০২.১ বাউল আবদুল করিম বলে

প্রাণের বাগান
বাউল আবদুল করিম বলে

বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা কালনী নদী আর হাওরের আফাল একটা মানুষকে বাউল বানাতে পারে, এ খবরটা যখন আমি শুনি ঘোষপাড়ার বাউল দীনদয়ালের মুখে, তখনই শাহ আবদুল করিমের পূর্ণাঙ্গ খবর নিতে উঠে পড়ে লাগি। ততদিনে আবদুল করিম বাংলাদেশের মানুষদের কাছে কিংবদন্তির মর্যাদা পেয়ে টেয়ে একেবারে জীবনেরই প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছেন। অসুস্থ করিমের খবরও পেয়েছিলাম আখড়াবাড়িতে বসেই। ২০০৯ সাল, সেপ্টেম্বর মাসে আশ্বিনের ফোটা কাশের ভেতর দিয়ে এক ঢেউ খেলানো হাওয়া তুলে সাধক করিমের খবর এলো। ঘোষপাড়ার বাউল সমাজ তাঁকে বিদায় দিলেন গানের ভেতর দিয়েই। আখড়াবাড়ির গায়ে বয়ে চলা রূপ হারানো ত্রিবেণীর মূল সোঁতাটা তখন এখানে গঙ্গা নামেই খ্যাত। তার ভেতরও যেন কালনীর ঢেউ/ আফল তুলে আনলেন সাহেব কলোনির প্রবীন বাউল সাধক স্মরনজিৎ খ্যাপা। বেশ মনে আছে আমার, খ্যাপার একতারায় বোল উঠেছে; গলায় হাওরের আফল–’ভবসাগরের নাইয়া/ মিছা গৌরব করো রে/ পরান ধন লইয়া/ একদিন তোমার যাইতে হবে/ এই সমস্ত থইয়া রে/ পরান ধন লইয়া।‘ বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের উজালধল গ্রাম থেকে বাউল আবদুল করিমের দেহ রাখার খবর নদিয়ার ঘোষপাড়াতে পৌঁছলে এভাবেই এখানকার বাউল সমাজ তাঁকে বিদায় জানিয়েছিল। আমার আজও কল্পনা করতে ভালো লাগে। উজালধলের আখড়া বাড়িতে যখন করিমকে স্ত্রী ও সাধন সঙ্গিনী সরলার কবরের পাশে সমাহিত করা হচ্ছিল, তখনই বোধহয় ডুবকিতে চাপড় দিয়ে দীনদয়াল গাইছেন–’অকূল নদীর ঢেউ দেখে ডরাই/ অসময়ে ধরিলাম পাড়ি আকাশেতে বেলা নাই।।… আবদুল করিম দায়ে ঠেকেছে দরদি কে ভবে আছে রে/ দেও সংবাদ মুর্শিদের কাছে মরণকালে চরণ চাই।।’ শাহ আবদুল করিমের মরন সংবাদে আখড়াবাড়িতে এভাবেই গুরু মুর্শিদেরা বাউল সাধকের চরন বন্দনা করেছিলেন মুর্শিদ গুরুর কাছেই। কালনীর স্মৃতি, আফল, হাওরের কিংবদন্তি হয়ে ওঠা বাউলা করিম এভাবেই প্রথম বাসা বেঁধেছিলেন আমার মনে–’নিশিদিনে শয়নে-স্বপনে/ পরানে পরানে মিশিয়া/ এই আঁধার রাতে নেও যদি সাথে/ তুমি নিজে পথ দেখাইয়া।।‘ বাউল আবদুল করিম এভাবেই বোধহয় পথ দেখিয়েছিলেন আমায়, আরও আশ্চর্য যেটা, সেই সুনামগঞ্জ, হাওরের ছেলেই আমার বন্ধু সুমনকুমার দাশ করিমের সঙ্গে এক অর্থে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটিয়ে দিলেন গত বছরের ফেব্রুয়ারিতেই। সেটা ছিল শাহ আবদুল করিমের জন্মশতবর্ষ স্মরণ অনুষ্ঠান। সিলেট শহরে ঘটা করে পালন হয়েছিল উৎসব। কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন শিল্পী ও সঙ্গীত সংগ্রাহক মৌসুমী ভৌমিক। অসম থেকে অধ্যাপক তপধীর ভট্টাচার্য। যদিও আমার কিন্তু সে উৎসবে যাওয়াই হয়নি। তথাপি আমি ছিলাম যেন সেই একেবারে উৎসবের মাঝখানে বসে–’আমি ফুল, বন্ধু ফুলের। ভ্রমরা/ কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া। / না আসিলে কালো ভ্রমর কে হবে যৌবনের দোসর/ সে বিনে মোর শূন্য বাসর আমি জিয়ন্তে মরা।’ সুমনের বই উদ্বোধন হচ্ছে ‘শাহ আবদুল করিম জীবন ও গান’, সাধু-গুরু-মরমিয়া-শিষ্যরা সব গাইছেন করিমের গান, বক্তব্য রাখছে সুমন। আমি ওঁর পাঠানো ছবি ও ভিডিও পেয়েই চলে যাচ্ছি সিলেট। ভাবছি, অনুষ্ঠান শেষে একবার গিয়ে বসব বাউল করিমের কবরে সুমনের সঙ্গেই হাঁটব ভাটি-সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবেড়িয়া; সাতটি জেলার চল্লিশটি উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত ভাটি অঞ্চল, অথচ এ বছরও তো ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে মার্চ… আমার যাওয়া হল না হাওর… দেখা হল না কালনীর আফাল… আবদুল করিমের কবর…কাজের কাজ যেটুকু হল–বাংলাদেশ থেকে একুশে গ্রন্থমেলায় বের হল আমার প্রথম বই ‘পশ্চিমবঙ্গের বাউল’। যার মূলে কিন্তু জড়িয়ে আছে আবার সুমনের বন্ধুত্ব আর বাউল আবদুল করিমেরই এক নিবিড় যোগাযোগ–’বন্ধু দরদিয়া রে/ আমি তোমায় চাই রে বন্ধু/ আর আমার দরদি নাই রে।‘

বাউল আবদুল করিমের গান আমি প্রথম অবশ্য শুনি ঘোষপাড়া নয়, সাহেব কলোনিতে স্মরণজিৎ খ্যাপার আখড়াবাড়িতে। খ্যাপা দুই মহতের পদ খুব পছন্দ করেন। এক, ভবা পাগলা। দুই, শাহ আবদুল করিম। ভবা পাগলা খ্যাপার মুখে নিজের লেখা গান শুনেই তাঁকে খ্যাপা উপাধিটি দিয়েছিলেন। মনসুরউদ্দিন তাঁর ‘হারামণি’তে পূর্ববঙ্গের সাটুরিয়া থানা এলাকার আমতা বেলেটি গ্রাম ভবার জন্মভূমি বলে উল্লেখ করলেও আদতে তাঁর জন্ম ঢাকার ধামরাই থানা এলাকার আমতা গ্রামে। ১৯৫০ সালে ভবা পাগলা পশ্চিমবঙ্গে এসে বর্ধমানের কালনায় কালী মন্দির ও আশ্রম স্থাপন করে মাতৃসাধনা শুরু করেন। কালনার মন্দির প্রতিষ্ঠার দিবসেই স্মরণজিৎ খ্যাপা গেয়ে ওঠেন–’মানুষ তোমার কোথায় অবস্থান/ আসো যাও নাই স্থিরতা অনুমান আর বর্তমান/ বুঝো না এই বারতা/ মানো না তুমি বিধাতা/ প্রকৃতি যে সেই তো মাতা কথাটি কী মূল্যবান।‘ এই গান শুনেই ভবা নিজের গলার মালা খুলে স্মরণজিৎ বাউলের গলায় পরিয়ে তাঁকে ‘খ্যাপা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

স্মরণজিৎ খ্যাপা সন্ধ্যায় চালপানি নিয়ে দৈন্য গানের আসরই শুরু করতেন আবার বাউল আবদুল করিমের পদ গেয়ে। গাইতেন–’দয়াল মুর্শিদ, তুমি বিনে/ কে আছে আমার? / তোমার নাম ভরসা করে অকুলে দিলাম সাঁতার। তাঁর বায়েদ শ্রীদাম ফকির এর পরই গেয়ে উঠতেন–… পড়িও না রিপুর ফাঁদে ভক্তি রেখো মুর্শিদপদে পড়বে না। কোনো বিপদে/ নিলে মুর্শিদ পদায়। আবদুল করিম মূঢ়মতি/ মুর্শিদ বিনে নাই তাঁর গতি/ কাঙাল জেনে দাসের প্রতি/ যদি মৌলার দয়া হয়।’ করিমের গানের পরই আসরে আসত ভবার গান।

খ্যাপা করিমের আরেকখানি জনপ্রিয় গানও গেয়ে থাকেন অনুষ্ঠানে গেলেই। একতারাতে সুর চড়িয়ে গাইতেন খ্যাপা–’আমি কুলহারা কলঙ্কিনী/ আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী। এ গানের সঙ্গে জমজমাট বাঁশির সঙ্গত রাখেন শ্রীদাম ফকির। এবছর একুশে গ্রন্থমেলাতেই প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশের বিশিষ্ট লোক সংস্কৃতি গবেষক সাইমন জাকারিয়ার শাহ আবদুল করিমের জীবনছায়া অবলম্বনে উপন্যাস ‘কুলহারা কলঙ্কিনী।

২০০৯ সালের মে মাসে তাঁর জীবদ্দশাতেই শাহ আবদুল করিম রচনা সমগ্র প্রকাশ পায় সিলেট থেকে কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শুভেন্দু ইমামের সম্পাদনায়। আর শুভেন্দুই ওঁর জন্মশতবর্ষ স্মরণ’ পুস্তিকাটিরও সম্পাদক ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের দু’জন লেখক এই স্মরণ পুস্তিকাতে লিখেছিলেন। আমার সৌভাগ্য আমি সেখানে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম।

ঘোষপাড়ার বাউলানি কৃষ্ণা দাসী গেলে পরেই আমাকে করিমের একখানি গান শোনাতেন–’কী জাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে, দেওয়ানা বানাইছে। কৃষ্ণার তখন জুড়ি ভাঙেনি নবকুমার দাস বাউলের সঙ্গে। দুজনেই এক সঙ্গে গান করে বেড়ান তাঁরা। একসময় এই জুটি ছিল বাউল সমাজে চর্চা ও শ্রোতা মনোরঞ্জনের বিষয়। তারপরই জুড়িহীন কৃষ্ণার একাকী জীবন শুরু হয়। তবু কৃষ্ণা করিমকে ছাড়েননি। আসর মাত করেই গাইতেন–’আমার বুকে আগুন রে বন্ধু/ তোমার বুকে পানি/ দুই দেশে দুই দেশে দুই জনার বাস/ কে নিভাইব আগুনি রে/ আর আমার দরদি নাইরে।‘ এই গান গাইতে গেলে কৃষ্ণার গলায় হাহাকার খেলত, চোখ ছলছল করত। রংদোলে চাঁচরের রাতে তবু কৃষ্ণা দাসী বাউল আবদুল করিম দিয়েই আসর। জমাতেন সতী মায়ের মেলায়—’না জেনে করেছি কর্ম/ দোষ দিব আর কারে/ সর্পের গায়ে হাত দিয়াছি/ বিষে তনু ঝরে রে/ আর আমার দরদি নাই রে।‘

জনপ্রিয় বাউল পূর্ণদাসের দিদি হলেন রাধারানি দাসী। কৃষ্ণার মতো তাঁর গান জনসমাজে পৌঁছায়নি। কেঁদুলির মেলার এককোণে পড়ে থাকতেন প্রবীনা রাধারানি। কেউ একটু গাইতে দিলে নিজেকে উজাড় করে দিতেন। থাকতেন বোলপুরের ওঁড়িপাড়া ভাই চক্রধর বাউলের অথর্ব ছেলেটিকে নিয়ে। পরে অবশ্য তাঁর বাস গোপালনগরে গিয়ে ওঠে। রাধারানি ছিলেন গানের ভাণ্ডারী। দুঃখ এটাই, তাঁর কণ্ঠ ধরে রাখা যায়নি। হারিয়ে গেছে তাই অল্পশ্রুত অনেক মহতের পদ, লেখাজোখা না থাকার কারণেই। রাধারানি দাসীর মুখে শুনেছিলাম বাউল করিমের একখানি পদ–’মন পাগলা তুই লোক সমাজে, লুকি দিয়ে থাক। / মনমানুষ তোর মন মাঝে, আছে রে নির্বাক।‘

চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ সিলেটের প্রবীণ লোকসঙ্গীত শিল্পী। জনপ্রিয় এই শিল্পী গত হয়েছেন ২০১৪ সালে। সেখানকার আরেক কিংবদন্তি সুষমা দাশ। সংগ্রাহক মৌসুমী ভৌমিক এই দুইজন প্রবীণ শিল্পীর গান সংগ্রহ করে এনে এখানে প্রকাশ ঘটিয়েছেন। চন্দ্রাবতী রাধারমণের গানের একজন নামী শিল্পী হলেও করিমেরও বেশ কিছু গান। গেয়েছিলেন। সুষমা এখনও ভারী বার্ধক্য নিয়েও করিমের গান পরিবেশন করেন। এক সাক্ষাৎকারে সুমন প্রশ্ন রেখেছিল, ‘করিমের কোনও গান কি জানেন? বা কোন গানগুলো বেশি পছন্দ আপনার?’ চন্দ্রাবতী উত্তর করেছিলেন, ‘জানতাম না কেনে? করিম ভাইয়ের বেশ কতগুলো বেশ কতগুলো গান গাইছি। তাঁর ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘মন মজালে ওরে বাউলা গান’, ‘কোন মেস্তুরী নাও বানাইল কেমন দেখা যায়’–এসব গান বেশি গাই। করিম ভাইয়ের সঙ্গে অনেকবার দেখা-সাক্ষাৎও হইছে।

আমাদের ছোটবেলাতেও রেডিও, টিভিতে বাজত–’আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম/ গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান/ মিলিয়া বাউলা গান ঘাটু গান গাইতাম।‘ এখনও এই গানটি আমাদের এখানকার লোকসংগীত শিল্পীরা গেয়ে থাকেন। করিমের আরেকখানি গানও এখানে বেশ প্রচলিত–’আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া/ গান গাই আমার মনকে বোঝাই/ মন থাকে পাগলপারা।‘

গোরভাঙার নামকরা ফকির আরমান করিমের একখানি গান গেয়ে বেড়ান প্রায় আসরে–’মুর্শিদের প্রেম বাজারে কে যাবে রে আয়/ যেতে যদি হয় বিলম্বে নয়/ চল যাই সকালবেলায়।‘ তবে বাউল করিমের গুটিকতক দেহতত্ত্ব, সাধনতত্ত্বের গানই কেবল গেয়ে থাকেন পশ্চিমবঙ্গের বাউল ফকিরেরা। বাংলাদেশে করিমের অনেক শিষ্য-বায়েত আছেন। তাঁরাই ধরে রেখেছেন বাউল আবদুল করিমের গান ও সাধনা–’এই যে তোমার দেহভাণ্ড বন্ধ করো সকল রন্ধ্র/ অমাবস্যায় পূর্ণচন্দ্র দেখবে হৃদাকাশে/ অনাহত দ্বাদশ দলে নয়ন যদি মেশে/ করিবে স্বদেশের চিন্তা রবে না আর এ বিদেশে।‘

সুমন কুমার দাশ আমার প্রাণের বন্ধু। বাংলাদেশে যাঁদের সঙ্গে আমার আত্মীক সম্পর্ক এখন, সমন তাঁদেরই অন্যতম। আমরা দু’জন দু’জনকে ‘বন্ধু’ সম্বোধনেই ডাকি। সিলেট থেকে সুমন ডাক দেয়, সেই ডাক নদিয়ায় এসে পৌঁছয়। অথচ কেউ কাউকে এখনও দেখিনি। সুমন কথা বললেই ওর ভাষা থেকে গানের গন্ধ বের হয়। শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে গৃঢ় ও গভীর সখ্য ছিল আমার বন্ধুর। এই একটি বিষয়েই আমি কেবল বন্ধুকে ঈর্ষা করি। আবদুল করিমের জীবনীকার সে। ওর কথা ভেঙেই আমি কিংবদন্তিসম মরমিয়ার অন্তরমহলে প্রবেশ করি আর আশ্চর্য হই। জানতে পারি শুধু গান নয়, বাউল করিম ‘নিমাই সন্ন্যাস পালা’ খুব চমৎকার গাইতেন। তবে সে পালা শোনার সৌভাগ্য সুমনেরও হয়নি। করিম বলেছেন, বাউলগান এত বেশি আসরে গাইতে হয়, নিমাই সন্ন্যাস পালা গাওয়ার সুযোগ আর হয়ে ওঠে না। এ ছাড়া আগের তুলনায় হিন্দু ধর্মীয় পালাগানের আসরও তো ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।

‘শাহ আবদুল করিম: তাঁর স্মৃতি, তাঁর গান’ নামক একটি লেখাতে বন্ধু সুমন লিখেছে সাধক করিমের সহজাত দিকটির কথা। পড়ে সম্মোহিত হয়ে উঠি। এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে বাউল করিমের এই মানসিকতাই প্রমাণ রাখে যে, একমাত্র গানই তাঁর বেঁচে থাকার শ্বাস। সাক্ষাৎকারে তিনি অবশ্য বারেবারেই বলেছেন সে কথা, ‘আমি তো কোনও কিছু পাওয়ার আশায় গান গাই না। আমার মনে গান চায় তাই গান গাই। গান গাই বলেই তো তুমি আমার কাছে এসেছ, তাই না?

বাউল করিমের এই জিজ্ঞাসারই উত্তর সুমন দিয়েছে নিজের লেখায়। জীবনের শেষ দিক। অনেকখানি খ্যাতি ও সম্মান নিয়ে শাহ আবদুল করিম তখন দেশের মানুষদের কাছে পরিচিত। বিদেশেও গেছেন প্রবাসী বাঙালিদের মরমিয়া সুর শোনাতে, বেড়িয়ে গিয়েছে তাঁর গানগ্রন্থগুলিও এক এক করে। কালনী নদী তাঁকে বাউল করেছে বলেই একটির গ্রন্থনাম ‘কালনীর ঢেউ’। এছাড়া ‘ভাটির চিঠি’, ‘ধল মেলা’, ‘গণ-সঙ্গীত’ও বেরিয়ে গেছে। প্রথমবার যুক্তরাজ্য সফর করেছে ১৯৬৮ সালে শিষ্য দুর্বিন শাহকে সঙ্গে করে। ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ, শেখ মুজিবুরের সঙ্গে বাংলা গড়ার স্বপ্নে সাড়াও দিয়েছেন–’দরদি, বাংলার নাও সাজাইয়া/ আমরা যাব বাইয়া। বাইতে বাইতে তরী এসেছে আপামর জনগনের ভেতর। গান, সাধনা, শিষ্য পরিবৃত্ত করিম আবার বাধাও পেয়েছেন। শরিয়ত সমাজের কাছে। মারফতি সমাজের আল্লা-ঈশ্বর না মেনে, বেদ-কোরান অস্বীকার করে সহজ মানুষ ভজা ধর্মে সাড়া দেওয়ার বাসনাতে বহুবারই নেমে এসেছে আক্রমণ। স্বাধীন বাংলাদেশে করিমও রেহাই পাননি। তাঁর স্ত্রী সরলা দেহ রাখলে গ্রামের ইমাম। জানাজা পড়াতে বাধা দিয়েছিলেন বাউল সাধক বলেই। কেননা করিমের বাউল সাধক বলেই। কেননা করিমের বাউল জীবন, সাধনা, গান–সবই নাকি বেশরা ও ইসলাম বিরোধী। লৌকিক ইসলামে বিশ্বাসী বাউল করিম দমে যাননি। নিজের বাড়িতেই স্ত্রীর কবর খুঁড়েছেন, শিষ্য আকবরকেও গুরু-মুর্শিদ করিম নিজেই জানাজা পড়িয়ে দাফন করেছেন। আবার এই বাংলাদেশই দিয়েছে তাঁকে সম্মান; একুশে সম্মানে ভূষিত হয়েছেন শাহ। আবদুল করিম। পেয়েছেন আমজনতার ভালোবাসা আর অসংখ্য পুরষ্কার। পূর্ববর্তী মহৎ লালন শাহ, হাসন রাজা, রাধারমণদের গানও তিনি কণ্ঠে ধারণ করেছেন; রেকর্ড করেছেন। বাদ পড়েননি সৈয়দ শাহনুর, দ্বিজদাস, আরকুম শাহ, শীতালং শাহদের মতো। আলু পরিচিত সাধক ও মহাজনও। গান গেয়েছেন, সাধনা করেছেন, বই বের করতে শেষ সম্বল নয় বিষে জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছেন। তবু সাধক, মহৎ মানুষের পাশে থাকতে চেয়েছেন, কেবল আত্মভোলা বাউল সাধক হতে চাননি শাহ আবদুল করিম–’মানুষই যদি না থাকে তাহলে দেহসাধনা করবে কে? দেহসাধনা করতে তো কেউ বাধাটাধা দিচ্ছে না, তবে বিপন্ন মানুষের কথা চিন্তা করতে হবে। গণমানুষের মুক্তি প্রয়োজন। তাই আমি বাউলগানের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরি। এই আঙ্গিকে গানও তো রয়েছে করিমের অসংখ্য। সেই করিমও শেষ জীবনে সংবর্ধনায় টাকা পেয়েছেন সোয়া তিন লাখ। করিম ভেবেছেন, সোয়া তিন হাজার। বলেছেন তখন, ‘এত টাকা! এই সোয়া তিন হাজার টাকা দিয়ে আমি কী করব?‘ আয়োজকরা বলেছেন ‘সোয়া তিন হাজার নয়, লাখ। করিম এই শুনে এক লাফে চেয়ার ছেড়ে ছেলেকে বলেছেন, ‘চল বাড়ি যাই। সর্বনাশ, অত টাকা! এগুলা নিয়া আমরা কিতা করমু? আমার টাকার দরকার নাই, মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই বড়ো প্রাপ্তি। চল চল বাড়ি চল।‘

সুমনের লেখা থেকে এ কাহিনী পড়ে আমি কেঁপে উঠি। মনে মনে ভাবি আমার বন্ধু এমন মানুষের সঙ্গ করেছে, সাক্ষাৎকার নিয়েছে, জীবনীগ্রন্থ লিখেছে। আমি সেই গ্রন্থ নিয়ে এই শেষ ফেব্রুয়ারিতেই শাহ আবদুল করিমের সখ্য বোধ করি। সুনামগঞ্জ, সিলেটের, ভাটি-হাওরের জল বাতাস লাগাই গায়ে। একতারা বাজিয়ে গাই–’মানুষ হয়ে তালাশ করলে মানুষ পায়/ নইলে মানুষ মিলে না রে বিফলে জনম যায়।‘

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *