০৪. মাইনে তো আড়াই শো টাকা হল

তোমার মাইনে তো আড়াই শো টাকা হল—এখন একটা কেলেঙ্কারি ঘোচাও তো।

কী করতে হবে?

ছাদে পাৎপিঁড়ি পেতে খাওয়ার পক্ষপাতী আমি নই। উৎপলা বললে।

দিব্যি তো গায়ে বাতাস লাগিয়ে আলোয় আলোয় মাছের কাঁটা বেছে খাওয়া হয়, মাল্যবান যেন নাকের আগায় চশমা ঝুলছে তার, এম্নিভাবে, একদৃষ্টে, সনির্বন্ধতায় উৎপলার দিকে তাকিয়ে বললে, আন্ধি ঘুপসির থেকে বাঁচোয়া না ছাদের আলোয়? ছাদে খাওয়াটা তো বেশ। আমার তো বেশ ভালো লাগে।

ছাদটা একটা আস্তাকুঁড় হয়ে থাকে

সে আর কতক্ষণ?

নিজে তো অফিসের মখে দিব্যি চাকলা গিয়ে হুট করে গাছের মাথায় চড় গিয়ে কিনা–কী দিয়ে কী হয়-ঝামেলা হামলা আমি একা বসে পোয়াই আর কী।

এঁটো গড়াতে থাকে অনেকক্ষণ?

ঠাকুরের সঙ্গে ঝি পীরিত করবে, ঝির হাতে ঠাকুর খইনি টিপবে— তারপরে তো এঁটোর কথা মনে পড়ে—

এই রকম? মাল্যবান মুখে দু-একটা কালমেঘ ঘনিয়ে এনে বললে, কতক্ষণ ফেলে রাখে? দু-তিনঘণ্টা? একটু চুপ থেকে মাল্যবান বললে বড়ো বেয়াদব তা হলে আবার খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কথা ভেবে ঠিক করে নিয়ে মাল্যবান বললে, এ-ঝিটাকে উঠিয়ে দিলে হয়।

না, সে সবের কোনো দরকার নেই।

এই না বললে ঠাকুরের সাথে পীরিত করে?

তা করুক, আমাদের তাতে ক্ষতি কী?

কিন্তু সে সব ভালা নয় তো।

আমাদের কাজ নিয়ে কথা; ওদের অন্তর্জলীর ভেতর নাক ঢোকাতে যাব কেন?

কিন্তু ভাদুরানীর স্বামী রয়েছে—তবুও ঠাকুরের সঙ্গে এই রকম।

তুমি তো আচ্ছা বেকুব দেখছি।

কেন?

ছোটো জাতের ভেতর কত রকম কাণ্ড হয়।

ছোটো জাত? ভাদরানী তো বামুনের মেয়ে।

তা হবে। বেশ তো–ঠাকুরও তো বামুন—

ঠাকুরও বামুন মাল্যবানের কাছে ব্যাপারটা এক মুহূর্তের জন্য চীনে প্রবাদের মতো সরল অথচ কঠিন, কঠিন অথচ সরল বলে মনে হল। কী যে এই সহজ ব্যাপারটা কী এর মানে কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারল না। তামাকের ধোঁয়ায় নোংরা দাঁতগুলো বের করে—সেই দাঁতগুলোর মতো আকাট অবর্ণনীয়তায় উৎপলার দিকে তাকিয়ে রইল সে।

ছাদে না খেয়ে এখন থেকে ছাদের উত্তরদিকের ঘরটায় খেলে হয়— বেশ ফটফটে ঝরঝরে ঘরটা—

কিন্তু ওটা তো ও-ভাড়াটেদের—

না গো, ওরা ও-ঘরটা ছেড়ে দিয়েছে।

কবে ছেড়ে দিল?

কাল।

মাল্যবান একটু ভেবে বললে, ওটার ভাড়া তো কম হবে না–

পঁচিশ টাকা চায়—আমি বলে-কয়ে কুড়ি টাকা করতে পারব। বলে একটু ঝিকমিক করে হেসে মাল্যবানের দিকে তাকাল।

মাল্যবান ভুরু উঁচকে বললে, কুড়ি টাকা অতিরিক্ত খরচ আবার।

কিন্তু তোমার মাইনেও তো বেড়েছে।

কিন্তু দশ রকম খরচও তো বেড়েছে। এটা আবার কেন?

কিন্তু ছাদে খাওয়া অসম্ভব–

মাল্যবান ভাবছিল; নাকের আগায় যেন তার চশমা ঝুলে পড়েছে, এরকম কেমন এক অথই শূন্যতার ভেতর থেকে নিশ্চুপ একনিষ্ঠতায় ও সনিবন্ধতায় উৎপলার দিকে। তাকিয়ে।

খেয়ে উঠতে না-উঠতেই কাক চড়াই এসে সমস্ত এঁটো চারদিকে ছড়াবে, ছাদে যে কাপড়গুলো শুকোতে দিই তার ওপর মাছের কাটা, আলু মশলার হলুদের ছোপ, পাখির বিষ্ঠা; রাধার কলঙ্কের চেয়ে কেষ্টোর কলঙ্ক বেশি: কাঁকড়ার গাঁধি চিংড়ির দাঁড়া ছিবড়ে পিঁপড়ে মাছি সমস্ত ছাদে মই-মই করছে রে বাবা!

রান্না ঘরে গিয়ে খেলে হয় না?

উৎপলা ডান হাতের চাটি মেরে বাঁ গালের জুলপির ভেতরে একটা মশা না কী পিষে ফেলে বললে, কুঁড়ি টাকা ভাড়া যাচ্ছে, ঝনাৎ করে টাকাটা ফেলে দেবে, না কি ফড়ের মতো কথা বলছ তুমি। রান্নাঘর হয়ে এসেছে কোনো দিন?

না, কী আছে ওখানে?

আমার বাজু আছে আর তোমার পায়ের মল।

এক সারি ননাংরা দাঁত কেলিয়েই মুখ বুজে ফেলল তৎক্ষণাৎ মাল্যবান; হাসল এক ঝিলিক, না, নাক সিটকাল বুঝতে পারা গেল না।

ছাদের উত্তরের দিকের ঘরটা ভাড়া করা গেল। চুণকাম করা ধবধবে সুন্দর দেয়াল, নতুন সবুজ রঙ মাখানো জানালা দরজা–দিব্যি।

তোমার মেজোশালার তত কলকাতায় আসবার কথা; যদি আসে, তাহলে এই ঘরটায় আমি আর মনু থাকতে পারি-বড়ো ঘরটা তাদের ছেড়ে দিতে পারি।

মাল্যবান ঠোঁটের ওপর ছাঁটা গ্যাঁজে আঙুল বুলিয়ে কথা ভেবে নিচ্ছিল কোনো উত্তর দিল না।

আপাতত একটা লম্বা টেবিল এই ঘরটার মাঝখানে এনে রাখা হল— চারদিকে তিন-চারটে চেয়ার। সকালের চায়ের ধেকে শুরু করে রাতের খাওয়া অব্দি সবই এই টেবিলে চলছিল।

উৎপলা একদিন একটা চিলতি চিঠি পড়েতে পড়তে বললে, মেজদা আসবেন।

কবে?

আসতে অবিশ্যি দেরি আছে।

এ-মাসে?

চিরকুটটা রেখে দিয়ে উৎপলা বললে, মাস-দেড়েকের মধ্যেই; পরিবার নিয়ে।

মেজোশালার ছেলেমেয়ে কটি?

তিনটি।

তিনটিই তো বেশ বড়ো-বড়ো।

হ্যাঁ।

তাহলে জায়গার টানাটানি হবে তো।

ঐ খাবার ঘরটায় গিয়ে আমরা থাকব।

তুমি আর মনু?

আমরা দুজন তো বটেই, উৎপলা সমীচীন কচ্ছপের চাড়ার মতো কঠিন একটা ভাব দেখিয়ে তবুও বললে তুমিও আসতে পার দেখি কী হয়।

মাল্যবান খুব অগ্রহে একটা কথা পাড়তে গিয়ে নিজেকে শুধরে নিয়ে অন্য কথা পেড়ে বললে, অতটুকু ঘরে তিনজন কী করে আঁটবে?

তা আমি বন্দোবস্ত করে দেব। দুটো খাট পড়লেই তো আমাদের তিনটি প্রাণীর হয়ে যায়। আমাদের একটা সেলের মতো ঘর হলেই হয়ে যায়। দেখেছ তো দমদম জেলে।

সত্যাগ্রহের আসামী মনে করে একটা বিশৃঙ্খলা ভিড়ের ভেতর থেকে অন্য অনেকের সঙ্গে মাল্যবান ও উৎপলাকে গ্রেপ্তার করে জেলে আটকে রাখা হয়েছিল—দিন দুইমাস ছয়েক আগে।

দেখেছি তো, মাল্যবান বললে। কিন্তু দোতলার বড়ো ঘরটায় এতদিন মাল্যবানকে কী—একটা ক্যাম্পখাট অব্দি পাততে দেওয়া হয়নি কেন? না হোক, উৎপলার অত বড়ো খাট মাল্যবানকে শুতে দেওয়া হয়নি কেন?

মাল্যবান নিজের দাম্পত্যজীবনের আকাশ প্রমার ব্যর্থতাকে তিল প্রমাণের ভেতর মজিয়ে এনে তিলের ভেতরে তবুও ব্রহ্মাণ্ড দেখতে দেখতে একটু বিষণ্ণ ভাবে হেসে ভাবছিল, কাঁকড়েশ্বরী পরমেশ্বরী, জেলে তো কাঁকড়ার গর্তেও আমাদের এঁটে গেছে, তোমরা মেজদা এলে খাবারের ঘরটায়ই হয়ে যাবে, কিন্তু তুমি আর আমি শুধু থাকি যখন এ-বাড়িতে, দোতলার এই বড়ো ঘরটায় আমর জায়গা হয় না কেন? নিচের ঘরে বকনাবাছুর রামছাগলের কান টানে, কান-টানে না, প্রাণ-টানের খুঁটে আমাকে না বেঁধে রাখলে তোমার রাখালী ঘুমটা পাকে না বুঝি ওপের তলায়?

ঠিক হয়ে গেল ছাদের উত্তর দিকের খাবারের ঘরে এরা তিনজনে থাকবে, বাকি দুটো বড়ো-বড়ো ঘরই মেজদা আর তার পরিবারকে ছেড়ে দেবে।

মেজোবৌঠান মানুষ মন্দ নয়, উৎপলা বললে, কিন্তু আমি ভাবি মেজদার জন্য। মেজদা একটু সুখী মানুষ কিনা—

পদ্মার ইলিশের মতো সুখী বটে তোমার মেজদা।

কী রকম?

সূর্যের একটা ঝিলিক দেখলেই লাট খেয়ে পড়ে মাছ—

আচ্ছা, আচ্ছা, হয়েছে উৎপলা বললে, আমি যা বলছিলাম, একটা আড়ে-দীঘে প্রমাণ ঘর নিজের জন্য না পেলে মেজদার চলবে না।

মাল্যবান বললে, ঐ দোতলার বড়ো ঘরটায় তিনি একাই থাকবেন বুঝি? ঘরটা বেশ বড়ো—আলো-হাওয়াও খুব। থাকুন।

ঐ ঘরটাই দেব দাদাকে—

তোমার বৌঠান থাকবেন কোথায়?

তিনিও ঐ ঘরেই।

তোমার দাদার সঙ্গেই।

শোন কথা, রামকানাইয়ের সঙ্গে তবে?

মেজদি তো নিচের ঘরে থাকলেও—

বৌঠান নিচের ঘরে থাকবেন? কেন? তোমার খচখচ করছে কোথায়?

মাল্যবান বললে, যে-রকম সুখী মানুষ তোমার দাদা তাঁকে একটা ঘর ছেড়ে দিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে অন্য এক ঘরে শোবার ব্যবস্থা যদি করেন বৌঠান, তাহলে সারাটা দিন দাদা তো তার কাছে গিয়ে থাকতে পারেন, কিংবা তিনি দাদার কাছে এসে বসতে পারেন। এতে তো কোনো অসুবিধে হয় না কারু

কিন্তু রাতের বেলা?

তখন অবিশ্যি যে যাঁর ঘরে গিয়ে শোবেন।

তা হয় না।

কেন?

বৌঠান কাছে না থাকলে মেজদার ঘুম হয় না। এ নিয়ে মেজদার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে ঠাট্টা করে।

ঠাট্টা চলে বটে।

কী রকম? বললে উৎপলা। তার মুখের আত্মতুষ্টির ঝিলিক নিভে গেল।

কোনো অসুখ আছে মেজদার?

কিছু নেই।

সুস্থ মানুষ?

মেজদা-মেজদি দুজনেই। ওরা এক জোড়! প্রথম থেকেই হয়ে এসেছে। তুমি এখন ভাঙবে?

খুব ভালো শাখার ব্যবসায়ী ছিলাম আমি, মাল্যবান একটু হেসে বললে, তোমার হাতও ননীর মতো নরম ছিল, কিন্তু কোনো শাখাই পরাতে পারলাম না কেন?

মাল্যবানের কথা উৎপলার কানে অপ্রাসঙ্গিক চরিত্রের স্বগতোক্তির মতো শোনাল। ও-রকম গোপনীয়তার ছায়া মাড়াতে চাইল না যে। শোনেনি যেন মাল্যবানকে, নিজের কথার জের টেনে উৎপলা বললে, এক চিলতি চিঠি এসেছে তো মেজদির কাছ থেকে পণ্ডিচেরী থেকে। দেড়মাস পরে পণ্ডিচারীর থেকে আসবেন মেজদা-মেজদি; ছেলেমেয়েরা পণ্ডিচারী নেই—কাছেই আছে–সেখান থেকে তাদের কুড়িয়ে নিয়ে আসবেন। আমাদের বাড়িঘর চুনকাম করিয়ে নিলে কেমন হয়।

মাল্যবান চুপ করে ছিল; তার খুব তাজা কথাটার কোনো উত্তরই দিল না উৎপলা; কথাটা শুনেছে বলেও স্বীকার করল না।

জানালা দরজা সব আগে থাকতেই বেশ রঙ করিয়ে নিলে ঠিক হবে। উৎপলা বললে।

আমাদের নিজেদের খরচে?

তবে আবার কার খরচে? বাড়িওয়ালার?

না, না, সে তো তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখবে আর হাসবে!

হাসবে?

জামাই-এর শালা আসছে বলে শালার বোনাই গরাদে স্বয়ং মাখছে। হাসবে না? চুনকাম রং করিয়ে নিতে খরচের ঠ্যালা আছে। ওসব জিেিনসর দরকারও নেই এখন। দেয়ালগুলো বেশ পরিষ্কার, দরজা-কপাটএ খারাপ নয়। এসব জিনিস নিয়ে মাথা খারাপ করবার মতো বেশি টাকার রস মাল্যবানের নেই এখন; কিন্তু উৎপলাকে কিছু বলতে গেল না সে। বললে বুঝবে না। মেজদা এলে তাকে দিয়ে বলালে বুঝবে। বটে কিংবা মেজদিকে দিয়ে; তাদের মাথা ঠাণ্ডা আছে; প্লাগটাগও বেশ ভালোই কাজ করছে তাদের অন্তরেন্দ্রিয়ের এঞ্জিনের। বেশ চমৎকার দাম্পত্য জীবনই জমিয়ে বসেছে বটো মাল্যবানেরা; কুয়াশার ভেতর থেকে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে যেন উৎপলার দিকে তাকিয়ে রইল মাল্যবান।

তাহলে এরা দুজনেই এই বড়ো ঘরে থাকবে শোবে?

হ্যাঁ।

আর ছেলেমেয়েরা?

নিচে শোবে।

একা-একা নিচে থাকবে?

দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলে ভয় নেই কিছু।

মাল্যবান কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বললে, আমি গিয়ে সেখানে শুতে পারি না?

ছেলেপুলেদের মধ্যে?

হ্যাঁ।

উৎপলার মুখের অসাধ দেখা দিল সময়ের শূন্যতার ভেতর একটা ছ্যাঁদার মতো যেন।

না, অত আটবে কী করে? অত ঘুজিঘুজিতে ওদের কষ্ট হবে।

তাহলে তুমি তো পার শুতে ওদের সঙ্গে। মাল্যবান বললে।

আমি অবিশ্যি শুতে পারি গিয়ে। তাই করতে হবে হয়তো। বৌঠান তো রাত হলে ওপরের থেকে আর নামতে পরবেন না।

একটা কীর্তনের সুর গাসতে গাইতে উৎপলা ছাদের দিকে চলে গেল। মাল্যবান খানিকটা হতচকিত, আড়ষ্ট, তারপরে অরহিত হয়ে অনেকক্ষণ ঘরের ভেতর বসে রইল। দুটো কীর্তন সাঙ্গ হল; তারপরে মাল্যবানের বাঁশ বনে ডোম কানা ভাবটা কেটে গেল অনেকখানি। কীর্তন শুনে অবিশ্যি নয়। এম্নিই।

একটা ভারি নিঃশ্বাস ফেলে সে গোলদীঘির দিকে চলে গেল।

দীঘির চারপাশে পাক খেতে খেতে সে অনেক কথা ভাবল, তারপর বেশি কথা ভাবতে ভাবতে চারদিকের নটেগাছগুলোকে ঠুঁটো হয়ে মুড়োতে দেখে একটা বেঞ্চিতে এসে চুরুট জ্বালাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *