রেপ

রেপ

পৃথিবীর কোনো পুরুষেরই যেন দুর্ভাগ্য না হয়, যে তার প্রেয়সীর বাড়ি হল একটা কবরখানার উলটো ফুটে, মেয়েটির ঘরের জানালাও সেই কবরমুখো আর তাকে হাপিত্যেশ করে দাঁড়াতেই হয় কবরখানার এক কোণে। মানুষ যতই নির্ভীক হোক না কেন, একটা কবরের শীতল বেদিতে সন্ধ্যের পর সন্ধ্যে ভালোবাসায় ভেজা, দুরু দুরু বক্ষে শুধু একটা মুখের অপেক্ষায় বসে থাকা যে কী অস্বস্তিকর তা ভাষায় বোঝানো অসম্ভব। অন্তত আমার ভাষায়।

শেলি কখন একবারটি জানালায় কুলফিওয়ালাকে ডাকবে, আমার সেই অপেক্ষা। তখন আমায় কুলফিওয়ালা হতে ইচ্ছে হয়। কবে, কোনদিন ফুচকাওয়ালাকে ডাকবে আমার সেই অপেক্ষা। একদিন ‘বিজু! বিজু!’ বলে বাড়ির ড্রাইভারকে ডাকতে লাগল, আর কী দমান দমে গেলাম। গাড়িওয়ালা মেয়েদের ভয়ানক দেমাক হয় দেখেছি, পদাতিক ছেলেদের ওরা বেশ করুণা করে লিফট দিতে চায়। আমার দুঃখটা বেশি। কারণ শেলির সঙ্গে যখন লোরেটোয় কিণ্ডারগার্টেনে পড়তুম তখন আমাদেরও গাড়ি ছিল। বেশ চকচকে ঝকঝকে অস্টিন অফ ইংল্যাণ্ড। শেলিদের মতো ভূতো কালো হাম্বার নয়। কিন্তু হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে বাবা দেহরক্ষা করায় সে-গাড়ি চুলোয় গেছে। শেলির বাবা ইতিমধ্যে রেসে জ্যাকপট পেয়ে হাম্বার কিনেছে। একদম বাজে, জেলে যাওয়ার মতো লোক। কিন্তু গুণ একটাই–শেলির বাবা। কিছু কপাল না থাকলে এ মেয়ের বাপ হয় কেউ?

শেলির কাছে বাপটি অবিশ্যি ভগবান। হেঁড়ে গলায় ইংরেজিতে খিস্তি করে পাড়া ঠাণ্ডা করে রাখে। লোহালক্কড়ের দালালি করে বলে মাঝে মধ্যেই বাড়িতে পার্টি দেয়। আমাকে রাস্তায় দেখলেই বলে, তুমি কোন কলেজে পড়? তোমার সাবজেক্ট কী? কিন্তু কখনো বাড়িতে যেতে বলে না। পাছে সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়, রোমান্স হয়। লোকটা ভুলেই গেল যে ছোটোবেলায় কত গেছি ওদের বাড়ি, খেলেছি ওর মেয়ের সঙ্গে। হারামি লোক তো এদেরই বলে। এই বয়সেও কী সেয়ানা নজর ছেলে-ছোকরাদের ওপর।

যে-কবরের ওপর বসে আমি শেলির দর্শনের অপেক্ষায় থাকি সেটা একটা অ্যাংলো মেয়ের কবর। মাত্র উনিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিল। ফলকে নাম খোদাই করা আছে ‘নেটালি ওয়েস্টন’। শেলির অপেক্ষায় থেকে আমি নেটালির চেহারা কল্পনা করি। কখনো অড্রে হেপবার্নের মতো করে ভাবি, কখনো রোসানা পোডেস্টা, কখনো ‘সাইকে’-র জেনেট লিলি আবার কখনো স্রেফ শেলি! এতে অন্ধকারে বসার ভয় কিছুটা কমে আর সময়ও কাটে অপেক্ষাকৃত দ্রুত। তারপর সেই জানালায় এসে কারণে, অকারণে শেলি দাঁড়ায় এই সব কল্পনা, পরিকল্পনা নিমেষে উবে যায়।

শেলি কিন্তু জানেও না যে এই অন্ধকারে আমি ওর অপেক্ষায় থাকি। এইভাবেই বসে ছিলাম যখন, হঠাৎ একদিন বাবলুদা পাশ থেকে শর্টকাট করে যেতে যেতে বলল, এ কী, অরু যে! কী করছ এখানে অন্ধকারে? কাঁচুমাচু মুখে বললাম, বড় ভালো লাগে এখানে একলা নির্জনে বসতে। বাবলুদা অনুভূতিটা বুঝল হয়তো। বলল, সেটা ঠিকই বলেছ। কনভেন্ট পার্কেও তো তিষ্ঠবার জো নেই। যা প্রেমিক-প্রেমিকার ভিড়। তা তুমি কোথায় পড়ছ এখন, বললাম,

প্রেসিডেন্সি।

-কী নিয়ে?

—ফিলোসফি।

—বিউটি!

গানবাজনার মতো আরও একটা অবান্তর বিষয়ে যে কেউ লিপ্ত হয়েছে তাতে বেশ মনে বল পেল বাবলুদা। বলল, অন্য সাবজেক্ট পাওনি বুঝি? বললাম, পেতাম হয়তো, চেষ্টা করিনি।

–কারণ?

—কারণ আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে মরণের পরে মানুষের কী হয়।

–সেটা ফিলোসফি অনার্স পড়লে জানা যায় বুঝি?

—তা যায় না। তবে মন, সত্তা, মানুষ, জ্ঞান, বস্তু এইসব বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায়।

বাবলুদা হুম বলে কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসল। তারপর গুনগুনিয়ে একটা সুর ভাঁজতে শুরু করল। বেশ লাগছিল, জিজ্ঞেস করলাম এটা কী সুর করছ বাবলুদা? বাবলুদা চোখ বুজে গুনগুন করতে করতেই এক ফাঁকে বলল, খাম্বাজ। বড়ো প্রেমের সুর।

আজ ঠিক সেই মুহূর্তে ওর ওই জানালা থেকে গেলাস ভাঙা রিনরিনে গলায় শেলিকে ডেকে উঠতে শুনলাম, বাবলুদা! কেমন আছ? বাবলুদা মাথা হেলিয়ে বোঝাল-ভালো। মুখ বুজে কিন্তু সেই সুর ভেঁজে যাচ্ছে। আর আমার বুকটা একেবারে হিম হয়ে গেল। তার মানে আমি যে এখানে সন্ধ্যের পর সন্ধ্যে ডিউটি দিয়ে যাই তা সব দেখতে পায় ও! অথচ একদিনও মুখ ফুটে ডাকল না। নাকি ও আমায় চিনতেও পারে না।

একটু পর জানালা থেকে শেলি মিলিয়ে গেল, খাম্বাজ গাইতে গাইতে বাবলুদাও উঠে হাঁটা দিল, আর আমি অসহায়ের মতো অন্ধকারে নেটালি ওয়েস্টনের কবরের পাথরে ছুরি দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে লেখা ‘শেলি’ নামগুলোতে হাত বুলোতে লাগলাম। বুঝলাম শরীরটা বেশ গরম হয়ে উঠেছে, ঘাড়ের দিকটা দরদর করছে। সোজা হাঁটলাম ঝুনুর বাড়ির দিকে, ততক্ষণে রাত দশটা।

ঝুনু দরজা খুলেই বলল, কী রে তুই? বললাম, একটা সাহায্য করবি?

—কী সাহায্য?

—শেলিকে ওর বাড়ির থেকে তুলব।

–তার মানে?

–কিডন্যাপ করব।

—কিডন্যাপ করবি? তুই!

–না তো কে?

–করে?

-রেপ করব।

ওরে শালা! বলে চৌকাঠেই বসে পড়ল পাড়ার উঠতি রংবাজ। এক হাত মাথায়, আরেক হাতে চৌকাঠ চেপে। অনেকক্ষণ পর মুখে কথা জোগাতে বলল, ব্যাটা তুই নাকি পাড়ার সোনা ছেলে। আর তোর তলে তলে এত? জানিস রেপ মানে কী?

—কারও ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌনসঙ্গম করা।

–ইচ্ছে-অনিচ্ছে সেকেণ্ডারি, আসল হচ্ছে সঙ্গম। তুই সঙ্গম করতে জানিস? চিৎকার করে উঠলাম, শাট আপ! আর রংবাজ ঝুনু সঙ্গে সঙ্গে চুপ মেরে গেল। খানিক পর বলল, কখন করবি? আজই? বললাম, এই মুহূর্তে। ও বলল, তা’লে দাঁড়া। মোটা বেল্টটা চড়িয়ে আসি।

রাস্তায় নেমেই ঝুনু বলল, ক্যাশকড়ি আছে তো কিছু? বললাম, কেন? ও বেশ অবাকই হল, আরে মরণ। বাচ্চুর ট্যাক্সিটা লাগবে না? এবার অবাক হয়ে আমি বললাম, ট্যাক্সি! ট্যাক্সি কীসের? রীতিমতো ঝাঝিয়ে উঠল ঝুনু, হাঁদা, তুই কি বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রেপ করবি ভাবছিস? অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, তা ঠিক, তা ঠিক। তা বিশ-বাইশ হবে। ঝুনু আশ্বস্ত হয়ে বলল, ওতেই হবে। বাচ্চুকে পাঁচ টাকা ধরিয়ে দেব। গঙ্গার সাইডে ট্যাক্সি ভিড়িয়ে ওতে-আমাতে বিকে’র একটা পাঁইট চড়াব, পিছনের সিটে তুই যা করার করবি।

ঝুনু বর্ণিত সিনারিওটা মনে রগড়াতে রগড়াতে অর্ধেক আনন্দই যে উবে গেল। শেলিকে নিয়ে পিছনের সিটে আমি কী করব ওরা নিশ্চয়ই ব্যাকভিউ মিররে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। শেলির লাল ঠোঁট, সাদা বুক, রেপ রেজিস্ট করার জন্য হাত-পা ছোড়াছুড়ি… সব! এই শেষের ব্যাপারগুলো মনে আসতে শরীরে মনে ফের বেশ জোর এল আমার। বললাম, আচ্ছা!

শেলিদের বাড়ির সামনে ট্যাক্সি হলট করতে ঝুনু বলল, যা ডেকে আন। আমি ফের একবার আশ্চর্য বোধ করলাম, আমি? তুই জানিস কতদিন যাবৎ আমার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ নেই, কোন মুখে গিয়ে ডাকব? ঝুনু ওর স্বভাবমতো ফের একবার খেকিয়ে উঠল, তা আমার এই বিলা মার্কা খুমা দেখলে আদৌ বেরুবে? উলটে বাপ বেরিয়ে আসবে পাইপগান নিয়ে।

বুঝলাম ভুল বলেনি ছোকরা। গাড়ির থেকে নামতে নামতে শুনলাম ঝুনু অর্ডার দিচ্ছে বাচ্চুকে, গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করিসনি। এদিকে আমার হার্টের স্টার্ট বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কী বলব যদি হারামি বাপটাই বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, কী চাই?

বেল দিতে একতলার দরজাটা অবিশ্যি খুলল শেলিই। একই সঙ্গে থমকে গেলাম দু-জনে আমরা। শেলিই প্রথম কথা বলল, কী ব্যাপার অরু? এতদিন পর, এত রাত্তিরে?

—আমি তো ভাবছিলাম এত রাত্তিরে তুমি দরজা খুললে…

—কেন, তোমার কি বাবাকে চাই?

—না না না না না। তোমাকেই।

–আমাকেই?

—হ্যাঁ, তোমাকে।

শেলি দরজার পাল্লা আর একটু হাট করে মেলে ধরে বলল, তাহলে এসো, ভেতরে এসো। আমি অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই বললাম, না না তুমিই বরং বাইরে এসো। ও বুঝল না ব্যাপারটা। বলল, সে কী! এই শীতের রাতে বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে কেন? আর তুমি তো রীতিমতো কাঁপছ। তোমার কি ঠাণ্ডা লেগেছে?

-না, না, আমার গরম লেগেছে।

শেলি অবাক চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি বললাম, তোমার সঙ্গে বাইরেই একটু দরকার।

শেলি তাও নড়তে চায় না।—আরে গায়ে চাদর নেই, আমার তো শীত করবে।

-শীত করবে না। আমি গাড়ির কাচ তুলে দেব।

এবার সত্যি সত্যি চমকে উঠেছে মেয়েটা।—গাড়ি! কার গাড়ি?

—ওই হল, একটা ট্যাক্সি।

–ট্যাক্সি? ট্যাক্সি কেন?

আর ওকে ধন্ধে রাখতে ইচ্ছে হল না। বলেই ফেললাম আসল কথাটা।

—তোমাকে কিডন্যাপ করব। ও কীরকম চুপ মেরে গেল। শেষে বলল, তোমার কি খুব টাকার দরকার? আমি লজ্জা বোধ করে বললাম, না, না তেমন কোনো ব্যাপার ঘটেনি। তোমার বাবাকে মিছিমিছি এর মধ্যে টানাটানি কোরো না। আমার…আমার…

—কী চাই?

–তোমাকে।

এবার অনেকটা সেই ঝুনুর ধারায় প্রায় মাথায় হাত দিয়ে দোরগোড়ায় বসে পড়ল শেলি। কী করো-না অরু, তুমি! এই সরল কথাটা অ্যাদ্দিন বলে যেতে পারলে না? এবার অভিমান এল আমার কণ্ঠে, কেন, সন্ধ্যের পর সন্ধ্যে ওই যে কবরের পাথরে বসে থেকেছি, একবারটি ভুল করেও ডেকেছ?

আমার কথা শেষ হয়নি, কিন্তু তোতলামি শুরু হয়ে গেছে শেলির। কী কী কী কী বললে? ওই কবরে বসে থাকা ছেলেটা তুমি?

.

-নয়তো কে? আজকেও তো বসেছি বাবলুদার সঙ্গে। বেশ তো বাবলুদাকে ডেকে কথা বললে, আমাকে দেখতেও পেলে না।

-আরে, আমরা তো ভাবতাম ওটা ওই অ্যাংলো মেয়েটার বয়ফ্রেণ্ড লুই ডিকোস্টা।

আমার মনে হল এটা পৃথিবীর চরম নিকৃষ্ট মিথ্যের একটা। এই নেভিব্লু,ফুল স্লিভস পুলওভার, আর এই সাদা ট্রাউজার্স তো পেটেন্ট করা পোশাক আমার। আমার গায়ের রং একটু ফর্সা ঠিকই তা বলে কোনো মতেই আমাকে অ্যাংলো ঠাওরানো উচিত না। আমি বললাম, এটা কেমন ধারা কথা তোমার শেলি? দেখছ আমাকে, আর ভাবছ আমি লুই ডিকোষ্টা।

শেলি প্রতিবাদ করল, আমি তোমাকে দেখে লুই ভাবছি এমনটা আবার হয় নাকি? তোমার চেহারা কি আমি এতই ভুলেছি। অগত্যা বললাম, ঠিক আছে, তুমি ওই জানলায় গিয়ে দাঁড়াও, আমি কবরটায় গিয়ে বসছি। দেখো তো ভুল ভাঙে কি না।

.

আমি কবরে গিয়ে বসলাম, শেলি জানালায় গিয়ে দাঁড়াল, তারপর দু-জনেই ফের ফিরে গেলাম ওদের বাড়ির দরজায়। শেলি মাথা নেড়ে বলল, না, আমি জানালা থেকে তোমাকে দেখিনি। ওই লুই ছোকরাকেই দেখলাম।

আমার শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করল। আমি আমতা আমতা করে বললাম, আমার একটি বন্ধুকে তোমাদের জানালায় দাঁড়াতে দেবে? ও দেখে বলুক তো কাকে দেখছে। শেলি বলল, ঠিক আছে। আমি কুনুকে ডেকে ওর সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম, আর নিজে গিয়ে বসলাম ওই পাথরে।

এরপর ঝুনু নেমে এসে বলল, না রে, তোকে তো দেখলাম না। এই একই পোশাকে একটা অ্যাংলো ছেলে বসে আছে দেখলাম। তোর সঙ্গে অবিশ্যি মিল আছে চেহারার।

আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে, পৃথিবীর অন্তত একটি জানালা দিয়ে দেখলে সামনের কবরে বসা বা দাঁড়ানো আমি আর অরুণ মুখোপাধ্যায় নই, কোথাকার এক অ্যাংলো ছোকরা মাত্র, যার নাম হয়তো লুই ডিকোস্টা। গা গুলিয়ে উঠছিল ঠিকই, তবুও নিজেকে সংযত করে শেলিকে বললাম, এর পরেও কি আমি তোমাকে নিয়ে পালাতে পারি? শেলি বলল, তার দরকার হবে না। তুমি কাল বিকেল পাঁচটায় এসো, আমি তোমার সঙ্গে বাবার কথা বলিয়ে দেবো।

—তোমার বাবার আমাকে পছন্দ হবে না।

–কেন?

–উনি ফিলোসফির লোক পছন্দ করেন না।

-তোমায় বলেছেন?

–আমি বুঝতে পারি।

-তাহলে সন্ধ্যে হলে ওই কবরে বোসো। আমি বাবাকে জানালা থেকে দেখিয়ে বলব ওই অ্যাংলো ছেলেটিকে বিয়ে করতে চাই। হি ইজ সো হ্যাণ্ডসাম।

—এটা কি পাগলামি না কি? এর চেয়ে তো পালিয়ে যাওয়াই ভাল।

–তারপর তো পালাব।

–মানে?

—মানে বাবা জানবে আমি অ্যাংলোর সঙ্গে পালিয়েছি, অ্যাংলো পাড়ায় পাড়ায় খবর নেবে। আর তুমি আমাকে লুকিয়ে রাখবে মাস কয়েক। তারপর …

আমার খুব ইজ্জতে লাগল। মনে হল শেলি আমাকে নিয়ে একটা ইয়ার্কি কেঁদেছে। ঠিক এই সময় দোতলায় ওর বাবার বিশ্রী, গম্ভীর চিৎকার শোনা গেল। শেলি ‘আসি বলে দোর এঁটে ছুটে গেল ভেতরে, আমি ট্যাক্সিতে ফিরে দেখি দিব্যি স্টার্ট বন্ধ করে ঝুনু আর বাচ্চু নিট হুইস্কি পেঁদাচ্ছে বোতলে মুখ লাগিয়ে। আমি ওদের বাড়ি চলে যেতে বলে নিজে ধীর পায়ে হেঁটে গেলাম নেটালি ওয়েস্টনের কবরে। রাত কত খেয়াল নেই, ক্লান্ত শরীরটাকে শুইয়ে দিলাম বরফ শীতল পাথরের ওপরে, মনে মনে বললাম, শেলি, আমার সব ভালোবাসাই তুমি মাটিতে মিশিয়ে দিলে এক দিনেই। এর চেয়ে এই পাথরে বসে তোমায় দেখাটাই ঢের ভালো ছিল। কত বদলে গেছ, সেয়ানা হয়েছ তুমি। কত নওছল্লা শিখেছ, এক কথায় রাজি হলে আমার প্রস্তাবে। আর আমি কিনা দু-বছর ধরে এই পাথরে বসে তোমার জন্য ধ্যান করছি। আমি তোমাকে না-পেয়ে, না-পেয়ে কিডন্যাপ করতে চাইছি, আর তুমি বললে বাবার সঙ্গে দেখা করো। ওইটা একটা বাবা! লেদ মেশিনের মতো কর্কশ গলা, জুয়াড়ি, মদ্যপ, কালোয়ার, হেটার অফ ফিলোসফি…

হঠাৎ কপালে একটা মৃদু, নারী-করের স্পর্শ। আমি ধড়মড়িয়ে উঠে দেখি একটা ফুলছাপ ফ্রক পরা, সোনালি চুল তরুণী মেম। মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল, হু আর ইউ? সুন্দর, লালিত্যপূর্ণ মেয়েলি কণ্ঠে উত্তর এল, অন হুজ গ্রেভ ইউ আর স্লিপিং। আমার হৃদপিন্ড উঠে এসেছে গলায়, তার মানে তুমি নেটালি ওয়েস্টন?

-হ্যাঁ।

–তার মানে তুমি মৃতা?

—হ্যাঁ।

–আ…মি…আ…মি কি কোনো দোষ করেছি?

—সামান্য একটু। আমার কবরে বসে অন্য মেয়ে নিয়ে ভেবেছ এতদিন।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, শেলির কথা ভেবেছি। ওকে যে আমি ভালোবাসি খুব…

—শি ইজ আ বিচ!

—এ কী অসভ্য কথা বলছ একটা ভালো মেয়ে সম্পর্কে?

—ভালো মেয়ে, মাই ফুট! তুমি তো সন্ধ্যেবেলা করে আসো। তার আগে বিকেল থেকে কত ছেলের সঙ্গে যে কত কী করে। সবার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ডেট করে। সবাইকে বলে আমার কবরে বসতে, এখানে বসলে নাকি তারা লুই ডিকোস্টা হয়ে যায়। তুমি জান, হু ইজ লুই ডিকোস্টা? হিজ মাই ওয়ান অ্যাণ্ড ওনলি লাভার। বাট হি বিট্রেড মি। বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।

ভীষণ কৌতূহলে টান-টান হয়ে বললাম, কীরকম? নেটালি আমার কোল ঘেঁষে বসে বলল, ও ইংল্যাণ্ড পালিয়ে যেতে চেয়েছিল নাইট ক্লাবে গান গাওয়া ছেড়ে। বললাম, সে তো ভালো খারাপটা কী? ও ধরা-ধরা গলায় ফের শুরু করল, সেটা ঠিকই ছিল। সেই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু ও প্যাসেজ মানি নিল একটা আমেরিকান সেলারের থেকে। বিনিময়ে চুক্তি করল শিপি চ্যাপকে একদিন থাকতে দেবে আমার সঙ্গে।

নিজের অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ও মাই গড। আর এই প্রথম লক্ষ করলাম যে, নেটালি ওয়েস্টন অসামান্য সুন্দরী। আমি সহানুভূতি জানাতে ওর কোমল, সুন্দর হাতটা নিজের হাতে নিলাম। ও মিষ্টি করে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। তারপর ফের শুরু করল—

ও আমেরিকান মরিলকে নিয়ে আর প্রচুর মদ, সিগারেট নিয়ে আমাদের ক্রিক লেনের বাড়িতে এল। খুব নাচলাম, গাইলাম আমরা। টোনি ব্লেনটের সামওয়ান এলস ইজ ইন ইওর আরমস টুনাইট’ গাইল লুই। আমি বুঝেছিলাম আমি খুব বেহেড হয়ে পড়ছি। লুই একটার পর একটা লাইট নিভিয়ে দিচ্ছিল। তারপর কখন যে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল আমি জানি না। যখন ঘোর ভাঙল দিস ডার্টি অ্যামেরিকান ওয়াজ রেপিং মি। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আটকাবার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারছিলাম না। হি ওয়াজ জাস্ট টু স্ট্রং।

এই সময় নেটালি কান্নায় ভেঙে পড়ল। ভাবতে পারি, যে ছেলেটিকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলাম সে-ই আমায় তুলে দিল যার-তার হাতে। আমার জীবনের প্রথম লাভমেকিং হল রেপের মাধ্যমে।

আমি ক্রমাগত মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললাম, ইটস ব্যাড! ইটস অফুল! আই কান্ট ইমাজিন দিস।

নেটালি বলল, পরের দিন সকালে আমি মুখ ধুতে গিয়ে হাতের শিরা কেটে ফেললাম। নোট রেখে দিলাম, আমার মৃত্যুর জন্য লুই ডিকোস্টা দায়ী।

আমি ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠছিলাম। শেষে বললাম, আমি লুই ডিকোস্টা নই।

—আমি জানি। কিন্তু আমার কবরে, যে বসে প্রেমের কথা ভাবে সে-ই তখনকার মতো লুই।

—তুমি কি এখনও লুইকে ভালোবাসো?

–ভালোবাসতে-বাসতেই তো মারা গেছি, মৃত্যুর পর কি তা আর বদলায়?

—মৃত্যু কি কিছুই বদলে দেয় না?

–দেয়, কেবল ভালোবাসাকে ছাড়া।

আমি চুপ করে একটু ভাবলাম দার্শনিক পাস্কালের কথা— হৃদয়ের কিছু যুক্তি আছে যার তল পাওয়া যায় না। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, কোনো অনুশোচনা থাকলে মৃত্যুর পরও কি তা বহন করে যেতে হয়? নেটালি বলল, যদি না শুধরে নেওয়া যায়।

—কীরকম?

–যেমন ভালোবাসা থেকে দেহের মিলন কেমন হয় আমি জানলাম না।

—সেটা কি খুব বড়ো বেদনা?–খু-উ-ব!

—কিন্তু সে তো লুইকে ছাড়া সংশোধন করাও অসম্ভব।

নেটালি তার দুই দুধসাদা বাহুতে আমাকে আলিঙ্গন করে ঠোঁটে চুমু দিতে দিতে বলল, এখন তো তুমিই আমার লুই ডার্লিং। আমার সমস্ত অঙ্গে কী সুখ এখন, কত সুখ ছেয়ে আছে। মেয়েটার মধ্যেও। কত বিচিত্র সুন্দর ধ্বনি ওর মুখ থেকে। শুধু বলছে, আমাকে ভালবাসা দিয়ে মেরে ফেললো। আমি বলছি, আমাকে মারো। ও বলছে, আমাকে। আমি বলছি আমায়।

হঠাৎ শেলির কণ্ঠ দূরে কোত্থেকে, ‘অ্যাই গোয়ালা। অ্যাই রামু!’ আমি চোখ মেলে দেখি প্রত্যুষের আলোয় শেলি গোয়ালাকে ডাকছে ওর ওই সুরেলা, গেলাসের কাঁচভাঙা গলায়। হঠাৎ আমার দিকে চাইল। নেভি ব্লু সোয়েটার আর সাদা ট্রাউজার্সে ধুলো মাখামাখি হয়ে শুয়ে আছি নেটালি ওয়েস্টনের কবরে। মেয়েটা ঠিকই বলেছে, ওই জানালা দিয়ে আমায় চিনতে না পারা ওর ভণিতা। নিশ্চয়ই কাল সাঁট করে নিয়েছিল ঝুনুর সঙ্গে। ও আমাকে ওই জানালা দিয়ে দেখলে লুই ডিকোস্টা ভাবে। আমি এই পাথর থেকে ওকে দেখে কী ভাবি তা কি ও জানে? ওকে রেপ করারও প্রবৃত্তি আমার নেই এখন। আমি স্বর্গীয় প্রেম ও মিলনের স্বাদ পেয়েছি।

আমি কবর থেকে উঠে আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে হাঁটলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *