অনন্দা

অনন্দা

এই পৃথিবীর এ এক শতচ্ছিদ্র নগরী।
দিন ফুরুলে তারার আলো খানিক নেমে আসে।
গ্যাসের বাতি দাঁড়িয়ে থাকে রাতের বাতাসে।
দ্রুতগতি নরনারীর ক্ষণিক শরীর থেকে
উৎসারিত ছায়ার কালো ভারে
আঁধার আলোয় মনে হতে পারে
এ-সব দেয়াল যে-কোনো নগরীর;
সন্দেহ ভয় অপ্ৰেম দ্বেষ অবক্ষয়ের ভিড়
এ-সব দেয়াল যে-কোন নগরীর;
সন্দেহ ভয় অপ্রেম দ্বেষ অবক্ষয়ের ভিড়
সূর্য-তারার আলোয় অঢেল রক্ত হতে পারে
যে-কোনো দিন; সে কতবার আঁধার বেশি শানিত হয়েছে;
বাহক নেই–দুরন্ত কাল নিজেই বয়েছে
নিজেরই শব নিজে মানুষ,
মানবপ্রাণের রহস্যময় গভীর গুহার থেকে
সিংহ শকুন শেয়াল নেউল সৰ্পদন্ত ডেকে।

হৃদয় আছে বলেই মানুষ দেখ, কেমন বিচলিত হয়ে
বোনভায়েকে খুন ক’রে সেই রক্ত দেখে আঁশটে হৃদয়ে
জেগে উঠে ইতিহাসের অধম স্থূলতাকে
ঘুচিয়ে দিতে জ্ঞানপ্রতিভা আকাশ প্ৰেম নক্ষত্ৰকে ডাকে।

এই নগরী যে-কোনো দেশ; যে-কোনো পরিচয়ে
আজ পৃথিবীর মানবজাতির ক্ষয়ের বলয়ে
অন্তবিহীন ফ্যাক্টরি ক্রেন ট্রাকের শব্দে ট্র্যাফিক কোলাহলে
হৃদয়ে যা হারিয়ে গেছে মেশিনকণ্ঠে তাকে
শূন্য অবলেহন থেকে ডাকে।
‘তুমি কি গ্ৰীস পোল্যাণ্ড চেক প্যারিস মিউনিক
টোকিও রোম ন্যুইয়র্ক ক্রেমলিন আটলান্টিক
লণ্ডন চীন দিল্লী মিশর করাচী প্যালেস্টাইন?
একটি মৃত্যু, এক ভূমিকা, একটি শুধু আইন।’
বলছে মেশিন। মেশিনপ্রতিম অধিনায়ক বলে :
‘সকল ভূগোল নিতে হবে নতুন ক’রে গড়ে
আমার হাতে গড়া ইতিহাসের ভেতরে,
নতুন সময় সীমাবলয় সবই তো আজ আমি;
ওদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে আমার স্বত্বাধিকারকামী;
আমি সংঘ জাতি রীতি রক্ত হলুদ নীল;
সবুজ শাদা মেরুন অশ্লীল
নিয়মগুলো বাতিল করি; কালো কোর্তা দিয়ে
ওদের ধূসর পাটকিলে বাফ কোর্তা তাড়িয়ে
আমার অনুচরের বৃন্দ অন্ধকারের বার
আলোক ক’রে কী অবিনাশ দ্বৈপ-পরিবার।

এই দ্বীপই দেশ; এ-দ্বীপ নিখিল তবে।
অন্য সকল দ্বীপের হ’তে হবে
আমার মতো—আমার অনুচরের মতো ধ্রুব।
হে রক্তবীজ, তুমি হবে আমার আঘাত পেয়ে
অনবতুল আমির মতো শুভ।’

সবাই তো আজ যে যার অন্তরঙ্গ জিনিস খুঁজে
মানবভ্রাতাবোনকে বুকে টেনে নেবার ছলে
তাদের নিকেশ ক’রে অনির্বাচন রক্তে এই পৃথিবীর জলে
নানারকম নতুন নামের বৃহৎ ভীষণ নদী হয়ে গেল;
এই পৃথিবীর সব নগরী পরিক্রমা ক’রে
নতুন অভিধানের শব্দে ছন্দে জেগে সুপরিসর ভোরে
এ—সব নদী গভীরতর মানে পেতে চায়—
দিকসময়ের আতল রক্ত ক্ষালন ক’রে অননুতপ্ততায়;
বাস্তবিকই জল কি জলের নিকটতম মানে?
অথবা কি মানবরক্ত বহন করি নির্মম অজ্ঞানে?
কি আন্তরিক অর্থ কোথায় আছে?
এই পৃথিবীর গোষ্ঠীরা কি পরস্পরের কাছে
ভাইয়ের মতো : সৎ প্রকৃতির স্পষ্ট উৎস থেকে
মানবসভ্যতার এই মলিন ব্যতিক্রমে জেগে উঠে?
যে যার দেহ আত্মা ভালোবেসে অমল জলকণার মতন সমুদ্রকে এক মুঠে
ধ’রে আছে?
ভালো করে বেঁচে থাকার বিশদ নির্দেশে
সূৰ্যকরোজ্জ্বল প্ৰভাতে এসে
হিংসা গ্লানি মৃত্যুকে শেষ ক’রে
জেগে আছে?

জেগে উঠে সময়সাগরতীরে সূর্যস্রোতে
তবুও ক্লান্ত পতিত মলিন হতে
কী আবেদন আসছে মানুষ প্রতিদিনই—
কোথার থেকে শুকুনক্রান্তি বলে :
‘জলের নদী? জেগে উঠুক আপামরের রক্ত কোলাহলে!’

এ-সুর শুরু হয়েছিলো কুরুবর্ষে–বেবিলনে ট্রয়ে;
মানুষ মানী জ্ঞানী প্রধান হয়ে গেছে; তবুও হৃদয়ে
ভালোবাসার যৌনকুয়াশা কেটে
যে-প্ৰেম আসে সেটা কি তার নিজের ছায়ার প্রতি?
জলের কলরোলের পাশে এই নগরীর অন্ধকারে আজ
আঁধার আরো গভীরতর করে ফেলে সভ্যতার এই অপার আত্মরতি;
চারি দিকে নীল নরকে প্রবেশ করার চাবি
অসীম স্বৰ্গ খুলে দিয়ে লক্ষ কোটি নরককীটের দাবি
জাগিয়ে তবু সে-কীট ধ্বংস করার মতো হয়ে
ইতিহাসের গভীরতর শক্তি ও প্রেম রেখেছে। কিছু হয়তো হৃদয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *