়োজন, আরোগ্য-সম্পাদনের জন্য ভেষজ-বিজ্ঞানও মানবমনের ততটা একাগ্রতারই পরিচয় দেয়। তিনি আমাদের প্রাণে প্রাণে অনুভব করাইয়া দেন যে, অধ্যয়ন মাত্রেই বিশেষ কোন জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত তপস্যা। সর্বোপরি, তিনি প্রচার করেন যে, ধর্মর্ভাবের বন্যাকে স্থায়ী করিবার শক্তি একমাত্র চরিত্রেই বর্তমান। তাহার মতে অন্যায়ের প্রতিরোধ করা গৃহীর ধর্ম, আর সাধুর ধর্ম হইল অপ্রতিকার। কারণ সকলের পক্ষেই সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হইল শক্তিলাভ। তিনি বলেন, “যখন তুমি অসংখ্য দেবসেনাকেও সহজে জয়লাভ করতে পারবে, তখনই ক্ষমা করো।” কিন্তু জয় সম্বন্ধে যতক্ষণ সন্দেহ আছে, ততক্ষণ তাহার মতে কেবল কাপুরুষ ব্যক্তিই একগালে চড় খাইয়া অপর গাল ফিরাইয়া দিবে।

তাঁহার গুরুদেব একটি বালকের সম্বন্ধে যে গল্প বলিতেন, তাহার মধ্যেও ঐ উপদেশ পাওয়া যায়। বালকটি জলের উপর দিয়া হাঁটিয়া যাইবার জন্য কুড়ি বৎসর ধরিয়া পরিশ্রম করে। এক সাধু তাহাকে বলেন, “বাঃ, মাঝিকে এক পয়সা দিয়ে লোকে যা করে, তুমি সেই কাজ করবার জন্য কুড়ি বছর পরিশ্রম করলে?” বালকটি উত্তরে বলিতে পারিত, কুড়ি বছর সহিষ্ণুতার সহিত পরিশ্রমের ফলে সে চরিত্রে যে-সব সদগুণ লাভ করিয়াছে, কোন মাঝি তাহার আরোহিগণকে তাহা দিতে পারিবে না। কিন্তু একথা সত্য যে, পরম বিবেচক এই ধরনের আচার্যগণের নিকট জাগতিক নৌবিদ্যারও যথোচিত পূর্ণ মূল্য ও উপযুক্ত স্থান আছে। বহু বৎসর পরে প্যারিসে এক ব্যক্তি এই সকল বিষয়ে ভারতীয় চিন্তাধারার ক্রমবিকাশের সাধারণ ইতিহাস সম্পর্কে এক প্রশ্ন লইয়া তাহার নিকট আসেন। প্রশ্নটি এই–”সনাতন হিন্দুধর্ম এককে সৎ (real) ও বহুকে অসৎ (unreal) বলেছেন, আবার বুদ্ধ কি বহুকেই সৎ ও (তদধিষ্ঠান) অহংকে (ego) অসৎ বলেননি?” স্বামীজী উত্তর দেন, “হাঁ, আর শ্রীরামকৃষ্ণ ও আমি কেবল এইটুকু তার সঙ্গে যোগ করেছি যে, বহু ও এক উভয়ে একই মনের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধ সেই একই সত্য।”

অধ্যাত্ম বিষয়ে জ্বলন্ত ভাষায় বলিবার অসাধারণ ক্ষমতা হেতু এবং অদ্ভুত গভীর ও গাম্ভীর্যময় এক প্রাচীন সাহিত্য হইতে উপকরণ সংগ্রহ করিতেন বলিয়া তিনি আমাদের নিকট সর্বোপরি আধ্যাত্মিক জীবনের প্রচারকরূপে, বহিজীবন অন্তৰ্জীবন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত—এই মতবাদ প্রচারের ঋষিরূপে প্রতিভাত হইতেন। একবার তিনি জনৈক শিষ্যকে বলেন, “মনে রেখো, ‘আত্মা’ প্রকৃতির জন্য নয়, প্রকৃতিই আত্মার জন্য—ভারত সর্বদা এই বাণী ঘোষণা করছে।” বস্তুতঃ ইহাই যেন ছিল মূল সুর, সুগম্ভীর ধ্বনি—তিনি যে সকল যুক্তিপূর্ণ উপভোগ্য বিষয়সমূহ আলোচনা করিতেন, বা যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করিতেন, তাহার মধ্য দিয়া ক্ৰমশঃ ইহাই শ্রুতিগোচর হইত। দীর্ঘকাল ধরিয়া যিনি তাহার বক্তৃতা শ্রবণ করিয়াছেন, হয়তো তাহার নিকট পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য আধ্যাত্মিক জীবনের প্রভেদ এইরূপ বোধ হইবে—একটি বাশীব সুরের মতো—অতি প্রত্যুষে বহুদূরে কোন নদীতীর হইতে ভাসিয়া আসিতেছে, অতি সুমিষ্ট, কিন্তু উহা জাগতিক অন্যান্য সুমধুর সঙ্গীতের অন্যতম। আর একটি, সেই সুরলহরীই, কিন্তু শ্রোতা ক্রমশঃ তাহার সমীপবর্তী হইয়া অবশেষে এতদূর তন্ময় হইয়া যান যে, তাহার সমগ্র সত্তা সেই সুরে বিলীন হইয়া যায়—শ্রোতা পরিণত হন গায়কে। আর সঙ্গে সঙ্গে জ্বলন্তভাবে প্রকাশ পায় ত্যাগের মাহাত্ম। এমন নহে যে, ত্যাগ শব্দটি তাহার উপদেশসমূহে পূর্বাপেক্ষা অধিকবার প্রযুক্ত হয়; কিন্তু সেই মুক্ত, অপরিসীম, অপ্রতিহত জীবনের সত্যতা প্রত্যক্ষভাবে অনুভূত হয়। মৌনব্রত অবলম্বন করিয়া কপর্দকহীন সন্ন্যাসীর জীবনযাপনের জন্য সংসার ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবার এবং অসহ্য বোধ হইলেও আত্মনিবেদনরূপ শৃঙ্খলে নিজেকে আবদ্ধ করিয়া রাখিবার প্রলোভনের সহিত সংগ্রাম করিতে হয়।

অবশেষে এমন সময় উপস্থিত হইল, যখন এই আহ্বান অতি গম্ভীর নির্ঘোষে উচ্চারিত হইল। একদিন প্রশ্নোত্তর-ক্লাসে কথায় কথায় কিছু বাদানুবাদ ঘটে। সহসা স্বামীজী, যাহাকে ‘তিনি বোমা ছুড়িয়া লোককে চমৎকৃত করা বলিতেন’ সেইরূপ এক সঙ্কল্পের বশবর্তী হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “জগতে আজ কিসের অভাব জানো? জগৎ চায় এমন বিশজন নরনারী, যারা সদর্পে পথে দাঁড়িয়ে বলতে পারে, ‘ঈশ্বরই আমাদের একমাত্র সম্বল।’ কে কে যেতে প্রস্তুত?” বলিতে বলিতে তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং শ্রোতৃবর্গের দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন, যেন কাহাকে কাহাকেও তিনি ইঙ্গিত করিতেছেন তাহার সহিত যোগদান করিতে। কিসের ভয়? তার পর বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে দৃঢ়প্রত্যয়ের সহিত তিনি যে কথাগুলি বলিলেন, তাহা এখনও আমার কানে বাজিতেছে, “যদি ঈশ্বর আছেন একথা সত্য হয়, তবে জগতে আর কিসের প্রয়োজন? আর যদি একথা সত্য না হয়, তবে আমাদের জীবনেই বা ফল কি?”

তাহার ক্লাসের এক সদস্যকে তিনি এই সময় এক পত্রে লেখেন, “জগৎ চায় চরিত্র। জগতে আজ সেইরূপ মানুষেরই প্রয়োজন, যাদের জীবন জ্বলন্ত প্রেমস্বরূপ, যারা সম্পূর্ণ স্বার্থশূন্য। সেই প্রেম প্রত্যেক বাক্যকে বজ্রের ন্যায় শক্তিশালী করে তুলবে। জাগো, জাগো, মহাপ্রাণ, জগৎ যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে, তোমার কি নিদ্রা সাজে?”

আমার মনে আছে, চরিত্রই সত্যকে সজীব করিয়া তোলে, সর্বপ্রকার সাহায্যের সফলতা নির্ভর করে প্রেমের উপর, কোন বাক্যের পিছনে চিত্তের যতটা একাগ্রতা থাকে, তাহাই বাক্যটিকে শক্তিপ্রদান করে—ভারতীয় এই ধারণা সেই সময় আমার নিকট কিরূপ নূতন বোধ হইয়াছিল। স্বামীজী বলিয়াছিলেন, “এইজন্য বাইবেলের এই উক্তি ‘কুমুদফুলগুলির কথা ভাবিয়া দেখ, তাহারা কেমন স্বতই বিকাশপ্রাপ্ত হয়’ কেবল উহার সৌন্দর্যের জন্য নহে, পরন্তু উহাতে যে গভীর ত্যাগের ভাব প্রকাশ পাইতেছে, সেজন্যই আমাদিগকে মুগ্ধ করে।”

ইহা কি সত্য? আমার মনে হইল, পরীক্ষা দ্বারা প্রশ্নটির সত্যাসত্য নির্ণয় করা যাইতে পারে; এবং কিছুকাল পরে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম যে, উহা সত্যই। যাহার ভাষার অন্তরালে চিন্তাশক্তি বিদ্যমান, এমন ব্যক্তির একটি মাত্র মৃদু বাক্যের দ্বারা তৎক্ষণাৎ কাজ হইয়া যায়, কিন্তু যিনি চিন্তার ধার ধারেন না, এমন ব্যক্তির মুখে ঐ কথাটিই উচ্চারিত হইলে কেহ তাহাতে কর্ণপাতও করে না। এই সম্পর্কে খলিফা আলির একটি উক্তি অপেক্ষা প্রকৃষ্টতর কোন উদাহরণ আছে বলিয়া আমার জানা নাই। “সংসারে তুমি যে পদ লাভ করিবে, তাহা তোমাকে অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতেছে, অতএব, তুমি উহার অন্বেষণ না করিয়া নিশ্চিন্ত মনে অবস্থান কর”—অনেকেই ইসলামধর্মের এই পুরুষসিংহের এই কথাগুলি শ্রবণ করিয়া মুগ্ধ হইয়া পারেন না। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত আমরা কথাগুলিকে বক্তার জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করিয়া না দেখি—যাহাকে চার বার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত খলিফার পদ হইতে বঞ্চিত করিয়া অপরকে ঐ পদে অভিষিক্ত করা হইয়াছিল—যতদিন পর্যন্ত আমরা জানিতে না পারি যে, কিরূপে এই ব্যক্তির সমগ্র জীবনের স্পন্দন ঐ কথা কয়টির মধ্যে অনুভূত হইতেছে, ততদিন আমরা ঐ সামান্য বাক্যটির মধ্যে যে অসাধারণ শক্তি নিহিত রহিয়াছে, তাহার কোন অর্থ খুঁজিয়া পাই না।

আমি আরও দেখিলাম, যে উক্তি শুধু শ্রোতার শ্রবণগোচর না করাইয়া যত্নপূর্বক তাহার মনের মধ্যে গাথিয়া দেওয়া হয়, তাহাতে অধিকতর সাড়া পাওয়া যায়। আর এই সকল মনস্তত্ত্ববিষয়ক আবিষ্কার করিতে আরম্ভ করিয়া ক্রমশঃ বুঝিতে পারিলাম, যদিও একথা বহুপূর্বেই সিদ্ধান্ত হইয়া গিয়াছে যে, বিচারের দ্বারা চৈতন্য ও জড়ের মধ্যে রেখা টানিয়া সম্পূর্ণরূপে পৃথক করিয়া ফেলা অসম্ভব, তথাপি ইহাই যুক্তিযুক্ত বোধ হয়, এই দুইটির মধ্যে অদ্বিতীয় সত্তার যে-দিকটা আমরা জড় বলি, তাহা চৈতন্য বলিয়া যাহাকে অভিহিত করি তাহারই পরিণামস্বরূপ, কিন্তু কোনক্রমেই উহার বিপরীত নহে। ইচ্ছাশক্তি নয়, পরন্তু শরীরকেই জীবত্বের একটি গৌণ ফল মাত্র বলিয়া বিবেচনা করিতে হইবে। ইহা হইতে দেহাতিরিক্ত উচ্চতর এক চৈতন্যের ধারণা আসিল—যাহা জড়ের অধীন না হইয়া বরং জড়কে পরিচালিত করে; সুতরাং শরীর যেমন জীর্ণ ত্বক পরিত্যাগ করে, সেইরূপ উহা জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নূতন বস্তুও গ্রহণ করিতে পারে, অর্থাৎ এই পরিচিত শরীরকেই পরিত্যাগ করিতে পারে। অবশেষে আমি দেখিতে পাইলাম, আমার নিজের মনই “শরীর আসে ও যায়”—স্বামীজীর অমরত্বজ্ঞাপক এই মহান উক্তির প্রতিধ্বনি করিতেছে। কিন্তু চিন্তার এই পরিণতি ধীরে ধীরে সংসাধিত হইয়াছিল, এবং পূর্ণতালাভ করিতে অনেক মাস লাগিয়াছিল।

ইতোমধ্যে যখন আমি পশ্চাতে ফিরিয়া এই সময়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তখন অনুভব করি যে, স্বামীজীর ক্লাসগুলিতে আমরা যে জ্ঞানলাভ করিয়াছিলাম তাহা প্রকৃতপক্ষে তর্কযুক্তিমূলক ব্যাখ্যা নয় বরং বলা যায়, নূতন ও উচ্চভাবময় এক জীবন লাভ, অথবা ভারতে যাহাকে দর্শন বা প্রত্যক্ষানুভূতি বলিয়া অভিহিত করা হয়, তাহাই।

ভগবানকে গোপালভাবে উপাসনা করার বর্ণনাপ্রসঙ্গে আমরা স্বামীজীর বিস্ময়কর উক্তি শ্রবণ করিলাম, “তাহার নিকট আমরা কিছু চাই না কি?” “প্রেম চিরকালই আনন্দের বিকাশমাত্র”, সুতরাং কোনপ্রকার যন্ত্রণা বা অনুশোচনা, স্বার্থপরতা ও দেহসুখসর্বস্বতারই নিদর্শন মাত্র—এই উপদেশ আমরা মাথা পাতিয়া গ্রহণ করিলাম। আমাদের ও অপরের মধ্যে বিন্দুমাত্র ভেদদৃষ্টি ‘ঘৃণা’ পদবাচ্য এবং উহার বিপরীতই প্রেম—এই কঠোর নির্দেশ আমরা স্বীকার করিয়া লইলাম। শৈশবের ধর্মমতে যাহারা বিশ্বাস হারাইয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকে এইরূপ অনুভব করিতেন যে, অন্ততঃ পরোপকার একটি শ্রেষ্ঠ আদর্শ এবং জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য জীবসেবার সম্ভাবনাটা থাকিয়াই যায়। পূর্বোক্তমতে বিশ্বাসী হওয়ায়, “ধর্মদানই শ্রেষ্ঠ, বিদ্যাদান একধাপ নিম্নস্তরের, আর যে কোন প্রকারের দৈহিক বা জাগতিক দান সর্বাপেক্ষা নিম্নস্থানীয়”—এই প্রাচ্যদেশীয় উপদেশটি শুনিয়া আমরা যে বিস্মিত হইয়াছিলাম, আজ দশ বৎসর পরে তাহা স্মরণ করিয়া আমার নিকট কৌতুককর বোধ হইতেছে। ব্যাধি ও দারিদ্র্যপীড়িতের প্রতি আমাদের যে উদ্বেলিত দয়া—এইভাবে তাহার স্থান নির্দেশ করা! এই তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করিতে আমার বহু বৎসর লাগিয়াছে, কিন্তু এখন আমি জানি যে, উচ্চতর দানের পশ্চাতে নিম্নতর দানটি আপনা হইতেই আসিয়া থাকে। অনুরূপভাবে, বিশুদ্ধ বায়ু আবশ্যক, এবং আশেপাশের বসতিসমূহ যেন স্বাস্থ্যের অনুকূল হয়, এই নীতির প্রতি পাশ্চাত্য দেশে যে অত্যধিক আগ্রহ প্রকাশ—যেন ঐগুলিই সাধুত্বের লক্ষণ—তাহার বিরুদ্ধে আমরা কঠোর শিক্ষা পাইলাম-‘জগতের প্রতি উদাসীন হও।’ বস্তুতঃ আমাদের মনে হইল, এই শিক্ষার রহস্য ভেদ করা সাধ্যাতীত। আপাততঃ অসংলগ্ন বোধ হইবে জানিয়াও স্বামীজী যখন সদর্পে বলিলেন, ঋষিরা দৃশ্য উপভোগ করিবার জন্যই পর্বতশিখরে বাস করিতেন, এবং যখন তিনি শ্রোতৃবর্গকে পূজার ঘরে পুস্পাদি রাখিতে ও ধূপধুনা দিতে বলিলেন, আহার ও শরীর বিষয়ে শুদ্ধি ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে বিশেষ যত্ন লইতে উপদেশ দিলেন, তখন এই ধর্মসম্বন্ধীয় দুই বিপরীত ভাবকে কিরূপে সংযুক্ত করিব, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি আমাদের দেশে প্রচলিত দৈহিক পারিপাট্য নীতিটি ভারতীয় আকারে প্রচার করিতেছিলেন। আর ইহা কি সত্য নহে যে, যতদিন পাশ্চাত্যে আমরা বড় বড় শহরে অবস্থিত বস্তিসমূহ (slums) পরিষ্কার করিতে সমর্থ না হই, ততদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য আমাদের অত্যধিক আগ্রহ বিশেষ সুবিধাভোগী একশ্রেণীর আত্মপূজারই অনুরূপ!

.

যে-সব মহাপুরুষ বিশেষ কুশলতা ও হিসাবী বুদ্ধির সহিত সাংসারিক সকল কাজের সুব্যবস্থা করিতে পারেন, তাহাদের প্রতি আমাদের যে শ্রদ্ধা ছিল তাহারও এইরূপ দুর্গতি ঘটিল। প্রকৃত আধ্যাত্মিক ব্যক্তি জাগতিক বিষয়ের প্রতি কেবল যে উদাসীন, তাহা নহে, ঐগুলির প্রতি ঘৃণা পোষণ করেন এবং কোনক্রমেই উহা সহ্য করিতে পারেন না। এই উপদেশ স্বামীজী কদাপি খর্ব করিতেন না। এই উপদেশ ঘোষণা করিবার সময় তিনি কখনও ইতস্ততঃ করিতেন না। উচ্চতম আধ্যাত্মিকতায় সাংসারিকতার স্থান নাই।

আমরা বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, এগুলি সাধুত্বেরই আদর্শস্বরূপ। আমরা অধ্যায়ের পর অধ্যায় এক মহতী ভাষা শিক্ষা করিতেছিলাম, যাহা দ্বারা জগতের উদ্দেশ্যগুলির সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়া আমাদের পক্ষে সহজ হইবে। যে বিষয়গুলি নাগরিক জীবন ও গৃহস্থালী ধর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট, এবং যাহাদের আত্মোন্নতির হাতেখড়ি (কিণ্ডারগার্টেন) স্বরূপ বলা যাইতে পারে, তাহাদের সম্পর্কে আমাদের কোনরূপ মতিভ্রম উপস্থিত হয় নাই। অপরদেশের গৌরবস্থল শৃঙ্খলা ও দায়িত্বজ্ঞানের আদর্শ সমাদর করিতে শিখিয়াই যে একটি দেশ সর্বাপেক্ষা অধিক উন্নতি করিতে পারে, এ ধারণা তিনি আদৌ অবিশ্বাস করেন নাই। সেই সঙ্গে আবার ভারতীয় আদর্শসমূহের চিরন্তন মূলমন্ত্রস্বরূপ এই কথাগুলিও আমাদের বলা হয়, “আধ্যাত্মিকতা সাংসারিকতা সহ্য করিতে পারে না।” ইহার প্রতিবাদস্বরূপ আমরা সুপরিচালিত, সুসংবদ্ধ জনকল্যাণরত সন্ন্যাসি-সঘগুলির উল্লেখ করিয়াছিলাম এবং প্রাচ্যের জনকয়েক জীর্ণবস্তু-পরিহিত, ঈশ্বরপ্রেমোন্মত্ত ভিক্ষুকের তুলনায় আমাদের বহু বহু মঠাধ্যক্ষ যাজক, মহাসাধিকা মঠাধ্যক্ষগণের উৎকর্ষতা দেখাইয়াছিলাম। তথাপি আমাদের স্বীকার করিতে হইয়াছিল যে, এমনকি পাশ্চাত্যেও যখনই ধর্মবহ্নি সহসা প্রজ্বলিত হইয়া উঠিয়াছে, তখনই উহা প্রাচ্য আকার ধারণ করিয়াছে। কারণ, যাহারা মীরাবাঈ ও চৈতন্য, তুকারাম ও রামানুজের জন্মভূমি ভারতকে জানেন, তাহাদের পক্ষে আসিসির সেন্ট ফ্রান্সিসকেও গৈরিকমণ্ডিত করিয়া দিবার লোভ সংবরণ করা কঠিন হইয়া পড়ে।

বৌদ্ধজাতকগুলির ইংরেজী অনুবাদের কোন একখণ্ডে এই কথাগুলি বার বার উল্লেখ দেখা যায়, “যখন মানব সেইস্থানে উপনীত হয়, যেখানে সে স্বৰ্গকে নরকের মতোই ভয় করে”—স্বামীজীর উপস্থিতি যে আধ্যাত্মিক অনুভূতি আনয়ন করিত, তাহার পরিচয় ইহা অপেক্ষা অধিকতর স্পষ্টভাবে আর কিরূপে দেওয়া যায়, তাহা আমার অজ্ঞাত। যাহারা ১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে তাঁহাকে লণ্ডনে বক্তৃতা করিতে শুনিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে অনেকেই এমন কিছু আভাস পান, যাহা দ্বারা প্রাচ্যবাসিগণ কেন জন্মাল পরিগ্রহ হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিতে চাহেন, তাহার কিছুটা অর্থ বুঝিতে পারিয়াছেন।

কিন্তু এই সকল মানসিক অবস্থার মধ্যে যেটি সর্বাপেক্ষা প্রবল হইয়া অপর অবস্থাগুলিকে পরিচালিত করিত, তাহার আভাসমাত্র ইতঃপূর্বে এই কথাগুলিতে ব্যক্ত হইয়াছে—”যদি ইহাই সত্য হয়, তবে আর কোন্ বস্তুতে প্রয়োজন? আর যদি একথা সত্য না হয়, তবে আমাদের জীবনেই বা ফল কী?” কারণ, তিনি স্বয়ং যে সকল সত্য শিক্ষা দিতে আসিয়াছিলেন, এবং নিজে যে সর্বোচ্চ আশা পোষণ করিতেন, তাহাদের একত্র করিয়া এবং অপরের কল্যাণের নিমিত্ত প্রয়োজন বোধ করিলে ঐগুলিকে হীন উৎকোচস্বরূপ জ্ঞান করিয়া নির্ভীকভাবে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা এই আচার্যের ছিল। বহু বৎসর পরে আমার কোন এক মন্তব্যের উত্তরে তিনি সক্রোধে যাহা বলেন, তাহা দ্বারা এই বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়—”যদি আমি কোন গুরুতর অপরাধ করলে, বাস্তবিক কাহারও উপকার হয়, তবে আমি নিশ্চয় এখনই তা করে অনন্ত নরকভোগ করতে প্রস্তুত!” আবার তিনি আমাদের মধ্যে কয়েক জনকে বহুবার সেই বোধিসত্ত্বের যে কাহিনী বলিতেন—যেন উহা বর্তমান যুগের বিশেষ উপযোগী—তাহাতেও এই আবেগই প্রকাশ পাইত। এই বোধিসত্ত্ব যতদিন জগতের শেষ ধূলিকণাটি পর্যন্ত মুক্তিলাভ না করে, ততদিন পর্যন্ত নিজে নির্বাণ গ্রহণ করিবেন না বলিয়া প্রতিজ্ঞা করেন। ইহার অর্থ কি এই যে, মুক্তিলাভের শেষ লক্ষণ হইল মুক্তি লাভের প্রচেষ্টা হইতে বিরত হওয়া? তখন হইতে ভারতে প্রচলিত বহু কাহিনীর মধ্যে আমি এই বিষয়টি লক্ষ্য করিয়াছি। দৃষ্টান্তস্বরূপ, রামানুজের অঙ্গীকার ভঙ্গ করিয়া পারিয়াদিগের নিকট পবিত্র মন্ত্র উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করা, বুদ্ধের কোন কিছু গোপন না রাখিয়া সমগ্র জীবন কর্মে উৎসর্গ করিয়া দেওয়া, শিশুপালের শীঘ্র শীঘ্র ভগবৎ সকাশে ফিরিয়া যাইবার জন্য ভগবানকে শত্রুভাবে বরণ করিয়া লওয়া; এবং সাধুগণের নিজ নিজ ইষ্টের সহিত দ্বন্দ্ব প্রভৃতি অসংখ্য কাহিনীর উল্লেখ করা যাইতে পারে।

.

কিন্তু সকল সময়েই যে স্বামীজী ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ পরিহার করিয়া চলিতেন, তাহা নহে। একদিন বক্তৃতান্তে তিনি আমাদের একটি ছোটখাট দলের নিকট আসিয়া যে প্রসঙ্গের অবতারণা হইয়াছিল তাহারই সম্বন্ধে বলেন, “আমার একটা কুসংস্কার আছে—অবশ্য এটা আমার ব্যক্তিগত কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়—যিনি একসময়ে বুদ্ধরূপে এসেছিলেন, তিনিই পরে খ্রীস্টরূপে এসেছেন।” অতঃপর ঐ বিষয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে ক্রমশঃ তাহার গুরুদেবের কথা আসিয়া পড়িল। এই প্রথম আমরা তাহার এবং বিবাহের পর স্বামী কর্তৃক বিস্মৃত হইয়াও যিনি সজলনয়নে তাহাকে নিজ অভীষ্ট পথে চলিবার স্বাধীনতা দিয়াছিলেন, সেই বালিকার কথা শুনিতে পাইলাম। কথা কহিতে কহিতে ক্রমশঃ তাহার কণ্ঠস্বর মৃদুতর হইয়া অবশেষে স্বপ্নবিষ্টের মতো হইয়া উঠিল। কিন্তু শেষে যেন স্বগতোক্তির মতো দীর্ঘনিঃশ্বাস সহকারে এই কথা বলিয়া তিনি উক্ত আবেশ হইতে নিজেকে জোর করিয়া মুক্ত করিলেন—”সত্যই, এসব ঘটনা ঘটে গেছে, এবং আবার ঘটবে। যাও বৎসে, শান্তিপূর্ণ হৃদয়ে যাও, তোমার বিশ্বাসই তোমাকে রোগমুক্ত করেছে।”(১)

আর একদিন কথা প্রসঙ্গে ইহা অপেক্ষা সামান্য এক ঘটনা উপলক্ষে তিনি আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “স্বদেশের নারীগণের কল্যাণকল্পে আমার কতকগুলি সঙ্কল্প আছে। আমার মনে হয়, সেগুলিকে কার্যে পরিণত করতে তুমি বিশেষভাবে সাহায্য করতে পার।” আমি বুঝিলাম, আমার নিকট এমন এক আহ্বান আসিয়াছে, যাহা জীবনকে পরিবর্তিত করিয়া দিবে। এই সঙ্কল্পগুলি কী ধরনের তাহা আমি জানিতাম না, এবং ভাবী জীবনের যে চিত্র অঙ্কনে আমি অভ্যস্ত হইয়াছিলাম, তাহা ত্যাগ করা সেই সময়ে এত কষ্টকর বোধ হইয়াছিল যে, ঐ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিতেও চাহি নাই। কিন্তু ইতঃপূর্বেই আমি অনুমান করিয়াছিলাম, জগৎ সম্বন্ধে আমার যে ধারণা, অন্যান্য জাতির দৃষ্টিভঙ্গির সহিত তাহার সামঞ্জস্য করিয়া লইতে গেলে আমাকে অনেক জিনিস শিখিতে হইবে। একবার আমি লণ্ডন নগরীকে সৌন্দর্যশালিনী করার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বলিয়াছিলাম। স্বামীজী তীব্ৰস্বরে উত্তর দেন, “আর তোমরা অন্য শহরগুলিকে শ্মশান করে তুলেছ।” আমার নিকট লণ্ডন নগরীর রহস্যময়তা ও দুঃখপূর্ণতা বহুদিন হইতে সমগ্র মানবজাতির সমস্যা বলিয়াই বোধ হইত—সমগ্র জগৎ যাহা চাহিতেছে তাহারই একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। “আর তোমরা তোমাদের এই নগরীকে সৌন্দর্যশালিনী করবার জন্য অন্য নগরগুলিকে শ্মশানপুরী করে তুলেছ।” তিনি আর বেশি কিছু বলিলেন না, কিন্তু কথাগুলি বহুদিন ধরিয়া আমার কানে বাজিতে লাগিল। আমার চক্ষে আমাদের নগরী সৌন্দর্যশালিনী ছিল না। আমার প্রশ্নটি স্বামীজী ভুল বুঝিয়াছিলেন। কিন্তু এই ভুল বোঝা হইতেই আমি দেখিতে পাইলাম, ইহাকে অপর দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা দেখা যায়। স্বামীজী একদিন আমাকে বলেন, “ইংরেজরা দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছে, আর সর্বদা তাদের চেষ্টা দ্বীপেরই মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা।” আমার সম্পর্কে এই মন্তব্য যথার্থই সত্য ছিল। পিছনে ফিরিয়া আমার জীবনের ঐ অংশের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বুঝিতে পারি, আমার আদর্শগুলি তখন পর্যন্ত কতদূর সঙ্কীর্ণ ছিল। ইংলণ্ড অবস্থানকালে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমি আর বেশি কিছু জানিতে পারি নাই। যে মহিলা বন্ধু আমায় পরে ভারতে তাহার সহকর্মিণী হইবার জন্য আহ্বান করেন, এক সন্ধ্যাকালে স্বামীজী ও আমি ঘণ্টাখানেকের জন্য লণ্ডনে তাহার গৃহে অতিথি হইলে, আমি স্বামীজীকে জানাই যে, তাহার কার্যে যোগদান করিতে আমার আগ্রহ আছে। স্পষ্টতই তিনি ইহা শুনিয়া বিস্মিত হন, কিন্তু শান্তভাবে বলেন, “আমার কথা বলতে গেলে, আমি স্বদেশবাসীর উন্নতিকল্পে যে কাজে হস্তক্ষেপ করেছি, তা সম্পন্ন করবার জন্য মোন হলে দু শবার জন্মগ্রহণ করব।” এই কথাগুলি এবং অপর কয়েকটি কথা, যাহা তিনি আমার যাত্রার প্রারম্ভে লিখিয়াছিলেন, আমার মানসপটে চিরবিরাজমান রহিয়াছে, “তুমি ভারতের জন্য কাজ কর আর নাই কর, বেদান্তধর্ম ত্যাগই কর আর ধরিয়াই থাক, আমি আমরণ তোমাকে সাহায্য করিব। ‘মরদকী বাত, হাথীকা দাঁত।’ হাতির দাঁত একবার বাহির হইলে আর ভিতরে যায় না। পুরুষের কথাও সেইরূপ।”

কিন্তু স্বামীজীর আপনজন সম্পর্কে এই উল্লেখগুলি ছিল নিতান্ত ব্যক্তিগত এবং সেজন্য উহারা তাঁহার নিকট সম্পূর্ণ গৌণস্থান অধিকার করিত। তাঁহার ক্লাসগুলিতে এবং উপদেশসমূহে মানুষকে অজ্ঞানের হস্ত হইতে রক্ষা করাই তাঁহার একমাত্র আকাঙক্ষা বলিয়া বোধ হইত। যাহারা তাহার কথা বা বক্তৃতাদি শ্রবণ করিয়াছেন, তাহারা এরূপ প্রেম, এরূপ অনুকম্পা আর কোথাও দেখেন নাই। তাহার নিকট সকল শিষ্যই শিষ্যমাত্র; সেখানে ভারতীয় অথবা ইউরোপীয় বলিয়া কোন ভেদ ছিল না। আবার তিনি নিজের প্রচারকার্যের ঐতিহাসিক অর্থ বা গুরুত্ব সম্পর্কে বিলক্ষণ সচেতন ছিলেন। লণ্ডনে তাহার শেষ বক্তৃতায় (১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর, রবিবার, অপরাহ্নে ‘রয়েল সোসাইটি অব পেন্টার্স ইন ওযাটার কলার্স নামক চিত্রশিল্পি-সঙ্ঘ-মন্দিরে)তিনি দেখাইয়া দেন যে, ইতিহাসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইয়া থাকে, এবং রোমরাজ্যে শান্তি বিরাজ করার ফলেই খ্রীস্টধর্ম সংস্থাপন সম্ভবপর হইয়াছিল। দূরদৃষ্টির ফলে তাহার হির ধারণা ছিল, তিনি যে বীজ বপন করিয়া গেলেন, ভবিষ্যতে বিরাট একদল ভারতীয় প্রচারক পাশ্চাত্যে আগমন করিয়া তাহার ফল উপভোগ করিবেন, এবং তাহারাও আবার ভাবী উত্তরাধিকারীর জন্য নূতন নূতন বীজ বপন করিয়া যাইবেন। সম্ভবতঃ, তাহার চালচলনে বুদ্ধের ন্যায় যে প্রশান্ত-গম্ভীর ভাব আমাদের এত মুগ্ধ করিয়াছিল, উহা তাহার ঐ দূরদৃষ্টি ও স্থির ধারণারই বহিঃপ্রকাশমাত্র।

—————
১ বাইবেল-সেন্ট ম্যাথু, ৯ম অধ্যায়।-অনুঃ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *