চোখ

চোখ

আচমকা ঘুম ভাঙতে রাখাল দেখল নতুন বউ মাধবী বড়ো করে ঘোমটা টেনে খাটের এক কোণে বসে আছে। ও কি কাঁদছে? ওর কি মন ভার? নাকি বাপের বাড়ির লোকদের মনে পড়ছে একে একে? রাখাল পর পর এইসব কথাই ভাবল, অবশেষে ওর মনে এল ভয়ংকর প্রশ্নটাই। বিপত্নীক স্বামীদের কি সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে মেয়েদের একটু সময় লাগে? কথাটা অর্থহীন নয়। অফিসের বন্ধু রথীনের কাছে এমন একটা কথা রাখাল শুনেছিল দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করার পূর্বে। তা বলে মাধবীর মতন আধুনিক মেয়ের মধ্যেও এসব সংস্কার থাকবে? রাখাল নিজেও আস্তে আস্তে উঠে বসল বিছানায়, আর নরম করে ডাকল

–মধু!

মাধবী একটু চমকে গিয়েছিল। ও ঘোমটা সরিয়ে কিছুটা লজ্জা, কিছুটা ভয় নিয়ে তাকাল রাখালের দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে নিল। রাখাল একটু বিব্রত বোধ করছিল। ঈশ্বরীর সঙ্গে দেড় বছর ঘর করলেও মেয়েদের সম্পর্কে ও তেমন বেশি কিছু জানে না বললেই চলে। সামান্য খানিকটা কেশে গলাটা ছাড়িয়ে নিয়ে রাখাল বলল— মধু, তোমার কি ঘুম আসছে না? উত্তরে মাধবী শুধু মাথা দোলাল, মানে না।

রাখাল মাধবীর ধার ঘেঁষে বসল গিয়ে। আলতোভাবে পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, কেন? ঘুম

আসার কী হল? ওর এই প্রশ্নের কোথায় যেন একটা উৎকণ্ঠার স্বর ছিল। মাধবী বলল,

চোখ বোঁজার পর থেকেই আমি সব আজেবাজে স্বপ্ন দেখছি। আর সমানে ঘুম কেটে যাচ্ছে।

–আজেবাজে স্বপ্ন? ভয়ের?

— ভয়ের না। কীরকম তবু!

— কী দেখেছ একটু মনে করতে পারো?

মাধবী এবারই যেন সত্যি সত্যি ভয় পেল। কী দেখেছে স্বপ্নে তাই বলতে গিয়ে ওর মুখটা সামান্য কুঁকড়ে উঠল। আর নতুন বরের সামনে সেই অবান্তর স্বপ্নের কথা ভাবতে গিয়ে খানিকটা হাসিও পেল। ওর মনে হল ওই ভয় কিংবা এই হাসি কোনোটারই কোনো মানে হয় না। ও শুধু ধ্যাৎ!’ বলে বালিশ টেনে রাখালের বুকের মধ্যে ঠেস দিয়ে শুয়ে পড়ল। এবং গায়ে গা ঠেকায় ওর টের পেতে ভুল হল না যে রাখালের বুকের ভেতরটায় সজোরে শব্দ হচ্ছে ‘ধকধক ধকধক’।

ওর ওই স্বপ্নের কথা শুনে ওর বরও তাহলে ভয় পেয়েছে। মাধবীর মনে হল স্বপ্নের কথাটা ও রাখালকে না বললেই ভালো করত।

স্বপ্নে মাধবী তেমন কিছু-একটা দেখেনি। শুধু দুটো চোখ। শুধু চোখ দেখে বোঝা যায় না সেটা কোনো ছেলের না মেয়ের। আবার বোঝা যায়ও। মাধবীর ধারণা ওই চোখ দুটো কোনো মেয়ের। যে মেয়ের ভেতরে খুব জ্বালা, রাগ আর হিংসে আছে। ওই চোখ দিয়ে মাধবীর গোটা শরীরটা সে পুড়িয়ে দিতে চাইছিল। স্বপ্নের মধ্যে মাধবী একবার ওই চোখকে লক্ষ করে বলেছিল, যা ভাগ! কিন্তু চোখটা তবু যেখানে ছিল সেখানেই স্থির হয়ে রইল। এরকম বার তিনেক বকাবকি করার পর স্বপ্নের মধ্যেই বিষয় ভয় পেল মাধবী, আর শেষমেশ অজ্ঞান হয়ে পড়ল। আসলে তখন স্বপ্ন কেটে, ঘুম ভেঙে মাধবী উঠে বসেছিল বিছানায়। আর ওর গা দিয়ে দরদর করে ঘাম বইছিল।

মাধবী বেশ ভোরেই ওঠে। মুখ-চোখে জল দিয়ে চা বানায় রাখালের জন্যে। চা নিয়ে না ডাকলে রাখাল ওঠে না। শেষ রাতের দিকে রাখাল ঘুমোয় নিঃসাড়, অচৈতন্য হয়ে। আজ কিন্তু বিছানা ছাড়তে গিয়ে মাধবী দেখল রাখাল নেই। তাহলে নিশ্চয়ই কলতলায় মুখ ধুচ্ছে। কিন্তু তাও না। রাখাল গোটা বাড়ির কোনোখানেই নেই। মাধবী তবু মুখ ধুয়ে উনুন জ্বেলে চা বসাল। তারপর ফুল ঝাড়টা তুলে নিয়ে ঘর পরিষ্কার করতে এল।

ঘরের এক কোণে গোটা চারেক তোরঙ্গ আছে। তার দুটো ওর বাবা বিয়ের সময় দিয়েছেন। বাকি দুটো রাখালের আগে থেকেই ছিল। এ ছাড়া একটা চামড়ার সুটকেসও আছে খাটের তলায়। যাতে রাখাল বাড়ির দলিলপত্র আর অন্য যাবতীয় কাগজ রাখে। ওই সুটকেস মাধবী কখনো খোলেনি। স্বামীর ঘরে ওরা পুরো এক পক্ষকালও হয়নি। নিজের থেকে ও স্বামীর কোনো জিনিসই দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে না। কিন্তু আজ ওর ইচ্ছে হচ্ছে সুটকেসের ডালাটা একবার উঠিয়ে দেখে ওতে কী আছে। কারণ এইমাত্র ওর নজরে পড়ল যে, রাখাল তাড়াহুড়োর মাঝে সুটকেসের আংটায় তালা লাগাতে ভুলে গেছে। তালাটা আলগাভাবে পড়ে আছে সুটকেসের ডালার ওপর।

মাধবী হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকল। তারপর বাঁ-হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে সুটকেসটা টানল। ওমা! কী ভারি সুটকেস রে বাবা! একটা সামান্য চামড়ার সুটকেস একটানে এক বিঘতও নড়ল না! এবার মাধবী দু-হাত দিয়ে সেটাকে প্রায় জাপটে ধরে একটু একটু করে বার করে আনল। ওর সন্দেহ জাগল এর ভেতর নিশ্চয় ভারি থালা-বাসন, গয়নাগাঁটিও আছে, যার কথা রাখাল ওকে বলেনি এতদিনেও। বরের ওপর সামান্য ক্ষোভও হল মাধবীর। রাখালের আগে বিয়ে হয়েছিল জেনেও মাধবী যদি ওকে বিয়ে করতে সম্মত হয়ে থাকতে পারে তবে রাখালেরও কি উচিত ছিল না ওকে একটু খুলেভেলে ঘরসংসারের কথা বলা? রাখালের সোনাদানা তো আর মাধবী খেয়ে ফেলবে না। স্বামীর যা থাকে স্ত্রীরও তো সেটুকু সম্পদ। মাধবী শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ক-ফোঁটা ঘাম মুছে এক ঝটকায় ডালাটা খুলে ফেলল আর ভূত দেখার মতো চমকে উঠে আবিষ্কার করল যে, সুটকেসে সত্যিই সামান্য ক খানা ফাইলই আছে। সোনাদানা বাসন-কোসনের লেশমাত্র নেই!

অথচ অত ভারী লাগল কেন সুটকেসটা তখন? মাথার মধ্যে সব কিছুই যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মাধবীর। ওর মনে হল গত রাত্রে ঘুমের অভাবেই অতটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল ও। তাই প্রথম টানে বাক্সটাকে অতখানি ভারী লেগেছিল। এবার ও বাক্সটাকে এক হাতে সামান্য জোরে ঠেলতে সেটা সড়সড় করে সরে গেল অনেকখানি। নিজের ওপর ভয়ংকর রাগ গিয়ে পড়ল মাধবীর। ওর কানে এল কেটলিতে চায়ের জল ফোঁটার শব্দ। হাঁটুর ওপর হাতের ভর দিয়ে কোনোক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে মাধবী উঠোনে গিয়ে চায়ের জলটা নামাল। তিন কাপ চা বানিয়ে তার দু-কাপ রাখালের জন্য ঢেকে রেখে একটা ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের কাপে নিজের চা-টুকু নিয়ে মাধবী এসে বসল ফের সুটকেসের পাশে। চায়ে চুমুক দিতেই শরীরটা হঠাৎ বেশ ঝরঝরে লাগল। ও আরও দুটো চুমুক দিয়ে কাপটা পাশে রেখে ফের তুলে ধরল সুটকেসের ডালাটা। ওর চোখে পড়ল বড়ো একটা ফাইলের কোণে এক রাশ পিপড়ে কোত্থেকে জড়ো হয়েছে।

সত্যি, বরটা ভীষণই ভুলোমনা, ভাবল মাধবী। না হলে পিঁপড়ের চাক বসেছে দামী কাগজপত্রে সেটাও তার চোখে পড়ে না? এভাবে কাগজগুলো নষ্ট হলে ক্ষতি কার হবে? মাধবীর? না গোটা সংসারের? মাধবী চট করে ফাইলটা তুলে দিয়ে যেখানটায় পিঁপড়ে জমেছে সেখানে সজোরে ঝাড়তে লাগল। পিঁপড়েগুলো পড়ক না পড়ুক ওই ঝাড়াঝাড়িতে ফাইল থেকে একটা খাম গলিয়ে পড়ল মাটিতে। সেটা তুলে জায়গামতন রাখতে গিয়ে মাধবীর মনে হল ওতে দুটো দুল আছে। একটু ভারী দুলই হবে হয়তো। স্বামীর আগের পক্ষের জিনিস। তবে মেয়ে বলেই হয়তো সেটা না দেখে যথাস্থানে ফিরিয়ে রাখতে মন সরল মাধবীর। ও খামের একটা দিক ফাঁক করে উঁকি মেরে সেটা দেখল। এবং সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে ও আতঙ্কে ওর চোখ দুটো প্রায় ঠিকরে কোটর থেকে বেরিয়ে আসছিল। দুটো কানপাশা বা দুলের জায়গায় খামের মধ্যে হাজির ছিল দুটো মানুষের চোখ! জ্যান্ত, জ্বলজ্বলে, হিংস্র। ওই খামের ফাঁক দিয়েই চোখ দুটো চেয়েছিল মাধবীর দুই চোখের দিকে! কোটরমুক্ত, নিষ্পলক ওই চোখ দুটো যে কোনো মহিলার, মাধবীর তাতে কোনোই সন্দেহ রইল না। এই চোখ দুটোই সে গতকাল রাত্রে স্বপ্নে দেখেছে। ও তীব্র এক চিৎকার করে খামশুদ্ধ চোখ দুটো ছুড়ে দিল দরজার দিকে। আর পরক্ষণেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

মাধবী জ্ঞান ফিরে দেখল ওর মাথার পাশে মুখ কাঁচুমাচু করে বসে আছে রাখাল। সঙ্গে আরও কে একজন। মাধবীর চোখ খুলেছে দেখে রাখালের পাশে বসা লোকটি বেশ জোরে জোরে বলে উঠল, যা কইছিলাম রাখাল, দ্যাখলা তো? এ হল গিয়া পিত্তজ্বর। রাত্তিরে দুঃস্বপ্ন হয়, দিনের বেলা মাথাঘুরা। এসব আমার নখদর্পণে। কয়েক লক্ষ সারাইছি অ্যাদ্দিনে। নাও, নাও এবার এই বড়িখান বউরে খাওয়াও দিকিনি। বলে ওর ময়লা ধুতির খুঁট থেকে একটি কালির বড়ির মতন কী বার করে রাখালের হাতে দিল লোকটা। রাখাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বড়িটা মাথায় ঠেকাল, যেন দেবতার প্রসাদ। আর মাধবীর হাড়পিত্তি জ্বলে গেল ওইসব বুজরুকির ওষুধ দেখে; ও বেশ বিরক্ত হয়েই বলল, হ্যাঁ গো, আমার তো কিছু হয়নি। আমায় ওষুধ দিচ্ছ কেন?

রাখাল মাধবীর মাথায় ওর হাতের তেলোটা আলতোভাবে রেখে বলল, তোমার কী হয়েছিল মধু? মাথা ঘুরছিল? মাধবী আস্তে আস্তে উঠে বসে বলল, না, মাথা ঘোরেনি। তোমার একটা দরকারি খাম পড়ে গিয়েছিল বাইরে। সেটা তুলতে গিয়ে দেখলাম তার ভিতরে মাধবী এতটুকু বলে যেন দম নিতে গেল। একটু চুপ করে রইল। তাতে উদবিগ্ন হয়ে রাখাল বলল, এই খামটা?

বলে সুটকেসের সেই খামটাই মাধবীর সামনে মেলে ধরল রাখাল। যে খাম মাধবী আতঙ্কের সঙ্গে ছুড়ে ফেলেছিল দোরগোড়ায়। মাধবী বলল, হ্যাঁ।

–তা এতে কী দেখলে?

–চোখ।

–চোখ!

— হ্যাঁ, দুটো চোখ।

হায় কপাল। বলে মাথা চাপড়াতে লাগল রাখাল। তুমি এর মধ্যে চোখ কোথায় পেলে? এতে তো ঈশ্বরীর দুটো কানপাশা আছে। তোমার জন্য নতুন করে গড়িয়ে দেব ভাবছিলাম। অথচ আজ সকালে তন্নতন্ন করে খুঁজেও খামটা সুটকেশের মধ্যে পেলাম না। তাইতো ছুটে গেছলাম তারকের বাড়ি। একবার এ দুটো ওর কাছে বন্ধক রেখে কিছু টাকা নিয়েছিলাম। ভাবলাম টাকা শোধ করলেও জিনিসটা বোধ হয় ফেরত আনিনি। কিন্তু তারক বলল, জিনিস তো আমি টাকা দেওয়ার দিনই ফেরত এনেছি। তারপর ঘরে ঢুকে দেখি দোরগোড়ায় দুল দুটো গড়াগড়ি খাচ্ছে।

এতক্ষণে সুযোগ বুঝে রাখালের পাশে বসা কবিরাজ ফের মুখ খুলল— আরে হ, ইডাই তো কইতে আছিলাম রাখাল। পিত্তজ্বরে দৃষ্টিভ্রম হয়। লাঠিরে সাপ দ্যাখে, সাপেরে ব্যাং। বুঝলা? অখন ওই ওষুধটা খাওয়াও অরে।

অমনি মাধবী মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, না না। আমার কোনো ওষুধের দরকার নেই। আমার কিছু হয়নি। কবিরাজ বলল, হইলেই বা তুমি বুঝবা ক্যামনে? তুমি তো নাবালিকা। মাধবী আরও রেগে গিয়ে জায়গা ছেড়ে উঠে গেল দালানে। স্বামীর জন্য রাখা দু-কাপ চা ফের কেটলিতে ঢেলে উনুনে বসালো গরম করার জন্য। আর সেখান থেকে শুনতে পেল কবিরাজ রাখালকে বলছে, দ্যাখলা তো রাখাল! এইডা হৈল গিয়া ভূতি ধরার লক্ষণ। ঘুণাক্ষরেও অরে জানতি দিও না যে আমি ওঝা; তাহলে ভয় পাবে, ভূতেরও পোয়া বারো ঘটব। এইডা খ্যাল রেইখো।

বলে ওঝামশাই ওরফে কবিরাজ ঘর ছেড়ে বেরোতে যাচ্ছিল। মাধবী বলল, বসেন বসেন। এক কাপ চা তো খেয়ে যান। কবিরাজ বলল, আমি মা হরতুকির জল খাই। চা আর খালাম কবে? বলে মাটির দিকে স্থির নজর রেখে ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। কবিরাজ বেরিয়ে যেতে মাধবী রাখালকে বলল, আমি কিন্তু ভুল দেখিনি। ওই দুল কিন্তু সত্যি চোখ হয়ে গিয়েছিল। রাখাল উদাসভাবে তাকিয়ে রইল মাধবীর দিকে। আর প্রায় অন্যমনস্কভাবেই অস্ফুট স্বরে একটা শব্দই উচ্চারণ করল, জানি।

দুপুরে মাছ কাটতে গিয়ে মাধবী দেখল মরা মাছের চোখ দুটো ওর দিকেই চেয়ে আছে। ঠায়। আর চোখ দুটোও ওর চেনা চেনা। গত রাত্রে স্বপ্নে দেখা। ও মাছটাকে সাততাড়াতাড়ি বঁটির পাশের ছাইয়ের গাদায় নামিয়ে রেখে স্বামীকে ডাকল, হ্যাঁ গো, শুনছ? রাখাল সবে স্নান করে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল! মাধবীর ডাক শুনে চিরুনি হাতেই বেরিয়ে এসে বলল, কী ব্যাপার?

–দ্যাখো, মাছের চোখটা দ্যাখো।

রাখাল উবু হয়ে বসে মাছটার চোখ এপাশ-ওপাশ করে দেখে বলল, হুম! একটু বেশি লাল। মাধবী বলল, তা বলছি না। ওগুলো একেবারে মানুষের মতন কিনা বল? রাখাল বলল, ধ্যাত! যত আজেবাজে চিন্তা তোমার। বলে ফের চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ফিরে গেল আয়নার সামনে। আর আয়নায় নিজের মুখ দেখে নিজেই ভয় পেল। ও দেখল আয়নায় প্রতিফলিত ওর চেহারাটা একজন ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের। আয়নার ওই মানুষটা ভয় পেয়েছে, কারণ ও জানে মাধবীর কথাটা মিথ্যে নয়। মাছের চোখ দুটো বাস্তবিকই মানুষের চোখ। চোখ দুটো ঈশ্বরীর। তাতে কোনো ভুল নেই। তবু নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য রাখাল চিরুনিটা তাকের ওপর ছুড়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে খুলে ফেলল ওর সুটকেসটা। দ্রুত হাত চালিয়ে ফাইল আর কাগজের বাণ্ডিল ঘেঁটে বার করে আনল ওর আর ঈশ্বরীর বিয়ের পর তোলা যুগল ছবিটা। আর মাছের চোখ ও ঈশ্বরীর চোখের সাদৃশ্য পরখ করার জন্য সরাসরি দৃষ্টি ফেলল নতুন বউ ঈশ্বরীর সুন্দর, ডাগর, প্রায় পটল চেরা চোখ দুটোর ওপর। আর দেখল এই মুহূর্তে এই ছবির ঈশ্বরীর চোখ দুটো একেবারে গর্তের মতন। কালো, অন্ধকার। ওখানে কোনো চোখ নেই!

শিরদাঁড়ায় প্রচন্ড একটা ব্যথা সহসা অনুভব করল রাখাল। ওর মনে পড়ল গ্রামের মেয়ে ঈশ্বরী কী পরিমাণ স্বামীগত প্রাণ এবং অন্যান্য সমস্ত বিষয়ে স্বার্থপর ছিল। হাসপাতালের বেডে শুয়েও ও বলেছিল, আমি ও-বাড়ি ছেড়ে কোনোদিন যেতে পারব না। প্রেসারের রোগী ঈশ্বরীর চোখ দুটো মৃত্যুর আগের দিন সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়। ওর মাথায় নাকি রক্ত চড়ে মাথাটাকেই লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। রাখাল সেদিন ওর মাথার কাছে ঝুঁকে পড়ে যে নিথর, দৃষ্টিহীন চোখ দেখতে পেয়েছিল কিছুক্ষণ আগে সেই চোখই দেখেছে ও বাজার থেকে আনা ত্রিশ টাকা মূল্যের ইলিশটার মধ্যে। রাখালের মাথা ঘুরছিল। ও হাতের ছবিটা নামিয়ে রেখে মাধবীর নাম ধরে ডাকল কিন্তু গলা দিয়ে এতটুকু আওয়াজ বেরুল না। আর বেরোলেও মাধবীর তা শোনার মতো ক্ষমতা ছিল না, কারণ ভয়ে আর আতঙ্কে মাধবী ততক্ষণে ইলিশের চোখ দুটো বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপে কোটর থেকে বার করে ফেলেছে। আর অসাড় হয়ে দেখছিল কীভাবে চোখ দুটো গড়াতে গড়াতে ঢুকে গেল ওদের ঘরে। যেন ঢালু জমিতে গড়িয়ে দেওয়া কাচের গুলি সমানে ধেয়ে যাচ্ছে।

রাখাল দেখল গুলির মতন গড়াতে গড়াতে মাছের চোখ দুটো এসে ঢুকে পড়ল ঈশ্বরীর চোখের কোটরে। আর অমনি ছবিটা একেবারে পূর্বের সেই চেহারায় ফিরে গেল। নতুন বর রাখালের পাশে নতুন বউ ঈশ্বরী বসে। বড়ো বড়ো পটলচেরা চোখে সলজ্জভাবে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার লেন্সের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *