সিঁড়িভাঙা অঙ্ক

সিঁড়িভাঙা অঙ্ক

ডিনা মিস প্ল্যানচেট করছে।

মস্ত মস্ত পর্দা টেনে রেখে ঘর অন্ধকার। গোলটেবিলের এক ধারে ফুলকাটা রেশমি কাপড়ের শেড করা টেবিল ল্যাম্প। এক ধারে ডিনা মিস, অন্য ধারে তার দিদি কুমি। ল্যাম্পের আলোয় দুই বৃদ্ধার রুপোলি চুল সোনালি হয়ে আছে। থেকে থেকে কুমি আন্টির সোনালি চশমার ফ্রেমে ঝিলিক দিচ্ছে আলো। অরু শুধু জানে প্ল্যানচেট মানে ভূত নামানো। অরু ফের বিরক্ত হয়ে পাশের ঘরে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসল। ডিনা মিস কেন ভূত নামাতে যাচ্ছে? ডিনা মিসকেই তো ভূতে পেয়েছে। ধুস! বলে অঙ্কের বই-খাতা বন্ধ করে অরু জানালা দিয়ে শরতের আকাশ দেখতে লাগল।

কী সুন্দর নীল হয়েছে আকাশটা! সাদা মেঘগুলো এই সময়েই এত সাদা হয় কেন? নীচে ইংরেজি ইশকুলের মাঠই বা অত সবুজ হয় কী করতে। অরু দেখল মাঠে ছেলেরা বল নিয়ে নেমে পড়েছে। চার নম্বর ফুটবল। অনেকেরই পায়ে হোজ আর ফুটবলের বুট। এত বলেও কাকার থেকে ফুটবলের বুট আদায় হল না অ্যাদ্দিনে। চোখ খারাপ বলে একটা গোটা ফুটবলও চোখে দেখতে পাবে না অরু? কিন্তু কে বোঝাবে কাকাকে? বললেই হাঁ হাঁ করে উঠবে—সে কী, মাঠে ঘাড় উলটে পড়লে কে দেখতে যাবে? কোথায় মাঠ, কোথায় পুজোর আকাশ, সাদা মেঘ, তা না দিন-দুপুরে বইখাতা নিয়ে পারসি মিসের বাড়ি গিয়ে অঙ্ক কষো। বারোটা অঙ্ক দিয়ে দিনটার বারোটা বাজিয়ে বুড়ি এখন প্ল্যানচেট করছে! আর একটা অঙ্কও মেলার নয়। উত্তর দেখাচ্ছে শূন্য, আর অরুর কষায় হয়ে গেল সাঁইত্রিশ। কী করে সম্ভব! যেমন অঙ্ক, তেমন এই মিস। অরুর ইতিহাস পড়তে, ইংরেজি পড়তে কত সুখ হয়, অঙ্ক কষে কে কবে বড়ো হয়েছে? কাকা বলবে, অঙ্ক কষো, অঙ্কই সব। ডিনা মিস বলবে, অঙ্ক কষলে মাথা খুলবে কী করে? কিন্তু কে বুঝবে, ক-টা বাজে অঙ্ক কীভাবে অরুর একটা গোটা দিনকে নষ্ট করে দেয়? অথচ কী সুন্দর হয়েছিল দিনটা। ঘুম থেকে উঠতেই পাড়াজুড়ে রব শুনতে পাচ্ছিল ‘আগুন! আগুন!’ উঠোনমুখে এসে অরু দেখল, সারাপাড়া খালি হওয়ার জোগাড়। ছেলে-বুড়ো দাদা-দিদি জ্যাঠা-মাসি—যার যা পরিচয়—সবাই ছুটছে মৌলালির দিকে। সি আই টি-র শেষে দু-নম্বর পোলের ওপাশে কাঠের গোলায় আগুন লেগেছে। অ্যান্তো বড়ো আগুন! ভাবল অরু। পুবের আকাশ লাল হয়ে গেছে, যেন আরেকটা সূর্য উঠবে ওই কোণ থেকে। লকলক করে শিখা বেরোচ্ছে, আরেকটু পর ধোঁয়ার মেঘও ছড়াবে। শনিবারের সকালে ছুটির হাওয়া বইয়ে দিয়েছে আগুন। কোথাও আগুন ধরলে, গুণ্ডায় গুণ্ডায় সোডার বোতল চললে, মস্তান ধরতে পুলিশ নামলে পাড়ায় ছুটির হাওয়া লাগে। অরুরও তখন মনে হয়, এরকম পাড়া হয় না।

জানো মিস, কী আগুন, কী আগুন! সব পুড়ে ছারখার। বলতে বলতে মিসের বাড়ি ঢুকেছিল অরু। কোথায় জিজ্ঞেস করবে, ক-জন মরল? দমকলের ক-টা গাড়ি দেখলে? তা না সটান বই ধরিয়ে বলল, এই নাও, সিঁড়িভাঙার অঙ্কগুলো করে ফেলো। সত্যি-সত্যি অরুর মন ভেঙে গেল তৎক্ষণাৎ। সিঁড়িভাঙার অঙ্ক কষে কে কবে খুব উঁচুতে উঠেছে। মিসের বাড়ি চারতলা, এ পাড়ার সবচেয়ে উঁচু বাড়ি। ছাদে উঠলে হাওড়ার ব্রিজ, মনুমেন্ট দেখা যায়, অথচ ওঠার লোক নেই। ফ্ল্যাট বাড়িতে সবাই নিজের ফ্ল্যাট সামলাচ্ছে। দোর এঁটে বসে ম্যাজিক আই দিয়ে তোক দেখে।

সবাই যখন আগুন দেখতে ছুটল, মনে হল এটা সপ্তমী। কুড়ি দিন আর বাকি কই। কাকা অমৃতবাজার পত্রিকা পড়তে পড়তে হুংকার দিল, অরু! বাড়ির বাইরে যাবে না। ওই রাস্কেলগুলো আগুন দেখতে যায় যাক। তুমি একটু কাগজ পড়ো। দেখেছ, রাশিয়া কত উন্নতি করেছে রকেটে। খুব শিগগির মানুষ যাবে মহাকাশে। এখন কুকুররা যাচ্ছে।

অরুর কান্না পাচ্ছিল। এর চেয়ে রাশিয়ার কুকুর হয়ে জন্মানোও ভালো ছিল। দেশে আগুন লাগবে তাও দেখতে পাব না? আমার চোখে কী হয়েছে। আমি তো সব দেখতে পাই। কোথায় মুখপোড়ার সঙ্গে বাঁধান খেলছে পেটকাটা, জগুদার মাঞ্জায় মাঞ্জায় লাট খেলছে মিন্টো লেনের সিরিলের লেজঝোলা, কাপমার ঘুড়ি। অরু তো… মনে হতেই মনে-মনে জিভ কাটল অরু। কাল চিলেকোঠার ঘরে বসে কী সব্বোনেশে ব্যাপার দেখে ফেলল অরু। পড়ছিল ‘ট্রিম অব টাইম’ বই থেকে জুলিয়াস সিজারের হত্যা, হঠাৎ এলভিসের লাভিং ইউ’ গান ভেসে এল লোরেনদের বাড়ি থেকে। অরু জানালা খুলে দেখে লোরেন একটা ঢাউস তোয়ালে পরে গানের সঙ্গে নেচে নেচে জামা ইস্তিরি করছে। গায়ের উপর দিকে কিছু নেই।

অরু মনে মনে বলল, কাকা, তুমি জানো অ্যাংলোরা কী সুন্দর! বিশেষ করে লোরেন। কী সুন্দর বুক, কাকা, ওর। পরিদের মতো। সাদা দুধের মতো, মাঝখানে…। ধ্যাৎ! নিজের বোকামিতে নিজেই লজ্জা পেয়েছিল অরু। কাকার কথায় খুব ব্যথা পেয়েছে অরু। আগুন দেখতে কেউ কি আগুনের মধ্যে গিয়ে ঝাঁপায়? কাকাটাই বা কী? এত বয়স হয়েছে, একটু আগুন দেখতেও মন চায় না? একটা গোটা কারখানা তো রোজ পোড়ে না! তাও কাঠের গুদাম, এসব তো পোড়ার জন্যই করা।

ডিনা মিসটাই বা কী? অঙ্ক দিয়ে চাকরের মতো বসিয়ে রেখে ভূত ডাকছে! আর তাও কে? না, ভাই জিমি। সবে এক বছর হল যমজ ভাইটি গেছে, তাই কী ডাকাডাকি! আরে, যে আসার সে এমনিই আসে। কেন, অরুর বাবা চলে গেছে চার বছর হল, কিন্তু রোজ সন্ধ্যেকালে ছাদের আলসের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেই বাবা আসে। হাতে হাত ধরে, আকাশের তারা চেনায়, হিটলার নেপোলিয়নের কথা বলে, অঙ্কের কথা কক্ষনো বলে না…তারপর অরুকে…তুলে দেয় আলসের ওপরে আর বলে ছোটো! তখন ডান হাতে বাবার হাত ধরে অনবরত আলসের এদিক থেকে ওদিক ছুটোছুটি করে অরু। গা দিয়ে ঘাম ছুটে যায় শেষে, কিন্তু বাবা ক্লান্ত হয় না।

কেউ এসব দেখতে পায় না, রাতের দিকে ছাদ মাড়ানো অভ্যেস নেই কারও। ছুটতে ছুটতে অরু দেখে হাওড়া পোলের ডগায় আলো, বড়য়া বেকারির চিমনির ধোঁয়া, গ্যাঁজাদের বাড়ির পায়রার খোপ, ফটিকদের ছাদে বিয়ের ম্যারাপ, পারসি বাড়ির বাগানে বটগাছের মাথা, বেনেবাড়ির ভাঙা পিয়ানোর সাদা-কালো রিড, ডাক্তার সাহার একতলার চেম্বারে রোগীর ভিড়, বটকেষ্টর মুদির দোকানে গামছায় মোড়া গুড়, রাখাল উকিলের ফিয়েট গাড়ির ফাটা টায়ার, অঞ্জুদের বাড়িতে প্রাইভেট টিউটরের শিঙাড়া খাওয়া, সিরিলের সঙ্গে গিন্নি মরিনের ঝগড়াঝাঁটি আর বাড়ির পিছনপাটে এসে গ্রাম চালিয়ে লোরেনের নাচ। মাঝে মাঝেই ঘুরে ঘুরে অরু বাবাকে দেখে…কখনো উকিলের সুটে, কখনো ফুলহাতা জামার সঙ্গে ধুতি, পাম শুতে, কখনো গলাবন্ধ কোট আর পায়জামায়।

বাবাকে দেখলেই অরুর গলা বন্ধ হয়ে আসে কান্নায়। কেন সবাই বলে অরুর বাবা নেই। কার বাবা রাত্তিরে ছেলের হাত ধরে আলসে দিয়ে দৌড়োয়? কার বাবা অন্ধকারে তারার দিকে তাকিয়ে কবিতা বলে? কার বাবা অন্ধকারে গাইতে পারে ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সংগীত ভেসে আসে’? কার বাবা হাত ধরে থাকলে সে পাখির মতো উড়তে পারে রাতের আকাশে? বাবা থাকলে এই রাতেরবেলায়ই আলসে দিয়ে চলতে পারে অরু। দিনেরবেলা এক পা-ও যাওয়ার ক্ষমতা নেই ওর ওখান থেকে। বাবা আবার নিষেধ করে, মা বা কাকাকে বোলো না যেন! তা হলে ছাদে উঠতে দেবে না।

বাবা কি খেপেছে! তাই কখনো বলা যায় মাকে, কাকাকে? এমনিতেই হাত ছেড়ে রাস্তা পার হতে দেয় না। তার ওপর জুটেছে এই ডিনা মিস, পড়িয়ে পড়িয়ে মাথাটা খারাপ করে দিল অরুর। মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করে। বেঁচে থাকার এই ছিরি! আর এখন দ্যাখো এই বুড়ি মিসকে! সিঁড়িভাঙা অঙ্ক ধরিয়ে প্ল্যানচেট করতে বসেছে। অরু ফের গুটি গুটি হলঘরে গেল। দুই বোন চোখ বুজে কীসব বকে যাচ্ছে। হয়তো জিমি এসেছে। ভাইয়ের সঙ্গে তো ওরা গুজরাটিই বলে। বোসো জি, চলো জি, খানা খেয়ো জি… যা-ই বলবে একটা ‘জি’ জুড়ে দেবে।

আলোর লাল আভায় গল্পের বুড়িদের মতো লাগছে দু-জনকে। অরু ভাবল কাছে গিয়ে হালুম! বলে একটা চিৎকার জুড়ে দেয়। কিন্তু তা আর হল না, তার আগেই বাবুর্চি মকবুল এসে কুতা যাইচ্চো? কুতা যাইচ্চো? করে ওকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেল কিচেনে। সেখানে একটা কাঠের বাক্সের ওপর বসিয়ে দিয়ে বলল, ই লাও হাণ্ডি কাবাব, বউত আইসসা আচে। উখানে তো জিন আছে, মিসিবাবা!

কাবাব খেতে খেতে অরু ভাবল জিন! সে আবার কী? জিন কী গো মকবুল দাদা? মকবুল বলল, আদমির মওত হলে জিন পাকিয়ে যায়। মওত কী গো মকবুলদাদা? আদমি যখন লিসাস লেনা বন্দ করে দেয়। নিঃশ্বাস বন্ধ! তার মানে মরে যাওয়া। তা মরে তো বহুত লোক, তাতে কি সব জিন হয়? মকবুল বলল, ডিনা মেমসাবের ভাই তো একসঙ্গে পয়দা হয়েছিল, তাই জিন হয়ে বহিনকে ডাকছে আয়! আয়!

দুর! মকবুলটা কিসসু জানে না। ডাকছে তো ডিনা মিস নিজে। জিমি আঙ্কেল তো আসার নামই করে না। বাবাকে তো ডাকার দরকার হয় না অরুর। ছাদের ঘরে একলা থাকলেই টোকা পড়ে দরজায়, আপনা থেকে খুলেও যায় পাল্লা। বাবা এলে বাবার গন্ধ পায় অরু। বিলিতি দাড়ি কামানোর সাবানের গন্ধ। নাক ভরে নিঃশ্বাস নেয় তখন অরু। মকবুল মাংস আর কীসের গন্ধ জানে! মকবুল ধারালো ছুরি দিয়ে ছপছপ ছাত পেটাইয়ের ঢঙে মাংসের কিমা বানাচ্ছিল। আর অরুর মনে পড়ছিল জগুদাকে। মিন্টো রো-র মস্তান। সেন্ট্রাল ক্যালকাটার সেরা বীর। বাবা নেপোলিয়নের কথা বললে অরু জিজ্ঞেস করে, আমাদের জগুদার মতো বীর? বাবা তখন খুব হাসে। বলে, জগুটা খুব ভালো ছুরি খেলে, না? অরু বলে, ভী-ষ-ণ!

জগুদার ছুরি খেলা মানে ছুরি নিয়ে ম্যাজিক করা। একদিন দেখিয়েছিল কীরকম খেলা। ধারালো ছুরি পকেটে নিয়ে ঘুরতে দেখে জিজ্ঞেস করল, তাতে কী হয়? জগুদা সঙ্গে সঙ্গে ছুরিটা বার করে ছুড়ে মারল সামনের দেয়ালের গর্তে। বলল, দেখলে তো? খুলতেই হল না!

বাবার হাত ধরে অন্ধকারে আলসে ধরে ছুটতে ছুটতে অরু বলেছিল, বাবা, আমি জগুদার কাছে ছুরি খেলা শিখব? বাবার হাত কেঁপে গিয়েছিল, না, না, অরু! কক্ষনো না। তুমি বড়ো হয়ে তোমার নিজের কথা লিখবে। আমার কথা, কাকার কথা, মার কথা লিখবে। এই পাড়ার সবার কথা লিখবে। তখন খুব ভালো করে জগুর কথা লিখো। অরু জিজ্ঞেস করল, কেন, এসব কথা কেন লিখব? কার জন্যে? বাবা তখন কোলে করে ওকে নামাতে নামাতে বলল, আমার জন্যে। অরু বলল, কেন, তোমার তো কত বই! বাবা ঘাড় নাড়ল, আমি আর জ্ঞান দিয়ে কী করব, অরু? অরু জিজ্ঞেস করল, তুমি তা-লে কী চাও? বাবা ওর গালে দুটো হাত রেখে বলল, ভালোবাসা, অরু, ভালোবাসা। অরু ফের ওর অঙ্কের টেবিলে গিয়ে বসল। নীচে ছেলেরা জোর দমে খেলছে। আরও নতুন নতুন মেঘ এসে গেছে আকাশে, একটা মিষ্টি হাওয়াও বইছে। লেখাপড়ার পক্ষে খুব খারাপ সময় এটা। সব অঙ্ক ভুল হওয়ার সময়। পড়া তো পড়া! না হলে প্ল্যানচেট শেষ করে এসে স্কেল নিয়ে দক্ষযজ্ঞ বাঁধাবে ডিনা মিস। কী ভাগ্যি, এখনও ডিনা মিস প্ল্যানচেট করছে।

কিন্তু ও কী! কীসের শব্দ ওসব? হ্যাঁ, তাই তো! ডিনা মিস কাঁদছে। ব্যাকুলভাবে কাঁদছে। ভাই জিমিকে ডেকে ডেকে কাঁদছে। কী বলছে ডিনা মিস? ওর এত কী কষ্ট? বেশ আছে তো দুই বোন সারাজীবন একা একা। ওদের তো ভালোই দেখতে, কেন তা-লে ওদের বিয়ে হয়নি আজও? চুল পেকে গেল, বুড়ি হয়ে গেল, শুধু বাচ্চা পড়িয়ে পড়িয়ে…অরু ফের উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে অন্ধকার হলঘরে দাঁড়াল। ডিনা মিস কাঁদছে, জিমি, আমরা তো যমজ। একবছর হয়ে গেল, কেন আমায় তুলে নিচ্ছ না? জীবনে কী আর আছে ভাই, তোমার স্ত্রী পুত্র পরিবার সবাই আলাদা হয়ে চলে গেছে। ওরা ভালোই আছে। মরছি শুধু আমি আর কুমি।

এবার কুমি আন্টি কাঁদতে শুরু করল, ভাই, বাতের ব্যথায় হাঁটতে-চলতেও পারি না। টাওয়ার অব সাইলেন্সে যখন শকুনরা তোমার দেহ ঠোকরাচ্ছিল, ভাবলাম কত অভাগা আমি। ছোটোভাই চলে গেল, আমি পড়ে রইলাম? কেন আমায় কি শকুনেও ছোঁবে না?

রাগে কাঁপছিল অরু। এই কি ভূত নামানো? অন্ধকারে চোখ-বুজে কান্নাকাটি। এরা তো মেয়েছেলের অধম। বয়সের গাছপাথর নেই, আত্মা কাকে বলে জানে না। কী হয়েছে অরু সিঁড়িভাঙা অঙ্ক জানে না তো? অরু আত্মা চেনে, চলে যাওয়া ফিরিয়ে আনতে পারে। তার জন্যে টেবিল ল্যাম্প লাগে না। অরু তাচ্ছিল্যভরে পটপট পটপট করে ঘরের সব আলো জ্বালিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ডিনা মিসের, হোয়াট আর ইউ ডুইং, অরুণ? দিস ইজ অ্যাট্রোশস!

অরু দৌড়ে পড়ার ঘরে গিয়ে বইখাতা গোছাতে লাগল। বাড়ি যাবে। ঘুরতেই দেখে ডিনা মিস হাতে স্কেল নিয়ে দাঁড়িয়ে। কাঁপতে কাঁপতে বলছে, তুমি জানো, আজ তুমি কী করেছ?

-জানি।

–কী জানো?

—জানি যে, তোমরা কিসসু জানো না!

—কী জানি না?

—কেউ চলে গেলে তাকে কী করে আনতে হয়? দপ করে এক নিমেষে নিভে গেছে ডিনা মিসের রাগ আর মুখ। কী বলছ তুমি অরুণ? এসব কথার তুমি কী জানো? অরু বলল, সব। ডিনা মিসের পাগল-পাগল লাগছে নিজেকে —সব জানো? অরু সিঁড়িভাঙা অঙ্ক জানো না? অরু রাগতস্বরে বলল, আকাশে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি লাগে বুঝি?

—তুমি কী বলছ অরুণ? আমি তোমার কাকার সঙ্গে কথা বলব কাল। তোমার ভূতে পেয়েছে।

-তোমায় ভূতে পেয়েছে মিস। আমি মরে যাওয়া লোকদের কাছে আনতে পারি।

–বটে! কীভাবে?

-আগে মরো। ভাইয়ের কাছে যাও। তারপর দেখো আমি তোমাকে আমাদের ছাদে ডেকে আনব। তোমার সঙ্গে খেলব, গান করব, কাঠের গোলার আগুনের গল্প শোনাব।

.

সন্ধ্যে নেমেছে। সরু চাঁদ আর তারার আকাশ। চিলেকোঠার ঘরে সকালের ভুলভাল অঙ্কগুলো নিয়ে কাটাকুটি করে যাচ্ছে অরু। কিন্তু মন পড়ে আছে দরজার দিকে, বাবার টোকার জন্য। এটা বাবার সময়।

কিন্তু টোকা না-পড়েই দরজা খুলে গেল। অমনি বই ছেড়ে অরু ছুট লাগাল ছাদের দিকে। বাবা টুক করে ওর ছোট্ট দেহটা তুলে দিল আলসের উপর আর হাত ধরে আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু হল দু-জনার। কিন্তু বাবার সেই দীর্ঘ, পুরুষ্টু পাঞ্জা এত সরু, নরম হয়ে গেল কেন হঠাৎ। বাবার কি শরীর খারাপ? অরু কাঁপা কণ্ঠে ডাকল, বাবা! আর তাকাল বাবার দিকে…

কিন্তু বাবা কই? এ তো ডিনা মিস! পিঙ্ক ফ্রেঞ্চ জর্জেট শাড়ি আর কালো ব্লাউজ, পায়ে কালো হিল-তোলা জুতো। হাতে সরু সোনার বালা, সোনার ঘড়ি। আর ধবধবে ফরসা মুখে আর লিপস্টিক-ঘষা ঠোঁটে প্রাণজুড়ানো হাসি। বলল, অরুণ, আমি পেরেছি। আমি পেরেছি অরুণ। কতদিন এই চাঁদের আলো আমি দেখিনি। কতকাল ছাদে উঠিনি রাতে। নাও ইউ মাস্ট টিচ মি টু রান। অরু, আই মাস্ট রান। ফ্লাই।

ডিনা মিসের হাত ধরে আলসে দিয়ে অরু ছুটছে আর নীচে দেখছে, বড়য়া বেকারি, পারসি বাগান, অ্যাংলোদের ঝগড়াঝাঁটি, টিউশন মাস্টারের শিঙাড়া খাওয়া, অ্যালসেশিয়ান কুকুর নিয়ে জগুদার পায়চারি, বেনেবউয়ের লুচি রান্না, খোট্টাদের রান্না, রাখাল উকিলের গাড়ি স্টার্ট, রঙ্গুলাল পোপার খিস্তিখেউড়, ছাদে লুকিয়ে মেলামেশা তাপস আর করুণার, পিছন দিকে গ্রাম চালিয়ে উদ্দাম নাচ লোরেন সুইনটনের।

কিন্তু কিছুই টানছে না আর অরুকে। কত উঁচুতে ছুটছে ও, আকাশের কাছাকাছি, যেখান থেকে মন চাইলেই রাস্তায় গিয়ে নামা যায়। সিঁড়ি লাগে না, সিঁড়িভাঙা অঙ্কও না। ডিনা মিস কিন্তু সিঁড়িভাঙা অঙ্কের সূত্র বলছে।

বড়মাস…BODMAS…প্রথমে ব্রাকেটগুলো খুলে দাও, একের পর এক। তারপর ভাগ, গুণ, যোগ, বিয়োগ। ফাস্ট ব্র্যাকেট, সেকেণ্ড ব্র্যাকেট, থার্ড ব্র্যাকেট। গুণ ভাগ যোগ বিয়োগের তো পরম্পরা আছে…

বিরক্ত হয়ে অরু বলল, মিস, তুমি কি অঙ্ক কষবে? তোমার কি মরেও ক্ষান্তি নেই। তা হলে এলে কেন? আমি কি তোমায় প্ল্যানচেট করেছি? সহসা শাড়ির ভাঁজ থেকে স্কেল বার করেছে ডিনা মিস, অরুণ, ফাস্ট লার্ন টু স্পিক উইথ ইয়োর এল্ডার্স। আই অ্যাম নট গোইং টু স্পেয়ার ইউ। ইফ ইউ ডোন্ট লার্ন ম্যানার্স অ্যাণ্ড অ্যারিথমেটিক, বলেই আলসে থেকে নামিয়ে হাতে দু-ঘা।

অরুর এখন সত্যিই দু-চোখ বেয়ে জল নেমেছে। ছাদের শান্তিটাও চিরকালের মতো গোল্লায় গেল। ব্যথায় আর বেদনায় অরু ডুকরে উঠল। বাবা। আর তখনই চোখে পড়ল আকাশের পূর্ব কোণে সকাল বেলার সেই অগ্নিকান্ডের শেষ ধিকি ধিকি শিখা। অরু চট করে মিসের হাত টেনে নিয়ে বলল, দ্যাখো, মিস, আমি মিথ্যে বলিনি। কাঠের গুদোমে সত্যিই আগুন লেগেছে। তখন তুমি আমাকে বিশ্বাস করলে না।

ডিনা মিস অরুর মার খাওয়া তালুতে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, আমি তোমায় বিশ্বাস করি অরুণ। বিশ্বাস করি বলেই তো আজ এখানে আসতে পারলাম। বিশ্বাস করি বলেই তো মাংসকাটা ছুরিটা বুকে নিয়ে শুয়েছিলাম দুপুরে। তারপর কখন…

ডিনা মিস শাড়ি সরিয়ে নিয়ে ওর ব্লাউজটা দেখাল। বুকের রক্তে ভেসে যাচ্ছে সেটা।

চোখ বড়ো করে অন্ধকারে ওই দৃশ্য দেখতে দেখতে অরু বলল—রক্ত! শাড়ি দিয়ে বুকটা ঢেকে দিতে দিতে ডিনা মিস বলল, না অরুণ, ভালোবাসা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *