তিনজন দার্শনিক এবং একটি খুন

তিনজন দার্শনিক এবং একটি খুন

আমাদের কাহিনির একটা ছোট্ট ভূমিকা আছে।

১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দের যে দিনটায় দুর্জয় নৌপর্যটক ভাসকো-ডা-গামা ভারতের অভিমুখে জলপথ আবিষ্কারের মনোবাঞ্ছা নিয়ে টেগাস নদীর উত্তাল জলে দাঁড় ফেললেন সেদিনই পৃথিবীর একটা বিরাট অংশের মানুষের জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলল। ভাসকো-ডা গামা উত্তমাশা দ্বীপের ভয়ংকর ঝড়ঝঞ্ঝা পেরোলেন। আফ্রিকার উপকূলকে চোখের সামনে রেখে মেলিনদা অবধি এলেন। তারপর ভারত মহাসাগরের বেড়া পেরিয়ে ১৪৯৮ সালের মে মাসে মালাবার উপকূলের কালিকটে এসে পৌঁছোলেন। সেখানকার জামোরিনের সঙ্গে তাঁর ভারি খাতির হল। ভারতের ধনসম্পদ পোর্তুগালের লিসবন শহরের বন্দরে যাবার পথ পেল। পোর্তুগিজরা তাদের ব্যাবসার আখড়া করল ভারতে। কিছু জমিও তাদের দখলে এল। ১৫০০ সালের থেকে দশ বছরের মধ্যেই দিউ শহরে একজন পোর্তুগিজ গভর্নর বসলেন। সেই মহামান্য আলফনসো আলবুকার্ক।

কিছুদিনের মধ্যেই পোর্তুগিজরা এদেশের মেয়েদের এক নাগাড়ে বিয়ে করতে শুরু করে। তাদের অধিকাংশেরই স্ত্রী ছিল পোর্তুগিজদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত মুসলমানদের বউরা। আলবুকার্ক এইসব বিয়েতে উৎসাহ দিয়েছিলেন অনাথা বিধবাদের মঙ্গলের জন্য। তিনি বিয়েতে স্বয়ং উপস্থিত থেকে বর-বউকে উপহার দিতেন। কখনো অর্থ, কখনো বস্ত্র, আবার কখনো ফল-ফুল গহনা। শেষে এই বিয়ের তোড় এমনই বেড়ে যায় যে, ১৫১২ সালের পয়লা এপ্রিল আলবুকার্ক পোর্তুগালের রাজা মানুয়েলকে এক মস্ত চিঠিতে তাঁর এই প্রয়াসের বিপুল সাফল্যের কথা জানান। এবং মন্তব্য করেন যে, এরপর হয়ত এত শত বিয়ের অনুরোধ মঞ্জুর করা মুশকিল হয়ে পড়বে।

এরকম এক বিবাহের সূত্রে আমাদের নায়ক মুসা ডা কোসতার জন্ম। মুসার মা ছিলেন পরমরূপসী ফৈজু বেগম। পোর্তুগিজ স্বামী রোবেরতো ফৈজুর নিহত স্বামী মুসার নামে ছেলের নামকরণ করেছিলেন। এই রকম বহু সন্তানের প্রসঙ্গ তুলে ঐতিহাসিক স্যার ডবলিউডবলিউ হান্টার লিখেছিলেন :

The lofty names of Albuauerque and De Silva and De Souza are borne by kitchen boys and cooks.’

অর্থাৎ, আলবুকার্ক, ডা সিলভা বা ডি সুজা ইত্যাদি নামধারী ছেলেদের এখন রসুইখানায় রাঁধুনের কাজ করতে দেখা যায়। বলা অনাবশ্যক যে, বক্তব্যটা হালআমলের মানুষদের ক্ষেত্রে যেমন তেমনিভাবেই যোড়শ শতাব্দীর কোনো সময়ের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।

আমাদের নায়ক মুসা কিন্তু ওই ছোটোখাটো কাজে জড়িয়ে পড়লেন না। আজকালকার ভাষায় যাঁদের ইনটেলেকচুয়াল বলা হয় মুসা ঠিক তাই হলেন। বাবার পরিচর্যায় তিনি ভার্জিল পড়েছিলেন, ফৈজু তাঁকে কোরান পাঠ করান। এবং (সত্যিই আমাদের আশ্চর্য করেন ফৈজু!) ওই মা-ও বাবাকে বুঝিয়ে ছেলেকে দর্শনচর্চা করতে পাঠান মহাপন্ডিত আরিয়ার চেট্টির কাছে। আরিয়ার চেট্টি যে ভারতীয় দর্শনে কোনো স্থান পাননি তার মুখ্য কারণ তিনি পনেরো বছর বয়সে শঙ্করাচার্যের বর্ণাশ্রমপ্রথাকে অবাস্তব বলে পরিত্যাগ করেছিলেন। মহাজ্ঞানী শঙ্করের বহু তর্কের সঙ্গে তিনি একমত ছিলেন। কিন্তু বর্ণভেদ ব্যাপারটাকে তিনি ‘বালখিল্যের প্রলাপ’ বলে নস্যাৎ করেন। ভার্জিল পড়া মুসাকে তিনি শিষ্য করায় দক্ষিণের আর সব পন্ডিতেরা তাঁকে বানর বলে চিহ্নিত করেন। তিনি রাস্তা দিয়ে হাঁটলে উন্নাসিক ব্রাহ্মণেরা দুদ্দাড় করে বাড়ি ঢুকে পড়তেন। পাছে তাঁদের আরিয়ার চেট্টির ছায়া মাড়াতে হয়। শেষ বয়সে আরিয়ার গলায় ঘন্টাও বেঁধেছিলেন। যাঁর আওয়াজে ব্রাহ্মণেরা, উচ্চ বর্ণের মানুষরা সিগন্যাল পেতেন।

এই আরিয়ারের কাছ থেকেই মুসা ডা কোসতা এক ভয়ংকর ধ্যানশাস্ত্র শিখেছিলেন। অবয়বহীন বস্তুর কথা তিনি চিন্তা করতে পারতেন। কোনো ঘটনার প্রকৃতি বিচার করে তিনি ঘটনার পূর্বের স্রোত, অর্থাৎ কারণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারতেন। অ্যাবস্ট্রাক্ট ফিলজফির নানান মার্গে তিনি ঘুরতেন। এবং সর্বোপরি, তিনি কোনো মৃতদেহের মুখ দেখে মৃত্যুর কারণ বলতে পারতনে। না না, আরেকটু বেশি, তিনি চেষ্টা করলে খুন হয়েছে এমন কোনো মানুষের মুখের ধ্যান করে খুনির মুখ পেতে পারতেন। বার কয়েক এরকম হওয়ার পর সাধারণ মানুষ এই বিচিত্র ধর্মের, বিচিত্র মানসিকতার, এবং বিচিত্র শাস্ত্রের মানুষ মুসাকে মনে মনে বেশ ভয়ই পেত। সম্রম করত এবং এই কারণেই দার্শনিকে জামঠাসা দক্ষিণদেশে তাঁর শত্রুরও শেষ ছিল না। মুসা কিন্তু যার-তার অনুরোধে তাঁর শাস্ত্রে ক্ষমতা কাউকে দেখাতেন না। তবে তাঁর মাঝেমধ্যেই লোভ হত স্থানীয় রাজাকে তাঁর ক্ষমতায় মুগ্ধ করে গুরুর ঘণ্টাটা সরিয়ে দেন। কিন্তু গুরুই সেদিকে তাঁকে বারণ করতেন। শাস্ত্র দিয়ে ছোটোখাটো স্বার্থোদ্ধার অন্যায়। নিজের একঘরে হয়ে থাকাটাকে তিনি দৈবের বিধান বলে ব্যাখ্যা করতেন। সম্ভবত ওই একাকীত্বকে তিনি কিছুটা ভাগ্যও মনে করতেন। কেবল প্রচন্ড কামাসক্তি জাগলে তিনি সুদূর সমুদ্রতীরে গিয়ে কোনো মেছুনিকে অর্থ দিয়ে শরীরকে শান্ত করতেন। তবে সুপুরুষ মুসার পক্ষে বড়ো বড়ো গোঁড়া ঘরের মেয়েদেরও শয্যাসঙ্গিনী করায় বিশেষ অসুবিধে হত না। তাঁর মেধার কথা এমনিতেই রটেছিল। তাতে অনেক সুন্দরীই মনে মনে শিহরিত হতেন। তা ছাড়া নিজের অন্তদৃষ্টির বলে তিনি কখনো-সখনো মেয়েদের মুখের ওপর ধ্যানচক্ষু রেখে জেনে যেতেন কে তাঁকে চায়। শোনা যায় এক পরম গোঁড়া ব্রাহ্মণের কন্যা মুসার জন্য পাগল হয়েছিল। সেই ব্রাহ্মণ তখন কন্যাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেন। তবে যাক সেসব অন্য কথা।

বাবা-মার থেকে চলে এসে আরিয়ার চেট্টির সঙ্গে থেকে থেকে মুসা এক সমাজসচেতন মনোভাবের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। কতকগুলো নিম্ন শ্রেণির জাতির ওপর ব্রাহ্মণদের অত্যাচার তাঁকে খেপিয়ে তুলত। এই অবমাননা একটা বিশেষ পদ্ধতিতে তাঁর মা ফৈজুকেও সহ্য করতে দেখেছিলেন মুসা। তবে রোবেরতো পোর্তুগিজ সাহেব বলে সামনাসামনি ফৈজুকে কিছু বলার ধৃষ্টতা কারো হয়নি। তাই এক শীতের সকালে বাজারে তরকারি কিনতে গিয়ে একটা বড়ো বিজ্ঞাপন দেখে ভারি পুলকিত হলেন, মুসা। তাতে স্থানীয় রাজা ঘোষণা করেছেন যে, আততায়ীর হাতে নিহত তাঁর পুত্রের হত্যাকারীকে যে ধরিয়ে দিতে পারবে তাকে অজস্র উপহারে এবং সম্মানে ভূষিত করবেন রাজা। মুসার সহসা ইচ্ছে হল এই সামান্য কাজটুকু করে তিনি গুরুর গলার ঘণ্টাটি সরিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করবেন। তিনি বাজারের দোকানিদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানলেন রাজাই এই ছিল একমাত্র ছেলে। বয়স পঁচিশ কি ছাব্বিশ। তবে দোষের মধ্যে সে ছিল জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। গতকাল রাত্রে তাকে তার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সম্ভবত বিষ প্রয়োগে তার মৃত্যু হয়েছে, কারণ তার গোটা মুখটা ভয়ংকর রকম নীল। রাজপরিবারের কেউই তার সুন্দর মুখমন্ডলের ওই ভীষণ চেহারার দিকে তাকাতে পারছেন না। এবং আজই দুপুরে রাজা রাজ্যের সমস্ত দার্শনিকদের এই খুনের কিনারা করার জন্য সভায় আহ্বান জানিয়েছেন। সব শুনে মুসা ঠিক করলেন তিনি এই অনুসন্ধানে নামবেন।

আমাদের এই অবসরে জেনে রাখা দরকার যে, যে সময়ের চৌহদ্দিতে আমরা আছি তখন জ্ঞানী বলতে দার্শনিকদেরই বোঝাত। খুনের মতন নৃশংস কাজেও দার্শনিকদের মতামত চাওয়া হত। আজকের মতন গোয়েন্দাগিরি তখন ছিল না। তবে সবাই আশ্চর্য হবেন জেনে যে, ওই সুদূর কালেও আলোচ্য অঞ্চলে কণ্ঠাম্মা নামে একজন মহিলা অঙ্কশাস্ত্রবিদ এবং দার্শনিক ছিলেন, যিনি তাঁর প্রখর বিশ্লেষণী শক্তির বলে সে-সময়ের অনেক খুনের খুনিদের ঠিক ঠিক ধরিয়ে দিতে পেরেছিলেন। কণ্ঠাম্মার অনুসন্ধানের পদ্ধতির সঙ্গে ভয়ংকর মিল পাওয়া যায় আগাথা ক্রিসটির তৈরি চরিত্র মিস জেন মারপলের অনুসন্ধান রীতির। অর্থাৎ জেন মারপলের মতন কন্ঠাম্মাও বিশ্বাস করতেন যে, যেকোনো জটিল খুনের কেসের সমান্তরাল কোনো অতীতের কেস বার করা গেলে দুটোর মিল এবং অমিলের তারতম্যের বিচারে বর্তমান খুনের সূত্র পাওয়া যেতে পারে। মিস মারপলের মতোই কষ্ঠাম্মার স্মৃতিশক্তি ছিল বিস্ময়কর। এমনিতেই ছিলেন অঙ্কের মানুষ, তার ওপর খুনের খোঁজ করা তাঁর একটা প্যাশনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। প্রায়ই তিনি গ্রামে গ্রামে বা শহরের ভেতরে এবং আশেপাশে ঘুরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আড্ডা জমাতেন। কথায় কথায় খোঁজ নিতেন খুনের ব্যাপারে। অথচ নেহাতই আলাপের ঢং-এ। শোনা যায় কণ্ঠাম্মার আলাপে মুগ্ধ হয়ে একবার এক খুনি তার খুনের কাহিনি ওঁকে শোনায়। একবারও তার সন্দেহ হয়নি যে মানুষটা আসলে কে। এই কণ্ঠাম্মা সেদিন রাজার সভায় অনুসন্ধানের দায়িত্ব নেবেন বলে হাজির হন।

সেদিন দুপুরে সভায় এসেছিলেন মারকুট্টে মানুষ কনডাপ্পান থিরুমাই। বিভিন্ন সভায় ‘পাত্ৰাধার তৈল না তৈলাধার পাত্র বা ওই জাতীয় নানাবিধ বাক্যবাগীশ তর্কে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীকে নাজেহাল করে ছাড়তেন। কাকতালীয় বিষয়াদি নিয়ে অত চিন্তা সে-যুগের খুব কম মানুষ করেছিলেন। ধর্মের ওপর দক্ষিণের মানুষের উত্তরোত্তর শ্রদ্ধা হারানোর পিছনে কনডাপ্পান থিরুমাইয়ের মতন লোকের অবদান অনেকখানি। তাঁর বিরুদ্ধে তর্কে অবতীর্ণ হয়ে অনেক পন্ডিত সভায় প্রস্রাব করে ফেলেছিলেন। কিন্তু কনডাপ্পানের একটা মস্ত ক্ষমতা ছিল কথার প্যাঁচে, কথার জালে, কথার মায়ায় এবং বহু ক্ষেত্রে ধমকানির মাধ্যমে তিনি অনেক খুনিকে খুন স্বীকারে বাধ্য করিয়েছিলেন। কখনো কখনো খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিংবা ব্যাপারটা জানেন এমন লোকদের জেরা করে আসল খুনির সম্পর্কে তিনি জেনে যেতেন। সেই আমলের অনেক খুনের পাপীকে ধরাতে পেরেছিলেন কনডাপ্পান। আজকের দিনের পুলিশের অনুসন্ধান রীতির সঙ্গে তাই মিল পাওয়া যায় এই দক্ষিণী পন্ডিতের কর্মধারার। সভায় তৃতীয় দার্শনিক হিসেবে সেদিন উপস্থিত হলেন যুবক মুসা। এতদিনে মুসার ক্ষমতার কথাও অনেকে জেনে গেছেন। তিনি ঢুকতেই মন্ত্রীমশাই একটু তারিফের ভঙ্গিতে তাঁকে অভিবাদন জানালেন।

মুসা তাঁর সামনে বসে অনুভব করলেন যে, সভাস্থ সকলেই শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে। রাগে এবং দুঃখে বৃদ্ধ রাজার চোখ ফেটে জল আসার উপক্রম হয়েছে। তিনি কম্পিত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন তাঁর নিদারুণ দুঃখের কথা। বললেন, এই আমার একমাত্র সন্তান ছিল। এর ওপরের দু-জন মহামারীতে মারা গেছে। এখন আমি সম্পূর্ণ নির্বংশ হলাম। আপনারা রাজ্যের মহামতিরা, আসল দোষীকে বার করে আমার বাধিত করুন। একটা কঠিন প্রতিশোধের জন্য আমি মুখিয়ে আছি। আপনারা আমায় সাহায্য করুন। যিনি দোষীকে ধরাতে পারবেন তাঁর যেকোনো আর্জি রাখার কথা আমি বিবেচনা করব। আপনাদের সাতদিন সময় দিলাম।

সভা ভঙ্গের পরে তিন দার্শনিক কাচের বাক্সে শোয়ানো রাজপুত্রের মুখ দেখতে গেলেন। মুসা দেখলেন রাজপুত্রের মুখ অসম্ভব রকম নীল। যেন বিষে মুখটা পুড়ে গেছে। শিরায় যেন রক্ত আর লাল নেই। মুসা আরও কাছে গিয়ে মুখটার ওপর ধ্যানে নিবদ্ধ হলেন। তারপর একসময় ঘণ্টা বাজিয়ে সকলকেই বার হবার নির্দেশ দেওয়া হল। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে দার্শনিক মুসা দা-কোসতা গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। সোনালি দুপুরের রোদ তাঁর চোখে পড়ল না। রাস্তার আশপাশে গাছগাছালি, পুকুর, বিল কিছুই তাঁর নজরে এল না। তিনি অবিন্যস্ত এক চৈতন্যে প্রবেশ করলেন। যে চেতনার কেন্দ্রে এক খুন। যে খুনের পিছনে একটি মুখের ধ্যানে দার্শনিক মগ্ন। তিনি জানলেন না তাঁর গন্তব্য কোথায়। এইভাবে চলতে চলতে একসময় তিনি সমুদ্রের তটে এসে পৌঁছোলেন। তখন সূর্য ডুবুডুবু। এই প্রথম এক খুন হওয়া মানুষের মুখ থেকে একবিন্দু ইশারা মুসা পেলেন না। ঘনায়মান সন্ধ্যার মতন তাঁর ভাবনার দিগবলয়েও অন্ধকার ঘনিয়ে এল। এক নীলাভ মৃত মুখের চিন্তায় মগ্ন মুসা ক্রমশই নিজেকে অসহায় বোধ করতে লাগলেন। তাঁর সন্দেহ জাগল নিজের পদ্ধতির ওপর। কিন্তু তিনি হাল ছাড়লেন না।

সপ্তাহ শেষে রাজার প্রাসাদে আবার সভা। আপামর জনতা। আজ ভিড় করে এসেছে। খুনিকে চোখে দেখতে। অনেকে পচা ডিম এনেছে খুনির গায়ে মারবে বলে। অনেকে এনেছে ছেঁড়া চটি-জুতো। একে একে কণ্ঠাম্মা এবং কনডাপ্পান চার চার জন মানুষের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, এদের মধ্যেই কেউ খুনি। সমস্ত সভায় একটা চাপা বিস্ময়ের রোল ছুটে গেল। কী! এখনও খুনি স্থির হল না। চার-চারজনের মধ্যে থেকে আসল খুনি তাহলে বার করবে কে? এই চারজনের মধ্যে একটি মেয়েও আছে যার সঙ্গে রাজপুত্রের কিছুটা ভাব ভালোবাসা ছিল। তাদের মধ্যে রাজপুত্রের ছোটোবেলার বন্ধু গোপীনাথ আছে। গত আট বছর ধরে রাজকুমারের সঙ্গে তাঁর বিবাদ চলছিল। অদ্ভুত অদ্ভুত রাজনৈতিক মত পোষণ করার জন্য গোপীনাথ বেশ কিছুকাল রাজা এবং মন্ত্রীর বিরাগভাজন হয়েছেন। আর ছিল দু জন ডাকসাইটে খুনি, যারা যেকোনো কারণে যাকে-তাকে ছুরি মারতে পারে। কিন্তু তাই বলে জড়বুদ্ধি রাজকুমারকে তারা খুন করবে কেন? সকলেই কীরকম হতভম্ব হয়ে গেল। তাহলে খুনি কে? এই রকম এক বিচিত্র আবহাওয়ার মধ্যে মুসা দাঁড়িয়ে উঠে ঘোষণা করলেন যে, যে মৃতদেহটি তিনি দেখেছিলেন সেটি খুনই হয়নি! ওই মানুষটি স্বাভাবিক মৃত্যুতে মরেছেন। তাই গত সাত দিন ধরে ধ্যান করেও মুসা কোনো খুনির সন্ধান পাননি।

রাজার থেকে শুরু করে তাঁর মন্ত্রী এবং পারিষদবর্গ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। সমবেত জনতার সেই একই অবস্থা। অথচ মুসার মতন এক দার্শনিকের কথা তো জলে ফেলে দেওয়া যায় না! শেষে রাজাই জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আমার ছেলে কি খুনই হয়নি? তোমার বক্তব্য কী? তুমি কী চাও? মুসা বললেন, রাজন, আমি মৃতদেহটা ফের দেখতে চাই। তখন বাধা দিলেন মন্ত্রী। না, ওই দেহ আর দেখা যাবে না। গত পরশু আমরা শবদাহ করে এসেছি। আপনি খুনি না পেয়ে থাকলে চুপ করে কোণায় গিয়ে বসুন। আমরা অন্য দু-জন দার্শনিকের কথা শুনব।

বহু অনুনয়-বিনয়ের পর মুসা সেদিন আরো পনেরো দিন সময় পেলেন। কাম্মা এবং কনডাপ্পাও সময় পেলেন ওই সময়ের মধ্যে সন্দেহভাজন চারজনের মাঝখান থেকে খুনিকে বার করার। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে মুসা বুঝলেন এবার তাঁর কর্মপদ্ধতি একটু অন্য রকম হবে। স্রেফ ধ্যানে বসলে চলবে না। তাঁকে রাজকুমারের আসল ধড়টা যেখান থেকে হোক বার করে আনতে হবে। তাঁর ঘোর সন্দেহ জেগেছে তাঁর দেখা মৃতদেহ সম্পর্কে। প্রথমত ওই মানুষটিকে কেউ খুনই করেনি। সম্ভবত রাজকুমারের সঙ্গে তার চেহারার প্রচুর মিল আছে। এর স্বাভাবিক মৃত্যুতে গোপন চক্রান্তকারী একটা সুযোগ পেয়েছে। সে রাজকুমারকে এই সুযোগে গুম করে এই মৃতদেহের মুখে অজস্র নীল রং মাখিয়ে এটিকে রাজকুমারের বলে চালিয়েছে। ওদিকে জড়বুদ্ধি রাজকুমারকে গুম করা বিশেষ ঝামেলার কিছুই না। এবং যেই এই কাজ করে থাকুক তার এই লাশ বদলের একটাই যুক্তি। দার্শনিক মুসা দা-কোসতার অনুসন্ধান রীতিকে ফাঁকি দেওয়া। মুহূর্তের মধ্যে নিজের পদ্ধতির ওপর মুসার অজস্র বিশ্বাস জন্মাল। তিনি জানলেন এই খুনের প্রতিশোধ নিতে একমাত্র তিনিই সাহায্য করতে পারেন। ওঁর তুলনায় কণ্ঠাম্মা এবং কনডাপ্পান স্থূল বুদ্ধির মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে মুসার আরো একটা আতঙ্ক জন্মাল। যদি তিনি খুনিকে বের না করেন ওই অপর দুই দার্শনিকের দৌরাত্ম্যে আরো একটা নিরীহ প্রাণ নষ্ট হবে। অত্যন্ত বিচলিত বোধ করে মুসা ত্রস্ত পায়ে শ্মশানের ডোমেদের মহল্লার দিকে হাঁটলেন।

কিন্তু হায়! কোনো ডোমই রাজপুত্রের লাশ পুড়িয়েছে বলে মনে করতে পারল না। মুসা তাঁর দেখা মৃতদেহটাকে মনে করে আসল রাজপুত্রের মুখের আদলের কথা তাদের বললেন। কারণ প্রাসাদে দেখা লাশের মুখ এবং আসল রাজপুত্রের মুখ একরকম হতেই হবে। এইভাবে এক মহল্লা থেকে মুসা অন্য মহল্লায় গেলেন। তাঁর চোখে-মুখে প্রশ্ন। অবশেষে ব্যর্থ মনোরথ মুসা সমুদ্রতটে জেলেদের সঙ্গে ভাব জমালেন। পাছে খুনি লাশটাকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে থাকে। কিন্তু কেউ কোনো হদিশ দিতে পারল না। রাত গভীর হতে মুসা গভীর চিন্তা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। দেখলেন গুরুর ঘরে প্রদীপ জ্বলছে, কিন্তু তিনি ঘরে নেই। পরিচারিকা অনুসূয়া খবর দিল গুরু মেছুনিদের আড্ডায় তাঁর রক্ষিতা পদ্মিনীর কাছে গেছেন। ক্লান্ত, দুর্বল মুসা কিছু না খেয়েই মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।

ভোরবেলা বাড়ি ফিরেই আরিয়ার চেট্টি মুসাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুললেন। বললেন, শুনছিলাম তুমি ক-দিন যাবৎ একটা মড়া খুঁজে বেড়াচ্ছিলে। কাল রাতে মেছুনি পদ্মিনীর কাছে শুনলাম ওঁদের বাড়ির পাশের জঙ্গলে একটা লাশ পচছে বেশ কিছুকাল ধরে। তুমি পারলে একবার খোঁজ নিও।

এই সংবাদে মুসা যার পর নাই খুশি হয়ে গুরুকে ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করতে লাগল। তিনি যতই জানতে চাইলেন মুসার কী দরকার লাশটাকে দিয়ে, মুসা কেবল কথাটা নানান রকম ভণিতা করে, মিথ্যে বলে কাটিয়ে গেলেন। সূর্য ভালোভাবে আকাশে প্রকাশ হতে মুসা হাতে একটা প্রকান্ড ছাতা নিয়ে তাই মাথার সামনে মেলে ধরে লাশের সন্ধানে বার হলেন। তাঁর ছাতার জন্য কেউ তাঁর মুখটা দেখতে পেল না। মুসার ভয় ছিল আসল খুনি নিশ্চয়ই তাঁর ওপর নজর রেখেছে। জঙ্গলের দিকে তাঁকে যেতে দেখলে আক্রমণ করতে পারে। মনে মনে মুসা জানল তাঁর এই সাফল্য অচিরেই তাঁর গুরুর গলার থেকে ঘণ্টাটা নির্বাসিত করবে। লোকেও জানবে কষ্ঠাম্মা এবং কনডাপ্পান আসলে হাতুড়ে দার্শনিক। সত্যিকারের জ্ঞানী হলেন আরিয়ার চেট্টি এবং মুসা।

বহু মেঠো পথঘাট পেরিয়ে, ডোবা-বিল ডিঙিয়ে শেষে যখন মুসা এসে পৌঁছোলেন তাঁকে বেশ ক্লান্ত ঠেকছিল। কিন্তু নষ্ট করার মতন সময় তাঁর নেই। এখনও যদি তিনি আসল রাজকুমারের মুখটা দেখতে পান তবে বাকি ক-টা দিনে তিনি ধ্যান করে খুনিকে ঠাওর করতে পারবেন। গভীর জঙ্গলে এবার মুসা তার নাকটা কাজে লাগালেন। পচা লাশের গন্ধ তাঁর পাওয়া চাই।

লাশের গন্ধ তিনি পেলেন। তারপর লাশও পেলেন। তারপর গভীর মনোনিবেশ করে লাশের মুখ পরখ করার পর মুসা মাথা তুলে দেখলেন একটা খোলা তরোয়াল হাতে তাঁর মাথার অদূরে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং মন্ত্রীমশাই! মুসার চোখে চোখ পড়তে তিনি হাসলেন। বাঃ! বাঃ! চমৎকার! মুসাভাই চমৎকার! আমি জানতাম আমার আদত শত্রু তুমিই। তুমিই পায়রা সত্যিকারের অনুসন্ধান করতে। এবং স্রেফ তোমার জন্যই গত পাঁচ বছর ধরে ক্রমাগত চেষ্টা করেও এই গর্দভ রাজকুমারকে আমি কোতল করতে পারিনি। আমার দরকার ছিল ওর মতোই একটা মানুষ যে খুন হয়নি। যার লাশ দিয়ে আমি কেবল তোমার চোখে ধূলো দেব। কিন্তু হায়! তাও পারলাম না।

মন্ত্রীর কথায় মুসা টের পেলেন এই সন্ধান চালিয়ে যাওয়ার অর্থ মৃত্যু। এবং এখনই। তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু আপনি একে মারলেন কেন? মন্ত্রী হাসলেন। কারণ তো খুব স্পষ্ট। আমি রাজা হতে চাই। এই ছেলের আগের দু-জনকেও আমি বিষ খাইয়ে মেরেছি। কিন্তু সে-সময় দেশে তোমার মতন ধূর্ত কোনো দার্শনিক ছিল না। তোমার অদ্ভুত ক্ষমতার প্রচার শুনে আমি এই তৃতীয় খুনের জন্য এতখানি অপেক্ষা করেছি। আজ তোমার জন্যই আমি এখানে অপেক্ষায় ছিলাম। এবার বলো তুমি বাকিটা জীবন এই ব্যাপারে চুপ থাকতে পারবে কি না। যদি পারো আমি তোমাকে সর্বতোভাবে পুরস্কৃত করব। তোমার গুরুর গলার ঘণ্টা আমি কাবেরীর জলে ছুড়ে ফেলে দেব। তোমার শাস্ত্রের বহুমুখী প্রচার করাব ভারতের প্রান্তে প্রান্তে। আর যদি মূখের মতো, দাম্ভিকের মতো সত্যানুসন্ধী হতে চাও তাহলে এই তরোয়াল তোমার গর্দানে পড়বে। তোমার গুরুর গর্দানে পড়বে। সব সত্যই জানার প্রয়োজন হয় না দার্শনিক!

নিজের প্রাণভয়ে, গুরুর প্রাণের কথা চিন্তা করে মুসা দা-কোসতা সেদিন মন্ত্রীর শর্ত মেনে নিলেন। যথাসময়ে রাজসভায় মহাত্মা গ্যালিলিওর মতন ঘোষণা করলেন, আমার পদ্ধতি ভুল। আমি লজ্জিত। সভাস্থ সকলেই একবাক্যে ধিক্কার দিল আরিয়ার চেট্টির মহান শিষ্যকে। কণ্ঠাম্মার তথ্য মেনে নিরীহ গোপীনাথকে রাজা মৃত্যুদন্ড দিলেন। একটা নতুন রাজনৈতিক চিন্তা লুপ্ত হল গোপীনাথের সঙ্গে সঙ্গে। মাথা হেঁট করে বাড়ি ফিরে এসে মুসা ঘরের কোণে লজ্জায় মুখ ঢাকলেন। আরিয়ার চেট্টি রাগে-দুঃখে-অভিমানে অকথ্য গালিগালাজ করলেন শিষ্যকে। বললেন, বারবার আমি বলেছিলাম তুমি ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য নিজের শাস্ত্রজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ো না। তুমি তাই করলে। আমি পরে জেনেছিলাম সব। কিন্তু কেন তুমি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামনে পড়ে নিজের শাস্ত্রকে ভ্রান্ত বললে? একবার শাস্ত্র প্রয়োগ করলে তার শেষ দেখতে হয়, তুমি না আরিয়ার চেট্টির ছাত্র ! আমার গলার ঘণ্টা তুমি ঘোচাবে বলে আমি লাশের হদিশ দিইনি। দিয়েছিলাম সত্যের সম্মানে। তাও তুমি পারলে না। তুমি আমার শিষ্য বলে আর পরিচয় দিও না।

এরপর আত্মাভিমানী আরিয়ার চেট্টি কাবেরীর জলে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। সেই রাতেই মুসা বাড়ি ছেড়ে গভীর অরণ্যের দিকে রওনা হলেন। তাঁর কথা আর কেউ কোনোদিন শোনেনি এবং তাঁরই সঙ্গে তাঁর অভিনব গোয়েন্দাশাস্ত্র অবলুপ্ত হয়। তবে বিচক্ষণ কণ্ঠাম্মা তাঁর একমাত্র পুত্রের নাম রেখেছিলেন মুসা। সমাজের কোনো বিরোধ তিনি মানেননি তখন। এত আশ্চর্য শ্রদ্ধা তার জন্মেছিল মুসা দা-কোসতার ওপর। তবে তাঁর এই সন্তান ছিল জড়বুদ্ধি। অনেকে এই নামের ধাঁধায় একে অন্যকে গুলিয়ে ফেলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *