০১.২ দেহের খবর জান গে রে মন

দেহের খবর জান গে রে মন

চৈত্র-পূর্ণিমার চাঁদ নিয়ে কুলের পাটের মেলা সাজে। চাঁদ যেন এক চৈতন্য। যমুনা-খালে আদিগন্ত ছড়িয়ে যেয়ে যে যখন তার হাসি ছড়ায় আর বাতাস ফাঁকা ধানের মাঠে সরু খালের জলীয় হাওয়া তুলে এনে ধানকে বাজায়, তখন মনে হয় নদিয়ার জ্যান্ত গৌর হাসছেন আর তাঁর হাসিই খলবল বেজেবেজে যাচ্ছে ধানের মাঠে। এ মেলার ধারক-বাহক আমাদের গৌরই। চৈতন্য স্মৃতি-বিজরিত এ মেলা। কুলিয়ার পাটের মেলা। লোকে বলে কুলের পাটের মেলা। অনেকে আবার বলেন, অপরাধ ভঞ্জনের মেলা। কথিত: বিশিষ্ট তার্কিক দেবানন্দ গোস্বামীকে চৈতন্যদেব এখানেই তর্কযুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। তার্কিক হিসাবে যথেষ্ট সুনাম ছিল দেবানন্দের। এ বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট অহংকার তৈরি হয়েছিল মনে যে, তাঁকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করবার মতো কেউই নেই। নবদ্বীপের তাবড় তাবড় সব পণ্ডিত তাঁর সঙ্গে তর্কযুদ্ধে একেবারে কুপোকাত হয়ে গিয়েছিলেন। এ-হেন তার্কিককে যখন চৈতন্যদেব পরাস্ত করেছিলেন, তখন অবশ্য চৈতন্যদেবের পরিচিতি বাংলা-বিহার-ওড়িশা ছড়িয়ে পড়েনি। সাধারণ এক শাস্ত্রজ্ঞ যুবকের কাছে পরাজিত হয়ে দেবানন্দের চোখ খুলে গিয়েছিল। তিনি নাকি চৈতন্যদেবের কাছে তখন তাঁর অহংকার জনিত সব অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছিলেন আর নদিয়ার গৌর তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। সেই মাহাত্মেই প্রচুর মানুষজন, সাধুগুরু, বৈষ্ণব-বাউল সব আসেন এখানে। যে যার অপরাধ স্বীকার করে নেন শ্রীপাঠের গৌরমূর্তির কাছে। নামকীর্তন চলে। বাউল। গানও হয়। তুলনায় নির্জন খালের ধার ফাঁকা থাকে। ওখানে বসে লোক হাওয়া খায়। দু’দণ্ড জুড়ায়।

আমরা দুই বন্ধু যে উদ্দেশ্যেই মাঝ-মেলায় গিয়ে বসলাম খালপাড়ে। মানুষজন কেউ নেই। মেলা তখন আমাদের গৌরচাঁদের ঝলক নিয়ে তার বিকিরণ ছড়াচ্ছে সমানে।

সবে বসেছি আমরা। শীতল জ্যোৎস্নায় চোখমুখ সব চকচক করছে, চুল উড়ছে। সুজিতের থলথলে পাজামায় হাওয়ার মাতন লেগেছে। ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল।

হঠাই শুনি একতারার বোল উঠেছে খালধার থেকে ভেসে আসছে গান। তার রেশ কানে এসে লাগছে আমাদের। আমরা উঠে গান বরাবর এগিয়ে গেলাম। সুজিত বলল, যা সিগারেটটা শেষ করে যাচ্ছি।

গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা বাউলের পাশে। একমনে গেয়ে চলেছন তিনি। চেনা গান আমার। কতবার কতজনের মুখে যে শুনেছি জালালউদ্দিনের এই পদ। একেক শোনায় একেক আবেশ এনে দিয়েছে মনে। আজকে বাউল যেন মানুষের উচ্চ্যমন্য, অহংকারী সত্তা সব এক-এক করে খুলে সাজিয়ে রেখে দিচ্ছেন যমুনাখালের তাল তাল শক্ত কাদায়। মানুষের দ্বৈততা, তাঁর গ্রামীন ও নাগরিক যাপন সংক্রান্ত প্রচলন সব যেন বাউল খুলে ফেলছেন মানুষের আসল ব্যক্তিময়তায়। তেমনই আমার মনে হচ্ছে। ভাবছি, চৈতন্যের অন্তর্গত সত্তা এখনও এতখানি করতে পারে?

বাউল গাইছেন:

চিন্‌গে মানুষ ধরে
মানুষ দিয়া মানুষ বানাইয়া সেই মানুষে খেলা করে।
কীসে দেব তার তুলনা কায়া ভিন্ন প্রমাণ হয় না।
পশুপক্ষী জীব আদি যত এ সংসারে
দুইটি ভাণ্ডের পানি দিয়া অষ্ট জিনিস গড়ে
তার ভিতরে নিজে গিয়ে আত্মারূপে বিরাজ করে।
মায়া সূতে জাল বুনিয়ে প্রেমের ঘেরে ভাব জাগায়ে
প্রাণেতে প্রাণ মিশাইয়া রহে জগত জুড়ে
নব রঙ্গে ফুল ফুটিলে ডোমর আসে উড়ে
ফুলের মধু দেখতে সাদা আপনি খেয়ে উদর ভরে।
সমুঝ দিয়ে দেখ চেয়ে পুরুষ নহে সবই মেয়ে।
থাকবে যদি পুরুষ হয়ে চল ভেদ-বিচারে
একটি পুরুষ নিজ ছুরতে জগত মাঝে ঘুরে–
লক্ষ নারীর মন জোগাইয়া প্রেমের মরা আপনি মরে।

আমাদের দেখে বলে বসলেন, বসেন।

আমরা পর-পর বসে গেলাম খালপাড়ে। যমুনা থেকে তখন হাওয়া উঠছে সমানে। বাউলের চুলদাড়ি নড়ছে। আমাদের মুখে চকচক করছে চৈত্রের চাঁদ।

জিজ্ঞাসা করলাম, মেলা ছেড়ে এখানে একা বসে গাইছেন? কাউকে বুঝি আর শোনাতে ইচ্ছা জাগছে না?

বাউল বললেন, তা নয়। মেলা হল গিয়ে হাঁ কর্তা। সর্বক্ষণ গিলছে। ভাবলাম একা বসে কিছু সময় ত্রিবেণীরে গান শোনাই।

বললাম এখানে আপনি তিন নদী কোথায় পেলেন?

হাসলেন বাউল। মনে হল চৈত্র-চাঁদ হেসে উঠছে তার মুখে।

–তিন তো সদা সর্বদা আমরা ধরে রাখি কর্তা। তিন তো মাইনষের মইধ্যে খেলা করে। তিনখান নদী লইয়া মানুষ নাড়েচড়ে। কথা কয়। ও কর্তা, মাইনষের ত্রিবেণী তো মাইনষের অন্দরে খেলা করে।

বুঝলাম, বাউল তিনটি নদীস্বরূপা নাড়ির কথা বলছেন।

বললাম, তিন যদি মানুষের মধ্যেই থাকে তাহলে মজা যমুনা খালের প্রতীকে লাভ কী? নিজেকে গান শোনালেই তো হল।

–কর্তা, প্রেমরে কি আপনে দেখবার পারেন? পারেন না। মাইনষের মধ্যে দিয়া প্রেমরে দেখেন। প্রেম যে কর্তা তালে প্রতীক নিল? নিল না? কী কন?

আমি চুপ। বাউলের মুগ্ধতায় নিমজ্জিত হয়ে গেছি। বন্ধুদেরও যেন ত্রিবেণী স্নান হয়ে গেছে রাত নটার কাঁটায়।

বলে চলেছেন বাউল।

মজা যমুনাডারে পিঙ্গলা মনে কইরা যদি ভেতর শানাই, তা কর্তা মনে পড়ব হেইগার মইধ্যে সঞ্জলের স্রোত ছিল। এই যমুনার তো গঙ্গা, সরস্বতীর সঙ্গে মিলন-মিশন ছিল। ত্রিবেণীখান অ্যাহনো যদি দেখেন, তবে দ্যাখবেন সেই ভাব-ভালবাসার রেখাখান দেখা যায়। যমুনা তো আয়নামহলের ঘরডারে মনে করায়। মজা যমুন্না যে ফিসফিসাইয়া কয় দিন গেল, নাড়ি জাগব কবে? যমুনা যে বাড়বাড়ির কাছারি ঘরে হেইডার বিচার চায়। তাই তারে মনে লইয়া মজাডারে গান শুনাই। মানুষ জাগাই। ভেতর-মানুষের আওয়াজ খান শোনেন কর্তা।

একতারাটা টুং টুং করে বাজিয়ে ধরলেন বাউল। গাইতে থাকলেন।

মানুষ হয়ে মানুষ হয়ে কর গো যা মানুষের লীলা
ধরবি যদি সে মানুষে খুলে দে দেহের তালা
মানুষে মানুষ রয়েছে ধর গে মানুষ মানুষের আহে
মানুষে মানুষ পেয়েছে বৃন্দাবনে ব্রজবালা।।
লইলে মানুষের সঙ্গ উথলিবে প্রেমতরঙ্গ
সাক্ষ্মী আছে শ্রীগৌরাঙ্গ কৈলাসেতে পাগল ভোলা
পরমাত্মা রূপে এসে মানুষে মানুষ আছে মিশে
সাধনকল্পে পারি দিশে রবে না আর ত্রিতাপ জ্বালা
দ্বিদল পরে দেয় পাহারা বেদবিধি পার উলটা খেলা।
রাজা হয়েছে দিশেহারা হল না তার মানুষ ধরা
রাজেশ্বরী দিচ্ছে সাড়া যোগ দিতেছে যোগে চেলা।।

আমরা শুনলাম বাউলের মানুষ এসে সাড়া দিচ্ছে ফাঁকা এ ধারে। মেলার কলরবের মানুষ সব যমুনার ফুরফুরে হাওয়ায়, ধবধবে চাঁদে যেন মানুষের লীলায় মেতে উঠছে। না হলে গৌরের জ্যান্ত লীলায় এখনও এত মানুষের সমাগম হয়?

বাউল বললেন, একদিন চাঁদমারী আসেন। বিস্তর গান শোনাব মানুষের। আমার বসতির কাছ ঘেঁষে ইড়া নদী। পিঙ্গলায় তো বসে রইলেন। সরস্বতীটা দেখে আসেন পঁচিশে চৈত্র। ত্রিবেণী শ্মশানঘাটে গান আছে। আসবেন।

উঠে পড়লেন হরি বৈদ্য বাউল। খালপাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে মিশে গেলেন দেবানন্দ গোস্বামী নামাঙ্কিত সৌধের ধার দিয়ে মানুষের স্রোতে।

তাঁকে আর দেখা গেল না। যমুনার ফুরফুরে হাওয়ায় মানুষের অন্তর্দীপ্তি খুঁজে ফেরা বাউলকে মানুষের ভিড়ই মিশিয়ে নিল চৈত্র-পূর্ণিমায়।

*****

‘মানুস-ধরে’ মানুষ চিনবার কথা বলেছেন হরি বৈদ্য বাউল। মানুষ ধরা হল গুরুর কাছে যাওয়া। গুরুর আসন বাউলের কাছে হৃদয় সিংহাসন। গুরুকে তারা পরমতত্ত্ব হিসাবেও ব্যাখ্যা করেন। মানবগুরুও বলে থাকেন বাউল। কেননা বাউলই মানুষ হলে ওঠেন গুরুর নির্দেশিকায়। গুরুই সাধক বাউলকে মানুষে পরিণত করে দেন। তারা মানুষকে ‘মনের মানুষ’, ‘সহজ মানুষ’, ‘ভাবের মানুষ’, ‘রসের মানুষ’, ‘আলেখ মানুষ’ ইত্যাদি নানা অভিধায় ভূষিত করে থাকেন। মনের মানুষ তার কাছে আত্মস্বরূপ। নিজের ভেতর নিজের জ্যান্ত উপস্থিতি, নড়াচড়া, কথা বলা ইত্যাদি নানা ইন্দ্রিয়গত উপস্থিতিকে টের পাইয়ে বাউল গুরু সাধক বাউলকে ক্রমান্বয়ে ‘মনের মানুষ’, ‘সহজ মানুষ’ ইত্যাদির নানা অভিজ্ঞানে পরিণত করান। গানে তাই বলা হয়েছে, মানুষ দিয়া মানুষ বানাইয়া সেই মানুষে খেলা করে।

বাউলগুরু শিষ্যর মানুষ সত্তার বিকাশ দিয়েই মানুষ বানিয়ে দেন সাধক বাউলকে। তখনই এই মানুষের মধ্যে সেই মানুষে খেলা করে সেই মানুষ হল বাউলের নানা তকমাধারী সব মানুষ। গুরু তাঁকে সেই মানুষ’ তৈরি করান। বাউল সাধনায় গুরু তাই ঈশ্বরের মতো। গুরুই শিষ্যকে মানুষের স্থির নিবেশ দিয়ে সহজতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। গুরু বাউলের অশ্রুময় সত্তা যেন। অন্তরালের আবরণ খসিয়ে গুরুই বাউলকে অন্বেষণের উত্যাক্ষা, অন্তর্লোককে সামনে এনে হাজির করান। বাউল তার সব অসূয়া। কারুবাসনাগুলোকে মুছতে থাকেন গুরু নির্দেশিত সাধনাতে এসে। গুরু তার কাছে সমর্পণ। নিবেদন। গুরু তার বস্তুজগৎকে ভাবজগতের দিকে টেনে নিয়ে যান। গুরুতত্ত্বের গানে বাউল বারবারই সেকথা প্রকাশ করে ফেলেন। লালন সহ প্রাচীন পদকর্তাদের গানে গুরু তাই আত্মবিশ্লেষণে সবসময়ই সজীব হয়ে ওঠেন। গুরু, সাধক বাউলের ব্যার্থতা, জ্বালা, যন্ত্রণা, খরস্রোতকে অগ্নিময় কেন্দ্রাভিগ করে দেন। গুরুর প্রতি যার জন্য সাধক বাউলের আকুতি প্রাচীন, আধুনিক, নবীন সব পদকর্তাদের লেখায় ঝলসে ওঠে। লালনের বহুশ্রুত সেই গুরুবন্দনার গান বাউল আখড়াতে গেলে হামেশাই শোনা যায়। অনেক বাউলকেই দেখেছি আসর বন্দনা সারেন এ গান দিয়েই। গরিফার এ আসরে নবকুমার দা বাউলকে এ গান দিয়েই আসর বন্দনা করতে আমি শুনেছিলাম। মঞ্চে উঠে গুরুপ্রণাম করে বাউল সে আসরে ধরলেন বহুশ্রুত এই লালনের গান। নবকুমারের কণ্ঠ উন্মুক্ত অশ্রুভরা নিমগ্ন বেদনা নিয়ে যেন ছড়িয়ে পড়ল গরিফার মস্ত ফুটবল খেলারই মাঠে।

নবকুমার গাইতে লাগলেন গান। আসরে তার কাছাকাছি বসে আমি লক্ষ করলাম চোখে তার জল চিকচিক করছে। নবকুমার কাঁদছেন আর গাইছেন:

গুরু, দোহাই তোমার, মনকে আমার লও গো সুপথে।
তোমার দয়া বিনে তোমায় সাধবো কি মতে।।
তুমি যারে হও গো সদয়, সে তোমারে সাধনে পায়;
বিবাদী তার স্ববশে রয় তোমার কৃপাতে।।
যন্ত্রেতে যন্ত্রী যেমন, যেমন বাজায় বাজে তেমন।
তেমনি যন্ত্র আমার মন, বোল তোমার হাতে।।
জগাই মাধাই দস্যু ছিল, তারে গুরুর কৃপা হল।
অধীর লালন দোহাই দিল সেই আশাতে।।

গুরু শিষ্য-বাউলকে কীভাবে সহজ মানুষে পরিণত করান একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম নবকুমারকে।

বাউল বললেন, রিপু মারা শেখান গুরু রিপু মরলে দেহের ইঁদুর-বিড়াল দেহেই খেলে বেড়ায়। বিড়াল ইঁদুরখানাকে খেয়ে আত্মতৃপ্ত হয় না।

–বিড়াল কী? জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাউলকে।

বললেন, বিড়াল হল কাম। বিড়ালের যেমন আঁশ ছাড়া, মাছ ছাড়া রোচে না। তেমনই দেহের কামও ছকছক নোলা নিয়ে বসে থাকে কখন ইঁদুরখানাকে খাবে।

জিজ্ঞাসা করলাম, ইঁদুর কী?

–ইঁদুর হল সহজ ইন্দ্রিয়। জ্ঞানেন্দ্রিয় একখানা। আমাদের পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়গুলো সরলে পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় সাড়া দেয়। কর্মেন্দ্রিয়গুলোই তো রিপু মারে। আর তখনই জ্ঞানের বিকাশ হয়। আর তা হলেই বিড়াল মাছ পর্যন্ত ছোঁয় না। সর্বদা কাশী যেতে চায়। শোনেননি নাকি সেই গান?

বাউল এবার সুর ধরলেন একতারায়। সঙ্গত দিলেন ঘরোয়া সান্ধ্য আসরে। গাইলেন না। গেয়ে উঠলেন তাঁরই শিষ্যসামন্তের একজন গুরুরই নির্দেশিকায়।

বিড়াল বলে মাছ খাব না, আঁশ ছোব না কাশী যাবো।
আবার বার মাসেই একাদশী, আমি বিশ্বনাথের প্রসাদ পাবো।
উঠি এক নেংটি ইঁদুর, ও তার কপালে টিপ মাথায় সিঁদুর
(বলে) আমি ঢাকাই শাড়ি পরে আবার মেজদার বৌদি হবো।
উঠি এক কোলা ব্যাঙ আবার বের করে সে লম্বা ঠ্যাং;
(বলে) আমি এক লাফেরে লঙ্কা গিয়ে, রাবণ মেরে রাজা হবো।
উঠি এক লাল পিপড়ে, সে বলে, আমি চলি কলে কৌশলে
আমি রেললাইনে মাথা দিয়ে বোম্বাই মেল আটকাবো।
আবার রাস্তা ধারের কেলে কুকুর, সে বলে, হব আমি কেষ্টঠাকুর
আমি কদম তলায় লেজ নাড়িয়ে শ্যামের বাঁশি কেড়ে নেবো।

নবকুমার বললেন, গুরুর সান্নিধ্যে এলেই দেহের বিড়াল মাছ ছোঁয় না। মাছ তো কাম। কাশী কাম মারার তীর্থক্ষেত্র। মহাদেব স্বরূপ তার অবস্থান। এই মানবদেহ। তার শুদ্ধতার জন্যই তো একাদশী করা। ইন্দ্রিয়গুলোকে মনে নিয়ে বোঝাপড়া সারা। সারতে গিয়ে নেংটি ইঁদুরখানা বেরোয়। ব্যাঙ বেরোয়। পিপড়ে আসে। এগুলো সব গিয়ে মদমত্ততাকে সামলায়। বাউল কী তার আর একা পারে? তখনই গুরু লাগে।

গুরুতত্ত্বের আরেক গান শুনেছিলাম নিত্যানন্দ বালার নতুনপল্লীর আখড়াতে বসে। নিত্যানন্দ সেদিন ছিলেন দারুণ মুডে। ভক্তশিষ্য পরিবেষ্টিত একেবারে। সবে সতীমার মেলা ভেঙেছে গতকাল। আজও সব বাউল যেয়ে উঠতে পারেননি আখড়া ছেড়ে। নিত্যানন্দর বাড়ির আখড়াতেও বাউল গমগম। সন্ধ্যার আসরে ক্রিয়াকরণের পর গেয়ে উঠলেন পাঞ্জু শাহের পদখানা।

গুরু-রূপে নয়ন দে রে মন
গুরু বিনে কেউ নাই তোর আপন।।
গুরু-রূপে অধর মানুষ দিবে তোরে দরশন।।
পিতার ভাণ্ডে কি রূপ ছিলি,
মায়ের গর্ভে কি রূপ হলি, মন,
পূর্ব-পরে নিরন্তরে গুরুরূপে নিরঞ্জন
রজবীজে মিলন কে করিল,
কোথায় আছে তার আসন,
ব্রহ্মাণ্ডের গড়ন গড়ে সে কোন্ জন।।
কোথায় ছিলি, কার বা সাথে ভাবে এলি, ওরে মন।
অধীর পাঞ্জ বলে, গুরু ধরে কর তার অন্বেষণ।।

নিত্যানন্দ বললেন, তা খ্যাপা আপনি মনের মানুষের কথা বলছিলেন না। সেদিন? আজ বলি দেহ না জাগলে চিনবেন কী করে তারে দেহ তো সাতে আবদ্ধ।

জিজ্ঞাসা করলাম। কী এই সাত?

বাউল বললেন, সাত সপ্তধাতু। যা দিয়ে স্থূল দেহ তৈরি। শুক্র-রজ, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, ত্বক–এই সাতে শরীর গঠিত। তাতে আবার পাঁচের সমন্বয়–ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। এই এগারোর আবাসভূমি শরীর। গুরু চেনান তারে।

–কীভাবে চেনান গুরু?

–সে বড়ো কঠিন কাজ। চক্ৰ চেনেন আপনে?

মাথা নেড়ে বললাম, না। সেভাবে তেমন জানি না। তবে নটা চক্রের কথা শুনেছি। বললেন, এত অল্পজ্ঞানে ‘মনের মানুষ বুঝবেন কী করে আপনি?

বললাম, সহজভাবে বলুন না। যদি ধরতে পারি।

–কী করে ধরবেন খ্যাপা? আগে গুরু ধরেন। তবে তো আপনে মানুষ ধরবেন। ইচ্ছা করে কিছু বললাম না। কেবল হাসলাম। আসলে আমার জানাটা কেবল নয়–নিত্যানন্দর জানাটা দিয়ে আমি জানতে চাইছি আজকের বাউল সমাজকে। তার পেশা গান। গানের জন্য দরবার করেন তিনি। এখানে-ওখানে ছুটে বেড়ান রীতিমতো গৃহী বাউল তিনি। ঘোষপাড়ার প্রায় সমস্ত বাউলই এখন তাই। তার মধ্যে দু’একজন কেবল সাধনভজন করেছেন কিছুটা। নবকুমার তাঁদের একজন। সাধন-সঙ্গিনী কৃষ্ণাকে নিয়ে বাউলপাঠ শুরু করেছিলেন। এখন নতুন সঙ্গিনী নিয়ে আছেন। তবে গায়ক বাউলরা তত্ত্বটাকে বেশ রপ্ত করেছেন। গান বেচে, তত্ত্ব বেচে, খানিকটা গুরুগিরি করে তারা পেট চালান। ভক্ত শিষ্য জোটান। তবে নিত্যানন্দ কথা বলেন সুন্দর। তার গানেরও সুনাম আছে বেশ। ডাক আসে দূর-দূরান্ত থেকে। ভক্ত-শিষ্যর সংখ্যাও তার কম নয়। রীতিমতো নবকুমারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে।

বাউল বললেন, গুরু তো রস-সাধনা শেখান। নরদেহকে গুরুই আমাদের নারায়ণ করে দেন। নররূপী নারায়ণ দেখেন, আমাদের দেহঘরে গুহ্যদেশে যে মূলাধারটি তা পৃথিবীর হদিশ দেয়। লিঙ্গের সন্ধিমূলে স্বাধিষ্ঠান জলের কথা বলে। নাভিমূলের মণিপুর শিখা ছড়ায়। হৃদয়ের অনাহত বায়ু ধরে। এই বায়ু পার করে। সহজ মানুষ করে।

কীভাবে করে? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

বললেন, গুরুবস্তু বায়ুক্রিয়াতেই ধরে রাখেন বাউল। নিজ শরীরে সঞ্চিত সব। গুরুতত্ত্ব শরীরের চক্রগুলোর ভেতর দিয়ে মাথায় ওঠে। উর্ধ্বে ওঠেন বাউল। পরমাত্মার দেখা পান। এ কী আর বলে বোঝানো যায় খ্যাপা নাম নেন, নাম নেন খ্যাপা। সব জানতে পারবেন।

বুঝলাম, নিত্যানন্দ আমাকে দীক্ষিত হতে বলছেন তাঁর কাছে। দলে টানতে চাইছেন আর কী। প্রান্তিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনকে এরা তো সবসময়ই টানতে চান। শিক্ষিত, অভিজাত এঁদের কাছে ঘুরঘুর করলে যে সমাজে তাঁদের দর বাড়ে। শিষ্য তৈরি হয় একটু বেশি।

বাউল বিন্দুসাধনের কথা বলেন। বিন্দুকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জড়সত্তা হিসাবেও আমরা। কিন্তু ভাবতে পারি। ‘শিবসংহিতা’তে আছে: ‘বিন্দুঃ শিবো রজঃ শক্তিরুভয়োর্মেলনাৎ স্বয়ম্। /স্বপ্ৰভূততানি জায়ন্তে স্বশক্ত্যা জড়রূপয়া।। অর্থাৎ বিন্দু হচ্ছে শিবস্বরূপ। রজ শক্তিস্বরূপ, দুইয়ের মিলনে জড়রূপী নিজের শক্তি বহুরূপে প্রকাশমান হয়। দেহকে ব্রহ্মাণ্ড বলেন বাউল। কারণ হচ্ছে দেহতে পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও আকাশ–এই পাঁচটি উপাদান দেহের বাইরে ও ভেতরে একাত্ম হয়ে আছে। ক্ষিতিশ্চ বারি তেজশ্চ বায়ুরাকাশমেব চ। / স্থৈর্যং গতা ইমে পঞ্চ বাহ্যাভ্যন্তরে এব চ।।’ এখন প্রশ্ন হল, পঞ্চ উপাদান কীভাবে দেহস্থ অন্দরে-বাহিরে রয়েছে? পাঁচটি উপাদানের পাঁচটি করে গুণও বর্তমান। যেমন–পৃথিবী অস্থি, চর্ম, নাড়ি, লোম মাংস (‘অস্থি চর্ম তথা নাড়ী লোম মাংসস্তথৈবচ। / এতে পঞ্চগুণাঃ প্রোক্তা পৃথিব্যাঞ্চ ব্যবস্থিতাঃ।।’)। জল= মল, মূত্র, শুক্র, শ্লেষ্ম, শোণিত (‘মলমূত্রং তথা শুক্রং শ্লেষ্ম শোনিতমেব চ। / এতে পঞ্চগুণাঃ প্রোক্তা আপস্তত্র ব্যবস্থিতাঃ।।‘) তেজ = ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, মোহ ও ক্ষান্তি (‘ক্ষুধা তৃষ্ণা তথা নিদ্রা প্রমোহঃ ক্ষান্তিরেব চ। / এতে পঞ্চগুণাঃ প্রোক্তাস্তেজস্তত্র ব্যবস্থিত।।’)। বায়ু = বিরোধ, আক্ষেপণ, আকুঞ্চন, ধারণ ও তৃপ্তি (‘বিরোধক্ষেপনাকুঞ্চধারণং তর্পনং তথা। / এতে পঞ্চগুণাঃ প্রোক্তা মারুতে চ ব্যবস্থিতাঃ।’) আকাশ = রাগ, দ্বেষ, মোহ, ভয়, লজ্জা (‘রাগো দ্বেষশ্চ মোহশ্চ ভয়ং লজ্জা তথৈব চ/ এতে পঞ্চগুণাঃ প্রোক্তা আকাশে চ ব্যবস্থিতা। ‘)। দেহে দশ বায়ুরও দশটি অবস্থান সূচক স্থানও বর্তমান। প্রাণ বায়ু হৃদয়ে থাকে। গুহ্যদেশে অপান বায়ু। নাভিদেশে সমান বায়ু, কণ্ঠে উদান বায়ু, সমস্ত শরীর জুড়ে ব্যান বায়ু। এছাড়া বাকি আরো পাঁচ বায়ু নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয় থাকে সহস্র নাড়ির মধ্যে। দেহসাধক বলেন শরীরে সপ্তপাতাল আছে। যোগক্রিয়ায় সেসব স্থানে অনায়াসে বিচরণ করা যায় দেহসাধক বলেন পায়ের অধোভাগ অতল, ঊর্ধ্বভাগ বিতল (‘পাদাধস্তুবতলং বিদ্যাং তদৃধ্বং বিতলং তথা )। জানু দুটোতে সুতল এবং সন্ধিস্থলে তল (জানুনোঃ সুতলঞ্জৈব তলং চ সন্ধিরষ্ক্রকে।’) গুদমধ্যে তলাতল, লিঙ্গমূলে রসাতল(তলাতলং গুদ মধ্যে লিঙ্গমূলে রসাতলম। ) পায়ের অগ্রভাগে ও কোমরের কটির সংযোগস্থলে পাতাল (‘পাতালং কটিসন্ধৌ চ পাদাদৌ লক্ষয়ে বুধঃ।।’)। সাধক যোগে এই সাত পাতালকে দর্শন করে থাকেন। যাকে বিজ্ঞান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একেকটি স্তর বা উপাদান হিসাবে দেখছে। দেহসাধক এগুলোকে সব দেহ উপাদান হিসাবেও চিহ্নিত করেছেন। শরীরে সাতটি লোকের কথাও বলে থাকেন সাধক। নাভিদেশে ভূলোক আর হৃদয়ে ভূর্বলোকের অবস্থান। (‘ভূর্লোকো। নাভিদেশেতু ভুবলোকস্তথা হৃদি। ‘)। স্বর্লোক থাকে কণ্ঠদেশে, চোখে মহর্লোক। (‘স্বর্লোকঃ কণ্ঠদেশে তু মহর্লোকশ্চ চক্ষুষি।।’) চোখের উপরে দ্রুদ্বয়ে জনলোক বাউল সাধক এই সন্ধিস্থলকে আরশিনগর বলে থাকেন। আর ললাটে থাকে তপোলোক (‘জনলোকস্তদৃধ্বঞ্জ তপোলোকা ললাটকে।‘)। মস্তকে, সহস্রারে সত্যলোক। অনেকে একে মহাযোনিও বলে থাকেন (‘সত্যলোকো মহাযোনী ভূবনানি চতুর্দশ।‘) সহস্রারেই ব্রহ্মরন্ধ্রের অধিষ্ঠান। বিন্দুধারণ এখানেই সুসম্পন্ন হয়ে থাকে সাধকের। সপ্তলোক ও সপ্তপাতালের সমষ্টিকে দেহসাধক বলেন চতুর্দল ভুবন। বাউল সাধক আবার চোদ্দকে পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়, পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও চতুর্ভুজের যোগফল হিসাবে দেখেন। সপ্তপর্বতের কথাও বলে থাকেন। দেহসাধক। দেহের ত্রিকোনে থাকে মেরুপৰ্বত। উর্ধকোণে মন্দর পর্বত (‘ত্রিকোণে চ হিতো মেরুরূৰ্ব্বকোণে চ মন্দরঃ। ) কৈলাস বিষ্ণুস্তদূর্পে চ সপ্তৈতে কুলপর্বতাঃ।।উধ্বভাগে বিন্ধ্য ও বিষ্ণুপর্বত। শাক্তানন্দ তরঙ্গিনী’তে এই ছটি পর্বত আছে। মৎস্যপুরাণ ও বিষ্ণুপুরাণে সাতটি পর্বতের উল্লেখ পাই। তবে নামে কিছুটা পরিবর্তন আছে। মহেন্দ্র, মলয়, সহ্য, শক্তিমান, ঋক ও পরিবার–এই হল সপ্তপর্বত। শরীরস্থ সাতটি দ্বীপের কথাও বলেন সাধক। অস্থিতে জম্বুদ্বীপ, মাংসে থাকে কুশদ্বীপ (‘অস্থিস্থানে মহেশানি! জম্বুদ্বীপো ব্যবস্থিত। মাংসেষু চ কুশদ্বীপঃ ক্রৌঞ্চদ্বীপঃ শিরাসু চ।’) শিরাতে ক্রৌঞ্চদ্বীপের অবস্থান। রক্তে থাকে শাকদ্বীপ (‘শাকদ্বীপঃ স্থিতো রক্তে প্রাণিনাং সর্বসিন্ধযু।‘)। তার উপরে সন্ধিদেশে থাকে শাল্মলি দ্বীপ (‘তদূর্ধ্বং শাল্মলিদ্বীপঃ ক্ষশ্চ লোমসঞ্চয়ে। ‘)। লোমপূর্ণ স্থানে থাকে প্লক্ষদ্বীপ। আর নাভিতে থাকে পুষ্কর দ্বীপ(‘নাভৌ চ পুষ্করদ্বীপঃ সাগ্ৰাস্তদনস্তরম্।।’)। সাতটি সাগরও থাকে দেহে। মূত্রে লবণসাগর আর শুক্রে ক্ষীরোদসাগর (লবণোদস্তথা মূত্রে শুক্রে ক্ষীরোদসাগরঃ। ‘) মজ্জায় থাকে দধিসাগর, তার উপরে চর্মে ঘৃত সাগর ( ‘মজ্জা দধিসমুদ্রশ্চ তদূর্ধ্বং ঘৃতসাগরঃ।।)। বসা বা চর্বি / মেদে থাকে জলসাগর আর কোমরে / কটিদেশে বা রক্তে থাকে ইক্ষুসাগর (‘বসাপঃ সাগরঃ প্রোক্ত ইক্ষু স্যাৎ কটিশোণিতম্।।‘)। শোণিতে থাকে সুরাসাগর (শোণিতেষু সুরাসিন্ধঃ কথিতাঃ সপ্তসাগরাঃ।।)। সাধক এই সাত সাগরের কথা বলে থাকেন। বাউল সাধক দেহে সাত রসের কথা বলে থাকেন। আবার সাতদিনের যে রজঃধারার নাম করেন তাও অনেকটা সাগরস্থ সাতনামের ধারেপাশে চলে আসে। দেহসাধক দেহস্থ নবগ্রহের কথাও বলে থাকেন। নাদচক্রে সূর্য, বিন্দুচক্রে চাঁদ অবস্থিত (নাভিচক্রে স্থিতঃ সূর্যো বিন্দুচক্রে চ চন্দ্রমা’। ) চোখে মঙ্গলের স্থান আর হৃদয়ে বুধ (‘লোচনে মঙ্গলঃ প্রোক্তো হৃদি সোমসুতো।‘)। পেটে বৃহস্পতির স্থান, শুক্রে শুক্র (‘উদরে চ গুরুশৈচব শুক্রে শুক্ৰস্তথৈব চ।।’) নাভিতে শনি বিরাজমান, মুখে রাহু (‘নাভিচক্রে স্থিতো মন্দো মুখে রাহু স্থিতঃ সদা। ‘)। পায়ে ও নাভিতে কেতুর স্থান (‘পাদে নাভৌ চ কেতুশ্চ শরীরে গ্রহমন্ডল।’)। বাউল নববিধা ভক্তিরসের কথা বলে থাকেন। বৈষ্ণবীয় ভক্তিরসও বাউলের নটার অন্তর্গত। সূর্য-চন্দ্রকে ইড়া-পিঙ্গলা স্বরূপও আমরা ভাবতে পারি। দেহে সপ্তপাতাল, সপ্তসাগর, সপ্তদ্বীপের কথা কিন্তু বাউল সাধকও বলেন। তন্ত্রসাধকের একার কল্পনা তা কখনওই নয়। চোদ্দ ভুবনের কথাও কিন্তু বাউল বলেন। এরকমই এক গান কেদুলি মেলাতে বিশ্বনাথ দাস বাউলের গলাতে শুনেছিলাম। সুধীরবাবার আখড়াতে বিশ্বনাথ সেবার এ গান গেয়েছিল। ভীমপুর-আসাননগরের লালন মেলাতেও বাংলাদেশের এক বাউলের মুখে রাধাশ্যামের এই পদ শুনেছিলাম। যথেষ্ঠ গুরু আধারিত এ গান। আগন্তক নিবেশ দিয়ে রূপময় বার্তা এ কখনওই নয়। এ গান শিক্ষা দীক্ষার প্রস্তুতি পর্বের জন্য বাউল সাধকের কাছে যেন ধ্রুপদী সঙ্গীত। যথেষ্ট ভাবগম্ভীর আধার দিয়ে গেয়েছিলেন সেদি এ গান বিশ্বনাথ। পদ্মাসনে বসে হাতে একতারা নিয়ে। তত্ত্বের নিবেশকে তিনি যেন ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছিলেন বাউলের দরবারে।

গাইছিলেন বিশ্বনাথ:

আগে দেহের খবর জান গে রে মন,
তত্ত্ব না জেনে কি হয় সাধ।
দেহে সপ্ত স্বর্গ, সপ্ত পাতাল,–
চৌদ্দ ভুবন কার ভ্রমণ।।
এই দেহে হয় চব্বিশ তত্ত্ব,
গুরুবর্ত করে দেখলি না রে
হয়ে অহঙ্কারে মত্ত।
আছে চব্বিশের উপর তিন তত্ত্ব,
যাতে মত্ত হয় রসিকগণ।।
আরো আঠারো চিজে দেহ গঠন হয়েছে,
পিতার চার, আর মাতার চার
দেখ দেহে রয়েছে।
আরো গুরু যে তায় দশ দিয়েছে,
সে কথা কি নাই স্মরণ।।
বলি ওরে মন-কানা, তোর ভ্রম তো গেল না,
দেহের মধ্যে কে আপন-পর, তাও তো চিনলি না।
এবার যত্ন করে গুরুদ্বারে চক্ষে দিলি না রে জ্ঞানাজ্ঞান।।
এই দেহেতে আছে বাইশ মোকাম–
তার কার বা কোন স্থান,
দেখ না খুঁজে, কোথায় বিরাজে
তোর পরম গুরু আত্মারাম।
ক্ষ্যাপা রাধাশ্যাম তুই না জানিস তত্ত্ব-প্রমাণ–
গোঁসাই গুরু চাঁদের এই বচন।।

রাধাশ্যাম বলছেন দেহতত্ত্ব না জানলে বাউল সাধন কখনও কোনওভাবেই সার্থক আকার নিতে পারে না। কেননা মানবদেহতেই মূলতত্ত্বের বাস। দেহকে ঘিরে থাকে উপলব্ধ-সত্তা। বাউল বলেন আত্মা। আত্মা তাঁদের কাছে ভগবান স্বরূপ। বাউল তো কল্পিত মূর্তির ভগবানে বিশ্বাস রাখেন না সাধারণত বাউলের ভগবান আত্মা। এই প্রাণস্পন্দ যুগল দেহসাধনা থেকে উঠে আসা স্পন্দ। ‘ভগবান’ কথাটিই কিন্তু যথেষ্ট যুগল-দ্যোতক। ‘ভগ’ কথার অর্থরূপ গর্ত। ‘বাণ’ হল লিঙ্গ। বাউলও গুহ্যপ্রতীকে বাণকে লিঙ্গই বলেন। নতুন কোনো আলাদা অর্থের প্রতীকরূপ বাণকে তিনি দেখেন না। যা সচরাচর তারা করে থাকেন। তবে যেটা মনে হয় তাঁদের সব প্রতীককল্পেরই একটা সদর্থক ভাবনা থাকে। ভেবেচিন্তেই বাউল সমাজ প্রতীককল্পগুলোকে তৈরি করেছেন। এখানেও সদর্থক অর্থেই তাঁদের ভেতর ভাবনা কাজ করেছে। প্রতীককে তারা অনুভূতিদেশের আলো দিয়েছেন। দিয়েছেন রক্তশব্দ, সমুদ্রশব্দ সব। যার জন্য প্রতীক প্রাণবন্ত তরঙ্গ তুলছে বাউলেরই গানে। চন্দ্র তাঁদের এমনি এমনি কি বাঁ নাক আর সূর্য ডান নাক হয়ে উঠেছে? মোটেই না। ইড়া পিঙ্গলার তেজদীপ্তি নিয়েই তো তারা ডান-বামের শিরোপা ধরেছে। পূর্ণচন্দ্রকে বাউল প্রেম বলেন। প্রেমের ভেতরে তো চিরকালই নরম মাধুর্য এক জ্বলজ্বল করে, বাউল তাই পূর্ণচন্দ্রকে প্রেম প্রতীকে রেখেছেন। ক্ষীরকেও প্রেম নামেই অভিহিত করে থাকেন তারা। ক্ষীরের জমাট নরম মিষ্টতার সঙ্গে প্রেমের ভাষার উৎসার তো সঠিক অর্থেই যায়। নীর তাঁদের কাম বা রজ। আভিধানিক নীর তো জলসূচক। রজ উন্মোচিত আবরণ তাই সে নিয়েছে বাউল-প্রতীকে। তিন, ছয়, পাঁচ প্রতীকেও তো শরীরের কেন্দ্রগত সব মাংসময়তা আছে। দেহে সপ্তস্বর্গ, সপ্ত পাতালের কথা বলেছেন রাধাশ্যাম গানে। শরীরস্থ প্রলয়ঙ্কর শক্তি সব। সাধকগণ তাঁদের প্রতীকময়তার দেহেই জীবন্ত করে রেখেছে। দেহ ব্ৰহ্মাণ্ড। নিয়েই সহজিয়া তাই অন্তর্লোকের অনুসন্ধিৎসাকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন গুরুর সংযুক্ত আধারে। দেহকে বাউল ‘পরম পুরুষ’ হিসাবে দেখেন। দেহ আত্মোপলব্ধির একেকটি স্তর। গুরু নির্দেশিত সেই স্তর ভেদ করে সাধক আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে উপণীত হন। আধ্যাত্মিক এই বিকাশ বাউল সাধকের আত্মিক বিকাশ। যুগল সাধনে শরীরস্থ অস্থি চর্মময় আধারে তারা মহারসের আনন্দধারা উপলব্ধ করে থাকেন। বাউল ক্রিয়ামূলক আচরণে চক্রস্থ নাড়িকে সতেজ করে, ষড়রিপুকে দমন করে পঞ্চভূতকে, সপ্তপাতাল আর। সপ্তস্বর্গকে বিকশিত করে সঙ্গিনীর শরীরে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র ছুঁয়ে, অষ্টম ইন্দুকে প্রতিলব্ধ করে ‘অটল’ হয়ে ওঠেন।

অটল কী? একবার প্রবৃদ্ধ বাউল সাধক শশাঙ্কশেখরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

বললেন, বিন্দুধারী ব্ৰহ্ম গো। মনের মানুষ হওয়া তো ব্রহ্মকে ধরে থাকা। ব্রহ্ম আত্মা নাড়ির ধুকপুকানি।

তারাপীঠে আশ্বিণের শুক্লা চতুর্দশী তিথিতেই একবার দেখা হয়েছিল যোগমায়া ভৈরবীর সঙ্গে। সাধুসন্তের সমাগমের উজ্জ্বল এই লগ্নযোগে যজ্ঞ করতে তিনি পৌঁছেছেন। থাকেন আগ্রায়। তার ভৈরব বিশ্বেশ্বর নাকি স্বয়ং শিব। ভক্ত-শিষ্যর এমনই সব মতামত। আর মা আদ্যাশক্তি মহামায়া। তা মহামায়া আমাকে সেই বিকেলে বললেন এমন এক আশ্চর্য কথা, আমি তো শুনে হতবাক হয়ে গেলাম।

মা বললেন, শব্দতে আস্তরজ্ঞান থাকে। শব্দ তাই ব্রহ্ম। একা শব্দ হল প্রকৃতি। শব্দবন্ধ হল তার পুরুষ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রূপ। কালী কি?

জিজ্ঞাসা করলাম, কী মা?

–আস্তর ফাটা, দ্যাখ, কালী হল কামনাকেই বশীভূত করে নেওয়া।

–কীভাবে তা হয়?

–কালী তো রতিযোগের নারী ক্রিয়াশীল। তিন রতির এক রতি হল গিয়ে কালী। বিপরীত বিহার করছেন তিনি। শিব নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। যেন মরে রয়েছে। যুগল সাধনায় নিষ্ক্রিয় শিবকে, পুরুষকে তো শক্তি জাগায়। তাই পুরুষ ব্রহ্মলাভের জন্য শক্তিরূপা কালীর কামনাকে হরণ করে নেন। নিণা কালী অর্থাৎ কামনা সগুণা হয়। আর তা হলেই সাধক অটল অমর হয়ে যায়।

মায়ের এই কথা শুনে আমার বাউলের অটল হবার কথা মনে পড়ে গেল। মা কে বললাম, মা এতে কী সাধক সহজ মানুষ হন?

বললেন, বাউল বলেন ও কথা। ঠিকই বলেন, সাধককে তো সহজ হতেই হবে। সহজ কী?

জিজ্ঞাসা করলেন মা।

বললাম কী মা? আপনি বলুন। আপনার কথা শুনতে চাই।

–সহজ হল সহস্রবার কাছে যাওয়া। কার কাছে যাবেন সাধক? যাবেন পরমা প্রকৃতির কাছে। তার কাছে গিয়ে নাড়িকে সহস্রবার জাগিয়ে নেবেন। সহজের সহস্র তখন চলে যাবে সহস্রার পদ্মে। এখানের ক্রিয়ায় সাধক অটল হবেন। রসিক হবেন। কারণ যে তিনি রস ধরেছেন।

বাউলও এই রস ধরেই কিন্তু রসিক হন। মনের মানুষ, সহজ মানুষ তার রসস্থ আলোকসম্পাত। সর্বোচ্চ দশা। নিভৃত ঘরে দ্বিদলের ক্রিয়া দ্বিদল প্রস্ফুটিত হয় আজ্ঞাচক্রে। এখানে তিন নাড়ির মিলনস্থল। বাউলের ত্রিবেণী। হৃদ্বয়ে এই দ্বিদল পদ্ম থাকে। বাউল কথিত তা আরশিনগর। সাধক বলেন শ্বেতবর্ণ পদ্ম এটি। এই সাদাকে পরমাত্মা স্বরূপ কল্পনা করতে পারি। কামনার নাশে ‘কালী’ মুছে ‘সাদা’ আসছে। দুই দ্বলে দুই বর্ণের কথা বলেন সাধক। ‘হ’ ও ‘ক্ষ’। ‘হ’ কে হৃদয়দ্যোতক আর ‘ক্ষ’কে ক্ষণ(শুভক্ষণ, শুভাগমন, ভাগ্যবান) হিসাবে কল্পনা করে নিলেই কিন্তু মনের মানুষের রেশটি যেন আরও স্পষ্ট হয়। হৃদয় দিয়েই উধ্বারেতার অনুভূতিকে ধরা ছোঁয়া যায়। ভাষা দিয়ে নয়। আর তা ভাগ্যবানের পক্ষেই সম্ভব। সবাই তো আর সেই স্তরে, মুহুর্তে, ক্ষণে যেতে পারেন না।

যোগমায়া মা বলেছিলেন, বীর্য হল কার্ত্তিক।

আমি চমকে গিয়েছিলাম শুনে। জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে মা বীর্য কার্তিক হলেন?

বললেন, তোর রূপ পরিষ্কার। কিন্তু তুই কালো হলেও কার্তিক হবি। বীর্য সবার কার্তিকের রূপের মতনই রূপময়। আর নারীর রজ হল লক্ষ্মী। রজঃস্রোতেই সাধক ঐশ্বর্য লাভ করেন। তার ঐশ্বর্য বীর্যের উদ্ভাস। বীর্যের সঙ্গে সাধকের সাক্ষাৎকার ঘটে ব্রহ্মরন্ধ্রে।

*****

রাধাশ্যাম গানে গুরুবর্তের কথাই বলেছেন: ‘এই দেহে হয় চব্বিশ তত্ত্ব/ গুরুবর্ত করে দেখলি না রে/ হয়ে অহঙ্কারে মত্ত।’

চব্বিশ তত্ত্ব হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোমের পাঁচ। পঞ্চভূত। মিষ্টি, টক, লবনাক্ত, তেতো, ঝালের এই পঞ্চস্বাদ। চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক, পানি, বাক, পাদ, পায়ু উপস্থের দশ। দর্শেন্দ্রিয়। কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্যের ছয়। ষড় রিপু। অনিমা, মহিমা, লঘিমা, গরিমা, পতি, প্রকাম্য, ইশিত্ব, বশিত্বের আট। অষ্টসিদ্ধি। সর্বমোট চব্বিশ। দেহের এই চব্বিশ তত্ত্বের হদিশ গুরু দেন। গুরু সাধকের দেহ আধারিত বিজ্ঞান। শরীরের আকাশ,বাতাস, তেজ, জল, পৃথিবীর সন্ধান সাধককে দেন গুরু। ভাব, যোগ ও ক্রিয়াসংযোগে। রাধাশ্যাম তার কথাই বলেছেন পদটিতে। চব্বিশের তিন তত্ত্ব। রতিকল্প–ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না। যাতে মত্ত হয় রসিকগণ। অর্থাৎ কিনা বাউল সাধক নিজে নাড়ির করণক্রিয়া বুঝে নেন, জেনে নেন গুরুর কাছে। তারপর তিনি রপ্ত করে ফেলেন। আর তখনই ‘আঠারো চিজ’কে জানতে হয়–’আরো আঠারো চিজে দেহ গঠন হয়েছে/ পিতার চার, আর মাতার চার/ দেখ দেহে রয়েছে। আর গুরু যে তায় দশ দিয়েছে, সে কথা কি নাই স্মরণ।।’

পিতার চার-হাড়, শিরা, শুক্র, মগজ। মাতার চার-মাংস, চামড়া, রক্ত, চুল। গুরুর দেওয়া দশ–দশেন্দ্রিয়। গুরুই তো ইন্দ্রিয়গত উপলব্ধি প্রদান করে থাকেন সাধক বাউলকে। তাই গুরুবর্তের কথাতে তা মনে রাখতে বলা হচ্ছে। গুরুই তো সাধক বাউলকে জ্ঞানচক্ষু দেন। তাই গুরুর স্থান পিতামাতার পরই। বৈষ্ণবরা বলেন–’গুরু ত্যজি গোবিন্দ ভজে, / সেই পাপী নরকে মজে।’ শাস্ত্রে বলা হয়েছে–’ন চ বিদ্যা গুরোস্তুল্যং ন তীর্থং ন চ দেবতা / গুরোস্তুল্যং ন বৈ কোহপি যদৃষ্টং পরমংপদম।।/ ন মিত্রং ন চ পুত্রাশ্চ ন পিতা ন চ বান্ধবাঃ। ন স্বামী চ গুরোস্তুল্যং যদৃষ্টং পরমং পদম। একমপ্যক্ষরং যস্ত গুরুঃ শিষ্যে নিবেদয়েৎ। পৃথিব্যাং নাস্তি তদ্রব্যং যদ্দত্ত্বা চাণী ভবেৎ।’ কোনও বিদ্যা, কোনও তীর্থস্থান, কোনও দেবতা, কিছুই গুরুর তুল্য নয়। গুরুর মতো বন্ধু কেউ নেই। পিতা, পুত্র, স্বামী, বন্ধু কেউই গুরুতুল্য হতে পারেন না। গুরু শিষ্যকে যা প্রদান করেন (মন্ত্র, যোগ, ক্রিয়া ইত্যাদি) তার তুল্য বস্তু পৃথিবীতে নেই। বাউল সাধক তাই গুরুতত্ত্বেরই সাধনা করেন। তাঁদের মত, গুরুতত্ত্বের যে স্বরূপ তার তিন রূপ। প্রথম রূপ ভোক্তা। যিনি স্কুল শরীর ভোগ করেন। দ্বিতীয় রূপ পুরুষ আর তৃতীয় প্রকৃতি। পুরুষ আর প্রকৃতির যুগল সাধনাতেই অনির্বচনীয় স্তরে চলে যান সাধক। যা তাঁদের সহজ মানুষের স্তর। সমস্ত মানুষ। অভিধা শেষে গিয়ে সাধকের অতীন্দ্রিয় গুরুতত্ত্বে মেশে। বাউল তখনই গুরুরূপের স্বরূপ দেহতত্ত্বের, মানুষতত্ত্বের, সাধনতত্ত্বের গান রচনা করেন আর প্রদর্শিত পথে হাঁটেন। কুলের পাটের মেলায় হরি বৈদ্য বাউল পরম গুরুতত্ত্বের মানুষকেই তাই সামনে আনছিলেন একা বসে পূর্ণচন্দ্রের আভায়– ‘কীসে দেব তার তুলনা কায়া ভিন্ন প্রমাণ হয় না/পশুপক্ষী জীব আদি যত এ সংসারে/দুইটি ভাণ্ডের পানি দিয়া অষ্ট জিনিস গড়ে–তার ভিতরে নিজে গিয়ে আত্মারূপে বিরাজ করে।’

পদকর্তা বলছেন মানুষ দিয়ে মানুষ বানানোর কথা। দেহ সাধনায় মানুষ বানানো হয় যুগল ঘনসংবদ্ধতার গাঠনিক সৌকর্যকে নিয়েই। দুই ভাণ্ডের পানির কথা বলেছেন রাধাশ্যাম। দুই ভাণ্ড যুগল দেহ। পানি রজ-বীর্য। অষ্ট জিনিস কীভাবে তৈরি হয় দুই ভাণ্ডের পানিতে? তৈরি হয় সাধনের সময়। বাউল সাধনার সময় দিনক্ষণ আর তিথিতে মাপা। তাঁদের ক্রিয়াকরণ তিনদিনের। যখন সঙ্গিনীর শরীরে রজস্রোত বইতে থাকে সাধনার প্রথম দিনে তখন থাকে নিরবিচ্ছিন্ন কাম। এই কাম তাঁদের কাছে লীলাসূচক। তখন বাউল সাধক চারচন্দ্র ভেদে নামেন। মল, মূত্র, শুক্র, রজ সব শরীরে ফিরিয়ে নেন। এতে নাকি দেহে একটা পরিবর্তন আসে। অনেক বাউল সাধকই বলেন চারচন্দ্র ভেদের পরে শরীরে তারা অষ্টদল পদ্ম দেখতে পান ঘুমের ঘোরে, স্বপ্নেসেখানে। বিন্দু প্রতীকের কথাও তারা বলেন। আসলে যেটা মনে হয় একটা ধারণার কথা বলেন তারা। ভাবেন আর স্বপ্নময়তার আবেশে সেই ছবি ফুটে ওঠে। তবে তা একান্তই ঘুমঘোরে কিনা বলা শক্ত। কেননা অষ্টদলের পদ্মচক্র তো আমাদের শরীরে যোগসাধক কখনও কল্পনা করেন না। মূলাধার চতুৰ্দলবিশিষ্ট। স্বাধিষ্ঠান ষড়দল বিশিষ্ট। মণিপুর দশ দলের। অনাহত দ্বাদশ দলের। বিশুদ্ধ ষোড়শ দলের। আজ্ঞা দ্বিদলের। গুরুচক্র শতদলবিশিষ্ট। সহস্রার সহস্রদলবিশিষ্ট পদ্মচক্র। তাহলে অষ্টদলের কথা এল কীভাবে? গানেও কিন্তু অষ্টদল পদ্মের উল্লেখ পাই। মণি গোঁসাইয়ের গানে এর স্পষ্ট উল্লেখই আছে: ‘অষ্ট ক্রোশ গভীরের নিচে রূপের একটা গাছ রয়েছে। / একশত সাত ফুল ত্রিজগৎ তার গন্ধে আকুল/ ফুল ফুটে তার মাসে মাসে মধু খায় ভ্রমর ডালে বসে।।’

বাউল স্বাধিষ্ঠানকে অনেক সময়ই বাদ দেন দেখেছি। তাহলে দাঁড়ালো: অষ্টপদ্ম চক্র। সহস্রার আটে চলে এল। আর সহস্রারেই সাধক বিসর্গাকারের মণ্ডলবিশেষ দেখতে পান ধ্যানযোগে। এই বিসর্গাকারের তেজোময় মণ্ডলটিকে তারা বলেন বিন্দুসম। এখানে। পরম শিবের স্থান বলে তাঁদের বিশ্বাস। শিব শক্তিদ্যোতক। যোগকালে সমস্ত পদ্মচক্রের পাঁপড় ছিড়তে ছিড়তে সাধক ব্রহ্মরন্ধ্রের উপরে সেই বিন্দুরূপকে দেখেন। ‘বিন্দু’ এখানে উর্ধ্বারেতা সমত্ত ধরতে পারি। কেননা মূলাধারের শুক্র যোগক্রিয়াতে সহস্রারের ব্রহ্মরন্ধ্রে এসে জমা হয়। তখনই দিব্যজ্ঞান, নিরাকার শূণ্যতার দেখা পান সাধক। মায়াচ্ছাদিত পরমাত্মা থৈ থৈ করতে থাকে সাধক শরীরে। বিন্দু দেখাকে বাউল উধ্বারেতার ইঙ্গিত স্বরূপই দেখেন বোধহয়। আর তারা যেহেতু অষ্ট চক্রের কথা বলে থাকেন, সেই জন্যই অষ্টদল পদ্ম রূপ। অষ্ট জিনিসের কথা বলেছেন রাধাশ্যাম। অষ্টপাশ বাউলের-লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, শঙ্কা, জিগীষা, জাতি, কুল, মান। এগুলোর কর্মযোগকে তারা থামিয়ে দেন। সাধক অষ্ট সিদ্ধির কথা বলেন। তান্ত্রিক সাধনাতে এর উল্লেখ পাই। অণুর মতো যোগবলে ক্ষুদ্র হয়ে যেতে পারেন সাধক (অণিমা)। বড় হয়ে যান (মহিমা)। ইচ্ছামতো হাল্কা হতে পারেন। আবার (গরিমা)। যা ইচ্ছা লাভ করতে পারেন (প্রাপ্তি)। ইচ্ছামতো কোনো জিনিস পেতে পারেন (প্রকাশ্য)। কোনো কিছুর উপর প্রভূত্ব বিস্তার করতে পারেন (ইশিত্ব)। বশ করতে পারেন যাকে তাকে (বশিত্ব) বাউল সাধকের এই অষ্টসিদ্ধি নেই এটা হলফ করে বলতে পারি। তাঁদের আট আটপাশের বাঁধন কাটা। আর অষ্টদল পদ্ম ধারণাকল্প। বাস্তবিক এরকম পদ্মচক্র শরীরে কিন্তু নেই। যেটা মনে হয় অষ্টপাশ মুক্তি হওয়াই তাঁদের অষ্টবৃত্তির নাশস্বরূপ আটটি দলপদ্ম। নবরঙ্গে ফুল ফোটার কথা বলেছেন পদকর্তা। নবরঙ্গ নয়বিধা ভক্তিরস। এই রসে রাধাভাব আসে। শরীর প্রকৃতি হয়। রাধাশ্যাম তাই বলেছেন: ‘নব রঙ্গে ফুল ফুটিলে ডোমর আসে উড়ে/ ফুলের মধু দেখতে সাদা আপনি খেয়ে উদর ভরে। / সমুঝ দিয়ে দেখ চেয়ে পুরুষ নহে সবই মেয়ে। / থাকবে যদি পুরুষ হয়ে চল ভেদ বিচারে’–এই ভেদ বিচার হল চারচন্দ্র ভেদ। তারপর সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পর্শ। ভাবাশ্রয়। বাণক্রিয়া। তিন দিনের যোগে এই বৈতরণী পার হলে বাউল বলেন শরীরে ‘সহজ মানুষের’ উদয় হয়েছে। সহজ মানুষ হল প্রকৃতি-পুরুষের নিবিড় আনন্দময় অবস্থা। যেখানে প্রেম শৃঙ্গার। তিনদিনের রেচক–পূরক–কুম্ভকের ক্রিয়ায় নাড়ি পরিষ্কার হয়ে যায়। বায়ুর সাম্যতা থাকে শরীরে। সুষুম্নার পথ সহজ সরল হয়ে ওঠে। আর এই সুষুম্না দিয়েই। বাউল সাধক নীচস্থ বীর্যকে উপরে ঠেলে তুলে দিয়ে সঙ্গিনীর শরীরে নিবিড় অচঞ্চল হয়ে পড়েন। এই অবস্থাই বাউলের সহজ মানুষের বিলাসস্বরূপ। বাণ ক্রিয়ার কথা বলেছি আমরা। কুম্ভক শক্তির উপর এই ক্রিয়া নির্ভরশীল। মদন, মাদন, শোষণ, স্তম্ভন ও সম্মোহন–এই পঞ্চবাণ-ক্রিয়া থাকে যুগল মিলনে। মদন হল ক্রিয়াযোগে রতিশক্তির উত্তেজক অবস্থা। মাদন হল সঙ্গিনীর দেহের বিভিন্ন উত্তেজক স্থানগুলোতে চুম্বনস্পর্শ দিয়ে উত্তেজনা জাগিয়ে দেওয়া। বাউল একে ‘হিল্লোল’ও বলেন। শোষণ হল সঙ্গিনীর শরীর। থেকে কামকে তুলে নেওয়া। স্তম্ভন যুগ্মদেহের স্থিরতা। সম্মোহন দেহের হিতাহিত শূন্যতা। মনের মানুষের বা সহজ মানুষের স্থিরকৃত ভূমি হল সম্মোহন। এখানে শরীর এলেই ওই বোধেন্দ্রিয় ক্রিয়া করে। রাধাশ্যাম বলেছেন: ‘থাকবে যদি পুরুষ হয়ে চল ভেদ-বিচারে/ একটি পুরুষ নিজে ছুরতে জগত মাঝে ঘুরে।’

পুরুষ এখানে বাউলবস্তু। কৃষ্ণধন। তার জন্যই লক্ষ নারীর মন জোগানোর কথা। ‘লক্ষ নারী’ সাধন শরীর। তাকে ঠিকমতো চালনা করলেই ‘প্রেমের মরা আপনি মরে।’ অর্থাৎ কিনা শরীর শূন্যতায় অখণ্ডতা দেখা দেয়। পরমাত্মা বিরাজ করে শুধু।

কুলের পাটের মেলায় বাউল হরি বৈদ্য রাজ খ্যাপার যে পদ শুনিয়েছিলেন সেখানেও বলা হয়েছে: ‘মানুষ হয়ে মানুষ হয়ে কর গে যা মানুষের লীলা/ ধরবি যদি সে মানুষে খুলে দেহের তালা।’ ‘বাউলের পরমতত্ত্ব’ সব দেহ ঘিরেই। চক্র ও তার সন্নিহিত পদ্ম; ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না নাড়ি এগুলোকে আশ্রয় করেই তাঁদের তত্ত্ব বিরোচিত। তান্ত্রিক আচার, সহজিয়া বৈষ্ণব মতো সবই দেহকে শ্রীক্ষেত্র করে সামনে এগোনো। তার জন্যই পদকর্তা দেহের তালা খুলতে বলছেন। শরীরের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডকে উপলব্ধ করতে বলছেন। সাধনপদ চর্যাপদের ভাষাতেও দেহস্থ অন্দরকে ঠিকঠাক জানার কথাই লেখা হয়েছে–’ঘরে অচ্ছই বাহিরে পুচ্ছই/ পই দেকখই পড়িবেশী পুচ্ছই। / সরহ ভণই বঢ় জাণউ অপ্পা। / ণউ সো ধেঅণ ধারণা জপ্পা।।‘ ঘরের মধ্যেই পরমতত্ত্ব আছে। তুমি কেবল বৃথাই বাইরে তার জন্য একে-তাকে জিজ্ঞাসা করছ। তোমার প্রিয় ভেতরই আছে, তবু তুমি প্রতিবেশীকে জিজ্ঞেস করছ সে কোথায় আছে। সরহ বলছেন, ওরে মূর্খ, আত্মতত্ত্বকে জান সত্য ধারণা নিয়ে। ধ্যান ধারণার দ্বারা দেহকে না জানলে কিছুই জানা যাবে না। এখানকার ‘তোমার প্রিয়’ সেই বাউল কথিত মনের মানুষই। দেহকে সাধক সহজ বৃন্দাবন মনে করে থাকেন। দেহ মথুরাও। এই দুই জায়গার আবেশ বাউল দু’জনের শরীরে মেখে সাধনাতে এগোন। জীবন্ত এক প্রতিভূ সব সময়ই তৈরি করতে চান বাউল। গৌরাঙ্গের রক্তমাংসের পরতও খুলে যায় তাঁদের দেহতত্ত্বের গানে। বৈষ্ণবীয় আধার এভাবে বাউলে ঢোকে। পদকর্তারা বৈষ্ণবীয় কবি চন্ডীদাসকেও তাঁদের অন্তর্ভূক্ত করে নেন। রামীকে তাঁদের সাধনগুরু সাজিয়ে নারীকে প্রতিনিধি স্থানীয় এক বিশেষ সিংহাসনই দেন। সহজিয়া-বৈষ্ণবরাও ‘মানুষ’, ‘সহজ মানুষ’ বলতে অন্তরস্থ সত্তাকে শ্রীকৃষ্ণ হিসাবে বোঝেন। এক্ষেত্রে চৈতন্যদেবই তাঁদের পথ দেখান। তার প্রতিমূর্তি, রাধাভাবের নিমগ্ন সাধনায় শ্রীকৃষ্ণ হয়ে ওঠে পরমতত্ত্ব। মানুষ, সহজ মানুষ। তাঁদের অনেক পদেই মানুষের এই অভিজ্ঞানকে আমরা দেখে থাকি। যেমন-’মানুষ মানুষ ত্রিবিধ প্রকার মানুষ বাছিয়া লেহ। / সহজ মানুষ অযোনি মানুষ/ সংস্কারা মানুষ-দেহ।।‘ বা, ‘সব পরিজন লয়ে সঙ্কৰ্ষণ / সহজ মানুষ হইলা। / সহজ রূপেতে সহজ মানুস/আস্বাদে মানুষ লীলা। অথবা, ‘সহজ মানুষ কোথাও নাই। / খুঁজিলে তাহারে নিকটে পাই। / যোনিতে জনম তাহার নয়। / তাহার জনম রাগেতে হয়।‘ চৈতন্য পরবর্তী সহজিয়া বৈষ্ণবধর্ম বাউলের প্রাথমিক স্তরের পাঠশালার মধ্যে বেশ কিছুটা ঢুকে আছে। যতই দুদ্দু শাহ লিখুন না কেন: ‘বাউল বৈষ্ণবধর্ম এক নহে তো ভাই/ বাউল ধর্মের সাথে বৈষ্ণবের যোগ নাই। / বিশেষ সম্প্রদায় বৈষ্ণব / পঞ্চতত্ত্বে করে জপতপ/ তুলসী মালা অনুষ্ঠান সদাই। / বাউল মানুষ ভজে/ যেখানে নিত্য বিরাজে/ বস্তুর অমৃতে মজে/ নারী সঙ্গী তাই।‘ বাউলের ধর্ম মতে বৈষ্ণবধারা যেমন আছে তেমনই অদীক্ষিত সাধনাবর্জিত বাউলরাও আছেন। আছেন যুগলমতের উপাসকগণ। চিন্তামণির মত রয়েছে। মারিফত পন্থীরাও আছেন। দরবেশি ধারা প্রবেশ করেছে। চিস্তিরামত, তরিকপন্থী, সহজিয়া, পাবনাস্রোত, কচ্ছাধারী সম্প্রদায়, শরিয়ত তরিকতের মিলিত ভাবাদর্শ, মথুরানন্দের স্রোত এসে মিশেছে বাউল-ফকিরের সম্প্রদায়ে। অখিলপন্থী, কালাচাঁদী, তান্ত্রিক সাধন, সহজিয়া, শ্রীরূপের মতাদর্শীরাও বাউল আধারে একত্রে মিলেমিশে আছেন সব। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায় বাউলের দীক্ষাগুরু বৈষ্ণব, শিক্ষাগুরু বাউল। আবার উল্টোটাও আছে। শিক্ষায় আসন, যোগ, দেহচর্চা, মুদ্রার ব্যবহারিক প্রয়োগের কথা বলে থাকেন বাউল সাধক। তবে তন্ত্রসাধকদের মতো তারা মুদ্রার অতখানি ব্যবহার করেন বলে মনে হয় না। মুদ্রাকে বলা হয় কুণ্ডলিনী শক্তির চাবিকাঠি। কুণ্ডলিনী যোগের জন্য দশ ধরণের মুদ্রা ব্যবহার জানা প্রয়োজন। খেচরী হল প্রধান মুদ্রা। সিদ্ধাসনে বসে যোনিমুদ্রার সাহায্যে যোগীগুরু চোখ, নাক, কান, মুখ সব। আচ্ছন্ন করে দেন, যাতে বাইরের কোনো কু-প্রভাব দেহে এসে না পড়ে। গোরক্ষসংহিতাতে। সিদ্ধাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘যোনিস্থানকমংঘ্ৰিমূলঘটিতং কৃত্বা দৃঢ়ং বিন্যসেৎ / মেট্ৰেপাদথৈকমেব হৃদয়ে ধৃত্বা সমং বিগ্রহ। স্থানুঃ সংযমিতেন্দ্রিয়োহ চলদৃশা পশ্যন্ জবোরর/ চৈতন্যাখ্যকপাটভেদজনকং সিদ্ধাসনং প্রোচ্যতে। যোনিস্থানকে বাঁ পায়ের গোড়ালি দিয়ে চাপ দিয়ে মূলদেশ বা মলদ্বার অঞ্চলের সামান্য কিছু উপরে উঠে পড়ে। এরপরই কাকিনীমুদ্রায় সাধক প্রাণবায়ুকে গ্রহণ করেন। প্রাণের সঙ্গে যোগসাধনে অপান বায়ু আসে। তখনই দেহের ছয় চক্রের দরজা খোলে। সাধক এখানে মন্ত্র জপেন ‘হুং হংসং’। ‘হুং’ তেজরশ্মি বা সূর্যতেজ। এতে কুণ্ডলিনী শক্তিতে উত্তাপ ছড়ায়। ‘সং’ হল ইচ্ছা। মূলাধারচক্রে বায়ু থাকে চন্দ্রসূর্যরূপী। হুং তো জাগিয়ে দিল কুণ্ডলিনীকে। ‘স’ টেনে তোলে। সহস্রারে উঠে যায় বায়ু। তখন সাধকের মনে হয় সর্বত্র প্রসারিত, বিরাজিত তিনি। তখনই। আনন্দময় হয়ে ওঠেন তিনি। তন্ত্রশাস্ত্র একে বলছে শিব। সাংখ্যদর্শন নাম দিয়েছে পুরুষ। বৌদ্ধশাস্ত্র শূন্যতা। উপনিষদ বলছে ব্ৰহ্মণ। অশ্বিনীমুদ্রাতে যতক্ষণ না বায়ু সুষুম্নাতে আসছে ততক্ষণ এখানে অবস্থান করেন সাধক। ইড়া-পিঙ্গলাতে / চন্দ্র-সূর্যতে তখন বায়ুবেগ টেনে সুষুম্নাতে এলে তখন তলপেটের মাংসপেশি একবার বাঁয়ে একবার ডানে সরে যায়। এতে কুণ্ডলিনী জাগে। এর সঙ্গেই চলে যোনিমুদ্রাতে সিদ্ধাসনে প্রাণবায়ু গ্রহণ এবং প্রাণবায়ুর সঙ্গে অপান বায়ুর সমন্বয় সাধন। শক্তিচালান মুদ্রার প্রয়োজন হয়ে পড়ে সাধকের যোনিমুদ্রার আগে। অশ্বিনীতে তলপেটে নানা আওয়াজ হতে থাকে। কুম্ভকের সাহায্যে এখানে কুণ্ডলিনীকে সহস্রারে নিয়ে যাওয়া হয়। তন্ত্রগুরু দেখেন এখানে শিবের সঙ্গে শক্তির মিলন হচ্ছে। এই মিলনে তিনি আনন্দময় হয়ে ওঠেন। মহাবেধ মুদ্রাতে যোগী মনকে নিবিষ্ট করে নেন। এখানে চন্দ্র, সূর্য, তেজ বা অগ্নি সব একাকার হয়ে যায়। মানে হল ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্নার ত্রিবেণীযোগাযোগী ভদ্রিকাকুম্ভক ও পদ্মাসন করতে থাকেন। পদ্মাসনে বসেই তলপেটকে সংকুচিত করেন তিনি। খেচরী মুদ্রাতে জিভকে বের করে। আনা হয় দুই ভুরুর মাঝখানে। এতখানি প্রসারিত হয় জিভ। এই স্থান বাউলের আরশিনগর। বাউলও আজ্ঞাচক্র ভেদ করেন। পরমাত্মারূপ তার জ্ব-পদ্মে। যুগল তিনি তা লাভ করেন। রাজ খ্যাপা তাই তার পদে বলেছেন: ‘পরমাত্মা রূপে এসে মানুষে মানুষ আছে মিশে সাধন কল্পে / পাবি দিশে রবে না আরে ত্রিতাপ জ্বালা / দ্বিদল পরে দেয় পাহারা বেদবিধি পার উল্টা খেলা।’

এই উল্টাখেলাতেই বাউল সাধক মনের মানুষকে বোঝেন, উপলব্ধি করেন। আর তার জন্যই তো বাউলের যত হাহাকার। এমনই এক হাহাকারের বহুশ্রুত গান শুনেছিলাম কৃষ্ণা দাসীর বাড়িতে বসেই। এক বিকেলে আমি আর চন্দ্রানী পৌঁছেছিলাম কৃষ্ণার ওখানে। তখন কৃষ্ণা সবে একতারা নিয়ে বসেছেন। পড়ে এসেছে বিকেল। কৃষ্ণা বললেন, কাল রেডিও সেন্টারে গাইতে হবে। ডাক এসেছে। তাই বসেছি।

ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমাদের দেখে বললেন, চা করি।
চন্দ্রানী বলল, ও সব পরে হবে। আগে গান শুনি।

কৃষ্ণা পুনরায় একতারা তুলে নিলেন হাতে গাইতে লাগলেন বহুশ্রুত সেই গান। কৃষ্ণা গাইছেন মন প্রাণ ঢেলে। সবে তখন নবকুমারের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তার গানে যেন সেই সম্পর্কের তিক্ত-কষা যুক্তির জাগর হয়ে ফুটে উঠছে সব। তিনি গাইছেন:

আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে–
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হত খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানল মরছি জ্বলে নিভাই কেমন করে
মরি হায় হায়রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
দিব তার তুলনা কি যার প্রেমে জগৎ সুখী
হেরিলে জুড়ায় আঁখি সামান্যে কি দেখিতে পারে
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে।
মরি হায় হায়রে–
ও সে না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষে মন চুরি করে।
কুল মান সব গেল রে তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে–
তাইতে মোরা দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায় না জেনে তার গগন ভেবে মরে
মরি হায় হায় রে–
ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানিস কৃপা করে
আমার সুহৃদ হয়ে ব্যথার ব্যথিত হয়ে
আমায় বলে দে রে।

বাউল বলেন মনের মানুষ দ্বিদলে অবস্থান করেন। দ্বিদল হল আজ্ঞাচক্রের স্থান। তারপর ষোড়শ দলে নেমে আসেন। ষোড়শ দল বিশুদ্ধচক্রের স্থান। সেখান থেকে দশমদলে নামেন তিনি। মণিপুরে। তারপর চতুৰ্দলে স্থিত হন। মূলাধার চক্রে। মূলাধারের এই সহজ মানুষকে সাধক বাউল উজানে ঠেলে নিয়ে দ্বিদলে স্বরূপকে উপলব্ধ করেন।

কৃষ্ণার গানে তার স্বরূপ নিয়েই নিভৃততম স্রস্ততা, শিহরণ, অনিশ্চয়টুকু ফুটে উঠেছে। আমাদের উপনিষদ বলছে, বাইরের সত্যকে খুঁজে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। নিজের মধ্যে ডুব দিলে পরমের সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য থাকে না। ‘তৎ তৃম অসি’–তুমিই সেই। এই তুমি আনন্দ-স্বরূপ নিজেরই অন্তরাত্মা। দ্রষ্টা, দৃষ্টি এবং দ্রষ্টব্য। একই সরলরেখার জিনিস। চার অবস্থার কথা বলা হয়েছে উপনিষদে–জাগ্রত, সস্বপ্ন। নিদ্রা, স্বপ্নহীন নিদ্রা, তুরীয় অবস্থা। এই চার অবস্থাকে আমরা বাউল সাধনার চারটি স্তরের সঙ্গে মিলিয়ে নিতেই পারি। জাগ্রত = স্থূল, স্বস্বপ্ন নিদ্রা = প্রবর্ত, স্বপ্নহীন নিদ্রা = সাধক, তুরীয় অবস্থা = সিদ্ধ। বাউলের অষ্টদল পদ্মের কথা আমরা কিন্তু উপনিষদে পাই। সেখানে বলা হয়েছে, অনাহত চক্রের নীচে অষ্টদল পদ্ম থাকে। এখানে ইষ্টদেবতার পূজা করতে হয়। বাউলের নিষ্ট ও ইষ্ট মনের মানুষ। তাই সাধক বাউল রজ পানের পর ঘুমঘোরে এই পদ্মেরই দেখা পান স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থাতে। এটা উপনিষদের দ্বিতীয় স্তর। বাউলেরও প্রবর্ত স্তর শিক্ষা-দীক্ষার শুরুর সময়ই তো চারচন্দ্র ভেদ করতে হয় তাকে। অষ্টদলে আট বৃত্তির কথাও বলছে উপনিষদ। পূর্ব দলে পূণ্যমতি, দক্ষিণ-পূর্বদলে নিদ্রা ও আলস্য, দক্ষিণ দলে কুরমতি, দক্ষিণ-পশ্চিম দলে পাপমতি, পশ্চিম দলে নীচতা, উত্তর-পশ্চিম দলে ক্রিয়ার ইচ্ছা, উত্তর-পূর্ব দলে বস্তুগ্রহণ। এই আট বৃত্তি কিন্তু মনের মানুষ লাভের জন্য যথেষ্টই সংযোগ সূচক।

মনের মানুষের জনপ্রিয় আরেক গান অনেক বাউলের মুখেই শুনতে পাওয়া যায়। ঘোষপাড়ার মেলায় সুমিত্রা দাসীর গলাতে সেই গানের কথা মনে এলে এখনও সেই উজ্জ্বলতার ঘোরকে কাটাতে পারি না আমি কিছু কিছু গান যেন গায়কেরই একান্ত হয়ে ওঠে। সুমিত্রার এই গানকে আমার মনে হয়েছিল একান্ত নিজস্ব গান। তার স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, সঙ্কটাপন্ন অর্থনীতি, পরিবার বিচ্ছিন্নতা–সব মিলিয়ে মনে হয়েছিল যেন এ গান তার গাইবার জন্যই রচিত। যখন সুমিত্রাকে দেখেছিলাম, ঠিকানা চেয়েছিলাম পুনরায় যোগাযোগের তখন নিজস্ব কোনও আস্তানা ছিল না তার। মাধবপুর, মুড়াগাছা, অতঃপর বীরভূম, বর্ধমান কোথাও স্থিতু হতে পারেননি এই নারী। সঙ্গীহীন উদাত্ত সঙ্গীত নিয়ে কেবল গ্রাম বাংলা চষে ফেলছেন তিনি। অথচ স্বপ্ন ছিল সাধনভজন করবেন। সাধকের প্রতারণা তাকে মুখর ও জেদি করে কেবল ছেড়ে দিয়েছে গানের দরবারে। সুমিত্রার তাই ভেঙে পড়া বিচ্ছিন্ন নগরে রোষ, ক্ষোভ আর বিদ্বেষের আরশিনগর রয়েছে। পড়শি তার এখন নাকি কেবলই গান। এ সুমিত্রার নিজের কথা।

ঘোষপাড়ার মেলায় সেবার তিনি গাইলেন:

আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর
ও এক পড়শি বসত করে।
গ্রাম বেড়িয়ে অগাধ পানি
ও তার নাই কিনারা নাই তরণী পারে–
আমি বাঞ্ছা করি দেখব তারি
আমি কেমনে সে গাঁয় যাই রে।
বলব কি সেই পড়শির কথা।
ও তার হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা নাই রে।
ও সে ক্ষণেক ভাসে শূণ্যের উপর
আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।
পড়শি যদি আমায় ছুঁত
আমার যম-যাতনা যেত দূরে।
আবার সে আর লালন একখানে রয়
তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।

ভিড়ের মাঝে সুমিত্রাকে খানিক নিভৃতে পেয়েছিলাম। বললেন, মচ্ছবের রান্নার পোড়াকাঠখানা দেখেছেন; দেখেন, আমার এখন তেমন দশা। সাধন পুড়েছে। ভজন নিয়ে তাই থাকি। ভজনই শান্তি, পাপ, প্রায়শ্চিত্ত। ভজন হল উত্রাই। তাই তিরবেগে ছুটতে ছুটতে আজ এখানে তো কাল ওখানে।

আমি সুমিত্রা চলে যাবার পর ভাবলাম, পড়শি তার এখন কেবল গান। তাকেই তিনি আজ্ঞাচক্রে দ্বিদলে স্থান দিয়েছেন। লালন যদি থাকতেন, সুমিত্রার এই ব্যথা কি বুঝতে পারতেন আজ। সুমিত্রার শরীরের অগাধ পানিতে একদিন বাউল-সাধক তরণী ভিড়িয়েছিলেন। তাতে স্কন্ধ-মাথাহীন পড়শি তিনি পেয়েছিলেন কিনা জানা নেই আমার। তবে সুমিত্রা পড়শির সেই উপেক্ষিত ছোঁয়ায় জীবনের সর্বশেষ অধ্যায়টি খুঁজে পেয়েছেন এখন। যে অধ্যায়ে গানখানি তার সর্বস্বতা নিয়ে পড়ে আছে একেবারে স্বতঃসিদ্ধ অস্তিত্বের অন্যরকম এক আরশিনগর। যেখানে দাঁড়ালে পড়শির হাঁ হাঁ রব কেবলই শোনা যায়। পড়শি কেঁদে ফেরে বাউলের হাওয়ায় হাওয়ায়।

*****

কুলের পাটের মেলায় বেশ রাতের দিকে শুনলাম কাঁটাগঞ্জের বাউল অরুণ দাসের গান। ততক্ষণে ভিড় থিতু হয়ে বসেছে আসরে। ইতিউতি অনেকে চাটাই পেতে গা এলিয়ে দিয়েছে খানিক। অরুণ দাস গাইতে উঠছেন। প্রথম গানেই দেহতত্ত্বকে ছিঁড়েখুঁড়ে টেনে বের করতে থাকলেন। যন্ত্রীদের থামিয়ে বললেন, এই এত মানুষের মধ্যে মানুষ। করতে হবে নিরীক্ষণ। কী বলেন সব খ্যাপা? ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি! ডুবকিতে চাপড় দিল সঙ্গত শিল্পী। একতারা বাজিয়ে নিলেন। ধরলেন মানুষতত্ত্বের গান। কুলের পাট গমগম করতে থাকল সুর আর তালের মানুষে।

বাউল গাইলেন:

এবার আপনার খবর আপনি জান রে মন
মানুষ কোথায় আছে কর নিরীক্ষণ।
আমি আমি সবাই বলে আমি কে চেন গা আগে
তার কর গা অন্বেষণ।
এমন মানব জনম পাবি যদি
ধর গা হাড়িরামের ওই চরণ।
তারে খুঁজেও পাওয়া যায়
আপনি-হারা হলে পরে কোথায় পাওয়া যায়
আপনাকে আপনি হতেছ হারা
খুঁজে করগা তার অন্বেষণ।
এই দেহেতে চৌদ্দ কোঠা
যেমন শোলার পাখি কয়গো কথা
শতেক হাড়ে পিঁজরাটা গাঁথা–
হাওয়া বল্ ছাড়া এ কল রবে গো পড়ে।
শুধু খাঁচার কথা কবে না তোর।
সদানন্দ ভাবছে বসে কি করবি মন শেষে
ও তার কর গা অন্বেষণ
এমন মানব জনম পাবি যদি
ধর গা হাড়িরামের চরণ।

অরুণ বাউলের গানে নিজেকে চেনারই কথকতা রয়েছে। সেজন্যই দেহের চোদ্দ কোঠাকে শোলার পাখির কথা বলার উপমার সঙ্গে সামঞ্জস্য করা হয়েছে। চোদ্দ কোঠা চোদ্দ ভুবনে সামিল–দুই চোখ, দুই নাক, দুই কান, মুখ, মাজা, পায়ু, উপস্থ, বুক, স্তন, নাভি আর ব্রহ্মরন্ধ্র। চোদ্দকে দশেন্দ্রিয় আর চার ভূত মিলিয়েও দেখতে পারি আমরা। চোদ্দ ভূবনে দুই শরীরের প্রত্যঙ্গ রয়েছে সব। সাড়ে তিন কোটি নাড়ি আছে। আছে পঞ্চভূতেরও বাসস্থান। সাত ধাতুর উপাদান আছে। এই সমন্বয়ের ঐক্যতান তখনই একীভূত হয়, সাধনক্রিয়া শুরু হয়। অষ্টপাশ নাশ হয়। আর অষ্ট সিদ্ধির একটি কিন্তু লঘিমা। ইচ্ছামতন হাল্কা হবার ক্ষমতা। এতে শোলার পাখির কথা বলার প্রতীক রয়েছে। দেহের যোগক্রিয়াতে হাল্কা স্তরই শোলার পাখির কথা বলা। এই কথা বলতে হয় বায়ুযোগে। বায়ুই সাধককে। উজ্জীবিত করে রাখে। বায়ুর অভিষেক ঠিকঠাক শরীরে না হলে উপর্যায়ের উদ্ভাসিত বহুমাত্রিক শক্তিকে সাধক কখনই আয়ত্ত করে উঠতে পারবেন না। শরীর তৈরি করে বায়ু। বায়ু কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগায়। আজ্ঞাচক্রে কুলকুণ্ডলিনী উঠে এলে শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়া প্রায়

বন্ধ হয়ে যায়। কারণ এই অঞ্চল থেকেই শূন্যতা দ্যোতিত হয়। নিজস্ব স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্ত্বার। বোধ জাগে। এই শূন্যতা হল পূর্ণতা। সাধক তৈরি শক্তির শরীর নিয়ে তখন সেজে ওঠেন। ‘কুল’ সংস্কৃত ভাষাতে পরম চেতনার নামান্তর। এর আরও এক অর্থ রূপ বা আকৃতি। কুণ্ডলিনী শক্তির কাজ হল কুলকে বেঁধে ফেলা। আর তা হলেই রূপ তখন অরূপ হয়ে ওঠে। এই রূপ অধর মানুষের রূপ। যা সাধকই কেবল ধরতে পারেন। পদকর্তা সদানন্দ সেই মানুষের নিরীক্ষণের কথাই বলেছেন।

ছিন্নমস্তার উপাসক আলো সাধু একবার আমায় বলেছেন, আমাদের শরীরের তো একান্ন পীঠ আছে।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কীভাবে তা আছে?

বললেন, একান্ন পীঠ শরীরের একান্নটা স্তর।

–কী এই স্তর?

–ছয় চক্রের স্তর। এতে সাতটি করে তরঙ্গ আছে। ছয়কে সাত দিয়ে গুণ কর তুই। বিয়াল্লিশ হল। এই ছয়ে আরও তিন স্তর আছে। তাহলে যোগে নয় হয়। সর্বমোট একান্ন হল। সতীর একান্ন টুকরো দেহবিশ্ব রে। সমগ্র শক্তি। ইতিবাচক মানুষে একান্ন থাকে।

বাউলের ইতিবাচক মানুষ হল অনুভূতির মানুষ। সহজ মানুষ।

বাউল বললেন, মানুষের তিরোধান হয় মানুষ দিয়ে গো! বুঝলেন না খ্যাপারা সব স্থূল মানুষ না মরলে সিদ্ধ মানুষ হবে কীরূপে? কী কন খ্যাপা?

আমি দেখছি চৈত্ৰচাঁদে কুলের পাটে চৈতন্যমূর্তিতে মানুষের হাওয়া লাগছে যেন। থই থই মানুষের শ্বাসে চৈতন্য কি বন্ধ মন্দিরে ঘুমিয়ে আছেন মানুষের নিরবচ্ছিন্ন এই হাওয়ায়! অরুণ বাউলের গানে ও একতারায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *