বেদের যুগে স্ত্রীশিক্ষা

বেদের যুগে স্ত্রীশিক্ষা

সাধারণভাবে আমাদের ধারণা যে বৈদিক যুগে নারীর শিক্ষায় কোনো অধিকার ছিল না। এ ধারণা এক অর্থে সত্যও বটে কারণ সে যুগে বিদ্যাশিক্ষা শুরু হবার আগেই ছিল উপনয়ন, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য পুরুষ সন্তানের। কাজেই স্বভাবতই নারী বাদ ছিল; এবং উপনয়ন না হলে বিদ্যাশিক্ষা শুরুই হত না। কিন্তু এ হল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, সমাজ যা অনুমোদন করত এবং রাজা অর্থ ও সহায়তা দিয়ে যে ব্যবস্থার আনুকূল্য করতেন।

এর বাইরেও শিক্ষা ছিল তা প্রাতিষ্ঠানিক নয়, বরং খানিকটা ব্যতিক্রমী। কী করে জানা যায়? প্রথমত, বেদরচয়িতাদের মধ্যে বেশ কিছু ঋষিকার ও নারী-ঋষির নাম পাই— রোমশা, লোপামুদ্রা, অদিতি, বিশ্ববারা, শাশ্বতী, অপালা, সিকতা, নীবাবরী, ঘোষা, অগস্বশা, সূর্যা, ইন্দ্রাণী, উর্বশী, দক্ষিণা, সরমা, জুহু, বাচ, রাত্রি, গোধা, শ্রদ্ধা, শচী, সর্পরাজ্ঞী, বসুক্ৰপত্নী, শ্রী, লাক্ষী, মেধা ইত্যাদি। এঁরা সকলেই নারী ছিলেন, জীবজন্তুর নামে পরিচিত নারী নয়, এমন কথাই বা বলা যাবে কী করে? তবে একটা কথা বোঝা যায় যে, বেশ কিছু নারী বেদের অংশবিশেষ রচনা করেছিলেন এবং তাঁদের রচনা বেদে সংকলিত হওয়া মানে বৈদিক ঋষিমণ্ডলীতে স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন।

তবে কি বেদের যুগে নারী শিক্ষিত হতে পারত? তাই বা কেমন করে বলি। সে যুগে পাঠ্য বলতে একমাত্র বেদ এবং বেদপাঠের যোগ্যতা ছিল উপনয়নে, আর নারীর ক্ষেত্রে উপনয়ন ছিল নিষিদ্ধ। তা হলে যাঁদের নাম পেলাম, তাঁরা বেদপাঠেই শুধু নয়, বেদ রচনাতেও অধিকারিণী ছিলেন এবং তাঁদের রচনা তৎকালীন ঋষিমণ্ডলীও গ্রহণ করতেন।

মেয়েদের উপনয়ন ছিল না, মনু বলেছেন নারীর পক্ষে বিবাহই উপনয়ন। তা হলে উপনয়ন হলে বেশিক্ষাই তো নিষিদ্ধ ছিল। তবু ঋগ্বেদে এতগুলি ঋষিকার নাম পাই, উপনিষদে গার্গী, আত্রেয়ী, মৈত্রেয়ী এবং আরো দু-একজনের নাম পাই যাঁরা বেদজ্ঞ বলেই বেদ নিয়ে আলোচনা করতেন। এ অধিকার তাঁরা পেলেন কোথায়?

এইখানে একটা সহজ বুদ্ধির সমাধান কাজে লাগে। সব সমাজেই বরাবরই একটা অলিখিত আইন ছিল। যেমন মনুর মতে নারীর পক্ষে বিবাহই বেদপাঠ তেমনই উলটোদিকে কিছু নারীর পক্ষে বেদপাঠই ছিল বিবাহ। এঁরা কারা? একটু ইঙ্গিত পাই কয়েকটি নামে গোধা (নিশ্চয়ই কুদর্শনা, ফলে বিবাহ হয়নি), হয়তো সর্পরাজ্ঞীও অমনই কেউ, রাত্রি (হয়তো কৃষ্ণবর্ণা, আর্যসমাজে উপেক্ষিত) দু-একজন কোনো কোনো পুরুষের নামেই পরিচিত যেমন বসুক্ৰপত্নী বা অগস্ত্ব্যস্বশা।

কল্পনা করা যায় কোনো মেয়ের শরীরে বিকৃতি আছে বিয়ের বাজারে অচল, পিতা আচার্য করুণাভরে মেয়েটিকে উপনয়ন দিলেন এবং ছাত্রদের পাশে বসিয়ে বিদ্যাদানও করলেন। কালে এ মেয়ে তো বেদজ্ঞ হল, হয়তো পরে বেদমন্ত্র রচনা করল, যেগুলি স্থান পেল সংহিতায়। কেউ বা অন্ধ, খঞ্জ, বিকৃতাঙ্গ, পঙ্গু হত, কেউ বা দুর্গন্ধযুক্ত বা বেশহীনা হত, ফলে সমাজে স্বাভাবিকভাবেই তাদের বিয়ে হত না। এমন মেয়েরা কী করবে? মনে হয় অনেক সময়েই তাদের পিতা তাদের শিক্ষায় অর্থাৎ বেদপাঠে অধিকার দিতেন। এঁদের মধ্যে যাঁরা বুদ্ধিমতী তাঁরা। নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধির স্বীকৃতি পেয়ে সমাজে মর্যাদা পেতেন।

গার্গী যাজ্ঞবন্ধ্যের সঙ্গে যখন বেদবিষয়ে তর্কে যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রায় কোণঠাসা করেছেন তখন কুদ্ধ যাজ্ঞবল্ক্য তাঁকে শাপ দিলেন ‘তোমার মাথা খসে পড়বে।’ অর্থাৎ যাজ্ঞবল্ক্যকে তর্কে বিপর্যস্ত করার মতো বিদ্যা ও বুদ্ধি গার্গীর ছিল। এমন আরো বেশ কিছু মেয়ে নিশ্চয়ই ছিল যারা শিক্ষার অধিকার পেয়ে, চর্চা করে বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

ক্রমে ক্রমে অন্যান্য নানা বিদ্যা সমাজে দেখা দিল এবং কিছু কিছু নারীও সে বিদ্যায় দক্ষ হয়ে কোনো কোনো পুরুষকে তর্কে পরাস্ত করেছেন।

এঁরা সংখ্যায় কম, অতএব ব্যতিক্রমী; কিন্তু এঁরা ছিলেন। মনে হয় অধিকাংশ স্থলে এঁদের শারীরিক ত্রুটি বা মানসিক বিকৃতির জন্যে এবং কখনো-বা বালবিধবা হওয়ার জন্য এঁরা এঁদের পিতার কাছে করুণার পাত্রী হয়ে, সমাজে অস্বীকৃত অধিকার পেয়েছিলেন।

প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষার কোনো পথই খোলা ছিল না এঁদের জন্য। পুরুষ যেমন উপনয়নের বেদাদি শিক্ষায় সমাজস্বীকৃত অধিকার পেতেন, নারীর জন্যে তেমন কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। কিছু কিছু দয়াপরবশ আত্মীয় বা গুরু বা ঋষি নিজের দায়িত্বে সম্ভবত এঁদের উপনয়নের ব্যবস্থা করে এদের মনের পুষ্টির একটা ব্যবস্থা করে দিতেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *