০২.৫ সাধনসঙ্গিনী

০২.৫ সাধনসঙ্গিনী

মেয়ে অমূল্য রতন সাধনার ধন।
যে করে ভজন কাছে রয় সদায়।
যত যোগী ঋষি মুনি মহা মহাজ্ঞানী
মেয়ের সঙ্গ ছেড়ে পড়েছে দশায়।

তখন সবে চেনাজানা হয়েছে ওঁদের সঙ্গে। আমি যাতায়াত করছি ঘোষপাড়ার আখড়ায়, গান শুনছি। ঠিকানা নিয়ে চলে যাচ্ছি উঁদমারি, সাহেবকলোনি, দিগরে। আরও দুর চৌহদ্দিতেও বিস্তার ঘটছে আমার আস্তে আস্তে। চক্রাকারে পাক খাচ্ছি নদিয়া। চলে যাচ্ছি আসাননগর, ভীমপুর, ঘূর্ণি, মাটিয়ারি, ভাতজাংলা, দেবগ্রাম। বর্ধমান ফুঁড়ে উঠছি বীরভূমে। হাটগোবিন্দপুরের সাধনদাস বৈরাগ্য বলছেন নবাসন গিয়ে নির্মলা মা-র সঙ্গ দেখা করতে। চলে যাচ্ছি আমি। সেখান থেকে খয়েরবুনি। সনাতন দাস বাউলের কাছে। বাঁকুড়া পরিক্রমায় সোনামুখী, বেলিয়াতোড় হয়ে পাত্রসায়ের। এদিকে নরম বীরভূম। আহমেদপুরের ভাঙা পরিত্যক্ত রেল কোয়ার্টারে ফুলমালা দাসীর আস্তানাতেই রাত কাটিয়ে দিচ্ছি। মাধুকরীর নানা সাইজের চাল জড়ো করে ফুলমালা ভাত চাপাচ্ছেন। আর সারাদিনভর মাধুকরীর উপোসী পেটের ধকল সহ্য করে হাসি মুখেই গাইছেন : ‘অধর স্বরূপে, মূলাধারে রূপ রয়েছে, / স্বধনে শ্যাম গউর হয়েছে।’ শ্যামের এই রক্তমাংসের গৌর হয়ে ওঠার তত্ত্ব তখনও আমি ভালো করে বুঝে উঠতে পারিনি। অহরহ গান শুনছি আখড়া-আশ্রমে। জয়দেব-সতীমা-অগ্রদ্বীপ-সোনামুখী-কুলের পাট-যুগলকিশোর-পাথরচাপুড়ি বাউলের কোনো মেলা-উৎসবই তখন বাদ যাচ্ছে না আমার। এমনই এক উৎসবের রাতেই আমার ‘বিন্দুধারণ’ কথাটির সঙ্গে প্রথম পরিচয়। ‘পাত’, ‘ছারাব’ —এইসব সাধন এলাকার কথাও সেদিনই আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন আখড়ারই বাউলনি। বেশ মনে আছে সেটা ছিল অগ্রদ্বীপের মেলার দ্বিতীয় দিন। গতদিন মাটির পাত্রে দই চিড়ে কলা খেয়ে কেটেছে। সেদিনটা হল ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধ। এই ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধকে উপলক্ষ্য করেই অগ্রদ্বীপের মেলার সূত্রপাত বলা চলে। এখানকার গোপীনাথ প্রতি বছরের চৈত্র একাদশীতে কাছা পরে শ্রাদ্ধ সারেন ঘোষঠাকুরের। কৃষ্ণ এখানে সন্তান। গোপীনাথের সেবাপুজো গোবিন্দ ঘোষ বাৎসল্যভাবে করে আসছিলেন দৈবনির্দেশিকায়। সেজন্য ছেলের অবর্তমানে গোপীনাথই নাকি তার শ্রাদ্ধ করে আসবেন ফি বছর, এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই মেলার মাহাত্ম বোধহয় এখানেই। ভক্তবৎসল ঈশ্বর প্রতি বছরের এই দিনে মন্দির থেকে বের হয়ে গোবিন্দ ঘোষের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমতো কাছা পরে এক হাতে কুশ ও অপর হাতে পিণ্ড নিয়ে শ্রাদ্ধ সারেন। সন্তান হয়ে ঈশ্বরের এই জাগতিক রূপারূপ আর কোথাও দেখা যায় কিনা আমি জানি না। বোধহয় নয়। শ্রাদ্ধানুসারে তাই প্রথম দিন কেউই অনুগ্রহণ করেন না এখানে। দ্বিতীয় দিন অন্নোৎসব। বেশ বেলাবেলি খেয়ে ওঠার পর ঠাই মিলেছে মীরা মা-র আখড়ায়। ওখানে বসেই হাপিত্যেশ করছি আমি সাধনার মূল বিষয় কিছু শুনবার বুঝবার। এমন সময় মীরা মাই এলেন আমার সামনে। শান্ত কোমল বাংলার বাউলনির চেহারা। কিন্তু কে বলবে গত রাতে এ চেহারাই কেমন বদলে উঠেছিল পাল্লাগানে। কী অনায়াসেই মা আসরের বাউলদের অপদস্থ করেছিলেন অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানসমৃদ্ধ সুরের ভাষায়। কত আসরেই তাকে আমি দেখেছি মধ্যমণি হয়ে বসে থাকতে। কোলে রাখা ভুগিতে চাপড় মারতে। ডান হাতে ধরা একতারাতে টুং টাং বাজিয়ে নিতে। তারপরই আসর বন্দনা দিয়ে শুরু করে একেবারে সুর আর শব্দের মহাসমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়তে। তবে এই আসর হাট-মাঠ-ঘাটের নয়। একান্ত ঘরোয়া আসর সব। বেশিরভাগই শিষ্য-শিষ্যাদের বাড়ির। সেখানে কেবল সাধুগুরু বাউল-বৈষ্ণবদের যাতায়াত। সাধারণের কৌতূহলী প্রবেশ সে অর্থে নেই। একান্ত ভক্তজনের সামনেই মীরা মা কেবল গান করেন। তিনি ছিলেন কাকা গোঁসাইয়ের প্রধান সঙ্গিনী। শুনেছি গোঁসাই ছিলেন সিদ্ধ সাধক। দেহ রাখার পর মীরা মা তার আশ্রমের দায়ভার নিয়ে আছেন। ভক্ত-শিষ্য সকলেরই মা তিনি। আশ্রমে তত্ত্বকথা শুনিয়ে, সাধনার গান গেয়ে তিনি বেশ মর্যাদার সঙ্গে দিন কাটান। বাউলের প্রচার-খ্যাতি-ব্যভিচার এসব নিয়ে তাঁর হেলদোল নেই একেবারে। ভাবে মজে থাকেন। সেজন্য তিনি বর্তমান বাউল সমাজের যোজন হাত দূরে। তাই তাঁর বিশ্বাস এখনও কাকা গোঁসাইয়ের ভাবধারায়। বাউলের অবক্ষয়, অবনতি এসবে তার কলরব সেই এখনও প্রাচীন পন্থাতেই পড়ে। মেয়েরা সাধনসঙ্গিনী হয়ে সাধকের অতলস্পর্শকেই শুধু ছোঁবে। গান করবে কী!

সেই রাতেই মা-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সাধনায় মেয়েদের স্থান কতটুকু? রেগে উঠলেন মা।

-কতটুকু মানে! মেয়ে না হলে সাধন হবে? মেয়েরা হল গিয়ে সরোবর। সাধক সেখানে স্নান সারেন। সিদ্ধ হন।

–মেয়েদের তবে সিদ্ধতা আসে না? তারা সঙ্গিনীই কেবল?

আবার রেগে উঠলেন মা।

–কে বলেছে আবোল-তাবোল?

বললাম, না সাধনায় সাধকেরা তো উর্ধ্বগামী করে দিতে পারেন বস্তুকে।

বলতে দিলেন না মা।

বললেন, তা বস্তু উধ্বগামী করতে সাহায্য করে কে? মেয়েরা যদি শ্বাস আর দমের কাজ না শেখে সে পারবে? কীভাবে উর্ধ্বগামী হবে শুনি। যত আজেবাজে কথা।

জানি আমার দৃষ্টিভঙ্গি মনঃপূত হচ্ছে না মা-র।

বললেন, মেয়েরা সমান তালে যোগ করে। রেচক, পূরক, কুম্ভক সব করে।

মা-কে বলতে পারলাম না আমি, তা নয় করল, করে সাধক সিদ্ধ হল, নাম রটল তার। তাতে হল কী সঙ্গিনীর? সে তো আর সিদ্ধ আসন পেল না। সে যে কেবল সাধনসঙ্গিনী। বুঝলাম মীরা মা দাপুটে বলে প্রাপ্য সম্মান আদায় করে নিতে পারেন। একথা নবাসনের নির্মলা মা-র ক্ষেত্রেও ভীষণরকম সত্য। সকলের কাছেই তিনি মা-গোঁসাই নামে পরিচিত। সাধক হরিপদ গোস্বামীর সাধনসঙ্গিনী ছিলেন তিনি। বছর তিনেক হল দেহ রেখেছেন নির্মলা মা। তাঁর মুখেই শুনেছিলাম দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর গোঁসাই ঠাকুরের তিনি সাধনসঙ্গিনী। বাউল পথে আসার আগে গোঁসাই ছিলেন তন্ত্রসাধক। নির্মলা নিজে ছিলেন সচ্ছল পরিবারের গৃহবধূ। চাকরি করতেন স্বামী। আঠারো বছরে বিধবা হয়ে হঠাৎ করেই এ পথে আসেন তিনি। গোঁসাইকে শিষ্যবাড়িতে দেখেই মুগ্ধা নির্মলা বেরিয়ে পড়েন তার হাত ধরে। আর তাকে পেয়েই নাকি গোসাই এবার বাউল পথ ধরে। তা এই নির্মলা মা-রও গোঁসাইকে নিয়ে নিশ্চিন্ত জীবনযাপন। আশ্রমে অনটন ছিল না কোনো। শিষ্যদের বদান্যতায় বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন দুজনেই। বেশ ঠাটবাটে ছিলেন। মা-গোঁসাই। জানি না এখন গোঁসাই ঠাকুরানির কী দশা? নির্মলা মা-রও মতাদর্শ সঠিক সাধনের সাহচর্যে অনেকটা মীরা মোহন্তর মতোই। কিন্তু সবাই তো আর মীরা মা বা নির্মলা মা নন, তাহলে তাদের অবস্থান কী? আর সেই অবস্থান চিহ্নিত করতেই এখন মেয়েরা সাধক নন, গানের সঙ্গে বসবাস করছেন অনেকেই। গান গাইছেন। অনুষ্ঠান করছেন। বাউলের ধার আর ধারছেন না। অনেক দিনের বঞ্চনার ফলে এটা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক। মীরা মা এসব আঁত থেকে দুরে গুরু মা, মা-গোঁসাইয়ের জীবনধারণ করছেন তাই মেয়েদের অসহায়তা তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। নির্মলা মা-ও পারতেন না।

বলতেন, সাধনে দুজনা হল গিয়ে দুজনের আশ্রয়। গোঁসাই আমার আত্মা। ওকে ধরেই তো পরমাত্মার সঙ্গে মিলতে হবে।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পরমাত্মার মিলনে সিদ্ধি কেবল সাধকের?

-কে বললে এ কথা! সঙ্গিনীর সঙ্গে সাধন করতেছে সাধক। তার গতি আছে আর সঙ্গিনীর গতি নেই? এ হয় নাকি? সাধনায় দুজনেরই সিদ্ধি আসে।

—এক সঙ্গিনী কি সবসময়ে সাধককে সাধনায় সহায়তা করতে পারেন?

—শোনো কথা! পারবে না ক্যান?

–সঙ্গিনীর রজঃপ্রবাহ বন্ধ হলে সাধনা হবে কীসে?

-এই কথা! বাইরের রস বন্ধ হল তো কী হল? ভিতরের রস তো আছে নাকি! নারী সবসময়ই রস ধরতে পারে। তাই সে তো রজকিনী, এ পথে আয়। না এলে বুঝবি কী করে সঙ্গিনী রসহীন হয়ে ক্যামনে রস ধরবে।

নির্মলা মা-র বিশ্বাসে চিড় ধরাতে আমি পারিনি ঠিকই। আসলে চেষ্টাও করিনি। কেননা তিনি তো যথার্থ সাধনেই ছিলেন। নিবিড় দাম্পত্যের মতোই ছিল এক সাধকের পরম নিশ্চিন্তের তার আশ্রমজীবন। কথা হচ্ছে ক-জন মেয়ে পায় তার ও মীরা মা-র এই নিশ্চিন্ত সাধনজীবন-যা পাওয়ার জন্যই সকলে এ পথে আসে। ভাগ্যবতী সেই নারী আর ক-জন। তাই প্রবঞ্চিত গনগনে দহনজ্বালা ওঁদের বোঝার কথা নয়।

দুপুরের ঠাঠাপোড়া রোদেই কথা চলছিল বেশ আমাদের। রাধাচূড়া গাছের নীচে মীরা মা-র আখড়া। অদুরে গঙ্গা। চৈত্রের তাপ জল-হাওয়া-ছায়ায় মোটও স্বস্তিদায়ক নয়। তবু তারই মধ্যে মহিলা বাউল নিয়ে বিশেষত কৃষ্ণা দাসীর সম্পর্কে; তার গান বিষয়ে নানা কথা এলে মীরা মা-র সুর চড়ছে সেই রোদের মতোই।

বললেন, মেয়েদের আখড়া ছাড়া, আশ্রম ছাড়া গান গাওয়া অপরাধ। এইসব মেয়েরা বাউলমতের কলঙ্ক।

বললাম, বাউল যদি অনুষ্ঠানে গাইতে পারে তাহলে মহিলা বাউলরা গাইতে পারবেন না কেন?

রেগে উঠলেন তিনি।

বললেন, বাউল মতের বোঝো কী তুমি? গান কি বাউলের পথ?

মীরা মা-কে বোঝাতে পারিনি গানই এখন বাউল-পথ। বাউলরাই তাই করে নিয়েছে। বাউল এখন আর নিভৃত সাধনের বিষয় নেই। আলো, প্রচারের জন্য সেও যা নয় তাই করে ফিরছে।

মা বললেন, মেয়েদের কাজ হল সাধুসঙ্গ করা। বাউলকে এগিয়ে দেওয়া। বাউল মতকে, পথকে প্রতিষ্ঠা করা। ধরে রাখা।

বলে যাচ্ছেন মীরা মা, নবকুমার জাত বাউল। কৃষ্ণা তো ওর সাধনসঙ্গিনী ছিল। এখন সাধন ভূলে গান ধরেছে। মেয়েরা নেচেদে গাইবে কেন? আখড়ায় গাইতে পারে। মেয়েদের কাজ হল সাধনভজন করা।

খুবই ঝঝি দিয়ে কথা বলছেন মীরা মা। আমি চুপ। শুনে যাচ্ছি। কথা বলছি। ভাবছি শুধু তার বিশ্বাসের কথা। সেই আসন কে টলাবে শুনি। কতজন সাধক বাউল আছেন এখন। যারা আছেন তারা সাধনাতে কতটা বা আগ্রহী। গান, প্রচার, বিদেশযাত্রার তদবির নিয়ে অনেকে ব্যস্ত। মেয়েরা এর ভেতর কতটা সাধুসঙ্গ পাচ্ছে। সাধুই নেই। সাধকই নেই তার আবার সঙ্গ। সঙ্গিনীর সঙ্গে সাধকজীবন তো এখন ব্যভিচারে, অনাচারে হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের তথাকথিত live-to gether i

নবকুমার কৃষ্ণাকে ছেড়ে নতুন সঙ্গিনী জুটিয়ে নিয়েছেন। কৃষ্ণা সে সময় মেয়ে নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছিলেন। আমাকে তার দুঃখের কথা, সংগ্রাম জানিয়েছিলেন তিনি।

বলেছিলেন, জানো তো প্রথম-প্রথম প্রোগ্রাম হত না। সে নষ্ট করে দিত। তখন এখনকার মানুষটি পাশে না থাকলে ভেসে যেতাম আমি।

কৃষ্ণা একজন সহৃদয় মানুষ পেয়েছিলেন। যিনি তাকে ঘর দিয়েছিলেন। মেয়ের বিয়ে পর্যন্ত দিয়েছিলেন। কৃষ্ণার এরপর বড়ো দল হল। নামডাক হল। তিনি বেশ কয়েকজন গায়ক বাউল, বাজনদার নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন আখড়ামচ্ছবে, অনুষ্ঠানে। রেডিয়ো-টিভিতে অনুষ্ঠানের ডাক আসতে থাকল। পরবর্তীতে এই মীরা মা-র আখড়াতে বসেই, অগ্রদ্বীপের মেলাতেই আমি কৃষ্ণাকে পাল্লাগানে নবকুমারকে একেবারে ধরাশায়ী করে দিতে দেখেছি। কৃষ্ণাকে নিয়ে গল্প কম ছিল না। সেই গল্প কী আশা করি কাউকেই তা বলে বোঝাতে হবে না। কিন্তু যেটা আশ্চর্যের, কৃষ্ণার পাড়াতে তার যথাযোগ্য সম্মান রয়েছে। যখন প্রথম যাই খোঁজে, জানতাম নবকুমারের সঙ্গিনী কৃষ্ণা। সেইমতো একে-তাকে বলতেই সকলে একবাক্যে বলেছিলেন কৃষ্ণা তার সাথে আর থাকেন না।

কে কাকে ছেড়েছিলেন সেটা অন্য প্রশ্ন। কৃষ্ণা কখনও কোনোদিন নবকুমার সম্পর্কে খারাপ কথা আমাকে বলেননি। আবার নবকুমারও নন। তা এই কৃষ্ণা বছর দুই হল চলে গেছেন হঠাৎকরে আরও বড় ইন্দ্রসভায় গান শোনাতে। আর কী আশ্চর্য, তার পর-পরই নবকুমারও পৌঁছে গেলেন সেখানে। ঘটনাটা আমি জানতাম না। বেশ অনেকবছরই দুজনের কারও সঙ্গেই আর যোগাযোগ হয়ে উঠছিল না। নবকুমার অসুস্থ ছিলেন খবর পেয়েছিলাম বটে। কৃষ্ণা গড়িফার একটা অনুষ্ঠানে যেতে আমাকে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন। যথারীতি নানা ঝামেলায় দুজনের কারও কাছেই আর যাওয়া হয়নি। গতবছরই আমার বান্ধবী তার দলবল নিয়ে সতী মা-র মেলাতে যাবেন বলে ফোন করলেন আমায়। আমি বললাম, গেলে অবশ্যই আমতলাতে নবকুমারের আখড়াতে যেতে আর কৃষ্ণার বাড়ির আখড়াতে রাত কাটাতে। সেইমতো বান্ধবী গেলেন আমার। সেখান থেকেই খবর এল দুজনেই দেহ রেখেছেন পর পর। কৃষ্ণা আগে। তারপরই নবকুমার দাস বাউল। আমার ভাবতে ভালো লেগেছিল পর পর এক মাসের মাথাতেই দুজনের চলে যাওয়ার খবর পেয়ে, কৃষ্ণা, নবকুমার বোধহয় ইন্দ্রসভাতেই আখড়া খুলেছেন। সাধনভজন করছেন। না হলে দুজনের মৃত্যু এত পিঠোপিঠি হল কেন! মনে পড়ছে কৃষ্ণার গানের কথা : ‘আলোকের মানুষ থাকে আলোকেতে। মোহ-অন্ধ জন না পারে চিনিতে।‘ নবকুমার গাইতেন : ‘এ আলোর এমনি ধারা,/ অন্ধকারে তারাও হেরে অন্ধ যারা।‘ দুজনেরই আলোর আর্তি ইন্দ্রসভার আসর মাত করছে এখন ভাবতে দোষ কী আমাদের। এই ভাবনাতে তো আনন্দবোধই আছে আর বাউল তো তাকেই খুঁজে ফেরেন : ‘আনন্দ মদন দুই রূপ সনাতন।‘ সেই রূপের দেখাও আমি প্রথম পেয়েছিলাম এই অগ্রদ্বীপের মেলাতেই। সেখানেই ‘ইন্দুবিন্দু’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার।

দুপুরে বিশ্রাম করছি আখড়ার কোণে। হঠাই নারীকণ্ঠের তীব্র চিৎকার শুনে হকচকিয়ে উঠলাম। রতন বাউল বললেন, ও কিছু না খ্যাপা। আপনে বিশ্রাম করেন। রাতের আসরে চকমকি দেখতে পারবেন।

বললাম, মেয়েটা চিৎকার করছে কেন? কেউ কি ধরে মারছে ওকে?

রতন বললেন, হ্যাঁ খ্যাপা।

বিস্মিত হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, কে মারছেন ওকে? আর তোমরাই বা ওকে বাঁচাতে যাচ্ছ না কেন? দিব্যি বসে আছ। মীরা মা কোথায়?

–তিনি গেছেন। আপনে অধীর হইয়েন না খ্যাপা। দেখতে দেখতে এসবের সঙ্গেও খাপ খাইয়ে নেবেন একসময়।

চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, মানে?

বাউল বললেন, খ্যাপা আপনে কি সত্যিই কিছু বুঝতেছেন না?

বললাম, না গো রতন। সুরের রাজত্বের এই আসুরিক আচরণের কিছুই আমি যে ধরতে পারছি না।

–তাহলে শোনেন খ্যাপা। বসেন। অধীর হইয়েন না। মেয়ে তো তার করণদোষে মার খ্যাতিছে গুসাইয়ের। ও এমনিতেই ঘাড়ত্যাড়া গোছের। একেবার অবাধ্য। গুসাই-মা হাতে ধরে ওরে শিখাল পড়াল সব, এখন কিনা মেয়ে কয় ও গুসাইয়ের সাধনসঙ্গিনী হবে না।

–মেয়েটা তো ঠিকই বলছে রতন।

–এ আপনে কী কইলেন খ্যাপা? অত বড়ো সাধকের সঙ্গিনী হবে সে, এ যে তার সাত পুরুষের ভাগ্য। আর মেয়েটা দ্যাখো গুসাইয়ের চরণ হেলায় হারায়। সবই কপাল। মায়া ধরেছে ওর এখন খ্যাপা। কামের মায়া।

–তোমাদের গোঁসাইয়ের তো সাধনসঙ্গিনী আছেন রতন। তবে আবার তার নতুন সাধনসঙ্গিনীর কী প্রয়োজন?

—শোনেন কতা। আমাদের গুসাই-মায়ের কী আর ছারাব হয়? ছারাব না হলে গুসাই নৌকা বাইবেন ক্যামনে শুনি? উলটা স্রোতে নৌকা বাওয়া কী অত সোজা ব্যাপার মনে করেন খ্যাপা? এ যে বড়ো কঠিন কাজ। সিদ্ধ সাধক বড়ো গুসাই। তার যে ডাগর মেয়ে চাই। না হলে সাধন যে বন্ধ হয়ে যায়। কত বয়েস জানেন গুসাইয়ের?

—কত?

–একশো ছুইছুই।

—এ বয়সে তিনি আর সত্যিই সাধনা করতে পারেন? তোমাদের সেই সাধনমতে উলটা স্রোতে নৌকা বাওয়া কি এ বয়সে সম্ভব রতন?

-কেন সম্ভব নয় খ্যাপা! গুসাইয়ের কি আর মনুষ্য শরীর?

জিজ্ঞাসা করলাম, তবে কি তিনি ঈশ্বর?

–কতকটা তো তাই-ই খ্যাপা। তিনি যে অটল মানুষ। চারচন্দ্রের সাধনা সারেন এখনও। বীর্যকে ঊর্ধরেতা দিতে পারেন যখন-তখন। বিন্দু ধরেন।

—এই বয়সে!

-এটা আশ্চর্যের কিছু না খ্যাপা। চন্দ্ৰসাধনের ফল গুসাইয়ের শরীর। তার সাধনে এলে আপনেও এই বয়স পর্যন্ত যাবেন আর ছুঁড়ি নিয়ে দিব্যি সাধনাতে মাততে পারবেন। মহাজন তাই কী বলছে জানেন খ্যাপা?

-কী?

-মহাজন বলছেন, চন্দ্ৰসাধন কর রে মন সময় থাকিতে। আর গুসাইয়ের সেই চন্দ্রসাধনে মেয়েটা গররাজি। বলে কিনা পাক ধরা শরীরকে সে সর্বস্ব দেবে না।

বললাম, ঠিকই তো বলেছে মেয়েটা।

—বাউলপাঠ নেন খ্যাপা। তাহলে এ ধারণা আর হবে না আপনের। আপনে শিক্ষিত। কিন্তু বাউলশিক্ষ্যে যে অন্যরকম। সেখানে কে কার শরীর ভোগ করে?

-কেন? দুজনে দুজনের।

-ভোগই নেই খ্যাপা। সেখানে কেবল প্রেম। সহজ মানুষ। সহজানন্দ। আসলে কী জানেন খ্যাপা মেয়ের কামের শরীর। আমাদের গুসাইও ছাড়ার পাত্তর নন। ও মেয়েকে তিনি সহজ মানুষ করবেনই। তাই তো এত মারধর।

শুনতে পারছি আমি মেয়েটার কান্নার আওয়াজ গাঢ় হচ্ছে। তার শরীরে চড়-থাপ্পড় পড়ছে সমানে।

গোঁসাই-মা বলে চলেছেন, কানে আসছে আমার সমানে সেইসব প্রজল্প : ঢলানি মাগি, শুধু ছোকছোকানি, ভেগে যাওয়ার তাল, ও মিনসে তোকে কী দেবে রে মাগি? মধু খেয়ে ফেলে যাবে রে তোরে। গুসাই সঙ্গে নিজেরে বুঝবি, গুসাই কি আর তোর গতর খাবে? গুসাই তোরে প্রেমে মজাবে, শরীরের কামদানা সব ঔড়ায়ে দেবেন শুসাই। মিনসে তোরে কী দেবে রে শুনি? পেট বাঁধানোর মন্তর ছাড়া আর কী দিবার পারে মানুষ? সহজ মানুষ ডাকতিছেন। যা রে মাগি যা যা। না হলে এই মার খা খা খা কালমুখী। গতরখাকী। পাতধারী মনুষ্যের প্রতি এত লোভ।

মেয়েটা এখন মার খেয়ে প্রবল জোরে চাচাচ্ছে। তার সেই অসহায় শরীর বাঁচানোর আর্তি ঢেকে দিতে চাচ্ছে আখড়ার বাউলের গুবগুবি। গান হচ্ছে : ‘মানুষ মিলে ভাগ্য ফলে / ডাকে যদি ভক্তিভাবে দীনের কাঙালে। / ব্রহ্মাণ্ডের পরপারে আছে মূলাধারমূলে। / নাহি দিবা, নাহি রাতি, মন, মানুষের মহলে।।‘

.

আখড়া আশ্রমে গেলে বাউলের এই ‘সহজতত্ত্ব’-র জ্ঞান মিলবে প্রথমেই। বাউলের সেই ‘সহজতত্ত’ জানা তো আসলে নিজেকেই জানা। এই আমি, দেহগত আমি, জন্মগত আমিকে সদ্গুরুর সাহায্যে জাগিয়ে ভোলা। বাউল আসলেই এক জাগরণকলা। এই জাগরণই যে তার গান। শরীরের সামগ্রিক দলিলমূল্য। বাউল সাধক বা পদকর্তা তাই-ই লিখে রাখেন তার দেহতত্তের গানে। যে তত্তের চারটি অনুপম যোগ বর্তমান। হঠযোগ, তন্ত্রযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ।

হঠযোগের কলা প্রায়শই বলে থাকেন বাউল সাধক। শিষ্যকে এই যোগ আর রেচক, পূরক, কুম্ভক করার উপদেশ আমি অনেক বাউল আশ্রমেই শুনেছি। এই ক্রিয়াকর্মের বেশ কিছু গানও আছে। যেমন—চণ্ডী গোঁসাইয়ের গান : যদি রেচক পূরক কুম্ভক করবি ভাই। তবে নাড়ির কপাট খুলা মায়া / শিখে নেগে আগে তাই।’ নাড়ির এই কপাট খোলার মায়াই হল গিয়ে যোগ। চারপ্রকার যোগের কথা আমরা জানি। মন্ত্রযোগ, হঠযোগ, রাজযোগ, লয়যোগ। মন্ত্রযোগ সর্বপ্রকার সাধনের মধ্যে নিকৃষ্ট বলেই কথিত। তথাপি কিন্তু জপেতে সিদ্ধির কথাও বলা হয়ে থাকে। মন্ত্রজপান্মনোলয়ো মন্ত্রযোগঃ। ‘অর্থাৎ মন্ত্র জপ করতে করতে যে মনোলয় হয়ে থাকে, তাই মন্ত্রযোগ। তবে একে নিকৃষ্ট বললেও জপসাধনায় যে আবার সিদ্ধিযোগ আছে শাস্ত্রে তারও উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, জপ সাধনাও সিদ্ধি এনে দিতে পেতে পারে। কালী, কৃষ্ণ, শিব যাই বলি না কেন আমরা এতে বা এই ইষ্ট সাধনায় সিদ্ধি পেতে গেলে জপের ভূমিকা অনিবার্য। বাউলের ইষ্ট মানুষ। তারই ভজনা বা সাধনা সারাক্ষণ বাউলের সাধনা। সেই সাধনার জপ হল গিয়ে গান। আবার বাউল মিলনযোগে কাম বীজ, কাম গায়ত্রীও জপ করার কথা বলে থাকেন। দেহতত্ত্ব বা বাউলতত্ত্বে তন্ত্রযোগের কথা বলেছি কিছু আগে। অনেকে বলতে পারেন তন্ত্র ও বাউল দুটো তো পুরোপুরি আলাদা সাধনা, তাহলে বাউলতত্ত্বে তন্ত্র আসবে কী করে? উত্তরে বলি, বাউল ক্রিয়াকর্ম। তন্ত্রও তো তাই। শরীর আধারিত সব অধ্যায় এইসব লোকায়ত সাধনা। বাউলের কিছু গান যাকে আমরা মন্ত্র বা বন্দনা হিসেবে যেমন দেখতে পারি, তেমনই তাকে আবার অনায়াসে তন্ত্ৰআধারেও ফেলতে পারি। কেননা এইসব গানে ক্রিয়াযোগই স্পষ্ট এবং প্রবল। যেমন—’অনুরাগে ভজরে মন, / পাবি রাধার যুগলচরণ, / রাধাকৃষ্ণ একাসনে / ধ্যানে মগ্ন মদনমোহন।‘ এই গান যুগল ভজনেরই আখর। যে ভজন হল গিয়ে হঠযোগেরই নামান্তর। হঠযোগ হল গিয়ে একত্রে সংযোগ। বাউল সাধনে যা অপরিহার্য। গুরু-শিষ্যর। সাধক সাধনসঙ্গিনীর। গুরু-শিষ্যর সংযোগের একটি বহুল প্রচারিত গানের কথা আমরা সকলেই তো জানি : ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কী? / ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তাকে তোমরা বলবে কী?’

এই চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগা হল গুরু আর শিষ্যের মিলন। তত্ত্বটি লালন ফকিরের সাধনা টেনে অনায়াসে বোঝনো যেতে পারে। লালনের গুরু ছিলেন সিরাজ সাঁই। তবে শিষ্যের এই আকাশছোঁয়া পরিচিত গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কখনও ছিল না। এই গানে ব্যবহৃত প্রথম চাঁদ হল গুরুচাঁদ। যিনি শিষ্যকে টানছেন, আশ্রয় দিচ্ছেন। গুরু এখানে যেন কল্পিত একটি বড়োসড়ো চুম্বকখণ্ড। এই চাঁদের গায়েই শিষ্যচাঁদ লেগে যাচ্ছে। অর্থাৎ শিষ্য হলেন লৌহকণিকা। শুরু তাকে নানা প্রাকরণিক কৌশলে চুম্বকের মতোই আকর্ষণ করছেন। দুজনেরই দেহই ঈশ্বরের অংশ হয়ে উঠছে যেন। পূর্ণচন্দ্র গুরু। তার আকর্ষণে চন্দ্রাংশ শিষ্য মিলিত হচ্ছেন বা হবেন, এতে কারও কিছু করবার নেই। ক্রিয়াশীল এই নিয়ম। তাই এখানে কোনোরকম ভাবনার অবকাশ থাকবার কথা নয়। লালন এখানে নিজেকে মাতৃঅংশ বলে মনে করেছেন। তাই ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম। ঝি হল সন্তানতুল্য অভিধান। নিজেকে তিনি মাতৃভাবে প্রতিপন্ন করে গুরুকে সন্তানের আসনে বসিয়েছেন। গানের এই মন্তব্যের প্রমাণ তিনি তো নিজেই।

হকারঃ কীৰ্ত্তিতঃ সূৰ্য্যষ্ঠকারশ্চন্দ্র উচ্যতে। / সূৰ্য্যাচমসোর্যোগাদ্ধঠযোগা নিগদ্যতে। অর্থাৎহশব্দে সূর্য ঠশব্দে চন্দ্র, হঠ শব্দে চন্দ্র-সূর্যের একত্র সংযোগ। অপান বায়ুর নাম হল চন্দ্র আর প্রাণ বায়ুর নাম হল সূর্য। প্রাণ আর অপান বায়ুর একত্র সংযোগকেই শাস্ত্রে হঠযোগ বলেছে। যোগশাস্ত্রে এই দুই বায়ু ত্যাগ গ্রহণের মাধ্যমেই ক্রিয়াকর্মের কথা বলা হয়েছে।

সবসময়ে গুহ্য ভাষাতেই কথা বলে থাকেন বাউল। কারণ শুরুর নির্দেশ : ‘আপন সাবধান কথা না কহিও যথা তথা / আপনার আমিরে তুমি হইও সাবধান। বাউলের গানও তাই প্রহেলিকাতে ভরা। হঠযোগের চন্দ্র বাউলের সংকেতময়তার বা নাক আর সূর্য ডান নাক। অর্থাৎ সেই ঘুরেফিরে শ্বাস প্রক্রিয়ারই কথা কিন্তু হল। জ্ঞানযোগ শরীর জাগৃতির গাণিতিক অধ্যায়ের পর উপলব্ধ বিশ্বাস। মনুষ্যত্বের প্রতি পুরোপুরি আস্থা। ভক্তিযোগ হল মহামিলনের পর স্থিতাবস্থা আর কী।

বাউল মূর্তিপুজোতে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু যেটা আশ্চর্যের-মদীক্ষার সময় মালসাভোগ নিবেদনে আত্মগুরুর সাথে সাথে পঞ্চপ্রভুকেও নিবেদন করেন। আত্মগুরু এখানে নিজের গুরুদেব বা তাকে মনগুরু হিসেবেও দেখতে পারি। আর পঞ্চপ্রভু হলেন—গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, শ্রীবাস, গদাধর। এ যথেষ্টই বৈষ্ণবীয় আচার। ‘বাউল আর বৈষ্ণব এক নহে তো ভাই’ বলা হলেও অন্তত এক্ষেত্রে এখন অনেকাংশেই একাকার হয়ে গেছে। বাউসের মাধুকরী তো বৈষ্ণব আচারের অঙ্গ। তবে পঞ্চ ম-কারে সাধনার নির্দেশ আছে। সেই সাধনা স্কুলের সঙ্গে সূক্ষ্ম সম্পূর্ণরূপেই নাড়িকল্পের। বৈষ্ণবীয় আচরণেও পঞ্চম-কার আছে। তার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন সহজিয়া বৈষ্ণব অনন্তদাস বৈরাগ্য। তবে নৈষ্টিক বৈষ্ণবরা এইসব সহজিয়াপন্থীদের বেশ নীচু নজরে দেখেন। বলেন, জাতখোয়ানো বৈষ্ণব। অনন্তদাস আমাকে বলেছিলেন, তারা হলেন অচ্যুতানন্দ গোত্রের। আসলে যেটা দেখেছি, সহজিয়াপন্থীরা প্রায় নব্বইভাগই এই গোত্রেরই। তিনি বলেছিলেন, এটাকে আপনি কৃষ্ণ গোত্রও ভাবতে পারেন। আমাদের পরিবার হল নিত্যানন্দ পরিবার। আর আমরা হলাম গিয়ে একশো বাইশ ঘরের বৈষ্ণব।’

বললাম, ‘এই জায়গাটা তো ঠিক বোধগম্য হল না।‘

হাসলেন প্রবৃদ্ধ অনন্তদাস।

বললেন, ‘মহাপ্রভুর অপ্ৰকটকালে নানা বৈষ্ণবীয় আচারের সম্প্রদায় যে গজিয়ে উঠল। বাউল, কর্তাভজা, নেড়া-নেড়ির দলও এই বৈষ্ণবধর্মে সংযুক্ত হয়ে পড়লেন। তখন নিত্যানন্দ প্রভু দেখলেন বৈষ্ণব ধর্মের শুদ্ধিকরণ প্রয়োজন। আর এটা করতে গিয়েই তিনি একশো একুশ সম্প্রদায়কেই বাতিল করে দিলেন। নিজেরটি কেবল রাখলেন। তাই আমরা হলাম শুদ্ধাচারী একশো বাইশঘরের বৈষ্ণব।’

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বৈষ্ণবীয় যে চারটি সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়ে থাকে তবে তাদের মধ্যে কি পড়েন না আপনারা?

-কেন পড়ব না? রামাত, নিমাত, বিষ্ণুস্বামী, মাধ্যাচার্য-এই হল গিয়ে চার সম্প্রদায়।

বুঝতে পারছি অনন্তদাস রামানুজ সম্প্রদায়কেই রামাত বলছেন আর নিম্বার্ক বা কারও কারও মতের সনক সম্প্রদায়কেই নিমাত বলে অভিহিত করেছেন। একাদশ শতাব্দীর লোক ছিলেন রামানুজ। তিনি শঙ্করের মায়াবাদ ও শৈবধর্মকে অগ্রাহ্য করে বিষ্ণুসাম্রাজ্যের ভক্তিবাদ প্রচারকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার সম্প্রদায়কে অনেকে আবার শ্রীসম্প্রদায় নামেও অভিহিত করে থাকেন। এই শ্ৰীসম্প্রদায় বা রামানুজ সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব ছাড়াও সনক, রুদ্র প্রভৃতি সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবরাও চৈতন্যদেবের বহু পূর্বেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যমান ছিলেন। সনক সম্প্রদায়ের প্রধান ব্যক্তি নিম্বাদিত্য। কথিত, সূর্যদেব নিমগাছের আড়াল থেকে তাকে দর্শন দিয়ে প্রায়োপবেশন অর্থাৎ কিনা আহার বর্জন করে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় উপবেশনের ব্রত ভঙ্গ করে দেওয়ার পরই নিম্বাচার্য উপাধি দিয়েছিলেন। তা এই নিম্বাচার্যও কৃষ্ণসহ রাধার যুগলতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু অনন্তদাস বৈরাগ্য এই দুই সম্প্রদায়গত অস্তিত্বকে মুছে যা বললেন তা আমার কাছে একেবারেই নতুন।

বললেন, রামাত হলেন রামের উপাসক। নিমাতরা নিরাকারবাদী। বিষ্ণুস্বামীরা বিষ্ণুনারায়ণের উপাসক আর মাধ্যাচার্যরা কৃষ্ণ উপাসক। আমরা হলাম সেই মাধ্যাচার্য সম্প্রদায়ের। কৃষ্ণকে আমরা বৈধীরীতিতে পেতে চাই।

জিজ্ঞাসা করলাম, কী এই বৈধী?

—আমাদের আশ্রয় হল রাধারানি। বিষয় গোবিন্দ। রাধাকে আশ্রয় করে কৃষ্ণ বা গোবিন্দতে পৌঁছোবার জোড়কলম তো মহাজনেরই দেওয়া।

—পন্থাটি কী তবে এ পথে?

—পন্থা তো চেতন্যচরিতামৃতেই আছে বাবা। আপনি খেয়াল করবেন। বলা রয়েছে সেখানে একেবারেই স্পষ্ট : লোকধর্ম, বেদধর্ম, দেহধর্ম, কর্ম, লজ্জা, দেহসুখ, আত্মসুখ, মর্মসুখ, দুশ্চার্য, আর্যপদ, নিজপরিজন স্বগুণ যত করে তাড়ন ভৎসন সর্বত্যাগ করি করে কৃষ্ণের ভজন ইহ্যকে কহিহে কৃষ্ণের দৃঢ় অনুরাগ। শৌচ ধৌত বস্ত্রে যেন নাহি কোনো দাগ। এই ভজনে পঞ্চ ম-ও লাগে বাবা।

বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তন্ত্রের পঞ্চ ম-কার?

-হ্যাঁ বাবা। কুণ্ডলিনীযোগ লাগবে না বাবা? বীর্যবস্তু তাহলে উর্ধ্বে উঠবে কীভাবে শুনি? এই বীর্যবস্তুকে সহস্রারে নিতে গেলেই তো ব্ৰহ্মরন্ধ্র থেকে মদ ঝরে ঝরে পড়বে।

—আর মাংস?

-মাংস হল জ্ঞানখঙ্গ দিয়ে ষড়রিপুকে বিনাশ করে দেওয়া। কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি যাবতীয় সব ইন্দ্রিয় তো মাংসরূপ। এগুলোর ছেদন দরকার। এগুলোকেই বৈষ্ণব ভক্ষণ করবেন।

-মৎস্য?

-শরীরের ছয়টি মৎস্য থাকে বাবা। অহংকার, দম্ভ, মদ, পৈশুন্য, মাৎসর্য আর হিংসা। এই ছয় মৎস্যকে বৈরাগ্যজালে আবদ্ধ করে রাখাই হল বৈষ্ণবের মৎস্য সাধনা।

–মুদ্রা সাধনা?

–এও তো পশুপাশই বাবা। এই পাশ মুক্ত হবে অষ্টমুদ্রাকে জয় করে।

–কী কী এই মুদ্রা?

-আশা, তৃষ্ণা, জুগুপ্সা, ভয়, ঘৃণা, মান, লজ্জা ও ক্রোধ। এই আটমুদ্রা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াই হল গিয়ে মুদ্রা সাধনা।

বললাম, বাকি রইল কেবল মৈথুন সাধনা।

বললেন, বাকি থাকবে কেন? যুগল সাধনে তো ইড়া ও পিঙ্গলা উভয় নাড়িতে বাহিত বায়ুকে সুষুম্নাতে মিলন করা হয়। এ হল সূক্ষ্ম মিলন। আর এই সুক্ষ্মযোগে দুই শরীর আলিঙ্গনরূপ মৈথুন স্বরূপ উপলব্ধি করে।

বাউল পঞ্চম ম-কার নয় পঞ্চভূতে সিদ্ধির কথা বলেন। তাদের পঞ্চভূতের সঙ্গে আবার অঘোরী মতের পঞ্চ ম-কারে কিছুটা মিল রয়েছে। অঘোরী মতে মৃত্তিকা-মুদ্রা, জল-মৎস্য, অগ্নি-মদ, মৈথুন-ব্যোম। তবে সাধক ভেদে এর প্রভেদ থাকতে পারে। যেটুকু বুঝেছি আমি, প্রতীকী অর্থময়তাতে এসব তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় পার্থক্য কেবল দৃষ্টিকোণের এর বেশি কিছুই নয়। অনুরাগে সাড়া পাওয়ার কথা বাউল বলেন। এই সাড়া হল গিয়ে নিজের অন্তরের সাড়া। সে সায় দিলেই তো আত্মার জাগৃতি হবে। তবে বাউলের আত্মার ফর্দ অন্য। উপনিষদের ব্যাখ্যার সঙ্গে তো সচরাচর মিলবে না।

উপনিষদে আত্মা কী? কীভাবে তাকে দেখানো হয়েছে? ‘স ম আত্মেতি বিদ্যুৎ’–তিনিই আমার স্বরূপ। ওঁ আত্মা বা ইদমেক একাগ্র আসীৎ। আত্মা হল আমি নিজে। কে এই আমি? এই আমি হল পঞ্চেন্দ্রিয়ের শরীর। বাক্, নাসিকা, চক্ষু, শ্রাত্র ও মন। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ই দেহ দ্বারা অধিগত থাকে। এজন্য এদের আধ্যাত্মিক বলা যেতে পারে। এই পঞ্চেন্দ্রিয় আবার পঞ্চপ্রকৃতি বা পঞ্চভূতের সঙ্গেও যুক্ত। বাক্-অগ্নি, নাসিকা-বায়ু, চক্ষু-আদিত্য, শ্রোত্র-দিক, মন-চন্দ্রমা। আত্মাকে আমরা জ্ঞানের ব্যাপ্তি হিসেবেও দেখতে পারি। ভারী সংজ্ঞায় যাচ্ছি না। বলছি আত্মা সর্বজ্ঞ। আমার এই যে আদন প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত তার ক্রিয়া দু-ধরনের। স্বরূপ পরিণাম আর বিরূপ পরিণাম। স্বরূপ পরিণাম কী? আপনার বা নিজের সত্ত্বকে সত্ত্বরূপে, রজকে রজরূপে, তমকে তমরূপে অবস্থান করানো। এগুলো সবই হল গিয়ে ব্যক্তিসত্তার আবরণ। যা নিজের স্বরূপকে বিস্মৃত করিয়ে রাখে। সত্ত্ব হল গিয়ে প্রকৃতি, স্বভাব, মন—এই তিনটি গুণকে ঠিকভাবে চিনে নেওয়া। রজ হল দর্শনজনিত গুণ আর তম তামসিক গুণ বা অজ্ঞানতাকে দূর করা। আবরণ তিনটি। যা নিজস্ব স্বরূপকে বিস্মৃত করে দেয়। মোহ-দরজা বন্ধ করে দেয়। সাধক এই তিন আবরণ খসিয়ে ফেলেন। প্রথম আবরণ তিন গুণ (সত্ত্ব, রজ, তম) যার কথা এতক্ষণ বললাম। দ্বিতীয় আবরণ ছয়টি স্বাদ (মিষ্টি, টক, লবণাক্ত, তিক্ত, ঝাল, কষা)। তৃতীয় আবরণ পঞ্চভূত (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম) তিন গুণ আমাদের মনকে প্রভাবিত করে। পঞ্চভূত আমাদের দৈহিক গঠনকে ঠিক রাখে। ছয় স্বাদ আমাদের দেহের রাসায়নিক অবস্থাকে ঠিক করে দেয়। এভাবেই আমাদের মন ও দেহ এক সুতোয় বাঁধা পড়ে। তার সঙ্গে দশটি ইন্দ্রিয় (পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়) যুক্ত হয়ে কুণ্ডলিনী শক্তির উপর চব্বিশটি আবরণ সৃষ্টি করে। কুণ্ডলিনী হল চৈতন্যস্বরূপ। শক্তিরূপবলে শাস্ত্র তাকে চৈতন্যস্বরূপা করে নারীর অভিজ্ঞান দিয়েছে। এই কুণ্ডলিনী বা চৈতন্যস্বরূপ / স্বরূপা যাই বলি না কেন তা যদি নিজের স্বচ্ছ দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে তবেই গণ্ডগোল লাগে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। আর দৃষ্টি যদি সে অর্জন করে ফেলে তবে ব্যক্তিসত্তা বা আমিরও সবরকমভাবে জাগরণ ঘটে। আমরা স্বরূপ পরিণাম বুঝলাম। অরূপ পরিণামও এক বলতে পারি। আর বিরূপ পরিণাম কী? পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ আর সেইসময়ে প্রকৃতির বিরূপ আচরণ। পুরুষ হল আমাদের নিজের অজ্ঞানতা। প্রকৃতি হল নিত্যতা। আমরা ধরছি পুরুষ ও প্রকৃতি আসলে আমাদের নিজের অজ্ঞানতা। প্রকৃতি হল নিত্যতা। আমরা বলছি পুরুষ ও প্রকৃতি আসলেই এক সংযোগ। যে যোগে প্রাণের সৃষ্টি হয়। বাউলের আত্মা দেহগত প্রাণকে ঘিরেই। কিন্তু তার অবস্থান বস্তুগত। কী এই আত্মাতে শামিল? দুদ্দু শাহের একটি গান আছে, তাতে বলা হয়েছে : বস্তুকেই আত্মা বলা হয়। আত্মা কোন অলৌকিক কিছু নয়। কিন্তু ব্যাপারটা এতে স্পষ্ট হয় না। আরেকটি গানে দুদ্দু বলেছেন : যে বস্তু জীবনের কারণ / তাই বাউল করে সাধন। এই বস্তু শরীরের রজ-বীর্য। সাধক বাউল নিজেদের শরীরের অন্তঃস্থিত পদার্থকে সংরক্ষণ করেন। গায়ক বাউলারা কেবল গানের তত্ত্বকথাকেই ব্যক্ত করেন ধর্মকথায়। পালন করেন তা কেবল সাধক বাউলরা। যাঁদের সংখ্যা এখন একেবারে হাতেগোনা। আরও একটি গানে দুদ্দু মেয়ের চরণ ধরেই সাধনার কথা জানিয়েছেন : ‘সাধন করো রে মন ধরে মেয়ের চরণ। বলেছেন : ‘পিতা শুধু বীর্যদাতা/ পালন ধারণ কর্ত্রী মাতা / সে বিনে মিছে কথা সাধন-ভজন / আগে মেয়ে রাজী হবে /  ভজনের রাহা পাবে / কেশ ধরে পাড়ে নেবে দুদ্দুর বচন।’

আর এই মেয়ের চরণ ধরতে গিয়েই তো সাধনপথে যত বিপত্তি। নাবালিকা কন্যাকে গুরুপাঠে রেখে চলে যান মা। কিছুটা সাধন-বিশ্বাসে কিছুটা আবার অভাবে। আশ্রমে অন্তত মেয়ের ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না। আর বাড়ন্ত শরীরে লোলুপ দৃষ্টিদানকারী পুরুষের উপদ্রব তো এখানে হবে না। তা ঠিক, প্রত্যন্ত গ্রামের বহু আশ্রম আমি দেখেছি যা গুরু-মা পরিচালিত। এসব আশ্রমে গুরু-মা ছোটো মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে তৈরি করতে থাকেন পরে যাতে বাউলদের হাতে তুলে দেওয়া যায়। আর মেয়েদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে কত গুরু-মা যে অনেকটা সেই নিজের জীবনের মতোই নাবালিকা মেয়েগুলোকে খানিক সাবালকত্বে পৌঁছে দিয়ে চরম সর্বনাশের হাতে ঠেলে দেন তা তারা নিজেরাও জানেন। আসলে এইসব গুরু-মারা নিজেরাও তো খানিকটা অসহায়; পুরুষ সাধকের উদাসীনতার শিকার। তিনি তো নিজেই জানেন যাকে বা যাদেরকে তিনি শ্বাস আর দমের কাজ যত্নভরে শিখিয়ে সাধনার উপযোগী করে তুলছেন তারা সব একদিন তারই মতো অব্যবহৃতা, পরিত্যক্তা নারী হয়ে উঠবে। সাধক তাদের ছুঁয়েও দেখবেন না। তখন কেবল বাউলের পরিত্যক্তা নারী হয়ে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধা বাউল সঙ্গিনী হয়ে পথে পথে মাধুকরী সম্বল করে কাটাতে হবে। এদের মধ্যে যারা কেবল একটু চালাকচতুর তারাই গুরু-মা সেজে সাধককে কবজা করে, সাধকের সাধনার নামে যৌন ব্যভিচার সাধনার অসাড় বুলিবাণীকে শিরোধার্য করে জীবনধারণ করতে পারবে। নানা গ্রামগঞ্জ ঘুরে এমন গুরু-মা যেমন আমি কম দেখিনি, তেমন বাউলের পরিত্যক্তা সাধনসঙ্গিনীও তো কম দেখিনি। গলা যদি সুরে খেলে, কিছু গান যদি রপ্ত করতে পারে আর সাধকের ব্যভিচার লোলুপতা বুঝে গিয়ে যদি গর্জে ওঠে, একা চলতে পারে সঙ্গিনী; বাউল যখন তাকে ছেড়ে দেয়, সেই দুঃসহ সময়ে যে নারী গান ফেরি করে বাঁচবার পথ করে নিতে পারে, তাদের পেছনে পরবর্তীতে বাউলের লাইন কেবল একটি কারণে গান বেঁচে নির্বাহের আশায়। এইসব দেখেই আজকের নতুন মেয়েরা সঙ্গীহীন হয়ে গানকেই কেবল গলায় তুলে সদর্পে, সম্মানের সঙ্গে বেঁচে আছেন আর সেই বাঁচাকেই মানতে পারছেন না প্রাচীন গুরু-মায়েদের দল। সাধনের সার বুঝে গেছেন কৃষ্ণা, সুমিত্রা, কল্যাণীদের মতো অসংখ্য নারী। কৃষ্ণার কথা আগেই বলেছি। এখন বাকিদের কথা বলি।

আসাননগরের মিনতি, ভীমপুরের শেফালি, ঘোষপাড়ার সুষমা কেউই আজ আর সাধনসঙ্গিনী নেই। সকলেই অর্থাভাবে আর পরিবেশের চরম অসহযোগিতায় অসহায়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছে মাত্র।

মিনতিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সুবাস যে চলে গেল, তুমি আটকালে না কেন?

করুণ দৃষ্টিভরে সে উত্তর করেছিল, যেতে চাইলে কাউকে কি আর ধরে রাখা যায় বলো? তাও স্বামী হলে না হয় কথা ছিল; একে-তাকে বলতাম, পঞ্চায়েত করতাম, এখানে তো সে বালাই নেই। লোককে বললে মজা মারবে, বলবে শরীর তো আছে, বেচে খাও গে। সুবাস গেছে এবার প্রভাতরে ধরো। তোমাদের এই তো জীবন। বলো, আর কথা বলা যায়?

—এ পথে এলে কীভাবে?

—কীভাবে আর! মায়ে রেখে এল গুরুপাঠে। সেখান থেকে তার সঙ্গী হলাম। ছ’বছর একসঙ্গে। এখন সে ছাড়াছাড়ি করে নিল।

-কেন? সুবাস ছেড়ে গেল কেন? তোমাদের জুড়ির তো নাম ছিল।

–হলে কী হবে গো। তাকে লোভে পেল। ডাগর মেয়েমানুষ এসে লোভ দেখাল।

–কীসের? শরীরের?

—শুধু শরীরের লোভে বাউল কি আর যায় গো। এক ঠাঁই-এ থেকেই তো সাধনার দোহাই দিয়ে নিত্যিনতুন শরীর পাওয়া যায়।

—তবে সুবাস গেল কেন?

-ওই যে বললাম লোভ। ডাগর মাগি এসে বলল বিদেশে যাবার পথ সে নাকি বলে দেবে।

সুবাস তাহলে এখন বিদেশে?

—অত সস্তা যাওয়া? কলকাতায় গেড়েছে। ধরাধরি চলছে শুনতে পাই।

—তোমার এখন চলে কী করে?

-ওই চেয়েচিন্তে। —গান গাও না?

—কী করে গাবো বলো? জুড়ি নেই। জুড়িহীনের গান কে শুনবে বলে তুমি?

তা ঠিক। সঙ্গীহীন রমণীর গায়নের কদর খুব বেশি নেই আখড়া-মোচ্ছবে। কৃষ্ণা, সুমিত্রা, কল্যাণীরা পেরেছে কেবল জীবনসংগ্রামে ঋদ্ধ হয়ে প্রবল জেদে আর দু-একজন সুহৃদের সহযোগিতায়। সুমিত্রা, কল্যাণী রীতিমতো এখন বাউল গায়িকা। মস্ত দল তাদের। মঞ্চে বাঁশি, খমক, গুবগুবির পাশে ক্যাসিয়ো। কৃষ্ণারও তাই ছিল।

সুমিত্রাকে বলেছিলাম, এই পরিবর্তন কেন?

উত্তর করেছিল আমায়, কেন নয় গো? বাউলরা সব লম্ফঝম্ফ মেরে গান করে। শ্রাতার হাততালি পায়। কেবল টুং টাং আওয়াজে শ্রোতা পাওয়া যায় না। পয়সা দিয়ে উদ্যোক্তারা সব নিয়ে যাচ্ছে আমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য। তা সেখানে গিয়ে যদি জমাতে না পারি, নাম হবে? আর ডাকবে আমাকে?

কল্যাণীর সেই একই কথা।

-মেলাখেলায় আর গাই না, যাই।

–না গাইলে যাও কেন?

–যাই লোক ধরতে। যোগাযোগ হয়। সুযোগ আসে। প্রোগ্রাম পাই।

–ভালোই রোজগার হয় তাহলে?

–হয়। তোমাদের আশীর্বাদে মন্দ নয়। রেডিয়ো, টিভিতে ডাক পাই। সরকারি অনুষ্ঠানেও খবর আসে। ক্যাসেট বের হয়েছে সরকারি খরচে। সব মিলিয়ে ভালোই চলে।

—আর ভজনসাধন?

–সেসব অনেক করেছি। গানই এখন সাধনভজন সব। সাধুগুরু ক-জন আছে গো? সব ভেক নিয়েছে। মুখোশ। সব আমার চেনা। নিজে গাইবে, নানা শরীর খাবে আর মেয়েরা কি মুখ গুঁজে আশ্রমে থেকে গাব জ্বাল দেবে?

বললাম, এসব তো সাধনপথের অনুশাসন।

-ঝাঁটা মারি ওসব অনুশাসনের মুখে। সব ভাঁওতাবাজি বুঝলে। যাঁরা বানিয়েছিলেন সাধুগুরু সব আর এরা তার কদর করবে! ক-জন বিন্দু ধরতে পারে শুনি? সবেরেই তো পাত হয়। সব জানা হয়ে গেছে আমার। শুধু গোঁসাইঠাকুর সেজে মশকরা করতে পারে ওরা।

সুমিত্রা বলেছিল, বুঝলে, আসল হল পেট।

বলেছিলাম, তাহলে সাধনে এলে কেন? অন্য কিছু করে তোত পেট চালাতে পারতে।

–এসেছি কি আর সাধে ভাই। নিয়তি এনেছে। এসে দেখলাম গড়ের মাঠ। পাই পাঁই দৌড়াচ্ছে সব। নামের লোভে, টাকার লোভে। আর সেই লোভে মরছে মেয়েগুলো সব। ভাগ্যিস গানটা শিখেছিলাম দাঁতে দাঁত মেরে, না হলে বলল এই সমাজ ছেড়ে বের হয়ে সমাজকে দাপট দেখাতে পারতাম?

এক অর্থে সুমিত্রা ঠিকই বলেছে। সবাই পারে না। সকলের মনোবল সমান নয়। মিনতি পারেনি। শেফালি নতুন সাধনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছে।

জয়দেবের মেলায় দেখা হয়েছিল ওর অসহায়তার কথা শোনার পরের বছরই। পাশে একজন যুবক বাউল। আমাকে দেখেই বলল, দাদা ভালো?

বললাম, ভালো। তুমি?

–আমি আবার সাধনে এলাম দাদা। গুরুই সঙ্গী জুটিয়ে দিলেন। দেখুন কেমন ডাগর সঙ্গী আমার।

দেখেছি যুবক বাউল একতারা হাতে শেফালির পাশে দাঁড়িয়ে। পথঘাট, গান, সাধনা বুঝে সে যে একদিন সরে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? তখন শেফালির কী হবে? কী আর হবে? বাদবাকি শেফালিদের যা হয় ওরও তাই হবে। সুষমারও যা হয়েছে। আর এদের মাঝেই আর এক দল। যাদের সাহসিকা ছাড়া কী আর বলতে পারি আমরা? যারা আত্মমর্যাদাকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, নিজেকে জানতে পেরেছেন। প্রকৃত বাউল সাধনা তো এই জানাকেই উসকে তোলে। আজকের অনেক নারী তাই নিজেকে জেনেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেন। এতে করেই কিন্তু বাউল সমাজের অচলায়তন ভাঙছে। টলে যাচ্ছে ভিত। তাতেই গুরু-মায়েদের পাশাপাশি সাধক শুরুও ফুঁসে উঠছেন। কেননা তাদেরও যে মান্যিগণ্যি কমে আসছে ক্রমশই।

বাউলরা বিশ্বাস করেন, মানবশরীরের ভেতরই পরমেশ্বরের সিংহাসন পাতা। তাকে লাভ করাই সাধকজীবনের মোক্ষ। কীভাবে তা সম্ভব? গুরুর শেখানো দম ও শ্বাসের কাজে-হঠযোগ, কুম্ভক, পূরকে, রেচকে বীর্যের নিম্নগতিকে তারা রুদ্ধ করে দেন। ওপরে উঠিয়ে নিতে পারেন তারা। বীর্য নারীর যোনিতে রমণের পর চিহ্নরূপ লেগে থাকবে না। রীতিমতো সেখানে যোনি পরীক্ষার নিয়ম। দুটো শব্দ বাউল ব্যবহার করেন। ‘বিন্দুধারণ’ আর ‘বিন্দুপতন’। তার মানে হল বীর্যের গতিবেগকে ওপরে উঠিয়ে নেওয়া হল বিন্দুধারণ। পতন হল বাউল বলেন-’যোনিতে পতন। মানে রমণে বীর্যপাত হয়ে যাওয়া। এই মিলন হয় সঙ্গিনীর রজঃস্রাবের তিন-তিনটে দিন। বাউল বলেন এই এর উৎকৃষ্ট সময়। এই তিনদিন তারা কামকে এই প্রক্রিয়ায় শুদ্ধ করে, তাদের মতে প্রেমে রূপান্তরিত করেন। মেয়েদের রজঃস্রাবের তিন-তিনটি দিন বাউলের ভাষায় ‘মহাযোগের সময়’ ঠিকঠাক উত্তীর্ণতায় বাউল সিদ্ধ স্তরে পৌঁছান। তারা বলেন নারীশরীরের মধ্যে ষড়দল, চতুর্দল, শতদল পদ্ম আছে। সে সব জেনে বুঝে তারপর হবে ‘জেন্তে মরা’। ‘জেন্তে মরা’ হল কাম থেকে প্রেমে নিষ্কামী হওয়া।

কথা হচ্ছে, নারীশরীরের মধ্যে যে ষড়দল, চতুর্দল, শতদল পদ্মের কথা বাউল বলেন তা শুধু নারীশরীর কেন, পুরুষ তথা মানবশরীরেও বর্তমান। তবে বাউল সাধক শুধু নারী শরীরে থাকবার কথা বলছেন কেন? শরীরের ছটা চক্রে এইসব পদ্মরূপের কল্পনা রয়েছে। কারণ হল পদ্ম কাদায়, পাকে জন্মায়, কিন্তু নিজে পঙ্কিল হয় না। কাদার উপরে সুন্দর ফুল হিসেবে ফুটে থাকে। এই কাদা বা পাক হল প্রতীকী অর্থে মায়া। এই মায়াকে ভেদ করে পদ্মফুল ফুটছে। পদ্ম সূর্যের আলো পেলেই তার পাপড়ি খোলে। তেমনই আমাদের শরীরের পদ্মগুলো তাদের দল খোলে কুণ্ডলিনীশক্তি জেগে উঠলে। সূর্যের আলো থাকা সত্ত্বেও যদি পদ্মের উপর জল ছিটিয়ে দেওয়া হয় তবে দেখা যাবে পাপড়িগুলো সব মুড়ে যাচ্ছে। সাধক বলছেন মানুষকে হতে হবে এই জলের উপরে ফোটা পদ্মের মতো। পদ্মের পাপড়িগুলো যেমন গায়ে জল পড়লে গুটিয়ে যায়, তেমনই ইন্দ্রিয়ের আচরণগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে পারে বিরূপ আচরণে। যার জন্যই যোগক্রিয়ায়, সংযমে তাকে জাগিয়ে রাখতে বলছেন সাধক। যোগীতস্ত্রগুলো আমাদের সেই পথেই নির্দেশিত করছে বারবার। যোগীগুরু, তন্ত্রসাধকরা এইসব পদ্মে ধ্যানমগ্ন হয়েই পড়েন। মানে শরীরক্রিয়ায় শরীরকে জাগান। উপাসনা করেন। বাউল নারীর শরীরে এই পদ্ম, ওই পদ্ম আছে বলে সাধনসঙ্গিনীকে মনে হয় উচ্চাসনই দিতে চান। কিন্তু এটা তো ঠিক, লালন ফকির, চণ্ডীদাস গোঁসাই, হাউড়ে গোঁসাই, পদ্মলোচন, দুন্দুশাহ প্রভৃতি পদকর্তারা তাদের সব ক্রিয়াকরণের গানে নারীকে যে সম্মান প্রদান করেছেন সে সম্মান বাস্তবে নারীর বা সাধনসঙ্গিনীর এখন নেই। তার কারণ অবশ্যই পুরুষের, সঙ্গীর, সাধকের, ব্যভিচার। না হলে আমাদের লোকায়ত সাধন কিন্তু নারীকে যোগ্য আসনই দিয়েছিল। কী তন্ত্র, কী বৈষ্ণব, কী বাউল সাধনে। বাউল সঙ্গিনীটিকে ‘রাধারানি’, ‘মনের মানুষী’, ‘শক্তি’ ইত্যাদি বিশেষণের মালা পরান ঠিকই—যেমন তন্ত্রে ভৈরব সঙ্গিনীকে, ভৈরবীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন। আসলে এই বিশ্লেষণ, সম্বোধন, মান্যতা, যথাযযাগ্য প্রাপ্য স্বীকৃতি সব ছিল প্রকৃত সাধকদের। বাউলের গানে মেয়েদের মান্যতার যে-সব পদ আমরা পাই তা কিন্তু এখনকার কারও রচনা নয়। বেশিরভাগটাই সাধক পদকর্তাদের। এখন কথা হচ্ছে এই সাধনক্রিয়া কীভাবে ঘটে থাকে আর সাধন-মিলনযোগে বাউলের কী প্রকারের অনুভূতি হয়? সে সম্পর্কে জানতে বুঝতে আমি মিলনযোগে শামিল অনেক বাউলের সঙ্গেই কথা বলেছিলাম। তাদের সঙ্গে টুকরো-টাকরা কথিকাগুলের এই প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে নেওয়া যেতেই পারে। তাহলে বাউল সাধনে বিন্দুসাধনার প্রেক্ষিতগুলো সব ধরতে বোধহয় সহজগম্য হবে।

.

মদনমোহনের আশ্রমে বসে প্রবীণ সাধক দয়াল খ্যাপাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম দেহমিলনের যোগক্রিয়ার কথা।

বললেন, প্রথমে গুরু নাম দেন। গুরুমন্ত্র জপতেজপতেই শরীর সেই মন্ত্রভাবকে টেনে নেয়। ভাব এলেই ক্রিয়াকরণ শুরু হয়। চারচন্দ্র তো আগে থেকেই নিয়ম করে পালন করতে হয়।

বললাম, খুব জরুরি কি চারচন্দ্রের ক্রিয়া?

—অবশ্যই। চারচন্দ্র শরীরকে উপযোগী করে। দম ধরতে সাহায্য করে গিয়ে ওই চারচন্দ্র। এই আমার নীরোগ সুঠাম শরীর নিয়মিত চারচন্দ্র সাধনের ফল।

-আপনি কি এখনও ক্রিয়াযোগ করেন? মল, মূত্র শরীরে ফিরিয়ে নেন?

বললেন, রোজ নয়, তবে করণক্রিয়া একেবারে বাদ দিই না।

দয়াল খ্যাপাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিন্দুর স্থিরতা কীভাবে রক্ষা করে থাকেন দেহসাধক?

বললেন, এ বিষয়ে তো বলে বোঝানো যাবে না বাবা। বিন্দুর স্থির দশার জন্যেই গুরু শিষ্যকে শ্বসনিয়ন্ত্রণ শেখান। এই ক্রিয়া আটবার, বত্রিশবার—এই করে-করে রপ্ত করে নিতে হয়। রেচক, পূরক, কুম্ভক করতে হয়। কুম্ভক নাড়ি শোধন করে দেয় বাবা। বিন্দুর স্থিরতা দেয় শরীরে।

-তাহলে আপনি বলতে চাইছেন যে, কুম্ভক যোগই বিন্দুধারণের স্থিরতা এনে দেয় শরীরে।

-হ্যাঁ বাবা। কুম্ভকক্রিয়াতেই এই শক্তি অর্জিত হয়। বায়ুর সাম্যতা যে কুম্ভকই ধরে রেখে দেয়। মূল সাধনা বাউলের ধরে রাখে কুম্ভকক্রিয়া।

—বাউলের সাধনা কি বিন্দুধারণের সাধনা?

—বিন্দু তো সহজানন্দ। বিন্দুরক্ষা না করলে সহজানন্দ আসবে কোথা থেকে বাবা? সহজানন্দে না এলে, সহজ না হলে মনের মানুষ সাধক পাবেই বা কেমন করে? আর এই মনের মানুষের সন্ধান দিতে পারে একমাত্র কুম্ভকযোগ।

জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে, রেচক, পূরকের কোনো অবদানই নেই?

—কেন থাকবে না। এ যে পারস্পরিক যোগ। প্রথমে যেটা করতে হয় শরীরের বাইরের বায়ুকে বাঁ নাকে টেনে নিতে হয়। প্রাণ বায়ু এতে শরীরের ভেতর প্রবেশ করে গেল। আর এই যে বা নাক দিয়ে বায়ুকে শরীরের ভেতর আনা হল, এই আনবার পরই খেলা শুরু।

-কীরকম!

-শুধু আনলে হবে, কাজে লাগাতে হবে না বাতাসকে। এনে রোধ করে রাখতে হবে সম্পূর্ণ বাতাস। তখনই গুরুমন্ত্র জপ চলবে। এই জপ চৌষট্টিবার করতে-করতে কুম্ভক করে নিতে হবে।

বললাম, কুম্ভক তো এমনিতেই হয়ে যাচ্ছে। আলাদা করে কী আর কুম্ভক হবে। বায়ু আটকানো মানেই তো কুম্ভক।

—সবই বুঝলাম বাবা। তবে শুধু আটকালে হবে। জমা বায়ু ডান নাকে টেনে কিছুসময় রেখে দিয়ে আবার বাঁ নাকেই ত্যাগ করতে হবে। ডান নাক থেকে বায়ু যখন ভোলা হবে তখনই মন্ত্র জপ চলবে বত্রিশবার। এই জপের ভেতরেই রেচক করে নিতে হবে। বায়ু আটকানোটাই আসল। যে যত বেশি সময় বায়ু আটকাতে পারবে তার বাণক্রিয়া তত ভালো হবে। কুম্ভক শক্তির উপরেই বাণক্রিয়া নির্ভর করে।

-পঞ্চবাণের কথা বলছেন আপনি?

-হাঁ বাবা। পঞ্চবাণের ছিলা কাটাই তো আসল কাজ। মদন, মাদন, শোষণ, স্তম্ভন, সম্মোহনের ভেতর দিয়ে যেতেই তো সাধক তার সঙ্গিনীর শরীরের বাণগুলো সব কেটে নাশ করে দেবে।

বললাম, সে তো লালনের গানেই আছে : পঞ্চবাণের ছিলা কেটে / প্রেম যজ স্বরূপের হাটে, / সিরাজসাঁই বসে রে, লালন, / বৈদিক বাণে করিস নে রণ, / বাণ হারায়ে পড়বি তখন রণ-খোলাতে হুবড়ি খেয়ে।

–সার কথা বললে বাবা। কিন্তু কথা হচ্ছে যত সহজে বললে বাস্তবে যে তা অত সহজ নয়। এ তো আর দেহমিলন নয় যে, আলিঙ্গন, চুম্বন ইত্যাদি দিয়ে দুই শরীরকে উত্তেজক করে নেওয়া।

-আপনাদের পঞ্চবাণের খেলাতে কি এইসব আলিঙ্গন, চুম্বন, নখক্ষত, দক্ষত নেই তাহলে?

—তুমি ভুল করছ বাবা। ওসব করণকৌশল কামের। দেহমিলনে ওসব আসে বাবা।

—আপনাদের মিলন তবে দেহমিলন নয়?

–না নয়। দেহমিলনের সময় কামই কামের একান্ত পরিণাম। ওই যে বৈদিক বাণ, লালনের জন্য রাখা সিরাজ সাঁইয়ের সাবধানবাণী, সেই বাণীকে মান্য দিয়েই গুরুগোঁসাই শেখান বৈদিক বাণকে নাশ করা। এটাই বাউল সাধনা।

জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি তাহলে বলতে চাইছেন আপনাদের মধ্যে দৈহিক মিলনে রিপুর উত্তেজনা থাকে না?

—উত্তজনা থাকে সঙ্গিনীর শরীরে।

—সঙ্গীর শরীর তবে কামহীন?

—মিলনের আগেই গুরু তা করে দেন।

–সঙ্গিনীর শরীরকে কেন কামহীন করে নেন না গুরু?

-সঙ্গিনী মাধ্যম বাবা। সঙ্গিনীর মধ্য দিয়েই যে সাধককে এগোতে হবে এই প্রেমের খেলাতে। তার শরীরের সমস্ত কামকে প্রেমে রূপান্তরিত করে নেওয়াই তো বাউলের সাধনা।

বললাম, এই একই কাজটা সঙ্গিনী করতে পারেন না?

বললেন, বুঝেছি। তুমি বাবা বিপরীত বিহারে নিয়ে যেতে চাইছ। নারীকে আমরা যে উচ্চাসন দিই। সাধনার দুই পদ্ধতি। এক, প্রথমে ধরতে হয় গুরুর চরণ। তারপরই…

বললাম, তারপরই দুই, মেয়ের চরণ?

—ঠিক।

—তা নয় হল। কিন্তু কী করে আপনারা মেয়ের চরণ ধরছেন? মেয়েকে তো ব্যবহার করছেন।

—এ কী কথা হল! মেয়ে পরমানন্দের শক্তি।

–তাহলে সেই শক্তিকে কি আপনারা ব্যবহার করছেন না?

—একেবারেই নয়। মেয়ের শরীরের কামশক্তিকে প্রেমশক্তিতে এনে দিচ্ছি। আপনাদের নারীর হল কাম প্রবর্তিত দেহ। তাই সেখানে সন্তান উৎপাদন হয়। আমাদের নারী প্রেমময়ী, তার সন্তান হবে না। বাউল সাধনায় সন্তানধারণ নিষিদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধাকে তো তার সন্তান দেননি।

–শ্রীকৃষ্ণকে মানেন আপনারা?

—আমাদের মানা জাগতিক। সকলের মানাই আসলে তাই।

বললাম, বলাই তো হয় ভগবান জগন্ময়।

–যাঁরা কৃষ্ণরে দেবতা বলেন, দেখবেন যে তারাও শাস্ত্র মানেন। চৈতন্যচরিতামৃত আওড়ান।

-সেটা তো স্বাভাবিকই। বৈষ্ণবীয় আকরই তো ওটা।

–ওখানেই যে বাবা স্পষ্ট লেখা কৃষ্ণ মনুষ্যশরীর।

বিস্মিত হয়েই এবার বললাম, কোথায়! কীভাবে!

দয়াল খ্যাপা বললেন, ভালো করে খেয়াল করবেন বাবা। সেখানে স্পষ্ট বলা রয়েছে, কৃষ্ণের যতেক লীলা, সর্বোত্তম নরলীলা, নরবপু কৃষ্ণের স্বভাব। তাহলে কী দাঁড়াল বাবা, কৃষ্ণ মনুষ্যময়। বাউল সেই মনুষ্যরে মানে।

বললাম, বাউল কৃষ্ণ হলে সঙ্গিনী রাধা।

—তাই তো হয়। রাধাকৃষ্ণ তো আসলে যুগলতত্ত্ব। যে তত্ত্ব স্পষ্ট বলে সাধন করো কিন্তু সাধনে কাম বাদ দাও। কামকে বাদ দিতেই তো পঞ্চবাণের ছিলা। রাধা বলে, আমি প্রেমময়ী। বাউল সেই প্রেমকে বিশ্বাস করে যুগল সাধনে মনের মানুষকে পেতে চায়।

–বাউল কি একা পায় তা?

–একা কেন পাবে! যুগল না হলে মনের মানুষ পাবে কেমনে! কৃষ্ণরাধা তাই সাধন প্রতীক। বাউল তাই মানে। সেজন্য সে রাধার কাম নাশ করে। শুরু সাধককে কৃষ্ণ করেন। সাধক কৃষ্ণ হয়ে সাধিকারে রাধা করে নেয়। সঙ্গিনী তখনই প্রেমময়ী রাধা হয়। তার কোনো সন্তান নেই। কাম নেই। আছে কেবল প্রেমতত্ত্ব। আর এই প্রেমতত্ত্বে যেতে হলে পঞ্চবাণের ছিলা কেটেই যেতে হবে বাবা। না হলে সেখানে যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই।

পঞ্চবাণের প্রথম যেটি মদন, বাউল বলেন সেটি কামরতির প্রথম সিঁড়ি। এই সিঁড়ি তিনি টপকে যান কীভাবে? অমাবস্যায় প্রথম মিলনে সঙ্গিনীর দেহের

স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গগুলোকে তিনি স্পর্শ করে সঙ্গিনীর শরীরের কামের বাণকে আরও শানিয়ে নেন। উত্তেজনা বৃদ্ধি করে দেন সঙ্গিনীর শরীরে। এই স্পর্শ হয় করনখে, পদনখে, গলায়, অধরে, জিহ্বায় আর ললাটে। বাউল বলেন সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পৰ্শর কথা। করনখে দশ, পদনখে দশ, দুই গলায় দুই, অধরে এক, জিহ্বায় এক, ললাটে দেড়। এই হল গিয়ে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পৰ্শর প্রত্যঙ্গ-হদিস। মূলত দৃষ্টিস্পর্শর কথা তারা বলে থাকেন। কীভাবে হয়ে থাকে এই চক্ষুস্পর্শ। আমাদের শরীরস্থ সুষুম্ন নাড়ি মূলাধার চক্র থেকে উৎপন্ন হয়ে নাভিমণ্ডলের যে ডিম্বাকৃতি নাড়িচক্র আছে, তার ঠিক মাঝখান দিয়ে উঠে গিয়ে সহস্রার চক্রের ব্রহ্মরন্ধ পর্যন্ত চলে গিয়েছে। সুষুম্না নাড়ির বাঁ দিকে রয়েছে ইড়া নাড়ি। দক্ষিণ বা ডান দিকে রয়েছে পিঙ্গলা নাড়ি। এই দুই নাড়ি দু-দিক থেকে উঠে স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত ও বিশুদ্ধ চক্রকে ধনুকাকারে বেষ্টন করে আছে। ইড়া দক্ষিণ নাসাপুট পর্যন্ত এবং পিঙ্গলা বাম নাসাপুট পর্যন্ত গমন করেছে। মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে সুষম্না নাড়ি ও মেরুদণ্ডের বাইরে দিয়ে পিঙ্গলা নাড়ি চলে গেছে। বাউল সাধক দক্ষিণের পিঙ্গলা নাড়িতে কিছু সময় নিশ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত করে দক্ষিণ চোখে দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে রাখেন। মদনবাণের সময় ইড়া নাড়িতে (বাঁ নাকে) শাসগ্রহণ করে মাদনবাণের সময় পিঙ্গলাতে নিয়ে যান। মাদনের সময় ডান বা দক্ষিণ নাকে শাসগ্রহণ করে সঙ্গিনীর শরীরে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেন। বাউলের কাছে ‘বাম’ ও ‘দক্ষিণ’ শব্দদুটি বিশেষ অর্থদ্যোতক। কারণ হল বাম দিকে চন্দ্র নাড়ি-বলা হয় একে ইড়ার সাম্যাবস্থা আর ডান দিকে বাউলের সূর্য নাড়ি-পিঙ্গলারই চাঞ্চল্যকর দশা। যোগশাস্ত্র এরকম ব্যক্ত করেছে। দক্ষিণ বা ডানের দিককে বাউল বলেন কামের অবস্থা। সেজন্য তারা দক্ষিণকে পরিত্যাগ করেন। তবে শুধু বাউল কেন, সহজিয়া বৈষ্ণবরাও যুগল সাধনে তাই-ই মানেন। এ বিষয়ে তো চণ্ডীদাসেরও নিষেধনামা আছে : দক্ষিণ দিগেতে কদাচ না যাবে। যাইলে প্রমাদ হবে। মদন-মাদন যে বাম ও দক্ষিণনেত্রে অবস্থিত চণ্ডীদাস তার কথাও উল্লেখ করেছেন পদে। লিখেছেন :’মদন বৈসে বাম নয়নে। মাদন বৈসে দক্ষিণ কোণে।‘ তৃতীয় বাণ শোষণ বাণ। শোষণ বাণের সময় বাউল যোগাভ্যাসের ক্রিয়াকে চালিত করেন। লিঙ্গনালে উত্থিত শুক্র বা বীর্যকে তারা ঠেকিয়ে রাখেন। স্তম্ভন বাণে যুগল শরীরেই একটা স্থিরতা আসে। শ্বসাদির কাজ কিন্তু কিছুটা বাউলসঙ্গিনীও করে থাকেন। বিশেষত কুম্ভক প্রক্রিয়া। স্তম্ভন বাণের সময়ই দেহের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অংশ স্থির চঞ্চল হয়ে পড়ে। সাধক তখন চরম দশায় উত্তীর্ণ হয়ে যান। সম্মোহনের সময় তাদের দেহস্মৃতি লুপ্ত হয়। বাহ্য দেহে বিপুল আনন্দের তরঙ্গ উত্থিত হয়ে পড়ে। এরপরই তারা বলেন পরমাত্মার বিকাশ ঘটে। নাভিপদ্ম থেকে হৃদয়পদ্মে এই অনুভূতির জাগরণ ঘটে। এতে তারা নানা সুমধুর ধ্বনি শুনে থাকেন। পরিশেষে চরম পরিণতি আসে তখন আজ্ঞা চক্রের দ্বিদলপদ্মে তারা মনের মানুষকে উপলব্ধ করেন।

এখন প্রশ্ন বাণক্রিয়া যদি শুধু চক্ষুস্পর্শেরই হবে তবে স্তম্ভন বাণের সময় দেহ স্থির চঞ্চল হয়ে পড়ছে কেন? যেটা মনে হয় চন্দ্ৰস্পর্শ, অষ্টমচন্দ্ৰস্পৰ্শ এগুলো কোনোটাই আসলে চক্ষুস্পর্শ নয়, প্রত্যঙ্গকে প্রত্যক্ষ ছোঁয়া। মদনবাণের সময়ই তা শুরু হয়ে যায়। শ্বাসক্রিয়া দিয়ে সাধক সঙ্গিনীর অঙ্গ স্পর্শ করেন আর সঙ্গিনীও শাসাদির কাজে সাধকের অঙ্গকে নিজ শরীরে একীভূত করে নেন। কামশাস্ত্র মিলনক্রিয়ার সময় চারপ্রকার আলিঙ্গনের কথা বলেছে। সঙ্গিনী সঙ্গীর দিকে আসতে থাকলে যদি তাকে আলিঙ্গন করা সম্ভব না হয়, অথচ সঙ্গিনীকে সঙ্গীর অনুরাগ জানানোর প্রবল ইচ্ছে তখন সঙ্গী অন্য কোনো কাজ করবার ছলে, বুদ্ধি করে সঙ্গিনীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে তার শরীরে নিজের শরীর স্পর্শ করবে। একে সৃষ্টক আলিঙ্গন (Slight Contact) বলে। সঙ্গী কোনো নির্জন স্থানে থাকলে তাকে সেই অবস্থায় দেখে সঙ্গিনী যদি কিছু নেওয়ার ছলে সেখানে গিয়ে স্তন দিয়ে সঙ্গীকে আঘাত করে তখন সঙ্গী সঙ্গিনীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে যদি নিজের শরীরে চেপে রাখে সেটা বিদ্ধক আলিঙ্গন (Breast Pressure Embrace)। অন্ধকার জায়গাতে সঙ্গিনীর শরীরের সঙ্গে সঙ্গীর শরীরের যে মিলন চলে সেটা উদ্ধৃষ্টক আলিঙ্গন (Huffing Embrace)। আর সঙ্গিনী এবং সঙ্গী যখন উদ্ধৃষ্টক আলিঙ্গনে আবদ্ধ অবস্থার কথা ভেবে একা একাই নিজের দু-হাত চেপে নিজেকে জড়িয়ে নেয় সেটা পীড়িত আলিঙ্গন (Pressive Rubbing Embrace)। কামশাস্ত্রে চুম্বনের সঙ্গে পাঁচটি ব্যাপারকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে—চুম্বক, নখক্ষত, দক্ষত, প্ৰহণন ও শীৎকার। তবে কামশাস্ত্র কখনও মিলনক্রিয়ার সময় তিথি নির্দেশ করেনি। বাউল সাধনে মিলনসময় নির্ণীত। ইড়া নাড়িতে বা নাকে যখন শ্বাস চলে তখনই মিলনের প্রশস্ত সময় বলে থাকেন বাউল গুরু। এই সময়টা রাতে খাবার ঘণ্টা দুই পরে আসে বলে বাউল বলে থাকেন। এটিকে সাধক অর্ধপ্রহর হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। সময়কাল তারা বলেন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এই ক্রিয়ার আরম্ভের সময় প্রথম চলে আলাপন। পরস্পর স্পর্শ করে পরস্পরের প্রত্যঙ্গগুলোকে। তারপরই শুরু হয়ে যায় দমের খেলা। অনেক সাধক বলেন এইসময় কাম-বীজ জপ করতে হয়। আর সঙ্গিনীকে কাম-গায়ত্রী।

এই জপক্রিয়া কেন করা হয় জিজ্ঞাসা করেছিলাম দয়াল খ্যাপাকেই।

বললেন, কাম-বীজ ও কাম-গায়ত্রী জপে সাধক-সাধিকার শরীর রাধাকৃষ্ণ হয়ে যায়।

জিজ্ঞাসা করলাম, কী এই মন্ত্র?

বললেন, কাম বীজ ক্লীং। ক্লীং কামদেবায় বিদ্যুহে পুষ্পবাণায় ধীমহি তন্নো কৃষ্ণ প্রচোদ্দয়াৎ।

-এগুলো কী?

—এগুলো সব কৃষ্ণবীজ। শরীরে কৃষ্ণ জাগানো। কৃষ্ণই চৈতন্য। তার বীজমন্ত্র হল : ক্লীং কৃষ্ণচৈতন্যায় নমঃ। রাধা হতে হয় সাধিকাকে। সেই ভাবাশ্রয়ের জন্য তাকে আবার রাধার বীজমন্ত্র জপতে হয়।

—কী এই মন্ত্র?

বললেন, ওঁ শ্রীং হ্রীং রীং রাধিকায়ে স্বাহা। আর রাধিকারও গায়ত্রী মন্ত্র আছে। তা হল : স্লীং রাধিকায়ৈ বিস্মহে প্রেমরূপায় ধীমহি তন্নো রাধে প্রচোদয়াৎ।

বললাম, এইসব মন্ত্র জপের অর্থ কী?

—সারাৎসার একটাই রক্ষা পাওয়া।

—কীসের থেকে রক্ষা?

—কামের থেকে। বীজমন্ত্র জপে করণক্রিয়ায় সাধকের বস্তুবীজ রক্ষা যেমন কাজ, তেমনই সাধিকার কাজও একই।

জিজ্ঞাসা করলাম, সাধিকা তো আর বস্তু ধরেন না?

-ধরবেন না কেন?

–ধরেন!

-হ্যাঁ তারও যে রাধাবিন্দু আছে। ধরতে হবে না তাকে? তিনি তো সেই রজবস্তুকে সহস্ৰারে আটকে রাখেন না। নামিয়ে আনেন মূলধারে। যোনিতে।

বললাম, তাহলে আর সাধিকা বিন্দু ধরলেন কই। বাউলনির বস্তুরক্ষা হল আর কই!

বললেন, হল না? বলেন কী!

-কীভাবে হল শুনি?

—এ যে একেবারে পরিষ্কার। রজবস্তুর স্থিরতা ধরছেন সঙ্গিনী। সেই স্থিরতা তিনি রাখতে পারছেন বলেই তো সাধক সেই নদী বা সরোবরে উলটা স্রোতে নৌকা বাইতে পারছেন। অটল হচ্ছেন তিনি।

—আর সাধিকা?

-তিনিও অটল। রজবস্তুকে স্থির করে দিয়ে। এই স্থিরতা এলেই তো উলটা স্রোতে নৌকা বেয়ে সাধক আর সঙ্গিনী দুজনেই জেন্তে মরা হয়ে ওঠেন। এই মরণেই তো জীবন আসে। সহজ মানুষের জীবন।

সেই জীবনের জন্য বিন্দুধারণের ব্যাবহারিক শিক্ষাটাই জানতে আমি বহু আখড়া ও আশ্রম ঘুরেছি। শিক্ষান্তে সাধকের অনুভূতিও কেউ কেউ আমাকে বলেছেন বিক্ষিপ্তভাবে। তবে তারই ভেতর প্রথম সাধক থেকে সিদ্ধ স্তরে ওঠা তুষার খ্যাপার মুগ্ধ অমৃতের সেই আত্মার সঙ্গে বিশ্বের নিগুঢ় সত্যের এক কুলপ্লাবী বাচনভঙ্গি, অনুভূতিশৈলী আমাকে সবথেকে মুগ্ধ করেছে। এক নৈসর্গিক পরিবেশের ভেতর দাঁড়িয়ে খ্যাপা আমায় সে সব জানিয়েছিলেন—যা আমার বোধ ও ব্যাপ্তিকে নাড়িয়ে তুলেছিল বেশ অনেকখানি। সেই স্মৃতিকথাতেই আমি এবার ফিরে যেতে চাই।

.

অজয়ের বুকে ভারী হাওয়া উঠছিল সেদিন বিকেলবেলা। জয়দেবের গমগম তখন আর নেই। ভাঙা মেলার স্মারক চারিদিকে ছড়িয়ে। তারই ভেতর নেশার প্রথম আবেশ পড়েছে তুষার খ্যাপার মনে। আমার হাতে কলকে ধরিয়ে দিয়ে খ্যাপা তখন বোধহয় আমারই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে চলছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি। খ্যাপা অতলে ডুব দিচ্ছে আর গাঁজার জটা থেকে বীজ ছাড়িয়ে আরও

একপ্রস্থ নেশার প্রস্তুতিটাও সেরে রাখছে। একতারা তখন তার সঙ্গিনী হয়ে বালিতটের ওপর বসে। তুষার খ্যাপার পাশেই স্থান হয়েছে তার। দু-টান হয়ে গেছে আমার। বাউল আমাকে পেয়েছে তখন সহচরের ভূমিকায়। সে আমাকে বলছে, খ্যাপা নিকটজনের কাছেই তো নিকটকথা বলা যায়। আর এ অতি গুহ্যকথা। যত্রতত্র কওয়াও যায় না। তার ওপর গুরুর বারণ। তা তোমারে তো খ্যাপা কওয়া যায়। জানবারও তোমার অমন আগ্রহ। বহুবার বহুভাবে তুমি জানতে-বুঝতে চেয়েছ। বলিনি। এড়িয়ে গেছি আমি। একদিন গুরুই কইলেন, তুষার তুমি খ্যাপারে কইতে পারো। ও এ লাইনের আপনার জন। মনের মানুষ। তা খ্যাপা, মনের মনিষ্যিরে মনের কথা কইবারও তো পরিবেশ লাগে। আজ সেই উত্তম পরিবেশ। মেলার হাঁ নেই। গিলে নেবারও কেউ নেই। শুধু আমি আর আমার সামনে আমাদের মনের মানুষ।

বললাম, তোমার গুরুপাট নিয়ে বলো তুষার।

-বলব খ্যাপা, আজ সবই বলব আমি তোমারে। এতে যদি তোমার নেকার উপকার হয়।

-তোমার সাধনগুরু কীভাবে খুঁজে পেলে তুষার? আর সাধনসঙ্গিনী? তার সঙ্গেও তো তোমার একযুগ হয়ে গেল সাধনার। নাকি?

-হ্যাঁ খ্যাপা। বারোটা বছর আমরা একসাথে। মেলায়-আখড়ায়-আশ্রমে আমাদের তফাত নেই। এই যে এখন সারদা নেই পাশে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন ও বসি রয়েছে। দেখেন খ্যাপা, একতারাখানা কেমন চুড়ো করে সুতলি বাঁধা রয়েছে। দেখি মনে হচ্ছে সারদা যেন চুল ছাড়ি বসি রয়িছে।

—তা সারদার দেখা কি তোমার স্মরণজিৎ খ্যাপার আশ্রমেই?

–গুরু আমার ছিল মাধব গোঁসাই। পাটুলির বড়ো আশ্রমের মাধব গোঁসাই।

–তাহলে তুমি প্রথমে বৈষ্ণব মতে ছিলে?

–হ্যাঁ খ্যাপা। অগ্রদ্বীপে গিয়ে গানপাগল হলাম আমি। শুরুর আখড়া হয় ওখানে প্রতি বছর। বার দুই গেছি। গুরু আমার গানে যেন শরীরখানা কাপায়ে দিতেন। বলতেন, শরীরখান তৈয়ারি করে নে। সময় থাকতে সাধন কর। তা এই গুরুর সন্ধানে গেলাম নৈহাটি। সাহেব কলোনিতেই তার মস্ত আশ্রম। দালানকোঠা। তোমায় আর বলছি কী এ কথা। তুমি তো জানো সব সেখানকার শ্ৰী।

-তোমার সঙ্গে সারদার তো ওখানেই আলাপ তুষার।

-তা গুরুর আশ্রমে যাতায়াত শুরু করলাম। গান শিখতে লাগলাম আমি। একদিন গুরুই বললেন, শুধু শিখলে হবে! সাধনে আয় তুই। তোর লক্ষণ ভালো।

দরাজ গলায় আরও সুর খেলবে যদি দম ধরতে পারিস। শাসের খেলা দমের খেলা না জানলে বাউল হবি ক্যামনে?

-তখন থেকে তোমার আশ্রমেই বসবাস।

-হ্যাঁ খ্যাপা। শুরু হয়ে গেল আমার সাধনপর্ব। গুরু বললেন ঘেন্না দূর কর তুষার। রেচক-পূরক-কুম্ভক রপ্ত হল তোর। এখন শুরু হবে তোর রসপালন ব্রত। তিন রস পালন করতে হবে তোকে। এটা তোর ব্রহ্মচর্যের সময়। গুরুর কথার পর পরদিন সকালের প্রস্রাব ধরে রাখলাম মালুইয়ে। ভোরবেলা দেখি প্রাতঃকৃত্যের আগে গুরু আমার ওখানে দাঁড়িয়ে। গুরু-মারে কইলেন, কই গো, নারকেল মালুইখান দাও। তুষার যে আজ থেকে রস খাবে।

জিজ্ঞাসা করলাম, খেলে তুমি তুষার?

তুষার বলল, হ্যাঁ গো খ্যাপা। অবলীলায় খেয়ে নিলুম। শুধু কি প্রথম বাসি পেটের প্রস্রাব নাকি, যতবার তা হয়েছে ততবারই মালুইয়ে ধরে সেটা খেয়ে শরীরে ফিরিয়ে দিয়েছি।

—সেই অনুভূতি কেমন তুষার? ঘেন্না লাগত খুব?

-না গো খ্যাপা। প্রথমে ভেবেছিলাম পারব না। উগরে দেব। আমার যা পিতপিতানি ছিল। ওসব সবই শুরুকৃপাতে দূর হল। প্রথম প্রস্রাব খেয়ে মনে হল কচি ডাবের জল খাচ্ছি। তারপর তো মনে হত সুমিষ্ট ডাবের জল। প্রথম দিনই গুরু বললেন, বিষ্টাও ধরে রাখ তুষার। আজ থেকেই গায়ে-মাথায় মাখতে থাক। খেতেও থাক।

—খেলে তুমি! কীভাবে?

–হ্যাঁ গো। গুরু বললেন প্রথমদিন, মালুই থেকে তোল কিছুটা তুষার।

—তুললে হাতে?

–ঘেন্নায়-ঘেন্নায় তুললাম। কিন্তু তোলার পর শুরুকৃপা।

—মানে!

-আমার হাতের বিষ্ঠা দেখি আমি মুখের ভেতর নিয়ে আস্বাদন করছি। স্বাদ তার অমৃত। তারপর স্নানের আগে গায়ে মাখছি। রাখছি তা গায়ে ঘণ্টা দুয়েক।

বললাম, গন্ধ বেরোত না গা থেকে? ঘিনঘিন করত না গা?

–ওসব কিছুই হত না। গুরুকৃপা। গুরু বললেন, হাতের তালুতে নে। ভালো করে ফেঁটে তোল আগে। ও মা, ফাটতে ফাটতে দেখি মাখন! বদগন্ধ আর নেই তার। অবলীলায় গায়ে মাখলাম। বুকে পেটে মুখে ভালো করে মালিশ মেরে ঘণ্টা দুই রোদে। চড়চড়ে হয়ে গেলে ঘষে তুলে স্নান করে ফেলতাম। তারপর দেখি আমার গা থেকে সুরভি বের হচ্ছে। সেন্ট মাখলে তোমাদের যেমন গা থেকে গন্ধ বের হয় আর কী।

–স্নানের পর কী করতে তুষার?

—স্নানের পরই দমের কাজ। ওদিকে সারদাকেও দমের কাজ শিখিয়ে তৈয়ারি রাখছেন গুরু-মা আমার।

-সারদা সেখানেই ছিল? আশ্রমে?

-হ্যাঁ। গুরু-মা আমার জন্য তাকে কোন্ এক আশ্রম থেকে জানি এনেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, সারদা কি রসপালন করত?

-না না। সাধিকাকে ওসব করতে হয় না। ওরা তো রসবতী নিজেরাই। ওদের এই ব্রহ্মচর্য নেই।

—তার পর কী হল তুষার?

–চলতে লাগল মাসখানেক এই একই নিয়ম। একদিন স্নান সেরে আসনে বসেছি আমি। দেখি গুরু এলেন ঘরে। পেছনে গুরু-মা। হাতে তার মালুই। বললেন আমায়, নাও ছেলে খাও। জিজ্ঞেস করলাম, কী মা? ক্ষীর? মা বললেন, হ্যাঁ বাপ। ক্ষীর। ভাবলাম খেতে গিয়ে গরম কেন!

—খেলে?

-খেলাম তো। খেয়ে দেখলাম স্বাদ নেই কোনো। গুরু বললেন, ওটা না কি ছিল সারদার রজ।

—শোনার পর কি ঘেন্না এল?

–না না। ততক্ষণে আমার ঝিম। ঘুম এল। মরণ ঘুম। বিকেলে উঠলাম।

—উঠে?

–উঠে শুনলাম রাতেই আমার বিন্দুধারণ শিক্ষে হবে আজ। তার নির্দেশে ধ্যানে গিয়ে বসলাম খ্যাপা। নির্দিষ্ট সময়ে গুরু ডেকে নিলেন ঘরে। দেখি সেখানে সারদাও বসে গুরু-মার পাশে। দুজনেরই মন্ত্রজপ চলল। একসময় দুজন দুজনের পাশে এলাম। তার পরই আমি তার সর্ব অঙ্গে চুমু দিতে থাকলাম। আশ্চর্য মাদকতা।

-কামের?

-না গো খ্যাপা। প্রেমের। শরীরে আমার সাড় ছিল না। পরে শুনলাম যে সারদারও। একসময় মনে হল সগ্যে বাস করছি। হিতাহিত জ্ঞান নেই। জ্ঞান যখন ভাঙল দেখি সূয্যি উঠেছে। গুরু এসে দোর খুলে দিলেন। গুরু-মা সারদার যোনি দেখে মাথা নাড়লেন। তারপর শুরু বললেন বিন্দুসাধনায় তুই পাস। ঠান্ডা মেরে ছিলি তুই। পরম এসেছিল শরীরে। শীতলতায় সে আসে।

-কে?

-কে আবার খ্যাপা! তিনি গো তিনি। মনের মানুষ। গুরু বললেন, আজ থেকে তোর নাম দিলাম তুষার। আর ভবা পাগলা আমারে খ্যাপা টাইটেল দিয়েছিলেন। তোর সাধনায় খুশি হয়ে তোরে আমি ওই টাইটেল ব্যবহারের অনুমতি দিলাম। আর তোর সঙ্গিনী, সে যে তোরে পার করল। সাধনার সার ও বুঝেছিল রে। তাই আজ থেকে ও সারদা আর তোর সাধনসঙ্গিনী বলেই টাইটেল ওরও প্রাপ্য।

বললাম, সেই থেকে তোমরা হলে খ্যাপা-খেপী। তাই তো? তাহলে এসব নামও তোমাদের গুরুপ্রদত্ত।

তুষার বলল, হ্যাঁ গো খ্যাপা। না হলে আমার সামাজিক নাম ছিল স্বপন। আর খেপীর রমলা।

—তোমরা তাহলে এখন আর সামাজিক মানুষ নয় তুষার?

-বাউলের আবার সমাজকী? সামাজিক জীব সে তো নয়। হলে পরে তো খ্যাপা আমার বাপ-মা হতাম এতদিনে। আমরা হলাম সহজ মানুষ। বিন্দুধারী সহজানন্দ আমাদের সমাজ।

জানি না এ কোন্ সমাজের কথা তুষার আমায় বলল! সন্ধ্যা নামছে এখন। ফঁাকা নির্জন অজয়ের ধারে আমরা এখন তিন মানুষ। সামাজিক আমি আর দুজন অতীন্দ্রিয় জগতের মানুষ-মানুষী। যদিও সারদা নেই। তুষারের হাতের একতারায় ও তার প্রতিভূ এখন।

3 Comments
Collapse Comments

এটি কি কোন বই? কীভাবে পাওয়া যাবে? আপনার সাথে যোগাযোগ করতে চাই।

Bangla Library (Administrator) May 30, 2021 at 2:34 am

হ্যাঁ বই। দুই বাংলার বাউল আখড়া। লেখক সোমব্রত সরকার। বইয়ের দোকানে খুঁজে দেখতে পারেন।

সাবাস ক্ষেপা, তোর হবে রে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *