২২. অফিস থেকে ফিরে উৎপলার কাছে

মাল্যবান অবিশ্যি সেই দিনই অফিস থেকে ফিরে উৎপলার কাছে গেল।

গিয়ে বললে, না, মেসে আর না।

কেন?

আমি আজই চলে আসছি।

কোথায় থাকবে, শুনি।

যে জায়গায় ছিলাম—নিচের তলা—

সেখানে জায়গা নেই।

মাল্যবান বললে, এ-বাড়ির কোনো ঘাপটিতে পড়ে থাকব, সে-জন্যে ভাবতে হবে না–

ক্ষেপেছ? উৎপলা একটু মেজাজে-মেজাজে বললে, আড়ি পাতবার জায়গা নেই বাড়িতে; তুমি বেশ রঙে আছ খুব যা হোক। সঙ্কুলান হবে না, তোমার মেসেই থাকতে হবে; ওদের তো আমি তাড়িয়ে দিতে পারি না।

কিন্তু, এটা তো আমার বাড়ি।

তা যদি বললো, তাহলে মেজদাকে নিয়ে আমরা অন্য ফ্ল্যাট ভাড়া করি—

না, না, সে-কথা আমি বলছি না—একটু বলার বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে অনুভব করে মাল্যবান বললে, তুমি চলে গেলে এ-বাড়িতে এসে কী হবে আর। সে তো মেসের মতনই হয়!

একটা কথা বলতে হবে বলে মাল্যবান বললে, মেসের বিছানায় শুয়ে থেকে এক-এক দিন রাতে বড় ভরসা হারিয়ে ফেলি। আমার মনে হয়, যদি মরে যাই, তাহলে তোমার সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা

উৎপলার মুখের দিকে তাকিয়ে মাল্যবানের জুৎ লাগল না তেমন; যে-কথাটা পেড়েছিল, সেটা শেষ করতে গেল না আর বললে, ঐ যা, আমার লাইফ-ইনসিয়োরেন্সের প্রিমিয়ামগুলো দিয়ে দিয়েছ তো। টাকাকড়ি তো তোমার কাছে রেখে গিয়েছিলাম—

খরচ হয়ে গেছে।

খরচ হল! তা হবেই তো, আজকাল তো রাবণের চিতে জ্বলছে কিনা এই বাড়িতে।

মেজদা বলেছেন তোমাকে আর-একটা পলিসি নিতে।

তা আর হয় না।

কেন, বয়েস তো তোমার আছে।

না, বয়েসের জন্যে নয়।

মেজদা বলেছেন, মেডিকেল টেস্‌টে ঠেকবে না, তিনি পাশ করিয়ে দিতে পারবেন।

তিনি এজেন্ট, তাঁর গরজ ঢের, মাল্যবান এঁচড়ে পাকা ছেলের মতো একটু ঠাট্টা অমান্যির হাসি (মনে হচ্ছিল উৎপলার) ছড়িয়ে বললে। কেমন সেয়ানার মতো মুখ করে বসে রইল, আসল জায়গায় মাল্যবানকে ধরা যতো সহজ মনে করেছিল উৎপলা, তা নয় যেন।

মেজদার কম্প্যানিতেই তোমার করা দরকার।

তা জানি জানি। করবার সাধ্যি থাকলে করতাম বৈকি। যে—দুটো আছে, তা ল্যাপস না করলেই আমাদের কুলিয়ে যাবে–

না, না, করে ফ্যালো।

টাকা নেই।

সে আমি বুঝব।

তা দেখো। কিন্তু আমি যা বলছিলাম, মেসে থেকে কেমন ঢল শুকিয়ে যায়–এক-এক দিন রাতে; বিয়ে করবার আগে তো মেসে থাকতাম, কিন্তু এখন পারছি না, কিছুতেই পারছি না। মেসের বাবুরা বলে, বেশ বনে-জঙ্গলে তো চরছেন দাদা হাতির মতো, আবার খেদার হাতি হবার সাধ।

বলে নাকি?

আমি তো বাড়ির হাতি, মাল্যবান বললে, বন দিয়ে আমি কী করব?

বল নাকি তুমি? রাজবাড়ির হাতি বল নাকি নিজেকে?

বলি শিববাড়ির হাতি—

কেন, শিব বাড়ির কেন?

ঐ যা মুখে আসে, তাই বলি। আমি কাল মেস থেকে উঠে আসব।

মেসে গিয়ে তোমার শরীর সেরেছে, উৎপলা বললে, হুট করে কিছু করে বোসো না। থাকো মেসে কিছুদিন। মেসেই তো বরাবর ছিলে, মেস-মেস ধাত হয়ে গেছে তোমার, ঘর-সংসার মানাচ্ছে না ঠিক। সেদিন আমার ভাইপো-ভাইঝিদের জন্যে নিচের ঘরটা গোছাচ্ছিলাম, মেজবৌঠান বললে, ঘরটাকে শালগ্রামটি মেসের কামরার মতোই করে রেখেছে দেখছি—

তাই নাকি? তুমি কী বললে?

বলব কী আর। বুদ্ধি খরচ করে কথা বলতে হলে চুপ করে থাকতে হয়।

মাল্যবান চারদিকে চোখ পাকিয়ে তাকালে, একটা ঢেঁকুর তুলল, গোঁফের কোণায় একটা মোচড় দিয়ে বলল, মেজ বৌঠান যা খুশি তা বলুন। আমার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিজের মনের ভাবে থাকবার অধিকার আমার রয়েছে। আমার যা খাসদখল, তা ফেলে মেসে গিয়ে আমি থাকব?

মাল্যবান একটা চুরুট জ্বালিয়ে নিয়ে বললে, স্বামীকে কি মেজ বৌঠান মেসে পাঠিয়ে সুখ করেছেন?

উৎপলা ঢিলে খোঁপা খসিয়ে ফেলে চুলের গোছা হাতে তুলে আঁট করে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বললে, ওদের তো আর আমাদের মতো নয়—

হয়েছে, হয়েছে, মাল্যবান শিংশপা রাক্ষসীকে কাছে না পেয়ে দাঁত দিয়ে কামড়ে চুরুটটাকে সেপাট করতে-করতে বললে, পাঁচ রকম দশ রকম, সব রকম জানা আছে আমার। ল্যা-ল্যা করতে-করতে আমি পরের বাড়ি চড়াও করতে যাই না তোমার ভাজের ভাতারের মতো। আমার নিজের রকম নিয়ে আমি নিজের বাডি থাকব—শালগ্রাম হব, শিবলিঙ্গ হব—যা খুশি হব—ওদের কী—

উৎপলা মেজাজ না চড়িয়ে ঠাণ্ডা ভাবেই বললে, ঠিক কথাই তো। তবে কালকে হবে না। আট-দশটা দিন পরে এসো, নিচের ঘরটা তোমাকে ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে—

শুনে মাল্যবানের মনের গরমটা স্নিগ্ধ হয়ে এলো আট-দশ দিন পরে?

হ্যাঁ।

নিচের ঘরটা খালি করে দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে?

তা হচ্ছে।

কে করছে ব্যবস্থা?

আমরাই।

ব্যবস্থা তো হচ্ছেই তার জন্যে, উৎপলাই ব্যবস্থা করছে, মিছেই চুরুটাকে কামড়ে ছিড়ে ফেলেছে সে। লোকসানি চুরুটটাকে ফেলে দিয়ে পকেট থেকে একটা টাটকা চুরুট বের করে মাল্যবান বললে, আমি ও-সব তেমন মানি-টানি না, তবে তথ্য হিসেবে জিনিসটা মন্দ নয়—

কোন জিনিসটা?

ঐ যে—আমাদের রাজযোেটকে বিয়ে হয়েছিল-তোমার মেজদা ঠোঁট ওল্টালেও তোমার বড়দা সেজদা খুশি হয়েছিলেন——তোমার বাবা তো খুবই–

মাল্যবান খুব গনগনে, আগুনে বেশ বানিয়ে ফেলল চুরুটটাকে কথা বলার ফাঁকে-ফাঁকে চুরুটটাকে বেশ প্যাঁচ মেরে টেনে-টেনে। কড়া গলায় একটু চাপা হাসি হেসে উৎপলা বললে, কে, বলেছিল তো পরেশ ঘটক।

হ্যাঁ, তিন রাত্তির মাথা ঘামিয়ে তিনি স্থির করেছিলেন।

রাজযোটক, উৎপলা ফিক করে হেসে উঠল শঙ্খিনীর মতো চনমনে গলায়; রাজযোটক-বিয়ের ফলাফল ফ্যাকড়া টেংড়ি বোলো গিয়ে পরেশ ঘটককে তার নিবন্ধের বাইরে।

তুমি পণ্ডিতকে উড়িয়ে দিতে চাও।

পাণ্ডিত্য দিয়ে আমার কোনো দরকার নেই, আমি যা অনুভব করি, তাই বলি।

কী কর তুমি—অনুভব?

কথা বাড়াতে পারি না। উৎপলা তুষের আগুনে যেন বাতাস লাগিয়ে একটু ধিক-ধিক করে উঠে বললে, এখন তোমাকে মেসে থাকতে হবে। আট-দশ দিনে নিচের ঘরটা খালাস করে দেয়া যাবে হয়তো, বলেছিলাম; কিন্তু তা হবে বলে মনে হয় না, মাস দেড়েক তো লাগবেই।

উৎপলা এক পাটি সুন্দর দাঁত বের করে হাসবার মতো মুখ করে তবুও না হেসে গম্ভীর ভাবেই বললে। দেখতে-দেখতে দাঁতের পাটি অদৃশ্য হয়ে গেল তার। ঠোঁটের ওপর ঠোঁট মিশ খেয়ে কঠিন হয়ে রইল খুব আঁট সিঁদুরের কৌটোর মতো।

মেসে কদিন থাকব?

যদ্দিন দরকার।

মেজদারা কবে যাবেন?

তা আমি কী করে জিজ্ঞেস করব তাঁদের?

তাঁদের নিজেদেরও তো একটা বিবেচনা থাকা দরকার।

উৎপলা মাল্যবানের থেকে কয়েক ধাপ ওপরে দাঁড়িয়ে থেকে যেন বললে, সেটা কি তুমি তাদের শিখিয়ে দেবে?

হাতের চুরুটটার দিকে চোখ পড়ল মাল্যবানের। চুরুটটা দাঁতে আটকে নিয়ে টানতে লাগল। টেনে-টেনে বেশ ছাই জমেছে যখন চুরুটের মুখে তখনও সে কী করবে আর—চুরুটটা টানতে লাগল। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলে মনে পড়ল মাল্যবানের। বিপিন ঘোষের গল্পটা উৎপলাকে বলতে শুরু করল! মুখবন্ধ শুনেই উৎপলা বললে, দুধপোড়া গন্ধ বেরুচ্ছে না?

কৈ, না তো।

না, না, গল্পটা শোনো : ও, পাশের বাড়িতে দুধ উথলে পড়েছে হয়তো—

পাশের বাড়িতে যে, তার টের পেল উৎপলা; নাক আছে তার, কান আছে, আরো নানা রকম সূক্ষ্ম পক্ষী সংস্কার পশু অনুভূতি রয়ে গেছে তার, পাশের বাড়ির ঠাকুরটা যে হেঁসেল থেকে সরে গিয়ে পানের দোকানে গল্প করছে, তাত চোখ কান খাড়া করে টের পেয়ে নিচ্ছিল সে, তবুও একটা খিচ রয়ে গিয়েছিল উৎপলার মনে। আমাদের দুধ পুড়লে সব্বোনাশ—মেজদার—

তোমার উনুনে দুধ নেই। আমি জানি। এই তো হেঁসেল থেকে ঘুরে এলাম রাঙী ছাঁচড়া রাঁধছে—মাল্যবান চুরুট নামিয়ে বললে।

উৎপলা তার ঘন কালো চুলের (বেণীর ভেতরে কোনো ট্যাসেল জড়ানো নেই) মস্ত বড়ো আবদ্ধ খোঁপার ওপর হাত রেখে চাপ দিতে দিতে বললে, না রে বাপু, তোমার বিপিন ঘোষের কেচ্ছা শোনবার সময় নেই আমার। তুমি নিড়বিড়ে বলেই ও-সব বিশ্বেস করো। খুব ভোগা দিয়েছে বিপিন ঘোষ; কিছু টাকা খসিয়েছে নিশ্চয়।

মাল্যবান বিক্ষুব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, টাকা যদি কিছু চাইত আমার কাছে, আমি দিতাম বৈকি। কিন্তু টাকা চাইবার লোক বিপিন ঘোষ! তা নয়। তুমি তার সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারতে। লোকটার বাস্তবিকই সব গেছে। দশ মিনিট বসে পর-পর তিনটে সিগরেট খেল—আমার সঙ্গে একটা কথাও বললে না—তারপর একটু গলার কণ্ঠায় হাত দিতেই চেখ মুখ একেবারে পাঁশগাদার কুকরোটাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে মোচলমানের ধেড়ে মোরগের মতো ভেঙে পড়ল যেন বিপিন ঘোষের। কোনো কথা না বলে একটা জহরকোট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

মাল্যবান বিপিন ঘোষের সঙ্গে একশোয়াসে হয়ে গেছে; যেন তারই স্ত্রী মরেছে, ঘর ভেঙে গেছে, কিন্তু তবু ত অন্তর থেকে সহ্য করবার শক্তি শানিয়ে নিতে হচ্ছে তার, এমনই একটা ভাঙা কাসি জোড়া দেবার মতো ভরাট, সাহসিক মুখে উৎপলার দিকে তাকাল তার স্বামী।

এমন উল্লুকও থাকে তোমার ঐ বিপিন ঘোষের মতো।

উল্লুক বললে, উৎপলা?

তোমার ট্যাক থেকে খসায়নি তো কিছু?

কেন খসাবে? তুমি ভেবেছ কী বলো তো দিকি—

ভোগা দিয়ে খসায়নি তো কিছু তোমার মতন ঢ্যাপঢেপে মানুষের কাছে থেকে? উৎপলা চেখে-মুখে চিনি মিছরির দানা ছড়িয়ে মাল্যবানের কোমরে একবার নিজের হাতটা জড়িয়ে নিয়ে বললে; ভালোই করেছে তাহলে। কিছু লাগবে আমার কাজ। কত আছে সঙ্গে! মাল্যবানের গলায় একবার হাতটা জড়িয়ে নিয়ে মিষ্টিমুখে একটা হ্যাচকা টান দিয়ে বললে, যা আছে, তাই দাও।

মাল্যবান গড়িমসি করতে-করতে বললে, দিচ্ছি। কিন্তু আজ আর মেসে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। এখানে একটা রাতের ব্যবস্থা হতে পারে।

টাকা হাতে নিয়ে উৎপলা বললে, খেতে তো পারো এখানে এ-বেলা।

না, না, খাওয়ার কথা নয়; একটু ঘুমোবার ব্যবস্থা হতে পারে। কোথায় শোও তুমি?

আমার পঞ্চাশটা টাকার দরকার।

আচ্ছা, ধার করে দেব।–

কবে!

কালই। আজ পঁচিশ টাকা দিচ্ছি। কোথায় ঘুমোয় মনু?—আর তুমি—

 

পরদিন মাল্যবান এসে বললে, ভেবেছিলাম, শীগগির এদিকে আসব না আর।

উৎপলা কোনো কথা বলছিল না।

কৈ, না এসে পারলাম না তো তবু। মাল্যবান একটা চেয়ার টেনে বসল।

ওখানে বসলে যে?

কেন কী হয়েছে?

দেখলে, আমি নিরিবিলি একটু কাজ করছি।

শুনে মাল্যবান একটু তাড়া দিয়ে বললে, তা কাজ করো—কাজ করো—আমি তো বাধা দিতে আসিনি। কার জন্যে ব্লাউজ সেলাই করছ?

সেলাই-এর কলের হাতলটা আগলা মঠোয় ধরে ঘোরাবে কিনা ভাবছিল উৎপলা। জামাটাকে কলের সঁচে ঠিক করে গুছিয়ে নিয়ে উৎপলা কল চালাতে লাগল।

সেলাইএর কল তোমার লক্ষ্মী। কেমন বন বন করে ঘুরছে তোমার হাতে বিষ্ণুর চাকার মতো একেবারে সতীদেহ কেটে ফেলে বাঃ! বাঃ! বললে মাল্যবান; সতীদে কেটে ফেলার কথা বলে সুভাষিতই বলেছে মনে হল মাল্যবানের; নিজের মনের বিজ্ঞান নির্জনে যে অপর—উৎপলাকে কাঁধে নিয়ে ফিরছে সে টুকরো-টুকরো করে কেটে দিচ্ছে এ-উৎপলাকে।

উৎপলা বেশ কল নিয়ে থাকতে পারে, এস্রাজ সেতার নিয়েও। বড্ড একঘেয়ে লাগে রাতের বেলা মেসে; এস্রাজ শিখে নিলে হত।

তুমি বাজারে এস্রাজ?

কেন, হবে না আমার?

বলে হরিকাকা কাছা দাও; হরিকাকা বলে, কাছা আমার খসল কোথায় যে দেব–উৎপলা কল ঘোরাতে ঘোরাতে ঘুরিয়েই চলল, পট করে সুতো কেটে যাওয়ায় একটু থেকে নেড়ে-চেড়ে বললে, না, কাটেনি, ঠিকই আছে।

ববিনে সুতো আছে?

আছে, ঠিক আছে, হাওড়া ব্রিজ হয়ে আছে; নাও, সরো—দিক কোরো না।

মাল্যবান উৎপলার হাতের চাকা-ঘুরুনিব দিকে তাকিয়েছিল বটে, কিন্তু মনটা চোত মাসের ফলকাটা তুলোর মতো কত শত বাতাসে—শতধা নীলিমায় যে উড়ছিল।

ছেলেরা রাস্তায় সাইকেল হাঁকিয়ে যায় বেনেটোলা, নবীন পালের লেন, পটলডাঙা, কলেজ স্ট্রিট, কলাবাগান, হাতিবাগান, গোয়াবাগান—চৌরঙ্গীর চৌমাথা। ভারি রগড়, কিন্তু এক-একটা জিনিস কিছুতেই শিখতে পারলাম না–বাইক করা, উর্দু বলা, পায়জামা চপ্পল শেরওয়ানী কিংবা সায়েবী স্যুটে পাড়ায়-পাড়ায় ল-ল করে বেড়ানো—

উৎপলা চুপচাপ কল ঘোরাতে-ঘোরাতে আরো বেশি নিঃশব্দ নিঃসম্পর্ক হয়ে পড়ল।

কেরানীর চাকরি আমাকে জুতিয়ে মারল। ইচ্ছে করে এই সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটু নিজের ভাবে থাকি, তুমি সেতার বাজাও, আমি শুনি—সারাটা দিন এইরকম।

উৎপলা কলের দাঁতের ভেতর থেকে ব্লাউজটাকে বের করে এনে একবার চোখের সামনে ছড়িয়ে দেখছিল; সেলাইএর এখনো ঢের বাকি। মাল্যবান যে অনর্গল পাঁচালী পেড়ে চলেছে, সে-দিকে কান না দিলেও অবচেতনার পথ দিয়ে মনের কানে কিছু কিছু শুনেছিল।

ধরো, আর কুড়ি-পঁচিশটা বছর তো সামনে রয়েছে। জীবনের একটা রকমারি হবে নাকি এর মধ্যে? কী বলো তুমি রকমারি হবে তো বটে? ভালো হবে-সুভালাভালি কেটে যাবে? কী বলল গো?

আরো কুড়ি বছর বাঁচবে বলে আশা কর?

বেঁচেও তো যেতে পারি।

অত বেশি বেঁচে কী লাভ? উৎপলা ব্লাউজের দিকে মন রেখে তবুও নিজের কথার দিকে মন দিয়ে শান্তভাবে; আমার নিজের কথাও বলছি—জীবনে আমাদের কী সম্ভব অসম্ভব বুঝলাম তো অনেক দিন বসে; এখন শান্তিতে সরে পড়লেই তো বেশ–

উৎপলার কথা শুনে মাল্যবান খানিকটা বিরক্ত বিচলিত হলপকেট থেকে মনের ভুলে বিড়ি বের করে জ্বালিয়ে ফেলছিল, প্রায়, কিন্তু স্ত্রীর সুমুখে বিড়ি সে আজকাল খায় না, সিগারেটও বার করলে না, বললে, বিদায় নিলে আমিই নেব, বেঁচে থাকে তোমার ঢের লাভ আছে। আমি এক-এক দিন রাতে মেসের বিছানায় শুয়ে ভাবি; ভাবি তোমার কথা। বাস্তবিক বেশ পড়তা নেই বটে কি তোমার জীবনে? কত লোকজনের সোরগোল তোমার ঘরে দিনরাত। তুমি নরকে বসলেও আশে-পাশে একশোটা নষ্ট চন্দ্র। তোমার মেজদা আর বৌঠান—এঁরা তোমার কাছে থেকে যত সুখী, তুমি নিজে তার চেয়ে ঢের বেশি সুখী এঁদের পেয়ে। কি বলো?

মাল্যবান চোখ বুজে কথা বলছিল। চোখ মেলে উৎপলার দিকে তাকাল। কাজ করছিল, কথা বলবার কিংবা মুখ তুলে তাকাবার সময় ছিল না উৎপলার।

সত্যিই, তোমার জিনিস ছিল ঢের, সদ্ব্যবহারও ছিল—বলতে-বলতে মাল্যবানের মনে হল নিজের বলিয়ে মুখটাকে দেখতে পেয়েছে সে; নিজের মুখটার মুখোমুখি এসে পড়েছে, মুখটা মুখ নেড়ে চলেছে শুধু উৎপলার হৃদয়ে প্রতিফলিত হতে গিয়ে প্রতিহত হয়ে ফিরে এসে কী ভীষণ মুখ নেড়ে চলেছে সে চিড়িয়াখানার একটা বানরের আকচার ছোলাভাজা চিবোবার মতো। এই হল তার কথা বলা? ভাব প্রকাশ করা?

উৎপলা এক মনে কল চালাচ্ছিল। এর যে টনক না নড়ে, তা নয়, কিন্তু অন্য-কোনো যৌন পরিস্থিতিতে অন্য কোনো মানুষের সঙ্গে? আচ্ছন্ন সারস বকের মতো নিজের বুকের পালকে মুখ গুঁজে সমাধান খুঁজছিল মাল্যবান, কিন্তু কিছু বের করতে পারল না সে।

বুকের পালক মাংসের ভেতর থেকে মুখটা খসিয়ে এনে যেন মাল্যবান বললে, থাক, মৃত্যুর কথা আমরা কেউই না বলি যেন আর। বেঁচে থাকা যাক যতদিন সময় বাঁচিয়ে রাখে। দেখা যায় কী হয়। ভরসা রাখাই ভালো। আমাকে একটা বাজনা শিখিয়ে দাও-না–এই এস্রাজ—।

হিমাংশুবাবু বেশ ভালো এস্রাজ বাজাতে পারেন, তাকে ধোররা।

হ্যাঁকে ধরব? আমি কি হিমাংশুবাবুর ঘাড়ে এস্রাজ শিখতে চেয়েছি?

কেন, খুব তো সহজ, তিনি তো প্রায়ই আসেন।

মাল্যবান, উৎপলার হাত, পেট্রোলিয়ামের গন্ধ, সেলাইএর কলের ঢাকা, ব্লাউজ তৈরির দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থেকে শেষে বললে, নাঃ, বাজাতে কি সবাই পারে। মিছিমিছি বলছিলাম।

এস্রাজের কথা সে আর তুলতে গেল না। মনু রীর কেমন দড়ি পাকিয়ে যাচ্ছে দেখলাম! কী হচ্ছে?

দড়ি পাকিয়ে যাচ্ছে। উৎপলা বললে।

কী খায়?

কী জানি।

পেটে সয় না হয়তো যা খায়, পেটের রোগ হয়েছে, শুকিয়ে যাচ্ছে তাই। না কি কিছু খেতেই পারে না, ভালো কিছু খেতে পায় না?

উৎপলা একটা সেলাই-এর বই খুলে কতকগুলো নক্সার দিকে মন নিবিষ্ট করে ছিল, মাল্যবান কী বলেছে না বলেছে তা সে শুনেছে কী না বোঝা যাচ্ছিল না, কোন উত্তর দিল না উৎপলা।

মনুর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

হচ্ছে না কি।

আদ্ধেক হয়ে গেছে টের পাচ্ছ না তুমি?

রোগে ধরেছে হয়ত, উৎপলা বললে, হয়তো ওর বাপের মনের রোগে ধরেছে ওকে–

মাল্যবান তাকিয়ে দেখল সেলাইএর বইটা ইংরেজি; বই নয়-একটা জর্নাল হয়তো; জর্নালের পাতা নেড়ে-চেড়ে দেখছে উৎপলা। একেবারে ঝুঁকে পড়েছে। পত্রিকাটার ওপর। উৎপলা সেলাইএ এম.এ. পাশ করবে, ডক্টরেটও পাবে হয়তো, কিন্তু মনু তো সুতো শাঁখ সাপ হয়ে যাচ্ছে—কেমন সরু—কী ভীষণ সিটে—মরুঞ্চে। এই হালে চললে মাল্যবান মেসে থাকতে থাকতেই—এ বাড়ির হালচালের ভেতর মনুকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। কঠিন হবে।

মিনুর লিভার খারাপ—সেই পিলগুলো দাও লিভারের?

না।

কেন।

কোথায় হারিয়ে গেছে ওষুধটা।

হারিয়ে গেল। তাহলে তো আজই কিনে নিতে হয়।

তা দিয়ো।

মাল্যবান কথাবার্তায় রকম-সকমে একটু নষ্টামির আঁচ ধরতে পেরে বললে, মিছিমিছি কিনে দিয়ে কী লাভ-যদি না খাওয়ানো হয়।

তাও তো বটে।

এ-পথ নয়, ও-পথ নয়, ঠিক পথটা ধরা দরকার অনুভব করে মাল্যবান বললে, তুমি তো বলছ এ-বাড়িতে কোনো জায়গা নেই।

তাই তো জানি।

ছাদে একটা ক্যাম্পখাট ফেলে শুয়ে থাকলে কেমন হয়?

তা তুমি নিজে বুঝে দ্যাখো।

তোমার কী মত?

আমরা বাড়ি দেখছি।

কেন?

কিছুকাল বাপের বাড়ি থাকব গিয়ে। বড়দা আসছেন কলকাতায়—

সেজদা আসছেন।

বাড়িও দেখা হচ্ছে না, কেউই আসছেন না জানে মাল্যবান। বিচিত্র জ্ঞানপাপের বোঝাটা পিঠে-ফেলে সে উঠে দাঁড়াল। উৎপলা ব্যস্ত হয়ে কল চালচ্ছিল।

মাল্যবান চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *