পুষ্পবতী

পুষ্পবতী

সে চুপচাপ বসে থাকে। তার কিছু ভালো লাগে না।

চৈত্র মাস। জল নেই। সেই কবে শীতে বৃষ্টিপাত, তারপর আর মেঘের দেখা নেই। আকাশ তামার বাসনের মতো চকচকে হয়ে আছে। দিন যায়, মাস যায়, আকাশ আর ঘোলা হয়ে উঠে না। মাঠ খা খা করছে, কিছু শকুন উড়ছিল। দূরে সব বাঁশের জঙ্গল, নিশীথে কোথাও থেকে বিশ্রী শব্দ ওঠে। কে যেন হেঁকে যায়, তোমার সব যাবে হে বিপ্রদাস, তুমি অবেলাতেই রওনা হয়ে যাও, আশায় আশায় আর বসে থেকো না।

আসলে তার কী মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে!

দু-দিকের সব মাঠ ফেলে পাকা রাস্তাটা চলে গেছে কতদূর। বাস যায়, সাইকেল যায়, আর বাঁশ বোঝাই হয়ে যায় গোরুর গাড়ি। মানুষজন মানে ওঠে। রাস্তায় পাশে কোথাও টালির কারখানা আবার দূরে গেলে মাছের ভেড়ি আরও দুরে গেলে ইটের ভাটা। ভাটাগুলির পাশ দিয়ে পাকা রাস্তায় মেলা ডালপালা বের হয়ে গেছে। কোনওটা হাসনাবাদ যায়, কোনওটা বারাসতের দিকে—আবার বসিরহাটের রাস্তাও তার চেনা। কিংবা সাইকেলে কিছুটা গেলেই হাসনাবাদ যাবার রেলে উঠে পড়া যায়।

এইসব রাস্তায় বিপ্রদাসকে যাওয়া-আসা করতেই হয়। বাধা মাইনের কাজ নেই। রাস্তার মোড়ে দোকান নেই। চা কিংবা মুদিখানার যে কোনও দোকান থাকলেও সে বসে বসে তার রুজি রোজগারের ধান্দা বের করতে পারত। আসলে একটা ছ্যাঁচড়া জীবন তার। সে ঠেক খেটে খায়। কখনও মাছের ভেড়িতে কখনও বাঁশের জঙ্গলে, অথবা ইটের গাড়িতে উঠে তেঘরিয়া, বাগুইহাটি, জ্যাংড়া। এমনকি মহিষবাথানের দিকেও সে যায়। চুন সুরকি বালি সুযোগ পেলেই ফেলে দিয়ে আসে। আর আছে তার কাঠা দুইয়ের মতো জমি সম্বল। সেচ পেলে ধান হয়, সবজি হয়, ফুল হয়, না পেলে উরাট থাকে।

পুষ্পবতী বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই মানুষটা কোন সকালে বের হয়েছে, ফেরার নাম নেই।

ঘুরে আসছি বলে বের হল।

কিন্তু ফিরছে না।

সকাল গেল। দুপুর গেল ফিরে এল না! কোথায় গেল মানুষটা! বলেও গেল না, তবে এমন যে হয় না, কতবারই দেখেছে, অনেক রাত হয়ে গেছে ফিরতে। তবে কেউ না কেউ খবর দিয়ে গেছে, কাকা হাসনাবাদের রেলে উঠে গেল, খবরটা দিতে বলল। চিন্তা করবে না কাকি। রাত হবে ফিরতে। কেউ না কেউ দেরি হলে খবর দিয়ে যায়।

বিকেল হয়ে গেল, ফিরছে না। কেউ কোনও খবরও দিয়ে যায়নি।

কত কাজ, অনুর স্কুল থেকে ফেরারও সময় হয়ে গেছে। বাসে যায়, বাসে ফেরে। সারাদিন একা একা, দুপুরে খেতে বসে কিছুটা খেয়ে জল ঢেলে দিয়েছে পাতে। কলতলায় বাসন পড়ে আছে—সামনে যতটুকু চোখ যায় উরাট মাঠ। মাঠে ফুলের চাষ হয়। সেচের জল পাওয়া যায়নি, গাছগুলো বড়ো হয়েছে, তবে ফুল ফোটেনি—চাষি মানুষদের সম্বল এই জমি, জমির চাষ থাকলে চাষি মানুষ কখনও একা হয়ে যায় না।

সেই চাষই নেই।

জমিও থাকবে না, কারণ সরকার সেই কবে নোটিস দিয়েছে।

সেই লোকটা কী যেন নাম, তাকে দেখলেই মানুষটা তার খেপে যায়। লোকটাকে দেখলে মানুষটা তার কেবল থুতু ফেলে।

থু থু। লোকটা নেমকহারাম, পঞ্চায়েতের বাবু, প্রভাবশালী মানুষ, কখনও একা হাঁটে না। দু-চারজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হাঁটে। পাজামা-পাঞ্জাবি গায়ে, ভোটের বাবুও হয়ে যায় মাঝে মাঝে। এবং এলাকার ঘরবাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই যেমন কিছু ঝোপজঙ্গল— একটা টালির বাড়ি। এই যেমন কিছু বাঁশ ঝাড় পার হয়ে দুটো কাছারি ঘর। মুরগির ওড়াউড়িও আছে— দাওয়ায় বসে থাকে কোনও অথর্ব মানুষ। লাঠি ভর দিয়ে, হাঁটে কখনও। হালের বলদ গোয়ালে বাঁধা, জোয়াল তোলা যায়নি। চাব না থাকলে হালের বলদেরও কাম থাকে না–অথবা মানুষটি পাকা রাস্তায় লাঠি ভর করে চলে যায়। তারপর জমিতে নেমে যায়, থাবড়া মেরে ধুলো ওড়ায় জমির। এটা যে খেপামি পুষ্পবতী ভালোই জানে। কারণ, এভাবে জঙ্গলে কিংবা ফলের বাগান পার হয়ে যত ঘরবাড়ি সবারই ত্রাস জমি যাবে, জমি থাকবে না। সরকার নোটিস ঝুলিয়ে যাচ্ছে। পুষ্পবতী অবশ্য চুপচাপ থাকে, কারণ সে দেখেছে, মানুষটা কোনও কথা বললেই বিরক্ত হয়।

কিন্তু কথা ত বাতাসে ভাসে।

এই যেমন ভাদু বলে গেল, তুমি কি গ কাকি তুমি জান না-রেজিস্ট্রি বন্ধ, জমি হাত ফেরতা করতে দেবে না। সরকার যে এখানে একটা পেল্লাই শহর বানাবে। তুমি কিছু জান না।

বিপ্রদাস একদিন বাড়ি থেকেই বের হল না। অবেলায় ঘাটে শুয়েছিল। ভাদু। উঠোনে দাঁড়িয়ে যেন সতর্ক করে দিয়ে গেল কাকিকে—সময় ভালো না, গবরমেন্টের শহর— সব মানুষ উৎখাত হবে। গেরাপি হবে এখানটায়। একশো কুড়ি ফুট রাস্তা যাবে। ঘরবাড়ি ইমারত দেখবে বাহার ধানের জমি ফুলের জমি বেহাত হয়ে যাবে। চাষি মানুষেরা হায় হায় করবে কপাল থাবড়াবে, তবু গরিবের সরকার গেঁরাপি করবেই। রক্ষা নাই।

সরকার বড়োই ধুরন্ধর। ভাদু তার গামছাখানা মাথার উপর ঘোরাচ্ছে। যেন মশামাছি তাড়াচ্ছে, কিংবা রাতে যখন সব নিশুতি হয়ে থাকে, তখনও সে মাঠের উপর দিয়ে নানা কথা বলতে বলতে, কখনও ঘুমেঙ্গি, নাচেঙ্গি, গায়েজি— যেন এই সব শব্দমালার মধ্যে সে বড়োরকমের সুখ পেয়ে যায়। তার মাথায় থাকে হাড় মুড়মুড়ির টিন, পিঠে ঝুলে থাকে একটা কুপির শিসওঠা আলো। পায়ে তার ঘুংগরো। সে পা হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে হাঁটে ঘুংগরোতে শব্দ হয় ঘুমেঙ্গি ফিরেঙ্গি, গায়েঙ্গি।

সেই খবর দেয় সব। কাগজের খবরও দেয়। বিপ্রদাস সব জেনেও চুপচাপ থাকে। পুষ্পবতী কিছু বললে পাত্তাই দেয় না।

তবু যখন পারে না, অনু পড়ছে দুলে দুলে, বারান্দায় মাদুর পেতে দুলে দুলে পড়ছে। ওর চুল ওড়ে, বাতাসে ফ্রক ওড়ে–ভাদুদা এক প্যাকেট হাড়মুড়মুড়ি বারোভাজা দিয়ে গেছে বড়ো তাজা এবং সুস্বাদু খেতে, খড় খড় করে খাচ্ছে তার মাধ্যমিকের অঙ্কের বইটা কোলে, সে খাতা পেনসিল নিয়ে বসে থাকলে পুষ্পবতী স্বপ্ন দেখতেই পারে।

হ্যাঁগা, ভাদু কী সব বলে গেল শুনছ।

বিপ্রদাস খাট থেকে লাফিয়ে উঠল, কী ভ্যাজর ভ্যাজর করছ।

আরে শুনলে না, কথাটা কী ঠিক?

 রাখো ত, গরমেন্টের বাপের জমি, ও কত উড়ো কথা ভাসে।

 উড়ো কথা বলছ। কাগজে বড়ো বড়ো খবর বের হয়েছে।

ও বের হয়। আবার উবেও যায়। ধাদধারা গোবিন্দপুর— এখানটায় হবে গেঁরাপিঁ।

সরকারের খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই।

গেঁরাপিঁ কী বস্তু জান তুমি?

বিপ্রদাস লুঙ্গি কোমরে খিচে বারান্দায় বের হয়ে এসেছিল— তারপর জলচোকিতে বসে বলেছিল, চা হবে একটু।

চিনি আনতে হবে।

এই অনু, দ্যাখ না বদনের দোকানে, দুধ চিনি খাতায় লিখে নিয়ে আয়। মুখ। করতে পারে, বলবি শেখরপুরের

তার আগেই ঝামটা।

আমি পারব না।

 তোরা কিছুই পারিস না। দুশো গ্রাম চিনিও ধারে আনতে পারিস না। তারপর পুষ্পবতীর দিকে তাকিয়েছিল—সরু কোমর, পিঠের ভাঁজ থেকে নিতম্বের কাছাকাছি চলে গেছে শরীরের কানামাছি। আরও নীচে হাত দিলে ভয়ংকর করাল গ্রাস–এই গ্রাসই তাকে এতকাল যে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সে তাও বোঝে। জমি, মেয়েমানুষ ছাড়া হয় না। সংসারে তার কথার দাম নেই।

তারপরই ভাবল, অনু তুই বড়ো হয়েছিস, সংসারের অভাব অনটন বুঝবি না! ভাদু আসে যায়, ব্যাটা ইজারা নিয়েছে, বাস্তুজমি, চাষের জমি সব যাবে। চারপাশে কোপের রাজত্ব। সরকারের কোপ আরও প্রখর। গায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়, তার উপর পুস্পবতীর গেরাপি। গেরাপি কী বস্তু তার ব্যাখ্যা না পেলে সে যেন অনশনে বসে যাবে।

আসলে শেখরপুরের কাজটার কথা সে বলতে চেয়েছিল— ধান্দায় ঘুরে বেড়ায়, যখন সে কাজ, দু-হাজার ইট ফেলে দাও বিপ্রদাস, বিপ্রদাস ইটের ভাটায় গিয়ে বলবে–দু-হাজার ইট ফেলে দাও, সে শুধু অর্ডার দিয়েই খালাস ভাটার কারবারি কমিশনে পঞ্চাশ একশো ধরিয়ে দেয়, এটাই তার পারিশ্রমিক। এই যেমন সে প্লাম্বারের ঠিকে মিস্ত্রিরও কাজ করে। শেখরপুরের মোহনবাবুর কাজটা সে পেতে পারে সে ঘুরেও এসেছে। জল উঠছে না।

হাতুড়িতে সে পাইপে ঘা মারে, এটা খোলে, ওটা খোলে, তারপর নিদান দেয় পাম্প খারাপ, নতুন পাম্প লাগাতে হয়। আসলে সব কাজেই সে হাফ মিস্ত্রি।

আসলে পাম্প গস্ত করার মতলবে। মোহনবাবু নতুন পাম্প কিনলে পুরোনো পাম্প বাতিল, তা বিপ্রদাস, ফেলে রেখে কী হবে, তুমি নিয়ে যাও। দামদর করে বিক্রি করে দাও। আমি আবার লোক কোথায় খুঁজব। কাজটা করতে পারলে চার-পাঁচশো টাকাও হয়ে যেতে পারে। টাকা ত আর ওড়ে না, খুটে খুটে তুলতে হয়। পাম্পের টাকা গস্ত করতে পারলে বদনের দেনা একদিনে শোধ। এরা কী সে বোঝে। সোজা কথার গেরাপি হল গে ঘুঘু চরবে উঠোনে।

বাস্তু জমি শালি জমি কিছুই বাদ যাবে না। দৌড়ালে রাস্তার কুকুরে কামড়াবে, গাছের ছায়ায় বসে থাকলে মাথায় হাগবে।

পুস্পবতীকে এমন কঠিন কথা বলে কী করে। সোহাগি মেয়েছেলে বুঝে ফেললে বিলাপ শুরু করে দিতে পারে। তবে কথাখানা যে উড়ে বেড়ায়, দশকান হয়ে এই টালির ঘরটাতেও চাউর হয়ে যায়। অনু বাসে যায় আসে। সেও শোনে সব। সেও পুস্পবতীকে এসে সব যে বলে তাও নয়। তবে বিপ্রদাস নিজে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। তার মাথায় কাগে বসে হেগে যাবে, সে কিছুতেই রাজি না।

তার এক কথা, আমার জমি আমি বুঝব। জমি দখল করতে আসুক না, ঠ্যাং ভেঙে দেব।

সে শুনতে পায়, বিপ্রদাস, সবাই যাচ্ছে, তুমিও চলে যাও। সরকার দোকান খুলে বসে গেছে, দলিল দস্তাবেজ, অর্থাৎ যা আছে তোমার গুপ্তখাতা, যার নজির দেখিয়ে তোমার এই রোয়াবি, না গেলে শেষে পস্তাবে।

সে একবার তেড়েও গিয়েছিল, কী বললে, আবার কথাখান বল, বলে দ্যাখ, মুণ্ড ছিঁড়ে ফেলব। গাছপালা সব আমার ভগমান হয়ে আছে জানো। বাপ-ঠাকুরদা লাগিয়ে গেছে, দিনমান একটা ল্যাংড়া কুকুরের মতো এখানে সেখানে ছুটি, গন্ধ শুঁকে বেড়াই, বাঁশের পাইকার, ইটের ভাটা, ভেড়ির মাছ, সব খবরাবর রাখার কাজ।

বাঁশের জঙ্গলের খোঁজ দিতে পারো বিপ্রদাস?

তা খবর আছে।

কথা বলিয়ে দাও।

কত করে।

দশ হাজার টাকা।

হবে। আমার কী থাকবে?

তোমার কী থাকবে মানে?

তহরি আছে না, খবর দেব, আর বাঁশ বোঝাই গাড়ি যাবে, আমি কী কলা চুষব!

কার বাঁশ, কোন জঙ্গলের বাঁশ, কাঁচা না পাকা ঘুনি, যাত্রাগাছির সব বাঁশ সাফ। আটঘরায় শরিকের এত বড়ো বাঁশের জঙ্গল, সেও শেষ। রাতকানা হয়ে ঘুরছি বিপ্রদাস। পাকা বাঁশের খোঁজ পাচ্ছি না।

পাকা বাঁশের অভাব, কী যে বলেন!

এক পা সাইকেলে, আর এক পা রাস্তায়—

যা হোক করে বাঁশের পাইকার একখানা পাকড়ানো গেছে। পাকা বাঁশের খোঁজে আছে। জমি জলের দরে বিক্রি, যে যা দর পাচ্ছে তাতেই খালি করে দিচ্ছে– বেহাত হয়ে গেলে ছালাও যাবে, আমও যাবে।

সারাদিন তার টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। কোথায় না যায়—যাত্রাগাছি, কদমপুকুরেও যায়, আরও দুরে আছে শুলংগুড়ি। বর্ডার পার হয়ে শুধু চলে আসছে মানুষজন। যাত্রাগাছি শুলংগুড়িতে ঠাঁই নিচ্ছে। প্রথমে বাঁশ পাতা কাঠ যা পাওয়া যায়, তাই দিয়ে ঝুপড়ি বানিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজে। কেউ কলের মিস্ত্রি, কেউ জোগাড়ের কাজ করে পয়সা কামাবার ধান্দা। অবশ্য তারুলিয়া, আটঘরা, বেকজোয়ানিতে অনুপ্রবেশ নেই বললেই হয়। গাঁয়ের মানুষজন তার খুবই চেনাজানা, সে যে বিপ্রদাস, সে যে এলাকার খোঁজখবর কেটু বেশি মাত্রাতেই রাখে তারা ভালোই জানে। শুলংগুড়ি, যাত্রাগাছির ঝুপড়ির পাশ দিয়ে হাঁটলে কেউ তাকে যে চেনে না, সেও কাউকে চেনে না—দেশকালের যখন এই অবস্থা, তখন সে বাঁশের পাইকার হরমোহন সুইকে কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি নয়।

কী বাঁশ চাই? পলতা বাঁশ, না মুলি বাঁশ, পলতা বাঁশের জঙ্গল শেখরপুরের দিকে মেলা, রাস্তার দুপাশে তাকালেই বোঝা, যার, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঘরবাড়ি, পাকা ইমারত থেকে বাবুদের বাগানবাড়ি সবই আছে। আবার মাঠ কিংবা চাষের জমি পার হয়ে উরাট জমিতে আছে বাঁশের জঙ্গল। গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেলে বিঘের পর বিঘে শুধু বাঁশঝাড়।

পাতলা বাঁশের দর কী যাচ্ছে? বাসুই মশাই পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে কপালের ঘাম মুচতে মুছতে প্রশ্ন না করে পারে না।

দর কী যাচ্ছে আপনি জানেন না হারমোহনদা? আসলে পাইকার মানুষ। ভি আই পি, রাস্তাখানাও ভি আই পি, দু-পাশের ধানের মাঠ শেষ, প্রলয়ঙ্করী সব কাণ্ড। আকাশ সমান উঁচু সব পেল্লাই হাউজিং–আপনার এতদিনের কারবার, সব জানেন, সব বোঝেন বাকড়োবা, মাছিডাঙা, পাথরকাটায় বাঁশঝাড় সাফ হয়ে গেছে বলে আতান্তরে পড়ে গেছেন—পঞ্চাশটা টাক হবে?

কেন, পঞ্চাশ কেন?

দিন, দেখি, বাজিয়ে দেখা যাবে না, তবে শুনে দেখলে বলতে পারি, কোনদিকে গেলে আপনার কারবারে ঘূণ ধরবে না। আমার পায়সাও হবে, আপনার কারবারও হবে। তবে বলতে পারি ঠকবেন না। টাকাটা আপনার বাঁশ বাগানখানা দেখলেই উসুল হয়ে যাবে।

পঞ্চাশ কী গাছে হয়?

আজ্ঞে না। গাছে হয় না জলেও হয় না, তবে হয়, না হলে আপনিই বা হন্যে হয়ে বাঁশের খোঁজে বের হয়ে পড়েছেন কেন, আর আমি ল্যানছুইরাই বা হাত পেতে চাইব কেন? হয় বলেই চেয়েছি। এটা আমার হকের টাকা।

নাও। বলে হরমোহন দশটা টাকা জ্যাব থেকে টিপে টিপে বের করে দিয়েছিল।

আগাম থাকল।

আমি কিছু জানি না, বাঁশের খবর কিছুই জানা নেই। বিপ্রদাস চোখ উল্টে দিল।

এই যে বললে,বাকড়োবা না কোথায়?

আজ্ঞে ওটা দশ টাকায় হয় না। পঞ্চাশ না হলে কোথায় বলা যাবে না।

লোকটা যে বড়ই ত্যাঁদর, কী করা! কুড়ি টাকা রাখ।

আজ্ঞে না। কুড়ি টাকায় দেড় কেজি চাল হয় না। তিনটে প্রাণীর কী করে চলে বলুন!

বাঁশ না হলে ভারা হয় না, দালান কোঠা হয় না, এক বাঁশ সাপ্লাই করে হাতিয়াড়ার মোড়ে দুখানা পেল্লাই বাড়ি। কুনজুস, ভটভটি চড়ে না, সাইকেলে মাঝেসাঝে বের হয়, যখন আকাল বাঁশের, কাজের লোক হারামি, ঠিক খবরাখবর পাওয়া যায় না, তখনই নিজে বের হয়ে পড়া। চিনতে বাকি নেই। বিপ্রদাস মনে মনে কথাগুলি আওড়াল।

ঠিক আছে,তোমার কথাও থাক,আমার কথাও থাক। ধরো আর দশ খুশি মনে নিয়ে যাও। এটা ত তোমার ফাউ টাকা। ঘোরাঘুরি করলে খবর পাব না হয়।

তা পাবেন। দেখছেন কেমন লু বইছে—গরম বাতাস। রোদে ঘুরে সর্দিগর্মি হলে সব রসাতলে। ফাউ টাকার ভাও তখন ভাসানে। বউঠানের কথাখান ভাবনে— একলা ফেলে চলে গেলে হুজ্জোতির শেষ থাকবে না।

হরমোহন কেমন কাতর হয়ে পড়ে। রোদে মাথার চাঁদিফাটছে। বড়ো জলতেষ্টা বোধহচ্ছিল। সর্দিগর্মি মারাত্মক ব্যামো। ঠাস করে পড়ল ত, মরল।

হরমোহন বলল, তা হলে পঞ্চাশই নাও। তবে সবটাই গচ্চা। কীযে দিনকাল শুরু হয়ে গেল। তারপর ঢোক গিলে বলল, অর্থই যত অনর্থের মূল, এই যে গেরাপি না কী হচ্ছে, সবটাই পচা টাকার খেলা—এটা বোঝ?

বিপ্রদাস জবাবে বলেছিল, সেই পচা টাকায় এক ধুন্দুমার কাণ্ড শুরু হয়ে যাবে। ঘরবাড়ি রাস্তা বেবাক লাল হয়ে যাবে। মানুষ-জন, ঘরবাড়ি জমি বাঁশবাগান গচ্চা দিয়ে হাওয়া খেয়ে বেড়াবে। বেশি কথা বললে বেস্মতালু জ্বলে,আপনে যান—কীসে কী কাণ্ড হবে বোঝা মুশকিল।

বিপ্রদাসের সেই থেকে বেহ্মতালু জ্বলছে। সে ঘরে বসে থাকতে পারে না। কারও সঙ্গে দেখা হলেই এক কথা—যাও, সময় থাকতে চলে যাও বিপ্রদাস। জমি ভেস্টেড হয়ে যাবে শেষে—বেলাবেলিতে রওনা না হলে নদী পার হতে পারবে না, জলে ডুবে মরবে।

ভাদু আর এক কাঠি উপরে। ব্যাটা সারাদিন মাদুরে পড়ে থাকে, বিধবা জননী তার বালিতে ডাল ভাজে, মাষকলাই ভাজে, লঙ্কা জিরে ভাজে, আর সারাদিন বসে বসে ডালমুট বানায়, ব্যাটা ভাদু বিকেলে সেই নিয়ে তার কারবারে বের হয়। পোশাকেরও কম বাহার থাকে না। ভূসোকালির রং জোবৰায়। আপাদমস্তক জোব্বায় শরীর ঢাকা, মাথায় লালরঙের ফেটি, কোকড়ানো চুলেদস্যি চেহারা, বাবুদের বাগানের কোনাখামচিতে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকে। দায় নেই অদায়ও নেই, কেবল সে সুযোগ পেলে তার বাড়িতে এসে বসে থাকে। আর জপায়, বোঝলা কাকি, মারকাটারি বই চলছে। দেখায় বাসনা থাকলে বলবে, টিকিট কেটে আনব। অনু ত এক খ্যাপ মেরে এসেছে। আর এক খ্যাপ দেবারও বাসনা।

তারপরই যত ফস্টিনস্টি, এই অনু এক গেলাস জল দে।

এই অনু, চা বানা। পয়সা রাখ। বদলকে বলগে, ভাদু বসে আছে। যা লাগে নিয়ে আয়।

শুয়োরের বাচ্চা। তুই ভাবিস বিপ্রদাস কিছু বোঝে না। অনু কার সঙ্গে খ্যাপ মারে ব্যাটা। তুই উসকে দিয়ে নিয়ে যাস, হলের ঘূপচিতে ব্যাটা কামড়াকামড়ি তোর। শেষ হয়ে যাবি বলে দিলাম। আমার দশটা না পাঁচটা, একটা মেয়ে, তারে তুই গস্ত করতে চাস। তোর আছেটা কী! বাবুদের বাগান পাহারা দিস, লপ্তমত বাগানে থাকিস খাস, আজ এক ডালে বসে আছিস, উড়িয়ে দিলে কাল আর এক ডালে। তোর আছেটা কী। পায়ে ঘুংগরো পরে সং সেজে ডালমুটের নাম কাচ্চা বাচ্চার মতো পরমাসুন্দরীকে নিয়ে খাবলাখালি!

২.

পুষ্পবর্তীও জানে, তার মানুষটার দু-পাশে দুই পরমশত্রু গজিয়ে গেছে। এক রোপি, আর এক ঘুংগুর কথা জানতে চাইলেই মানুষটা খেকিয়ে ওঠে।

ভাদুই ঠিক বলেছে, গেরাপি হলগে কাকি, বাবুদের গ্যারাকল। সব হেঁজিপোজি তাড়িয়ে দাও, প্রশস্ত রাস্তা বানাও, অট্টালিকা বানাও, আমরা বাবুরা গিয়ে নিশ্চিন্তে বসবাস করি। গাড়ি ঘোড়া চড়ি। হাওয়া খাই।

আমরা যাব কোথায়!

সে ত বাবুদের জানার কথা নয়। বাবুরা মেলা টাকা দেবে, তাই নিয়ে যাব। একসঙ্গে এত টাকা জীবনে দেখেছে! বলো কাকি, এত মাথা গরম হলে চলে। যাও, জায়গার ত অভাব নেই, বাবুদের যখন পছন্দ, টাকাও মেলা, যেতে এত আপত্তি কীসের বুঝি না কাকি।

কিন্তু কাকা তোমার কিছুতেই মাথা পাতছে না, কোথায় যে সকালে বের হয়ে গেল, বেলা পড়ে আসছে, ফেরার নাম নেই, তোমাকে কি কিছু বলে গেছে।

আমাকে? তুমি জানো না, বাক্যালাপ বন্ধ। আমাকে শাসিয়েছে, ভাদু সাবধান, কেউটের গর্তে হাত ঢোকাবি না।

অমা! সে কবে! তোমার কাকার মাথা ঠিক নেই। কিছু মনে কোরো না।

ওই ত সেদিন, কাকা আমাকে হলের সামনে তোড়পাল। অনু ফুচকা খাচ্ছিল, দমাদম সাঁচাচ্ছিল—পারমিশান থাকলে যা হয়, আর কাকি তুমি ত জানো, কেউ খেতে চাইলে আমি বারণ করি না। অনু যখন ফুচকা খায় কী যে সমুধুর দৃশ্য কাকি! নুয়ে যাচ্ছে, কনুই তুলে ওড়না সামলাচ্ছে, শালপাতার ঠোঙা ঠোঁটের কাছে, ফতুর হয়ে যেতেও রাজি, আমি কিছুতেই অনুকে বলতে পারি না, এই আর খাস। তোর বাপ রাস্তার দাঁড়িয়ে আমাকে তড়পাচ্ছে। আচ্ছা আমার কী দোষ বলো।

যখন পছন্দ করে না।

আমি পছন্দ করার কে? পছন্দ যার, তাকে তোমার জিগাও, সে একদণ্ড আমাকে না দেখলে পাগল হয়ে যায়—তারপরই থেমে জিভ কেটে বলল, ছিছি তোমাক এ-সব কথা বলা আমার উচিত হয়নি। এই অনু, অনু আছিস। যা বদনের দোকানে, এক ঠোঙা মুড়ি আন, কাকি তেলমুড়ি মেখে দাও, তোমরাও খাও, আমিও খাই। কাকার আজ মনে হয় ফিরতে রাত হবে।

আমার খেতে ইচ্ছে করছে না ভাদু। তোমার কাকা সেই কখন কিছু মুখে না দিয়ে বের হয়ে গেল? এখনও ফেরার নাম নেই।

তখনই অন ঘর থেকে বের হয়ে এল। ফ্রক গায়ে, গামছা জড়ানো শরীরে। কারণ উঁচ স্তন খুবই তার পরিপুষ্ট, বাডে দিনে দিনে। এ-বছরের ফ্রক ও বছরে। টাইট হয়ে যায়। একজন ছাঁচড়া মানুষের সে কন্যা, চাইলেই দেবে কোত্থেকে। ফলে গামছাখানা সম্বল। গামছাখানা গায়ে জড়ানো, শরীর ঢাকা থাকে, অথবা বলা যায় আব্রু–সে বের হলেই এক লাফে উঠোন তারপর বলল, টাকা দাও। আমি নিয়ে আসছি—মা না খেলে, আমরা খাব না হবে কেন। আমার খিদে পেয়েছে।

ভাদু বলল, খিদের আর দোষ কি? উঠতি বয়সে খিদে বেশিই থাকে। তোর বাবা মোটেই বোঝে না। বলে ভাদু একটা পাঁচটাকার নোট বের করে দিতেই খপ করে ধরে ফেলল অনু। কী সুঠাম শরীর। যেন অঙ্গ তার সোনার হরিণ। পায়ের গোড়ালি থেকে জানু পর্যন্ত মসৃণ এবং পাকা বেলের মতো রং। আর জানুর ঊর্ধ্বে কী থাকে–ভাদু ভালোই টের পায়। উঠতি বয়েস যে পরমান্ন। খেতে ভারি সুস্বাদু। মেয়েটার দৌড়ে লাফিয়ে চলে যাওয়ার মধ্যে থাকে এক যেন অনন্তের ইশারা সামনে জলাজমি তারপর সড়ক এবং সড়কের পাশের ঘরবাড়ি পার হয়ে বদনের দোকান, সেখান থেকে এক ঠোঙা মুড়ি।

ভাদু বলল, দ্যাখো কাকি, মেয়েটার দিকে তাকিয়েও তোমাদের ভাবা উচিত। দালাল ঘুরছে, বল ত, আমি কথা বলিয়ে দিতে পারি, বেশিই দাম পাবে। একশো কুড়ি ফুটের রাস্তা ভাবা যায়, তার পাশে জমি। গেরাপি শুরু হলে জমির দর হুহু করে বাড়বে। পাকা মাথার বাবুরা লপ্তে লপ্তে জমি কিনে রাখছে, সরকারকে দাও, ওদের দিতে আপত্তি কোথায়! দ্বিগুণ দাম দেবে—দশ কাঠায় কত টাকা হয় সহজেই বুঝে নিতে পার। না বুঝলে কন্যেতির কাছে বুঝে নিতে পার। অঙ্কে চৌকুস তোমার কন্যা, না হলে ভাদুকা বলতেই অজ্ঞান হয় কেন বোঝে না।

পুষ্পবতী সেই যে বাঁশে ঠায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মানুষটার ফেরার অপেক্ষায় রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে, তা থেকে তার একবিন্দু নড়চড় হচ্ছে না। কেমন উদাস গলায় তবু না বলে পারল না, জমি ত সরকারের, ওরা নিয়ে কী করবে! জমি বেহাত হলে সরকার ছাড়বে কেন?

আরে সেটা তোমার ভাবার কথা না। পাকা মাথার লোক তারা, সবরকমের অঙ্ক জানে, তারা ঠিক করলে সরকারের জমি কলমের এক খোঁচায় বেসরকারি হয়ে যাবে। বোঝলা না সরকার হল জনগণের। তোমরাও জনগণ। পাকা মাথার লোকেরাও জনগণ। জনগণ চাইলে সরকারের সাধ্য কী মাথা না পাতে?

পুষ্পবতীর মাথায় কিছুই ঢোকে না। ডবল দাম পাওয়া যাবে। সোজা কথা।

ভাদু বিকাল হলেই চষা মাঠ পার হয়ে যায়, তারপর গাঁয়ের উপর দিয়ে হাঁটে। রাস্তার হাঁটে, বাড়ি বাড়ি হাঁটে, হাঁটে আর হাঁটে। মুখে চোং–চাই হাড় মুড়মুড়ি ভাজা। আর ঘুংগরো ছ্যাঁচরায়—যে যেখানে থাকে, কোঠাবাড়ি, বাগানবাড়ি, কিংবা চাষবাসের মানুষজন, তাদের কাচ্চাবাচ্চা সব মিলে ভিড় করলে ভাদুর বিক্রি বাড়ে। পুষ্পবতীর মনে হয় ভাদু মানুষের রহস্য টের পায়। অন্ধকার রাস্তায় দু পাশের ঘরবাড়ি ফেলে সে হাঁটে–তার কাছে মোড়া কুপির আলো থেকে শিস উঠে। তার পায়ে ঘুংগরো বাজে। আর মাঝে মাঝে চোং মুখে হাঁক ডাক—চাই হাড়মুড়মুড়ি সাড়ে চোদ্দ ভাজা। খেলেও মজা, না খেলেও মজা।

সে তারুলিয়া আটঘরা নবাবপুরেও যায়। সে অন্ধকার রাতে মাঠ ভাঙে। দূর থেকে সচল একটা আলো দেখলেই অনু টের পায় ভাদু ফিরছে। উঠোনে দাঁড়িয়ে পুষ্পবতীও দেখেছে, অনেক দূরে, যখন রাত নিশুতি হয়ে যায়—ভাদু মাঠ ভেঙে বাড়ি ফেরে। এই ফেরার মধ্যে ভাদুর নানা মজা থাকতেই পারে। সে শহরেও যায়। মানুষজনের সঙ্গে তার আলাপ পরিচয়ের শেষ নেই—দামালেরা শকুনের মতো উড়ছে চারপাশে–ভাদু খবর পেতেই পারে। ডবল দামে বিক্রি করতে পারলে–যে করে হোক কোথাও গিয়ে তিনটে পেট চলে যাবে। আর তিনটা পেটই বা ভাবে কেন, মেয়ে সোমত্ত হয়ে গেছে, আজ আছে, কাল নেই, বলতে গেলে দুটো প্রাণীর জমি ঘরবাড়ি বেচা টাকায় হেসে খেলে চলে যাবে।

ভাদু খবর রাখে। সব খবর।

মানুষটা ফিরলে ভাদুর পরামর্শ যে খুব একটা খারাপ না বুঝিয়ে বললে শুনবে। কী দরকার জমি নিয়ে হুজ্জোতি করার। বিনা পয়সায় ত আর নিচ্ছে না। ভাদু ঠিকই বলে, কাকি, বাগুইহাটি, জ্যাংরা, কেষ্টপুর হয়ে গেলে কী ভালো হয়ে। সেদিনও সেখানে সব ধানের জমি, যেদিকে তাকাও, ধানের জমি, আশেপাশে গরিব মানুষের ঘরবাড়ি জোতদার জমিদারও ছিল—এখন যাও, দেখো গে কী একটা মস্ত কারবার গলিঘুজি ভর্তি। কাঁচা নর্দমার গ্যাস। আসলে মুখে বিস্ফোরণের কথা উচ্চারিত হয় না। সে বলে, জনবিচ্ছুরণে প্রাণবায়ু ওষ্ঠাগত যেখানে সেখানে কাঁচা রাস্তা, পিল পিল করে মানুষজন বাসে উঠছে নামছে। মারুতি গাড়ি ঝাঁকে ঝাঁকে, শুধু একটা অকল্পিত শহর—আসলে ভাদু বলতে চায় অপরিকল্পিত শহর। যার মাথা মুণ্ড কিছু নেই। ধানের মাঠও নেই, টালির ঘরও নেই। সব লোপাট। যতদূর চোখ যায় হাউজিং আর হাউজিং। চোখে দেখলে পিলে চমকে যাবে জানো!

তোমার কাকা কি সেটা বোঝে?

বোঝাতে হবে। এতে চরণবাবাজি বলল, ভাদু, কাল বড়ো মহাকাল। সে শুধু গিলে খায়। বলে বিশুবিয়স।

সেটা আবার কী!

এই অনু, বিশ্ববিয়স কীরে।

আমি জানি না।

কী কচু পড়িস বুঝি না! ধুম উদগীরণ করে। তপ্তলাভা উদগীরণ করে। বুঝতে পারলি।

না।

ইস্কুলে যাস কেন? ঘাস কাটতে যাস। চরণবাবাজির কথা কখনও মিছে হয়! উত্তপ্ত লাভা নেমে আসছে। গ্রাম মাঠ ভেসে যাবে। কেউ রুখতে পারবে না। জনবিচ্ছুরণে এই হাস। আমার কথাখান বুঝতে পারলি!

আমার বুঝে দরকার নেই। মাকে বোঝাও, বাবাকে বোঝাও।

শুনলে ত কাকি, তোমার মেয়ের কথা। আসলে কাকি, ওই সে হাউসিং-এর পাল্লায় পড়ে আমরা যে তাড়া খাচ্ছি, কেউ কি আটকাতে পেরেছে। সরকারের সাধ্য আছে-তুমি জমি বেচলেও আটকাবে না, না বেচলেও আটকাবে না। গাছের শেকড়বাকড়ের মতো ছড়িয়ে পড়বে। আজ অথবা কাল। ধানের মাঠও থাকবে না, জমিও থাকবে না। যাও না আটঘরা তেঘরিয়ার দিকে, ওটা ত তোমার বাপের বাড়ি ছিল, যাও না, চিনতে পার কি না দেখে এসো সরকার ত আর কাউকে ঠেলে দেয়নি, তবে তোমার বাপ-কাকারা জমি বেচে দেশান্তরী হল কেন? এক দেড় হাজার টাকায় বিক্রি—আর এখন জমির দাম কত জানো, এক দেড় লাখ। টাকা যতই দাও, জমি ত আর বাড়ে না। সব বাড়ে, শুধু জমি বাড়ে না।

ভাদুর কথাবার্তা পুস্পবতীর খুবই মনে ধরে। ভাদু বলেই চলে, আজ না হয় কাল তোমাকে জমি ছাড়তেই হবে। চলে যেতে হবে, দূরে আরও দূরে। তবু সরকার ন্যায্য দাম দেবে, বড়ো বড়ো প্রাসাদ, রাস্তা প্রশস্ত, পার্ক ময়দান, এক ময়দানবের যজ্ঞও শুরু হয়ে যাবে—চরণবাবাজিরও যজ্ঞ হয়, চরণবাবাজির যজ্ঞ হলে কেষ্টপুর হয়, একবাড়ির পেচ্ছাব আর এক বাড়িতে পড়ে, আর ময়দানবের যজ্ঞে যার যার পেচ্ছাব তার তার বাড়িতে। তারপর পাতালে ঢুকে যায়। বোঝো তার কাণ্ডকারখানা? শহরের মানুষজন ঘরবাড়ি ঠেলেঠুলে এই এলাকায় ঢুকে যাবেই—কেউ আটকাতে পারবে না। কাকাকে সেটাই বোঝাতে পারে না, দিতে হয় জমিটা ময়দানবের হাতেই তুলে দাও। চরণবাবাজিকে দিয়ে তেঘরিয়া কেষ্টপুর জ্যাংরা বাগুইহাটি করে দিও না।

পুষ্পবতীর মনে হয় খুবই ন্যায্য কথা, ভাদু কিছুটা খ্যাপা গোছের মানুষ, তবু তার কথায় যেন কোথায় একটা সূত্র খুঁজে পায়। বাপ-কাকারা কেন, সেও তেঘরিয়ার গেলে ধরতেই পারবে না, বসতবাড়ি, দুটো জামরুলের গাছ, কিছু কলাগাছ, লাউয়ের মাচান কোথায় হারিয়ে গেছে। বাপ-কাকারা বসিরহাটের দিকে মদনপুরে উঠে গেছে। সস্তায় জমি ঘরবাড়ি সব হয়েছে, দাদারা ট্রাক চালায়, তারাও দূরে আরও দূরে হয়তো একদিন চলে যাবে। পুষ্পবতীর চোখে জল চলে আসে।

ভাদু কখন উঠে চলে গেছে তাও টের পায়নি।

চৈত্রমাস, গরমে গা জ্বলে যাচ্ছে। তপ্তখোলার মতো এই টালির ঘরে পুষ্পবতী তবু কী যে আরাম পায়–সে দেখল সদরের ওপারে বাঁশবাগানে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, ছায়া নেমে এসেছে ঘরবাড়িতে। মানুষটার তবু ফেরার নাম নেই।

সে ডাকল, অনু, অনু রে।

অনু ভেজা একখানা গামছা জড়িয়ে গা ধুয়ে এসেছে-এই অবেলায় যখন তখন কলপাড়ে গিয়ে বসে থাকে—পাইপে জল ওঠে না, জল সেই পাতালে এখনও মনে হয় মাঝে মাঝে। সেটুকু ওঠে, তাই দিয়ে তপ্তশরীর ঠান্ডা করতে হয়—জং ধরা পাইপ, কার কখানা বাতিল পাইপ নিয়ে এসে সেই করে টিউকলটি করেছে, তারপর থেকে বলা চলে নিজের টিউকল, তা ঘোলা জল উঠলেও নিজের টিউকল, খাবার জল দু-বালতি বদন মুদির বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হয়—এখন মেলা কাজ, বাসন সব কলপাড়েই পরে আছে। কাক শালিখের উপদ্রবও নেই, এঁটো কাটা কিছু আর না থাকলে কাক শালিখ উড়বে কেন, ঘর ঝাঁট দিতে হয়। অনুটা যে আবার কোথায় গেল।

এই অনু, অনু বাসন কটা, ধুয়ে রাখ।

পারব না।

সব কথায় এক রা। না, পারব না। কী করছিস! তারে জামাকাপড় মেলা, তুলে রাখ।

সাড়া নেই।

পুষ্পবতী ঘরের ভিতর উঁকি দিয়ে দেখল মেয়ে তার ভাঙা আর্শিতে প্রসাধনে ব্যস্ত। সব যেতে বসেছে, কোনও যদি হয় আপশোস থাকে। মেয়ে এখন নিজের মর্জিমতো চলে। বাবাকেও ডরায় না।

এই অনু তোর কি মায়াদয়া নাই! মানুষটা কোন সকালে কিছু মুখে না দিয়ে বের হয়ে গেল, একবার খোঁজখবর নিবি না! হেমাঙ্গর সঙ্গে যদি দেখা হয়, কলের কাজ করতে যদি চলে যায়, হেমাঙ্গ জানতেই পারে। হেমাঙ্গ ওস্তাদ মিস্ত্রি, কলের কাজ থাকলে হেমাঙ্গর পরামর্শ ছাড়া করে না–তুই যা, যদি হেমাঙ্গ ফিরে আসে।

অনু অর্থাৎ অনুপমা আর্শিতে দাঁত দেখছে। দরজায় ঝুঁকে আছে যে মহিলাটি, সে যে তার মা, তাও যেন মনে হয় না। কী সংসারের ছিরি, সে শালোয়ার কামিজ পরে এখন যে রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। তার কী সময় আছে বাপকে খোঁজার। বাপের খোঁজে কোথায়ই বা যাবে! বাপের মাথায় আগুন জ্বলছে, যা কিছু একটা করে বসতে পারে, খেপে গেলে এখনও ত্রাসে ফেলে দেয়! সেই বাপকে খোঁজা তার কম্ম নয়। মুখ খিচিয়ে কথা বললে কাঁহাতক সহ্য হয়!

তার এক কথা, আমি পারব না। কতদিনই ত যায়, ফিরেও আসে। তোমার আবার বেশি বেশি! এত উতলা হলে চলে! মেয়েটাও চোখের সামনে ওড়না উড়িয়ে বের হয়ে গেল। কোথায় যাবে কিছুই বলে গেল না। এই আসছি বলে সেও চলে গেল। হতচ্ছাড়া জীবন হয়ে যাচ্ছে, জমি বাড়িঘর কিছুই থাকবে না টের পেয়ে মেয়েটাও কেমন দজ্জাল হয়ে গেল।

পুষ্পবতী কী যে করে! তবু কিছুটা জলা পার হয়ে গেলে মানুষজনের দেখা পাওয়া যায়। চেনাজানা কাউকে দেখলেও বলতে পারে, আপনার দাদাকে দেখলেন! সেই কোন সকালে বের হয়ে গেল, কিছু বলেও গেল না, এই আসছি বলে বের হয়ে গেল, এখন কী যে করি?

আর তখনই দেখল তার মানুষটা বাস থেকে নামছে। দু-হাতে দুটো ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি বাজার, এই যেমন চাল ডাল তেল নুন, তরি তরকারি, ব্যাগ দেখেই পুষ্পবতী দৌড়ে গেল রাস্তায়, সারাদিন একটা মানুষ নিখোঁজ হয়ে থাকলে, যা হাহাকার শুরু হয়! কাছে গিয়ে বলল, দাও, আমি নিচ্ছি।

পারবে না।

কোথায় গেছিলে! একটা খবর নেই! তুমি ত না বলে না কয়ে কোথাও যাও না। আমার কী চিন্তা!

বিপ্রদাস কোনও কথা বলল না। হাতের ব্যাগও পুষ্পবতীকে দিল না। নিজেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তা থেকে জলার পাড়ে পাড়ে বাড়িতে উঠে ডাকল, অনু, অনু, ধর মা।

অনুর কোনও সাড়া নেই।

দরজা হাট করে খোলা।

বিপ্রদাস তাকাল পুষ্পবতীর দিকে। আপশোসের গলায় বলল, আমার সব যাবে। তারপর বারান্দায় ব্যাগ রেখে ডাকল, এই অনু, তুই কোথায়?

মেয়ে তোমার কোথায় উড়তে গেল। আমার মানা শুনল না। এইসব বলতে গিয়ে পুষ্পবতীর মুখ গোমড়া।

টিভি, বুঝলে টিভি। সব খাবে। বাবুরাও খাবে, টিভিও খাবে। ধিঙ্গি নাচ। কোমর বাঁকিয়ে নাচ, লাইরে লাপ্পা গান—সিরিয়েল, কত মজা। বাপ ফিরেছে কী মরেছে, কিছুই যায় আসে না। ঠিক চাঁদুদের টিভির সামনে বসে পড়েছে।

তখন দুটো একটা নক্ষত্র আকাশে ভাসমান—এদিকটায় আলো আসেনি। পুষ্পবতী হারিকেন জ্বেলে দাওয়ায় রেখে দিল। হাতমুখ ধোওয়ার জন্য এক বালতি জল তুলে রাখল। দড়িতে গামছা রেখে দিল। বিপ্রদাস মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না, সে ঠায় খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে। কিছু বলছে না। গুম মেরে আছে।

তারপরই চিৎকার করে বলল, তোর মেয়ে, টিভি বের করছি! বলেই পাগলের মতো ছুটে গেল উঠোন পার হয়ে। পুষ্পবতী তাকিয়ে আছে। বড়ো চণ্ড রাগ মানুষটার। সারাদিন পর বাড়ি ফিরে মেয়েকে না দেখে মাথা গরম—এবং দুটো ব্যাগে কী এনেছে বোঝার চেষ্টায় সব টেনে নামাল—এক প্যাকেট চাউমিন পর্যন্ত এনেছে। মেয়েটা চাউমিন খেতে ভালোবাসে, দিতে পারে না, আজ তাও এনেছে, কোথায় ব্যাগের সব গোছাতে গিয়ে মেয়েটা তার উল্লাসে ফেটে পড়বে, কোথায় পুষ্পবতীর সঙ্গে সবকিছু গোছগাছ করতে বসবে—তা না, কোথায় টিভির সামনে গিয়ে বসে আছে। আসলে মানুষটা যে তার সর্বস্ব দেবে বলে কথা দিয়ে কিছু টাকা ধার করেছে পঞ্চবাবুর কাছ থেকে পুষ্পবতী জানে না। যখন চারপাশে ঠাঠা রোদ্দুর, ঝিম মেরে আছে প্রকৃতি, তেষ্টায় বুক ফাটছে, তখনই মোটর সাইকেলে পঞ্চবাবু দেবতার মতো হাজির—বিপ্রদাস কী ঠিক করলে, হন্যে হয়ে ঘুরছ, মেজাজ ঠিক নেই মনে হয়। ধরো দুশো টাকা, পরে কথা হবে। বিনা মেঘে এই জল যে তার সবকিছু গস্ত করার অছিলা বিপ্রদাস ভালোই বোঝে। তবু তার নিরুপায় জীবন তাকে হাত বিস্তার করে দিতে সাহায্য করল।

বদনদের বাড়ি ঢুকে বিপ্রদাস ডাকল, বদন আছ, বদন!

ও তো দোকানে আছে। বদনের দিদি বের হয়ে বলল, দোকানে যাও না, পাবে।

অনু এসেছে।

না ত।

টিভি দেখতে আসেনি!

না ত!

দেখো না কাউকে জিজ্ঞেস করে। যদি আসে।

বদনের দিদি হেসে ফেলল, বিপ্রদাস আমি ত টিভির সামনেই বসে আছি।

অঞ্জলি কোথায়?

টিভির সামনে।

বদনের বউ?

টিভির সামনে।

সবাই টিভির সামনে, কেবল তার মেয়েটা টিভির সামনে বসে নেই। কোথায় গেল। কার বাড়ি গেল! নিতাইদার বাড়ি ঢুকে বলল, অনু এসেছিল?

না ত।

সবারই এক কথা। সুখদা বলল, দ্যাখ বাসে উঠে চলে গেল কি না! সিনেমার নেশা। যে নিয়ে যায় তার সঙ্গেই চলে যায়।

কথাটার মধ্যে ভারি অশ্লীল কটাক্ষ, তবে বিপ্রদাসের সময় খারাপ, তার সব যেতে বসেছে, পুষ্পবর্তী আর মেয়েটা ছাড়া আর কেউ নেই। কোথাও দূরে চলে যাবে, আর এমুখো হবে না, ময়দানবের ইন্দ্রপুরী তার হাড়গোড় চুষে ছিবড়ে করে ছেড়েছে।

সে বাড়ি বাড়ি খুঁজল। রাস্তায় খুঁজল। ভাদুর সঙ্গে যদি যায়, ভাদু ফুচকা খাওয়াবার লোভ দেখিয়ে যদি আরতি সিনেমা হলে নিয়ে যায়, কিংবা যদি দুষ্ঠজনেই উড়ে যায়—গোপনে কী ঠিক করা আছে সে কিছুই জানে না, ভাদু ইচ্ছে করলেই এক ডাল থেকে আর এক ডালে উড়ে যেতে পারে-যত ভাবছে, তত মনে হচ্ছে পায়রার বকম বকম শব্দ তাকে গোলমালে ফেলে দিচ্ছে। সে বাসস্ট্যাণ্ডে গেল—নেই। চায়ের দোকান এবং মনিহারি দোকানে গেল—যদি দাঁড়িয়ে থাকে। ওই তো মনে হয়, কাছে গিয়ে দ্যাখে সুরধুনী, নবীন চ্যাটুজ্যের মেয়ে, হেলে দুলে হাসি মসকরা করছে তার নাগরের সঙ্গে।

কী নির্লজ্জ চেহারা—রাস্তার লোকজনের তোয়াক্কা করছে না। বিপ্রদাসের কেমন আঙুলগুলো শক্ত হয়ে উঠছে। পায়রার বক বকম, দু আঙুলে গলা ছিঁড়ে ফেলবে। সে শক্ত হয়ে যাচ্ছে আর ছুটছে। ভাদু ছাড়া কারও কাজ নয়, মেয়েটাকে ফুসলে ফাসলে গায়েব হয়ে গেছে।

পুষ্পবর্তী বারান্দা থেকে সব তুলে নিয়ে যাচ্ছে ঘরে, তখনই বিপ্রদাস ছুটে এসে বলল, মেয়ে তোর ভেগেছে হারামজাদি, নচ্ছার মেয়েছেলে, কিছুই দেখিস না, মাথায় রক্ত উঠে গেলে তুই তুকারি করার স্বভাব—আর রক্ত ফুটতে থাকলে, তেড়েও যায়, কিন্তু পুষ্পবর্তী খুবই কোমল স্বভাবের, কী করবে, এত যে গালাগাল, তাও মনের ভালো, রাগ পড়লে ঠান্ডা হয়ে যাবে, পুষ্পবতী ঠান্ডা মাথাতেই বলল, কোথাও গেছে। চলে আসবে।

আর আসছে। তারপরই দেখল মুড়ির ঠোঙা ওড়াউড়ি করছে উঠোনে।

ঠোঙা উড়ছে কেন?

ভাদু এসেছিল।

তা হলে সেই ঠোঙা উড়িয়ে দিয়ে গেল।

যা হয় মাথা খারাপ হয়ে গেলে যা হয়, সে একদণ্ড দেরি করল না। ভাদুর ডেরায় গেল—ভাদুর জননী বলল, ভাদু হাড়মুড়মুড়ি বারো ভাজা নিয়ে গাওয়াল করতে বের হয়ে গেছে। কোথায় কতদূরে গেছে, কারণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে সামনে মাঠ, কোথাও ভেরি, রাস্তার দু-পাশে কত গ্রাম কত জনপদ, ভাদু বাড়ি বাড়ি চোং মুখে যদি সত্যি ঘুরে বেড়ায়, আবার নাও বেড়াতে পারে। ভাদু এক মাঠ ভেঙে আর এক মাঠে হেঁটে যায়, তার কাছে ঢাকা কুপিখানার কারিকুরিও মেলা। তার পিঠে টিনের মাথায় সাপের মতো ফোঁস করে থাকে কুপিখানা। ঝড়ে বাতাসে নেভে না—সে মাঠের যত দূরেই থাক, নিশীথে তার চলন্ত কুপির আলো দূর থেকেও দেখা যায়। কাছে এলে পায়ে তার ঘুংগরো বাজে, বেটা যদি গাওয়ালে যায় তবে পালাবার পথ নেই। কোথাও যদি অনুকে তুলে দিয়ে আসে—অনুরে তোর এক ফুচকা খাবার লোভ, বাপের কথা ভাবলি না, তর মার কথা ভাবলি না, তুই উফড়ে গেলি কোথায়-কাকে বলি! বলতে যে তোর কলঙ্ক, তোর মা-বাপের কলঙ্ক। কাকে বলে।

অন্ধকারে মাঠ ভাঙছে বিপ্রদাস। কাশবন পার হয়ে যাচ্ছে। ধুবির বিল এসে পড়তেই মনে হল, আকাশ ক্রমে আরও নেমে আসছে। সে ডাকছিল, অনু রে অনু। আসলে সে অন্ধকারে ভাদুর আশায় দাঁড়িয়ে আছে। এই মাঠ ভেঙে সে ফেরে। আরও ফিরবে। এবং ভাসমান নক্ষত্রমালার ভিতর কোনও নক্ষত্র সচল হয়ে উঠলেই বোঝে, ভাদু ফিরছে। এই ফেরার মধ্যে ভাদু এক আশ্চর্য রহস্যময়তায় যেন মগ্ন হয়ে যায়—তার কুপির আলো বাতাসে কাঁপে, এবং ক্রমে

এগিয়ে আসতে থাকলে কখনও আলেয়ার মতো মনে হয়। চারপাশে কীটপতঙ্গের। আওয়াজ-মযদানবের ইন্দ্রপূরীর নির্বাসিত মানুষজন সেকেউ জানেই না, সে একটা খুন করবে বলে প্রতীক্ষায় আছে। যেন জীবনের সব জ্বালা, এবং জীবনের সব হাড়গোড় বের করা এক ভয়ংকর দাহ্য পদার্থ হাতে নিয়ে সে ঘুরছে। তখনই ভাদু তার মাথার কুপি নিয়ে সামনে উদ্ভাসিত-পায়ের ঘুংগরো ঝন ঝন করে বেজে উঠতেই বিপ্রদাস লাফিয়ে পড়ল, গলা টিপে ধরল, বল শুয়োরের বাচ্চা, অনু কোথায়।

আমি কী করেছি, আমি জানি না কাকা—আমাকে মেরে ফেলো না। অনু কোথার আমি জানি না।

বিপ্রদাস থমকে গেল। কুপিতে আলোতে দেখল, সত্যি বড় নিরীহ গোবেচারা মুখ ভাদুর। তার এই সংশয়ের পীড়ন যে তাকে উন্মাদ করে দিচ্ছে। তার দু হাঁটু ভেঙে আসছে, অবশ হয়ে যাচ্ছে শরীর-কেমন কাতর গলায় বলল, ভাদু অনু কোথায় চলে গেল?

ভাদু কেমন নির্বাকল্প গলায় বলল, কেউ কোথাও যায় না কাকা, যে যার মতো জায়গা বদল করে নে। ওঠো। বসে থাকলে হবে। চল একসঙ্গে না হয় খুঁজে বেড়ায়।

অন্থকাল আরও বাড়ে। দক্ষিণের হাওয়া বয়—ময়দানবের ইন্দ্রপুরী থেকে দুজন নির্বাসিত মানুষ এক নারীর অন্বেষণে অন্ধকালে হাঁটে। অন্থকালে মাঠ ভাঙে। আর পুষ্পবর্তী লণ্ঠন হাতে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে, মানুষটা কখন ফেরে সেই আশায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *