একজন কবির উদ্দেশে

একটি পংক্তির মধ্যপথে অকস্মাৎ কবেকার
দীর্ঘ গাছ ফেলে ছায়া, কার আত্মহত্যা গান গায়;
একটি শব্দের শেষে বসিয়ে কোমল কমা তুমি
দেয়ালে কী যেন খোঁজে বারবার; কিছু পথরেখা
স্মৃতিরুপ ভেসে ওঠে, কোনো কোনো রাস্তার কি নাম
কিছুতে পড়ে না মনে। একটি পংক্তির মধ্যপথে

মনে পড়ে যায় পার্কে দেশলাই ধার চেয়ে তুমি
আঁধারে ধরিয়ে ছিলে সিগারেট। একটা সন্ধ্যায়
পথে যেতে যেতে দূর থেকে দেখেছিলে পথপ্রান্তে
পুরোনো বর্ষায় কী নিসঃঙ্গ ভিজছে নতুন গণিকা
তেঁতুল গাছের নিচে, প্রসাধন তার মুছে গেছে
ব’লে তাকে বড়ো বেশি বালিকার মতো লেগেছিলো।

বাক্যের শুরুতে কিছু ডোরাকাটা প্রাণী ধেয়ে আসে,
অর্ধযতি টেনে ভাবো তোমার টাইপরাইটার 
নেই, ঘরে ইঁদুরের বড়ো উপদ্রব, বর্ষাকালে
শোবার ঘরের ছাদ ভীষণ প্রস্রাব করে, ভাবো
তোমার একটি ঘড়ি চাই, শ্যার্টে বোতাম লাগানো
দরকার, তা’ছাড়া জুতোজোড়া পাল্টে নিলে ভালো হয়।

কখনো একটি পংক্তি খুব বেঁকে বসলে ভীষণ
বিরক্তিতে তড়িঘড়ি দাঁড়াও চেয়ার ছেড়ে যাও
বারান্দায়, যেন বুনো ঘোড়াটিকে বাগ মানানোর
সরঞ্জাম আছে সেখানেই; নিজেকেই প্রশ্ন করো-
তোমার জীবন কি রকম মূল্যবান? কতটুকু
প্রকৃত জীবন তুমি যাপন করেছো? কখনোবা

কলম সরিয়ে রেখে ভাবো ক্লান্ত তোমার গৃহিণী
রাঁধে বাড়ে, কোনো কোনোদিন কাঁদে অভ্যস্ত বালিশে
মাথা রেখে, যথারীতি সন্তান পালন করে, তুমি
পার্টিতে চুমুক দাও স্বপ্নের মতন গ্লাশে, শিল্প
সমালোচকের সঙ্গ ছেড়ে কথা বলো সুসজ্জিতা
মহিলার সঙ্গে, করো মুখস্থ মুখশ্রী কারো কারো।

রাত্রির পার্টিতে তুমি রাত্রির মতোই হয়ে যাও;
কখনো দাঁড়িয়ে একা এক কোণে এলেবেলে শব্দ
তুলে নাও কারো চোখ চুল কিংবা ঘরের দেয়াল
থেকে অগোচরে ধীরে সুস্থে স্বপ্নাংশ রচনা করো।
এই আসবাব, এইসব মুখ, এসবের সঙ্গে
সম্পর্ক আছে কি কিছু সরাসরি তোমার শিল্পের?

এই বাড়ি, যা বয়স্ক, বেশ জীর্ণ বটে, যা তোমার
আপন নিবাস, এই বাড়ি প্রতিদিন তোমাকেই
লক্ষ্য করে তীক্ষ্ম গুপ্তচরের নিষ্ঠায়, এ বাড়ির
থেকে ঝরে এক রাশ রঙিন পালক, পালকেরা
তোমার স্বপ্নের অভ্যন্তরে ঝরে, হয়ে যায় ফের
শিল্পের শিশির; এ বাড়ির অতিশয় নোনাধরা
দেয়ালে দেয়ালে ঠোকরায় প্রাচীন স্বপ্নের লোভে
রুক্ষ কাগজের মতো পাখি ঠোকরায় বারংবার।

টেবিলে তোমার হাত পড়ে থাকে স্তিমিত কখনো,
অলস কলম যেন; ভাবো চাঁদ উঠলেই হাতে
আবার জাগবে স্রোত প্রখর রূপালি। কোনো কোনো
মুহূর্তে একটি বাক্য লেখা হ’লে দ্যাখো সবিম্পয়ে
বৃষ্টিপাতে ডোবে চক্ষুময় নৌকা, বনস্থলী, সেতু
রত্নসম্ভারের মতো জলকন্যা, যুদ্ধের জাহাজ।

অকস্মাৎ মধ্যরাতে একটি পংক্তির মধ্যপথে
মনে পড়ে সেই কবে কারো কাছে কি যেন চাইতে
ভুলে গিয়েছিলে; অনন্তের শুভ্রতায় এ তোমার
কেমন ভিখিরিপনা? অন্ধকারে কাঙালের হাত
তোমাকে মুদ্রার মতো তুলে নিতে চায়। ফুল ফোটে
তোমার মুখের হাড়ে, বারংবার ধ্বনিপুঞ্জ তুমি।