ঝুমির দুঃখ

ঝুমির দুঃখ

সকালবেলায় যে কী হয়, কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতে চায় না ঝুমি। বিরক্ত বিরজা সুন্দরী। গজগজ শুরু সক্কালবেলাতেই।

নে ঝুমি। যত পারিস ঘুমিয়ে নে। বেলা কত হল টের পাস না। জীবনেও পাবি না। দ্যাখ তোর কপালে কী লেখা আছে। সোমও মেয়ে, ঘুম তোর ভাঙে না। কবে ভাঙবে। আমি মরলে!

ঝুমি লেপ-কাঁথায় মুখ ঢেকে পড়ে আছে। বুড়ির চোপা শুরু হয়ে গেছে। সে কিছুতেই সাড়া দেবে না। চেঁচাক, চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করুক তবু সাড়া দেবে না।

বিরজা সুন্দরী সাতসকালে উঠে কে কী করছে, সে চোখ বুজেও টের পায়। আকাশ পরিষ্কার না হতেই উঠে পড়ার অভ্যাস। এক সঙ্গে এক তক্তপোশে শোয়। কাক ডেকে গেলেই, দুগগা দুগগা শুরু হয়ে যায়। উত্তুরে হাওয়ায় দরজা খুললেই ঠান্ডায় টাল মেরে যায় ঘরটা। দরজা খুলে কখন বের হয়েছেন তাও সে জানে। উঠোনে নেমে হাত জোড় করে সূর্যপ্রণাম। তারপর ঘটি নিয়ে কলতলায়। তারপর একখানা বালতিতে গোবর জল। সারা বাড়ি গোবর ছড়া। ঘর থেকে এঁটো বাসন কলতলায় নিয়ে যাওয়ার সময় একবার ডেকে গেছেন, ঝুমি ওঠ। হাত মুখ ধো। তোর মেশোর বাড়ি যেতে হবে। গোছগাছ করে না দিয়ে গেলে এক হাতে পারি। সে সাড়া দেয়নি।

চালাঘরটা গোবর জলে লেপে দেওয়ার সময় আবার ডেকেছে, কত বেলা হল। একটু চা করে আমাকে দে! তুই খা। সাইকেলটা মেরামত না করলে যাবি কী করে। অধরকে বলেছি, ঝুমির সাইকেলটা পাচার হয়ে গেছে। মেরামত করে দিস, খোকার টাকা এলে দিয়ে দেব। ও ঝুমি, কী বলছি, কানে কী যাচ্ছে তোর!

ঝুমি সারা দেয়নি।

সে বলতে পারত, এত সকালে উঠে কী করবটা শুনি। রোজ একই কথা কাঁহাতক ভালো লাগে। কিছুই করতে দেবে না। হাত-পা নোংরা হবে। শরীরে গোবরের গন্ধ লেগে থাকবে। সকালবেলায় জল ঘাঁটাঘাঁটি করলে হাতে, পায়ে হাজা হবে। পাত্রপক্ষ দেখতে এলে পছন্দ হবে না।

ঝুমির তখন মরে যেতে ইচ্ছে হবে। পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে শুনলেই তার মাথা গরম হয়ে যায়। কাল রাত থেকেই পাত্রপক্ষর আসা শুরু হয়েছে। সকালে উঠতে হবে। বড়ো মাসিকে খবর দিতে হবে। কত কথা বুড়ির পারব না। তার এক কথা।

তোর ঘাড় পারবে। পারবে না। ঘরের খুঁটি হয়ে থাকতে চান। বলবি, কৃপানাথ খোঁজ দিয়েছে পাত্রের। লেবুতলায় বাড়ি। পাত্রের বাজারে চালের দোকান আছে। একটু বয়স বেশি, দোজবর। তাতে কী কিছু কমতি থাকে পুরুষ মানুষের?

আমি কোথাও যেতে পারব না। খুঁটি হয়ে থাকি আর বাঁশ হয়ে থাকি, পারব না।

এত ভালো পাত্র হাতের কাছে কোথায় পাব। কৃপানাথ বলেছে ঝুমি মাথা। পাতলে হয়ে যাবে।

দিদা, তুমি চুপ করবে।

আমি চুপ করব কেন। কী খারাপ কথা বলছি। পাত্র কী খারাপ কথা!

আবার পাত্রপক্ষ চেঁচিয়ে দ্যাখ কী হয়।

বিরজা সুন্দরী ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলেন, পাত্রপক্ষ বললে তোর এত মাথা গরম করবার কী আছে বুঝি না। চেষ্টা তো কম করছি না। কাকে না ধরেছি। কেউ মাথা পাতে। তোর মামারা তো হাত ধুয়ে বসে আছে। বাপের খবর নিতে গেলে গোপের বাগে যেতে হয়। কে যায়। তার কী মাথায় আছে, মা মরা মেয়েটার হিল্লে করা দরকার। সে কী মানুষ! মরেছি, কী বেঁচে আছি তারও খবর নেয় না।

ঝুমি চুপচাপ চা না খেয়ে বের হয়ে যেতে পারে। মদনের বউর ঘরে গিয়ে বসে থাকতে পারে, কথায় কথায় খাওয়ার ওপর এত রাগ যে, দিদা তখন জলে পড়ে যায়। সে গুম মেরে গেলে তাকে বেশি ঘাঁটায় না।

এই সেদিন ফের আর এক নতুন পাত্রপক্ষ হাজির। সাঁজবেলায় কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসেই বলেছিলেন, ছেলেটার সঙ্গে তোর যদি হয় রাজযোটক হবে। বি এ পাস। কিছুদিন মাথা খারাপ ছিল। কেবল বসে বসে কাগজ ছিড়ত। থুতু ছিটাত। খুব মেধা। বি এ পাস সোজা কথা। পড়তে পড়তে মাথা খারাপ। শহরে কোঠাবাড়ি আছে। টাকাপয়সা বাপ যা রেখে গেছে তোদের চলে যাবে। ছেলেটি দেখতেও বেশ। লম্বা দশাসই চেহারা। তোর সঙ্গে মানাবে ভালো। তারপর কেন যে বলেছিলেন, এক গ্লাস জল দে। এতটা রাস্তা, হেঁটে কী আসা যায়! রিকশাওয়ালারা সব নবাব। এটুকু রাস্তা বলে কী পাঁচ টাকার কমে হবে না দিদিমা। তোদের মুণ্ডু, দ্যাখ বুড়ি পারে কী না। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম। কৃপানাথ নিয়ে গেছিল—শহরে কাজ আছে বলে সঙ্গে ফিরতে পারেনি।

জল সে দেয়নি। তার মাথা গরম। পাগল ছাগল বা যা পাওয়া যায়। ভেবেছে কী! সে গুম হয়ে বলেছিল কিছুক্ষণ। তারপর বলেছিল, জল নিয়ে খাও। কে বলেছিল যেতে।

ঝুমির সঙ্গে পাত্রপক্ষের কথাবার্তায় বিরজা সুন্দরী কখনও মাথা গরম করেন। অনেক সময় ঝুমির সামনে পাত্রপক্ষের কথা তুলতেও আতঙ্ক বোধ করেন। কত যে সম্বন্ধ এল। ঝুমি সামান্য প্রতিবন্ধী। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটার স্বভাব। বিরজা সুন্দরী আর কী খুঁত আছে বোঝেন না। লোক আসে, দেখেও যায়, কী সুন্দর চোখ ঝুমির। হাতে পায়ে লাবণ্য ঝরে পড়ছে। সেই ঝুমি এক গ্লাস জল না দিলে যে পাপ হবে, তাও বোঝে না। বিরজা সন্দরী সব সয়ে গিয়ে, নিজেই জল ভরে খেয়েছিলেন। ঢকঢক করে জল খেয়ে বলেছিলেন, মাথাখান তার তো ঠিকই আছে দেখলাম। আমার সঙ্গে কী সুন্দর কথা বলল। মাথার দোষ সেরে গেছে। একটাই দাবি—আইন পাস করলে বিয়ে।

ঝুমি চৌকাঠে হেলান দিয়ে শুনছিল। ঘরে একখানা হ্যারিকেন জ্বলছে। দাওয়ায় কুকুরটা শুয়ে আছে। চালাঘরটায় একটা কুপি জ্বলছে। বাড়িটা অন্ধকারে ডুবেছিল। তারকের মার গলা পাওয়া যাচ্ছে। দিদার খবর নিতে এসে সেও বসে গেছে। ঠিক, বুড়ি পাত্রের খবর নিতে যাওয়ার সময় সাত কাহন করে সবাইকে বলে গেছে। সম্বন্ধ এলেই বুড়ির যেন বেশি দুটো হাত-পা গজায়।

তারকের মা এক মুখ জর্দা মুখে পান চিবাচ্ছিল। আর চর চর কথা বলছিল।

কথা হল!

হল রে মা! আমার হলে তো হবে না। ওর মেসো মামারা দেখুব বলে কথা, সাত মণ ঘি না পুড়লে হয়!

কোনো দাবি দাওয়া!

দাবি দাওয়া আর কী করবে? বললাম, মা মরা মেয়েটাকে উদ্ধার করেন। ঝুমি আমার শরীর দিয়ে পুষিয়ে দেবে।

থামবে! চেঁচিয়ে উঠেছিল ঝুমি।

শরীর দিয়ে পুষিয়ে দেবে কথাটা কত অশ্লীল, দিদা বোঝেন না। ঝুমার জ্বালা ধরে যায়। তারকের মা সবিধের নয়, সম্বন্ধ না হলে কেচ্ছা ছড়াবে। দিদা কেন যে বোঝেন না। তার ঘর থেকে বের হয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কোথায়ই বা যাবে। মদনদা বউকে নিয়ে বেথুয়াডহরি গেছে। দুই মামির বাড়ি জমি পার হলে। ইলেট্রিকের লাইট এয়েছে এই গরিমাতেই মামিদের পা পড়ে না মাটিতে। সেজমামি টিভি কিনেছে, আগে সন্ধ্যা হলেই ছুটে যেত। এখন আর তার তাও যেতে ইচ্ছে করে না।

তুই ঝুমি ফোঁস মনসা—কোনও কথা বলা যায়! কথায় তোর এত বিষ, ওঝার খোঁজে আছি, আসুক, বিষ কী করে নামাতে হয় তখন টের পাবি।

সে উঠে পড়েছিল। উঠোনে কাঁঠালগাছ, তার ছায়ায় একা দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ।

তুই আবার কেথায় গেলি! আলো নিয়ে উঠোনে বের হয়ে এসেছিলেন বিরজা সুন্দরী। তারকের মাও বের হয়ে এসেছে। তারকের মা বলল, যা ঘরে যা। অশান্তি করিস না। খোঁজখবর না নিয়ে তো আর কথা পাকা হচ্ছে না।

ছেলে কী করে কাকিমা?

বিরজা সুন্দরী বললেন, কিছু করে না। আইন পড়তে চায়। একটাই দাবি কলকাতায় রেখে আইন পড়াতে হবে। তা আমার খোকাকে লিখলেই হবে। দুটো তো বছর, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আইনটা পাস করিয়ে দিতে লিখব। থোকা আমার কথা ফেলতে পারবে না।

তারকের মা সব খবরই নিয়ে চলে গেল। মাঝে মাথা খারাপ ছিল। এখন ভালো আছে। সুস্থ আছে। বি. এ. পাস। ঝুমি কিছু পাস না করা মেয়ে, বি, এ, পাস ছেলে পাওয়া কত কঠিন, তাও স্বীকার করে চলে গেল!

দেখুন মেয়েটার ভাগ্য যদি খোলে। নিয়তি বলে কথা। উঠোনে দাঁড়িয়েই বিরজা সুন্দরী আর তারকের মার কথা হচ্ছিল। ঝুমি ঘরে ঢুকে, ঠাকুরের ফটো থেকে ফুল বেলপাতা সরিয়ে সিল্কের কাপড় দিয়ে তারকেশ্বরের ফটো ঢেকে দিল। এই কাজগুলি করলে মনে সে শান্তি পায়। জ্বালা থাকে না। কে কী বলছে শুনতেও তার ভালো লাগে না। রাতে সামান্য ভাত করে নিলেই হয়। দিদা দুধ রুটি খান। সে চালাঘরটায় ঢুকে আটা মাখতে বসে গেল।

বিরজা সুন্দরী তারকের মাকে কিছুটা রাস্তা এগিয়ে দিতে গেছেন। কুকুরটা দিদার পিছু নিয়েছে। সে একা। পাটকাঠি জ্বেলে খড়কুটো আখায় ঢুকিয়ে দু-হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে দিয়েছিল।

বিরজা সুন্দরী ঢুকতেই সে টের পেল, দিদার কথা শেষ হয়নি। নিজে নিজেই বকছেন। বয়স হলে এই বুঝি হয়। সারাদিন প্যাচাল ছাড়া থাকতে পারেন না। তা রাজি হয়ে এলাম। বলে এলাম, আমার বড়ো পুত্র খুবই বিবেচক মানুষ, মার কথা ফেলতে পারবে না। আপনার ছেলে আমাদেরও ছেলে। একটা চিঠি লিখতে হবে, তোর মেসোকে দিয়ে। বুঝলি ঝুমি, সকালে তোর বড়ো মাসিকে খবর দিবি। ওরা দুজনে যেন চলে আসে। তোর সেজমামাকেও আসতে বলবি। সবাই পরামর্শ করে একখানা চিঠি লেখা দরকার। আমার বড়ো পুত্রের কোনও অভাব আছে! ঠাকুর চাকর, মেলা ঘর। দোতলার একখানা ঘর না হয় ছেড়ে দেবে। দুটো তো বছর। বুঝিয়ে লিখলে ও মাথা পাবে। ওর তো এক কথা, সব করব মা, কিন্তু পণ দেব না। আরে বাবা, পণ ছাড়া বিয়ে হয়! পণ না দিলে মেয়ের ইজ্জত থাকে—তা তুই তোর কথাও রাখ, মার কথাও রাখ। পণ চায়নি, আইন পড়তে চেয়েছে। পরের ছেলেকে পড়ালে পুণ্য হয়। খোকা নিজেও তো পরের বাড়িতে মানুষ। তোর রাঙাকাকা না নিয়ে গেলে, তোর রবরবা থাকত কোথায়! পরের ছেলে লোকে মানুষ করে না! ঝুমির ভবিষ্যৎ বুঝবি না।

ঝুমি কোনও কথা বলেনি। যায় কথা ফুরিয়ে যাওয়ার কথা, তারই এখন কত রাজ্যের কথা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয়েছে, সকালে উঠে সাইকেলটা অধরের দোকানে নিয়ে যাবি। পানচার ঠিক করে নিবি। আমার হাতের কাজ এগিয়ে চলে যাবি মেসোর কাছে। থেকে যাস না আবার। বড়ো মাসির কী! বোঝে, আমার কষ্ট বোঝে। আদর করে পাঁচ পদ খাওয়ালে, এটা ওটা দিয়ে ভরে রাখলেই কী শরীর বোঝে!

ঝুমি আর পারে!

সে লেপ কাঁথা সরিয়ে কথা এড়িয়ে উঠে গেল। কলপাড়ে গিয়ে হাতমুখ ধুল। যাপার গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় নেমে বলল, দিদা তুমি কী আরম্ভ করলে সকালে উঠে বলত।

কী আবার আরম্ভ করলাম।

এমন মুখে তাকিয়ে থাকলেন বিরজা সুন্দরী যে ঝুমি কী বলবে আর ভেবে পেল না। চোখে এক অপার্থিব শূন্যতা—যা দেখলে বড় কষ্ট হয় তার। কতদিন থেকে সে যেন সত্যি দিদার গলার কাঁটা হয়ে আছে। এত উচাটনে থাকে যে, মাঝে মাঝে মনে হয়, বুড়ির না শেষে মাথা খারাপ হয়ে যায়। হয়ে যে যায়নি তাই বা কে বলবে—তা না হলে বড়ো মামাকে চিঠি লিখবে ভাবতে পারে! কে না কে— তার স্বভাব চরিত্র কেমন, সেখানে গিয়ে ফের পাগলামি শুরু হতে পারে। মামি পছন্দ করবেন কেন! কোনও অপরিচিত লোককে, কেউ বাড়িতে রেখে জামাই আদরে খাওয়াবে দিদাই ভাবতে পারে।

তা দিদার কথা ভেবে হাসিও পাচ্ছিল, আবার কেন যে কান্না পাচ্ছে।

সে আখায় খড়কুটো জ্বেলে চা করে দিল দিদাকে। চা খেয়ে দিদার মাথা ঠান্ডা হয়। ঠান্ডায় কুঁকড়ে আছে। আগুনের পাড়ে বসে বিরজা সুন্দরী তার স্বপ্নের কথা শুরু করে দিল।

তোর দাদু, বুঝলি, তোর দাদুর বাবা, মানে আমার শ্বশুর, আমাকে কোথায় দেখেছিলেন জানিস?

কোথায়!

আমাদের এক শিষ্য বাড়ি। দেখেই পছন্দ। বাবা আমার সেকেলে মানুষ, শিষ্য বাড়িতে দেখলে তো হবে না। বাড়ি গিয়ে দেখতে হবে। শ্বশুরমশাই তাতেও রাজি। কোনও বরপণ দিতে পারবেন না, তাতেও রাজি। আমার গরিব বাবার কন্যাদায়, কী বুঝে যে তোর দাদুর বাবা বলে ফেললেন, দেখুন বেয়াইমশাই, কন্যাটি আমাদের রত্ন—যদি দোষ না ধরেন বলি, তুলে নিয়ে না হয় স্বগ্রামে নিয়ে যাব। সেখানেই বিয়ে হবে। ব্যাণ্ড পার্টি বাজিয়ে একটা মিছিল বুঝলি, পালকিতে আমি আর আমার ছোটো বোন সরণি। অচেনা জায়গা, অদেখা মানুষ তারাই তো শেষে নিজের হয়ে গেল! তুই এত ঘাবড়ে যাস কেন বল তো, খোকাকে বুঝিয়ে বললে, ও বুঝবে না মনে করিস।

আমি কিছু জানি না।

এটা তোর রাগের কথা ঝুমি। ইস চায়ে মিষ্টি দিসনি! মাথা দেখছি তোরও ঠিক নেই।

তোমার পাল্লায় পড়লে কারও মাথা ঠিক থাকে! তুমি কৃপাদাকে নিয়ে চলে গেলে। বড়োমাসি বলেছে না, ও একটা ঠক জোচ্চোর—ঘটকালি করে খায়, ওর পাল্লায় পড়বে না।

আরে নিজ চোখে বাড়িঘর দেখে এলাম, মিছা কথা হবে কেন।

সে যা ভালো বোঝ করো।

তুই তবে চলে যা। কল থেকে দু-বালতি জল তুলে রেখে যাস। সাইকেলে চলে যাবি। এক ক্রোশ রাস্তা কতক্ষণ লাগে বল। তোর ঠেটা স্বভাব, যেখানে যাবি উঠতে চাস না। আসার সময় বাজার হয়ে আসিস। ভালো মাছটাছ পেলে আনবি। কৃপানাথকে খেতে বলেছি। গরিব মানুষ, এক ডাকে সাড়া দেয়। আমার আর কে আছে বল! সত্যি দিদার কেউ নেই। শেষে সেই পালকি সুন্দরী আজকের বিরজা সুন্দরী। সবাই উড়ে চলে গেছে। খোঁজখবরও বড়ো একটা কেউ রাখে না। দুই মামা, পাশেই বাড়ি করে আলাদা থাকে, তাদের যে দিদা পেটে ধরেছে এখন দেখলে, তাও মনে হয় না। তাকেও উড়িয়ে দেবার মতলবে কত ফন্দি মাথায় নিয়ে যে ঘুরছে।

বড়োই কাতর অনুরোধ। যা দুটো রুটি করে দিচ্ছি, খেয়ে চলে যা। আমার কী কষ্ট আর কেউ বোঝে।

ঝুমি এখানটাতেই বড়ো দুর্বল বোধ করে। কিন্তু তার তো ইচ্ছে হয় না যেতে। কোনো মেয়ে কবে তার পাত্রপক্ষের খবর দিতে মাসির বাড়ি যায়, সে জানে না।

সে সাইকেলে বড়ো মাসির বাড়ি রওনা হলেই টিটকারি, কী রে ঝুমি মাসির বাড়ি যাচ্ছিস?

সে সাড়া দেয় না।

কী রে ঝুমি কোনও খবর বুঝি এসেছে!

সে সাড়া দেয় না।

সাইকেল চালিয়ে যায় ঠিক, সবাই জানে সে মাসির বাড়ি যাচ্ছে পাত্রপক্ষের খবর দিতে।

দিদা বোঝেই না, একটা মেয়ের পক্ষে এটা কত অসম্মানের কথা! লজ্জার কথা।

সে সাইকেলে উড়ে যেতে থাকলেই টের পায়, দিদা খবর দিয়ে বেড়াচ্ছে।

ও ঠানদি ঝুমি কোথায়!

আর কোথায় রে ভাই। পাত্রপক্ষের একটা খবর পেলাম। ওর মাসি-মেসোকে খবর দিতে বললাম। সেখানে গেছে। আমার আর কে আছে, যাবে। তার তখন শুধু কান্না পায়। সাইকেলে সে যায় ঠিক, তবে সে গোপনে কাঁদেও। আজ তার কী যে মনে হল, সে কিছুতেই খবরটা দেবে না ঠিক করল। দিদার মাথা খারাপ হতে পারে, তার তো মাথা খারাপ হয়নি।

কিছুটা রাস্তা গিয়ে মনে হল, না গেলে অথর্ব শরীর নিয়েই বুড়ি হাঁটা দেবে। সে আর কী করে। মাসি-মেসোকে খবর দিয়ে সোজা চলে এল। বড়ো মাসি গেল, মেসো গেল পাত্রপক্ষের বাড়ি। তারাও ঝুমিকে দেখে গেল।

খুবই পছন্দ।

তার কিছু ভালো লাগে না। সে যে কী করে!

চিঠিটাও লেখা হয়ে গেল। ইনল্যান্ডে ইনিয়ে বিনিয়ে দিদা বড়ো মামাকে লিখেছে, এটা আমার শেষ কাজ বাবা। অমত করিস না। চিঠিটাও ঝুমিকে ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। ক্ষোভে দুঃখে তার চোখে জল এসে যায়।

চিঠিটা পেলেই মামির মুখ গোমড়া হয়ে যাবে। চিঠিটা পড়লেই ক্ষেপে যাবে মামি। মামা বেচারা মুখ গোমড়া করে বসে থাকবে। কিছু বলতে পারবে না।

গাছপালার ছায়া পার হয়ে অন্তহীন এক পথ চলে গেছে মনে হল তার। চিঠিটা দুবার বের করল ব্লাউজের ফাঁক থেকে। মনটা তার ভার হয়ে আছে। মামিমা ঠিকই টের পাবে, চিঠি ঝুমিই ডাকবাক্সে ফেলেছে। এত বেহায়া মেয়ে—ভাবতেই পারে। তার জন্য দিদা খাটো হয়ে যাবে। সে চিঠিটা দেখল। চারপাশে তাকাল। খালি মাঠ। স্কুল ছুটি। অদূরেই আছে ডাকবাক্স। ফেলার আগে কেন যে মনে হল, এ চিঠি মরে গেলেও ডাকবাক্সে ফেলতে পারবে না। দিদার করুণ মুখখানিও ভেসে উঠল। চিঠিটা ছিঁড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতেই তার সমস্ত ভার যেন লাঘব হয়ে গেল।

বাড়ি ফিরে এলে দিদার এক কথা, ঠিকমতো ডাকবাক্সের ভিতর ফেলেছিস ততা। ঠিকমতোই তো ফেললাম। ঠিকমতোই যাবে। এক গ্লাস জল দাও। খুব তেষ্টা। মিছে কথা বললে কী জলতেষ্টা পায়। তার এত তেষ্টা কেন!

দিদা যত্ন করে এক গ্লাস জল দিল। সে জলটা খেতে গিয়ে বিষম গেল। সারা ঘর জলময় হয়ে গেল। সে শুধু কাশছে। এত প্রবল কাশি যে মুখ ফুটে আর একটা কথা বলতে পারল না। সরল সাদাসিধে এই বৃদ্ধাকে মিছে কথা বলতে গেলে এত কষ্ট হয়, আগে জানত না। আজই সে তা টের পেল। তার চোখ ফেটে জল আসছে। কী নিশ্চিন্ত মুখ। প্রশান্ত চাউনি দিদার। সে সহ্য করতে না পেরে উঠোনো বের হয়ে গেল। মাথার ওপর আকাশ। না হলে দিদার কাছে ঠিক ধরা পড়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *