০১.১ প্রতিপদে পূর্ণিমা যার তিন ধারাতে জনম তার

উজানতরী
প্রতিপদে পূর্ণিমা যার তিন ধারাতে জনম তার

ঘোষপাড়া মেলার আগের রাত। মেলা শেষ পর্বের প্রস্তুতির আয়োজন সেরে ফেলেছে পুরোদমে। আখড়ায় বাউল ফকিরদের সমাবেশ। সাধুরা তাঁদের ডেরায় ভক্ত শিষ্যদের সঙ্গে গল্পে মশগুল। হোমযজ্ঞ শুরু হয়ে গিয়েছে দু’এক জায়গায়। আজ চাঁচর। এ রাতের চাঁদে পূর্ণিমার ঘোর লেগে। চতুর্দশীর আলো নিয়ে চাঁদ দাঁড়িয়ে পড়েছে সতীমার পুকুরের পাড়ে। এ ধারটা নির্জন। দু’একজন বৃদ্ধা ভিখারি রাতে শোবারও প্রস্তুতি সেরে নিয়েছে বাঁধানো পাড়ে ময়লা ঘেঁড়া চাঁটাই পেতে। পুকুরের সিঁড়ির দিকটায় এগিয়ে গেলাম গানের আওয়াজ পেয়ে লোকজন তেমন নেই। অথচ এখানে এমনভাবে বসে কে গাইছেন এই গান! কাকে বা শোনাচ্ছেন! এগিয়ে গেলাম আমরা তিন বন্ধু। শীতের কামড় না থাকলেও ঠাণ্ডা একটা বাতাস বইছে। এ বছর দোল আগে। মাঝ ফেব্রুয়ারি বলে শীত তার লোটাকম্বল গুছিয়ে নেয়নি। ভাঁজ করা চলছে সবে। আমি গায়ের পাতলা চাদরটা কানে মাথায় জড়িয়ে নিলাম। আমার আবার চট করে ঠাণ্ডা লেগে যায়। গানের রেশ আমাদের কানে পুরোপুরি লেগে গিয়েছে। আমরা নিবিষ্ট মনে শুনছি। বৃদ্ধ এক ফকির একমনে গেয়ে চলেছেন। আমি নিশ্চিত তিনি আমাদের উপস্থিতি টের পাননি এখনও। পুকুরের দিকে মুখ করে রয়েছেন বলে আমাদের তিনি দেখতেও পাচ্ছেন না। হাওয়ায় আমার দুই বন্ধুর চুল ফরফর করে উড়ছে। চাদরের ভেতর ঢুকে পড়ছে হাওয়া। চাদর পুরোটা জড়ানো নয় বন্ধুদের শরীরে। উত্তরীয় করে গলাতে দোলানো। হাওয়া ঢুকে চাদর বেঁকেচুরে যাচ্ছে। উত্তরীয় যেন দোল খাচ্ছে রাধাকৃষ্ণের মতো। দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতে শুরু করলে শরীরী সেই ভালোবাসার মধ্যে যেভাবে দু’জনের প্রত্যঙ্গ নড়ে; দোল খায়, ফকিরের পিঠে তারই ছায়া পড়েছে যেন। ভালোবাসায় মেতে উঠেছেন তিনি। এমনি তাঁর গায়কির আবিষ্টতা। তন্ময় হয়ে যাচ্ছি আমরা সব। আবীর ঘনঘন সিগারেট ধরাচ্ছে না। সুজিত ফাঁকা নির্জনে এসেছে সিগারেটে গাঁজা ভরে টানবে বলে, টানা দূরের কথা গাঁজার প্যাকেটও পকেট থেকেই বের করে উঠতেই পারেনি। গান এভাবেই বিবশ করেছে ওদের, মশা কামড়াচ্ছে। মুখের চারধারে ঘুরঘুর করছে মশা। তবু আমারও বিরক্তবোধ নেই। ফকির যেন গানের গাঁজা খাইয়ে দিয়েছেন আমাদেরকে। গাইছেনঃ

পূর্ণিমার চাঁদ ধরবি কে রে
তোরা দেখ চেয়ে ত্রিবেণীর উত্তর-দক্ষিণ
রবি শশি তার দুই কিনারে। বা
পের ঘরে রবির কিরণ
শশির ঘরে মার দর্শন
তোরা দেখতে পেলে হবি সৃজন
বাছাধন তাই চিনে নেরে।
কি করে চিনি চক্ররে
উদর ভরে আধ অক্ষরে
তোরা রুহিনির চাঁদ ধরবি যদি
ফাঁদ পেতে নে হৃদয়পুরে।
শাহা শির আলির হৃদয়পুরে
কেনে রয়েছে ঘুমের ঘোরে
ও তোর প্রেমের কক্ষে দেখনা
চেয়ে তোর নগরচাঁদ নগরের পরে।

ঘোর ভাঙল ফকিরের। পিছন ফিরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝলাম। তারে আর গান শোনানো হবে না। সে বলল মানুষ এসেছে গো। তুমি থোও। কথা কও ওদের সঙ্গে। গান শোনাও। আমি পিছন ফিরি দ্যাখলাম সত্যি। আপনারা সব এসি গিয়েছেন। বসেন খ্যাপারা সব। দুটো-একটা কতা কই। পরাণের কতা।

আমাদের তিনজনই ফকির বসার একটা সিঁড়ি বাদ দিয়ে বসে পরলাম। আবীর সিগারেট ধরাল। সুজিত বের করে নিল গাঁজা। ফকির আর আমাদের দূরত্ব এখন এক সিঁড়ির। কিন্তু এই মানুষটাকেই এতক্ষণ আমরা ধরতে ছুঁতে পারছিলাম না। গানে তিনি আমাদের থেকে যোজন দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিলেন। এখন যেন খানিক ছুঁতে, ধরতে পারছি বলে মনে হচ্ছে। আবীর কলকে ছাড়া গাঁজা টানে না। ওর নাকি সিগারেটে আমেজ হয়না। কলকে প্রস্তুত করে বার দুই টানার পর ও ফকিরের দিকে বাড়িয়ে ধরল সেটা। বলল, নেন আসেন।

কলকে প্রসন্ন বদনে কপালে ঠেকালেন ফকির। টানলেন। বার দুই টানার পর বললেন, ওধারে খেপী মা রয়েছেন। ওনারে একটু দিই, ডাকি? কী বলেন আপনারা।

কিছু বলার আগেই তিনি ডাকলেন–মা, মাগো, আসো দিকি এদিক পানে। বাবারা সব প্রসাদ করিছে।

মস্ত এক হাওয়া বইল এ সময়। আমরা দেখলাম হাওয়া ফুঁড়ে উঠে এলেন যিনি তাঁর সর্বাঙ্গ জলে ভেজা। লাল শাড়ির আঁচলে তবু লেপ্টালেপ্টি খাচ্ছে হাওয়া। কপালের সিঁদুর জল লেগে মিয়ে গেছে যেন। হাত ভর্তি পলায় চাঁদ লেগে জলের চিকচিক।

মা এসে ছিলিম ধরলেন। কোনওদিকে তাকালেন না পর্যন্ত। কপালে ঠেকালেন। বললেন, ব্যোম শঙ্কর। বার তিনেক টেনে তিনি নেমে গেলেন সোজা। যেখান থেকে উঠে এসেছিলেন সেখানেই চলে গেলেন তিনি। এ যেন সীতার পাতাল প্রবেশ।

ফকির বললেন, গরম ধরিসে মার সেই থেকে জলে।

আমি ভাবলাম, এই শেষ শীতেও মা-র শরীরে এত গরম।

বললেন, তারাপীঠ থেকে এসেছেন মা। সঙ্গে কালভৈরব। এসে থেকে জলে রয়েছেন তিনি। তন্ত্র করেন তো। তাই শরীরে এত তাপ মা’র। তারাপীঠ যাবেন। দেখবেন শ্মশানে মায়ের দাপট। প্রতি অমানিশায় ক্রিয়াকর্ম করেন তিনি আর কালভৈরব। ভৈরব এসে থেকেই যে কোথায় গায়েব হলেন!

হাওয়া দিচ্ছে। খেপী মা জলেই সেঁধিয়ে রয়েছেন। চুপ হলেন ফকির। চোখে বোধহয় রং লেগেছে। বেশ কিছু টান হয়ে গেছে তাঁর।

******

জিজ্ঞাসা করলাম–কাকে গান শোনাচ্ছিলেন?

–কাকে আবার! ফিক হেসে বললেন ফকির। আমার এ সময় মনে পড়ে গেল কবির কথা–’চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো। / ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো।।’

আমি সত্যিই চাইছি ফকির তাঁর জ্যোৎস্না হাসির পরত ছুঁয়ে কিছু বলুন। অমন যার গান; ভেতর থেকে ঠিকরে বেরোনো সব কথার কুচি, এমন ভাব যেন তিনিই পদকর্তা। এতখানি একাত্মতা! গানের সেই পরশ কথাতেও নিশ্চয়ই থাকবে। এ আমার বিশ্বাস। তবে অভিজ্ঞতার পর এরকম বিশ্বাস আমি সংগ্রহ করেছি।

জবাব দিলেন না ফকির।

তবে কি তিনি কথা বলতে চাইছেন না!

ভাবলাম আমি।

বললাম, ‘তালে আমাদের দেখার সাথে সাথে বললেন যে, ‘তারে আর গান শোনানো হবে না।‘ কাকে গান শোনাচ্ছিলেন আপনি? খেপী মা তো বললেন ডুব মেরেই থাকেন জলে। কুম্ভক করে। তবে শ্রোতাটা কে শুনি? কেউ তো নেই এখানে।

আবারও ফিক হাসলেন ফকির। চুপ মারলেন। বুঝলাম তিনি কিছুই বলবেন না।

বললাম, আমরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন পরাণের কতা কইবেন। কই কিছুই যে কইছেন না!

নীরবতা ভঙ্গ দিলেন ফকির।

বললেন, খ্যাপার যে আর তর সইছে না।

আবীর, সুজিত থম মেরেছে। বুঝলাম ধরেছে ওদের।

ফকির বললেন, আমি খ্যাপা চাঁদরে শোনাচ্ছিলাম গান। চাঁচরের চাঁদ কথা কইছে। ভাবলাম চাঁদরে চাঁদের কতাই শোনাই। তাই চিমটে বাজিয়ে গাইছিলাম আর কী।

চমকে গেলাম আমি।

বলেন কী ফকির! চাঁদকে শোনাচ্ছেন গান। আশ্চর্য!

বিস্ময়কে তিনিই ভাঙলেন।

বললেন, ভাবছেন নেশা ধরি গেছে আমার। তা খ্যাপা চাঁচরে তো চাঁদের নেশাই ধরে।

আমি চুপ কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।

ফকির বললেন, আপনে চাঁদের সঙ্গে কতা কন না? কন কন।

আমি অবাক।

বলে চলেছেন তিনি–সকল মানুষই কথা কয় চাঁদের সঙ্গে। বুঝে, না-বুঝে, জেনে, না-জেনে কথা চলে চাঁদের সঙ্গে। খ্যাপা জানেন তো আপনে। এ লাইনে ঘোরাফেরা তো অনেকদিনের বলেই মনে হচ্ছে। চিমটেটা বাজাতে থাকলেন তিনি। আবার গান ধরলেনঃ

সে কথা কি কইবার কথা জানিতে হয় ভাবাবেশে
অমাবস্যা পূর্ণিমা সে পূর্ণিমা সে অমাবস্যে
অমাবস্যায় পূর্ণিমা যোগ আজব-সম্ভব সম্ভোগ
জানলে খণ্ডে এ ভব রোগ
গতি হয় অখণ্ড দেশে।
রবিশশী রয় বিমুখা
মাস অন্তে হয় একদিন দেখা
সেই যোগের যোগে লেখাজোখা
সাধলে সিদ্ধি হয় অনায়াসে।
দিবাকর নিশাকর সদাই
উভয় অঙ্গে উভয় লুকায়
ইশারাতে সিরাজ সাঁই কয়
লালন রে তোর হয় না দিশে।

প্রথমেই বুঝেছিলাম বৃদ্ধ ফকির চাঁদ বলতে কী বোঝাতে চাইছিলেন। তবে এসব ক্ষেত্রে দেখেছি না জানার ভান করলেই বেশি জানা যায়। আমি যে তাঁর ইঙ্গিত ধরতে পেরেছি এটা অভিজ্ঞ ফকির ধরে ফেলেছিলেন। এজন্যই আমাকে এ লাইনে অনেকদিনের কথা বলেছিলেন তিনি।

গানের ভেতর দিয়েই ফকির বলে দিয়েছেন, সে কথা কি কইবার কথা জানিতে হয় ভাবাবেশে। সত্যিই ভাবের এই আবেশ না থাকলে প্রতীকী কথকতার অন্তঃসার কিছুই ধরা যাবেনা, বোঝা যাবে না। আর তা না ধরতে পারলে ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ও অধরা থেকে যাবে। পূর্ণিমার চাঁদ’ ধরতে হলে আমাদের নিজেদের মধ্যেই ডুবে যেতে হবে। শরীরের গহন অন্দরে, কলকজায় রয়েছে সেই পূর্ণিমার চাঁদ। পদকর্তা শাহ শির আলি তারই হদিশ দিতে চেয়েছেন পদটিতে।

ফকির যার জন্য বলেছিলেন আমাকে ‘আপনে চাঁদের সঙ্গে কতা কন না?’ তাঁর এই জিজ্ঞাসা মানুষের অনন্ত জিজ্ঞাসা। দেহসাধক এর উত্তর পান দেহকে ধরে। তাঁর এই দেহ জানা, দেহ চেনার অন্তর্জগত তৈরি করে দেন গুরু। গুরু দেহের অবিকৃত প্রকৃতিগুলোকে খুলে ধরেন। দেহপ্রকৃতি তখন হাসে, জাগ্রত হয়, চাঁদও ধরতে পারে সেজন্যই সুফিসাধক জালালউদ্দিনের গানে আমরা পাই—’চিনগে মানুষ ধরে/ মানুষ দিয়া মানুষ বানাইয়া সেই মানুষে খেলা করে। / কীসে দেব তার তুলনা কায়া ভিন্ন প্রমাণ হয় / পশুপক্ষী জীব আদি যত এ সংসারে/ দুইটি ভাণ্ডের পানি দিয়া অষ্ট জিনিস গড়ে–/ তার ভিতরে নিজে গিয়ে আত্মারূপে বিরাজ করে।’

প্রশ্ন হল আমাদের দেহ কীভাবে এই চাঁদকে খুঁজে পাবে? কীভাবে বা আমরা ধরব শাহ শির আলির চাঁদ। বৃদ্ধ ফকির তো সেই চাঁদ খুঁজে, চাঁদ ধরে দিব্যি বেশ চাঁদের সঙ্গে কথকতা কইছেন। গান শোনাচ্ছেন চাঁদকে। ভাবা যায়, আশ্চর্য!

তবে আমরাও ইচ্ছে করলে চাঁদকে অনায়াসে গান শোনাতে পারি। তাঁর জন্য আমাদের শরীরকে কেবল জাগ্রত করতে হবে যোগে। শরীরের ভেতর আমাদের চাঁদ আর সূর্য সদা বিরাজমান হয়ে দিব্যি আলো ছড়াচ্ছে। আমরা কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। তন্ত্রে মৎস্যসাধক তিনিই হতে পারেন, যিনি শরীরের গঙ্গা ও যমুনা নামে দুই মাছকে বেশ ভালোভাবে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে নিতে পারেন। কীভাবে খাবেন তন্ত্রসাধক শরীরের এই দুই কল্পিত মৎস্যকে?

‘গঙ্গা যমুনয়োর্মধ্যে মৎসৌ ঘৌ চরতঃ সদা/ তৌ মৎসৌ ভক্ষয়েদ যস্তু স ভবেন্মৎস্য সাধকঃ।।’ অর্থাৎ কিনা গঙ্গা যমুনার মধ্যে দুটো মাছ চরে বেড়াচ্ছে। গঙ্গাকে। সাধক বলছেন ইড়া, পিঙ্গলা হল যমুনা। রজ ও তম এই দুই মাছ তার মধ্য দিয়ে চলাচল করে। রজ=শ্বাস, তম=প্রশ্বাস। যে সাধক এই দুই মৎস্যকে ভক্ষণ করতে পারেন তিনি। মৎস্যসাধক বা মৎস্যাসী। কীভাবে এটা সম্ভবপর? এটা সম্ভবপর যোগক্রিয়ায়। প্রাণায়ামে রেচকেপূরকে। কুম্ভকে।

মৎস্য অবতারের গল্পে আছে মৎস্যের আবির্ভাবই হয়েছিল সপ্ত ঋষিকে প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য। এক অসুর বেদ চুরি করে সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। বেদও মৎস্য অবতার উদ্ধার করে আনেন।

সমুদ্রকে আমরা ধরতেই পারি মানবদেহ। সমুদ্রের তলদেশ হল মূলাধার। মূলাধার চক্র নীচস্থ অবস্থানেই থাকে শরীরে। শ্বাসবায়ু হল মৎস্য, অসুর হচ্ছে প্রশ্বাস বায়ু। এই অসুর কুলকুণ্ডলিনীকে মূলাধারের দিকে টেনে নামিয়ে আটকে রাখে। সপ্ত ঋষিকে আর বেদ চুরি করে এনে রাখার মতো করেই। শ্বাস মৎস্য অবতার সেজে মূলাধার থেকে সেই কুলকুণ্ডলিনী অর্থাৎ চক্ৰমধ্যস্থিত শক্তি বা জ্ঞানকে টেনে ওপরে তোলে। এইজন্য শ্বাসকে মৎস্য অবতার রূপে ভাবতে পারি। আর এই রূপকে, প্রতীকে শ্বাসকে ভাবলে প্রশ্বাসকে করতে হচ্ছে অসুর। তাহলে দাঁড়াল এইঃ শ্বাস/ প্রাণবায়ু/ মৎস্য, প্রশ্বাস/ অপান বায়ু/ অসুর।

সাধক যেমন আমাদের নাড়িকে নদীরূপের প্রতীকী অবয়ব দিয়েছেন তেমনই নাড়িকেই আবার আকাশ, মহাকাশের দ্যোতনাও দিয়েছেন। আর সেই দ্যোতনাকে সাথে নিলে ফকির কথিত চন্দ্র রয়েছে আমাদের শরীরের মধ্যেই। কীভাবে? চন্দ্রকে বাউল সাধক / দেহ সাধক / সহজিয়া সাধক বলেন ইড়া আর পিঙ্গলাকে সূর্য। বাউল অবশ্য সরাসরি চন্দ্রকে ইড়া বলেন না। চন্দ্র হল তাঁদের কাছে বাঁ নাক আর সূর্য ডান নাক। রেচক করার সময় শরীরের ভেতর টেনে নেওয়া বায়ু ডান নাক দিয়েই বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পূরকে যা বাঁ নাকের মাধ্যমে শরীরের মধ্যে টেনে আনা হয়। ডান নাক দিয়ে বায়ু রেচন করা হয় আবার বিপরীতক্রমে মানে শ্বাস ছেড়ে দেবার পর ডান নাকেই টেনে দুই নাকে রেখে কুম্ভক করে বাঁ নাক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় রেচক করেই।

মহাবিশ্বের সৃষ্টির স্তরকেও সাধক শরীরের মধ্যেই দেখেন। ছটি স্তরকে তাঁরা দুটি চক্র হিসাবে বর্ণনা করেন এবং প্রত্যেকটি চক্রে এক একজন নিয়ন্ত্রক দেবতা আছেন আর চক্ৰমধ্যে একটি বিশেষ গুণও বর্তমান বলে তাঁদের বক্তব্য। চক্রে চক্রে সাধক যখন সেই চেতনাকে অপর চক্রে ঠেলে তুলে উধ্বক্রমে শক্তিকে তুলতে তুলতে চক্র পার হয়ে যান তখন একেক চক্রকে তাঁরা বলে থাকেন মহাবিশ্বের স্তর। এই ছয় চক্রের শেষ দুই চক্রের মধ্যে কিন্তু চন্দ্র রয়েছেন। চন্দ্রই এই দুই চক্রের নিয়ন্ত্রক দেবতা। বিশুদ্ধ চক্র সাধকের কাছে মহাবিশ্বেরই তর্পলোক, তা সত্ত্ব গুণে আচ্ছন্ন আর নিয়ন্ত্রক দেবতা চন্দ্র। আজ্ঞা চক্র সত্যলোক, সত্ত্ব গুণ তার। নিয়ন্ত্রক দেবতা সেই চন্দ্রই। তাহলে এখানে এভাবে। দেখলেও কিন্তু দেখব শরীরের ভেতরই রয়েছে চন্দ্র। প্রসঙ্গত এখানে বাকি চার চক্রের কথাও বলে রাখি। মূলাধারে ভুবর্লোক, গুণ তম, নিয়ন্ত্রক দেবতা অগ্নি। স্বাধিষ্ঠানে স্বর্লোক, তমগুণ, অগ্নি দেবতা। মণিপুরে মহর্লোক, গুণ রজ, দেবতা সূর্য। অনাহতে জনর্লোক, রজ গুণ, সূর্য দেবতা।

মুদ্রা সাধকের তন্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবেঃ ‘সহস্রারে মহাপদ্মে কর্ণিকা মুদ্রিতা চরেৎ। আত্মা তত্রৈব দেবেশিকেবলং পারদোপমম।।/ সূর্য কোটি প্রতীকাশং চন্দ্রকোটি সুশীলতম। অতীব কমনীয়ঞ্চ মহাকুণ্ডলিনী যুতম। যস্য জ্ঞানোদয় তত্র মুদ্রা সাধক উচ্যতে।।’ মানে হল মাথার উপরের অংশে সহস্রার মহাপদ্ম বর্তমান। তার কর্ণিকার মধ্যে পারদের মতোই ঢল ঢল সুনির্মল সাদা বর্ণ সব আছে। সেই বর্ণের এমনই জ্যোতি যে, চন্দ্ৰসূর্যের জ্যোতি থেকেও সে জ্যোতিস্মান। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন কুণ্ডলিনী আকারে মহাশক্তি। তিনি পরমাত্মা, পরমব্রহ্মণ, তুরীয় তুরীয়াতীত আনন্দ সব। যার জোরেই শরীরের রাস্তাঘাট, গাছপালা সব প্রকট হয়ে পড়ছে। চাঁদকে কিন্তু মনের প্রতীক হিসাবেও ধরে থাকি আমরা। ধরার কারণ চন্দ্রের বিভিন্ন কলাতে মনের প্রভাব। মহিলাদের, বলা ভালো, সঙ্গিনীর রজঃপ্রবৃত্তির সময়কে বাউল সাধক অভিহিত করে ‘অমাবস্যা’ বলে। আমাদের এক সংস্কারও আছে–মাসিক বা রজঃপ্রবৃত্তির সময় বাড়ির মহিলারা ঠাকুর ঘরে ঢোকেন না। পুজো করেন না ওই সময়। বলেছি আমরা চাঁদকে মনের প্রতীক। চেক বিজ্ঞানীরা প্রমাণও করেছেন রজঃপ্রবাহের সময় মহিলাদের চিত্তচাঞ্চল্য বেশি হয়। আর দেবার্চনা হল গিয়ে ধ্যানস্থ অবস্থার কাজ। ধ্যানে ভক্তিতে দেবতাকে ডাকার, অর্চনা করার নিয়ম। এই রজঃপ্রবাহের কালে যেহেতু মহিলাদের চিত্তচাঞ্চল্য বেশি মাত্রাতে থাকে সেইজন্যই আসলে এই সংস্কার। এই যৌক্তিকতাকেই বোধহয় সংস্কারে গাথা হয়েছে। তবে তাও নয়। সংস্কার আগে তৈরি। প্রামাণিক নথি বিজ্ঞানীদের হাতে এসেছে বেশ পরে। তবে বোধহয় সংস্কার এ কারনেই গড়া–রজঃপ্রবাহের সময় বা চলাকালীন সেই স্রোতে যৌনাঙ্গ তথা চারপাশ অশুচি বা চটচটে হয়ে পড়ে। কাপড় জাতীয় বস্তু ব্যবহার করতে হয়। তখন তো আর টেনে নেবার মতো ন্যাপকিন জাতীয় কিছু ছিল না। তাই এই অপরিচ্ছন্ন দশাতে, ঘিন ঘিনে ভাবে ঠাকুরের কাছে যেতে যেন বাঁধো বাঁধো লাগে। সেই থেকেই এই বিধিকল্পের সংস্কার। চন্দ্রের প্রভাবে যে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে তা জ্যোতিষীরাও মানেন। সেজন্যই তাঁরা অস্থির মতি ব্যক্তিদের ‘মুন স্টোন’ ধারণ করার পরামর্শ দেন।

খেপী মা সেদিন আমাকে শিবের মাথার বাঁকা চাঁদকে বলেছিলেন সাধকের সিদ্ধির জাগৃতির স্বরূপ।

তা বাবা ফকির তো কোলো তার মতো। চাঁদ, ব্যোমভোলার মাথার চাঁদ কী। বাবা? কী মনে কর তুমি?

আমি চুপ।

মা বললেন, ওসব সাধনযোগ তুমি ছাড়ান দাও দিকি।

ফকির হাসছেন মিটমিট করে। কালভৈরব তখন মায়ের পাশে।

খেপী মা বললেন, শিবের চাঁদ সাধনে সিদ্ধি গো।

কীভাবে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

খেপী মা বললেন, চাঁদ শূন্যতা। শূন্যতা পরম। পরম হল গিয়ে শিব–বলেই মা ব্যোমভোলে ব্যোমভোলে বলে দু’বার চিৎকার তুললেন।

ভৈরবের ডেরায় তখন যজ্ঞের আগুন নিভে আসছে। ফকির চিমটে নিয়ে তৈরি। ভৈরবের কথামতো গান ধরলেন তিনি।

কালভৈরব বলতে লাগলেন–চন্দ্র হল ব্রহ্মাণ্ডস্বরূপ। বাউল ফকিরও তা মানে। তাদেরও ব্রহ্মাণ্ড শরীর। আমাদেরও। সবার ব্রহ্মাণ্ড হল গিয়ে সেই শরীর। আমি-আমি আমি-আমি–বলতে লাগলেন ভৈরব।

থামেন দিকি।

খেপীর কথায় বাবা থামলেন।

মা বললেন, শরীরের আজ্ঞা চক্র ভেদ হলেই চন্দ্ৰজ্যোতি বের হয়। শিবের মাথার চাঁদ হল সেই জ্যোতি। শরীরই শিব বাবা।

ভৈরব বললেন, আজ্ঞা ভেদ হলে একে একে শক্তি উপরে উঠেই শিবত্ব লাভ। জীবত্ব থেকে মানুষ শিবত্ব লাভ করে। মানে হল মানুষই ভগবান।

বেষ্টিত ভক্ত-শিষ্য বলতে লাগলেন, কালভৈরব কী জয়। খেপী মা কী জয়। তারাপীঠ কী জয়। তারা মা কী জয়। জয় শঙ্কর।

খেপী মা বললেন, হারামজাদারা সব জয় দিলি,সিদ্ধ ফকিরের জয় দিলি না। বলেই বললেন, ফকির ফজর শাহ কী।

সমবেতভাবে জয়ধ্বনি উঠল–জয়।

গান ধরলেন ফকির। শোনা সেই গান। পুকুর ধারে যা গেয়েছিলেন ফকির।

*****

গানে স্পষ্টই বলা হয়েছে–’পূর্ণিমার চাঁদ ধরবি কে রে/ তোরা দেখ চেয়ে ত্রিবেণীর উত্তর দক্ষিণ/ রবি শনি তার দুই কিনারে।’ পূর্ণিমার চাঁদ হল চন্দ্রকলার বৃদ্ধির পর একেবারে পূর্ণাঙ্গ অবস্থা। এই পূর্ণচন্দ্র হল বাউল মতের প্রেম। পূর্ণচন্দ্রের প্রতীককে বাউল প্রেমই বোঝেন। ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ ধরার অর্থ প্রেমকে সাঙ্গ করা। যে প্রেম শরীরের মধ্যে রয়েছে। প্রেম এখানে কাঙ্খিত পরম ঠিকই কিন্তু সেই পরমকে পেতে, উপলব্ধি করতে শরীরের যোজন যোজন পথই অতিক্রম করতে হয় বাউলকে। Platonic Love এর কথা আমরা জানি। আবার শরীর ছাড়া প্রেম হয় না কিছুতেই; আমি তোমাকে ভালোবাসির অর্থ তোমার সত্ত্বাকে ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু এই সত্ত্বা তো শরীরের মধ্যস্থিত সত্ত্বা; রক্তমাংসের সত্ত্বা, তাই শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকেও ভালোবাসার সঙ্গে জড়িয়ে নিতে চান অনেকে। বাউল এই দ্বিতীয় মতে থাকলেও তাঁদের। বিশ্বাস শরীরের পথঘাট, রজ-বীর্য পার হয়ে এই ভালোবাসা হল কাম-পথকে পেছনে। রেখে প্রেম-পথকে সামনে আনা। এই পথ সাধনার পথ। প্রকৃতি-পুরুষের / যুগল শরীরের সাধনপথ। বাউল বলে একে ‘রাগের ভজন’। ‘রাগ’ এখানে, এ পথে আত্মার মোহাবস্থা বা নিজের কামাবস্থা কাটিয়ে ফেলে নিজের জাগ্রত দেহকে গরীয়সী করে তোলা। দেহ করে তোলা ভাবদেহ। বাহ্যদেহকে নষ্ট করলেই দেহ হবে ভাবদেহ। তার জন্যই দেহসাধনা। বাউলের সাধনা বাউল মতে ‘রাগের ভজন’ যেমন, তেমনই, ‘রাগের কারণ’। তাঁরা নিজেকে অনেক সময় ‘রাগের মানুষ’ বলেও উল্লেখ করে থাকেন। যা ‘মনের মানুষের নামান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়।

গানে ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ ধরবার জন্য ‘ত্রিবেণীর উত্তর দক্ষিণ দিকে যেতে বলা হয়েছে। ‘ত্রিবেণী’ বাউলের কাছে তিন নদীর নামান্তর। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী নদীরূপী তিনি নাড়ি ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না। শুধু বাউল সাধক নন, তন্ত্র তথা আমাদের যোগশাস্ত্র এই তিন নাড়িকে নদীনামের শিরোপা দিয়ে ‘ত্রিবেণী’ বা ‘ত্রিকূট’ বলে অভিহিত করেছে। বাউল অবশ্য ‘ত্রিকুট’ বলেন না। প্রধান চোদ্দ নামই আমাদের চোদ্দটি নদীর নামেই। চোদ্দ নাড়ি কী কী? ‘সুষুড়ো পিঙ্গলা চ গান্ধারী হস্তি জিত্বিকা। / কুহূঃ সরস্বতী পূষা শঙ্খিনী চ পয়স্বিনী। / বারুণ্যলয়ুষা চৈব বিশ্বোদরী যশস্বিনী। / এতাসু তিম্রো মুখ্যাঃ সুঃ পিঙ্গলেড়াসুষুমিকাঃ।।’ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, গান্ধারী, হস্তিজিহ্বা, কুহু, সরস্বতী, পূষা, শঙ্খিনী, পয়স্বিনী, বারুণী, অলম্বুষা, বিশ্বোদরী ও যশস্বিনী–এই চোদ্দটি নাড়ির মধ্যে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না প্রধান। সাধক এই চোদ্দ নাড়িকে বলছেন পূণ্যনদী। তিনটি নাড়ির নদীনাম বলে ফেলেছি আমরা। বাকি এগারোটি নাড়ির নদী নাম হল–গান্ধারী = কাবেরী, হস্তিজিহ্বা = সিন্ধু, কুহু = নর্মদা, পূষা = তাম্রপর্ণী, শঙ্খিনী = তাপ্তী, পয়স্বিনী = গোদাবরী, বারুণী = চন্দ্রভাগা, অলম্বুষা = গোমতী, বিশ্বোদরী = বিতস্তা, যশস্বিনী = ইরাবতী। সাধক বলেন গঙ্গারূপা ইড়া, যমুনাস্বরূপা পিঙ্গলা আর সরস্বতীরূপিণী সুষুম্না। আজ্ঞাচক্রের উপরে ত্রিবেণী বা ত্রিকূট রূপের প্রতীকী স্থানে মিলিত হয়েছে। এই তিন নদীরূপী নাড়িতে সাধক যোগক্রিয়ায় বাহ্যস্নান সারেন প্রতিনিয়ত। এলাহাবাদের ত্রিবেণীতে স্নানে যে পূণ্য এই বাহ্যস্নানেও সাধকগণ একইরকম পূণ্যফল লাভ করে থাকেন। বাউল সাধকও তাই বিশ্বাস করেন। তন্ত্রমতে ইড়াকে চন্দ্রস্বরূপা, পিঙ্গলাকে সূর্যস্বরূপা এবং সুষুম্নাকে চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নিস্বরূপা হিসাবে দেখা হয়। আর এই তিন নাড়িতেই সত্ত্ব, রজ, তম এই তিনটি গুণ বিরাজমান।

ফকিরের গাওয়া গানের মধ্যেও রয়েছে তারই যথার্থ সংকেত। পূর্ণিমার চাঁদ ধরার জন্য ‘ত্রিবেণীর উত্তর দক্ষিণ’ দিকে চেয়ে দেখতে বলা হয়েছে। ‘ত্রিবেণী’ তিন নাড়িরূপী নদীর মিলনক্ষেত্র। সুষুম্না নাড়ি মূলাধার থেকে উৎপন্ন হয়ে একেবারে ব্রহ্মরন্ধ্র। পর্যন্ত গিয়েছে। ব্রহ্মরন্ধ্রে শরীরের শেষচক্র সহস্রারের স্থান। সুষুম্নার বাঁ দিকে রয়েছে ইড়া আর পিঙ্গলা ডান দিকে। ত্রিবেণীর উত্তরদিক বলতে ইড়া এবং দক্ষিণ দিক বলতে সুষুম্নাকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন পদকর্তা প্রতীকী ভাষাতে। ‘রবি শশি দুই কিনারে’ মানে হল ইড়াতে চন্দ্রের স্থান আর সুষুম্নাতে সূর্যের স্থান। যার কথা প্রতীকময়তার ইঙ্গিত আমরা কিছু আগে বলে নিয়েছি। পদকর্তা বলেছেন: ‘বাপের ঘরে রবির কিরণ/ শশির ঘরে মার দর্শন / তোরা দেখতে পেলে হবি সৃজন / বাছাধন তাই চিনে নেরে।’ বাপ–মা এখানে পুরুষ আর প্রকৃতি। যুগলদেহ। সাধক ও সাধন সঙ্গিনী। বাপকে সূর্যের প্রতীকে রাখা হয়েছে, মাকে চন্দ্রপ্রতীকে। কারণ ইড়াতে চন্দ্র আর পিঙ্গলাতে সূর্যের অবস্থান বলে। পদকর্তা বা সাধক এ নির্দেশ দিচ্ছেন শিষ্যকেই। সেজন্যই বলা হয়েছে গানে ‘তোরা দেখতে পেলে হবি সৃজন’। সৃজন হল যুগলসাধনের জন্য প্রাণোচ্ছ্বসিত সৃষ্টিবলয়। একত্র সাধনার ইঙ্গিত। বাছাধন’ বলে শিষ্যকে সে সাধনায় নামবার জন্যই বিধিকল্প বেঁধে দিয়েছেন গানে। যার জন্যই চক্রকে চেনার ইঙ্গিত–’কি করে চিনি চক্ররে’। কেন না চক্রের ভেতরেও তো চাঁদ আছে।

কীভাবে রয়েছে সেই চাঁদ? কোন্ অবস্থাতে শক্তির কলাকৃতিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে চাঁদ? সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক। চাঁদ রয়েছে বিশুদ্ধ আর সহস্রার চক্রে। বিশুদ্ধ চক্রে শাকিনী শক্তির কল্পনা করে থাকেন দেহসাধক। তিনি কিন্তু আবার চন্দ্রের মতো শুক্লবর্ণা। আর এই চক্রতেই চন্দ্রমণ্ডলকেও কল্পনা করে বসেন সাধক। বিশুদ্ধ চক্রের পকে দ্বিদলের রূপ দেওয়া হয়েছে। এই দুটো দলই আবার চাঁদের মতোই শ্বেতবর্ণ। সহস্রারে কলঙ্করহিত শুদ্ধ চাঁদের অবস্থান। এই চক্রের সহস্রদল পদ্ম সম্পর্কে নানা বিশেষণ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে এই সহস্রার থেকেই আনন্দপ্রবাহ নির্গত হয় সাধকদের উদ্দেশ্যে: ‘সুধাধারাসারং নিরবধি বিমুঞ্চন্নতিতরাং / যতেঃ স্বাত্মজ্ঞানং দিশতি ভগবান নির্মলমতেঃ। / সমাস্তে সৰ্ব্বেশঃ সকল-সুখ-সন্তান-লহরী/ পরিবাহো হংসঃ পরম ইতি নাম্ন পরিচিতঃ।।’ যিনি নিরন্তর সাধকজনের প্রতি অমৃতধারা রূপ সারবস্তু বা চন্দ্র থেকে নিঃসৃত শুক্লবর্ণ অমৃতকিরণ অতিমাত্রায় বর্ষণ করতে করতেই স্বাত্মজ্ঞান (জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভেদ জ্ঞানকারক তারক ব্রহ্ম মন্ত্র) উপদেশ দিচ্ছেন। যা সকলের অধীশ্বর এবং সর্ব রকম সুখের বিস্তার স্বরূপ লহরীর নিঝর রূপ, সেই পরমহংস নামে পরিচিত ভগবান পরম শিব সহস্রদল পদ্মে অবস্থান করেন। সাধকগন তাঁর ধ্যানেই সদা নিমগ্ন থাকেন। আর এই পদ্মতেই চন্দ্রের অমানামে সেই প্রসিদ্ধা ষোড়শী কলা আছেন–’অত্রাস্তে শিশুসূৰ্য্য সোদরকলা চন্দ্রস্য সা ষোড়শী’। এই পদ্মতেই ইষ্টচৈতন্য স্বরূপের বিকাশ ঘটে। বোধদয় হয়। বলা হয় এর আকৃতি অর্ধচন্দ্রের মতো বক্র।

তাহলে দেখা যাচ্ছে শরীরের মধ্যেই আমাদের চন্দ্রের বসবাস। যে চন্দ্র শরীরের সবকটি, বিশেষত প্রধান তিন নাড়ির সঙ্গে সর্বদাই ফিসফাস করছে। কথা বলছে। সেজন্যই ফকির আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি চাঁদের সঙ্গে কতা কন না? কন কন। ফকিরের সেই চাঁদের কথাবার্তা আমাদের শরীরের ভেতরে চলতে পারে কিন্তু প্রতিনিয়তই। তবে যোগক্রিয়াতে সেটা একমাত্র সম্ভবপর। গানে সেজন্যই চক্ৰচেনার কথা বলা হয়েছে। ‘যা উদর ভরে আধ অক্ষরে’ রয়েছে। অর্থাৎ কিনা শরীরের অভ্যন্তরে অচেনা অবস্থাতে রয়েছে। এজন্যই পদকর্তা বলেছেন-’কি করে চিনি চক্ররে’। বলেছেন–’তোরা। রুহিনির চাঁদ ধরবি যদি/ ফাঁদ পেতে নে হৃদয়পুরে’। ‘রুহিনি’ কথার অর্থ কী? ‘রুহিনি’ হল আত্মা, নিজের ভেতরজাত অংশও বলতে পারি। তাকে চিনতেই ফাঁদ পাততে বলা হয়েছে ‘হৃদয়পুরে’।

বাউলের দৈগন্তিক প্রসারকে এভাবেও আমরা দেখতে চাইছি এখানে, গানের শঙ্খিনীমালার সৌন্দর্যে শরীরের মধ্যবর্তী ছায়ার অপরূপকে খুলে ফেলে তার থেকে চকিত বিপর্যয়ের ঢেউ নিয়ে উদ্দীপ্ত সমুদ্রে স্নান করতে চাইছি বারবার। যে স্নানে চাঁদের মর্মস্পর্শী পটভূমিকা রয়েছে। তার জন্যই ফকির গাইছেন–শাহা শির আলির হৃদয়পুরে। কেনে রয়েছ ঘুমের ঘোরে / ও তোর প্রেমের কক্ষে দেখনা চেয়ে/ তোর নগরচাঁদ নগরের পরে। ‘হৃদয়পুর’ হল শরীরের সদর অন্দর। উপলব্ধর প্রতীকী সুগভীর গূঢ়ার্থ। ‘প্রেমের কক্ষ’ যুগল শরীরের মত্ততা। সাধকের মতো ভাবের প্রতিফলনের কুঠুরি। ‘নগর’ হল শরীর। ‘নগরের চাঁদ’ শরীরের চন্দ্ররূপী নাড়ির জাগরণ। যার ফলে সাধকের মনে সাধনা বহত্যা-বিস্তারী শক্তি ঘোরাফেরা করে। যে শক্তি; চাঁদ চিনতে পাড়ার এই কলাকৌশলই একদিন সাধককে সিদ্ধস্তরে ঠেলে দেবে।

ফকির আরেকটি গানও আমাদের শুনিয়েছিলেন। সে গানেও চাঁদের কথা রয়েছে। বহুশ্রুত লালনের পদ এটি। বহু বাউলই প্রতিনিয়ত এটা গেয়ে থাকেন। বাউল মোচ্ছব ও মেলাতে এলে এ গান শোনাই যায়। কতবার যে কতজনের মুখে শুনেছি এ গান। মনে আছে সোনামার আশ্রমে এক সন্ধ্যায় আমির চাঁদ ফকিরের মুখে শুনেছিলাম এ গান। চৈত্রের হাওয়ায় বালিউড়াতে তাঁর চুলদাড়ি নড়ছে। বাঁশের খুঁটিতে হেলান খেয়ে বয়স্ক মানুষটি গাইছেন–’সে কথা কি কইবার কথা জানিতে হয় ভাবাবেশে/ অমাবস্যা পূর্ণিমা সে পূর্ণিমা সে অমাবস্যে’।

বাউলের কাছে অমাবস্যাই পূর্ণিমা হয়ে ওঠে। পদকর্তা তাই বলেছেন–‘পূর্ণিমা সে অমাবস্যে।‘ কীভাবে পূর্ণিমা অমাবস্যা হয়ে যাচ্ছে আর অমাবস্যাই হয়ে উঠছে পূর্ণিমা? পূর্ণিমার চাঁদ ‘পূর্ণচন্দ্র’ বাউলের হল প্রেম। এই প্রেম আসে চন্দ্ৰসাধনায়। গোপালের গানে ইঙ্গিতময়তার মধ্যে উঠে এসে চন্দ্ৰসাধনা–’চন্দ্ৰসাধন কর রে মন সময় থাকিতে/ সময় গেলে শের পটকালে হবে না তাই আখেরেতে।।’ ‘চন্দ্রসাধন’ কী? চাঁদ নিয়ে উপাসনা? অবশ্যই তাই। বাউল চাঁদ খায়, চাঁদ মাখে। চাঁদের বেসাতি তৈরি করে বাউল। কীভাবে তা হয়? বাউলের ‘চন্দ্র’র নানারূপ আছে। চাঁদকে তারা প্রতীকময়তার ভেতর রেখে হেঁয়ালি তৈরি করেন শুধু। ‘চন্দ্র’ তাঁদের বাঁ নাক। পূর্ণচন্দ্র প্রেম, আবার ‘শুক্র’ বলতেও বাউল অনেক সময় চাঁদকে ইঙ্গিত করেন। চন্দ্র বলতে তাঁরা আবার সাধন লব্ধ আত্মজ্ঞানকেও সামনে রাখেন। ‘চারভূত’-ও বাউলের চন্দ্র। ‘চারিচন্দ্র’। মল, মূত্র, রজ, শুক্র। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম–এই পাঁচটি পঞ্চভূত। চারভূত তাঁদের ‘চারিচন্দ্র’। তবে ফকিররা কিন্তু চারভূত বলতে বৈদিক মতের পঞ্চভূতকে একেবারে মানেন না।

আমির চাঁদ ফকির বলেছিলেন, চারভূত হল গিয়ে আব, আতস, জল, আগুন, মাটি ও বাতাস।

ফজর শাহ জলকে জানিয়েছিলেন খাক বাত বলে।

তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাউল ফকিরে পার্থক্যটা কী?

বললেন, পার্থক্য কিছু নেই খ্যাপা। যা আছে সব তৈরি করা। মুর্শিদ আর কৃষ্ণ আলাদা নাকি খ্যাপা! সব এক। সব শরীরের উদরে রয়েছেন।

আমির চাঁদ বলেছিলেন, ফকিরিতে নানাবিধ সাধনা আছে। কোনটা করবা তুমি। যুগল আছে, পৃথক আছে, দমের সাধনা আছে। বস্তুরও আছে।

চারচন্দ্রের সাধনা ফকির করে? জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি।

–করে, করে না। মানে, মানে না। সব আছে গো। আসল হল গিয়ে নিজেরে জানা। তা তুমি চার-পাঁচ যে চন্দ্রই বল বাপু নিজেরে না বুঝলে কিছুই হবে না। নবী কে গো?

–কে?

–নবী হল গিয়ে আমি নিজে।

ঘোষপাড়ার নবকুমার দাসকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম চারচন্দ্রের কথা। নিত্যানন্দ বালা, নরোত্তম দাসকে বললে কিছুই বলেননি তাঁরা। নরোত্তম গান গেয়ে শুনিয়েছিলাম। যেটি শুনিয়েছিলাম আমার বেশ চেনা গান। প্রথমে গুনগুন করেই গাইছিলেন বাউল। শিষ্য (বাজনদার) একতারাতে সুর দিতেই গাইলেন। দরাজ গলায় বাউল বাড়ি (আখড়া) ম ম করতে থাকল চাঁদেরই গন্ধে।

দিন-দুপুরে চাঁদের উদয় রাত পোহান ভার।
হলো অমাবস্যায় পূর্ণিমার চাঁদ তের প্রহর অন্ধকার।।
সূর্য-মামা মরে গেছে বুকে মেরে শূল,
বামুনপাড়ায় কায়েতবুড়ি মাথায় বইছে চুল।
আবার কামরূপেরে কাকা ম’ল,
কাশীধামে হাহাকার।
ময়রা-মামীর কুলের স্বামী বসে রয়েছে,
তার গর্ভেতে তিন জনার জন্ম হয়েছে।
আবার ভাদ্র-মাসের তেরোয় পৌষে
চড়ক-পূজার দিন এবার।।
বৃন্দাবনে বলছে বামী বোষ্টমী–
একাদশীর দিনে হবে জন্মাষ্টমী।
আবার রাজবাড়ীতে টাট্ট ঘোড়ার
সিং বেরিয়েছে দু’টো তার।।
গোঁসাই পোদয় কয় ভেবে এবার,
কথা শুনতে চমৎকার,
সাধক বিনে বুঝতে পারে
এমন সাধ্য কার।
কথা যে বুঝেছে, সেই মজেছে,
গিয়েছে সে বেদের পার।।

গান শেষে থামলেন বাউল। বললেন, লাইনে না এলে এর মানে জানা যাবে না। একটু ঘোরাফেরা করেন, ঠিক একদিন জেনে যাবেন। আমাকে আর শুধতে হবে না।

হাসলেন বাউল।

বললেন, দীক্ষা হয়েছে?

বললাম, না।

আগে চট করে দীক্ষাটা নিয়ে ফেলুন। তাহলেই দেখবেন অনুরাগ আসবে।

নবকুমার দাসকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, চারচন্দ্র সম্বন্ধে আপনার অনুভূতি কী?

প্রথম প্রথম শুধু চারচন্দ্র কেন, নবকুমার আমার কোনও প্রশ্নেরই সেইভাবে জবাব দিতেন না। বিরক্ত প্রকাশ করতেন। ভাবখানা এমন এখানে না আসলেই পারেন। ওদিকে যখন অত যাতায়াত তাহলে ওখানে গিয়েই মেটান না কৌতুহলী জিজ্ঞাসা সব। তবে আমি রাগ করতাম না। বুঝতাম বিষয়টা হয়তো পছন্দ করছেন না নবকুমার। কিন্তু কোনওদিন এই বিষয়ে তিনি আমাকে কটু কথা বলেননি। বাউল সমাজে মিশে এটা বুঝেছি সেখানে তাঁদের ভেতরে নানা অরাজকতা থাকলেও তাঁরা বাইরের মানুষদের প্রাপ্য অতিথির সম্মান দেন।

দুপুরের ঠাঠাপোড়া রোদে মাটিয়ারী গিয়ে মহিলা বাউল বিশেষত কৃষ্ণা দাসীর সম্পর্কে; তাঁর গান বিষয়ে নানা কথা এলে মীরা মার উত্তেজিত সুর সব মনে আছে।

বলেছিলেন, মেয়েদের আখড়া ছাড়া, আশ্রম ছাড়া গান গাওয়া অপরাধ। এই সব মেয়েরা বাউল মতের কলঙ্ক।

বলেছিলাম, বাউল যদি অনুষ্ঠানে গাইতে পারে তাহলে মহিলা বাউলরা গাইতে পারবেন না কেন?

রেগে উঠেছিলেন তিনি।

বললেন, বাউল মতের বোঝ কী তুমি গান কি বাউলের পথ?

মীরা মা’কে বোঝাতে পারিনি গানই এখন বাউল-পথ। বাউলরাই তাই করে নিয়েছে। বাউল এখন আর নিভৃত সাধনার বিষয় নেই। আলো, প্রচারের জন্য সেও যা নয় তাই করে ফিরছে।

মা বললেন, মেয়েদের কাজ হল সাধুসঙ্গ করা। বাউলকে এগিয়ে দেওয়া বাউল মত কে, পথকে প্রতিষ্ঠা করা। ধরে রাখা।

বলে যাচ্ছেন মীরা মা–নবকুমার জাত বাউল। ও তো ওর সাধনসঙ্গিনী ছিল। এখন সাধন ভুলে গান ধরেছে। মেয়েরা নেচেকুঁদে গাইবে কেন? আখড়ায় গাইতে পারে। মেয়েদের কাজ হল সাধনভজন করা।

খুবই ঝাঝি দিয়ে কথা বলছেন মীরা মা। আমি চুপ। শুনে যাচ্ছি। কথা বলছি না। ভাবছি শুধু তাঁর বিশ্বাসের আসন টলাবে কে শুনি! কতজন সাধক বাউল আছেন এখন। যারা আছেন তাঁরা সাধনাতে কতটা বা আগ্রহী! গান, প্রচার, বিদেশ যাত্রার তদবির নিয়ে অনেকে ব্যস্ত। মেয়েরা এর ভেতর কতটা সাধুসঙ্গ পাচ্ছে। সাধুই নেই, সাধকই নেই তার আবার সঙ্গ। সঙ্গিনীর সঙ্গে সাধক জীবন তো এখন ব্যাভিচারে, অনাচারে হয়ে উঠেছে। পাশ্চাত্যের তথাকথিত live together

নবকুমার কৃষ্ণাকে ছেড়ে নতুন সঙ্গিনী জুটিয়ে নিয়েছেন। কৃষ্ণা সে সময় মেয়ে নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছিলেন। আমাকে তার দুঃখের কথা, সংগ্রাম জানিয়েছিলেন তিনি।

বলেছিলেন, জানো তো প্রথম-প্রথম প্রোগ্রাম হত না। সে নষ্ট করে দিত। তখন এখনকার মানুষটি পাশে না দাঁড়ালে ভেসে যেতাম আমি।

জানি কৃষ্ণা এখন সহৃদয় এক মানুষের দেখা পেয়েছেন। যিনি তাঁকে ঘর দিয়েছেন, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। কৃষ্ণার এখন বড় দল। বেশ কয়েকজন গায়ক বাউল, বাজনদার নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান আখড়া-মচ্ছবে, অনুষ্ঠানে। রেডিও টিভিতে অনুষ্ঠানের ডাকও পান তিনি। তাঁর মানুষটা যদিও বাউল সমাজের কেউ না। তবু আমি বলব কৃষ্ণার বিপদে তিনি তো যোগ্য মানুষের মতো পাশে দাঁড়িয়েছেন। গানই এখন কৃষ্ণার সাধনা।

যদিও গল্প রটে। সে গল্প কী আশাকরি কাউকেই বলে বোঝাতে হবে না। কিন্তু আশ্চর্যের! কৃষ্ণার পাড়াতে তাঁর যথাযোগ্য সম্মান রয়েছে। যখন প্রথম যাই খোঁজে, জানতাম নবকুমারের সঙ্গিনী কৃষ্ণা। সেইমতো একে-তাকে বলতেই সকলে একবাক্যে বলেছিলেন কৃষ্ণা তাঁর সাথে আর থাকেন না।

কে কাকে ছেড়েছেন অন্য প্রশ্ন। কৃষ্ণা কখনো কোনওদিন নবকুমার সম্পর্কে খারাপ কথা আমাকে বলেননি। আবার নবকুমারও নন। প্রথম-প্রথম তাঁকে বোধহয় কেউ ভুল বুঝিয়ে ছিল। বাউলের আগ্রহী মানুষ জেনে শেষে তিনি অদ্যাবধি মধুর সম্পর্কই রেখে চলেছেন।

মীরা মা সেদিন চড়া সুরে আমার সঙ্গে কথা বললেও বলেছিলেন, নাও বেলপানাটা খেয়ে নাও আগে। যা গরম। শরীর জুড়োবে। খাও আগে। ওসব পরে হবে। নিজে হাতে আমাকে বাতাস করেছিলেন তিনি একেবারে হাসে মুখে। তখন কোথায় তাঁর রাগ। একেবারে বাড়ির মা মাসিমা মনে হচ্ছিল তাঁকে। তিনি কাকা গোঁসাইয়ের সাধন সঙ্গিনী ছিলেন। শুনেছি গোঁসাই ছিলেন সিদ্ধ সাধক। দেহ রাখার পর মীরা মা তাঁর আশ্রমের দায়ভার নিয়ে আছেন। ভক্ত-শিষ্য সকলের মা তিনি। আখড়া করেন অগ্রদ্বীপের মেলায় প্রতি বছর। তাঁর আখড়া ঘিরে বিশিষ্ট বাউলদের সব জমায়েত হয়। আশ্রমে তত্ত্বকথা শুনিয়ে, সাধনার গান গেয়ে তিনি বেশ মর্যাদার সঙ্গে দিন কাটান। বাউলের প্রচার-খ্যাতি ব্যাভিচার এসব নিয়ে তাঁর হেলদোল নেই একেবারে। ভাবে মজে থাকেন। সেজন্য তিনি বর্তমান বাউল সমাজের যোজন হাত দূরে। তাই তাঁর বিশ্বাস এখনও কাকা গোঁসাইয়ের ভাবধারার। বাউলের অবক্ষয়, অবনতি এসবে তাঁর কলরব সেই এখনও প্রাচীন পন্থাতেই পড়ে। মেয়েরা সাধন সঙ্গিনী হয়ে সাধকের অতলস্পর্শকেই শুধু ছোঁবে। গান করবে কী! তাঁর মুখেই নবাসনের নির্মলা মার কথা শুনেছিলাম। মীরাকে মনে হয়েছিল নির্মলা মা’র প্রজ্ঞা নিয়েই যেন দাঁড়িয়ে আছেন তিনি মাটিয়ারীর বটের ছায়ায়।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সাধনায় মেয়েদের স্থান কতটুকু?

রেগে উঠলেন মা।

কতটুকু মানে। মেয়ে না হলে সাধন হবে? মেয়েরা হল গিয়ে সরোবর। সাধক সেখানে স্নান সারেন। সিদ্ধ হন।

মেয়েদের তবে সিদ্ধতা আসে না? তাঁরা সাধন সঙ্গিনীই কেবল?

বেশ রেগে উঠলেন মা।

কে বলেছে আবোল তাবোল?

বললাম, না সাধনায় সাধকেরা তো উর্ধগামী করে দিতে পারেন বস্তুকে।

বলতে দিলেন না মা।

বললেন, তা বস্তু উর্ধগামী করতে সাহায্য করে কে? মেয়েরা যদি শ্বাস, দমের কাজ না শেখে সে পারবে? কীভাবে উর্ধগামী হবে শুনি! যত আজেবাজে কথা।

জানি আমার দৃষ্টিভঙ্গি মনোপুত হচ্ছে না মা’র।

বললেন, মেয়েরা সমান তালে যোগ করে। রেচক, পূরক, কুম্ভক সব করে।

মা’কে বলতে পারলাম না আমি, তা নয় করল, করে সাধক সিদ্ধ হল, নাম রটল তাঁর। তাতে হল কী সঙ্গিনীর? সে তো আর সিদ্ধ আসন পেল না। সে যে কেবল সাধন সঙ্গিনী। বুঝলাম মীরা দাপুটে বলে প্রাপ্য সম্মান আদায় করে নিতে পারেন। কিন্তু সবাই তো আর মীরা মোহান্ত নন, বা মীরার বলা নির্মলা মা নন, তাহলে তাঁদের অবস্থান। কি? আর সেই অবস্থান চিহ্নিত করতেই এখন মেয়েরা সাধক নন গানের সঙ্গে বসবাস করছেন। গান গাইছেন। অনুষ্ঠান করছেন। বাউলের ধার ধারছেন না। অনেক দিনের বঞ্চনার ফলে এটা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক। মীরা মা এসব আঁচ থেকে দূরে গুরুমা, মা গোঁসাইয়ের জীবনধারণ করছেন তাই মেয়েদের অসহায়তা তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। তাঁর ভাব সাধক বাউলের যথার্থ সঙ্গিনীর ভাব। নির্মলা মারও তাই হবে মীরা মার মুখে যতটা শুনেছি সেই ভিত্তিতেই বললাম।

একদিন বেশ ঠাণ্ডা মেজাজে পেয়েছিলাম নবকুমারকে। গরিফায় এক অনুষ্ঠানে গাইবার আগে কথা চলছিল।

বললেন, আমাদের শরীরে তো নিয়ত চন্দ্রের চলাচল। চন্দ্র হল শীতলতা।

কীসের? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

কীসের আবার, সিদ্ধির।

কীভাবে আসবে এই সিদ্ধি? বললাম।

চন্দ্রতত্ত্বে আসবে তা। শরীরের মধ্যে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র আছে। যুগলে অমাবস্যাতে এই সাড়ে চব্বিশকে ধরতে-ঘঁতে–জানতে-বুঝতে হবে। তারপর জোয়ার নামবে।

আর কিছু বলতে চাইলেন না নবকুমার।

বললেন, একদিন আসেন। সেখানে হবে খোন। এই হাটে-মাঠে তত্ত্ব হয়? হয় না।

ইতিমধ্যে ডাক পড়ল তাঁর। বাজনদাররা উঠে মঞ্চের দিকে এগোতে লাগলেন। নবকুমার পায়ে ঘুঙুর জোড়া বাঁধতে বসলেন।

আমাদের ঝম ঝম চন্দ্রের ওখানেই ইতি হয়ে গেল।

*****

রজঃপ্রবাহকে বাউল বলেন রজঃস্নান। এই স্নানের চারটি গালভরা নামও আছে। গরল, উন্মাদ, রোহিনী, বাণ। চার নামই স্পষ্ট করে রজঃযোগ চারদিন। প্রথমদিন গরল। মানে হল বিষ। সেই বিষকেই সাধক সুধা করে দেন। দ্বিতীয় দিন উন্মাদ। বাউল বলেন জোয়ার শুরু হল। একে তাঁরা অমাবস্যাও বলে থাকেন। ঘোর অমাবস্যার তৃতীয় দিন। রোহিণী। রোহিণী কিন্তু চাঁদ প্রতীকের সামঞ্জস্যতা রাখছে। চন্দ্ৰপত্নী হলেন রোহিণী। বাউলের চন্দ্রনাড়ি জাগছে আর চন্দ্রপত্নী তৃতীয় দিনে যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে সাধককে সাহায্য করছেন। সাধক চতুর্থ দিনে বাণে সিদ্ধ হচ্ছেন। বাণ বলতে কিন্তু বাউল লিঙ্গকে চিহ্নিত করেন। এই বাণকে উৰ্দ্ধরেতা দেন সাধক। বীর্য নিম্নগতি পায় না। তবে এই চারটিকে রজঃস্নানের চারটি দিনের রজঃপাতের নাম হিসাবেই দেখেন তাঁরা। স্নাননাম যদিও অনেকে বলেন। এই বৈপরিত্য গুরু অভিহিতের ফল। গুরু যেমন বলে থাকেন সাধককে, সাধক বাউল সেভাবে, সে নামে চিহ্নিত অরে থাকেন। ‘চারিচন্দ্র’ বলতে অনেকে আবার মল, মূত্র, রজ, শুক্র না বলে বলেন আদি, নিজ, উন্মত্ত, গরল। আদি হল আমিসত্ত্বা। নিজ হল নিজের মল-মূত্র। উন্মত্ত হল সঙ্গিনীর রজ। গরল হল গিয়ে শুক্র। বীর্যকেই তাঁরা অমৃত করে নেন, মানে বীর্যকে উধ্বপ্রবাহ দিয়ে ‘অধর মানুষ’, ‘অটল মানুষ’ হয়ে যান। অধর, অটল হল সিদ্ধ স্তরের দশা। স্কুল, প্রবর্ত, সাধক পেরিয়ে সিদ্ধ স্তরে তিনি ব্যক্তির উচ্ছ্বাস ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সহজ হয়ে ভক্ত শিষ্যদের সামনে নিমগ্নতার আততিকে তুলে ধরেন। মত বিনিময় করেন।

সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র হল করনখে দশ, পদনখে দশ, দুই গলায় দুই, অধরে এক, জিভে এক, কপালে দেড়। অষ্টম চন্দ্র বা অষ্টম ইন্দুর কথাও বলে থাকেন বাউল। ‘অষ্টম চন্দ্র’ হল মুখ এক, স্তন দুই, হাত দুই, বুক এক, নাভি এক, যোনি এক।

প্রশ্ন হল সংখ্যা চিহ্নিত এই প্রত্যঙ্গগুলোতে কী কাজ হয়ে থাকে? দেহ যখন দেহাতীত হয়ে ওঠে; বস্তুঙ্খলন থেকে উর্ধ্বে বিরাজ করে দেহ, রজঃবীজের নিয়ন্ত্রণ চলে এসে দেহ সংবৃত নির্জন হয়ে পড়ে যুগল মিলনে তখন সাধক ও সঙ্গিনীর এই সব প্রত্যঙ্গ মারফৎ স্বকীয় মৃত্যু ঘটে। এখানে চুম্বনে আত্মবিস্মৃত মগ্নতা আসসে। সাধক ও সঙ্গিনী ভুলে যান নিজস্বতা। সঙ্গমরত মানবশরীর সঙ্গমের ঊর্ধ্বে উঠে উপমেয়কেই যেন খুঁজে পায়। উপমেয় হল বাউল মতে, কামের মধ্য থেকে কামকে হেঁটে বাদ দিয়ে নিষ্কামী হওয়া। আর কামকে বাদ দেবার সাধনা গুরুই শেখান। সেজন্যই তা হল রপ্ত এক কৌশল। যে কৌশলে ‘সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র’ ও ‘অষ্টম চন্দ্রের’ ব্যবহার অনিবার্য। এগুলো সবই সঙ্গমের। উপান্ত দশায় এসে গুরু নির্দেশিত সব পূর্ণচ্ছেদ। অমোঘ টানে বা আকর্ষণে প্রত্যঙ্গের ওসব স্থানে কখনও সংখ্যাচিহ্নিত চুম্বন, স্পর্শ ইত্যাদি কোনওভাবে সম্ভবপর নয়। এগুলোকে গুরুর সুমুদ্রিত স্বাক্ষর হিসাবেই শুধু দেখা ভালো। তবে ঊধ্বরেতা যথেষ্টই শরীর রপ্তের কাজ। কঠোর যোগসাধন না হলে তা হবে না। কী তন্ত্রে, কী বাউলে, দেহ সাধনায় সাধক সঙ্গমস্থ দশায় বীর্যকে উর্ধেরেতা দান করেন। তবে সন্ন্যাসী তো আর শরীর ছোঁন না, তাঁরা বলেন স্ত্রীসঙ্গে বিন্দুনাশ হয়। বিন্দুনাশ হলে আত্মক্ষয় ও সামর্থহীনতা আসে–’যদি সঙ্গং করোতেব বিন্দুস্তস্য বিনশ্যতি। আত্মক্ষয়ে বিন্দুহানাদসামর্থঞ্চ জায়তে।।‘ ‘পীত্বা মোহময়ীং প্রমোদমদিরামুন্মত্তীভূতং জগৎ’। ভর্তৃহরি এই কথা বলেছেন। বলেছেন মোহময়ী। প্রমোদরূপ মদিরা পান করে এই অনন্ত জগৎ উন্মত্ত হয়ে আছে। ‘ভগেন চৰ্ম্মকুণ্ডেন। দুর্গন্ধেন ব্রণেন চ। / খণ্ডিতং হি জগৎ সৰ্ব্বং সদেবাসুরমানুষ।।‘ এই আকর্ষণ থেকে। উদ্ধার পাবার পথ কী? অভ্যাস আর সংযম। সন্ন্যাসী তা রপ্ত করেন। তাঁরা ব্রহ্মবস্তু বলেন বীর্যকে। শরীরে তা আছে বলেই আনন্দ। যোগসাধনে বিন্দুধারণ না হলে উন্নতি সম্ভবপর। নয় কখনোই। ‘যোগিনস্তস্য সিদ্ধিঃ স্যাৎ সততং বিন্দুধারণাৎ।’ সতত বিন্দুধারণ করলে। যোগীগণের সিদ্ধি হয়। তাঁরা বলেন বীর্য সঞ্চিত হলে পরে মস্তিষ্কে প্রবল শক্তি সঞ্চয় হয়। এই শক্তির বলে একাগ্রতা সাধন হয়। সাধক অনেক উপরে উঠতে পারেন। সংসার ছাড়ার কথা বলেন সন্ন্যাসী। অর্থাৎ সংসারের ‘সং’ ছেড়ে ‘সার’কে গ্রহণ করতে বলেন তাঁরা। দুরাশার অন্ধকারে না ডুবে অসার রূপে ‘সং’ না সেজে ‘সার’ হয়ে সংসারে আশার সুধা ভরার কথা বলে থাকেন তাঁরা। সংসারে সার প্রসার করতে বলেন তাঁরা। অর্থাৎ শরীরের যোগ শরীরের উপাদানকে শরীরে রেখে শরীরকে পাশব-বাসনা থেকে মুক্ত রাখেন তাঁরা।

যুগল সাধনে ‘সার’ গ্রহণ হয় ঠিকই কিন্তু সংসারের ‘সং’ কিছু থাকে ঠিক। সে অন্যত্র আলোচিত বিষয়। বাউল তাঁর শরীর সংবেদিতার মন্ত্র বলে থাকেন গানে। যেমন লালন বলেছেন–’না জেনে করণ কারণ কথায় কথায় কি হবে/ কথায় যদি ফলে কৃষি তবে বীজ কেন রোপে? / গুড় বললে কি মুখ মিঠা হয়/ দিন না জানতে আঁধার কি যায়/ তেমনি জেনো হরি বলায় হরি কি পাবে।

বাউলের পৃথিবী এই পাওয়ার প্রতীকী উত্তরাধিকারকে সবসময় ধরে রাখে গানে। গান তাই বাউলের সাধন অনুভূতির ভাষা। গান তাঁর যথাযোগ্য আলোরই বৈরাগ্য। সেদিকেই আমরা মুখ ফেরাব।

পদকর্তা বলেছেন : ‘অমাবস্যায় পূর্ণিমা যোগে আজব-সম্ভব সম্ভোগ / জানলে খণ্ডে এ ভব রোগ / গতি হয় অখণ্ড দেশে।’

‘আজব-সম্ভব সম্ভোগ’ হল বাউলের কাম জয়ের সম্ভোগ। প্রেমে রূপান্তর হয় কাম তাঁদের ভাষায় ‘চন্দ্ৰসাধনা’ করলে। আর সিদ্ধিতে সাধকের স্থান হয় ‘অখণ্ড দেশে’। আর তার জন্যই সাধনভজন। গোপালের ‘চন্দ্ৰসাধন কর রে মন সময় থাকিতে’ গানটির কথা বলেছিলাম আমরা। গোপাল বলছেন সেখানে চারটি চন্দ্র মন আর পবন চার জা’গাতে চারের আসন / আর আতস খাক বাদে মিলন চলন চারেতে / লাল জরদ সিয়া সফেদ চারটি রঙেতে। / চার মঞ্জিলে খেলছে তারা রয়েছে চার হিকমতে। / চার কুতুব আর ষোল প্রহরী একশ আট চন্দ্র তাইতে ধরি / রয়েছে সব সারি সারি ধরাধরিতে।।/ অদ্য হয়ে সাড়ে চব্বিশ হয় জাহেরাতে /  সাড়ে চারকে সাধলে পাবি সিদ্ধি হবে চার যুগেতে।।’

চন্দ্রের কথা কিছু আগেও বলেছি আমরা। বাউলের চন্দ্রে আছে শরীরের বর্জ্য পদার্থ, বাঁ নাকের শ্বাস, বিভিন্ন দেহাঙ্গ, এমন কী নখ পর্যন্ত। এগুলোর সাহায্যেই তাঁরা চান্দ্র ঘটনাতে সামিল হন। ‘চান্দ্র ঘটনা’ হল সঙ্গিনীর রজঃপ্রবাহ। এই রজঃপ্রবাহের মধ্যেই চলে সাধনা। সাধনার সঙ্গী চার চন্দ্র–দুই বর্জ্য আর দুই শরীরের রজ-বীর্য। ‘মন আর পবন’ অর্থাৎ কিনা যুগল মনের একাত্মতা এবং যুগল বায়ু বাঁ শ্বাসের গুরু শেখানো রপ্তকৌশল। চার জায়গাতে চলে চারের আসন। চারটি জায়গা চারটি দিক–পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ আর চারের সাধন আদি, নিজ, উন্মত্ত, গরল–যা কিনা দুই বর্জ্য ও রজ বীর্যেরই মতান্তর। চার রঙ–জরদ, সফেদ, সিয়া, লাল–তা হলে রজের চারদিনে পরিবর্তিত রূপ। স্রোতধারার চারদিনে চার রঙ ধারণ করে রজ। মতান্তরে স্রোতধারা বা রজঃপ্রবাহের তিন দিনে দিন রঙের হয় সঙ্গিনীর রজ–সফেদ, সিয়া, লাল। চার কুতুব চারদিক। ‘ষোল জন প্রহরী’ হল–ষড়রিপু আর দু’ভাগের পাঁচ পাঁচ করে দশেন্দ্রিয়। ‘একশ আট চন্দ্র’–অষ্টম পাশের আট আর ছয় চক্রের পদ্ম পাপড়ির একত্র যোগফল। সেজন্য বলা রয়েছে রয়েছে সব সারি সারি। আমাদের শরীরকে স্থূল শরীর হিসাবে দেখে থাকেন প্রথমে বাউল সাধক। এই স্থূল দেহ ত্যাগ হলে আসে জ্যোর্তিদেহ। তারপর মানসদেহ ও নিমিত্ত দেহের প্রতিষ্ঠান। বিজ্ঞানেও কিন্তু এই তিন স্তরের উল্লেখ আমরা পাই। Astral body (জ্যোর্তিদেহ), Mentral body (মানসদেহ), Casual body (নিমিত্ত দেহ)। ছয়টি যে চক্র বললাম তা মানব শরীরে বর্তমান। ইংরাজিতে মানবদেহ বলা হচ্ছে হিউম্যান বিং। Human এর Hue রঙ বা Colour Being হল আলো বা light. Human Being faces oftco IGT colour menifextation in light সুতরাং এভাবে দেখলে দেহ রঙপেন্সিলের একটা বাক্স। তার আধারে ছটি চক্র। মূলাধার (Root), স্বাধিষ্ঠান (Abdomen), মণিপুর (Solar Plexus), অনাহত (Heart), বিশুদ্ধ (Throat), আজ্ঞা (Third Eye)। যেটা বোঝাতে চাইছি এই সব প্রতীকী কল্পনাতেও কিন্তু বিজ্ঞান রয়েছে। গাঠনিক সেই অভিধাকে মেনেই চক্ৰ কল্পিত প্রতীকী নামকে ধরে রেখেছে।

বাউল বলেন কারণবারি, রস বা রজ। যা দেহেরই অন্তর্গত পদার্থ বাউলের যে যুগলমিলন তা ঘটে কিন্তু জ্যোর্তিদেহে। বাউল যাকে প্রবর্ত স্তর বলেন আর কী। এই স্তরে তিনি শেখেন শ্বাসাদির কাজ, আসন। সাধক স্তরে যুগল দেহ বাউল মতের ‘ভাবদেহ’ হবার জন্য পাঠ গ্রহণ করে। এই হল মানস দেহ। সিদ্ধিস্তর বাউলের নিমিত্ত দেহ। বিজ্ঞানে, প্রাণে এই তিনাবস্থার উল্লেখ আছে কিন্তু। বাউলের যে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র সাধনা তা যুগল মিলনে সসীমকে আসলে অসীম করে দেওয়া। তার জন্যই সাধক দেহের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মধ্যে দিয়ে অসীমের জন্য গোপন সংকেত রাখেন। সেই সংকেতের ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্য তিনি নেন। খোঁজাখুঁজি করেন লক্ষ্যস্থলটির জন্য। চতুর্দশ স্থল মঞ্জরীর কথা বলেন সাধক। বলেন শরীরের মধ্যে চোদ্দ কমল ফোটে কীভাবে ফোটে এই কমল? কপালে ভানু মঞ্জরী, চোখে রূপ মঞ্জরী, নাকে কস্তুরী মঞ্জরী, জিভে রস মঞ্জরী, কানে গুণ মঞ্জরী, গলায় ভূঙ্গ মঞ্জরী, দুই স্তনে রঙ্গ মঞ্জরী, নাভিতে লবঙ্গ মঞ্জরী, কোমরে কিঙ্কিণী। মঞ্জরী, লিঙ্গে রতি মঞ্জরী, উরুতে মোহন মঞ্জরী, পায়ে পদ্ম মঞ্জরী, হাতে বিলাস মঞ্জরী, হৃদয়ে প্রেম মঞ্জরী। সাধক বাউল সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রে ও অষ্টম চন্দ্রে যে প্রত্যঙ্গগুলো স্পর্শ করেন সেখানে কিন্তু বৈষ্ণবীয় আধারের চোদ্দ মঞ্জরীই বর্তমান। সাধন-করনখে চুম্বন। করেন পুরুষ ও প্রকৃতি। অর্থাৎ কিনা তাঁরা বিলাস মঞ্জরীতে বিচরণ করেন তখন। যা কিছু চাওয়া-পাওয়া সব তাঁরা নষ্ট করে বসেন। পদনখে যখন চুম্বন চলে তখন থেকেই বর্ধিত শোভা উপরের দিকে উঠতে থাকে। পায়ে পদ্ম মঞ্জরী বর্তমান। শোভা খুলতে থাকে প্রতীকী এই পদ্মরূপে। গলাতে যখন চুম্বন চলে তখন যেন ভ্রমরের মতোই স্বর নিক্ষিপ্ত হয় (যাকে। কামশাস্ত্রে শীকার বলছে)। গলায় তাই ভৃঙ্গ মঞ্জরীর কল্পনা। অধরে বা ঠোটস্থ চুম্বনের অর্ধস্ফুট আওয়াজও ভৃঙ্গ মঞ্জরীতে আমরা রাখতে পারি। জিভের চুম্বনে লালা নির্গত হতে থাকে, মিশে যেতে থাকে তা এ-জিভে ও-জিভে। এখানে রস মঞ্জরীর অবস্থান। ললাটে চুম্বনকালে তেজ বা জ্যোতি নির্গত হতে থাকে। মনে রাখতে হবে ব্রহ্মরন্ধ্র কিন্তু সহস্রার চক্রতেই বিরাজমান। একে ভানু মঞ্জরী হিসাবে প্রতীককল্প দিচ্ছেন সহজিয়া বৈষ্ণব। অষ্টম চন্দ্রের মুখে যদি চুম্বন চলে তাহলেও সেটাকে ভৃঙ্গ মঞ্জরীরে রাখতে পারি আমরা। কেননা মুখ থেকেই মধুর বচন নির্গত হয়। স্তনের চুম্বনে আমোদ বা আনন্দ লাভ হয়। একে বলা হচ্ছে রঙ্গ মঞ্জরী। হাতের চুম্বনেও বিলাস মঞ্জরীকে ভাবতে পারি। বুকের চুম্বনে প্রেম মঞ্জরীকে। বুকের ভেতরই তো মন বা হৃদয়ের সিংহাসনকে রাখি আমরা। নাভি চুম্বনে ফুল। আধার দিলে তা অবশ্যই লবঙ্গ মঞ্জরী। যোনি চুম্বনকে উরুর মোহন মঞ্জরীর প্রতীক হিসাবে কল্পনা করে নিতে পারি।

এখন প্রশ্ন এই সাড়ে ২৪টি স্থান স্পর্শ বা চুম্বন করা হয় কেন পুরোপুরি সম্ভোগ বা মিলনের আগে? করা হয় এই কারণেই, বাউল কামে থেকে নিষ্কামী হবার কথা বলে থাকেন। তাঁরা সঙ্গিনীর এই সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র চুম্বন বা স্পর্শ করে কামকে ভোঁতা করে। দেন। কাম তখন প্রেমের দিকে ধাবিত হয়। এমন তাঁদের সাধনার বিশ্বাস। অষ্টম চন্দ্রও স্পর্শ বা চুম্বন এ কারণেই হয় বা হয়ে থাকে। তা এই কার্যকরণ সাধক কি সঙ্গিনীকে করেন কেবল? নাকি সঙ্গিনীও সাধকের সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র চুম্বন করে থাকেন? উত্তরে মতান্তরে আছে। তবে প্রবীন প্রাজ্ঞ বাউল শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্যের মতকে গুরুত্ব দিলে তা দাঁড়ায় সাধকই তা করেন। সঙ্গিনীকে সাধনার জন্য প্রস্তুত করে নেন সাধক।

নবকুমার আমাকে বলেছিলেন, সঙ্গিনীও সাধকের সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রকে জাগায়।

বললাম, অনেকে বলেন সাধক তা একা করেন।

বললেন, কখনও না। দুই গণ্ডে দু’বার যে তা ওই দুজনেরই না কি?

আমি তাঁকে আর বললাম না, দুই গণ্ডকে যদি গলার দু’ধারের স্পর্শ বলি তাহলে কি খুব ভুল ধরব? একথা তাঁকে আর বলা হয়নি। তার আগেই গান ধরলেন তিনি–

যদি হয় মহাভাবুক জেলে,
ধর্ম মাছ ধরতে পারে
ভাবের দ্বারে গুরু-ভাব-ভক্তি জাল।

বুঝলাম, চন্দ্র সাধনে আমার কথা তাঁর পছন্দ হয়নি। তাই যাদুবিন্দুর পদ গেয়ে আমার ভেতর যাতে গুরু-ভাব-ভক্তি–এসব আসে তারই ইঙ্গিত দিতে চাইছেন। নবকুমার।

*****

পদকর্তা গেয়েছেন: ‘রবিশশী রয় বিমুখা/ মাস অন্তে হয় একদিন দেখা/ সেই যোগের যোগে লেখাজোখা / সাধলে সিদ্ধি হয় অনায়াসে।‘

‘রবিশশী’ ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ি। ‘মাস অন্তে একদিন দেখা’ রজঃপ্রবাহের দিন। ‘যোগের যোগ’ মহাযোগ। এই যোগে শরীর সাধনায় সিদ্ধির কথা বলছেন লালন।

‘দিবাকর নিশাকর সদাই/ উভয় অঙ্গে উভয় লুকায়/ ইশারাতে সিরাজ সাঁই কয়/ লালন রে তোর হয় না দিশে।’

ইড়া আর পিঙ্গলা নাড়ি ‘উভয় অঙ্গ’ অর্থাৎ কিনা সাধক ও সাধন সঙ্গিনীর মধ্যে লুকিয়ে আছে। তা জাগানোই দেহসাধকের কাজ। সে কাজ বা সাধনায় সিদ্ধির করণকৌশলই লালনকে দিতে চাইছেন তাঁর গুরু সিরাজ সাঁই। গুরু সাধনার দিশা দিতে চাইছেন শিষ্যকে।

লালন এভাবেই তাঁর পদে গুরুকে অধিপতির সিংহাসন দিয়েছেন। শরীর সাধনাতে গুরুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। গুরু ছাড়া ও পথে সিদ্ধ হবার উপায় নেই কোনো। শুধু এ পথ কেন আধ্যাত্মবাদের পথে গুরুই দিশা। শিষ্যকে অজ্ঞানতার তিমির থেকে গুরুই উদ্ধার করেন। তাই সাধক ছুটে যান গুরুর কাছে। আমাদের শাস্ত্রও সেই নির্দেশ দিয়েছে–’মধুলব্ধো যথা ভৃঙ্গ পুষ্পৎ পুষ্পরং ব্রজেৎ / জ্ঞানলুব্ধস্তথা শিষ্যো গুরুব্বন্তরং ব্রজেৎ।।‘ ভ্রমর যেমন মধুর লোভে এক ফুল থেকে আরেক ফুলে ছুটে যায়, তেমনই জ্ঞানপিপাসু শিষ্য এক গুরু থেকে অপর গুরুর আশ্রয় গ্রহণ করবে।

পিতামাতাকে গুরু হিসাবে দেখা যায়, প্রথম গুরু হিসাবে তাঁদেরই স্থান দেওয়া হয়। বাউল বলেন যে তাঁদের প্রথম জন্ম পিতার বীর্য আর মাতার রজ নিয়ে। দ্বিতীয় গুরু মন্ত্রগুরু। বাউলও এমত মানেন। তন্ত্রে মন্ত্রযোগ নিকৃষ্ট শ্রেণীর হিসাবে দেখা হয়। বাউল তা মুখে না বললেও তাঁদের তৃতীয় জন্ম গুরুর হাতেই বলেই তাঁরা মনে করেন। কেননা গুরু নির্দেশিত পথেই দেহসাধনা চলে। তবে তন্ত্রে মন্ত্রযোগ নিকৃষ্ট শ্রেণীর হলেও তাঁর একটা বিশেষ স্থান আছে। বলা হয়েছে : ‘মনোহন্যত্র শিববাহন্যত্র শক্তিরণ্যত্র মারুতঃ। / ন সিধ্যন্তি বরারোহে কল্পকোটিশতৈরপি।’ মন্ত্র জপের সময়ে মন, পরম শিব, শক্তি এবং বায়ু পৃথক পৃথক স্থানে থাকলে অর্থাৎ এদের একত্র সংযোগ না হলে শতকল্পেও মন্ত্রসিদ্ধি আসে না। বলা হয়েছে: ‘মন্ত্ৰাৰ্থং মন্ত্ৰচৈতন্যং যোনিমুদ্রাং ন বেত্তি যঃ। / শতকোটিজপেনাপি তস্য বিদ্যা ন সিধ্যাতি।।’ মন্ত্ৰার্থ, মন্ত্র চৈতন্য, যোনিমুদ্রা না জেনে শতকোটি জপ করলেও মন্ত্রে সিদ্ধিলাভ হয় না। কেননা শরীরস্থ চক্রে যোনিমুদ্রাতে দেবদেবীর প্রতীকী রূপের কল্পনা রেখেই সাধক ধ্যানজপ করেন তাই সেগুলো সম্পর্কে সঠিক অভিহিত না থাকলে মন্ত্রজপে শরীর শক্তির জাগৃতি আসতে পারে না কিছুতেই। তন্ত্রসাধক বলেন তন্ত্র। ক্রিয়াকরণের যোগ। বাউল সাধক তা না বললেও এই সিদ্ধি ক্রিয়াকরণেরই সিদ্ধি। বলা হয় মন্ত্রের মধ্যে যে প্রাণশক্তি তা থাকে মণিপুর চক্রে–’মণিপুরে সদা চিন্তাং মন্ত্রাণাং প্রাণরূপকম্। মণিপুরে মন্ত্রের প্রাণরূপ সর্বদা কল্পনা করবে। মন্ত্রের প্রাণ জেনে ক্রিয়া না করলে মন্ত্রচৈতন্য কখনওই আসবে না। গুরুমন্ত্রকে সুষুম্নার মূলদেশে জীবরূপে চিন্তা করে মন্ত্র জপ করলে মন্ত্ৰার্থ ও মন্ত্রচৈতন্য আসে, তাই বলে থাকেন সাধক। ‘মূলমন্ত্র প্রাণবুদ্ধ্যা সুষুম্নমূলদেশকে। / মন্ত্ৰার্থং তস্য চৈতন্যং জীবং ধ্যাত্বা পুনঃ পুনঃ।।’

বাউলের চতুর্থ জন্ম হয় সিদ্ধিতে। আর সিদ্ধিতে ‘চন্দ্রসাধন’ অনিবার্য। বাউল তাঁর দেহতত্ত্বের গানে চন্দ্রসাধনের চাঁদের কথা বার বার বলে থাকেন।

মদন শাহের পদ:

চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করব কি
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম তারে তোমরা বল কি।
ঘর আছে তার দুয়ার নাই মানুষ আছে বাক্য নাই
কে তাহাদের আহার দেয় কেবা দেয় সন্ধ্যাবাতি।
ছ’মাসে হয় জীবের স্থিতি ন’মাসে হয় গর্ভবতী
হয় এগারো মাসে তিনটি সন্তান
কোনটি করবে ফকিরি।
বত্রিশ বাহু সোল মাথা গর্ভে ছেলে কয় গো কথা
কেবা তাহার মাতা পিতা এই কথাটি জিজ্ঞাসি।
বলে মদন শা ফকিরে মায়ে ছুঁলে পুত্র মরে
এই চার কথার অর্থ বললে তারই হবে ফকিরি।

খ্যাপা মনোহরও চন্দ্রতত্ত্বের অনুপ্রেরণা নিয়েই এই ধরণের একটি পদ রচনা করেছিলেন জয়দেব-কেন্দুবিতে বসেই। গানের নীচে তারিখ রয়েছে ১৬-১-১৯৭০ সেই গানটিও আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা দেখে নিই একবার।

খ্যাপা মনোহরের পদ:

চাঁদ উঠেছে চাঁদের গায়ে
তোমরা ভেবে করবে কী,
বাপের পেটে মায়ের জনম।
তারে তোমরা বলবে কী
চাঁদ উঠেছে চাঁদের গায়ে
তোমরা ভেবে করবে কী।
অমাবস্যায় একাদশী
বিধবা রহিল বসি
পূর্ণচন্দ্র কালশশী
নাম ধরে তার ডাকবে কী।
বাপের পেটে মায়ের জনম
তারে তোমরা বলবে কী।
প্রতিপদে পূর্ণিমা যার
(ক্ষ্যাপা) তিন ধারাতে জনম রে তার
গঙ্গা যমুনা সরস্বতী
বাপের দোহাই দিবে কী।
চাঁদ উঠেছে চাঁদের গায়ে
তোমরা ভেবে করবে কী,
বাপের পেটে মায়ের জনম
(ক্ষ্যাপা) তারে তোমরা বলবে কী!

দুটি পদের প্রথমেই দেখছি ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার কথা রয়েছে। অর্থাৎ কিনা গুরু-শিষ্যের মিলনের কথাই এগুলোতে সব প্রতিভাত আছে। গুরু শিষ্যকে নির্দেশ দিচ্ছেন, টানছেন যেন চুম্বকদণ্ডের মতো। শিষ্য সেই প্রতিধর্মের লৌহকণিকা। লেগে যাচ্ছেন গুরুর গায়ে। অর্থাৎ কিনা গুরুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন শিষ্য বাউল। সাধন এলাকার এই মার্গ নিয়ে তাই আমাদের ভাবনার কিছুই নেই। বাকসংযমের অনুধাবনীয় স্তরেই যেন আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন সাধক পদকর্তারা সব। মদন শাহের পদে এরপর রয়েছে ‘ঝিয়ের পেটে মায়ের জনম’। খ্যাপার পদে আছে আছে বাপের পেটে মায়ের জনম।

‘ঝি’ সন্তানের ইঙ্গিত দিচ্ছে। গুরু এখানে সন্তানের পদমর্যাদা পাচ্ছেন। গুরুর বেদবানী পালন করছেন শিষ্য। মানে হল গুরুকেই লালন করছেন তিনি। তাই গুরুর প্রতীকী রূপ পদে ‘ঝি’ বলেই। ‘ঝি’ প্রতিরূপ খ্যাপার গানে এসেছে ‘বাপ’ হয়ে। ‘বাপ’ গুরুতুল্য। বাপকে লালন করছেন মা। ‘মা’ বা মাতৃঅংশ বাউল সাধক নিজে। তিনি সাধনার দ্বারা যেন গুরুকে ধারণ করেই আছেন। তারই কথা বলেছেন পদকর্তারা। প্রতীকের সন্নিহিত আবেশ ভাঙ্গলে শিষ্যর গ্রন্থিমোচন হয়ে গুরুর আধারিত অংশ নিয়ে তিনি মাতৃভাবে প্রসাদ পেয়ে সন্তানস্বরূপ ধারণ করে থাকেন গুরুকেই। পদকর্তাদের এই অস্তিত্বরহস্য অনিবার্যের ইশারা। যা ভাষার প্রভাতী আলাপনের বীণাকে যেন বাজিয়ে ধরে।

মদন শাহের পদে তৃতীয় লাইনে রয়েছেঃ ‘ঘর আছে তার দুয়ার নাই মানুষ আছে বাক্য নাই/ কে তাহাদের আহার দেয় কেবা দেয় সন্ধ্যাবাতি।’ মদন শাহ ‘ঘর’ বলতে শরীর বুঝিয়েছেন। বাউল ভাষায় ঘর সব সময়ই স্ত্রীর প্রতিবিম্ব। বলেছেনঃ ‘ঘর আছে তার দুয়ার নেই’–দুয়ার হল দরজা। দরজা এখানে ইন্দ্রিয়দ্যোতক। আর দুয়ার নেই বলেই আলোচ্য ঘরে সন্ধ্যাবাতি দেবার দরকার নেই। ঘরই যখন অধিষ্ঠিত হয়নি, ইন্দ্রিয় তৈরি হয়নি, ক্রিয়াকৈবল্য শুরু হয়নি তখন আহারের প্রয়োজন হয়? আহার হল নাড়ির মতন। যার তরঙ্গে ওঠাপড়ার ঘর গড়ে ওঠে। আর তা তৈরি করতে পদকর্তা মদন তৈরি। এজন্য তিনি বলেছেন: ‘ছ’মাসে হয় জীবের স্থিতি ন’মাসে হয় গর্ভবতী / হয় এগারো মাসে তিনটি সন্তান/কোনটি করবে ফকিরি।

‘ছ’মাস ছটি রিপু। ‘ছ’মাসে জীবের স্থিতি–ছটি রিপু নিয়েই মানুষ থাকে তুঙ্গ তীব্রতায়। যার থেকে বেরোবার কথাই বলেন সাধক। ‘ছ’মাসের এক কন্যা’ও রিপুর ক্রিয়াত্মক কল্পনা। ন’মাসের গর্ভ–বাউল মতের নববিধা সেই ভক্তিরস। নটি চক্রের কথাও আমরা কিন্তু ভাবতে পারি। ‘এগার মাসের তিনটি সন্তান’–দশেন্দ্রিয় ও মনের সমন্বয়। এই সব একত্রিত করে এগুলো বশীভূত করে তবেই যেতে হবে সাধনা ও সংযমে। এর ফলে শ্রেষ্ঠ গুণ তিনটি সাধক শরীরে একত্রিত হবে। এই তিন গুণ হল জ্ঞান, বিবেক ও বৈরাগ্য।

শশাঙ্ক দাস বৈরাগ্য একবার আমাকে বলেছিলেন, দশেন্দ্রিয়, ষড়রিপু এগুলো সব হল গিয়ে বাবা চিনি খাওয়া রাক্ষুসি। শরীরের মধু সব খেয়ে নেয়। সাধনায় এদের আগে মারতে হবে বাবা।

‘বত্রিশ বাহু ষোল মাথা গর্ভে ছেলে কয় গো কথা/ কেবা তাহার মাতা পিতা এই কথাটি জিজ্ঞাসি। মদনের এই জিজ্ঞাসার উত্তর: ষোলমাথা = দশেন্দ্রিয় + ষড়রিপু। বত্রিশ বাহু = পঞ্চভুতের পাঁচ (ক্ষিতি,অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম) + পঞ্চগুণ বা স্বাদ (মিষ্টি, টক, লবণাক্ত, তেতো, ঝাল) + দশেন্দ্রিয় (পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়–বাক, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ, এবং পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়–চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক) + ছয় রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য) + আট দ্বার (দুই কান, দুই চোখ, দুই নাক, মুখ, পায়ু) = চব্বিশ। এর সঙ্গে ব্রহ্ম বস্তু দেড় আর অর্ধাংশ রজ ও বীর্য নিয়ে দেহ হয় পঁচিশ। তার সঙ্গে সাত যোগে হয় বত্রিশ। এই সাত হল সাত সাগর। শরীরের সাতটি উপাদানকে বাউল সাধক অভিহিত করেন সাত সাগরের নামে।

মূত্র (লবনসাগর),বীর্য (ক্ষীরোদসাগর),মজ্জা (দধিসাগর),চর্ম (ঘৃতসাগর), জিভ (জলসাগর), রক্ত (সুরাসাগর), রজ (ইক্ষুসাগর)। এগুলোকে ‘সপ্তধাতু’, ‘সপ্ততালা’ও বলেন বাউল। সর্বমোট এই বত্রিশটি উপাদান যা দেহস্থ ক্রমপরিণামী স্তর–বাউল তাঁর সিদ্ধির পূর্ণতা বিকাশে সেগুলো পুনর্লব্ধ নৈঃসঙ্গ করে নিয়ে সিদ্ধির অভিজ্ঞানপত্র রচনা করেন। সাধকের আখ্যাপত্রকে দূরে ঠেলে দেহসাধনার সর্বশেষ সিংহাসনটি দখল করে। বসেন। এজন্যই মদন শাহ ‘বত্রিশ বাহু সোল মাথায় গর্ভস্থ ছেলেকে’ জানতে, বুঝতে, উপলব্ধি করতে বলেছেন। মদন শা বলেছেন: ‘মাকে ছুঁলে পুত্র মরে।’ ‘মা’ কে? সাধক বাউল। ‘ছেলে’ গুরু। ‘গুরু’র পরবর্তীতে ‘শিষ্য বা সাধক বাউল’ সে জায়গাটা নিচ্ছেন। সাধনার অতল প্রয়াণ ঘটছে এখানে। গুরুর যেন মৃত্যু হচ্ছে। গুরুরূপী ছেলে মরে গিয়ে শিষ্যরূপী মা জেগে উঠছেন। শিষ্য মাতৃস্থ অবয়ব নিয়ে আবারও পরবর্তীতে তাঁর শিষ্যদের পূর্বচ্ছবিতে গুরু হয়ে মৃত্যুলাভ করবেন। এই কথা যদি কেউ অনুধাবন করতে না পারেন। তবে ‘ফকিরি’ মানে সাধনা বৃথা।

*****

অগ্রদ্বীপে মীরা মোহান্তের আখড়ায় বসে শুনেছিলাম চাঁদের আরেক গান। ঘোষপাড়ার মেলা ঘেঁষে শেষাশেষি ফাল্গুনে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। দোলপূর্ণিমার পরের একাদশী তিথিতে বসে অগ্রদ্বীপের মেলা। লোকে বলে ঘোষঠাকুরের মেলা। মেলার প্রথম দিন চিড়া-মচ্ছব চলে। দ্বিতীয় দিন অন্ন-মচ্ছব সেবার প্রথম উপস্থিত হয়েছি অন্ন-মচ্ছবের দিনে। গিয়ে দেখি ভাত আর তরকারি রান্না চলছে সমানে। গর্ত খুঁড়ে কলাপাতা পেতে ঢালা হচ্ছে তাতে ভাত তরকারি। সেই গরম ভাত পেটে পড়েছে বেলাবেলি। সন্ধ্যার আখড়া সাজেনি তখনও। ভক্ত-শিষ্য, বাউল সব এধার-ওধার ঘোরাফেরা করছে। নদীর ঠাণ্ডা উঠে আসছে হাওয়ায়। মীরা মা গল্পগাছা করছেন ভক্তদের সঙ্গে।

আমার কথা চলছিল কাঁঠালতলার রতন বাউলের সঙ্গে। বললেন প্রতিবার এ আখড়াতেই এসে ওঠেন। কথা চলতে চলতে চলে গেল চন্দ্রকথায়। একতারাটা তাঁর বসবার পাশেই ছিল কাত হয়ে শুয়ে। যেন সেও মচ্ছবের ভাত-তরকারি পেটে পুরে ঝিমুচ্ছে। তুলে নিলেন রতন। ঘুম ভাঙল একতারাটার। টুং টাং হতেই মীরা মা ফিরে বসলেন এদিকে। আলোচনা শ্লথ হয়ে ঘুরে বসল বাউলেরই গানে। রতন বাছার গাইলেনঃ

আমি চাঁদকে চিনলাম না আমার লগ্নেতে চাঁদ ছিল না
চাঁদের হাতি চাঁদের ঘোড়া চাঁদের গরু চাঁদের মেড়া চাঁদ জগৎজোড়া
সেথা চাঁদে চাঁদে লেনাদেনা চৈতন্যের কেনাবেচা।।
চাঁদের হাট চাঁদের বাজার চাঁদ পসারি হাজার হাজার
চাঁদের ওজনদার।।
সেথা লক্ষ লক্ষ ভাবের ভাবী অসংখ্য চাঁদ যায় জানা।
সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র আছে কামগায়েত্রী কামবীজের কাছে
সাধক চাঁদ সাধে
ক্ষেপাচাঁদ গোঁসাই বলে সে চাঁদ আমার ভাগ্যে হল না।।

রতন বাউলের গানে আখড়া হয়ে উঠল চাঁদের হাট। ভক্ত-শিষ্য সমবেত হল সব। সেজে উঠল আখড়া। রাতের আখড়ায় গান শুরু হয়ে গেল রতনের গানে। মীরা মা। বললেন, আসর বন্দনার আর দরকার নেই। চন্দ্র বন্দনা হয়ে গেছে।

বাউল বললেন আমায়–অমাবস্যা তিথি আসছে গো সামনে। আজ দ্বাদশী তিথি চলছে।

আবার একতারা তুলে নিতেন বাউল। মাইক এল। এল নানা বাদ্যযন্ত্র। ডুবকিতে চাপর পড়ল। বোল উঠল খমকেও। গান শুরু করে দিলেন বাউল।

বললেন, আরেকখান চাঁদের গান গাই। বাবুরা সব এয়েছেন চন্দ্রকথা শুনতে। জানছেন। বুঝছেন। শুধোচ্ছেন সব। তা বাবুরা, দেখেন এবার চাঁদ কী কইছে। আপনাদেরও তো চাঁদপানা মুখ।

গৌরচন্দ্রিকা সেরে আবার গান ধরলেন বাউল। পরিচিত সেই গান। পূর্ণচন্দ্র দাসের কণ্ঠে বহুবার শোনা।

ও চাঁদ ফাঁকি দিয়ে ভোট নেবে, ভেবেছ আবার।
তোমায় চিনে গেছে সব ভোটার।
যেমন করেছ বোকামি, দেহ আক্কেল সেলামি,
বেলতলাতে বল ন্যাড়া যায় হে কতবার!
দেশের ভালো হবে বলে, মিলিয়া সকলে,
আদর অরে কল্লেম কমিশনার।
তার রাখলে খুব ধর্ম, করলে উচিত কর্ম
এমন ফিকির আঁটছ গলায় ছুরি দেবার।।
রইলে মনের মত হয়ে ডাকতেম সব সয়ে,
রাখতে পারলে কৈ তেমন পশার
কিসের অহঙ্কারে মত্ত, কদিন এই ইন্দ্রত্ব
তিন বছর বই আর তো, রবে না পাওয়ার।
তোমার নয় হে পিতৃশ্রাদ্ধ, সে করবে যে বরাদ্দ,
কড়া কথায় কারো নাই অধিকার।
যখন সাধারণের টাকা, সকলকে চাই ডাকা,
একলা হরির খুড়া কে তুমি তার।
তখন কাছা দিয়ে গলে, আমায় ভোট দাও বলে,
দ্বারস্থ হয়েছে সবার।
সেদিন গেছে চলে, এখন গেছ ভুলে,
দেখলে যেন চিনতে পার না আর।
করে গরবীকে পেষণ, শুষ্ককে শোষণ
সেই রক্তের ধনে তোমার এই কি ব্যবহার।
ওহে তিল কাঞ্চন হলে, অনায়াসে যায় চলে,
কর বৃষোৎসর্গ পরের ভাঁড়ারে।

আসরে দেখলাম চাঁদের আকর্ষণে এতক্ষণে জোয়ার নেমেছে। ভিড় বেড়েছে। আখড়া ছেড়ে মেলায় ঘুরে দেখি পিলপিল করছে মাথা।

বাউলের প্রথম গানে ‘চাঁদ’কে চিনতে পাড়ার কথাই বলা হয়েছে। বাউল বিশ্বাস করেন চন্দ্রময় মানুষের উপস্থিতি। তার শরীরে চাঁদ প্রতিনিয়ত খেলা করছে।

রতন বলেছিলেন, বাবুমশাই চাঁদ কী কেবল জলে খেলিছে, চাঁদ শরীরের জলকেও টানছে। উপরে তুলি দিচ্ছে।

আমি বুঝলাম রতন বীর্যর ঊর্ধ্বগতির কথাই বোঝাতে চাইছেন আমাকে।

এ গানে বাউল সাধকের আপশোস চাঁদ তার চেনা হল না। লগ্নে নেই চাঁদ। বাউলের নশ্বরতায় চাঁদ তাঁকে অমর, অনন্ত, অসীমের সন্ধান দেয়। সাধকের সাধনাকে চাঁদ সিদ্ধ গুণসম্পন্ন করে দেয়। বাউল তাই চন্দ্ৰসাধনাতে জোর দেন। গুরু সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রের কাজ দেখান। সাধক তা প্রতিস্থাপন করেন সঙ্গিনীর শরীরে। সেই চাঁদের অসিদ্ধি, বেদনা, তার জন্য হাহাকার, আর্তি ফুটে উঠেছে পদকর্তার গানে। দেহচিত্তপ্রাণমন সব ঢেলে চন্দ্র উপাসনা করতে শেখান গুরু। সাধক সেই উপাসনার আস্তরণটুকু সরাতে পারেননি এখনও। কারণ চাঁদ তার আয়ত্ত্বে নেই এখনও। চাঁদ আয়ত্ত্বে না এলে সাধকের সিদ্ধির জন্য সাধনা করা বৃথা। কীভাবে চাঁদ আয়ত্ত্বে আসবে? পদকর্তা বলছেন: চাঁদ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। চাঁদের হাতি, ঘোড়া, গরু, মেড়া, চাঁদ জগৎজোড়া। হাট বাজার লেনাদেনা সবেতেই চাঁদ। পদকর্তা আসলে বোঝাতে চাইছেন চন্দ্রময় মানুষের উপস্থিতি। আমাদের নাড়ি, চক্রে চাঁদ কীভাবে তার স্পর্ধিত শাসন চালাচ্ছে। কীভাবে সাধককে চাঁদ নিয়ন্ত্রণ করছে সেসব আমরা বলেছি।

চাঁদ আসলেই এক প্রতীকী অবিচ্ছেদ্যতা। প্রকৃতি-পুরুষে। সাধক-সাধিকাতে। সাধক-সাধন সঙ্গিনীতে চাঁদ সদানন্দ ভাবের পরিবেশ তৈরি করে দেয় সাধক শরীরে।

দশমহাবিদ্যারূপে শক্তির যে নানা রূপ দেখি আমরা, সেখানে আদ্যাশক্তি হিসাবে কালী কৃষ্ণবর্ণা। দেশশক্তি হিসাবে তাঁর নাম তারা। এরূপে তিনি নীলবর্ণা। এই দুই রূপই কল্যানময়ী মাতৃরূপ। দু’জনেরই কপালে চন্দ্রকলা বর্তমান। দেশ ও কাল অনন্ত বলে মানলেও কালের উৎপত্তি ও লয় আছে। দেশেরও উৎপত্তি ও লয় আছে। চাঁদ সেই উৎপত্তি ও লয়কেও প্রতীকী অর্থে প্রকাশ করে। ওঠে ও ডুবে যায়। যদিও বিজ্ঞান বলছে চাঁদের রূপ দিনের আকাশেও থাকে সূর্যের তেজস্ক্রিয়তায় চাঁপা পড়ে। তাহলে এটাও তো ঠিক চন্দ্র ও সূর্য দেশ ও কালে সর্বশক্তিসম্পন্ন। তাদের উপস্থিতি মহাশূণ্যে সবসময়। শরীরকেও সেই প্রতীক দিয়ে বসেন সাধক। শরীরের নাড়ি তাই হয়ে ওঠে চন্দ্র ও সূর্য নাড়ি। চক্রে চক্রে বিরাজ করে চাঁদ। তার বলবীর্যকে আমরা দেখি সাধকের শরীরে। চাঁদ এভাবেই ভাবের মাত্রাকে বৈভব এনে দেয়। চাঁদে যান মানুষ। চন্দ্রকে আহ্বান করেন। আবিষ্কার করেন চাঁদে প্রাণের প্রহর কোন ছোটবেলাতে মা তো আকাশের চাঁদ দেখিয়েই শিশুকে বলেন–’আয় আয় চাঁদমামা টী দিয়ে যা। / চাঁদের কপালে চাঁদ টী দিয়ে যা।‘ আর ঠিক তখনই চাঁদমুখ শিশুর হাসি ফোটে মুখে চাঁদের বুড়ির চরকা কাটার গল্প এখনও এই কম্পিউটার, সিডির যুগেও ঠাকুমা-দিদিমার মুখে হাঁ করে শোনে বাচ্চারা। চাঁদকে তেমন করেই দৃশ্যত হাজির করেন বয়স্করা। তাঁদের বাত-বেদনার সঙ্গেও জড়িয়ে যায় চন্দ্র মহিমার কথা। পূর্ণিমা অমাবস্যাকে তারা ব্যথা প্রকটের কাল হিসাবেও চিহ্নিত করেন। এ সময় রসস্থ হয়ে ওঠে শরীর। তাই ব্যথা প্ৰকটে তারা ময়দা-আটা খান। ভাতকে বর্জন করেন। বাউলের ‘রস’ শুক্র-রজ বা বীর্য-রজ অমাবস্যার মহাযোগে ‘চারচন্দ্র’, ‘সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র’র প্রতীকে, ইশারায় ইন্দ্রিয়কে অচল করে দিয়ে, প্রবৃত্তিকে নিষ্কাম করে নিয়ে চন্দ্রের আধিপত্যকে চিহ্নিত করে। পদকর্তা বাউল তাই চন্দ্রপাঠের ইস্কুলে গিয়ে অকৃতকার্য হয়ে গেয়ে ফেরেন: ‘চাঁদ আমার ভাগ্যে’ হল না। এই অকৃতকার্য শিষ্যকে কৃতকার্য হবার প্রতীকী মন্ত্র। সাবধান বাণী। বাউল তাই বারবারই গেয়ে ফেরেন চাঁদের কথা চন্দ্র নিয়মের মুদ্রিত অক্ষর নিয়ে লেখা হয় অজস্র গান। চন্দ্রবিধি, নিষেধাজ্ঞা, পালন, নির্দেশ, শিক্ষা, চর্চা, প্রচার, সাধনা সবই একাকার হয়ে যায় বাউলের এ সব গানে। তেমনই এক গান শুনেছিলাম চৈতন্য বাউল আশ্রমে।

গাইছিলেন বাউল:

চাঁদের বিবরণ জানে যে জন সুজন বলি তারে
চাঁদ অমাবস্যা হলে চলে যায় পাও-তলে দক্ষিণ কনিষ্ঠ আঙুল ভিতরে
চাঁদ প্রতিপদ হলে চলে যায় পাতালে দ্বিতীয়াতে মিলে পায়ের উপরে
থাকে তৃতীয়াতে পায়ের গোছোতে মিলে চতুর্থীতে হাঁটুর উপরে।।
পঞ্চমীতে তায় জানুর উপর রয় ষষ্ঠীতে কোমরেতে যায়
সপ্তমীতে স্থিতি নাভিতে বসতি অষ্টমীতে রয় বক্ষ মাঝারে
নবমী যোগেতে কণ্ঠ ‘পরে আসে দশমীতে ঠোঁটের উপরে
একাদশ যোগে থাকে নাসিকাতে মিলে দ্বাদশ চোখের ভিতরে
ত্রয়োদশী হলে যায় কপালে চতুর্দশীতে পূর্ণিমা যে
পূর্ণিমাতে রয় পূর্ণ মগজেতে আর্জান বলে ধন্য সাধুতে হরে।।

এই পদে দেহে চন্দ্র পরিক্রমার কথাই বলা হয়েছে। ‘সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র’ পরিক্রমা করেন সাধক সাধিকার শরীরে। সেই পরিক্রমারই বর্ণনা রয়েছে এই গানে। ‘চাঁদ অমাবস্যা হলে চলে যায় পাও-তলে দক্ষিণ কনিষ্ঠ আঙুল ভিতরে’। অমাবস্যা এখানে রজঃপ্রবৃত্তির কাল। যে কালে সাধক চন্দ্র পরিক্রমা শুরু করেন। সঙ্গিনীর পদনখে (পাও তলে দক্ষিণ কনিষ্ঠ আঙুলে ভিতরে), প্রতিপদে চাঁদ অবস্থান করে পাতালে। পাতাল’ এখানে অষ্টম চন্দ্রের যোনি। দ্বিতীয়াতে পায়ের উপরে। তৃতীয়াতে গেছে। চতুর্থীতে হাঁটু। চাঁদ এভাবে সঙ্গিনীর প্রত্যঙ্গ গুলোকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। চাঁদ হল চন্দ্র সাধক। যার চন্দ্ররূপী নাড়ি, চন্দ্র চক্র সব জেগে গেছে। সিদ্ধির পরিস্থিতি তৈরি হয়ে উঠেছে। পূর্ণিমার চাঁদ। সাধকের প্রেমময়তা। জ্ঞান ও বোধিচর্চার গুরুকেন্দ্রিক ভাব-উপলব্ধি। আর্জান শাহের আরেকটি পদে পাই–’আগে পড়গা ইস্কুলে প্রথম যে স্বরে অ-এর স্বর যেও না ভুলে। / অ-এতে অন্ধকার ছিল স্বর বেয়ে আলো করিল/ একা চন্দ্র টলে গেল পক্ষ গেল মিলে।’ ‘চন্দ্র টলা’ মানে গুরু নির্দেশিত সাধনার ভিতটুক নড়ে যাওয়া। ‘টলা’ মানে হল শুক্র বা বীর্য স্খলিত হয়ে যাওয়া সাধিকার যোনির ভেতর। বাউল ‘অটল মানুষ’ হওয়ার কথা সব সময়ে বলে থাকেন। ‘অটল মানুষ’ হল ঈশ্বরতুল্য মানুষ। মূর্তিময়তায় সাধারণত বাউলের বিশ্বাস নেই। ‘ঈশ্বরতুল্য মানুষ’ হল ‘বস্তুরক্ষার মানুষ’। শুক্র সঞ্চয়ের মানুষ। শুক্রের অধগতি না আসা হল ‘অটল মানুষের’ সাধনলব্ধ ফল। সাধক বাউল দেহমিলনে সাধক শরীরকে উধ্বগতি দিয়ে বস্তুরক্ষা করে থাকেন। বাউল সাধনাতেও বস্তু বিসর্জন একেবারে নিষিদ্ধ। বাউল বলে রজঃপ্রকাশের তিনটি দিনে সঙ্গিনীর শরীরে কোনওরূপ কাম থাকে না। তার জন্যই সাধনে শুক্র স্খলিত হয় না। ‘প্রেমজন্ম’ হয়। সন্তান জন্ম হয় না। এই জন্ম সিদ্ধ সাধকের জন্ম। বাউল বলেন কামগায়ত্রী থাকে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রে।

জগদীশ পণ্ডিতের শ্রীপাঠে একদিন অতি বৃদ্ধা বৈষ্ণবী আমাকে বলেছিলেন, তা ছেলে তুমি আমি কেউ পুরুষ নই গো।

তাহলে আমরা সব কী? জিজ্ঞেসা করেছিলাম বৈষ্ণবীকে।

বৈষ্ণবী বলেছিলেন, কী আবার? কৃষ্ণের পৃথিবীর আমরা সব হলাম গিয়ে নারী। তা তুমি ছেলেই হও আর মেয়েই হওকৃষ্ণ একা বেটা ছেলে। জোয়ান মরদ। পুরুষ।

শ্রীনিবাস গোস্বামীও এই শ্ৰীপাঠে বসে একদিন বলেছিলেন, আমরা সব নারীবেশে চৈতন্য হয়ে কৃষ্ণের উপাসনা করি। চৈতন্য কেবল মহাপ্রভু নন। চৈতন্য আমাদের বিবেক, বৈরাগ্য আর জ্ঞান। এই তিনের বিকাশ হলেই আমরা বুঝতে পারব আমাদের স্বরূপ নারীর।

–আপনি তো চৈতন্যদেবের রাধাভাবে উপাসনার কথা বলছেন?

–তা নয়। তা নয়। চৈতন্যদেবই আমাদের বুঝিয়েছিলেন রাধাভাবে উপাসনা করে শরীর থেকে কামের সব বীজমন্ত্র ঝেরে ফেলতে। তাই তো কামগায়ত্রী।

বাউলও সে কথা বলেন। সঙ্গিনীর শরীরে ‘সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র’কে তারা জাগিয়ে নিয়ে কামগায়ত্রী রচনা করেন। কামবীজকে ধ্বংস করে দেন এভাবে তারা।

.

বহুল প্রচারিত পদটিতে আমরা দেখেছি চাঁদকে ফাঁকি দিয়ে ভোট নেবার কথা বলছে অজ্ঞাত পদকর্তা। ভোট’ এখানে নির্বাচন ঠিকই। এই নির্বাচন সাধনার মৌলিক প্রত্যয়। যেখানে ফাঁকি দিয়ে আর ভোট নেওয়া যাবে না, মানে সাধনা চলবে না, কারণ ভোটার অর্থাৎ সাধক চিনে গেছেন চাঁদকে। চাঁদের চলিষ্ণুতা শরীরস্থ সাক্ষ্যে হাজির করে। দিতে জানেন সাধক। সাধনায় তাই চাঁদ চেনা জরুরি। সাধকরা এখন তা চিনে গেছেন। প্রথমে সাধক চাঁদকে আদর করে কমিশনার করে দিয়েছিলেন। কিন্তু চাঁদ গুরুত্ব দেয়নি। ভোটারকে। চাঁদ অহংকারে মত্ত ছিল। পদকর্তা বলছেন–চাঁদের পাওয়ার তিন বছরের। তিন–তিনটে নাড়ি ঠিকই। কিন্তু এখানে ‘তিন’ সাধনার প্রথম তিনটে স্তর–স্থূল, প্রবর্ত, সাধক। এই তিন স্তরে চাঁদের ভূমিকা অনিবার্য। তার ‘পাওয়ার স্বীকার করেন দেহসাধক। চন্দ্র ঠিকঠাক সাড়া না দিলে সাধনা মোহাবস্থাতেই থেকে যাবে। সিদ্ধ দশাতে আর যাবে না। কখনও। তাই তিন বছর অর্থাৎ তিন স্তরের রঙ্গভূমিতে চাঁদের ইতিবাচকতা রয়েছে। সাধক বাউল যার জন্য তখন চাঁদের দৌরাত্ম সহ্য করেন। তারপর সিদ্ধদশাতে চাঁদ দিয়ে কাম বশীভূত করে নিয়ে তিনি চাঁদকেই চোখ রাঙান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *