অ্যাংলোচাঁদ

অ্যাংলোচাঁদ

লরা ম্যাসি ওর বরকে ছেড়ে পালানোর পর হঠাৎ কথাটা মনে এল আমার। যেটা বলেছিল সিরিল আমায় চাঁদনি রাতে ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে।

রোজকার মতো সিরিল সেদিনও নেশা করেই ছিল। না হলে আকাশের ত্রিসীমানায় কোথাও কোনো ঘুড়ি নেই, পাখি নেই, গর্জন করে উড়ে যাওয়া অ্যারোপ্লেন নেই, এমনকী শীতের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘও নেই। নীলচে কালো আকাশে শুধু একটা নিস্তব্ধ চাঁদ, আর তারই মধ্যে শিস দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর শখ হয় সাহেবের!

আমি ওর মুখপোড়া ঘুড়ির বদলে আধখাওয়া চাঁদটাই দেখছিলাম, যেটা নজরে আসতে সিরিল বলল, দেখে নাও, দেখে নাও, দিস ইজ আ ডিফারেন্ট মুন। এ একেবারে অন্য চাঁদ। দেখে নাও ডিপু।

আমি চাঁদই দেখছিলাম, ওর কথা শুনতে ওর দিকে তাকাইওনি। কিন্তু কথাটা কীরকম টংটং করে বাজল কানে, ট্রামের ঘণ্টির মতো। জিজ্ঞেস করলাম, এটা আলাদা চাঁদ বুঝি? কীভাবে?

সিরিল সাঁ সাঁ করে টেনে ঘুড়ি নামাতে নামাতে বলল, এটা অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান চাঁদ, তোমাদের বাঙালি বাড়ির চাঁদ নয়।

নেশা করে সিরিল এরকম অনেক কথাই বলে, আমি আমল দিই না। ভাবলাম নেশার বুকনিতে ওকে মারে কে! তার উপর চাঁদে পেয়েছে।

সিরিল ঘুড়ি নামিয়ে, লাটাই গুটিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে ফের বলল, তুমি ভাবছ আমি ঠাট্টা করলাম, ভাবো। বাট ইটস ট্রু। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছাদ থেকে দেখা চাঁদ আর বাঙালি ছাদ থেকে দেখা চাঁদ এক না।

বাড়ি ফিরে সিরিলের আরও একশোটা কথার মতো এ কথাটাও আমি ভুলে গিয়েছিলাম। অথচ, কেন জানি না, এইটাই সেই ট্রামের ঘণ্টির মতো মাথার মধ্যে বাজতে লাগল যেই খবরটা কানে এল বলাইয়ের মুদির দোকানে—লেনার্ডের বউ ভেগেছে।

লেনার্ড ম্যাসির বউ লরা। ছিপছিপে, হিলহিলে অ্যাংলো সুন্দরী, কেবল মুখটুকু বাদে সারাশরীরে সরু সরু, কাটা কাটা দাগ। দেখা যেত হাত, স্কার্টের নীচে পা, আর পিঠখোলা ব্লাউজ পরে থাকলে পিঠের খোলা অংশে। লরা রস করে বলত, মাই লাভমার্কস। ভালোবাসার চিহ্ন। আসলে লেনার্ডের ছুরিতে বানানো দাগ সব, খেপে গিয়ে, সন্দেহে পাগল হয়ে, কখনো বা ভালোবেসে করা। ছ-ছটা বছর মেয়েটা নাকি এভাবে ছুরির ডগায় বেঁচে আছে। একবার হাতে-পায়ে রক্তারক্তি অবস্থায় আমায় ডাক দিল দোতলার জানালা দিয়ে, ডিপু, হারি প্লিজ! শিগগির এসো!

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় করে উঠে গিয়ে দাঁড়াতে, বলল, শিগগির আমায় একটা ডেটল আর তুলে এনে দাও দাস ব্রাদার্স থেকে। রাশ, অর আইল ডাই। বলে রক্তে ভেজা একটা পাঁচ টাকার নোট ধরিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল বেতের সোফাতে।

আমি ডেটল এনে দাঁড়িয়ে আছি ওদের বসার ঘরে, লরা নেই। ছাঁৎ করে উঠল বুকটা। কী হল রে বাপ! মরে গেল নাকি? আমি বার কয়েক ডাক দিলাম, লরা! লরা! কোনো শব্দ নেই। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কানে এল একটা চাপা গোঙানি শোবার ঘর থেকে…আমার হাতে ডেটল আর তুলো কাঁপতে লাগল। আর দাঁড়িয়ে থাকা সয় না, আমি আস্তে করে ঠেলে সরিয়ে দিলাম বেডরুমের দরজা।

নারী-পুরুষের সংগম সেই আমার প্রথম দেখা। লরার গায়ের রক্তের ছিটে লেনার্ডের গায়েও। ওরা ভালোবাসছে, না একে অন্যকে খেয়ে ফেলছে কেউ ঠাওরাতে পারবে না। আমি ডেটল আর তুলো চৌকাঠের উপর নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম ওদের রকমসকম, তারপর চুপচাপ বেরিয়ে এলাম।

এরপরেও একদিন ডেটল না বেঞ্জিন কিনে আনতে হল। নিয়ে গিয়ে আর লেনার্ডকে দেখলাম না, সে তার কাটাছেড়ার কাজ সেরে জাহাজ-ডকের ডিউটিতে চলে গেছে। পরনের ফ্রক ছেড়ে মেয়েটা বিছানার চাদর জড়িয়ে সোফায় বসে ভিজে কাকের মতো কাঁপছে। বললাম, ভালোবাসার আর তোক খুঁজে পেলে না, লরা? আর কতদিন সহ্য করবে একে?

ওষুধটা নিতে নিতে ও বলেছিল, জানি জানি। শুধু বুঝতে পারি না ও কেন আমায় মেরেই ফেলে না।

বলাইয়ের দোকান থেকে ফেরার সময় সিরিলের কথাটা ঘুরছিল মাথায়। অ্যাংলো চাঁদ আর বাঙালি চাঁদ আলাদা।

হয়তো ভুলও বলেনি। দু-দিন যেতেই কেউ আর দেখি বিশেষ উচ্চারণও করে না ব্যাপারটা। ভাবখানা এমন অ্যাংলোদের মধ্যেও তো ঘটেই চলেছে। ছ-বছর বিয়ে টিকেছে, আবার কী চাই! পাড়ার গেজেট বলাই মুদিও একসময় হাল ছেড়ে বসল। বাঙালি পাড়ায় অ্যাংলো চাঁদ উঠল কি ডুবল কারও খেয়ালই রইল না।

আমি যতই ভাবি, এই ভাগাভাগিটা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না। শোভাকে নিয়ে চাঁদু পালালে গোটা পাড়া মাসখানেকের মতো ঝিম মেরে যায়। যেখানেই যাবে, একটা চাপা, ফিসফিসে কথাবার্তা। …হ্যাঁরে, ওরা কি রেজিস্ট্রি-টেজিস্ট্রি করেছে? না, এমনিই পালালে? …দূর! দূর! রেজিস্ট্রির কী দরকার? পেট তো বাঁধিয়েই বসেছে! সে খবর রাখো?… দ্যাখো, এবার কদ্দিন পর বউকে ঘরে তোলে কেষ্টচরণ!… তারপর হঠাৎ সংবিৎ ফিরলে আমাকে দেখে তোড়ফোড় বলাইয়ের, অ্যাঁ, এ সব কী? বড়োদের কথার মধ্যে টিপটিপ করে এসে দাঁড়ানো! কী চাই, মুড়ি-চানাচুর? তা, সেটা বলবি তো?

তখন আমার রাগি প্রতিবাদ, তোমরা তো সেই থেকে বিজ বিজ, বিজ বিজ করেই যাচ্ছ। আমার কথা শোনার মধ্যে আছ? বলাই বেগতিক দেখে একগাল হেসে বললে, তা যা বলিছিস। চাকরি-বাকরির যা মন্দার বাজার…এইসব নিয়েই বুড়োরা আমরা একটু ভাবনাচিন্তা করি।

কোনো মতে হাসি চেপে, সেই রাগভাব বজায় রেখে মুড়ির পয়সা গুনতে গুনতে বললাম, হু…!

লরার পালানো নিয়ে যে দু-দিন চর্চা চলল তারই মধ্যে ছোট্ট একটা বিপদ ঘটল আমার। পচা মাঞ্জা ফেরত দিতে গেছিলাম মৌলালির মোড়ে আক্রমের ঘুড়ির দোকানে। মাঞ্জা ফেরত নেবার ব্যাপারে ব্যাটা একদম পিশাচ। সমানে বাহানা করে যাচ্ছে একটা-না একটা। …ই দেখো, কৈসা মজবুত হ্যায়। ক্যা বোলতা মাঞ্জা তিখা নেহি?

আমি বলছি, এই ধরছি আমার এমনি সুতো। কাটো তত তোমার মাঞ্জা দিয়ে।

আক্রম ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে বলল, তুমি ঘুড়ি উড়াইতেই জানো না, ডিঙ্গু বাবা। তুমি আমার সময় নষ্ট করাচ্ছ।

আমি যারপরনাই রেগে গেছি, কী, আমি তোমার সময় নষ্ট করছি? তুমি যা-খুশি মাঞ্জা গচাবে আর…

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা হাত পড়ল আমার পিঠে, আস্তে করে। ঘুরে দেখি সিরিল। সারাশরীর মদে ভসভস করছে, চোখ দুটো জবার মতো লাল। বলল, লেট দ্যাট রাবিশ মাঞ্জা গো। তুমি আমার সঙ্গে এসো আমি তোমায় মাঞ্জা দেব।

ওর ওই অবস্থা দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে গেছি আমি। কোনোমতে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?

ও শক্ত করে আমার লাটাইধরা হাতটা ধরে টানল, কাম! সিরিলদের ছাদে এসে বসেছি যখন দু-জনে, তখন সন্ধ্যে নেমেছে চারপাশে। ঝপ করে খানিকটা ঠাণ্ডাও পড়েছে, কিন্তু আকাশে কোনো চাঁদ নেই।? দু-জনে দূরে দূরে দুটো ইটে বসেছি, কিন্তু এইখান থেকেই ওর মদের বিদঘুটে গন্ধ পাচ্ছি। সিরিল বলল, আজ আমার সব লাটাই, সব মাঞ্জা তোমায় দিয়ে দেব। বাট…

মস্ত মস্ত শ্বাস ফেলে সিরিল কথা ভুলে যাচ্ছে। কিন্তু আমার তর সইছে না, বলে বসলাম, বাট কেন?

সিরিল পকেট থেকে তামাক বার করে সিগারেট পাকিয়ে বলল, বাট…

ফের বড়ো বড়ো শ্বাস পড়া শুরু হল, কী বলতে চায় তাও যেন ভুলে গেল। আমি আর থাকতে না পেরে বলে দিলাম, ইউ আর ড্রাঙ্ক টুডে।

অন্ধকারে লম্বা একটা রিং ছাড়ল সিরিল। বলল, হ্যাঁ, আমি মাতাল। আমি সব সময়ই মাতাল। কিন্তু আমি কোনো অন্যায় করি না।

সিরিলের রিংগুলো যত উপরে উঠছে ততই রাস্তার আলো এসে পড়ছে ওগুলোর উপর। ছোট্ট ছোট্ট গর্তঅলা মেঘ যেন আমি ওই রিং গুনতে গুনতে বললাম, অন্যায়ের কথা বলছে কেন?

ও হাত দিয়ে একটা উড়ন্ত রিং ধরার চেষ্টা করল। দেখল রিংটা নেই। বলল, ইটস লাইক দিস। গত দু-দিনে আমি বারোশো টাকা রেসে হেরেছি, ঠিক এইভাবেই টাকাগুলো হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। কুইনেলা, ট্রেবল টোট, জ্যাকপট…সব ধোঁয়া!

বা-রো-শো টাকা! আমি মনে মনে হিসেব কষছি বারোশো টাকা মানে কত টাকা। কাকা মাইনে পায় হাজার। আমাদের জি ই সি রেডিয়োর দাম ছশো। জগরুর মাইনে তিরিশ। আমার স্কুলের মাইনে…

আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, এত টাকা…

সিরিল বলল, ঠিক বলেছ, এত টাকা। বাট আই ক্যান অলওয়েজ আর্ন দ্যাট ব্যাক। আই অ্যাম আ বি ও এ সি স্টাফ। ব্রিটিশ ওভারসিজ এয়ারলাইন্স কর্পোরেশন। ইউ নো দ্যাট?

বললাম, জানি। তাই বলে এইভাবে টাকা ওড়াবে?

হঠাৎ সিরিল উঠে এল আমার দিকে, আমি ভয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি ইট থেকে। সিরিল সিগারেটটা ছুড়ে দিয়ে আমাকে বিশ্রীভাবে জড়িয়ে ধরল আর কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। ওর ঘামে, গন্ধে, আদিখ্যেতায় আমার গা ঘুলিয়ে উঠছে। আমি  ওর হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম, প্লিজ লেট মি গো।

ও যেন সাপের ছোবল খেয়েছে হঠাৎ। ওর ওই মদে ভাসা লাল চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে মেলে ধরে আমায় বলল, ইউ টক লাইক লরা। তুমি তো লরার মতো কথা বলছ।

লরা! এবার চমকে উঠেছি আমি। আমার পায়ের আর নড়ার জো নেই। তোতলানো শুরু হয়েছে আমার, কেন, লরার কথা বললে কেন?

সিরিল টলতে টলতে ওর ইটের উপর কোনো মতে গিয়ে বসে পড়ে বলল, বিকজ আই লাভড হার। ওকে আমি মার্লিনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতাম। মার্লিন আমার বউ ঠিকই, কিন্তু লরা…লরা…শি ওয়জ…

রাগে, ক্ষোভে কাঁপতে কাঁপতে আমিই ওর হয়ে কথাটা শেষ করে দিলাম, আ বিচ!

সিরিল কিছু বুঝল, কি বুঝল না বুঝতে পারলাম না। অন্ধকারে হাবার মতো চেয়ে রইল আমার দিকে। আমি আমার পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ইস্পাতের ঠাণ্ডা ছুরিটা চেপে ধরলাম। সেই কবে তুলে এনেছিলাম পাড়ার ড্রেন থেকে। কেলে বিশেষ ছুরি। এই নিয়ে অ্যাটাক করেছিল মস্তান জগুদাকে। জগুদা এক প্যাঁচ ওকে মাটিতে ফেলে এই ছুরি দিয়ে ওর গেঞ্জি ফালা ফালা করে দেয়। তারপর পোড়া সিগারেটের মতো ছুরিটাকে টপকে দেয় নর্দমার দিকে। সে-দৃশ্য আমি ছাদ থেকে দেখেছিলাম। ওই চাঞ্চল্যের মধ্যে কারও নজরই যায়নি বিশের ছুরিটা শেষ অব্দি কোথায় গেল। পরে রাত নামতে, পাড়া শুনশান হতে আমি অন্ধকারে গুলি খোঁজার ভান করে জিনিসটাকে কুড়িয়ে এনেছিলাম ওখান থেকে। সেই থেকে তিন-তিন বছর এ জিনিস লুকোনো আমার ছাদে পায়রার খোপে। কেউ জানেনি কেলে বিশের অটোম্যাটিক ছুরি ঘুমিয়ে আছে আমার জিম্মায়। কেবল সেদিন চাঁদের আলোয়—

আমি চোখের জল মুছতে মুছতে ওটাকে ঘুম থেকে তুলে এই পকেটে ভরলাম…

আমি উঠে পড়েছি চলে আসব বলে, শুনি সিরিল ফের সেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে, ডিপু, ইউ টেক অল মাই লাটাইজ, অল মাই কাইটস অ্যাণ্ড মাঞ্জাজ, বাট…

আমি ভেংচানোর সুরে বললাম, বাট?

সিরিল ফের একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ফরগিভ লেনার্ড!

আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। লেনার্ডকে ক্ষমা! আর সে-কথা সিরিল বলছে কেন? ও কী জানে? কে ওকে কী বলল? হায় ভগবান, এভাবে তাজ্জব হওয়ার জন্য কি এই অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছাদ? যে-ছাদে এই মুহূর্তে কোনো চাঁদও নেই।

আমার তোতলামি যেন আর কাটে না। কী…কী…কী…বলছ তুমি, সিরিল? লেনার্ডকে ক্ষমা করার কথা উঠছে কেন? ও কী করেছে?

সিরিল মুঠো করে সিগারেটে টান দিতে দিতে বলল, ও যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। ইভন জিসাস ক্রাইস্ট কান্ট ফরগিভ হিম।

—কিন্তু ও করেছটা কী?

—হি হ্যাজ রেপড ইউ, হ্যাজনট হি?

আমি ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমি পকেটের মধ্যে ফেলে বিশের ছুরিটা জোর করে চেপে ধরলাম। চোখ ফেটে ক-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গালে। সিরিল ওর নতুন ধরানো সিগারেটটা আলসের বাইরে ছুড়ে ফেলে এসে দাঁড়াল আমার পাশে। আমার চোখের জল মোছাতে লাগল সিরিল, আর বলল, তোমার জন্যই লেনার্ডকে ছেড়ে চলে গেছে লরা। লেনার্ড নিজে আমায় বলেছে। অল হি সিকস নাও ইজ ইয়োর ফরগিভনেস। তুমি ক্ষমা করবে না, ডিপু?

ক-দিন হল সিরিল লেনার্ডকে ক্ষমা করার কথাটা বলেছিল আমি ভুলে গেছি। লরাও যে কতদিন বর ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে মনে রাখতে পারছি না। চাঁদ থাকুক, না থাকুক আমি কী এক ঘোরের মধ্যে রোজ ছাদে উঠে আসি সন্ধ্যে নামলেই। এখন সব চাঁদকে আমার আধখাওয়া ঠেকে, চাঁদ আর কমেও না, বাড়েও না, অমাবস্যার রাতগুলোও কী করে, কী করেই জানি উধাও হয়ে গেছে। এই এক অদ্ভুত চাঁদ আর ওই একটা শব্দ, ফরগিভনেস’, সিরিল আমার জীবনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যের অন্ধকারে এখন আমি ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিরিলদের জানলাটা দেখি; যেখানে পর্দার ফাঁক দিয়ে কিছুটা লালচে আলো ঠিকরে বেরোয়। লাল শেডের হলল্যাম্পের চাপা আলো। আর দেখি লেনার্ড-লরাদের জানালা, যেটা সেই থেকে খোলাও হয় না। একটা নিরেট অন্ধকার টানিয়ে লেনার্ডটা যে কোথায় লুকিয়ে থাকে আমি বুঝতেও পারি না।

আমি আস্তে আস্তে পকেট থেকে বার করে আনলাম কেলে বিশের ছুরি। বোতাম টিপে বার করে ফেললাম ওর লিকলিকে ধারালো ফলা। আর-হায়, আজও এক আধখাওয়া চাঁদের রাত। জ্যোৎস্নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলাম নিষিদ্ধ অস্ত্রের আকার-প্রকার। তিন তিনটে বছর ঘুমিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু মরে যায়নি। ওকে দেখতে দেখতে মনে পড়ল লেনার্ডের বিশ্রী ছুরিটাও। যা শিল্পীর তুলির মতো আলতো করে ও বুলোচ্ছিল লরার হাতে, বুকে, তলপেটে আর সমানে আমার দিকে ঘুরে বলছিল, দিস ইজ হাও ইউ মেক লাভ, বচ্চা। ডেটল, বেঞ্জিন ঘষে মেয়েদের ভালোবাসা যায় না। ভয়ে, উৎকণ্ঠায় আমার গলা বুজে আসছিল। কোনো মতে তাও বললাম, আমি তোমার বউয়ের সঙ্গে খারাপ কিছু করছিলাম না, লেনার্ড। আমি ওর ক্ষতে ওষুধ বুলিয়ে দিচ্ছিলাম।

ওষুধ?—বিশ্রীভাবে নাক সিটকালো লেনার্ড। মেয়েদের ওষুধের তুমি কী জানো? জানো, মেয়েরা কী ওষুধ চায়?

বলতে বলতে লরাকে ছেড়ে আমার উপর ঝাঁপাল লেনার্ড, ওর সারা গা থেকে বিশ্রী মদের গন্ধ। আমি দু-হাতে ওকে ঠেলে সরাতে গিয়ে হড়কে পড়লাম কাঠের আলমারিটার গায়ে। লেনার্ড চট করে আমার হাত দুটো ধরে টান টান করে বিঁধে দিল আলমারিতে। লজ্জায়, অপমানে আমি অবশ হয়ে গেছি, কিন্তু কাঁদতে পারছি না। যিশুর মতো আমার মাথাটা ঝুলে পড়েছে একদিকে, আর চোখ বন্ধ করে সহ্য করছি আমার গালে, আমার ঠোঁটে, আমার কপালে লেনার্ডের মাতাল চুম্বন।

আমি এও শুনছি দূর থেকে লরা চেঁচাচ্ছে, লেনি, ইউ কান্ট ডু কিস টু হিম। লেনি, ও একটা বালক মাত্র। লেট হিম গো!

এ যে কতক্ষণ চলেছিল আর কোনো দিন আমার মনে পড়বে না। যখন সংবিৎ ফিরল দেখি খাটে শুয়ে লেনার্ড ওর ছুরিটা শূন্যে ছুড়ে দিচ্ছে আর সেটা বুকে পড়ার আগে লুফছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে লরা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আর আমার সারা গা দিয়ে ঘাম ঝরছে মরা বৃষ্টির মতো। বাড়ি ফিরে এসে স্নানঘরে ঢুকে গায়ে প্রথম জলটা ঢালার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ ফেটে ভুলে যাওয়া কান্নাটা বেরোতে শুরু করল।

সেই রাতে বাড়ির সবাই দল করে উত্তম-সুচিত্রার ‘সপ্তপদী’ দেখতে বেরুচ্ছিল; আমি বললাম, তোমরা যাও, আমার পড়া আছে।

পড়া ঘোড়াই ছিল, ছিল বোঝাপড়া। আমি সন্ধ্যে হতেই টুকটুক করে উদ্ধার করলাম বিশের ছুরিটা পায়রার খোপ থেকে। একট ন্যাকড়া জোগাড় করে ঝাড়লাম সেটা, তারপর ওর ভোলা ফলায় চুমু খেয়ে শপথ নিলাম, লেনার্ড, দিস ইজ ফর ইউ। এই রইল তোমার জন্য, লেনার্ড।

কিন্তু না, লরাকে আমি বাঁচাতে পারিনি। ও নিজেই পালিয়ে বেঁচেছে। আমার আর চুপি চুপি ওর হাতে ছুরি গুঁজে দিয়ে বলা হল না, সারাগায়ে তোমার ছুরির দাগ এঁকেছে লেনার্ড। একবার শুধু এইটা দিয়ে ওর বুকের কোথাও একটা দাগ কমো, আমি দেখতে চাই।

না, না, ওই দৃশ্যটা আমি ভাবতে চাই না আর। শেষ অবধি লেনার্ড আমার শরীর নিয়ে কী করেছে আমি জানতেও পারিনি, কিন্তু লরার বুকের মাঝ মধ্যিখানে ওই সরু রক্তের নালি!

ফের সেই ডাক শুনেছিলাম জানালা থেকে, ডিপু, রাশ! আই’ম ডাইং।

আমি দৌড়ে উঠে গিয়ে দেখি নীল স্কার্টের উপর পাতলা সাদা ব্লাউজে ঠক ঠক করে কাঁপছে লরা। বলল, ওই ডেটলটা শিগগির নিয়ে এসো। বলেই বেডরুমে ঢুকে গেল। আমি ডেটল, বেঞ্জিন, তুলো নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি মেয়েটা ব্লাউজ ছেড়ে খালি গায়ে খাটের উপর বসে। আমায় বুকের মাঝখানটা দেখিয়ে বলল, আজ ও এখানেও ছুরি বোলাল।

আমি থমকে দাঁড়িয়ে দেখি ডেটল তুলো নিয়ে। আমি একটা নগ্ন মেয়ের গায়ে হাত দেব কেন? এ তো অসভ্যতা। এই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখাটাও পাপ।

আমি লরার সামনে ডেটল রেখে পিছন ঘুরে বললাম, নো, লরা, আই কান্ট টাচ ইউ। ইটস নট ডান।

আমার তখন মনে পড়ছে কাকার কথা কিছুদিন আগে। মাকে বলছিল আমায় ফিরতে দেরি দেখে—জানো বউদি, শেষমেষ ঠিকই করলাম দিপুকে বোর্ডিঙে পাঠিয়ে দেব। তোমার কষ্ট হবে জানি। কিন্তু দাদা থাকলে সেও এটাই চাইত। এই সব অ্যাংলো-ফ্যাংলোদের সঙ্গে ওর এত মেশামিশি ঠিক না। ওদের তো চরিত্র বলে কোনো বস্তু নেই।

আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চুপ মেরে শুনছিলাম।

লরার থেকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে কাকার কথাটাই ভাবছিলাম। টের পেলাম লরা শিশি খুলে ডেটলে তুলো ভিজিয়ে বুকে ঘষছে। ওর ঠোঁট গলে মাঝে মাঝেই ‘উঃ!’ ‘আঃ!’ শব্দ হচ্ছে। একবার বলল, হতচ্ছাড়া সিরিলটা বলে তোমার গায়ে ওষুধ দিতে আমায় ডাকো না কেন?’ স্কাউন্ডেল।

ও কেন বলেছিল এই কথাটা? আমাকে চটাতে? নাকি, আমি যাতে সিরিলকে ডেকে আনি? আমি বুঝতে পারিনি। শুধু বুঝলাম ওভাবে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা অমানুষের কাজ। তা হলে ডাক শুনে রাস্তা ডিঙিয়ে ছুটে এসেছিলাম কেন?

আমি ঘুরে গিয়েছিলাম লরার দিকে। বললাম, দাও, আমি ওষুধ বুলিয়ে দিচ্ছি। নারীর বুক কত গভীর আমি জানিনি কোনোদিন। মার বুকে মুখ লুকিয়ে তো কত কাঁদি কতদিন। কিন্তু এ কেমন শিহরণ ঠাকুর! আমি কি খারাপ হচ্ছে যাচ্ছি?

কত কথা বলছে লরা, আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। ব্যথার মধ্যে ও গানও গাইছে। ন্যাট কিং কোলের ফ্যাসিনেশন’। আর লক্ষ লক্ষ অচেনা অনুভূতির মধ্যে, অজ্ঞাত শিহরণের মধ্যে আবছা আবছা ভাবে আমি বুঝতে শিখছি সিরিল কেন কথায় কথায় আমায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, ইউ থিঙ্ক লরা লাভজ লেনার্ড?

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলি, ইয়েস! ইয়েস! ইয়েস!

ও ঘাবড়ে গিয়ে বলে, এত গলাবাজি করে বলার কী আছে? তখন ওর ওই বদ প্রশ্ন থামানোর জন্য আমি বলি, কারণ আমি জানি।

ও মুখ বিকৃত করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, শিট! আর এখন লরার খালি গায়ে ওষুধ বোলাতে বোলাতে আমি কেনই জানি না জিজ্ঞেস করে বসালাম, লরা, ডু ইউ লাইক সিরিল?

লরা গান থামিয়ে গিয়ে ওর সুন্দর ভুরু দুটো ধনুকের মতো বাঁকিয়ে তুলে বলল, হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করলে কেন?

আমার সত্যিই তো কোনো কারণ ছিল না এটা জিজ্ঞেস করার। তাই চট করে একটা মনগড়া কারণ ফাঁদলাম, কারণ ও তোমার খুব পছন্দ করে।

–করুক গে! ওকে বোলো ওই পছন্দটাক যেন মার্লিনের উপরে খরচ করে।

—আর লেনার্ডকে? ডু ইউ লাভ হিম?

লম্বা একটা শ্বাস ফেলল লরা। হ্যাঁ, না কী বলবে বলে চোখ বন্ধ করল, আর ঠিক তক্ষুনি দড়াম করে বেডরুমের দরজায় লাথি মেরে ঘরে ঢুকল লেনার্ড ম্যাসি। ভগবান জানেন কেন, ঠিক সেই লহমায়, আমার তুলোধরা আঙুলগুলো থমকে দাঁড়িয়েছে লরার বুকে।

সো হোয়াটস দ্য গ্রেট হিয়র দিস আফটারনুন?—লেনার্ড হাতভর্তি মদ আর খাবার রাখল মেঝেতে। লরা ওর ব্লাউজটা গায়ে চড়াতে যাচ্ছিল, লেনার্ড সেটা খামচে নিয়ে ছুড়ে দিল মাটিতে।

তারপর…

তারপর তো আমার আর কিছুই মনে পড়ে না। যখনই ভাবি ওই দৃশ্য—লেনার্ডের ওই মদো, ঘেমো মুখ চষে বেড়াচ্ছে আমার সারামুখে…হয়তো দেহেও, কারণ বাড়ি ফিরে দেখেছি হাওয়াই শার্টের সব বোম খোলা…আমার সব স্মৃতি অন্ধকার হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে বারকয়েক দেখা হয়েছে সিরিলের সঙ্গে। ওর শুধু এককথা লেনিকে ক্ষমা করে দাও। ও পাগল, কিন্তু মানুষ খারাপ নয়।

যেদিন ট্রামস্টপে দাঁড়িয়ে ফের এটা বলল ও, পাশ থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠল মার্লিন, খারাপ না মানে? মানুষ এর থেকে কত খারাপ হবে? সঙ্গে সঙ্গে চুপ মেরে গেল সিরিল।

আর কাল যেই বড়ো রাস্তার মুখে একই গাওনা শুরু করল ও, আমি পরিষ্কার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এত সব বলো কেন রোজ? আই অ্যাম ওল্ড এনাফ টু আণ্ডারস্ট্যাণ্ড অল দিস। আর তুমি যদি জানতে চাও তো শোনো—লরা কোনো দিনও তোমায় পছন্দ করেনি।

দপ করে নিভে গিয়েছিল সিরিলের মুখটা। অনেকক্ষণ চুপ থেকে মরা গলায় বলল, জানি আমি জানি।

–তা হলে?

—আসলে কী জানো, লেনি ছাড়া জগতে আমার কোনো বন্ধু নেই। আর প্রেমে পড়লাম তো ওরই বউয়ের প্রেমে পড়লাম। কত ছুরির আঁচড় যে মেয়েটা খেয়ে গেল আমার জন্য। গা দিয়ে রক্ত পড়ছে, কিন্তু কোনো দিনই ডাকেনি আমাকে বা মার্লিনকে। দেখতাম ডেটল নিয়ে তুমিই ছুটছ।

বললাম, তার যথেষ্ট মূল্যও পেয়ে গেছি সে-দিন।

সিরিল আমার কাঁধে হাত রাখল, অথচ জানো, তোমাকে ও ওভাবে ডাকছে দেখলে হিংসে হত আমার। ভাবতাম একদিন চারপাশে কোথাও তুমি থাকবে না, ও আমায় ডেকে ফেলবে নিরুপায় হয়ে। ডাকেনি। আর…

সিরিল একটু চুপ করে ছিল, আমি খোঁচালাম আর?

—আর মেয়েটা চলেও গেল তোমার জন্য। লেনিকে সেদিন রাতেই বলেছিল, ইউ হ্যাভ অ্যাবিউজড আ নাইস, ইনোসেন্ট বয়। আমি তোমার সঙ্গে আর থাকতে পারি না।

আমার বুকটা কীরকম কাঁপল হঠাৎ। বললাম, কিন্তু ও গেছে কোথায়?

সিরিল বলল, শুনেছি খড়গপুরে বোনের বাড়িতে।

—ফিরবে না?

—ফিরবে? আনবেটা কে?

–কেন, লেনার্ড!

সিরিল হাসল, ওর অবস্থা কী হয়েছে জানো? সেই থেকে ও মদ আর সিগারেটের উপর আছে। ও খায় না, ঘুমোয় না, কাজে যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে। ওর চাকরিটা হয়তো চলেই যাবে।

তাই! —জীবনে এই প্রথম লেনার্ডের জন্য একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুল আমার।

সিরিল বলল, তাও প্রথম প্রথম বলত তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে যাবে। এখন তো ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে, ওর সাড়াশব্দও বন্ধ হয়ে গেছে। পাশের ফ্ল্যাটে থাকে, তবু খবর নেওয়ার উপায় নেই।

-কেন?

—কারণ মার্লিন বলে হি ডিজার্ভজ টু বি লেফট অ্যালোন।

–তুমি তাই করছ তা হলে?

সিরিল প্রতিবাদ করল, না। আমি গতকাল ওর ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে ওকে বিছানা থেকে টেনে তুলে বেশ ক-টা চড় কষিয়েছি গালে-–সোয়াইন! তুমি লরাকে সন্দেহ করো। তুমি জানো কী ধাতুতে তৈরি মেয়েটা? শি ইজ অ্যান অ্যাঞ্জেল, ইউ ব্লাডি ফুল! যাও গিয়ে ফিরিয়ে আনো ওকে। আর ক্ষমা চাও গিয়ে ডিপুর কাছে।

আমি সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গেছি।… কেন, ক্ষমা চাইবে কেন আমার কাছে?

আমার তো কোনো অধিকার নেই ওর বউয়ের শরীরে ওষুধ লাগানোর! তুমি সহ্য করতে মার্লিন আর আমাকে ওভাবে দেখলে?

সিরিল স্তম্ভিত হয়ে গেল। বলল, ইউ মিন ইট? ইউ রিয়েলি মিন ইট? ও তোমার মনের কথা?

আমি পকেট থেকে ছুরিটা বার করে ওর সামনে ধরলাম—যেদিন ব্যাপারটা ঘটল আমি এই ছুরি পকেটে ভরেছিলাম। ভেবেছিলাম লরাকে দিয়ে বলব, একবার অন্তত ওকে মারো, রক্ত বার করো। কিন্তু…

—কিন্তু?

—কিন্তু এখন মনে হয় লরা এটা চাইত না। ও অবাক হত আমার কথা শুনে।

-কেন?

আমার গলা জড়িয়ে আসছিল, বুকে একটা চাপা ব্যথা হচ্ছিল। কোনো মতে বলতে পারলাম, ও যে লেনার্ডের ছুরির কাঁটা-ছেড়াকে ভালোবাসার চিহ্ন ভাবত। লাভ মার্কস।

আমি ফের ছুরিটাকে দেখতে লাগলাম চাঁদের আলোয়। আধখাওয়া চাঁদের আলোতেও ছুরি বেশ হিংস্র। আমি আস্তে আস্তে বাঁ-হাতের কবজির কাছে ব্লেডটা বুলোলাম আর শিউরে উঠলাম ‘উঃ! আর চমকে দেখি আমার পাশে নিঃশব্দে প্রেতাত্মার মতো এসে দাঁড়িয়েছে লেনার্ড।

আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, লেনার্ড! তুমি!

লেনার্ড আমার হাত থেকে ছুরিটা আস্তে করে সরিয়ে নিতে নিতে বলল, এটা খেলার জিনিস নয়, ডিপু। এ সব আমার মতো খারাপ লোকদের কাছে থাকাই ভালো।

ও আস্তে করে ছুরিটা বন্ধ করে নিজের পকেটে রাখল। আমি অবাক হয়ে ওকে দেখছিলাম। রোগা ফরসা শরীরটা তামাটে মেরে গেছে। চোখের তলায় গর্ত, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আর সারাহাতে সরু সরু আঁচড়।

আমি শিউরে উঠেছি—এ তোমার কী দশা, লেনার্ড? আর ইউ ও-কে?

ক্লান্ত হাসি হাসল লেনার্ড। পটপট করে জামাটা খুলে ফেলল। সারাগায়ে ছুরির দাগ। ঠিক যেমন ভরা লরার দেহ। বলল, আর ইউ হ্যাপি নাও, ডিপু?

বললাম, এতে খুশি হওয়ার কী আছে? আমি তো ড্রাকুলা নই।

লেনার্ড বলল, তুমি রিভেঞ্জ, বদলা চাও না? বললাম, না।

—আমি কিন্তু পেনান্সে, প্রায়শ্চিত্তে বিশ্বাসী।

–তোমার প্রায়শ্চিত্তের ধরনটা ভালো না।

–আমার ভালোবাসার ধরনটাও কি ভালো?

আমি চুপ করে গেলাম। ও কাছে এসে পকেট থেকে ছুরিটা বার করে বলল, জাস্ট টু শো হাও মাচ আই লাইক ইউ, ডিপু। তারপর কড়াৎ করে ছুরিটা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল নীচে। ছুরি এসে ওর ঘাড় ঘেঁষে মাটিতে গোত্তা খেল। আমি বললাম, এটা কী হচ্ছে লেনার্ড?

লেনার্ড এবার আরও উঁচুতে ছুড়ে দিয়েছে ছুরিটা। আমি ছুরিটা দেখতে গিয়ে আধখাওয়া অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান চাঁদটাও দেখে ফেললাম। এবার ছুরি এসে পড়ল ওর কোমরের পাশে। আমি চিৎকার করলাম, লেনি, স্টপ ইট!

লেনার্ড আরও উপরে ছুড়ে দিল ছুরিটা। বনবন করে পাক খেতে খেতে ছুরি উঠল উপরে। লেনার্ড চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল মাটিতে। চোখ বন্ধ করে ফেলেছি আমিও। খানিক পরে ফটাস আওয়াজ করে ছুরি পড়ল চোখ বুজে পড়ে থাকা লেনার্ডের গলার একসুতো দূরে।

লেনার্ড তখনও চোখ খোলার সময় পায়নি, আমি ছুট্টে গিয়ে ছুরিটা কুড়িয়ে ছুড়ে দিলাম ছাদ থেকে অনেকদূরে পারসিবাড়ির বাগানে। লেনার্ড বলে উঠল, এ কী করলে? এ কী করলে, ডিপু? খেলাটা নষ্ট করে দিলে।

আমি ফিরে এসে নীচু হয়ে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, দ্যাটস ও-কে লেনি। লেনি, আই লাভ ইউ! আমার কিছু মনে নেই, সে-দিন কী ঘটেছিল। নো কোয়েশ্চেন অব ফরগিভিং, আই সিম্পলি লাভ ইউ। তুমি যদি চাও আমি তোমার সঙ্গে যাব লরাকে ফিরিয়ে আনতে। তুমি প্লিজ আর কখনো ছুরি খেলো না।

আমার চোখের জল পড়েছে লেনার্ডের কপালে। ও আমার মুখটা ধরে কপালে চুমু দিল। চাঁদের আলোয় পাগলটাকে এখন আমার লরার মতো নিস্পাপ মনে হচ্ছে।

একবুক ক্লান্তির সঙ্গে লেনার্ড বলল, আহ, স্লিপ! কতদিন ঘুমোইনি…

ও ঘুমিয়ে পড়ল। আমি ওর পকেটে হাত গলিয়ে ওর নিজের ওই রক্তচোষা ভয়ংকর ছুরিটা বার করে চাঁদ লক্ষ করে আকাশে ছুড়ে দিলাম…

বুঝতে পারলাম না সেটা আর মাটিতে ফিরে এল কি না আদৌ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *