ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে

ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে

টিভিতে একটা দারুণ হরর ছবি দেখা হচ্ছিল হাতে বিয়ারের কৌটো নিয়ে। ভয় বা সাসপেন্স কোথাও কম হলে বাপী যেন কিছু বলি বলি ভাব করেও থেমে যাচ্ছিল।

একবার দু-বার ভেবেছিলাম ও বলতে চাইছেটা কী? অন্ধকার ঘরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলাম ওর মুখের হাবভাব। মনটা একরকম ডুবেই আছে টিভির হররে। আবার কিছুটা ভেসেও আছে কোথায় যেন একটা। ভয়ের ছবির টেনশনের সঙ্গে অন্য কী একটা টেনশনও যেন মিশেছে।

কিন্তু বাপীর টেনশন। টেনশন কথাটাই যেন ওর ডিকশনারিতে নেই। যেকোনো পরিস্থিতিতেই ঠাণ্ডা মাথায় টেনে টেনে কথা বলাই ওর স্টাইল। টুকিটাকি ব্যক্তিগত হিসেব লেখার সময়ও হালকা করে চালিয়ে রাখে বব ডিলান কী মেহেদি হাসানের গান। দাড়ি কামাবার সময়ও জ্বলন্ত ‘ক্যামেল’ সিগারেট একটা শোয়ানো থাকে বেসিনের ধারে অ্যাশট্রেতে। গোটা কয়েক ব্লেডের পোঁচ দিয়েই সাবান-লেপা মুখে দু-এক টান দিয়ে নেয় সিগারেটে। যা টেনশন থেকে নয়, আরামে।

ও যখন ছুটির দিন দুপুরে লাঞ্চের পর লেনিন বা মাওদের বই মুখে নিয়ে আরাম কেদারায় বসে তখন ক্ষণিকের জন্য টের পাই ও আসলে কী ছিল কলেজে। ডাকসাইটে নকশাল অ্যাক্টিভিস্ট। বোম ছুড়ছে, ছুরি চালাচ্ছে, পুলিশের বন্দুক কাড়ছে, একেক রাত একেক পল্লিতে শুচ্ছে, ক্কচিৎ কখনো কফিহাউস বা কলেজ স্ট্রিটের গলিগালায় দেখা হলে সোৎসাহে কুশল জানছে, তোরা বেঁচে আছিস তো?

আমরা তখন মনে মনে হাসি। কেন, আমাদের মরার কী হয়েছে? আমরা কি রাজনীতি করে বেড়াচ্ছি? আর সেই প্রশ্ন শুধোচ্ছে কি না রাজনৈতিক শত্রু আর পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে-বেড়ানো বাপী।

তারপর একসময় পালাতে পালাতে বাপী এই লণ্ডনে। মস্তবড়ো হোটেলে বড়োসড়ো চাকরি আর রেকর্ড, বই নিয়ে ভুলে আছে সবকিছু। আমি কাজের যোগাযোগে মাস কয়েকের জন্য লণ্ডন এসে প্রথম ওকে খবর দিলাম, তোদের বোধ হয় পালিয়ে-বেড়ানোর ইতি হল। বামফ্রন্ট সরকার তোদের বিরুদ্ধে যাবতীয় কেস উঠিয়ে নিয়েছে।

কথাটা শুনে বাপী খুশি হয়েছিল, না হয়নি বোঝার উপায় ছিল না। সাদামাঠাভাবে শুধু বলেছিল, ভালো।

আর বাপী এখন আমার পাশে মোটা লেপ চাপা দিয়ে নরম কার্পেটে শুয়ে। ঘুমোয়নি যে তার যথেষ্ট ইঙ্গিত ওর থেকে থেকেই এপাশ-ওপাশ করা, যা কখনোই করে না। হোটেলে কাজ করার দরুন বিয়ার-হুইস্কিটা প্রায় নিখরচায় হয়। নেশায় থাকে বলে বিছানায় পড়ে আর ঘুমোয়। যেটা আজ হচ্ছে না।

এপাশ-ওপাশ করতে করতে একবার আমার দিকে পাশ ফিরে ডেকে উঠল বাপী অ্যাই নীতিন, ঘুমিয়ে পড়লি?

আমি মোটেও ঘুমিয়ে পড়িনি, কিন্তু দর বাড়ালাম প্রথম ডাকে সাড়া না দিয়ে। বাপী ফের ডাকল, অ্যাই নীতিন।

আমি ঘুম জড়ানো গলায় ভান করে বললাম, কী?

বাপী বলল, সকাল বেলায় বাবলিকে দেখলি?

বাবলিকে সেদিন সকালেই দেখেছিলাম বাপীর ফ্ল্যাটে। ভারি সুন্দর মেয়েটি। যাকে বলে বিউটি। একটু চাপা গায়ের রং, যাতে রূপ আরও ফুটেছে। একটু মেমসাহেব মেমসাহেব ভাব আছে চেহারায়। স্মার্ট কথাবার্তা, দারুণ ইংরেজি অ্যাকসেন্ট। যদিও মাত্র মাস কয়েক হল বিয়ে হয়ে লণ্ডনে এসেছে। একটু বুঝি গর্ব করেই বলছিল, আমি কিন্তু লণ্ডনের প্রোডাক্ট নই, নীতিনদা। ষোলোআনা কলকেতে। লোরেটো মিডলটন।

কিন্তু আমি নজর করেছিলাম আরও একটু বেশি কিছু। হাসিখুশি মেয়েটা আসলে বেশ বিষণ্ণও। সুন্দর মুখে সেরকম একটা ছায়া আছে। অনেকক্ষণ কথা বললে হঠাৎ হঠাৎ ‘আহা’! ‘উহু’-ও বেরিয়ে আসে। ব্যাপারটা আমি নজর করেছিলাম, কিন্তু আমল দিইনি। অন্যের। ব্যাপারে ও ধরনের শৌখিন গোয়েন্দাগিরি ভালো নয়। আমার আসেও না।

বাবলি চলে যেতেই বাপী বলেছিল, ও হল নীলুর বউ। নীলুকে তো তুই চিনিস।

চিনি বই কী। নীলুকে চিনব না। ক-দিন আগেই তো নিউক্যাসল থেকে উইক-এণ্ডে এসে কীরকম হইচই করে গেল। আর কী দেবদূতের মতো চেহারা! এত সুন্দর নিটোল ফর্সা ধবধবে চেহারা যে হঠাৎ দেখলে মেয়ে মনে হয়। তার ওপর পরেছিল লাল টকটকে। ফুলহাতা সোয়েটার। সোয়েটারের ‘ভি’ কাট কলারের কাছে কালো টাই ঝকঝক করছে সাদা শার্টের ওপর। দেখে বুঝেছিলাম ছেলে খুব শৌখিন আর সেলফ কনশাস। বিয়ার খেতে খেতেও বেশ তাকিয়ে নিচ্ছিল পেছনের আয়নায়।

আমি লেপের ভেতরেই পাশ মুড়লাম বাপীর দিকে। বললাম, দেখলাম তো বাবলিকে। কেন কী হয়েছে?

বাপী বলল, নীলু ওর থেকে ডিভোর্স চেয়েছে।

হঠাৎ করে আমাদের উষ্ণ বিছানায় কে যেন ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিয়েছে। শুধু বিস্ময় নয়, কীরকম একটা আতঙ্ক হল ভেতরে, অত সুন্দর একটা মেয়েকে ছেড়ে দিতে চায়! কেন, কী হতে পারে ওদের মধ্যে? এই তো সবে বিয়ে করে এল।

বললাম, ডিভোর্স কেন? নীলু কি কোনো মেমসাহেব নিয়ে পড়ল?

বাপী বলল, মেমসাহেব নয়, জাস্ট সাহেব।

–তার মানে!

–নীলুর প্রেমিক একটি পুরুষ। নীলুর অধ্যাপক।

–কী বলছিস কী? ইউ মিন নীলু ইজ আ হোমোসেক্সয়াল?

–হ্যাঁ। আরও চলতি ভাষায় বলতে গেলে হি ইজ আ গে। গে কথাটা শুনেছিস? আমি এতই অবশ হয়ে গেছি ভেতরে ভেতরে যে বাপীর কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে হল । বাপী ভালো করেই জানে যে ইংরেজি ডিকশনারির কোনো শব্দই প্রায় আমার অজানা নয়। ওটা বলে ও বোধ হয় আমাকে একটু চটাতে চেয়েছে। আমি গা করলাম না। চুপ করে রইলাম।

বাপী ফের বলল, ট্র্যাজেডিটা কী জানিস? নীলু আর বাবলির প্রেম সাত-আট বছর বয়স থেকে। দু-বছর আগে যখন বিলেতে পড়তে এল নীলু তার আগে ওদের আশীর্বাদও হয়ে গেছে। কিন্তু ছ-মাস আগে যখন ও দেশে ফিরল বিয়ে করতে ও পুরোদস্তুর গে।

উত্তেজিত হয়ে আমি কথার মধ্যেই জিজ্ঞেস করে বসলাম, তো সে-কথা ও জানাবার প্রয়োজন বোধ করল না বাবলিকে?

অন্ধকারের মধ্যে বালিশের আশপাশ হাতড়ে বাপী সিগারেটের প্যাকেট বার করল। একটা নিজে ধরিয়ে আরেকটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। ঘুমের দফারফা তো হয়েইছে, সে-ক্ষেত্রে আরেকটু ধূমপান হলে মন্দ কী? আমিও সিগারেট ধরালাম।

একটা লম্বা সুখটান দিয়ে বাপী বলল, নীলু সবিস্তারে সব জানিয়েছিল। ব্যাপার-স্যাপার জেনে বাবলির বাবা-মা বিয়ে ভেঙে দিতে চায়। কিন্তু বাবলি দেয়নি। বলেছিল ওকে ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করতে পারব না। ওর গোঁ ছিল ও বিয়ে করে বরকে শুধরোবে।

আম বললাম, পারেনি?

বাপী মাথা নাড়ল। বাপী সিগারেট খাবে বলে উঠে বসেছিল। জানালার বাইরে থেকে স্ট্রিট লাইটের এক মৃদু রশ্মি ঘরের একটা দেওয়ালে এসে পড়েছিল। তাতে ততটুকুই আলো হচ্ছিল যাতে মানুষকে ছায়া হিসাবে ঠাওর করা যায়। আর তাতেই আমি বুঝলাম বাপী মাথা দুলিয়ে না বলছে।

আমি ফের বললাম, অগত্যা?

-অগত্যা ডিভোর্স। তার আগে একটা শেষ চেষ্টা করব কি না ভাবছি।

—শেষ কী চেষ্টা?

–ওই সাহেবটাকে বোঝানোর।

—কী বোঝাবি? আর সে-চেষ্টা কি বাবলি করেনি ভাবছিস।

-না, মোটেও তা ভাবছি না। কারণ বাবলি তা করেছে। ওকে নাকি জিম বলেছে যে, কেউ যদি তোমার প্রেমিককে কেড়ে নিতে চায় তাতে কি তুমি সম্মতি দেবে?

কথাটা শুনেই কেমন রি রি করে উঠল গা-টা। সামনে লোকটা থাকলে হয়তো ঠেসে চড় কষিয়ে দিতাম। কথার ছিরি কী পুরুষ মানুষের।

বললাম, তাহলে আর কী চেষ্টা করবি তুই?

বাপী গলা নামিয়ে বলল, চেষ্টা আর কী! গিয়ে তিন ঠুসো মারব। চোয়াল ভেঙে দেব। প্রচন্ড ঝামেলা পাকাব।

আমার মনের ওপর ঝিলিক দিয়ে গেল সেই বাপী। নকশাল আন্দোলনের আগুন আর বোমার মাঝখানে হাতে পেটো নিয়ে দাঁড়িয়ে একরোখা ছেলেটা ফুঁসছে।

আমি ওর আজগুবি উচ্ছাসে জল ঢালার জন্য বললাম, তাতে আর কী সুবিধে হবে বাবলির? নীলু যদি হোমোসেক্সয়ালই হয়ে থাকে তাহলে সবার আগে সারানো উচিত তো ওই হারামজাদাকে। সাহেবকে মেরে ভাগাতে কতক্ষণ? কিন্তু তাতে কি ঘরের ছেলেটার চরিত্র সংশোধন হবে? সে তো আবার একটা পুরুষ ধরবে।

রাগের মাথায় প্রিয় বন্ধু সম্ভর ছোটো ভাইটাকে খিস্তি দিয়ে ফেলল বাপী, শালা মাদী কোথাকার।

আমি বললাম, এসব তো তোমার লণ্ডনের কালচার বাপু; ওকে আর দোষ পেড়ে কী হবে? তা ছাড়া এটা তো ঠিক কারও চরিত্রের ব্যাপার নয়। একটা রোগও। কাল বাদে পরশু তুইও যে হবি না তার কোনো…

থাম তো! বাজে বকিসনি! গর্জে উঠল বাপী। একটা কনস্ট্রাকটিভ চিন্তা কিছু নেই, শুধু ফোড়ন কাটা।

এবার আমার খুব হাসি পেয়ে গেছে। বললাম, কনস্ট্রাকটিভ চিন্তা বলতে কী বোঝাচ্ছিস?

-যাতে মেয়েটার দুরবস্থা কিছু ঘোচে।

—মেয়েটার দুরবস্থার একটাই সুরাহা। ওই অপদার্থটাকে ডিভোর্স দিয়ে দেশে ফিরে যাওয়া।

অন্ধকারের মধ্যেই দেখলাম বাপী ফের মাথা নাড়ছে। একটুক্ষণ পর মুখে বলল, না, সেটা হবে না।

–কেন?

–ওকে এখানেই থাকতে হবে। যা ও চায়। ফলে ওকে চাকরিও করতে হবে। আর যদি অন্য কাউকে…

—বিয়ে?

–হ্যাঁ। তুই করবি?

–তার মানে!

–আমি তোরও চাকরির ব্যবস্থা করব যদি তুই…

আমি কী যে বলব ছেলেটাকে বুঝে পেলাম না। আমি এসেছি মাস কয়েকের কাজে, দেশে ফিরে বিয়ের কথা। গার্লফ্রেণ্ডের ছবি রাখি পার্সে। দিনে একলা থাকলে বার করে দেখি। আর এই হতভাগা কিনা…একটু হোঁচট খেলাম ভেতরে কোথায়। সত্যি তো। আমি তো কোনোদিন ওকে আমার বান্ধবী বা বিয়ের কথা কখনো বলিনি। অথচ দেখতে দেখতে কাটিয়ে দিয়েছি তিনটে মাস এক ঘরে।

আমি রেগে না গিয়ে শান্তভাবে বললাম, না সেটাও হবে না, বাপী। আমি দেশে ফিরেই বিয়ে করছি। ভেবেছিলাম তোকে কিছু না বলে সময়মতো সারপ্রাইজ দেব। তো…

বাপী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি। আমি তোর ওয়ালেটের ছবিটা তোকে না জানিয়ে বেশ কবার দেখেছি। আর তোকে লেখা নন্দিনীর চিঠিগুলো লুকিয়ে চুরিয়ে পড়েওছি।

এইবার রাগটা এল আমার মাথায়। চিঠি পড়া বা ছবি দেখার জন্য নয়। কেন ও তাহলে এই কথাটা বলল। বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বললাম তাহলে বাজিয়ে দেখছিলি মন টলে কি না।

বাপী হাতড়ে হাতড়ে অ্যাশট্রের জায়গা মতো সিগারেটের টুকরোটা গুঁজে দিতে দিতে বলল, তা একেবারেই নয় নীতিন। ভাবছিলাম ও যদি এমন কাউকে বিয়ে করে যাকে আমি চিনি তাহলে ইচ্ছেমতো বাড়ি গিয়ে ওকে দেখে আসতে পারব। সেই কথাটাই হয়তো ফসকে গিয়ে…

বাপীর গলা জড়িয়ে আসছিল। কথাটা ও শেষ করতে পারল না। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে, বাপী প্রেমে পড়েছে। আমি ওর পিঠে আলতো করে হাত রেখে বললাম, তুই শুয়ে পড়। কাল তোর অফ-ডে। কাল রবিবারও। সকালে লিটল ভেনিস কাফেতে ব্রেকফাস্ট করব চল। একটা সলিউশন বার করতেই হবে।

কীরকম অসুস্থ লোকের মতো ধড়াস করে বিছানায় পড়ল বাপী। কতক্ষণ পর ও ঘুমোল আমি জানি না। শুধু সকালে চোখ মেলে দেখলাম বেচারি অকাতরে ঘুমোচ্ছে। ডাকতে গিয়েও কীরকম মায়া হল। হয়তো সারারাত ছটফট করেছে অনিদ্রায়। ভোর রাতের ক্লান্ত ঘুম হয়তো। আমি গায়ের লেপ সরিয়ে ঘরের এক কোণে বেসিনের দিকে পা বাড়ালাম মুখ পোব বলে। আর তখনই কীরকম ধড়মড় করে জেগে উঠল বাপী। যেন প্রচন্ডভাবে কেউ ধাক্কা দিয়েছে ওকে। আর জেগে উঠেই আমার দিকে কীরকম ক্লান্ত, অসহায় দৃষ্টি মেলে বলল, কই, লিটল ভেনিস যাবি না?

একটা সুন্দর খালের পাশে ঘন সবুজ উইলো আর এভারগ্রিন গাছের হাতছানির মধ্যে শিল্পীদের নিজস্ব কাপে লিটল ভেনিস। জলে-ঘেরা পল্লির এই একটেরে কাফের দেওয়াল সাজানো আছে তেলরং, জলরং, স্কেচ, ড্রয়িং, লিথোগ্রাফে। শিল্পীদের ভালোবাসার উপহার সব। আমরা দু-জনে গিয়ে বসলাম একেবারে জানালার গায়ে। আমি জানালার বাইরে জল আর গাছপালা দেখছিলাম। সেই ফাঁকে কখন একসময় ব্রেকফাস্ট অর্ডার করে বসে আছে বাপী। আমি বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে টেবিলের মেনুটা খুঁজতে গিয়ে দেখলাম বেকন, হ্যাম, অমলেট ও কফিতে সাজানো আছে টেবিল। আর টেবিলের উলটো দিকে আমার দিকে চেয়ে বসে আছে বাপী। আমি যেন সেই ডেলফাইয়ের ওরাকল। যার উচ্চারণের ওপর নির্ভর করছে ওর সব সুখ, সব অনুভূতি, সব সাফল্য ও ব্যর্থতা ও সারা জীবন।

আমি কালো কফিতে একটা চিনির কিউব ফেলে গুলতে গুলতে বললাম, বাপী, তুই ওকে বিয়ে কর।

বাপী বোকা ছেলে নয়, ও নিশ্চয়ই আশা করেছিল আমি এরকম কিছু একটা বলব। তা সত্ত্বেও ও চমকে উঠে বলে ফেলল, আমি!

আমি ভাব দেখালাম যেন সত্যি কিছু হয়নি। বললাম, হ্যাঁ, তুই।

মনের বাসনা অন্যে বুঝে গেলে খুব পুরুষালি লোকেরও লজ্জা হয়। বাপীও বাদ গেল না। ও লজ্জায় পড়ে বেকনের একটা বড়ো চোকলা মুখে তুলে জোরে জোরে চিবোতে লাগল। আমি আর কিছু বলছি না দেখে ফের বলল, আমি?

বললাম, কেন, অসুবিধে কী?

ফের মাথা নামাল বাপী। জুল জুল করে খাবারগুলো দেখছে আর কী ভাবছে। কিছু বলতেও চাইছে, কিন্তু মুখে কথা জোগাচ্ছে না। আমি সাহায্য করার জন্য বললাম, রাজি হবে না ভাবছিস?

বাপী মাথা নাড়ল।–সে তো অনেক পরের কথা। আমি ভাবছিলাম ব্যাকগ্রাউণ্ডগুলো। ও শিল্পপতির মেয়ে, আমি ইস্কুলের হেডমাস্টারের। বিদেশে অবিশ্যি এসব কাউকে ভাবতে দেখি না। আবার ভাবি, রক্ত। রক্তের চরিত্র কি অন্য সমাজে গিয়েও পালটায়?

—কিন্তু এখানে তো তুই ত্রাণকর্তার ভূমিকায়। তোর কী বড়ো ল্যাটা অন্যের বউয়ের সমস্যা মাথায় নেওয়ার?

বাপী একটু চুপ করে থেকে ফের শুরু করল, এ ছাড়াও তো সমস্যা আছে, নীতিন।

-কীরকম?

–ও যে এখনও ভীষণ ভালোবাসে নীলুকে। ডিভোর্স নিলে আলাদা থাকতে তো ওকে হবেই। কিন্তু ফিরে বিয়ে করতে চাইবে কি না বলা মুশকিল।

—তাহলে তুই আমাকে বলেছিলি কেন বিয়ের কথা?

-বললাম তো হঠাৎ করে মুখে এসে গেল। তা ছাড়া…তা ছাড়া কোথায় যেন একটা ভীষণ মিল দেখলাম তোর আর নীলুর মধ্যে। সফিস্টিকেটেড, নীচু স্বরে কথা, চেহারা…।

আমি চটেমটে বলে উঠলাম, এনাফ ইজ এনাফ! আই অ্যাম নট আ হোমোসেক্সয়াল ইন দ্য ফাস্ট প্লেস।

বাপী হাত দেখিয়ে আমাকে থামিয়ে বলল, প্লিজ! আমাকে ভুল বুঝিস না। এগুলো হল জাস্ট ফাস্ট ইম্প্রেশনজ। তোর সঙ্গে মিশলে বোঝা যায় যে তুই একেবারে অন্য ধরনের মানুষ। কিন্তু এবার তুই আমায় বল, তোর কেন মনে হল আমার ওকে বিয়ে করা উচিত?

খুব সাদামাটাভাবে বললাম, কারণ তুই ওর প্রেমে পড়েছিস এবং সম্ভবত ওকে বিয়েও করতে চাস।

বাপী খাবার আর কফির কাপ-ডিশ পাশে সরিয়ে একটা ক্যামেল’ সিগারেট ধরাল। একটা আমায় দিয়ে বলল, নে। তারপর ব্রেকফাস্টের দাম ও টিপস টেবিলে গুছিয়ে রেখে বলল, চল, সাদারল্যাণ্ড অ্যাভেনিউতে বাবলির ফ্ল্যাটে একবার যাই।

আমি ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কিছুই বললাম না, কারণ এত সবের পর বাবলিকে স্পষ্ট করে দেখার উদগ্র বাসনা হচ্ছিল। কীরকম বাসনা হচ্ছিল ওর নিজের মুখে ওর সমস্যাগুলো শুনি। দেখি পুরাতন প্রেম কীভাবে টিকেবর্তে আছে ওই একরত্তি মেয়ের মধ্যে। কতই বা আর বয়স? টেনেটুনে উনিশ-কুড়ি।

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাপী বলল, তুই কিন্তু আমার হয়ে কিছু বলিস না ওকে। জানি , কী ভাবতে কী ভেবে বসে। আমি ওকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম, আমি আদৌ সেই গাড়োল নই, বাপী মহাশয়!

বাপী অপ্রস্তুত হয়ে একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল, ধর।

সাদারল্যাণ্ড অ্যাভেনিউয়ের ওপর ফ্ল্যাটটা নীলুর দাদা সন্তুর। লণ্ডনের অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন, সংক্ষেপে ‘ডবল এ’-তে ডে অ্যাণ্ড নাইট শিফটে কাজ করে সন্তু। প্রধানত নাইট শিফটেই। দিনে লিঙ্কনজ ইন-এ আইন পড়ে। ক-দিন হল বাবলি ওখানে এসে থাকছে, বলল বাপী। তারপর একটু রহস্য যোগ করে বলল, ভাসুরঠাকুরের আশ্রয়ে। কিন্তু আমার হাসি পেল না। আমি নীরবে সিগারেট ফুকতে ফুকতে বাপীর পাশাপাশি হাঁটছি।

সন্তুর এই ফ্ল্যাটটা বাস্তবিকই গর্জাস। বার কয়েক আমি আর বাপী এখানে পার্টি করতে এসেছি। মস্ত মস্ত ঘর, ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো দিয়ে বাগানের থেকে আলাদা করা। ফ্ল্যাটের দু-খানা বড়ো ঘর নিয়ে থাকে সন্তু, বাকি দু-খানায় একটা ইংরেজ যুবতী। লম্বা-চওড়া সুন্দরী মেয়ে, নাইটক্লাবে নাচে। এবং দেখে-শুনে মনে হয় ফাঁকা সময়ে সন্তুকেও নাচায়। সন্তুর খুব ঝোঁক ওর ওপর, কিন্তু বিশেষ এগোতে পারে না সিলভিয়ার ক্যারিবিয়ান প্রেমিকের ভয়ে। সে এক ছ-ফুট সাত ইঞ্চি কৃষ্ণাঙ্গ পপ সিঙ্গার। মাল খেয়ে থাকলে সিলভিয়াকেও দু-চার ঘা বসিয়ে দেয় মর্জি মতো। সন্তু ওর প্রেমিকার দিকে হাত বাড়াচ্ছে জানলে জ্যান্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে বাঙালিনন্দনকে।

সম্ভর ফ্ল্যাটে বেল টিপতে টিপতে বলল, এখনও সন্তুর নাইট ডিউটি করে ফেরার সময় হয়নি। বাবলি একাই থাকবে। কথা বলতে সুবিধেই হবে।

কিন্তু বেল-এ সাড়া নেই। বাপী ফের বেল টিপল। তারপর আবার। চতুর্থবার যখন টিপতে যাবে তখন কুট করে আওয়াজ হয়ে দরজা খুলে গেল। আর দরজা খুলে চোখ রগড়াতে রগড়াতে শোয়ার পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে নীলু।

সিলভিয়ার প্রেমিক সেই কালো দৈত্যটাকে দেখলেও আমরা এর চেয়ে বেশি অবাক হতে পারতাম না। বাপী বা আমি দু-জনেই এত বোকা বনে গেছি যে, মুখে কোনো হাসি বা কথা জোগাচ্ছে না। প্রিয়, পরিচিত ছেলেটাকে দেখে আমাদের কোনো প্রতিক্রিয়াই প্রায় হচ্ছে না।

শেষে নীলুই বরফ ভাঙল, কী, কেমন আছ তোমরা?

 সামাল দেবার জন্য বাপী বলল, কী, সন্তু ফেরেনি এখনও?

আমাদের ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকিয়ে নিতে নিতে নীলু বলল, সময় হয়ে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে এসে পড়বে। ততক্ষণে তোমরা একটু কফি খাও।

আমরা কেউ আপত্তি করলাম না।

নীলু আমাদের নিয়ে বসাল প্রথম ঘরটায় যেখানে একটা বত্রিশ-চৌত্রিশ বছরের ভদ্র চেহারার ইংরেজ লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। নীলু বলল, দিস ইজ মাই ফ্রেণ্ড, টিচার অ্যাণ্ড লাভার জিম। অ্যাণ্ড দিজ আর মাই গ্রেট ফ্রেণ্ডস বাপী অ্যাণ্ড নীতিন।

একটু চোখ পিটপিট করে ঘরের আলোটা চোখে সইয়ে নিয়ে তড়াক করে বিছানার ওপর হাঁটু মুড়ে বসল জিম। আর আমাদের দুজনের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, হাই!

কাল রাতেই এই ব্যাটাকে পেঁদাবার কথা বলছিল বাপী। লোকটার চেহারা-চরিত্র দেখে বোধ হয় ওর সেই রাগ গলে জল হয়ে গেছে। প্রায় ইতস্তত না করেই ও ডান হাত বাড়িয়ে ধরে নিল ওর হাত। আর ঝাঁকাতে থাকল। তারপর আমার পালা। হাত ঝাঁকালাম আমিও। তারপর কোনোমতে পায়জামার ঢিলে দড়িটা টাইট করতে করতে টলমল পায়ে বিছানা থেকে মেঝের কার্পেটে নামল জিম।

কিছুটা সৌজন্য রক্ষার জন্যই আমি আর বাপী ‘এক্সকিউজ মি’ গোছের কিছু বলতে বলতে বেরিয়ে এলাম বাইরে। আমাদের দুজনেরই ইচ্ছা বাবলির ঘরে গিয়ে বসি।

বেরিয়ে করিডোর দিয়ে পাশের ঘরে যাওয়ার পথে…হ্যাঁ, ওই তো বাবলি। একটা ঢিলে ঢালা নাইটিতে কোনোমতে নিজের নগ্নতাকে ঢেকে টয়লেটের দিকে ত্রস্ত পায়ে এগোচ্ছে। আমাদের দেখে এক দন্ড থামল, প্রায় অনাবৃত বুকটাকে টেনেটুনে ঢেকে কঠিন, হিংস্র চোখে আমাদের দিকে চাইল। মুখে অস্ফুটে বলল, ও! তোমরা। তারপর ঢুকে গেল বাথরুমে। আমরা বুঝতে পারছি না এরপর আমাদের এখোননা উচিত কি না। কিন্তু বাপী সাপুড়ের বাঁশিতে ধরা সাপের মতো এগিয়েই চলল বাবলির ঘরের দিকে। সঙ্গে আমিও।

এবার আরেক সাহেব লাফ দিয়ে উঠল বিছানা থেকে। বলল, আই অ্যাম অ্যাণ্ডি। জিমস ফ্রেণ্ড। নাও বাবলিজ ফ্রেণ্ড টু।

দুটো রোবটের মতো বাপী এবং আমি হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ডশেক করলাম ওর সঙ্গে। একজন বললাম, ‘আই অ্যাম নীতিন’, আরেকজন, ‘আই অ্যাম বাপী। এ সাহেবও দেখি পায়জামার গিট সামলাতে সামলাতে কার্পেটে নামছে। আমি আর বাপী ভাবছি এবার পালিয়ে কোথায় চুকব।

এবার পেছন থেকে দৌড়ে এল নীলু।

—কী হে, তোমরা পায়ে পায়ে ঘুরছ কেন? বসো। এখানেই বসো। অ্যাণ্ডি ইজ আ গ্রেট ফ্রেণ্ড অব আওয়ার্স। হি হ্যাজ ফলেন হেড ওভার হিলজ ফর বাবলি। দে উইল মেক আ ফাইন কাপল।

রাগে জ্বলে যাচ্ছে আমার গোটা শরীর বাস্টার্ডটার কথায়। বাপী আঙুল মটকাতে শুরু করেছে। সেটা ওর রাগের লক্ষণ। অবস্থা গুরুতর হতে পারে দেখে আমি বাপীর পিঠে হাত রেখে বললাম, চল বাইরে বাগানে গিয়ে বসি। বাপী কিছু বলার আগে পেছন থেকে বলে উঠল বাবলি, না, প্লিজ। তোমরা আমার ঘরেই বসো।

ঘুরে দেখি একটা আকাশি নীল ড্রেসিং গ্রাউন পরে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বাবলি। একটু আগের সেই রাগী চেহারাটা কোথায় মিলিয়ে গেছে। এক অদ্ভুত প্রশান্তি এখন খেলা করছে ওর ওই সুন্দর মুখে। ও যেন আরও সুন্দরী হয়েছে।

আমি এক মনে ওকে দেখতে দেখতে ঘরের সোফাটায় গিয়ে বসলাম। বাপীও এসে বসল। ‘আই উইল গো ড্রেস আপ মাইসেলফ’ বলে অত্যন্ত সুদর্শন সাহেব ঘরের বাইরে চলে গেল। ওর দিকে আলতো দৃষ্টি ফেলে বাবলি বলল, অ্যামেরিকান ছেলে। জিমের বন্ধু, ডাক্তার। কালই পরিচয় হল।

আমরা কেউ কিছু বললাম না উত্তরে। এই অ্যাণ্ডি সম্পর্কে আমাদের দুজনের কারোরই কোনো কৌতূহল নেই। কিছুক্ষণের নীরবতার পর না-রাগ, না-আনন্দ, না-দুঃখ এমন একটা মনোভাবে বাবলি বলল, লাস্ট নাইট উই স্লেপ্ট টুগেদার। আমি ওর সঙ্গে শুয়েছি।

আমাদের পক্ষে কোনো শব্দ করারও জো নেই। আমরা শুধু বাবলিকে দেখছি। আস্তে আস্তে কীরকম পাথরের মতন হয়ে যাচ্ছে বাবলি। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার দিকে স্থির তাকিয়ে বলছে, জিম ভালো ব্যাবসা করেছে। আমার নীলুকে কেড়ে নিয়ে অ্যাণ্ডি তুলে দিয়েছে। স্ট্রং, হ্যাণ্ডসাম, অ্যামেরিকান ইয়ুথ। আই শুড বি হ্যাপি। আমার কী সৌভাগ্য নীতিনদা।

আর থাকতে পারছি না ঘরে। গলার কাছে মোচড়াচ্ছে কীরকম। বাবলি দু-হাতে চোখ ঢেকেছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। নীল কার্পেটের ওপর দৃষ্টি এঁটে মনোরোগীদের কায়দায় আপনমনে বিড়বিড় করে কীসব বলে যাচ্ছে বাপী। আমি একটা বড়ো স্টেপে ঘরের বাইরে গিয়ে টয়লেটটা খালি পেয়ে ওখানেই ঢুকে গেলাম। পিছনে দরজা টেনে দিয়ে দোনামনায় পড়লাম। এই ছোট্ট এক চিলতে টয়লেটে দাঁড়িয়ে আমার কী উপকার হবে? তার চেয়ে…

আমি পাশ ঘুরতেই বেসিনের আয়নাটাকে সামনে পেলাম। আর আয়নার মধ্যে নিজেকে। আর, আমার চোখে জল। গন্ডদেশ দিয়ে গড়াচ্ছে। কেন? কার জন্যে? কতটুকু?

আমি দেখছি আমি কাঁদছি। বাপী কাঁদতেও পারে না। তাই বোবা মেরে বসে আছে। বাবলির সামনে। বাবলিও কাঁদছে, কিন্তু ও চায় না আমরা দেখি। আমি চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছি টয়লেট থেকে, ফের আয়নার একটা অংশে চোখ গেল। লাল লাল দাগ কীসব। আমি কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। লাল লিপস্টিকে আঁচড় কাটা। নিশ্চয়ই বাবলির। কিন্তু কার জন্য? আমি আরও ঘনিষ্ঠ হলাম আয়নার। আর স্পষ্ট দেখছি ফেয়ারওয়েল নীলু! আই স্টিল লাভ ইউ।

ভেতরে কীরকম প্রতিরোধ হচ্ছে একটা। নীলু, নীলু, নীলু। পাষন্ড, বাস্টার্ড, সোয়াইন। ও কোনোদিন বুঝবে না ভালোবাসা কী। ও কোনোদিন বুঝবে না বাবলিই বা কী। শুধু ভালোবাসার জন্যই ভালোবেসে-বেসে মরে যাবে মেয়েটা।

আমি পকেটের রুমাল বার করে আয়নার লেখাগুলো ঘষে ঘষে মুছতে লাগলাম। নীলুর প্রাপ্য নয় এই ভালোবাসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *