অদ্ভুত আঁধার এক

অদ্ভুত আঁধার এক! 

ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের কথা। ছুটিটা বাসায় কাটিয়ে রাতে হলে ফিরছি। একা একা নাইট জানি, তাই বাসার সবাই বেশ টেনশনে। ফোনের পর ফোন দিয়ে অস্থির করে তুলছিল। দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারছিল না কেউই।

ট্রেন ছাড়ল রাত ১১ টার অনেক পরে। আম্মু ঘুমিয়ে যায় ১১ টার অনেক আগেই, কিন্তু সেদিন জেগে ছিল। আম্মুকে ফোন করলাম, আমার ফোনের পর আম্মু ঘুমাল।

“ভাই, আপনার ফোন থেকে একটা কল করা যাবে?”

পাশের সিটে বসা প্রশ্নকারীর দিকে ঘুরে তাকালাম। ২৪/২৫ বছরের মতো বয়স। নিম্নবিত্ত। কিছুটা অবাক হয়েই বিরক্তিমাখা সুরে বললাম, “হ্যাঁ করেন।” 

আমার বিরক্তিটা সহজেই টের পেল। কৈফিয়তের সুরে বলল, “ভাই আমার ফোন হারায়ে গেসে গতকাল। বুড়া মা বাসায় চিন্তা করছে। ফোন না করলে আমার মা’টা ঘুমাতে পারবে না। আমার ফোন থেকে তার পাশের বাসায় ফোন করল (তার মায়েরও ফোন নেই)। তার মাকে জানাতে বলল সে ভালোমতো ট্রেনে উঠেছে।

এসি রুমে আরামদায়ক বিছানায় শোয়া সন্তানের জন্য যে রকম দুশ্চিন্তা করেন, ফুটপাতে শোয়া মা-ও তার সন্তানের জন্য সে একই রকম দুশ্চিন্তাই করেন। সন্তানের প্রতি মায়েদের এ ভালোবাসায় আর কোনো ব্যাপার নেই, কোনো ভেজাল নেই। আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিশাল একটা অংশ মায়েদের এই অপার্থিব ভালোবাসা, বোনের স্নেহের প্রতিদান দিচ্ছে তাদের নিয়ে লেখা চটিগল্প পড়ে! আমরা অনলাইনের জগৎটাকে এমন অসুস্থ বানিয়ে ছেড়েছি যে, বাংলায় টাইপ করে গুগলে কিছু খুঁজতে গেলে রীতিমতো ভয় হয়, কোনো সুস্থ লোকের প্রবৃত্তি হয়নী! 

একটা বিশাল প্রজন্ম গড়ে উঠেছে এবং উঠছে যারা প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডি পার হবার আগেই চরম অশ্লীলতার জগৎটার সাথে পরিচিত হয়ে যাচ্ছে। যারা মা, বোন, কাযিন, ভাবি, খালা, চাচি, মামি এদের নিয়ে লেখা মিথ্যেয় ভরা চটিগল্প পড়ে আর দিনরাত সেক্স ফ্যান্টাসিতে ভোগে। পর্ন দেখাকে জাস্টিফাই করার জন্য কিছু মানুষ যেমন দাবি করে আমি তো শুধু দেখছিই কিছু করছি না, তেমনই চটিগল্পের জন্যও এমন যুক্তি দেখানো মানুষের অভাব নেই। 

আসলেই কী তা-ই? চটিগল্প কী ক্ষতিকর নয়? চটিগল্প, পর্ন ভিডিওর মতোই ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে পারে পীঠকের ওপর। বই, কথা, লেখী মানুষের মনোজগৎকে প্রভাবিত করার জন্য খুবই শক্তিশালী একটি মাধ্যম। কুরআনের দিকে আমরা তাকাতে পারি। 

আল্লাহ্ কালামু-সংবলিত এ পবিত্র বই কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের গতিপথ পরিবর্তন করেছে এবং করছে। পাথরের চেয়েও কঠিন মনের মানুষ। কুরআন পড়ে শিশুর মতো অঝোরে কাঁদে, এ কুরআন পড়েই আল্লাহর জন্য মানুষ তার জীবনটা বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।

বইয়ের প্রভাবকে খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই। চটিগল্প পড়ার সময় পাঠক অনেকক্ষণ ধরে বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করার সময় পায়। ইচ্ছে হলেই পড়া বন্ধ করে সেক্স ফ্যান্টাসিতে ডুবে যায়। কিন্তু পর্ন ভিডিওর ক্ষেত্রে এ সুযোগ থাকে সীমিত। দৃশ্যের দ্রুত পরিবর্তন হয়, চিন্তা করার খুব একটা সময় থাকে না। কোনো বিষয়ের ওপর ভিডিও দেখা বা লেকচার শোনার চেয়ে সেই বিষয় নিয়ে বই পড়লে সেটা বেশি সময় ধরে মাথায় থাকে। চটিগল্পে পড়া জিনিসগুলো পাঠকের মস্তিষ্কে দীর্ঘ সময়ের জন্য পাকাঁপোক্ত আসন গেড়ে বসে। সারাক্ষণ মাথার মধ্যে কৃমির মতো কিলবিল করতে থাকে গল্পের ঘটনাগুলো। বিকৃত অবাধ্য চিন্তাগুলোর হাত থেকে সহজে রেহাই পাওয়া যায় না।

আর সারাক্ষণ মাথার মধ্যে বিকৃত চিন্তা ঘোরাফেরা করলে সেটা আপনার আচরণে প্রভাব ফেলবেই। পর্ন দেখা বা হস্তমৈথুন করার ট্রিগার হিসেবে কাজ করে এটা। চটিগল্পের নেশী আপনাকে একদিন না-একদিন হস্তমৈথুন আর পর্ন-আসক্তির দিকে ঠেলে নিয়ে যাবেই। সাধারণত চটিগল্পের নেশী দিয়েই অশ্লীল অসভ্য ভয়ঙ্কর এই জগৎটাতে মানুষের প্রবেশ ঘটে, হস্তমৈথুন পর্ন-আসক্তির বেড়া ডিঙ্গিয়ে লিটনের ফ্ল্যাটে গিয়ে এ পথচলা শেষ হয়; ভুল বললাম বোধহয়, লিটনের ফ্ল্যাটে না, পথচলা শেষ হয় জাহান্নামের আগুনের গর্তে গিয়ে। যদি আপনি কখনো এ জঘন্য নেশার ফাঁদে পড়ে থাকেন, তাহলে একটু নিচের কথাগুলো চিন্তা করুন। প্রথম প্রথম যখন চটিগল্প পড়া শুরু করেছিলেন তখন মা, বোন, খালা, ভাবি, চাচি, মামি, কাযিন, পাশের বাসার আন্টি, টিচার, কাজের মেয়েদের নিয়ে লেখা গল্পগুলো পড়ে আপনার মনে হতো না, গল্পগুলো কত জঘন্য? কিন্তু আস্তে আস্তে আপনার কাছে সেটাই স্বাভাবিক হয়ে গেল। আপনি তাদের নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগা শুরু করলেন, তাদের বিভিন্ন অচিরণের অন্য অর্থ করা শুরু করলেন, শেয়ালের চোখে দেখতে শুরু করলেন তাঁদের। বশ করার ফন্দি আঁটলেন, হয়তো সুযোগও খুঁজলেন, তাই না? অস্বীকার করবেন না। 

স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি ছেলেদের চিন্তাভাবনা কতগুলো নিকটাত্মীয়কে (ভাবি, শালী, কানি) নিয়ে একটু অন্য রকম হয়। চটিগল্প তাদের সেই অবাধ্য চিন্তায় রংচং লাগিয়ে, একেবারে নষ্ট কল্পনা যেমন চায় তেমনভাবেই উপস্থাপন করে। চটিগল্পের প্রধান সমস্যাটাই এখানে। আপনাকে এটা যৌনতা সম্পর্কে একগাদা মিথ্যে তথ্য গুলে খাওয়াবে এবং একসময় আপনি সেগুলো সত্যি বলে ধরে নেবেন। সত্যিই বোধহয় তারা আমার কাছ থেকে কিছু চায়, আমার সাথে বিছানায় যেতে আগ্রহী… ইত্যাদি, ইত্যাদি। আপনার চিন্তা এখানেই থামবে না, চটিগল্পে পড়া নারী শিকারের টেকনিকগুলো নিজের জীবনেও প্রয়োগ করার চেষ্টা করবেন। বিকৃত চিন্তার গল্পগুলো পড়ে নিজের ভেতর ক্রমাগত যে “কীমের” আগ্নেয়গিরি তৈরি করছেন তার অন্নুৎপাত হলে কী হবে, ভেবেছেন কখনো? কত ঘর ভাঙবে, সম্পর্ক আর জীবন নষ্ট হবে? আপনার বাবা-মার কথা একবার চিন্তা করুন। কী পরিমাণ লজ্জিত, অপমানিত হবেন তারা! চটিগল্পের নেশী আপনাকে তিলে তিলে ধ্বংস করে ফেলবে। আপনার দৃষ্টিশক্তি কমে যাবে, স্মৃতিশক্তি কমে যাবে। আপনার মস্তিষ্কে বড়সড় একটা পরিবর্তন আসবে এবং এই পরিবর্তনটা ক্ষতিকর। চটিগল্প কীভাবে যৌনতা সম্পর্কে মহিলাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয় মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি সেটার ওপর একটা এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিল। দেখা গেল, যেসব মহিলারা চটিগল্প পড়ে তাদের। মদ্যপান করার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তাদের একাধিক যৌনসঙ্গী থাকে, অবাধ যৌনাচার, বেহায়াপনায় তারা গা ভাসিয়ে দেয়। আল্লাহ্ বলেছেন, “যিনার কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই তা অশ্লীলতা ও বিপথগামীতা” –এমন সবকিছু থেকে দূরে থাকো, যা তোমাকে যিনার দিকে নিয়ে যেতে পারে। চটিগল্প পড়ার অভ্যাস আপনাকে যিনার দিকে নিয়ে যাবে কি না সেটা পরে আলোচনার ব্যাপার, আসল পয়েন্টটা হচ্ছে চটিগল্প পড়াই যিনার অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ বলেছেন, “আদমসন্তানের ওপর যিনার যে অংশ লিপিবদ্ধ আছে তা সে পাবেই। চোখের যিনা হলো নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি দৃষ্টিপাত করা, দু’কানের যিনা হলো শ্রবণ করা, রসনার যিনা হলো কথোপকথন, হাতের যিনা হলো স্পর্শ করা, পায়ের যিনা হলো হেঁটে যাওয়া, অন্তরের যিনা হলো আকাঙ্ক্ষা এবং কামনা করা।” 

তাহলে এবার হিসেব করুন কয় ধরনের যিনা আপনি করলেন। প্রথমত, হাত দিয়ে কীবোর্ড চেপে সার্চ করে করে চটিগল্প বের করে হাতের যিনা করলেন। দ্বিতীয়ত চোখের যিনা– চোখ দিয়ে নিষিদ্ধ জিনিস দেখলেন এবং পড়লেন। তৃতীয়ত অন্তরের যিনা– চটিগল্পে পড়া জিনিসগুলো চিন্তা করলেন এবং ভাবলেন, “ইশ! একবার যদি হতো এ রকম!”

 এবার আরেকটা হাদীস শোনাই। খুব ভয়ঙ্কর হাদীস। রাসূলুল্লাহ বলেছেন, “আমি স্বপ্নে একটি চুলা দেখতে পেলাম যার ওপরের অংশ ছিল চাপা আর নিচের অংশ ছিল প্রশস্ত আর সেখানে আগুন উত্তপ্ত হচ্ছিল, ভেতরে নারী-পুরুষরা চিৎকার করছিল আগুনের শিখা ওপরে এলে তারা ওপরে উঠছে, 

আবার আগুন স্তিমিত হলে তারা নিচে যাচ্ছিল, সর্বদা তাদের এ অবস্থা চলছিল। আমি জিব্রিলকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এরা কারা? জিব্রিল বললেন, “এরা হলো যিনাকারী নারী ও পুরুষ।” 

জাহান্নামের আগুন এতটাই ভয়াবহ সেখানে কেউ যদি এক সেকেন্ড না, এক মাইক্রো সেকেন্ড বা তারচেয়েও অনেক কম সময় থাকে, তাহলেই সে দুনিয়ার সকল আনন্দ, সকল মজী, আরাম-আয়েশ ভুলে যাবে। হয়তো সে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি ছিল, জীবনেও কোনো দুঃখ-কষ্টের মুখোমুখি হয়নি, রাজার হালে। থেকেছে, যা মন চায় খেয়েছে, ইচ্ছেমতো পান করেছে। কিন্তু জাহান্নামের একটি মুহূর্ত দুনিয়ার সব সুখস্মৃতি ভুলিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। চটিগল্প পড়ে সাময়িক মজা পাচ্ছেন কিন্তু একটা বিশাল পাপের পাহাড় তৈরি করছেন ধীরে ধীরে। আর আপনার আপ্যায়নের জন্য উত্তপ্ত করা হচ্ছে জাহান্নামের আগুন। নিজেকে বাঁচান! জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচান! কোনোমতেই যে ওই আগুন সহ্য করা সম্ভব না! 

অদ্ভুত আঁধার এক

অদ্ভুত আঁধার এক

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *