1 of 2

পৃথিবী তারপর শব্দগন্ধহীন

পৃথিবী তারপর শব্দগন্ধহীন

ছুটির দিনে সুবিনয় অন্যরকমের। অন্য দিনগুলোর মতো সে সেদিন কিছুতেই তাড়াহুড়ো করে না। ঘুম থেকে উঠতে তার দেরি হয়ে যায়। বিছানায় এপাশ ও পাশ করার স্বভাব। সে সকালে সেদিন বাজারে পর্যন্ত যায় না। নিবারণ বাজার করে আনে। ওর তখন সারাটা সকাল কেবল চিৎকার চেঁচামেচি। সিগারেটের প্যাকেটটা কোথায় গেল। বুক পর্যন্ত চাদর টেনে শুসে থাকার স্বভাব। ছ-দিনের খাটাখাটনি একদিনে সে পুষিয়ে নিতে চায়। সে সেদিন কুটোগাছটি পর্যন্ত নাড়তে চায় না।

আর যখন মা থাকে না, পলু থাকে না তখনও সে এ-ভাবে জীবন কাটাতে ভালবাসে। ছুটির দিনে সে বাড়িতে খায় না। নিবারণকে খাবারের পয়সা দিয়ে দেয়। সে কোনো হোটেলে খেয়ে নেয়। সন্ধ্যা সকাল বিকেল এখন শুয়ে থাকা। কোনো গল্পের বই পেলে কথা থাকে না। গল্পের বই পড়তে পড়তে কখনও মনে হয় আজকাল কেউ তাকে ডাকছে।—বিনুদা, দরজা খোল। আমি অপু। আর তখনই এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা। মাথার ভেতর মনে হয় গির্জার ঘণ্টা বাজছে। অথবা মনে হয় রেলগাড়ি চলে যাচ্ছে দূরে। অথবা কোনো প্রপাতের শব্দ। সে তখন চুপচাপ শুয়ে থাকতে ভালোবাসে। আসলে কেউ তাকে ডাকে না—সে এটা বুঝতে পারে।

তারপর যা হয়, বিকেল গড়িয়ে গেলেই বিনু আর শুয়ে থাকতে পারে না। জানালা খুলে দিলে বুঝতে পারে বিকেলের সূর্য রেল-ইয়াডের ও-পাশে নেমে গেছে, গাছের ছায়া লম্বা হয়ে যাচ্ছে। ছোটো ছোটো সব ফুলের সমরোহ চারপাশে। ফুলগুলো সব সে ঠিক চেনে না। শহরে এদিকটাতে কোথাও কোনো সবুজ মাঠে সব সুন্দর সুন্দর বাড়ি। লনে কোথাও মেয়েরা টেনিস খেলছে। সে জানালা খুললে এসব দেখতে পায়। মেয়েরা টেনিস খেললে ওর দেখতে ভীষণ ভালো লাগে।

সে কখনও কখনও এ-ভাবে বিকেলটা কাটিয়ে দেয়। সামনে অ্যাসফালটের কালো রাস্তা কোথায় চলে গেছে সে যেন সঠিক জানে না। রাস্তার দু-পাশে কোথাও কলের চিমনি, কখনো সাইরেনের শব্দ, আর কখনো সব গাড়ি হুসহাস বের হয়ে যাচ্ছে। তখন নিবারণ আসে, হাতে এক কাপ চা। দাদাবাবু চা আপনার।

সে চোখ তুলে তাকায়। নামটা মনে করতে পারে নিবারণ। নিবারণ অনেকদিন ওর সঙ্গে থেকে গেল। অনেকদিন কোনো মানুষ একসঙ্গে থেকে গেলে আপনি মায়া গড়ে ওঠে। অপু তার সঙ্গে অনেকদিন ছিল। ছুটির দিনগুলো তখন এত একঘেয়ে মনে হত না। বড় সহজে ছুটির দিনগুলো তার শেষ হয়ে যেত। তারপর কেমন রাখতে হয়—এই এতটা অ্যান্টি লিখব, নইলে পাবলিক নেবে না, কিন্তু লাইনটা খুব মোটা করে টানা আছে, দাস ফার অ্যান্ড নো ফাদার।

রাত্রি আর একটু গভীর হয়ে এসেছে, কলধবনি এখন শান্ত, আর সেই শান্ত পরিবেশে নক্ষত্রখচিত আকাশের নীচে উঠেছে সেতারের মদ ঝঙ্কার। কার্পেটের ঠিক মাঝখানে বসেছেন আলি সাহেব, তার চোখ বোজা আর শীর্ণ আঙুলগুলো ওঠানামা করছে সেতারের গা বেয়ে—কোমল মৃদু সেই স্পর্শ, যেন অভিমানী প্রিয়ার কপট ঘুম ভাঙানোর জন্যে প্রেমিকের ভীরু সঞ্চার।

আশে পাশে ছড়িয়ে আছে অনেক সুশ্রী তনু। অনেক কোমল মুখশ্রী নরম আলোয় আরও স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। অন্ধকারে হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠেছে কোনো নাকছাবি বা কর্ণভূষণ। তালে বা বেতালে মাথা নাড়ছেন লম্বাচুলের কোনো কোনো পুরুষ, আর্টক্রিটিক তারা বা কোনো সংস্থার কর্ণধার, কবি বা চিত্রাভিনেতা-তারা সকলেই বিশিষ্ট এবং বুদ্ধিজীবী।

একটু দূর থেকে লক্ষ্য করছিল জয়তী কার্পেটে না বসে সে বসেছে কোণের একটা হেলানো চেয়ারে। পরনে তার রূপোলি পাড়ের গোলাপি বেনারসি, হাতে কানে গলায় হিরের ঝিলিমিলি। মুখে তার তৃপ্তি মাখানো—সবাই এসেছে, সবাই এমনকী জয়ন্ত ভৌমিক অবধি। কি মায়াবী এই রাত্রি, কি মধুর এই সেতার, কী মোহন এই পরিবেশ… কিন্তু কিছু কি এতো ভালো লাগত যদি না এরা সকলে উপস্থিত থাকত? উষ্ণ ঘন মদের মতো এই উৎসবের প্রতিটি মুহূর্ত নিঃশেষে পান করছিল সে। এই পরিমণ্ডল রচনা করতে পারার ক্ষমতা তাকে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছিল। স্বপ্নালু চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো জয়তী।

সেতারের ঝঙ্কার দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। প্রিয়ার ঘুম ভেঙেছে বুঝি, প্রেমিকের আবেশ নিবিড় হয়েছে, অভিলাষ তীব্র থেকে তীব্রতর। তারারা আলো আরও উজ্জ্বল, সুরের মূৰ্ছনা ঢেউয়ের মতো উঠছে আকাশপানে। নূপুর পরা কচি পদপল্লব ছন্দে ছন্দে মূদু স্পন্দিত হচ্ছে। নিঃশব্দচারী বেয়ারারা স্ন্যাকস আর ড্রিংকস বদলে বদলে দিয়ে যাচ্ছে।

আপনার গ্লাস যে খালি, সোমনাথ আস্তে বলল। আরে না-না, আপনি ব্যস্ত হবেন। সে কী কথা, সোমনাথ গ্লাস নিয়ে উঠল, আর তক্ষুনি তার মাথা ঘুরে গেল। দু-এক সেকেন্ড সব অন্ধকার, তারপর কোণের বার-এর দিকে এগিয়ে গেল। আজকাল প্রায়ই এরকম হচ্ছে। ডাক্তার দেখিয়ে চেক-আপ করব তারই বা সময় কই? ব্যাঙ্গালোর যাবার আগে একবার—ভিড় গোলমাল আর সহ্য হয় না। জয়তী জানে সব, তবু কিছুমাত্র বিবেচনা নেই। সেতারটা কিন্তু সত্যি সুন্দর বাজাচ্ছে, সোমনাথের কপাল মুহূর্তের জন্যে মসৃণ হল, সহসা তাকে তরুণ দেখাল।

…তীব্র গভীর উন্মাদনা… তারপর মধুর মধুর ক্লান্তি। ধীরে ধীরে লীয়মান হল সুরের রেশ সেই প্রশান্তির বক্ষে। নিঃশ্বাস পড়ল টেবিলে টেবিলে আলো উজ্জ্বল হল, আর সুগন্ধী সুসজ্জিত এই সমাবেশ উজ্জীবিত, চঞ্চল, মুখর হয়ে উঠল।

মফতলালের শেয়ার সম্বন্ধে কী বলছিলেন তখন? ওহে, বুলু সেনকে জিজ্ঞেস করো তো রাজাধ্যক্ষ সত্যি কাজ ছাড়ছে নাকি? ওই তো জয়ন্ত ভৌমিক, বাঃ হ্যান্ডসাম সত্যি। মিসেস সিং, এতো দামি প্রেজেন্ট কেন? কিছু না কিছু না, মেনি হ্যাপি রিটার্নস—

চিকেনটা একটু দেখি, জয়তী আজ তুমি দেখছোই না আমাকে, আমি কিন্তু সেই তখন থেকে–আঃ ছাড় না, কি যে করো সন্দীপ, ডাকছি তোমার গিন্নীকে, ইটস হার্ড অন আস, উই পুওর ইন্টেলেকচুয়লস–

আচ্ছা—খুব এনজয় করলুম, আবার নেকসট ইয়ার, সত্যি চমৎকার কপল। যাই বলো জয়তী যেন একটু—মানে সবই ভালো—তবু যেন একটু, ডোন্ট বি ক্যাটি ডার্লিং–

রাত্রি আরো গভীর, লনের আলো নিভে গেছে। বিশাল হলে ছড়িয়ে আছে সিগারেটের টুকরো, ফুলের পাপড়ি আর রঙিন কাগজ। তাপ-নিয়ন্ত্রিত শোবার ঘরে রাত্রির পোশাক পরে ঢুকল সোমনাথ, বিছানা থেকে জয়তী হাত বাড়িয়ে স্বামীকে কাছে ডাকল।

তোমার জন্যে কী এনেছি বলো তো? জয়তী কৌতুকভারে—ব্রীড়াভরে হাসল, তারপর সিল্কের চাদরের তলা থেকে একটা প্যাকেট বের করে আনল।

সোমনাথ খুলল মোড়কটা, ঝকমকে পিতলের একটা পাত্র বের করল।

কি এটা?

আইস টাম্বলার।-সুন্দর না?

আইস রাখবে কী করে এতে? মুখ তত খোলা, বরফ গলে যাবে না?

গলে যাবে?-আচ্ছা যদি মুখটা ঢেকে দেওয়া যায়?

তবুও গলে যাবে, দেখছ না চারিদিকে পার্ফোরেটেড?

ও–।

আর কোনো কথা হল না। নিঃশব্দ ঘরে এরার কন্ডিশনারটার একঘেয়ে গুজন স্পষ্ট হয়ে উঠল।

দুটো একটা শব্দ, হাসি, রিনরিন করে বাজনার মতো যেন কার গলা ভেসে আসে। এই ওঠো। আর না। প্লিজ ওঠ না।

-এত তাড়াতাড়ি উঠবে।

–মাকে বলেছি পুনুর সঙ্গে সিনেমায় যাব। এখন না ফিরলে ভীষণ ভাববে। তারপরই কানে কানে ফিসফিস করে কথা বলার মতো শব্দ ভেসে আসে তিনটের শো কটা অবধি থাকে মশাই।

তখন বিনু ঘড়ি দেখত। কানের কাছে এনে দেখত, ঘড়ি ঠিক চলছে, না চলছে না। তারপর বলত, আর একটু বসি। সাতটা মাত্র বাজে। তুমি চলে গেলে ভারি একা হয়ে যাব আমি।

অপু আর কিছু বলতে পারত না তখন। সে তার সব জোর হারিয়ে ফেলত বুঝি। ঘাসের ভেতর সে পা আরও ডুবিয়ে দিত। শাড়ি টেনে আরও পা ঢেকে বসত। অস্পষ্ট আলো থাকত তখন চারপাশে। মাঠের এ-দিকটা ভারি নিরিবিলি মনে হত তাদের। সামান্য ঝোপ-জঙ্গল পাশে। ওরা বেশ সুন্দর করে ছেলেমানুষের মতো কখনো আইসক্রিম খেত, কখনো চা, অথবা কখনো বেলুন উড়িয়ে দিতে ভালোবাসত আকাশে। এবং মাঠের গাছপালার ভেতর ওরা হেঁটে যেতে যেতে কখনও ভারি অন্যমনস্ক হয়ে যেত।

—এই বিনুদা, কী ভাবছ!

–কিছু না।

–তা হলে দাঁড়িয়ে পড়লে কেন!

–দ্যাখো দ্যাখো অপু কি সুন্দর নীল আকাশ! আর কত বড়ো।

অপু বলত, ও আবার দেখার কি আছে।

বিনু বুঝি বলতে পারত, আকাশ মানুষের কাছে সব সময় নীল থাকে না। সব সময় এত বড়ো দেখায় না। অপু তোমার সঙ্গে হাঁটলে, আকাশটাকে ভীষণ নীল মনে হয়, আকাশটা মনে হয় ভীষণ বড়। ইচ্ছে করে তখন আমরা আকাশটা ছুঁয়ে দি। তারপর সহসা ভীষণ সতর্ক গলায় বলত—তোমার আকাশ ছুঁতে ইচ্ছা করে

অপু। অপু পায়ের নোখে তখন মাটি খুঁড়ত। ওর মুখ দেখা যেত না। স্যাম্পু করা চুলে ওর মুখ ঢেকে থাকত। বিনুর বার বার ইচ্ছে হত চুল সরিয়ে ওর সুন্দর মুখ দেখবে। ওর ইচ্ছে হলেও সে সেটা কিছুতেই পারেনি।

বিনু তখন ভয়ে ভয়ে বলত, তুমি কিছু মনে করলে?

অপু তেমনি মুখ না তুলে বলত, না।

-তবে বল ছুঁতে ইচ্ছে করে কি না?

আপু বলেছিল করে।

আর বিনুর কি যে হত তখন। মাথার ভেতর আবার সেই রিনরিন বাজনা। যেন সে দু-হাতে তখন চারপাশের যা কিছু আছে সব লুটেপুটে নেবে। সে যেন লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটবে। সে আর অপু। অপুর শাড়ি তখন বাতাসে উড়বে। আর সুন্দর সব গাড়ি ঘোড়া চারপাশে। তখনও সে আর অপু। কেবল কোথাও কেউ ক্ল্যারিওনেট বাজাবে—তখনও সে আর অপু। পৃথিবীতে শুধু সে আর অপু। আর কিছু সে ভাবতে পারত না। আর কিছু তার মনে থাকত না।

অপু বলত, আমরা তারপর কি করব বিনুদা?

বিনু বলত, আমরা কিছু করব না, শুধু ফুল ছিঁড়ে খাব।

অপু বলত, তুমি ভারি খারাপ কথা বলতে পার বিনুদা।

এ-ভাবে ওরা চুপচাপ কথা বলত। ছুটির দিনগুলো সে অপুকে নিয়ে এভাবে ঘুরত। সে জানত না, অপুরা কখনও প্রবাসী হয়ে যেতে পারে। সে বুঝতে পারত না অপুর বাবা এটা পছন্দ করবেন না। আর অপুর স্বভাবতে ভীষণ নরম। অপু কষ্ট পাবে, কিন্তু কেউ তার জন্য কষ্ট পাক অপু তা চায় না। বিনুর মনে হয় দিনগুলো একইভাবে কেটে যাবে। তার তখন অফিসে সামান্য কাজ, সামান্য বেতন, সে বড়ো বলে দায়দায়িত্ব বেশি। ছোটো ফ্ল্যাট ছোটো সংসার মা আর পুনু। পুনুর সঙ্গে অপুর ভীষণ ভাব অপু পুনুর কলেজের বন্ধু। পুনুই প্রায় এক সন্ধ্যায় অপুকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল তার কাছে। বলেছিল দাদা এই হচ্ছে আমাদের অপর্ণা রায়। আমরা কলেজের বন্ধুরা ওঁকে অপু ডাকি। ভারি মিষ্টি দেখতে না দাদা।

অপুর দু চোখ ভারি। অপু সেদিন কিছুতেই মুখ তুলে তাকাতে পারেনি। ওকে খুব সুন্দর বলে পুনু কি যে বিপদে ফেলে দিয়েছে। শিরশির করে রক্তচাপ সারা শরীরে তার। সে তো আগেই দেখেছে বিনুদাকে। বিনুদার লম্বা গড়ন, ঘন চুল আর সহজ কথাবার্তা এত বেশি আকর্ষণ করেছিল যে সে একটা কথা বলতে পারেনি।

অপু একদিন বলেছিল, বিনুদা তোমাকে একটা কথা বলা দরকার।

বিনু মুখ তুলে তাকিয়েছিল। ওর মুখে মটন-ওমলেট। সে কথা বলতে পারছিল না।

অপু আবার বলেছিল, বাড়িতে সবাই টের পেয়েছে।

–কী বলছ। প্রায় বিষম খাবার মতো। আর তো তোমাদের বাড়ি আমার যাওয়া হযে না। ভাববে ভীষণ ধূর্ত আমি। বড়লোকের মেয়েকে ফুসলে নিয়ে যাচ্ছি।

অপু খুব গম্ভীর। খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। কথা বলছে না। বিনুও কেমন ভয় পেয়ে গেল। বলল, এই।

—বিনুদা সব কিছু নিয়ে তুমি ঠাট্টা করতে পার। আমি পারি না। ভেবেছি মাসিমাকে বলে তোমার কাছে চলে আসব।

অপুকে ভীষণ সাহসী দেখাচ্ছিল। অপু সেদিন পরেছিল, লালপেড়ে মুর্শিদাবাদ সিল্ক গায়ে নীল রং-এর ব্লাউজ—সাদা রং-এর জমিন ছিল ওর শাড়ির, আর কী যে স্নিগ্ধ লাগছিল ওকে দেখতে। কপালে বড়ো করে আলতার টিপ। সারা মুখ ছিল পবিত্রতায় ভরা। বেশ স্থির গলায় বলেছিল, তুমি তো বিনুদা ভীতুগোছের মানুষ। তোমার সব কিছু জোর করে না নিলে আমি কিছু পাব না।

বিনুর মনে হয়েছিল, অপু ঠিকই বলেছে। অপু এবং সে আলাদা স্বভাবের। অপুর বাবা এটা সহজে মেনে নেবেন না। অপু যত কথা বলতে বলতে গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিল তত তার ভয়। ভেতরে যেন খচখচ করে সংশয়ের কাঁটা ফুটছে। প্রাণের ভেতর থেকে কেমন সে আর সাড়া পাচ্ছিল না।

বিনু বলেছিল অপু একটু অপেক্ষা করতে হবে। পুনুর বিয়ে হয়ে যাক। মা শুনলে খারাপ ভাববেন। সংসারে আমি ভীষণ তা হলে স্বার্থপর হয়ে যাব।

অপু বলেছিল, বাবা দিল্লিতে বদলি হয়ে যাচ্ছেন।

–হঠাৎ।

তোমার হাত থেকে বোধ হয় আমাকে বাঁচাবার জন্য। অপু এমন বলতে পারত। সে কিছু বলল না। এ-সব বলে তার বাবাকে বিনুদার কাছে ছোটো করে দিতে পারে না। সংসারে যে অপুকে নিয়ে চাপা অশান্তি চলছে, কিছুতেই কেন জানি মুখ ফুটে কোনোদিন অপু বলতে পারল না। কোথায় যেন এতে ওর পারিবারিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছিল।

আর বিনু এটা কখনও বুঝতেই পারিনি। সে অপু এবং তার বাবা মাকে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল। অপু তেমনি হাসিখুশি ছিল। সে বুঝতেই পারেনি, অপুকে নিয়ে তার বাবা মা দূরে চলে যাচ্ছে। আর এদিকে সহজে ফিরছে না। সে স্টেশনে গাড়ি ছাড়ার সময় বলেছিল, গিয়েই চিঠি দেবে অপু। তোমার চিঠি পেলে ছুটি নিয়ে চলে যাব।

অপু বলেছিল, আচ্ছা।

তারপর আর অপু তাকে চিঠি দেয়নি। কতদিন হয়ে গেল। সে একটা চিঠির আশায় কতদিন জানালায় দাঁড়িয়ে থেকেছে। চিঠি আসেনি।

তারপর একদিন রোজ দশটা চিঠির মতো একটা চিঠি—তাও মার নামে। অপুর বিয়ে। সরল সহজ নিমন্ত্রণের চিঠি। আর কিছু না। কেয়ার অফ শুধু সুবিনয় মজুমদার। সে অপুকে যে একটা চিঠি লিখবে ভেবেছিল তাও আর পারল না।

এবং এ-ভাবে যখন বিনুর ছুটির দিনগুলো ভীষণ লম্বা হয়ে যেত তখন বার বার মনে পড়ত অপুকে। জানালায় দাঁড়ালেই মনে হয় অপু যেন বার বার তার হাত ধরে আকাশ ছুঁয়ে দেখবে বলছে, সে কিছুতেই পারছে না।

আর এ-ভাবে জানালায় দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারল ক্রমে সূর্য রেল-ইয়ার্ডের ও পাশে অস্ত যাচ্ছে। গাড়িগুলো টংলিং টংলিং শব্দ করে চলে যাচ্ছে। ক্রমে আকাশ অন্ধকার হয়ে উঠছে। নিবারণ ঘরের আলো জ্বেলে দিচ্ছে এক এক করে। আশ্চর্য শূন্যতার ভেতর সে এখন বেঁচে আছে। পুনুর বিয়ে হয়ে গেছে। মা মাঝে মাঝে তীর্থে চলে যান। এত বড়ো ফ্ল্যাটে সে আর নিবারণ। আর কেউ না। অপু এ-সব একেবারে জানে না। ওর তখন শুধু অপুর নামে একট চিঠি লিখতে ইচ্ছে হয়–তোমাকে পাওয়ার মতো সব কিছু হয়েছে আমার অপু। সুন্দর ফ্ল্যাট, বিশ্বস্ত চাকর ছোট্ট পুলের বাগান, দুটো নীর রং-এর বেতের চেয়ার, একটা ছোট্ট সাদা রং-এর গাড়ি। সবই হয়েছে। তবু ছুটির দিনে আর কোথাও যাই না। বাসাতেই শুয়ে বসে সারাটা দিন কাটিয়ে দিই। কোথাও বেড়াতে বের হলে নিজেকে বড় একা মনে হয় অপু। আমার কিছু ভালো লাগে না তখন।

তারপর মনে হয়ে বিনুর অপুকে সে যেন প্রতিদিন এ-ভাবে একটা চিঠি লিখতে পারে। প্রতিদিন একটা করে নীল রং-এর খাম ডাকবাকসে ফেলে দিয়ে আসতে পারে। কোনো ঠিকানা থাকবে না। শুধু নাম লেখা থাকবে অপু। চিঠিটা অপু পেল কি পেল না আসে যায় না। সে চিঠি অপুকে লিখেছে, তার নিজের কাছে এর চেয়ে বেশি দামি আর কিছু নেই। আর যদি কেউ এসে দেখতে পায়, ওর টেবিলে, বালিশের নীচে, ড্রয়ারে সেলফে সর্বত্র, এমন অনেক চিঠি, চিঠি লিখে রাশি রাশি কাগজ সারা ঘরে ছড়িয়ে রেখেছে—অবিশ্বাস করার কিছু নেই। বিনু সময় পেলেই অজস্র চিঠির বেলুন আকাশে উড়িয়ে দিতে ভালোবাসে। আসলে মানুষ বোধ হয় দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকতে ভালোবাসে। সবাই কিনা বিনু জানে না, তার তো বেশ ভালো লাগে।

আর তখনই মনে হয় মার মুখ অভিমানে ফেটে পড়ছে। বিনু, তুই আর বিয়ে-থা করবিনে। বয়স তোর জন্য বসে থাকছে!

সে হেসে বলত মা বিয়ে বিয়ে করছ, হয়ে গেলেই তো শেষ। সে কখনও ঠাট্টা করে বলত ইস আমার বিয়ে, ভাবতে কি মজা লাগে না। বিয়ের কথা ভাবলেই আর ঘুম আসতে চায় না মা। তারপর সে মায়ের মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলত, আচ্ছা মা, বাবার সঙ্গে যখন তোমার বিয়ের কথা হল, ঘুম আসত তোমার?

মা তখন ছোট্ট মেয়েটির মতো ফিক করে হেসে দিত। বলত, নাক ডাকিয়ে ঘুমোতাম।

-মা তুমি সত্যি কথা বলছ না।

–হ্যাঁরে সত্যি কথা। তোর বাবাতো আমার দাদার বয়সি। দাদার সঙ্গে একই স্কুলে পড়ত। আমাদের বাড়িতে বিয়ের আগে কত এসেছে।

–মা–আ, তুমি ভালোবেসে বাবাকে বিয়ে করেছ। সব্বাইকে বলে দেব।

বিনু ভা…ল হ…চ্ছে…না।

তখনই নিবারণ এসে বলল, দাদাবাবু আপনাকে কে ডাকছে। বিনুর চিন্তাভাবনা সহসা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, যেমন সে প্রতিদিন ছুটির দিনে বিকেলে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে, আজও তেমনি ছিল। কত কিছু মনে হচ্ছিল তার। নিবারণকে ডেকে বলল, বলতে বল। যাচ্ছি।

পার্লারে ঢুকে সে হতবাক। অপু চুপচাপ বলে আছে। পাশে ছোট্ট অ্যাটাচিকেস। ওর কপালে খুব ছোটো সিঁদুরের টিপ। সে পরেছে মুগা রং-এর মণিপুরী শাড়ি। পায়ে আলতা। আর আশ্চর্য সৌরভে সারা ঘর ম ম করছে। বিনু বলল, অপু, অপু, তুমি।

অপুর চোখ ভারি চঞ্চল। সতেজ। নতুন অভিজ্ঞতা অপুর শরীরে। বিনু আনন্দে চিৎকার করে ডাকল নিবারণ তুই ওকে চিনিস না।

নিবারণ বলল, অন্ধকারে ভালো দেখতে পাইনি বাবু।

বিনু বলল, অপু তুমি এখানে ভাবতে পারছি না।

অপু শুধু বলল, এলাম। তুমি কেমন আছো?

—আমি ভালো আছি অপু।

অপুর বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, তুমি ভালো নেই বিনুদা। তুমি মিথ্যে কথা বলছ। সে এসব কিছুই বলল না। শুধু বলল, মাসিমা, পুনু।

-মা তো এখানে নেই। পুনুর বিয়ে হয়ে গেছে।

–তুমি একা।

–না। বিনু ফের একটু থেমে বলল, আমি আর নিবারণ।

অপু বলল, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন? বোস। একা বেশ ভালোই আছ দেখছি।

-এই চলে যাচ্ছে। বিনু কথাবার্তায় কেন জানি আর সহজ হতে পারছে না। সে ঘাবড়ে গেছে।

-তোমার মতো মানুষের চলে গেলেই হল।

তারপর কেউ কিছু বলছে না। চুপচাপ। দূরবর্তী কোনো বনে টুপটাপ পাতা ঝরে পড়ছিল বোধ হয়।

বিনুর তখন মনে হল, অপুর আর আগের স্বভাবে নেই। খোঁচা দিয়ে কথা বলতে শিখে গেছে। অভিজ্ঞতায় ভীষণ সতেজ এবং দু-পাড় ভরে আছে বর্ষার নদীর মতো।

অপু বলল, ভাবলাম যখন কলকাতায় এলাম মাসিমা পুনুর সঙ্গে দেখা করে যাব। কেউ নেই। তুমি একা।

বিনু আবার মনে করিয়ে দিল,, নিবারণ আছে।

—নিবারণ আছে, আমাকে মনে করিয়ে না দিলেও চলবে।

বিনু বলল, চল তাহলে ভিতরে গিয়ে বসি।

আমি আর একদিন না হয় আসব।

 ভিতরে নাই গেলাম।

-–আমার সব দেখে যাবে না! আমি কিভাবে বেঁচে আছি দেখে যাবে না!

অপু চারপাশের দেয়াল দেখছে। মানুষটার রুচি আছে। সোফা, ডিভানে। কারুকার্যময় কভার বিদেশি রেকর্ডপ্লেয়ার গমগম করে যেন এক্ষুনি রেকর্ড বেজে উঠবে। আসলে সে কি করবে ভাবছিল। আসলে সে যে গোপনে এখানে চলে এসেছে। কথাবার্তায় এতটুকু বুঝতে দিল না।

বিনু বলল, কবে এলে, কোথায় উঠেছ, তোমার কোনো খবরই আমি জানি না। অপু চোখ তুলে এক পলক দেখে নিল মানুষটি তেমনি আছে। এতটুকু স্বভাবে পরিবর্তন নেই। তার মানুষের সঙ্গে এ-মানুষের স্বভাব একেবারে আলাদা। জোরজার করে নিতে জানে না।

বিনু ফের বলল, একটু বসে গেলে তুমি খারাপ হয়ে যাবে না। আমারও ভালো লাগবে।

-সত্যি বলছ! অপুর চোখে সামান্য বিদ্যুৎ খেলে গেল।

–জানি না অপু। তুমি কত বদলে গেছ। এবার অপু কেমন সাহসী মেয়ের মতো হেঁটে যেতে থাকল বিনুর পাশাপাশি। লম্বা করিডোরে আশ্চর্য সব সুন্দর ছবি, জানালায় মানিপ্ল্যান্ট। বারান্দা পার হয়ে ওরা ডাইনিং রুমে ঢুকে গেল। পাশে দুটো ছোটো ব্যালকনি। ব্যালকনির পাশে বিনুর শোবার ঘর। সেন্টার টেবিল। বাতিদানে সবুজ ঝালরের ঢাকনা। ফুলদানিতে একটা তাজা পলাশের ডাল। ফুলগুলো লাল টকটক করছে। জানালাগুলো সব বন্ধ।

অপু কেমন সহজভাবে নিঃশ্বাস ফেলার জন্য এক এক করে জানালাগুলো খুলে দিতে থাকল। এখন মনেই হবে না, সে এ-বাড়ির কেউ নয়। জানালা খুলে দেবার সময় একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বিনুদাকে দেখল। বিনুদা ভীষণভাবে ওকে দে কেউ নেই। নিবারণ কোথাও গেছে। ওর শরীরে সেই রক্তপ্রবাহ ফের ঝিমঝিম করছে। বিনুদার সঙ্গে আকাশ ছুঁতে ইচ্ছে করছে।

অপু বলল, কি সুন্দর ফ্ল্যাট তোমার বিনুদা। জানালাগুলো বন্ধ করে রাখো কেন! তুমি ভীষণ দেখছি অন্ধকারে থাকতে ভালোবাস।

বিনুর মনে হল জানালা খুলে দিয়ে অপু সবটাই খোলামেলা করে দিল। যদি কোনো ইচ্ছের কথা থাকে, বাইরের মাঠ, দূরের রেলগাড়ির শব্দ এবং বড় আকাশ কখনো তাদের ছোটো হতে দেবে না। বিনু না হেসে পারল না। ওর কেবল বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল অপু বিয়ের পর তুমি আরও সুন্দর হয়েছ। বর্ষার নদীর মতো তোমার এখন পাড়ে পাড়ে কাশফুল। আমাকে সামান্য ফুল তুলতে দেবে না অপু?

অপু কেমন ছেলেমানুষের মতো হাত পা ছড়িয়ে বিনুর বিছানায় বসে পড়ল। বলল বিনুদা, এখানে কখনো আসব, তোমার সঙ্গে কখনো পালিয়ে দেখা করতে পারব স্বপ্নেও ভাবিনি।

বিনু জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এখন সিগারেট খাচ্ছে। মাঝে মাঝে চুরি করে দেখছিল অপুকে। অপু কত কথা বলে যাচ্ছে! কিছু শুনছে, কিছু শুনছে না। অপু কেন এখানে এসেছে। তার স্বামী এখন কোথায়, কবে তাকে নিতে আসবে, তার বাবার খবর কী, সে কবে চলে যাচ্ছে ফের, তার কিছুই বলছে না।

বিনু বলল ঠিকানা কী করে পেলে?

—সব খবর রাখি মশাই।

–পুনুর বিয়ে হয়ে গেছে জানতে?

—সব জানতাম।

—সব জেনে এভাবে চলে এসেছ! এটা ঠিক করনি।

অপু আদৌ পাত্তা দিচ্ছে না তার কথা। সে তার খুশিমতো এখানে পালিয়ে এসেছে। সে বলে আসতে পারত, তবু কি যে থেকে যায়, গোপনে কোথাও চলে যেতে এখনও তার ভীষণ ভালো লাগে। এ শহরে এসে সে এক দণ্ড দেরি করতে পারেনি।

বিনু বলল, কী খাবে?

—কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

–কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। বিনু সামান্য দুষ্টুমি করতে চাইল।

–এই খারাপ কথা একদম বলবে না।

–কবে এসেছ এখানে? বিনু সামান্য ঘুরিয়ে দিল প্রসঙ্গ।

—আজই।

—কবে যাবে?

—জানি না।

—মানুষটি কোথায়?

–বাইরে গেছে।

—কবে আসবে?

—বেশি হলে ছ-মাস।

–অনেকদিন গেছে?

–গত মঙ্গলবার। এখন থেকে পুরো ছ-মাস বাবার কাছে।

–খুব কষ্ট তবে!

-আবার! একটু থেমে বলল, বাড়িতে যাবার আগে, তোমার এখানে হয়ে গেলাম। তোমাকে না দেখে যেতে পারলাম না।

-মেসোমশাই তাহলে এখানে।

—বাবা সল্ট লেকে বাড়ি করেছেন।

–তাই!

অপু বলল, এভাবে পালিয়ে দেখা করে গেলাম বলে রাগ করছ না তো! তুমি যা মানুষ। বলেই আগের মতো হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল অপু। আর আশ্চর্য অপু, বিনুদা ঘরে নেই। সে বলল, তুমি কোথায় বিনুদা?

-এখানে।

–কী করছ?

–চা।

–কেন তোমার নিবারণ?

–ওর চা তুমি খেতে পারবে না।

–আমি বুঝি চা করতে জানি না? বলেই এক লাফে উঠে বসল। বিনুর পাশে গিয়ে বলল, তুমি সরো। কোথায় কী আছে বল। করে আনছি। চা না খাওয়ালে তোমার কিছুতেই যখন চলছে না…

ওরা দুজন-যখন সামনা-সামনি বসে চা খাচ্ছিল ঘরে সামান্য সবুজ আলো, অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে দুজনের মুখের ছায়া তখন বিনু না বলে পারল না, তুমি না এলে ভালো করতে।

অপু চায়ের কাপ নীচে নামিয়ে রাখল। বলল, তার মানে।

–তুমি খারাপ হয়ে যাও, আমি চাই না অপু।

অপু কেমন বিস্মিত গলায় বলল, খারাপ! খারাপ আবার কী জিনিস!

—তুমি বুঝতে পারছ সব। দোহাই আর ব্যাখ্যা করতে বল না।

অপুর হাসি পাচ্ছিল। ভীষণ, হাসি পাচ্ছিল। বোধ হয় হেসে বলত, তুমি কি বোকা না বিনুদা! কিন্তু সে হাসল না। বরং খুব গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, বাজে কথা রাখ।

আর বিনু কত সহজে যে বুঝে ফেলল, অপু আর আগের অপু নেই। অভিজ্ঞতা অপুকে ভীষণ বদলে দিয়েছে। সে শুধু আকাশ ছুঁয়ে দিলেই খুশি না, আরও কিছু চায়। অপুর মুখে চোখে ক্রমে উষ্ণতা জমে উঠছে। বিন্দুমাত্র শিথিলতা উভয়কে গ্রাস করবে। সে বলল, আমি ফুল ছিঁড়ে খেতে ভালবাসি। তুমিও। তবু আমার কাছে তুমি আগের অপু হয়ে যাও।

অপু বলল, আমরা সবাই। তারপর কিছু বলল না। যেন নিজের বাড়ি, নিজের ঘর, এমনভাবে দরজা জানালা সব ফের বন্ধ করে দিচ্ছে। অপুর অহমিকায় লাগছে। তুমি চিরদিন ভালো মানুষ থাকবে, ভারি মজা! আমি ব্যবহারে ব্যবহারে পুরোনো হয়ে যাই, তোমার তাতে বুঝি কিছু আসে যায় না। এসব সে বলতে পারত। ভাবো শুধু ঐশ্বর্য তোমারই আছে, আমার ঐশ্বর্য কিছু নেই! সে এবার বিনুর পাশে দাঁড়িয়ে বলল, নিবারণ কোথায়?

বিনু বলল, অপু নিবারণ রাতে বাইরের ঘরে থাকে। প্লিজ তুমি ছেলেমানুষী কর না।

অপু যে এখন কী করে। সে অপমানে মুখ লুকিয়ে রেখেছে বিনুর পিঠে। এবং বিনু বুঝতে পারলে, এতদিন পর অপু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

আর তখনই বিনুর কি হয়ে যায়। আবার সেই রিনরিন বাজনা মাথার ভেতর। যেন সে তেমনি অপুকে কাছে পেয়ে দুহাতে সব লুটেপুটে নেবে। সে আগের মতো ফের লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটবে—সে আর অপু। পৃথিবীতে সে আর অপু। আর কিছু লাগে না।

বিনু একটা শাদা চাদরে এবার শরীর ঢেকে দিল। নীল রঙের সামান্য বাতিটা জ্বলছে। দূরে সেই রেল-ইয়ার্ডের ঘটাং-ঘটাং শব্দ। ক্রমে নিশীথের সব শব্দ মুছে গেলে শুধু নীল আলোটা জেগে থাকল পৃথিবীতে। অনেক দুরে বনের গভীরে হায়েনারা যেন ডাকছে। আর কিছু না। পৃথিবী তারপর শব্দ গন্ধহীন এক আশ্চর্য পারাবারে নিথর হয়ে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *