পাবকের বাবা মুনসির পাহাড়

পাবকের বাবা মুনসির পাহাড়

আজ পাবকের বাবা মারা গেছে। সবাই তাই বলছে। কিন্তু সবাই বললে কী হবে, মারা গেছে মানেটা কী? সবাই তো বলে পাবকের মা নেই। কিন্তু নেই মানে কী?

মারা গেছে, নেই এসবের কোনো মানে পাবক জানে না। সবাই তো বলেছিল পাবক গলায় ফাঁস পরিয়ে খুকসি বেড়ালটাকে মেরেছে। কিন্তু তার মানে! হ্যাঁ ঠিকই, পাবক একটা দড়ি পরিয়েছিল খুকসির গলায়। কিন্তু মরে গেছে, মেরে ফেললে—এ সমস্ত কী!

তবে একটু একটু ভয় পাবকের হয়, যখন ভাবে কই খুকসি তো আর জামবাটির দুধ চাটতে আসে না। সে-ভয়টা কিন্তু পাবকের মাকে ভাবলে হয় না। পাবক মাকে তো দেখেইনি কোনোদিন! তবু বাবা যখন মাঝে মাঝে মার ছবি নিয়ে নাড়াচাড়া করে, মুছে পরিষ্কার করে ছবিতে মালা-সিঁদুর দেয়, তখন পাবক ভাবতে চেষ্টা করে এই ছবির লোকটাকে ও নিজে কখনো দেখেছিল কি না। কিন্তু ওভাবে চিন্তা করলেও পাবকের কারোকেই মনে পড়ে না।

আচ্ছা, মনে না পড়লেই কি লোকে বলে, ও লোকটা নেই, কিংবা সেই মেয়েটা নেই? ওই বুড়ো ধোপাটা, মানে পরসাদী, ওকে তো পাবকের ভীষণ মনে পড়ে। কিন্তু লোকে যে বলে পরসাদী নেই? অবশ্য পরসাদীও আজকাল পাবকের প্যান্টুলুন কি বাবার লুঙ্গি পায়জামা নিতে বা দিতে আসে না। ওর মেয়েটা আসে। আবার খুকসিকে নাকি পাবক মেরেছে। খুকসি নাকি মরে গেছে। কিন্তু খুকসিকেও তো পাবক ভুলতে পারে না।

তা হলে হলটা কী? বাবা মারা গেছে মানে?

পাবক চুপি চুপি ছাদে উঠল। ছাদে একলা উঠলে বাবা রাগ করে। নিশ্চয় হাসপাতাল থেকে এসেই হাঁক দেবে, পাবক, তুমি কোথায় গেছ? ছাদে? আবার ছাদে! তোমার টফি বন্ধ।

পাবকদের ছাদে আলসে নেই। তাই তো বাবার অত ভয়। কিন্তু বাবা কি জানে না সন্ধ্যেবেলা পাবক নিজেও ছাদটাকে ভীষণ ভয় পায়। চাকর রঙ বলে ছাদে ভূত নাচে রাত্তির বেলা। ছেলেপুলের ঘাড় মটকে দেয় যে ভূতগুলো। তার ওপর পাবকদের ছাদের ভূতগুলো নাকি চাকরভূত। মানে যেগুলো বড়ো ভূতদের ফাইফরমাশ খাটে। রঙ বলে, রূপাদের ছাদে একটা জমিদার-ভূত থাকে। রাত দশটায় ধিকিম ধিকিম আলো ছড়িয়ে হুঁকো খায়।

কিন্তু বাবা এখনও ডাকেনি। এখন থেকে ছাদে বসতে পাবকের একটু একটু ভয় করে। এমন দেরি করার কথা তো ছিল না। বাবা! তুমি মিছিমিছি দেরি করলে। এখন আমার কীরকম ভয় করছে?

অবিশ্যি বাবা গেল দু-দিন বাড়িতেই নেই। পাবকের কাকা-কাকি পাবককে খাওয়ায় পরায়, গল্প শোনায়। মাঝে মাঝে অবাক করে পাবকের মা-র কথা বলে। রাঙাকাকি জানে না পাবকের কিছুই মনে হয় না মা-র কথা বললে। বাবা তাই তো মা-র কথা পাবকের সামনে তোলেই না।

এমনিতেও বাবা হাসপাতালে রোজ যায়। বাবা নাকি ডাক্তারবাবু। রূপার বাবা মাঝে মাঝে এসে পাবককে আদর করে। তারপর বাবাকে দেখতে পেলেই বলে, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, কানটা এরকম কটকট করছে কেন? আর বাবা তখন ইংরেজিতে কী সব হাবিজাবি বলে। পাবক জানে ইংরেজি মানে গলাটা গম্ভীর করে ফিসফিস করে কথা বলা। যেভাবে বাবা বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলে।

দেখো কী মুশকিল; বাবা এখনও ডাকছে না। এক্ষুনি সূর্য ডুববে; আর ভূতগুলো জুটবে কোত্থেকে এসে।

.

এবার সত্যি সত্যি বাবা ডাক দিল। কিন্তু নীচের তলা থেকে নয়, একদম পাশ থেকেই। এই যাঃ! বাবা কখন গুটিগুটি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

—পাবক তুমি দুপুরে ঘুমোলে না?

ভীষণ রাগ হয়েছে পাবকের। পাশের বাড়ির ডাকুর মুখপোড়া ঘুড়িটার লাট দেখতে দেখতে পাবক বলল, ‘আমার ঘুম নেই।

-তুমি আমার ওপর রাগ করেছ?

–হ্যাঁ করেছি। তুমি কাল এলে না কেন?

–বারে! আমি যে হাসপাতালে গেলাম। ওখানে অনেক রোগী এসেছে।

–যাও মিথ্যুক! রোগী এসেছে!

বাবা খুব হাসছিল। পাবক নিজের থেকেই বলল, দেখো না, আমি ছাদ থেকে নামব না। বাবাও বেশ সুর করেই বলল, বেশ তো! আমিও নামব না! চলো, ওই মোড়ায় বসে গল্প করি।

কী সর্বনাশ! পাবকের বিশ্বাস হয় না ছাদের ছেড়া মোড়াটায় বসে বাবা ওর সঙ্গে গল্প করছে। কি, বাবা তো কোনোদিন ছাদে এসে বসত না? তাও আবার এই সূর্য ডোবার সময়।

বাবা বলল, পাবক তুমি সূর্য ডোবা দেখছিলে?

পাবক বলল, না গো, আমি এমনিই বসেছিলাম তুমি দেরি করছিলে বলে। আর জানেনা বাবা, ওই গিরিবালা বলছিল তুমি নাকি মরে গেছ।

বাবা রেগেমেগে বলল, আমি দেখছি গিরিবালাকে। ও বলেছে আমি মরে গেছি। এই তো আমি তোমার সঙ্গে গল্প করছি। এবার হঠাৎ করে পাবক জানতে চাইল, বাবা, মরে গেছে মানে কী?

বাবার মুখটা কীরকম হয়ে গেল। কালো কালো। কিন্তু বাবা দুম করে হেসে ফেলে বলল, না না। ওটা বাজে কথা। গিরিবালা ওই বলে ছোটোদের ভয় দেখায়। কেউ আবার মরে নাকি! সবাই বেঁচে থাকে। সবাই বাঁচতে চায়। যেমন মনে আছে তোমার মুনসিকে।

পাবকের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল মুনসিকে। দার্জিলিঙে পাবকদের ঘরের কাজ করত। ওর নাকি কী অসুখ করেছিল। কোনো কাজ করতে পারত না শেষের দিকে। তাই বাবা ওকে খাটাত না। পাবকের মতো ওকেও রোজ টফি কিনে দিত। আর টফি পেলেই ওর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠত। তখন ওর গল্প বলার মেজাজ আসত। ওর নিজের পাহাড় দুটোর আর পরিবিবির গল্প শোনাত। বাবা আর পাবক একদিন ওর সঙ্গে পাহাড় দেখতে গিয়েছিল।

পাবক বাবাকে বলল, হ্যাঁ, বলো না, বলো না মুনসির কথা।

দার্জিলিঙে ন-পিসির বাড়িতে বছরে এক-একবার বাবা পাবককে নিয়ে গিয়ে থাকে। খুব বড়ো বাড়ি ন-পিসির। সারাদিন দাপিয়েও পাবক শেষ করতে পারে না। জানালা খুলে ঘরে মেঘ ঢুকিয়ে পাবক আলমারি, চেয়ার-টেবিল, দেওয়ালের ছবিগুলোকে চান করায়। বুড়ো অ্যালসেশিয়ান হাকিমকেও মধ্যে মধ্যে উত্ত্যক্ত করে পাবক। পিসি তখন সোয়েটার বুনতে বুনতে জোরে জোরে চেঁচায়, এই পাবকটাই আমার জীবন নেবে। পাবক, পাবক, তুমি হাকিমকে আবার মারছ!

বাঃ মারব না, অত বড়ো ঢাউস কুকুরটা শুধু পড়ে পড়ে মাংস আর ডগ বিস্কিট খাবে। কিন্তু কোনোদিন পাবকের সঙ্গে খেলবে না। বাড়িতে চোর এলেও চোখ মেলে দেখবে না।

পিসেমশাই আর বাবা বেরিয়ে গেলে পিসি আর পাবকের এই রকম ঝগড়া চলত রোজদিন। ওইরকম এক ঝগড়ার সময় ব্যোমবাহাদুর একদিন মুনসিকে নিয়ে এসেছিল। ওকে দেখামাত্রই পাবকের রাগ চলে গেল। সাঁ করে ওকে পাশে টেনে নিয়ে বলল, তোর নাম কীরে? তুই আমার সঙ্গে বল খেলতে পারবি?

মুনসি পাবকের থেকে একটু বড় ছিল। পাবককে দেখে তারও মুখটা চকচক করে উঠল। বলল, আমি তো কাম করব।

পাবক ধমকে দিল ওকে, কাম কীরে! আমার মতো কথা বলতে পারিস না?

সেদিন সন্ধ্যেবেলায়ই মুনসি বাবা আর পাবককে ওর পাহাড়ের কথা শুনিয়েছিল। ওর নাকি একটা লালপাহাড় আর একটা নীলপাহাড় আছে। একটার নাম লালি, আরেকটার নাম নীলি। আর ওর পরিবিবি ওই লালপাহাড় দিয়ে আসত সকালে চুনারি বাগানের ফুল তুলতে, মালা গাঁথতে। কেউ তাকে দেখতে পারত না এক মুনসি ছাড়া। ফুলের মালার একটা বিবি নিজে পরত। অন্যটা একটা ছোটো রংচটা গাছকে পরাত। বিবি রোজ তিনটি করে ফুল দিত মুনসিকে। একটা সাদা, একটা হলুদ, একটা সবুজ। তারপর বিবি রংচটা গাছটার ডালে বসে পা ঝুলিয়ে গান গাইত। নীচে থেকে মুনসি তাই শুনত।

আবার যেই সূর্য ডুবে গেল, অমনি বিবি তড়িঘড়ি করে নীল পাহাড়ের চুড়ো বেয়ে নিজের দেশে চলে যেত।

মুনসি কতবার বলেছে, বিবিজি, আমায় নিয়ে চলো তোমার সঙ্গে। পরি বলত, ছিঃ! তোর ওই নোংরা ফাটা জামা। তোকে দেখলে আমার ভাই-বোনেরা হাসবে।

মুনসি বলত, তা হলে আমায় নতুন জামা দাও। তখন বিবি খিলখিল করে হেসে ফেলত। মুনসির কোঁকড়ানো চুল ধরে আদর করে দিত। বলত, না না, তুই এইখানেই থাক। আমি রোজ তোকে দেখতে আসব।

এই সব শুনে পাবক বলত, মিথ্যুক কোথাকার। পরির দেশের মেয়ে তোকে দেখতে আসত, মিছে কথার জায়গা পাস না।

বাবা পাবককে থামিয়ে দিত। ছিঃ! পাবক। পরিবিবি আসত হয়তো। তুমি তো দেখোনি। আর মুনসি তোমায় মিথ্যে কথা বলবে কেন। কী বল মুনসি?

মুনসি ততক্ষণে কেঁদে ফেলত। এক বাবা ছাড়া কেউ কোথাও ওর কথা বিশ্বাস করে না। মুনসি তাই পাবকের দিকে ভীতু চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে বাবাকেই বলত, সত্যি বলছি বাবুজি, পরি আমায় দেখতে আসত।

বাবা বলত, সে আর তোকে দেখতে আসে না? অমনি মুনসির কথা শেষ হয়ে যেত। মাথা নীচু করে বসে থাকত। তারপর কোনো একসময় বাবার চায়ের কাপ-ডিস তুলে নিয়ে রান্নাঘরে চলে যেত।

মুনসি ঘর থেকে বেরোলেই পাবক জোরে চেঁচিয়ে উঠত, ‘মিথ্যুক!’

পাবকের ভারী রাগ হত। পাবক নিজেই কোনোদিন পরি দেখতে পেলে না। আর মুনসিকেই সব পরি দেখা দেয়।

একদিন কিন্তু পাবকের কথা শুনেও মুনসি কাঁদল না। বাবার কানের কাছে উঠে এসে ফিসফিস করে বলল, তুমি কাউকে বলবে না তো বাবুজি! কাউকে বোলো না যেন। ওই পরিবিবি না অনেকদিন আগে চলে গেছে। আর আসে না। কথাটা পাবক শুনে ফেলেছিল। কথাটা শুনে খুব মন খারাপ হয়ে গেল ওর। মাঝে মাঝে পাবক ভাবত মুনসিকে বলবে পরির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে। কিন্তু লজ্জা পেত মিথ্যুকটাকে কোনো কিছু বলতে।

বাবা জিজ্ঞেস করল মুনসিকে, কেন, কী হয়েছিল তার পরির? রাগ হয়েছিল তোর ওপর?

মুনসি মাথা নাড়ল। না বাবু, বিবির বিয়ে দিয়ে দিল ওর বাবা, অন্য দেশের এক পরির ছেলের সঙ্গে।

এবার মুনসি হেসে ফেলল। বাবাকে বলল, তুমি দেখবে আমার পাহাড়?

পরের দিন সকালে পাবক, বাবা আর মুনসি পাহাড় দেখতে গেল। অনেক, অনেক হেঁটেছিল ওরা। একসময় একটা ঝোপের উপর দাঁড়িয়ে পড়ে মুনসি বলল, পাবকজি, ওই দেখো লালি।

একটা পাহাড়ের পাশ দিয়ে আর একটা মিষ্টি দেখতে পাহাড়। তার উপর সকালের লাল রোদ পড়েছে। পাহাড়টা সত্যিই লাল।

পাবক দুঃখ পেয়েছিল। তা হলে তো মুনসি মিথ্যে বলেনি। ওর পরিবিবিও সত্যি! ভীষণ রাগই হল পাবকের। বলল, তোর নীলি কোথায়?

মুনসি মাথা চুলকোচ্ছিল। বলল, সূর্য না ডুবলে তো নীলিকে দেখা যায় না পাবকজি। ভারি চিন্তায় পড়ে গেল পাবক। বাবাও দেখি কিছু বলে না।

একটু পরে ওরা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে এল। সারা রাস্তা কী বকবক করছিল মুনসিটা। পাবকের ইচ্ছে করছিল জোরে জোরে ওর কান মুলে দেয়। যেভাবে মিঠুদি পাবকের কান চিমটে দেয় এক্কা-দোক্কা খেলার সময় ঘর চুরি করলে।

ওই মিঠুদিই আবার পাবকের নাকের ওপর ঝুলে-পড়া চশমা সোজা করে দেয় দোলনা চড়ার সময়।

পাবক চশমাটা এবার নাকের ওপর সোজা করে বসাল। বাড়ির বারান্দায় বসে মুনসি ফের ওর পরির গল্প বলবে। বাবা, পিসেমশাই সব খাওয়া-দাওয়া করে বেরোবে। পিসি সোয়েটার বুনবে। হাকিম ঘুমোবে। শুধু পাবক মন দিয়ে মুনসির গল্প শুনবে।

.

বাবা কেন মুনসির কথা বলছে? বাবার কি ওকে খুব ভালো লাগত। তা হলে আনল না কেন ওকে সঙ্গে করে এদেশে? ও তো আসবার জন্য কত কাঁদল; ব্যোমবাহাদুরও তো বলল নিয়ে যেতে ওকে। বাবাই তো কেবল আনতে চাইল না।

পাবক বাবার মুখের দিকে তাকাল। বাবা, মুনসিকে আনলে না কেন?

বাবা ফের হাসল। বলল, ওর তো শরীর খুব খারাপ ছিল। ওই দেশেই ও ভালো আছে। এখানে কি ও পাহাড় দেখতে পেত?

পাবক বলল, আমিও তো কতদিন পাহাড় দেখিনি। রোজ রোজ তো শুধু ঘুড়ি দেখি, আর গৌরীদের বাড়ির শিউলি গাছটা, আর নূপুরদের বাড়ি…

বলতে বলতে বাবা পকেট থেকে দুটো ছোট্ট ছোট্ট পাহাড় বের করল। একটা লাল, আরেকটা নীল। পাবক আনন্দে লাফিয়ে উঠল মোড়া থেকে। দাও, দাও ওগুলো আমাকে, বলে বাবার মোড়ার পাশে গিয়ে বসল।

বাবা পাহাড় দুটো পাবকের হাতে দিল। পাবক দিনের শেষ বরাদুরে পাহাড় দুটো অবাক হয়ে দেখল! যেভাবে মুনসি ওর পাহাড় দেখত। দেখতে দেখতে হাসি ফুটল পাবকের মুখে। বাবারও।

বাবা বলল, তুমি পড়া করেছিলে আজ?

পাবক মাথা নাড়িয়ে না বলল।

বাবা বলল, যাও তা হলে তোমার সঙ্গে আড়ি। তুমি খারাপ হয়ে গেছ।

বাবাকে শান্ত করতে, বাবাকে ফের হাসাতে পাবক রাঙাকাকুর মুখে শোনা আবোল তাবোল কবিতা বলল। কবিতা বলতে গিয়ে যেই কথা আটকে গেল অমনি পাবক বলল, আচ্ছা বাবা, রামগরুড়ের ছানা কীরকম দেখতে?

বাবা মোড়া ছেড়ে উঠে মাথায় শিঙের মতো করে হাত রাখল। তারপর ব্যাঙের মতো কুঁজো হয়ে ছাতে বসল। পাবক হেসে ফেলল তাই দেখে।

একটু একটু রোদ তখনও ছিল। বাবার মুখে, বাবার চশমায় সেই রোদ পড়ল। কী সুন্দর লাগছিল তখন বাবাকে দেখতে। পাবক ভাবল কারোর বাবাকে এত সুন্দর দেখতে না। কারোর বাবা এরকম রামগরুড়ের ছানা সাজতে পারে না। ওইজন্যই তো রূপা, গৌরী, মিঠুদি, নূপুর সবাই পাবকের বাবাকে রোজ দু-বেলা দেখতে আসে। টফি চাইতে আসে।

এবার পাবক নিজেও হাট্টিমাটিমটিম সাজল ছাদের ওপর। বাবা বলল, আমাকে কি রামগরুড়ের ছানার মতো গোমড়া দেখাচ্ছে? পাবক বলল, ভীষণ! তুমি হাসো তো বাবা।

বাবা হাসল। কী মিষ্টি হাসি। চশমার রোদ আর হাসি মিশে গেছে। পাবক বলল, বাবা তুমি নাচতে জানো? বাবা বলল, তুমি নাচো পাবক।

পাবক বলল, কীরকম নাচব? আমি কি নাচ শিখেছি কোনোদিন নূপুরের মতো?

বাবা বলল, এসো, এইভাবে নাচো। বলেই বাবা আওড়াতে লাগল—

চাকবুম তাকদুম চামচিকে চাকবুম।
তাধিন্না তাধিন্না ধিন ধেই ধেই তাকদুম।
তাথৈ তাথৈ ধা হেই গিরেতুম,
বুমচাক মৌচাক চাকা নেই পাগডুম।

অল্প রোদের ছাদে বাবা আর পাবক নাচল অনেকক্ষণ। শেষকালে দু-জনেই হাঁপিয়ে গিয়ে মোড়ায় বসে পড়ল। পাবক মনে মনে বলল, গিরিবালাটা কী মিথ্যুক! বলে বাবা আসবে না হাসপাতাল থেকে।

বাবার তখনও হাঁপ উঠছিল। বলল, আমি বুড়ো হয়ে গেছি। তাই না?

পাবক মাথা নাড়ল। না বাবা তুমি বুড়ো না। তোমার চুল পাকেনি। তোমার তো দাঁত পড়েনি। তুমি তো লাঠি নিয়ে হাঁটো না। তুমি তো ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে সারাদিন ঘুমোও না গৌরীর দাদুর মতো।

বাবা কিন্তু ফের নিজে থেকেই পাবকের মনের কথাটা বলে দিল। পাবক, তুমি গিরিবালার কথা বিশ্বাস করবে না। আমি তোমায় কত ভালোবাসি। আমি কি কখনো মরতে পারি?

কাউকে ভালোবাসলে বুঝি কেউ মরে না, না বাবা, পাবক জানতে চাইল। পাবক বলল, ঠিক বলেছ। যারা ভালোবাসে তারা মরে না। ভালোবাসলে তো কাছে আসতে হয়। কথা বলতে হয়। আদর করতে হয়। চুমু দিতে হয়।

বাবা উঠে এসে পাবককে চুমু দিল একটা। পাবক বলল, কিন্তু বাবা, যারা ভালোবাসে না, তারা চুমু দেয় না। বাবা বলল, তারা হিংসুটে, তারা দুঃখ পায়। তারা কি তোমার-আমার মতো গান গাইতে পারে? কখনো না।

পাবক জিজ্ঞাসা করল, তা হলে ওরাই কি মরে যায়?

বাবা বলল, যারা ভালোবাসে না, তারা মরার মতোই বেঁচে থাকে।

তা হলে মরা কী?

ভালোবাসতে না পারা। না আসা। কাছে এসে আদর না করা।

আর গিরিবালা বলল কেন তুমি মরে গেছ? তুমি তো এখন এসে আমায় আদর করলে। দুটো পাহাড় দিলে।

গিরিবালা মিথ্যুক। ওকে আমি চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেব। ও হিংসুটে।

বেশ হবে তা হলে। তুমি ওকে তাড়িয়ে দিয়ো না বাবা, মুনসিকে নিয়ে আসবে। ও তোমাকে চা করে দেবে আর আমাকে গল্প বলবে।

আস্তে আস্তে আলো খুব কমে গেল। পাবকের একটু ভয় ভয় করছিল। তাই উঠে এসে বাবার কোল ঘেঁষে বসল। বাবা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমায় ভয় করছে পাবক?

ছিঃ! তুমি না পুরুষ মানুষ। তোমার আবার কীসের ভয়। ভয় পায় ভীতুরা, মেয়েরা। কখনো কিছুতেই ভয় পাবে না। ভয় পেয়ে ঠাকুরকে ডাকবে, আমাকে ডাকবে। দেখবে ভয় চলে গেছে। তুমি ঠাকুরকে ডাকার মন্ত্র জানো?

হ্যাঁ। ওই যে মন্ত্রটা পিসি শিখিয়েছিল—

ভূত আমার পুত
পেতনি আমার ঝি,
রাম-লক্ষণ সাথে আছে
করবে আমার কী!

পাবক তোমাকে আমি আরও একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি। এটা রোজ বলবে। ভূত কেন, তোমার কোনো ভয়ই থাকবে না।

বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না করি যেন ভয়।

বারেঃ অত বড়ো কথা কি আমি বলতে জানি নাকি! আমি কি ওসব বুঝতে পারি!

ওমা, তুমি কি বোকা পাবক। মন্ত্র কখনো বড়ো-ছোটো হয় নাকি? সব মন্ত্রই সমান! তুমি বড়ো হচ্ছ, তোমার তো আরও বেশি বেশি শিখতে হবে পাবক।

আচ্ছা তুমি ফের বলল, আমি শুনব।

বাবা ফের কথাগুলো বলল। তারপরের বার দু-জনেই একসঙ্গে কথাগুলো উচ্চারণ করল। পাবক এরকম বার দুই বলার পর হাঁপিয়ে গেল। তুমি না বাবা আমাকে পড়াশুনো করাচ্ছ ছাদে বসিয়ে! আর মন্ত্র বলব না।

বাবা বলল, তোমার বলতে কষ্ট হলে মনে মনেই বলবে। মনে মনে ভাববে। যেমন তোমার মুনসি মনে মনে পরির সঙ্গে কথা বলত। পরির কথা ভাবত।

পাবকের মনে পড়ল মুনসির কথা। দিনরাত পরিবিবির চিন্তা করত। ঘুমিয়ে নাকি স্বপ্নও দেখত। বাবাকে বলেছিল ওর পাহাড় দুটো সবচেয়ে পরিষ্কার, কারণ ও স্বপ্নে বালতি বালতি জল ঢেলে ওর পাহাড়গুলোকে চান করাত।

পরিও নাকি আবির এনে লালির গায়ে ছড়াত। নীল কালির তুলি বোলাত নীলির উপর। আর যেইবার বৃষ্টিতে সব ধুয়ে গেল, পরিবিবি তিন দিন তিন রাত্তির রংচটা গাছের ডালে বসে কেঁদেছিল।

তখনই তো মুনসি খুব দুঃখ পেল। আর ঘুমিয়ে গিয়ে স্বপ্নে স্বপ্নে ফের পাহাড়গুলো রং করে দিল।

মুনসির স্বপ্নের মধ্যে এত কাজ ছিল যে, ওর জেগে থাকলে সমস্ত দিনটাই মাটি হয়ে যেত। প্রায়ই বাবুকে বলত, কাল রাতে বাবুজি আমি লালির গা থেকে চারটে খারাপ পোকা ফেলে দিয়েছি। ওগুলো থাকলে ওর খুব কষ্ট হয়। ছটফট করে। চোখ দিয়ে জল পড়ে।

কিন্তু হায়! মুনসি তো গরিব ছেলে। মা-বাবা নেই। শুধু স্বপ্ন দেখলে কি আর পেট চলবে? লোকের বাড়ি খেটে খেতে হত। তাও তো বাবা ওকে কম কাজ দিত। বাকি গল্প বলা আর স্বপ্ন দেখা।

শেষে ওর খুব কাশি হত। বাবা ওষুধ দিত ওকে আর বলত, তুই ঘুমো এখন মুনসি। বাজে বকিসনি বেশি।

মুনসির চোখ বন্ধ দেখলেই পাবক বুঝত ও পরির স্বপ্ন দেখছে। মুখে তখন ওর একফোঁটা হাসিও লেগে থাকত। যেরকম হাসি আজ বাবার মুখে পাবক দেখল।

বাবা বলল, পাবক, তুমি পাহাড় দুটো আমাকে দাও। ওগুলো মুনসির দেশে নিয়ে যাব আমি। ওকেই ফিরিয়ে দেব ওর পাহাড়।

পাবক বলল, তুমি কী করে পেলে মুনসির পাহাড়?

—ওই দেশেই তো গেলাম আমি গত পরশু দিন।

–বারে! সবাই যে বললে তুমি হাসপাতালে গেলে! ওই হলদে গাড়ি তো হাসপাতালের।

—ধুত্তোর! ওরা কিসসু জানে না। আমায় তো গাড়িতে শুইয়ে দিল। তারপর যেই না গাড়ি ছাড়ল আমি টুপ করে নেমে পড়ে মুনসির কাছে চলে গেলাম।

—ঠিক হয়েছে? ঠিক হয়েছে! বেশ হয়েছে। কাকুরা কী বোকা! তা বাবা মুনসি তোমায় আমার কথা কিছু বলল না?

—বললই তো। কত কথা বলল। ও-ই তো আমায় পাহাড় দুটো দিল তোমায় দেখাতে। আবার ওগুলো ফিরিয়ে দেব ওকে। ও শুয়ে শুয়ে দেখবে।

-কেন বাবা, ও কি আর ঘুরে-বেড়ায় না?

—পাবক যখন চলে আসে মুনসি তখন ঘুমোচ্ছিল। বোধ হয় পরিকেই দেখছিল চোখ বুজে। তার আগের রাত্তিরটা ও ঘুমোতেই পারেনি। শুধু কাশছিল। পাবক ওর গরম দুধটা মুনসিকে দিয়েছিল। কিন্তু মুনসি খাবে কি! ওর খুব ঠাণ্ডা লাগছিল।

পরদিন পাবকদের চলে আসার কথা। বাবা মুনসিকে আপেল, নাসপাতি কিনে দিল। ব্যোমবাহাদুরকে টাকা দিল। বলল, মুনসিকে ভালো ভালো খাবার দেবে।

কিন্তু সেদিন পাবকের যাওয়া হল না। কোত্থেকে একটা গাড়ি এল মুনসিকে নিতে। মুনসির যে গাড়ি আছে আগে কখনো পাবক জানত না। বাবা বলল, ওটা পরিবিবির গাড়ি। মুনসিকে নিতে এসেছে ওরা।

মুনসিকে যখন গাড়িতে শুইয়ে দিল, তখন সবাই খুব চুপ ছিল। বাবা কেন কাঁদল? কই পাবক তো কাঁদেনি! মুনসি তো চাইত পরির কাছে যেতে। তবে ওর বাবাকেও খুব ভালো লাগত। বলেছিল, বাবুজি, আমাকে তোমায় দেশে নিয়ে চলো। আমি পাবকজির সঙ্গে থাকব।

বাবা কিন্তু তাকে নেয়নি। তা হলে ও যখন পরির কাছে চলে গেল বাবা তখন কাঁদল কেন?

পাবক কান্নাটান্নাও পছন্দ করে না। শুধু বাবা বকলে কি বাড়ি ফিরতে দেরি করলে ওর বুকে কীরকম একটা ব্যথা হয়। চোখে জল আসে। তবে ও বুঝেই পায় না নূপুর, মিঠুদি, গৌরী ওই রকম ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে দিনরাত কাঁদে কী করে?

আবার আজ দু-দিন ধরে কাকু-কাকি গিরিবালাও একটু-আধটু কাঁদে। ওদের কী হয়েছে গো?

পাবক পাহাড় দুটো বাবাকে ফেরত দিল। মুনসি ঠিকই বলেছিল—এখন যখন সূর্য ডুবে গেছে ওই একটা পাহাড় কীরকম নীল লাগছে। ও পাহাড়টা সেবার দেখা হয়নি ওদের।

ছাদে আর আলো নেই। কিন্তু পাবকের একটুও ভয় করছে না। বাবার হাঁটুতে থুতনি ঘষতে ঘসতে বলল, বাবা, আমার কি কোনোদিন মা ছিল না? আমার কেন মাকে মনে পড়ে না?

কিন্তু বাবা কথা বলার আগেই নীচে কীরকম একটা চেঁচামেচির আওয়াজ। নিশ্চয়ই কাকি জোরে জোরে কাঁদছে। হ্যাঁ, তাই তো! গিরিবালাও কাঁদছে। কাকু বোধ হয় ‘পাবক পাবক’ করে ডাকছেও।

পাবক বলল, বাবা চলো নীচে যাই। আমার আর ছাদে ভালো লাগছে না।

অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পাবক জিজ্ঞেস করল, বাবা ওরা সব কাঁদছে না? বাবা বলল, হ্যাঁ, তাই তো!

-কেন ওরা কাঁদছে কেন?

—ওরা তো বোকা। ওরা ভাবছে আমি মরে গেছি।

–কেন বাবা, তুমি কেন ওদের কাছে যাও না? ওদের কারোকে আদর দাও না?

-–ওরা যে বোকা, পাবক। ওদের কি আমি আদর করতে পারি! ওরা শুধু বলে ‘টাকা দাও, টাকা দাও। তোমার মতো ওরা কি আমায় ভালোবাসে?

পাবক এবার পুরো ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। তাই বাবার হাত শক্ত করে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। ভাবল ওরা এখন ‘মরে গেছে, মরে গেছে’ করলেও পাবক আর অবাক হবে না।

সিঁড়ির শেষ ধাপেতে এসে বাবা পাবককে জাপটে ধরে জোরে জোরে চুমু দিল। ওর চুলে হাত বোলাল। নাকের ওপর গোল গোল চশমাটা সোজা করে দিল। তারপর বলল, পাবক, একটু লুকোচুরি খেলবে? পাবক বলল, কীরকম?

তুমি নীচের ঘরে গেলে দেখবে আমি চোখ বুজে খাটে শুয়ে আছি। যেরকম মুনসি শুয়েছিল সেদিন। কিন্তু কাউকে বলবে না-ওটা কিন্তু আমি না। আমি এইখানে তোমার পাশে…বাবা তার উষ্ণ হাতটা পাবকের গালে রাখল। তারপর বলল—ওরা কিন্তু ভাবছে আমি ওটাই। আসলে আমি ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছি। ওটা নকল খেলা। আসল খেলা আমার তোমার সঙ্গে। মুনসির সঙ্গে।

তারপর বাবা আরও কাছে এসে পাবকের কানে কানে বলল, ওরা কাঁদছে কাঁদুক। ওরা বোকা। তুমি কিন্তু একটুও কাঁদবে না। তুমি কাঁদলে আমারও কান্না পাবে। আর এই খেলাটা নষ্ট হয়ে যাবে।

পাবককে একতলার বৈঠকখানার কাছে এনে বাবা হঠাৎ-ই মিলিয়ে গেল। পাবক মাথার কাছে গিয়ে চুপটি করে বসলে ওর সঙ্গে কথা কইবে। আর কেউ ওই সব কথা শুনতেই পাবে না। ওরা শুধু কাঁদবে।

পাবক ঘরের দোরগোড়ায় আসতেই কাকি ছুটে এসে পাবককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। পাবক বলল, কাকি, ছাড়ো। আমি বাবার কাছে যাব। কাকি ওকে হাত ধরে এনে বসিয়ে দিল বাবার মাথার কাছে। পাবক মাথা নীচু করে বাবার মুখের কাছে কান এনে শুনতে চাইল বাবা কিছু বলছে কি না।

—হ্যাঁ, সত্যি! বাবা কথা বলছে। বাবা বলছে, পাবক, কী মজা বলো?

পাবক ফিসফিস করে বলল, তাই তো?

পাবক, আমি সবসময় এমনি করে তোমার কাছে আসব, রাজি তো? পাবক ফের ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ।

পাবক, এরা খুব কান্নাকাটি গোলমাল করছে। আমি কাল ফের তোমার কাছে আসব। তুমি কিন্তু ভালোভাবে থাকবে। না হলে আমার কষ্ট হবে।

পাবক ফের ফিসফিস করে বলল, না বাবা। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি আর কোনোদিনও তোমার কথা অমান্য করব না। কিন্তু তুমি না এলে আমি খুব রাগ করব। তখন আমি কাঁদব।

কাকা এবার বড়ো দুটো মালা এনে বাবার গলায় পরিয়ে দিল। পাবক মাথার কাছ থেকে সরে গিয়ে বাবার পায়ের কাছে বসল। আর বাবার ধবধবে সাদা পা দুটোয় আস্তে আস্তে করে হাত বোলাতে লাগল। বাবার আরাম হবে এতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *